The Mighty INDIA CALLING: যত কান্ড কোলকাতাতে (পর্ব ৩)

ঘুমের ঘোরেই টের পেলাম মজুমদার, মৌলি, রুবাইদা রেডি হচ্ছে বের হওয়ার জন্য। ওরা বের হওয়ার সময় আমাকে ডেকে দিলো। আমি কোনমতে টলতে টলতে উঠে দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। তারপর বিছানায় উঠে আবার ঘুম।

সাড়ে নয়টার দিকে দরজায় নক পড়লো, কোনমতে ঘুম থেকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে?’ টের পেলাম নিশাত আর তমা। ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে দিলাম। ওরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো ‘কি রে? বের হবি না? তোর রুমের লোকজন সব কই?’ আমি চোখ ডলতে ডলতে বললাম যে ওরা চলে গেছে, আমি ঘুমাচ্ছিলাম। ওরা বলল, ‘তুই কি একা থাকবি নাকি? পনের মিনিটের মধ্যে রেডি হ। আমরা বের হবো।’

ওরা চলে গেলে আমি চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ঘুম তাড়িয়ে ঝটপট রেডি হয়ে গেলাম। ঠিকঠিক পনের বিশ মিনিট পর আমরা বের হয়ে পড়লাম। ঢুকলাম আরাফাত হোটেলে। আমি, নিশাত, তমা, রিন্তু, পৃথ্বী পাঁচজনে মিলে অর্ডার দিলাম নান রুটি আর ডাল দিয়ে খাসী মাংস। হোটেলটা মুসলিম। সুতরাং আমরা তৃপ্তি করে খেলাম। আমার বিল আসলো ৩০ রুপি।

রফ
কোলকাতার পথেঘাটে (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম)

এখান থেকে বের হয়ে ট্রাম লাইন ধরে এগিয়ে একটা চায়ের দোকানে থেমে ওরা মাটির ভাঁড়ে করে চা খেলো। চা খেতে খেতে আমরা দোকানের মানুষগুলোর সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে আমাদের বেশ কদর করলো। ওনারা আমাদের সাজেশন দিলো হেঁটে হেঁটে কলকাতা শহর ঘোরার জন্য। হাঁটার জন্য নাকি কলকাতা খুব চমৎকার। ট্যাক্সি বা রিক্সা ভাড়া করতে গেলেই নাকি গলা কেটে দিবে। ইউনিফর্ম ছাড়া কোন মানুষের কাছে কোন কিছু জিজ্ঞেস না করতে বললো। আরও বললো, ভিক্টোরিয়া, ভারত মিউজিয়াম এগুলো নাকি খুবই কাছে।

উনাদের কাছ থেকে উপদেশ পেয়ে আমরা হাঁটা ধরলাম। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে পার্ক স্ট্রিটের দিকে হাঁটতে লাগলাম। কি চমৎকার নিরিবিলি রাস্তা, পুরানো দেয়াল, পুরানো আমলের বাড়ি, নতুন ডিজাইনের বাড়ি, চওড়া ফুটপাথ। হাঁটতে হাঁটতে আমরা মেইন রোডে উঠে পড়লাম। সেখানে বড় একটা ফ্লাই ওভার। আমরা তার নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। রাস্তার ঐ পাশে দেখা যাচ্ছে ডগ শো টাইপের কিছু একটা হচ্ছে। ঠিক হলো প্রথমে ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, তারপর দরকার হলে ডগ শো। আবার রাস্তা ক্রস করে আগের পাশে এসে হাঁটা ধরলাম। ফুটপাতে কি চমৎকার সব জিনিসপত্র! লেবুর শরবত অর্থাৎ নিম্বু পানি, টি শার্ট, বাচ্চাদের জামা, জুয়েলারি, ক্যালেন্ডার, পোস্টার, পুরানো কয়েন, শো পিস আরও কত কি! নিশাত আর তমা দুজনে দুটো পিতলের বালা কিনলো। একটা ৬০ অন্যটা ৪০ রুপি দিয়ে। সেইটা পড়েই ওরা হাঁটতে লাগলো। আমরা জাদুঘরে পৌছে গেলাম। রিন্তু গেলো টিকেট কাটতে। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এসে বললো লোকটা আমাদের আইডি দেখাতে বলেছে অথবা বিদেশি টিকেট কাটতে বলেছে। হিজাব পড়া রিন্তুকে সে কলকাতার মানুষ বলে বিশ্বাস করে নাই। সাধারণ টিকেট ২০ রুপি আর বিদেশি টিকেট ২০০-৩০০ রুপির মত। এত টাকা দিয়ে বিদেশি টিকেট কাটার কোন মানেই হয় না। ইন্ডিয়ার প্রথম টিকেট কাটতে গিয়েই ধরা খেয়ে আমরা বেশ হতাশ হলাম।

মিউজিয়ামে ঢুকতে না পারি তো কি হয়েছে? ডগ শো তো আছে। আবার রাস্তা পার হয়ে ডগ শোতে গেলাম। এবার পৃথ্বী ১০ রুপির টিকেট কেটে দিলো। ভেতরে ঢুকলাম। খোলা আকাশের নিচে নানা রকমের কুকুর নিয়ে বড়লোক মানুষজন এসেছে। হাউন্ড, অ্যালসেশীয়ান, ল্যাব্রাডর, বুল ডগ, পিকনিজ কি নেই এখানে। ইয়া বিশাল দৈত্যের সমান কুকুর থেকে শুরু করে ছোট্ট নিরিহ কুইকুই করছে এমন কুকুরও আছে। একটা কুকুর দেখলাম একদম মেরু অঞ্চলের নেকড়ে বাঘের মতন। মালিকরা তাদের কুকুরগুলোকে সাজগোজ করাচ্ছে। দাঁত মাজিয়ে দিচ্ছে, ক্রিম লাগাচ্ছে, স্প্রে দিচ্ছে- কুকুরগুলো আরাম করে সে সব উপভোগ করছে। কুকুর ছাড়াও আছে কুকুরের জন্য দোকান। কুকুরের খাবার, কসমেটিক্স, খেলনা, ঘরবাড়ি, বিছানাপত্র, ওষুধপাতি – এই সব জিনিস্পাতি নিয়ে একেকটা স্টল বসেছে। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কুকুরের সাথে পোজ মেরে ছবি তুললাম। তারপর টায়ার্ড হয়ে বিশ্রাম নিতে বসলাম।

আমি এক ফাঁকে বাথরুমটা দেখে আসতে চাইলাম। সবাই বললো আগে তুই যা তারপর আমরা যাবো। খুঁজে খুঁজে লেডিস বাথরুমটা বের করলাম। শামিয়ানার ভেতর কাপড়ের পর্দা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। বাথরুম দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। খোলা আকাশের নিচে একটা কাপড়ের পার্টিশানের দুই পাশে মাটির উপর স্রেফ আলগা দুইটা হাই কমোড বসানো। কমোডের জিনিসগুলো যাবার কোন যায়গা নাই। কিন্তু সেটা নিয়ে কারও মাথাব্যাথা আছে বলে মনে হলো না। এর মাঝেই বড়লোক মানুষজন সব বাথরুম ব্যবহার করছে। পানির কোন ব্যবস্থা নাই, একটা দরজা পর্যন্ত নাই, দুর্গন্ধে আমার বমি আসার উপক্রম হলো। আমি দৌড়ে বের হয়ে আসলাম। ওদের সবাইকে সাবধান করে দিলাম, ভুলেও যেন বাথরুমের দিকে না যায়। শুনে ওরাও ভয় পেলো, সব জায়গায় এরকম বাথরুম থাকলে তো সমস্যা। আমরা এখান থেকে বের হওয়ার জন্য উঠলাম। গেটে এক অসম্ভব কিউট বাচ্চা মেয়েকে তার মায়ের কোলে লেপ্টে থাকতে দেখলাম। আমরা সবাই সেই বাচ্চা, তার পিচ্চি ভাই আর মায়ের সাথে ছবি তুললাম। বের হয়ে দারোয়ানের সাথে কথা বলে আমরা সামনে যেন কি একটা আছে শুনে হাঁটতে লাগলাম।

কিছুদূর আগানোর পরেই আমরা রাস্তার মাঝে একটা বিশাল পার্ক টাইপের জায়গায় গাছ দিয়ে বানানো ময়ুর দেখলাম। ভেতরে ঢুকতে হলে অনেক দূর হাঁটতে হবে দেখে আর ভিতরে ঢুকলাম না। বাইরে দিয়েই দেখেই আবার হাঁটতে লাগলাম। কোলকাতার এই জায়গাটা অনেকটা আমাদের বনানী এলাকার মতন। রাস্তার একপাশে উঁচু উঁচু সব কমার্শিয়াল বিল্ডিং, তবে দুই বিল্ডিংয়ের মাঝে অনেক গ্যাপ। রাস্তার অন্য পাশে পার্ক, গার্ডেন, ময়দান টাইপের জায়গা। তার সাথে চওড়া ফুটপাথ, চওড়া বুলেভার্ড টাইপের জায়গা। আবার ফুটপাথের সাথে পার্কের ভিজুয়াল কানেকশন খুবই ভালো। এক পাশে পার্ক, চওড়া ফুটপাথ, একটু পর পর বিশ্রাম নেবার জায়গা আর মেট্রো ধরার জন্য আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবার সিঁড়ি, ফাঁকা রাস্তা দিয়ে ছুটে চলছে রংচঙ্গে বাস- আমরা হাঁটাটা খুবই উপভোগ করছিলাম। সুন্দর আরবান প্ল্যানিং নগরবাসীর মনে কি রকম প্রভাব ফেলে তা হাতে কলমে বুঝতে পারছিলাম।

একসময় আমরা ইলিয়ট পার্ক নামের একটা পার্ক পেলাম। সেখানে ঢুকে ঘুরলাম, ফিরলাম। চমৎকার জায়গা। কোন আজেবাজে লোক নাই আর মেইন্ট্যানেন্স খুবই ভালো। আমরা অনেক ছবি তুললাম। বের হয়ে এসে জানতে পারলাম এটা টাটা কোম্পানি সরকারকে উপহার দিয়েছে। কি উপহার! কিছুদূর গিয়ে আমরা বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম পেলাম। কিন্তু শোর সময় আমাদের সাথে না মিলার কারনে আমরা বাইরে থেকেই ছবি তুললাম। এইটাও নাকি বিড়লা কোম্পানি সরকারকে উপহার দিয়েছে! প্ল্যানেটোরিয়ামের গেট থেকে বের হয়ে একটু এগিয়েই দেখলাম নানা রকম ফল কেটে বিক্রি করছে একজন। পেপে, তরমুজ, শশা, পেয়ারা, আপেল ছোট ছোট কিউব করে কাটা, উপরে বিট লবন টাইপ কিছু একটা ছিটিয়ে ওয়ান টাইম ইউজ কাগজের প্লেটে সাজিয়ে রেখেছে। আমি আর নিশাত ২০ রুপি দিয়ে একটা প্লেট কিনে ভাগ করে খেলাম। বেশ ভালো লাগলো।

খানিক দূর আগাতেই গুগল ম্যাপ দেখে চিৎকার করে উঠলাম আমি, গড়ের মাঠ! গড়ের মাঠ!! সামনে তাকিয়ে দেখলাম- এই তা হলে সেই গড়ের মাঠ? শুধু মাঠ বললে ভুল হবে, এ তো এক ময়দান। বি-শা-ল বড় খালি জায়গা। তাতে কত মানুষ! কেউ খেলছে, কয়েকটা দল ফুটবল প্র্যাক্টিস করছে, এখানে ওখানে ছাগল চড়ে বেড়াচ্ছে, অনেক মানুষ হাত পা ছড়িয়ে গল্প করছে, তাদের ঘিরে পানিপুরিওয়ালা, ফলওয়ালাসহ আরও বহু রকমের স্ট্রিট ফুড নিয়ে লোকজন বসে আছে।আমি চোখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগলাম, মনে হলো টেনিদা আর প্যালারামকে বোধহয় একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে!

অবশেষে এসে পৌছালাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। ফুটপাথ থেকেই দেখা যায় বিশাল রাজকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ধবধবে সাদা মহলটা। বাইরে থেকে দেখেই বোঝা গেলো এটা গ্রীক স্থাপত্য। এবার আমরা আবার পৃথ্বীকে পাঠালাম টিকেট কাটতে। সহজেই ১০ রুপির টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। অনেক দূরে হেঁটে আমরা দালানের ভিতর ঢুকলাম। সারা জীবন যে গ্রীক স্থাপত্য পড়ে এসেছি তার বিভিন্ন উপাদান যেমন- কলাম, রোজ উইন্ডো, ডোম, পেন্ডেন্টিভ ইত্যাদি চোখের সামনে দেখে বেশ উত্তেজিত বোধ করলাম। ভেতরে বিশাল বিশাল সব চমৎকার স্ট্যাচু, পেইন্টিং, দলিল, অস্ত্র ইত্যাদি আছে। আর আরেকটা হলে ভারতের ইতিহাস, তাদের বীরদের কথা, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস অনুযায়ী তাদের ঘরবাড়ির সেট ইত্যাদি জিনিস বানানো আছে। এই অংশটা আমার কাছে বেশ রঙ চঙ্গে মনে হলো।

এখান থেকে বের হয়ে আমাদের সাথে প্রথম ‘সুলভ শৌচালয়’ এর সাথে পরিচয় হলো। এটা আর কিছুই না, এটা হলো পরিষ্কার বাথরুম তবে টাকা দিয়ে ব্যবহার করতে হয়। যখন আমরা ভিক্টোরিয়া থেকে বের হয়ে আসি তখন খেয়াল করি, এর অনেক অংশই এখনো আন্ডার কন্সট্রাকশনে আছে। পেটে তখন আমাদের খিদের আগুন জ্বলছে। তাড়াতাড়ি বের হয়ে স্ট্রিট ফুডে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমি নিলাম ২০ রুপি দিয়ে ডিম রোল নামের একটা জিনিস। অন্যরা নিলো ভেলপুরি, চাট, চানাচুর, পেটিস, নুডুলস, নিম্বু পানি- এই সব। কোনটারই দাম ২৫ রুপির বেশি না। আমরা তৃপ্তি করে পেট ভরে খেলাম।

dgr
জিভে পানি আসা পাপড়ি চাট (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী)

এরপর আমরা মোড়ের ট্রাফিককে জিজ্ঞেস করতে গেলাম বেলুর মঠ কিভাবে যাওয়া যায়। কিন্তু তারা আমাদের আশায় পানি ঢেলে দিয়ে বলল যে এখন বাজে চারটা আর বেলুর মঠ পৌছাতে পৌছাতে পাঁচটা বেজে যাবে। আর পাঁচটার সময়ই বেলুর মঠ বন্ধ হয়ে যায়। কি আর করা, আমরা কুইক ডিসিশন নিলাম যে কফি হাউজে যাবো। ওনারা সাজেশন দিলো এখান থেকে মেট্রো করে চলে যেতে। আমরা মহা আনন্দে আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো স্টেশনে গেলাম। কি সুন্দর ফাঁকা আর পরিষ্কার! আমরা দেওয়ালে টানানো লিস্টে কলেজ স্ট্রিটের নাম খুঁজতে লাগলাম, কিন্তু পেলাম না। একজন ইউনিফর্ম পড়া মহিলা এগিয়ে এসে আমাদের বলল এম জি রোডের টিকেট কাটতে। আমরা কাউন্টারে লাইন ধরে ৫ রুপির টিকেট কাটলাম। টিকেট কোথায়, এ তো প্লাস্টিকের কয়েন! প্ল্যাটফর্মে ঢুকার আগে মেশিনে স্ক্যান করে সেই কয়েন দেখিয়ে ঢুকতে হয়। আমরা প্ল্যাটফর্মে ঢুকে দেখলাম ফাঁকা, শুনশান প্ল্যাটফর্ম। মুহুর্তের মাঝেই মেট্রো আসলো। তবে মেট্রোটা ফাঁকা নয়- প্রচুর ভীড়। মুহুর্তের জন্য দরজা খুললো, আমরা কিছু বোঝার আগেই সবাই ঠ্যালা ধাক্কা দিয়ে কোন মতে ভিতরে ঢুকে গেলাম। কোন মতে উপরে ঝুলতে থাকা হাতল ধরলাম, আর সাথে সাথেই দরজা বন্ধ করে ভয়ানক ত্বরণে মেট্রোটা এগিয়ে যেতে লাগলো। আমরা সবাই পিছন দিকে একদম হেলে পড়লাম। প্রচন্ড ভীড় , গায়ে গা ঘেঁষে আমরা দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্তু সুবিধা করতে পারলাম না। একটু পর পর একেকটা স্টেশন আসে আর আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ি একজন আরেকজনের উপর। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, কত স্বপ্ন ছিলো, আমরা সবাই পাশাপাশি মেট্রোতে বসে একসাথে সেলফি তুলবো, তারপর সবাইকে দেখাবো যে আমরা কত এক্সাইটিং একটা কাজ করেছি- কিন্তু তা আর হলো কোথায়? এখন এখান থেকে নামতে পারলে বাঁচি। কান খাড়া করে রেখে এক সময় আমরা টের পেলাম যে আমাদের এম জি রোড স্টেশন চলে এসেছে। সেই আগের মতন কয়েক সেকেন্ডের জন্য মেট্রো থামতেই আমরা ধাক্কাধাক্কি করে হুড়মুড় করে নেমে পড়ি। মেট্রো থেকে নেমেই আমরা একজন অন্যজনের দিকে তাকাই, সবার চোখেই একই দৃষ্টি ‘এটা কি হইলো? একেই কি বলে মেট্রো? কিছু বুঝার আগেই তো শেষ হয়ে গেলো’ ।

যাই হোক আমরা সেই প্লাস্টিকের কয়েনটা জমা দিয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে বের হয়ে আসি। ফাঁকা এম জি রোডের কোন দিকে কফি হাউজ তা বুঝতে পারি না। আবার ট্রাফিকের কাছে যাই। রাস্তা দেখিয়ে উনি আমাদের হাঁটতে বলে। আমরাও হাঁটতে থাকি। বেশ কিছুদূর হেঁটে খুঁজে পাই বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজ আর তার উল্টা পাশে কফি হাউজ।

কফি হাউসের ভেতরে যখন ঢুকি তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় ৫টা ছুঁই ছুঁই। অত্যন্ত সাধারণ চেহারার দালান। নিচ তলায় বোধহয় গোডাউন। দোতলায় কোন এক ব্যক্তির শোক সভা চলছিলো। আমরা তিনতলায় গিয়ে বসলাম। এই সেই বিখ্যাত কফি হাউজ! পাইক পেয়াদাদের মতন ফিটফাট পোশাক পড়ে বেয়ারারা ঘুরছে, আশেপাশে সব তরুন-যুবক বয়সী লোকেরা আড্ডা দিচ্ছে, আর নিচতলায় শোক সভায় আগত মানুষ -সব মিলিয়ে এক অদ্ভূত কম্বিনেশন তৈরি হলো। আমরা কোল্ড কফি, আর কি সব পাকোড়া অর্ডার দিলাম। একটু পর যত্ন করে ধোয়া কাঁচের গ্লাসে করে পানি দিয়ে গেলো। আমরা উসখুস করতে লাগলাম কখন খাবার আসবে, তার জন্য। এর মধ্যে অবনী, আদিবা, সৌরভ, জেরিন, আফরা আসলো। আমরা এক টেবিলে বসে গল্প করতে লাগলাম। খানিক পরে রিজভী, তুষার, শুভ, জুবায়ের, রাজিবসহ আরও অনেকেই যোগ দিলো। আমরা সবাই মিলে জোর গলায় হাসাহাসি করতে লাগলাম। অনেক্ষন পর খাবার আসলো। যদিও পাকোড়াটা মজার ছিলো না, তারপরও কফি হাউজ বলে কথা!  বন্ধুবান্ধব, আড্ডা, হৈচৈ সব মিলিয়ে আমরা দারুন সময় পার করলাম।

সাড়ে সাতটার দিকে আমরা সবাই বের হয়ে বাসে উঠলাম। ৬ রুপিতে একটা লোকাল বাস আমাদের হাওড়া ব্রিজ পার করে নামিয়ে দিলো।  আমরা কাছ থেকে ঝলমলে হাওড়া ব্রিজ দেখলাম। ভারি চমৎকার লাইটিং, ক্ষনে ক্ষনে রঙ বদলায়। ব্রিজের স্ট্রাকচারটাও অত্যন্ত দারুন। ডাবল ট্রাস দেওয়া, নিচে কোন সাপোর্ট নাই, পুরাই ঝুলন্ত এক ব্রিজ। আমরা ব্রিজের উপরে উঠলাম। নিচে হুগলী নদী। ঠান্ডা বাতাসে জমে যাওয়ার উপক্রম হলেও আমাদের বেশ ভালোই লাগছিলো। আমরা ব্রিজ থেকে নেমে নিচে ফুলের পাইকারি বাজারে গেলাম। পচা গন্ধে নাক চাপা দিয়ে হাঁটতে হলো। শেষমেশ একটা নদীর তীর পাওয়া গেলো যেখান থেকে সুন্দর ব্রিজের ভিউ আসে। আমরা দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। তারপর আবার বাসে উঠলাম।

আলোকিত হাওড়া ব্রিজ (কৃতজ্ঞতায় সামিয়া অবনী)

কোলকাতার বাসগুলো বেশ সুন্দর। কাঠের বডি, বেশ চওড়া, ভেতরে দাঁড়ানোর অনেক জায়গা, জানালাগুলো স্লাইড করে বাসের দেওয়ালের ভিতর ঢুকিয়ে ফেলা যায়। সিটগুলোতেও বসে আরাম। তবে হাত দিয়ে ধরার রড অনেক উপরে, হাত সবসময় টানটান করে রাখতে হয়। আরেকটা ব্যাপার হলো সবগুলো বাসেই ‘জয় মা তারা’ লিখা থাকে। বাইরে আবার বাসগুলো বেশ রংচঙ্গে। আর বাস ভাড়াও অ-নে-ক কম। আমি যখন বাসের ফ্যান হয়েই যাচ্ছিলাম ঠিক তখনই সুহাইলার সাথে বাসে দাঁড়ানো নিয়ে এক মহিলার সাথে দারুন ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। যখন দেখে মনে হচ্ছিলো ব্যাপারটা হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যাবে তখনই শুভ আমাদের সবাইকে নিয়ে ধর্মতলার স্টপেজে নেমে গেল। আমরা সুহাইলাকে ঠান্ডা করে আবার ধর্মতলা টু পার্ক স্ট্রিট আরেকটা বাসে উঠলাম। এবার আমরা সুন্দর মতন পার্ক স্ট্রিটে নেমে যাই।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা রাস্তা হারিয়ে এইগলি, ওইগলি ঘুরতে থাকি। মেইন রোডে সব বড় বড় রেস্টুরেন্ট- সাবওয়ে, ম্যাক ডোনাল্ডস, চাইনিজ তুং ফং, পাঞ্জাবী হোটেল – এইসব দেখতে পাই। এর মধ্যে এক গলিতে শামিয়ানা টানিয়ে কোন এক চিশতী বাবার উদ্দেশ্যে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন দেখি। সেখানে একটা বাচ্চার গলায় ‘মুঝে মাজবুর হ্যায় জয় চিশতী’ গানটা আমার কানে এখনো বাজে। তারপর যাই হোক রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায়। আমরা সোজা দাওয়াত হোটেলে ঢুকি। এটা মুসলমান হোটেল। আমি ১১০ রুপি দিয়ে নান আর চিকেন টিক্কা অর্ডার দেই। দামটা একটু বেশি হলেও খাবার বেশ মজা। খাওয়া শেষে পানির বড় বোতল কিনে হোটেলে ফেরত আসি। আমি অন্যদের সাথে কথা বলে জানলাম, আমরা ছাড়া আর কেউ ভিক্টোরিয়া দেখে নাই, বেলুর মঠ বন্ধ ছিলো, ফুড ফেস্টিভ্যাল বোরিং ছিলো। শুনে বেশ খুশি হলাম। যাক দিনটা সাকসেস্ফুল হয়েছে।

খানিক পরে চিং লাফাতে লাফাতে আসলো। লাফ মানে লাফ, একেবারে আক্ষরিক অর্থেই লাফ। ব্যাপার কি? এত খুশি কেন চিং? আমরা জিজ্ঞেস করছিলাম, কিন্তু খুশির ঠ্যালায় ওর মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। পরে আমরা বুঝতে পারলাম, চিং, উর্মি আর অদিতি দিপিকা পাড়োকানকে সামনা সামনি দেখেছে। দিপিকা নতুন ছবির শুটিং করার জন্য কলকাতায় এসেছে। দিপিকা হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় ওরা ধাক্কাধাক্কি করে একেবারে সামনে থেকে দেখে এসেছে। দিপিকার সাথে আরও ছিলো ইমতিয়াজ আলি আর সুনিধী চৌহান। কালো টপ-স্কার্ট, লাল সোয়েটার, লাল জুতা আর ছোট চুলে দিপিকাকে নাকি বেশ সুন্দরী লাগছিলো। পরে বুঝেছি, সিনেমাটা ছিলো ‘তামাশা’।

যাই হোক চিং চলে গেলে আমরা যার যার লাগেজ গুছিয়ে  রাখি, পরদিন ট্রেন জার্নি। ঠিক হয় যে, সকালে বের হওয়ার আগেই সব লাগেজ নিচতলায় ছেলেদের রুমে জমা দিয়ে বের হতে হবে। আমরা গোছগাছ করতে করতে উর্মির অট্টহাসি শুনতে পাই। আমাদের নিচেই ওদের রুম। জানালা দিয়ে ওদের হাহা হিহি শব্দ ভেসে আসতেই থাকে। আমরাও অনেক গল্প করে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি।

The Mighty INDIA CALLING: যে অভিযানের শুরু কোলকাতায় (পর্ব ২)

গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিচ্ছি, কিন্তু তাতে কোন কাজ হচ্ছে না, বুকের ঢিপঢিপানিটাও এতটুকু কমছে না।

কি আশ্চর্য! আমি সত্যিই তাহলে রওয়ানা হলাম…………… ৪৩ দিনের জন্য, তাও আবার আম্মুকে ছাড়া……চিন্তা করতেই ঢিপঢিপানি আবার বেড়ে গেল।

মোটামুটি শাহবাগ পর্যন্ত আমরা হৈচৈ চিৎকার করতেই লাগলাম শ্যামলি কোম্পানির সৌহার্দ নামক বিলাসবহুল বাসের ভেতরে। বাইরে রাত ১২.৩০-১.০০ টা বাজে, কিন্তু তাতে আমাদের কোন ভ্রূক্ষেপ নাই।

সবাই একটু ঠান্ডা হয়ে গেলে আমি নিজের বসার জায়গার দিকে মনোযোগ দিলাম। সবার পিছনের সিট। ৯০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেল, জানালার পাশে। সমস্যা হওয়ার কথা না। তাও ভালো আমি তো সিট পেলাম, বুবাইদা তো কোন সিট না পেয়ে সুন্দর ফ্লোরে আসন গেরে বসলো। সামনে বড় স্ক্রিনে পিকে দেখানো শুরু হলো। কিন্তু মনের মধ্যে টেনশন আর বুকের ঢিপঢিপানি নিয়ে সিনেমা না দেখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে করলাম।

মন অন্যদিকে ঘুরানোর জন্য পাশে বসা সারার সাথে রেগুলার টাইপ প্যাচাল পাড়তে শুরু করলাম। এক পর্যায়ে সারা কোন রকম সিগ্নাল না দিয়েই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গেলো। সারার কাধেঁ হেলান দিয়ে আমিও ঘুমানোর চেষ্টা করলাম যদিও জানতাম যে ঘুম আসবে না। যার জীবনে হাতে গোনা এক দুই দিন ক্লান্ত হয়ে গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়ার রেকর্ড ছাড়া আর কোন রেকর্ড নাই এইরকম দিনে তার যে ঘুম আসবে না- এই কথাটা বুঝতে পারা খুবই স্বাভাবিক। তারপরও সামনে কি দিন আসছে কোন আইডিয়া নাই। তারপরও বিশ্রাম নেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম আমি। চেষ্টাটা পুরাই বৃথা গেলো।

গভীর রাতে যখন দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে উঠলাম টের পেলাম বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। আমাদের সবাইকে জাগিয়ে বোর্ডিং পাস পূরণ করতে বলা হলো। এর আগে থেকেই রুবাইদা আমাকে আর সারাকে বাই টার্ন নিচে বসার অফার ফিরিয়ে দিয়েছিল। এবার শুভ, রিজভী আর তুষারকে দিলো। মনে মনে স্যালুট দিলাম- হ্যাটস অফ রুবাইদা।

বাসের ড্রাইভার অত্যন্ত চমৎকার করে চালিয়ে মোটামুটি ভোর ৬.২০শে বেনাপোল বর্ডারে পৌঁছিয়ে দিলো। চারপাশে ঘন কুয়াশা। ভয়ংকর শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমি নেমে খুঁজতে গেলাম বাথরুম। কিন্তু অফিসাররা আসে নাই বলে আমাদের ভিতরে ঢুকতে দিলো না। আবার কাঁপতে কাঁপতে বাসে উঠে বসলাম। কি শীতরে বাবা, সোয়েটার মানে না!

sfe
বেনাপোল পেট্রোপোল বর্ডারে হাসিখুশি দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় বৃষ্টি মজুমদার)

কিছুক্ষন পর অন্ধকার কেটে আলো ফুটতে শুরু করলো। আবার নেমে খুঁজতে গেলাম বাথরুম। এবার বাথরুম পেলাম তবে পানি নাই। পরে অনেক ভিতরে আরও একটা বাথরুম আবিষ্কার করলাম, সেটাতে আবার আলো নাই। কে জানি একজন বললো, ভালোই হলো ভিতরের ময়লা চোখে দেখা যাবে না। যাই হোক নাক চাপা দিয়ে একজন করে করে ঢুকলাম। একটু ফ্রেশ হওয়ার পর সবাইকেই বেশ ফুরফুরা মনে হলো। আমরা ওয়েটিং এ বসে দুনিয়ার গল্প করতে শুরু করলাম। সামনের দিনগুলো কেমন হবে……… ০৯ ব্যাচের সাথে পাল্লা দিয়ে আমরাও ঘুরবো………বরফের মধ্যে কেমন করে পোজ দিবো এইসব বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলি আর হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাই। আশেপাশের লোক সব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আমরা পাত্তা দেই না। উচ্চস্বরে হাসতে থাকি……………।

অবশেষে বোর্ডিং পাস জমা দিয়ে, লাইভ ফটো তুলে বের হয়ে আসি। আদিবার আব্বুর সৌজন্যে বর্ডারে আমরা এক্সট্রা খাতির যত্ন পাই। অনেকে সেখানেই টাকা ভাঙ্গিয়ে রুপি করে ফেলে, অবশ্য তার জন্য বাসে সবাইকে বসে থাকতে হয় অনেকক্ষণ। বসে থাকতে থাকতে এক সময় বিরক্তি ধরে যায়। হিমি তো মেজাজ গরম করেই ফেলে।

যাই হোক আমরা ১০ টার দিকে বর্ডার ক্রস করে পেট্রোপোলে ঢুকি। দেশ ছেড়ে বিদেশে প্রবেশ, অনেকেই উত্তেজিত বোধ করে। বাস থেকে নেমে ইন্ডিয়ার মাটিতে প্রথম পা রাখি। বেশ অদ্ভূত অনুভূতি হলো, গেটের ওপারে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ আর আমি আছি ইন্ডিয়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে! ভারি অদ্ভূত। অবশ্য খুব তাড়াতাড়ি এসব কাব্যি ছেড়ে দৌড়ালাম লাইন ধরতে। ভারতে প্রবেশের লাইন।

আশেপাশে দালালদের ছড়াছড়ি আর সব রাগি রাগি বিএসেফের লোক। দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বারবার বলতে লাগলো, ‘ লাইন সিধা কারো, লাইন সিধা কারো’। এইসব হিন্দি শুনে আমার গা জ্বালা করতে লাগলো, কিন্তু কিছু করার নাই- আগামী দেড় মাস আমাদের এইসব কথা বার্তা শুনে কাটাতে হবে। ভাঙ্গাচোড়া অফিসে ঢোকার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্তি ধরে যায়। এরমধ্যে সুহাইলা আমাকে দেখালো, দেয়ালে একটা সাইন বোর্ডে লাল রঙ দিয়ে লিখা আছে ‘ভারতে যাইবার পথ’। অত্যন্ত হাস্যকর লাগলো আমাদের কাছে। অবশেষে এক সময় আমরা পাসপোর্টে সিল লাগিয়ে আবার লাইভ ছবি তুলে বের হয়ে আসলাম। ভেতরে অনেকেই আমাদের কাছে জানতে চাইলো এত মানুষ কেন যাচ্ছি, কত দিনের জন্য যাচ্ছি, সাথে টিচার কে কে- এই সব কথা।

আমাদের মধ্যে সারাই সবার আগে ১৫ রুপি দিয়ে ব্রিটানিয়া চকোলেট ফ্লেভারর কেক কিনলো। বাসে উঠে সেটাতে ভাগ বসালাম। একসময় সবাই চলে আসলে ১১টার সময় বাস ছেড়ে দিলো। সবাই আবার একটা সম্মিলিত চিৎকার দিলাম- আমরা ফাইনালি ইন্ডিয়ায় ঢুকে পড়েছি, কি আনন্দ! কি আনন্দ!!

পথে বিএসেফ টাইপের একটা লোক উঠলো বাসে চেক করার জন্য। একমাত্র জুবায়েরকেই জিজ্ঞাসাবাদ করলো। যখন শুনলো আমরা সবাই একসাথে বেড়াতে যাচ্ছি তখন আর বেশি কিছু না করে আমাদের ছেড়ে দিলো। বাস আবার চলতে শুরু করলো। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। ঘরবাড়িগুলো ছোট ছোট, টালি দেওয়া টিনের ঘর- দেখেই বোঝা যায় এটা বাংলাদেশ নয়, অন্য কোন দেশ। আস্তে আস্তে গ্রাম ছেড়ে শহুরে ভাব শুরু হতে লাগলো। হাস্যকর সব নামের দোকানপাট, হোটেলের নাম ‘তুমি আসবে বলে’, স্কুলের নাম ‘মোনালিসা’- অদ্ভূত!

ইতোমধ্যে আমার এক পাশে সারা অন্য পাশে রুবাইদা গভীর ঘুমে অচেতন। প্রচন্ড ক্লান্তিতে আমার চোখ বুজে আসছে কিন্তু ঘুমাতে পারছি না। সারার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম। শেষ হয় না কেন এই যাত্রা?

মোটামুটি বিকাল চারটার দিকে আমরা নামলাম মার্কুইজ স্ট্রিটে শ্যামলী বাস কাউন্টারের সামনে। সেখানে মাইশার আম্মুকে দেখে খুব খুশি লাগলো- বিদেশের মাটিতে একজন দেশের মানুষ। আন্টি একটা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে নদীয়ায় এসেছিলেন। তাই আমাদের রিসিভ করতে টাইমমত এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন আগেভাগেই। ছেচল্লিশজন মানুষ প্রায় শ খানেক লাগেজ নিয়ে কোনরকমে ঢুকলাম ছোট্ট একটা ওয়েটিং রুমে। কমিটির লোকজন হোটেল ঠিক করতে গেল। জানা গেলো যে ভি আই পি কন্টিনেন্টাল নামের যে হোটেলের কথা আমরা ভিসা ফর্মে দিয়েছিলাম, সেটা শুধুই দেওয়ার জন্য দেওয়া হয়েছে। আমরা থাকবো আরও কমদামি টাইপ হোটেলে। আধা ঘন্টা পর যখন আমরা শুনলাম হোটেল পাওয়া গেছে তখন কারো গায়ে কোন শক্তি নেই। ধুঁকতে ধুঁকতে আমরা লাগেজ নিয়ে বের হলাম। হোটেলটা কয়েক কদম সামনেই পাওয়া গেছে, হোটেল প্যারাডাইজ।

হোটেলটা ঠিক হোটেল না, কেমন জানি ভুতুড়ে জায়গা। চিপা অন্ধকার এন্ট্রি দিয়ে ঢুকে সরু সিড়ি দিয়ে উঠে তিন তলায় আমি আর মজুমদার সবার আগে রুম ঠিক করলাম। রুমগুলো দেখলেই কেমন মন খারাপ হয়ে যাওয়ার মতন। ছোট্ট একটা অন্ধকার রুমে ডাবল বেড, একটা টেবিল, কাপড় ঝুলানোর জন্য দড়ি, টিমটিমে লাইট, চিকন লম্বা একটা বাথরুম। আমি, রুবাইদা, মজুমদার আর মৌলি সব মালপত্তর নিয়ে উঠলাম। সবাই ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত। একটু হাতমুখ ধুয়ে সবাই বের হয়ে পড়লাম।

প্রথমত টাকা ভাঙ্গাতে হবে, দ্বিতীয়ত সিম কিনতে হবে, তৃতীয়ত খেতে হবে কারণ আগেরদিন রাতে বাসায় শেষ খাওয়া খেয়েছিলাম। কিন্তু কিভাবে এতগুলো কাজ করবো? কোথায় যাবো? কাউকে তো চিনি না।

হোটেলের নিচেই পূর্ব পরিচিত প্রসূন ভাইয়াকে দেখে খুব ভালো লাগলো, বিদেশের মাটিতে আরেকজন পরিচিত মানুষ! ঠিক হলো ভাইয়া আমাদের সিম কিনে, খাওয়ার দোকানে যেতে সাহায্য করবেন। উর্মি, অদিতি আর চিং একটু ফ্রেশ হতে রুমে গেলো, মজুমদার এক মুচির কাছে ওর ছেঁড়া ব্যাগ সেলাই করতে দিলো, আমি আর রুবাইদা দাঁড়িয়ে রইলাম ফুটপাথে। ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে। হলুদ অ্যাম্বাস্যাডার ট্যাক্সি, টিং টিং শব্দ করে ট্রামের ছুটে চলা, হাতে টানা রিক্সা, রাস্তা ভর্তি মানুষ, মার্কুইস স্ট্রিটের দুপাশের ঝলমলে বাতি- দেখতে দেখতে মনে হলো আমি মনে হয় কোন বই কিংবা সিনেমার সিনের ভেতর ঢুকে গেছি। দৃশ্যগুলো অনেক পরিচিত কিন্তু আগে কখনো কাছ থেকে দেখা হয় নাই। আর এখন আমার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি প্রাণ চঞ্চল কোলকাতাকে! কি আশ্চর্য!

আমরা সবাই বের হলাম। মার্কুইস স্ট্রিট্রের শ্রীলেদার্সের আগে একটা চিপা গলির ভেতর ছোট্ট দোকানে লাইন ধরে আমরা সিম কিনলাম। ভোদাফোনের সিম। সব মিলিয়ে ৫৭০ রুপি খরচ পড়লো। এই টাকায় পেলাম সারা ইন্ডিয়ায় এক রেট, বাংলাদেশে প্রতি মিনিটে ২ রুপি আর সম্ভবত ২ জিবি থ্রিজি ইন্টারনেট- সবই এক মাসের জন্য। সাথে সাথে বাসায় ফোন দিয়ে কথা বললাম। কি যে ভালো লাগলো!

প্রসুন ভাইয়া আমাদের সব চিনিয়ে দিলেন মানি এক্সচেঞ্জ, মুসলমান হোটেল দাওয়াত, বাংলা ও চাইনিজ হোটেল  ভোজ, সকালের নাস্তার জন্য হোটেলের একদম কাছে আরাফাত হোটেল। অনেক চিন্তা ভাবনা করে আমরা ভোজে ঢুকলাম। শুরু হলো আমাদের ভেজ খাওয়ার মিশন। আমি আর রুবাইদা অর্ডার দিলাম ফ্রায়েড রাইস আর ভেজ মাঞ্চুরিয়ান। খাবার আসার সময়টুকুতে আমি একবার বাথরুমে ঢুঁ মেরে আসি। রেস্টুরেন্টের ইন্টেরিয়র যতটা মনোরম, বাথরুমটার ততটাই সদরঘাট অবস্থা।

একে একে আমাদের অনেকেই ভোজে এসে ঢুকতে থাকে। আমরা উঁচু গলায় হৈচৈ করতে থাকি, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি। খাবার এসে পড়লে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমাদের দেশের চাইনিজের সাথে ওদের চাইনিজের বেশ পার্থক্য। ফ্রায়েড রাইসে কামড় দিলে লবন টাইপের একটা কি জিনিস যেন কিচকিচ করে। তবে টেস্ট অন্যরকম হলেও বেশ মজা। আমার বিল আসে ৯৫ রুপি। তখন পর্যন্ত আমার টাকা ভাঙ্গানো হয় নাই। এই বিলটা মৌলি দিয়ে দেয়।

বিল মিটিয়ে আমরা পান মশলার বড় বড় মিছরিগুলি চিবাতে চিবাতে বের হয়ে আসি। মোড়ের শ্রীলেদার্সে ঢুকে পড়ি। শ্রীলেদার্স- আনন্দমেলায় কত অ্যাড দেখেছি- আজকে সত্যি সত্যি ঢুকে পড়লাম! আরে বাবা- জিনিস এত্ত সস্তা, মাথা ঘুরে গেলো। ঘুরে ঘুরে দেখলাম অনেক্ষণ ধরে। তারপর আবার ভোজে ফিরে গিয়ে হিমি আর সীমান্তকে খুঁজে বের করলাম, আমরা রওয়ানা দিলাম একসাথে মানি এক্সচেঞ্জের দিকে। কিন্তু রাত হয়ে যাওয়ায় দোকানে রেট কমিয়ে বলে। আমি আর হিমি রাগ করে অল্প কিছু টাকা ভাঙ্গাই। তারপর হেঁটে হেঁটে হোটেলের দিকে যেতে থাকি। রাতের মার্কুইস স্ট্রিটে আমরা হাঁটতে থাকি। আমি চারপাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। কি অদ্ভুত রাস্তাঘাট, অদ্ভুত মানুষজন। এইরকম রাস্তা, ট্যাক্সি, লোকজন এবং তাদের অন্যরকম আচরণ, তারা দেখতে আমারই মতন কিন্তু আবার একেবারেই আলাদা -সবকিছু মিলিয়েই আমার কাছে আশ্চর্য লাগতে থাকে।

হোটেলে ফিরে হাত পা ছড়িয়ে বসতে বসতেই সীমান্তর বার্থডে কেক কাটার সময় হয়ে যায়। ১২ টার সময় আমরা দোতলার বারান্দায় চিৎকার করে গান গেয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে সীমান্তকে উইশ করি আর সীমান্ত বার্থ ডে টুপি পড়ে হিমির আনা কেকটা কাটে। আমাদের হৈচৈয়ে পাশের রুম থেকে এক বাচ্চা তার মায়ের কোলে চেপে বের হয়ে আসে। ওকেও কেক দেওয়া হয়। আমরা হাই ভলিউমে কথা বলতেই থাকি। একটু পর কমপ্লেইন আসে যে একজন রোগি ঘুমাতে পারছে না। আমরা তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে রুমে ফেরত আসি।

মোম্বাতি সব জ্বালানো হয়েছে, এখনই কাটা হবে কেকটা! (কৃতজ্ঞতায় সারাহ তাবাসসুম)
মোম্বাতি সব জ্বালানো হয়েছে, এখনই কাটা হবে কেকটা! (কৃতজ্ঞতায় সারাহ তাবাসসুম)

আদিবা রুমে রুমে এসে পরদিনের প্ল্যান বলে যায়। ভোর ৬টার সময় ফুলের আড়ত, তারপর বেলুর মঠ, ফুড ফেস্টিভাল, ভিক্টোরিয়া, কফি হাউজ, হাওড়া ব্রিজ। আমি প্ল্যান শুনে রুমমেটদের বলে দেই সকাল ৬টার প্ল্যান আমার জন্য অসম্ভব। সারা দিন জার্নি করে রাতে মাত্র কয়েকঘন্টা ঘুমালে আমার চলবে না। তাই ঠিক হলো ওরা ওদের মতন যাবে, আমি অন্য কোন ব্যবস্থা করে নিবো।

চার জনে লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। খুব সময় লাগলো না। ঘুমিয়ে পড়লাম। ইন্ডিয়াতে প্রথম ঘুম।

The Mighty INDIA CALLING: দ্বিমিকবাসীর ভারত ভ্রমণের শুরুর কথা (পর্ব ১)

 

( প্রথমেই বলে রাখি, যাদের পরিচিত দুই একজন আর্কিটেক্ট আছেন বা যাদের বাসায় স্থাপত্যের শিক্ষার্থী আছে তারা কমবেশি সবাই জানেন যে আর্কিটেকচার জীবনে একটা ট্যুর হয়, যার নাম ‘ইন্ডিয়া ট্যুর’। যারা জানেন না তাদের জন্য বলে দিচ্ছি, সাধারনত থার্ড ইয়ার শেষে আর্কিটেকচারের শিক্ষার্থীরা পাশের দেশ ভারত ভ্রমণে যায়। এটা কোন অফিশিয়াল ট্যুর নয়। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে এই ট্যুরটা দেয়। এই ট্যুরের চলটা অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। ৮০র দশকে যারা শিক্ষার্থী ছিলেন তাদের ট্যুর শুধুমাত্র দিল্লী আগ্রাতেই সীমাবদ্ধ ছিলো। তারপর দিনে দিনে ট্যুরের পরিসর বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে এখন এই ট্যুর ষোল সতেরটা শহর জুড়ে চল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশ দিন ব্যাপী হয়ে থাকে। যে কোন শিক্ষার্থীর কাছেই এই ধরনের ট্যুর একটা স্বপ্নের মতন ব্যাপার। কারণ এইরকম বয়সে সচরাচর এত বড় ট্যুর কারও ভাগ্যেই জোটে না। আবার অনেকের জন্য এইটাই থাকে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ!

তাই দেখা যায় ফার্স্ট ইয়ার থেকেই স্থাপত্য শিক্ষার্থীর মনে নানা রকম জল্পনা কল্পনা চলতে থাকে এই ট্যুর নিয়ে। বিশেষ করে প্রতি বছর যখন একেক ব্যাচের সিনিয়ারদের কাছ থেকে ইন্ডিয়ায় যাওয়া এবং ফেরত আসার কাহিনী শোনা হয় তখন থেকেই ট্যুরের স্বপ্ন ডালপালা মেলতে থাকে। সিনিয়ারদের দেখে দেখে তার মনে স্বপ্ন বোনা হতে থাকে, ‘আমি যখন মানালি যাবো তখন বরফের মধ্যে ডুবে একটা ছবি তো তুলবোই’ ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই বলা যায় একেবারে স্থাপত্য জীবনে গোড়া থেকেই একজন শিক্ষার্থীর মোটামুটিভাবেই জীবনের একটা ‘লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য’ থাকে  ইন্ডিয়া ট্যুরে যাওয়া। আর ট্যুরে যাওয়াটাতো সোজা ব্যাপার না। সেটার জন্য সবার আগেই বিশাল আর্থিক সামর্থ্য দরকার। সেটার যোগান তো এক দিনে হবে না, তাই ট্যুরে যাওয়ার এক-দুই বছর আগে থেকেই চলতে থাকে টাকা জমানোর কাজ। প্রতিদিনের টিউশনি বা প্রোফেশনাল কাজ দ্বারা উপার্জিত অর্থ থেকে একটা বড় অংশ আলাদা করে রাখতে হয় ইন্ডিয়া ট্যুরের জন্য। তাই কোন না কোনভাবে একজন শিক্ষার্থী ট্যুরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কোনভাবেই স্মৃতি থেকে সরিয়ে রাখতে পারে না ‘ইন্ডিয়া ট্যুর’এর ব্যাপারটা!)

সেই ২০১৪ সালের কথা। থার্ড ইয়ারে ক্লাস শুরু হওয়ার পরপরই আমরা বলাবলি করতাম, ‘আমরা না এবার ইন্ডিয়ায় যাবো?’ । থ্রি টুতে একদিন আমাদের মিটিং হলো। সেদিন শুভ জানিয়ে দিলো, ‘যাবো না মানে, অবশ্যই যাবো!’। সেই থেকে আমাদের প্রিপারেশন শুরু। প্রথমে শুরু হলো টাকা জমানো। অ্যাডমিশনের কোচিং করিয়ে সবাই রোজগার জমিয়ে রাখতে লাগলো। তবে সেটা আসলে কিছুই না। যে যেভাবে পারলো টাকা জমাতে লাগলো। কথায় কথায় সবার টাকা বাঁচানোর ফন্দি, ‘বুঝলি সামনে ট্যুর আছে, এখন টাকা খরচ করতে পারবো না’। এরই মধ্যে এক ফাঁক দিয়ে আমাদের কমিটি গঠন হয়ে গেলো।

এর সাথে প্যারালালি আসলো পাসপোর্টের কাজ। যাদের যাদের পাসপোর্ট নাই তারা ফাঁকে ফোকড়ে ছুটলো পাসপোর্ট অফিসে। ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই আমরা একবার পরীক্ষা এগিয়ে নেওয়ার জন্য চেষ্টা করেছিলাম যাতে পরীক্ষার পরের ছুটিটা লম্বা হয়। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যার্থ গেলো। রুটিন অনুযায়ী পরীক্ষার আগে আমরা দেড়মাসেরও বেশি সময় পাবো, কিন্তু পরীক্ষার পর পাবো কাটায় কাটায় এক মাসের মত।

ক্লাস শেষ হতেই নভেম্বর মাসে পাসপোর্ট রেডি হওয়ার পাশাপাশি ভিসার চেষ্টা শুরু হলো। প্রথমে আমরা নিয়ম অনুযায়ী অনলাইনে অ্যাপ্লাই করলাম। কাজ হলো না। তারপর ধরা হলো দালাল। দালাল ধরার পর প্রতিদিন তিন চারজনের ইন্টারভিউয়ের ডেট পড়তে লাগলো। এভাবেই ধীরে ধীরে ভিসা হচ্ছিলো। ভিসার পুরো ব্যাপারটা অবনী নিদারুণ ধৈর্য্য নিয়ে সামাল দিচ্ছিলো।

ভিসা হতে তো সময় লাগবে। কিন্তু তাতে কি, কেনাকাটা আছে না? সবাই চলে গেলাম ঢাকা কলেজ আর বংগ বাজার। শীতের কাপড়চোপড়, মোটা প্যান্ট, হাতমোজা, পা মোজা, মাফলার, উলের টুপি, ইনার- আরও কত কি কিনলাম! দোকানে দোকানে তখন আমাদের লোকজনকে দেখা যায়। তখন একজন আরেকজনের সাথে সলাপরামর্শ করে কেনাকাটা করি। আমি বাটা থেকে ওয়াটারপ্রুফ কেডস কিনলাম। তারপর নিউমার্কেট থেকে কিনলাম হ্যান্ড ব্যাগ আর ট্রলি ব্যাগ বা মেইন লাগেজ।

এইসব কেনাকাটা করতে করতে তিনজন ছাড়া বাকি সবার ভিসা মোটামুটি হয়ে গেলো। জানুয়ারি মাসে আমাদের পরীক্ষার মধ্যেই একদিন ডেট পড়লো পাসপোর্ট জমা দেওয়ার। ঠিক তার আগের দিন নাটকীয়ভাবে রিন্তু ট্যুরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো! নাটকীয় বলছি এই জন্য কারণ দীর্ঘদিন ধরেই রিন্তু বলে আসছিলো যে ও ট্যুরে যাবে না। আমরা অনেক হাতে পায়ে ধরার পরেও ও কিছুতেই রাজী হচ্ছিলো না। তাই হঠাৎ করে যেদিন শুনলাম রিন্তু ইন্ডিয়া যাবে- আমরা আমাদের মন নেচে উঠলো। যেদিন আমরা সবাই আসলাম কমিটির হাতে পাসপোর্ট জমা দিতে, সেদিন রিন্তু নিশাতকে সাথে নিয়ে গেলো পাসপোর্ট অফিসে- ইমার্জেন্সি পাসপোর্ট করার জন্য (ওর বুকের পাটা দেখে আমি মনে মনে হতবাক হয়ে গেলাম, কী সাহস!)। তবে আল্লাহর রহমতে একেবারে শেষ মুহুর্তে রিন্তুসহ বাকি চারজনের ভিসা করানো সম্ভব হয়েছিলো।

এর মধ্যে দফায় দফায় প্ল্যান হতে লাগলো। আমরা কোন রুটে যাবো, কোথায় কয়দিন থাকবো এইসব নিয়ে আদিবা দিনরাত লিস্ট বানাতে লাগলো। একদিন মিটিং ডেকে সবাইকে ট্যুরের আউটলাইনটা বুঝিয়ে দেওয়া হলো। একেবারে শেষ মুহুর্তে লাগলো এক গণ্ডগোল।

দেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে আমাদের একটা পরীক্ষা সাত দিন পিছিয়ে দেওয়া হলো। আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমাদের পাশাপাশি জিরো নাইন ব্যাচের সবাই মরিয়া হয়ে উঠলো। ওনাদেরও একই সময়ে ইন্ডিয়া ট্যুরে যাওয়ার কথা।  নোটিশ আসার পরদিনই আমরা আর জিরো নাইন ব্যাচের সবাই গিয়ে ডিপার্টমেন্টের হেডকে জানালাম আমাদের সমস্যার কথা। আমরা দুই ব্যাচ অনুরোধ করলাম যেন আমাদের পরীক্ষাটা এগিয়ে নেওয়া হয়। হেড, ডিন, ডি এস ডাব্লিউর মধ্যে মিটিং বসলো। মিটিং শেষে ওনারা জানালেন পরীক্ষাটা এগিয়ে নেওয়া হয়েছে শুধু আমাদের দুই ব্যাচের জন্য। আমরা হাঁফ ছাড়লাম, যাক বাবা বাঁচা গেলো।

ঐদিকে কাস্টমসের অফিস টাইমিংয়ের  সাথে মিল রেখে রওয়ানা দিতে গেলে শেষ পরীক্ষার পরদিন রওয়ানা দেওয়া সুবিধাজনক না। ওদিকে জিরো নাইন ব্যাচও শেষ পরীক্ষা দিয়ে রাতেই রওয়ানা হচ্ছে। তাই সিদ্ধান্ত হলো আমরাও পরীক্ষা দিয়ে রাতের বেলাতেই রওয়ানা দিবো। সিদ্ধান্তটা নিজের কাছেই কেমন যেন লাগলো, তাই বলে পরীক্ষা দিয়ে রাতের বেলায়ই? ব্যাপারটা একটু বেশি বেপরোয়া হয়ে যায় না?

এমনিতেও পরীক্ষার গ্যাপ কম। তারউপর আবার একটা পরীক্ষা এগিয়ে এনেছি, মাঝে সময় খুব কম। এরমধ্যে আমাদের ব্যাগ গুছানো চলতে লাগলো। জানুয়ারির ষোল তারিখ আমরা পরীক্ষার হলে গেলাম আরবান পরীক্ষা দিতে। সারা বুয়েট ফাঁকা, শুধু আমরা কয়েকজন একটা রুমে বসে পরীক্ষা দিলাম। দুপুর দুইটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত পরীক্ষা চললো। খাতা জমা দিয়ে এক মুহূর্তও কেউ সময় নষ্ট করলাম না। সবাই বাসার দিকে দৌড় লাগালাম। আমাদের বলে দেওয়া হলো রাত দশটার মধ্যে প্লিন্থে উপস্থিত থাকতে।

আমি বাসায় ফেরার পথে একটা সানগ্লাস কিনলাম। বাসায় পৌঁছে শেষ মুহূর্তের জিনিসপত্র ভরলাম ব্যাগে। সবাই নানা রকম উপদেশ দিতে লাগলো যা বেশির ভাগই অর্থহীন। কিন্তু আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম সব। পেটের মধ্যে কেমন যেন পাক খেয়ে উঠতে লাগলো আর এক অজানা আশংকায় বুকের ভেতর গুরগুর করতে লাগলো। রাত আটটা বাজতেই এশার নামাজ পড়ে, ভাত খেয়ে রেডি হয়ে নিলাম। নয়টার দিকেই বাসা থেকে রওয়ানা দিলাম বুয়েটের উদ্দেশ্যে।

cc
শীতের রাতের জমজমাট প্লিন্থ ১৬ই জানুয়ারি, ২০১৫ (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম)

দশটা বাজার অনেক আগেই আমি পৌঁছে গেলাম ডিপার্টমেন্টে। তখনও তেমন কোন লোকজন আসে নাই। ধীরে ধীরে একজন একজন করে আসতে লাগলো। প্রায় সবার সাথেই বাবা-মা আছে। প্রথমবারের মত আমাদের আব্বু আম্মুদের পদচারণায় শীতের রাতের প্লিন্থ গমগম করে উঠলো। ওদিকে বাস আসে নাই, কখন আসবে তার খবরও নাই। তবে আমাদের খারাপ লাগছিলো না। সিনিয়ররা এসে নানারকম উপদেশ দিয়ে গেলো। জুনিয়ররা আসলো বিদায় দিতে। আমাদের জন্য টি শার্ট আসলো, ব্যাজও আসলো, বড় ব্যানারও টানানো হলো লুভরে কিন্তু বাসের আর পাত্তা পাওয়া গেলো না। কমিটির লোকজনকে সবাই বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো। ওরাও বাসের সাথে যোগাযোগ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে লাগলো। ওদিকে রাত এগারোটা-সাড়ে এগারোটা বেজে যাচ্ছে। আমার আম্মুর কপালে চিন্তা দেখা দিলো, ‘মেয়ে এই কাদের সাথে যাচ্ছে? এরা তো বাসই ঠিক করতে পারে না। দেশের মধ্যে একটা বাস কখন আসবে বলতে পারে না- এরা ইন্ডিয়া গিয়ে কি করবে?’ । এই সব চিন্তা করে আমার আম্মু হতাশ দৃষ্টিতে কমিটির লোকজনদের দিকে তাকাতে লাগলো।

রাত বারোটার দিকে বাস এসে হাজির হয়। আমরা আমাদের ব্যাগট্যাগ নিয়ে দৌড়িয়ে ছুটে যাই বাসের দিকে। লাগেজ কম্পার্টমেন্টে আমাদের লাগেজ উঠাতে দেই। যতক্ষণ না লাগেজ ভিতরে ঢুকানো হচ্ছে ততক্ষণ নিচে দাঁড়িয়ে থাকি। খুব তাড়াতাড়ি আমাদের লাগেজ ওঠানো হয়ে যায়। সাথে সাথে আমরাও উঠে পড়ি বাসে। জানালা দিয়ে আম্মুর দিকে হাত নেড়ে বিদায় জানাই। ঠিক সাড়ে বারোটার সময় আমাদের বাস যাত্রা শুরু করে। তারপর-

 

তারপর?

তারপর হলো শুরু-

৪৬ জন শিক্ষার্থীর জীবনে ঘটে যাওয়া সোনার কালিতে লেখা এক ঐতিহাসিক মহাকাব্য যার নাম ‘ইন্ডিয়া কলিং’- এর ভূমিকা রচিত হলো মাত্র। ৪৩ দিন, ১৫টা শহর, অচেনা দেশ, টানটান অ্যাডভেঞ্চার , নতুন নতুন অভিজ্ঞতা আর পদে পদে অনিশ্চয়তায় ভরা এক মহা কাব্যিক উপাখ্যানের শুরু হলো এখান থেকেই………

তুলা মেঘের সাজেক উপত্যকা

এ বছরের শুরুতে দেড় মাস ব্যাপী ইন্ডিয়া ট্যুর দেওয়ার পর দ্বিমিকবাসী বেশ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। পুরো একটা টার্ম জুড়ে কোন ট্যুর না দেওয়ার ঘটনা এই লেভেল ৪ টার্ম ১ এ প্রথমবারের মত ঘটে। তাই এইবার বাই হুক অর বাই  কুক একটা ট্যুর দিতেই হবে- এমন চিন্তা শুরু থেকেই আমাদের মাথায় আসে। আমরা বিক্ষিপ্তভাবে নানা প্ল্যান করলেও অবশেষে ওয়ান এন্ড অনলি জাফরের আয়োজনে সবাই বের হয়ে পড়ি মেঘ পাহাড়ের দেশ সাজেকের উদ্দেশ্যে। অনেকদিন পর একটা ব্যাচ ট্যুর- হাসি, আনন্দ আর অ্যাডভেঞ্চারে কানায় কানায় পূর্ণ ছিলো দুইটা দিন। যারা যায় নাই তাদের জন্য যে চরম মিস- সে কথা না বললেও চলে।

 

বাস থেকে নেমেই মনে হলো হাত, পা সব জয়েন্ট থেকে খুলে পড়ে যাবে। সারা রাতে বাসে মুড়ির মতন ঝাঁকানি খেতে খেতে বাস থেকে নেমেই তাই আমরা ২১ জন দ্বিমিকবাসী হাত পা ছুড়তে লাগলাম। যে জায়গাটায় দাঁড়িয়েছিলাম সেটা হলো শাপলা চত্বর। খাগড়াছড়ি শহরের এটাই মনে হলো সব চেয়ে বড় কেন্দ্রস্থল। প্রায় সাথে সাথেই জাফরের সাথে কন্টাক্ট করে জাফরের ঠিক করে রাখা দুই চান্দের গাড়ি এসে হাজির হলো। চান্দের গাড়ি পেয়ে আমরাও মহা উৎসাহে টপাটপ উঠে পড়ি। কিন্তু আমাদের গাড়ি আর ছাড়ে না। খবর নিয়ে জানলাম, সার্কিট হাউস থেকে কর্মকর্তা কেউ একজন আসছেন আমাদের রিসিভ করতে। অবশেষে একজন অফিসার আসলেন। তিনি নোভার সাথে কুশলাদি বিনিময় করে আমাদের সাথে রওয়ানা দিলেন সার্কিট হাউসে। আমরা মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যিস নোভা ছিলো!

পাহাড়ের উপর চমৎকার, ছিমছাম, পরিপাটি সার্কিট হাউস দেখেই আমাদের সবার মনে একসাথে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারী চাকরি করার খায়েশ জাগলো। যাই হোক, চমৎকার তিন খানা রুম আমাদের জন্য খুলে দেওয়া হলো। আমরা মেয়েরা দুইটা রুমে ভাগ হয়ে পালা করে ফ্রেশ হয়ে নিতে লাগলাম। ঐদিকে জাফর আমাদের জন্য সকালের নাস্তা নিয়ে আসতে বললো। আমরা সবাই ডাইনিঙয়ে বসে অফিসারদের মত করে নাশতা খেলাম। পরোটা, ভাজি আর চা। পেট ভরে এসব খেয়ে আমরা ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে পড়লাম। আবার চেপে বসলাম চান্দের গাড়িতে। হেল্পার আমাদের জানালো চাইলে চান্দের গাড়ির উপরেও আমরা বসতে পারি। শিশির টকাটক উঠে গেলো আমাদের গাড়ির উপরে। প্রায় দশটার দিকে দুই গাড়ি লাইন ধরে চলতে লাগলো।

খাগড়াছড়ি শহর পার হতেই রাস্তার দুইপাশে লোকজন কমতে লাগলো। চমৎকার সব পাহাড়ের দিকে আমরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে আমরা চলতে লাগলাম। আর নিজেরা মজাসে গল্পগুজব করছিলাম। নোভা জানালো সাজেক ভ্যালি আসলে রাঙ্গামাটি জেলায় পড়েছে কিন্তু খাগড়াছড়ি থেকে যেতে সুবিধা হয় বলেই নাকি সবাই খাগড়াছড়ি থেকেই সাজেক যায়। শুনে বেশ ভালোই লাগছিলো যে এক সাথে খাগড়াছড়ি প্লাস রাঙ্গামাটি দুইটা জেলায় পা দিতে পারবো। একটু পর পর আর্মির চেক পোস্ট আসছিলো। আমাদের চান্দের গাড়ির হেল্পার বারবার নেমে চেক পোস্টে নানা রকম বিবরন দিয়ে আসছিলো।

এভাবে প্রায় দেড় ঘন্টা চলার পর আমরা থামলাম শুকনাছড়া বা হাজাছড়া ঝর্ণার উদ্দেশ্যে। রাস্তা থেকে নেমে আমরা হাঁটতে লাগলাম। পথ কখনও পানির ধারার নিচে, কখনও উঁচু, কখনও নিচু। বেশ মজা করে আমরা হাঁটতে লাগলাম। প্রায় দশ পনের মিনিট হাঁটতেই আমরা পৌঁছে গেলাম ঝর্ণার কাছে। ঠান্ডা পানিটাতে পা ডুবিয়ে রাখতে আমাদের যে কি ভালো লাগছিলো আর বলার মতন না। সবাই যার যার মত পানিতে নেমে পড়লো। তানভীর আর রাফাত বেয়ে বেয়ে পাহাড়ের গায়ে খাঁজ বরাবর উঠে ঝর্ণার পাশে বসে রইলো। ঝকঝকে রোদের মধ্যে টলটলে পানিটাকে পেয়ে সবাই খুব শান্তি পাচ্ছিলো। কয়েকজন তো চলেই গেলো ঝর্নার নিচে দাঁড়াতে! তবে এখানে পানির গভীরতা কম। তাই তেমন বিপদের কিছু মনে হলো না। ঝর্ণার পানিতে শরীর জুড়িয়ে আমরা আবার ফেরত গেলাম।

ঠান্ডা পানির হাজাছড়া ঝর্ণা (কৃতজ্ঞতায়- পৃথ্বী)
ঠান্ডা পানির হাজাছড়া ঝর্ণা (কৃতজ্ঞতায়- পৃথ্বী)

চান্দের গাড়িতে উঠার আগে দেখলাম পিস এক টাকা হিসেবে পাহাড়ী কলা বিক্রি হচ্ছে। তানভীর আমাদেরকে খাওয়ালো সেই কলা। কলা খেতে খেতে আমরা গাড়িতে উঠলাম। এবার অনেকেই শিশিরের সাথে গাড়ির ছাদে উঠে বসলো। আমরা আগের মতই ভিতরেই বসলাম। গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। ঠান্ডা বাতাসে আমাদের ভেজা জামা কাপড় সব শুকিয়ে যেতে লাগলো। যতই সামনের দিকে যেতে লাগলাম, একটা অদ্ভূত দৃশ্য চোখে পড়লো। রাস্তার দুই পাশে ছোট ছোট উপজাতি বাচ্চারা সব আমাদের গাড়ির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে হাত নাড়তে লাগলো। উপর থেকে জাফর লজেন্স ছুঁড়ে দিতে লাগলো বাচ্চাদের দিকে। বাচ্চারাও দৌড়ে দৌড়ে লজেন্স কুড়াতে লাগলো। এখানে নাকি এটাই সঠিক নিয়ম। বাচ্চারা অভিবাদন জানাবে আর পর্যটকরা তাদের দিকে চকলেট, লজেন্স ছুঁড়ে দিবে। ভাগ্যিস জাফর আগে থেকে জানতো!

আস্তে আস্তে পাহাড়গুলো কেমন যেন বদলে যেতে লাগলো। পরিষ্কার নীল আকাশ, কার্টুনের মত মেঘের চাঁই, বড় বড় সবুজ গাছে ঢাকা পাহাড় দেখতে দেখতে আমাদের যাদের ক্যামেরা ছিলো, তারা সব ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো। কারন নিজের চোখে দেখা এইসব দৃশ্য ক্যামেরাতে এক কানাও ধরে রাখা যাবে না। অন্তরা আর সুমাইয়া গলা ছেড়ে গান ধরলো। রাস্তা কখনও খাড়া নিচু, কখনও খাড়া উঁচু। যখন উঁচুতে উঠি তখন বুক ধুক ধুক করতে থাকে আর যখন নিচে নামি তখন গলা থেকে চিৎকার বের হয়ে আসে অটোমেটিক। ঐদিকে রুবাইদা সামনে বসে প্রায় ঘুমে ঢলে পড়েই যেতে থাকে। আমি বেশ কয়েকবার ওকে জাগিয়ে দেই।

সাজেকের পথে (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী)
সাজেকের পথে (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী)

দীঘি নালা, বাঘাই ঘাট, মাসালং বাজার সব পার হয়ে প্রায় দুইটার দিকে আমরা গিয়ে পৌঁছাই সাজেক ভ্যালির রুইলুই পাড়ায়। চেক পোস্ট পার হয়ে সোজা গিয়ে পৌঁছাই আগে থেকে ঠিক করে রাখা আলো রিসোর্টে। চারটা রুম আমাদের জন্য বুক করে রাখা ছিলো। আমরা মেয়েরা টপাটপ তিনটা রুমের দখল নিয়ে নেই। সবার গোসল করার ইচ্ছা ছিলো কিন্তু রিসোর্টের লোক এসে বলে গেলো এখানে পানি বেশ দামি কারণ পানি আনতে হয় নিচ থেকে গাড়ি করে। যেহেতু আমরা ২১ জন তাই আমাদের বুঝে শুনে পানি খরচ করতে হবে। তাই আমরা আর গোসল না করে হাতমুখ ধুয়েই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা ঠিক করে রাখা হয়ে ছিলো ঠিক পাশের খাবার হোটেলটাতে। দুপুরে খেলাম ভাত, আলু ভর্তা, মুরগি আর ডাল। সাথে শশা, লেবু আর কাঁচা মরিচ। আমি ঝালের চোটে তেমন কিছুই খেতে পারছিলাম না। যাই হোক খেয়েদেয়ে আমরা রুমে ফিরে আসলাম। মার্জিয়া আর অন্তরা বাদে আমরা বিছানায় শুয়ে লম্বা হয়ে রেস্ট নিলাম সবাই। আগের রাতে হতচ্ছাড়া বাসের ঝাঁকুনিতে কেউ এক দন্ডও চোখের পাতা এক করতে পারে নাই। এখন একটু বিশ্রাম না নিলেই নয়।

ঠিকঠাক চারটার সময় আমরা সবাই বের হয়ে পড়লাম। আগের মত চান্দের গাড়িতে করে উঠে রওয়ানা দিলাম কংলাক পাড়ার দিকে। এবার অনেকেই উঠে বসলো গাড়ির ছাদে। একটু দূর গিয়ে গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিলো। বাকিটা পথ হেঁটে যেতে হবে। বাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে আমরা হাঁটতে লাগলাম। বিকালের লাল রঙয়ের রোদে পাহাড়্গুলোকে পুরো ছবির মতন লাগছিলো। আমার এক পাহাড়ের ছায়া অন্য পাহাড়ের গায়ে পড়াতে বেশ চমৎকার এক আলো ছায়ার খেলা দেখা যাচ্ছিলো। আমরা সেদিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে হাঁটতে লাগছিলাম। হঠাৎ কতগুলো ছোট ছোট বাচ্চা ছোট ছোট বাঁশের লাঠি নিয়ে দৌঁড়ে আসলো। আমরা পাঁচ টাকা করে একেকটা লাঠি কিনে নিলাম। বেশ অভিযাত্রীর ভাব নিয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম। একটু পর শুরু হলো পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠা। একে তো হাঁটতে হাঁটতে আমাদের অনেক পরিশ্রম হচ্ছিলো তার উপর খাঁড়া পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে আমরা পুরাই ক্লান্ত হয়ে গেলাম। এই কংলাক পাড়া হচ্ছে সাজেকের সবচেয়ে উঁচু জায়গা। এত কষ্ট করেও কেন মানুষ এইখানে উঠে টের পেলাম উপরে উঠে। এক দৃষ্টিতে যখন তাকিয়ে ছিলাম বিকালের রোদের রঙে রঙ্গিন হয়ে যাওয়া পাহাড়গুলোর দিকে, অনেকক্ষন কোন কথা বলতে পারলাম না। নিশাতকে দেখলাম ক্যামেরা বন্ধ করে ফেলতে। কি লাভ? এই দৃশ্য কোনদিনও ক্যামেরায় ধরে রাখা সম্ভব না। আমাদের সাথে চান্দের গাড়ির দুজন হেল্পার সব সময় ছিলো। ওনারা বললো আরও একটু উপরে উঠেন, সূর্যাস্ত দেখবেন না? আমরা উনাদের ফলো করে লুসাই, টিপরা উপজাতিদের ঘরবাড়ি পার হয়ে আরও উঁচু এক জায়গায় এসে পৌঁছালাম। মনে হলো ক্যানভাসের উপর অস্তগামী সূর্যটা যেন কমলা রঙের বোতল উপুড় করে আকাশের গায়ে রঙ ঢেলে দিয়েছে। সেই রঙের প্রতিফলিত হয়ে ছিটকে পড়ছে ঐ দূরের অবাস্তব পাহাড়গুলোর গায়ে। দৃশ্যটা এতই মনোমুগ্ধকর যে সবাই চুপ হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম, বুঝতে হবে এ তো আর যে সে শিল্পীর ক্যানভাস নয়, এ স্বয়ং আল্লাহর ক্যানভাস। মানুষের সাধ্য কি এই দৃশ্য নকল করার?

কমলা সূর্যটা টুপ করেই ডুবে যাচ্ছিলো (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী)

ওদিকে আমরা গ্রুপ ফটোর জন্য রেডি হতে হতেই সূর্যটা টুপ করে হারিয়ে গেলো আকাশের মাঝে। সূর্য ডুবতেই আমাদের টনক নড়লো। এই পাহাড়ি পথে আমাদের এখন ফেরত যেতে হবে। আমরা তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলাম। আলো থাকতে থাকতেই খাড়া পাহাড়টা বেয়ে নিচে নেমে পড়লাম। তারপরও কোন থামাথামি না করে ছুটতে লাগলাম। অনেক দূর হেঁটে যখন আমরা মোটামুটি ভালো রাস্তায় এসে পৌঁছালাম, তখন দেখলাম আকাশে এক বিশাল গোল চাঁদ। যদিও পরেরদিন পূর্নিমা তারপরও এত বিশাল চাঁদ কেবল ইংলিশ সিনেমাতেই দেখা যায়। আমরা হাঁ করে দেখতে লাগলাম চাঁদটাকে। পাহাড়ের ধারের জংলার ফাঁক দিয়ে দেখা সেই বিশাল চাঁদ তার ধবধবে জোসনা দিয়ে মূহুর্তেই সব আলোকিত করে দিলো। একপাশে বিশাল চাঁদ, অন্য পাশে আকাশের গায়ে লেপ্টে থাকা কমলা রঙ দেখতে দেখতে আমার মনে হলো আমি বোধহয় এই মূহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। এত সুখ কেন জীবনে?

পাহাড়ী চাঁদ (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম)
পাহাড়ী চাঁদ (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম)

চান্দের গাড়িতে যখন উঠলাম, একটু একটু ঠান্ডা লাগতে শুরু করলো। আমাদের আবার নামিয়ে দেওয়া হলো হেলি প্যাডে। বিশাল হেলি প্যাডে দাঁড়িয়ে পরিষ্কার আকাশে বিশাল চাঁদটা দেখে আমাদের মনে হলো আমাদের বোধহয় মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আমি উপরে তাকিয়ে দেখলাম বিশাল আকাশ জুড়ে কোটি কোটি তারা। এত তারা জীবনে দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। ঠান্ডা বাতাসে আমাদের সব ক্লান্তি নিমেষেই দূর হয়ে গেলো। আমরা পাগলের মত ছবি তোলার চেষ্টা করে যেতে লাগলাম সেই চাঁদের আলোয়। সৃষ্টি ধৈর্য ধরে আমাদের সকল পাগলামি ক্যামেরা বন্দি করার চেষ্টা করে যেতে লাগলো। আমরা তারপর সারি ধরে বসে গান গাইতে শুরু করলাম। যখন সৃষ্টি ধরলো, ‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে/ বসন্তেরই মাতাল সমীরনে’ তখন মনে হলো আমি বুঝি কোন এক রূপকথার রাজ্যে এসে পড়েছি। এত সুন্দর একটা দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য দান করার কারণে আল্লাহকে মনেমনে ধন্যবাদ জানালাম।

ওদ
বিশাল একটা চাঁদের নিচে বসে তখন আমাদের মাথা খারাপ অবস্থা            (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম)

আমরা সেখান থেকে আলো রিসোর্টে পৌঁছে চা, চিপস, কেক খেতে খেতেই খবর পেলাম আমাদের রাতের খাবার রেডি। এখানকার লোকাল কেকগুলো খেতে খুবই মজা। দেখতে পিঠার মত, খেতে কেকের মত। জাফর এসে জানালো আমাদের প্ল্যান মত বার বি কিউ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। আগের মেনুই দিলো রাতের বেলা। খেয়ে দেয়ে সবাই কয়েক কদম হেঁটে আসলাম ফুটপাথ বিছানো চওড়া পাকা রাস্তাটা ধরে। চাঁদের আলোয় সব কেমন যেন অপার্থিব লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো বিশাল এক লাইট কেউ জ্বেলে দিয়েছে। দূরের মিজোরামের পাহাড়গুলোও রহস্যময় লাগতে লাগলো। কি সুন্দর পথ, শুধু আমরা ছাড়া আর কেউ নাই! মনে হচ্ছিলো হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই দূরে কোথাও। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয় তাই আমরা তাড়াতাড়ি ফেরত আসলাম। আমি তারপর রুমে ফিরে শুয়ে পড়ার বন্দোবস্ত করতে লাগলাম। অনেকক্ষন পর যখন সবাই রুমে ফেরত আসলো, লাইট নিভিয়ে আমরা ঘুমাতে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ঘুমাতে আর পারছিলাম কই? পাশের রুমের বোর্ডাররা সারা রাত বিকট স্বরে নাক ডেকেই যেতে লাগলো। আমরাও ঘুমানোর চেষ্টা বাদ দিয়ে অন্ধকারে চরম হাসাহাসি করতে লাগলাম।

মে
মেঘ যখন পায়ের নিচে (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী)

পরদিন ভোরে আমি, নিশাত আর পৃথ্বী বাদে বাকি সবাই সূর্যোদয় দেখতে গেলো। আমি পরে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম হোটেলের দরজা দিয়েই দেখা যাচ্ছে আমি যে লেভেলে দাঁড়িয়ে আছি, তার অনেক নিচে জমে আছে তুলা তুলা মেঘ। পাহাড়গুলো অর্ধেক যেন হারিয়ে গেছে তুলা তুলা মেঘের সারির পিছনে। আমি দেখে থ হয়ে গেলাম। যারা সূর্যোদয় দেখতে গিয়েছিল তাদের কাছ থেকে বর্ণনা শুনে বেশ আফসোস লাগলো। আমরা নাস্তা খেতে গেলাম। লুচি, ভাজি, অমলেট আর চা। পেট ভরে খেয়ে আমরা উঠে পড়লাম। আবার রওয়ানা দিলাম চান্দের গাড়িতে চড়ে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে।

এবার আর কোন থামাথামি নাই। টানা চলতে লাগলাম আমরা। ঠিক যেই পথ দিয়ে এসেছি, সেই পথ দিয়ে ফেরত গেলাম। তিন ঘন্টা পর আবার সেই খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউজে এসে নামলাম আমরা। আবার ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এরপর একটু বিশ্রাম নিয়েই বের হলাম সিস্টেম রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে। বাঁশ কাঠের ইন্টেরিয়র করা রেস্টুরেন্টটাতে আমরা সবাই মিলে অর্ডার দিলাম অনেক কিছুই। পোলাওর চালের নরম ভাতের সাথে বাঁশ কুড়ুল, লাউ চিংড়ি, মাশ্রুম, হাঁসের ভুনা, থাঙ্কুনি পাতার ভর্তা, শুটকি ভর্তা, ডাল সবই খেয়ে দেখলাম। বাঁশটা সবচেয়ে মজা ছিলো। আমার কাছে বেশ ভালোই লাগলো খেতে। খেয়েদেয়ে আমরা রওয়ানা হলাম আলুটিলা গুহার উদ্দেশ্যে।

আলুটিলার গেটে পৌঁছে আমরা ৫ টাকার টিকেট আর ১০ টাকার মশাল কিনলাম। মশালটা আসলে কিছুই না, বাঁশের আগায় কেরসিন মাখানো পাটের দড়ি। তারপর সোজা হাঁটা ধরলাম। মোটামুটি ২৬৬ টা সিঁড়ি ভেঙ্গে পৌঁছালাম গুহা মুখে। গুহা মুখে পৌঁছে আমরা জাফরের দেয়াশলাই থেকে মশাল ধরিয়ে নিলাম। খুবই হাস্যকর মশাল। ঝিরঝির পানির উপর দিয়ে যখন গুহা পথে ঢুকলাম মুখ দিয়ে বিস্ময়ের এক আর্ত চিৎকার অটোমেটিক বের হয়ে আসলো। এ তো যেন কোন হলিউডি সিনেমার গুহার ভিতর ঢুকে পড়েছি। কিংবা তিন গোয়েন্দার আটকে পড়া গুহাগুলো তো এইরকমই ছিলো। আমি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে আগাতে শুরু করি। ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এর মধ্যে আমার মশালটা টুপ করে নিভে গেলো। অন্ধকারে পানির ধারা আর বড় বড় পাথরের চাঁই পার হতে হতে একরকমের গা ছমছমে অনুভূতি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আমরা বেশ হৈচৈ মজা করে একে অন্যকে সাহায্য করে আগাতে লাগলাম। গুহার ভেতর কোথাও কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোথাও কোমর পানি, কোথাও কোথাও সরু পথ, কোথাও এত নিচু ছাদ যে কুঁজো হয়ে হাঁটতে হয়। খাগড়াছড়ি টুরের বেস্ট পার্ট মনে হলো আমার এই গুহা দর্শন। প্রায় পনের বিশ মিনিট পর আমরা সূর্যের আলো দেখতে পেলাম। লতা পাতা আর শ্যাওলা জাতীয় গাছে ঢাকা গুহা মুখটা অত্যন্ত সুন্দর ছিলো। বের হয়ে ভাবলাম বাংলাদেশে এত সুন্দর একটা গুহা আছে কল্পনাই করতে পারি নাই। ভেজা আর কাদা মাখা জামা কাপড় নিয়ে আমরা একটু পানি খেয়েই ফেরার পথ ধরলাম। ফেরার পথে দেখতে পেলাম পাহাড়ের উপর থেকে অত্যন্ত সুন্দর খাগড়াছড়ি শহর। মনে হলো যেন সিমলা শহরের ছোট ভার্সন দেখছি।

দ্ব
দারুণ অ্যাডভেঞ্চারের আলুটিলা গুহার শেষ মাথায় দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী

আমরা দৌড়ে দৌড়ে চান্দের গাড়িতে উঠলাম। অবস্থা এমন হলো যে আমার গাড়িতে শুধু আমিই একমাত্র ভিতরে বসে আছি, বাকি সবাই উপরে। যাই হোক পনের মিনিটের মধ্যে গিয়ে পৌঁছালাম রিসাং ঝর্ণার কাছে। অনেক ঢাল বেয়ে গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিলো। আমরা হেঁটে হেঁটে বেশ খাড়া ঢালু পথ দিয়ে দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে নামতে লাগলাম। আসলে দৌড় দিচ্ছিলাম না। পথটা এতই খাড়া ছিলো যে হাঁটাটা অটোমেটিক দৌঁড় হয়ে যাচ্ছিলো। মারজিয়া দৌড় কন্ট্রোল করতে না পেরে হিমির সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়েই গেলো। যাই হোক আমরা লাইন ধরে নামতে লাগলাম। একটা বাঁক পার হওয়ার পর পরই তানভীর আমাদের দেখালো রিসাং ঝর্না। আমরা উপর থেকে দেখলাম অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট একটা ঝর্না। অদ্ভূত ব্যাপার হচ্ছে ঝর্নাটা গিয়ে পড়েছে পুরাই ঢালু হয়ে যাওয়া পাথরের দেওয়ালের উপর। দেখতে অনেক সুন্দর লাগছিলো ঝর্নাটা। কিন্তু সেই ঝর্ণাটা কাছ থেকে দেখা আমাদের আর কপালে ছিলো না। সেই মূহুর্তেই খবর পেলাম আমাদের একটা চান্দের গাড়ি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়েছে। ভয়ানক এই কথা শুনে আমরা হতবাক হয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি যেই পথে নেমেছি সেই পথে উঠতে শুরু করলাম। পরিশ্রমের ঠ্যালায় জিহ্বা বের হয়ে গেল। তারপরও যথাসাধ্য পা চালিয়ে উপরে উঠে এলাম। এসে দেখলাম খবর সত্যি। একটা গাড়ির হেল্পার মাতবরি করে গাড়ি পার্ক করতে গিয়েছিলো। কিন্তু পাহাড়ের ঢালে সে কন্ট্রোল রাখতে পারে নাই। গাড়ি ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গেছে আর উনি লাফ দিয়ে বের হয়ে গেছেন। দেখলাম লোকটা শুয়ে আছে। হাতে, গলায় আর কোমরে মারাত্মক চোট। ব্যাথার চোটে মুখটা লাল হয়ে গেছে। আশেপাশের লোকজন উৎসাহী হয়ে দেখতে আসছে গাড়িটা। উপজাতি কয়েকজনকে দেখলাম তরতর করে পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে নেমে যেতে। শেষমেশ আমরা আর কোন অপশন না পেয়ে এক গাড়িতেই সবাই চাপাচাপি করে ফেরার পথ ধরি।

সার্কিট হাউজে ফিরে এসে দেখি কারেন্ট নাই। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা বসে ছিলাম। বারান্দায় বের হয়ে দেখি আকাশে ফানুস ওড়ানো হচ্ছে। আজ প্রবারনা পূর্ণিমা। কাছেই একটা মন্দির থেকে ওড়ানো হচ্ছে রঙ্গিন ফানুস। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে লাগলাম বিশাল চাঁদ, হাজারও ঝিকিমিকি তারার সাথে ফানুসের ওড়াওড়ি। সাড়ে সাতটার দিকে খেতে গেলাম সার্কিট হাউজের পাশেই বিসমিল্লাহ হোটেলে। অর্ডার দিলাম নান আর সবজি। শেষমেশ চা খেয়ে বের হলাম সেই দোকান থেকে। আমি, লিয়া, মারজিয়া, সৃষ্টি, সুমাইয়া, সুহাইলা মিলে অটো ভাড়া করে রওয়ানা দিলাম বাজারে। উদ্দেশ্য কিছু ফলমূল কেনা। হাতে সময় খুব অল্প। এরই মধ্যে তাড়াহুড়া করে আমরা সবাই মিলে তেঁতুল, কমলা, ডাব, কলা, পেপে, জাম্বুরা কিনলাম। সবই দরাদরি করে কিনতে হলো। সময় থাকলে ঠান্ডা মাথায় কেনা যেত। কিন্তু নয়টায় বাস ছাড়বে, কি আর করা!

তাড়াহুড়া করে সার্কিট হাউসে পৌঁছে লোডশেডিঙের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে ব্যাগটা নিয়েই আবার নেমে পড়ি। আবার অটোতে উঠে শাপলা চত্বরের কাছে বাস কাউন্টারে নেমে পড়ি। ঠিকঠাক সময় মতই বাস ছেড়ে দেয়। এই বাসটা আগের বাসের মতন লক্কর ঝক্কর না। জার্নিটা ভালোই হবে এই আশায় ভালো করে শাল জড়িয়ে ঘুম দেওয়ার প্রিপারেশন নেই। মনে মনে বলি ‘বিদায় খাগড়াছড়ি’।

 

ক্যামেরাবাজীঃ যেভাবে আসলো ক্যামেরা

শুরুতেই বলে নেই, যারা শিরোনাম পড়েই আমাকে পাঁড় ফটোগ্রাফার মনে করছেন তারা আসলে বিশাল ভুল করছেন। আমি মোটেও কোন জাতের কিছু নই। হ্যাঁ ক্যামেরা নিয়ে ক্লিক ক্লিক করতে ভালোই লাগে। তবে সেই ক্লিক ক্লিকের ফলাফলগুলো আমার হার্ড ডিস্কেই সীমাবদ্ধ। তবে আগ্রহের কারণে পাঠশালায় একটি ফটোগ্রাফিক কোর্সে ভর্তি হয়েছি। প্রথম ক্লাসে ফটোগ্রাফির ইতিহাস জেনেই আমি মুগ্ধ। এইজন্য যাদের আগ্রহ আছে তাদের বলছি, ফটোগ্রাফির ইতিহাস জানাটা খুবই জরুরি। এই লিখা পড়ে ইতিহাস বোরিং লাগলে সেটা সম্পূর্ণ আমার দোষ, মোটেও ইতিহাসের দোষ নয়।

সম্পূর্ণ ঘরকে ঘুটঘুটে অন্ধকার করে দেয়ালে ছোট্ট একটা ফুটা করলে বাইরের পুরো দৃশ্য প্রতিফলিত হয়ে দেয়ালজুড়ে ঘরের ভেতর চলে আসে, অনেকটা প্রজেক্টরের মাধ্যমে আমরা যেরকম দেখি ঠিক সেরকম। যারা আমার কথা বিশ্বাস করছেন না তারা গুগলে camera obscura লিখে সার্চ দিন।  আমি কয়েকদিন আগেও এই ব্যাপারটা জানতাম না। তবে পরে মনে করে দেখলাম এই জিনিসটা স্কুলে থাকতে ফিজিক্স বইয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ব্যাপারটা যে এতই চমৎকার তা ধরতে পারি নাই। পড়ার দরকার ছিলো তাই গড়গড় করে পড়ে গিয়েছিলাম। তবে মনে হতে পারে ‘ক্যামেরাবাজী’টাইটেল দিয়ে এইসব ফালতু প্যাচালের অর্থ কি?

আসল ঘটনা হলো এইটাই ক্যামেরার বেসিক প্রিন্সিপাল। অবাক হয়ে গেলাম যখন শুনলাম এরিস্টটলের আমল থেকেই মানুষ এই তত্ত্বটা জানতো। তারা রিফ্লেকশনের সাহায্যে বাইরের দৃশ্য ঘরের ভিতরে দেখার পদ্ধতিটা জানতো কিন্তু কিভাবে ছবিটা রেকর্ড করে রাখতে হয় সেই পদ্ধতি তারা জানতো না। তারপর আবিষ্কার হয় লেন্স। লেন্সের সাহায্যে দেয়ালজুড়ে থাকা বিশাল প্রতিফলনকে ছোট করে ফেলা সম্ভব হয়। এতে শিল্পীদের ছবি আঁকার রেফারেন্স নিতে সুবিধা হয়।

 সর্বপ্রথম জোসেফ নিসেফর নিপ্স ১৮২৬ সালে ফটোসেন্সিটিভ ক্যামিকেল ব্যবহার করে ১০ ঘন্টা ধরে এই ছবিটি তোলেন। বলা হয়ে থাকে এটিই পৃথিবীর প্রথম ছবি।

লুইস ড্যাগুয়ের ১৮৩৯ সালে প্যারিসের রাস্তার তুলনামূলক পরিষ্কার ছবিটি তোলেন। সময় লাগে ১০ মিনিট। তিনি image capture করারপদ্ধতি ঘোষণা করেন। তার ছবি তোলার পদ্ধতিকে ড্যাগুয়ের টাইপ নাম দিয়ে ফরাসী সরকার সত্ব কিনে নেয়।

ছবিটা দেখে মনে হতে পারে যে প্যারিসে হয়তো সেদিন হরতাল ছিলো, কেমন যেন সুনশান নীরব রাস্তা। কিন্তু বিষয় আসলে তা নয়। আসল ঘটনা হলো ছবিটা তুলতে সময় লেগেছে ১০ মিনিট। তার অর্থ হচ্ছে ১০ মিনিট ধরে যে জিনিস স্থির থাকবে ক্যামেরায় শুধু তার ছবি উঠবে। তবে একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে ফুটপাতে একটা পা উঁচু করা মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে । মনে হচ্ছে তিনি সেদিন বুট পালিশ করতে এসেছিলেন। বুটপালিশ করতে এসে এক পা উঁচু করে নিশ্চয়ই ১০ মিনিট স্থির দাঁড়িয়েছিলেন। কি ভাগ্য উনার, বুট পালিশ করতে এসে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন!

প্রায় একই সময়ে উইলিয়াম হেনরী ফক্স ট্যালবট ভিন্ন উপায়ে image capture করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তার পদ্ধতিকে বলা হয় ক্যালো টাইপ

ফরাসী সরকার ড্যাগুয়ের টাইপ উন্মুক্ত করে দেয় ফলে এই পদ্ধতির দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তখনকার দিনে মানুষ নিজের চেহারার সত্যিকার ছবি দেখার জন্য দলে দলে স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তুলতে শুরু করে। যদিও ছবি তুলতে সময় লাগতো ১০ মিনিট কিন্তু তাতে কি, পোর্ট্রেট তোলা হু হু করে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। শুধূ নিজের নয়, বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সাথে ছবি তোলারও চল আসলো। কিন্তু ১০ মিনিট ধরে সময় লাগার কারণে ক্যামেরার প্রতি মনোযোগ স্থির রাখা সম্ভব হতো না। এজন্য আগেকার দিনের ছবিতে সবার চোখের দৃষ্টি থাকতো আনমনা।

ছবি তোলা জনপ্রিয় হওয়ার সাথে সাথে একই ছবির একাধিক কপির প্রয়োজন হয়। এখানেই ছিলো ড্যাগুয়ের টাইপের দূর্বলতা। এই পদ্ধতিতে ছবির কপি করা সম্ভব ছিলো না। অনেকটা ‘ওয়ান পিস মেড কারিগর ডেড’ টাইপের। অন্যদিকে ক্যালো টাইপে ছবির কপি করা সম্ভব ছিলো। তাই ধীরে ধীরে ক্যালো টাইপ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

উনিশ শতকে মূলত পোর্ট্রট, ট্রাভেল ফটোগ্রাফী, ওয়ার ফটোগ্রাফীর বেশি প্রচলন ছিলো। সেই সময়ের বিখ্যাত কয়েকজন পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফার হলেন,

                                                      ডেভিড অক্টাভিয়াস হিল

 

ফেলিক্স নাদারইনি সব বিখ্যাত মানুষদের ছবি তুলতেন।

জুলিয়া মার্গারেট ক্যামেরুন

 

বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ, আর্কিওলজিকাল রিসার্চ, হিস্টোরিক ডকুমেন্ট সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ট্রাভেল ফটোগ্রাফীর প্রচলন বাড়ে। তবে ভ্রমনে ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া মানে এক এলাহি কান্ড। একজন ক্যামেরা নাও্‌, একজন ট্রাইপড নাও, একজন ডার্ক রুম বানানোর তাঁবু নাও, এক জন নাও ওয়াশ করার জন্য ক্যামিকেল …মানে এক বিরাট দল। এই সব লটবহর নিয়ে ভ্রমন করার সামর্থ যাদের থাকতো তারাই শুধু ছবি তুলতে পারতো।

 

তখনকার দিনের যুদ্ধের ছবির সাথে এখনকার দিনের যুদ্ধের ছবির অনেক তফাত। সেইসব ছবি অনেক স্টিল এবং ফ্রোজেন, অর্থাৎ যা ঘটনা ঘটার তা অলরেডি ঘটে গেছে। তার কারণ ছিলো তখনকার দিনে একটা ছবি তুলতে ১০ মিনিট সময় লাগতো আর ছবি তুলে ডার্ক রুম বানিয়ে সাথে সাথে ওয়াশ করতে কম হ্যাপা হতো না। তাই সব ছবিই ছিলো যুদ্ধের আগের বা পরের মুহুর্তের।

 

 

      

১৮৮৮ সালে জর্জ ইস্টম্যানের কোডাক বক্স ক্যামেরা সারা পৃথিবীতে হৈচৈ ফেলে দেয়। এটাই প্রথম সহজে বহনযোগ্য, সর্ব সাধারণের জন্য সহজসাধ্য ক্যামেরা। কারণ এই ক্যামেরায় ১০০টা ফিল্মের রোল ব্যবহার করা হয় যা দিয়ে ছবি তোলার পর পর ক্যামেরাটি কোম্পানির ঠিকানায় পোস্ট করে পাঠালে কোম্পানি ১০০টা ছবি ওয়াশ করে আবার নতুন একটা রোল ভরে পুনরায় গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতো। এক্ষেত্রে ফটোগ্রাফারকে নিজে ডার্ক রুম বানিয়ে গাদা গাদা ক্যামিকেল দিয়ে আর ছবি ওয়াশ করতে হত না। ফলে পুরো পদ্ধতি অনেক সহজ হয়ে গেলো।

ধীরে ধীরে ক্যামেরার প্রসারের সাথে সাথে ডকুমেন্ট হিসেবে, সমাজ পরিবর্তনের সাক্ষী হিসেবে, যুদ্ধের সাক্ষী হিসেবে এবং ফটোসাংবাদিকতার মাধ্যম হিসেবে ফটোগ্রাফীর প্রচলন বাড়ে।

 

 

       

ইউজিন অ্যাটগেট ফটোগ্রাফ তুলে ডকুমেন্টেশন করে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি শিল্পী, স্থপতি, গবেষকদের জন্য ছবি তুলতে তুলতে বিশাল সংগ্রহ গড়ে তুলেন।

 

আরেকজন হচ্ছেন অগাস্ট স্যান্ডার। ইনি তুলতেন সোশাল পোর্ট্রেট। তার কর্মকান্ডের কারণে নাৎসি সরকার বিরক্ত হয়ে বহু ছবি পুড়িয়ে ফেলে। পরে তার বন্ধু, আত্মীয়দের কাছ থেকে পাওয়া ছবিগুলোই আমরা দেখতে পাই।

 

লেউইস হাইন তুলতেন শিশু শ্রমিকের ছবি।

  

 নানা রকম ছলে বলে কৌশলে তিনি কারখানায় ঢুকে ছবি তুলতেন। আমেরিকার চাইল্ড লেবার অ্যাক্ট প্রনয়নে তার তোলা ছবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তার একটি বিখ্যাত উক্তি, ”Photographs may not lie, liers may photograph”

 

 

অ্যান্সেল ইস্টন অ্যাডামস আবার প্রকৃতির ছবি তুলতেন।

 

 

অন্য সবার চাইতে হেনরি কারটিয়ার ব্রেসন ভিন্ন ধারার ছবি তুলতেন। তিনি একাধারে শিল্পী, দার্শনিক, ফটোগ্রাফার ছিলেন। তার ছবিতে চমৎকার কম্পোজিশনের সাথে বিশেষ মুহুর্তের ছোট্ট একটি গতিময় পোশ্চার থাকে যা পুরো ছবিকে প্রাণ দেয়।

মার্গারেট বোর্ক হোয়াইট ছিলেন প্রথম নারী ওয়ার ফটোগ্রাফার। ডরোথা ল্যাংগে, জো রোসেন্থাল, এডি অ্যাডাম, জর্জি জেলমা সবাই যুদ্ধ এবং সাংবাদিকতা বিষয়ক ফটোগ্রাফার ছিলেন। 

বিদেশি প্যাঁচাল তো অনেক হলো, এবার আসি দেশের কথায়। যদি আপনি মনে করেন আমরা অশিক্ষিত মূর্খ জাতি, আমাদের আবার ফটোগ্রাফির ইতিহাস কিতাহলে ভুল কবেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮৪০ সাল থেকেই ক্যামেরা চালু হয়ে যায়। না না আপনি কিন্তু ভুল পড়েন নি। সেই ১৮৪০ সাল থেকেই এখানে ছবি তোলার প্রচলন শুরু হয়ে যায়। তখন মূলত রাজাজমিদারেরাই ছবি তুলতেন। সেই যুগের ফটোগ্রাফার হচ্ছেন রাজেন্দ্র মিত্র। অন্নপূর্ণা দত্ত হলেন সেই যুগের প্রথম পেশাদার নারী ফটোগ্রাফার।

বাংলাদেশের বিখ্যাত ফটোগ্রাফাররা হচ্ছেন গোলাম কাশেম ড্যাডি, মনসুর আলম বেগ, রশিদ তালুকদার, নায়েব উদ্দিন আহমেদ, বিজন সরকার ইত্যাদি। সায়েদা খানম হচ্ছেন পেশাদার প্রথম বাংলাদেশি নারী ফটোগ্রাফার। আরও আছেন আমানুল হক, আনোয়ার হসেন, শহিদুল আলমসহ অনেকেই। 

                                            

গোলাম কাশেম ড্যাডি                                                          রশিদ তালুকদার

                         

আনোয়ার হোসেন                                                   শহিদুল আলম