আমার অসাধারণ আম্মু

 

আম্মু, আজকে রাতে তুমি আমার সাথে ঘুমাবে? ”

 

তোর সাথে শুতে হবে ?”

 

শোও না, প্লিইইজআমি আনুনয় করে বলি।

ব্যাপারটা এমন নয় যে আমি রাতে একা ঘুমাতে পারি না। আমি সেই ক্লাস ফোর থেকেই একা ঘুমাই। তারপরও কয়েকদিন পর পর কেমন যেন লাগে। তাই মাঝেমাঝেই আম্মুকে আমার সাথে ঘুমাতে আসতে হয়। দুইজনে মিলে ফিসফিস করে রাজ্যের গল্প করি। তারপর একসময় আম্মুর শাড়ি ঘেঁষে ঘুমিয়ে পড়ি। আহ, কি শান্তি!

 

 পরীক্ষার সময় তো কথাই নেই। রাতের ভাতটা অবশ্যই আম্মুর হাতে খেতে হবে। কেন যে আম্মুর হাতে ভাত খেলে ভাতের স্বাদ বহুগুন বেড়ে যায় সেটা আমি বলতে পারবো না। আর সকালে আম্মুর কাছ থেকে দোয়া নিতেই হবে। যত যাই হোক, সেদিন আমার জন্য আম্মুকে স্পেশাল দোয়া করতেই হবে।

 

 অন্য কারো হাতে আমি মাথায় তেল দেই না। এই একটা কাজ আম্মুকে করতেই হবে। আমি চেয়ারে বসে থাকবো আর আম্মু মাথায় বিলি কেটে কেটে তেল দিয়ে দিবে। আরামে আমার ঘুম চলে আসবে।

 

 দুপুরে কি খেয়েছিস?”

 

কি আর খাবো? ঐ মোটা চালের ভাত আর মুরগি মাংস।আমি মুখ ভেংচিয়ে উত্তর দেই।

 

পরদিন থেকে আমার জন্য লাঞ্চ বক্স রেডি হয়। ভিতরে থাকে ভাজি, মাংস আর ডাল। কি মজা আম্মুর সেই রান্না!

 

 ভার্সিটি থেকে ফিরে আম্মুর সাথে বকবক করতে থাকি।জানো আম্মু আজকে না কি হয়েছে………… আম্মু সামনের

 

শনিবার না আমাদের সেমিনার আছে…………উফফ আজকে যা জঘন্য প্রোজেক্ট দিয়েছে না……… আমার আমলা আপু কি বলেছে জানো………… আজকে না আমাদের নতুন ব্যাচ এসেছে………………………” । আমি বলতেই থাকিবলতেই থাকি। স্কুল, কলেজ সবখানেই একই অবস্থা ছিলো আমার। গাড়িতে উঠেই বকবক করতে থাকতাম, অনর্গল।

 

 

বিশ্ব মা দিবস কবে তা আমি ঠিক করে বলতে পারবো না। আম্মুও হয়তো জানে না। কারণ আম্মুর অত সময় নেই। ছেলেমেয়েদের জন্য রান্না করা, মুখে তুলে খাইয়ে দেওয়া, মাথায় তেল দিয়ে দেওয়া, সারাদিনের ঘটনার সারমর্ম শোনা এসব করতে করতে হাতে সময় থাকে কখন? আর সংসারের কাজের কথা তো বাদই দিলাম। আমার সাবেক শিক্ষিকা মা আমার সবচেয়ে বড় সঙ্গী। আমি আম্মুকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য কোন মা দিবস লাগে না। ছোট্ট এই আমি আম্মুকে কতটা ভালোবাসি তা আমার প্রতিদিনের এসব ছেলেমানুষি কার্যকলাপের মধ্যেই প্রকাশ পায়। আর আমার প্রতি আম্মুর ভালোবাসার কথা তো বললামই না…………………

 

 

 


একটি প্রাচীন উপদেশ

বিশাল মরু প্রান্তর। বিশাল সিট্রনটা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চারদিকে। সিট্রনের যান্ত্রিক চিৎকারে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠছে। রয়া একটা বড় পাথরের চাঁইয়ের দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। হাতের এটমিক ব্লাস্টারটাই একমাত্র সম্বল। জ্বালানী খুব বেশি নেই, হিসেব করে ব্যবহার করতে হবে- ভাবলো সে। সিট্রন নামক বিশাল রোবটটা যথেষ্ট দূর্বল হয়ে পড়েছে। আর বেশিক্ষণ সময় লাগবে না। রয়া এটমিক রকেটটা রিলোড করে প্রস্তুত হয়ে নিলো। সোজা বের হয়ে সিট্রনের পিছনে দাঁড়ালো। ”তোমার খেলা শেষ, সিট্রন”- বলে যেই চিৎকার দিয়ে রকেটটা ছাড়তে যাবে তখনই রয়ার কানের কাছে বিপবিপ করে সিগনাল বাজতে লাগলো। ততক্ষণে সিট্রন তার দিকে তাক করে ফেলেছে লেজার গান। যেকোন সময়ে রয়ার দিকে ছুটে আসবে একঝাঁক লেজার, ছিন্নভিন্ন করে দিবে তাকে। বাঁচার আর কোন আশা নাই দেখে বিরক্ত হয়ে মাথা থেকে হেডপিসটা খুলে ফেললো সে। মুহূর্তেই মরুপ্রান্তর, বিশাল আকারের রোবট সিট্রন, সিট্রনের যান্ত্রিক ঝনঝনানি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। বরং সেখানে ফুটে উঠলো একটা ঘরের ছবি। রয়া এখন তার ঘরের ভেতর।

একপাশের হলোগ্রাফিক ফোন থেকে এখনও ভেসে আসছে বিপ বিপ শব্দ। রয়া বিরক্ত হওয়ার ভঙ্গিতে হেডপিসটা একপাশে রেখে ফোন অন করে দিলো। ঘরের মাঝে তারই সমবয়সী একটা মেয়ের ভীষণ উত্তেজিত হলোগ্রাফিক ছবি ফুটে উঠলো।

”রয়া, তুই এক্ষুণি আমার বাসায় চলে আয়।”

”দিবিন, তুই জানিস তুই আমার কি ক্ষতিটা করেছিস? আমি আজকেও তোর কারণে একটুর জন্য সিট্রনকে মারতে পারলাম না। আমি প্রায় মেরেই ফেলেছিলাম………. তুই এমন সময় কল দিলি……….আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। তাতেই ব্যাটা আমার দিকে লেজার গান তাক করে ফেললো। ধুৎ, আবার সব শুরু থেকে করতে হবে” -রয়া বেশ দুঃখের সাথেই কথাগুলো বললো।

”তুই আছিস সারাদিন তোর থ্রিডি গেম নিয়ে। তোর এই বদমাশ সিট্রনকে আজকে না মারতে পারলে কালকে মারবি, এটা আর এমন কি ব্যাপার?-” দিবিন তার কথা শেষ করতে পারলো না।

রয়া চিৎকার দিয়ে বললো ” তুই জানিস, আমি তিনদিন ধরে চেষ্টা করছি-”

” চুপ থাক। কোন মেয়েকে আমি এভাবে গেম খেলতে দেখি নাই-”

” আমি মেয়ে হয়ে এভাবে গেম খেললে তোর অসুবিধা কি?”

দিবিন এবার নরম হয়ে যায়,” আহ-হা, আমি কি সে কথা বলেছি? আমি তো শুধু তোকে আমার বাসায় আসতে বলার জন্য কল দিচ্ছিলাম। তুই যে এভাবে সিট্রনের সাথে মরণপণ যুদ্ধ করতে থাকবি এবং আমার কারনে হেরে যাবি এত সব ব্যাপার আমি কেমন করে জানবো? ”

রয়াও এবার শান্ত হয়ে যায়। বেস্টফ্রেন্ডের উপর সে বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারে না। স্বাভাবিক গলায় বলে,” আচ্ছা বল, তোর বাসায় আমার কেন আসতে হবে?”

দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠে দিবিন, ” বাবা, দারুণ একটা জিনিস বাসায় নিয়ে এসেছে।”

” কি জিনিস?”

” বইয়ের পাতা!”

” বইয়ের পাতা? (একমুহূর্ত চিন্তা করে) জাদুঘরে বই দেখেছি। এটা নিশ্চয়ই সেটারই একটা পাতলা অংশ হবে। কিন্তু এটাতে তুই এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন?”

দিবিন একটু আশাহত হয়, ” আমি কখনও এত কাছ থেকে বই দেখি নাই। আর তাছাড়া এই পাতাটার অবস্থা ভালো। চেষ্টা করলে পড়া যেতে পারে। আমি ভাবলাম তুই আর আমি মিলে যদি এটার অর্থ জানতে পারি-”

”তাহলে তো আমাকে আসতেই হয়। তুই দাঁড়া, আমি মাকে বলে এক্ষুণি তোর বাসায় আসছি।”

দিবিন খুশি হয়ে যায়, ” তাড়াতাড়ি আয়” বলে সে লাইন কেটে দেয়।

রয়া হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দিবিনের বাবা প্রত্নতত্ত্ব ও পুরাকীর্তির জগতে বেশ বিখ্যাত মানুষ। সেই সুবাদে দিবিনের বাসায় প্রায়ই আজব আজব জিনিস আসে। সেসব নিয়ে রয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ না থাকলেও দিবিনের কারনে সে এমন ভাব করে যেন সে খুবই আনন্দ পাচ্ছে। রয়া খুব দ্রুত ওর মায়ের সাথে যোগাযোগ করে।

‘হ্যালো মা।”

”কি ব্যাপার, কোন সমস্যা?” মা কপাল কুঁচকে তাকালেন।

”না, কোন সমস্যা না। আমি একটু দিবিনদের বাসায় যেতে চাচ্ছিলাম আর কি।”

”কেন? ওর বাবা আবার কি বিচিত্র জিনিস এনেছে?” মা একটা বাঁকা হাসি দেন।

” আহ- মা, থাক না।” দিবিনও হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করে।

” গেলে যাও। তবে সাথে নেক্সিকে নিয়ে যাও।”

রয়ার মুখটা কালো হয়ে গেল, ” দিবিনের বাসা একদম কাছে। রাইডারে চড়ে গেলে সাত মিনিট সময় লাগে। এখানে নেক্সিকে নিয়ে যাওয়ার দরকার কি? আর তাছাড়া নেক্সি সিকিউরিটি রোবট নয়, হাউস কিপার রোবট-”

”তুমি কি চাও আমি তোমার বাবাকে বলে তোমার জন্য সিকিউরিটি রোবট ঠিক করি?” মা শক্ত গলায় কথাগুলো বললেন।

রয়া মুখ গোঁজ করে উত্তর দিলো, ” না।”

” তাহলে চলে যাও। আর রাইডারটা সাবধানে চালাবে।”

দশ মিনিটের মধ্যে দিবিনের বাসার সামনে রাইডারটা থামলো। রাইডার থেকে রয়ার পিছু পিছু নেক্সিকে নামতে দেখে দিবিন খুব খুশি হলো।

”যাক বাবা, তুই বুদ্ধি করে নেক্সিকে নিয়ে এসেছিস। আমি তো নেক্সির কথা বলতেই ভুলে গিয়েছি।”

”নেক্সিকে দিয়ে তুই কি করবি?” রয়া একটু অবাক হয়।

” বা-রে, নেক্সি না থাকলে ঐ কাগজটা পড়বে কে? তুই?”

”কেন, তোদের জ্ঞানী রোবট লরাক্স কই?”

”লরাক্সের সেন্ট্রাল সিস্টেম ড্যামেজ হয়েছে। ওর সিস্টেম নতুন করে লোড করার জন্য ওকে রোবট ফার্মে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

”কিন্তু লরাক্স ছিলো ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, ভাষা এইসব বিষয়ে এক্সপার্ট। আর নেক্সি হচ্ছে সাধারণ রোবট। ও কি পারবে এই প্রাচীনকালের লিখা পড়তে?”

”যা পারবে তাতেই চলবে। তোকে এত চিন্তা করতে হবে না।”

দিবিন খুব সাবধানে ট্রান্সপারেন্ট ম্যাটার দিয়ে সিল করা বইয়ের পাতাটা এনে দিলো। রয়া দেখলো ময়লা একটা ছাই রঙের জিনিস, এটাকে কাগজ বলে। কাগজটার চারপাশ ছেঁড়া থাকলেও মাঝখানটা মোটামুটি অক্ষত আছে। কিছু হিজিবিজি লিখা আছে, তবে রয়া কিংবা দিবিনের পক্ষে তা পড়া সম্ভব নয়।

নেক্সি তার রোবোটিক আই দিয়ে কাগজটা থ্রিডি স্ক্যান করে যান্ত্রিক কন্ঠে বলে উঠলো, ” প্রাচীন সভ্যতার একটি দূর্লভ নমুনা-”

রয়া তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ”আমরা তোমার কাছে এসব জানতে চাই নাই। তুমি শুধু আমাদের লিখাটা পড়ে শোনাও।”

”কিন্তু মহামান্য রয়া, আমি এ বিষয়ে অভিজ্ঞ নই। আমার সেন্ট্রাল সিস্টেমে ভাষা, অনুবাদ বিষয়ক কোন প্রোগ্রাম নাই।”

রয়া দাঁতে দাঁত ঘষে বললো,”তোমার সিস্টেমে কি কি প্রোগ্রাম আছে তা আমি জানি। তারপরও আমি তোমাকে এটা পড়তে বলছি। তুমি আর কোন কথা না বলে দয়া করে পড়া শুরু কর।”

নেক্সি আর কোন কথা বাড়ালো না। যান্ত্রিক কন্ঠে পড়তে শুরু করলো,”সহজ ব্যাকরণ ও রচনাশৈলী।২৫৮”

” কি? কি বললে?” দুজনেই উৎসুক হয়ে উঠলো, ” ব্যাকরণ, রচনাশৈলী মানে কি? আর ২৫৮ ই বা কি?”

নেক্সি যান্ত্রিক কন্ঠে গড়গড় করে বলতে লাগলো, ” ব্যাকরণ মানে ভাষার নিয়ম কানুন। রচনা মানে কোন বিষয় সম্পর্কে তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন। শৈলী মানে সৌন্দর্যের শিল্প। আর ২৫৮ একটি সংখ্যা।”

”বাপ রে বাপ।” রয়া আড়চোখে দিবিনের দিকে তাকায়।

দিবিন খুব আগ্রহ নিয়ে বলল, ” চমৎকার, নেক্সি। দারুণ হচ্ছে। পড়ে যাও।”

নেক্সি আবার পড়তে লাগলো,” পরীক্ষার পূর্বরাত্রি। এখানে পরীক্ষা মানে নিরীক্ষণ। পূর্ব মানে পূর্ব দিক। রাত্রি মানে রাত।”

দিবিন মাথা চুলকে বললো, ” আমার না মনে হচ্ছে পরীক্ষা মানে আমরা যে পরীক্ষা দেই সেই পরীক্ষা।”

রয়া বললো, ”অসম্ভব। সেই আমলে থ্রিডি স্ক্রিন ছিলো না। কেন্দ্রীয় ডাটাবেস ছিলো না। এসব ছাড়া পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। আর তাছাড়া-”

”তাছাড়া পূর্ব রাত্রি মানে কি? পূর্ব দিকে যে রাত উঠে- সেটা?” দিবিন জিজ্ঞেস করে।

” পূর্ব দিকে যে রাত উঠে- এটা মানে কি? পূর্ব দিকে কোন রাত উঠে নাকি?”

” না মানে পূর্ব দিকে সূর্য তো উঠে-”

”সূর্য আর রাত এক জিনিস হলো নাকি?”

” তা ঠিক। তবে-”

”তুই থাম। আমার মনে হয় শুধু নেক্সিকে বাকি অংশটুকু পড়তে বলা উচিৎ। কারণ এভাবে অর্থ শুনে আলোচনা করতে থাকলে সারা দিন লেগে যাবে।”

দিবিনও রয়ার কথায় সায় দেয়। নেক্সি আবারও পড়তে শুরু করে।

” এই কান ধরিতেছি, আর কোনদিন ক্লাস পালাইয়া সিনেমা দেখিতে যাইবো না। আর কোনদিন ক্লাসের সময় পিছনের সারিতে বসিয়া ঘুমাইয়া লইবো না। আর কোনদিন বাড়ির কাজ না করিয়া ক্লাসে যাইবো না-”

”দাঁড়াও, দাঁড়াও।” দুইজন একসাথে বলে উঠলো।

”দেখেছিস! আমি বলেছিলাম না আমাদের মতন পরীক্ষার কথা হচ্ছে।” দিবিন হাতে কিল দিয়ে ওঠে।

”হুম, সেইরকমই তো মনে হচ্ছে। বিশেষ করে যখন ‘ক্লাস’ শব্দটা আছে। তবে যাই বলিস, ভাষাটা দারুণ কঠিন। কিছুই বুঝতে পারছি না।”

” আমি মনে হয় একটু একটু বুঝতে পারছি। ‘কান ধরা’ ছিলো এক ধরনের শাস্তি। এখানে নিশ্চয়ই কাউকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে যে ‘ক্লাস পালাইয়া সিনেমা দেখিতে’ যেতো। যদিও একথাটার কোন অর্থ আমি বুঝলাম না। সে নিশ্চয় বেশি ঘুমাতো আর ‘বাড়িতে’ মানে ঘরে কোন কাজ করতো না।”

রয়া একটু অবাক হয়ে বললো, ”ঘরে আবার কি কাজ করবে?”

”যেমন ধর রোবটের কাজ। তখন তো আর রোবট ছিলো না, সব কাজ মানুষকেই করতে হত।”

”আহ -হা রে। রোবটের কাজ না করার জন্য মানুষকে শাস্তি? বেশি অমানবিক লাগছে।” রয়া মানুষটার কথাচিন্তা করে দুঃখ পায়।

”………………দুই চোখে রাজ্যের ঘুম নামিতেছে। কখন বাকি অধ্যায়গুলো পড়িব সে উপায় খুঁজিতেছি। আহ, এমন নিশুতি রাত বোধহয় জীবনে আর দেখি নাই। বাড়ির সকলেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। এই নিস্তব্ধ জগৎ সংসারে বোধ করি আমি ছাড়া দ্বিতীয় জনপ্রানী নাই। যদি সারা বছর পড়ায় হেলা না করিতাম, তবে অন্যদের মত আমিও আজ আরাম করিয়া ঘুমাইতে পারিতাম।”

”থামো, থামো।” রয়া দিবিনের দিকে তাকিয়ে বললো, ”কিছু বুঝলি?”

দিবিন মাথা চুলকে বললো,” ইয়ে- মানে এই লাইনগুলো একটু বেশি কঠিন। বুঝতে পারছি না।”

”আমার মনে হয় কোন একজন মানুষের খুব দুঃখের কথা বলা হয়েছে। শব্দগুলোর অর্থ ঠিক বুঝতে পারি নাই। তবে ‘ঘুম’ কথাটা বারবার এসেছে। মনে হচ্ছে সেই শাস্তি পাওয়া লোকটার কোন কারণে ঘুমাতে খুব অসুবিধা হচ্ছে।”

”হতে পারে।” দিবিন ইতস্তত করে বলে,” কিন্তু ঘুমাতে কি অসুবিধা হতে পারে? একজন মানুষ চাইলেই তো ঘুমাতে পারে।”

রয়া হঠাৎ বলে ওঠে,”আমার মনে হয় এটাও ওই লোকটার শাস্তি।”

”কোনটা?”

”ঘুমাতে না দেওয়াটাই শাস্তি।”

”ছিঃ এরকম শাস্তি হয় নাকি? মানুষ তো খুবই নিষ্ঠুর ছিলো। এটা তো চরম অমানবিক শাস্তি। তাও আবার শুধু ঘরের কাজ না করার জন্য- ”

”ঠিকই বলেছিস। কি জানি, রোবট না থাকলে আমরাও হয়তো এরকম শাস্তি পেতাম।” রয়া জীবনে প্রথম বার নেক্সির দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকালো।

”…………আর চোখ খোলা রাখিতে পারিতেছি না। নরম তুলতুলে বালিশটা যেন হাতছানি দিয়া ডাকিতেছে। আধা ঘন্টা ঘুমাইয়া লই। পরে উঠিয়া বাকি অধ্যায়গুলো পড়িয়া লইবো। কিন্তু সিলেবাসের এক চতুর্থাংশও যে শেষ হয় নাই। মাঝরাত্রি প্রায় হইয়া পড়িয়াছে। বাকি অধ্যায়গুলো কখন পড়িবো …………”

দিবিন চিৎকার দিয়ে বলে, ”বালিশ কি জিনিস আমি জানি!”

”কি জিনিস?”

”বালিশ এমন একটা জিনিস যেটা মাথায় দিয়ে আগেকার দিনের মানুষরা ঘুমাতো। চারকোনা, নরম একটা জিনিস। ওদের তো স্লিপিং সেট ছিলো না, তাই আরাম করে ঘুমানোর জন্য মাথার নিচে এই জিনিসটা রেখে ঘুমাতো।”

”ঘুরে ফিরে আবারও ঘুমের ব্যাপারস্যাপার চলে আসছে। আরেকটা কথা দেখেছিস, অনেককিছু ‘পড়া’-র কথা হচ্ছে। কি পড়ছে বল তো?”

” কি জানি? একবার মনে হলো রাত পড়ে যাচ্ছে। আরেকবার মনে হলো ‘অধ্যায়’ নামের কোন জিনিস পড়ে যাচ্ছে।”

” হি হি হি” রয়া হেসে ফেলে, ” রাত কি একটা এটমিক ব্লাস্টার যে হাত থেকে পড়ে যাবে?”

দিবিন গম্ভীর মুখে বলে, ” হাসিস না রয়া। এটা বেশ সিরিয়াস ব্যাপার। প্রাচীনকালে কিভাবে একটা মানুষকে শাস্তি দেওয়া হত সেই ব্যাপারটা আমরা জানতে পারছি। শাস্তিটা খুব সিরিয়াস কিন্তু কারণটা খুব সাধারণ।”

”………যাহা হউক, পাস করিতে না পারলে মুখ দেখানোর জো রইবে না। কিন্তু যাহা পড়িলাম তাহাতে পাস করিব এ কথা প্রশ্ন কর্তাও বলিতে পারিবে না। সকলে নতুন ক্লাসে উঠিবে আর আমি আবারও এখানেই বসিয়া রইবো এইকথা ভাবিতেই চোখে জল চলিয়া আসিলো। আজ সময়ের কাজ সময়ে না করার চরম শিক্ষা হাড়ে হাড়ে টের পাইতেছি। একথা যদি আগে বুঝিতাম তাহা হইলে আজ এই বিপদে পড়িতে হইতো না।”

নেক্সির পড়া শেষ হতেই দুজনে একজন আরেকজনের দিকে তাকালো।

” চোখে জল আসা মানে কাঁদা না?” রয়া জিজ্ঞেস করে।

”তাই তো জানতাম, তুইও জানিস দেখছি।”

রয়া দাঁতে দাঁত ঘষে বললো, ”বদমাশগুলো লোকটাকে এমন শাস্তি দিয়েছে যে লোকটার চোখে পানি চলে এসেছে।”

” মনে হয় শারীরিক নির্যাতনও করেছে।” দিবিন বলে।

” কি করে বুঝলি?”

”শুনিস নাই ‘হাড়ে হাড়ে’ কথাটা? আমার তো মনে হয় পিটিয়ে হাড় ভেঙ্গে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।”

রয়া শিউরে উঠে, ” কি সাংঘাতিক!” এক মূহুর্ত চুপ থেকে সে বলে,” তোর বাসায় এসেছিলাম এমন কিছু দেখতে যাতে মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু কি বাজে জিনিস শুনলাম, প্রাচীনকালে মানুষ এতটা বর্বর ছিলো- ভাবতে গা শিরশির করে উঠছে।”

”আগে আমাদের কখনও এমন হয় নাই। সবসময় আমরা দারুন দারুন তথ্য জানতে পেরেছি। কিন্তু শুধু এইবার-”

”কেন হয়েছে জানিস?”

”কেন?”

”কারণ সবসময় জিনিসগুলোর ব্যাখ্যা দেয় তোদের রোবট লরাক্স। শুধুমাত্র এইবার আমরা নিজেরা জিনিসটা বুঝতে চেষ্টা করেছি।”

”তারমানে- তারমানে- তুই বলতে চাচ্ছিস লরাক্স আমাদের ভুল ব্যাখ্যা দেয়?”

”খুব সম্ভবত তাই।”

”তার মানে এতদিন আমরা যা যা জেনে এসেছি সবই ভুল?”

”হতে পারে। সম্ভবত লরাক্স আমাদের ভুল ইনফর্মেশন দেয়।”

”আর দিবেই না কেন?” দিবিন দুঃখের সাথে বলতে থাকে,”যে ইতিহাসে মা তার সন্তানকে ঘরের কাজ না করার জন্য এত মারাত্মক শাস্তি দিতে পারে-”

”মা!” চমকে উঠে রয়া,” কি আশ্চর্য, মা তার সন্তানকে শাস্তি দিচ্ছে তুই বুঝলি কিভাবে?”

” মা ছাড়া ঘরের কাজ না করার জন্য আর কেই বা শাস্তি দিবে?”

রয়া মিনমিন করে বলে,” তা ঠিক বলেছিস। ভাগ্য ভালো, আমাদের মায়েরা এমন জল্লাদ না। ”

দিবিন গম্ভীর গলায় বলে উঠে,” এখন আমাদের কি করতে হবে জানিস?”

”কি করতে হবে?”

”যেহেতু আমাদের মায়েরা এরকম জল্লাদ না, তাই তাদের কিছু পুরষ্কার দিতে হবে। মায়েদের সব কথা আমাদের শুনতে হবে।”

” ঠিকই বলেছিস। মাঝে মাঝে নেক্সি অকেজো হয়ে গেলে ঘরের সব কাজ মা অফিস করে এসে করে। আমি কিছুই করি না। এজন্য আগেকার দিনে নির্মমভাবে শাস্তি দেওয়া হত। অথচ মা আমাকে কিছুই বলে না।”

”আজকে থেকে আমরা আমাদের মায়েদের সব কথা শুনবো। ঠিক তো?”

”একদম ঠিক।” রয়াও গলা মেলালো।

” কিন্তু-” দিবিন ইতস্তত করে, ”- ইয়ে, আমাদের ঘরের কাজে সাহায্য করার সময় কই? সারাদিন কোন না কোন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়।”

” ধুর গাধা, তোকে কি রোজ রোজ কাজ করতে হবে নাকি? যখন দরকার পড়বে শুধু তখন- তা ছাড়া সব কিছুর জন্য সময় ভাগ করে নিবি। আর দেখিস না, আমি রোজ কিভাবে আমার থ্রিডি গেম খেলার জন্য সময় বের করে নেই?”

দিবিন গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লো, ”বুঝেছি। আর বলতে হবে না।”

তারপর বাচ্চাদুটোর মায়েরা অবাক হয়ে খেয়াল করলো তাদের মেয়েরা বেশ বদলে গেছে। তারা মাকে কাজে অনেক সাহায্য করে আর মায়ের কথার অবাধ্য হয় না। সবচেয়ে বড়কথা তারা সময়ের কাজ সময়ে করে।

সম্পূর্ণ সঠিক উপদেশ সম্পূর্ণ ভুলভাবে জেনে সম্পূর্ণ সঠিকভাবে পালনের এর চেয়ে চমৎকার উদাহরন বোধহয় এরচেয়ে ভালো নেই।

 

 

আমার বেকুব হওয়ার কাহিনী (পর্ব ২): পাটালিপুত্র শহর ও অশোকের স্তুপা

ভারতবর্ষের ইতিহাসে গ্রীকদের শাসন বেশ উল্লেখযোগ্য। তবে সে আমলের কোন কথা ভারতের কোন অধিবাসীর রের্কড থেকে পাওয়া যায় নাই। আমাদের সেই আমলের কথা আমরা বিদেশিদের কাছ থেকে জানতে পারি। স্যার এজন্য দুঃখ প্রকাশ করেন যে, আমাদের ইতিহাস আমরা সংরক্ষণ করিনি- করেছে বিদেশিরা। জনৈক গ্রীক অ্যাম্বাসেডর মেগাস্থিনিসের বিবরন থেকে সেই আমলের কিছু কথা জানা গেছে। গ্রীকরা এদেশের যে জিনিসটা দেখে বেশি অবাক হত তা হলো, এদেশের মানুষ দিনে মাত্র দুই ঘন্টা কাজ করে আর সারা দিন গল্প করে, গান গায়, খায়দায় আর ঘুমায়। গ্রীকদেশের বৈরী আবহাওয়ার জন্য তাদের মানুষদের স্বভাবতই কর্মঠ ও পরিশ্রমী হতে হয়। কঠোর পরিশ্রম করে তারা একমুঠো ফসলের জন্য। অথচ এদেশে মাটিতে বীজ পড়লেই গাছ হয়ে যায়, নদীতে জাল ফেললে কাঁড়ি কাঁড়ি মাছ পাওয়া যায়, কনকনে শীত নেই, নেই ঝাঁ ঝাঁ গরম, সবসময় আরামদায়ক আবহাওয়া। এখান থেকেই সেই কথাটা এসেছে, ”হায় সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!”। উল্লেখ্য সেলুকাস ছিলেন ভারতবর্ষে আলেক্সান্ডারের গভর্নর। তারা অবাক হওয়ার পাশাপাশি এদেশের অঢেল প্রাচূর্য এবং ঐশ্বর্য দেখে ঈর্ষান্বিত হয়েছিলো।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর পর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য অন্যান্য গ্রীক গভর্নরদের পরাজিত করেন। শুধু সেলুকাসের সাথে চুক্তি করা হয় এবং তাকে ২০০ হাতি (খুব সম্ভবত) দেওয়া হয়। সে সময় পাটালিপুত্রে রাজধানী স্থাপন করা হয়। স্যার বড় পর্দায় পাটালিপুত্রের যে ছবি দেখালেন তা দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। পুরো শহর উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, ফাঁকে ফাঁকে তীরন্দাজদের জন্য ছোট ছোট খোপ, শহরের চারপাশে চওড়া ও গভীর পরিখা, ৫০০টা টাওয়ার, ৬৪টা গেট – এ এক বিশাল কান্ড! দেওয়াল, দূর্গ, ঘরবাড়ি অর্থাৎ পুরো শহর কাঠের তৈরি ছিলো। ছবিটা দেখে আমার চোয়াল ঝুলে পড়লো। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ সালের দিকে আমাদের এত উন্নত শহর ছিলো! কি অবাক করা কান্ড!!

তাদের শাসন ব্যাবস্থা শুনে আমি আবার বেকুব হয়ে গেলাম। রাজা চন্দ্রগুপ্ত ৩০ জন সদস্য নিয়ে ৬টা বোর্ড তৈরি করেছিলেন। তাদের কাজ ছিলো যথাক্রমে,

  • শিল্পজাত পন্যের উৎপাদন পর্যবেক্ষন করা
  • বিদেশি অর্থাৎ গ্রীকদের সমস্যা সমাধান করা
  • জন্মমৃত্যুর হিসাব রাখা
  • বাজারে পন্যের গুণাগুণ ও ওজন পর্যবেক্ষন করা
  • ভেজাল, বাসি ও পচা জিনিসপত্র যাতে পন্যে মিশানো না হয় তা পর্যবেক্ষন করা
  • পন্যের বিক্রয়মূল্য থেকে ট্যাক্স আদায় করা

৬টা বোর্ডের মধ্যে প্রায় ৪টাই বাজারের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। অত বছর আগেও রাজা অন্যান্য সবকিছু থেকে বাজারকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন। আর এতবছর পরও আমরা ঠিকমত বুঝতে পারছি না বাজার ব্যাবস্থাকে আসলে কতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। মনের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো। হায়, আমরা কত অভাগা জাতি!

সাঁচিতে অবস্থিত তোরনসহ একটি স্তুপা

এরপর সম্রাট অশোকের সময় স্থাপত্যের মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার শুরু হয়। স্তুপা নামক অর্ধগোলাকৃতি এক ধরনের স্থাপনা তৈরি করা হয় যার উচ্চতা ৩৫ ফুট, ব্যাসার্ধ ৭০ ফুট। এর গেটকে বলা হতো ‘তোরন‘ যাকে অনুসরন করে এখন জাপানে বিভিন্ন রকম গেট তৈরি করা হয়। কি আশ্চর্য, জাপানিজ গেটের উৎপত্তি আমাদের ভারতবর্ষে!! হাঁ হয়ে গেলাম যখন শুনলাম ১/২ টা নয়, সম্রাট অশোক সারা ভারতবর্ষে ৮৪০০০টা স্তুপা তৈরি করে গিয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে অজন্তা ইলোরায় পাহাড় কেটে বানানো বিশেষ ‘রক কাট চেম্বার‘ বানানো হয়েছিলো। আরও ছিলো বৌদ্ধবিহার বা মনেস্ট্রি। সেগুলোর প্ল্যান দেখে থ হয়ে গিয়েছিলাম। কি বুদ্ধি ছিলো মানুষের! এত সুন্দর প্ল্যান করা জিনিস আমাদের এখানে ছিলো ভাবতেই কেমন অদ্ভুত লাগে।

আমার বেকুব হওয়ার কাহিনী (পর্ব ১): সিন্ধু সভ্যতা এবং আলেক্সান্ডার

খুব ছোটকালে বাঙালি জাতি সম্পর্কে চমৎকার ধারনা পেয়েছিলাম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে। কবিতার কয়েকটা লাইন এরকম ছিলো,

”অলস দেহ ক্লীষ্ট গতি-
গৃহের প্রতি টান।
তৈল-ঢালা স্নিগ্ধ তনু
নিদ্রারসে ভরা,
মাথায় ছোট বহরে বড়
বাঙালি সন্তান।”

কবিতাটা পড়ে তখন থমকে গিয়েছিলাম। মনে মনে ভাবলাম সত্যি সত্যি বাঙালি কি এমন? নাহলে কবিগুরু তো আর এমনি এমনি লিখে যাননি। আস্তে আস্তে সব কিছু আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে এলো, কবিগুরু কোন ফালতু কথা বলে যাননি। বাঙালি আসলেই এমন। এটা বোঝা অবশ্য কঠিন কিছু না। আমরা পরপর তিনবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন, এটা কি এমনি এমনি সম্ভব? আমার বিদেশে থাকা কাজিনদের কাছ থেকে শুনতে পাই বাঙালি পরিচয় দিলে ওদের কতরকম অসুবিধা হয় কারন ওদের দেশে সকল প্রকার অপরাধ কর্মের সাথে সাথে কমপক্ষে এক জন বাঙালি জড়িত থাকবেই। এক কাজিন তো বলেই ফেললো কোনভাবে ন্যাশনালিটি বদলানো যায় কিনা! তাছাড়া সব কাজে বাঙালি নিজেকে নিজেই ব্যাঙ্গ করে, যেমন- বাঙ্গালির টাইম বলে একটা কথা আছে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি এটা কোন বিদেশি মানুষ বলে যাননি। বাঙালি যে সময়ানুবর্তীতার প্রতি কেমন উদাসীন তা প্রমান করার জন্যই নিজেরাই এই প্রবচন চালু করেছে। যতই বড় হচ্ছি ততই দেখছি বাঙালি হিসেবে আসলে বড় গলায় বলার কিছু নেই। আমাদের গর্ব করার বিষয় শুধু বায়ান্ন, একাত্তর আর ড. মুহম্মদ ইউনুস। এছাড়া এত বিশাল জাতি হিসেবে আমাদের সত্যিকার অর্থে অর্জন খুব বেশি কিছু নাই।
আমি এই ধারনা নিয়েই এত বছর বেড়ে উঠেছিলাম। অন্তত কয়েক মাস আগ পর্যন্ত আমার বাঙালি জাতি সম্পর্কে এই ধারনাই ছিলো। কিন্তু রমজান মাসের এক শনিবার হঠাৎ আমি ধাক্কা খেলাম। যে সে ধাক্কা না, বেশ বড়সড় ধাক্কা।

আমাদের লেভেল-১, টার্ম-২ এ নতুন একটা কোর্স পেলাম যার নাম হিস্ট্রি অফ বেঙল আর্কিটেকচার। খুব স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছিলাম প্রচন্ড বোরিং একটা ক্লাস হবে। কিন্তু ক্লাসে ঢুকে স্যার প্রথম যে কথা বললেন শুনে হচকিয়ে গেলাম। স্যার আমাদের খুব সিম্পল প্রশ্ন করলেন, বাংলাদেশে কয়টা নদী আছে? বেশ অবাক হয়ে আমি আবিষ্কার করলাম প্রশ্নের উত্তরটা তো আমি জানিনা। শুধু আমি যে জানিনা তা নয়, ক্লাসের কেউই সঠিক উত্তরটা জানে না। স্যার বললেন, ”আমাদের দেশ সম্পর্কে আমরা শুধু এটা জানি যে আমরা আসলে কিছুই জানি না”। লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেলো। স্যার জানতে চাইলেন আমাদের প্রধান খাদ্য চালের বাৎসরিক চাহিদা সম্পর্কে। আমরা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। স্যার বোর্ডে বিশাল সংখ্যাটা লিখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”আমরা পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশের একটা হয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি খাবার চাল খাই। শুধু খাই না, সবটাই নিজেরা উৎপাদন করি। এটা মোটেই কম কথা নয়”। খানিকপর স্যার বললেন আমাদের ইতিহাসের কথা। মহেঞ্জদারো, হরপ্পা, সিন্ধু সভ্যতার কথা। খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সালে গড়ে ওঠা সে শহরে ছিল ড্রেনেজ সিস্টেম, অ্যাটাচড বাথরুম, আন্ডার গ্রাউন্ড ওয়াটার স্টোরেজ। একই সময়ে ইংল্যান্ডে চলছে স্টোনহেঞ্জের যুগ! শুনে আমি কেমন যেন বেকুব হয়ে গেলাম। আমাদের ভারতবর্ষে যখন প্ল্যানড সিটি, ইংল্যান্ডে তখন মাত্র স্টোনহেঞ্জ!! স্কুল কলেজে শিক্ষা নিতে নিতে জীবনের ১২ টা বছর পার করলাম, অথচ আমাদের ইতিহাসের এই সাংঘাতিক কথাটা আমি জানতাম না। কি আশ্চর্য!!!

পরের ক্লাসগুলোতে আরও ধাক্কা খেলাম। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে যখন আলেক্সান্ডার ভারতবর্ষ আক্রমন করে, তখন পুরো ভারতবর্ষ দখল করলেও মাত্র দুটো এলাকা আক্রমন করে নাই। সত্যি বলতে আক্রমন করার সাহস পায় নাই। সে এলাকার দূর্গ এবং রক্ষণ ব্যবস্থা এতই উন্নত ছিলো যে আলেক্সান্ডারের নীতিনির্ধারকেরা সে দিকে আক্রমণ করার চিন্তা ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়েছিলেন। সে জায়গা দুটোর নাম ছিলো গঙ্গারিডো আর প্রাসিওই। নাম দুটো গ্রীকদের দেওয়া। যখন নাটকীয়ভাবে স্যার বললেন প্রাচীন এই দুটো জায়গাকে বর্তমানে বাংলাদেশ বলা হয়, আমার মাথায় বাজ পড়লেও আমি এত অবাক হতাম না। কি সাংঘাতিক কথা, আমার দেশ এত উন্নত ছিলো! আলেক্সান্ডার দ্যা গ্রেট পর্যন্ত এই দেশ আক্রমন করতে সাহস পায় নি। হায় খোদা! নিজের দেশের এই কথা আমি এত বছর জানলাম না, কি পোড়া কপাল!!

আগে বাঙালি হিসেবে মানসিকভাবে ‘একটু’ দূর্বল ছিলাম, এখন আমি আর দূর্বল না। আমার ভারতবর্ষ, আমার দেশের ইতিহাস মোটেও হেলাফেলা করার মত না। শুধু দুঃখের ব্যাপারটা হলো, এই সাংঘাতিক ইতিহাসগুলো আমরা কেউই জানি না। এই স্যার না বললে আমরাও কোনদিন জানতে পারতাম না।

চাঁদটা শুধু ওঠার অপেক্ষা

এবার শুধু অপেক্ষার পালা। দীর্ঘ এক মাস ধরে চলা প্রস্তুতির সমাপ্তি পর্যায়ে দাঁড়িয়ে সকলে একবার করে হিসেব করে নিচ্ছেন ঈদের কি কি প্রস্তুতি এখনও বাকি রয়ে গেছে।

শবে ক্বদর শেষে আরও কয়েকটা রোজা বাকি থাকলেও ইফতারির দোকানগুলোতে হাঁড়ি পাতিল গোছানোর ভাব শুরু হয়ে গেছে। বাইরের মানুষ ইতোমধ্যে ঢাকা শহর ছেড়ে চলে গিয়েছে। গাড়ির হর্নমুক্ত, জ্যামহীন ঢাকা শহরের রাস্তায় নেমে ‘অরিজিনাল’ ঢাকাবাসীদের মুখের হাসি চওড়া হচ্ছে। টেলিভিশনে বাড়ি ফেরার বিজ্ঞাপনগুলো (বিশেষ করে গ্রামীনফোনের) প্রচার করা হচ্ছে। যারা এখনও বাড়ি ফিরতে পারেননি তারা লাস্ট চান্স হিসেবে বাসের ছাদ, লঞ্চের ছাদ আর ট্রেনের ছাদে একটা পা রাখতে পারার আশায় টার্মিনালগুলোতে বসে আছেন।

ঈদের জন্য কেনা নতুন জামাগুলো বের করে সবাই একচোখ দেখে নিচ্ছেন। নতুন জামা, পায়জামা আর পাঞ্জাবিগুলো ইস্ত্রি করা হচ্ছে। জামা আর শাড়ির সাথে মিলিয়ে গয়নাগাটি কেনা হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু কখন কোন পোশাক পড়া হবে সেটা আলোচনা করে ঠিক করাই বাকি। ঈদের নামাজে যাওয়ার জন্য আতর, টুপিও রেডি। নতুন স্যান্ডেলটাও বাক্স থেকে বের করে রাখা আছে।

বাজারে ‘আগুন’ লেগে যাওয়ার পরও প্রত্যেক ঘরে ঘরে চিনি, দুধ আর সেমাই কেনা হয়ে গেছে। গৃহকর্ত্রী মনে মনে হিসেব করছেন কয়টা মুরগি আর কয় কেজি গরু রান্না করতে হবে। কোন বিছানায় কোন চাদর দেয়া হবে আর টেবিলে নতুন কি ক্লথ বিছানো হবে সেটা ঠিক করতে করতে মা মেয়ের মধ্যে বাদ প্রতিবাদ শুরু হয়ে গেছে।

ছোটরা দাদা বাড়ি অথবা নানা বাড়িতে দারুণ হৈচৈ করছে। পাতা মেহেদি বাটা মেয়েদের নখে বসে পড়তে শুরু করেছে। আর টিউব মেহেদি বার বার নেড়েচেড়ে দেখা হচ্ছে, ঠিকমত মেহেদি বের হচ্ছে কিনা।

ব্যাংক থেকে আনা নতুন একশো টাকার নোটগুলো বের করে ভাগ করে রাখা হচ্ছে। ছোটরা সালাম করতে এলে তো আর খালি হাতে যেতে দেওয়া যায় না! মোবাইল ফোনগুলোতে টাকা ভরে রাখা আছে। ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে পরিচিতদের এসএমএস করতে যাতে এক মূহুর্তও দেরি না হয়।

যে মানুষ সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে, হঠাৎ করেই ঘুরেফিরে তাদের কথা মনে পড়তে শুরু করেছে। কি আশ্চর্য, গত ঈদেও মানুষটা আমাদের সাথে আনন্দ করেছে অথচ এ বছর সে কেমন করে হারিয়ে যেতে পারলো সবাইকে ছেড়ে? আর যে পরিবারের সদস্য পড়ে আছে বিদেশ বিভুঁইয়ে, তারা বুকে একধরনের বিশাল শূন্যতা চেপে রেখেছে। আহা, সবাই মিলে যদি একসাথে ঈদ করা যেত- ভাবতে ভাবতেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে দুফোঁটা নোনা জল। তবে কেউ দেখে ফেলার আগেই হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তাড়াতাড়ি সেটা মুছে ফেলতে হচ্ছে।

সব রকম প্রস্তুতিই শেষ। এবার শুধু চাঁদটা উঠার অপেক্ষা। সকল প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সন্ধ্যার আকাশে দেখা যাবে বাঁকা এক ফালি চাঁদ। আর ঘরে ঘরে বেজে উঠবে চির সবুজ সেই গান, “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ”। আর ছড়িয়ে পড়বে এক অনাবিল আনন্দ, সারা দেশ মেতে উঠবে খুশির কলকাকলিতে।

সকলকে জানাই ঈদ মুবারাক