সারা রাতে ঘুমের ফাঁকে ফাঁকে তুষার আর শুভর আর্ত চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। মৌলি আর ঐশির উৎকন্ঠা টের পাচ্ছিলাম ‘ড্রাইভারকে বল আস্তে চালাতে/ সাবধানে চালাতে বল’। পুরো বাস যে সাপের লেজের মতন পথ দিয়ে চলছে তা ঘুমের ঘোরেও টের পাচ্ছিলাম। মাঝে একবার চোখ খুলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। এমন এক অদ্ভূত দৃশ্য জানালার বাইরে যা কোন ভাষাতেই বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। আমরা প্রায় বাসের সমান সমান চওড়া রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি যার একপাশে পাহাড় আর অন্যপাশে খাদ। জানালা দিয়ে নিচে তাকালে কোন রাস্তা চোখে পড়ে না কারণ চাকার পরই খাদ। আর দূরে পাহাড়ের গায়ে বিল্ডিংগুলো থেকে জ্বলে ওঠা বাতিগুলোকে দেখে চোয়াল ঝুলে পড়লো। আকাশ সমান উঁচু পাহাড়গুলোর গায়ে গড়ে ওঠা বসতিগুলোকে রাতের অন্ধকারের মাঝে ভ্যান গগের ‘স্টারি নাইটের’ বাস্তব অন্ধকার সংস্করণ বলেই মনে হলো। এ এক অপার্থিব দৃশ্য। যারা দেখে নাই তাদের বলে বোঝানোর মত ক্ষমতা আমার নাই। আমার পাশেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে রুবাইদা। ভাবলাম ওকে ডাক দেই। কিন্তু ও সাড়া দিলো না। খানিক পরে আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম।
ভোর বেলায় আমরা পৌঁছালাম সিমলায়। কমিটির লোকজন হোটেল ঠিকঠাক করলো কয়েক জায়গায় ঘুরে। অনেক পরে অবশেষে আমাদের জন্য ঠিক করা হলো ‘হোটেল শাইল’। আমরা বাস থেকে নেমে পড়লাম। বেশ ফুরফুরে ঠান্ডা বাইরে। তাকিয়ে দেখলাম আমাদের হোটেলের এন্ট্রি রাস্তার লেভেল থেকে অনেক নিচে। অনেক ঢালু পথ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে লাগেজ গুলোকে নিয়ে হোটেলে পৌঁছালাম। আমি আর মজুমদার গিয়ে একটা রুমে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে যাই- এত সুন্দর হোটেল। চমৎকার রুম, লাল রঙের কার্পেট, সুন্দর বিছানা, একটা বে উইন্ডো যেটাতে বসার জন্য আমরা হুড়াহুড়ি শুরু করলাম। দরজা লাগিয়ে আমি আর মজুমদার গান গাইতে গাইতে নাচতে লাগলাম। হটাৎ শুনলাম সুমাইয়ার মোবাইল আর মানি ব্যাগ বাস থেকে হারিয়ে গেছে। ও প্রত্যেক রুমে রুমে এসে খোঁজ নিতে লাগলো আমরা সেগুলো দেখেছি কিনা। এসব শুনে আমাদের মন খারাপ হয়ে গেলো।
একটু ধাতস্থ হয়ে আমরা আমাদের সব শীতের কাপড় বের করতে লাগলাম। চকচকে বাথরুমে গরম গরম পানি দিয়ে আমরা একেক জন গোসল করতে লাগলাম। কি যে ভালো লাগলো- আহা! জামা কাপড় গুছিয়ে অন্য সবার সাথেই বের হতে হতে বেশ দেরি হয়ে গেল। হোটেল থেকে বের হয়ে একটু সামনে গিয়েই আমরা থেমে গেলাম। মেইন রাস্তার বাঁকে, পাহাড়ের কিনারায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম। নীল আকাশে হালকা সাদা সাদা মেঘ, পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা ঘরবাড়ি, গাঢ় সবুজ গাছ, ফুরফুরে বাতাস, রিফ্রেশিং এক ধরনের ঠান্ডা আমাকে পুরাই স্পেলবাউন্ড করে দিলো। মনে হলো যেন আমাদের দেশের ট্রাকগুলোর পিছনে আঁকা প্রাকৃতিক দৃশ্যর বাস্তব রূপ এটা। আমরা মল রোডে যাবার জন্য একটা বাসে উঠলাম। বাসগুলোতে জোরে জোরে হিন্দি গান বাজতে থাকে। উঁচু নিচু ঢালু বাঁক পার হয়ে সেই বাস আমাদের ১০ রুপি ভাড়া নিয়ে একটা জায়গায় নামিয়ে দিলো। সেখান থেকে ঢালু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গরটন ক্যাসেলের পাশে আমরা একটা হোটেলে মায়িশা, নোভাদের দেখলাম। আমরাও ঢুকে পড়লাম। জায়গা খালি হতেই আমরা বসে পড়লাম।
অন্যান্য জায়গা থেকে এখানে খাবারের দাম বেশি হবে জানতাম কারণ এটা টুরিস্ট স্পট। আমি আর রুবাইদা মায়িশাদের কাছ থেকে সাজেশন নিয়ে ১৭০রুপির পাঞ্জাবী থালি অর্ডার দিলাম। থালিতে চিজের তরকারি, ডাল, রুটি আর ভাত ছিলো। খেতে মোটামুটি। খেয়েদেয়ে আমরা বের হয়ে আসলাম। চোখের সামনে গরটন ক্যাসেল সবার আগে ছিলো। তাই সেটাতেই ঢুকে পড়লাম। এটা আসলে সরকারি অফিস। অফিস আওয়ার শেষ কিন্তু সামনে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পুরা ক্যাসেলে সাজানোর কাজ হচ্ছে। আমরা সেখানে এক লোকের কাছে পারমিশন নিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। অনেক বড় কিন্তু সুন্দর বিল্ডিং। ভিতরে কেউ নাই শুধু আমি আর রুবাইদা। বিল্ডিংটার মধ্যে গ্রিক এবং ইন্ডিয়ান স্থাপত্যের মিশেল আছে। এত বড় বিল্ডিঙে আমরা দুইজন ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। অনেকক্ষন ঘোরার পর বেশ ভয়ভয় করতে লাগলো। আমরা তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে পড়লাম।
গরটন ক্যাসেল থেকে বের হয়ে সামনে দাঁড়াতেই জোর বাতাস এসে হাঁড় কাঁপিয়ে দিলো। দুই জোড়া হাত মোজাই আমি একসাথে পড়ে ফেললাম। তারপর ঢাল বেয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম। কি চমৎকার দৃশ্য রাস্তার দুইপাশে। সমতল রাস্তা থেকে হয় উঁচুতে না হয় নিচুতে ঘরবাড়িগুলো। আবার লাল রঙের টালি ওয়ালা বাড়ির ছাদ থেকে গাছের ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে বানরের দল। এখানে বানরের বেশ আধিপত্য। এখানে হনুমানের অনুসারীর সংখ্যা বেশি। কয়েকটা গেটে হনুমানের মুর্তি দেখলাম তবে বেশিরভাগই ডিজপ্রপোরশনেট। এখানে একটা মেইন রোড ধরে শুধুমাত্র গাড়ি চলে। আর বাদবাকি সব জায়গায় হেঁটে বা সাইকেলে চড়ে যেতে হয়। এইরকম ঢাল বেয়ে ওঠা নামা করার জন্য আমাদের হাতে তাই হাঁটা ছাড়া আর অপশন রইলো না। আমরা অনেক হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছালাম ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ অ্যাডভান্স স্টাডিজের গেটে। ঢাল বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি, রুবাইদা আর সারা পিছিয়ে পড়ি। পিছিয়েই যেহেতু পড়েছি তাই একটু রেস্ট নিয়েই যাই ভেবে আমরা পাহাড়ের ঢালের ধারে একটা বেঞ্চে বসে পড়লাম। আমাদের পাশেই আমাদেরকে কোন পাত্তা না দিয়েই ধাড়ি ধাড়ি বানর ঘোরাফেরা করতে লাগলো। বানর পরিবারকে দেখে ভালো লাগলো। বাচ্চা বানর মা বানরের কোলে জাপটে ধরে বসে আছে। সেই অবস্থাতেই মা বানরটা লং ডিস্টেন্স জাম্প দিয়ে আমাদের তাজ্জব করে দিচ্ছে।
একটু রেস্ট নিয়ে আমরা যখন পাহাড়ের চূড়ায় প্রাসাদটাতে পৌঁছালাম তখন সূর্য নেমে গেছে। আমরা টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকি কিন্তু বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে দেখে আমাদের বিল্ডিঙয়ে ঢুকতে দেয় না। বাইরে থেকে দেখে আমার মনে হয় আমি যেন ইংল্যান্ডের কোন প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এত সুন্দর আর বিলাসী একটা প্রাসাদ বৃটিশরা এত উঁচু একটা পাহাড়ের চূড়ায় কেমন করে বানালো ভেবে আমি কোন কূল পেলাম না। লর্ড লিটন নামের কেউ একজন গরমের সময় ছুটি কাটানোর জন্য এই প্রাসাদটা তৈরি করেন। এর ভিতরে নাকি রুম গরম করার জন্য নিজস্ব মেকানিজম ছিলো। শুধু কি প্রাসাদ? প্রাসাদের সামনের অংশটাও কম সুন্দর কি? একেবারে পাহাড়ের চূড়া, এখান থেকে তাকালে মনে হবে বুঝি বেহেশত বোধহয় এইরকমই সুন্দর। আমরা সেই বেহেশ্তি জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখলাম। সূর্য ডুবার পরও আমার সেখান থেকে যেতে ইচ্ছা করছিলো না। কিন্তু এখনই অন্ধকার নামবে দেখে আমরা তাড়াতাড়ি রওয়ানা দিলাম। ঢাল বেয়ে নামতে নামতে আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলাম একবার শ্বাসরুদ্ধকর প্রাসাদটাকে। আহ_____। পরে জানলাম এই প্রাসাদেই নাকি ’৪৭ সালে ভারত, পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের স্বাধীনতার সিদ্ধান্ত হয়।
আমরা নেমে গেটের কাছে আসি। তারপর ক্যাব ভাড়া করে মল রোডের দিকে রওয়ানা দেই। রাস্তা থেকে দেখতে পাই পাহাড়ের গায়ে সবুজ গাছের ভিতর থেকে বিশাল এক হনুমানের মুর্তি বের হয়ে আছে। তীব্র হলুদ লাইটে মুর্তির গায়ে রিফ্লেক্ট করে চকচকে সোনার ইফেক্ট দিচ্ছে। এত দূরের থেকে যখন এই স্কেলের মুর্তি দেখা যাচ্ছে, তখন ওটার আসল হাইটের কথা আমি ভেবেই পেলাম না কত হতে পারে। কম সেকম ১০০ ফিট বা ১০ তলা বাড়ির সমান তো হবেই, আরও বেশি হতে পারে। রাতের অন্ধকারে পাহাড়ের গায়ের ঘন জংগল থেকে গদা হাতে নিয়ে বিশাল এক সোনার হনুমানের মুর্তি যে তাকিয়ে আছে পুরা সিমলার দিকে- দেখতে এতই অবাক লাগে যে চোখ ফেরানো যায় না।
ক্যাব আমাদের মল রোডে বিশাল গাড়ির লাইনের সামনে নামিয়ে দেয়। ড্রাইভার মজুমদারকে বুঝিয়ে বলে এখানে একটা লিফট আছে। টিকেট কেটে সেই লিফটে করে উপরে উঠতে হবে। তারপর আমরা কেনাকাটা করার দোকানপাটগুলো পাবো। আমরা ১০ রুপি দিয়ে টিকেট কেটে সেই লিফটে উঠার লাইনে দাঁড়ালাম। বিশাল লাইন। একটু একটু করে আগাচ্ছে লাইন। অনেক পরে আমরা লিফটে উঠলাম। সেই লিফট একটা হাইটে উঠে নামিয়ে দিলো। তারপর অনেকটা পথ হেঁটে গিয়ে আরেকটা লিফট ধরতে হয়। সেই লিফট নামিয়ে দেয় মলে। মল আসলে কিছুই না। রাস্তার দুইপাশে সারি সারি দোকানপাট। বেশীরভাগই সোয়েটার, শাল, টুপি এই সবের দোকান। শাল আর সোয়েটারগুলো বেশ সুন্দর। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকি। আমার মোবাইলের ব্যালেন্স রিচার্জ করার দরকার হয়। আমি খুঁজতে থাকি মোবাইল রিচার্জের দোকান। পুরা রাস্তা ঘুরেও কোন রিচার্জের দোকান পাই না।
কে এফ সির দোকান দেখে আমি সেখানেই ঢুকে পড়ি রাতের খাবারের জন্য। অর্ডার দেই ৮০ রুপির ভেজ বার্গার। সেখান থেকে বের হয়ে মজুমদার আর আমি মোবাইল রিচার্জের দোকান খুঁজতে থাকি। কে এক জন বললো সামনে ‘বিল্লো ব্যাঙ্ক’ আছে সেখানে রিচার্জ পাওয়া যাবে। আমি আর মজুমদার সারা এলাকা চষে ফেললাম খুঁজতে খুঁজতে। তারপর একটা বন্ধ দোকানের সাইনবোর্ডে দেখি লিখা ‘উইলো ব্যাঙ্ক’। কি আর করা মোবাইল রিচার্জ না করেই আমরা ফেরার পথ ধরলাম। রুবাইদা আর আমি লিফটে করে নিচে নামার সময় আলাদা হয়ে যাই। সেই বিশাল লাইন ধরেই দৌড়াদৌড়ি করে নিচে নেমে আমরা রুবাইদার জন্য অপেক্ষা করি। মজুমদার এখানেও মোবাইল রিচার্জের দোকান খুঁজতে যায়। ফিরে এসে মুখ খিঁচিয়ে বলে, ‘এত্ত বড় ভোদাফোনের সাইনবোর্ড টানায় দোকান সাজায় রাখসে, কিন্তু মুখে বলে- রিচার্জ তো নেহি মিলে গা’। কি অদ্ভূত জায়গা রে বাপ, একটা ফোনের রিচার্জ পাওয়া যায় না! ওদিকে মাইক্রো ভাড়া ঠিক হয়ে যায় তাই রুবাইদাকে ফেলেই আমরা রওয়ানা দিয়ে দেই। ফোনে ওর সাথে যোগাযোগও করতে পারছিলাম না। আমি বেশ অপরাধবোধে ভুগছিলাম। পথে গাড়ি থামিয়ে মজুমদার এক দোকানে রিচার্জের জন্য নামে। সেই দোকানে রিচার্জ করা পসিবল না হলেও ২০ রুপির কার্ড ও কিনে আনে নিজের জন্য আর আমার জন্য। মাইক্রো আমাদের হোটেলে নামিয়ে দেয়। আমাদের নয়জনের ভাগে ভাড়া পড়ে ৪৫ রুপি করে।
রুমে ঢুকে আমি জানালা দিয়ে আবার সেই মনোমুগ্ধকর রাতের দৃশ্য দেখতে থাকি। কিছুক্ষন পর রুবাইদা ফেরত আসে। ওর নাকি আসতে কোন অসুবিধাই হয় নাই। সকালের জন্য জামা কাপড় ঠিক করে আমরা ঘুমানোর ব্যবস্থা করতে থাকি। মজুমদার আর মৌলি নোভাদের রুমে যায়। রুমে থাকি শুধু আমি আর রুবাইদা। আমি গরম জামাকাপড় পরেই লেপ কম্বলের নিচে ঢুকে পড়ি। উহ বাবা- কি শীঈঈঈঈঈঈঈত।