The Mighty INDIA CALLING: হিম ঠান্ডা আর ছবির মতন সাজানো শহর সিমলা (পর্ব ১০)

সারা রাতে ঘুমের ফাঁকে ফাঁকে তুষার আর শুভর আর্ত চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। মৌলি আর ঐশির উৎকন্ঠা টের পাচ্ছিলাম ‘ড্রাইভারকে বল আস্তে চালাতে/ সাবধানে চালাতে বল’। পুরো বাস যে সাপের লেজের মতন পথ দিয়ে চলছে তা ঘুমের ঘোরেও টের পাচ্ছিলাম। মাঝে একবার চোখ খুলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। এমন এক অদ্ভূত দৃশ্য জানালার বাইরে যা কোন ভাষাতেই বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। আমরা প্রায় বাসের সমান সমান চওড়া রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি যার একপাশে পাহাড় আর অন্যপাশে খাদ। জানালা দিয়ে নিচে তাকালে কোন রাস্তা চোখে পড়ে না কারণ চাকার পরই খাদ। আর দূরে পাহাড়ের গায়ে বিল্ডিংগুলো থেকে জ্বলে ওঠা বাতিগুলোকে দেখে চোয়াল ঝুলে পড়লো। আকাশ সমান উঁচু পাহাড়গুলোর গায়ে গড়ে ওঠা বসতিগুলোকে রাতের অন্ধকারের মাঝে ভ্যান গগের ‘স্টারি নাইটের’ বাস্তব অন্ধকার সংস্করণ বলেই মনে হলো। এ এক অপার্থিব দৃশ্য। যারা দেখে নাই তাদের বলে বোঝানোর মত ক্ষমতা আমার নাই। আমার পাশেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে রুবাইদা। ভাবলাম ওকে ডাক দেই। কিন্তু ও সাড়া দিলো না। খানিক পরে আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম।

ফ্রগ
দূর পাহাড়ের গায়ে জেগে ওঠা ঘরবাড়ি, সারা সিমলা জুড়েই চোখে পড়ে এমন দৃশ্য (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

ভোর বেলায় আমরা পৌঁছালাম সিমলায়। কমিটির লোকজন হোটেল ঠিকঠাক করলো কয়েক জায়গায় ঘুরে। অনেক পরে অবশেষে আমাদের জন্য ঠিক করা হলো ‘হোটেল শাইল’। আমরা বাস থেকে নেমে পড়লাম। বেশ ফুরফুরে ঠান্ডা বাইরে। তাকিয়ে দেখলাম আমাদের হোটেলের এন্ট্রি রাস্তার লেভেল থেকে অনেক নিচে। অনেক ঢালু পথ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে লাগেজ গুলোকে নিয়ে হোটেলে পৌঁছালাম। আমি আর মজুমদার গিয়ে একটা রুমে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে যাই- এত সুন্দর হোটেল। চমৎকার রুম, লাল রঙের কার্পেট, সুন্দর বিছানা, একটা বে উইন্ডো যেটাতে বসার জন্য আমরা হুড়াহুড়ি শুরু করলাম। দরজা লাগিয়ে আমি আর মজুমদার গান গাইতে গাইতে নাচতে লাগলাম। হটাৎ শুনলাম সুমাইয়ার মোবাইল আর মানি ব্যাগ বাস থেকে হারিয়ে গেছে। ও প্রত্যেক রুমে রুমে এসে খোঁজ নিতে লাগলো আমরা সেগুলো দেখেছি কিনা। এসব শুনে আমাদের মন খারাপ হয়ে গেলো।

একটু ধাতস্থ হয়ে আমরা আমাদের সব শীতের কাপড় বের করতে লাগলাম। চকচকে বাথরুমে গরম গরম পানি দিয়ে আমরা একেক জন গোসল করতে লাগলাম। কি যে ভালো লাগলো- আহা! জামা কাপড় গুছিয়ে অন্য সবার সাথেই বের হতে হতে বেশ দেরি হয়ে গেল। হোটেল থেকে বের হয়ে একটু সামনে গিয়েই আমরা থেমে গেলাম। মেইন রাস্তার বাঁকে, পাহাড়ের কিনারায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম। নীল আকাশে হালকা সাদা সাদা মেঘ, পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা ঘরবাড়ি, গাঢ় সবুজ গাছ, ফুরফুরে বাতাস, রিফ্রেশিং এক ধরনের ঠান্ডা আমাকে পুরাই স্পেলবাউন্ড করে দিলো। মনে হলো যেন আমাদের দেশের ট্রাকগুলোর পিছনে আঁকা প্রাকৃতিক দৃশ্যর বাস্তব রূপ এটা। আমরা মল রোডে যাবার জন্য একটা বাসে উঠলাম। বাসগুলোতে জোরে জোরে হিন্দি গান বাজতে থাকে। উঁচু নিচু ঢালু বাঁক পার হয়ে সেই বাস আমাদের ১০ রুপি ভাড়া নিয়ে একটা জায়গায় নামিয়ে দিলো। সেখান থেকে ঢালু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গরটন ক্যাসেলের পাশে আমরা একটা হোটেলে মায়িশা, নোভাদের দেখলাম। আমরাও ঢুকে পড়লাম। জায়গা খালি হতেই আমরা বসে পড়লাম।

অন্যান্য জায়গা থেকে এখানে খাবারের দাম বেশি হবে জানতাম কারণ এটা টুরিস্ট স্পট। আমি আর রুবাইদা মায়িশাদের কাছ থেকে সাজেশন নিয়ে ১৭০রুপির পাঞ্জাবী থালি অর্ডার দিলাম। থালিতে চিজের তরকারি, ডাল, রুটি আর ভাত ছিলো। খেতে মোটামুটি। খেয়েদেয়ে আমরা বের হয়ে আসলাম। চোখের সামনে গরটন ক্যাসেল সবার আগে ছিলো। তাই সেটাতেই ঢুকে পড়লাম। এটা আসলে সরকারি অফিস। অফিস আওয়ার শেষ কিন্তু সামনে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পুরা ক্যাসেলে সাজানোর কাজ হচ্ছে। আমরা সেখানে এক লোকের কাছে পারমিশন নিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। অনেক বড় কিন্তু সুন্দর বিল্ডিং। ভিতরে কেউ নাই শুধু আমি আর রুবাইদা। বিল্ডিংটার মধ্যে গ্রিক এবং ইন্ডিয়ান স্থাপত্যের মিশেল আছে। এত বড় বিল্ডিঙে আমরা দুইজন ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। অনেকক্ষন ঘোরার পর বেশ ভয়ভয় করতে লাগলো। আমরা তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে পড়লাম।

গরটন ক্যাসেল থেকে বের হয়ে সামনে দাঁড়াতেই জোর বাতাস এসে হাঁড় কাঁপিয়ে দিলো। দুই জোড়া হাত মোজাই আমি একসাথে পড়ে ফেললাম। তারপর ঢাল বেয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম। কি চমৎকার দৃশ্য রাস্তার দুইপাশে। সমতল রাস্তা থেকে হয় উঁচুতে না হয় নিচুতে ঘরবাড়িগুলো। আবার লাল রঙের টালি ওয়ালা বাড়ির ছাদ থেকে গাছের ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে বানরের দল। এখানে বানরের বেশ আধিপত্য। এখানে হনুমানের অনুসারীর সংখ্যা বেশি। কয়েকটা গেটে হনুমানের মুর্তি দেখলাম তবে বেশিরভাগই ডিজপ্রপোরশনেট। এখানে একটা মেইন রোড ধরে শুধুমাত্র গাড়ি চলে। আর বাদবাকি সব জায়গায় হেঁটে বা সাইকেলে চড়ে যেতে হয়। এইরকম ঢাল বেয়ে ওঠা নামা করার জন্য আমাদের হাতে তাই হাঁটা ছাড়া আর অপশন রইলো না। আমরা অনেক হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছালাম ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ অ্যাডভান্স স্টাডিজের গেটে। ঢাল বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি, রুবাইদা আর সারা পিছিয়ে পড়ি। পিছিয়েই যেহেতু পড়েছি তাই একটু রেস্ট নিয়েই যাই ভেবে আমরা পাহাড়ের ঢালের ধারে একটা বেঞ্চে বসে পড়লাম। আমাদের পাশেই আমাদেরকে কোন পাত্তা না দিয়েই ধাড়ি ধাড়ি বানর ঘোরাফেরা করতে লাগলো। বানর পরিবারকে দেখে ভালো লাগলো। বাচ্চা বানর মা বানরের কোলে জাপটে ধরে বসে আছে। সেই অবস্থাতেই মা বানরটা লং ডিস্টেন্স জাম্প দিয়ে আমাদের তাজ্জব করে দিচ্ছে।

একটু রেস্ট নিয়ে আমরা যখন পাহাড়ের চূড়ায় প্রাসাদটাতে পৌঁছালাম তখন সূর্য নেমে গেছে। আমরা টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকি কিন্তু বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে দেখে আমাদের বিল্ডিঙয়ে ঢুকতে দেয় না। বাইরে থেকে দেখে আমার মনে হয় আমি যেন ইংল্যান্ডের কোন প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এত সুন্দর আর বিলাসী একটা প্রাসাদ বৃটিশরা এত উঁচু একটা পাহাড়ের চূড়ায় কেমন করে বানালো ভেবে আমি কোন কূল পেলাম না। লর্ড লিটন নামের কেউ একজন গরমের সময় ছুটি কাটানোর জন্য এই প্রাসাদটা তৈরি করেন। এর ভিতরে নাকি রুম গরম করার জন্য নিজস্ব মেকানিজম ছিলো। শুধু কি প্রাসাদ? প্রাসাদের সামনের অংশটাও কম সুন্দর কি? একেবারে পাহাড়ের চূড়া, এখান থেকে তাকালে মনে হবে বুঝি বেহেশত বোধহয় এইরকমই সুন্দর। আমরা সেই বেহেশ্তি জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখলাম। সূর্য ডুবার পরও আমার সেখান থেকে যেতে ইচ্ছা করছিলো না। কিন্তু এখনই অন্ধকার নামবে দেখে আমরা তাড়াতাড়ি রওয়ানা দিলাম। ঢাল বেয়ে নামতে নামতে আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলাম একবার শ্বাসরুদ্ধকর প্রাসাদটাকে। আহ_____। পরে জানলাম এই প্রাসাদেই নাকি ’৪৭ সালে ভারত, পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের স্বাধীনতার সিদ্ধান্ত হয়।

আমরা নেমে গেটের কাছে আসি। তারপর ক্যাব ভাড়া করে মল রোডের দিকে রওয়ানা দেই। রাস্তা থেকে দেখতে পাই পাহাড়ের গায়ে সবুজ গাছের ভিতর থেকে বিশাল এক হনুমানের মুর্তি বের হয়ে আছে। তীব্র হলুদ লাইটে মুর্তির গায়ে রিফ্লেক্ট করে চকচকে সোনার ইফেক্ট দিচ্ছে। এত দূরের থেকে যখন এই স্কেলের মুর্তি দেখা যাচ্ছে, তখন ওটার আসল হাইটের কথা আমি ভেবেই পেলাম না কত হতে পারে। কম সেকম ১০০ ফিট বা ১০ তলা বাড়ির সমান তো হবেই, আরও বেশি হতে পারে। রাতের অন্ধকারে পাহাড়ের গায়ের ঘন জংগল থেকে গদা হাতে নিয়ে বিশাল এক সোনার হনুমানের মুর্তি যে তাকিয়ে আছে পুরা সিমলার দিকে- দেখতে এতই অবাক লাগে যে চোখ ফেরানো যায় না।

দচ
শেষ বিকালে পাহাড় চূড়ায় ব্রিটিশ প্রাসাদে 

ক্যাব আমাদের মল রোডে বিশাল গাড়ির লাইনের সামনে নামিয়ে দেয়। ড্রাইভার মজুমদারকে বুঝিয়ে বলে এখানে একটা লিফট আছে। টিকেট কেটে সেই লিফটে করে উপরে উঠতে হবে। তারপর আমরা কেনাকাটা করার দোকানপাটগুলো পাবো। আমরা ১০ রুপি দিয়ে টিকেট কেটে সেই লিফটে উঠার লাইনে দাঁড়ালাম। বিশাল লাইন। একটু একটু করে আগাচ্ছে লাইন। অনেক পরে আমরা লিফটে উঠলাম। সেই লিফট একটা হাইটে উঠে নামিয়ে দিলো। তারপর অনেকটা পথ হেঁটে গিয়ে আরেকটা লিফট ধরতে হয়। সেই লিফট নামিয়ে দেয় মলে। মল আসলে কিছুই না। রাস্তার দুইপাশে সারি সারি দোকানপাট। বেশীরভাগই সোয়েটার, শাল, টুপি এই সবের দোকান। শাল আর সোয়েটারগুলো বেশ সুন্দর। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকি। আমার মোবাইলের ব্যালেন্স রিচার্জ করার দরকার হয়। আমি খুঁজতে থাকি মোবাইল রিচার্জের দোকান। পুরা রাস্তা ঘুরেও কোন রিচার্জের দোকান পাই না।

কে এফ সির দোকান দেখে আমি সেখানেই ঢুকে পড়ি রাতের খাবারের জন্য। অর্ডার দেই ৮০ রুপির ভেজ বার্গার। সেখান থেকে বের হয়ে মজুমদার আর আমি মোবাইল রিচার্জের দোকান খুঁজতে থাকি। কে এক জন বললো সামনে ‘বিল্লো ব্যাঙ্ক’ আছে সেখানে রিচার্জ পাওয়া যাবে। আমি আর মজুমদার সারা এলাকা চষে ফেললাম খুঁজতে খুঁজতে। তারপর একটা বন্ধ দোকানের সাইনবোর্ডে দেখি লিখা ‘উইলো ব্যাঙ্ক’। কি আর করা মোবাইল রিচার্জ না করেই আমরা ফেরার পথ ধরলাম। রুবাইদা আর আমি লিফটে করে নিচে নামার সময় আলাদা হয়ে যাই। সেই বিশাল লাইন ধরেই দৌড়াদৌড়ি করে নিচে নেমে আমরা রুবাইদার জন্য অপেক্ষা করি। মজুমদার এখানেও মোবাইল রিচার্জের দোকান খুঁজতে যায়। ফিরে এসে মুখ খিঁচিয়ে বলে, ‘এত্ত বড় ভোদাফোনের সাইনবোর্ড টানায় দোকান সাজায় রাখসে, কিন্তু মুখে বলে- রিচার্জ তো নেহি মিলে গা’। কি অদ্ভূত জায়গা রে বাপ, একটা ফোনের রিচার্জ পাওয়া যায় না!  ওদিকে মাইক্রো ভাড়া ঠিক হয়ে যায় তাই রুবাইদাকে ফেলেই আমরা রওয়ানা দিয়ে দেই। ফোনে ওর সাথে যোগাযোগও করতে পারছিলাম না। আমি বেশ অপরাধবোধে ভুগছিলাম। পথে গাড়ি থামিয়ে মজুমদার এক দোকানে রিচার্জের জন্য নামে। সেই দোকানে রিচার্জ করা পসিবল না হলেও ২০ রুপির কার্ড ও কিনে আনে নিজের জন্য আর আমার জন্য। মাইক্রো আমাদের হোটেলে নামিয়ে দেয়। আমাদের নয়জনের ভাগে ভাড়া পড়ে ৪৫ রুপি করে।

রুমে ঢুকে আমি জানালা দিয়ে আবার সেই মনোমুগ্ধকর রাতের দৃশ্য দেখতে থাকি। কিছুক্ষন পর রুবাইদা ফেরত আসে। ওর নাকি আসতে কোন অসুবিধাই হয় নাই। সকালের জন্য জামা কাপড় ঠিক করে আমরা ঘুমানোর ব্যবস্থা করতে থাকি। মজুমদার আর মৌলি নোভাদের রুমে যায়। রুমে থাকি শুধু আমি আর রুবাইদা। আমি গরম জামাকাপড় পরেই লেপ কম্বলের নিচে ঢুকে পড়ি। উহ বাবা- কি শীঈঈঈঈঈঈঈত।

The Mighty INDIA CALLING: লে কর্বুসিয়ের এর শহর এবং একজন পাথর প্রেমিকের আশ্চর্য জগৎ (পর্ব ৯)

সকালবেলা যখন ঘুম থেকে উঠলাম, মনে হলো চারপাশে ঠান্ডার ভাপ জমে আছে। সব গুছিয়ে নিয়ে ওভার কোট গায়ে দিয়ে রুম থেকে বের হলাম। সকাল ৮টা ২০শের দিকে সব লাগেজ লিয়াদের রুমে জমা দিলাম। ছোট ডাবল রুমে এতগুলা মানুষের এতগুলা লাগেজ, ব্যাগপ্যাক আরও অন্যান্য ব্যাগ ঢুকাতে আমাদের সেই কায়দাকানুন করতে হলো। শেষমেষ এমন অবস্থা হলো যে শুধুমাত্র দরজা লাগানোর জায়গাটুকু আছে, আর বাকি পুরো রুমের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা জুড়ে শুধুই লাগেজ আর লাগেজ। অনেক কষ্টে সব ব্যবস্থা করে আমরা বের হলাম নাশতা করার জন্য।

আগের দিনের খুশি ধাবাতে আর যেতে ইচ্ছা করলো না। আমরা খুঁজে খুঁজে নতুন দোকান বের করলাম যার নাম রজনী ধাবা। চিকন লম্বা একটা দোকান। তিনটা টেবিল আর চারটা করে চেয়ার। আমি অর্ডার দিলাম ১০ রুপির আলু পরোটা আর  ২৮ রুপির মিক্সড ভেজিটেবল। সাথে যথারীতি মুলা কুচি। তবে খাওয়াটা ভালোই ছিলো। খেয়েদেয়ে আমরা গোয়েলে উঠলাম। গন্তব্য চন্ডীগড় হাইকোর্ট।

ফস
পাঞ্জাবী খাওয়া দাওয়া (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী)

আবার সেই বোরিং রাস্তা আর একই রকম মোড় পার হতে হতে এক সময় আমরা বেশ সবুজ গাছগাছালিতে ঢাকা একটা জায়গায় এসে পড়লাম। এখান থেকে শুরু রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া। আমরা লাইন ধরে দাঁড়ালাম। আমাদেরকে বললো চুপচাপ থাকতে। কিন্তু আমরা যখন ৪৬ জন দ্বিমিকবাসী একসাথে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা কি আর হয়? বেশ খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর পারমিশন মিললো। অনেকক্ষণ ধরে আমাদের কিছু নিয়মকানুন বলা হলো। তারপর আমাদেরকে চেক করে করে ভিতরে ঢুকতে দিলো। গাইড হিসেবে সাথে থাকলো একজন ইউনিফর্ম পরা লোক। আমরা চেকিং পার হয়েই একটা গ্রুপ ছবি তুললাম। তারপর হাঁটতে লাগলাম। দুপাশে সবুজ ঘাস আর তার মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা পাথুরে রাস্তা দিয়ে শীতের সকালে হাঁটতে লাগলাম আমরা। এক সময় পৌঁছে গেলাম হাইকোর্ট ভবনে।

বিল্ডিঙ্গের সামনে হাজার খানেক মটর সাইকেল পার্ক করে রাখা। আমরা র‍্যাম্প দিয়ে উঠতে লাগলাম উপরে। সেই কি র‍্যাম্প, পা ধরে আসলো সবার। এক পর্যায়ে ছাদের মতন খোলা জায়গায় এসে পড়লাম। কিছুক্ষন সেখানে থেকে তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। তারপর এসে পৌঁছালাম বিখ্যাত সেই রঙ্গিন ওয়ালের সামনে। লাল, হলুদ আর সবুজ এই তিনটা রঙের ওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা খ্যাচ খ্যাচ ছবি তুলতে লাগলাম। এতক্ষন তাও যা আমরা চুপচাপ ভদ্র থাকার চেষ্টা করছিলাম, এই ওয়াল দেখে আমাদের ভদ্র সেজে থাকার সব চেষ্টা বৃথা গেল। আমাদের দৌঁড় ঝাঁপ দেখে সেই গাইড বেচারা তাজ্জব হয়ে গেলো। কয়েকবার সেই লোক আমাদের চুপ করার অনুরোধ করেও শেষমেশ হাল ছেড়ে দিলো। আমাদের তাড়া দিলো সামনে আগানোর জন্য।

সস
বিখ্যাত হ্যান্ড স্কাল্পচারের সামনে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় ইফফাত রিদওয়ানা ঐশী)

আমরা একটু এগিয়ে লে কর্বুসিয়েরের হ্যান্ড স্কাল্পচারের সামনে গিয়ে গ্রুপ ফটো তুললাম। তারপর চলে গেলাম হ্যান্ড স্কাল্পচারের একদম কাছে। সেখানেও সমানে চলতে লাগলো ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক। সেই গাইড আমাদের আবার তাড়া দিয়ে সামনে হাঁটতে বললো। চমৎকার পার্কের মতন জায়গা দিয়ে আমরা হেঁটে বেড়াতে লাগলাম। অনেকক্ষন হাঁটার পর আমরা একটা বিল্ডিঙের সামনে আসলাম কিন্তু ছুটির দিন দেখে সব বন্ধ, আমাদের ঢুকতে দিলো না। আমরা সময় নষ্ট না করে পার্লামেন্ট বিল্ডিঙের দিকে হাঁটতে লাগলাম। শীতের দিনে গাছগাছালি ঘেরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে আমার খুব ভালো লাগছিলো। হাঁটতে হাঁটতে এক এক সময় বেশ গরমও লাগছিলো। আমি ওভার কোটটা খুলে ফেললাম।

অনেক্ষণ হেটে শুকনা প্যাচপ্যাচা ওয়াটার বডি পার হয়ে আমরা পার্লামেন্ট বিল্ডিঙের পিছন দিকে এসে পৌঁছালাম। দ্যা মাইটি ইয়েলো ওয়াল! ডিপার্টমেন্টে ঢোকার পর থেকে কত মানুষের ছবি দেখেছি এই হলুদ ওয়ালের সামনে- আজকে আমরা এখানে এই কথাটা ভাবতেই কেমন যেন আনন্দ লাগলো। ততক্ষনে হাঁটতে হাঁটতে সবাই টায়ার্ড হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ রেস্ট নেওয়া হলো। তারপর গ্রুপ ফটো। নানা রকম ফটো- খালি ক্লিক ক্লিক।

এতদূর হেঁটে সবার এনার্জি লেভেল ডাউন হয়ে গেছে। এরপর আরও হেঁটে যখন বিধানসভা বিল্ডিঙ্গে এসে পৌঁছালাম তখন সবার গলা শুকিয়ে গেছে। অনেকেই বসে পড়লো। অনেকে পানির খোঁজ করতে গেলো। অবশেষে সুপেয় পানি পাওয়া গেল। আমরা সবাই ঢকঢক করে ঠান্ডা পানি খেলাম। এই বিল্ডিংটাও মোটামুটি ঘুরেফিরে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। আবারও অনেক হাঁটা। বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে গোয়েলে এসে পৌঁছালাম। গোয়েলে উঠে হাত পা ছেড়ে বসলাম। গোয়েল আমাদের নিয়ে রওয়ানা দিলো চন্ডীগড় আর্কিটেকচার স্কুলের দিকে।

এক দিকে দুপুর হয়ে গেছে, তার উপর সকাল থেকে এত হাঁটা হাঁটি করার কারনে খিদেয় সবার পেট চোঁ চোঁ করতে লাগলো। আমরা ব্যাস্ত রাস্তাঘাট পার হয়ে এগুতে লাগলাম। এক সময় গোয়েল আমাদের নামিয়ে দিলো। সামনে নাকি রাস্তা কাটা, বাস আর যাবে না। কি আর করা, আমরা বাস থেকে নেমে পড়লাম। সামনে পেলাম এক বাদামবুট ওয়ালা। সবাই ভিড় করে বাদাম, মটর, কটকটি কিনতে লাগলো। আমি ১০ রুপির মুরলি কিনলাম। তাই চিবাতে চিবাতে হাঁটতে লাগলাম। সামনে রাস্তা সত্যি কাটা। সেই কাটা রাস্তা দিয়ে অনেক কসরত করে লাইন ধরে হেঁটে আমরা পৌঁছালাম আর্কি স্কুলে।

ছুটির দিন দেখে এটাও বন্ধ। তবে আমরা বাইরে থেকে ঘুরে বেড়ালাম আর ছবি তুললাম। দুপুরে খাওয়ার জন্য ছুটে গেলাম ক্যাফেতে। ক্যাফেতে খালি দুটা আইটেম- ভেজ স্যান্ডুইচ, ভেজ বার্গার। আমি ২০ রুপি দিয়ে ভেজ স্যান্ডুইচ কিনলাম। অত্যন্ত বাজে। খালি পিয়াজ আর পিয়াজ। এটাই একমাত্র ভেজ। খেয়ে আমার মুখ থেকে পিয়াজের গন্ধ বের হতে লাগলো। পিয়াজের স্বাদ আর গন্ধ দূর করার জন্য আমি দিয়ে ছোট্ট এক প্যাকেট বিস্কুট খেলাম। তারপর বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। সবাই আরও কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলাম ঐ ক্যাম্পাসে। তারপর আবার হাঁটা শুরু করলাম।

পুরোটা পথ পাড়ি দিয়ে যখন গোয়েলে উঠলাম তখন জানতে পারলাম, আমাদের কারণে বাস ফাইন খেয়েছে। আমাদেরকে পাংকু হেল্পার বললো আমাদের আসার কথা শুনে গোয়েল পার্কিং ছেড়ে রাস্তায় বের হয়ে এসেছিলো। কিন্তু আমরা আসতে লেট করেছি দেখে ট্রাফিক পুলিশ এসে সাড়ে চার হাজার টাকার মতন ফাইন করে গেছে। কি আর করা, আমরা সবাই গাটের থেকে ১০০ করে রুপি বের করে দিলাম। নেক্সট আমরা যাবো রক গার্ডেনে। সেখানে আমাদের নামিয়ে বাস চলে যাবে হোটেলে। কারণ রাতে জার্নি আছে, ড্রাইভারকে ঘুমাতে হবে।

রক গার্ডেনের সামনে নেমে আমার আর নড়তে ইচ্ছা হচ্ছিলো না। কিছুক্ষণ ফুটপাথের উপর বসে রইলাম। তারপর ২০ রুপি দিয়ে টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকলাম। রক গার্ডেন শুনে আমার মনে হয়েছিলো সবুজ গাছে ঘেরা কোন একটা পার্কের মধ্যে নিশ্চয়ই পাথরের ভাস্কর্য টাইপ জিনিস্পাতি আছে। কিন্তু আমার ধারনা ভুল। রক গার্ডেন আক্ষরিক অর্থে পাথর দিয়ে বানানো এক রাজ্য। পাথরের রাস্তা, পাথরের নিচু আর্চ দিয়ে হেঁটে যেতে হয় আর একটু পরপর অদ্ভূত সব ভাস্কর্য চোখে পড়ে। দেওয়ালে লিখা ইতিহাস পড়ে জানলাম নেক চাঁদ নামের এক লোক সরকারী জমিতে লুকিয়ে লুকিয়ে এইসব ভাস্কর্য বানানো শুরু করে। ভাংগা কাঁচ, চুড়ি, টাইলস, কমোড, বেসিন, সুইচ, বোতল এইসব হাবিজাবি জিনিস দিয়ে প্রায় দুই হাজার ভাস্কর্য দিয়ে সাজানো হয় অদ্ভূত এক পাথুরে সম্রাজ্য। সরকারের কাছে প্রথম যখন ব্যাপারটা ধরা পড়ে তখন এ নিয়ে বেশ হৈচৈ পড়ে যায়। সরকারি জমিতে অবৈধ স্থাপনা ধ্বংসের কথাটাই উঠে আসে। কিন্তু মানুষ প্রতিবাদ জানায়। পরে সরকার বাধ্য হয় এইটা কমপ্লিট করে জনগনের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে।

আমি আর রুবাইদা হাঁটতে থাকি আর অবাক হই। একজন মানুষ কেমন করে এই বিশাল পাথুরে জগত তৈরি করতে পারে আমরা ভেবে পাই না। হাঁটতে হাঁটতে আমরা জলপ্রপাত পার হই যার রেলিঙে পেচিয়ে আছে পাথুরে সাপ। কখনো একটু উঁচু, কখনো একটু নিচু পথে আমরা চিপা চিপা পথে এগিয়ে যেতে থাকি। খুব ভালো লাগে আমাদের। অনেক বড় জায়গা, আমরা এমনিতেই ক্লান্ত। আমি বিশ্রাম নিতে নিতে এগুতে লাগলাম।

এদ্ভ
অদ্ভূত পাথুরে রাজ্যে পায়ে হেঁটে চলা (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

সুভেনিয়র শপের থেকে রুবাইদা কিছু একটা কিনতে চাইলো। আমরা দুইজনেই কাউন্টারে উকি দিয়ে দেখছিলাম কি কি জিনিস আছে, এমন সময় আমার ব্যাগের চেইন কেউ একজন টান দিয়ে খুলে ফেললো। আমি আর রুবাইদা সাথে সাথে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালাম। মুহূর্তের জন্য একটা মানুষকে দেখলাম এক কদম পিছিয়ে ভীড়ের মধ্যে মিশে যেতে। আমি আর রুবাইদা বিশ্বাস করতে পারলাম না এত চমৎকার একটা জায়গায় কেউ আমাদের ব্যাগ থেকে টাকা চুরির চেষ্টা করতে পারে!  আমি আরও সাবধান হয়ে চলা শুরু করলাম।

হাঁটতে হাঁটতে একেবারে শেষ মাথায় একটা বড় ওপেন স্পেস। সেখানে ওপেন স্টেজে গানের সাথে লাইভ নাচ হচ্ছে। ইন্ডিয়ানদের সাথে অনেক সাদা চামড়ার মানুষ দেখলাম স্টেজে নাচ দেখাচ্ছে। আর তাদের ফলো করে চারপাশের মানুষজনও স্টেপ মিলিয়ে নাচার চেষ্টা করছে। হিন্দি সিনেমায় সাধারণত যে সব নাচ গান দেখি সেটা তাহলে একেবারে অবাস্তব না! একপাশে এক লোক উট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি সেই উটের সাথে ছবি তুললাম। তারপর অনেক্ষন বসে থেকে নাচ গান দেখলাম। শরীরের সব এনার্জি মনে হচ্ছিলো শেষ হয়ে গেছে। এক সময় সেখান থেকে বের হয়ে আসলাম। অটো ভাড়া করে আমরা সুখা লেকে রওয়ানা দিলাম। পার হেড ভাড়া পড়লো ১০ রুপি করে।

সুখা লেক জায়গাটা অনেকটা ধানমন্ডি লেকের মতন। টলটলে পানির একটা লেক। লেকটাকে ঘিরে অনেক রকম এক্টিভিটি। চিকন লম্বা ঠোংগায় করে ঝালমুড়ি, প্লেটে করে ফল কুচি বিক্রি হচ্ছিলো দেদারসে। এক জন লোক পোর্ট্রেট এঁকে দিচ্ছিলো। তার সামনে ভীড় করে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। অনেক মানুষ পড়ন্ত বিকালের সময়টা কাটানোর জন্য এসে জড় হয়েছে এখানে। গল্প গুজব, হাসি ঠাট্টা, আনন্দ আড্ডা সবকিছুই জমজমাট করে রেখেছিল জায়গাটাকে। লেকের পাড়ে বসে থেকে নিজেকে অনেক রিফ্রেশড লাগলো। এখানে বসে থেকেই ডিসিশন নেওয়া হল, আমরা যাবো সেক্টর ২২। তারপর সেখান থেকে যাবো সেক্টর ১৭এ সার্কাস দেখতে। আমরা আবার অটোতে উঠলাম। ভাড়া পড়লো পারহেড ১৫ টাকা করে।

সেক্ট্রর ২২ শে নেমে জাফরকে বলি সার্কাসে যাওয়ার সময় আমাদের খবর দিতে। তারপর আমি আর রুবাইদা সেই শীতের কাপড়ের জায়গায় যাই। রুবাইদা ওর জন্য ইনার কিনতে চায়, কিন্তু পছন্দ হয় না। আমরা ঘুরতে থাকি। এক পর্যায়ে মার্কেটের ভিতরে একটা পুজার রুম আবিষ্কার করি। এখানকার প্রতিমাগুলোকে কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছ। একটা ছবি তুলতে ইচ্ছা করছিলো কিন্তু ভিতরে হঠাৎ কে জানি টিং টিং করে ঘন্টা বাজানো শুরু করে। আমিও ছবি না তুলে সরে আসি। পরে রুবাইদা চিন্তা ভাবনা করে দুইটা মোটা প্যান্ট কিনে। ঐদিকে রাত নামার সাথে সাথে ঠান্ডাটা চাগিয়ে উঠতে থাকে। হঠাৎ করেই আমার খুব দূর্বল লাগতে শুরু করে। মনে হতে থাকে আমি বুঝি আর এক পাও হাঁটতে পারবো না।

রুবাইদা আমাকে নিয়ে একটা বেঞ্চে বসে থাকে। আমার শরীর বেশ খারাপ লাগতে থাকে। পা দুইটা মনে হচ্ছিলো যেন অবশ হয়ে গেছে। এর মধ্যে মোবাইল বের করে দেখি জাফরের মিসকল। কল ব্যাক করে জানলাম আমি ফোন ধরি নাই দেখে ওরা আমাদের ফেলেই চলে গেছে সার্কাসে। রুবাইদা অসম্ভব ঠান্ডা মাথায় আমাকে সাহস দিতে থাকে। ও চিন্তা করে বের করে অনেকদিন অ্যানিমেল প্রোটিন খাওয়া হয় নাই দেখেই মনে হয় আমার এই অবস্থা। আমি অনেক্ষণ বেঞ্চে বসে থাকি। তারপর.৩০ রুপি দিয়ে একটা রিক্সা ঠিক করি সেক্টর ১৭ পর্যন্ত। সেই রিক্সা করে আমরা যেতে থাকি। প্রচন্ড ঠান্ডায় আমরা জমে যাচ্ছিলাম।

সম্পূর্ন অপরিচিত রাস্তা দিয়ে আমরা যেতে যেতে একসময় সার্কাসে পৌঁছালাম। ৭০ রুপি দিয়ে টিকেট কেটে আমরা যখন কোন দিক দিয়ে ঢুকবো বলে ইতস্তত করছিলাম তখন যে লোকটা টিকেট দিলো সে পরিষ্কার বাংলায় কথা বলে আমাদের ঢোকার রাস্তা দেখিয়ে দিলো। সার্কাসে ঢুকে আমি উর্মি, অদিতি, চিং, জাফর, অন্তরা, মিমকে দেখতে পেলাম। আমরাও ওদের সাথে বসে পড়লাম। এটাকে বলা হয় এশিয়াড সার্কাস। অনেকদিন ধরেই চলছে শো। লোকজন নেই বললেই চলে। তবে বেশ সুন্দর পারফর্মেন্স সব। রাশিয়ান পারফর্মারদের পর্বগুলো বেশি চমৎকার ছিলো।  দুইটা বাচ্চা দারুণ সুন্দর ব্যালেন্সের খেলা দেখালো। ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক দেখালো। বিশাল গোলকের ভিতর দুইজন লোক বাইক নিয়ে একে অন্যকে ক্রস করে চক্কর কাটতে লাগলো। পশুপাখির পার্ফরমেন্সও ছিলো অনেকগুলো যেমন- হাতি, পাখি, কুকুর। বামন ভাঁড়েরা দর্শককে হাসাতে লাগলো।  আমাদের খুবই ভালো লাগছিলো।

শো শেষ হওয়ার আগেই পৌনে নয়টার সময় আমরা বের হয়ে যাই। কোথায় রাতের খাবার খাবো ভাবতে থাকি। তখন জাফর খুব সুন্দর একজন শিখ ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে যে কাছাকাছি কোথায় খাওয়ার দোকান আছে? লোকটা তখন খুব আন্তরিকভাবে আমাদের রাস্তা দেখিয়ে দেয়। কয়েক মিনিট হেঁটে আমরা বেশ কিছু খাবারের দোকান পাই। ‘তোশিব ফাস্ট ফুড’ নামের একটা দোকান থেকে ৮০ রুপি দিয়ে এক প্লেট ভেজ চাওমিন অর্ডার দেই আমি আর রুবাইদা। পরিমান দেখে আমাদের চোখ কপালে উঠে যায়। এতগুলা চাওমিন দেয় যে আমরা কোন মতেও খেয়ে শেষ করতে পারবো না। আমরা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে খেতে থাকি। খাওয়াটা খুবই মজা। আমাদের মতন আশেপাশে সবাই গল্পগুজব করে ফুটপাথে দাঁড়িয়েই খাচ্ছে। আমরা কেউই খাওয়া শেষ করতে পারি না। খুব কষ্ট লাগে খাওয়াগুলো নষ্ট করতে কিন্তু কি আর করা, এতগুলো দিবে পরিমানে আমরা বুঝি নাই। শেষমেষ আমরা পানি কিনে হোটেলে ফেরত যাই পৌনে দশটার দিকে।

রাস্তায় আমরা কিছুক্ষণ পর বিয়ে বাড়ির বর যাত্রীকে যেতে দেখি। ঠিক যেমনটা সিনেমায় দেখা যায়- বর ঘোড়ার পিঠে আর তাকে ঘিরে হাই ভলিউমে গানের সাথে আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুদের দুই হাত তুলে নাচ। দেখে মজা পেলাম। হোটেলে আমাদের বসার কোন জায়গা নেই। রিসিপশন জুড়ে ছেলেরা আর মেয়েরা সেই ফুল প্যাকড লাগেজ রুমে লাইন ধরে বাথরুমে ঢুকতে থাকে। অনেকেই বারান্দা, সিড়ি এইসব জায়গায় দাঁড়িয়ে বা বসে থাকে। আমি ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একটা রুম আবিষ্কার করলাম যেটাতে অদিতি, উর্মিসহ আরও কয়েক জন বসে আছে। জানলাম হোটেলওয়ালা আমাদের অবস্থা দেখে দয়া করে এই রুমটা খুলে দিয়েছে বসার জন্য। আমিও বিছানায় হেলান দিয়ে বসলাম। এই চিপা সিঁড়ি দিয়ে লাগেজ নামিয়ে রাস্তা দিয়ে টেনে নিয়ে বাসে তুলে ঠিকঠাক মত রওয়ানা দিতে দিতে আমাদের দেরি হলো।

প্রায় রাত ১২টার সময়  আমাদের গোয়েল যাত্রা শুরু করলো সিমলার উদ্দেশ্যে। বাসে উঠে টের পেলাম আমার পা দুইটা যেন হাতির পায়ের মতন ফুলে গেছে। রুবাইদা বললো জুতা খুলে বসতে। কিন্তু নিজের ফুলে যাওয়া পা দেখে আঁতকে ওঠার ভয়ে আমি জুতা খুললাম না। পায়ের পাতা জুতা ছিঁড়ে যেন বের হয়ে আসতে চাইছিলো। আমি একটু ঢিলা করে দিলাম শুধু। অসম্ভব পরিশ্রমের একটা দিন গেল। একদিনে এত হাঁটা আমি জীবনেও হাঁটি নাই। তবে শহরটা খুবই সুন্দর আর নিরাপদ। মানুষগুলোও যথেষ্ট আন্তরিক আর সাহায্য করার মনোভাব নিয়ে থাকে। সিনেমাতে আমরা পাঞ্জাবী লোকদের যেমনটা দেখি, বাস্তবেও তারা সেরকম। ছেলেরা খুব সুন্দর, ফর্সা। মেয়েরা একটু মোটা, বেশিরভাগই ফর্সা, বাচ্চাগুলো মোটা মোটা। মেয়েরা যথেষ্ট দুর্ধর্ষ। বুড়োরা তো আরও সাংঘাতিক। সবচেয়ে বড় কথা খাবারের দাম এখানে যথেষ্ট রিজনেবল। যদিও আমি অসুস্থ হয়ে পড়ে যথেষ্ট লজ্জা পেয়েছি- কারণ আমি জীবনে কোনদিনও এই রকম ভাবে দূর্বল হয়ে বসে পড়ি নাই, তারপরও সারাদিনটা অনেক সুন্দর ছিলো। চন্ডীগড় ছেড়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, জীবনে আর কি কোন দিন আসা হবে এখানে?

 

 

The Mighty INDIA CALLING: ‘সর্দারজী’ র দেশে দ্বিমিকবাসী (পর্ব ৮)

আমার ঘুম ভাঙল ঘাড় ব্যাথায়। বাসের সিটে হেলান দিয়ে থাকায় প্রচন্ড ঘাড় ব্যাথা হতে লাগলো। চোখ মেলে দেখলাম আমরা পাঞ্জাব পৌঁছে গেছি। তখন মাত্র সকাল হয়েছে। কুয়াশা কেটে চকচকে সূর্যের আলো ফালি ফালি করে বের হচ্ছে। রাস্তাঘাটে মানুষজন নাই। চারপাশে ঝকঝকে রাস্তাঘাট, একটু পর পর পার্ক, সবুজ গাছপালা- সব মিলিয়ে অত্যন্ত রিফ্রেশিং পরিবেশ। আমার ইচ্ছা হলো বাইরে গিয়ে বুক ভরে শ্বাস নেই। কিন্তু জমানো ঠান্ডার ভয়ে জানালাটাও খুলতে পারলাম না। আমাদের বাস এসে থামলো পাঞ্জাব আর হরিয়ানার বর্ডারের কাছাকাছি জায়গায়। আমাদের ছেলেপেলে হোটেল মিডটাউন নামের এক হোটেলে কথা বার্তা বলে সব ঠিক করলো। আমরা নেমে পড়লাম।

এবার আমরা চারজন একসাথে। বাস থেকে নেমেই মজুমদার ছুটলো রুম দখল করতে আর আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম লাগেজের অপেক্ষায়। সবার আগে আমার লাগেজ নামিয়ে দিলো বাসের পিছন থেকে। আমি ওদের রেখে লাগেজ নিয়ে রওয়ানা দিলাম। মজুমদার বললো ও তিন তলায় রুম ঠিক করেছে। অনেকেই রুম পায় নাই। ১০টা বাজলেই কয়েকটা রুম খালি হবে তখন সবাইকে রুম দেওয়া হবে। আপাতত মেয়েদের জন্য তিনটা রুম দেওয়া হয়েছে। তারই একটা রুম আমাদের। আমি আমার সুটকেস অমানুষিক কষ্ট করে সিড়ি দিয়ে টেনে টেনে তিনতলায় তুললাম। ততক্ষনে রুবাইদা আর মৌলি মজুমদারের লাগেজ টেনে টেনে নিয়ে আসলো। সবাই মিলে একে অন্যকে সাহায্য করে মাল পত্র সিড়ি দিয়ে তুলতে লাগলাম।

রুম দেখে আমাদের খুব পছন্দ হলো। অনেক বড় রুম, বিশাল খাট, এটাচড বারান্দা তবে এটা পাশের আরও দুইটা রুমের সাথে কানেক্টেড। বারান্দায় দাঁড়ালে নিচে সবুজ জমি দেখা যায় সেখানে একটা গরু নিবিষ্ট মনে ঘাস চিবাচ্ছে। আমি কিছুক্ষনের জন্য বারান্দায় কড়া রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশ আরাম লাগলো। সবচেয়ে অদ্ভূত হল বাথরুমটা। এত বড় বাথরুম আমি আর কোনও হোটেলে দেখি নাই। মনে হলো যেন ওখানে খাট পেতে ঘুমানো যাবে। যথারীতি বদনা নাই। তবে রুবাইদা এবার ওর সাদা বদনাটা বের করে দিলো। গরম পানির ব্যবস্থা পেয়ে আমরা লাইন ধরে গোসলে ঢুকলাম। গোসল করতে গিয়ে টের পেলাম বালতি আছে কিন্তু কোন মগ নাই। রুম সার্ভিস তখন খুবই ব্যাস্ত আমাদের সবাইকে রুমের ব্যবস্থা করে দিতে, ওখানে জানালে মগ পেতে বেশ দেরি হবে। চট করে আমরা আমাদের রুমের পানির জগটাকেই মগ বানিয়ে গোসল করা শুরু করে দিলাম।

যারা রুম পায় নাই তারা আমাদের রুমে মালপত্র নিয়ে বসে থাকলো। তারপর এক জন একজন করে ওরা রুম পেয়ে পেয়ে বের হয়ে গেলো। আমি দেখতে পেলাম আমাদের বারান্দার সাথে এটাচড রুম দুটা আমাদের মেয়েরাই পেয়েছে। সেই রুমগুলাও খুবই সুন্দর। বারান্দার রোদে ভেজা গামছা মেলে দিয়ে আমি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। ভেজা চুল শুকানোর জন্য মৌলির হেয়ার ড্রায়ার নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমাকে বেশ সুন্দর আর লম্বা লাগছে। মন ভালো হয়ে গেলো। একটু পরেই টের পেলাম আয়নাটাতে সবাইকেই চিকন আর লম্বা লাগে। সবাই খুশি খুশি মনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নানাভাবে দেখতে লাগলো।

রুমের সামনে রিজভীর সাথে দেখা। ওকে ধন্যবাদ দিলাম এত সুন্দর একটা হোটেল ঠিক করে দেওয়ার জন্য। ও বললো বাইরে থেকে এখানকার বিল্ডিংগুলো দেখে আহামরি কিছু মনে হয় না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে হোটেলগুলো অনেক সুন্দর। রুমের বাইরে অনেক খোলামেলা স্পেস, লাইট ওয়েল দিয়ে সরাসরি রোদ এসে পড়ে – এসব দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।

সবার গোসল শেষে আমরা যখন নাস্তা করতে বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন প্রথম জানলাম খবরটা- আমাদের এখনই এই হোটেল ছেড়ে দিতে হবে। সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। ব্যাপার কি? কেন ছেড়ে দিতে হবে এই হোটেল? আসল ঘটনা জানা গেল ইশতিয়াকের কাছে। আমাদের কমিটিকে দামদর সব ঠিকঠাক করার করার পর হোটেল কর্তৃপক্ষ আইডি কার্ড জমা দিতে বলে। ওরা আমাদের পাসপোর্ট জমা দিলে লোকজন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে ‘আপ্লোগ ইন্ডিয়ান নেহি হো? আমরা বাংলাদেশি জানার পর তারা খুব লজ্জিত হয়ে জানায় সরকারি নিয়ম অনুযায়ী এই হোটেলের বিদেশি অতিথি রাখার অনুমতি নাই। ওরাই আমাদের আরেকটা হোটেল ঠিক করে দিবে কিন্তু আমরা এই হোটেলে থাকতে পারবো না। ওদের আর কি দোষ, কমিটির কমিউনিকেশন মেম্বাররা এত ভালো হিন্দিতে কথা বলেছিলো যে ওরা ধরতেই পারে নাই যে আমরা বিদেশি। ওরা নিজেদের ভুল স্বীকার করে খুব অনুরোধ করে আমাদের চলে যাওয়ার জন্য।

কি আর করা- আমরা যা যা মালপত্র বের করেছিলাম সব আবার ঢুকিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে সেই তিনতলার সিড়ি দিয়ে আবার টেনে টেনে ব্যাগ নামাতে লাগলাম। তারপর আবার সেই ব্যাগ বাসে তুলে আমরা বের হয়ে পড়লাম। সেটাই ছিলো ইন্ডিয়া ট্যুরে আমাদের সবচেয়ে ছোট্ট হোটেল স্টেয়িং।

আগের দিন রাতেও ডিনার বলতে যা বলা হয় সেইটা ঠিকমত হয় নাই। সকালেও কোন খাওয়া হল না। সেই অবস্থাতেই বাসে করে আমরা চন্ডীগড় ঢুকে গেলাম। চন্ডীগড় লে কর্বুসিয়েরের ডিজাইন করা অত্যন্ত বড়লোকদের শহর। রাস্তা গুলো চওড়া, চকচকে পরিষ্কার আর একদম সোজা ছক মেনে চলে। একটু পর পর একই রকম চৌ রাস্তার মোড় বা ওদের ভাষায় মার্গ এসে পড়ে যেগুলোতে সবুজ সাইনেজের মাধ্যমে ডিরেকশন দেখানো আছে।  এখন বেলা হয়ে যাওয়ায় রাস্তাঘাটে মানুষজন দেখা যাচ্ছে। দাড়িওয়ালা, পাগড়ি পরা শিখদের দেখতে খুব ভালো লাগছিলো। আর মহিলাগুলো সব সালোয়ার কামিজ পরে, বড় বড় বেনি করে এক কালারের সোয়েটার পরে হেঁটে বেড়াচ্ছে- ঠিক যেমনটা সিনেমায় দেখে থাকি। চন্ডীগড়ের আরেকটা লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে বাইক, মোটরসাইকেল আর সাইকেল। কি ছেলেরা, কি মেয়েরা- সবার কাছেই যেন দুইচাকার বাহনগুলো জনপ্রিয়। বাইক আর মোটরসাইকেলের পাশাপাশি রাস্তাঘাটে প্রচুর মানুষ সাইকেল চালাচ্ছে। এদের মধ্যে হাফ প্যান্ট পরা মোটা স্কুল ইউনিফর্ম পরা বাচ্চা ছেলেটা যেমন আছে তেমনি সাদা চুলগুলো বেনিতে গুঁজে সালোয়ার কামিজ আর কেডস পরা দাদীমাও আছেন। আমি হাঁ করে সব দেখতে লাগলাম। আরেকটা জিনিস লক্ষ করলাম এখানকার গাড়ির নম্বর প্লেট শুরু হয় –CHO দিয়ে।

r
ছবির মতন সাজানো চন্ডিগড় শহরের  ঝকঝকে রাস্তা ( কৃতজ্ঞতায় আরমিন রহমান মৌলি)

আমরা সেক্টর ৪৫ এ এসে থামলাম। এখানেই ঠিক করে দেওয়া হয়েছে আমাদের হোটেল যার নাম গোল্ডেন প্যারাডাইস। হোটেলটা বাইরে থেকে দেখে আমরা দমে গেলাম। রাস্তা থেকেই দেখা যায়, টানা বারান্দা দিয়ে এক সারি রুম। আমাদের দেশে অনেকটা কমলাপুর রেলস্টেশনের আশেপাশে যেরকম হোটেল দেখা যায় সেরকম আর কি। ঢুকতে হয় একটা চিপা গেট দিয়ে। তারপর আড়াই থেকে তিনফুট চওড়া একটা চিপা খাড়া খাড়া স্টেপ ওয়ালা সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে হয়। এবারও আমি আর মজুমদার দৌড়ঝাপ করে সেই তিন তলাতেই রুম ঠিক করলাম। আমাদের রুমটা একেবারে রাস্তার পাশে, বারান্দার শেষ প্রান্তে। ছোট্ট রুমে একটা খাট, দুইটা গদিওয়ালা চেয়ার আর একটা ছোট্ট টেবিল আছে। দেওয়ালে টিভি ঝুলানো, তার সাথে আবার দুইটা রিমোট। বাথরুমটা গিয়ে দেখলাম, অবস্থা মোটামুটি। বালতি, মগ সবই আছে, সাথে আবার ছোট্ট একটা মোড়া। ফ্লোরে সাদা কালো হিজিবিজি প্যাটার্নের পাথর। এতে একটা সুবিধা আছে ফ্লোর ময়লা হলেও টের পাওয়া যাবে না। আমরা আগের হোটেলে গোসল করে আসার কারনে বেশ খুশি ছিলাম। এখন এই বাথরুমে গোসল করতে হবে না ভেবেই আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলাম।

রুমে সেট হয়েই আমরা খেতে বের হলাম। হোটেলের নিচের রাস্তাটা কেমন জানি মরা মরা। নেটে সার্চ দিয়ে কাছেই ‘খুশি ধাবা’ নামের এক খাওয়ার দোকানে গেলাম। ছোট দোকানটাতে তেমন কিছুই খাওয়ার নাই। অনেক কষ্টে একটা থালি নিলাম ২৫ রুপি দিয়ে। এতে আছে ৬টা পোড়া রুটি, সয়া মাংসের ঝোল আর ডাল। সালাদ হিসেবে আছে মুলা কুচি। খাবারের কোন টেস্ট নাই। অনেক ঘন্টা কিছুই খাওয়া হয় নাই দেখে জোর করেই সবগুলা পোড়া রুটি খেয়ে ফেললাম। খাওয়া শেষে আবার হোটেলে ফেরত আসলাম। আশেপাশের রুমে খোঁজ খবর নিয়ে দেখলাম সবাই শপিং করার জায়গায় যেতে চায়- সেক্টর ২২ আর সেক্টর ১৭। আমি আর রুবাইদাও চিন্তা ভাবনা করে বের হয়ে পড়লাম।

হোটেলের সামনের রাস্তাতেই অটো পার্ক করে বসে ছিলো। আমি রুবাইদা আরও কয়েক জনের সাথে অটো ভাড়া করে উঠে পড়লাম। সেক্টর ২২ যেতে পার হেড খরচ পড়লো ২০ রুপি। একই রকম সোজা রাস্তা আর সবুজ চৌরাস্তা পার হয়ে হয়ে আমরা যখন সেক্টর ২২ পৌঁছালাম ততক্ষনে আমার মনে হলো আমরা যে জায়গাটাতে থাকি সেটা বোধহয় তুলনামূলক লো ক্লাস এরিয়া। যাই হোক অটো থেকে নেমে আমরা যে জায়গাটায় আসলাম সেটাকে অনেকটা ঢাকা নিউমার্কেটের মতই মনে হলো। তবে আমাদের নিউ মার্কেট বাউন্ডারির ভেতর আর এটাতে ঠিক বাউন্ডারি নাই। কেমন যেন লম্বাটে টাইপ অনেক বড় জায়গা জুড়ে আলাদা আলাদা মার্কেট।

সামনেই হোটেল-রেস্টুরেন্ট। তারপর শুকনা খাবার যেমন বাদাম, খেজুর, বিস্কুট, চানাচুর, চিপস এইসবের দোকান। পাশাপাশি জামাকাপড়, ব্যাগ, জুতা সব কিছুরই দোকান ছিলো। একটু পর একটা চত্তর। সেখানে হকাররা অনেক টুকিটাকি জিনিস নিয়ে বসে আছে। তারপর শুরু হয় শীতের কাপড়ের দোকান। শীতকালে পাঞ্জাবী ছেলেরা কি মেয়েরা, সবাই এক ধরনের চকচকে পলিথিন পলিথিন টাইপের উজ্জ্বল রঙয়ের জ্যাকেট পরে। প্রায় সব দোকানেই দেখলাম ভেতরে বাইরে সবখানেই সারি সারি লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, বেগুনী সব রঙের হাতা ওয়ালা বা হাতা ছাড়া জ্যাকেট ঝুলিয়ে রেখেছে। দাম যাচাই করে বুঝলাম ২০০ রুপিতে এগুলো কিনতে পাওয়া যাবে। ভেতরের দিকের দোকানে শীতের কাপড়, ঝকমকে জামাকাপড়, জুয়েলারি সবই আছে। দাম মোটামুটি কম। রুবাইদা সুন্দর হাতের কাজ করা ফুলখাড়ি ওড়না কিনলো ৭০০ রুপি দিয়ে।

আমাদের ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমি ১১০ রুপি দিয়ে চানাচুরের প্যাকেট কিনলাম আর রুবাইদা খেজুরের প্যাকেট কিনলো। তারপর  রাস্তা পার হয়ে একটু দামী দোকানপাটওয়ালা জায়গায় যাই। আমরা মনের সুখে চওড়া ফুটপাথ দিয়ে ঘুরতে থাকি আর দুনিয়ার গল্প করতে থাকি। এর মধ্যে দেখলাম এক জুয়েলারির দোকান থেকে মৌলি সস্তায় আনেকগুলো কাজল কিনে ব্যাগ ফ্রি পেল। দেখতে দেখতে সেই জুয়েলারির দোকানে ঠাসাঠাসি ভিড় হয়ে গেল। আমরা হাঁটতে হাঁটতে দেখতে লাগলাম, পাঞ্জাবের পাঞ্জাবী, শেরওয়ানী, কনের পোশাক, পাগড়ি, কোটি, সিল্কের লুঙ্গি, স্টেশনারি দোকানসহ আরও অনেককিছু। রাস্তার পাশেই ঠেলাগাড়িতে করে কমলার জুস বিক্রি হচ্ছে। ইয়া বড় বড় কমলা, ব্লেন্ডারে করে জুস বানিয়ে দিচ্ছে। মায়িশা খেয়ে খুবই প্রশংসা করলো। ওদের সাথে দেখা হওয়ার পর জানলাম ওরা সেক্টর ১৭ যাবে। আমরা দুইজন মনে করেছিলাম এটাই সেক্টর ১৭। কিন্তু বুঝলাম এটা সেক্টর ২২ এর মধ্যেই।

তারপর আমরা ঐশি, নোভা, বাঁধনদের সাথে সাথে অটো ভাড়া করে সেক্টর ১৭তে যাই। পার হেড ভাড়া পরে ১৫ রুপি। সেক্টর ১৭ অনেক পশ। দামি দামি জিনিসের দোকানপাট সব, আবার সেগুলোতে সেল চলছে। আলাদা আলাদা অটোতে আসায় আমি আর রুবাইদা আলাদা হয়ে যাই। তারপর ব্র্যান্ডের দোকান ঘুরতে ঘুরতে আবার একত্র হই। আমাদের ঘুরতে খুবই ভালো লাগে। ঝলমলে সব দোকানপাট, সামনে অনেক চওড়া ফুটপাথ, তারপর এক লেন স্ট্রিট লাইটিং আর সিটিংয়ের জন্য, তারপরে রাস্তা। সবখানে ফর্সা ফর্সা মানুষজন, গল্প করছে, আড্ডা দিচ্ছে। ওদের ভাষাটা কেমন যেন আন্তরিক।

আস্তে আস্তে দোকান পাট বন্ধ হতে থাকে। মানুষজন কমতে থাকে রাস্তা থেকে। আমরা একটা ঝলমলে খাবার দোকানের সামনে দাঁড়াই। আমি আর রুবাইদা একটা ভেজ চাওমিন অর্ডার দেই ১০০ রুপি দিয়ে। খাবারের টেবিলগুলো দোকানের বাইরে, খোলা আকাশের নিচে। অনেক ভিড় থাকায় আমরা ঠিকমত দাড়াতে পারছিলাম না। আমাদেরকে পাশেই একটা সিনেমা হলের ফুড কোর্টে বসতে বলে। আমরা সেখানে গিয়ে দেখি আর কেউ নাই। শুধু আমরা আমরাই। আমরা হৈচৈ করে খেতে থাকি। ঐশির মোবাইলে সেলফিও তোলা হয়। খাবার বেশ মজা ছিলো আর পরিমানে এত বেশি ছিলো যে আমাকে আর রুবাইদাকে পুরোটা শেষ করতে অনেক কষ্ট করতে হয়।

খেয়েদেয়ে আমরা আবার বের হয়ে অটো ঠিক করতে থাকি। রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা ফাঁকা, কিন্তু ভয় লাগে না। শহরটাকে কেন যেন নিরাপদ মনে হয়। এইবার অটো ভাড়া পরে পার হেড ২০ রুপি করে। আমরা একই রকম রাস্তা দিয়ে ছুটতে থাকি। হঠাৎ একটা সার্কাসের প্যান্ডেল চোখে পড়ে। অনেক বড় সার্কাস। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে থাকি।

হোটেলে ফিরে শুনি অনেকেই হোটেলের পাশে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে গেছে। আমার আর বের হওয়ার ইচ্ছা হলো না। কে জানি এসে খবর দিলো রাত ১২টার সময় শান্তর বার্থ ডে কেক কাটা হবে। আমরা সবাই গেলাম। ছোট্ট রুমের মধ্যে গাদাগাদি করে শান্তকে উইশ করা হলো। তারপর লিয়ার আনা কেকটাকে কেটে খাওয়া হলো। এর মধ্যে জাফর কেকের টুকরা জুবায়েরের গায়ে ফেলে দিলো। যাই হোক সবাই শেষমেষ রুমে ফিরে যাই।

কমিটির লোকজন রুমে এসে খবর দিয়ে যায় যে আগামী কাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত সবগুলো রুম ঠিক করা আছে। ১২টার পর ছেলেদের জন্য একটা আর মেয়েদের জন্য একটা রুম থাকবে। তাই মালপত্র সব গুছিয়ে ১২টার আগেই ঐ রুম দুইটায় রেখে তালা মেরে দিতে হবে। আবার আমরা আমাদের সব মালপত্র গুছিয়ে নিলাম যাতে সকালে সমস্যা না হয়। ঘুমানোর জন্য কম্বলের নিচে ঢোকার সময় মনে হলো আমার পা দুইটা বেশ ফুলে গেছে। কি আর করা, ফোলা পা নিয়েই সেকেন্ডের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম।

The Mighty INDIA CALLING: বিশ্রী ঠান্ডার দিনে ‘গোয়েল’ এর সাথে পরিচয় (পর্ব ৭)

সকাল বেলা যখন হিমি আর লিয়ার ফোন বেজে ওঠে, তখনো আমি কানে কবুতরের আওয়াজ শুনছিলাম। আমরা কম্বলের তলা থেকে মাথা বের করে দেখলাম বাইরে অন্ধকার। ঘড়িতে দেখি ৯ টা বাজে। আমরা ধড়মড় করে উঠে বসি। ৯ টার সময়ই তো আমাদের বের হওয়ার কথা। তাড়াহুড়া করে আমরা রেডি হই। নাশতা করার সময় নাই, আবার গত রাতেও কিছু খাই নাই। কোন উপায় না দেখে দেশ থেকে নিয়ে আসা কেকগুলো খেয়ে ফেললাম। কি পরে বাইরে যাবো সেই চিন্তায় পড়লাম। কারণ এখানকার ওয়েদার খুবই কনফিউজিং। রোদ গায়ে লাগলে গরম, আবার একটু পরেই কনকনে ঠান্ডা। ভেবে চিনতে তিনটা সোয়েটার, কানটুপি, মাফলার, দুইজোড়া হাতমোজা সবই নিয়ে বের হলাম। যখন যেটা লাগবে সেটা পরা যাবে।

আমরা নিচে নেমে বসে রইলাম। এমন সময় এক লোক হাতুড়ি নিয়ে হাজির হলো তমার লাগেজের তালা ভাঙ্গার জন্য। সেই যে হাওড়া স্টেশনে ওর পার্স চুরি গেছে, তারপর থেকে ও আর ওর ব্যাগ খুলতে পারে নাই। হোটেল থেকে এখন একজনকে পাঠিয়েছে সেই তালা ভাঙ্গার জন্য। আমি আর তমা গেলাম একসাথে ওদের রুমে। লোকটা তালাটা ভাঙতেই আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম ‘আলহামদুলিল্লাহ’। উনি অবাক হয়ে হিন্দিতে বলে, ‘আপনি মুসলমান?’। আমার উত্তর শুনে উনি জানায় উনিও মুসলমান। জানতে চায় আমাদের দেশের সবাই মুসলমান কিনা, যারা এখানে এসেছি তারা সবাই মুসলমান কিনা। তমা শেষে উনাকে বখশিশ দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় করে।

১১টার দিকে আমরা হোটেল থেকে বের হয়েই টের পেলাম ওয়েদার মোটেও সুবিধা জনক নয়। আকাশ মেঘলা আর কনকনে ঠান্ডা। আমরা গলি দিয়ে বের হয়ে প্রথম বারের মতন আমাদের ভাড়া করা বাসটা দেখতে পেলাম। ক্যাটক্যাটে কমলা রঙের বাস, গায়ে লিখা ‘গোয়েল টুরিস্ট’। গোয়েলের সাথে সেই আমাদের প্রথম দেখা। আগামী ২১ দিনের জন্য বাসটা ভাড়া করা হয়েছে। এই ২১ দিনে আমাদের একটা বড় সময় এই বাসের ভিতর কাটবে। এইসব ভাবতে ভাবতে বাসের ভিতর উঠে বসলাম। দরজা দিয়ে ঢুকে ইঞ্জিন আর ড্রাইভারের সিটটা পার হবার পর আরেকটা দরজা, তারপর আমাদের বসার জায়গা। বাসটার ভেতরের ইন্টেরিওর কেমন জানি বিয়ে বাড়ির মতন। জানালায় লাল রঙের ঝালর লাগানো, সিটগুলো উজ্জ্বল লাল- বেশির ভাগেরই প্যাকেট খোলা হয় নাই, আর সামনে খুবই অদ্ভূত এক পেইন্টিং টানানো। আমরা সবাই কোন মতে বসে পড়লাম। কয়েকটা সিট খালি। দেখা গেল সুহাইলাসহ আরও কয়েকজন আসে নাই। ওদের আবার খবর দিয়ে আনা হলো। যাই হোক আমাদের যাত্রা শুরু হলো। প্রথম গন্তব্য কুতুব মিনার।

পথেই আমরা ইন্ডিয়া গেট দেখলাম। যখন কুতুব মিনারে পৌঁছাই তখন চারপাশে ঘন কুয়াশা। কুতুব মিনার আমরা ঠিকমত দেখতেই পারছিলাম না। ১০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে গেট দিয়ে ঢুকেই আমাদের সাথে ০৯ ব্যাচের আপু ভাইয়াদের সাথে দেখা হলো। ওনারা সিমলা মানালি ঘুরে আবার দিল্লী এসেছেন। ওনাদের সাথে হাই হ্যাল্লো করতে করতেই বৃষ্টি শুরু হলো। একে তো ঝাপসা কুয়াশা ছিলোই, তার সাথে বৃষ্টিটা শীতটাকে আরও কয়েকগুন বাড়িয়ে দিলো। আমরা একটু আশ্রয়ের জন্য ছুটতে লাগলাম এদিক ওদিক। ক্যামেরা স্কার্ফ দিয়ে পেচিয়ে ব্যাগে ভরলাম। কুতুব মিনার তো ঠিকমত দেখা হলোই না বরং মেজাজ খারাপ করে বৃষ্টিটা থামার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। এত মানুষের কাছ থেকে সাজেশন নেওয়া হয়েছে, কেউ কোনদিন ছাতা নেওয়ার কথা বলে নাই। পুরা ব্যাচের ৪৬ জনের মধ্যে কারও কাছে ছাতা নাই। আমার বেশ মন খারাপ হলো।একটা বিশাল স্থাপনার নিচে সবাই পোজ মেরে সেলফি তুলতে লাগলো। আমি মেজাজ খারাপ করে বাইরে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম।

দ
বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে কুতুব মিনারের সামনে কয়েকজন দ্বিমিকবাসী ও শূণ্যয় সদস্য (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

খনিক পর যখন মনে হলো বৃষ্টিটা কমে গিয়েছে, তখন আমরা ঝটপট বের হয়ে দৌড় দিলাম। কনকনে ঠান্ডা আমাদের হাড় ভেদ করে ঢুকতে লাগলো। কোন রকম বাসে উঠে আমরা বসলাম। হাত দুইটা বারবার অসাড় হয়ে যাচ্ছিলো, ঠান্ডাকে বকতে বকতে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। আমরা ৩ টার দিকে পৌঁছালাম লোটাস টেম্পলে। কাঁপতে কাঁপতে আমরা ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। রাস্তার পাশে হঠাৎ ০৯ এর বাস দেখলাম। আমরা কয়েকজন সেখানে উঠে আপুদের সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। আপুরা বললো ওনারা সিমলা, মানালিতেও এই রকম বিশ্রী ঠান্ডা পায় নাই। আমাদের তাড়াতাড়ি করে  দিল্লী থেকেই দুই সেট ইনার কিনে নিতে বললো। আমরা কিছুক্ষন কথা বলে ওনাদের বাস থেকে নেমে হাঁটা দিলাম।

ঝাপসা কুয়াশাময় পরিবেশে লোটাস টেম্পলটা বাইরে থেকে দেখতে বেশ ভালো লাগছিলো। কিন্তু কাছে গিয়ে যখন জানতে পারলাম ভিতরে জুতা খুলে ঢুকতে হবে, তখন আমার মেজাজটা গরম হয়ে গেলো। এই ঠান্ডার মধ্যে জুতা খুললে আমার নির্ঘাত নিউমোনিয়া হয়ে যাবে, তার উপর বৃষ্টি ভেজা রাস্তা- জুতা খোলার তো প্রশ্নই আসে না। আমি পিছু হটলাম। আমার সাথে মৌলিও যোগ দিলো। আমরা আবার হেঁটে হেঁটে বাসের দিকে যেতে লাগলাম। মাঝখানে রাস্তার পাশে পার্ক করা একটা বাসের ইঞ্জিন থেকে গরম ভাপ বের হচ্ছিলো। আমি আর মৌলি বাসের সাথে গা লাগিয়ে খানিক্ষন দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশ আরাম লাগছিলো আমাদের। আমরা হাত আর পিঠ সেক দিয়ে বেশ উষ্ণ করে নিলাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে গোয়েলে এসে পৌঁছালাম। পুরো বাসে আমি, মৌলি আর চিং।

অনেক্ষন পরে সবাই যখন ফেরত আসলো তখন সবাই বলতে লাগলো আমরা নাকি মিস করেছি, ভেতরটা অনেক সুন্দর ছিলো, কষ্ট করে ঢুকলেই পারতাম। আমার কোন আফসোস রইলো না- আমি ভাই এত ঠান্ডা সহ্য করতে পারতাম কিনা সন্দেহ। যাই হোক অনেক বেলা হয়ে গেছে কিন্তু কোন খাওয়া হয় নাই। আমরা আবার রওয়ানা দিলাম। এবার যাচ্ছি জামে মসজিদ। বাসেই ডিসিশোন হলো, ঠান্ডা আর বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য ইনার আর রেইনকোট কেনা দরকার। ধারে কাছে মার্কেট আছে, মেম বাজার আর পাল্লিকা বাজার। আজকে রাতেই যেকোন একটাতে গিয়ে কেনাকাটা করতে হবে।

জামে মসজিদের কাছাকাছি পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের ৬টা বেজে গেলো। বাস থেকে নেমে রাস্তা ক্রস করে আমরা হাঁটতে লাগলাম। পাকা রাস্তা পার হয়ে কাঁচা রাস্তা আসলো। সেই রাস্তা নোংরা থেকে নোংরাতর হতে লাগলো। বৃষ্টিতে, কাদায় আর ময়লায় মাখামাখি হয়ে যাওয়া রাস্তায় আমরা অত্যন্ত সাবধানে হাঁটতে লাগলাম। দুইপাশে মুসলমান দোকানপাট দেখা গেলো। জামা কাপড়, তসবি টুপি, জায়নামাজ, রোরখা, আতর, ডেকচি, হাড়ি পাতিল, জুতা স্যান্ডেল – কি নেই সেখানে! এত ময়লা কাদা পার হয়ে জামে মসজিদে আর আমরা কেউ ঢুকলাম না। পাশ দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছি তখনই নাকে কাবাবের গন্ধ লাগলো। দেখলাম সারি সারি খাবারের দোকান। সেখানে বিরিয়ানি আর শিকের মধ্যে গাঁথা ঝলসানো মাংস থেকে ভুরভুর করে সুগন্ধ বের হচ্ছে। জিভে আমাদের পানি চলে আসলো। কত দিন মাংস খাই না!

আমরা কয়েক ভাগ হয়ে একেক দোকানে ঢুকে পড়লাম। অনেকে গেলো ‘করিমস’ হোটেলে। আমি, রুবাইদা, আদিবা আরও কয়েকজন ‘সুবহানাল্লাহ’ নামের এক দোকানে ঢুকে বিফ বিরিয়ানি অর্ডার দিলাম। ওরা বলেই দিলো যে ইন্ডিয়ার বিফ আসলে মহিষ, তারপরও ৫০ রুপিতে বাসমতি চালের বিরিয়ানি খেয়ে ভালোই লাগলো। ওখানে খেয়ে দেয়ে বের হয়েই দারুন এক মিষ্টির দোকান চোখে পড়লো। দোকানের নাম ‘কল্যান সুইটস’। এখানকার মিষ্টির দোকান আমাদের মিষ্টির দোকানের চাইতে আলাদা। দোকানের ভিতর বড় বড় থালার মধ্যে হালুয়া জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। কোনটা বাদামের হালুয়া, কোনটা শাহী হালুয়া। আর সামনের কাঁচের শোকেসে সারি সারি মাটির বড় বড় গ্লাসে লাচ্ছি, বাদাম দুধ সাজানো। অন্য পাশে হরেক রকমের মিষ্টি- লাল মোহন যেটাকে ওরা বলে গুলাব্জামুন, বাদামের বরফি, রঙ বেরঙ্গের মিষ্টি দেখে আমার জিভে পানি চলে আসলো। কিন্তু মাত্রই বিরিয়ানি খেয়ে পেট ভরে রেখেছি, আবার রাতে জার্নিও আছে। তাই খাওয়ার আগে আমরা একেকটা মিষ্টির নাম জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। দোকানের লোকটা আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপ কাঁহাসে হো, হায়দ্রাবাদ?’ আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘ বাংলাদেশ’।

দোকানের লোকটা আমাদের ফ্রিতে হালুয়া আর শাহী টুকরা টেস্ট করতে দিলো। দুটোই মজা ছিলো। লিয়া লাচ্ছি খেলো আর তানভীর বাদাম দুধ খেলো। ওদের লাচ্ছি অনেক ঘন, চামচে করে খেতে হয়। দোকান থেকে বের হওয়ার পর তানভীর জানায় বাদাম দুধটা অসম্ভব মজা ছিলো। তানভীরের উপর রাগ লাগলো, আরেকটু আগে বললেই আমি এক গ্লাস খেতে পারতাম। রাত হয়ে গেছে, আমরা ফেরার পথ ধরলাম। সেই ময়লা, নোংরা রাস্তা হেঁটে আমরা আবার বাসে উঠে বসলাম। রাত হয়ে যাওয়ায় সব মার্কেট বন্ধ হয়ে গেছে ভেবে আমরা সরাসরি হোটেলে ফেরত যাই।

হোটেলে গিয়ে শুনতে পারি লিয়া গেছে মার্কেটে। আমি লিয়াকে ফোন দিয়ে বলে দেই আমার জন্য একটা ইনার কিনে আনতে। আমরা ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হতে থাকি। ওদিকে লিয়াও ফেরত আসে। ও ৫৫০ রুপি দিয়ে সুখান্দ কোম্পানির ইনার কিনে আনে। আমার ইনার আমি ট্রায়াল দিয়ে দেখি, বেশ গরম বলেই মনে হয়। এই জিনিস পরে যদি গরম লাগে তাহলে বাসে খুব অশান্তি লাগবে ভেবে আমি ইনারটা না পরেই রেডি হই।

হোটেলের এক্টামাত্র ছোট্ট লিফট দিয়ে মালপত্র নামিয়ে আমরা নিচে ওয়েট করি। রাত ১২টা- ১টার দিকে আমরা মালপত্র নিয়ে বাসে উঠে বসি। সারা বেশ ছটফট করতে লাগলো। ওর ইনার পরে খুব অশান্তি লাগছে। বেচারি খুলতেও পারছে না আবার স্বস্তিও পাচ্ছে না। আমি ব্যাগ থেকে কম্বল বের করে গায়ে দিলাম। কম্বলের নিচে ভাবতে থাকি দিল্লী শহরটা তাড়াতাড়ি ছাড়তে পারলেই বাঁচি। এখানকার মানুষজন ভালো না, আবহাওয়া খুবই অসহ্যকর, রাস্তাঘাট মরা মরা। এই পচাঁ শহরটা থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। এইসব ভাবতে ভাবতে আর বাসের দুলুনিতে ঘুম পেয়ে গেলো। কখনও ভাবি নাই যে বাসে আমি ঘুমাতে পারবো। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, আমার দুই চোখ কিছুক্ষনের মধ্যেই গভীর ঘুমে বুজে আসলো।

 

 

 

The Mighty INDIA CALLING: রাজধানী দিল্লীতে পদার্পণ (পর্ব ৬)

সকাল সাড়ে সাতটা কি পৌনে আটটার দিকে উর্মির ডাকে আমার ঘুম ভাঙ্গে। উর্মি বলতে থাকে আমরা নাকি প্রায় চলে এসেছি। আমি অবাক হয়ে যাই। আমাদের দুপুর বেলা দিল্লী পৌঁছানোর কথা আর এখন সকাল বেলাতেই চলে এসেছি –এটা আবার কেমন কথা। মনে হলো ট্রেন বুঝি রাতে উড়ে উড়ে এসেছে। যাই হোক ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে মালপত্র সব গুছিয়ে বসতে বসতে অনেকক্ষণ কেটে গেলো। এর পর দেখলাম নিলয়ের সাথে কানটুপি পরা এক লোক বেশ কথা বলছে ইংরেজীতে। উনি আমরা ৪৬ জন দেড় মাসের জন্য বেড়াতে এসেছি শুনে বেশ পুলকিত হয়েছেন। খানিকক্ষণ পর উর্মি আর চিংয়ের সাথেও নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। আমাদের কথা, বাংলাদেশের কথা, বুয়েটের কথা এইসব নিয়ে আলোচনা হতে লাগলো।

এক পর্যায়ে উনি জিজ্ঞেস করলেন এই দেশ কেমন লাগছে আমাদের কাছে। উর্মি জবাব দিলো ভালো লাগছে, কোলকাতা খুব চমৎকার লেগেছে। উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন আমাদের অভিজ্ঞতা কি ইন্ডিয়া নিয়ে? এই বার আমি দৃষ্টি আকর্ষন করে বললাম, ‘এই যে ব্যাগের সাথে লাগানো যে শিকলগুলো দেখতে পাচ্ছেন, আমি আমার দেশে অনেকভাবে ভ্রমণ করেছি কিন্তু কখনো এই জিনিস কখনো দেখি নাই। শিকল দিয়ে ব্যাগের সাথে তালা মেরে রাখার ব্যাপারটা আমাদের কাছে একেবারেই নতুন’। ভদ্রলোক বেশ লজ্জা পেয়ে গেলেন আমার কথা শুনে। উনি আরও অনেকক্ষণ কথা বললেন। আমার পাশের মহিলাও আমাদের সাথে যোগ দিলো। ঠিক স্টেশনে নামা নিয়ে আমরা টেনশনে ছিলাম। কিন্তু উনারা আমাদের আশস্ত করলেন যে আমাদের ঠিক স্টেশনেই নামিয়ে দিবেন।

কমলাপুরের আগে যেমন এয়ারপোর্ট স্টেশন, নিউ দিল্লীর আগে তেমন গাজিয়াবাদ স্টেশন। গাজিয়াবাদ আসার পরই দেখলাম যাত্রীরা সবাই মালপত্র নিয়ে একদম রেডি। আমরা প্রায় দশটার দিকে নিউ দিল্লী স্টেশনে নামলাম। সবাই একত্র হয়ে আমরা স্টেশনের ভিতরেই মালপত্র নিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতে লাগলাম, আর আমাদের কমিটির লোকজন গেলো হোটেল ঠিক করতে। স্টেশনের ভিতরেই ম্যাকডোনাল্ডস থেকে সকালের নাশতা ম্যাক আলু টিক্কি খেলাম ২৮ রুপি দিয়ে। খেয়ে পেট ভরে গেলো। অনেকে আবার চিকেন আর ভেজ র‍্যাপ খেয়েছে ৭০ রুপি দিয়ে।

্দচে
আমাদের নিউ দিল্লী স্টেশনে রেখে কমিটি গেছে হোটেল ঠিক করতে (কৃতজ্ঞতায় সারাহ তাবাসসুম)

অনেক্ষণ অপেক্ষা করার পর হোটেলের সন্ধান পাওয়া গেলো। হোটেল থেকে আমাদের জন্য মাইক্রোবাস পাঠানো হয়। সেইগুলোতে মালপত্র তুলে আমরা গাদাগাদি করে চড়ে বসি। দিল্লী ব্যস্ত শহর। আশেপাশে অনেক ঘোড়ার গাড়ি। গাড়িতে আমার বেশ গরম লাগে। সব শীতের কাপড় খুলে আমি ব্যাগের উপর মাথে রেখে ঘুমিয়ে পড়ি। দুপুর পৌনে একটায় আমরা পাহাড়্গঞ্জের হোটেল ইউকে তে পৌঁছাই। হোটেল ম্যানেজারের চেহারা অত্যন্ত ধুরন্দর। উনি কুতকুতে চোখ আর পুরুষ্টু গোঁফ নিয়ে কমিটির লোকজনদের সাথে কথা বলতে লাগলেন। হোটেলে আমাদের চারজনের গ্রুপ ভাগ হয়ে যায়। আমি পড়ি লিয়া, হিমি আর সুহাইলার সাথে।

আমাদের রুমটা অনেক উপরে। রুমে  ঢুকেই আমার মনটা ভালো হয়ে যায়। আগেরটার চাইতে অনেক ভালো রুম। বাথরুমটাও বড় এবং সাদা ধবধবে। তবে বাথরুমের দরজা ঠিকমত আটকায় না, আর নো বদনা নো হোস পাইপ। তবে একটা বড়সড় মগ ছিলো। শুনলাম পার হেড নাকি ৬০ রুপি করে খরচ পড়েছে রুম ভাড়ায়। সবার আগে হিমি গোসলে ঢুকলো। বের হয়ে বললো গিজার কাজ করছে না। তারপর সুহাইলা ঢুকলো। ওর গোসল শেষ হলে আমি আর লিয়া রুম সার্ভিসে খবর দিলাম গরম পানির জন্য। একজন লোক এসে জানালো এটাতে বয়লার আছে যেটা রুম সার্ভিসে খবর পেয়ে উনারা অন করে দিয়েছেন। এখন আর গরম পানির কোন অসুবিধা হবে না। লিয়া গোসলে ঢুকে ‘উহ বাবা, পুড়ে গেলাম’ বলে চিৎকার করতে লাগলো। সবশেষে আমি গোসলে ঢুকি। গরম আর ঠান্ডা পানি মিশিয়ে সাবান শ্যাম্পু দিয়ে জম্পেশ একটা গোসল দেই। ভীষন আরাম লাগে আমার।

প্রায় বিকাল পাঁচটার দিকে আমরা লাঞ্চ খেতে যাই। রাস্তায় বের হওয়ার সাথে সাথেই সতর্কবার্তা শুনি দিল্লীতে ব্যাগট্যাগ খুব সাবধানে রাখতে হবে। আমি আমার হ্যান্ডব্যাগটা সামনে ঝুলিয়ে হাঁটতে থাকি। হোটেলের কাছেই একটা দোকানে আমরা অনেকে একসাথে ঢুকে পড়ি। আমি আর রুবাইদা অর্ডার দেই সাউথ ইন্ডিয়ান থালি। ১১০ রুপির সেই থালিতে ছিলো আলুর ঝোল তরকারি, ছোলারতরকারি, সাম্বার ( টক পাতলা ডাল), ঘন ডাল, টক দই, ভাত, রুটি আর পাঁপড়। অনেকেই দম আলু, মটর পনির, চানা, মশলা দেওয়া ধোসা এই সব অর্ডার দিলো। প্রত্যেকটা খাবারেই প্রচুর মশলা ছিলো আর অনেক টেস্টি ছিলো।

খাওয়া দাওয়া শেষে আমি চট করে হোটেলে গিয়ে মোটা সোয়েটার নিয়ে আসি। সূর্য ডোবার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে ঠান্ডা বাড়তে লাগে। দেখি সবাই দুইটা দলে ভাগ হয়ে ঘুরতে বের হচ্ছে। আমরা রাজীব চক যাবো বলে ঠিক করি। রাস্তায় দাঁড়ানো ট্রাফিককে জিজ্ঞেস করতেই উনি দেখিয়ে দেন ডিরেক্ট বাস। আমরা বাস থামতেই বাসে উঠার জন্য হাঁটা ধরি। কিন্তু পিছন থেকে ডাক আসে। ট্রাফিক আমাদের বলে যে আমাদের জন্য অটোতে করে যাওয়া ভালো হবে। ততক্ষণে মিম, অন্তরা আর তমা বাসে উঠে গেছে। আর এদিকে আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অটো ঠিক করার চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু আমাদের কথা শুনে উনারা বেশি বেশি দাম হাঁকায়। এগিয়ে আসেন এক বয়স্ক মহিলা। উনি নিজে এক্টার পর একটা অটো ঠিক করে দেন আমাদের জন্য। উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা দলে দলে রওয়ানা দেই।

ঐশি, মায়িশা, আমি আর নোভা এক অটোতে উঠি। আমাকে নোভা আর মায়িশা পালা করে কোলে নেয়। অটোওয়ালা আমাদের পরিচয় জেনে অনেক্ষণ কথা বলে। জানতে চায় এত ভালো হিন্দি আমরা কোথায় শিখলাম। নোভা সব কৃতিত্ব স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোকে দিয়ে দেয়। ৬০ রুপি ভাড়া দিয়ে খানিক পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম রাজিব চক। বিল্ডিং গুলো আমাদের বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের মতন। সবগুলো বিল্ডিং বৃত্তাকারে সাজানো আর বৃত্তের কেন্দ্রে আছে বিশাল এক ইন্ডিয়ার পতাকা। চারপাশে সব দামি আর অভিজাত দোকান। দোকানের বাইরে শহরের উচ্চ শ্রেণীর মানুষেরা আড্ডা দিচ্ছে। আমি, নিশাত, রিন্তু, রুবাইদা একসাথে ঘুরলাম। নিশাত বাটা থেকে দুই জোড়া স্যান্ডেল কিনলো। ঝলমলে সব দোকানের চোখ ঝলসানো সব জিনিস দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে গেলাম। ফাস্ট ট্র্যাকের একটা নীল জিন্সের বেল্ট দেওয়া বড় ডায়ালের ঘড়ি আমার অনেক পছন্দ হলো। কিন্তু টাকা সাথে না থাকায় আমি কিনলাম না। পরে কোন এক সময় কিনে নিবো- এই চিন্তা করে ওখান থেকে বের হয়ে আসি। অনেকক্ষণ পর আমরা সবাই একসাথে জড়ো হলাম। এরপর গেলাম ‘ক্যাফে কফি ডে’ র উদ্দেশ্যে।

'ক্যাফে কফি ডে'তে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)
‘ক্যাফে কফি ডে’তে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

‘ক্যাফে কফি ডে’ ইন্ডিয়ার নামকরা কফি চেইনশপ। আমি আর রুবাইদা সেখানে ছোট্ট কাপে করে বেলজিয়ান চকো শট আর ম্যাংগো মেলডি খেলাম। দাম ৩০ রুপি করে। সেখান থেকে বের হয়ে আমরা অনেক চিন্তাভাবনা করে কাছের মেট্রো স্টেশনে গেলাম। ৮ রুপি দিয়ে টিকেট কেটে আগের মতই গাদাগাদি করে চড়ে বসলাম মেট্রোতে। কয়েক মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলাম আমাদের স্টেশনে। মেট্রো থেকে নেমে আমরা চল্লিশ জনের মতন মানুষ উচ্চস্বরে হাহা হিহি করতে করতে হাঁটতে থাকি। আমাদের হৈচৈয়ে বিশাল মেট্রো স্টেশনটা গম গম করে উঠে। আশেপাশের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আমরা এভাবেই চেঁচামেচি করতে করতে বের হয়ে আসি স্টেশন থেকে।  এখান থেকেও পাহাড়গঞ্জ একটু দূরে। রাস্তার পাশে ইজি বাইক টাইপের কয়েকটা যান ঠিক করতে চাইলে তারা উলটাপালটা দাম চায়। সবশেষে আমরা হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। লাইন ধরে আমরা হাঁটতে থাকলাম।

রাত প্রায় দশটার সময় দিল্লীর রাস্তা ধরে এতগুলো ছেলেমেয়ের গল্প করতে করতে লাইন ধরে হেঁটে যাওয়া স্বাভাবিক নয়। তাই অনেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দেখছিলো। রাতের দিল্লী অদ্ভূত রকমের। স্ট্রিট লাইটিং আর পাহাড়্গঞ্জের সাইনেজ দেখে কেমন জানি লাস ভেগাস শহরের মতন লাগে। এরই মধ্যে বৃষ্টি আর ইশতিয়াকের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। যাইহোক আমরা অবশেষে হোটেলে এসে পৌঁছলাম। অনেকেই রাতের খাবার খেতে গেলো। আমার পেট ভরা ছিলো। আমি আর কিছু খেলাম না। খাওয়ার পানি কিনে হোটেলে ফেরত চলে আসলাম। রুমে ঢুকতে পারলাম না কারণ রুমমেটরা কেউ আসে নাই।

গিয়ে বসলাম নিশাতদের রুমে। দেখি মজুমদার বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে আর রিন্তু নানা রকম নাচ গান করে ওর মন ঠিক করার চেষ্টা করছে। জানতে পারলাম রাত ১২টার সময় আমাদের মিটিং আছে প্রত্যেককে হাজির থাকতেই হবে। অনেকক্ষণ ওদের সাথে গল্প করলাম। তারপর রুমে ফিরে আসলাম। আবার রাত ১২টার সময় শান্তদের রুমে আমরা সবাই জড়ো হলাম।

একটা ডাবল বেডের রুমে আমরা ৪৬ জন মানুষ কেমন করে আঁটলাম সে এক ভারি রহস্য। কিন্তু তারপরেও আমরা ৪৬ জন মানুষ আর আমাদের ৪৬ জোড়া স্যান্ডেল নিয়ে দূর্দান্ত এক মিটিং করলাম। শুভ আর অবনী বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে কথা বললো। কল্কা মেইলে ঘটে যাওয়া ঝগড়াঝাটি, কেন আমরা একসাথে সিট পেলাম না, আর এই নিয়ে নানা গুজব – এই সব কিছু নিয়ে দৃঢ় বক্তব্য দিলো অবনী। একটা বাইরের দেশে এসে আমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত এই টাইপের কথা বার্তাও হলো। শুভ জানালো আজকে আমরা যখন ঘুরতে বের হয়েছি তখন কমিটির লোকজন আগামী ২১ দিনের জন্য একটা বাস ঠিক করতে যায়। ওরা ৪৫ সিটের একটা বাস পেয়েছে যেটার পিছনের ৫ জনের জায়গায় ৬ জন বসতে হবে। আগের বার রুবাইদা একা পুরা জার্নিতে কষ্ট করেছে। এইবার সবাইকে মিলে মিশে কষ্ট করতে হবে। ওর কথায় আমরা সবাই সমর্থন জানালাম। ও আরও ব্যাখ্যা দিলো, এতদিন আমরা সবাই আলাদা আলাদা ঘুরেছি, এখন থেকে আমরা বাসে করে ঘুরবো- আক্ষরিক অর্থে আসল ট্যুর শুরু হবে এখন থেকে। আমরা আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠি। তারপর জুবায়ের রাস্তাঘাটে সবার সাথে সহনশীল আচরন করার কথা বলে। কারণ থানা পুলিশ ঝামেলা হলে কমিটি কোন দায়িত্ব নিবে না জানিয়ে দেয়। আমরা তাতেও খুশিতে সমর্থন জানাই। কিছুক্ষণ পর আশেপাশে রুম থেকে কমপ্লেইন আসতে থাকে। আমরা দ্রুত আমাদের মিটিং শেষ করে যার যার রুমে চলে যাই।

রাতের বেলা সীমান্ত হিমিকে ফোন দিয়ে জানায় যাতে আমরা ভালো করে দরজা বন্ধ করে ঘুমাই। কারণ হোটেলে নাকি উলটা পালটা অদ্ভূত লোকজন আছে। আমরা সব রকম ব্যবস্থা এনশিওর করে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে যাই। রুমের জানালার পাশেই মনে হয় কবুতরের খোঁয়াড়, সেখান থেকে ফরফর করে কবুতরের শব্দ আসতে লাগলো।