The Mighty INDIA CALLING: জার্নি ব্যাক টু বাংলাদেশ এবং বর্ডারে ছোটখাটো ‘কেয়ামত’ (পর্ব ৪৩)

সত্যি সত্যি গভীর রাতেই আমরা ঘুম থেকে উঠলাম। মোটামুটি চারটা বাজে তখন। নিজেরা চোখ ডলে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। প্রত্যেকেই রেডি হয়ে শেষ বারের মত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম। এতটুকু সময় নষ্ট না করে একে একে মালপত্র রুম থেকে বের করতে লাগলাম। সবার লাগেজের সংখ্যাই ছয়, সাত, আটের মতন। একটা মাত্র লিফট দিয়ে এতগুলো লাগেজ নিচে নামানোটাও কম হ্যাপা না। সবার আগে মজুমদার আর মৌলি বের হয়ে গেলো। সবার শেষে আমি আর রুবাইদা রুম ছেড়ে বের হলাম। লিফটের সামনে তখন লাগেজের লাইন পড়ে গেছে। এদিকে আমরা আবার তিনতলায় আছি। ওদিকে দোতলার লোকজন সব লিফট ভরে মালপত্র ঢুকাচ্ছে কারণ লিফট তিন তলায় আসার আগে দোতলায় থামে। তাই লিফট যখনই তিন তলায় আসে তখনই ভরা থাকে, আমরা আর উঠতে পারি না। এভাবে কেটে গেলো অনেকক্ষণ। শেষে আমরা অধৈর্য্য হয়ে গেলাম। তখন দোতলার লোকজনদের একটু মায়া দয়া হলো। ওরা আমাদের জন্য একটা খালি লিফট পাঠালো। সেই লিফটেই আমি আমার সব বড় ব্যাগ সাধ্যমত তুলে দিলাম। বাকি গুলো নিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলাম।

নিচে গিয়ে আবার লিফট থেকে মালপত্র টেনে টেনে নামাতে হলো। আগেই দেখেছিলাম নিচতলার ফ্লোরটায় লেভেল আপডাউন অনেক বেশি। এই ভারি ভারি ব্যাগ টেনে হিঁচড়ে নিতে নিতে আমাদের ঘাম ছুটে গেলো। আমরা মালপত্র রিসেপশনে রেখে বাইরে বের হয়ে আসলাম। অন্ধকার রাত, সূর্য ওঠার কোন লক্ষণ নাই। ওদিকে আমাদের বাস আসে নাই। তাই আমরা বের হতে পারছি না।

একসময় আমাদের বাস আসলো। সেটা দাঁড়িয়ে রইলো রফি আহমেদ স্ট্রিটে। আমাদেরকে সেখান পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে। হেঁটে যাওয়াটা তো কোন ব্যাপারই না। কিন্তু সাথে যখন এতগুলো মালপত্র, তখন আমাদের মাথা চুলকাতে হলো। কিন্তু কিছু করার নাই। বিসমিল্লাহ বলে রওয়ানা দিলাম। পিঠে ব্যাকপ্যাক, কাঁধে সাইড ব্যাগ, এক হাতে দুইটা পোথিসের ব্যাগ আর লাগেজের উপর বড় ব্যাগটা বসিয়ে অন্য হাতে আরেকটা ছোট ব্যাগ নিয়ে সেই হাতেই লাগেজটা টানতে লাগলাম। আমার মনে হলো আমার সব বোধ শক্তি শেষ হয়ে গেছে। এভাবে করে সাতটা ব্যাগ নিয়ে এই রাস্তা হেঁটে পাড়ি দেওয়া যে সম্ভব না সেটা বুঝার ক্ষমতাও যেন লোপ পেয়ে গিয়েছে। লাগেজের হ্যান্ডেল ধরে টানার সময় একটু পর পর ধুড়ুম করে লাগেজের উপর থেকে বড় ব্যাগটা পড়ে যেতে লাগলো। একবার আমি নিজেই তুললাম, আরেকবার জাফর তুলে দিলো, আরেকবার তুলে দিলো রুবাইদা। শেষে আমার অবস্থা দেখে রুবাইদা এগিয়ে আসলো। ও বুদ্ধিমানের মতন সব লাগেজ একবারে না এনে ভাগেভাগে নিয়ে এসেছে। ও আমার কয়েকটা জিনিস বয়ে নিয়ে গেলো।

অনন্তকাল পর মনে হলো আমি রফি আহমেদ স্ট্রিটে এসে পৌঁছেছি। তখন আকাশ একটু একটু পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। ভোরের সেই ফ্যাকাশে আলোয় দেখলাম একটা সাধারণ বাস রাস্তায় ট্রাম লাইনের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তার পিছনে আমাদের লাগেজের বিশাল স্তুপ। আমি গিয়ে আমার লাগেজও সেখানে রেখে দিলাম। বাসে কেন লাগেজ ওঠানো হচ্ছে না- এই প্রশ্নের উত্তর পেলাম একটু পরেই। আসলে লাগেজ ওঠানোর সব জায়গা ভরে গেছে। বাসের লোকজন চিন্তা ভাবনা করে কিছু কিছু লাগেজ বাসের ভিতর আমাদের বসার জায়গায় তুলে দিচ্ছে। কিন্তু এই পাহাড়সম লাগেজের স্তুপ কোথায় জায়গা দেওয়া হবে সেটার কোন সমাধান কেউ করতে পারছে না। ওদিকে কমিটির লোকজন উশখুশ করতে লাগলো। বাস এখনই ছেড়ে দিতে হবে কারণ আমরা দাঁড়িয়ে আছি ট্রাম লাইনের উপর। ট্রাম চলাচল শুরু হলে আমাদের বাসের কারণে রাস্তা ব্লক হয়ে যাবে। ওদিকে সবাই এসে পৌঁছায়ও নাই। আমরা যারা যারা ছিলাম তারা বাকিদের ফোন দিতে লাগলাম। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই মোটামুটি সবাই চলে আসলো। ওরা কোথায় যেন এক ভ্যান ওয়ালাকে পেয়েছিলো। সবার সব মালপত্র ভ্যানে তুলে দিয়ে ওরা দৌঁড়ে দৌঁড়ে আসতে লাগলো।

ওদিকে মারাত্মক গ্যাঞ্জাম লেগে যাচ্ছে। এত লাগেজ কেমন করে তোলা হবে সেটার কোন সমাধান হচ্ছিলো না। সবাই মিলে একসাথে হৈচৈ জুড়ে দিতে শুরু করলো কারণ সময় পার হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। শেষমেষ ব্যাপক চিৎকার করে ইশতিয়াক পরিস্থিতি সামলালো। প্রথমে আমরা সবাই সুড়সুড় করে বাসের ভিতর ঢুকে পড়লাম। বসার জায়গার কোন বালাই নাই, দুইজনের সিটে তিনজন করেও বসে গেলাম। কোনমতে সবাই উঠে বসার পর হাতে হাতে সব মালপত্র টেনে আমাদের সম্পূর্ণ বাসটা ভরে ফেলা হলো। আমাদের আর নড়া চড়ার কোন উপায় রইলো না। এক সমুদ্র লাগেজে যেন আমরা ডুবে গেলাম। সব লাগেজ উঠে যেতেই আমাদের বাস ছেড়ে দিলো। এই বার আমি নিজের দিকে একটু মনোযোগ দিলাম। জানালার পাশে বসেছে নোভা আর তারপাশে বসেছি আমি। তবে আমার সিটটা আমি শেয়ার করছিলাম নোভার হ্যাভারস্যাকের সাথে। নোভার কোলেও একটা ব্যাগ, পায়ের নিচেও আরেকটা ব্যাগ। আমার পায়ের নিচটা খালি ছিলো দেখে আমি আমার কোলে ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে অন্য একটা ব্যাগ পায়ের নিচে রেখে দিলাম।

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদের দিকে তাকানোর চেষ্টা করছিলাম। লাগেজের ফাঁক ফোকড়ে টাইট প্যাকড হয়ে বসে থাকা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত চেহারাগুলো দেখে আমার কেন যেন হাসি পেতে লাগলো। সারা বাসের মধ্যে আমিই একমাত্র হাসতে লাগলাম।  কয়েকজন একটু বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকালো। অন্তরা বলেই ফেললো, ‘নুযহাত, হাসি থামা নইলে মাইর খাবি কিন্তু’। আমার যে কষ্ট হচ্ছিলো না সেটা নয়। কিন্তু এরকম অভিজ্ঞতার কথা জীবনে আর দ্বিতীয়বার হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। কি অদ্ভূতভাবেই না আমরা ইন্ডিয়া ছেড়ে যাচ্ছি! ওদিকে অন্তরার বসার জায়গা ছিলো খুবই সামান্য। ও সেখান থেকে উঠে একটা ব্যাগের উপর পা তুলে বসে পড়লো আর নিজেকে ‘বিজনেস ক্লাস’ এর যাত্রী বলে দাবী করলো। এটা দেখেও আমি আরও হাসতে লাগলাম।

কিছু সময় পার হয়ে গেলে আমি একটু চোখ বন্ধ করার উপায় খুঁজছিলাম। আমার বামদিকে নোভার হ্যাভারস্যাকটা গ্যাঁট মেরে বসে আছে। আর ডানদিকে লাগেজের স্তুপের মধ্যে তানভীরের সবুজ স্যুটকেসটা উল্টা হয়ে এমনভাবে পড়ে আছে যার চাকাটা একদম আমার মাথা বরাবর। কি আর করা, একবার হ্যাভারস্যাক আরেকবার স্যুটকেস জড়িয়ে আমি চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করতে লাগলাম। শরীর প্রচন্ড ক্লান্ত, চোখ বন্ধ হয়ে এলেও ঠিক ঘুম আসলো না।

বর্ডারের কাছাকাছি চলে আসতেই সবাই নড়েচড়ে উঠলো। তখন আরেকটা আতংকজনক ব্যাপার বুঝতে পারলাম। আমাদের এই বাস এইখানেই ছেড়ে দিতে হবে। বর্ডার ক্রস করে আমরা আরেকটা বাসে উঠবো। এই লাগেজগুলো নিয়ে কেমন করে বর্ডার পার হবো সেই চিন্তা করে আমার পেটের ভেতর পাক খেয়ে উঠতে লাগলো। পেট্রোপোল বর্ডারে এসে আমাদের বাসটা থামলো একেবারে রাস্তার উপর। বাস থামার সাথে সাথেই কয়েকজন লোক অসম্ভত দ্রুত গতিতে আমাদের বাস থেকে মাল নামাতে শুরু করলো। ওদিকে বাইরে এই বাসে ওঠার জন্য যাত্রীদের জটলা বেঁধে গেলো। আমরা সবাই চুপ করে বসে রইলাম। সব মাল বের করা হয়ে গেলে আমরাও একে একে বাস থেকে নামতে লাগলাম। গা ঘেঁষে হুউশ করে পিছন দিয়ে যাচ্ছে বাস। তাড়াহুড়া করে লোকজন উঠছে আর নামছে বাস থেকে। এরকমই এক ব্যস্ত রাস্তার ধারেই বি-শা-ল স্তুপ করে আমাদের মালপত্র রাখা হয়েছে। আর সেটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছি আমরা সবাই। সে এক দেখার মতন দৃশ্য!

এই লাগেজের পাহাড়ের মধ্যেই আমরা যার যার নিজেদের লাগেজ খুঁজতে লাগলাম। কোনমতে একটু কোনা দেখতে পেলেও সবাই খুশি হচ্ছিলো, ‘যাক বাবা- লাগেজ হারায় নাই, আছে’।  বর্ডারে সবাই শেষবারের মত রুপি ভাঙ্গিয়ে টাকা করে নিলো। আমরা শ্যামলী ওয়েটিং রুমে খানিক্ষন বসলামও। সেখানেই জানতে পারলাম, দেবার একটা ব্যাগ মিসিং। ভাগ্য ভালো খুব মূল্যবান কিছু ছিলো না সেটাতে। তবে দেবার মন খারাপ হয়ে গেলো। আমি আমার ফোনে গ্রামীনের সিমটা ভরে ফেললাম। কিন্তু ফোন দিতে পারলাম না কারণ টাকা নাই। ওদিকে আম্মু রুবাইদার ফোনে ফোন দিয়ে আমার সাথে কথা বললো। আমি আম্মুকে বললাম আমার ফোনে টাকা পাঠাতে।

কিছুক্ষনের মধ্যেই কমিটির লোকজন বললো ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়াতে। কিন্তু আমাদের লাগেজের কি হবে? এই প্রশ্নের জবাবে ওরা জানালো শ্যামলীর লোকজনই লাগেজ নিয়ে যাবে। শুনে আমরা হতবাক হয়ে গেলাম। কে নিয়ে যাবে, কই নিয়ে যাবে কিছুই তো জানতে পারবো না! কিন্তু এছাড়া কিছু করারও নাই। তাই আল্লাহর ভরসায় লাগেজগুলোকে রেখেই আমরা লাইনে দাঁড়ালাম। লাইনে তো দাঁড়িয়েছি, কিন্তু অজানা আশংকায় বুক দুরুদুরু করতে লাগলো। ঠিকমত আসবে তো সব লাগেজ? দেবারটা তো চোখের সামনেই হারিয়ে গেলো!

লাইন ধরে ভিতরে ঢুকে পাসপোর্টে সিল মেরে ফটো তুলে ঠিকঠাক মত বের হয়ে এসে দেখি এক খোলা জায়গায় মাটির উপর আমাদের লাগেজ গুলো পড়ে আছে। কি সর্বনাশ! আমি দৌড়ে গিয়ে আমারগুলো খুঁজে বের করলাম। এখান থেকে বর্ডারের গেট পর্যন্ত লাগেজ টেনে নেওয়ার জন্য লাল উইনিফর্ম পরা অথরাইজড কুলি আছে। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে বুঝতে লাগলাম কি করা উচিৎ। সব শেষে যা আছে কপালে ভেবে সেই আগের মত সাতটা লাগেজ বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করে নিজেই টানা শুরু করি। সে যে এক কি ব্যাপক অভিজ্ঞতা সে কথা আর নাই বলি! আমার পাশেপাশে রুবাইদাও ওর মালপত্র টেনে টেনে নিচ্ছে। লাইন ধরে বাংলাদেশ-ভারত গেট পার হলাম। গেট পার হতেই সবুজ উইনিফর্ম পরা বাংলাদেশের অথরাইজড কুলিরা আমাদের সাথে দরদাম করতে লাগলো। এতক্ষণ তো নিজেই টেনে এনেছি, কিন্তু এইবার মনে হলো  শরীরে কুলাবে না। একটা কুলি নিতেই হবে। আমি আর রুবাইদা মিলে একজনকে ঠিক করলাম। লোকটা আমার আর রুবাইদার বড় ব্যাগগুলো বয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। বড় লাগেজ ব্যাকপ্যাক আর ছোটখাটো ব্যাগগুলো আমরা নিজেরাই টানতে লাগলাম।

ব্যাগপত্র টেনে আমরা বেনাপোলের কাস্টমসের অফিসে পৌঁছালাম। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফর্ম ফিলাপ করলাম। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মালপত্রগুলো নিয়ে শেষমেশ আমরা বের হয়ে পড়লাম। কুলি আমাদের সাথে হেঁটে হেঁটে আমাদের মালপত্রগুলো শ্যামলীর কাউন্টার পর্যন্ত পৌঁছে দিলো। সেখানে দেখলাম ভ্যান গাড়িতে আমাদের মাল তোলা হচ্ছে। তারপর ভ্যানগাড়িতে করেই ব্যাগেজ নিয়ে যাওয়া হবে বাস পর্যন্ত। আমি আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আবার আল্লাহর ভরসায় সব মাল দিয়ে দিতে হবে। কারণ বাস কোথায় আছে সেটা জানিনা আর এই ভ্যান আদৌ বাস পর্যন্ত পৌঁছাবে কিনা সেটারও কোন গ্যারান্টি নাই। আর অল্প বিস্তর লাগেজ হলে এক কথা, এরকম দুই তিনশ মালপত্র বাসে নিয়ে ওঠাতে ওঠাতেই যে কয়েকটা মিসিং হয়ে যাবে না সেটাও বা কে বলতে পারে? কিন্তু কিছুই করার নাই। ‘ফী আমানিল্লাহ’ বলে দিয়ে দিলাম সব মালপত্র।

এই কাউন্টারে দাঁড়িয়েই শুনলাম আমাদের বাসে কয়েকটা সিট কম আছে। তাই আমাদের কয়েকজনকে অন্য একটা বাসে করে যেতে হবে। সেই বাসটা এখনই ছেড়ে দিবে, এটা শুনেই ছেলেরা টপাটপ রাজি হয়ে গেলো। ওদেরকে আমরা বিদায় জানিয়ে দিলাম। তারপর হাঁটতে লাগলাম আমাদের বাসের দিকে।  কিছুদূরে হেঁটে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের বাসের কাছে। বিশাল খোলা জায়গায় শ্যামলীর লাল রঙের বাসটা দাঁড়িয়ে আছে। সেটার নিচে লাগেজ রাখার ফোঁকরে লোকজন লাগেজ তুলছে আর মুখ টিপে হাসি দিচ্ছে। ভাবখানা এমন, ‘বাপ রে বাপ, লাগেজের বহর দেখো!’।

আমরা বাসে উঠে বসলাম। আমি আর রুবাইদা সিট পেলাম একেবারে পিছনের সিটের আগে রোতে। বিলাসবহুল বাস, চওড়া সিট। এসির ঠান্ডা বাতাসে আমরা আমাদের ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে আরাম করে বসলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই বাসের লোকজন মাথা চুলকে বলতে লাগলো যে সিকিভাগ মাল দিয়েই লাগেজ কম্পার্টমেন্ট ভরে গেছে আর এসি বাস হওয়ায় ছাদের মাল তোলা সম্ভব না। এখন ওনারা কি করবেন বুঝতে পারছেন না। কমিটি ওনাদের আশ্বাস দিয়ে বললো যে ওনারা যেন নিশ্চিন্তে বাকি সব মাল বাসের ভিতর পুরে দেয়, যেভাবেই হোক।

ওনারা পিছন থেকে মাল ভরা শুরু করলো। পুরো আইল জুড়ে এমনভাবে জিনিসপত্র রাখা হলো সেগুলো একেবারে ছাদ পর্যন্ত ঠেকে গেলো। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে আমার সারির অন্য পাশের সিটে যে বসেছে তাদের চেহারা দেখতে পাচ্ছিলাম না। দাঁড়ালেও তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সিটের উপর পা তুলে কুঁজো হয়ে দাঁড়ালে অন্য আইলের অন্য পাশের মানুষদের একটু আধটু দেখা যায় আর কি! আমরা নিজেদের দুরাবস্থায় নিজেরাই হাসতে লাগলাম! সব লাগেজ তোলা হয়ে গেলে আমাদের অবস্থা আগের মত হয়ে গেলো। তবে সকালের বাসে যদি লাগেজের সমুদ্র সৃষ্টি হয়ে থাকে, এই বাসে বাসে সৃষ্টি হলো ‘মহা সমুদ্র’। তবে পার্খক্য একটাই, আগেরবার বসার জায়গা জুড়েও লাগেজ ছিলো, এইবার অ্যাটলিস্ট বসার জায়গাটুকুন ফাঁকা আছে!

লাগেজের স্তুপের সাথে আমরা
লাগেজের স্তুপের সাথে আমরা

বাস যখন চলতে শুরু করে তখন আমাদের গায়ে কোন শক্তি নাই। এর মধ্যেই জুবায়ের কমিটির তরফ থেকে বিদায়ী ভাষণ দিলো। আমাদের পক্ষ থেকেও মজুমদার কমিটিকে ধন্যবাদ জানালো। এর মধ্যেই আমাদের যাত্রা শুরু হলো। মোটামুটি বাস চলতে শুরু করার সাথে সাথেই সবাই চোখ বুঁজে ফেললো। বেশিরভাগই ঘুমিয়ে পড়লো, যারা ঘুমাতে পারলো না তারাও টুঁ শব্দটি করলো না। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত একদল যাত্রী নিয়ে আমাদের বাস ছুটতে লাগলো ঢাকার পথে।

বিকাল বেলা বাস থামলো মধুখালীতে। আমরা আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠলাম। একটু ফ্রেশ হওয়া দরকার। কিন্তু যেই না নামতে যাবো, সেই লাগলো বিপত্তি। নামার তো কোন জায়গা নাই- কেমন করে নামবো? আমাদের কয়েকজন তখন বিকল্প ‘রুট’ আবিষ্কার করলো। সামনের জনের সিটের মাথার উপর এক পা আর হ্যান্ডেলের উপর আরেক পা রেখে রেখে লোকজন সিট টপকে টপকে বের হতে লাগলো। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য! এই সব দেখে আমি প্রথমে ভাবলাম বের হবারই কোন দরকার নাই। তারপর কে যেন বললো, ‘এই অভিজ্ঞতা কি হবে আর জীবনে? কি আছে জীবনে- একবার ট্রাই করেই দ্যাখ!’ । এরকম উৎসাহে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমিও সাহস করে এগিয়ে গেলাম। খুব সাবধানে একেকজনের সিট টপকে টপকে বাস পার হওয়া- একটু ব্যতিক্রমধর্মী কাজই বটে! তবে ব্যাপারটা যে দারুণ অ্যাডভেঞ্চারাস, তাতে কোন সন্দেহই নাই!

এই লাগেজের সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে আমাদের নামতে হয়েছে
এই লাগেজের সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে আমাদের নামতে হয়েছে

আমাদের বেশির ভাগেরই পকেটে টাকা নাই। তাই খুব কম মানুষই খাবার কিনতে গেলো। আমার খাওয়ার কোন ইচ্ছা ছিলো না। আমি ফিরে আসলাম আবার বাসের মধ্যে। যেভাবে নেমেছিলাম ঠিক সেভাবে উঠে পড়লাম। ওদিকে কমিটি আমাদের প্যাটিস আর কিমা বন কিনে দিলো। এটাই ছিলো কমিটির তরফ থেকে আমাদের শেষ ট্রিট। আমরা চপচপে তেল দেওয়া খাবারগুলো তৃপ্তির সাথে খেয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ পর আবার যখন বাস ছাড়লো, তখন আবার অনেকে ঘুমিয়ে পড়লো।

সন্ধ্যা সাতটা থেকেই বাসা থেকে ফোন আসতে লাগলো। আমরাও মোটামুটি আন্দাজ করে করে টাইম বলছিলাম। কিন্তু বরাবরের মতনই নানা কারণে বারবার লেট হচ্ছিলো। দীর্ঘদিন পর ঢাকা শহর দেখে আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে যেতে লাগলো শেষমেশ যখন বাস ভার্সিটি এলাকায় ঢুকলো, তখন সবাই আনন্দের একটা চিৎকার দিয়ে উঠলো। সেই সাথে একটা হাহাকারও কানে বাজতে লাগলো সমানতালে। ইন্ডিয়া ট্যুর শেষ! আমাদের এত দিনের এত জল্পনা কল্পনার ট্যুরটা শেষ করে আমরা সত্যিই দেশে ফিরে এসেছি! এও কি সম্ভব যে জীবনে ইন্ডিয়া ট্যুরে যাওয়ার এক্সাইটমেন্ট আর থাকবে না?

বাস যখন পলাশি ঢুকে তখন শেষবারের মত আমরা গলা ছেড়ে গান ধরলাম। বুয়েটে এসে বাস ঢুকতেই দেখলাম আমাদের সবার আব্বু আম্মুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাস থামতে দেখেই সবাই উৎসুক হয়ে বাসের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কয়েকজন বোধহয় বাসে উঠেও যেতেন কিন্তু লাগেজের সমারোহ দেখে কেউ আর কাছে আসলেন না। সামনের দিকে যারা ছিলো তারা হ্যাঁচকা টান দিয়ে দিয়ে লাগেজগুলো ছুঁড়ে মারতে লাগলো বাইরের দিকে। এভাবে করে লাগেজ সরাতে সরাতে যাদের যাদের বের হবার পথ ক্লিয়ার হচ্ছিলো তারা বের হয়ে যাচ্ছিলো। আমরা যারা পিছনে আছি তারা বের হলাম সবার শেষে। বাস থেকে নামতেই দেখি আগের মত পাহাড় বানিয়ে লাগেজ রাখা হয়েছে। সেখান থেকে একেকজন একেকজনের লাগেজ টেনে টেনে বের করছে।

আমাকে রিসিভ করার জন্য আম্মু, আব্বু আর মামা এসেছে। আমার বাসার লোকজন আমাকে প্রথমে চিনতে পারে নাই। চিনতে পারবেই বা কেমন করে? ওজন কমেছে অন্তত পাঁচ কেজি, গায়ের রঙ মিশমিশে কালো হয়ে গেছে। এতদিন পর নিজেকে দেখে নিজেই চিনতে পারতাম কিনা সন্দেহ! সবাইকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি যখন একেকটা লাগেজ খুঁজে খুঁজে বের করে আনতে লাগলাম তখন সবাই অবাক হয়ে গেলো। আমি এতগুলো মাল টেনে টেনে আনছি দেখে সবাই অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো, কেমন করে আমি এতগুলো জিনিস নিয়ে আসলাম? সব শেষে যখন বড় ব্যাগটা টেনে আনলাম তখন মামা দৌড়ে আসলো ব্যাগটা ধরতে।

গাড়িতে ওঠার সময় গুনে গুনে দেখলাম সাতটা ব্যাগই এসেছে। একটা শান্তির নিশ্বাস ফেললাম, যাক- আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। কোনমতে সব কিছু গাড়িতে ভরে আমরা রওয়ানা হলাম বাসার উদ্দেশ্যে। গাড়িতে ওঠার সাথে সাথেই আম্মু দুনিয়ার কথা বলতে শুরু করলো। আমি সবই শুনছিলাম, কিন্তু কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে। মাথায় খালি ঘুরছিলো একেটা দৃশ্য- মালালির বরফ, আগ্রার তাজমহল, জয়সাল্মীরের মরুভূমি, গোয়ার সমুদ্র, ত্রিভান্দামের সৈকত, কলকাতার আলো ঝলমলে মার্কুইস স্ট্রিট- আরও কত কি!

কোথায় ছিলাম আর কোথায় চলে আসলাম? সত্যি সত্যিই কি ইন্ডিয়া ট্যুর শেষ হয়ে গেলো?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *