The Mighty INDIA CALLING: যে অভিযানের শুরু কোলকাতায় (পর্ব ২)

গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিচ্ছি, কিন্তু তাতে কোন কাজ হচ্ছে না, বুকের ঢিপঢিপানিটাও এতটুকু কমছে না।

কি আশ্চর্য! আমি সত্যিই তাহলে রওয়ানা হলাম…………… ৪৩ দিনের জন্য, তাও আবার আম্মুকে ছাড়া……চিন্তা করতেই ঢিপঢিপানি আবার বেড়ে গেল।

মোটামুটি শাহবাগ পর্যন্ত আমরা হৈচৈ চিৎকার করতেই লাগলাম শ্যামলি কোম্পানির সৌহার্দ নামক বিলাসবহুল বাসের ভেতরে। বাইরে রাত ১২.৩০-১.০০ টা বাজে, কিন্তু তাতে আমাদের কোন ভ্রূক্ষেপ নাই।

সবাই একটু ঠান্ডা হয়ে গেলে আমি নিজের বসার জায়গার দিকে মনোযোগ দিলাম। সবার পিছনের সিট। ৯০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেল, জানালার পাশে। সমস্যা হওয়ার কথা না। তাও ভালো আমি তো সিট পেলাম, বুবাইদা তো কোন সিট না পেয়ে সুন্দর ফ্লোরে আসন গেরে বসলো। সামনে বড় স্ক্রিনে পিকে দেখানো শুরু হলো। কিন্তু মনের মধ্যে টেনশন আর বুকের ঢিপঢিপানি নিয়ে সিনেমা না দেখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে করলাম।

মন অন্যদিকে ঘুরানোর জন্য পাশে বসা সারার সাথে রেগুলার টাইপ প্যাচাল পাড়তে শুরু করলাম। এক পর্যায়ে সারা কোন রকম সিগ্নাল না দিয়েই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গেলো। সারার কাধেঁ হেলান দিয়ে আমিও ঘুমানোর চেষ্টা করলাম যদিও জানতাম যে ঘুম আসবে না। যার জীবনে হাতে গোনা এক দুই দিন ক্লান্ত হয়ে গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়ার রেকর্ড ছাড়া আর কোন রেকর্ড নাই এইরকম দিনে তার যে ঘুম আসবে না- এই কথাটা বুঝতে পারা খুবই স্বাভাবিক। তারপরও সামনে কি দিন আসছে কোন আইডিয়া নাই। তারপরও বিশ্রাম নেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম আমি। চেষ্টাটা পুরাই বৃথা গেলো।

গভীর রাতে যখন দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে উঠলাম টের পেলাম বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। আমাদের সবাইকে জাগিয়ে বোর্ডিং পাস পূরণ করতে বলা হলো। এর আগে থেকেই রুবাইদা আমাকে আর সারাকে বাই টার্ন নিচে বসার অফার ফিরিয়ে দিয়েছিল। এবার শুভ, রিজভী আর তুষারকে দিলো। মনে মনে স্যালুট দিলাম- হ্যাটস অফ রুবাইদা।

বাসের ড্রাইভার অত্যন্ত চমৎকার করে চালিয়ে মোটামুটি ভোর ৬.২০শে বেনাপোল বর্ডারে পৌঁছিয়ে দিলো। চারপাশে ঘন কুয়াশা। ভয়ংকর শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমি নেমে খুঁজতে গেলাম বাথরুম। কিন্তু অফিসাররা আসে নাই বলে আমাদের ভিতরে ঢুকতে দিলো না। আবার কাঁপতে কাঁপতে বাসে উঠে বসলাম। কি শীতরে বাবা, সোয়েটার মানে না!

sfe
বেনাপোল পেট্রোপোল বর্ডারে হাসিখুশি দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় বৃষ্টি মজুমদার)

কিছুক্ষন পর অন্ধকার কেটে আলো ফুটতে শুরু করলো। আবার নেমে খুঁজতে গেলাম বাথরুম। এবার বাথরুম পেলাম তবে পানি নাই। পরে অনেক ভিতরে আরও একটা বাথরুম আবিষ্কার করলাম, সেটাতে আবার আলো নাই। কে জানি একজন বললো, ভালোই হলো ভিতরের ময়লা চোখে দেখা যাবে না। যাই হোক নাক চাপা দিয়ে একজন করে করে ঢুকলাম। একটু ফ্রেশ হওয়ার পর সবাইকেই বেশ ফুরফুরা মনে হলো। আমরা ওয়েটিং এ বসে দুনিয়ার গল্প করতে শুরু করলাম। সামনের দিনগুলো কেমন হবে……… ০৯ ব্যাচের সাথে পাল্লা দিয়ে আমরাও ঘুরবো………বরফের মধ্যে কেমন করে পোজ দিবো এইসব বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলি আর হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাই। আশেপাশের লোক সব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আমরা পাত্তা দেই না। উচ্চস্বরে হাসতে থাকি……………।

অবশেষে বোর্ডিং পাস জমা দিয়ে, লাইভ ফটো তুলে বের হয়ে আসি। আদিবার আব্বুর সৌজন্যে বর্ডারে আমরা এক্সট্রা খাতির যত্ন পাই। অনেকে সেখানেই টাকা ভাঙ্গিয়ে রুপি করে ফেলে, অবশ্য তার জন্য বাসে সবাইকে বসে থাকতে হয় অনেকক্ষণ। বসে থাকতে থাকতে এক সময় বিরক্তি ধরে যায়। হিমি তো মেজাজ গরম করেই ফেলে।

যাই হোক আমরা ১০ টার দিকে বর্ডার ক্রস করে পেট্রোপোলে ঢুকি। দেশ ছেড়ে বিদেশে প্রবেশ, অনেকেই উত্তেজিত বোধ করে। বাস থেকে নেমে ইন্ডিয়ার মাটিতে প্রথম পা রাখি। বেশ অদ্ভূত অনুভূতি হলো, গেটের ওপারে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ আর আমি আছি ইন্ডিয়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে! ভারি অদ্ভূত। অবশ্য খুব তাড়াতাড়ি এসব কাব্যি ছেড়ে দৌড়ালাম লাইন ধরতে। ভারতে প্রবেশের লাইন।

আশেপাশে দালালদের ছড়াছড়ি আর সব রাগি রাগি বিএসেফের লোক। দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বারবার বলতে লাগলো, ‘ লাইন সিধা কারো, লাইন সিধা কারো’। এইসব হিন্দি শুনে আমার গা জ্বালা করতে লাগলো, কিন্তু কিছু করার নাই- আগামী দেড় মাস আমাদের এইসব কথা বার্তা শুনে কাটাতে হবে। ভাঙ্গাচোড়া অফিসে ঢোকার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্তি ধরে যায়। এরমধ্যে সুহাইলা আমাকে দেখালো, দেয়ালে একটা সাইন বোর্ডে লাল রঙ দিয়ে লিখা আছে ‘ভারতে যাইবার পথ’। অত্যন্ত হাস্যকর লাগলো আমাদের কাছে। অবশেষে এক সময় আমরা পাসপোর্টে সিল লাগিয়ে আবার লাইভ ছবি তুলে বের হয়ে আসলাম। ভেতরে অনেকেই আমাদের কাছে জানতে চাইলো এত মানুষ কেন যাচ্ছি, কত দিনের জন্য যাচ্ছি, সাথে টিচার কে কে- এই সব কথা।

আমাদের মধ্যে সারাই সবার আগে ১৫ রুপি দিয়ে ব্রিটানিয়া চকোলেট ফ্লেভারর কেক কিনলো। বাসে উঠে সেটাতে ভাগ বসালাম। একসময় সবাই চলে আসলে ১১টার সময় বাস ছেড়ে দিলো। সবাই আবার একটা সম্মিলিত চিৎকার দিলাম- আমরা ফাইনালি ইন্ডিয়ায় ঢুকে পড়েছি, কি আনন্দ! কি আনন্দ!!

পথে বিএসেফ টাইপের একটা লোক উঠলো বাসে চেক করার জন্য। একমাত্র জুবায়েরকেই জিজ্ঞাসাবাদ করলো। যখন শুনলো আমরা সবাই একসাথে বেড়াতে যাচ্ছি তখন আর বেশি কিছু না করে আমাদের ছেড়ে দিলো। বাস আবার চলতে শুরু করলো। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। ঘরবাড়িগুলো ছোট ছোট, টালি দেওয়া টিনের ঘর- দেখেই বোঝা যায় এটা বাংলাদেশ নয়, অন্য কোন দেশ। আস্তে আস্তে গ্রাম ছেড়ে শহুরে ভাব শুরু হতে লাগলো। হাস্যকর সব নামের দোকানপাট, হোটেলের নাম ‘তুমি আসবে বলে’, স্কুলের নাম ‘মোনালিসা’- অদ্ভূত!

ইতোমধ্যে আমার এক পাশে সারা অন্য পাশে রুবাইদা গভীর ঘুমে অচেতন। প্রচন্ড ক্লান্তিতে আমার চোখ বুজে আসছে কিন্তু ঘুমাতে পারছি না। সারার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম। শেষ হয় না কেন এই যাত্রা?

মোটামুটি বিকাল চারটার দিকে আমরা নামলাম মার্কুইজ স্ট্রিটে শ্যামলী বাস কাউন্টারের সামনে। সেখানে মাইশার আম্মুকে দেখে খুব খুশি লাগলো- বিদেশের মাটিতে একজন দেশের মানুষ। আন্টি একটা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে নদীয়ায় এসেছিলেন। তাই আমাদের রিসিভ করতে টাইমমত এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন আগেভাগেই। ছেচল্লিশজন মানুষ প্রায় শ খানেক লাগেজ নিয়ে কোনরকমে ঢুকলাম ছোট্ট একটা ওয়েটিং রুমে। কমিটির লোকজন হোটেল ঠিক করতে গেল। জানা গেলো যে ভি আই পি কন্টিনেন্টাল নামের যে হোটেলের কথা আমরা ভিসা ফর্মে দিয়েছিলাম, সেটা শুধুই দেওয়ার জন্য দেওয়া হয়েছে। আমরা থাকবো আরও কমদামি টাইপ হোটেলে। আধা ঘন্টা পর যখন আমরা শুনলাম হোটেল পাওয়া গেছে তখন কারো গায়ে কোন শক্তি নেই। ধুঁকতে ধুঁকতে আমরা লাগেজ নিয়ে বের হলাম। হোটেলটা কয়েক কদম সামনেই পাওয়া গেছে, হোটেল প্যারাডাইজ।

হোটেলটা ঠিক হোটেল না, কেমন জানি ভুতুড়ে জায়গা। চিপা অন্ধকার এন্ট্রি দিয়ে ঢুকে সরু সিড়ি দিয়ে উঠে তিন তলায় আমি আর মজুমদার সবার আগে রুম ঠিক করলাম। রুমগুলো দেখলেই কেমন মন খারাপ হয়ে যাওয়ার মতন। ছোট্ট একটা অন্ধকার রুমে ডাবল বেড, একটা টেবিল, কাপড় ঝুলানোর জন্য দড়ি, টিমটিমে লাইট, চিকন লম্বা একটা বাথরুম। আমি, রুবাইদা, মজুমদার আর মৌলি সব মালপত্তর নিয়ে উঠলাম। সবাই ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত। একটু হাতমুখ ধুয়ে সবাই বের হয়ে পড়লাম।

প্রথমত টাকা ভাঙ্গাতে হবে, দ্বিতীয়ত সিম কিনতে হবে, তৃতীয়ত খেতে হবে কারণ আগেরদিন রাতে বাসায় শেষ খাওয়া খেয়েছিলাম। কিন্তু কিভাবে এতগুলো কাজ করবো? কোথায় যাবো? কাউকে তো চিনি না।

হোটেলের নিচেই পূর্ব পরিচিত প্রসূন ভাইয়াকে দেখে খুব ভালো লাগলো, বিদেশের মাটিতে আরেকজন পরিচিত মানুষ! ঠিক হলো ভাইয়া আমাদের সিম কিনে, খাওয়ার দোকানে যেতে সাহায্য করবেন। উর্মি, অদিতি আর চিং একটু ফ্রেশ হতে রুমে গেলো, মজুমদার এক মুচির কাছে ওর ছেঁড়া ব্যাগ সেলাই করতে দিলো, আমি আর রুবাইদা দাঁড়িয়ে রইলাম ফুটপাথে। ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে। হলুদ অ্যাম্বাস্যাডার ট্যাক্সি, টিং টিং শব্দ করে ট্রামের ছুটে চলা, হাতে টানা রিক্সা, রাস্তা ভর্তি মানুষ, মার্কুইস স্ট্রিটের দুপাশের ঝলমলে বাতি- দেখতে দেখতে মনে হলো আমি মনে হয় কোন বই কিংবা সিনেমার সিনের ভেতর ঢুকে গেছি। দৃশ্যগুলো অনেক পরিচিত কিন্তু আগে কখনো কাছ থেকে দেখা হয় নাই। আর এখন আমার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি প্রাণ চঞ্চল কোলকাতাকে! কি আশ্চর্য!

আমরা সবাই বের হলাম। মার্কুইস স্ট্রিট্রের শ্রীলেদার্সের আগে একটা চিপা গলির ভেতর ছোট্ট দোকানে লাইন ধরে আমরা সিম কিনলাম। ভোদাফোনের সিম। সব মিলিয়ে ৫৭০ রুপি খরচ পড়লো। এই টাকায় পেলাম সারা ইন্ডিয়ায় এক রেট, বাংলাদেশে প্রতি মিনিটে ২ রুপি আর সম্ভবত ২ জিবি থ্রিজি ইন্টারনেট- সবই এক মাসের জন্য। সাথে সাথে বাসায় ফোন দিয়ে কথা বললাম। কি যে ভালো লাগলো!

প্রসুন ভাইয়া আমাদের সব চিনিয়ে দিলেন মানি এক্সচেঞ্জ, মুসলমান হোটেল দাওয়াত, বাংলা ও চাইনিজ হোটেল  ভোজ, সকালের নাস্তার জন্য হোটেলের একদম কাছে আরাফাত হোটেল। অনেক চিন্তা ভাবনা করে আমরা ভোজে ঢুকলাম। শুরু হলো আমাদের ভেজ খাওয়ার মিশন। আমি আর রুবাইদা অর্ডার দিলাম ফ্রায়েড রাইস আর ভেজ মাঞ্চুরিয়ান। খাবার আসার সময়টুকুতে আমি একবার বাথরুমে ঢুঁ মেরে আসি। রেস্টুরেন্টের ইন্টেরিয়র যতটা মনোরম, বাথরুমটার ততটাই সদরঘাট অবস্থা।

একে একে আমাদের অনেকেই ভোজে এসে ঢুকতে থাকে। আমরা উঁচু গলায় হৈচৈ করতে থাকি, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি। খাবার এসে পড়লে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমাদের দেশের চাইনিজের সাথে ওদের চাইনিজের বেশ পার্থক্য। ফ্রায়েড রাইসে কামড় দিলে লবন টাইপের একটা কি জিনিস যেন কিচকিচ করে। তবে টেস্ট অন্যরকম হলেও বেশ মজা। আমার বিল আসে ৯৫ রুপি। তখন পর্যন্ত আমার টাকা ভাঙ্গানো হয় নাই। এই বিলটা মৌলি দিয়ে দেয়।

বিল মিটিয়ে আমরা পান মশলার বড় বড় মিছরিগুলি চিবাতে চিবাতে বের হয়ে আসি। মোড়ের শ্রীলেদার্সে ঢুকে পড়ি। শ্রীলেদার্স- আনন্দমেলায় কত অ্যাড দেখেছি- আজকে সত্যি সত্যি ঢুকে পড়লাম! আরে বাবা- জিনিস এত্ত সস্তা, মাথা ঘুরে গেলো। ঘুরে ঘুরে দেখলাম অনেক্ষণ ধরে। তারপর আবার ভোজে ফিরে গিয়ে হিমি আর সীমান্তকে খুঁজে বের করলাম, আমরা রওয়ানা দিলাম একসাথে মানি এক্সচেঞ্জের দিকে। কিন্তু রাত হয়ে যাওয়ায় দোকানে রেট কমিয়ে বলে। আমি আর হিমি রাগ করে অল্প কিছু টাকা ভাঙ্গাই। তারপর হেঁটে হেঁটে হোটেলের দিকে যেতে থাকি। রাতের মার্কুইস স্ট্রিটে আমরা হাঁটতে থাকি। আমি চারপাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। কি অদ্ভুত রাস্তাঘাট, অদ্ভুত মানুষজন। এইরকম রাস্তা, ট্যাক্সি, লোকজন এবং তাদের অন্যরকম আচরণ, তারা দেখতে আমারই মতন কিন্তু আবার একেবারেই আলাদা -সবকিছু মিলিয়েই আমার কাছে আশ্চর্য লাগতে থাকে।

হোটেলে ফিরে হাত পা ছড়িয়ে বসতে বসতেই সীমান্তর বার্থডে কেক কাটার সময় হয়ে যায়। ১২ টার সময় আমরা দোতলার বারান্দায় চিৎকার করে গান গেয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে সীমান্তকে উইশ করি আর সীমান্ত বার্থ ডে টুপি পড়ে হিমির আনা কেকটা কাটে। আমাদের হৈচৈয়ে পাশের রুম থেকে এক বাচ্চা তার মায়ের কোলে চেপে বের হয়ে আসে। ওকেও কেক দেওয়া হয়। আমরা হাই ভলিউমে কথা বলতেই থাকি। একটু পর কমপ্লেইন আসে যে একজন রোগি ঘুমাতে পারছে না। আমরা তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে রুমে ফেরত আসি।

মোম্বাতি সব জ্বালানো হয়েছে, এখনই কাটা হবে কেকটা! (কৃতজ্ঞতায় সারাহ তাবাসসুম)
মোম্বাতি সব জ্বালানো হয়েছে, এখনই কাটা হবে কেকটা! (কৃতজ্ঞতায় সারাহ তাবাসসুম)

আদিবা রুমে রুমে এসে পরদিনের প্ল্যান বলে যায়। ভোর ৬টার সময় ফুলের আড়ত, তারপর বেলুর মঠ, ফুড ফেস্টিভাল, ভিক্টোরিয়া, কফি হাউজ, হাওড়া ব্রিজ। আমি প্ল্যান শুনে রুমমেটদের বলে দেই সকাল ৬টার প্ল্যান আমার জন্য অসম্ভব। সারা দিন জার্নি করে রাতে মাত্র কয়েকঘন্টা ঘুমালে আমার চলবে না। তাই ঠিক হলো ওরা ওদের মতন যাবে, আমি অন্য কোন ব্যবস্থা করে নিবো।

চার জনে লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। খুব সময় লাগলো না। ঘুমিয়ে পড়লাম। ইন্ডিয়াতে প্রথম ঘুম।

The Mighty INDIA CALLING: দ্বিমিকবাসীর ভারত ভ্রমণের শুরুর কথা (পর্ব ১)

 

( প্রথমেই বলে রাখি, যাদের পরিচিত দুই একজন আর্কিটেক্ট আছেন বা যাদের বাসায় স্থাপত্যের শিক্ষার্থী আছে তারা কমবেশি সবাই জানেন যে আর্কিটেকচার জীবনে একটা ট্যুর হয়, যার নাম ‘ইন্ডিয়া ট্যুর’। যারা জানেন না তাদের জন্য বলে দিচ্ছি, সাধারনত থার্ড ইয়ার শেষে আর্কিটেকচারের শিক্ষার্থীরা পাশের দেশ ভারত ভ্রমণে যায়। এটা কোন অফিশিয়াল ট্যুর নয়। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে এই ট্যুরটা দেয়। এই ট্যুরের চলটা অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। ৮০র দশকে যারা শিক্ষার্থী ছিলেন তাদের ট্যুর শুধুমাত্র দিল্লী আগ্রাতেই সীমাবদ্ধ ছিলো। তারপর দিনে দিনে ট্যুরের পরিসর বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে এখন এই ট্যুর ষোল সতেরটা শহর জুড়ে চল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশ দিন ব্যাপী হয়ে থাকে। যে কোন শিক্ষার্থীর কাছেই এই ধরনের ট্যুর একটা স্বপ্নের মতন ব্যাপার। কারণ এইরকম বয়সে সচরাচর এত বড় ট্যুর কারও ভাগ্যেই জোটে না। আবার অনেকের জন্য এইটাই থাকে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ!

তাই দেখা যায় ফার্স্ট ইয়ার থেকেই স্থাপত্য শিক্ষার্থীর মনে নানা রকম জল্পনা কল্পনা চলতে থাকে এই ট্যুর নিয়ে। বিশেষ করে প্রতি বছর যখন একেক ব্যাচের সিনিয়ারদের কাছ থেকে ইন্ডিয়ায় যাওয়া এবং ফেরত আসার কাহিনী শোনা হয় তখন থেকেই ট্যুরের স্বপ্ন ডালপালা মেলতে থাকে। সিনিয়ারদের দেখে দেখে তার মনে স্বপ্ন বোনা হতে থাকে, ‘আমি যখন মানালি যাবো তখন বরফের মধ্যে ডুবে একটা ছবি তো তুলবোই’ ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই বলা যায় একেবারে স্থাপত্য জীবনে গোড়া থেকেই একজন শিক্ষার্থীর মোটামুটিভাবেই জীবনের একটা ‘লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য’ থাকে  ইন্ডিয়া ট্যুরে যাওয়া। আর ট্যুরে যাওয়াটাতো সোজা ব্যাপার না। সেটার জন্য সবার আগেই বিশাল আর্থিক সামর্থ্য দরকার। সেটার যোগান তো এক দিনে হবে না, তাই ট্যুরে যাওয়ার এক-দুই বছর আগে থেকেই চলতে থাকে টাকা জমানোর কাজ। প্রতিদিনের টিউশনি বা প্রোফেশনাল কাজ দ্বারা উপার্জিত অর্থ থেকে একটা বড় অংশ আলাদা করে রাখতে হয় ইন্ডিয়া ট্যুরের জন্য। তাই কোন না কোনভাবে একজন শিক্ষার্থী ট্যুরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কোনভাবেই স্মৃতি থেকে সরিয়ে রাখতে পারে না ‘ইন্ডিয়া ট্যুর’এর ব্যাপারটা!)

সেই ২০১৪ সালের কথা। থার্ড ইয়ারে ক্লাস শুরু হওয়ার পরপরই আমরা বলাবলি করতাম, ‘আমরা না এবার ইন্ডিয়ায় যাবো?’ । থ্রি টুতে একদিন আমাদের মিটিং হলো। সেদিন শুভ জানিয়ে দিলো, ‘যাবো না মানে, অবশ্যই যাবো!’। সেই থেকে আমাদের প্রিপারেশন শুরু। প্রথমে শুরু হলো টাকা জমানো। অ্যাডমিশনের কোচিং করিয়ে সবাই রোজগার জমিয়ে রাখতে লাগলো। তবে সেটা আসলে কিছুই না। যে যেভাবে পারলো টাকা জমাতে লাগলো। কথায় কথায় সবার টাকা বাঁচানোর ফন্দি, ‘বুঝলি সামনে ট্যুর আছে, এখন টাকা খরচ করতে পারবো না’। এরই মধ্যে এক ফাঁক দিয়ে আমাদের কমিটি গঠন হয়ে গেলো।

এর সাথে প্যারালালি আসলো পাসপোর্টের কাজ। যাদের যাদের পাসপোর্ট নাই তারা ফাঁকে ফোকড়ে ছুটলো পাসপোর্ট অফিসে। ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই আমরা একবার পরীক্ষা এগিয়ে নেওয়ার জন্য চেষ্টা করেছিলাম যাতে পরীক্ষার পরের ছুটিটা লম্বা হয়। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যার্থ গেলো। রুটিন অনুযায়ী পরীক্ষার আগে আমরা দেড়মাসেরও বেশি সময় পাবো, কিন্তু পরীক্ষার পর পাবো কাটায় কাটায় এক মাসের মত।

ক্লাস শেষ হতেই নভেম্বর মাসে পাসপোর্ট রেডি হওয়ার পাশাপাশি ভিসার চেষ্টা শুরু হলো। প্রথমে আমরা নিয়ম অনুযায়ী অনলাইনে অ্যাপ্লাই করলাম। কাজ হলো না। তারপর ধরা হলো দালাল। দালাল ধরার পর প্রতিদিন তিন চারজনের ইন্টারভিউয়ের ডেট পড়তে লাগলো। এভাবেই ধীরে ধীরে ভিসা হচ্ছিলো। ভিসার পুরো ব্যাপারটা অবনী নিদারুণ ধৈর্য্য নিয়ে সামাল দিচ্ছিলো।

ভিসা হতে তো সময় লাগবে। কিন্তু তাতে কি, কেনাকাটা আছে না? সবাই চলে গেলাম ঢাকা কলেজ আর বংগ বাজার। শীতের কাপড়চোপড়, মোটা প্যান্ট, হাতমোজা, পা মোজা, মাফলার, উলের টুপি, ইনার- আরও কত কি কিনলাম! দোকানে দোকানে তখন আমাদের লোকজনকে দেখা যায়। তখন একজন আরেকজনের সাথে সলাপরামর্শ করে কেনাকাটা করি। আমি বাটা থেকে ওয়াটারপ্রুফ কেডস কিনলাম। তারপর নিউমার্কেট থেকে কিনলাম হ্যান্ড ব্যাগ আর ট্রলি ব্যাগ বা মেইন লাগেজ।

এইসব কেনাকাটা করতে করতে তিনজন ছাড়া বাকি সবার ভিসা মোটামুটি হয়ে গেলো। জানুয়ারি মাসে আমাদের পরীক্ষার মধ্যেই একদিন ডেট পড়লো পাসপোর্ট জমা দেওয়ার। ঠিক তার আগের দিন নাটকীয়ভাবে রিন্তু ট্যুরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো! নাটকীয় বলছি এই জন্য কারণ দীর্ঘদিন ধরেই রিন্তু বলে আসছিলো যে ও ট্যুরে যাবে না। আমরা অনেক হাতে পায়ে ধরার পরেও ও কিছুতেই রাজী হচ্ছিলো না। তাই হঠাৎ করে যেদিন শুনলাম রিন্তু ইন্ডিয়া যাবে- আমরা আমাদের মন নেচে উঠলো। যেদিন আমরা সবাই আসলাম কমিটির হাতে পাসপোর্ট জমা দিতে, সেদিন রিন্তু নিশাতকে সাথে নিয়ে গেলো পাসপোর্ট অফিসে- ইমার্জেন্সি পাসপোর্ট করার জন্য (ওর বুকের পাটা দেখে আমি মনে মনে হতবাক হয়ে গেলাম, কী সাহস!)। তবে আল্লাহর রহমতে একেবারে শেষ মুহুর্তে রিন্তুসহ বাকি চারজনের ভিসা করানো সম্ভব হয়েছিলো।

এর মধ্যে দফায় দফায় প্ল্যান হতে লাগলো। আমরা কোন রুটে যাবো, কোথায় কয়দিন থাকবো এইসব নিয়ে আদিবা দিনরাত লিস্ট বানাতে লাগলো। একদিন মিটিং ডেকে সবাইকে ট্যুরের আউটলাইনটা বুঝিয়ে দেওয়া হলো। একেবারে শেষ মুহুর্তে লাগলো এক গণ্ডগোল।

দেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে আমাদের একটা পরীক্ষা সাত দিন পিছিয়ে দেওয়া হলো। আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমাদের পাশাপাশি জিরো নাইন ব্যাচের সবাই মরিয়া হয়ে উঠলো। ওনাদেরও একই সময়ে ইন্ডিয়া ট্যুরে যাওয়ার কথা।  নোটিশ আসার পরদিনই আমরা আর জিরো নাইন ব্যাচের সবাই গিয়ে ডিপার্টমেন্টের হেডকে জানালাম আমাদের সমস্যার কথা। আমরা দুই ব্যাচ অনুরোধ করলাম যেন আমাদের পরীক্ষাটা এগিয়ে নেওয়া হয়। হেড, ডিন, ডি এস ডাব্লিউর মধ্যে মিটিং বসলো। মিটিং শেষে ওনারা জানালেন পরীক্ষাটা এগিয়ে নেওয়া হয়েছে শুধু আমাদের দুই ব্যাচের জন্য। আমরা হাঁফ ছাড়লাম, যাক বাবা বাঁচা গেলো।

ঐদিকে কাস্টমসের অফিস টাইমিংয়ের  সাথে মিল রেখে রওয়ানা দিতে গেলে শেষ পরীক্ষার পরদিন রওয়ানা দেওয়া সুবিধাজনক না। ওদিকে জিরো নাইন ব্যাচও শেষ পরীক্ষা দিয়ে রাতেই রওয়ানা হচ্ছে। তাই সিদ্ধান্ত হলো আমরাও পরীক্ষা দিয়ে রাতের বেলাতেই রওয়ানা দিবো। সিদ্ধান্তটা নিজের কাছেই কেমন যেন লাগলো, তাই বলে পরীক্ষা দিয়ে রাতের বেলায়ই? ব্যাপারটা একটু বেশি বেপরোয়া হয়ে যায় না?

এমনিতেও পরীক্ষার গ্যাপ কম। তারউপর আবার একটা পরীক্ষা এগিয়ে এনেছি, মাঝে সময় খুব কম। এরমধ্যে আমাদের ব্যাগ গুছানো চলতে লাগলো। জানুয়ারির ষোল তারিখ আমরা পরীক্ষার হলে গেলাম আরবান পরীক্ষা দিতে। সারা বুয়েট ফাঁকা, শুধু আমরা কয়েকজন একটা রুমে বসে পরীক্ষা দিলাম। দুপুর দুইটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত পরীক্ষা চললো। খাতা জমা দিয়ে এক মুহূর্তও কেউ সময় নষ্ট করলাম না। সবাই বাসার দিকে দৌড় লাগালাম। আমাদের বলে দেওয়া হলো রাত দশটার মধ্যে প্লিন্থে উপস্থিত থাকতে।

আমি বাসায় ফেরার পথে একটা সানগ্লাস কিনলাম। বাসায় পৌঁছে শেষ মুহূর্তের জিনিসপত্র ভরলাম ব্যাগে। সবাই নানা রকম উপদেশ দিতে লাগলো যা বেশির ভাগই অর্থহীন। কিন্তু আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম সব। পেটের মধ্যে কেমন যেন পাক খেয়ে উঠতে লাগলো আর এক অজানা আশংকায় বুকের ভেতর গুরগুর করতে লাগলো। রাত আটটা বাজতেই এশার নামাজ পড়ে, ভাত খেয়ে রেডি হয়ে নিলাম। নয়টার দিকেই বাসা থেকে রওয়ানা দিলাম বুয়েটের উদ্দেশ্যে।

cc
শীতের রাতের জমজমাট প্লিন্থ ১৬ই জানুয়ারি, ২০১৫ (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম)

দশটা বাজার অনেক আগেই আমি পৌঁছে গেলাম ডিপার্টমেন্টে। তখনও তেমন কোন লোকজন আসে নাই। ধীরে ধীরে একজন একজন করে আসতে লাগলো। প্রায় সবার সাথেই বাবা-মা আছে। প্রথমবারের মত আমাদের আব্বু আম্মুদের পদচারণায় শীতের রাতের প্লিন্থ গমগম করে উঠলো। ওদিকে বাস আসে নাই, কখন আসবে তার খবরও নাই। তবে আমাদের খারাপ লাগছিলো না। সিনিয়ররা এসে নানারকম উপদেশ দিয়ে গেলো। জুনিয়ররা আসলো বিদায় দিতে। আমাদের জন্য টি শার্ট আসলো, ব্যাজও আসলো, বড় ব্যানারও টানানো হলো লুভরে কিন্তু বাসের আর পাত্তা পাওয়া গেলো না। কমিটির লোকজনকে সবাই বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো। ওরাও বাসের সাথে যোগাযোগ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে লাগলো। ওদিকে রাত এগারোটা-সাড়ে এগারোটা বেজে যাচ্ছে। আমার আম্মুর কপালে চিন্তা দেখা দিলো, ‘মেয়ে এই কাদের সাথে যাচ্ছে? এরা তো বাসই ঠিক করতে পারে না। দেশের মধ্যে একটা বাস কখন আসবে বলতে পারে না- এরা ইন্ডিয়া গিয়ে কি করবে?’ । এই সব চিন্তা করে আমার আম্মু হতাশ দৃষ্টিতে কমিটির লোকজনদের দিকে তাকাতে লাগলো।

রাত বারোটার দিকে বাস এসে হাজির হয়। আমরা আমাদের ব্যাগট্যাগ নিয়ে দৌড়িয়ে ছুটে যাই বাসের দিকে। লাগেজ কম্পার্টমেন্টে আমাদের লাগেজ উঠাতে দেই। যতক্ষণ না লাগেজ ভিতরে ঢুকানো হচ্ছে ততক্ষণ নিচে দাঁড়িয়ে থাকি। খুব তাড়াতাড়ি আমাদের লাগেজ ওঠানো হয়ে যায়। সাথে সাথে আমরাও উঠে পড়ি বাসে। জানালা দিয়ে আম্মুর দিকে হাত নেড়ে বিদায় জানাই। ঠিক সাড়ে বারোটার সময় আমাদের বাস যাত্রা শুরু করে। তারপর-

 

তারপর?

তারপর হলো শুরু-

৪৬ জন শিক্ষার্থীর জীবনে ঘটে যাওয়া সোনার কালিতে লেখা এক ঐতিহাসিক মহাকাব্য যার নাম ‘ইন্ডিয়া কলিং’- এর ভূমিকা রচিত হলো মাত্র। ৪৩ দিন, ১৫টা শহর, অচেনা দেশ, টানটান অ্যাডভেঞ্চার , নতুন নতুন অভিজ্ঞতা আর পদে পদে অনিশ্চয়তায় ভরা এক মহা কাব্যিক উপাখ্যানের শুরু হলো এখান থেকেই………