ক্লাশ এইটে থাকতে একটা প্যারাগ্রাফ পড়েছিলাম, ‘Summer is back in the wind’। ক্যালেন্ডারের দিকে না তাকিয়ে কিভাবে বোঝা যায় যে প্রকৃতিতে গ্রীষ্মকাল শুরু হচ্ছে সেইটা নানা কসরত করে ইংরেজী সাহিত্যে প্রকাশ করতে হত। সেই প্যারাগ্রাফের মত আজ বলতে ইচ্ছে করছে ‘Holy Ramadan is back in the wind’। আমাদের জীবনে এক বছর পরে আবারও রমজান মাস ফিরে এসেছে, ক্যালেন্ডারের সাহায্য ছাড়াই সহজে ব্যপারটা টের পাওয়া যায়।
রাস্তার মোড়ে মোড়ে যখন ছোট টেবিলে পলিথিনের ঠোঙ্গায় যখন মুড়ি বিক্রি করতে দেখা যায় তখনই বুঝতে হয় রমজান এসে গেছে। রমজান মাসে খাবারের দোকানগুলো সেজে ওঠে বাহারি সাজে। দোকানের সীমানা ছাড়িয়ে সামনের ফুটপাথে রঙ বেরংয়ের ব্যানার টানিয়ে লিখা হয় ‘………শাহী ইফতারের বিশাল আয়োজন’। অনেকে আবার কম্পিটিশনে নেমে যায় ১০০ পদ ও ১৫০ পদের ইফতারি তৈরি করতে। পুরানো ঢাকার অবস্থা তো আরও রমরমা। কম বেশি প্রতিদিন পত্রিকায় একটা করে ছবি আসে সাদা সাদা টুপি পড়া হাজারও কালো কালো মাথা গিজগিজ করছে ছোট্ট একটা জায়গাকে কেন্দ্র করে। নিচের ক্যাপশন দেখে বুঝে নিতে হয় এটা পুরানো ঢাকার ইফতারের দোকানের ছবি।
শুধু কি খাবারের দোকান? ফলের দোকানেও চলে বাহারি আয়োজন। দোকানের ফল দোকানের সীমানা ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে এমন আকর্ষণীয় ভাবে যে চলতে ফিরতে একবার না একবার ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখতেই হবে। অনেকে আবার ফলের গিফট বক্স তৈরি করেন। এটা তেমন কিছুই না, একটা বাঁশের ঝুড়িতে নানা পদের ফল আর রুহ আফজা সাজিয়ে সেলোফেন পেপার দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়। কোন বাসায় ইফতার পার্টিতে যাওয়ার সময় অনেকেই ফলের দোকান থেকে এরকম গিফট বক্স কিনে নেন। আর অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে রোজায় ফলের বেচা বিক্রি হয় দ্বিগুন। তাই ফলওয়ালাদের দন্ত বিকশিত হাসি দেখেই বোঝা যায় রমজান এসেছে।
রোজায় মার্কেটগুলো সাজানো হয় রঙ্গিন কাপড় দিয়ে। রোজা শুরুর সাথে সাথে সকল জিনিসের ট্যাগে পুরানো দাম মুছে ১০ থেকে ২০০০ টাকা বাড়িয়ে লিখা হয়। এরপরও মানুষের কেনাকাটায় কোন থামাথামি নাই। ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় সামলাতে সামলাতে বিক্রেতাদের দম ফেলার সুযোগ থাকে না। আর গাউসিয়া, নিউ মার্কেট, চাঁদনী চক এলাকার তো কথাই নেই। ওইসব মার্কেটে যাওয়া তো দূরের কথা, ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার কথা শুনলেই অনেকের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে।
রোজার সময় আজকাল স্কুল কলেজ সব সরকারী নির্দেশেই বন্ধ থাকে। এটা অবশ্যই ভালো দিক। তবে পত্রিকায় দুজন প্রভাষককে দেখলাম রোজার ছুটির চরম বিরোধিতা করে চিঠি পাঠিয়েছে। তাদের মতে বাচ্চাদের পড়াশুনার ‘ক্ষতি‘ বন্ধ করার জন্য অবিলম্বে রোজার ছুটি বাতিল করা উচিত। আমি দুবছর আগে স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলাম। আমার দশ বছর স্কুল জীবন এবং দেড় বছর কলেজ জীবনে কখনই মনে হয় নাই যে স্কুল বন্ধ হওয়ার কারণে পড়াশুনার বিন্দুমাত্র ‘ক্ষতি‘ হয়েছে। এবং আমার বিশ্বাস যদি দুই বছরে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যাবস্থায় ‘আমূল‘ পরিবর্তন না হয়ে থাকে তবে এখনকার সকল শিক্ষার্থী আমার সাথে এই বিষয়ে একমত হবে। আর মুসলিম দেশে যদি ক্ষুদে রোজাদারদের যদি রোজা রেখে স্কুলে দৌড়াতে হয় তবে এরচাইতে বড় লজ্জা বোধহয় আর কিছুতেই হবে না।
এ তো গেলো শুধু বাইরের কথা। এবার আসি ঘরের কথায়। দুপুর হলেই মায়েদের রান্নাঘরের কাজ শুরু হয়ে যায়। আর বিকেল হলে তো পিঁয়াজু, বেগুনি, সবজি বড়া ভাজার গন্ধে পেটে খিদে গুরগুরিয়ে ওঠে। ইফতারের সময় যত ঘনিয়ে আসে, শুরু হয় ঘরের সবার ব্যস্ততা। ইফতারের টেবিল সাজানোর কাজটা ঘরের সব সদস্যরা মিলেই করে। কেউ শসা কাটে, কেঊ ফল কাটে, কেউ শরবত বানায়, কেউ খেজুর পরিষ্কার করে – এভাবে হাতে হাতে কাজ করতে করতেই আযান পড়ে যায়।
রমযানের অন্যতম শিক্ষা সংযম। আর সংযমের সবচাইতে বড় বাধা টেলিভিশন। তাই রোজায় ঘরে ঘরে টেলিভিশন দেখার হার কমে যায়। কমে যায় হাই ভলিউমে গান ছাড়ার প্রবনতা। হিপহপ গানের বদলে অনেক জায়গা থেকে ভেসে আসে কুরআন তেলওয়াত। ঘরে ঘরে কুরআন তেলোয়াতের হারও বেড়ে যায়। অনেকেই চায় সাতাশ রোজা অর্থাৎ শবে কদরের আগে কুরআন খতম করতে। ছেলেরা জামাআতে তারাবীহ পড়ার সময়ই এক খতম করে এক ঢিলে দুই পাখি মেরে ফেলে। আবার ঘরে বসেও অনেকে আরেক খতম দেয়।
রমজান মাস রহমতের মাস, বরকতের মাস, সংযমের মাস। সারা বছরের সকল পাপের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাওয়ার সর্বোত্তম সময় এই রমজান মাস। যে রমজান মাস পেয়েও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলো না তার চেয়ে দুর্ভাগ্যবান বোধহয় আর কেউ নেই। আমাদের জীবনে আরও একটি রমজান মাস এসেছে। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সামর্থ দান করুন যাতে আমরা সঠিকভাবে মাসটিকে কাজে লাগাতে পারি – এই প্রার্থনা হোক সকল মুসলমানের।