The Mighty INDIA CALLING: পুনরায় দিল্লীতে এবং একটি মন্দির ও দরগা দর্শন (পর্ব ১৪)

দিনে যখন ঘুম ভাংলো, তখন ঘাড় আর কোমরে টনটনে ব্যাথা। ঘাড় মালিশ করতে করতে ছোট্ট সিটের মধ্যে নিজের পা টা মেলে ধরার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু তেমন কোন লাভ হচ্ছিলো না। আর বাসও টানা চলছিলো। থামাথামির যেন কোন বালাই নেই। বাসে গ্যাট মেরে বসে থাকা ছাড়া আর কোন উপায়ও ছিলো না। কি আর করা, আমরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করতে লাগলাম।

প্রায় দুপুর ১২টার দিকে আমরা দিল্লী পৌঁছালাম। সেই আগের ইউ কে হোটেলে উঠি। কিন্তু এইবার আমরা বরাদ্দ পাই সব পচা পচা রুম। প্রথমে আমরা একটা রুমে যাই, সেটার বাথরুম থেকে বোঁটকা এক রকম গন্ধ বের হচ্ছিলো। তাড়াতাড়ি সেইটা বদলে আমরা আরেকটা রুমে উঠি। এই রুমটা অনেক ছোট। রুমে আমাদের লাগেজ গুলো রাখার পর আর তেমন জায়গাই ছিলো না। আর বাথরুমটা খুবই পচা। সেটাতে টিমটিম করে একটা হলুদ লাইট জ্বলছিলো যেটা ভিতরের পরিবেশকে আরও জঘন্য করে দিচ্ছিলো। আমরা রুম পেয়ে খুব মন খারাপ করলাম। কিন্তু কি আর করা, হোটেল মালিক যে এরকম ধড়িবাজ সেটা কি আর আগে জানতাম? ওরা সবাই ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে। আমি মৌলির হিটারটা দিয়ে পানি গরম করে নেই। গোসল করতে গিয়ে আমার গা ঘিনঘিন করছিলো। কোনমতে তাড়াতাড়ি করে বাথরুম থেকে বের হই।

আগের সারাদিনে আমি শুধু একটা স্যান্ডুইচ আর এক প্যাকেট চিপস খেয়ে ছিলাম। আর সকালেও কিছু খাওয়া হয় নাই। আমরা তাই তাড়াতাড়ি করে বের হই খাওয়ার জন্য। হোটেলের কাছেই একটা দোকানে চিকেন বিরিয়ানি পাওয়া যাচ্ছিলো। লোকটা হালাল বলাতে ৪০ রুপি দিয়ে এক প্লেট চিকেন বিরিয়ানি অর্ডার দেই। পিয়াজের টুকরা দিয়ে সাজিয়ে এক প্লেট বিরিয়ানি এসে হাজির হয় সামনে। আমি গোগ্রাসে খাই। খাওয়া দাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে আমরা বের হয়ে আসি। আমরা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই অক্ষরধাম টেম্পল। কিভাবে যাবো জানতে চাইলে একেকজন একেক রকম কথা বলে। দিল্লীর লোকজনকে কোন কথা জিজ্ঞেস করে লাভ নাই বুঝে আমরা ট্রাফিককে জিজ্ঞেস করি যে কেমন করে অক্ষরধাম টেম্পলে যাওয়া যেতে পারে।

আমরা ৬০ রুপি দিয়ে আগের মত অটো ভাড়া করে রাজিব চকে যাই। সেখান থেকে আগের বার যে মেট্রো স্টেশনে গিয়েছিলাম সেখানে যাই। টোকেন কাটি অক্ষরধামের। মেট্রো আসতেই ঠিক ঠিক চড়ে বসি। সব মেট্রো পাতাল দিয়ে যায়, কিন্তু এই মেট্রো হঠাৎ করে পাতাল ফুঁড়ে আকাশে উঠে গেলো। ঝলমলে দিনের আলোয় নিচে দেখা গেলো দিল্লী শহর। একটু পর পর অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছিলো একেকটা স্টপেজের। আমরা কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করছিলাম কোন স্টপেজের কথা বলে। একটু পর পর খেয়াল করছিলাম আমাদের স্টপেজ আসে কিনা। আমাদের অবস্থা দেখে একজন জিজ্ঞেস করে আমরা কোথায় যাবো। অক্ষরধাম যাবো শুনে উনি বলে আপনাদের তো মেট্রো মাঝে বদলাতে হবে। শুনে আমরা ভয় পেয়ে যাই, কারণ এমন কথা আমাদের স্টেশন থেকে কেউ বলে দেয় নাই। উনি আমাদের বোঝাতে থাকেন যে, যমুনা ব্যাংক স্টপেজে আমাদের নেমে যেতে হবে, তারপর আরেকটা মেট্রোতে করে সোজা যাওয়া যাবে অক্ষরধাম। উনার কথায় আশেপাশের অনেকেই সায় দেয়। আমরা বলি যে আমাদের একটাই টোকেন। উনারা বলে এই এক টোকেনেই যাওয়া যাবে, নতুন করে ভাড়া দিতে হবে না। দিল্লীর মানুষের কথায় বিশ্বাস করাটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছলাম না। এছাড়া মেট্রোর ম্যাপ চেক করে দেখলাম ওনাদের কথার সাথে মিলে যাচ্ছে বিষয়গুলো, যা আছে কপালে ‘ফী আমানিল্লাহ’ বলে নেমে পড়লাম যমুনা ব্যাংক স্টপেজে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দেখি অন্য পাশে আর কোন মেট্রো নাই। মনে মনে আল্লাহ, আল্লাহ করতে লাগলাম। এমন সময় হুউউশ করে একটা মেট্রো আসলো। আমরা সেটাতে উঠে পড়লাম। সেটা সত্যিই আমাদের অক্ষরধাম নামিয়ে দিলো। মেট্রো থেকে নেমে দেখি সারা, রাত্রি, বাসিরুন, সুমাইয়া ওদেরকে। সারা বলতে লাগলো, ‘সাহস খুব বেড়ে গেছে রে, মেট্রোতে উঠে আবার মেট্রো চেঞ্জ করে অক্ষরধাম পৌঁছে গেলাম, সাহস খুব বেশী বেড়ে      গেছে রে-’

মেট্রো স্টেশন থেকে বের হয়ে আমরা খোলা আকাশের নিচে এসে পড়লাম। এই জায়গার নাম অক্ষরধাম। এখন মন্দিরটা  কই আছে খুঁজে বের করতে হবে। আমরা কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করলাম। সবাই রাস্তা দেখিয়ে দিলো। মোটেও দূর না। হাঁটা পথ। আমরা রাস্তা পার হয়ে পৌঁছে গেলাম অক্ষরধাম মন্দিরে। গেটে ঢুকার সময় সেই লেভেলের কড়াকড়ি। আমরা সবাই লাইন ধরে এক এক লেয়ারের সিকিউরিটি পার হয়ে হয়ে যেতে লাগলাম। এক জায়গায় আমাদের সবার ব্যাগ জমা নিয়ে নিলো। ক্যামেরা, মোবাইল ফোন, সোয়েটার- সব কিছু জমা দিয়ে প্রায় খালি হাতে আমরা শেষ নিরাপত্তা স্তরে প্রবেশ করলাম। এবার আমাদের সবার চেকিং চললো। আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বারবার প্যান্টের পকেট থাবড়ে থাবড়ে চেক করতে লাগলো। এক পর্যায়ে সারা বেশ চেতেমেতে সিকিউরিটি মহিলাকে ঝাড়ি মেরে দিলো। অবশেষে সব নিরাপত্তা স্তর পার হয়ে আমরা ভিতরে ঢুকলাম।

ভিতরে আলিশান ব্যাপার স্যাপার। চার পাঁচটা অত্যন্ত কারুকাজ করা গেট পার হতে হতেই আমাদের চোয়াল ঝুলে পড়লো। দুটা ময়ুর গেটের মাঝখানে অল্প পানির পুলের মধ্যে বিশাল দুইটা নকশা কাটা পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম। তাতে অনেক পয়সা জমে আছে। জানতে পারলাম, এটা হলো স্বামী নারায়নের পায়ের ছাপের রেপ্লিকা। বিশাল রাস্তার শেষ মাথায় অনেক উঁচুতে অনেক কারুকাজ করা নয় গম্বুজের লাল পাথরের মন্দিরটা দেখা যায়। আমরা সে দিকে হাঁটতে লাগলাম। আরও কিছুদূর হেঁটে জুতা জোড়া জমা দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম মন্দিরে ঢোকার জন্য। এতো এতো অলংকরন দেখতে দেখতে মাথা ঘুরে যায়। যা বুঝলাম মন্দিরটা নতুন কিন্তু বানানো হয়েছে পুরানো টেকনোলজি কাজে লাগিয়ে। পুরাই পাথরের মন্দির, কোন আরসিসি নাই। আর পাথরের দেয়াল কুঁদেই লাখ খানেক ছোট বড় দেব দেবীর মুর্তি, ফুল পাতা, পশু পাখি এইসব বানানো হয়েছে।

মেইন মন্দিরে ঢুকে আমার মনে হলো এইটা যতটা না মন্দির, তার চেয়ে বেশি জাদুঘর বা এক্সিবিশন সেন্টার। গর্ভগৃহের মাঝখানে স্বামী নারায়নের বিশাল চোখ ঝলসানো সোনালি মুর্তি। আর বড় মুর্তিটার চারপাশে সাইজে ছোট আরও কয়েক জনের একই রকম সোনালি মুর্তি। দেখে মনে হলো সোনার তৈরি। আর গর্ভগৃহটা সোনালি রুপালি রঙের এতো বেশি কারুকাজমন্ডিত ছিলো যেটা দেখে আমার ইউরোপের বারোকো স্টাইলের কথা মনে পড়ে গেলো। স্বামী নারায়নের বড় মুর্তি ছাড়াও রাধা কৃষ্ণা, লক্ষী-নারায়ন, রাম-সীতা, শিব-পার্বতীরও মুর্তি ছিলো। সবগুলো মুর্তিই লাইটিঙ্গের কারণে ঝকঝক করছিলো। আমরা চারপাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। দেয়ালে ছবির মাধ্যমে অনেক ইতিহাস বর্ননা করা আছে। এক পাশে স্বামী নারায়নের ব্যবহার্য জিনিস যেমন জামা, মালা, পায়ের ছাপ এইসব সাজানো আছে। সব কিছু দেখে আমরা মেইন মন্দির থেকে বের হয়ে আসলাম। হেঁটে হেঁটে জুতা ফেরত নিয়ে আমরা অন্য দিকে গেলাম।

কতগুলো শো আছে যেগুলো টিকেট কেটে দেখতে হয়। শো দেখতে গেলে আমাদের দেরি হয়ে যাবে বলে আমরা শো দেখতে গেলাম না। আমরা সহজ আনন্দ নামের স্টেপ ওয়েল দেখলাম যেখানে সন্ধ্যার পর নয়নাভিরাম লেজার শো হয়। তারপর দেখলাম অভিষেক মন্দির। জানলাম, এখানে স্বামী নারায়নের কৈশর কালের মুর্তির উপর মন্ত্রপূত পানি ঢাললে মনের আশা পূরন হয়। আমি যখন দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেই যচ্ছিলাম তখন রুবাইদা আমার কাঁধ খামচে ধরলো। আমি কাঁচের জানালা দিয়ে ভিতরে তাকিয়ে দেখি ভিতরে সবাই বসে চোখ বন্ধ করে মন্ত্রের তালে তালে ডানে বামে ঝুঁকছে। এই অবস্থায় আমি ভিতরে ঢুকে পড়লে সেটা খুব বিব্রতকর অবস্থা হতো সবার জন্যই।  আল্লাহ বাচিঁয়ে দিয়েছেন আমাকে। তারপর আমরা দেখি লোটাস গার্ডেন। তারপর হাঁটতে হাঁটতে আমরা কতগুলো চমৎকার ফুড কোর্ট, সুভেনিয়র সুপার শপ পার হয়ে যখন বের হবার রাস্তা খুঁজতে লাগলাম, ততক্ষনে সূর্য প্রায় ডুবে যায় যায় অবস্থা। এরই মধ্যে এখানকার বাথরুমে আমার সানগ্লাসটা হারিয়ে ফেলায় মন বেশ খারাপ ছিলো। আর অন্ধকার নামার সাথে সাথেই শীত জাঁকিয়ে পড়তে লাগলো। আমার সব এক্সট্রা সোয়েটার ঢোকার সময় জমা দিয়ে ফেলেছিলাম। তাই তাড়াহুড়া করে বের হবার চেষ্টা করতে থাকি। পরে মনে পড়ে আমাদের টোকেন সারার কাছে। গেটের কাছাকাছি পৌঁছে সবার জন্য অপেক্ষা করতে করতে এক সময় সারাকে খুঁজে পাই। তাড়াতাড়ি করে ব্যাগ ফেরত নিয়ে সোয়েটার, মাফলার আর হাত মোজা পরে ফেলি।

এবার সবার সাথে আলোচনা করতে থাকি কোথায় যাওয়া যেতে পারে নেক্সট- এই সব নিয়ে। সিদ্ধান্ত হলো নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগায় যাওয়া হবে। আমরা বের হয়ে ট্যাক্সি ঠিক করার চেষ্টা করতে থাকি, কিন্তু ট্যাক্সির বদলে মাইক্রোবাস এসে হাজির হয়। আমরা দরাদরি করে যা আছে কপালে বলে উঠে পড়ি মাইক্রোতে। আমি আর সারা গাদা গাদি করে পিছনে বসি। সারা আবার মাথা নেড়ে আমাকে বলতে থাকে, ‘সাহস খুব বেড়ে গেছে রে, মাইক্রোতে করে কয়েকজন মেয়ে মিলে অপরিচিত শহরে রাতের বেলা দরগায় যাচ্ছি, সাহস খুব বেশী বেড়ে গেছে রে-’।  আমিও ভেবে দেখলাম, ঢাকা শহরেও আমার এরকম রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাইক্রো ভাড়া করে অপরিচিত জায়গায় যাওয়ার সাহস হবে না। আর এখন……

দরগার কাছাকাছি একটা জায়গায় এনে আমাদের নামিয়ে দিলো মাইক্রো বাস। পার হেড ভাড়া পড়লো ৪০ রুপি। আমরা নেমে চিপা গলি দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। দুপাশে খাবার দোকান। কাবাব ভাজা হচ্ছে, মাংস ঝলসানো হচ্ছে, বিশাল বিশাল কড়াইয়ে শত শত লালমোহন মিষ্টি ডুবিয়ে জ্বাল দেওয়ায় হচ্ছে- এই শীতের মধ্যে এই রকম ধোঁয়া ওঠা খাবারের দোকান পার হতে গিয়ে আমাদের সবারই খিদে লেগে গেলো। আমরা ঠিক করলাম ফেরার সময় পেট ভরে খেয়ে নিবো। রাস্তার ধারে নানা রকমের পসরা সাজিয়ে বসেছে লোকজন। এলুমিনিয়ামের বাটি থেকে শুরু করে আতরের শিশি কি নাই সেখানে! সব কিছুই দামে সস্তা। কে জানি একটা ছোট্ট এলুমিনিয়ামের বদনা কিনলো। এই সব দেখতে দেখতে আমরা হাঁটতে লাগলাম। আস্তে আস্তে একেবারে বাজারের মত জায়গায় ঢুকে গেলাম। লোক জনের হাঁকডাক বাড়তে লাগলো। দুইপাশের দোকান গুলোতে থালা ভর্তি ফুল, মোমবাতি, গোলাপ জল, আগরবাতি, লাল সুতা, জরি দেওয়া কাপড় এইসব সাজিয়ে রেখেছে। আর আমাদের চিৎকার করে বলতে লাগলো স্যান্ডেল খুলে জমা দিয়ে ভিতরে যেতে। যারা আগে কখনো দরগায় যায় নাই তারা লোকজনের এই রকম আচরন দেখে নার্ভাস হয়ে গেলো। আমরা কয়েকজন মিলে ঐসব লোকদের ধমক ধামক উপেক্ষা করে হাঁটতে লাগলাম। যতই সামনে যেতে লাগলাম ততই লোকজন আমাদের ধরেবেঁধে ওই সব থালা কিনতে বাধ্য করার চেষ্টা করতে লাগলো। আমরা সবশেষে একেবারে বাজারের শেষ মাথায় এসে জুতা খুললাম। ওইখানে এক দোকানে জুতা জমা দিয়ে ঢুকলাম দরগার উঠানে।

একটা ছবি থেকে তোলা নিজামুদ্দিন দরগার এরিয়াল ভিউ
একটা ছবি থেকে তোলা নিজামুদ্দিন দরগার এরিয়াল ভিউ

এই দরগার খোলা জায়গা গুলো টুকরা টুকরা। আর সারা উঠান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কবর। মনে হলো উনারা যে যেই জায়গায় মারা গিয়েছিলেন ঠিক সেই জায়গাতেই উনাদের কবর দেওয়া হয়েছে। আমরা সাবধানে কবর পাশ কাটিয়ে হেঁটে হেঁটে নিজামুদ্দিনের দরগার সামনে আসলাম। খুব সুন্দর সাদা রঙয়ের পাথরের উপর সোনালি কারুকাজ করা দরগা। ছেলেরা ভিতরে সেই থালা নিয়ে ঢুকছে। আর বাইরে চারপাশে ভীড় করে বসে মহিলারা মোনাজাত করছে, কুরআন শরীফ পড়ছে, কাউকে মনে হলো সেজদা দিতেও দেখলাম। চারিদিকে লাল সুতার সমাহার। দরগার সামনে ছোট উঠানটা জুড়ে কাওয়ালি গানের আসর বসেছে। একজন গায়ক হারমোনিয়াম বাজিয়ে জোর গলায় গান করছে আর তার সাথে অনেকেই ঝুনঝুনি, খঞ্জনি এইসব বাজিয়ে সুর দিচ্ছে। পুরা উঠান জুড়ে লোকজন ভীড় করে গান শুনছে। কেউ কেউ আবেগে মাথা নাড়ছে, হাতে তালি দিচ্ছে। আমার মনে হলো আমাদের দেশে মাজার যেমন শান্ত, নিরিবিলি জায়গা, ইন্ডিয়াতে মাজার বেশ উৎসবমুখর জায়গা। এত বড় একজন আউলিয়ার মাজারের পাশেই উচ্চস্বরে গান বাজনা হচ্ছে ব্যাপারটা দেখে আমার খুব কষ্ট লাগলো। চারিদিকে পুরাই বিদাতি পরিবেশ। এর মাঝে একটু নফল নামাজ পড়া যাবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। তবে খুঁজে পেলাম মেয়েদের নামাজের জায়গা। বলতে গেলে সেটা পুরাই খালি। যাই হোক আমি কোন মতে দু রাকাত নফল নামাজ পড়েই বের হয়ে আসলাম। দেখি কাওয়ালির আসর ভেঙ্গে গিয়েছে। সবাইকে নকুলদানা শিন্নি হিসেবে দেওয়া হয়েছে। আমিও সেই শিন্নির ভাগ পেলাম। লোকজনের হৈচৈ চিৎকার শুনে মনে হলো যেন কোন মেলার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি।

আবার রাত নয়টার সময় শুরু হবে কাওয়ালি। তার আগেই ঘুরেফিরে আমরা বের হয়ে যাওয়ার প্ল্যান করলাম। রাতের বেলায় খুব বেশি ঘোরাঘুরি করতে ইচ্ছা করলো না।  এমনিতেও পরিবেশটা শান্ত নয়, তাই আমরা বের হয়ে এলাম। সেই চিপা বাজারের রাস্তা দিয়ে আবার হেঁটে হেঁটে বাইরে চলে আসলাম। এক লোক দেখলাম ছোট ছোট শিক কাবাব বিক্রি করছে। আমরা ২০ রুপি দিয়ে ৪টা শিক কাবাব কিনে খেলাম। খুব বেশি মজা লাগলো না। পরে ঘোরাঘুরি করে এক হোটেলের দোতলায় উঠে বসলাম। সেই হোটেলে আমরা ছাড়া আর কোন মেয়ে নাই। সারা এলাকাতেই অবশ্য আমরা ছাড়া তেমন কোন  মেয়েই ছিলো না। আমরা আরাম করে বসে নানা রকম আইটেম অর্ডার দিলাম।  গল্পগুজব করতে করতে আমরা হোটেলটাকে গমগমে বানিয়ে ফেললাম। নিচে যেসব লোক বসা ছিলো, ওনারা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো যে কারা এত হৈচৈ করছে। এক সময় আমাদের অর্ডার আসলো। আমার ৩৯ রুপির ডাল গোস্ত আর নান মজা ছিলো। এছাড়া মগজ, নেহেরি, ফ্রায়েড চিকেন, সিল্মা রুটি সবই টেস্ট করে দেখলাম। সবগুলোই মজা। খেয়ে দেয়ে অনেকে আবার চা অর্ডার দিলো। সব শেষে বিল মিটিয়ে আমরা বের হয়ে আসলাম। দেখি বড় বড় লাল মোহন যাকে ওরা বলে ‘গুলাব্জামুন’ জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। আমরা ছোট বাটিতে করে সিরায় ডুবানো লাল মোহন খেলাম। অনেকে হালুয়াও টেস্ট করলো। পেট ভরে সব খেয়ে দেয়ে আমরা ফাইনালি বের হয়ে আসলাম। একটা অটো ভাড়া নিলাম মোড়ের থেকে। ১০০ রুপি ভাড়া নিয়ে সেই অটো আমাদের হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলো।

হোটেলে ফিরে ছোট্ট রুমটাতে ঢুকে আমার আবার মন খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু কি আর করা, একজন লোককে ডাকিয়ে বাথরুমটা পরিষ্কার করে দিতে বললাম। কিন্তু যেই লাউ সেই কদুই রইলো। কিছুক্ষণ পাশের রুমের সুমাইয়া, রাত্রির সাথে গল্পগুজব করে রুমে ফিরে আসলাম। ওদিকে মজুমদার আর মৌলিও ফেরত এসেছে। সবাই মিলে বিছানাটায় চাপাচাপি করে শুয়ে পড়লাম। সহসা ঘুম আসতে চাইলো না। তারপর এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

 

The Mighty INDIA CALLING: সাদা বরফের দেশে রৌদ্র ঝলমলে একদিন (পর্ব ১৩)

সকালে ঘুম থেকে উঠলাম দেরি করে। আড়মোড়া দিয়ে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে চারদিকে তাকালাম। রুমের বিশাল জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঝলমলে রোদ, আগের দিনের বরফের চিহ্ন মাত্র নাই। বিছানা থেকে উঠে আবার সেই জানালার সামনে দাঁড়ালাম। পরপর দুইদিন দুই রকম রূপ দেখলাম মানালির। মন ভরে গেলো। আহ জীবন কত সুন্দর!

দেস
আগের দিনে সাদা বরফের বদলে সবুজ পাতা রোদে ঝলমল করছে চারদিকে

আমরা ঢিলেঢালাভাবে ফ্রেশ হতে লাগলাম পালাক্রমে। কিছুক্ষন পর দরজায় নক পড়লো। খুলে দেখলাম শুভ দাঁড়িয়ে। শুভ জানালো ১২টার মধ্যে রুম ছেড়ে দিয়ে লাগেজ জমা দিতে হবে গতকাল যে রুমে আমরা পার্টি করলাম সেই রুমে। রুবাইদা তখনও ঘুমাচ্ছিলো। ওকে ডেকে তুললাম। বাকি দুইজন ইতোমধ্যে রুম ছেড়ে বের হয়ে পড়েছে। আমি আর রুবাইদা ধীরেসুস্থে ব্যাগপত্র গোছগাছ করলাম। নাশতা খেতে ইচ্ছা করছিলো না আমাদের কারোরই। তাই কোনরকম তাড়াহুড়া করলাম না। ১২টার দিকেই আমরা চাবি জমা দিয়ে রুম থেকে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে পড়ি।

ব্যাগ জমা দিতে গিয়ে দেখি ছেলেদের রুমের চাবি যার কাছে থাকার কথা সে নাই। সবাই ডাইনিং হলে লাগেজ রেখেই চলে গেছে। কিন্তু অনেকেই বললো এভাবে লাগেজ ফেলে যাওয়াটা ঠিক হবে না। পরে আমরা কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিয়ে ডাইনিং হলের দোতলার রুমে লাগেজ রাখলাম। তারপর নিচ থেকে অন্যদের লাগেজগুলোও টেনে টেনে দোতলায় তুলে দিলাম। হঠাৎ একটা ব্যাগের ভিতর থেকে স্পাইডার ম্যানের মাঝারি সাইজের একটা পুতুল উঁকি দিলো। আমি নেড়েচেড়ে দেখলাম পুতুলটা নতুন না, পুরানো। আমাদের বয়সের কেউ একজন সাথে করে স্পাইডারম্যানের পুতুল নিয়ে ঘুরছে, ব্যাপারটা কেমন অবিশ্বাস্য লাগলো। আমি কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করলাম কার পুতুল এটা, কেউই ঠিক মত বলতে পারলো না। কে জানি বললো, সারার হতে পারে। সারার দেড় বছরের ভাতিজা আছে। ভাতিজার পুতুল সারার ব্যাগে আসতেই পারে- এই ভেবে আমি সেখান থেকে বের হয়ে পড়লাম।

বের হয়েই সারা আর রাত্রির সাথে দেখা। সারাকে পুতুলের কথা জিজ্ঞেস করতেই সারা জানায় পুতুলটা বাসিরুনের। বাসিরুনের ছোট্ট ভাই এই পুতুলটা ওকে দিয়ে নাকি বলেছে, ‘স্পাইডারম্যান উইল প্রোটেক্ট ইউ’। ছোট ভাইয়ের পুতুল নিয়ে তাই ও ঘুরছে সারা ইন্ডিয়া। তারপর আমরা হোটেলে নিচে দাঁড়াই খানিক্ষণ। গতদিন সাদা কুয়াশায় সব ঢাকা ছিলো বলে হোটেলের চারপাশটা দেখতে পাই নাই। আজকে দেখলাম, আমাদের হোটেলের পিছনে বরফ ঢাকা সাদা পাহাড়। পাতাহীন কংকাল গাছগুলো বরফে ঢাকা। হোটেলের এক কর্মচারী বললো ‘ওগুলো আপেল গাছ। শীতকালে তো মানলিতে তেমন কেউ আসে না। টুরিস্ট সিজন তো গরমকালে, তখন আপেল গাছগুলো সবুজ হয়ে থাকে। তখনই দেখার মতন দৃশ্য হয়। এখন যে পাহাড় সাদা দেখাচ্ছে সেটা পুরো সবুজ হয়ে যায়’। সারা আমাদের বললো, ‘আমরা ভাই গরমের দেশের মানুষ। জীবনে সবুজ অনেক দেখেছি তাই আবার এখানে আসতে হলে এই বরফের দিন দেখেই আসবো’। আমরাও সারার কথাতেই সায় দিলাম।  কতক্ষন ঘুরেফিরে, ছবি তুলে আমরা বাইরে বের হলাম।

আমরা চার জন সেই অলৌকিক বিয়াস নদীর ধার ধরে হাঁটতে লাগলাম। সেই নীলচে সবুজ রঙয়ের স্রোতওয়ালা পানি আর ছোট বড় হাজারো পাথর- রূপ তার এতটুকু পরিবর্তিত হয় নাই। ঝরঝর শব্দ করে কোনায় বরফ জমে থাকা পাথরে ধাক্কা খেয়ে ছুটে চলা নদীর সাথে সাথে আমরাও হাঁটলে লাগলাম। আমাদের সাথে যোগ দিলো আফরা আর জেরিন। রূপকথার রাজ্যের মতই আমাদের সামনে হাজির হলো লটপটে কিন্তু চওড়া এক সাঁকো। আধা আধি বরফে ডুবে থাকা সাঁকোটা পার হবো বলে ঠিক করলাম আমরা। এর মধ্যেই একটা জিপ হর্ণ দিতে দিতে আমাদের সরিয়ে দিয়ে সেই সাকোঁর উপর দিয়ে জোরে চালিয়ে পার হয়ে গেলো।  আমরা বুঝলাম যেটাকে আমরা চওড়া সাঁকো ভেবেছিলাম সেটা আসলে চিপা ব্রিজ। এবং মোটে লটপটে নয় বরং বেশ শক্তপোক্ত। আমরা হেঁটে হেঁটে সেই ব্রিজ পার হলাম। ব্রিজের ধারে সুতার মধ্যে লাল, নীল, হলুদ বিভিন্ন রঙের চারকোনা কাপড়ের টুকরায় সম্ভবত নেপালি ভাষায় কিছু লিখা আছে। দেখে আমার ভিডিও গেম ‘আঞ্চারটেড- এ্যামাং দ্যা থিভস’ এর কথা মনে পড়লো। সেখানেও রাস্তাঘাটে এরকম টুকরা কাপড় দেখেছিলাম।

আসদ
ব্রিজের ধারে লাল, নীল টুকরা কাপড়ের সারি

আমরা উঁচু নিচু পাহাড়ী ঢাল বেয়ে হাঁটতে লাগলাম। মাঝে একটা পশ দোকান দেখে আমরা ভিতরে ঢুকে পড়লাম। দোকানটা আমাদের দেশের আড়ঙের মত। জিনিসপত্র অনেক সুন্দর কিন্তু সেই দাম সবকিছুর। আমরা ঘুরেফিরে সব নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। অনেক জিনিস পছন্দও হচ্ছিলো কিন্তু কেনার সামর্থ ছিলো না। সেখান থেকে আমরা বের হয়ে পড়লাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতেই মল রোড চলে এলাম।

মল রোডে আরও কয়েকজনের সাথে দেখা হলো। খবর পেলাম এখানে কাছেই একটা মঠ, তিব্বিতি কলোনি আর দূরে হাদিম্বা টেম্পল দেখার মত জায়গা। আমরা দূরেরটা বাদ দিয়ে কাছেরগুলো আগে দেখবো বলে ঠিক করলাম। প্রথমে গেলাম মঠটাতে। মঠটার নাম গাধান থেকচোকক্লিং গোম্পা মনেস্ট্রি। ছোট্ট একটা মঠ। সামনে একটা খোলা জায়গা যেখানে দলা দলা করে বরফ জমে আছে। আমরা সাবধানে বরফগুলো পার হয়ে মঠের সদর দরজায় পৌঁছালাম। ‘যত কান্ড কাঠমান্ডুতে’ যে প্রেয়ার হুইলের কথা পড়েছিলাম আজকে সামনা সামনি দেখলাম। প্রার্থনা কক্ষের চারপাশটা তামাটে আর সোনালি রঙের ধাতুর তৈরি প্রেয়ার হুইল দিয়ে ঘেরা। অনেককেই দেখলাম প্রেয়ার হুইলগুলোকে ঘুরাতে ঘুরাতে পুরো মঠের চারপাশে একবার চক্কর দিতে। আমরা জুতা খুলে ভিতরে ঢুকলাম।

ভিতরে বিশাল বড় এক বুদ্ধ মূর্তি। ছবি তোলা নিষেধ বলে আমরা আর ক্যামেরা বের করলাম না। বিশালাকার এই মূর্তির চারপাশে নানা রঙের বাতি, ধাতব পাত্রে নানা রকম প্রসাদ, ধুপকাঠি টাইপের জিনিস। দেয়াল জুড়ে রঙ্গিন পেইন্টিং। তাতে অনেক ইতিহাসের বর্ননা। নিচের সিড়ি দিয়ে দেখলে বুদ্ধের মাথাটা অনেক উঁচুতে থাকে বলে ভালোমত দেখা যায় না। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই আমরা বুদ্ধের আই লেভেলের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম প্রায়। বুদ্ধের বিশাল মাথাটা আমাদের দিকে যেন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আমরা খানিক্ষন ঘোরাঘুরি করে শান্তি শান্তি জায়গাটা থেকে বের হয়ে গেলাম।

তারপর হাঁটতে লাগলাম তিব্বতি কলোনির দিকে। বেশি দূর যাওয়া লাগলো না। চারপাশেই দেখা পেলাম নেপালি, তিব্বতি স্টাইলের ঘরবাড়ির। রাস্তার দুপাশে সব দোকানপাট। কাঠ, ধাতু দিয়ে তৈরি শো পিসগুলো দেখতে ভালোই লাগছিলো। পোশাকে আশাকে সাধারন মানুষজন, এদের চেহারা মোটেও ইন্ডিয়ান নয় বরং সেই তিব্বতি বা নেপালি ছাপটা অনেক বেশি দৃশ্যমান। ছোট ছোট দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে আমরা একসময় চলে আসলাম সেই মল রোডে। মল রোডে ঢুকতেই নোভাদের সাথে দেখা। ওরা হাদিম্বা টেম্পল থেকে এসেছে। ওদের কাছে জানতে চাইলাম কেমন করে ওখানে যাওয়া যাবে। ওরা পরামর্শ দিলো না যাওয়ার। যেতে হয় অনেকদূর- গিয়েও ওদের কাছে তেমন ভালো লাগে নাই। আমরাও ভাবলাম আর যাবো না ওখানে।

মল রোডটা অনেক চওড়া একটা রাস্তা যেটাতে গাড়ি চলতে দেখি নাই বললেই চলে। পুরা রাস্তাটাই পথচারীদের জন্য। দুই লেনের ডিভাইডারে একটু পর পর বসার ব্যবস্থা। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে যাতে বিশ্রাম নেওয়া যায়। আর রাস্তার দুপাশে আছে দোকানপাট। কাশ্মীরি শাল, স্টোল, সোয়েটার, স্যুট, পঞ্চ, থ্রি পিস- এইসব জিনিসে ভরা সেই দোকানগুলো। আর জিনিসগুলোও দেখার মত। কাশ্মীরি কাপড়গুলোর দিকে আর তাকানো যাচ্ছিলো না। এত সুন্দর সুন্দর শাল আর স্যুট দেখে মনে হয় সব কিনে ফেলি। দামও মোটামুটি কম। একটু দরাদরি করে কিনতে হয়। তবে দোকানদারেরা বেশিরভাগই কাশ্মীরি- তারা দেখতে যেমন লম্বা, ফর্সা, সুন্দর, ব্যবহারও তেমনি ভদ্র। আমাদের অনেককেই এখানে শান্তিতে কেনাকাটা করতে দেখলাম। নিলয় তো একে একে ১৭টা শাল কিনে ফেললো! এছাড়াও আছে বাদাম যেমন কাজু, খেজুর, আঞ্জির, আলুবোখারা, খোরমানি ইত্যাদি, ফ্রেশ জুস, লোকাল মানালি ড্রেস। আগের রাতে লিচি আর পামের জুস খেয়ে দারুন মজা পেয়েছিলাম। এখানে সেই দোকানটা খুঁজে পেলাম। দোকান জুড়ে জুস, আচার, জ্যাম, মধু, আর প্রসেসিং করা শুকনা ফল। আমি জুস নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু ফোনে আম্মুকে বলতেই আম্মু না করে দিলো। বললো ভারি বোতল টানতে অনেক কষ্ট হবে। তখন মনে কষ্ট পেলেও উপদেশটা এক্কেবারে ঠিক ছিলো। আমি সস্তায় দুই প্যাকেট কাজু বাদাম, খোরমানি আর আলুবোখারা কিনলাম। আমরা যেটাকে আলুবোখারা বলি ওরা সেটাকে খোরমানি বলে, আর যেটাকে ওরা আলুবোখারা বলে সেটা আমি চিনলাম না তবে দেখতে বড় কিশমিশের মত। সব মিলিয়ে খরচ পড়লো ৪০০ রুপি। আমরা একটা দোকান থেকে ৫০ রুপি দিয়ে বিশাল একটা ভেজ স্যান্ডুইচ কিনে খেতে লাগলাম। এটাই আমাদের লাঞ্চ।

াদ
মল রোড (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

খেয়েদেয়ে আবার আমরা ঘুরতে লাগলাম। সারা মল রোডেই আমাদের লোকজনকে দেখা যাচ্ছিলো। সুমাইয়াকে দেখলাম রাস্তার উপর বসার জায়গায় বসে এক মনে স্কেচ করছে। নিশাত, তমাকে এক ঝলকের জন্য একটা দোকান থেকে বের হতে দেখলাম। মীম আর অন্তরা তো যেই দোকানে ঢুকছে সেই দোকান থেকেই কিছু না কিছু কিনে বের হচ্ছে। এক সময় আমি আর রুবাইদা বসে বসে গল্প করতে লাগলাম। আমাদের চারপাশে ‘খাঁটি জাফরান’ নিয়ে কয়েকজন ঘোরাঘুরি করতে লাগলো। এক জনকে দেখলাম অসম্ভব কিউট কয়েকটা খরগোশ নিয়ে বসে আছে। এদের সাথে ছবি তুলতে হলে পয়সা দিতে হয়। চারিদিকে কেমন যেন উৎসব উৎসব ভাব। সবাই খুশি খুশি মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে- দেখতেই আমার ভালো লাগছিলো।

ওদিকে চারটার মধ্যে আমাদের হোটেলে ফেরার কথা। আমি, রুবাইদা, মিম আর অন্তরা একটা অটোভাড়া করলাম চন্দ্রমুখী কটেজ পর্যন্ত। পার হেড ভাড়া পড়লো ৬০ রুপি। প্রায় পৌনে চারটার দিকে আমরা হোটেলে পৌঁছাই। হোটেলে যাওয়ার আগে রুবাইদা হঠাৎ বেকারির দোকানগুলোতে ঢুঁ মারতে চায়। কয়েকটা দোকানে ঢুকে দেখলাম মজার মজার কেক, বিস্কুট, পেস্ট্রি সারি সারি করে সাজানো। একটা দোকানে রুবাইদা সাদা রঙের বিস্কুট টাইপের একটা জিনিস কিনতে  চায়। জিনিসটা অনেক মজার ছিলো। আমি জার্নির আগে উলটাপালটা কিছু খাবো না, তারপরও রুবাইদার কাছ থেকে এক চিমটি খেয়ে দেখলাম- আসলেই অনেক মজার। জিনিসটার নাম আমরা বুঝি নাই। দোকান থেকে বের হয়ে মনে পড়লো দোকানটার নামও দেখি নাই। রুবাইদা বললো, ‘আরে, এরকম কয়েকটা গল্প আন ফিনিশড থাকতে হয়। আমরা সবাইকে বলবো ঐ যে চন্দ্রমুখী কটেজের বাম দিকে একটা বেকারির দোকানে কি যে একটা জিনিস খেয়েছিলাম- আহ হা…’।

হোটেলে ফিরে আমরা লাগেজের রুমে গিয়ে বসলাম। একটু পরে আমি গেলাম বারান্দায়। সেখানে আমি আর উর্মি দোলনায় বসে দোল খাচ্ছিলাম। বারান্দা দিয়ে এক পাশে বরফে ঢাকা সাদা আর ধূসর পাহাড় দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিলো, কেন চলে যাচ্ছি এখান থেকে? আরও কয়েকটা দিন এখানে থাকলে কি হতো? ওদিকে অদিতি নতুন লাগেজ কিনেছে। ভিডিও কনভারসেশনে বাসার সবাইকে দেখাচ্ছে ম্যাজেন্টা কালারের সেই লাগেজটা। দিনের আলো হটাৎ করেই যেন কমতে শুরু করলো। কমিটির লোকজন আমাদের জন্য জিপ ঠিক করে নিয়ে আসতে লাগলো। আমরাও একে একে মালপত্র নামিয়ে হোটেলের সামনের ঢালে জড়ো হতে লাগলাম। এই ঢালটা সিমলার ঢালের তুলনায় কিছুই না। মালপত্র মেইন রোডে তুলতে আমাদের তেমন কষ্ট হলো না। একটা জিপে আমি মালপত্র নিয়ে উঠে পড়লাম। জিপটা ছাড়ার আগেই দেখতে পেলাম চন্দ্রমুখী কটেজের সামনে কয়েকটা গাড়ি ভরে নতুন কাস্টোমার এসেছে। আমার মনে হলো যেন আমাদের রুমটাতেই আমি কাউকে যেন উঠতে দেখলাম। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। কয়েক ঘন্টা আগেও এই রুমটা আমার বাসার রুমের মতন আপন ছিলো, অথচ এখন সেটা অন্য কারো দখলে চলে গেছে। মানুষের জীবনটাও এরকম। সময়ের সাথে সাথে একজন মানুষের সব কিছুই অন্য কারও কারও দখলে চলে যায়। কিন্তু মানুষ সেটা বিশ্বাস করতে চায় না। সে শুধু বর্তমানের আনন্দটুকু নিয়েই ব্যস্ত থাকে। ঠিক যেমন আমি একটু আগেও হাসি, গল্প, আনন্দে মেতে ছিলাম- অনেকটা সেরকমই।

জিপ আমাদের নিয়ে থামালো এলয় পার্কিঙ্গে। এখানেই আছে আমাদের বাস গোয়েল। জিপের জন্য পার হেড ১৫০ রুপি করে ভাড়া পড়লো। বাসের পিছনে কাদা পার করে লাগেজ গুলো জড়ো করে রাখতে লাগলাম আমরা। অনেকের মালপত্র অনেক বেড়ে গেছে, তাই শুধু পিছনে লাগেজ আঁটছিলো না। কিছু লাগেজ আমরা আমাদের বসার জায়গাতেও তুলে নিলাম। প্রায় সাড়ে ৬টার দিকে বাস চলতে শুরু করলো দিল্লীর উদ্দেশ্যে।

আস্তে আস্তে রাত নামতে লাগলো। আমাদের বাস ইতোমধ্যে কয়েকটা টানেল পার হলো। আমরা চিৎকার করে আনন্দ করলাম। রাত নামতেই সেই পরিচিত দৃশ্য। পাশের পাহাড়ের গায়ে মিটমিট আলো জ্বলছে যেটাকে আকাশের তারার থেকে খুব একটা আলাদা করা যায় না। তবে সিমলার পাহাড়ের দৃশ্য আর মানালির পাহাড়ের দৃশ্যের মাঝে হাল্কা ফারাক আছে। সেটা নিজের চোখে না দেখলে বোঝা যায় না। এই সুন্দর দৃশ্যের সাথে উপরি পাওনা হিসেবে আকাশে একটা চাঁদের অস্তিত্ব দেখা গেলো। আমার মনে হলো ঘাড় ঘুড়িয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার ঘাড় ব্যাথা হয়েই যাবে। কিন্তু তারপরও তাকিয়ে রইলাম বাইরের দিকে। এই তো শেষ, আজকের রাতের পর এই দৃশ্য জীবনে হয় তো আর কোন দিনও দেখতে পারবো না। মনে মনে বললাম। ‘বিদায় মানালি, বিদায়’।  অনেক ঠান্ডা লাগছিলো, আমি ব্যাগ থেকে কম্বল বের করে মুড়িয়ে বসি। এক সময় আমাদের বাস রাস্তার পাশের এক পাঞ্জাবী ধাবায় থামে। সেখানে খাওয়া দাওয়া তেমন কিছুই নেই। অনেকেই ম্যাগি নুডুলস অর্ডার দেয়। লোকগুলা এত ঢিলা যে সেই নুডুলসের অর্ডার পেতেও প্রায় আধা ঘন্টা- পয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। সবাই যখন এক পর্যায়ে বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে যায় তখন বাটিতে করে সিদ্ধ নুডুলস আসে। আমি এক প্যাকেট চিপস খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলি।

তারপর আবার একসময় বাসে উঠি আমরা। বাস চলতে শুরু করে। জার্নিটা বেশ ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছিলো। কে যেন সামনে গিয়ে গান ছাড়ার ব্যবস্থা করতে বলে। কিন্তু জানা যায় আমাদের কাছ থেকে গান নিয়ে গান ছাড়া যাবে না, শুধু উনাদের কাছে যে সব গানের ক্যাসেট আছে সেগুলো ছাড়া যাবে। উপায় না দেখে আমরা তাতেই রাজি হই। ছাড়া হলো ১৯৮২ সালের ‘শোলা অর শবনম’ সিনেমার ‘তু পাগল প্রেমি আওয়ারা’ গানটা। অসহ্যকর গানের ‘ওয়ে ওয়ে ওয়ে ওয়ে ওয়ে ওয়ে ওয়…’ টানটা আমাদের মাথা ধরিয়ে দিলো। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন এই গানটা শেষ হবে। কিন্তু রহস্যজনক কারনে গানটা শেষই হচ্ছিলো না। যখনই আমরা ধারনা করছিলাম গানটা শেষ হবে তখনই কয়েক মাইক্রো সেকেন্ড বিরতি দিয়ে আবার কথা শুরু হয়ে যাচ্ছিলো। এক পর্যায়ে আমরা সবাই যখন দম ফেললাম যে গানটা শেষ হয়েছে, তখন আদিবা বলে উঠলো, ‘ আই হ্যাভ ডাউট যে গানটা সত্যিই শেষ হয়েছে-’ ঠিক তখনই আদিবার সন্দেহ সত্যি প্রমানিত করে গানটা আবার চলতে লাগলো। লোকজন উঠে হেল্পারকে অনুরোধ করে আসলো গানটা বন্ধ করার জন্য এবং আমাদের বাকি দিনগুলোতে যাতে আর কোনদিনই কোন গান ছাড়া না হয়। আমরা নিজেরা নিজেরা গানটাকে পচিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলাম। এক পর্যায়ে সবাই একে একে ঘুমিয়ে পড়লো। আমিও কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমালাম।

 

 

The Mighty INDIA CALLING: যে সৌন্দর্য শুভ্র নীহারের, যে সৌন্দর্য হিম কুয়াশার (পর্ব ১২)

লেপের তলায় মুখ গুঁজে থাকা অবস্থাতেই মৌলির ফোন বেজে উঠতে শুনলাম। ঘুম জড়ানো কন্ঠে মৌলি ফোনটা ধরলো। জাফর ফোন দিয়েছে। মৌলি ওকে জানালো আমরা ঘুম থেকে এখনো উঠি নাই, লেপের তলাতেই আছি। শুনে জাফর বললো শিগগিরি বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে তাকিয়ে দেখতে। শুনে মৌলি অনেক কষ্টে লেপের তলা থেকে বের হয়ে কোটটা গায়ে জড়িয়ে বিছানা ছেড়ে নামে। হঠাৎ শুনতে পাই চিৎকার। চিৎকার শুনে মজুমদার আর রুবাইদা তড়াক করে উঠে গেলো। আমিও উঠতে গেলাম কিন্তু হাতড়ে ওভারকোটটা পাচ্ছিলাম না। এবার শুনলাম তিনজনের সম্মিলিত চিৎকার। আমি আর অপেক্ষা করলাম না। কম্বলটা গায়ে জড়িয়েই উঠে পড়লাম। দৌড়ে গেলাম জানালার কাছে।

আমি থ হয়ে গেলাম। জানালা দিয়ে দেখা গেলো একটাই রঙ- সাদা। বাইরের সবকিছু সাদা। মাটি, পাকা রাস্তা, গাড়ি, গাছের ডাল, দূরের ঘর বাড়ি- সব সাদা। এক সাদা স্বপ্নের জগতে এসে পড়েছি যেন। সারা রাত তুষারপাত হওয়ার কারনে সব কিছু পুরু বরফের নিচে চাপা পড়ে আছে। দৃশ্যটা দেখে আমার গলা দিয়ে অন্য তিনজনের মত অটোমেটিক চিৎকার বের হয়ে আসলো। আমরা চার জন লাফাতে লাফাতে চিৎকার করতেই থাকলাম। মনে হতে লাগলো খুশীতে আমাদের বুঝি মাথা নষ্ট হয়ে যাবে, আমরা বুঝি পাগল হয়ে যাবো। তারপরও আমরা থামলাম না, একে অন্যকে জড়িয়ে লাফাতে লাগলাম। তাড়াতাড়ি আম্মুকে ফোন দিলাম। খুশীতে আমার গলা দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিলো না। তারপরও কোনমতে বললাম সবকিছু। একে তো মোবাইলে ব্যালেন্স তেমন নাই তার উপর কবে ব্যালেন্স ভরতে পারবো সেটাও জানি না। তাই বেশিক্ষন কথা বলতে পারলাম না। আম্মুও সব শুনে অসুখ বিসুখ না বাধানোর একগাদা উপদেশ দিয়ে ফোন রেখে দিলো।

আমরা তাড়াতাড়ি করে যে যেভাবে ছিলাম তার উপরই কোনমতে গায়ে কোট জড়িয়ে, পায়ে জুতা গলিয়েই বের হয়ে পড়লাম। চারিদিকে সাদা বরফের রাজ্যে পা দিয়েই এক ধরনের শিহরণ অনুভব করলাম। নিস্তব্ধ এক সাদা জগতে আমরা কয়েকজন রঙ্গিন পোশাক পরে হাঁটতে লাগলাম। আমার জুতার সোল বরফে ডুবে যাচ্ছিলো। ওয়াটার প্রুফ জুতা ছিলো বলে বাঁচোয়া। তারপরও মনে হচ্ছিলো জুতার সোলটা বোধহয় ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। তবে এসব পাত্তা না দিয়ে আমরা ঘুরতে লাগলাম। বরফের মধ্যে ছেলেমানুষের মতন ছুটে বেড়াতে লাগলাম। সাদা বরফগুলোকে গ্লাভস পরা আঙ্গুল দিয়ে গুতিয়ে দেখতে লাগলাম, পা দিয়ে নিচের বরফগুলোকে লাথি মারতে লাগলাম, বরফে ঢাকা গাড়ির সামনে ছবি তুললাম আর চন্দ্রমুখী কটেজের বারান্দা থেকে আমাদের যারা বের হয়নাই তারা দাঁত বের করে হাসতে লাগলো।

এফ
চন্দ্রমুখী কটেজের সামনে তখন সবই সাদা (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

কে যেন তাড়া দিলো নাশতা খেয়ে রেডি হয়ে নেওয়ার জন্য। আমরা তাড়াতাড়ি রুমে ফিরে গেলাম। রুমে একজন একজন করে ফ্রেশ হয়ে রেডি হতে লাগলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম আমার গাল গুলো টকটকে লাল হয়ে গেছে। আমি বেশ কয়েকবার ছবি তুলে গালের লাল রংটা ধরে রখতে চাইছিলাম। কিন্তু কোনভাবেই ক্যামেরায় সেটা আসছিলো না। পাশের রুমের সৃষ্টির কাছে থেকে হেয়ার ড্রায়ার এনে লাগেজ খুলে যত্তগুলা গরম কাপড় এনেছিলাম সবগুলো গরম করে গায়ে পরে নিলাম। সবকিছু পরে যখন শেষে ওভারকোটটা গায়ে দিলাম তখন হাত পা আর নাড়াতে পারছিলাম না। এত্তগুলো গরম কাপড় গায়ে দিয়ে আমরা সবাই কেমন যেন কার্টুনের মত হাঁটতে চলতে লাগলাম।

হোটেল থেকে বের হয়ে বাম দিকে হাঁটতে লাগলাম। রাস্তার পাশে ছোট ছোট দোকান। সেগুলোতে ছাতা, গামবুট, গরম কাপড় এইসব ভাড়া দেওয়া হয়। আমরা দৈনিক হিসাবে ছাতা ৩০ রুপি আর গামবুট ৫০ রুপি দরে ভাড়া নিলাম। আকাশের অবস্থা সুবিধার ছিলো না। ঐ দোকানে থাকতে থাকতেই গুড়া গুড়া তুষার পড়তে লাগলো। আমরা এর মধ্যেই ভেজা রাস্তার মধ্য দিয়ে হেঁটে একটা ছোট পাঞ্জাবী ধাবা টাইপের দোকানে নাশতা করতে ঢুকলাম। আমরা অর্ডার দিলাম ২৫ রুপির আলু পরোটা আর ৩০ রুপির ডাবল ডিমের অমলেট। আমরা গুটিসুটি মেরে দোকানে বসে রইলাম। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা আর তুষারপাত আর ভিতরে আমরা হাহা হিহি করে নিজেদের গরম রাখার চেষ্টা করছিলাম। আমাদের সামনেই একজন মহিলা আর তার স্বামী মিলে পরোটা বানাচ্ছিলো আর গরম তাওয়ায় তেল ঢেলে আলু পরোটা ভাজতে লাগলো। কিন্তু ওনাদের মধ্যে কোন তাড়া দেখতে পাচ্ছিলাম না। এমন আস্তে আস্তে ময়দা বেলে তার মধ্যে আলু ঢুকিয়ে পরোটা বানাচ্ছিলেন যেন ওনারা বাসার জন্য নাশতা রেডি করছেন। আমরা ধৈর্য ধরে বসে থাকলাম নাশতা খাওয়ার জন্য। অবশ্য চুলা থেকে নামানো পরোটা আর প্রায় ডুবো তেলে ভাজা ডিমটা অনেক মজা ছিলো।

খেয়ে দেয়ে আমরা হোটেলের সামনে এসে জড়ো হলাম। সেখানে জানতে পারলাম আমাদের আজ রাতেই আমাদের মানালি ছেড়ে দিল্লীর দিকে রওয়ানা হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আবহাওয়ার অবস্থা আর মানালির সৌন্দর্য দেখে ডিসিশন নেওয়া হয়েছে যে আজ আমরা মানালি থেকে যাবো। পরদিন দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো ইনশাল্লাহ । আর আজ রাতেই আমাদের সবার জন্য কমিটির তরফ থেকে অ্যারেঞ্জ করা হবে ‘সারপ্রাইজ পার্টি’। ইতোমধ্যে আবহাওয়ার কারণে আমাদের যে জায়গায় যাওয়ার কথা ছিলো (সম্ভবত সোলাং ভ্যালি) সেটা ক্যান্সেল হয়ে গেছে। তার বদলে আমরা নেহেরু কুন্ডে যাবো বলে ঠিক হলো। এর জন্য কমিটি জিপ ভাড়া করে রেখেছে। আমরা দুদ্দাড় করে জিপে উঠে বসতে লাগলাম। একটা করে জিপ ভরে উঠতে লাগলো আর একটা করে জিপ ছাড়তে লাগলো।

দফগ
নেহেরু কুন্ডে যাবার ঘোলাটে সাদা পথ (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

জিপে করে নেহেরু কুন্ডে যাওয়ার রাস্তাটা অত্যন্ত উপভোগ্য ছিলো। আস্তে আস্তে হাল্কা তুষারপাত বাড়তে লাগলো। এক সময় সেটা এতই বেড়ে গেলো যে ড্রাইভারকে ঘন ঘন ওয়াইপার চালাতে হলো সামনের কাঁচ পরিষ্কার রাখার জন্য। দুপাশের দৃশ্যের কথা আর কি বলবো, সেই দৃশ্য বর্ননা করার সাধ্য আমার নেই। সবাই হাঁ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মজুমদারকে ড্রাইভার বললো এই রকম ওয়েদার খুব একটা থাকে না। আর এক দুই দিনের মধ্যেই হয়তো তুষারপাত বন্ধ হয়ে আবার স্বাভাবিক ওয়েদার হয়ে যাবে। মজুমদার ওর মোবাইল গাড়ির সামনের কাঁচে লাগিয়ে ভিডিও করতে লাগলো। আমি উশখুশ করতে লাগলাম। পায়ের তালুতে কেমন যেন যন্ত্রনা হচ্ছে। যন্ত্রনা বাড়তে বাড়তে যখন অসহ্যকর হয়ে পড়লো তখন গামবুট খুলে ফেললাম। এক লেয়ার পলিথিন ব্যাগ আর তিনটা মোজা খুলে যখন পায়ে হাত দিলাম, টের পেলাম ভেজা। এত সাবধানতা সত্ত্বেও কেমন করে পায়ে পানি বা বরফ কুচি পৌঁছালো সে রহস্য ভেদ করতে পারলাম না। কি আর করা, কাপড় দিয়ে পা মুছে মাত্র একটা মোজা পরে আবার পা গামবুটে ঢুকালাম। ভেজা মোজা গুলো ব্যাগে ভরলাম।

এক সময় আমরা যায়গায় এসে পৌঁছালাম। জিপ থেকে বের হয়েই ভারি তুষার পাত মাথায় নিয়ে দৌড় দিলাম। দেখলাম সবাই একটা দোকানে ঢুকছে। আমরাও ঢুকে পড়লাম। সেখানে ২০০ রুপি দিয়ে বরফের মধ্যে দিয়ে চলাফেরা করার জন্য বিশেষ জামা ভাড়া পাওয়া যায়। দোকানে ঢুকার সাথে সাথে ওরা আমাদের সাইজের রংচঙ্গে সব জামা বের করে দিতে লাগলো। আমাকে দিলো বিশাল সাইজের লাল নীল রঙের হাস্যকর একটা জামা। আমরা ঠিক মত পরতে পারছিলাম না। ওরা আমাদের পরিয়ে দিতে সাহায্য করছিলো। আমরা গায়ের সব গরম কাপড় এমন কি ওভারকোট সহ সেই জামার ভিতরে ঢুকে পড়লাম। আমি পায়ের জন্য কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমাকে বাঁচিয়ে দিলো তমা। ও ব্যাগের ভেতর থেকে এক জোড়া মোটা মোজা বের করে দিলো। আমি চটপট সেই মোজা পায়ে পড়ে ফেললাম। তারপর বের হয়ে পড়লাম সেই দোকান থেকে। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটা ছোটখাটো ঢাল, সেটা পুরাই বরফে ঢাকা। কেমন করে সেই পার হবো সেটা চিন্তা করে মাথা চুলকাতে লাগলাম।

যাই হোক হাচড় পাচড় করে কোনমতে বরফ বেয়ে বেয়ে সেই ঢাল পার হলাম। তারপর হাঁটা ধরলাম সামনের দিকে। এসে পড়লাম ঠিক যেন উত্তর মেরুর কোন জায়গায়। চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ। কিছু বোঝার আগেই বড় বড় পেঁজা তুলার সাইজের তুষার পড়তে লাগলো। যেন এক সাদা ঝড়ের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। অবস্থা এমন হলো যে, আমরা শুধু চার পাঁচ হাত সামনের মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছি। এর বাইরে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না, সবই সাদা আর সাদা। পুরা জিনিসটা কেমন যেন স্বপ্নের মত লাগলো। নরম বরফের উপর পা ফেলে ঠিক মত হাঁটতে পারছিলাম না। এর মধ্যে রিজভীকে দেখলাম ক্যামেরা বের করে বেশ বিপদে পড়েছে। আমি ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম আর তার নিচে রিজভী ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে ছবি তুলতে লাগলো। আমার নিজের ক্যামেরাটা নিয়েও বেশ চিন্তায় পড়লাম কারণ আমার ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগ নাই। তারপর পলিথিন বের করে ক্যামেরাটা ভরে ভালোমত গিঁট দিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলাম। জোর তুষারপাতের মধ্যেই আমরা একে ওকে বরফের বল মারতে লাগলাম। একটা করে পা ফেললেই পায়ের গামবুটের নিচে চুরচুর করে ভাংতে লাগলো বরফ। সাদার সমুদ্রে হঠাৎ হঠাৎ একেক জনকে খুঁজে পাচ্ছিলাম আমরা। উর্মি, আদিবাকে দেখলাম তুষার মানব বানাতে। আমিও হাত লাগালাম। টিভিতে তুষার মানব বানানো দেখে যতটা সোজা মনে হয় বাস্তবে ততটা সোজা নয়। আমাদের তুষারমানব দেখতে অতটা ভালো হলো না, তবে আমরা মাফলার, সানগ্লাস, চিং এর রঙ্গিন ছাতা দিয়ে ওকে ফিনিশিং দিয়ে ছবি তুললাম।

এফদ
ভারী তুষারপাতের কারণে কারও চেহারাই দেখা যাচ্ছে না (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

এর মধ্যেই স্কি নিয়ে কয়েক জন আমাদের পিছে পিছে ঘুরতে লাগলো। আমি যেহেতু স্কিয়িং পারি না, তাই রাজি হলাম না। তবে অনেকেই স্কি ভাড়া নিয়ে চেষ্টা করলো। তারপর মানালি ড্রেস নিয়ে কয়েকজন মহিলা ঘুরঘুর করতে লাগলো। ঝড় একটু কমলে মজুমদার সবার আগে মানালি ড্রেস ভাড়া করে পড়লো। দেখাদেখি আমরা সবাই সেই ড্রেস ৫০ রুপি দিয়ে ভাড়া করে পড়লাম আর ছবি তুললাম। অবনীকে মাঝখানে রেখে আমরা গোল হয়ে সবাই নাচতে লাগলাম। কোন কথা নাই, সুর নাই- তবে আনন্দের কোন কমতি ছিলো না। আমাদের কি যে ভালো লাগছিলো তা আর বলার মত না। আমরা বরফে ডুবে ডুবে ছবি তুলছিলাম। বল ছোড়া তো ছিলই, এছাড়া বরফে শুয়ে বাটারফ্লাই তৈরি করার চেষ্টাও করছিলাম আমরা। এত দৌড় ঝাপ করতে করতে আমার এক রকম গরমই লাগছিলো। তারপর শুনলাম অনেকেই বলছে যে তাদেরও গরম লাগছে। এর মধ্যে নিশাত হাসি মুখে জানালো যে ওর নাক থেকে নাকি রক্ত পড়ছে। বরফে আসলে অনেকেরই এমন হয় শুনেছি, সেদিন সামনা সামনি দেখলাম। আমাদের আশেপাশে যেসব কুকুর ঘোরাফিরা করছিলো তারা দেখতে অনেকটা নেকড়ের মত। এ ছাড়াও আস্ত এক চমড়ি গাই বিশাল শরীর নিয়ে বড়লোকি চালে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিলো। এদের সাথে ফটো তুললে মালিককে ভাড়া দিতে হয়। কেউ কেউ ফ্লাস্কে করে চা কফি বিক্রি করছিলো। আর কয়েকজন আবার কৌটায় করে ‘খাঁটি’ জাফরান নিয়ে সবার পিছে পিছে ঘুরতে লাগলো। ছেলেরা কয়েকজন ‘খাঁটি’ জাফরান কিনে ফেললো প্রায় পানির দরে। আস্তে আস্তে তুষারপাত কমতে কমতে এক সময় থেমেই গেলো। তখন চারদিক একটু একটু করে পরিষ্কার হতে লাগলো।

ওর
আস্তে আস্তে কুয়াশা সরে দূরের রহস্যময় পাহাড়গুলো উঁকি দিতে লাগলো (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম। দূরের বরফ ঢাকা পাহাড়গুলো যেন কেমন বেহেশ্ত থেকে এসেছে বলে মনে হলো। সাদা রঙের আলো ছায়ার খেলা চলতে লাগলো সেই পাহাড়গুলোতে। হাল্কা ধূসর রঙের আকাশের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ সাদা রঙের আলোর পিছনে দূরের একেকটা পাহাড় অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগলো, আবার পর মুহূর্তেই সেই সাদা কুয়াশার আলো সরে যেতেই পাহাড়গুলোকে দেখা যেতে লাগলো। আমরা চোখ সরাতে পারছিলাম না। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম সেই বেহেশ্তি দৃশ্য। ছোটবেলায় যখন স্টুডিওতে ছবি তুলতে যেতাম তখন পিছনে ব্যাকগ্রাউন্ডে কাঁচা হাতে আঁকা বরফের পাহাড়ের দৃশ্য দেখতাম। আমার মনে হলো ঠিক যেন সেই রকম কোন স্টুডিওর ব্যাকগ্রাউন্ড আমি দেখতে পাচ্ছি। তবে শিল্পী যখন আল্লাহ নিজেই, তখন  ওয়ার্কম্যানশিপ কোন লেভেলের হবে সেই প্রশ্ন না করে নিজে থেকেই বুঝে নেওয়া ভালো। এই রকম মনোমুগ্ধকর জায়গা থেকে আমাদের নড়তে কোনই ইচ্ছা করছিলো না। কিন্তু কমিটির লোকজন তাড়া দিতে লাগলো কারণ আবার আকাশ কালো হয়ে যাচ্ছে। তার মানে আবার সেই তুষারপাত শুরু হতে পারে। আবহাওয়া খারাপ হওয়ার আগেই আমাদের হোটেলে পৌঁছানো দরকার।

এফ
ট্যুরের মধ্যে সবচেয়ে আনন্দময় দিনে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

আমরা আগের রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে বের হয়ে সেই দোকানে গেলাম। ওখানে ড্রেস ফেরত দিয়ে আবার জিপে চেপে বসলাম। যখন হোটেলে পৌঁছালাম তখন প্রায় দেড়টা বাজে। হোটেলে না গিয়ে সোজা আগের দিনের সেই খাওয়ার দোকানে গিয়ে ঢুকলাম। এবার ৭৫ রুপি দিয়ে অর্ডার দিলাম ভেজ চপ্সুয়ে। আমরা কান্নুর সাথে দুষ্টামি করতে লাগলাম। কান্নুও পালটা  আমাদের ছাতা টেবিল থেকে টেনে ফেলে দিতে লাগলো। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চপ্সুয়ে আসলো। কি যে মজা, আহহহহহ!

রুবাইদা, মৌলি আর মজুমদার শপিং এ যাবে বললো। আমার একটু আরাম করতে ইচ্ছা করছিলো। আমি শপিং এ যাবো না ঠিক করলাম। মজুমদারের কথা অনুযায়ী খুঁজে খুঁজে ভোদাফোন রিচার্জের একটা দোকান বের করলাম। সেখানের লোকটা বললো ২১৪ রুপি রিচার্জ করতে হলে ২২২ রুপি দিতে হবে। আমি তার কারণ জানতে চাইলে লোকটা জানালো যেহেতু আমারটা কলকাতার সিম, তাই কলকাতার বাইরে রিচার্জ করতে হলে বাড়তি চার্জ দিতে হবে। এই রকম আজাইরা নিয়ম শুনে মেজাজ আমার খারাপ হয়ে গেলো। কিছু না বলে তাও রিচার্জ করে নিলাম। তারপর সিমলা থেকে মজুমদারের কিনে দেওয়া ২০ রুপির কার্ড বের করে উনাকে বললাম রিচার্জ করে দিতে। লোকটা চাঁদ মুখ করে বললো মানালির বাইরে থেকে কেনা কার্ড মানালিতে রিচার্জ হবে না। এই কার্ড রিচার্জ করতে চাইলে আমাকে সিমলা যেতে হবে। শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। এ কি দেশ রে বাবা! সেই চন্ডীগড়ের শেষের দিক থেকে রিচার্জ খুঁজতে খুঁজতে এই মানালিতে এসে রিচার্জ করতে পারলাম তাও ৮ রুপি বাড়তি দিয়ে, আবার বলে এক শহরের কার্ড অন্য শহরে কাজ করবে না। এরা যদি বাংলাদেশের মোবাইল কোম্পানিগুলার সার্ভিসের অবস্থা দেখতো তাহলে মনে হয় মাথা ঘুরে পড়েই যেতো।

আমি হোটেলে ফিরে নিরিবিলি নামাজ আদায় করে লেপ, কম্বলের নিচে ঢুকে শুয়ে থাকলাম। ঘুম তেমন আসলো না। তবে বিশ্রাম হলো। এক সময় অন্তরা আসলো গল্প করতে, আমরা অনেকক্ষন গল্প করলাম। দেখতে দেখতে ঝুপ করেই সন্ধ্যা নামলো। আমি মাগরিবের নামাজ পড়ে আম্মু, বড় মামা আর মিজান আংকেলকে ফোন দিলাম। কিছুক্ষণ পর মজুমদার, মৌলি আর রুবাইদা শপিং করে ফেরত আসলো। রুবাইদা কি কি কিনেছে দেখালো। বাইরে হঠাৎ গান শুনতে পেলাম। অন্তরা বললো মনে হয় আমাদের পার্টির গান। আমি বললাম তাই বলে এত আগে গান ছাড়বে। মজুমদার আর মৌলি বললো নিচে আমাদের পার্টির জন্যই গান হচ্ছে। ডিজে আনা হয়েছে নাকি। মৌলি আর মজুমদার নিচে নাচানাচি করতে চলে গেলো। রাত ৯টার দিকে আমি আর রুবাইদাও বের হলাম। আমরা প্রথমে গেলাম গাম বুট আর ছাতা ফেরত দিতে। নিজেদের জুতা পরে আমরা আসলাম আমাদের পার্টির স্থানে।

খোলা আকাশের নিচে কতগুলো চ্যালাকাঠ জমা করে আগুন জ্বালানো হয়েছে। তার একপাশে এক ডিজে ফিউশন করা মিউজিক বাজাচ্ছে আর তালে তালে আগুনের চারপাশে সবাই গোল হয়ে নাচানাচি করছে। দেয়ালের পাশে হাফ ওয়ালে যারা টায়ার্ড হয়ে যাচ্ছে তারা বসে কিছুক্ষন রেস্ট নিচ্ছে, রেস্ট নেওয়া হয়ে গেলেই আবার নাচতে চলে যাচ্ছে। রুবাইদা বললো যে ও রুমে গিয়ে বসে থাকতে চায়। আমি বললাম ঠিক আছে, খাওয়ার সময় হলে আমি ডেকে দিবো। রুবাইদা চলে গেলে আমি হাফ ওয়ালের উপর বসে পড়ি। আমার খুব ভালো লাগছিলো। সবার চোখেমুখে এক ধরনের আনন্দের ঝিলিক। এই নাচের মধ্যেই মাঝে মাঝে কয়েকজন মিলে আলাদা হয়ে পড়ছিলো, তখন আবার বাকি সবাই মিলে তাদের পচাচ্ছিলো। কিছুক্ষন পর মায়িশা এসে আমার সাথে যোগ দেয়। আমরা দুইজন শুধু বসে থাকি আর অন্যদের দেখতে থাকি। এর মধ্যে জুবায়ের এক জগ গরম পানি এনে দেয়। সবাই খুব মাঞ্জা মেরে গরম পানি জগ থেকে ঢোঁক দিয়ে খেতে থাকে। আমি সবাইকে দেখছিলাম, অন্তরা, ঐশি, কৌশিক, নিলয়, নোভা, তুষার, জাফর, মজুমদার, মৌলি, সৃষ্টি, সৌরভ, সীমান্ত আফরা, হিমি, আদিবা – সবাইকে। সবার আনন্দ দেখে মনে হচ্ছিলো যেন আমাদের জীবনে কোন দুঃখ নাই, কোন দিন ছিলোও না। এ জীবন যেন শুধুই আনন্দের।

নাচানাচি শেষ করে আমরা খাওয়ার রুমে গেলাম। সেখানে আমাদের জন্য বুফে ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভাত, সবজি, মুরগি, ডাল, গাজরের সালাদ আর গরম পানি। জুবায়ের আশ্বস্ত করলো যে প্রত্যেকটা মুরগি ও নিজে জবাই করেছে। আমি রুবাইদাকে ডেকে আনলাম। তারপর সবাই খেতে বসলাম। মেনুটা যত বাঙ্গালি বলে মনে হয়, স্বাদটা ততটা নয়। সবগুলো খাবারই ঝাল। তবে সবজিটা অনেক মজা ছিলো। আর সাথে গরম পানিটাও খুব ভালো লাগছিলো। অনেকদিন পর সালাদ হিসেবে পাওয়া গাজর খেতেও মন্দ লাগছিলো না। যাই হোক আমরা খুব উপভোগ করলাম আমাদের খাওয়া। খাওয়া শেষে হাত ধুতে গেলাম যখন কলের পানিতে, আমার মনে হলো ঠান্ডা পানির স্রোতে আমার পুরা হাত অবশ হয়ে গেছে। খাওয়ার পর ঘোষণা আসলো, আমাদের জন্য মানালির বিখ্যাত তাজা ফলের সিরাপ কেনা হয়েছে। আমরা যেন কমিটির রুমে গিয়ে সিরাপ দিয়ে বানানো জুস খেয়ে আসি। আমরা ডাইনিঙ্গের সিড়ি বেয়ে কমিটির চার তলার রুমে উঠলাম।

সেটা ছিলো হানিমুন স্যুট। চৌচালা রুফের নিচে এত্ত সুন্দর একটা রুম যা দেখেই আমাদের সবার মাথা ঘুরে গেলো। আমরা সবাই মাটিতে পাতা কার্পেটের উপর বসলাম। বিছানায় বসে শুভ আমাদের মধ্যে কাল্পনিক একটা লাইন টেনে বললো দুই দলের মধ্যে গানের কলি খেলা হবে। ব্যাস আর যায় কই, সবাই হৈ হৈ করে গান যুদ্ধে নেমে পড়লো। এই হোটেলে আমরা ছাড়া আর কেউ নাই। তাই আমাদের গলা ছেড়ে গান গাওয়ার পাশাপাশি হৈচৈ চিৎকার করতে কোনই বাধা রইলো না। জোরসে শুরু হলো গান গাওয়ার পাশাপাশি আমাদের আড্ডাবাজী। আর অন্য পাশে জুবায়ের সোফায় বসে এক গ্লাস এক গ্লাস করে জুস বানাতে লাগলো। তারপর রিজভী সেগুলোকে ছোট ছোট ওয়ান টাইম কাপে ঢেলে এক কাপ এক কাপ করে সবার মধ্যে পাস করতে লাগলো। তারপর আমি উঠে গেলাম ওদের সাহায্য করতে। একটা ছোট ট্রেতে রিজভীকে বললাম কাপগুলো তুলে দিতে। আমি সেই ট্রেটা নিয়ে সবার কাছে কাছে গিয়ে এক কাপ এক কাপ করে জুস দিতে লাগলাম।

দে
ঠান্ডার রাতে জুস খেতে ব্যস্ত সবাই (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

ওদিকে গান যুদ্ধ খুব জমে উঠেছে। জাফর আর উর্মি একসাথে চড়াও হয়ে উঠছে অন্য দলের উপর। অন্য দলের নোভা আর মজুমদারও সমান সমান লড়ে যাচ্ছে। জাফর তো আরও সাংঘাতিক, ও এতই সিরিয়াস গানের ব্যাপারে যে বেশ কয়েকবার ভুল করে সে অন্য দলের পক্ষ হয়ে গানও গেয়ে ফেললো। আর ওদিকে জুবায়ের দ্যা জুস মেকার জুস বানিয়ে যেতেই লাগলো, রিজভী দ্যা সাপ্লাইয়ার কাপে জুস ঢেলে দিতে লাগলো আর আমি পাঁচ ছয় রাউন্ড করে জুস বিলি করতে লাগলাম। দুইটা ফ্লেভারের জুস ছিলো। জুসটা এতই ভালো ছিলো যে কারও সামনে নিয়ে যখন জিজ্ঞেস করতাম, ‘দিবো?’ সে বিনা দ্বিধায় হাত বাড়িয়ে কাপটা তুলে নিতো।

এই করতে করতে কখন যে রাত সাড়ে ১২টা বেজে গেলো টেরই পাই নাই। এক সময় আমাদের আসর ভেঙ্গে গেলো। সবাই কমিটিকে ধন্যবাদ দিয়ে যার যার রুমে ফেরত গেলো। সেই আগের মতন আমরা সবাই লেপ কম্বলের নিচে চাপা পড়ে ঘুমাতে লাগলাম।

 

The Mighty INDIA CALLING: মানালির পথে রুদ্ধশ্বাস দৃশ্যাবলী (পর্ব ১১)

ঘুম ভাঙল ভোরবেরলা। সেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। দেওয়ালে টানিয়ে রাখা ছবির মত সুন্দর এক দৃশ্য। এত সুন্দর দৃশ্যও তাহলে আছে পৃথিবীতে! যাই হোক, আমাদেরকে বের হতে হবে। চটজলদি ফ্রেশ হয়ে আগের রাতের গুছানো সব মালপত্র একে একে রুম থেকে বের করলাম। হোটেলের এন্ট্রির সামনে গিয়ে আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। হোটেলে ঢুকার সময় তো খাড়া ঢাল দিয়ে গড়িয়ে লাগেজ নামিয়েছি। কিন্তু এখন? এখন তো টেনে উপরে তুলতে হবে। ইয়া আল্লাহ বাঁচাও!

হোটেলের কেউ লাগেজ তুলে দিতে পারবে কিনা খোঁজ খবর নিলাম। কিন্তু কোন মানুষ পেলাম না। যা আছে কপালে, ফী আমানিল্লাহ বলে শুরু করলাম ঢাল বেয়ে লাগেজ টেনে উপরে তোলা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হাতের কব্জিটা মনে হলো জয়েন্ট থেকে ছুটে যাবে। পায়ের মাংস পেশি টনটন করতে লাগলো। হাতের তালুতে লাগেজের হ্যান্ডেলের লাল দাগ পড়ে গেলো। পিঠের ব্যাকপ্যাকটাকে মনে হলো আমাকে পিছন দিয়ে টানছে। বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগলাম। গাল মুখ লাল হয়ে গেলো। এই প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যেও দারুন পরিশ্রমে আমার গরম লাগা শুরু হলো।  বার বার রাস্তার দিকে মাথা তুলে দেখতে লাগলাম কখন শেষ হবে এই যাত্রা? যখন আমি রাস্তার লেভেলে উঠে গোয়েলের পিছনে লাগেজ নিয়ে রাখলাম, বুকের পাজড় তখন হাপড়ের মতন ঊঠা নামা করছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো ধাতস্থ হতে। মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে আমি যখন ঢালের নিচে আমাদের হোটেলের দিকে তাকালাম, আমি অবাক হলাম। এই এত বড় ঢালের রাস্তা পার হয়ে আমি কেমন করে এই ভারি মাল্পত্রগুলো টেনে আনলাম, নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। নিজের প্রতি নিজেই বেশ খুশি হয়ে গেলাম। বাহ- আমি তো বেশ পরিশ্রমী! গোয়েলের গায়ে হেলান দিয়ে দেখতে লাগলাম আমাদের মানুষজন সবাই লাইন ধরে ঢাল বেয়ে লাগেজ টানতে টানতে আসছে।

কয়েক জন মিলে তাড়াতাড়ি নাশতা করার জন্য ছুটলাম। হোটেলের সামনেই ছোট একটা দোকান, সেখানে শুধু কেক, পাউরুটি আর চা আছে। কেকটা দেখে ভালো মনে হলো না। আমরা কয়েকজন মিলে পাউরুটি কিনলাম। সবাই চা দিয়ে ভিজিয়ে খেলো, আমি শুকনা পাউরুটিই চিবিয়ে খেলাম। সবশেষে পাঁচ রুপি দিয়ে একটা পার্ক কিনে বের হয়ে আসলাম। সবার আসা হয়ে গিয়েছে। আমরা বাসে উঠে পড়লাম। মোটামুটি ১০টার দিকে আমরা রওয়ানা হলাম মানালির দিকে।

বাস ছাড়ার দশ পনের মিনিট পর কমিটির লোকজন টের পেল যে যেই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার কথা সেই রাস্তা দিয়ে আমরা যাচ্ছি না। সৌরভ, জুবায়ের ওরা গিয়ে ড্রাইভারের সাথে কথা বলে রাস্তা চেঞ্জ করতে বললো। ড্রাইভার কিছুক্ষন পর রাস্তার বাইরে বাসটা পার্ক করলো। উনি জানালো, মানালি যাওয়ার দুইটা রাস্তা আছে। একটা রাস্তা নিরাপদ, দেখার মতন তেমন কিছু নাই। আমরা সেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। অন্যটা ভয়ানক বাঁকযুক্ত, কিন্তু দুপাশের দৃশ্য অনেক সুন্দর। কিন্তু সেই রাস্তা দিয়ে দিনের বেলা গেলে যাত্রীরা ভয়ে চিৎকার করে তখন ড্রাইভারের চালাতে খুব অসুবিধা হয়। আমাদের ছেলেরা বললো যে আমরা দ্বিতীয় রাস্তা দিয়েই যেতে চাই। তখন ড্রাইভার আমাদের বললো যে উনার কোন অসুবিধা নাই, কিন্তু উনি শর্ত দেয় যে আমরা কোন চিৎকার করতে  পারবো না। শর্ত শুনে আমরা ভয় পেয়ে যাই। কিন্তু তারপরও রাজি হই। তখন আমাদের পাংকু হেল্পার এসে ড্রাইভার আর আমাদের মাঝের দরজাটা বন্ধ করে লক করে দেয়। তখন আমরা বুঝি টুরিস্ট বাসগুলোতে ড্রাইভার আর যাত্রীদের মাঝে দরজা কেন দেওয়া হয়।

আমরা উল্টা ঘুরে নতুন রাস্তা দিয়ে যাত্রা শুরু করি। পাহাড়ের গায়ে আঁকাবাঁকা যে পথ দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম সেটার বাঁকগুলো যেন আমাদের বাসের মাপে মাপেই বানানো হয়েছে। আমি বাংলাদেশের মানুষ। পাহাড় পর্বত বললেই চট্টগ্রামের পাহাড়ের ছবিই চোখে ভেসে ওঠে। কিন্তু এত বড় বড় পাহাড় আমি কখনোও দেখি নাই। মাঝে মাঝে হিন্দি সিনেমাতে এই রাস্তার ছবি দেখা যায়। আমরা একটা পাহাড়কে পেচিয়ে পেচিয়ে উপরে উঠি আবার পেচিয়ে পেচিয়ে নামতে থাকি। তবে নিচে নামা কম, উপরে উঠা বেশি। সমতল ভূমি থেকে অনেক উপরে ঊঠে যাওয়ার পর আমার কানে সমস্যা হতে লাগলো। প্লেনে যেরকম কানে তালা লেগে যায় সেরকম না। কেমন যেন অস্বস্তি। আমি দুই হাত দিয়ে কান চেপে বসে থাকলাম।

ঘন্টা খানেকের মধ্যেই বাস একটা ধাবা টাইপের দোকানে থামলো। ড্রাইভার জানালো সামনে আর খাবারের দোকান পাওয়া যেতে নাও পারে। তাই আমরা নেমে চিপস বিস্কুট এই সব খেলাম। অনেকে অমলেট, ম্যাগি নুডুলস খেয়ে নিলো। আরও কিছু খাওয়া দাওয়া কিনে নিয়ে বাসে উঠে পড়লাম। একটু বিরতির পর বাস আবার চলতে শুরু করলো। দুই পাশের অবাস্তব সব পাহাড়ি দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা ছুটতে লাগলাম।

এফ
ঐ দূরে নকশা কাটা কঠিন সব পাহাড়

একই রকম পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ করেই লীলচে সবুজ রঙয়ের পানির জলাশয় দেখতে পেলাম রাস্তার এক পাশে। অল্প পানির জলাশয়ে সাদা ফেনার স্রোত তুলে ঝরঝর করে বয়ে চলছে টলটলে পানি, তাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা আকারের পাথর- দৃশ্যটা এতই নৈসর্গিক যে মনে হল আমি বোধহয় পৃথিবীর বাইরে কোথাও চলে এসেছি। এই রকম অপরূপ জলাশয় আমি কোনদিন কল্পনাও করি নাই। জানলাম এই জলাশয়ের নাম বিয়াস নদী। পানদহ নামের এক জায়গার কাছাকাছি এসে বিয়াস নদীর শ্বাস রুদ্ধকর সৌন্দর্য দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। পথেই একটা জল বিদ্যুত পাওয়ার সেন্টার দেখলাম। এই বিয়াস নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদন করা হয়। আমরা চলতে লাগলাম, আমাদের সাথে সাথে বিয়াস নদীও এঁকে বেঁকে চলতে লাগলো। সবাই একটু উসখুস করতে লাগলো। বাসটা একটু থামানো যায় না, একটু নেমে নিচের নদীটা দেখে আসা যেত। ড্রাইভারের দরজায় নক করে সেই কথা বলতে ড্রাইভার সুবিধাজনক জায়গায় নিয়ে বাসটা থামালো। আমরা বাস থেকে নেমে হাত পা ছাড়লাম। ততক্ষনে সূর্য অস্ত যাই যাই করছে।

দ্ভ
টল্টলে নীল পানির বিয়াস নদী আমাদের সাথে এঁকেবেঁকে যাচ্ছিলো

শেষ বিকালের এই সময়টাতে আমরা বিয়াস নদীর ধার দিয়ে হেঁটে বেড়ালাম। খাদের কিনার দিয়ে হাঁটছি আর নিচেই বিয়াস নদী। অন্যপাশের পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে সাদা পানির ঝরনা। মনের অবস্থা তখন কেমন সে কথা আর না বোঝালেও হয়। মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালাম, আমার কপালে এত সুন্দর দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য রাখার জন্য ঠিক করলাম হোটেলে পৌঁছে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়বো। যখন সূর্য প্রায় ডুবে গেছে, তখন আমরা বাসে উঠে আবার রওয়ানা দিলাম। কোথাও থামাথামি নাই। এর মধ্যে অনেকেই থামতে বললো একটা বাথরুমের ধারে কাছে। বাসটা একবার থামলো। রাস্তার ধারে একটা জঙ্গলের মধ্যে দুইটা বাথরুম। কোন পানির ব্যবস্থা নাই, নাই কোন লাইট। লাভের লাভ তো কিছুই হলো না, কোনমতে মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে আবার বাসে উঠে বসলাম।

বাস আবার চলতে লাগলো। পথ আর শেষ হয় না। অনেকক্ষন পরে হঠাৎ রাস্তার দুই ধারে স্তুপের মতন কি যেন সব দেখা গেলো। আমরা উত্তেজিত হয়ে গবেষনা শুরু করলাম, ওগুলো কি বরফ নাকি অন্য কিছু। রাতের অন্ধকারে তেমন কিছু দেখাও যাচ্ছিলো না। তাই আমাদের তর্কও আর শেষ হচ্ছিলো না। এই করতে করতে আমরা যখন এসে পৌঁছালাম ‘চন্দ্রমুখী কটেজ’ এ তখন রাত ৯টা বাজে। কমিটির গ্রিন সিগনাল পেয়ে আমরা বাস থেকে নেমেই ঠান্ডার একটা ঝাপ্টা খেলাম। আমি তাড়াতাড়ি রাস্তার পাশে জমে থাকা স্তুপে পা দিয়ে লাথি মেরে দেখলাম এগুলো আসলেই বরফের স্তুপ। রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য দুইপাশে বরফগুলো স্তুপ করে রাখা হয়েছে। তবে বরফের সাথে মাটি মিশ্রিত থাকার কারণে স্তুপগুলোর রঙ সাদা নয় বরং ময়লা রঙের। এই জন্যই বাস থেকে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিলো ওগুলো বরফ কিনা।

আমরা গরমের দেশের মানুষ। তাই বরফ দেখে যে আমরা উত্তেজিত হয়ে উঠবো সেই কথা অনুমেয়ই ছিলো। কিন্তু উত্তেজনার বাঁধ ভাংলো যখন আমরা রাস্তা থেকে ঢাল বেয়ে নেমে চন্দ্রমুখী কটেজে ঢুকলাম। সিড়ি হিয়ে উঠে প্রথম যে রুমটা পেলাম সেটাতে ঢুকে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। মনে হলো যেন নেপালের কোন এক প্রাসাদে ঢুকে পড়েছি। বর্গাকৃতির বিছানা, দুইটা গদি আঁটা সোফা, চিকন লম্বা টেবিল, লাল কার্পেট দিয়ে সাজানো রুমটা ছবির মতন সুন্দর। একপাশের পুরো ওয়ালটা জুড়ে জানালা, তার সামনে কার্পেট দিয়ে ঢাকা এক সারি বসার জায়গা। ধবধবে সাদা বাথরুমে আছে বিশাল এক বাথটাব। বাথরুমের সব গুলো লাইন দিয়েই গরম পানির ব্যবস্থা। মজুমদার, মৌলি আর রুবাইদা লাগেজ টানতে টানতে রুমে এসে খুশিতে আত্মাহারা হয়ে উঠলো। আমি আর মজুমদার নাচতে শুরু করলাম। সারাটা দিন বাসের ছোট্ট সিটে বসে থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এই রকম হোটেল পেয়ে সব বিরক্তি নিমেষেই উধাউ হয়ে গেলো।

নাচানাচি শেষ করে টের পেলাম সারাদিন কিছুই খাওয়া হয় নাই, সেই সকালবেলা শেষ চিপস খেয়েছি আর এখন রাত হয়ে গেছে। দ্রুত খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। রুম থেকে বের হয়ে শুনলাম হোটেল আমাদের অফার দিয়েছে ওনারা আমাদের জন্য রান্না করতে পারে তবে ভেজ আর রুটি। আমরা তাতে রাজি হলাম না। হোটেলের সামনের ঢাল পার হয়ে রাস্তায় উঠে আমরা ডান দিকে গেলাম। একটা খাবারের দোকান দেখে তাড়াতাড়ি করে ঢুকে পড়লাম। কিন্তু সেই দোকানের লোকরা জানালো উনাদের রান্না করতে অনেক সময় লাগবে। তাছাড়া অল্প কিছু আইটেম পাওয়া যাবে। আমরা অনেকেই সেখান থেকে বের হয়ে গেলাম। এবার হাঁটতে হাঁটতে হোটেল থেকে বাম দিকের রাস্তা ধরলাম। রাত হয়ে গেছে। সব দোকানপাটই বন্ধ। একটা দোকান খোলা পেয়েই ঢুকে পড়লাম। দেখলাম আমাদের মানুষজন সব ভিতরে বসে আছে।

ঝটপট ৮০ রুপির ভেজ চাওমিন অর্ডার দিয়ে বসে রইলাম। দোকানটা ছোট্ট। দেখতে মনে হয় যেন নেপাল বা তিব্বতের কোন ঘরের ভিতর বসে আছি। কাঠের টেবিল আর বেঞ্চ গুলা সারি করে বসানো। পুরাই ফ্যামিলি দোকান। বাবা মা রান্না করেন, বড় ছেলে ক্যাশে বসে, মেজ ছেলে বাবা মাকে সাহায্য করে আর সবচেয়ে ছোট্ট যে মেয়ে যার নাম কাঞ্চন বা কান্নু, সে একটা বেবি কটে বসে কাস্টমারদের বিনোদন দেয়। এত্ত কিউট একটা মেয়ে, গোলাপি দুটা গাল- ওর সাথে খাতির করার জন্য আমাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গেলো। পিচ্চিটা তার কটে বসেই সবার সাথে হাসছিলো, ভেংচি কাটছিলো, রাগ করছিলো। হঠাৎ করে এতগুলো অর্ডার পেয়ে ওনাদের উপর বেশ চাপ পড়ে গেলো। ওনারা সময় লাগবে বলে দিলো। আমরাও বসে থেকে গল্পগুজব করতে লাগলাম। দোকানের দরজাটা স্লাইডিং, এর একটা পাল্লা আছে আরেকটা নাই। এই খোলা পাল্লার জায়গা দিয়ে হু হু করে হিম শীতল বাতাস ঢুকতে লাগলো। একটু পরেই বৃষ্টি পরার টিপ টিপ শব্দ হতে লাগলো। আমরা কপাল চাপড়ালাম, হায় বৃষ্টি- তুমি আর আমাদের পিছু ছাড়লে না!

আফচদ
কান্নু নামের ছোট্ট পুতুলটা

যখন সাদা ধবধবে বাটিতে করে ধোঁয়া ওঠা চাওমিন আসলো, সবার পেটের খিদে গুড়গুড় করে উঠলো। দারুন মজা ছিলো সে খাবারটা। শুধু চাওমিনই না, যারা সুপ, ভেজ মাঞ্চুরিয়ান, ফ্রাইড রাইস চপসুয়ে অর্ডার দিয়েছিলো তাদের সবার খাবারই অত্যন্ত মজা ছিলো।  আমরা গপাগপ খেয়ে ফেললাম। খেয়েদেয়ে দেরি না করেই আমরা বের হয়ে পড়লাম। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে শীতের রাতে দৌঁড় লাগলাম হোটেলের দিকে। এই রকম -২ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বৃষ্টিতে দৌড়াতে হবে এটা কল্পনাতীত ছিলো। যাই হোক দৌড়াতে দৌড়াতে হোটেলের সিড়ি ঘরে এসে পৌছালাম আমরা। সিড়ির আলোতে রুবাইদা একটা আর্তচিৎকার দিলো। নিজের ওভারকোটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম- হাজার হাজার চকচকে কণা ঝিকমিক করছে। তু-ষা-র-পা-ত।

আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম। তাহলে যেটাকে বৃষ্টি মনে করেছি সেটা আসলে তুষার পাত! আমার খুশিতে নাচতে ইচ্ছা হলো। দৌড়িয়ে রুমে ঢুকে সবাইকে চিৎকার করে বললাম তুষারপাতের কথা। কিন্তু মজুমদার আর মৌলি মুখ শুকনা করে লেপের তলা থেকে বললো, প্রচন্ড ঠান্ডায় কিছুতেই শরীর গরম হচ্ছে না। এই ঠান্ডায় ঘুমানো সম্ভব নয়। আমি দৌড়াদৌড়ি করে এসেছি বলে ততটা টের পাচ্ছিলাম না। রুম সার্ভিসে ফোন দিয়ে বলি রুম হিটারের ব্যবস্থা আছে কিনা। ওরা বলে রুম হিটারে নেই তবে প্রত্যেক রুমের ক্যবিনেটে এক্সট্রা লেপ দেওয়া আছে। আমি ক্যাবিনেট খুলে এক্সট্রা লেপটা বের করে ওদের গায়ে ছড়িয়ে দেই।

ওভারকোটটা খুলে বাকিসব গরম কাপড় পরেই লেপের নিচে ঢুকে পড়ি। কানে উলের টুপি, গলায় মাফলার, হাতে আর পায়ে মোজা, গায়ে একাধিক গরম কাপড়, দুইটা লেপ আর নিজেদের একটা করে কম্বলের নিচে চাপা পড়ে ঘুমাতে চেষ্টা করি। একসময় আরামদায়ক একটা তাপমাত্রা তৈরি হয় লেপের নিচে আর সাথে সাথেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি।

The Mighty INDIA CALLING: হিম ঠান্ডা আর ছবির মতন সাজানো শহর সিমলা (পর্ব ১০)

সারা রাতে ঘুমের ফাঁকে ফাঁকে তুষার আর শুভর আর্ত চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। মৌলি আর ঐশির উৎকন্ঠা টের পাচ্ছিলাম ‘ড্রাইভারকে বল আস্তে চালাতে/ সাবধানে চালাতে বল’। পুরো বাস যে সাপের লেজের মতন পথ দিয়ে চলছে তা ঘুমের ঘোরেও টের পাচ্ছিলাম। মাঝে একবার চোখ খুলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। এমন এক অদ্ভূত দৃশ্য জানালার বাইরে যা কোন ভাষাতেই বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। আমরা প্রায় বাসের সমান সমান চওড়া রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি যার একপাশে পাহাড় আর অন্যপাশে খাদ। জানালা দিয়ে নিচে তাকালে কোন রাস্তা চোখে পড়ে না কারণ চাকার পরই খাদ। আর দূরে পাহাড়ের গায়ে বিল্ডিংগুলো থেকে জ্বলে ওঠা বাতিগুলোকে দেখে চোয়াল ঝুলে পড়লো। আকাশ সমান উঁচু পাহাড়গুলোর গায়ে গড়ে ওঠা বসতিগুলোকে রাতের অন্ধকারের মাঝে ভ্যান গগের ‘স্টারি নাইটের’ বাস্তব অন্ধকার সংস্করণ বলেই মনে হলো। এ এক অপার্থিব দৃশ্য। যারা দেখে নাই তাদের বলে বোঝানোর মত ক্ষমতা আমার নাই। আমার পাশেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে রুবাইদা। ভাবলাম ওকে ডাক দেই। কিন্তু ও সাড়া দিলো না। খানিক পরে আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম।

ফ্রগ
দূর পাহাড়ের গায়ে জেগে ওঠা ঘরবাড়ি, সারা সিমলা জুড়েই চোখে পড়ে এমন দৃশ্য (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

ভোর বেলায় আমরা পৌঁছালাম সিমলায়। কমিটির লোকজন হোটেল ঠিকঠাক করলো কয়েক জায়গায় ঘুরে। অনেক পরে অবশেষে আমাদের জন্য ঠিক করা হলো ‘হোটেল শাইল’। আমরা বাস থেকে নেমে পড়লাম। বেশ ফুরফুরে ঠান্ডা বাইরে। তাকিয়ে দেখলাম আমাদের হোটেলের এন্ট্রি রাস্তার লেভেল থেকে অনেক নিচে। অনেক ঢালু পথ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে লাগেজ গুলোকে নিয়ে হোটেলে পৌঁছালাম। আমি আর মজুমদার গিয়ে একটা রুমে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে যাই- এত সুন্দর হোটেল। চমৎকার রুম, লাল রঙের কার্পেট, সুন্দর বিছানা, একটা বে উইন্ডো যেটাতে বসার জন্য আমরা হুড়াহুড়ি শুরু করলাম। দরজা লাগিয়ে আমি আর মজুমদার গান গাইতে গাইতে নাচতে লাগলাম। হটাৎ শুনলাম সুমাইয়ার মোবাইল আর মানি ব্যাগ বাস থেকে হারিয়ে গেছে। ও প্রত্যেক রুমে রুমে এসে খোঁজ নিতে লাগলো আমরা সেগুলো দেখেছি কিনা। এসব শুনে আমাদের মন খারাপ হয়ে গেলো।

একটু ধাতস্থ হয়ে আমরা আমাদের সব শীতের কাপড় বের করতে লাগলাম। চকচকে বাথরুমে গরম গরম পানি দিয়ে আমরা একেক জন গোসল করতে লাগলাম। কি যে ভালো লাগলো- আহা! জামা কাপড় গুছিয়ে অন্য সবার সাথেই বের হতে হতে বেশ দেরি হয়ে গেল। হোটেল থেকে বের হয়ে একটু সামনে গিয়েই আমরা থেমে গেলাম। মেইন রাস্তার বাঁকে, পাহাড়ের কিনারায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম। নীল আকাশে হালকা সাদা সাদা মেঘ, পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা ঘরবাড়ি, গাঢ় সবুজ গাছ, ফুরফুরে বাতাস, রিফ্রেশিং এক ধরনের ঠান্ডা আমাকে পুরাই স্পেলবাউন্ড করে দিলো। মনে হলো যেন আমাদের দেশের ট্রাকগুলোর পিছনে আঁকা প্রাকৃতিক দৃশ্যর বাস্তব রূপ এটা। আমরা মল রোডে যাবার জন্য একটা বাসে উঠলাম। বাসগুলোতে জোরে জোরে হিন্দি গান বাজতে থাকে। উঁচু নিচু ঢালু বাঁক পার হয়ে সেই বাস আমাদের ১০ রুপি ভাড়া নিয়ে একটা জায়গায় নামিয়ে দিলো। সেখান থেকে ঢালু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গরটন ক্যাসেলের পাশে আমরা একটা হোটেলে মায়িশা, নোভাদের দেখলাম। আমরাও ঢুকে পড়লাম। জায়গা খালি হতেই আমরা বসে পড়লাম।

অন্যান্য জায়গা থেকে এখানে খাবারের দাম বেশি হবে জানতাম কারণ এটা টুরিস্ট স্পট। আমি আর রুবাইদা মায়িশাদের কাছ থেকে সাজেশন নিয়ে ১৭০রুপির পাঞ্জাবী থালি অর্ডার দিলাম। থালিতে চিজের তরকারি, ডাল, রুটি আর ভাত ছিলো। খেতে মোটামুটি। খেয়েদেয়ে আমরা বের হয়ে আসলাম। চোখের সামনে গরটন ক্যাসেল সবার আগে ছিলো। তাই সেটাতেই ঢুকে পড়লাম। এটা আসলে সরকারি অফিস। অফিস আওয়ার শেষ কিন্তু সামনে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পুরা ক্যাসেলে সাজানোর কাজ হচ্ছে। আমরা সেখানে এক লোকের কাছে পারমিশন নিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। অনেক বড় কিন্তু সুন্দর বিল্ডিং। ভিতরে কেউ নাই শুধু আমি আর রুবাইদা। বিল্ডিংটার মধ্যে গ্রিক এবং ইন্ডিয়ান স্থাপত্যের মিশেল আছে। এত বড় বিল্ডিঙে আমরা দুইজন ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। অনেকক্ষন ঘোরার পর বেশ ভয়ভয় করতে লাগলো। আমরা তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে পড়লাম।

গরটন ক্যাসেল থেকে বের হয়ে সামনে দাঁড়াতেই জোর বাতাস এসে হাঁড় কাঁপিয়ে দিলো। দুই জোড়া হাত মোজাই আমি একসাথে পড়ে ফেললাম। তারপর ঢাল বেয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম। কি চমৎকার দৃশ্য রাস্তার দুইপাশে। সমতল রাস্তা থেকে হয় উঁচুতে না হয় নিচুতে ঘরবাড়িগুলো। আবার লাল রঙের টালি ওয়ালা বাড়ির ছাদ থেকে গাছের ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে বানরের দল। এখানে বানরের বেশ আধিপত্য। এখানে হনুমানের অনুসারীর সংখ্যা বেশি। কয়েকটা গেটে হনুমানের মুর্তি দেখলাম তবে বেশিরভাগই ডিজপ্রপোরশনেট। এখানে একটা মেইন রোড ধরে শুধুমাত্র গাড়ি চলে। আর বাদবাকি সব জায়গায় হেঁটে বা সাইকেলে চড়ে যেতে হয়। এইরকম ঢাল বেয়ে ওঠা নামা করার জন্য আমাদের হাতে তাই হাঁটা ছাড়া আর অপশন রইলো না। আমরা অনেক হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছালাম ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ অ্যাডভান্স স্টাডিজের গেটে। ঢাল বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি, রুবাইদা আর সারা পিছিয়ে পড়ি। পিছিয়েই যেহেতু পড়েছি তাই একটু রেস্ট নিয়েই যাই ভেবে আমরা পাহাড়ের ঢালের ধারে একটা বেঞ্চে বসে পড়লাম। আমাদের পাশেই আমাদেরকে কোন পাত্তা না দিয়েই ধাড়ি ধাড়ি বানর ঘোরাফেরা করতে লাগলো। বানর পরিবারকে দেখে ভালো লাগলো। বাচ্চা বানর মা বানরের কোলে জাপটে ধরে বসে আছে। সেই অবস্থাতেই মা বানরটা লং ডিস্টেন্স জাম্প দিয়ে আমাদের তাজ্জব করে দিচ্ছে।

একটু রেস্ট নিয়ে আমরা যখন পাহাড়ের চূড়ায় প্রাসাদটাতে পৌঁছালাম তখন সূর্য নেমে গেছে। আমরা টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকি কিন্তু বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে দেখে আমাদের বিল্ডিঙয়ে ঢুকতে দেয় না। বাইরে থেকে দেখে আমার মনে হয় আমি যেন ইংল্যান্ডের কোন প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এত সুন্দর আর বিলাসী একটা প্রাসাদ বৃটিশরা এত উঁচু একটা পাহাড়ের চূড়ায় কেমন করে বানালো ভেবে আমি কোন কূল পেলাম না। লর্ড লিটন নামের কেউ একজন গরমের সময় ছুটি কাটানোর জন্য এই প্রাসাদটা তৈরি করেন। এর ভিতরে নাকি রুম গরম করার জন্য নিজস্ব মেকানিজম ছিলো। শুধু কি প্রাসাদ? প্রাসাদের সামনের অংশটাও কম সুন্দর কি? একেবারে পাহাড়ের চূড়া, এখান থেকে তাকালে মনে হবে বুঝি বেহেশত বোধহয় এইরকমই সুন্দর। আমরা সেই বেহেশ্তি জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখলাম। সূর্য ডুবার পরও আমার সেখান থেকে যেতে ইচ্ছা করছিলো না। কিন্তু এখনই অন্ধকার নামবে দেখে আমরা তাড়াতাড়ি রওয়ানা দিলাম। ঢাল বেয়ে নামতে নামতে আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলাম একবার শ্বাসরুদ্ধকর প্রাসাদটাকে। আহ_____। পরে জানলাম এই প্রাসাদেই নাকি ’৪৭ সালে ভারত, পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের স্বাধীনতার সিদ্ধান্ত হয়।

আমরা নেমে গেটের কাছে আসি। তারপর ক্যাব ভাড়া করে মল রোডের দিকে রওয়ানা দেই। রাস্তা থেকে দেখতে পাই পাহাড়ের গায়ে সবুজ গাছের ভিতর থেকে বিশাল এক হনুমানের মুর্তি বের হয়ে আছে। তীব্র হলুদ লাইটে মুর্তির গায়ে রিফ্লেক্ট করে চকচকে সোনার ইফেক্ট দিচ্ছে। এত দূরের থেকে যখন এই স্কেলের মুর্তি দেখা যাচ্ছে, তখন ওটার আসল হাইটের কথা আমি ভেবেই পেলাম না কত হতে পারে। কম সেকম ১০০ ফিট বা ১০ তলা বাড়ির সমান তো হবেই, আরও বেশি হতে পারে। রাতের অন্ধকারে পাহাড়ের গায়ের ঘন জংগল থেকে গদা হাতে নিয়ে বিশাল এক সোনার হনুমানের মুর্তি যে তাকিয়ে আছে পুরা সিমলার দিকে- দেখতে এতই অবাক লাগে যে চোখ ফেরানো যায় না।

দচ
শেষ বিকালে পাহাড় চূড়ায় ব্রিটিশ প্রাসাদে 

ক্যাব আমাদের মল রোডে বিশাল গাড়ির লাইনের সামনে নামিয়ে দেয়। ড্রাইভার মজুমদারকে বুঝিয়ে বলে এখানে একটা লিফট আছে। টিকেট কেটে সেই লিফটে করে উপরে উঠতে হবে। তারপর আমরা কেনাকাটা করার দোকানপাটগুলো পাবো। আমরা ১০ রুপি দিয়ে টিকেট কেটে সেই লিফটে উঠার লাইনে দাঁড়ালাম। বিশাল লাইন। একটু একটু করে আগাচ্ছে লাইন। অনেক পরে আমরা লিফটে উঠলাম। সেই লিফট একটা হাইটে উঠে নামিয়ে দিলো। তারপর অনেকটা পথ হেঁটে গিয়ে আরেকটা লিফট ধরতে হয়। সেই লিফট নামিয়ে দেয় মলে। মল আসলে কিছুই না। রাস্তার দুইপাশে সারি সারি দোকানপাট। বেশীরভাগই সোয়েটার, শাল, টুপি এই সবের দোকান। শাল আর সোয়েটারগুলো বেশ সুন্দর। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকি। আমার মোবাইলের ব্যালেন্স রিচার্জ করার দরকার হয়। আমি খুঁজতে থাকি মোবাইল রিচার্জের দোকান। পুরা রাস্তা ঘুরেও কোন রিচার্জের দোকান পাই না।

কে এফ সির দোকান দেখে আমি সেখানেই ঢুকে পড়ি রাতের খাবারের জন্য। অর্ডার দেই ৮০ রুপির ভেজ বার্গার। সেখান থেকে বের হয়ে মজুমদার আর আমি মোবাইল রিচার্জের দোকান খুঁজতে থাকি। কে এক জন বললো সামনে ‘বিল্লো ব্যাঙ্ক’ আছে সেখানে রিচার্জ পাওয়া যাবে। আমি আর মজুমদার সারা এলাকা চষে ফেললাম খুঁজতে খুঁজতে। তারপর একটা বন্ধ দোকানের সাইনবোর্ডে দেখি লিখা ‘উইলো ব্যাঙ্ক’। কি আর করা মোবাইল রিচার্জ না করেই আমরা ফেরার পথ ধরলাম। রুবাইদা আর আমি লিফটে করে নিচে নামার সময় আলাদা হয়ে যাই। সেই বিশাল লাইন ধরেই দৌড়াদৌড়ি করে নিচে নেমে আমরা রুবাইদার জন্য অপেক্ষা করি। মজুমদার এখানেও মোবাইল রিচার্জের দোকান খুঁজতে যায়। ফিরে এসে মুখ খিঁচিয়ে বলে, ‘এত্ত বড় ভোদাফোনের সাইনবোর্ড টানায় দোকান সাজায় রাখসে, কিন্তু মুখে বলে- রিচার্জ তো নেহি মিলে গা’। কি অদ্ভূত জায়গা রে বাপ, একটা ফোনের রিচার্জ পাওয়া যায় না!  ওদিকে মাইক্রো ভাড়া ঠিক হয়ে যায় তাই রুবাইদাকে ফেলেই আমরা রওয়ানা দিয়ে দেই। ফোনে ওর সাথে যোগাযোগও করতে পারছিলাম না। আমি বেশ অপরাধবোধে ভুগছিলাম। পথে গাড়ি থামিয়ে মজুমদার এক দোকানে রিচার্জের জন্য নামে। সেই দোকানে রিচার্জ করা পসিবল না হলেও ২০ রুপির কার্ড ও কিনে আনে নিজের জন্য আর আমার জন্য। মাইক্রো আমাদের হোটেলে নামিয়ে দেয়। আমাদের নয়জনের ভাগে ভাড়া পড়ে ৪৫ রুপি করে।

রুমে ঢুকে আমি জানালা দিয়ে আবার সেই মনোমুগ্ধকর রাতের দৃশ্য দেখতে থাকি। কিছুক্ষন পর রুবাইদা ফেরত আসে। ওর নাকি আসতে কোন অসুবিধাই হয় নাই। সকালের জন্য জামা কাপড় ঠিক করে আমরা ঘুমানোর ব্যবস্থা করতে থাকি। মজুমদার আর মৌলি নোভাদের রুমে যায়। রুমে থাকি শুধু আমি আর রুবাইদা। আমি গরম জামাকাপড় পরেই লেপ কম্বলের নিচে ঢুকে পড়ি। উহ বাবা- কি শীঈঈঈঈঈঈঈত।