ঘুম থেকে ঊঠলাম সকাল ৭ টার দিকে। রুবাইদা, মজুমদার আর মৌলি ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে নিচে ছেলেদের রুমে জমা দিয়ে বের হয়ে পড়লো। আমি একা একা ব্যাগ গুছালাম। সারা রুম তন্নতন্ন করে চেক করলাম, যে কিছু ফেলে যাচ্ছি কিনা আমরা। এক পর্যায়ে লাগেজ নিচের রুমে জমা দিয়ে রুমে এসে বসে থাকলাম। এর মধ্যে নিশাতরা ভুল করে আমাকে ফেলেই বের হয়ে পড়ে। আবার ফোন করে যোগাযোগ করে নিউ মার্কেটের সামনে ওদের সাথে যোগ দেই।
তারপর নিশাত আলাদা হয়ে যায়। আমরা অলিগলি দিয়ে বেশ ভিতরে ঢুকে পড়ি। আবার নিশাতকে খোঁজার জন্য আমি আর রিন্তু এগিয়ে যাই। এরপর দেখা যায় নিশাত সবাইকে খুঁজে পেয়েছে কিন্তু আমি আর রিন্তুই হারিয়ে গেছি। আবার খোঁজাখুঁজি করে সবাই একত্র হলাম। এরপর রওয়ানা দেই মার্কুইস স্ট্রিটে। মানি এক্সচেঞ্জে টাকা ভাঙ্গিয়ে রুপি করে নিলাম। আবার গেলাম আরাফাত হোটেলে। এবার অর্ডার দিলাম ৫ রুপির পুরি আর ৩৫ রুপির ডাল-খাসি। আমার খরচ পড়লো ২২ রুপি। পেট ভরে খেয়েদেয়ে আমরা বের হলাম- এবারের গন্তব্য সায়েন্স সিটি।
রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশকে জিজ্ঞেস করে বেশ কিছু দূর হেঁটে তিনটা মোড় পার হয়ে আমরা ২৪/এ বাসের জন্য দাঁড়ালাম। পথে আমি ২০ রুপি দিয়ে দুইটা ডাস ডাসা পেয়ারা কিনে নিলাম। পরে কাঠের মিনিবাস টাইপের বাসে না উঠে একটা বড় বাসে উঠে পড়ি। বেশ ফাঁকা বাস। আমরা হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বসি। দূরত্ব ঘন্টাখানেকের হলেও ভাড়া ৯ রুপি। আমি জানালা দিয়ে দুপাশের কলকাতা শহর দেখতে থাকি। ভারি অদ্ভুত এই শহর, ভারি অদ্ভুত।
আমাদের সাইন্স সিটির গেটের উলটা পাশে নামিয়ে দেয়। আমরা আন্ডারপাস দিয়ে রাস্তা ক্রস করে আসি। আন্ডারপাসটায় আমরা ছাড়া আর কেউ ছিলো না। আমরা হাউকাউ করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলি। সায়েন্স সিটির গেটের সামনে বিশাল এক ডাইনোসোরের মুর্তি। আর একটু পাশে বিক্রি হচ্ছিলো স্ট্রিট ফুড। তমা চা খেলো। কাপের সাইজ এত ছোট মনে হলো যেন ওষুধ খাওয়ার কাপ। একটু পরেই রুবাইদা, মজুমদার ওদের সাথে দেখা হলো। ওরা বের হয়ে যাচ্ছে আর আমরা ঢুকছি। রুবাইদার পরামর্শ মত আমরা ৪০ রুপি দিয়ে এন্ট্রি টিকেট কাটলাম। আর নিশাত কাটলো ৭০ রুপি দিয়ে কেবল কারের টিকেট। এটা তেমন কিছুই না। খালি গেটটা পার করে দেয় কেবল কার দিয়ে।
ভেতরটা বেশ বড়। অনেকগুলো আলাদা বিল্ডিং। মেইন গ্যালারীটা পুরাই র্যাম্প করে স্পাইরাল হয়ে উপরে উঠে গেছে। আমরা দুই ভাগ হয়ে গ্যালারি দেখলাম। ছোট্ট কালে পড়া বিজ্ঞান বইয়ের সব উদাহরণ চোখের সামনে দেখতে পেয়ে ভালোই লাগলো। ঘুরতে ঘুরতে টায়ার্ড হয়ে আমি, অবনী আর তমা গ্যালারি ছেড়ে বের হলাম প্রায় পৌনে চারটার দিকে। আমাদের চারটার মধ্যে হোটেল থেকে হাওড়া স্টেশনে রওয়ানা হওয়ার কথা। দেরি হয়ে গেছে দেখে আমরা তাড়াতাড়ি একটা বাস ধরলাম নিউমার্কেট পর্যন্ত। ভাড়া একই নিলো কিন্তু উঠার সময় ট্রাফিক পুলিশ বলে দিয়ে ছিলো পকেটমার থেকে সাবধান থাকতে। আমরা কোনমতে বাস থেকে নেমে টানা রিক্সায় চড়ে সাড়ে চারটার দিকে হোটেলে পৌঁছলাম। নিচে দেখি একটা একটা করে ট্যাক্সি ক্যাবে করে মানুষজন উঠে রওয়ানা দিচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি করে নিচের রুম থেকে নিজের লাগেজ বের করে শান্ত, লিয়া, সৃষ্টির সাথে এক ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম। ট্যাক্সি ভাড়া মোট ১৫০ রুপি।
আগে থেকেই কমিটি বলে দিয়েছিলো পুরানো স্টেশনে নামতে। আমরা তাই নামলাম। ট্যাক্সি থামতেই কুলির দল এসে হাজির হলো। তারা বললো দিল্লীর ট্রেন কল্কা মেইল তো নতুন স্টেশনে। আমরা তাদেরকে পাত্তা না দিয়ে নিজেরাই লাগেজ টেনে পুরানো স্টেশনে ঢুকলাম। ঢুকে জানতে পারলাম আমাদের ট্রেন আসলেই নতুন স্টেশনে আসবে। অগত্যা বিশাল রাস্তা আমাদের পাড়ি দিতে হলো এই সব ব্যাগপত্র নিয়ে। অবশেষে হাতের আঙ্গুলে লাল দাগ ফেলে আমরা নতুন স্টেশনে পৌঁছলাম। বি-শা-ল স্টেশন। অ-নে-ক মানুষ। অবশেষে খোঁজাখুঁজি করে জাফরকে পেলাম। তখনই জানলাম ঘটনাটা।
সন্ধ্যা ৭টার কল্কা মেইল ডিলে করেছে। কত সময়ের জন্য তা কেউ বলতে পারলো না। তবে মিনিমাম ১০-১১ ঘন্টা তো হবেই। বাজ পড়লো সবার মাথায়। এর মানে এই খোলা প্ল্যাটফর্মে বসে রাত পার করতে হবে? এই শীতের মধ্যে? Oh no!
তবে আমাদের মানুষেরা থাকলে কষ্ট করে হলেও কোন মতে থাকা যাবে, প্ল্যাটফর্ম দেখতে দেখতে আমি মনে মনে ভাবলাম। এর মধ্যে জাফর এসে জানালো উপরে মেয়েদের ওয়েটিং রুম আছে। আমরা সেখানেই থাকবো। প্ল্যাটফর্মে থাকতে হবে না আমি তাতেই খুশি। ব্যাগ টানতে টানতে লিফটে উঠলাম। লিফটের ভেতর মায়িশা আর নোভাকে রাগে ফেটে পড়তে দেখলাম। কমিটির কর্মকান্ড নিয়ে নাখোশ ওরা। ওদের দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেলাম আমি। মনে হচ্ছিলো একটা না একটা গন্ডোগোল লাগবেই। ওয়েটিং রুমে ঢুকে দেখি রুবাইদা সবচেয়ে পিছনের রোতে মালপত্র গুছিয়ে, শিকল তালা মেরে ঘুমানোর পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে বসে আছে। আমাকে দেখে বল্লো, ‘নুযহাত, তোমার জন্য জায়গা রেখেছি। পিছনে দেওয়ালের সাথে মাথা ঠেস দিয়ে ঘুমানো যাবে। আর নিচে ব্যাগের উপর পা রাখলে আরাম হবে। আমরা চুপচাপ এখানে বসে থাকি। পরিস্থিতি ভালো না’। বুঝলাম আমার মত রুবাইদাও উত্তপ্ত পরিস্থিতির আঁচ পেয়েছে।
আস্তে আস্তে আমাদের মানুষজন সবাই এক এক করে আসতে লাগলো। সবাইরই মন কম বেশি খারাপ। এই রকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলো না কেউই। আমি সবার সাথে কথা বলে পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করলাম। এদিক সেদিক ঘুরে দেখতে লাগলাম আগামী ১২ ঘন্টা আমাকে কোথায় কাটাতে হবে। মোটমাট দুইটা ওয়েটিং রুম। ছেলেদেরটা বাইরে আর মেয়েদেরটা ভিতরে। মেয়েদেরটাতে চমৎকার টয়লেট আছে। ২ রুপি, ৩ রুপি, ৫ রুপি দিয়ে ঢুকতে হয়। ভেতরে গোসলখানাও আছে। আশেপাশের মানুষদের দেখলাম। সবাই মনে হলো ব্যাপারটাতে অভ্যস্ত যে ট্রেন লেট হবে, আর এক দুই রাত ওয়েটিং রুমে থাকতে হবে। এক মহিলাকে তো গোসল করে শাড়ি বদলে চুল মুছতে দেখলাম। এক ফ্যামিলিকে দেখলাম সুন্দরমত ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে টিফিন ক্যারিয়ারে করে পরোটা, তরকারি খেতে। দেখে মনে হল যেন পিকনিক করতে এসেছে। আর বারবার মাইকে একটা অ্যানাউন্সমেন্ট বাজতে লাগলো। কি যে বলে আমরা কিছুই বুঝি না। বিরক্তিকর এই অ্যানাউন্সমেন্ট বাজতেই লাগলো। চারপাশের সবাইকে দেখে মনে হল আমরা ছাড়া কারও কোন টেনশন নেই। ১০-১২ ঘন্টা ট্রেন লেট যেন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
এক সময় আমাদের সবাই চলে আসলো। ছেলেরা ওদের মালপত্র সব মেয়েদের ওয়েটিং রুমের একটা শেলফের মধ্যে স্তুপ করে রেখে শিকল দিয়ে ভালোমত জড়িয়ে তালা মেরে দিলো। বেচারা কমিটি মেম্বারদের জন্য আমার খারাপ লাগলো। তবে বেশ কিছুক্ষণ পার হয়ে যাওয়ায় উত্তপ্ত পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়েছে বলে কেউ কারও উপর চড়াও হলো না। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যুদ্ধ যুদ্ধভাবটা অনেকটাই কমে গেছে।
সবে মোটে সন্ধ্যা পার হয়েছে। রুবাইদাকে দেখলাম চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে দেওয়ালে মাথা ঠেস দিয়ে ঘুম দিতে। আমারও ক্লান্ত লাগছিলো। খানিক্ষন চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিলাম। দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নাই। কিছু খেয়ে নেওয়া উচিৎ- মনে মনে ভাবলাম।
রাতে খাওয়ার জন্য নিচে নামলাম। ইতোমধ্যে অনেকে খেয়ে এসে রিপোর্ট দিয়ে গেছে। ওদের পরামর্শ মত খেতে ঢুকলাম ‘জন আহার’ নামক রেস্টুরেন্টে। আমি নিলাম ৩৫ রুপির ভেজ থালি। এই থালিতে ছিলো ভাত, পাতলা ডাল, আলুর ঝোল তরকারি, ফ্রি আচার আর লাল রঙের কি একটা সবজি জাতীয় জিনিস যেটা খেতে খুবই বাজে। খাওয়াটা অসম্ভব ঝাল ছিলো। আমার বেশ কষ্ট হলো। অনেকেই নিলো ৩৬ রুপির ছোলা ভাটুরা, ৩৫ রুপির ভেজ চাওমিন। চাওমিনটাই সবচেয়ে মজা ছিলো। অবাক হয়ে গেলাম ডেজার্টের দাম দেখে। মাত্র ১৪ রুপিতে পেস্ট্রি পাওয়া যায় এখানে। আমরা একসাথে বসে গল্পগুজব করে খেতে থাকি। খাওয়া শেষে আমি পেয়ারা ধুয়ে খাই। তারপর অন্য সবার সাথে স্টেশন ঘুরতে বের হই।
আমি এত বড় রেল স্টেশন আগে দেখি নাই। অনেক অনেক প্ল্যাটফর্ম। অনেক মানুষ চারপাশে। একপাশে সারি বেঁধে দোকান। রসগোল্লা, বাদাম, ডাল, চানাচুর, চিপস কি নাই সেখানে! আমাদের অনেকেই বাতাস দিয়ে ফুলানো বালিশ কিনলো। আমরা এটা সেটা দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগলাম। তারপর আবার ফেরত আসলাম ওয়েটিং রুমে।
কিছুক্ষন পর আবিষ্কার হলো, তমার পার্স চুরি হয়ে গিয়েছে। আমরা যখন দোকানপাট দেখছিলাম তখনই কেউ ওর ব্যাগ খুলে মেরে দিয়েছে পার্সটা। পার্সে এক হাজারের মত রুপি ছিলো, দেশের সিম কার্ডটা ছিলো, লাগেজের চাবি ছিলো আর ছিলো শিকলের চাবি। শিকলের চাবিটা হারিয়েছে দেখে তমা চিন্তিত হয়ে পড়লো। ওর লাগেজ তো শিকল দিয়ে বাঁধা আছে তাও আবার অন্যদের লাগেজের সাথে। শিকল খুলতে না পারলে কেমন করে হবে?
আমি খেয়েদেয়ে দাঁত মাজতে গেলাম। মেয়েদের বাথরুমে ঢুকতে গেলেই পয়সা দিতে হয়। দাঁত মাজার জন্য পয়সা দিতে ইচ্ছা হলো না। আমি গেলাম একটা খোলা বারান্দা টাইপ জায়গায়। সেখানে বেসিন আছে। আমি হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে দাঁত মাজতে লাগলাম। কনকনে শীত, উপরে খোলা আকাশ, নিচে ঝলমলে হাওড়া স্টেশন আর কাছেই রঙ্গিন হাওড়া ব্রিজ- এরকম জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি দাঁত মাজবো, জীবনে কোনদিন কল্পনাও করি নাই। দাঁত মাজতে মাজতেই দেখতে লাগলাম রাতের কোলকাতা শহর আর হাওড়া ব্রিজের রংচঙ্গে লাইট। প্রচন্ড ঠান্ডা পানি দিয়ে কুলি করে হাত মুখ সব অবশ করে আমি ফেরত আসলাম।
সত্যি বলতে কি আমার বেশ ভালোই লাগছিলো। এই রকম একটা অভিজ্ঞতা আমার আগে কখনও হয় নাই। ওয়েটিং রুমটাকে বাসাবাড়ি বানিয়ে বসে থাকাটা চমৎকার লাগছিলো। আমরা গল্পগুজব করতে লাগলাম আর হাহা হিহি করে ফেটে পড়তে লাগলাম। অন্যরা এর মধ্যে শাল কম্বল মুড়ি দিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করলো। এক পর্যায়ে আমাদেরও কথাবার্তা কমতে লাগলো। সবাই নেক পিলোতে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করতে শুরু করলো। আমিও চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুম আসলো না। মাঝে মাঝে খুট খাট শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম- তমার ব্যর্থ প্রচেষ্টা শিকল আর তালা ভাঙ্গার। আর কানের কাছে জোরে জোরে বাজতেই লাগলো সেই অসহ্যকর অ্যানাউন্সমেন্ট………