দেশে পৌঁছার পর পটোল ভাজি, মাছের তরকারি আর ডাল খেতে কি মজা লাগতো! দীর্ঘদিন ধরে বাইরের খাবার খেতে খেতে বাসার খাবার মুখে দিতেই অন্যরকম শান্তি পেতে লাগলাম। প্রথম কয়েকদিন বেঘোরে বিছানায় পড়ে ঘুমাতে লাগলাম। চোখ বুজলেই দেখতে পেতাম সাদা বরফের মধ্যে গামবুট পরে হাঁটছি আর পায়ের নিচে সাদা বরফের স্তুপের মধ্যে জুতার ছাপ পড়ে যাচ্ছে। কতবার যে ঘুমের ঘোরে দেখেছি এই দৃশ্য! অনেক সময় হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যেত, ভাবতাম আরে, পা সোজা করতে পারছি কেমন করে? পায়ের কাছের দেওয়ালটা কই চলে গেলো? পরক্ষণেই মনে পড়তো, আমি তো কলকাতায় নাই, আছি আমার নিজের দেশে নিজের ঘরে। এইভাবে পার হলো কত দিনের পর দিন!
প্রথম প্রথম দ্বিমিকবাসীর সাথে দেখা হলেই খালি ইন্ডিয়া ট্যুরের কথাই আসতো ঘুরে ফিরে। ক্লাস শুরু করার পর থেকে সেটা আরও বড় পরিসরে হতে লাগলো। সারা ফোর্থ ইয়ারে খুব কমই দিন গেছে যে আমরা ইন্ডিয়া ট্যুরের কোন কথা আলোচনা করছি না। এমনকি এখনও আমরা দল বেঁধে গল্প করছি আর ইন্ডিয়া ট্যুরের কথা উঠে আসে না, এমনটা কখনই হয় না। কোন না কোনভাবে সেই দিনগুলোর কথা আসবেই…
আমার ব্যাক্তিগত জীবনেও অনেক পরিবর্তন এসেছে এই ট্যুরের পর। যেখানে যার সাথেই দেখা হয়, কায়দা করে জানিয়ে দেই আমার তেতাল্লিশদিন ব্যাপী ভ্রমনের কথা। সবাই তখন চোখ বড় বড় করে তাকায়। আর গত দু বছর ধরে বাসার লোকজন ট্যুরের কথা শুনতে শুনতে ত্যাক্তবিরক্ত। একমাত্র আম্মু ছাড়া এখন ভদ্রতা করেও কেউ আর শুনতে চায় না। এছাড়া সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো আমার নিজের উপর আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে বহুগুণ। যেকোন পরিবেশে খাপ খাওয়ানো, বিভিন্ন পরিস্থিতি সামলে নেওয়া, বিভিন্ন মানুষের সাথে মেশা, অস্বাভাবিক শারীরিক পরিশ্রম করা, অচেনা জায়গায় চলাফেরার কায়দা রপ্ত করা, দলগত সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া, দিনের পর দিন সত্যিকারের ‘টিম ওয়ার্ক’ করাসহ আরও নানা রকম অভিজ্ঞতা হয়েছিলো বলেই নিজেকে আমি চিনতে পেরেছি নতুন রূপে (মাঝে মাঝে নিজেই অবাক হয়ে যাই, যখন ভাবি এত কিছু তখন কেমন করে করেছি!) । আমার মাঝে যে এত প্রতিভা সুপ্ত হয়ে লুকিয়ে ছিলো সে কথা আমি জানতে পারলামই এই ট্যুরে গিয়ে!
লাগেজ ভর্তি শীতের পোশাক, পিঠে ব্যাকপ্যাক, কাঁধে ডিএসএলআর, হৃদয়ে তুমুল অ্যাডভেঞ্চারের নেশা আর মনে বরফ, মরুভূমি, পাহাড়, গুহা আর সমুদ্র যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আমরা ৪৬ জন সম বয়সী পাড়ি জমিয়েছিলাম ভিনদেশের উদ্দেশ্যে। অনেক রকম আশংকা, অনেক অনিশ্চয়তা, টাকা পয়সার টানাটানি এই রকম নানা রকম সমস্যাকে সাথে নিয়েই সত্যিকারের জীবনটাকে দেখতে পেয়েছি খুব কাছ থেকে এবং সেই দেখা কমানোর ব্যাপারে এতটুকু ছাড় দিতে রাজী ছিলাম না কেউই। সামর্থের মধ্যে যতটুকু পাওয়া সম্ভব তার সবটুকুই পেয়েছি এবং আল্লাহর রহমতে জীবনের সবচেয়ে সেরা সময়টা পার করেছি এই তেতাল্লিশদিনে। নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার সেই টাটকা অভিজ্ঞতাগুলো সবার স্মৃতির মানসপটে পাকাপাকিভাবে ছাপ ফেলে দিয়েছে। সেই ছাপ মলিন হলেও কিছুতেই মুছে যাবার নয়, বরং জীবনের নানা রকম পরিস্থিতি বারবার মনে করিয়ে দেয় সেই স্বপ্নময়ী দিনগুলোর কথা।
‘Go bag packing in your 20’s. It can be life changing’
উদার প্রকৃতি, রাজসিক স্থাপত্য, জীবন ঘনিষ্ট রীতিনীতি আর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে গড়ে ওঠা হাজারও স্মৃতি এই ছেচল্লিশজন মানুষ বয়ে বেড়াবে বাকি জীবন………
আমি আপনার একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত। এভাবে আরও লিখতে থাকুন ।অসাধারণ!
ধন্যবাদ, খান আলি ভাই! ভালো থাকুন!!