‘স্কাল্পচার সেন্টার’ – যা মনে প্রশ্ন জাগায় হোয়াট ইজ আর্কিটেকচার???

যে দিন আমরা ‘স্বরচিত সেবতী’ নামক বাড়িটার উপর রিপোর্ট করে প্রথম দফা জমা দিলাম, সেই দিনই নতুন প্রজেক্ট ঘোষণা করা হলো, ‘স্কাল্পচার সেন্টার’ যার সাইট ধানমন্ডিতে। পরদিন হরতালের মধ্যে পড়িমড়ি করে ছুটে গেলাম সাইট দেখতে। সেই থেকে শুরু হলো আমার স্কাল্পচার সেন্টারের পথ চলা। শুরুতেই স্টুডিওতে রিয়াদ স্যারের স্বপ্নময়ী আইডিয়া শুনে পুরা মাথাটা আউলে গেলো। যেই ফর্ম চিন্তা করি, সেটাই অর্ডিনারি মনে হয়। অনেক কষ্টে কাবজাব ওয়ালা একটি চোঙ্গা সদৃশ ফর্ম নিয়ে হাজির হলাম। স্যারের কথায় সেই ফর্ম ঝড়ো হাওয়ার মতই উড়ে গেলো। আবার শূন্য অবস্থায় ফেরত আসলাম। তারপর যেই ফর্ম বানালাম, সেটা দেখে আশেপাশে সবাই বললো, ‘স্মৃতি সৌধ থেকে ইন্সপিরেশন নিয়েছো বুঝি?’ যা হোক মোটামুটি নিজের সেই ফর্মটা নিজের কাছে ভালোই লাগে। এরপর পরের স্টেপ ফাংশন সলভ করতে শুরু করলাম। শুরু করতে গিয়েই বুঝলাম এই ফর্মে আদৌ ফাংশন ঢুকানো সম্ভব না। তবুও পড়ে রইলাম সেই ফর্ম নিয়ে, কিছু একটা করেই ছাড়বো। এইভাবে কেটে গেলো প্রায় দুই সপ্তাহ। শূন্য এক ফর্ম নিয়ে পাগল পাগল হয়ে ঘুরি, সমাধান পাই না, আইডিয়া পাই না..
তারপর একদিন স্টুডিওতে আসলেন শাহেদা ম্যাডাম। ম্যাডাম এসে এমন এক লেকচার দিলেন, যা শুনে আমি ডিসাইড করি, অনেক হয়েছে আর না। নতুন ফর্ম চাই, তবে আগের চাইতে সহজ এবং সাধারণ। বাসায় এসে সব নতুন করে ডিসাইড করি- সেই বাবল ডায়াগ্রাম, সেই স্কেমেটিক ডায়াগ্রামে ফেরত যাই। পুরাই জিরো থেকে শুরু করি। আবার যাই স্টুডিওতে স্যারদের দেখাতে। সিরিয়াল অনুসারে বাঁধন ভাইয়াকে ডিজাইন দেখাতে যেতে হয়, কিন্তু সাইটের উপর প্ল্যান না এঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেদিন তিনি ডিজাইন দেখেন না। পরদিন কোন এক কারণে সরকারী ছুটি থাকলেও ডিপার্টমেন্টে আমাকে যেতে হয় ডিজাইন দেখানোর জন্য। মোটামুটি রকম কমেন্ট আর রেফারেন্স পেয়ে যখন বের হয়ে আসি, তখন মনে এক ধরনের ফুরফুরে আনন্দ। যাক, আমার ডিজাইন প্রসেস দেরিতে হলেও শুরু হয়েছে।
কিন্তু আটকা পড়ি পরের সপ্তাহে। আগের ফর্ম আর কিছুতেই বাঁধন ভাইয়ার পছন্দ হয় না। বারবার ফর্ম ভেঙ্গে ফেলার পরামর্শ আসে। তারপর সাহস করে ফর্ম ভেঙ্গেই ফেলি। তৈরি হয় অতি জটিল ফর্ম। ভয়ানক ত্যাড়াব্যাকা। ফাংশন সলভ করতে গিয়ে হিমশিম খাই। তারপর আবার দেখাই, এবারও ফর্ম ওনার পছন্দ হয় না। জটিল ত্যাড়াব্যাকা ফর্মের কুফল বুঝতে পারি এবং আবার ফর্ম বদলে ফেলার পরামর্শ পাই। জমার এক সপ্তাহ আগে এরকম পরামর্শ পেয়ে হতাশা চেপে ধরে আমাকে। সাহস করে রিয়াদ স্যারকে দেখালেও তিনিও ফর্ম সহজ করে বদলে ফেলার একই পরামর্শ দেন। আবার সিদ্ধান্ত নেই প্রথম টাইপের ফর্মে ফিরে যাবো, যা চেঞ্জ করার সেটাতেই করবো। শুরু হয় পি. এল.। ক্লাশ খুললেই শনিবার জমা। তার আগের রবিবার আমি শেষবারের মত প্রিলি দেখাতে যাই। সেদিনও ফর্ম চেঞ্জ হয়, রুফ নিয়ে নতুন আইডিয়া পাই। রিকয়ারমেন্ট অনুযায়ী ড্রইং করতে গিয়ে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। এত ড্রইং শেষ করে মডেলসহ শনিবার জমা দেওয়া সম্ভব না।
যাই হোক নাক মুখ গুঁজে ড্রইং করতে থাকি। দিন যায়, রাত আসে, রাত যায়, দিন আসে, কিন্ত কাজ আর শেষ হয় না। শুক্রবার রাতে পাগলের মত কাজ করে সকাল বেলা বুয়েটে গিয়ে দেখি বাঁশ ফেলে গেট ব্লক করা। কোন মতে ভিতরে ঢুকে দেখি সাবমিশন ক্যান্সেল। জানে পানি ফেরত আসে। আবার সব কিছু গুছিয়ে বাসায় আসি। গোসল করে, খেয়ে দেই ঘুম। সন্ধ্যাবেলা ডিপার্টমেন্টে আসি, পরদিন পহেলা বৈশাখের কাজ করার জন্য। সব ব্যাচ ধুমসে কাজ করছে, শুধু আমাদের ব্যাচ এতিমের মত ঘোরাঘুরি করছে- আমাদের কোন প্রিপারেশন নাই, প্ল্যান নাই, কিছুই নাই। অনেক কষ্টে এক খানা স্ট্রাকচার জোড়াতালি দিয়ে মাস্কট বানানো হলো। পরদিনও সেই একই অবস্থা। সব ব্যাচেরই সবাক অংশগ্রহন আছে, খালি আমরা কিছুতেই নাই। যাই হোক, বেশ রাত পর্যন্ত কনসার্টে থেকে বাসায় আসি।
পরদিন খবর পাই আজকে জমা। আবার মাথায় বাজ পড়ে। তাড়াতাড়ি ড্রইংয়ের শুরু করি। খানিক বাদেই খবর পাই, আজকে জমা দেওয়া সম্ভব না। আবার খানিক বাদেই খবর পাই আজকেই হবে জমা। সব মিলিয়ে মাথায় তখন দেড়শ টনের চিন্তা। যাই হোক অনেক কষ্টে আমরা আবার স্যারদের বলে কয়েকটা দিন সময় বাড়াই।

তারপর শুরু হয় সেই লেভেলের কোপা জুরি- যাকে বলে রক্তাক্ত অবস্থা।শাহেদা ম্যাডামের চরম কোপ খেয়ে কয়েকজন ছাড়া আমরা অধিকাংশই মাটির সাথে মিশে গেছি।দীর্ঘ দেড়-দুই মাসের সাধনা পুরস্কারের বদলে তিরস্কার উপহার দেওয়ায় বিষন্নতার ছায়া নেমে আসে জীবনে। এক বুক হতাশা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগে হোয়াট ইজ আর্কিটেকচার??? 

সবচাইতে মজার ব্যাপার হয় টার্ম শেষে যখন আমাদের গ্রেড টানানো হয় তখন অবাক হয়ে আমরা জানতে পারি যে আমাদের স্কাল্পচার সেন্টারের টোটাল গ্রেড, ফাইনাল প্রজেক্ট কমার্শিয়াল ব্যাংকের একটা প্রিলির গ্রেডের সমান গুরুত্ব পেয়েছে। তাহলে এই দেড় দুই মাস পাগলের মত খেটে, পহেলা বৈশাখ বিসর্জন দিয়ে, জুরিতে সাফ ধোলাই খেয়ে রক্তাক্ত হৃদয় নিয়ে বাসায় যে ফিরলাম, তার অর্থ কি হল? কিসের জন্য এত খাটলাম আর সেই খাটনির মূল্যটাই বা কি রইলো?   হোয়াট ইজ আর্কিটেকচার??? ???

Why in Architecture?

‘কেন আর্কিটেকচার পড়তে এসেছো?’

আমি ডিপার্টমেন্টে ঢুকার পর প্রথম দিন থেকেই প্রশ্নটির মুখোমুখি হয়ে আসছি। ফার্স্ট ইয়ারে থাকার সময় আমরা যে উত্তর দিতাম সেটা অনেকটা এরকম, ‘ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল আর্কিটেক্ট হবো’ বা ‘আমি আঁকাআঁকি করতে খুব পছন্দ করি তাই…’ অথবা ‘ইচ্ছা ছিলো সৃজনশীল পেশায় কাজ করবো এজন্য……’। আরেকটা উত্তর ছিলো যেটা সবার সামনে বলা যেত না সেটা হলো, ‘চান্স পেয়েছি তাই পড়তে এসেছি।’

স্যাররা এইসব উত্তর শুনে হাসতেন।

আমি বুঝতাম এসব উত্তর আসলে ঠিক নয়। ওনারা অন্য কিছু জানতে চাচ্ছেন। তাহলে সঠিক উত্তরটা কি? কেন আমি আর্কিটেকচার পড়ছি- এটাই কি প্রশ্নটা? নাকি এত সাব্জেক্ট বাদ দিয়ে আর্কিটেকচার পড়ার পিছনে কারণ কি? আর্কিটেকচার পড়ে আমি কি করবো? কি সেই উদ্দেশ্য- এটাই কি স্যাররা জানতে চাচ্ছেন?

অনেকদিন এর উত্তর খুঁজলাম। ঘরবাড়ি ডিজাইন করার জন্য আর্কিটেকচার পড়ছি। আর্কিটেক্ট হয়ে সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি ডিজাইন করবো। মোটামুটি এই রকম উত্তর একটা ঠিক করলাম প্রথম সেমিস্টারে।

দ্বিতীয় সেমিস্টারে উঠে মনে হলো উত্তরটায় ঘাপলা আছে।সারা পৃথিবীর প্রায় সব সাবজেক্টে যেখানে চার বছরে স্নাতক ডিগ্রি দেয়া হয় সেখানে আমরা শুধু বাড়িঘর ডিজাইন করা শিখি পাঁচ বছর ধরে। কি নেই আমাদের শেখার তালিকায়, ফিজিক্স, সোশিওলজি, আর্ট, মিউজিক, প্ল্যানিং, মেকানিক্স, ইকনোমিক্স, ফটোগ্রাফী, সাইকোলজি, স্কাল্পচার, লজিক এন্ড ফিলোসফি, ইলেক্ট্রিকাল ইকুইপমেন্ট, সেমিনার, একাউন্টিং, ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু নন ডিপার্টমেন্টাল সাব্জেক্টগুলো যদি এরকম হয় তাহলে দুইটা সম্ভসবনা হতে পারে।

এক, এসব জিনিস বেহুদা পড়ায়, কারণ এসব না পড়েও অনেক নন আর্কিটেক্ট বিল্ডিং ডিজাইন করতে পারে।

দুই, এসব জিনিস পড়ায় শুধু বিল্ডিং ডিজাইন করার জন্য না, আরও অন্যকিছু করার জন্য।

এক নম্বর সম্ভাবনা নিজের ঠিক বিশ্বাস হয় নাই। যদি দুই নম্বর সম্ভাবনা মেনে নেই, তাহলে প্রশ্ন আসে এই ‘অন্যকিছু’টা কি?

দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টারে উঠে ‘ফাংশন’ নামক একটা জিনিসের সাথে পরিচয় হলো। তখন বুঝতে পারলাম আর্কিটেক্টের কাজ বাসা বাড়ি সুন্দর করে ডিজাইন করা না, আর্কিটেক্টের কাজ স্থান (space)কে দৃষ্টিনন্দনভাবে (aesthetically) ব্যবহার উপযোগী(functional) করে তোলা। স্থাপত্য অর্থটা অনেক জটিল মনে হয় নিজের কাছে। কারণ তখন থেকেই বুঝতে পারলাম কাজটা আসলে কতটা কঠিন।

দ্বিতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারে উঠার আগেই কিছু ভাসা ভাসা জিনিস জানতে পারলাম। একটা বাড়ি আসলে শুধু বাড়ি নয়। এটার সাথে জড়িত আসলে অনেক কিছু। আগেকার দিনে বাড়িগুলো হতো এক রকমের। পুরানো বাড়িগুলোতে দেখা যায় এক রুমের মধ্য দিয়ে অন্য রুমে যেতে হয়। রুমগুলো ছোট হলেও বারান্দা থাকে বিশাল। আবার প্রত্যেক তলার ছাদের উচ্চতা ছিলো অনেক বেশি। বাড়িগুলো তৈরি হতো চুন-সুরকি দিয়ে।

আর এখনকার ফ্ল্যাট বা বাড়িতে দেখা যায় প্রাইভেসির জন্য প্রত্যেক রুমে আলাদা প্রবেশ পথ। আবার ডিজাইন এমনভাবে করা হয় যেন এক রুম থেকে আরেক রুমের ভিতরটা দেখার সুযোগ না থাকে। প্রাইভেসির জন্য মা- বাবার রুম, ছেলের রুম, মেয়ের রুম, গেস্ট রুম, লিভিং রুম, ডাইনিং রুম ইত্যাদি বেশ পৃথক থাকে। এর ফল স্বরূপ এখনকার পারিবারিক বন্ধন পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। যেমন বাবা অফিস থেকে এসে নিজের রুমে চলে যায়। ছেলে ছেলের রুমে, মেয়ে মেয়ের রুমে যার যার মত ব্যস্ত থাকে। তাই নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। বাড়ছে মোবাইলে কথা বলা আর ফেসবুকিং এর নেশা।

আজকাল রুম একটু বড় করার জন্য বারান্দা নাই করে দেওয়া হচ্ছে। মানুষের সুস্থতার জন্য এতটুকু খোলা জায়গার প্রয়োজনীয়তা যে কি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটু আউটডোর স্পেসের অভাবে  বন্দি হয়ে যাচ্ছে নগরবাসী যার প্রভাব পড়ছে তাদের স্বাস্থ্যে এবং মানসিকতায়। ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা হাসপাতাল আর ডায়াগনসিস সেন্টার দেখলেই বোঝা যায় নগরবাসীর লাইফ স্টাইলে বড়সড় ধরনের ঘাপলা আছে। আর সংকীর্ণ্‌, ঘুপচি, দম বন্ধ করা বাসায় থেকে যে কোন মানুষ সৎচিন্তাশীল এবং বিশাল হৃদয়ের অধিকারী হবে না এ কথা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না।

বাসাবাড়িতে ছাদের উচ্চতা কমে যাওয়ার জন্য গরম বাতাস ঘুলঘুলি দিয়ে বের করে দেওয়ার যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ছিল তা বাদ হয়ে যাচ্ছে। এখন তাই পাখার বাতাসেও কাজ হচ্ছে না। দরকার হচ্ছে এসির। বাড়ছে বিদ্যুত বিল, বাড়ছে লোডশেডিং। জাতীয় পর্যায়ে বিদ্যুত আমদানির কথাও ভাবা হচ্ছে এখন।

চুন সুরকির বদলে কনক্রিট ব্যবহার বেড়ে গেছে। কনক্রিট নন ডিসপোজেবল ম্যাটেরিয়াল। তাই দিন দিন মাটির উপর শক্ত শক্ত আবর্জনা বাড়ছে যেটা কোন দিনও মাটির সাথে মিশবে না।

এতগুলো কথা বললাম এই কথা বোঝাতে যে ছোট্ট একট বাড়ি ডিজাইন করা মানে যে শুধু বাড়ি ডিজাইন করা তা নয় এর সাথে মানুষের জীবনধারা, স্বাস্থ্য, দেশের ভবিষ্যত, দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ সরাসরিভাবে জড়িত। যার অর্থ দাঁড়ায় একটা দেশের স্থপতিরা মিলে দেশের মানুষের জীবনধারা, স্বাস্থ্য, দেশের ভবিষ্যত, দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ বদলে দিতে পারেন- সেটা ভালো দিকেও হতে পারে, খারাপ দিকেও হতে পারে। তাহলেই বোঝা যায় একটা দেশের জাতীয় পরিসরে একজন স্থপতির ভুমিকা কত বি-শা-ল।

এখন আমি সেই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পেয়েছি। এখন যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কেন আর্কিটেকচার পড়তে এসেছো?(য)’, আমি মাথা উঁচু করে বলবো, “দেশকে বদলে দিতে চাই, এজন্য আর্কিটেকচার পড়তে এসেছি।’’

 

আমার বেকুব হওয়ার কাহিনী (পর্ব-৩)

ভারতীয় উপমহাদেশে চারশত খ্রিস্টাব্দে গুপ্ত শাসনামলে প্রথম মন্দির বা ‘টেম্পল’ এর ধারনা আসে। গুপ্ত সম্রাজ্যের পর প্রভাকরবর্ধন (৫৮০-৬০৫), রাজ্যবর্ধন(৬০৫-৬০৬) এবং হর্ষবর্ধন(৬০৬-৬৪৭)নতুন সম্রাজ্যের শুরু করেন সে সময় শাসক রাজ্যবর্ধনের সাথে বর্তমান বাংলাদেশ এলাকার রাজা শশাঙ্কের সাথে কিছুটা গন্ডগোল হয়, যার ইঙ্গিত সংক্ষিপ্ত শাসনামল দেখেই কিছুটা পাওয়া যায়। তবে আসল মিরাকেল ঘটে হর্ষবর্ধনের শাসনামলে। গুপ্ত সম্রাজ্যের সময়ই সর্বপ্রথম নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এই প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিলো পাটালিপুত্রের পাশে পাটনা শহরের ৫৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে। হর্ষবর্ধনের সময় এই বিশ্ববিদ্যালয় উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিলো।

মোটামুটিভাবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮টা কলেজ ছিল সব মিলিয়ে যার ছাত্র সংখ্যা ছিলো ১০ হাজার। সুন্দরভাবে প্ল্যান করা ৮টা আলাদা বিল্ডিং ছিলো যা দেখতেও ছিলো খুব চমৎকার। তিনটা ভিন্ন দালানে ছিলো সমৃদ্ধ পাঠাগার যাদের নাম ছিলো রত্নসাগর, রত্নদধি ও রত্ন্ররঞ্জক। সম্ভবত প্রত্যেকটা দালান প্রায় ৯ তলা বিল্ডিঙের সমান উঁচু ছিলো। উল্লেখ্য পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ইটের তৈরি ছিলো। এটি ছিলো পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যন্ত উঁচু মানের পড়াশোনা হতো। বৌদ্ধ দর্শন, গনিত, আয়ুর্বেদ, চিকিৎসা বিজ্ঞান, আইন, বৈদিক দর্শনসহ আরও অনেক বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর একজন বাঙালি ছিলেন। ভদ্রলোকের নাম ছিলো শীল ভদ্র। পড়াশোনার পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিও ছিলো। নিয়মিত বিতর্ক হতো। ছাত্রদের ক্লাস অ্যাসাইন্মেন্ট দেওয়া হত। বিশ্ববিদ্যালয় ২৪ঘন্টা খোলা থাকতো। বাইরের দেশ থেকে ভিজিটিং প্রফেসররা আসতেন। কোরিয়া, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, চীন, তুরস্ক এবং ইরান থেকেও ছাত্ররা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসতো।

সবচাইতে চমৎকার ব্যাপার হলো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা ব্যবস্থা। এত বিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সরকার থেকে কোনও বরাদ্দ দেওয়া হত না। আশেপাশের ১৮০টা গ্রামের সকল আয় ব্যায় করা হত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনে।

হর্ষবর্ধনের সময় পরিব্রাজক হিউয়েন সাং উপমহাদেশে এসেছিলেন। তার বিবরণ থেকে নালন্দা সম্বন্ধে জানা যায়। ‘হর্ষচরিত’ বই থেকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবরণ পাওয়া যায়। লেখক এ. ঘোষ এর বই ‘এ গাইড টু নালন্দা’ থেকে বর্তমান যুগে নালন্দা ভ্রমনের অভিজ্ঞতা জানা যায়।

এবার আসা যাক তুলনায়। আমরা আবার সবসময় নিজেদের ‘মূর্খ, অসভ্য, অশিক্ষিত’ জেনেছি আর ইউরোপিয়ানদের ‘জ্ঞানী, সভ্য, শিক্ষিত’ জেনে এসেছি তো, তাই তাদের সাথে ছোট্ট একটা তুলনা না করার লোভ সামলাতে পারছি না। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে হিউয়েন সাং যখন নালন্দার কথা লিপিবদ্ধ করতে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময়ে বর্তমান ইতিহাসখ্যাত অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তখনও জংগল হয়ে পড়ে আছে। আর আমেরিকা? আমেরিকা তখনও কলম্বাস আবিষ্কার করেন নি। সভ্যতার ছোঁয়া সেখানে পৌঁছাতে আরও শত শত বছর বাকি।

স্যারের কথা শুনে আমি চুপ করে বসে থাকি। প্রায় এক হাজার বছর আগে এই ছিলো আমাদের সাথে ইউরোপ-আমেরিকার তুলনা। আর এখন?

জনৈক রসিকের ইমেইল রঙ্গ

”হাই, আমি জিম। আমার একজন অনুবাদক দরকার যে আমাকে জাপানি থেকে ইংলিশে অনুবাদ করে দিতে পারবে।
তাড়াতাড়ি প্রয়োজন।
খুব জরুরি।”

ইন্টারনেটে এরকম একটা অ্যাড দেখে রবিন রিপ্লাই পাঠালো,
”হাই জিম,
আমি চ্যান। আমি একজন জাপানি। তোমাকে জাপানি থেকে ইংলিশে অনুবাদের ব্যাপারে আমি সাহায্য করতে পারবো।”

”ধন্যবাদ চ্যান।
আসলে আমি একটা সিডি প্লেয়ার কিনেছি। এটাতে কোন সাউন্ড পাচ্ছি না। ম্যানুয়েল পুরোটাই জাপানি ভাষায় লিখা। আমি তোমাকে কয়েকটা পেজ স্ক্যান করে পাঠাচ্ছি। তুমি আমাকে কি বলতে পারো এখানে কি করতে হবে কিছু বলা আছে কিনা?”

ছবিটা দেখে রবিন একটা হাসি দিলো,
”হ্যাঁ, তিনটা জিনিস দরকারি মনে হলো
১। ফেইলিওর অফ সাউন্ড ফ্রম ডিভাইস
 ২। স্কিপিং অফ ডিস্ক ফর পুওর সাউন্ড
 ৩। সাউন্ড ভলিউম লো ভেরি মাচ”

”হুম, প্রথমটার ব্যাপারে  কি করতে হবে বলা আছে?”

”কি বলা আছে আমি বলছি,
হ্যাল্লো, গ্লোরিয়াস সিডি প্লেয়ার ব্যাবহারের জন্য ধন্যবাদ। যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য দুঃখিত। ত্রুটি ঠিক করার জন্য নিচের নির্দেশ অনুসরন করুন
 ১। সিডি প্লেয়ারের প্লাগটি খুলে ফেলুন
 ২। সিডি প্লেয়ারের প্লাগটি পুনরায় লাগান
দ্যাখো তোমার কোন সাহায্য হয় নাকি।”

”নাহ, লাভ হয় নাই। আর কিছু কি বলেছে?”

”ওহ, সরি। আরও কয়েকটা নির্দেশনা আছে,
যদি এখনও গ্লোরিয়াস সিডি প্লেয়ার সম্পূর্ন ঠিক না হয়ে থাকে তাহলে আপনার গ্লোরিয়াস সিডি প্লেয়ারটিতে অডিও ভূত ভর করেছে। গ্লোরিয়াস সিডি প্লেয়ারটি ভূতের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য নিচের নির্দেশনা অনুসরন করুন
 ১। সাতটি মোমবাতি জ্বালান
 ২।সুরের দেবী বেঞ্জাইতেন এর কাছে প্রার্থনা করুন
 ৩।মহান দেবী বেঞ্জাইতেন ভূতের কবল থেকে সিডি প্লেয়ারটিকে মুক্ত করে দিবেন
 ৪।পুনরায় সিডি প্লেয়ারটি চালু করুন
যদি আপনার সিডি প্লেয়ারটি এরপরও ভূতের কবল থেকে মুক্ত না হয় তাহলে আপনার দুর্ভাগ্য। আপনার পুরো পরিবারের জন্য দুর্ভাগ্য এবং অভিশাপ। শীঘ্রই মহান সেপ্পুকু আপনাকে মৃত্যুদন্ড দিবেন।
আশা করি তুমি ভূত তাড়াতে সক্ষম হবে। গুড লাক।”

”কি!! সত্যিই কি এটা লিখাছিলো???????”

”আমি শুধু তোমাকে অনুবাদ করে দিলাম।”

”কখনই এরকম থাকতে পারে না। কি একটা ফালতু ম্যানুয়েল এটা! কিভাবে এটা মানুষকে সাহায্য করবে?”

”আমি দুঃখিত। শুনেছি আজকাল সিডিপ্লেয়ারের ভূতেরা খুব জ্বালাচ্ছে। আমার কাছে একটা তলোয়ার আছে। খুব ধারালো। মহান সেপ্পুকুর সাথে ফাইট দিতে তোমাকে সাহায্য করবে। তুমি কি নিতে চাও?”

”তুমি কি পাগল!! না ছাগল!!! এইসব গাঁজাখুরি কেউ বিশ্বাস করে?”

কয়েকদিন পর জিম রবিনকে মেইলে আরও একটা ছবি পাঠায়,
”আমি বোধহয় ভুল পেজের ছবি পাঠিয়েছিলাম। এটা মনে হচ্ছে সূচীপত্র। তুমি কি বলতে পারো ট্রাবলশুটিং কত নম্বর পেজে আছে? তাহলে আমি সেটার ছবি তোমাকে পাঠিয়ে দিবো।”

রবিন আরও চওড়া একটা হাসি দেয়,
”এটা সূচীপত্র নয়। এটা সুশি রান্নার রেসিপি। ১৬ নম্বরটা স্যামন মাছের সুশি, খেতে খুবই মজা। রান্না করে দেখতে পারো।”

”বুঝেছি, আমাকে ঘোল খাওয়ানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ **, আহাম্মক,**।”

পরেরদিন রবিন আরেকটা ইমেইল অ্যাড্রেস থেকে জিমকে ইমেইল পাঠালো,
”হাই, আমি স্যাম। আমার মনে হয় আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারবো। কলেজে থাকতে আমার জাপানি ভাষার কোর্স ছিলো, আমি জাপানি বলতেও পারি। দু বছর জাপানেও ছিলাম।”

জিম তাকে রিপ্লাই পাঠালো,
”অনেক ধন্যবাদ। আমি আসলে এক গবেটের কাছে সাহায্য চেয়ে চেয়ে এতদিন সময় নষ্ট করেছি। যাইহোক, আমার সিডি প্লেয়ার কাজ করছে না আর ম্যানুয়েলটা জাপানি ভাষায় লিখা। তোমাকে সূচীপত্রের ছবি পাঠালাম। আমাকে আপাতত বলো ট্রাবলশুটিং অংশটা কত নম্বর পেজে আছে?”

”তুমি তো আমাকে সুশি রান্নার রেসিপি পাঠিয়েছো। তুমি কি শিওর এটাই তোমার ম্যানুয়েল?'”

”কি আশ্চর্য! এটার আগের পেজে একটা সিডি প্লেয়ারের ছবি আছে। তার পরের পেজে কেন একটা সুশি রেসিপি থাকবে?”

”জাপানি ম্যানুয়েলগুলোতে মাঝে মাঝে অ্যাড থাকে। এটা মনে হয় সেরকমই। নিচে আবার লিখা আছে- গ্লোরিয়াস সিডি প্লেয়ার ব্যাবহারের জন্য ধন্যবাদ, সঙ্গীত উপভোগ করতে করতে কয়েকটা সুশি হয়ে যাক না কেন?

”পাগল নাকি??? আচ্ছা যাই হোক আমি আরেকটা ছবি পাঠাচ্ছি। আমার মনে হয় এখানে ট্রাবলশুটিঙ্গের ব্যাপারে কিছু লিখা আছে। দেখো তো সাউন্ড না থাকলে কি করতে হবে কিছু বলা আছে কিনা?”

”হ্যাঁ হ্যাঁ। বলা আছে একবার প্লাগ খুলে আরেকবার লাগাতে।”

”আমি ওটা করেছি। আর কিছু লিখা নেই?”

”আছে, তবে…আচ্ছা বলছি। লিখা আছে যে তোমার সিডি প্লেয়ারটাতে আমানাজাকু  বা ভূতের আসর হয়েছে। তিনটা মোমবাতি জ্বালিয়ে সুরের দেবী বেঞ্জাইতেন এর কাছে প্রার্থনা করতে।”

কয়েকদিন পর রবিন জিমকে লিখলো,
”জিম, তুমি কি ভূত তাড়াতে পেরেছো?”

জিম এরপর আর কোন উত্তর দেয় নাই।

তিনি সত্যিই চলে গেলেন!

৯৭-৯৮ সালের দিকের কথা। মোটামুটি শিওর হয়ে গেছি হুমায়ুন আহমেদের বই আমার জন্য নয়। মনে মনে বেশ হতাশ হই, এই লেখক এক বাজে লিখেন কেন? যে মানুষ এত ভালো নাটক বানাতে পারে, তাঁর লিখা কেন বোরিং?

নাটকের কথা বললেই সবার আগে মনে পড়ে ‘আজ রবিবার’ এর কথা। কি চরম একটা নাটকই না ছিল সেটা! বড়চাচা, আনিস, দাদাজান, ছোটচাচা, মতি, তিতলি, কংকাদের আমি আজও ভুলতে পারি নাই। একটা পরিবারে যে কত অদ্ভূত সব ঘটনা ঘটতে পারে… কত রকমের যে সমস্যা……… কত বিচিত্র পরিস্থিতি……… সব মিলিয়ে অসাধারণ। তারপর আরও ছিলো ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘সবুজ ছায়া’, ‘সবুজ সাথী’। একটা পর্বও মিস করতাম না। বাসায় আম্মুর নিয়ম ছিলো পরীক্ষা চলাকালীন সময় কোন টিভি ছাড়া যাবে না। ব্যাতিক্রম ছিলো শুধু হুমায়ুন আহমেদের নাটক। আর বাসায় বড়দের কাছে শুনতাম ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’ আর ‘কোথাও কেউ নেই’ এর কথা। বাকের ভাই, বদি আর মজনুর তিন তিনটা পোস্টকার্ড এখনও আছে আমার কাছে। আর ঈদের সময় তো কথাই নেই। রাত ৮টা-সাড়ে ৮টা বাজলেই সারা বাড়ির লোকজন নিঃশব্দে টিভিসেটের সামনে এসে হাজির হতো। মনে আছে একবার ঈদের দিন এক মামার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো। ওদিকে আবার নাটক শুরু হয়ে যাচ্ছে, সব দিক চিন্তা করে অন্ধকার রাস্তায় আমি আর ভাই দিলাম দৌড়। পরে হাঁপাতে হাঁপাতে বসলাম টিভিসেটের সামনে।

২০০৩-০৪ সালের দিকে আবারো চেষ্টা করলাম, যদি তাঁর লেখা ভালো লাগে? আবার সেই একই সমস্যা, বোরিং। হিমু, মিসির আলী কাউকেই পছন্দ করতে পারলাম না। এবার ডিসিশন ফাইনাল, হুমায়ুন আহমেদের বই আমার জন্য নয়।
মাঝে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম মধুমিতায়। সিনেমার নাম ‘দুই দুয়ারী’। চমৎকার ছবি, চমৎকার গান… বিশেষ করে ‘বরষার প্রথম দিনে/ ঘনকালো মেঘ দেখে/ আনন্দে কাঁপে যদি তোমার হৃদয়’ । দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আবার আফসোস, যে মানুষ এত ভালো সিনেমা বানাতে পারে, তাঁর লিখা কেন বোরিং?

বিভিন্ন কারনে প্রায়ই পত্রিকার হেড লাইন হন তিনি। আফসোস হতো, হায়! এরকমটা কি না হলে হত না?
পত্রিকা মারফত জানতে পারি, অসুস্থ হলেন- অস্ত্রোপোচার হলো- সুস্থ হলেন- দেশে আসলেন- আবার চলেও গেলেন। হঠাৎ শুনি তিনি নেই।
তিনি কখনই আমার প্রিয় লেখক ছিলেন না। আমি কখনোই তাঁর বই কিনে পড়ি নাই। কিন্তু তারপরও কেমন একটু কষ্ট লাগলো। কেমন ফাঁকা, শূন্য লাগলো। কি আশ্চর্য! তিনি সত্যিই চলে গেলেন!