The Mighty INDIA CALLING: অরোভিল যাত্রার একদিন (পর্ব ৩৬)

সকালে ঘুম ভাঙ্গলো দেরিতে। অন্যান্য দিনের মতই মৌলি আর মজুমদার আগেভাগে বের হয়ে গেলো। আমি আর রুবাইদা আলসেমি করে আস্তে ধীরে বের হলাম। আমাদের সাথে যোগ দিলো মিম আর অন্তরা। আমরা হোটেল থেকে বের হয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য নাশতা করা। গত রাতে যে গলিতে খাবার খেয়েছিলাম, হেঁটে হেঁটে সেই গলিতে গেলাম আমরা। খাবারের দোকান আছে কিন্তু প্রায় সব দোকানেই নাশতা শেষ। খুঁজে পেতে একটা দোকান পাওয়া গেলো যেখানে কিছু খাওয়া অবশিষ্ট আছে। আমরা ঝটপট বসে পড়লাম। প্রত্যেকটা পুরি দশ রুপি করে আর সাথে সবজি ফ্রি। আমি দুইটা পুরি নিলাম একটা থালায়। আর একজন লোক এসে ছোটখাটো স্টেনলেস স্টিলের বালতির মত পাত্র থেকে বিশাল বড় চামচে করে ঝোল ওয়ালা আলুর তরকারি ঢেলে দিয়ে গেলো। এই সবজি আর পুরি ছাড়াও ইডলি, সম্বর, নারিকেলের ভর্তা, চাটনি এই রকম মজার মজার জিনিস ছিলো। খেতে আমাদের মোটামুটি লাগলো। খেয়ে দেয়ে আমরা বের হয়ে আসলাম সেই দোকান থেকে। হাঁটা ধরলাম আন্না সালাই রোডের দিকে।

আন্না সালাই রোডে একটা অদ্ভূত রিকশা পার্ক করে রাখা দেখলাম। আমাদের দেশের মতন প্যাডেল রিকশাই, তবে দেখতে কেমন যেন হাস্যকর! একটা পেস্ট্রি শপ দেখলাম, ‘কেক পয়েন্ট’। ভেতরে ঢুকে পড়লাম আমরা। এটা নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কেক বানানোর জন্য গিনেজ রেকর্ডধারী দোকান। তবে এমন রেকর্ডধারী দোকানেও খুব কম দামেই পেস্ট্রি পাওয়া যাচ্ছে। আমরা নানা রকম পেস্ট্রি অর্ডার দিলাম। তারপর গল্প করতে করতে খেতে লাগলাম। আর ওদিকে ডিসিশন নিতে লাগলাম এরপর কোথায় যাবো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে বের হয়ে পড়লাম। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে একটা বাসে উঠে পড়লাম। এখন আমাদের গন্তব্য ‘অরোভিল’।

কেক পয়েন্টের পেস্ট্রি
কেক পয়েন্টের পেস্ট্রি

পন্ডিচেরির বাসগুলো বেশ আরামের। আমি বসলাম একেবারে পিছনে। আশেপাশে সব শাড়ি পরা শক্ত সমর্থ চেহারার মহিলারা। একজন বুড়ো মহিলাকে দেখলাম এক গামলা ভেজা কাপড় নিয়ে বাসে উঠে পড়তে। কন্ডাক্টর এসে ওনার সাথে তর্ক জুড়ে দিলো। মহিলাও গলা চড়িয়ে কথা বলতে লাগলো। এর মধ্যে আমি অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম, তর্ক করতে করতেই কন্ডাক্টর এসে গামলাটা ধরে সুন্দর করে একটা জায়গার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে লাগলো। আমরা পাঁচ রুপির টিকেট কাটলাম। প্রায় আধা ঘন্টা পর বড় রাস্তার ধারে দুই পাশে কিছুই নাই এমন এক জায়গায় আমাদের নামিয়ে দিলো বাস। যে জায়গাটায় আমাদের নামিয়ে দিলো সেখান শুধু কতগুলো অটোরিক্সা পার্ক করা আছে। আমরা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলাম অরোভিল কোথায়? কিন্তু কিছুই খুঁজে পেলাম না। অন্তরার ফোনে দেখলাম এখান থেকেও অরোভিল বেশ দূরে। বুঝলাম বাসের রুট এখানেই শেষ, এরপর অটো নিতে হবে। অগত্যা আমরা ১৫০ রুপি দিয়ে একটা অটো ভাড়া করলাম। অটো আমাদের নিয়ে চলতে শুরু করলো।

যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম সেটা অনেকটা গ্রামের রাস্তার মত। কিন্তু দেখার মত তেমন কোন জিনিসপাতি নাই। রাস্তার দুইধারে সারি সারি গাছ, সম্ভবত ইউক্যালিপ্টাস। লাল রঙের মাটি আর সবখানে লাল রঙের ধূলা। কেমন যেন অদ্ভূত রাস্তা! এর মধ্য দিয়েই দেখতে পারছিলাম সাদা চামড়ার অনেক বিদেশি লোকজন বাইকে চেপে আমাদের ওভার টেক করে যাচ্ছে। আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকাচ্ছিলাম। অরোভিল জায়গাটা আসলে কি? আমাদের একটা গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে অটোওয়ালা জানতে চাইলো আমরা চাইলে একঘন্টার মধ্যে এই অটোতে করে ফেরত যেতে পারি। আমরা সেই মোতাবেক ঠিক করলাম। অটোওয়ালা জানালো সে এইখানে আমাদের জন্য বসে থাকবে।

আমরা গেট দিয়ে ঢুকে পড়লাম। জায়গাটা অদ্ভূত। কতগুলো সুন্দর সুন্দর দোকানপাট চোখে পড়লো। আমরা ঢুকে পড়লাম একটায়। দোকানগুলো আমাদের দেশি ব্র্যান্ড ‘যাত্রা’র মত। হাতে তৈরি দারুণ সুন্দর সুন্দর সব জিনিস। আর সেই রকম দামি। প্রথম দোকানটা দেখেই আমরা বুঝে গেলাম সবটা দেখে কিছুতেই এক ঘন্টার মধ্যে বের হওয়া যাবে না। তাহলে আর শুধু শুধু অটোওয়ালাকে আটকে রেখে লাভ কি? আমি তাড়াতাড়ি এসে অটোওয়ালাকে খুঁজে বের করে তার পাওনা বুঝিয়ে দিলাম। তারপর আবার হেঁটে গেলাম সেই দোকানটার দিকে।

এইরকম আরও অনেকগুলো দোকানে ঢুকলাম। কোনটাতেই আমরা কিছু কিনতে পারলাম না। খালি দেখেই যেতে লাগলাম। তারপর গেলাম একটা এক্সিবিশন হল টাইপের জায়গায়। সেখানে মোটামুটি জানতে পারলাম, এক ফ্রেঞ্চ মহিলা যাকে সবাই ‘দি মাদার’ বলে, তিনি এই অরোভিলের প্রতিষ্ঠাতা। ব্যাপার স্যাপার খুব কঠিন, তারপরও যা বুঝলাম তার সারমর্ম হচ্ছে এইরকম- মাদারের ইচ্ছা ছিলো এমন একটা জায়গা গড়ে তোলা যেখানে মানুষ জাতি, ধর্ম, গোত্রের পরিচয়ে পরিচিত হবে না। বরং তা হবে সব ধরনের মানুষের জন্য উন্মুক্ত। এখানে এসে কাজ করার বিনিময়ে যে কেউ থাকতে পারবে। এই ইচ্ছা বাস্তবায়ন করার জন্য মাদারকে সাহায্য করেছিলেন স্বামী অরবিন্দ নামক আরেক জন সাধু। এখান থেকেই জানতে পারলাম এখানে ‘মাতৃমন্দির’ নামক একটা বলের মত গোল বিল্ডিং আছে। সবাই বের হয়ে হাঁটতে লাগলাম সেই বিল্ডিঙের খোঁজে। প্রথমে বিল্ডিং দেখার পাস নিলাম। ভিতরে ঢুকা যাবে না, শুধু বাইরে থেকেই দেখতে হবে। যাই হোক, এই পাস নিয়েই আমরা হাঁটতে লাগলাম। কিছুদূর পর কেমন জঙ্গল শুরু হলো। ঠিক জঙ্গল না, অনেকটা পার্কের মত, আবার ঠিক পার্কও না। প্রচন্ড গরমে গাছের ছায়ায় ছায়ায় আমরা হাঁটতে লাগলাম। এক পর্যায়ে আমাদের হাত পা ধরে এলো। এর মধ্যে হিমি সীমান্তদের সাথে দেখা হলো। ওরাও ওদের অটোওয়ালাকে এক ঘণ্টার কথা বলে ভিতরে ঢুকে অনেক্ষণ সময় পার করে ফেলেছে। এখন কি করবে বুঝতে পারছে না।

জঙ্গলের ভিতর দিয়ে  হেঁটে চলা
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলা

এর মধ্যে আমরা গাছপালার ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো এক কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে ফেলেছি। গরমে আমাদের গলা শুকিয়ে গেলো। অনেক্ষণ পর একটা গেট পেলাম যেখানে আমাদের পাস চেক করে করে ঢুকতে দিচ্ছিলো। গেটটা পার হয়েই একটু পরই চোখে পড়লো বিশাল এক বট গাছ। সেখানে আনিস, বাসিরুন, লিয়া আর সুহার সাথে আমাদের দেখা হলো। অদ্ভূত এই বটগাছের ঝুলন্ত শিকড় থেকে গজিয়েছে আরও অনেকগুলো গাছ। গাছটা অনেক পুরানো। বিশাল ডালপালা মেলা এই গাছটার ছায়ায় বসে আমরা খানিক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। তারপর আমরা সবাই আবার হাঁটা শুরু করলাম। এবার বেশিক্ষণ লাগলো না। কয়েক মিনিট পরেই পেয়ে গেলাম সেই ‘মাতৃমন্দির’। বিশাল জায়গার মধ্যে মস্ত বড় গোলক, তার সারা গায়ে পিতলের বাসনের মতন বৃত্তাকার প্লেট লাগানো। আমাদের একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত যাওয়ার পারমিশন ছিলো। আমরা তাই দূরে দাঁড়িয়েই দেখতে লাগলাম। নিচের ল্যান্ডস্কেপিংও এমনভাবে করা যেন মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে এসেছে এই গোলকটি। আমরা সবাই গোল্লাটাকে পাশে রেখে ছবি তুলতে লাগলাম।

চোখ ঝলসানো সোনালি রঙের মাতৃমন্দির
চোখ ঝলসানো সোনালি রঙের মাতৃমন্দির

সত্যি বলতে কি, যখন ক্লাস প্রজেক্টে গোল্লা বিল্ডিং ডিজাইন করা হয় তখন মডেলে দেখতে মন্দ লাগে না। কিন্তু যখন সত্যি সত্যি চোখের সামনে এত্ত বিশাল একটা গোল্লা দাঁড়িয়ে থাকে তখন যেন কেমন অদ্ভূত লাগে। আর সোনালি রঙের ধাতব প্লেটগুলোতে সূর্যের আলোর রিফ্লেকশোনের ফলে পুরো গোল্লাটা চকচক করছিলো। তাই দেখে কেন যেন আমাদের সবার গরম লাগা শুরু হলো। তাই আমরা আর বেশিক্ষন থাকলাম না। উঠে পড়লাম। এবার আর বেশি কষ্ট করতে হলো না। পেয়ে গেলাম এক বাস সার্ভিস। এই বাসে করে নির্দিষ্ট সময় পরপর দর্শনার্থীদের বিনা পয়সায় আবার আগের জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হয়। আমরা উঠে পড়লাম সেই বাসে। টাইম হয়ে গেলে আমাদের নিয়ে বাস ছেড়ে দিলো। প্রায় দশ মিনিটের মাথায় আমরা পৌঁছে গেলাম প্রথমবার আমাদের অটো ঠিক যেখানে নামিয়েছিলো সেইখানে। আমরা আবার গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। এবার দেখতে পেলাম একটা শর্ট মুভি দেখানো হচ্ছে। সবাই দুদ্দাড় করে ঢুকে পড়লাম সেখানে। মুভিটায় দেখানো হলো অরোভিলের কথা আর মাদারের কথা। প্রায় ত্রিশ মিনিটের ভিডিও দেখে আমরা সেই হল থেকে বের হয়ে আসলাম।

ততক্ষনে বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। ভাবলাম দুপুরের খাবারটা সেরে নেই এখানে কোথাও। কিন্তু লাভ হলো না। যেই ক্যাফেতেই যাই, দাম দেখে আর খেতে পারি না। শেষে সিদ্ধান্তে নেই যে, এখানে না, বাইরে কোথাও খেয়ে নেওয়া যাবে। আর বেশি দেরি না করে  আমরা এসে দাঁড়াই মেইন গেটের সামনে। তাকিয়ে দেখি একটা অটোও নাই। কোন অটো আসলেই লোকজন খপ করে সেটাতে চড়ে বসছে। আমরা ভয়ে পেয়ে গেলাম, এরকম হলে অটো পাবো কেমন করে? কিন্তু মিম আর অন্তরা অনেক কাহিনী করে একটা অটো ঠিক করে ফেললো। সেই অটো আমাদের বাস চলাচলের বড় রাস্তার সামনে নামিয়ে দিলো। আমরা নেমে এদিক ওদিক তাকালাম। একটা সস্তা খাবারের হোটেল চোখে পড়লো আর তাতেই আমরা ঢুকে পড়লাম। পুরো হোটেলে আমরা ছাড়া আর কেউ নাই। আমি আর রুবাইদা মিলে অর্ডার দিলাম ৯০ রুপির ভাত আর সবজি। একটা লোক অর্ডার নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। বুঝলাম ইনিই রান্না করবেন অর্থাৎ দেরি হবে খাবার আসতে।  গল্প করতে করতেই খাবার চলে আসলো। ঝরঝরে বাসমতি চালের ভাত আর সবজি আমরা গপাগপ খেতে লাগলাম। মজাই লাগলো খেতে।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। এখান দিয়ে হরদম লোকাল বাস যাচ্ছে। এইরকম একটা লোকাল বাসে উঠে পড়লাম আমরা। বসার কোন জায়গা পেলাম না। কোনমতে রড ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রচন্ড ভিড়। এতই ভিড় ছিলো যে কন্ডাক্টর আর আমাদের কাছেই আসতে পারে নাই। কোনমতে আন্না সালাই রোডে এসে আমরা নেমে পড়ি আর ৫ রুপি ভাড়া মিটিয়ে দেই। বাস থেকে নেমে খানিক্ষণ দম ফেলে ধাতস্থ হই। এবার ঠিক করি নেক্সট যাবো অরবিন্দ আশ্রমে। একটা অটো ঠিক করি ৫০ রুপি ভাড়া দিয়ে। অটো আমাদের নামিয়ে দেয় কাছাকাছি একটা রাস্তায়। সেখান থেকে হেঁটে আমরা আশ্রমের সামনে যাই। রাস্তার উপর জুতা জমা দেওয়ার কাউন্টার আছে সেখানে স্যান্ডেল জমা দিয়ে আমরা আশ্রমের ভিতরে ঢুকে পড়ি।

গেট দিয়ে ঢুকার সাথেসাথেই মনে হলো কোন এক নিঃশব্দ জগতে ঢুকে পড়লাম। কেউ কোন কথা বলছে না। সবাই চুপ। আমরাও চুপ হয়ে গেলাম। সবাই লাইন ধরে কোথায় যেন যাচ্ছে, আমরাও সবার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম। জায়গাটা আসলে একটা বিশাল বাড়ির। আমরা ফুলের বাগান পার হয়ে উঠানের মত জায়গায় এসে পৌঁছালাম। সেখানে দেখলাম ছোট্ট একটা চাদরের নিচে একটা কবর বাঁধাই করা। তার উপর প্রচুর ফুল। সেই বাঁধানো কবরটাকে ঘিরে সব মানুষজন বসে আছে চুপ করে। মনে হলো এটা স্বামী অরবিন্দের কবর। আমরা এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করছিলাম, আর কি দেখার আছে খুঁজে বের করার জন্য। পুরো জায়গাটা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক পুরানো বিশাল বাড়ি। আমরা বারান্দা ধরে হাঁটছিলাম। বারান্দার পাশে সারি সারি ঘর। এরকম একটা ঘরের ভিতর মনে হলো ‘দি মাদার’ এর কবর। রুমের ভেতর একটা কফিন। সেটার উপর আবার নেটের সাদা কাপড়ের পর্দা। তার সামনে কয়েকজন চুপচাপ বসে আছে। একজনকে তো দেখলাম মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে কফিনের সামনে পড়ে থাকতে। দৃশ্যটা দেখে আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। এই রকম প্রকাশ্য শিরক আমি চোখের সামনে কোথাও দেখি নাই। আমরা খুব বেশিক্ষণ এখানে থাকলাম না। আমরা লাইব্রেরিটা ঘুরে দেখলাম। রুবাইদা কয়েকটা বাচ্চাদের জন্য নীতিকথার বই কিনলো। তারপর আমরা বের হয়ে গেলাম।

এখান থেকে বিচটা খুবই কাছে। আমরা হেঁটে হেঁটে বিচে চলে গেলাম। সমুদ্রের প্রাণ জুড়ানো বাতাসে আমাদের মন ফুরফুরে হয়ে গেলো। দিনের আলোতে দেখতে লাগলাম সমুদ্রকে। কোন ভিড়ভাট্টা নাই, আছে শুধু শান্তি আর শান্তি। পাথুরে ব্লকের উপর বসে অলস ভঙ্গিতে বসে গল্প করতে লাগলাম সবাই মিলে। শেষ বিকালের সময়টা এভাবেই কাটলো। তারপর আমাদের চোখের সামনে সূর্যটা লাল হয়ে টুপ করে ডুবে গেলো পানির ভেতর। সন্ধ্যা নামতেই আমরা উঠে পড়লাম। প্রশান্তির এই সমুদ্রকে বিদায় জানিয়ে আমরা হাঁটা ধরলাম।

পন্ডিচেরির শান্তির সৈকত
পন্ডিচেরির শান্তির সৈকত

হাঁটতে লাগলাম গলি ধরে। কোনখানেই তেমন কোন লোকজন নাই। চুপচাপ শান্ত আর নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে আমরা গল্প করতে করতে হাঁটতে লাগলাম। দুপাশের সুন্দর সুন্দর সব ঘরবাড়ি দেখতে দেখতে হাঁটছিলাম আমরা। আমি এক দোকান থেকে ৩০ রুপি দিয়ে নানা রকম চিপস আর চানাচুর মিশিয়ে কিনে নিলাম। সেইটা খেতে খেতে আমরা হাঁটছিলাম। আন্না সালাই রোডে এসে পড়লে চোখে পড়লো বিশাল বিশাল সব সিনেমার পোস্টার। এত বড় পোস্টার আমি কখনও দেখি নাই!

এখান থেকে আমরা দুই দলে ভাগ হয়ে গেলাম। রুবাইদা আর মিম চলে গেলো হোটেলে আর আমি আর অন্তরা গেলাম শাড়ির দোকান ‘পোথি’ র উদ্দেশ্যে। এর মধ্যে অন্তরা আবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে পানিপুরি খেয়ে নিলো। তারপর আমরা ঢুকলাম পোথিতে। পুরো পোথি ভর্তি খালি আমাদের লোকজনই ভরা। বেচার ইশতিয়াককে দেখলাম একটা শাড়ি কিনতে চাচ্ছে কিন্তু সব মেয়েদের সাজেশন নিয়ে আর এত এত শাড়ি দেখে বেচারার পাগল হয়ে যাওয়ার দশা। ঐদিকে তমা টপাটপ দুইটা শাড়ি কিনে ফেললো। আমি ঘুরে ঘুরে অন্যদের শাড়ি কেনা দেখতে লাগলাম। পোথির লোকজনও আমাদের দলটাকে দেখে বেশ অবাক। সারা দিন ধরে একই বয়সী ছেলেমেয়ে ভিড় আর হৈ চৈ করে শাড়ি কিনছে এটা বোধহয় তারা কখনও দেখে নাই।  একেবারে শেষ পর্যন্ত আমরা দোকানে রইলাম। আমাদের জন্যই বোধহয় ওরা দোকান বন্ধ করতে পারছিলো না। শেষবারের মত কেনাকাটা করে আমরা বের হয়ে আসলাম।

পোথির উল্টা পাশেই একটা বেশ বড় রকমের খাবারের দোকান চোখে পড়লো। আমি আর তমা ঢুকে পড়লাম সেখানে। পুরাই ভেজ দোকান। তাই আমার অর্ডার দিতে কোনই সমস্যা রইলো না। আমরা অর্ডার দিলাম ইডলি-সম্বর আর পাও ভাজি সাথে ডেজার্ট হিসেবে মিষ্টি।  একটা হলুদ প্লাস্টিকের থালায় আসলো দুইটা ইডলি, তিন রকমের চাটনি আর একটা ছোট বাটিতে সম্বর বা পাতলা ডাল। আরেকটা লাল থালায় আসলো দুইটা বনরুটির সাথে পাওভাজি আর পিয়াজ কুচি। আর একটা ছোট কাপে করে আসলো রসে ডুবানো চারটা লালমোহন মিষ্টি। সব মিলিয়ে আমাদের খরচ হলো ১০০ রুপি। আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে খেতে শুরু করলাম। ইডলিটা দেখতে যতটা সুন্দর খেতে ততটা ভালো নয়। পাওভাজিটাই মজা করে খাওয়া গেলো। আর মিষ্টিটা ছিলো খুবই শক্ত। খেয়ে মুখের টেস্টটাই নষ্ট হয়ে গেলো।

ইডলি আর পাওভাজির সাথে সেই শক্ত লালমোহন
ইডলি আর পাওভাজির সাথে সেই শক্ত লালমোহন

খাওয়া দাওয়া শেষ করে হোটেলে ফিরে আসলাম আমরা। ইতোমধ্যে বলে দেওয়া হয়েছে ভোর চারটার সময় ঘুম থেকে উঠতে হবে আমাদের। জুবায়ের প্রতি রুমে রুমে এসে ডেকে তুলবে সবাইকে। আমাদের জন্য বাস এসে বসে থাকবে। ভোর বেলাতেই রওয়ানা হবো চেন্নাইয়ের উদ্দ্যেশ্যে। ক্লান্ত শরীরে ব্যাগ গুছিয়েই শুয়ে পড়লাম আমরা। প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

 

The Mighty INDIA CALLING: খুব ভোরে একদিন পন্ডিচেরিতে (পর্ব ৩৫)

পন্ডিচেরিতে পৌঁছালাম ভোর বেলা। আমাদের বাস এসে থামল এমন একটা জায়গায় যার নাম ‘মারাইমালাই আদি গাসালাই’ । আমরা এসি বাসে আরাম করে চোখ বুজে পড়ে রইলাম। আমাদের কমিটির লোকজন নামলো হোটেল ঠিক করতে। দুই একটা হোটেলের পাশে বাস পার্ক করা হলো। কিন্তু ঠিকঠাক হচ্ছিলো না। অবশেষে ইশতিয়াক আমাদের সবার উদ্দেশ্যে বললো যে হোটেল একটা পাওয়া গেছে কিন্তু হোটেল ওয়ালাদের একটু ‘শুচি’ সমস্যা আছে। একসাথে ছেচল্লিশজনকে তারা থাকতে দিচ্ছে কিন্তু তাদের একটাই শর্ত যেন রুম আর বাথরুম পরিষ্কার থাকে। শুনে আমাদের হাসি পেল। ওরা আমাদের পরিষ্কার রুম আর বাথরুম দিলে আমরাও পরিষ্কার রুম আর বাথরুমই ফেরত দিবো- এ আর এমন কি?

আমরা লাইন ধরে বাস থেকে নামতে লাগলাম। আমাদের লাগেজগুলো বের করে নিয়ে লাইন ধরে মালপত্র টানতে টানতে দুইটা গলি পার হয়ে আমাদের হোটেলের দিকে যেতে লাগলাম। আর রাস্তাঘাটে স্কুলের বাচ্চারা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে অবাক হয়ে আমাদের দেখতে লাগলো। যে হোটেলে আমরা ঢুকলাম তার নাম ‘হোটেল সর্বমংগলম ইন’ । ভেতরটা বেশ পরিপাটি করে সাজানো। ঠিক কমার্শিয়াল হোটেলের মতন না, বরং বাসাবাড়ির মত ঘরোয়া। আমাদের রুম ঠিক করা হয়েছে তিন তলায়। সব চেয়ে বড় যে সমস্যায় পড়লাম যখন টের পেলাম যে হোটেলে কোন লিফট নাই। কাঠের রেলিং দেওয়া চকচকে সিড়ি বেয়ে আমরা আমাদের মালপত্র টেনে উঠাতে লাগলাম। তিন তলায় যখন পৌঁছালাম, তখন আর আমাদের গায়ে কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই। খুঁজে খুঁজে আমাদের রুম বের করলাম। ছোট্ট একটা পরিপাটি রুম যার একটা মাত্র জানালা করিডরে খুলে, আর সাথে ঝকঝকে একটা বাথরুম। বরাবরের মতই রুমে ঢুকে ফ্যান ছেড়ে আমরা চারজন বিছানায় ফ্ল্যাট হয়ে পড়ে গেলাম।

'হোটেল সর্বমঙ্গলম ইন' এর অ্যাট্রিয়াম
‘হোটেল সর্বমঙ্গলম ইন’ এর অ্যাট্রিয়াম

একজন একজন করে গোসল করতে ঢুকলাম বাথরুমে। মজুমদার আর মৌলি আগে গোসল করে বের হয়ে পড়লো। আমি আর রুবাইদা বের হলাম খানিক্ষণ পরে। হোটেলের নিচে রিসেপশনে আমাদের প্রত্যেককে একটা করে ফর্ম ফিল আপ করে সাথে পাসপোর্ট সাইজের ছবি জুড়ে দিতে হলো। বিদেশি নাগরিকদের নাকি এসব করতে হয়! আমরা মুখ টিপে হাসলাম। সারা ইন্ডিয়ার কোথাও এরকম ঝামেলা করতে হয় নাই দেখে বুঝলাম উনারা অন্য সবার চাইতে বেশি সাবধানী। এই সব করে বের হতে হতে বেশ দেরি হয়ে গেলো। আমি, রুবাইদা, মিম আর অন্তরা বের হলাম একসাথে। মোবাইলে দেখলাম কাছেই আছে আন্না সালাই রোড। খাওয়া দাওয়া করতে সেদিকেই হাঁটা ধরলাম।

রাস্তাঘাট একদম নির্জন। আশেপাশে দোকানপাট প্রায় সবই ফাঁকা। একটা ফাস্ট ফুড টাইপের দোকানে গিয়ে ঢুকলাম আমরা। কোন কাস্টোমার নাই। আমাদের দেখে একজন লোক এগিয়ে এসে তামিল ভাষায় কি যেন বলেই বের হয়ে গেলো। আমরা একটু অবাক হয়ে গেলাম – এ কি ব্যাপার রে ভাই? কাস্টোমারকে রেখে দোকানদার বের হয়ে যায় কখনও তো দেখি নাই! কি আর করা, খালি দোকানে বসে আমরা মেনু উল্টাচ্ছিলাম। মিনিট পাঁচেক পর অন্য একজন লোক ঢুকে আমাদের কাছে এসে অর্ডার নেওয়ার ভংগিতে দাঁড়ালো। আমরা অর্ডার দিতে লাগলাম। কিন্তু লোকটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে কথা বলে অদ্ভূতভাবে ডানে বামে মাথা নাড়াতে লাগলো। আমরা বুঝলাম না সে কি অর্ডার নিচ্ছে নাকি নিচ্ছে না? খানিক পরে বুঝলাম এইরকম ভঙ্গিতে মাথা নাড়ানোর অর্থ ‘হ্যাঁ’। আমি আর রুবাইদা ভেজ নিচ্ছিলাম দেখে কেন যেন সে বলে উঠলো, ‘চিকেন হালাল’। বলেই সে কাঁচের দরজায় লাগানো একটা স্টিকার দেখালো, ‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট হালাল’। আমি শিওর হবার জন্য আরেকবার জিজ্ঞেস করলাম সত্যিই হালাল কিনা? উনি আবার কনফিউসড ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’।

যাই হোক অর্ডার দিয়ে আমরা গল্পগুজব করতে লাগলাম। বেশ অনেকক্ষণ সময় পর খাবার আসলো। আমি অর্ডার দিয়েছিলাম ১০০ রুপির চিকেন চিজ বার্গার। আমারটাই আসলো সবার আগে। চারকোনা প্লেটে সার্ভ করা মেয়নিজ আর লেটুস দেওয়া বার্গারটা বেশ মজাই ছিলো। অন্যদের অর্ডার গুলোও চলে আসলো। আমরা গপাগপ খেতে লাগলাম। খেয়েদেয়ে বিল মিটিয়ে দিয়ে বের হয়ে আসলাম সেই দোকান থেকে। এবার হাঁটতে লাগলাম রাস্তা ধরে। রাস্তার পাশেই একটা সিনেমা হলে বড় পোস্টার ঝুলছে। নামটা তামিল ভাষায় লিখা। পোস্টারে পৌরানিক দৈত্যের মতন একজনের সাথে সুন্দরী এক নায়িকার ছবি আছে। আমার সাউথের একটা মুভি হলে বসে দেখার খুব শখ ছিলো। কিন্তু এই দৈত্য দানব দেখে মুভিটা আর দেখতে ইচ্ছা হলো না। যদি খুব ভায়োলেন্ট মুভি হয়, এই ভয়ে আমি আর ওদিকের পথ মাড়ালাম না। পরে জেনেছিলাম সিনেমাটার নাম ‘আই’।

হালাল সেই চিকেন চিজ বার্গার
হালাল সেই চিকেন চিজ বার্গার

কিছুদূর হেঁটেই আমরা তাজ্জব হয়ে গেলাম। এ কি, ভুল দেখছি না তো? এ যে বিশাল এক ‘পোথি’র শো রুম! মাত্রই ত্রিভান্দামে ঘুরে আসা শাড়ির জনপ্রিয় ব্র্যান্ড পোথির শো রুম দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সামনে। আমরা হৈ হৈ করে ঢুকে পড়লাম তাতে। ত্রিভান্দামের চাইতে এই পোথিতে ভীড় একদমই কম। ভীড়বাট্টা দেখে আমরা আরও খুশী হয়ে গেলাম। আমাদের অনেকজনকেই দেখলাম বিভিন্ন ফ্লোরে শাড়ি দেখছে। লোকজন নাই দেখে শান্তি মত ঘুরে ঘুরে শাড়ি পছন্দ করতে লাগলাম আমরা। একেকবার একেক ফ্লোরে ঘুরে ঘুরে শাড়ি দেখতে দেখতে কখন যে সময় কেটে যেতে লাগলো টেরই পাই নাই। মোটমাট তিনটা শাড়ি আর সাতটা থ্রি পিস কিনে আমরা যখন বের হই পোথি থেকে তখন বিকাল হয়ে গেছে। আমি আর রুবাইদা দুই হাত ভর্তি শপিং নিয়ে হোটেলে ফিরে গেলাম। কয়েক ঘন্টা রেস্ট নেওয়া জরুরি, না হলে শরীর চলবে না।

অল্প বিস্তর রেস্ট নিয়ে আমরা যখন আবার বের হবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমি, অন্তরা, মিম আর রুবাইদা বের হলাম বিচের উদ্দেশ্যে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে নির্জন ফাঁকা রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম আমরা। একটা মজার জিনিস আমার চোখে পড়লো। রাস্তার আশেপাশের দেওয়ালে সিনেমার পোস্টারের মত নানা রকমের শুভেচ্ছা মূলক পোস্টার। যেমন- কোন একটা বাচ্চার জন্মদিন, তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে হয় তো তার পরিবারের লোকজন পোস্টার টানিয়েছে। পোস্টারে বড় করে বাচ্চাটার ছবি, তারপর সবার উপরে নায়ক রজনীকান্তের ছবি, তার আশে পাশে অন্য মানুষদের আলাদা আলাদা পোজ মারা ছবি। এরাই মনে হচ্ছে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। এই রকম এক দম্পতিকে বিয়ের শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্টার, একজন বুড়ো মানুষকে শুভেচ্ছা জানিয়েও পোস্টার দেখলাম। মজাই পেলাম। এই সব দেখেই বুঝলাম, এই এলাকার লোকদের জীবনের সাথে সিনেমা ব্যাপারটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

একটি শিশুকে অভিনন্দন জানিয়ে তার শুভাকাংখীদের পোস্টার!!!!!!
একটি শিশুকে অভিনন্দন জানিয়ে তার শুভাকাংখীদের পোস্টার!!!!!!

বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা দোকানে চা খাওয়ার জন্য সবাই থামলো। দেখলাম জুবায়ের আর রাজিব ভাড়া নেওয়া একটা বাইক পার্ক করে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। এর আগে গোয়াতেও বাইক ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা ছিলো। কিন্তু সেখানে বাইক চালাতে লাইসেন্স লাগে। তাই আমাদের কেউ বাইক ভাড়া নিতে পারে নাই। কিন্তু পন্ডিচেরিতে লাইসেন্সের বালাই নাই। এমনিতেই বাইক ভাড়া পাওয়া যায়। আমাদের জাফর, শুভ, রিজভি, ইশতিয়াক, রাজিব ওদের সবাইকেই দেখা গেল একটা করে বাইকে চেপে ঘোরাঘুরি করতে। এতে একটা ভাবও আসে! যাই হোক, ওরাও চা খাবে। চায়ের অর্ডার দিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম। গরম গরম তেলে কি কি যেন ভাজা হচ্ছে। রুবাইদা বেসনে মরিচ ভাজা কিনলো কয়েকটা। আমি খেলাম সিংগারা। আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করে নানা রকম গল্প করতে লাগালাম। কিন্তু চা আর আসে না। সারাটা ইন্ডিয়াতেই লোকজনের এই ঢিলামি এত দিনে আমাদের সহ্য হয়ে যাওয়া উচিৎ ছিলো, কিন্তু তাতেও আমাদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙ্গে। ঠিক এমন সময়ে চা এসে হাজির হলো। তাড়াতাড়ি চা খেয়ে আমরা রওয়ানা হলাম।

রাস্তাঘাট শুনশান নিরব। হাঁটতে চলতে খুবই আরাম। হাঁটতে হাঁটতে আমরা বিচের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। দেখতে পেলাম অভিজাত সব ইতালিয় রেস্টুরেন্ট। সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে আমরা বিচে চলে গেলাম। এই বিচটা আমার পরিচিত কক্সবাজার বা গোয়ার বিচের মতন নয়। পায়ে হাঁটার জন্য একটা বিশাল চওড়া রাস্তা, তার পাশে অনেকটা জায়গা ছেড়ে বেশ নিচে কঙ্ক্রিটের ব্লক ফেলা। ঠিক সেই ব্লক গুলোতে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউ। এখানে সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে হাঁটার ব্যাপার নাই। ব্লকগুলোতে যাওয়াই বেশ কঠিন কাজ। আর একবার পা হড়কে পড়ে গেলে তো সবই শেষ!

চারদিক বেশ শান্ত। লোকজন ঘুরছে ফিরছে, কিন্তু কোন হৈহুল্লোড় নাই। হলুদ সোডিয়াম লাইটের আলোতে ঝকঝক করছে চারদিক। ঠান্ডা প্রাণ জুড়ানো বাতাসে আমাদের সবার মন ভালো হয়ে গেলো। আমরা সবাই বসে গল্প করতে লাগলাম। বিশুদ্ধ নোনা বাতাস, মায়াবী সোডিয়াম লাইট, আর পায়ের নিচে উত্তাল সমুদ্রের গর্জন- আহ, এত শান্তি কি করে লুকিয়ে থাকতে পারে একটা জায়গায়? অনেকক্ষণ বসে রইলাম আমরা। তারপর হাঁটতে লাগলাম বড় রাস্তা ধরে এই মাথা টু ওই মাথা। মন আমাদের এত ফুরফুরে হয়ে গেলো যে ভুলেই যাচ্ছিলাম যে রাত বাড়ছে, আমাদের ফিরে যেতে হবে। রাত আনুমানিক সোয়া নয়টার দিকে আমরা বের হয়ে আসলাম সেই বিচ থেকে। এতটা পথ হেঁটে আর হোটেল যেতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না। ৪০ রুপি দিয়ে একটা অটো ভাড়া করলাম। একটা অদ্ভূত জিনিস খেয়াল করলাম, পন্ডিচেরির অটোতে ইলেক্ট্রিক হর্নের বদলে বাচ্চাদের খেলনা ভেঁপু লাগানো। ড্রাইভার চালাতে চালাতে বাঁশির পিছনের রাবারের বলটাতে টিপ দিলে পোঁপ পোঁপ করে বেজে ওঠে সেটা। বেশ মজা লাগলো। অটোতে করে খুব কম সময়ে ফিরলাম হোটেলে।

হলুদ সোডিয়াম বাতির আলোতে উদ্ভাসিত পন্ডিচেরির বিচ ও তার পাশের বিশাল চওড়া রাস্তা
হলুদ সোডিয়াম বাতির আলোতে উদ্ভাসিত পন্ডিচেরির বিচ ও তার পাশের বিশাল চওড়া রাস্তা

হোটেলে নেমেই রুবাইদা রুমে চলে গেলো। আমি, অন্তরা আর মিম রাতের খাবার খাওয়ার জন্য পায়তারা করতে লাগলাম। হোটেলের গলিটা পার হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে আরও দুই একটা গলি পার হয়েই কয়েকটা ছোট্ট খাবারের দোকান পেয়ে গেলাম। দোকানটা খুব ছোট, তাই রাস্তার উপরই চেয়ার টেবিল পেতে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা একটা টেবিলের চার পাশে ঘিরে বসলাম। একজন লোক এগিয়ে আসলো। পরিষ্কার হিন্দিতে জানালো পরোটা, চিকেন আর মাটন পাওয়া যাবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম ভেজ কিছু আছে কিনা? জানতে পারলাম একটা সব্জির তরকারি আছে। কিন্তু লোকটা আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলো, মাংস না খেয়ে কেন ভেজ অর্ডার দিচ্ছি। আমার হয়ে মিম এর উত্তর দিয়ে দিলো। শুনে লোকটা হাসি মুখে বললো এখানে সব মাংসই হালাল। আমরা শুনে খুশি হয়ে গেলাম। আমি শিওর হওয়ার জন্য দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করলাম, ‘সত্যিই তো?’। লোকটা হাসিমুখে জবাব দিলো, ‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট অ্যান্ড ইটস অ্যা প্রমিস’। তারপর আর কি, আমরা চিকেন আর মাটন দুটোই অর্ডার দিলাম। পরোটা দিয়ে মজা করে খেলাম হালাল চিকেন আর মাটন। বেশ মজা ছিলো খেতে। আমার বিল আসলো ৬৭ রুপি। খেয়ে দেয়ে বিল মিটিয়ে দিয়ে তৃপ্ত মনে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে হোটেলের দিকে রওয়ানা দিলাম।

হোটেলের লবিতে দেখি এক মহিলাকে ঘিরে আমাদের লোকজনের জটলা বেঁধে আছে। ভদ্রমহিলা পরিবার নিয়ে কলকাতা থেকে এসেছেন। কয়েকদিন বাংলা না বলতে পেরে ওনার কেমন যেন হাঁসফাঁস লাগছিলো। হঠাৎ আমাদের বাংলা কথা বলতে শুনে উনি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। বাংলায় গল্প জুড়ে দিলেন আমাদের সাথে। যখন জানতে পারলেন আমাদের কান্ড কাহিনী, খুব মজা পেলেন। বিরক্ত হয়ে বলতে লাগলেন এটা একটা জায়গা হলো নাকি- কেউ তো কোন ভাষাই বোঝে না। এখানকার শাড়ির যা দাম, কোলকাতায় তো সব নাকি পানির দরে পাওয়া যায়। মন খুলে কথা বলতে লাগলেন আমাদের সাথে। বাংলা ভাষায় কথা বলতে পেরে চোখে মুখে আনন্দ ঠিকরে পড়ছিলো ওনার।

রুমে ফিরে আসলাম। আমাদের পাশের রুমটা নিশাতদের রুম। নিশাতের মোবাইলটা ধার করে শাড়ি, জামা কাপড়ের ছবি তুলে বাসার লোকজনকে পাঠালাম। লাগেজ উলট পালট করে সব কিছু ভিতরে ঢুকালাম। ততক্ষণে মজুমদার আর মৌলিও ফেরত এসে গেছে। গোছগাছ শেষ হলে জোড়ে ফ্যান ছেড়ে লাইট নিভিয়ে আমরা চারজন শুয়ে পড়লাম। এবং চোখ বন্ধ করার সাথে সাথেই ঘুম চলে আসলো।

The Mighty INDIA CALLING: ত্রিভান্দাম শহরে একটি ‘শাড়ি’ময় দিন (পর্ব ৩৩)

খুব ভোরে ঘুম ভাংলো জোর একটা গানের শব্দে। উচ্চস্বরে কোথাও গান বাজছে। বিছানা থেকেই টের পেলাম। বালিশ দিয়ে কান চেপে শুয়ে রইলাম অনেক্ষণ। কিন্তু অত্যন্ত উৎসবমুখর গান। খুব বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে দিলো না আমাদের এত উচ্চস্বরের গান। উঠে পড়লাম আমরা। ফ্রেশটেশ হয়ে নিয়ে বের হয়ে পড়লাম নাশতা খাওয়ার জন্য। আবার সেই আগের রেইন বো রেস্টুরেন্টে এসে পৌঁছালাম। রুবাইদা এখানে খেতে রাজি হলো না। ও চলে গেলো। আমি অন্যদের সাথে বসে অর্ডার দিলাম ৬০ রুপির মাসালা পুরি যেটা আসলে ৩টা লুচি আর ডালের প্যাকেজ। খেতে মোটামুটি। গল্পগুজব করতে করতে খাওয়া শেষ করতে অনেক দেরি হয়ে গেলো। খেয়েদেয়ে বের হয়ে সেই মন্দিরটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। রুবাইদা সেখানে হালকা খাওয়াদাওয়া করে নিচ্ছে। ওর জন্য ওয়েট করলাম। এই ফাঁকে দেখলাম অনেক বয়স্ক মহিলা হাঁড়ি, লাকড়ি, কলা গাছ- এইসব জিনিস মাথায় চাপিয়ে দৌড়ে দৌড়ে মন্দিরের প্রাঙ্গনে ঢুকছে। অনেককে দেখলাম মন্দিরের উঠানে লাকড়িতে আগুন দিয়ে হাড়িটা চাপিয়ে কিছু একটা রান্না করতে। আর উচ্চস্বরে একটানা বেজেই যেতে লাগলো গান। তামিল ভাষার আরতি টাইপের গান হবে হয়তো। তবে গানের সংখ্যা খুব বেশি নয়- তিন থেকে চারটা। এগুলোই বাজতে লাগলো বারবার। তবে স্বীকার করতেই হবে গানগুলো যথেষ্ট উৎসব মুখর। অন্তরা তো শুনতে শুনতে মুখস্ত করেই ফেললো একটা দুইটা গান! ওদিকে খাওয়া শেষে রুবাইদা আবার এক লিটারের ট্রপিকানা গোয়াভা জুস কিনলো। আগের দিনের পমেগ্রান্ডের চাইতে গোয়াভাটা খেতে বেশ ভালো।

আমরা দুইজন সিদ্ধান্ত নিলাম আজকে শাড়ি দেখতে শহরে যাবো। আবার সেই ঢাল পার হয়ে দুইজনে সমতল রাস্তায় এসে পৌঁছালাম। লোকজনকে ইশারা ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে করে একটা বাস স্টপেজে এসে দাঁড়ালাম দুইজনে। এই স্টপেজে প্রথম বারের মতন একজন ‘টাউট’ লোকের সাথে পরিচয় হলো আমাদের। মাঝবয়সী একজন লোক আগ বাড়িয়ে আমাদের জজ্ঞেস করলো আমরা মুসলিম কিনা? আমাদের বেশভূষা দেখেই বোঝা যায় যে আমরা মুসলমান, এইটা জিজ্ঞেস করাটা বাহুল্য। তারপরও আমাদের জবাব শুনে উনি হাসিমুখে কি কি যেন সব বললেন, যার অর্থ হয়, ‘আমি ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম যে তোমরা মুসলমান’। তারপর আমাদের বাস আসতেই লোকটা আমাদের সাথে একই বাসে উঠে পড়লো। বাসের ভিতরে ঢুকে লোকটা তার পাশের সিটে বসার জন্য আমাদের ডাকতে লাগলো। বাস মোটামুটি খালিই ছিলো। আমরা লোকটার পাশে না বসে দূরে গিয়ে বসলাম। লোকটা ঠিকই সিট চেঞ্জ করে আমাদের পাশে এসে বসলো। উনি হাসিমুখে রুবাইদার সাথে আকার ইঙ্গিতে অনেক কথা বলতে লাগলো। আমরা একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। একটু পর টিকেট চেকার আসলো। উনি যেন কি বলে দিলো, টিকেট চেকার হাতে ধরে রাখা মেশিন থেকে ঘ্যাসঘ্যাস করে তিনটা প্রিন্টেড টিকেট বের হতে লাগলো। সেই লোকটা চট করে আমাদের তিনজনের টিকেটের দাম দিয়ে দিলো। আমরা হাতপা নেড়ে বোঝাতে লাগলাম যে আমরা এই লোকটার সাথে যাচ্ছি না। রুবাইদা প্রবলভাবে মাথা নেড়ে বলতে লাগলো যে আমরা দুইজন আলাদা- আমরা যাবো এম জি রোড, কিন্তু টিকেট চেকার ধরেই নিয়েছে যে আমরা তিনজন একসাথে যাচ্ছি। উনি লোকটার হাতে অন্য একটা স্টপেজের টিকেট ধরিয়ে দিলো, যে স্টপেজে লোকটা নেমে যাবে। কন্ডাক্টর চলে যাবার পর ওই লোকটা আমাদের দিকে ভালোমানুষের মতন হাসি দিয়ে বলতে লাগলো যে, ‘ কি যে মুর্খ এরা, কিছুই বোঝে না। তবে তোমাদের কোন সমস্যা হবে না। তোমাদের স্টপেজ আরও পরে’। তারপর লোকটা আমাদের দুইজনের কাছে থেকে ১৫ রুপি করে নিলো বাস ভাড়া বাবদ। আমাদের মনে হলো আসলে ভাড়া হয়তো ১০ রুপি, উনি ওনার ভাড়াটা আমাদের উপর দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু কিছু বলার নাই, টিকেট ওনার হাতে, আবার ভাষাও বুঝি না। আমরা একটু অসন্তুষ্ট হয়ে ওনাকে ১৫ রুপি করে দিয়ে দিলাম। লোকটা একটু পরেই নেমে গেলো, এমন কি নামার সময়ও আমাদের দিকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। লোকটা চলে গেলে আমরা একটু হাঁফ ছাড়লাম, যাক বেশি লস যায় নাই!

লোকটা নেমে যেতেই কন্ডাক্টর আমাদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সে তখন প্রথমবার বুঝতে পারলো যে আমরা তিনজন আসলে একসাথে যাচ্ছি না এবং আমরা হাত পা নেড়ে তাকে এই কথাই বুঝাতে চেয়েছিলাম। সে কাছে এসে ইশারায় আমাদের সরি বললো। তারপর আবার জানতে চাইলো যে আমরা কোথায় যাবো। এবার এম জি রোডের কথা বলতেই নতুন করে আমাদের ৭ রুপির টিকেট কেটে দিলো। ভুল করার জন্য লোকটা আবার আমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো। এতক্ষণ ভালোমত চার পাশ দেখতে পারি নাই। এবার খেয়াল করে দেখলাম বাসগুলো অনেক চওড়া, ফাঁকা ফাঁকা সিট, জানালাতে গ্রিল দেওয়া। বিশাল বাসটার আন্দাজে লোকজন অনেক কম। একেকটা স্টপেজে এসে বাস থামে, লোকজন চাপ দিয়ে লক করা দরজা খুলে উঠে পড়ে। সবার শেষে যে উঠে সে দরজা টান দিয়ে লক করে একটা ঘন্টা বাজিয়ে দেয়, ড্রাইভার বাস চালাতে শুরু করে। আবার কেউ নামতে চাইলে ঘন্টা বাজিয়ে দেয়, ড্রাইভার ব্রেক কষে বাস থামিয়ে দেয়। সে নেমে গিয়ে আবার টান দিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। বাসে চড়া এখানে খুব আরামের। এত ছিমছাম পাবলিক ট্রান্সপোর্ট- আমাদের দেশে তো কল্পনাই করা যায় না!

আমরা আগেই বলে রেখেছিলাম যে এম জি রোড আসলেই যেন আমাদের বলে দেওয়া হয়। এম জি রোড আসতেই কন্ডাক্টর আমাদের ইশারা করলো। আমরা বাস থেকে নেমে দরজা টান দিয়ে লাগিয়ে দিলাম। বাস হুশ করে চলে গেলো। আমরা চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম। ঠিক শহর বললে চোখের সামনে যা ভেসে আসে, এটা ঠিক তেমন লাগলো না। চারপাশে অনেক উঁচু উঁচু কাঁচ ঘেরা বিল্ডিং আছে বটে, কিন্তু রাস্তাঘাট অস্বাভাবিক ফাঁকা। লোকজন তেমন নাই বললেই চলে। এদিক ওদিক তাকিয়ে আমরা আন্দাজে হাঁটতে লাগলাম। একটা দোকানে দেখলাম কলা ভাজা বিক্রি হচ্ছে। এর আগে বইয়ে পড়েছিলাম বলে আমার আগ্রহ হলো চেখে দেখার। আমি ১০ রুপির কলা ভাজা কিনে নিলাম। খেতে মজা লাগলো না। কাঁচা কলা প্রসেসিং করে রোদে শুকিয়ে মশলা মাখিয়ে তেলে ভাজা হয়েছে। সেই দোকান ভর্তি শুকনা কলা আর কাঁঠালের স্লাইস। মনে হয় এইগুলো দিয়ে তরকারি রান্নাও হয়। রুবাইদা এর ওর সাথে অল্পবিস্তর কথা বলার চেষ্টা চরিত্র করে আবিষ্কার করলো যে এখানকার সবচেয়ে বড় শাড়ির দোকান ‘পোথি’। আমরা ডিরেকশন বুঝে হাঁটতে লাগলাম সোজা রাস্তা ধরে। হাঁটতে হাঁটতেই পেয়ে গেলাম জয়লক্ষী নামের দোকান যেটা ওদের ভাষায় ‘জায়লাক্সমি’। ঠিক দোকান না, অনেকটা আমাদের গুলশানের শপার্স ওয়ার্ল্ডের মতন। একটা জমিতে একটাই বিল্ডিং, পুরোটাই একটা দোকান। আমরা চারপাশ দেখে ঢুকে পড়লাম সেই দোকানে। আরিব্বাস, শাড়ির জগতে এসে পড়েছি যেন! একেকটা ফ্লোরে একেকটা টাইপের শাড়ি। আমরা ঢুকতেই একগাদা সেলস গার্ল এসে জিজ্ঞেস করতে লাগলো কোন ধরনের শাড়ি দেখত চাই- এইসব। কারনটা একটু পরে বুঝলাম। এত বড় দোকানে ওরা ডিরেকশন না বলে দিলে কেউ শাড়ি খুঁজে পাবেই না!

রুবাইদা কি কি সব বলাতে আমাদের পাঠিয়ে দিলো চার তলায়। আমরা লিফটে করে চার তলায় উঠলাম। সেখানে আমাদের খুব আদর যত্ন করে বসালো। টপাটপ অনেকগুলো শাড়ি বের করে দেখালো। শাড়িগুলো যেমন সুন্দর, তেমনই দাম। রুবাইদা কালো রঙের কথা বলতেই সেলস গার্লটা উঠে কই যেন চলে গেলো। আমরা বসে রইলাম। আমাদের পাশেই এক ফ্যামিলি কনের জন্য বিয়ের শাড়ি কিনতে এসেছে। কয়েকজন সেলস গার্ল টপাটপ করে কনেকে বিয়ের শাড়ি একটার পর একটা গায়ে জড়িয়ে পরিয়ে দেখাচ্ছিলো। খুব কম সময়ের মধ্যে ওরা ব্লাউজ পিসসহ জামার উপর দিয়ে এমন করে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে দেয় দেখে মনে হয় যেন সত্যি সত্যি ব্লাউজ সহ শাড়িটা পরানো হয়েছে। কয়েকটা পরার পর ফাইনালি একটা শাড়ি সিলেক্ট করতেই ওরা কোথা থেকে এক বিশাল কারুকাজ করা ছাতা বের করে আনলো। তারপর কনেকে সেই ছাতার নিচে দাঁড় করিয়ে প্রফেশনাল ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলানো হলো। আর আশেপাশের সব সেলস গার্লরা জোরে হাততালি দিয়ে উঠলো। আমি আর রুবাইদা হাঁ করে সব দেখতে লাগলাম। ততক্ষণে রুবাইদার সেলস গার্ল প্রায় বিশটার মতন কালো শাড়ি নিয়ে এসেছে। আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে শাড়িগুলো দেখলাম। কিন্তু এখনই হুট করে কিনে ফেলাটা মনে হয় ঠিক হবে না ভেবে উঠে চলে আসলাম। আমরা বাকি ফ্লোরগুলোও ঘুরে ঘুরে দেখলাম। প্রত্যেকটা টাইপের শাড়ির জন্য আলাদা আলাদা সেকশন। এবং প্রত্যেক সেকশনে দামের রেঞ্জ অনুযায়ী আলাদা আলাদা সাব সেকশন করা আছে। এত সুন্দর অ্যারেঞ্জমেন্ট যে একজন ক্রেতার আসলে কোন সমস্যাই হওয়ার কথা না। বাজেট অনুযায়ী শাড়ি পছন্দ করার জন্য এরচেয়ে নির্ঝঞ্ঝাট কোন পদ্ধতি হতেই পারে না!

পুরোটা দেখে আমরা বের হয়ে আসলাম। তারপর আবার হাঁটতে লাগলাম ‘পোথি’র উদ্দেশ্যে। হাঁটতে হাঁটতেই রুবাইদা কানের দুল কিনলো, আমি পার্স কিনলাম। তারপর অনেক দূর গিয়ে একসময় পেলাম ‘পোথি’। এটাও আগেরটারই মত। তবে আগেরটা ফাঁকা ফাঁকা ছিলো, আর এটাতে আছে উপচে পড়া ভিড়। অনেক লোকজনের সাথে যখন দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম দেখলাম, এটা আরেকটা শাড়ির জগৎ। আগের দোকানটার মত অত সাজানো গোছানো নয় এটা। যেখানেই একটু জায়গা আছে সেখানেই টাল করে রাখা আছে শাড়ির স্তুপ। আমরা ঢুকে শাড়ি দেখতে লাগলাম। একটা মজার জিনিস আবিষ্কার করলাম আমরা। এখানে একই শাড়ি অনেক গুলো কোয়ালিটির পাওয়া যায়। যেমন একই শাড়ি ৫০০০ রুপি থেকে শুরু করে ৯০০ রুপিতেও পাওয়া যাচ্ছে। এতে সুবিধা হলো, শাড়ি পছন্দ হলে দামের জন্য কেউ ফেরত যাবে না। প্রত্যেকের সাধ্যের মধ্যে শাড়িটার কোন না কোন কোয়ালিটি পাওয়াই যাবে। একটু এগিয়ে যেতেই আমরা দেখতে পেলাম নিশাত, রিন্তু, তমা আর পৃথ্বীকে। পৃথ্বীর হাতে চারটা শাড়ির প্যাকেট। নিশাত ভারি সুন্দর একটা শাড়ি কিনলো। রিন্তুর কেনা থান কাপড়টা আমার খুব পছন্দ হলো। কিন্তু আমি কিনতে গেলে জানতে পেলাম, সেই থানে আর জামা বানানোর জন্য যথেষ্ট কাপড় নাই। আমরা এদিক ওদিক ঘুরে দেখতে লাগলাম। রুবাইদা কয়েকটা শাড়ি পছন্দ করে ফেললো। এত হাজার হাজার শাড়ি দেখে আমাদের মাথা কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছিলো, তাই কোনটা কিনবে রুবাইদা ভাবতে ভাবতেই বের হয়ে আসলাম আমরা।

সকাল থেকেই হাঁটা হচ্ছে, দুপুরে কিছু খেয়ে নেওয়া প্রয়োজন। দেখলাম পোথির বাইরেই সারি ধরে খাবারের দোকান। অনেক মানুষজন খোলা আকাশের নিচে বসে খাচ্ছে, অনেকটা আমাদের সীমান্ত স্কয়ারের মতন। আমরাও সিদ্ধান্ত নিলাম এখান থেকেই খেয়ে নিবো। সবগুলো দোকান ঘুরলাম আমরা। খাবারের মেনু অদ্ভূত ভাষায় লিখা। দেখে আমাদের পেট ফেটে হাসি পাচ্ছিলো। উদ্ভট খাবার কিনে ধরা খেতে ইচ্ছা করছিলো না। তাই সেফ সাইডে থাকার জন্য আমরা অর্ডার দিলাম ৭৫ রুপির কেরালা মিল। একটা বিশাল থালায় সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো মাড়সহ মোটা চালের ভাত, দুইটা বড় বড় পাপড়, শুকনা মরিচ দেওয়া কচু আর নারিকেলের তরকারি, একটা টকটকে লাল রঙের ভাজি, টক নারিকেল আর টক দই। আমরা দুইজনে খেতে খেতে গল্প করছিলাম। খেতে খেতেই রুবাইদা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো যে ও কি কি শাড়ি কিনে ফেলবে। সেই লাল রঙের ভাজিটা ছাড়া বাকি সব খেতে ভালোই ছিলো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে গলাটা শুকিয়ে গেলো। সেখানেই একটা আমুল আইস্ক্রিমের দোকান ছিলো। সেখানে ‘শারজাহ’ নামের একটা ড্রিংকস দেখে আমার খুবই পছন্দ হলো। ৫০ রুপির এক গ্লাস শারজাহ অর্ডার দিয়ে দিলাম। রুবাইদা আমাকে বসিয়ে রেখে আবার পোথিসের ভিতর ঢুকলো শাড়ি কিনে আনতে। আমি বসে রইলাম। একটু পরেই শারজাহ চলে এলো। আহ- কি মজা। এক গ্লাস অত্যন্ত ঘন মিল্ক শেকের মতন একটা জিনিস, তাতে বাদাম, চকোলেট আর আইসক্রিম দেওয়া। আমার খুবই মজা লাগলো খেতে। আমার শারজাহ শেষ হওয়ার আগেই রুবাইদা চলে আসলো। ও এসে আরও একটা শারজাহ অর্ডার দিলো। আমরা দুইজনে বসে বসে শারজাহ খেতে লাগলাম।

কেরালা থালি
কেরালা মিল

এবার আমরা ধীরে সুস্থে ঘুরতে লাগলাম। ঢুকলাম ‘বিগ বাজার’ এ। বিগ বাজারে সব অফার ওয়ালা জিনিসপত্র থাকে। কমদামে ভালো জিনিসই পাওয়া যায়। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম সবকিছু। আমি ওয়াফির জন্য দুইটা বই কিনলাম। বিগ বাজার থেকে বের হয়ে কতগুলো খুব সুন্দর অ্যাংরি বার্ডের চাবির রিং পেলাম। আমি ২০ রুপি করে পাঁচটা কিনলাম। এরপর হাঁটা ধরলাম সোজা। আমার খুব শখ ছিলো সাউথে এসে সাউথের সিনেমা হলে সাউথের মুভি দেখবো। তাই একটা সিনেমা হলে গিয়েছিলাম কি মুভি চলে দেখতে। সেখানে দেখলাম সুপার স্টার ধানুশের একটা মুভি চলছে। সিনেমা হলের বাইরে ‘অল ইন্ডিয়া ধানুশ ফ্যান ক্লাব’, ‘ধানুশ ফ্যান ক্লাব অফ কেরালা’ এইসব নামের বড় বড় ব্যানার ঝুলছে। সিনেমা যে সাউথের মানুষের জীবনের একটা বিরাট অংশ, এগুলো দেখেই সেটা আন্দাজ করা যায়। আমরা যখন যাই তখন কোন কারণে হলটা বন্ধ ছিলো। আমাদের দেখে দারোয়ান তড়িঘড়ি করে বের করে দিয়ে গেট বন্ধ করে দিলো। কথা বলেও কোন লাভ নাই, কারণ ভাষা তো বুঝি না!

সিনেমা হলটা ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে আসতেই অনেক রেললাইনের জাংশন দেখতে পেলাম। তারপর একটু ভিতরের দিকে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে বড় একটা মন্দির পেয়ে গেলাম। মন্দির ঘিরে ব্যাপক সাজ সাজ রব। মনে পড়লো আজকে শিব রাত্রি। এমন উৎসবের দিনে একটু ঘুরে দেখাই যায় মন্দিরটা। সেই চিন্তা করে আমরা দুইজন হাঁটতে লাগলাম মন্দিরটার দিকে। কাছে গিয়ে জানতে পারলাম মন্দিরটার নাম শ্রী পদ্মনাভ স্বামী টেম্পল। মন্দিরের সামনের রাস্তায় বাঁশ ফেলে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা দুইজনে সাবধানে বাঁশটা পার হয়ে সামনের রাস্তায় গেলাম। অনেক মানুষ রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে। বেশির ভাগই সাদা পোশাক। ছেলেরা সাদা শার্টের সাথে সাদা লুঙ্গি আর মেয়েরা সাদা শাড়ি বা লাঙ্গা। রাস্তার দুপাশ ধরে চেঞ্জিং রুম। অনেককেই দেখছিলাম অন্য জামা কাপড় পরে এসে চেঞ্জিং রুমে জামা বদলে লুঙ্গি পরে নিতে। সবাইকে দেখে বেশ অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের মানুষজন বলেই মনে হলো। অনেক স্কুল কলেজ পড়ুয়া কম বয়সী স্মার্ট ছেলেদের দেখলাম ফ্যাশনেবল শার্ট আর টি শার্ট বদলে সাদা শার্ট আর লুঙ্গি পড়তে। মনে হলো এটাও বুঝি উৎসবের একটা অংশ, সবাই থাকবে সাদা পোশাকে।

এত সাদার মাঝে আমাদের দুইজনকে যে খুবই অদ্ভূত লাগছিলো, সেকথা আর না বললেও হয়। যাই হোক এসেছি যখন, মন্দিরটা দেখেই যাই। অনেক উঁচু সিঁড়ি পার হয়ে মন্দিরের দোরগোড়ায় দেখতে পেলাম মেটাল ডিক্টেটর হাতে নিয়ে পুলিশ আর্চ ওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সবাইকে তল্লাশি করেই ভিতরে ঢুকাচ্ছে। আমাদের দেশে অনেক মন্দিরেই গিয়েছি। ইন্ডিয়ার অন্যান্য মন্দিরও ঘুরেছি, কিন্তু কোথাও এমন সিকিউরিটি দেখি নাই। আমি আর রুবাইদা আড়চোখে একজন অন্য জনের দিকে তাকালাম। আমি ঢোক গিলে পুলিশকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলাম আমরা ভিতরে যেতে পারবো কিনা। পুলিশটা এক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো খানিক্ষণ। পাশের আরেকজন জিজ্ঞেস করলো, ‘ হিন্দু হোঁ?’। আমরা মাথা নেড়ে জবাব দিলাম ‘না’। ওনারা হাবেভাবে বুঝিয়ে দিলো ভেতরে যাওয়া যাবে না। এরমধ্যে প্রথমজন গিয়ে তার বসকে ডেকে এনেছে। লোকটা জিজ্ঞেস করলেন যে আমরা কোন ধর্মের লোক, কোথা থেকে এসেছি, কোথায় থাকি এইসব এইসব। তারপর ভদ্রভাবে বললেন যে ভিতরে ঢোকা সম্ভব নয়। আমরাও আর কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পড়লাম। তারপর হাঁটতে লাগলাম রাস্তার দিকে। মন্দিরের সামনের রাস্তা থেকেই আমি আর রুবাইদা পার্স আর ব্যাগ কিনলাম।

আরও খানিক্ষণ হাঁটাহাঁটি করার পর একটা মার্কেট দেখে মনে হলো একটু ঢুকে দেখি ভিতরে। কেমন যেন অন্ধকার, লোকজন নাই- ভুতুড়ে পরিবেশ। আমরা আবার তাড়াতাড়ি বের হয়ে পড়ি সেখান থেকে। তারপর বড় রাস্তাটা পার হয়ে যাই আরেকটা শাড়ির দোকানে। সেটার নাম ‘কল্যান’। এই দোকানটা বাকি দুইটার চেয়ে তুলনামূলক ছোট। চারতলা বিল্ডিং জুড়ে পুরোটাই শাড়ির দোকান। এখানেও রুবাইদার শাড়ি পছন্দ হলো। কালেকশন একটু কম থাকায় রুবাইদার বরঞ্চ সুবিধাই হলো পছন্দ করতে। সেলস গার্লরা আমাদের পিছন পিছন ঘুরতে লাগলো জোঁকের মতন। সব দেখেটেখে রুবাইদা আরও তিনটা শাড়ি কিনে ফেললো। আমরা দোকানে থাকতে থাকতেই তমা আর সৃষ্টিকে দেখলাম দোকানে ঢুকতে। দেশের বাইরে এসে যেখানেই দ্বিমিকবাসীর সাথে দেখা হয় সেখানেই আমরা বেশ কোলাকুলি করে ফেলি, তখন অন্যরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ওদের সাথে হাই হ্যালো করেই আমরা নেমে গেলাম নিচে। বিলটিল দিয়ে যখন আমরা বের হই, তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে।

কল্যানের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম যে কোভালাম যাওয়ার বাস কোথায় থামে। সামনেই বাস স্টপেজ দেখিয়ে উনি আমাদের অপেক্ষা করতে বললো। একটু এগিয়ে স্টপেজে গিয়ে দাঁড়াতেই দশ পনের মিনিটের মধ্যেই একটা বাস চলে আসলো। আমরা তাতে উঠে পড়লাম। ঠিক আগের মত আরামদায়ক, চওড়া আর প্রায় ফাঁকা বাস। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে শোঁ শোঁ করে আমাদের বাস চলতে লাগলো। কন্ডাক্টর আসতেই ১৬ রুপির টিকেট কাটলাম কোভালামের। তবে এই কন্ডাকটরও ভাষা বোঝে না। তাই কোভালাম আসলে যে আমাদের ডেকে দিতে হবে সেই কথাটা ওনাকে বোঝাতে পারছিলাম না। তারপর দেখলাম দুইটা সাদা চামড়ার টুরিস্ট মহিলা আমাদের বাসে বসে আছে। আমরা ভাবলাম এরা নিশ্চয়ই কোভালামই যাচ্ছে। আমরা তক্কে তক্কে রইলাম। ঠিকই একটা স্টপেজ কাছাকাছি আসতেই ঐ দুইজন উঠে দাঁড়ালো। আমরাও জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে লাগলাম যে কোথায় এসেছি। তিনদিন ধরে কোভালামে আছি। তাই স্টপেজটা চিনতে আর ভুল হলো না। বাস থামতেই আমরা নেমে পড়লাম। দুইজনের দুই হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ। এই নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে ঢালের দিকে যেতে লাগলাম আমরা।

আজকে সকালেই তানভীর আর জেরিনকে বলতে শুনেছিলাম ফার্স্ট ক্লাস হালাল মাংস পাওয়া যায় একটা হোটেলে। ঢাল ধরে হেঁটে হেঁটে আসার সময় চোখে পড়ে গেলো ওদের বর্ণনা অনুযায়ী সেই হোটেলটা। আমরা ঠিক করলাম একবারে খেয়ে দেয়েই হোটেলে যাই। হোটেলটার নাম ‘ইশা রেস্টুরেন্ট’। টিনের চাল দেওয়া খুব সাধারণ একটা দোকান। আমরা যখন ঢুকলাম সেখানে, আমরা ছাড়া আর কোন কাস্টোমারই ছিলো না। আমাদের যত্ন করে বসালো। ওরা আমাদের ভাষা চমৎকার বুঝলো। জানালো মুরগি, গরু সবই আছে। আমরা অর্ডার দিলাম ১০ রুপির রুটি আর ৩০ রুপির গরুর মাংস। মাংস রান্নাটা এত মজা যে আর কি বলবো! খুব তৃপ্তি করে আমরা খেতে লাগলাম। সাথে নিলাম ৮ রুপির ইড়িউপ্পাম নামের আরেকটা জিনিস। এটাও ইডলি জাতীয় ভাপা পিঠার মতন কেমন যেন চালের গুড়ির নুডুলস দিয়ে বানানো মনে হলো। খুব মজা লাগছিলো আমাদের খেতে। খেতে খেতেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম যে এখন থেকে প্রতি বেলাই এখানে খাবো। এমন সময় এক হাসিখুশি বিদেশি টুরিস্টের আগমন হলো। লোকটা পুরোদস্তুর ইন্ডিয়ান সাধু বাবা টাইপের গেট আপ নিয়েছে।  রেস্টুরেন্টের লোকজন তার গেট আপের অনেক প্রশংসা করলো। লোকটাও খুশি মনে খাওয়া অর্ডার দিয়ে খেতে শুরু করলো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা বিল দিয়ে বের হয়ে গেলাম সেখান থেকে।

বের হতেই রুবাইদা আমাকে জানালো যে ঐ বিদেশি লোকটা পর্ক বা শুকরের মাংস অর্ডার দিয়েছে। শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম- কই, আমাদের তো মেনু বলার সময় একবারও বলে নাই যে পর্ক পাওয়া যায়। মুসলমান দেখেই হয় তো চেপে গিয়েছিলো বিষয়টা। রুবাইদা সাজেশন দিলো এইখানে আর না আসার, কারণ হয় তো পাশাপাশি হাড়িতে একই খুন্তি দিয়ে রান্না হয় মুরগি, গরু আর শুকর। বলা তো যায় না! আমার আফসোস লাগলো, ইশ- কি মজাটাই না ছিলো খাওয়াটা……

হেঁটে হেঁটে যতই হোটেলের কাছে যেতে লাগলাম, কানে বাজতে লাগলো সকালের সেই গান। সকাল থেকে শুরু করে সারাদিন চলছে একই গান। একটা গানের কথা অনেকটা এইরকম, ‘-নামাশ্যিবায়ে, নামাশ্যিবায়ে/ওম নামাশ্যিবায়ে-’। এর মধ্যে আমরা হোটেল পৌঁছে গেলাম। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই আমরা আমাদের শপিংয়ের জিনিসপত্র সব বের করে দেখতে লাগলাম। এত এত জিনিস আমাদের লাগেজে ভরে রাখাটাও বেশ কষ্টসাধ্য কাজ ছিলো। আমরা বেশ ক্লান্ত ছিলাম। সারাদিন কম তো ঘোরাঘুরি হয় নাই! গোছগাছ করতে করতেই মজুমদার আর মৌলি এসে পড়লো। সারা দিনের কথা শুনে মজুমদার বললো জানালো পদ্মনাভ মন্দিরটা খুবই উচ্চ গোত্রের হিন্দুদের জন্য। বিধর্মী তো দূরের কথা, সব হিন্দুরাই সেখানে ঢুকতে পারে না। সেখানে আমাদের দুইজনের ভিতরে ঢুকতে যাওয়াটা বেশ সাহসিকতার কাজ হয়ে গেছে। যাক বাবা, এজন্য যে কোন ঝামেলায় পড়তে হয় নাই সেজন্যই আমরা খুশি হলাম। এর মধ্যে আমি ভাবলাম হোটেলের সামনের মন্দিরটাতেই এত লাইটিং করা হয়েছে, এটাই একবার দেখে আসি। আমি বের হলাম মন্দিরটা ঘুরে আসার জন্য। ভাবলাম হয় তো আমাদের দেশের মন্দিরগুলোর মত বেদির উপর বড় কোন মূর্তি থাকবে, কিন্তু ভিড়ের মধ্যে কোন মূর্তি দেখতে পাচ্ছিলাম না। কাঁচ ঘেরা একটা জায়গায় অনেক ভিড় ছিলো তবে সেটার ধারে কাছেই যেতে পারলাম না। বলতে গেলে প্রায় কিছুই না দেখে আবার হোটেলে ফিরে গেলাম।

যখন ঘুমাতে বিছানায় যাচ্ছিলাম, তখনও কানের কাছে বাজছিলো মন্দিরের সেই গান। রাত হয়ে যাওয়ায় চারপাশ আরও চুপচাপ হয়ে গেছে। গানে শব্দটা আরও জোরে কানে এসে লাগছে। কিন্তু কিছু করার নাই। কানে বালিশ চেপে শুয়ে পড়লাম। তবে ঘুমটা ঠিকমত আসলো না। কিন্তু কিছু করার নাই, উৎসবমুখর গানগুলোর মধ্যেই ঘুমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম আমি।

The Mighty INDIA CALLING: ‘ব্যাক ওয়াটার’ অভিযান (পর্ব ৩২)

চমৎকার একটা ঘুম দেওয়ার পর সকালে ফুরফুরে মেজাজে ঘুম ভাঙ্গলো হাজারও পাখির কিচির মিচির ডাকে। আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লাম। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আমরা বের হয়ে পড়লাম নাশতা খাওয়ার উদ্দেশ্যে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে গত রাতের সেই রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। দেখি আমাদের লোকজন আরও অনেকজন আছে। আমরা ওদের সাথে একটা টেবিল শেয়ার করে বসে পড়লাম। মেনু দেখে অর্ডার দিলাম চাপাতি আর ডাল ফ্রাই। অর্ডার দিয়ে অনেক্ষণ বসে রইলাম। আমরা হাহা হিহি করে হাসাহাসি করে দারুন গল্প জুড়ে দিলাম। গত রাতে ভালো করে দেখতে পারি নাই, দিনের আলোতে তাই চারপাশটা ভালো করে দেখলাম। আমরা যেখানে বসে আছি সেখানে ছনের চাল দেওয়া। পাশেই একটা টলটলে নীল পানির সুইমিং পুল। এখানকার হোটেলে বেশ কয়েকজন ভিনদেশি অতিথি আছে। তারাও সকালে খাওয়ার জন্য ফুল ফ্যামিলি সুদ্ধু খেতে নেমে এসেছে। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলো ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে- আমরা খুব মজা পেলাম এইসব দেখতে দেখতে।

নাশতা খেয়ে বের হয়ে আসি আমরা। আমার খুব আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা করছিলো। মোড়ের দোকানটায় গিয়ে কিনে নিলাম ‘আমুল আইসক্রিম’। ৩৫ রুপি আন্দাজে অনেক মজার আইসক্রিম। আইসক্রিম খেতে খেতেই হোটেলে ফিরে গেলাম। কিছুটা রেডি হয়ে নিলাম, তবে কোথায় যাবো এখনও কিন্তু জানি না। এরপর শুনলাম আমাদের আরেকটা যেই হোটেল আছে ‘রাজি হোমস’ সেটাতে কমিটি একটা মিটিং কল করেছে। আমরা সেখানে ছুটে গেলাম। আমরা সবাই দোতলার বারান্দায় লাইন ধরে বসলাম। আদিবা সবাইকে বললো, দুইটা অপশন আছে- আলাপুজা আর পুভার। আলাপুজায় যাওয়া বেশ সময় সাপেক্ষ সেক্ষেত্রে পুভারে যাওয়াটা ভালো অপশন। কমিটি গিয়ে কথা বার্তা বলে এসেছে, এখানে থেকে রিজার্ভ বাসে করে গিয়ে সব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আবার এখানে ফিরে আসতে মোটমাট প্রত্যেকের ৪৫০ রুপি করে খরচ পড়বে। আমরা সবাই এই প্রস্তাবে রাজি হই। ঠিক হয় বাস ঠিক দুইটার সময় এসে হাজির হবে। আমরা যেখানেই যাই যেন সময়মত এসে বাস ধরতে পারি।

এই হোটেল থেকে বের হয়ে রুবাইদা ট্রপিকানার পমেগ্র্যান্ডে ফ্লেভারের জুস কিনলো। বড় সেই জুসের প্যাকেট হাতে নিয়ে আমরা কোথায় যাবো, কোথায় যাবো চিন্তা করতে লাগলাম। হাতে যেহেতু সময় বেশি নাই, তাই দূরে কোথাও না গিয়ে বিচে ঘোরাঘুরি করে আসার কথাতেই সবাই সায় দিলো। রুবাইদা হোটেলে চলে গেলো। আমি, অন্তরা আর মিম ঘুরতে গেলাম বিচের দিকে। রাতের বেলায় যেমন জমজমাট দেখেছিলাম বিচের পাশের দোকানপাট আর হোটেলগুলো, দিনের বেলা সেরকম নয়। প্রায় সবই ফাঁকা, লোকজন কম। আমরা প্রথমে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম লাইট হাউজের দিকে। ভাঙ্গাচোরা একটা পুরানো লাইট হাউজ সমুদ্রের পাড়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। লাইট হাউজের ছায়ায় বসে আমরা অনেক্ষন গল্পগুজব করলাম। নিরিবিলি চুপচাপ এই বিচে সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে পাথরের উপর হাত পা ছড়িয়ে অলস বসে থাকতে আমাদের ভালোই লাগছিলো। অনেক্ষণ পর আমরা উঠে পড়লাম। হাঁটতে লাগলাম দোকানগুলোর দিকে। একেকটা দোকানে ঢুকে আমাদের মাথা ঘুরে গেলো। একদম কাশ্মিরের শাল সোয়েটার থেকে শুরু করে মুক্তার সেট, রত্ন পাথর কি নাই এখানে! যা দেখি সেটাই পছন্দ হয়, কিন্তু দাম আকাশ্চুম্বী। আমরা তাই কোনকিছু কেনার কথা চিন্তা করছিলাম না। ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম একেক দোকান। এর মধ্যে সুমাইয়াকে দেখলাম নারিকেল দিয়ে বানানো একটা বানর কিনতে। বানরটা খুবই সুন্দর। শয়তানি ভরা কালো কালো চোখ দুইটা দিয়ে তাকিয়ে থাকে।

দেফ
বাটির মতন উল্টানো বৃত্তাকার ঢালু বিচ  (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

আমরা তাড়াতাড়ি করে বিচ থেকে বের হয়ে আবার সেই আগের রেস্টুরেন্টে গেলাম। এবার শেয়ারে অর্ডার দিলাম ভাত, চিংড়ি মাসালা আর এগ নুডুলস। আমার খরচ পড়লো ১৮৫ রুপি। খুব মজা করে খেলাম আমরা। তাড়াতাড়ি করে খেয়ে আমরা দৌড় দিলাম হোটেলের দিকে। হোটেলে গিয়ে রুবাইদাকে নিয়ে আমরা দুইজনে একবারে বের হয়ে পড়লাম ২.৩০ টার দিকে। বাস এসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ঢালের অন্য প্রান্তে। পুরো ঢালটা আমাদের পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হবে, তাও এই গরমের মধ্যে! ওকে, দিলাম না হয় পাড়ি- কি আছে জীবনে? এই বিশাল ঢাল বেয়ে উপরের দিকে উঠতে উঠতে আমাদের সব শক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছিলো। ভাগ্য ভালো ঢালটা খুব বেশি খাড়া নয়। তবে খুব বেশি খাড়া না হলেও অনেক বিশাল পথ পাড়ি দিতে আমাদের কষ্ট হচ্ছিলো কারণ মাথার উপর গনগনে সূর্য। গরমের কারনেই আমাদের দম বের হয়ে যাচ্ছিলো। অবশেষে আমরা ঢাল পাড়ি দিয়ে শেষ মাথায় এসে দেখি এক বিশাল বাস দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে ভিতর থেকে একজন কমবয়সী ছেলে বের হয়ে আসলো। আকারে ইঙ্গিতে বুঝলাম এটাই আমাদের বাস। আমরা ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম আর কেউই আসে নাই, খালি আমরা দুইজন।

আমি বাসের ভিতর উঠে দেখলাম চমৎকার বাস। দামি বাস বলতে যা বোঝায় আর কি- সেরকম বাস। মজার ব্যাপার হচ্ছে বাসের এক পাশে দুই সিটের রো আর অন্য পাশে তিন সিটের রো। আমি তাড়াতাড়ি করে দুই সিটের রোতে এক জায়গায় ব্যাগ রেখে সিট দখল করলাম। রুবাইদা গরমে টিকতে না পেরে নেমে গেলো। আমি বাসেই বসে রইলাম। আস্তে আস্তে সবাই আসতে লাগলো। সবাই উঠে পড়লে বাসে এসি ছেড়ে দিলো। আমরা খুশিতে চিৎকার করে উঠলাম। গোয়েলে চড়তে চড়তে বাসে যে এসি থাকতে পারে সেই বিষয়টাই ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের নিয়ে বাস চলতে শুরু করলো। আর সেই সাথে হাই ভলিউমে বাজতে লাগলো ধুমধাড়াক্কা সব গান। এরমাঝে আমাদের জানিয়ে দেওয়া হয় ফাইনালি ৪০০ রুপি করে দিতে হবে পার হেড। শুনে আমরা আরেক দফা খুশি হয়ে গেলাম।

খুব বেশিক্ষন লাগলো না। আমরা পৌঁছে গেলাম পুভার। পুভারে আমরা যেই জায়গাটায় থামলাম তার নাম ব্যাক ওয়াটার। গাছপালা দিয়ে ঘেরা একটা জায়গার মাঝখানে একটা জলাশয় আছে। সেটাতে আমরা নৌকায় চড়ে পাড়ি দিবো। আমাদের জন্য তিন তিনটা নৌকা আসলো। নৌকাগুলো দেখতে কাশ্মিরি শিকারা নৌকার মতন লাগলো। আমরা টপাটপ করে উঠে বসলাম নৌকাগুলোতে। একটা নৌকায় আমি, শুভ, রিজভী, তুষার, রুবাইদা, রিন্তু, নিশাত, পৃথ্বী আর বাসিরুন চড়ে বসলাম। আমাদের প্রত্যেককে লাইফ জ্যাকেট পড়তে হলো। তারপর ভটভট করে ইঞ্জিন স্টার্ট হলো। চলতে শুরু করলো আমাদের তিন নৌকা। প্রচুর নারিকেল গাছসহ দুইপাশে নানা রকম গাছগাছালির ছায়ায় ঢাকা টলটলে সবুজ পানির উপর দিয়ে আমরা চলতে লাগলাম। পাখির কিচিরমিচির আর পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাড়া আর তেমন কোন শব্দ নাই। সব কিছু মিলিয়ে খুবই চমৎকার পরিবেশ, কিন্তু আমরা কেমন যেন ছটফট করতে লাগলাম- এইই দেখতে এসেছি শুধু? এই জঙ্গল, পানি, পাখির ডাক তো দেশে সবখানেই পাওয়া যায়, এটা তো তেমন আহামরি কিছু না। আর যদি বিচার করতেই হয় তাহলে স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের রাতারগুলের ধারে কাছে এটা নাই। আমরা একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলাম এই জঙ্গলের শেষ দেখার জন্য। এর মধ্যেই এক নৌকা থেকে অন্য নৌকায় আমরা একে অন্যকে চিৎকার করে ডাকাডাকি করতে লাগলাম, হাত ডুবিয়ে একে অন্যকে পানি ছিটিয়ে দিতে লাগলাম। এই করতে করতেই আমাদের নৌকা একটা বিচে এসে থামলো।

ঘোলা পানির উপর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আমাদের নৌকাগুলো যাচ্ছিলো
ঘোলা পানির উপর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আমাদের নৌকাগুলো যাচ্ছিলো

আমাদের আগেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিলো যে বিচটা খুবই বিপজ্জনক, আমরা যেন কেউই পানিতে না নামি। গিয়ে দেখলাম সত্যি তাইই। একেবারে ঢালু একটা বিচ সোজা নেমে গেছে নিচের দিকে। আর প্রচন্ড শক্তিতে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগলো বালির উপর। একবার পা হড়কালে আর উঠে আসার সম্ভাবনা নাই। আমরা কক্সবাজার দেখে অভ্যস্ত। কক্সবাজারের মত এত সুন্দর নিরাপদ বিচ দেখতে দেখতে বিপজ্জনক বিচ কেমন হতে পারে তা নিয়ে আমার আইডিয়া ছিলো না। তাই এরকম একটা বিচ দেখে সত্যিই আমরা সবাই সাবধানে দাঁড়ালাম। পানিতে নামার কথা কেউ ভুলেও চিন্তা করছিলাম না।

ওয়েক
ঢালু হয়ে যাওয়া বিচে নীল সমুদ্রের পাশে ‘কালা’ হয়ে যাওয়া কতিপয় দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় সাবরিনা মেহজাবিন রাত্র)

খানিক দূর এগিয়ে সবাই ডাব কিনে খেলাম। দাম নেহায়েত কম ন্য। ২৫ রুপি করে রাখলো একেকটা। অল্পবিস্তর হাঁটাহাটি করে ছবিটবি তুলেই আমরা রওয়ানা দিয়ে দিলাম। আবার উঠে বসলাম সেই নৌকাটাতে। নৌকাতে যেতে যেতেই অন্য এক নৌকার দিকে আমাদের চোখ আটকে গেলো। সেই নৌকাটা বাইছে একজন সাদা চামড়ার পর্যটক। সাথে ওনার স্ত্রী বসে ছিলো। মহিলাটা বসা ছিলো হুইল চেয়ারে। লোকটা এবং মহিলাটা দুজনেই আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো। আমরাও পালটা হাত নাড়লাম। কত কষ্ট করে হলেও মানুষ আসে দূর দূরান্ত ঘুরতে। আর তাদের দুইজনে হাসিখুশি চেহারা দেখে মনে হলো, জীবনে সুখী হওয়ার জন্য আসলে মনটাই বড় ব্যাপার, অন্য কিছু নয়।

আচ
সেই পর্যটক আর হুইল চেয়ারে বসা ওনার স্ত্রী (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

জঙ্গল পার হয়ে আমরা এসে পড়লাম তীরে। সেখানেই হঠাৎ করে এক লোককে দেখে মনে হলো সৌরভের তামিল ভার্সন। আমরা এই নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাসাহাসি করলাম। এরপর দেখলাম অনেকেই উশখুশ করছে শহরে গিয়ে ‘রয়’ মুভিটা দেখে আসার জন্য। কিন্তু শহর কেমন করে যাওয়া হবে, মুভি দেখে কেমন করে সেখান থেকে ফেরত আসা হবে- এই নিয়ে নানা রকম চিন্তা ভাবনা হচ্ছিলো। আমরা সবাই উঠে বসলাম আমাদের বাসে। ধুমধাড়াক্কা গান ছেড়ে আমাদের বাস চলতে শুরু করলো। আমি জানালা দিয়ে দেখতে লাগলাম দুপাশের দৃশ্য। সাউথের ঘরবাড়িগুলো অনেক বেশি কারুকাজ করা আর রংচঙ্গে- ঠিক যেমনটা সিনেমায় দেখা যায়। মন্দিরগুলোতে অনেক অনেক মুর্তি। আবার মন্দির ছাড়াও অনেক চার্চ দেখলাম। আর যে দিকেই চোখ যায় শুধু নারিকেল গাছ আর নারিকেল গাছ। মনে হয় যেন পথেঘাটে ফ্রি নারিকেল পাওয়া যাবে। মাঝে অনেকেই শহরে নেমে গেলো। বাকিদের নিয়ে বাস আবার চলতে শুরু করলো।

বাস আমাদের নামিয়ে দিলো সেই ঢালের মাথায়। ততক্ষনে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাস থেকে নেমে আমি আর রুবাইদা এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করবো বলে ঠিক করলাম। কাছেই একটা শাড়ির দোকান পেয়ে ঢুকে গেলাম আমরা। ছোট দোকান হলেও ওনারা যত্ন নিয়ে শাড়ি দেখালো। দেখলাম যেটাকে আমরা শাড়ি ভেবে ভুল করেছি, সেটা আসলে শাড়ি নয়, সেটার নাম লাঙ্গা। বাচ্চা মেয়েদের জন্য লাঙ্গাগুলো দেখলাম- খুবই সুন্দর। আমরা অনেক্ষন দেখে টেখে বের হয়ে আসলাম। এরপর গেলাম একটা অত্যন্ত দামি দোকানে। দেখে মনে হলো আমাদের আড়ংয়ের মতন। অনেক সুন্দর সুন্দর সব জিনিসের অনেক দাম। আমরা চুপচাপ পুরোটা দেখে বের হয়ে আসলাম। কোথাও শান্তিমত শাড়ি দেখতে পাচ্ছি না। ঠিক করলাম পরেরদিন শহরে যাবো শাড়ির দোকান খুঁজতে। আমরা ঢালের দিকে ফেরত গেলাম। দেখলাম পুরো ঢালের বিশাল এলাকা জুড়েই লাইটিং হচ্ছে আর মাইক লাগানো হচ্ছে। আগামীকাল শিবরাত্রি- তারই জন্য এত আয়োজন। আর বিচের আগে আমাদের হোটেলের সামনেই একটা শিব মন্দির আছে। সেখান থেকেই এসব করা হচ্ছে।

আমরা হোটেলে ফিরে গেলাম। কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে গোসল সেরে আবার বের হয়ে পড়লাম বিচের উদ্দেশ্যে। রাতের বেলায় প্রাণ জুড়ানো ঠান্ডা বাতাসে বসে আমি আর রুবাইদা অনেক্ষন গল্প করলাম। কখনও বসে, কখনও দাঁড়িয়ে, কখনও হেঁটে। বিচের ঝলমলে রেস্টুরেন্ট আর সুভেনিয়র শপে আলোতেও আমরা ঘুরতে লাগলাম এ মাথা থেকে ও মাথায়। অন্ধকার সমুদ্রের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিলো- কি চমৎকারই না এই জীবন!

রাত বেশ গড়িয়ে গেলে আমি আর রুবাইদা উঠে পড়ি। চলে যাই সেই রেস্টুরেন্টে। পেটে তেমন খিদে ছিলো না। তাই অর্ডার দেই এগ নুডুলস। ১০০ রুপির এগ নুডুলসটা ভালোই ছিলো। নুডুলস শেষ করে একটা আইসক্রিমও খেলাম আমি। খেয়ে দেয়ে হোটেলে ফেরত গেলাম আমরা দুইজনে। অল্পক্ষনের মধ্যেই বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে দিলাম ঘুম।

 

 

The Mighty INDIA CALLING: ত্রিভান্দাম দিয়ে ‘দক্ষিণ’ এর যাত্রা শুরু (পর্ব ৩১)

গভীর ঘুমটা ভাংলো উর্মির ডাকে। আমি সবসমই দেরি করে ঘুম থেকে উঠি। ওরা উঠে গেছে অনেক আগেই। আমি না উঠলে উর্মি আর নিলয় ঠিকমত বসতে পারছে না। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে ডেকে দিলো উর্মি। চোখমুখ ডলে আড়মোড়া ভেঙ্গে আমি উঠে পড়লাম। জম্পেশ একটা ঘুম দিয়ে শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগতে লাগলো। আমি উঠে বসতেই উর্মির বাংকারটা ভাঁজ করে দিলো নিলয়। আমরা তিনজনে আরাম করে আমার সিটে বসলাম।

নিলয় জানালো গতরাতে ট্রেনের দুলুনিতে আমাদের সবার লাগেজ গড়িয়ে গড়িয়ে ট্রেনের করিডরে ছুটে চলে গিয়েছিলো। নিলয় টের পেয়ে উপরের বাংকার থেকে নেমে আসে। আমাদেরকে মরার মত ঘুমাতে দেখে ও একাই সবার লাগেজ টেনে   টেনে আবার জায়গা মত নিয়ে আসে। আমরা একজন অন্যজনের দিকে তাকালাম, এত কিছু হয়ে গেলো আর কিছুই টের পেলাম না?

সকালের নাস্তা কিনে নিলাম ডিম ভাজা আর পাউরুটির একটা বাক্স। ট্রেন একটা স্টেশনে থামতেই চিং ট্রেনের জানালা দিয়ে স্টেশনের এক ফেরিওয়ালার কাছ থেকে একটা প্যাকেট কিনলো। ট্রেন ছেড়ে দিতেই আমরা প্যাকেট খুলে দেখলাম ভিতরে পরোটা আর ভাজি। একদম গরম গরম পরোটা, আর ভাজিটাও খুব মজার। মনে হলো ট্রেনের নাশতা না কিনলেই ভালো হতো! কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা স্টেশনে ট্রেন থামতেই চিঙয়ের উপরের বাংকারে থাকা ভদ্রলোকটা আমাদের কাছ থেকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন। আমরাও হাসিমুখে ওনাকে বিদায় জানালাম। উনি চলে যাওয়ার পর আমরা ভালো করে চারপাশটা দেখলাম। মনে হলো আগের ট্রেন জার্নির মতই এবারও আমাদের খোপে সব মিলিয়ে আটটা সিটেই আমরা চারজন ছাড়া আর কেউ নাই। আমরা একেকজন একেক সিটে গিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বসলাম।

যখন বেলা বাড়লো, তখন ট্রেনের মাঝে সিল করে রাখা দরজাটা খুলে দিলো। ওই পাশ থেকে লোকজন এসে আমাদের সাথে দেখা সাক্ষাত করতে লাগলো। সবাই এসে বললো ‘তোদের খোপে তো বেশ আলো বাতাস আছে!’। একটু পর আমরাও ঘুরতে গেলাম ওদের খোপে। আসলেই ওদের বগিটা বেশ গরম আর তুলনামূলক অন্ধকার, কারণটা কি বুঝলাম না। ওরা সবাই মিলে খুব মজা করছে। আমাকে দেখে সবাই বললো এক পাঞ্জাবী আংকেল নাকি রাত্রির সাথে খুব খাতির জমিয়ে ফেলেছিল। ওরা দুজনে মিলে দারুন সব কথা বার্তা বলে সবাইকে হাসাতে হাসাতে অস্থির করে ফেলেছিলো। আমি খানিক্ষন রুবাইদার পাশে বসে গল্পগুজব করলাম। তারপর ফেরত এলাম আমাদের বগিতে। ওরা অনেকেই আমাদের বগিতে এসেছে গল্পগুজব করতে। আমাদের খোপের ইলেক্ট্রিক সকেটটা ঠিকমত কাজ করছিলো বলে ওরা অনেকেই এসে লাইন ধরে মোবাইল চার্জ দিতে লাগলো।

গল্পগুজব করতে করতে আমাদের দারুন সময় কাটছিলো। এর মধ্যে পেলাম দুঃসংবাদটা। নোভার ব্যাগটা চুরি হয়েছে। অনেক খোঁজাখুজির পর বাথরুমে ব্যাগটা পাওয়া গেলো কিন্তু ভিতরে বেশ কিছু রুপি ছাড়াও ওর দামি মোবাইল, পাওয়ার ব্যাংক ও ঘড়িটা মিসিং। চোর সস্তা মনে করে ওর দামি সানগ্লাসটা রেখে গিয়েছে- এটাই একমাত্র সান্ত্বনা। নোভা আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাপ্লিকেশন লিখে ট্রেনের পুলিশের কাছে জমা দিয়ে আসে। যদিও কোন লাভ হবে না, তারপরও…

এই ট্রেনে সাউথের লোকজনই বেশি। তাদের দেখতে বেশ মজা লাগে। মহিলারা খুব সুন্দর করে টাইট ফিট শাড়ি পরে। সাদা লুঙ্গি পরা লোকজনও দেখলাম। সবচেয়ে মজার হচ্ছে ওদের ভাষা। কি যে অদ্ভূত লাগে শুনতে! ফেরিওয়ালারাও কেমন করে যেন কথা বলে। একটু পর পর এক ফেরিওয়ালাকে দেখলাম ‘-বাডা-বাডা-বাডা-’ বলে কি সব জিনিস বিক্রি করতে। আমি আগ্রহ নিয়ে তাকালাম কি এই জিনিস ‘বাডা’ তাই দেখতে। দেখে মনে হলো পিয়াজুর বড় ভার্সন। আমার মনে হলো কথাটা আসলে ‘বড়া’, সেটাকেই ওদের ভাষায় বলা হচ্ছে ‘বাডা’। চারপাশের সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে আমাদের সময় চটপট কেটে যেতে লাগলো। এরমধ্যে আমি আর উর্মি খেয়ে নিলাম ৭০ রুপির ডিম বিরিয়ানি। দুপুর হয়ে আসতেই একজন অন্যজনকে সতর্ক করে দিতে লাগলো আমাদের স্টপেজ নাকি কাছাকাছি চলে এসেছে। আমরাও গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আমাদের আধা দিনের সংসার গোছাতে শুরু করলাম।

ট্রেন একটু পরপরই একেকটা স্টেশনে থামে আর আমরা উশখুশ করি, এটাই কি আমাদের স্টপেজ কিনা জানার জন্য। আমাদের স্টপেজের নাম কোচভেলি। পরপর অনেকগুলো স্টেশন পার হয়ে গেলো, কিন্তু কোনটাই আমাদের স্টেশন নয়। আমরা আবার টেনশনে পড়ে গেলাম- ভুল করলাম না তো। ঐপাশের বগি থেকে ফোন দিয়ে আমাদের জানায়- না, এখনো আসে নাই আমাদের কোচ ভেলি। এই করতে করতে কতগুলো আন্টি উঠে আসলো এক স্টেশন থেকে। আমি উনাদের কাছে গিয়ে ইংরেজিতে বললাম কোচভেলির কথা। ওনারা বললেন যে চিন্তা করার কিছু নাই, কোচ ভেলিই লাস্ট স্টপেজ। তাই ট্রেন ছেড়ে দিবে সেই ভয় নাই। আর উনারাও কোচ ভেলিতেই যাচ্ছেন। সামনেই আসবে সেটা। দেখতে দেখতে সোয়া তিনটার সময় আমাদের কোচভেলি চলে আসলো। ট্রেন থেমে গেলে আমরা চারজন সব মালপত্র নিয়ে নেমেও গেলাম। কিন্তু প্ল্যাটফর্মে নেমে আর কাউকে দেখতে পেলাম না। নিলয় অন্য সবাইকে ফোন দিলো। অনেক্ষণ পর একজন একজনকে নামতে দেখলাম। ওরা নাকি বুঝতেই পারে নাই কোচভেলি চলে এসেছে! যাই হোক ৪৬ জন মানুষের শ খানেক মালপত্র নিয়ে নামতে বেশ সময় লাগলো। নতুন স্টেশনের দিকে আগালে আমাদের নাকি উল্টা হবে। তাই কমিটি হোটেল ঠিক করতে যখন গেলো তখন মালপত্র নিয়ে আমরা প্ল্যাট ফর্মেই বসে রইলাম। পুরো প্ল্যাটফর্ম খালি, খালি আমরা দ্বিমিকবাসীরাই থেকে গেলাম। আমরা ওয়েটিং চেয়ারগুলোতে বসলাম। আমি সবার দিকে তাকিয়ে লক্ষ করতে লাগলাম, দীর্ঘদিন ভ্রমণের ছাপ পড়েছে সবার চোখেমুখে। সবারই গায়ের রঙ পুড়ে গেছে কয়েক পোচ। আর নোভাকে দেখলাম চোখমুখ লাল করে হাঁটতে। ওর নাকি জ্বর এসেছে। কি আশ্চর্য, ট্রেনে ওঠার সময় নোভা ফর্সা ছিলো আর ট্রেন থেকে নেমে ও হয়ে গেলো লাল!

আমরা অনেক্ষণ হাত পা এলিয়ে বসে ছিলাম। তারপর কে যেন বুদ্ধি দিলো, বসতে হলে ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসি না কেন? তারপর আমরা সবাই হাত পা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়লাম। যার যার মালপত্র নিয়ে সে সে প্ল্যাটফর্মের উল্টা দিকে হাঁটতে লাগলাম। দীর্ঘক্ষণ হাঁটার পর টের পেলাম স্টেশনে যেতে হলে আমাদের প্ল্যাটফর্ম বদলে পাশের প্ল্যাটফর্মে যেতে হবে। মাথায় তখন আমাদের বড়সড় বাজ পড়লো। কেমন করে এই প্ল্যাটফর্ম থেকে ওই প্ল্যাটফর্মে যাবো?

দেখা গেলো তিন ধরনের উপায় আছে। প্রথম উপায়টা হলো ওভার ব্রিজ। আমাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রায় বিশ ফুট উঁচু একটা ওভার ব্রিজ আছে যেটা পাশের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে নেমেছে। আমরা ওভার ব্রিজটা এক ঝলক দেখেই এই প্রস্তাব বাতিল করে দিলাম। এতগুলো মালপত্র নিয়ে এই উঁচু ওভার ব্রিজ পার হওয়া সম্ভব না। দ্বিতীয় উপায়টা হচ্ছে ট্রেন। প্ল্যাট ফর্মে এখনও আমাদের ট্রেনটা থেমে আছে। আর এইটার অন্য পাশে থেমে আছে আরও একটা ট্রেন। এই প্ল্যাটফর্ম থেকে মাল তুলে প্রথমে একটা ট্রেনে ঢুকতে হবে, তারপর সেটার অন্যপাশ দিয়ে নামতে হবে। তারপর ঐ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটায় উঠতে হবে, তারপর সেই ট্রেনটার অন্য পাশ দিয়ে নামলে কাংখিত প্ল্যাটফর্মটা পাওয়া যাবে! আমাদের অনেকেই সেই পদ্ধতিতে আগালো। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম পদ্ধতিটা কেমন। এর মধ্যে অবনী যেই উঠলো মালপত্র নিয়ে একটা ট্রেনে, ওমনি ট্রেনটা অল্প বিস্তর নড়তে লাগলো। আমরা পাগলের মত চিৎকার করতে লাগলাম অবনীর জন্য। অবনী তাড়াতাড়ি করে ওর মালপত্র ছুড়ে ফেলে নেমে গেলো সেই ট্রেন থেকে। আমরাও বুকে আটকে থাকা নিশ্বাসটা ছেড়ে দিলাম। অবনীর অবস্থা দেখে আমাদের কারও আর সাহস হলো না এইভাবে প্ল্যাটফর্ম পার হতে। আমরা সবাই তাই তিন নম্বর উপায়ের দিকেই গেলাম। তিন নম্বর উপায়টা হচ্ছে, প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় গিয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে দুই দুইটা রেল লাইন পার করে অন্য পাশের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে ওঠা। জিনিসটা যত সহজে বলা হয়ে গেলো, করাটা হলো তারচাইতে একশ গুণ কঠিন। পাকা উঁচু প্ল্যাটফর্ম থেকে নামার পরই মাটিতে আমাদের লাগেজের চাকা আটকে যেতে লাগলো। কোনমতে সেটা টেনে হিচড়ে নিয়ে রেললাইনের কাছে আনা হলো। তারপর ভারি লাগেজটা তুলে উঁচু একটা রেল পার করা হলো। তারপর দেখা গেলো পাথর আর কাঠের স্লিপারের কারণে লাগেজ নাড়ানোই যাচ্ছে না। পুরো ভারি লাগেজটাকে তুলে নিয়ে একটা আস্ত রেলাইন কোনমতে পার করা হলো। তারপর কয়েক সেকেন্ড দম ফেলেই আবার মাটির রাস্তায় নেমে পড়তে হলো। তারপর পরের রেললাইনটাও একইভাবে পার করা হলো। তারপর সিঁড়ি দিয়ে লাগেজ গুলো টেনে টেনে প্ল্যাটফর্মে তোলা হলো। কাঁধে হ্যান্ড ব্যাগ, পিঠে ব্যাকপ্যাক, হাতে ট্রলি ব্যাগ আর খাবার পানির প্যাকেট- সব কিছু নিয়ে যখন প্ল্যাটফর্মে উঠলাম তখন আমার পাঁজড় হাপড়ের মত উঠা নামা করছে। আমি হাঁপাতে হাঁপাতেই একবার তাকিয়ে দেখলাম, ওইপাশে উঁচু প্ল্যাটফর্মটা থেকে দুইটা রেল লাইন পার করে এতগুলো মালপত্র নিয়ে আমি এই পাশে কেমন করে আসলাম, ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না!

অমানুষিক কষ্ট করার পর সবাই গলদ্ঘর্ম হয়ে গুটি গুটি পায়ে আগাতে লাগলাম ওয়েটিং রুমের দিকে। সবাই ওয়েটিং রুমের চেয়ারগুলোতে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম। এই লাগেজ টানা নিয়ে প্রচন্ড পরিশ্রম গেছে আমাদের। এবার একটু বিশ্রাম না নিলেই নয়। একটু স্থির হয়ে সবাই খেয়াল করলাম, দুপুরের খাবার হজম হয়ে গেছে- কিছু খেয়ে নেওয়া প্রয়োজন। ওয়েটিং রুমের পাশেই ছোট একটা দোকান থেকে আমি পানি, কেক আর মিল্কিবার কিনে খেতে শুরু করলাম। খাওয়া দাওয়া শেষে একটু পরেই খবর পেলাম আমাদের হোটেল ঠিক হয়ে গেছে। আবার আমরা যার যার বাক্স প্যাটরা নিয়ে রওয়ানা দিলাম।

স্টেশন থেকে বের হয়ে দেখলাম কোন গাড়িঘোড়া নাই। কেমন যেন ফাঁকা রাস্তা। এর মধ্যে একটা একটা অটো আসলেই সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো। কয়েকজন মিলে একেকটা অটো ঠিক করতে লাগলো ৪০০ রুপি দিয়ে। এর মধ্যে অন্তরা কেমন করে যেন ২০০ রুপি দিয়ে একটা অটো ঠিক করে ফেললো। অটো ঠিক করে ফেলার পর শুরু হলো আমাদের মালপত্র উঠানোর সংগ্রাম। ছোট্ট একটা অটোতে মিম, অন্তরা, রুবাইদা আর আমার চারটা বড় লাগেজ, তিনটা ব্যাকপ্যাক আর সাথে অন্যান্য প্যাকেট এবং হ্যান্ড ব্যাগ- সব মিলিয়ে ১২-১৩টা মাল নিয়ে আমি, মিম আর অন্তরা উঠে পড়লাম। রুবাইদার জায়গা হলো না, ও ওর বাকি মালপত্র নিয়ে অন্য কারও সাথে যাবে বলে চলে গেলো। একটা ছোট অটোতে এতগুলো মাল আটানোর পর আমরা তিনজন মানুষ কেমন করে এটে গেলাম- এটা একটা ব্যাপক রহস্য! মিম একটা বড় লাগেজ নিয়ে ড্রাইভারের পাশে কোনরকম বসলো। আমি আর অন্তরা বাকিসব লাগেজের ফাঁকে কোনরকমে বসতে পারলাম। আমার হাঁটুটা বারবার অটো থেকে বাইরে বের হয়ে যাচ্ছিলো। আমি হাত দিয়ে প্রাণপণে হাঁটুটা টেনে ভিতরে ঢুকানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। এই করতে করতেই আমাদের অটোটা ছেড়ে দিলো। এত ওজন নিয়ে অটোটা নড়াচড়া যে করতে পারলো, সেটাই বিশাল ব্যাপার!

আমি আর অন্তরা কুন্ডুলী পাকিয়ে একে অন্যকে জড়াজড়ি করে বসে রইলাম। পুরো ফাঁকা রাস্তা দিয়ে আমাদের অটো শাঁ শাঁ করে চলতে লাগলো। মাঝে মাঝে দেখতে পাচ্ছিলাম অন্য অটোতে আমাদের লোকজনদের। ওদের অবস্থাও আমাদের মতই। এর মধ্যে এক সিগ্নালে আমাদের অটোগুলো পাশাপাশি থামলো। অটোওয়ালা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলো যে আমরা একই সাথে যাচ্ছি। তাই উনি গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন ভাড়া কত করে। অপর অটোওয়ালা জবাব দিলো ৪০০ রুপি করে। আমাদের অটোওয়ালা কিছু বললো না। অন্তরা সব দেখে বললো, ‘ব্যাটা মনে হয় ৪০০ রুপিই নিবে’। আমাদের অটো চলতেই লাগলো। ফাঁকা ফাঁকা পথঘাট পেরিয়ে আমরা যেতে লাগলাম। আমি একবার অন্তরাকে বললাম গুগল ম্যাপে একটু দেখে নেওয়ার জন্য। কিন্তু অন্তরা জানিয়ে দিলো যে মোবাইল পর্যন্ত হাতটা পৌঁছানোর কোন জায়গা নাই। তাই আমরা আল্লাহর ভরসায় চলতে লাগলাম।

প্রায় ঘন্টা খানেক পর যখন গুটিসুটি মেরে থাকতে থাকতে আমাদের হাঁটু, কোমর, ঘাড়, কনুই টনটন করতে লাগলো তখন মনে হলো আমরা কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। হঠাৎ দেখি কমিটির লোকজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ওরা পথ দেখিয়ে দিলো। তারপর হঠাৎ করেই আমরা একটা ঢাল বেয়ে নামতে লাগলাম। আমাদের বুক ধুকপুক করতে লাগলো। এত মালপত্র সমেত অটোটা এমনিতেই ইমব্যালেন্সড, তার উপর খাড়া ঢাল, সামলাতে পারবে তো? আমি আর অন্তরা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়তে লাগলাম। আমাদের অটো প্রচন্ড বেগে ঢাল বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। আমরা রক্তশূন্য মুখে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। হঠাৎ একটা গেটের সামনে ঘ্যাঁচ করে আমাদের অটোটা থামলো। আমি গলা বের করে দেখলাম ইশ্তিয়াক দাঁড়িয়ে আছে। ও জিজ্ঞেস করলো, ‘তোরা কারা কারা আছিস?’ । আমি বললাম আমাদের কথা। ইশতিয়াক বললো, ‘তোদের রুম সামনের হোটেলে’। এমন সময় দেখলাম মজুমদার, মৌলিও একটা অটো থেকে নেমে এই হোটেলে ঢুকছে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি তো এই হোটেলে, তাই না?’। ইশতিয়াক মাথা নেড়ে বলতে লাগলো, ‘সামনের হোটেলে, সামনের হোটেলে-‘। আমি আর কথা বাড়ালাম না। আরও ঢাল বেয়ে আমাদের অটো নামতে লাগলো। তারপর ঢালের মধ্যেই বামদিকে বিশাল একটা টার্ন নিলো। আমাদের বুক ধক করে উঠলো। তারপর আরেকটা হোটেলের সামনে গিয়ে আমাদের অটো থামলো। সেটার নিচে জুবায়ের দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ভাড়া দেওয়ার সময় অটোওয়ালা আমাদের কাছে ৪০০ রুপি দাবি করে বসলো। আমাদের কিছু করার নেই, অন্য সবাইই ৪০০ রুপি দিয়েছে। আমরাও তাই দিলাম। তারপর মাল টেনে টেনে জুবায়েরের কাছে আসতেই জুবায়ের বললো, মিম আর অন্তরার রুম এই হোটেলে কিন্তু আর আমার আর রুবাইদার রুম আগের হোটেলটায়, যেটা আমরা পার হয়ে এসেছি। আমি ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলাম। এখন আমি কেমন করে ঢাল বেয়ে যাবো? শুধু আমার লাগেজ হলেও না হয় কথা ছিলো। সাথে রুবাইদারটাও আছে। কি করবো?

জুবায়ের বললো, ‘দাঁড়া, কোনটা কোনটা লাগেজ বল, সব টেনে দিচ্ছি’। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম, এই ঢাল বেয়ে ‘সব’ লাগেজ তুলে দেওয়ার অফার কেউ দিতে পারে- এটা আমি ভাবতেও পারি নাই। এমন সময় রাজিব যেন আসলো কোথা থেকে। জুবায়ের ওকে বললো আমাকে হেল্প করতে। ও একটা কথাও না বলে দুইটা লাগেজের হ্যান্ডেল ধরে ফেললো। আমি বললাম, ‘আমার লাগেজ আমি নিজেই নিতে পারবো, তুই শুধু রুবাইদারটা টেনে দে, তাহলেই হবে’। রাজিব রুবাইদার লাগেজটা ধরে শক্ত হাতে টেনে নিয়ে ঢাল বেয়ে উঠতে লাগলো। এমনিতে সমতলে লাগেজ টানাই ঝামেলা তার উপর এখন ঢাল। হ্যান্ড ব্যাগ, ব্যাকপ্যাক, খাবারের প্যাকেট আর ট্রলি টেনে টেনে ঢাল বেয়ে উঠতে উঠতে আমার ভীষণ পরিশ্রম হচ্ছিলো। পায়ের মাংসপেশী টনটন করতে লাগলো, হাতের আঙ্গুল্গুলোতো মনে হচ্ছিলো ছিঁড়ে আলাদা হয়ে যাবে। প্রচন্ড পরিশ্রমে আমার চোখমুখ লাল হয়ে গেলো। জোরেজোরে নিশ্বাস নিতে লাগলাম, মনে হচ্ছিলো এই ঢাল বেয়ে ওঠা কোনদিন শেষ হবে না। অথচ খুব বেশি দূরেরও কোন রাস্তা না, সমতল হলে হয়তো তিন মিনিট লাগতো হেঁটে যেতে। আমি সামনে রাজিবকে দেখতে লাগলাম ধীর পায়ে রুবাইদার ব্যাগটা টেনে টেনে যেতে লাগলো। আমিও দাঁতে দাঁত কামড়ে উঠতে লাগলাম ঢাল বেয়ে।

অবশেষে হোটেলের সামনে এসে থামলাম। রাজিব হাঁপাতে হাঁপাতে রুবাইদার লাগেজটা রেখে দিলো। আমি ওকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম। তারপর টেনে টেনে আমি সব মালপত্র নিয়ে আমাদের একতলার রুমে এসে পড়লাম। এসেই হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় গিয়ে ফ্ল্যাট হয়ে পড়ে গেলাম। মজুমদার আর মৌলি গোসলের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। এর মধ্যেই রুবাইদা ওর বাকি মাল সমেত রুমে এসে ঢুকলো। আমি একটু ধাতস্ত হয়ে লক্ষ করলাম আমার রুমটা। খুব বেশি বড় নয়, কিন্তু সুন্দর রুম। সাথে একটা মাঝারি বারান্দাও আছে। সেখানে একটা টি টেবিল আর দুইটা চেয়ার। সব দেখেটেখে আমার রুমটা পছন্দ হলো।

গোসল শেষে মৌলি আর মজুমদার বের হয়ে যায়। এরপর আমি গোসলে ঢুকি। রুবাইদা ওর বিশাল হ্যাভারস্যাকটা খুলে জামা কাপড় বের করতে থাকে। গোসল থেকে বের হয়ে আমি ধোয়া কাপড়গুলো বারান্দা টি টেবিল আর চেয়ারের উপর মেলে দেই। অপেক্ষা করি রুবাইদার গোসল শেষ হওয়ার জন্য। খেয়াল করি, রুবাইদা সব কিছুতেই কেমন যেন নিরুৎসাহী হয়ে গেছে। এই ত্রিভান্দাম আসার পরই দেশে যাবার জন্য রুবাইদার মন যেন একেবারেই ছুটে গেছে। কোন কিছুতেই ওর আর কোন আগ্রহ নাই।

রুবাইদার গোসল শেষ হলে আমরা বের হই। ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে। যদিও বিচ কাছেই তারপরও এই রাতের বেলা কেন যেন বিচে যেতে ইচ্ছা হলো না। যে ঢালু রাস্তায় আমাদের হোটেল তার নাম ‘হিল অ্যান্ড সি ভিউ রিসোর্ট রোড’। এই রোডের দুই পাশে অনেক দোকানপাট। সবগুলোতেই জয়পুরে দেখে আসা সেই পায়জামা ঝুলছে। আর ধারে কাছে বিচ আছে বলে সব দোকানেই সাজানো আছে স্যান্ডেল, হাফ প্যান্ট, হ্যাট- এইসব জিনিসপত্র। আমরা একেকটা দোকান ঢুকে দেখছিলাম। জিনিসগুলো খুবই সুন্দর, জয়পুরের চাইতে মান অনেক ভালো। জয়পুরের জিনিসগুলো দেখে পছন্দ করা মুশকিল, কিন্তু এখানে জিনিসগুলো সহজেই পছন্দ হয়ে যায়। তবে দামও জয়পুরের চাইতে কয়েকগুণ বেশি। আমার মনে পড়লো কমিটির সাজেশন। দেশে থাকতেই কমিটি আমাদের সবসময় সাউথে খরচ করার জন্য ভালো অ্যামাউন্টের টাকা রেখে দিতে বলতো, কারণ সাউথে নাকি সবকিছুর দাম বেশি। আর সাউথের সব জায়গায় ওরা আমাদের ভাষা বুঝবে না এবং ওদের সব খাবার খাওয়াও যায় না। তাই সাউথে খেতে হলে একটু ভালো মানের দোকানে খেতে হবে যেখানে ওরা ইংরেজি বা হিন্দি বুঝবে। আমরা বেশ কয়েকটা দোকান ঘুরে ঘুরে দেখলাম। তারপর হেঁটে হেঁটে ঢালু মোড়টা পার হয়ে আমাদের বাকি লোকজন আছে যেই হোটেলে তার সামনে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। চমৎকার খোলামেলা রেস্টুরেন্ট। আমরা একেবারে শেষের দিকে বেতের চেয়ার টান দিয়ে একটা টেবিল দখল করে দুইজনে বসলাম। রেস্টুরেন্টের দাম আমাদের কাছে মোটামুটি সহনীয় মনে হলো। আমরা অর্ডার দিলাম ৭০ রুপির টমেটো রাইস আর ২০০ রুপির গ্রিল ফিশ। বেশিক্ষণ সময় লাগলো না। একটু পরেই চলে এলো আমাদের খাবার। লাল রঙের টমেটো দিয়ে ফ্রাই করা ভাত খেতে ভালোই লাগলো। আর মাছটাও অনেক মজা। আমরা দুইজনে সময় নিয়ে তৃপ্তি করে খেলাম।

এফ
সূর্য ডোবার ঠিক আগে কোভালাম বিচে (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

খেয়ে দেয়ে আমরা বের হয়ে গেলাম। এবার যেতে লাগলাম বিচের দিকে। সেই ঢালু মোড়টা থেকে বাঁক না নিয়ে সোজা গেলেই সামনে পড়বে সমুদ্র। রাত হয়ে যাওয়ায় অনেক দোকানপাটই বন্ধ হয়ে গেছে। তবে রাস্তাগুলো শুনশান নিরব না। মানুষজন আছে, আর পরিবেশটা ভালো। আমরা দুইজন একটা মন্দির পার হয়ে সামনে এগিয়ে বিচে চলে গেলাম। বিচটা মোটেও অন্ধকার না। বেশ আলো আছে। কারণ বিচের একেবারে কাছেই সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে দামি দামি দোকানপাট আর রেস্টুরেন্ট। তাদের ঝলমলে আলো বিচটাকে অন্ধকার থাকতে দিচ্ছে না। অদ্ভূত ব্যাপার হচ্ছে, বিচটা ঢালু। কেমন যেন উল্টানো বাটির মত। আমরা বেশিদূর গেলাম না। বালির উপর বসে অনেক্ষণ গল্পগুজব করলাম নানা বিষয় নিয়ে। খানিকদূর হেঁটেও আসলাম বিচ ধরে। তুষারের সাথে দেখা হলো এর মধ্যে, উদাস মনে হাঁটাহাঁটি করছে ও। ঝলমলে দোকানপাট, ঠান্ডা লোনা বাতাস আর সমুদ্রের গর্জনে ভালোই লাগছিলো আমাদের। একসময় ঘড়ি দেখে উঠে পড়লাম আমরা। রাত হয়েছে, হোটেলে ফেরা দরকার।

হোটেলে ফিরেই দেশে ফোন দিলাম। কথা বললাম আম্মুর সাথে। প্রতি রাতেই দেই। তবে আজকে বললাম একটু বেশি সময় ধরে। এর মধ্যে মজুমদার আর মৌলি চলে আসলো। এমনিতেই আমরা ক্লান্ত ছিলাম। সারা দিন কম পরিশ্রম যায় নাই আমাদের। তাই ঘুমাতে একটুও দেরি হলো না। ফ্যানটা ছেড়ে লম্বা হয়ে শুয়ে দিলাম ঘুম। গাঢ় ঘুম।