খুব ছোটকালে বাঙালি জাতি সম্পর্কে চমৎকার ধারনা পেয়েছিলাম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে। কবিতার কয়েকটা লাইন এরকম ছিলো,
”অলস দেহ ক্লীষ্ট গতি-
গৃহের প্রতি টান।
তৈল-ঢালা স্নিগ্ধ তনু
নিদ্রারসে ভরা,
মাথায় ছোট বহরে বড়
বাঙালি সন্তান।”
কবিতাটা পড়ে তখন থমকে গিয়েছিলাম। মনে মনে ভাবলাম সত্যি সত্যি বাঙালি কি এমন? নাহলে কবিগুরু তো আর এমনি এমনি লিখে যাননি। আস্তে আস্তে সব কিছু আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে এলো, কবিগুরু কোন ফালতু কথা বলে যাননি। বাঙালি আসলেই এমন। এটা বোঝা অবশ্য কঠিন কিছু না। আমরা পরপর তিনবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন, এটা কি এমনি এমনি সম্ভব? আমার বিদেশে থাকা কাজিনদের কাছ থেকে শুনতে পাই বাঙালি পরিচয় দিলে ওদের কতরকম অসুবিধা হয় কারন ওদের দেশে সকল প্রকার অপরাধ কর্মের সাথে সাথে কমপক্ষে এক জন বাঙালি জড়িত থাকবেই। এক কাজিন তো বলেই ফেললো কোনভাবে ন্যাশনালিটি বদলানো যায় কিনা! তাছাড়া সব কাজে বাঙালি নিজেকে নিজেই ব্যাঙ্গ করে, যেমন- বাঙ্গালির টাইম বলে একটা কথা আছে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি এটা কোন বিদেশি মানুষ বলে যাননি। বাঙালি যে সময়ানুবর্তীতার প্রতি কেমন উদাসীন তা প্রমান করার জন্যই নিজেরাই এই প্রবচন চালু করেছে। যতই বড় হচ্ছি ততই দেখছি বাঙালি হিসেবে আসলে বড় গলায় বলার কিছু নেই। আমাদের গর্ব করার বিষয় শুধু বায়ান্ন, একাত্তর আর ড. মুহম্মদ ইউনুস। এছাড়া এত বিশাল জাতি হিসেবে আমাদের সত্যিকার অর্থে অর্জন খুব বেশি কিছু নাই।
আমি এই ধারনা নিয়েই এত বছর বেড়ে উঠেছিলাম। অন্তত কয়েক মাস আগ পর্যন্ত আমার বাঙালি জাতি সম্পর্কে এই ধারনাই ছিলো। কিন্তু রমজান মাসের এক শনিবার হঠাৎ আমি ধাক্কা খেলাম। যে সে ধাক্কা না, বেশ বড়সড় ধাক্কা।
আমাদের লেভেল-১, টার্ম-২ এ নতুন একটা কোর্স পেলাম যার নাম হিস্ট্রি অফ বেঙল আর্কিটেকচার। খুব স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছিলাম প্রচন্ড বোরিং একটা ক্লাস হবে। কিন্তু ক্লাসে ঢুকে স্যার প্রথম যে কথা বললেন শুনে হচকিয়ে গেলাম। স্যার আমাদের খুব সিম্পল প্রশ্ন করলেন, বাংলাদেশে কয়টা নদী আছে? বেশ অবাক হয়ে আমি আবিষ্কার করলাম প্রশ্নের উত্তরটা তো আমি জানিনা। শুধু আমি যে জানিনা তা নয়, ক্লাসের কেউই সঠিক উত্তরটা জানে না। স্যার বললেন, ”আমাদের দেশ সম্পর্কে আমরা শুধু এটা জানি যে আমরা আসলে কিছুই জানি না”। লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেলো। স্যার জানতে চাইলেন আমাদের প্রধান খাদ্য চালের বাৎসরিক চাহিদা সম্পর্কে। আমরা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। স্যার বোর্ডে বিশাল সংখ্যাটা লিখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”আমরা পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশের একটা হয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি খাবার চাল খাই। শুধু খাই না, সবটাই নিজেরা উৎপাদন করি। এটা মোটেই কম কথা নয়”। খানিকপর স্যার বললেন আমাদের ইতিহাসের কথা। মহেঞ্জদারো, হরপ্পা, সিন্ধু সভ্যতার কথা। খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সালে গড়ে ওঠা সে শহরে ছিল ড্রেনেজ সিস্টেম, অ্যাটাচড বাথরুম, আন্ডার গ্রাউন্ড ওয়াটার স্টোরেজ। একই সময়ে ইংল্যান্ডে চলছে স্টোনহেঞ্জের যুগ! শুনে আমি কেমন যেন বেকুব হয়ে গেলাম। আমাদের ভারতবর্ষে যখন প্ল্যানড সিটি, ইংল্যান্ডে তখন মাত্র স্টোনহেঞ্জ!! স্কুল কলেজে শিক্ষা নিতে নিতে জীবনের ১২ টা বছর পার করলাম, অথচ আমাদের ইতিহাসের এই সাংঘাতিক কথাটা আমি জানতাম না। কি আশ্চর্য!!!
পরের ক্লাসগুলোতে আরও ধাক্কা খেলাম। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে যখন আলেক্সান্ডার ভারতবর্ষ আক্রমন করে, তখন পুরো ভারতবর্ষ দখল করলেও মাত্র দুটো এলাকা আক্রমন করে নাই। সত্যি বলতে আক্রমন করার সাহস পায় নাই। সে এলাকার দূর্গ এবং রক্ষণ ব্যবস্থা এতই উন্নত ছিলো যে আলেক্সান্ডারের নীতিনির্ধারকেরা সে দিকে আক্রমণ করার চিন্তা ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়েছিলেন। সে জায়গা দুটোর নাম ছিলো গঙ্গারিডো আর প্রাসিওই। নাম দুটো গ্রীকদের দেওয়া। যখন নাটকীয়ভাবে স্যার বললেন প্রাচীন এই দুটো জায়গাকে বর্তমানে বাংলাদেশ বলা হয়, আমার মাথায় বাজ পড়লেও আমি এত অবাক হতাম না। কি সাংঘাতিক কথা, আমার দেশ এত উন্নত ছিলো! আলেক্সান্ডার দ্যা গ্রেট পর্যন্ত এই দেশ আক্রমন করতে সাহস পায় নি। হায় খোদা! নিজের দেশের এই কথা আমি এত বছর জানলাম না, কি পোড়া কপাল!!
আগে বাঙালি হিসেবে মানসিকভাবে ‘একটু’ দূর্বল ছিলাম, এখন আমি আর দূর্বল না। আমার ভারতবর্ষ, আমার দেশের ইতিহাস মোটেও হেলাফেলা করার মত না। শুধু দুঃখের ব্যাপারটা হলো, এই সাংঘাতিক ইতিহাসগুলো আমরা কেউই জানি না। এই স্যার না বললে আমরাও কোনদিন জানতে পারতাম না।
vaalo laaglo nk poreeee…..shundor likhecho tumi…..nuzhat… shudhu ekta somossa level 1 term 2 hobe…..
ektu vab marka com dilam archi…
তুই প্রথম অামার এখানে লিখলি, হিমি!
তোকে স্পেশাল থ্যাংকস। ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আরেকবার থ্যাংকস।
2r lekha pore bujte parlam amra bangali ra jaat hisebe age unnoto silam..ekhon nai.
Arri Appu sir er kotha cls a shune OBAK hoi nai, kn2 2r lekha pore OBAK holam! Besh valo likhsis!
থ্যাংকস, লিউ ।
বঙ্গসন্তান হিসেবে গর্ব অনুভব করছি।।
ধন্যবাদ, ভাই।
khubi valo laglo pore….eto valo likhish jantam na….
খুব ভালো লেখা । অনেকদিন পরে , প্রায় দু মাস পরে আবার লেখা পেলাম । এখনকার ভারতকে নিয়ে এই উপমহাদেশের অন্তত তিনটে দেশ – ভারত,বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সব ভাইবোনেদের সঙ্গে গৌরব ভাগাভাগির বাস্তব অস্বস্তি আছে । কিন্তু আমাদের পুরানো (অন্তত মুঘল আমল পর্যন্ত) ভারতবর্ষের সমস্ত গৌরবের অংশীদার আমরা সবাই । যাইহোক , লেখাটার পড়ে এই ব্যাপারে কিছু তথ্য জানানোর লোভ সম্বরন করতে পারলাম না । তথ্যগুলো হল :
1. ভারতবর্ষ কখনো পররাজ্য দখল করে নি বা কোন জাতিকে পদানত করে রাখে নি । Colonization অর্থে বলছি ।
2. আলেকজান্ডার ও পুরুর সম্বন্ধে যে গুল্প চালু আছে সেটা ডাঁহা মিথ্যা । আলেকজান্ডার পুরুকে মোটেই পরাজিত করতে পারে নি – বরং সয়ং পুরুর সঙ্গে সন্মুখসমরে পুরুর ছোঁড়া বল্লমের আঘাতেই আলেকজান্ডার মারাত্মক ভাবে আহত হয়ে “সাফল্যের সঙ্গে পশ্চাদাপসরণ” করতে করতে মাতৃভূমি গ্রীসের ম্যাসিডোনিয়া পর্ষন্ত আর পৌঁছতে পারেন নি । মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাবিলনেই তার জীবনদীপ নির্বাপিত হয় । সাহেব ঐতিহাসিকেরাও এখন স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন । এমনকি হলিউডের ফিল্ম যাতে বিখ্যাত অভিনেত্রী এ্যাঞ্জেলিনা জোলি অভিনয় করেছেন ; তাতেও এই ঘটণাটা গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হয়েছে । ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে গেলো , কারন এখানে বাংলাদেশ নেই । তবুও লোভ সামলাতে পারলাম না । পারলে দেখে নাও : http://en.wikipedia.org/wiki/File:AlexanderPoster.jpg
3. গঙ্গারিডো আর প্রাসিওই কি শুধুই বর্তমান বাংলাদেশ ? না কি এখনকার পশ্চিমবঙ্গেরও অনেক এলাকা এর মধ্যে আছে ? যেমন চন্দ্রকেতুগড় (এর খুব কাছেই আমার দেশের বাড়ি ; এখনকার নাম বেড়াচাঁপা/দেবালয়) ।
4. ভারতবর্ষের প্রকৃত ইতিহাস এখনও লেখা হয় নি – সবই বৃটিশদের দ্বারা লিখিত বিকৃত ইতিহাস । যেমন স্বাধীণতা সংগ্রামে মুসলিম জণগোষ্টির অবদানকে একেবারেই অস্বীকার করে অামাদের অন্ধকারে রাখা হয়েছে । মহাণ বিপ্লবী “মাষ্টারদা” সূর্য সেনের আন্দোলনে মুসলিম স্বাধীণতা সংগ্রামীদের অনবদ্য অবদানকে এখনও পর্যন্ত স্বীকৃতি দেওয়া হয় নি ।
আর একটা কথা -“1952, 1971 আর মোহম্মদ ইউনুস”- এগুলোর মাঝে “বঙ্গবন্ধু”র কথা একবারও মনে এল না ! সত্যিই বড্ড অদ্ভুত লাগছে !
যাই হোক তোমার লেখাটা আরও বড় ও বিস্তৃত হলে আরও ভালো হয় । অনেক কিছু লিখে ফেললাম তোমার লেখাটা আসলে ভালো লেগেছে বলেই ।
শুভেচ্ছা নিও ।
আলেক্সান্ডার ও পুরুর কাহিনী আমরা সবাই জানি। কিন্তু কাহিনীটা মিথ্যা এটা জানতাম না।
গঙ্গারিডো আর প্রাসিওই কি শুধুই বর্তমান বাংলাদেশ কিনা নাকি পশ্চিমবঙ্গও এর মাঝে আছে তা সঠিক বলতে পারবো না। আমি শুধু স্যারের কথাগুলো তুলে ধরেছি। স্যার বলার সময় পশ্চিমবঙ্গের কথা উল্লেখ করেন নি। শুধু বাংলাদেশের কথা বলেছিলেন।
স্যার আমাদের পড়ানোর সময় ড. অতুল চন্দ্রের লিখা ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ বইটার রেফারেন্স দেন। আগ্রহী হলে খুঁজে দেখতে পারেন।
অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ, জেঠু। কালীপূজা কেমন কাটলো জানাবেন।
ক্লাস সিক্সের সমাজ বইয়ে এই কথাগুলো লেখা ছিল। তখন মনে হয় উপলব্ধি করতে পারনাই। আমাদের জাতি আসলে বার্ধক্যে আক্রান্ত… হাজার হাজার বছরের উন্নতি এখন ধূলিসাৎ।
সমাজ বইয়ে ইতিহাস এভাবে লিখা ছিলো না। এজন্য পড়লেও ব্যাপারটা বুঝতে পারি নাই।
তবে আমি আপনার মত হতাশ নই। আমরা আমাদের ইতিহাসটাই ঠিকমত জানি না। আগে তো সেটা জানতে হবে। পরে না হয় উন্নতির কথা ভাবা যাবে………
sundor likhsish… good
সুন্দর লেখা keep it up
তবে নদীর প্রকৃত সংখ্যা কেউ জানতো না- এইটা maybe ঠিক না… আমাদের সারির বেশ কয়েক জন জানতো, ওই সময় বলেওছিল- স্যার খেয়াল করেননি।
স্টোনহেঞ্জের সাথে তুলনাটা দারুণ হয়েছে…
কিন্তু আমার যা মনে পড়ে কেউই স্যারকে নদীর সঠিক সংখ্যাটা বলতে পারে নাই।(আমি আবার দূর্বল স্মৃতি শক্তির অধিকারী তো…………)
অনেক ধন্যবাদ।
slightlytrolling কে উত্তর দিতে গিয়ে তুমি যে হতাশায় আক্রান্ত নও সেটার উচ্চকিত ঘোষণাটা ভালো লাগলো । আর এটাই তোমার +ve দিক । খুব ভালো লাগলো ।
আমি কখনও হতাশ নই। যত যাই হোক আমাকে কেউ হতাশ বলতে পারবে না। বিশেষ করে আমার দেশকে নিয়ে তো নয়ই।
আমি আশাবাদী মানুষের দলে। এই আশা, এই স্বপ্ন শেষ হবেনা কোনদিন।
আমি আমার দেশের পাশে আছি সবসময়।
amader prachin ei garbo gulo samparke kichu dharona chilo , history nie garbo thaka valo kintu amader bartoman der duty holo sei golden era ke firie ana jate future amader nie thik eirokom garbo korte pare . we should take the challenge to create the repetation of history.
bangla horof e lekhata ekhono thik rapto karte parini baddo deri hoi tai………..
অনেক চমৎকার লিখেছেন। ধন্যবাদ।
কিন্তু সমস্যা কি জানেন? আপনার কথাগুলো আমি বুঝি, আপনি বোঝেন, অথচ যাদের এখন বোঝার কথা তারাই বোঝে না।
বাংলা লিখা কঠিন কিছু নয়। ‘অভ্র’ সফটওয়ারটা ডাউনলোড করে নিলে ফোনেটিক ব্যাবহার করে সহজেই বাংলা লিখা যায়। প্রথম প্রথম একটু সময় লাগবে, তারপর আপনিও ধাঁই ধাঁই করে বাংলা লিখতে পারবেন।
শুভকামনা রইল।
আরে ওরা তো ছিল খাটি আর্য সন্তান। আর্যরা ছিলো উন্নত আর শক্তিশালি। তখন কি বাঙালি ছিল? বাঙালি তো হাল আমলে তৈরি হইছে। সংকরায়নের ফলে। আমরা সংকর জাতি।