The Mighty INDIA CALLING: জার্নি ব্যাক টু বাংলাদেশ এবং বর্ডারে ছোটখাটো ‘কেয়ামত’ (পর্ব ৪৩)

সত্যি সত্যি গভীর রাতেই আমরা ঘুম থেকে উঠলাম। মোটামুটি চারটা বাজে তখন। নিজেরা চোখ ডলে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। প্রত্যেকেই রেডি হয়ে শেষ বারের মত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম। এতটুকু সময় নষ্ট না করে একে একে মালপত্র রুম থেকে বের করতে লাগলাম। সবার লাগেজের সংখ্যাই ছয়, সাত, আটের মতন। একটা মাত্র লিফট দিয়ে এতগুলো লাগেজ নিচে নামানোটাও কম হ্যাপা না। সবার আগে মজুমদার আর মৌলি বের হয়ে গেলো। সবার শেষে আমি আর রুবাইদা রুম ছেড়ে বের হলাম। লিফটের সামনে তখন লাগেজের লাইন পড়ে গেছে। এদিকে আমরা আবার তিনতলায় আছি। ওদিকে দোতলার লোকজন সব লিফট ভরে মালপত্র ঢুকাচ্ছে কারণ লিফট তিন তলায় আসার আগে দোতলায় থামে। তাই লিফট যখনই তিন তলায় আসে তখনই ভরা থাকে, আমরা আর উঠতে পারি না। এভাবে কেটে গেলো অনেকক্ষণ। শেষে আমরা অধৈর্য্য হয়ে গেলাম। তখন দোতলার লোকজনদের একটু মায়া দয়া হলো। ওরা আমাদের জন্য একটা খালি লিফট পাঠালো। সেই লিফটেই আমি আমার সব বড় ব্যাগ সাধ্যমত তুলে দিলাম। বাকি গুলো নিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলাম।

নিচে গিয়ে আবার লিফট থেকে মালপত্র টেনে টেনে নামাতে হলো। আগেই দেখেছিলাম নিচতলার ফ্লোরটায় লেভেল আপডাউন অনেক বেশি। এই ভারি ভারি ব্যাগ টেনে হিঁচড়ে নিতে নিতে আমাদের ঘাম ছুটে গেলো। আমরা মালপত্র রিসেপশনে রেখে বাইরে বের হয়ে আসলাম। অন্ধকার রাত, সূর্য ওঠার কোন লক্ষণ নাই। ওদিকে আমাদের বাস আসে নাই। তাই আমরা বের হতে পারছি না।

একসময় আমাদের বাস আসলো। সেটা দাঁড়িয়ে রইলো রফি আহমেদ স্ট্রিটে। আমাদেরকে সেখান পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে। হেঁটে যাওয়াটা তো কোন ব্যাপারই না। কিন্তু সাথে যখন এতগুলো মালপত্র, তখন আমাদের মাথা চুলকাতে হলো। কিন্তু কিছু করার নাই। বিসমিল্লাহ বলে রওয়ানা দিলাম। পিঠে ব্যাকপ্যাক, কাঁধে সাইড ব্যাগ, এক হাতে দুইটা পোথিসের ব্যাগ আর লাগেজের উপর বড় ব্যাগটা বসিয়ে অন্য হাতে আরেকটা ছোট ব্যাগ নিয়ে সেই হাতেই লাগেজটা টানতে লাগলাম। আমার মনে হলো আমার সব বোধ শক্তি শেষ হয়ে গেছে। এভাবে করে সাতটা ব্যাগ নিয়ে এই রাস্তা হেঁটে পাড়ি দেওয়া যে সম্ভব না সেটা বুঝার ক্ষমতাও যেন লোপ পেয়ে গিয়েছে। লাগেজের হ্যান্ডেল ধরে টানার সময় একটু পর পর ধুড়ুম করে লাগেজের উপর থেকে বড় ব্যাগটা পড়ে যেতে লাগলো। একবার আমি নিজেই তুললাম, আরেকবার জাফর তুলে দিলো, আরেকবার তুলে দিলো রুবাইদা। শেষে আমার অবস্থা দেখে রুবাইদা এগিয়ে আসলো। ও বুদ্ধিমানের মতন সব লাগেজ একবারে না এনে ভাগেভাগে নিয়ে এসেছে। ও আমার কয়েকটা জিনিস বয়ে নিয়ে গেলো।

অনন্তকাল পর মনে হলো আমি রফি আহমেদ স্ট্রিটে এসে পৌঁছেছি। তখন আকাশ একটু একটু পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। ভোরের সেই ফ্যাকাশে আলোয় দেখলাম একটা সাধারণ বাস রাস্তায় ট্রাম লাইনের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তার পিছনে আমাদের লাগেজের বিশাল স্তুপ। আমি গিয়ে আমার লাগেজও সেখানে রেখে দিলাম। বাসে কেন লাগেজ ওঠানো হচ্ছে না- এই প্রশ্নের উত্তর পেলাম একটু পরেই। আসলে লাগেজ ওঠানোর সব জায়গা ভরে গেছে। বাসের লোকজন চিন্তা ভাবনা করে কিছু কিছু লাগেজ বাসের ভিতর আমাদের বসার জায়গায় তুলে দিচ্ছে। কিন্তু এই পাহাড়সম লাগেজের স্তুপ কোথায় জায়গা দেওয়া হবে সেটার কোন সমাধান কেউ করতে পারছে না। ওদিকে কমিটির লোকজন উশখুশ করতে লাগলো। বাস এখনই ছেড়ে দিতে হবে কারণ আমরা দাঁড়িয়ে আছি ট্রাম লাইনের উপর। ট্রাম চলাচল শুরু হলে আমাদের বাসের কারণে রাস্তা ব্লক হয়ে যাবে। ওদিকে সবাই এসে পৌঁছায়ও নাই। আমরা যারা যারা ছিলাম তারা বাকিদের ফোন দিতে লাগলাম। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই মোটামুটি সবাই চলে আসলো। ওরা কোথায় যেন এক ভ্যান ওয়ালাকে পেয়েছিলো। সবার সব মালপত্র ভ্যানে তুলে দিয়ে ওরা দৌঁড়ে দৌঁড়ে আসতে লাগলো।

ওদিকে মারাত্মক গ্যাঞ্জাম লেগে যাচ্ছে। এত লাগেজ কেমন করে তোলা হবে সেটার কোন সমাধান হচ্ছিলো না। সবাই মিলে একসাথে হৈচৈ জুড়ে দিতে শুরু করলো কারণ সময় পার হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। শেষমেষ ব্যাপক চিৎকার করে ইশতিয়াক পরিস্থিতি সামলালো। প্রথমে আমরা সবাই সুড়সুড় করে বাসের ভিতর ঢুকে পড়লাম। বসার জায়গার কোন বালাই নাই, দুইজনের সিটে তিনজন করেও বসে গেলাম। কোনমতে সবাই উঠে বসার পর হাতে হাতে সব মালপত্র টেনে আমাদের সম্পূর্ণ বাসটা ভরে ফেলা হলো। আমাদের আর নড়া চড়ার কোন উপায় রইলো না। এক সমুদ্র লাগেজে যেন আমরা ডুবে গেলাম। সব লাগেজ উঠে যেতেই আমাদের বাস ছেড়ে দিলো। এই বার আমি নিজের দিকে একটু মনোযোগ দিলাম। জানালার পাশে বসেছে নোভা আর তারপাশে বসেছি আমি। তবে আমার সিটটা আমি শেয়ার করছিলাম নোভার হ্যাভারস্যাকের সাথে। নোভার কোলেও একটা ব্যাগ, পায়ের নিচেও আরেকটা ব্যাগ। আমার পায়ের নিচটা খালি ছিলো দেখে আমি আমার কোলে ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে অন্য একটা ব্যাগ পায়ের নিচে রেখে দিলাম।

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদের দিকে তাকানোর চেষ্টা করছিলাম। লাগেজের ফাঁক ফোকড়ে টাইট প্যাকড হয়ে বসে থাকা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত চেহারাগুলো দেখে আমার কেন যেন হাসি পেতে লাগলো। সারা বাসের মধ্যে আমিই একমাত্র হাসতে লাগলাম।  কয়েকজন একটু বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকালো। অন্তরা বলেই ফেললো, ‘নুযহাত, হাসি থামা নইলে মাইর খাবি কিন্তু’। আমার যে কষ্ট হচ্ছিলো না সেটা নয়। কিন্তু এরকম অভিজ্ঞতার কথা জীবনে আর দ্বিতীয়বার হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। কি অদ্ভূতভাবেই না আমরা ইন্ডিয়া ছেড়ে যাচ্ছি! ওদিকে অন্তরার বসার জায়গা ছিলো খুবই সামান্য। ও সেখান থেকে উঠে একটা ব্যাগের উপর পা তুলে বসে পড়লো আর নিজেকে ‘বিজনেস ক্লাস’ এর যাত্রী বলে দাবী করলো। এটা দেখেও আমি আরও হাসতে লাগলাম।

কিছু সময় পার হয়ে গেলে আমি একটু চোখ বন্ধ করার উপায় খুঁজছিলাম। আমার বামদিকে নোভার হ্যাভারস্যাকটা গ্যাঁট মেরে বসে আছে। আর ডানদিকে লাগেজের স্তুপের মধ্যে তানভীরের সবুজ স্যুটকেসটা উল্টা হয়ে এমনভাবে পড়ে আছে যার চাকাটা একদম আমার মাথা বরাবর। কি আর করা, একবার হ্যাভারস্যাক আরেকবার স্যুটকেস জড়িয়ে আমি চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করতে লাগলাম। শরীর প্রচন্ড ক্লান্ত, চোখ বন্ধ হয়ে এলেও ঠিক ঘুম আসলো না।

বর্ডারের কাছাকাছি চলে আসতেই সবাই নড়েচড়ে উঠলো। তখন আরেকটা আতংকজনক ব্যাপার বুঝতে পারলাম। আমাদের এই বাস এইখানেই ছেড়ে দিতে হবে। বর্ডার ক্রস করে আমরা আরেকটা বাসে উঠবো। এই লাগেজগুলো নিয়ে কেমন করে বর্ডার পার হবো সেই চিন্তা করে আমার পেটের ভেতর পাক খেয়ে উঠতে লাগলো। পেট্রোপোল বর্ডারে এসে আমাদের বাসটা থামলো একেবারে রাস্তার উপর। বাস থামার সাথে সাথেই কয়েকজন লোক অসম্ভত দ্রুত গতিতে আমাদের বাস থেকে মাল নামাতে শুরু করলো। ওদিকে বাইরে এই বাসে ওঠার জন্য যাত্রীদের জটলা বেঁধে গেলো। আমরা সবাই চুপ করে বসে রইলাম। সব মাল বের করা হয়ে গেলে আমরাও একে একে বাস থেকে নামতে লাগলাম। গা ঘেঁষে হুউশ করে পিছন দিয়ে যাচ্ছে বাস। তাড়াহুড়া করে লোকজন উঠছে আর নামছে বাস থেকে। এরকমই এক ব্যস্ত রাস্তার ধারেই বি-শা-ল স্তুপ করে আমাদের মালপত্র রাখা হয়েছে। আর সেটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছি আমরা সবাই। সে এক দেখার মতন দৃশ্য!

এই লাগেজের পাহাড়ের মধ্যেই আমরা যার যার নিজেদের লাগেজ খুঁজতে লাগলাম। কোনমতে একটু কোনা দেখতে পেলেও সবাই খুশি হচ্ছিলো, ‘যাক বাবা- লাগেজ হারায় নাই, আছে’।  বর্ডারে সবাই শেষবারের মত রুপি ভাঙ্গিয়ে টাকা করে নিলো। আমরা শ্যামলী ওয়েটিং রুমে খানিক্ষন বসলামও। সেখানেই জানতে পারলাম, দেবার একটা ব্যাগ মিসিং। ভাগ্য ভালো খুব মূল্যবান কিছু ছিলো না সেটাতে। তবে দেবার মন খারাপ হয়ে গেলো। আমি আমার ফোনে গ্রামীনের সিমটা ভরে ফেললাম। কিন্তু ফোন দিতে পারলাম না কারণ টাকা নাই। ওদিকে আম্মু রুবাইদার ফোনে ফোন দিয়ে আমার সাথে কথা বললো। আমি আম্মুকে বললাম আমার ফোনে টাকা পাঠাতে।

কিছুক্ষনের মধ্যেই কমিটির লোকজন বললো ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়াতে। কিন্তু আমাদের লাগেজের কি হবে? এই প্রশ্নের জবাবে ওরা জানালো শ্যামলীর লোকজনই লাগেজ নিয়ে যাবে। শুনে আমরা হতবাক হয়ে গেলাম। কে নিয়ে যাবে, কই নিয়ে যাবে কিছুই তো জানতে পারবো না! কিন্তু এছাড়া কিছু করারও নাই। তাই আল্লাহর ভরসায় লাগেজগুলোকে রেখেই আমরা লাইনে দাঁড়ালাম। লাইনে তো দাঁড়িয়েছি, কিন্তু অজানা আশংকায় বুক দুরুদুরু করতে লাগলো। ঠিকমত আসবে তো সব লাগেজ? দেবারটা তো চোখের সামনেই হারিয়ে গেলো!

লাইন ধরে ভিতরে ঢুকে পাসপোর্টে সিল মেরে ফটো তুলে ঠিকঠাক মত বের হয়ে এসে দেখি এক খোলা জায়গায় মাটির উপর আমাদের লাগেজ গুলো পড়ে আছে। কি সর্বনাশ! আমি দৌড়ে গিয়ে আমারগুলো খুঁজে বের করলাম। এখান থেকে বর্ডারের গেট পর্যন্ত লাগেজ টেনে নেওয়ার জন্য লাল উইনিফর্ম পরা অথরাইজড কুলি আছে। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে বুঝতে লাগলাম কি করা উচিৎ। সব শেষে যা আছে কপালে ভেবে সেই আগের মত সাতটা লাগেজ বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করে নিজেই টানা শুরু করি। সে যে এক কি ব্যাপক অভিজ্ঞতা সে কথা আর নাই বলি! আমার পাশেপাশে রুবাইদাও ওর মালপত্র টেনে টেনে নিচ্ছে। লাইন ধরে বাংলাদেশ-ভারত গেট পার হলাম। গেট পার হতেই সবুজ উইনিফর্ম পরা বাংলাদেশের অথরাইজড কুলিরা আমাদের সাথে দরদাম করতে লাগলো। এতক্ষণ তো নিজেই টেনে এনেছি, কিন্তু এইবার মনে হলো  শরীরে কুলাবে না। একটা কুলি নিতেই হবে। আমি আর রুবাইদা মিলে একজনকে ঠিক করলাম। লোকটা আমার আর রুবাইদার বড় ব্যাগগুলো বয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। বড় লাগেজ ব্যাকপ্যাক আর ছোটখাটো ব্যাগগুলো আমরা নিজেরাই টানতে লাগলাম।

ব্যাগপত্র টেনে আমরা বেনাপোলের কাস্টমসের অফিসে পৌঁছালাম। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফর্ম ফিলাপ করলাম। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মালপত্রগুলো নিয়ে শেষমেশ আমরা বের হয়ে পড়লাম। কুলি আমাদের সাথে হেঁটে হেঁটে আমাদের মালপত্রগুলো শ্যামলীর কাউন্টার পর্যন্ত পৌঁছে দিলো। সেখানে দেখলাম ভ্যান গাড়িতে আমাদের মাল তোলা হচ্ছে। তারপর ভ্যানগাড়িতে করেই ব্যাগেজ নিয়ে যাওয়া হবে বাস পর্যন্ত। আমি আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আবার আল্লাহর ভরসায় সব মাল দিয়ে দিতে হবে। কারণ বাস কোথায় আছে সেটা জানিনা আর এই ভ্যান আদৌ বাস পর্যন্ত পৌঁছাবে কিনা সেটারও কোন গ্যারান্টি নাই। আর অল্প বিস্তর লাগেজ হলে এক কথা, এরকম দুই তিনশ মালপত্র বাসে নিয়ে ওঠাতে ওঠাতেই যে কয়েকটা মিসিং হয়ে যাবে না সেটাও বা কে বলতে পারে? কিন্তু কিছুই করার নাই। ‘ফী আমানিল্লাহ’ বলে দিয়ে দিলাম সব মালপত্র।

এই কাউন্টারে দাঁড়িয়েই শুনলাম আমাদের বাসে কয়েকটা সিট কম আছে। তাই আমাদের কয়েকজনকে অন্য একটা বাসে করে যেতে হবে। সেই বাসটা এখনই ছেড়ে দিবে, এটা শুনেই ছেলেরা টপাটপ রাজি হয়ে গেলো। ওদেরকে আমরা বিদায় জানিয়ে দিলাম। তারপর হাঁটতে লাগলাম আমাদের বাসের দিকে।  কিছুদূরে হেঁটে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের বাসের কাছে। বিশাল খোলা জায়গায় শ্যামলীর লাল রঙের বাসটা দাঁড়িয়ে আছে। সেটার নিচে লাগেজ রাখার ফোঁকরে লোকজন লাগেজ তুলছে আর মুখ টিপে হাসি দিচ্ছে। ভাবখানা এমন, ‘বাপ রে বাপ, লাগেজের বহর দেখো!’।

আমরা বাসে উঠে বসলাম। আমি আর রুবাইদা সিট পেলাম একেবারে পিছনের সিটের আগে রোতে। বিলাসবহুল বাস, চওড়া সিট। এসির ঠান্ডা বাতাসে আমরা আমাদের ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে আরাম করে বসলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই বাসের লোকজন মাথা চুলকে বলতে লাগলো যে সিকিভাগ মাল দিয়েই লাগেজ কম্পার্টমেন্ট ভরে গেছে আর এসি বাস হওয়ায় ছাদের মাল তোলা সম্ভব না। এখন ওনারা কি করবেন বুঝতে পারছেন না। কমিটি ওনাদের আশ্বাস দিয়ে বললো যে ওনারা যেন নিশ্চিন্তে বাকি সব মাল বাসের ভিতর পুরে দেয়, যেভাবেই হোক।

ওনারা পিছন থেকে মাল ভরা শুরু করলো। পুরো আইল জুড়ে এমনভাবে জিনিসপত্র রাখা হলো সেগুলো একেবারে ছাদ পর্যন্ত ঠেকে গেলো। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে আমার সারির অন্য পাশের সিটে যে বসেছে তাদের চেহারা দেখতে পাচ্ছিলাম না। দাঁড়ালেও তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সিটের উপর পা তুলে কুঁজো হয়ে দাঁড়ালে অন্য আইলের অন্য পাশের মানুষদের একটু আধটু দেখা যায় আর কি! আমরা নিজেদের দুরাবস্থায় নিজেরাই হাসতে লাগলাম! সব লাগেজ তোলা হয়ে গেলে আমাদের অবস্থা আগের মত হয়ে গেলো। তবে সকালের বাসে যদি লাগেজের সমুদ্র সৃষ্টি হয়ে থাকে, এই বাসে বাসে সৃষ্টি হলো ‘মহা সমুদ্র’। তবে পার্খক্য একটাই, আগেরবার বসার জায়গা জুড়েও লাগেজ ছিলো, এইবার অ্যাটলিস্ট বসার জায়গাটুকুন ফাঁকা আছে!

লাগেজের স্তুপের সাথে আমরা
লাগেজের স্তুপের সাথে আমরা

বাস যখন চলতে শুরু করে তখন আমাদের গায়ে কোন শক্তি নাই। এর মধ্যেই জুবায়ের কমিটির তরফ থেকে বিদায়ী ভাষণ দিলো। আমাদের পক্ষ থেকেও মজুমদার কমিটিকে ধন্যবাদ জানালো। এর মধ্যেই আমাদের যাত্রা শুরু হলো। মোটামুটি বাস চলতে শুরু করার সাথে সাথেই সবাই চোখ বুঁজে ফেললো। বেশিরভাগই ঘুমিয়ে পড়লো, যারা ঘুমাতে পারলো না তারাও টুঁ শব্দটি করলো না। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত একদল যাত্রী নিয়ে আমাদের বাস ছুটতে লাগলো ঢাকার পথে।

বিকাল বেলা বাস থামলো মধুখালীতে। আমরা আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠলাম। একটু ফ্রেশ হওয়া দরকার। কিন্তু যেই না নামতে যাবো, সেই লাগলো বিপত্তি। নামার তো কোন জায়গা নাই- কেমন করে নামবো? আমাদের কয়েকজন তখন বিকল্প ‘রুট’ আবিষ্কার করলো। সামনের জনের সিটের মাথার উপর এক পা আর হ্যান্ডেলের উপর আরেক পা রেখে রেখে লোকজন সিট টপকে টপকে বের হতে লাগলো। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য! এই সব দেখে আমি প্রথমে ভাবলাম বের হবারই কোন দরকার নাই। তারপর কে যেন বললো, ‘এই অভিজ্ঞতা কি হবে আর জীবনে? কি আছে জীবনে- একবার ট্রাই করেই দ্যাখ!’ । এরকম উৎসাহে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমিও সাহস করে এগিয়ে গেলাম। খুব সাবধানে একেকজনের সিট টপকে টপকে বাস পার হওয়া- একটু ব্যতিক্রমধর্মী কাজই বটে! তবে ব্যাপারটা যে দারুণ অ্যাডভেঞ্চারাস, তাতে কোন সন্দেহই নাই!

এই লাগেজের সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে আমাদের নামতে হয়েছে
এই লাগেজের সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে আমাদের নামতে হয়েছে

আমাদের বেশির ভাগেরই পকেটে টাকা নাই। তাই খুব কম মানুষই খাবার কিনতে গেলো। আমার খাওয়ার কোন ইচ্ছা ছিলো না। আমি ফিরে আসলাম আবার বাসের মধ্যে। যেভাবে নেমেছিলাম ঠিক সেভাবে উঠে পড়লাম। ওদিকে কমিটি আমাদের প্যাটিস আর কিমা বন কিনে দিলো। এটাই ছিলো কমিটির তরফ থেকে আমাদের শেষ ট্রিট। আমরা চপচপে তেল দেওয়া খাবারগুলো তৃপ্তির সাথে খেয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ পর আবার যখন বাস ছাড়লো, তখন আবার অনেকে ঘুমিয়ে পড়লো।

সন্ধ্যা সাতটা থেকেই বাসা থেকে ফোন আসতে লাগলো। আমরাও মোটামুটি আন্দাজ করে করে টাইম বলছিলাম। কিন্তু বরাবরের মতনই নানা কারণে বারবার লেট হচ্ছিলো। দীর্ঘদিন পর ঢাকা শহর দেখে আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে যেতে লাগলো শেষমেশ যখন বাস ভার্সিটি এলাকায় ঢুকলো, তখন সবাই আনন্দের একটা চিৎকার দিয়ে উঠলো। সেই সাথে একটা হাহাকারও কানে বাজতে লাগলো সমানতালে। ইন্ডিয়া ট্যুর শেষ! আমাদের এত দিনের এত জল্পনা কল্পনার ট্যুরটা শেষ করে আমরা সত্যিই দেশে ফিরে এসেছি! এও কি সম্ভব যে জীবনে ইন্ডিয়া ট্যুরে যাওয়ার এক্সাইটমেন্ট আর থাকবে না?

বাস যখন পলাশি ঢুকে তখন শেষবারের মত আমরা গলা ছেড়ে গান ধরলাম। বুয়েটে এসে বাস ঢুকতেই দেখলাম আমাদের সবার আব্বু আম্মুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাস থামতে দেখেই সবাই উৎসুক হয়ে বাসের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কয়েকজন বোধহয় বাসে উঠেও যেতেন কিন্তু লাগেজের সমারোহ দেখে কেউ আর কাছে আসলেন না। সামনের দিকে যারা ছিলো তারা হ্যাঁচকা টান দিয়ে দিয়ে লাগেজগুলো ছুঁড়ে মারতে লাগলো বাইরের দিকে। এভাবে করে লাগেজ সরাতে সরাতে যাদের যাদের বের হবার পথ ক্লিয়ার হচ্ছিলো তারা বের হয়ে যাচ্ছিলো। আমরা যারা পিছনে আছি তারা বের হলাম সবার শেষে। বাস থেকে নামতেই দেখি আগের মত পাহাড় বানিয়ে লাগেজ রাখা হয়েছে। সেখান থেকে একেকজন একেকজনের লাগেজ টেনে টেনে বের করছে।

আমাকে রিসিভ করার জন্য আম্মু, আব্বু আর মামা এসেছে। আমার বাসার লোকজন আমাকে প্রথমে চিনতে পারে নাই। চিনতে পারবেই বা কেমন করে? ওজন কমেছে অন্তত পাঁচ কেজি, গায়ের রঙ মিশমিশে কালো হয়ে গেছে। এতদিন পর নিজেকে দেখে নিজেই চিনতে পারতাম কিনা সন্দেহ! সবাইকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি যখন একেকটা লাগেজ খুঁজে খুঁজে বের করে আনতে লাগলাম তখন সবাই অবাক হয়ে গেলো। আমি এতগুলো মাল টেনে টেনে আনছি দেখে সবাই অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো, কেমন করে আমি এতগুলো জিনিস নিয়ে আসলাম? সব শেষে যখন বড় ব্যাগটা টেনে আনলাম তখন মামা দৌড়ে আসলো ব্যাগটা ধরতে।

গাড়িতে ওঠার সময় গুনে গুনে দেখলাম সাতটা ব্যাগই এসেছে। একটা শান্তির নিশ্বাস ফেললাম, যাক- আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। কোনমতে সব কিছু গাড়িতে ভরে আমরা রওয়ানা হলাম বাসার উদ্দেশ্যে। গাড়িতে ওঠার সাথে সাথেই আম্মু দুনিয়ার কথা বলতে শুরু করলো। আমি সবই শুনছিলাম, কিন্তু কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে। মাথায় খালি ঘুরছিলো একেটা দৃশ্য- মালালির বরফ, আগ্রার তাজমহল, জয়সাল্মীরের মরুভূমি, গোয়ার সমুদ্র, ত্রিভান্দামের সৈকত, কলকাতার আলো ঝলমলে মার্কুইস স্ট্রিট- আরও কত কি!

কোথায় ছিলাম আর কোথায় চলে আসলাম? সত্যি সত্যিই কি ইন্ডিয়া ট্যুর শেষ হয়ে গেলো?

The Mighty INDIA CALLING: এবং ট্যুরের শেষ দিনে শেষ বুফে ডিনার (পর্ব ৪২)

ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না। কিন্তু অন্তরা এসে হাজির। আজকে প্ল্যান মোতাবেক ভারত মিউজিয়ামে যাওয়ার কথা। সব আলসেমি ঝেড়ে ফেলে আমাকে উঠতেই হলো। তবে আমরা তাড়াহুড়া করলাম না। ধীরে সুস্থে তৈরি হয়ে নিলাম। তারপর সবাই মিলে বের হয়ে পড়লাম।

আমি, মিম, অন্তরা আর রুবাইদা প্রথমে নাস্তা সেরে নিলাম। তারপর হাঁটতে লাগলাম ভারত মিউজিয়ামের দিকে। নানারকম চিন্তাও করছিলাম আমরা। আগেরবার আমাদের বিদেশি বলে সন্দেহ করছিলো যেই কারণে আমরা ঢুকি নাই। এইবার যেন সেই সমস্যা না হয়। তবে আগেরবার আমরা নিতান্তই অনভিজ্ঞ ছিলাম, আর এখন আমাদের অভিজ্ঞতার ঝোলায় আছে তাজমহল, অজন্তা, ইলোরা- এইসব টুরিস্ট স্পট। অনেক চিন্তা ভাবনা করে আমরা অন্তরাকে দায়িত্ব দিলাম পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার। অন্তরা মনে মনে ছক কষে নিলো। ভারত মিউজিয়ামে পৌঁছে গেলাম ঠিকমত। টিকেট কাটতেও কোন অসুবিধা হলো না। কিন্তু যখনই আমরা লাইনে দাঁড়ালাম ভিতরে ঢুকার জন্য তখনই সিকিউরিটির লোকজন আমাদের দিকে কড়া গলায় জানতে চাইলো আমরা কোথা থেকে এসেছি। আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম। কিন্তু অন্তরা একটুও না ঘাবড়ে জবাব দিলো, ‘আমদাবাদ সে আয়া হুঁ’।  এই উত্তরের জন্য ওনারা প্রস্তুত ছিলো না। সাধারনত যাদের বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে তারা বড়জোর নিজেদের কোলকাতার লোক বলেই দাবি করে। এইরকম আহমেদাবাদের অধিবাসী বলে দাবি করে বসে না। লোকগুলোর ভ্যাবাচেকা ভাব কাটার আগেই আমরা তাড়াতাড়ি করে ভিতরে ঢুকে পড়ি।

ভিতরে ঢুকে আমরা যুদ্ধজয়ের ভঙ্গি করি। যাক এই শেষ জায়গাটাতেও আমরা ‘ভারতীয়’ সেজে ঢুকতে সফল হয়েছি। মিউজিয়ামের গ্যালারি দেখতে শুরু করলাম। বি-শা-ল মিউজিয়াম। শুরু হলো সেই বৈদিক আমলে ‘কাউ গেট’ দিয়ে। তারপর একে একে সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখতে লাগলাম। আমাদের জাদুঘরে যে সব মূর্তি আছে সেগুলো প্রায় সবই ছোট ছোট। কিন্তু এখানকার মূর্তিগুলো বিশাল সাইজের। তামা, ব্রোঞ্জ, কষ্টি পাথর কত রকমের মূর্তি! মূর্তি ছাড়াও আছে অস্ত্রশস্ত্র, তৈজসপত্র- শুধু এই সব দেখতে দেখতেই আমরা ক্লান্ত হয়ে গেলাম। রুবাইদার শরীর খারাপ লাগা শুরু হলো। ও আর ঘুরতে রাজি হলো না। আমাদের ফেলে ও একাই হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। রুবাইদা চলে গেলে আমরা তিনজন ঘুরতে লাগলাম।

দোতলায় একটা গ্যালারিতে আস্ত মমি রাখা হয়েছে। আমি কখনও সামনাসামনি মমি দেখি নাই। এই প্রথম মমি দেখে আমার সারা শরীরে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠলো। সার্কোফাগাসের ঢাকনাটা সরিয়ে রেখে শুধু মুখটাই অনাবৃত করে রাখা হয়েছে। বাকি শরীর কাপড় দিয়ে জড়ানো। চোখবিহীন শূন্য কোটর, হাড্ডিসার খুলি আর খিঁচানো দাঁত নিয়ে নিথর হয়ে পড়ে আছে যেন মানুষটা। চার হাজার বছর আগে পৃথিবীর বুকে নিশ্চয়ই দোর্দন্ড প্রতাপের সাথে চলাফেরা ছিলো তার। আজ সে মানুষের দর্শনীয় বস্তু হয়ে পড়ে আছে এক মিউজিয়ামের ভিতর। কি অদ্ভূত পরিনতি! আমি তাকিয়েই রইলাম মমিটার দিকে, মানুষ এই স্বল্পক্ষণের জীবনকে নিয়ে কত ব্যস্ততা, কত হিংসা, কত হানাহানি, কত কি। অথচ মৃত্যু অনিবার্য- এই পৃথিবীর কোনকিছুই স্থায়ী নয় এই কথাটা মনে করার সময়টাই মানুষ পায় না। যে পৃথিবীর জন্য এত কিছু করা হচ্ছে, মৃত্যুর পর শুধু হাড়টাই রয়ে যাবে এই পৃথিবীতে- মমিটা যেন আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে এই কথাটা মনে করিয়ে দিলো।

জিওলজি, জুয়োলজি, বোটানি, অ্যান্থ্রোপ্লজি, আর্ট সব সেকশনের গ্যালারি গুলো দেখতে দেখতে আমাদের পা টনটন করছিলো। সব শেষে আর্ট গ্যালারির মধ্যে বাংলাদেশের জামদানি, বালুচরি, মসলিন, নকশি কাঁথা, কাঠের কারুকাজ, হাতির দাঁতের তৈরির জিনিসপত্র দেখেটেখে আমাদের বুক গর্বে দশ হাত ফুলে উঠলো। এই গ্যালারিতে বাংলাদেশের বস্ত্র এবং কারু শিল্পের সাথে পাল্লা দেওয়ার সামর্থ আর কোন এলাকার নাই। সব দেখেটেখে যখন বের হয়ে গেলাম তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে।

মিম আর অন্তরা যাবে পার্ক স্ট্রিটের একটা দোকানে আগের দিনে কেনা একটা ব্যাগ চেঞ্জ করতে। আমি তাই একা একা রওয়ানা হলাম হোটেলের দিকে। আবার সেই নিউ মার্কেটের ভিতর দিয়ে আসতে লাগলাম। ভাবলাম কিছু খেয়ে নেই। খাওয়াদাওয়া করে একা একাই হাঁটছিলাম। হঠাৎ মনে হলো একটা বড় ব্যাগ কেনা দরকার। আমি হকারদের কাছে গিয়ে ব্যাগ দরদাম করছিলাম। এমন সময় রুবাইদা ফোন দিলো। রুবাইদা অনুরোধ জানালো ওর জন্যও একটা ব্যাগ কিনতে। আমি এই মাথা টু ওই মাথা হেঁটে সবার সাথে দরদাম করে শেষ পর্যন্ত ৯০ রুপি করে একেকটা ব্যাগ কিনলাম। তারপর আবার হাঁটতে লাগলাম। মার্কুইস স্ট্রিটের শ্রীলেদার্সের উল্টা পাশে ‘মোর’ সুপার শপে ঢুকে পড়লাম। বেশ কিছু চিপস কিনলাম। এক ভদ্রলোক অনেক সময় নিয়ে কাউন্টারে মালপত্র জমা দিলেন। তার পিছনেই আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। অনেকক্ষণ পর যখন আমার পালা এলো তখন কারেন্ট গেলো চলে। যাইহোক এক সময় কারেন্ট ফেরত এলো। আমি সব বিল মিটিয়ে দিয়ে বের হয়ে আসলাম। তারপর সোজা হাঁটা দিলাম দিদার বক্স লেনের দিকে।

আগের মতই হোটেলে গিয়ে দিলাম ঘুম। ঘুম থেকে উঠে প্রথমে নতুন ব্যাগে মালপত্র ভরলাম। এই ব্যাগ গুছানো শেষ হলে। আমরা খোঁজ খবর নিতে থাকি আমাদের সিনেমা দেখার কি হলো। জানতে পারি এতগুলো টিকেট একসাথে পাওয়া সম্ভব হয় নাই। তাই আপাতত সিনেমা দেখার প্ল্যান বাতিল। তবে রাতে ডিনারের ব্যাপারটা ঠিক আছে। যেতে হবে ‘নিজাম’স রেস্টুরেন্ট’ এ। এটাও নিউ মার্কেট এলাকাতেই। তাই আমরা ভাবলাম যেতেই যখন হবে, আগে থেকে নিউ মার্কেট গিয়ে ঘোরাঘুরি করাই ভালো।

আবার আমরা বের হলাম সেই নিউ মার্কেটের উদ্দেশ্যে। গত দুইদিন ধরে আমরা এতবার এখানে ঘোরাঘুরি করেছি যে প্রতিটা কাকপক্ষীরও আমাদের চিনে ফেলার কথা। তারপরও আমরা ক্ষান্ত হই নাই। ঘুরতে ঘুরতে আমাদের মনে পড়তে লাগলো শেষে মুহূর্তের কিছু কেনাকাটার কথা। একেবারে শেষমুহূর্তে ‘বিগ বাজার’ গিয়ে ভাতিজাটার জন্য খেলনা কিনলাম। ভিতরে বিল দিতে গিয়ে এক বিশাল ঝামেলায় পড়ি। আবার আমার আগের জন গন্ডগোল শুরু করে। ভদ্রলোক দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছেন। উনি কয়েক ট্রলি ভরে প্রায় শ খানেক আইটেম নিয়ে এসেছেন। এত আইটেমের বিল করতে গিয়ে ক্যাশ কাউন্টারে গোলমাল লেগে যাচ্ছিলো। গোলমাল শেষে সব আইটেম ব্যাগে ভরা হলে ওনার ছেলেমেয়েদের আরও কিছু কেনাকাটা করার ইচ্ছা জাগে। তখন সব লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এরকম শ খানেক আইটেম বিল করার পর কেউ যদি বিল না দিয়ে আরও কেনাকাটা করতে যায় তখন মেজাজ খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক। ওনার এই শ খানেক আইটেমের পিছনে আমি মাত্র একটা খেলনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ওনার জন্য কিছুতেই আমার বিলটা হচ্ছে না। তারপর অনেক গ্যাঞ্জাম শেষে আমি কোনমতে বিল মিটিয়ে দিয়ে ছুটতে ছুটতে বের হয়ে আসি। বাইরে রুবাইদা আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। তারপর আমরা ছুটতে ছুটতে যেতে থাকি নিজাম’সের উদ্দেশ্যে। এর মধ্যে তমা আর ফাহাদের সাথে দেখা হয়। তখন আমার  মনে পড়ে যে বাদাম তেল কেনার কথা ছিলো, যেটা আমি বেমালুম ভুলে গেছি। তাড়াতাড়ি করে তমার হাতে রুপি গুঁজে দেই এক বোতল তেল কিনে আনার জন্য। তারপর ছুটতে ছুটতে গিয়ে হাজির হই ‘নিজাম’স’এ।

কমিটি থেকে আমাদের বলা হয় ২০০ রুপির মধ্যে খাবার অর্ডার করতে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে আমরা কেউই ২০০ রুপির অর্ডার দিতে পারলাম না। আমাদের টেবিলে আমি, রুবাইদা, নিশাত আর পৃথ্বী ছিলাম। আমরা হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি, কাবাব রোলস, কুলফি, ফিরনি আর কোল্ড ড্রিংক্স অর্ডার দিলাম। কিন্তু কোনভাবেই বিল ৮০০ রুপির উপরে গেলো না। হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির নাম করে যেটা আসলো সেটা বিরিয়ানিই বটে! এক প্লেট উঁচু করা বিরিয়ানি যার উপরটা কিশমিশ, বাদাম, মোরব্বা আর চেরি দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া। আমি জীবনেও বিরিয়ানিতে এরকম শুকনা ফলের ব্যবহার দেখি নাই। ভয়ে ভয়ে মুখে দিলাম, খেতে না জানি কেমন হয়! মুখে দিয়েই টের পেলাম- না ভুল হয় নাই। চমৎকার স্বাদযুক্ত খাবারই অর্ডার দিয়েছি। বিরিয়ানির সাথে কিশমিশ, মোরব্বা চিবিয়ে খেতে খেতে ভালোই লাগছিলো। কিন্তু পরিমানে এত বেশি ছিলো যে আমি প্রথমেই বুঝেছিলাম খেয়ে শেষ করা সম্ভব হবে না।

efws
শেষ ডিনারে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় মোজাম্মেল হক জাফর)

ওদিকে সবাই হৈচৈ হাহা হিহি করে সেলফি তুলতে লাগলো। জাফর জানালো যে ওকে আমাদের স্টুডিও টিচার বারবার ম্যাসেজ পাঠাচ্ছে সবাইকে নিয়ে ক্লাসে আসার জন্য। আমরা এইসব ব্যাপার নিয়ে প্রাণ খুলে হাসতে লাগলাম। ওদিকে আমাদের কাবাব রোল আর কুলফি চলে আসলো। প্রাণপণ খেয়েও বিরিয়ানি শেষ করতে পারলাম না। তখন মনে হলো রোল দুটো সাথে করে নিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। নিশাত আরও বুদ্ধি দিলো যে, সকালে তো আমরা নাশতা করার সুযোগ পাবো না- এই রোল দিয়েই আমাদের সকালের নাশতা হয়ে যাবে। আমরা রোল দুটোকে প্যাকেট করে দিতে বলে মনোযোগ দিলাম কুলফির উপর। মজা করে কুলফি খেতে খেতে আমরা আফসোস করছিলাম আমাদের ট্যুরটা সত্যি সত্যিই শেষ হয়ে গেলো এজন্য। যাই হোক সব খাওয়া দাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে আমরা বের হয়ে গেলাম ‘নিজামস’ থেকে।

অন্ধকার রাতে সোডিয়াম লাইটের আলোতে আমরা দল বেঁধে হাঁটতে লাগলাম। নিউ মার্কেটের অলিগলি পার হয়ে মির্জা গালিব স্ট্রিট দিয়ে হেঁটেহেঁটে হোটেলের দিকে আসতে লাগলাম। এর মধ্যেও ছোটখাটো মুদি দোকান পেলেই সবাই থেমে গিয়ে এটা সেটা কিনতে শুরু করে। এই করতে করতে আমাদের হোটেল যেতে যেতে বেশ সময় লাগছিলো। রাত হয়ে গেছে, মোটামুটি সব দোকাপাট বন্ধ। লোকজন কম, রাস্তাঘাট শুনশান। এর মধ্যে আমরা দল বেঁধে হেঁটে যেতে লাগলাম। সবার মনেই একটা হাহাকার- এই তো শেষ, এত স্বপ্নময়ী দিনগুলো একে একে সব ফুরিয়ে গেলো। এত অবাধ স্বাধীনতা, এত অনিশ্চয়তা, এত হাসি আনন্দের আজকেই রাতেই ইতি। কেউ কাউকে বলছিলো না কিন্তু একটা চাপা কষ্ট সবার বুকেই জমাট বেঁধে ছিলো।

হোটেলে পৌঁছে আমরা একে একে আমাদের জিনিসপত্র ফাইনালি গুছিয়ে নিলাম। সবারই অনেকগুলো করে ব্যাগ। সব মিলিয়ে আমার সাতটা ব্যাগ হলো। এর মধ্যে বড় ব্যাগ তিনটা আর ছোট ব্যাগ চারটা। ব্যাগগুলো দেখে ভয় লাগলেও মনে মনে ভাবলাম, একবার বাসে উঠাতে পারলেই তো আর চিন্তা নাই। কিন্তু তখন কি আর জানতাম, এই ব্যাগ নিয়ে কি ভোগান্তিটাই না হবে!

শেষবারের মতন আমরা ছোট বিছানাটায় পা ভাঁজ করে শুয়ে পড়লাম। উঠতে হবে গভীর রাতে। তাই বেশি কথাবার্তা না বলে আমরা ঘুমিয়ে গেলাম। গুডবাই কোলকাতা!

 

The Mighty INDIA CALLING: শুধুমাত্র নিউমার্কেটেই সারাদিন (পর্ব ৪১)

ঘুম ভাংলো সেই অন্ধকার রুমে। অন্য সবাই বের হয়ে গেলেও আমি অনেকক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে পা সোজা করে নিলাম।  এমনিতেও শান্তি নিকেতন যাওয়া হচ্ছে না। তাই আজকে সিদ্ধান্ত নিলাম দূরে কোথাও যাবো না। শুধুই আশেপাশে ঘোরাঘুরি করবো। কোন চাপ নাই। তাই ধীরেসুস্থে ঘুম থেকে উঠলাম।

এত ঢিলামি করতে করতে বেশ দেরি হয়ে গেলো। আমরা হোটেল থেকে বের হয়ে মার্কুইস স্ট্রিটের দিকে হাঁটতে লাগলাম। যখন হেঁটে হেঁটে দাওয়াত হোটেলে পৌঁছালাম তখন দুপুর হয়ে গেছে। আমি পরোটা মাংস অর্ডার দিলেও রুবাইদা ভাত অর্ডার দিলো। আমরা ধীরে সুস্থে খাওয়াদাওয়া করলাম। আজকে আমাদের কোন তাড়া নাই, তাই আমরা খুব ফুরফুরা মেজাজে ছিলাম।

দাওয়াত থেকে বের হয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম নিউমার্কেটের দিকে। পথের মধ্যে সব জায়গা আস্তে ধীরে দেখতে দেখতে গেলাম। একবার ঢুকলাম শ্রীলেদার্সে। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। চটপট পছন্দ হয়ে গেলো কয়েক জোড়া স্যান্ডেল। আমি আর রুবাইদা কিনে ফেললাম অনেকগুলো স্যান্ডেল। তারপর অনেকক্ষণ পর শ্রীলেদার্স থেকে বের হয়ে গেলাম নিউ মার্কেটের দিকে। কোলকাতার নিউ মার্কেটের একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, যানজট এড়ানোর জন্য এখানে গাড়ি চলাচলই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক দূরে গাড়ি রেখে সবাই হেঁটে হেঁটে আসে। আর রাস্তার দুইধার ধরে রাজ্যের সব পসরা নিয়ে হকাররা বসে থাকে। আমরা যখন যাই তখনও মার্কেট ঠিক জমে ওঠে নাই। আমরা তাই লিন্ডসে স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে চৌরঙ্গী রোড অর্থাৎ মেইন রোডে এসে পড়লাম। এর মধ্যেই এর ওর কাছ থেকে টুকটাক জিনিসপত্র কেনাকাটা চলতে লাগলো। তারপর আমরা হাঁটতে লাগলাম এস্প্লানেডের দিকে।

পেয়ে গেলাম একটা বিগ বাজার। দেরি না করে সোজা ঢুকে পড়লাম ভিতরে। অনেক ঘুরে ফিরে সেলসগার্লদের কবল থেকে বেঁচে টপাটপ কিনে ফেললাম আক গাদা ক্যাডবেরির বড় বার। আরও এদিক সেদিক দেখে শুনে কয়েক প্যাকেট চকোলেট নিয়ে নিলাম আমি আর রুবাইদা। তারপর যখন বিগ বাজার থেকে বের হয়ে আসলাম তখন মোটামুটি সব দোকানপাট জমে উঠেছে। আর আমাদের কেনাকাটাও পাল্লা দিয়ে চলতে লাগলো। আমরা হাঁটতেই লাগলাম আর হাঁটতেই লাগলাম। এস এন ব্যানার্জি রোড, চৌরঙ্গি রোড, চৌরঙ্গি প্লেস, হুমায়ুন প্লেস, বার্ট্মান স্ট্রিট, হগ স্ট্রিট, ইট স্ট্রিট, ম্যাজ লেন, সুদ্দার স্ট্রিট, হার্টফোর্ট লেন, কাওয়াই লেন- আরও কত বাহারি নামের রাস্তা ধরে আমরা ঘুরতেই লাগলাম। সাথে সাথে আমাদের হাতে শপিং ব্যাগের সংখ্যাও বাড়তে লাগলো।

ঘুরতে ঘুরতে বিকাল হয়ে গেলে আমরা নিউ মার্কেটের সামনেই এক দোকানে ফাস্ট ফুড খেয়ে নেই। আর সাথে নেই তাজা কমলার জুস। এইসব খেয়েদেয়ে আবার যাই নিউমার্কেটে। আমাদের যেমন মার্কেটের ভিতরটা সরগরম থাকে এই মার্কেটের ব্যাপারটা সেরকম না। দালানের ভিতরটা ফাঁকা, লোকজন নাই, হৈচৈ নাই, চুপচাপ এবং নীরব। অনেকটা আমাদের দেশে ঈদের পর মার্কেটগুলো যেমনটা থাকে ঠিক সেইরকম। আমরা একটু খোঁজাখুঁজি করে একটা চকোলেট লজেন্সের দোকানে ঢুকলাম। সেখান থেকে নানা রকম চকোলেট কিনে তারপর গেলাম এক কস্মেটিক্সের দোকানে। সেখান থেকেও কিনলাম বেশ কিছু জিনিসপাতি। তারপর ভারি ব্যাগ নিয়ে দুই জনে টানতে টানতে বের হয়ে আসলাম মার্কেট থেকে। এভাবে হেঁটে হোটেল যাওয়াটা কষ্টকর। তাই নিলাম এক টানা রিক্সা। এই টানা রিক্সাওয়ালা রাস্তাঘাট চেনে না। কয়েক কদম গিয়েই জানতে চায় আর কত দূর, আর কত দূর। আরাফাত হোটেলের সামনে গিয়ে শেষমেশ লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে আমরা হাঁটাই শুরু করলাম। দুনিয়ার শপিং ব্যাগ নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আমরা হোটেলে ঢুকলাম। রিসেপশনের লোকজন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো আমাদের শপিঙের পরিমান।

কোনমতে রুমে ঢুকে আমরা আমাদের সব মালপত্রগুলো ঢুকালাম। তারপর ঠিক করলাম বিশ্রাম নিবো। জোরে ফ্যান ছেড়ে দুইজনে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। একটু ঘুম দেওয়া দরকার।

ঘুম থেকে উঠে আবার সেই বেরিয়ে পড়া। সেই একই রাস্তা, একই শ্রীলেদার্স, একই নিউমার্কেট। সারাদিন ধরে একই জায়গায় ঘোরার ফলে সব লোকজন আমাদের চেহারা মুখস্ত করে ফেললো। এমনকি শ্রীলেদার্সের লোকজনও আমাদের চিনে ফেললো। এই শ্রীলেদার্সে কেনাকাটা করতে করতেই হঠাৎ আসাদ ভাইয়ের সাথে দেখা। আসাদ ভাই আমার দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। ভিনদেশে এসে দেশের পরিচিত মানুষ পেলে যা আনন্দ লাগে সেটা আর বলার মত না। আসাদ ভাই এসেছেন সিমলা ঘুরতে। ঘোরাফিরা শেষে এখন দেশে ফেরত যাচ্ছেন। ওনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার আমরা বের হয়ে পড়ি। রুবাইদা দুই একবার মার্কেটের ভিতর থেকে কেনাকাটা করতে চাইলো, কিন্তু সেরকম কিছুই আমরা পেলাম না। নিউমার্কেটের বড় শ্রীলেদার্সে গেলাম। সেখানেও কেনাকাটা চললো। আমাদের অনেকের সাথে সেখানে দেখাও হলো। আমরা হাসি ঠাট্টা করে একসময় বের হয়ে আসলাম সেখান থেকে।  রাতের মার্কেট পাড়া চক্কর দিতে দিতে আমরা আবার সেই বিগ বাজারের সামনে এসে থামলাম। আমি তিনটা সুন্দর পানির বোতল কিনলাম ৮০ রুপি দিয়ে।

রাত বাড়ার সাথে সাথে দোকানপাটও বন্ধ হয়ে আস্তে লাগলো। আমরাও আস্তে আস্তে ফেরার রাস্তা ধরলাম।সেই পরিচিত রাতের মার্কুইস স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমাদের হোটেলের দিকে যেতে লাগলাম। হোটেলে যখন ঢুকি, রিসেপশনে যিনি বসা ছিলেন তিনি আমাদের দিকে এক গাল হেসে বললেন, ‘আপনারা তো আমাদের জন্য কিছুই বাকি রাখছেন না, সব জিনিস তুলে নিয়ে যাচ্ছেন’। বলাই বাহুল্য, আমরা প্রত্যেকে যে হারে বড় বড় শপিং ব্যাগ নিয়ে হোটেলে ঢুকছিলাম তাতে ওনার এই মন্তব্য অত্যুক্তি হয় না।

সব মালপত্র নিয়ে রুমে ঢুকে পড়লাম আরেক বিপদে। রুমে তো জিনিসপত্রের জায়গা হচ্ছে না। আমরা শেষমেশ বিছানার উপর তুলে রাখলাম অনেক কিছু। ওদিকে মজুমদার আর মৌলির শপিংও কম নয়। সবাই রুমে আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছিলাম। সিদ্ধান্ত হলো একজন তার মালপত্র গুছাবে আর আমরা বাকিরা রুমের বাইরে বসে থাকবো। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক একজন একজন করে রুমে মালপত্র গুছাতে লাগলো আর আমরা বাকিরা রুমের বাইরে করিডরে হাঁটাহাটি করতে লাগলাম। শেষমেশ সবাই যখন গুছিয়ে শেষ করলো তখন আর রুমে পা রাখার কোন জায়গা নাই। খালি দরজাটা খোলার জন্য যতটুকু খালি জায়গা দরকার ঠিক ততটুকুই জায়গা খালি আছে। রুমে ঢুকে সেখান থেকে এক লাফে বিছানায় উঠে যেতে হয়। বিছানা থেকে সরাসরি বাথরুমে ঢুকে যেতে হয়। আবার বাথরুম থেকে বের হয়ে সরাসরি বিছানায় উঠে যেতে হয়। সেখান থেকে এক লাফে দরজার সামনে চলে আস্তে হয়। এই হলো আমাদের রুম। কোথাও আর পা ফেলার জায়গা নাই।

ওদিকে ফল পার্টির আয়োজন শুরু হচ্ছে। ব্যাগ ভর্তি কেজি কেজি ফল নিয়ে আসা হয়েছে। অন্য সব ফ্লোরের তুলনায় আমাদের ফ্লোরে আমাদের জনসংখ্যা বেশি বলে এই ফ্লোরের করিডরেই পার্টি করা হবে ঠিক হয়েছে। করিডরে একটা টেবিল আর সোফা ছিলো। সেইটা দখল করে আমরা দুনিয়ার ফল সাজিয়ে বসলাম। কলা, মাল্টা, সবুজ আঙ্গুর, কালো আঙ্গুর, আপেল, আনারস, কমলা, পেঁপে, তরমুজ কি নেই! শুভ বিশাল এক ছুরি নিয়ে মাল্টা, আনারস কাটতে বসে গেলো। আমরা হাতে হাতে ওয়ান টাইম ইউজ প্লেট নিয়ে নানা রকমের ফল নিয়ে নিয়ে খেতে লাগলাম। সাথে ছিলো কোক, ফান্টা আর সেভেন আপ। আমরা হৈচৈ করে সেগুলো খেতে লাগলাম। আমাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে ভয় পেয়েই বোধহয় আশেপাশের রুম থেকে কোন কমপ্লেন আসলো না। অনেক মজা আর গল্পগুজব করে আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হলো। আমরা সব সুন্দর করে গুছিয়ে নিলাম। সব ময়লা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে একদম পরিষ্কার ঝকঝকে তকতকে করে দিলাম। তারপর সবাই বিদায় নিয়ে যার যার রুমে ফেরত গেলাম।

আমাদের ফল পার্টি প্রায় শেষ
আমাদের ফল পার্টি প্রায় শেষ

অনেকে গেলো ছাদের মধ্যে আড্ডা দিতে। আমি আর রুবাইদা রুমে বসেই গল্প করছিলাম। আমার সেরকম রাত জাগার অভ্যাস নাই কিন্তু রুবাইদার সাথে গল্প করতে করতে কখন যে সময় চলে যেতে লাগলো টেরই পেলাম না। যখন টনক নড়লো যে অনেক রাত হয়ে গেছে তখন আমরা ঝটপট বালিশ নিয়ে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে ভাবলাম, আর মাত্র একটা দিন!

 

The Mighty INDIA CALLING: মিশন গড়িয়াহাট, বড়বাজার এবং কলেজ স্ট্রিট (পর্ব ৪০)

ঘুম ভাংলো অন্ধকার রুমের ভিতর। রুমে কোন দরজা জানালা না থাকায় ভিতরটা একদমই অন্ধকার। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম বেলা হয়ে গেছে। সারা রাত পা ভাঁজ করে রাখতে রাখতে পা দুটো যেন কেমন হয়ে গেছে। অন্যরা বিছানা ছেড়ে নেমে গেলে আমি এই ফাঁকে পা দুটো টানটান করে নেই। সবার শেষে গোসল করলাম আমি। বাথরুমের দরজা থেকেই লাফিয়ে উঠে গেলাম বিছানায়। এর মধ্যে আমাদের চারজনেরই বেশ কিছু শপিং হয়েছে। পোঁটলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু আমাদের রুমে তো তেমন জায়গা নাই। তাই আমরা সেগুলো বাথরুমের সামনের আসা যাওয়ার জায়গাটাতে স্তুপ করে রেখে দিয়েছি। এজন্য বাথরুমে যেতে হচ্ছে আমাদের বিছানার উপর থেকে সরাসরি। আবার বের হয়েও সরাসরি বিছানায় উঠে যেতে হচ্ছে।

নাশতা খেতে আবার নাজ হোটেল গেলাম আমরা। সেখানে শুনলাম নিশাতরা আজকে ঠাকুর বাড়ি যাবে। আগেরবার ওদের সাথে ঘোরাঘুরি করেছিলাম। আমাদের সেবার ঠাকুরবাড়ি যাওয়া হয় নাই। এবার ওরা যাচ্ছে দেখে আমার লোভ লাগলো। কারণ প্ল্যান করেছি প্রথমে গড়িয়া হাটে যাবো, তারপর কলেজ স্ট্রিট। আর কালকের দিনে সময় পেলে নিউ মার্কেট আর ভারত মিউজিয়াম ঘুরে আসবো। ওদের কথা শুনে কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেলাম, গড়িয়াহাটের প্ল্যান বাদ দিয়ে জোড়াসাঁকো চলে যাবো নাকি? পরে কলেজ স্ট্রিটের কথা চিন্তা করে সেই প্ল্যান বাদ দিলাম। আগের বার কলেজস্ট্রিট গিয়েও সাপ্তাহিক ছুটিতে বইয়ের দোকান বন্ধ থাকায় কোন লাভ হয় নাই। তাই এবার কলেজ স্ট্রিট যদি না যাই তাহলে আমার হৃদয়টা চৌচির হয়ে যাবে। ফেলুদা, টেনিদা, কাকাবাবু, টিনটিন, অ্যাস্টেরিক্স, আনন্দমেলার প্রকাশনী আনন্দ পাবলিশার্সে যাওয়ার আমার কত বছরের শখ! কোলকাতায় এসে যদি না যাই এখানে, তাহলে আমার কিছুতেই চলবে না। জোড়াসাঁকো বাদ দিতে পাড়ি কিন্তু কলেজ স্ট্রিট- নেভার! নাজ হোটেলে বসে নাশতার টেবিলে বসে বিস্তর আলোচনা করে শেষমেশ ঠিক করলাম, যাই হোক ‘স্টিক টু দ্যা প্ল্যান’ থাকি।

নাশতা খেয়ে দেয়ে আমরা বের হয়ে গেলাম। রফি আহমেদ স্ট্রিটে উঠে ট্রামের জন্য অপেক্ষা করলাম খানিক্ষন। আগেরবার ট্রামে চড়া হয় নাই। তাই এবার ট্রামে না চড়লেই নয়। ট্রাম আসলে আমরা উঠে পড়ি ট্রামে। মোটামুটি খালিই ট্রাম। আমাদের নিয়ে গদাই লস্করি চালে ট্রাম চলতে লাগলো। এতই ধীরে ধীরে যাচ্ছিলো যে আমাদের মনে হলো হেঁটে গেলেই বোধহয় এর চেয়ে তাড়াতাড়ি যেতে পারতাম। অনেকক্ষণ ধরে চড়ার পর নানা রকম জ্যাম ঠেলেঠুলে ট্রাম আমাদের পার্ক স্ট্রিট নামিয়ে দিলো। পার্ক স্ট্রিটে নেমে আমরা একটা লোকাল বাসে উঠলাম। মোটামুটি ভিড় ছিলো বাসে। আমরা কোনমতে ফাঁক ফোকর দিয়ে বসার জায়গা ম্যানেজ করলাম। প্রচন্ড গরমে বাসের ভিতর আমরা দরদর করে ঘামতে লাগলাম। অনেক রাস্তা পার হয়ে, জ্যাম পার হয়ে শেষমেশ আমরা গড়িয়াহাটে পৌঁছালাম। বাস থেকে নেমে আমাদের মনে হলো- আহ কি শান্তি!

গড়িয়াহাটকে আমি মনে করেছিলাম আমাদের মিরপুর বেনারসি পল্লীর মতন হবে বোধহয়। কিন্তু আমার আইডিয়া ঠিক হলো না। আমরা এদিক ওদিক তাকিয়েও কোন শাড়ির দোকান দেখলাম না। অন্তরা লোকজনকে শাড়ির দোকান কোথায় সে কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলো। সবাই বললো সামনের দিকে হাঁটতে। আমরাও হাঁটতে লাগলাম। হঠাৎ দেখা পেলাম ‘আদি ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়’। রুবাইদা জানালো এটা নাকি বিখ্যাত দোকান। আমিও তাই আগ্রহী হয়ে উঠলাম, বিখ্যাত দোকান বলে তো কথা! ঢুকে আমাদের কাছে আহামরি কিছু লাগলো না। খুব বড় কোন দোকান না। সব সুতি টাইপের কাপড়ের শাড়ি আর ধুতি। রুবাইদা তো চিন্তা করতে লাগলো ধুতির কাপড় দিয়ে দেশে গিয়ে আংকেলের জন্য পাঞ্জাবি বানাবে কিনা? আমাদের আশাহত চেহারা দেখেই হয় তো সেলসম্যানরা আমাদের দোতলায় যেতে বললো। আমরা একটা চিপা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেলাম। দোতলায় সব জমকালো শাড়ি। কিন্তু পছন্দ হবার মতন নয়। আর সাউথের দোকানগুলোতে শাড়ি দেখার একটা আরাম ছিলো, এখানে এসে সেটা পাচ্ছিলাম না। এখানকার সেলসম্যান আমাদের দেখে জানতে চাইলো কি শাড়ি দেখতে এসেছি, নিজের জন্য শাড়ি না মায়ের জন্য শাড়ি- এইসব ফালতু কথা বার্তা। আমরা শাড়ি নিয়ে আগ্রহী হচ্ছিলাম না বলে হটাৎ করে বললো, ‘বুঝেছি, ছোটরা এসেছো বলে পছন্দ করতে পারছো না, তাই তো?’ আমরা মুখ টিপে হাসতে লাগলাম। তারপর লোকটা বললো, ‘কার সাথে এসেছো এখানে?’ এই কথা শুনে আমরা আরও হাসতে লাগলাম। ‘কারও সাথে আসি নাই’- আমাদের মুখে এই জবাব শুনে লোকটা কেমন যেন বোকা বনে গেলো। এবার সিরিয়াস টোনে জিজ্ঞেস করলো, ‘সত্যি করে বল তো, মা কি নিচ তলায় শাড়ি দেখছেন?’ আমাদের পেট ফেটে হাসি আসতে লাগলো। আমরা তাড়াতাড়ি এমন ভান করে সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে লাগলাম যেন ‘মা’কে ডাকতে যাচ্ছি। নিচে এসে দেখলাম অন্তরা কি এক ঘিচা সিল্ক নামের শাড়ি আবিষ্কার করেছে। শাড়িটা দেখতে স্মার্ট কিন্তু দামটা অতিরিক্ত বেশি।

খালি ধুতির কাপড় কিনেই আমরা বের হয়ে গেলাম ‘বিখ্যাত’ দোকান থেকে। সবাই মনে মনে একটু আশাহতও হলাম। আমরা গড়িয়াহাটের দোকানগুলোকে ঠিক পছন্দ করতে পারছিলাম না। আর রাস্তার দুপাশ জুড়েও সব শাড়ির দোকান না। বেশ খানিকক্ষন পরপর একেকটা দোকান। আমরা ঢুঁ মেরে ঢুকি, আর ঠিক সেভাবেই বের হয়ে যাই। শাড়ি দেখে ভালো লাগে না। বরং রাস্তার চওড়া ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে আমাদের ভালোই লাগছিলো। আবার ফুটপাথের পাশেই নানারকম ফেরিওয়ালা জিনিসপত্র নিয়ে বসে আছে। ব্যাগ, জুয়েলারি, ওয়ান পিস, স্যান্ডেল এইসব জিনিসপত্র সাজিয়ে বসে আসে লোকজন। আবার অনেককে দেখলাম কতগুলো বই খুলে সাজিয়ে বসে আছে। বুঝতে পারলাম, ওনারা হাতে মেহেদি পরিয়ে দেয়। বইগুলোতে নানারকম নকশা আছে। মহিলারা এসে যেই ডিজাইন দেখিয়ে দেয়, ওনারা সেই অনুযায়ী হাতে নকশা করে দেয়। একটা ব্যাপার হাস্যকর লাগলো, আমাদের দেশে সব জায়গায় মেয়েরাই মেহেদি আর্টিস্ট হয়। ছেলে মেহেদি আর্টিস্ট এই প্রথম দেখলাম আমি।

আমরা এমনি এমনি ঘুরতে ঘুরতে ‘প্রিয় গোপাল বিষয়ী’ নামের একটা দোকানে ঢুকলাম। নিচ তলায় হঠাৎ করেই ছেলেদের পাঞ্জাবী পেয়ে গেলাম। রঙ্গিন পাঞ্জাবিগুলো সিম্পলের মধ্যে বেশ সুন্দর। রুবাইদা বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছিলো। হঠাৎ ও একটা পাঞ্জাবির দাম জিজ্ঞেস করলো লোকটা জবাব দিলো, ‘৬০০ রুপি’। আমাদের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। মাত্র সাত আটশ টাকায় আমাদের দেশে এরকম কোন পাঞ্জাবিই পাওয়া যায় না। এত সস্তা পাঞ্জাবি! রুবাইদা একটা পাঞ্জাবি খুলে দেখাতে বললো। ভাঁজ করা পাঞ্জাবিটা খোলার সাথে সাথেই সাদা একটা পায়জামা বের হয়ে আসলো। রুবাইদা জিজ্ঞেস করলো ‘পায়জামার দাম কত?’। লোকটা বললো, ‘পায়জামা সহই দাম ৬০০ রুপি’। এবার আমরা আক্ষরিক অর্থেই চিৎকার করে উঠলাম, ‘পা-য়-জা-মা সহ ৬০০ রু-পি-ই-ই! অবিশ্বাস্য কমদাম’। সেলসম্যান বোধহয় ঘাবড়ে গেলো আমাদের রিঅ্যাকশন দেখে। কিন্তু তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। আমরা সত্যিই ঝাঁপিয়ে পড়লাম পাঞ্জাবী কিনতে। রুবাইদা ওর বাবা আর ভাইয়ের জন্য দুইটা, আমি আমার বাবা, ভাই আর মামার জন্য তিনটা, অন্তরা ওর বাবা আর ভাইয়ের জন্য দুইটা করে পাঞ্জাবি চয়েস করলাম। বিল মিটিয়ে দিয়ে আমরা খুশি খুশি মনে পাঞ্জাবি কিনে দোকান থেকে বের হয়ে আসলাম।

আরও খানিক্ষণ এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করলাম আমরা। সবশেষে মিম একটা দোকান থেকে ওর বাবার জন্য পাঞ্জাবি কিনে নিলো। আমরা আর ঘোরাঘুরি করার আগ্রহ পেলাম না। শাড়ির দোকানগুলো দেখে বেশ বিরক্ত লাগছিলো। সাউথের এত চমৎকার শাড়ির কালেকশনসমেত দোকানগুলোকে আমরা ভুলতেই পারছিলাম না। সেটার তুলনায় কোলকাতার শাড়িগুলোকে ‘খ্যাত’ লাগছিলো। আর শাড়ি দেখার মধ্যেও আনন্দ পাচ্ছিলাম না। সাউথে শাড়ি কিনে আমাদের মাথা এমনই আউলে গেছে যে নামকরা গড়িয়াহাটে এসে আমরা কেউই কোন শাড়ি পছন্দ করতে পারছিলাম না বরং এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা একটা বাসে চড়ে বসলাম। গন্তব্য বড় বাজার। উর্মির কাছে শুনেছিলাম, বড় বাজারে পাইকারি দামে চকোলেট আর কসমেটিক্স পাওয়া যায়। সেই উদ্দেশ্যেই রওয়ানা দিলাম।

জ্যাম ঠেলেঠুলে গঙ্গার পাড় দিয়ে বাস আমাদের নিয়ে চলতে লাগলো বড় বাজার। অন্য দুইজন শাড়ি পরা মহিলার সাথে আমিও ইঞ্জিনের ধার ঘেঁষে লম্বা সিটে বসেছিলাম। ওনারা পূর্বপরিচিত কারণ দুইজনই কোন একজনের আচরনে খুব কষ্ট পেয়েছেন, সেই কথাই আলোচনা করছিলেন। আমিও বসে বসে সেই আলোচনা শুনছিলাম। বেশ অনেকক্ষণ জার্নি করে আমরা পৌঁছালাম বড়বাজার। বাস থেকে নেমেই মনে হলো, এখানে আসাটা মনে হচ্ছে ঠিক হয় নাই। জায়গাটা আমাদের দেশের কাওরান বাজারের মতন অনেকটা। রাস্তাঘাটে প্রচুর ভিড়, প্রচুর লোক হাঁটাহাঁটি করছে। ছোট ছোট দোকান উপচে পড়া সস্তা জিনিসপাতি। আমরা খানিকক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরলাম। লোকজনের ধাক্কা খেয়ে শেষমেষ বুঝতে পারলাম এইখানে কোন সুবিধা করতে পারবো না। বাকি সবাই অস্থির হয়ে যেতেই আমরা চট করে একটা বাসে চড়ে বসলাম। বাসটা আমাদের নিয়ে গেলো কলেজ স্ট্রিট।

কলেজ স্ট্রিট নেমে হাঁপ ছেড়ে বাঁচালাম। বাস থেকে নেমেই আমরা লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম আনন্দ পাবলিশার্সের কথা। সেই ডিরেকশন মতন চলতেই প্রথমে চোখে পড়লো একটা শাড়ির দোকান ‘আদি মোহিনী মোহন কাঞ্জিলাল’। নাম দেখেই অন্তরা খুব আগ্রহী হয়ে উঠলো। আমরা ভিতরে ঢুকতেই অসম্ভব কড়া মেকাপ দেওয়া একজন মহিলা আমাদের দেখে মিষ্টি একটা হাসি দিলো। তারপর উনি কতগুলো লোকজন ডেকে আমাদেরকে উপরে নিয়ে যেতে বললেন। আমরা সরু, চিপা পথ দিয়ে হেঁটে একটা সিঁড়ি পেলাম। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই দেখলাম এই মহিলার শাড়ি পরা বড় বড় ছবি দেওয়ালে টানানো। বুঝলাম ইনি হচ্ছেন মডেল। দোতলায় উঠে আমরা এসি দেওয়া জায়গা পেলাম। কলকাতায় এই একটা দোকানে দেখলাম ছোট ছোট খোপ খোপ করে বিভিন্ন রকম শাড়ি নিয়ে একেকজন বসে আছেন। যেন আমাদের  হকার্স মার্কেটের আট দশটা দোকান নিয়ে এই একটাই দোকান। অনেকক্ষণ দেখেটেখে অন্তরা শেষ পর্যন্ত একটা শাড়ি কিনে ফেললো। আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে ওনারা বারাবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো, দিদির সাথে দেখা হয়েছে কিনা? দিদি কে- জানতে চাইলেই ওনারা চোখ কপালে তুলে এমন ভঙ্গি করলেন যেন বাংলাদেশে থেকে দিদিকে না চেনাটা খুবই আশ্চর্য বিষয়। ওনাদের কথা শুনে বুঝতে পারলাম এই মহিলা শুধু মডেলই নন, ইনি সম্ভবত বিখ্যাত নায়িকা। ওনাকেই সবাই দিদি বলে ডাকে।

এখান থেকে বের হয়েই একটা রাস্তার ধারের দোকানে বসে লুচি আর ভাজি খেয়ে নিলাম। তারপর মিম আর অন্তরা গেল ওদের এক পরিচিত আংকেলের সাথে দেখা করতে, আর আমার পাল্লায় পড়ে রুবাইদা গেলো আনন্দ পাব্লিশার্সের শোরুম খুঁজতে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে পেয়ে গেলাম সেই কাংখিত দোকান- আমার স্বপ্নের জায়গা ‘আনন্দ পাব্লিশার্স’। কাঁচের দরজা ঠেলে দোকানে ঢুকতেই একটু ধাক্কা খেলাম- এত ছোট্ট দোকান! আমার কল্পনার আনন্দ পাব্লিশার্স অনেক বড়, সেখানে লাইব্রেরির মতন তাকে তাকে বই সাজানো থাকবে। বই খুঁজতে খুঁজতে দুই একটা মানুষ হারিয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু যেন- এরকমই আমি মনে মনে ভেবেছিলাম। কিন্তু এ কি দেখছি? এ তো আমাদের বইমেলার স্টলগুলোর  সমান সাইজের একটা দোকান। দেওয়াল জুড়ে তাকের মধ্যে বই সাজানো, কিন্তু অনেক ফাঁকা ফাঁকা। একটা কমবয়সী ছেলে অলস ভঙ্গিতে কাউন্টারে বসে আছে আর আরেকজন লোক মাঝ বয়সী কি সব হিসাব নিকাশ করছে। আমি ঢুকেই জিজ্ঞেস করলাম এটাই কি আপনাদের দোকান নাকি আরও দোকান আছে। মাঝ বয়সী লোকটা মাথা তুলে জবাব দিলো, ‘না এটাই আমাদের একমাত্র দোকান’। যাই হোক আমি ইতি উতি করে তাকিয়ে বই খুঁজতে লাগলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই কয়েকজন সিনিয়র আপু ভাইয়া এসে হাজির হলো। আমরা আনন্দের সাথে আপুদের সাথে মোলাকাত করলাম। ওনারাও ঢুকে একই প্রশ্ন করলো, ‘এটাই দোকান, নাকি আরও কিছু আছে?’ । ওনারাও কিছু বইপত্র কিনে চলে গেলো। ওদিকে মিম আর অন্তরাও হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির। মিমও একই এক্সপ্রেশন দিলো, ‘এত ছোট দোকান!’। আমাদের রহস্যজনক অভিব্যাক্তি দেখে মাঝবয়সী লোকটা কাউন্টারে ছেড়ে উঠে আসলো। উনি কৌতুহলী হয়ে আমাদের সাথে কথা বলতেই বের হয়ে গেলো আমাদের ‘ইন্ডিয়া কলিং’ এর সারকথা। ভদ্র লোক চোখ কপালে তুলে ফেললেন, ‘মাই গড, বাংলাদেশ থেকে-’ উনি নিজের পরিচয় দিলেন জয়ন্ত দাস নামে। আমাদের উনি সাহায্য করলেন বই খুঁজে বের করতে। কয়েকটা বই চাইতেই উনি লোক পাঠিয়ে কোথা থেকে যেন এনে হাজির করলেন। তারপর কি কি যেন অফার আছে, সেইসব দিয়ে আমাদের বইয়ের দাম কমিয়ে দিলেন। সব শেষে সুন্দর করে আমাদের গাদা গাদা বই প্যাক করে দিলেন। তারপর এক গাদা বুকলিস্ট দিয়ে উনি নিজের নাম আর ফোন নম্বর লিখে দিলেন। বললেন দেশে ফিরে যেন ওনাকে একটা পৌঁছ সংবাদ পাঠাই। ওনার কাছ থেকে আরও একটা ইংলিশ বইয়ের দোকানের ঠিকানা আর হাতে আঁকা ম্যাপ নিয়ে বের হয়ে গেলাম আমরা।

আবার সেই কফি হাউজে...............
আবার সেই কফি হাউজে……………

আনন্দ থেকে বের হয়ে আমরা চলে গেলাম কফি হাউজ। আবার সেই আগের জায়গা। দোতলায় গিয়ে বসলাম আমরা। অর্ডার দিলাম কোল্ড কফি। খানিক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে কফি খেয়েদেয়ে কফি হাউজকে বিদায় জানিয়ে বের হয়ে আসলাম। ততক্ষনে সূর্য ডুবে গেছে। ম্যাপ ধরে ধরে অন্ধকারের মধ্যে রাস্তা খুঁজে খুঁজে বের করে ফেললাম ‘ইন্ডিয়ানা’ নামের দোকানটা। দোকানের সামনের দিকটা বন্ধ। আমরা ঘুরে গলির ভেতর দিয়ে পিছনের দরজার দিকে হাজির হলাম। দোকানটাতে ঢুকার কোন জায়গা নাই। সারা দোকান জুড়েই স্তুপ করে রাখা বই। আমাদের মধ্যে মিম একমাত্র দোকানটার ভিতরে গিয়ে বলে আসলো যে আমরা বই কিনতে এসেছি। দোকানের লোকজন একটু ইতস্তত করতে লাগলো। বুঝলাম ওনারা একটা মেলায় অংশগ্রহন করেছিলেন। আজকে ছিল সেই মেলার শেষদিন। তাই মেলার সব বই এনে টাল করে দোকানে রাখা হয়েছে। এজন্য দোকান জুড়েই খালি বই আর বই। অন্য সবার জন্য দোকান বন্ধ থাকলেও আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি আর জয়ন্ত দাস পাঠিয়েছে শুনে এই অবস্থার মধ্যেও ওনারা কয়েকজন বের হয়ে আমাদের দোকানে ঢুকার ব্যবস্থা করে দিলেন। আমাদের হাতের মালপত্র সব বাইরে রেখে আমরা চারজন মানুষ কোনমতে দোকানের ভিতরে ঢুকে পড়লাম। এইরকম বাজে দিনে এসেছি বলেই হয়েতো ওনারা সব বইয়ের দাম অনেক কমিয়ে রাখলেন। আমরাও দুই হাত ভরে কিনতে লাগলাম। ইতিহাস, থ্রিলার থেকে শুরু করে বাচ্চাদের এবিসিডির বই কিছুই বাদ গেলো না। অনেক বই ওনারা আমাদের দিতে পারছিলেন না, কারণ সেগুলো অনেক ভিতরে। বারবার বলছিলেন যেন আগামীকাল আসি। ওনারা দোকানটা গুছিয়ে নিলেই আমাদের পছন্দ মতন সব বই ওনারা হাজির করতে পারবেন। যাই হোক আমরা সব বইয়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে ভারী ভারী সব বইয়ের বোঝা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসলাম। ততক্ষণে বেশ রাত হয়ে গেছে। দোকানের লোকজনই আমাদের ট্যাক্সি ঠিক করে দিলো। ট্যাক্সিতে আমাদের গাদাগাদা বইয়ের প্যাকেট তুলে দিয়ে আমরা উঠে বসলাম। রাতের বেলায় ট্যাক্সি আমাদের নিয়ে ছুটলো দিদার বক্স লেনের দিকে।

হোটেলে পৌঁছে আমাদের বইয়ের বোঝা কোনরকম রুমে জায়গা করে ঢুকালাম। তারপর খেতে নামলাম নিচের নাজ হোটেলে। খুব সস্তায় সেখানে শিক কাবাব পাওয়া যায়। আট রুপি করে একেকটা শিক কাবাব। আমরা রুটি আর শিক কাবাব অর্ডার দিলাম। খেতে অত ভালো ছিলো না। যাই হোক কোন রকম খেয়েদেয়ে রুমে ফেরত গেলাম। রুমে গিয়ে শুনতে পেলাম ডিসিশন ফাইনাল, আরও দুই দিন আমরা কোলকাতায় থাকবো। তারপরের দিন রওয়ানা দিবো দেশের পথে। এর মধ্যে আগামীকাল রাতে আমাদের ফল পার্টি হবে আর শেষদিন রাতে থাকবে মুভি দেখা আর ডিনার।

হাতে সময় আছে দেখে ভাবছিলাম শান্তিনিকেতন ঘুরে আসা যায় কিনা। তানভীরের সাথে এই নিয়ে কথাও বললাম। শুনলাম শেয়ালদা স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ে সোজা শান্তিনিকেতন গিয়ে পৌঁছায়। কেমন করে শেয়ালদা যাওয়া যায় সেইটা নিয়ে অনেকক্ষণ কথাবার্তাও হলো। অনেকক্ষণ কথাবার্তা হওয়ার পর আমরাই বুঝতে পারলাম যে, মনে হয় যাওয়া হবে না। যাই হোক, রাত হয়েছে- সবাই যার যার ছোট্ট রুমে ঢুকে পা ভাঁজ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ভাঁজ করা পা নিয়ে শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে গেলাম।

The Mighty INDIA CALLING: যে দিনের শুরু সেই ‘হাওড়া’তেই (পর্ব ৩৯)

আমার গভীর ঘুমটা ভাংলো কারও ধাক্কার চোটে। টের পেলাম রুবাইদা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ডাকছে। অনেক কষ্টে চোখ খুললাম। দেখি ট্রেনের ভেতরটা অন্ধকার আর কেমন যেন খালি খালি। তড়াক করে উঠে বসলাম। ট্রেন দেখি থেমে আছে! সব লোকজন নেমেও গেছে, খালি আমরাই আছি ট্রেনের মধ্যে! কি হচ্ছে, কিছুই তো বুঝতে পারছি না!

কয়েক সেকেন্ড পরে ব্যাপারটা বুঝলাম। আমরা কোলকাতা পৌঁছে গিয়েছি। ট্রেন থেমে আছে হাওড়া স্টেশনে। সব যাত্রী নেমেও গেছে। আমরা মড়ার মতন ঘুমাচ্ছিলাম বলে কিছু টের পাই নাই। টের যে পাই নাই তার কারনও আছে। আমাদের পৌঁছানোর কথা সকাল বেলায়। আমরা যে রাত ৪টাতেই পৌঁছে যাবো, যে কথা কেমন করে বুঝবো? যাই হোক কেউ একজন প্রথমে ঘুম ভেঙ্গে ব্যাপারটা টের পেয়ে আমাদের সবাইকে ডেকে দিয়েছে। আমরা অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে চাবি বের করে আমাদের লাগেজ যে শিকল দিয়ে বাঁধা তার তালা খুললাম। নিজের স্যান্ডেলটা খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হলো। অন্য সবাই তাদের লাগেজ গুলো অন্ধকারের মধ্যে টেনে টেনে বের করলো। এক পর্যায়ে আমরা আমাদের মালপত্র সব বের করে নেমে গেলাম ট্রেন থেকে।

প্ল্যাটফর্মের দৈর্ঘ্য মাশাল্লাহ বেশ বড়। গভীর ঘুম থেকে উঠেই কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিশাল বিশাল লাগেজ সব হাতে নিয়ে আমরা বিশাল প্ল্যাটফর্ম পাড়ি দিতে লাগলাম। আমার ঘুম ঘুম ভাব তখনও কাটে নাই, কিন্তু কিছু করার নাই। আমি চোখ ডলতে ডলতে আবিষ্কার করলাম এটা পুরানো স্টেশন। আগেরবার আমরা দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেছিলাম নতুন স্টেশন থেকে। একসময় আমরা প্ল্যাটফর্ম পাড়ি দিয়ে একটা জায়গায় আমাদের সব লাগেজ জড় করে বিশাল পাহাড় বানিয়ে রাখলাম। তার চারপাশে গোল করে ঘিরে দাঁড়ালাম। বাইরে তখনও ঘুটঘুটে অন্ধকার। আলো না ফুটলে আমরা কিছুই করতে পারবো না। অগত্যা আমাদের অপেক্ষা করতে হবে সকাল হওয়ার জন্য।

টুথব্রাশ হাতে একজন দ্বিমিকবাসী, পিছনে আমাদের লাগেজের স্তুপ
টুথব্রাশ হাতে একজন দ্বিমিকবাসী, পিছনে আমাদের লাগেজের স্তুপ

অনেককে দেখলাম টুথব্রাশ বের করে দাঁত মেজে নিচ্ছে। আমিও সবার দেখাদেখি টুথব্রাশ বের করে নিলাম। ব্যাপারটা বেশ দেখার মত। জনা ত্রিশ চল্লিশেক ছেলেমেয়ে স্টেশনের মধ্যে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করে দাঁত মাজছে। যদিও এই গভীর রাতে তেমন কোন লোকজন স্টেশনে ছিলো না, তারপরও কেউ কেউ যে অবাক হয় নাই সে কথা বলা যায় না। আমরা যেখানে ঘাঁটি গেড়েছিলাম তার কাছাকাছিই সারি ধরে কয়েকটা কল ছিলো। সেখানে আমরা কুলি করে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। দাঁতটাত মেজে আমার বেশ ফ্রেশ লাগলো। দেখলাম মায়িশা একটা দোকান থেকে সুন্দর দেখে কলা কিনে এনেছে। করার কোন কাজ না পেয়ে আমিও কলা আর পেয়ারা কিনে তাতে কামড় বসালাম। একটা বেঞ্চ পেলাম বসার জন্য। তাতে আমরা পালা করে বসতে লাগলাম।

লাগেজের স্তুপের মধ্যেই ঘুম (কৃতজ্ঞতায় মোজাম্মেল হক জাফর)
লাগেজের স্তুপের মধ্যেই ঘুম (কৃতজ্ঞতায় মোজাম্মেল হক জাফর)

সবাই ক্লান্ত। তাই গল্পগুজব তেমন জমে উঠলো না। ঘুম ঘুম চোখে কেই বা অন্যের সাথে গল্প করতে চায়। তারপরও আমাদের কথাবার্তা চলতেই লাগলো। অনেকে আবার থাকতে না পেরে লাগেজের গায়ে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। অনেকে মেঝেতে পোথির প্যাকেট বিছিয়ে বসে পড়লো। সৈকত আর জাফর লাগেজের মধ্যেই গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেলো। অবনীও সাংঘাতিক ঘুম দিয়ে দিলো। আর রুবাইদা তো সোজা হয়ে বসে ঘুমিয়ে গেলো। আমরা যারা ঘুমালাম না তারা অন্যদের ঘুমিয়ে পড়া নিয়ে হাসাহাসি করছিলাম। কে যেন টপাটপ ছবিও তুলে ফেললো এসবের।

আমাদের সময় আর কাটছিলো না। ওদিকে সূর্য ওঠার কোন নামগন্ধ নাই। সূর্য না উঠলে আমাদের হোটেল ঠিক করতে কেউ নযেতে পারবে না। কোলকাতায় যে সূর্য উঠতে দেরি হয় সেটা আমরা সেদিন হাড়েহাড়ে টের পেলাম। কি করে সময় কাটানো যায় বুঝতে পারছিলাম না। শেষমেশ ট্রেন জার্নিতে আমাদের ‘আবিষ্কৃত’ লেইম জোকসের বয়ান শুরু হলো। ভয়াবহ লেইম লেইম সব জোকস শুনে আমরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলাম।

মোটামুটি সাতটার দিকে লালচে সোনালি রোদ নিয়ে সূর্য উঁকি দিলো কোলকাতার আকাশে। আমাদের লোকজন পড়িমড়ি করে ছুটলো হোটেল ঠিক করার জন্য। তার আগেই আমরা বারবার বলে দিয়েছিলাম আগের সেই প্যারাডাইস হোটেল যেন ঠিক করা না হয়। ওরা চলে গেলে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। খুব বেশিক্ষণ সময় লাগলো না। এক ঘণ্টার আগেই খবর চলে আসলো যে হোটেল ঠিক হয়ে গেছে। নতুন এই হোটেলের নাম ‘নিউ সিটি হোটেল’। আগের হোটেল থেকে খুব বেশি দূরে নয়। হোটেলের কার্ডের একটা ছবি মোবাইলে তুলে নিলাম। তারপর আমরা স্টেশন থেকে বের হতে শুরু করলাম আস্তে আস্তে। এর মধ্যে কোন কারণ ছাড়াই তমা ওর সব লাগেজ নিয়ে ধড়াম করে পড়ে গেলো আমাদের সবার চোখের সামনে। আমরা তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে ওকে তুললাম। আল্লাহর রহমত, ও কোন রকম ব্যাথা পায় নাই। তমা নিজেও বুঝলো না ও কেন পড়ে গেলো। আসলে দীর্ঘদিন ট্যুর দিয়ে সবার হাত পাই আর মাথার নির্দেশ মতন চলতে চাইছিলো না। তার উপর প্রচন্ড খাটনি, পরিশ্রমের চোটে সবার শরীরই কমবেশি দূর্বল হয়ে পড়েছে। তাই এরকম অবস্থায় দুই একটা মানুষ পড়ে যেতে পারে- এটাই আমার কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হলো।

স্টেশনের বাইরেই আমরা মাইক্রো টাইপের গাড়ি পেয়ে গেলাম। রাস্তাঘাট ফাঁকা, লোকজন নাই। তাই তেমন দরাদরি করা লাগলো না। ৩৫০ রুপিতেই রাজি হয়ে গেলো। আমাদের বাক্স প্যাটরা ঢুকেতে বেশ বেগ পেতে হলো। তারপর আমি, রুবাইদা, মিম, সারা, রাত্রি আর অন্তরা উঠে পড়লাম ট্যাক্সিতে। আমি বসলাম সামনের সিটে। আমাদের নিয়ে ট্যাক্সি চলতে শুরু করলো। আমরা হাওড়া ব্রিজ পার হলাম। তারপর এঁকে বেঁকে আমাদের ট্যাক্সি ছুটলো মার্কুইস স্ট্রিট পার হয়ে দিদার বক্স লেনের দিকে। দিদার বক্স লেনের ভিতর দিয়ে একটা মুসলিম ইন্সটিটিউট পার হয়ে, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে নাজ হোটেলের গা ঘেঁষে আমাদের নিউ সিটি হোটেল পাওয়া গেলো সহজেই।

হোটেলটা আগের হোটেলের চাইতে অনেকগুন ভালো। আমরা আমাদের বাক্স প্যাটরা নিয়ে ভিতরে ঢুকতে শুরু করলাম। এই হোটেলের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, ফ্লোরটা খুব স্টাইল করে উঁচু নিচু করা। একটু পরপর এক ধাপ নামতে হয় না হলে এক ধাপ উঠতে হয়। এই ভারি ভারি লাগেজ টেনে টেনে আমাদের জিহবা ঝুলে পড়লো। ভিতরে ঢুকার পর একটা লাউঞ্জে বসলাম আমরা। সব রুম এখনও খালি হয় নাই। তাই আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। একে একে একজন একজন করে রুম পেয়ে পেয়ে চলে যেতে লাগলো। কিন্তু আমরা ঠাঁয় বসে রইলাম। এর মধ্যে অনেক সিড়ি পার হয়ে সুড়ংগ টাইপের জায়গায় একটা খালি রুমে আমাদের কিছুক্ষনের জন্য বসতে দিলো। আমরা সেই রুমের বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসলাম। অনেকদিন পর বাথরুমে বদনা দেখে খুব শান্তি লাগলো। আমরা সেই রুমের বিছানায় বসতে না বসতেই আমাদের রুম রেডি হয়ে গেছে খবর আসলো।

এই হোটেলে লিফট আছে। কোলাপ্সিবল গেট দেওয়া লিফটে করে আমরা মালপত্র নিয়ে একজন একজন করে তিন তলায় উঠলাম। আমাদের রুম তখনও ঝাড়ু দেওয়া হচ্ছিলো। উঁকি মেরে দেখে নিলাম এক ঝলক। খুবই ছোট রুম। একটা ছোট ডবল বেড (এইটাকে ডবল না বলে সিঙ্গেলের চাইতে একটু বড় বলাই ভালো) আর একটা টেলিভিশনের ছোট্ট সেলফ। বিছানায় ওঠার জন্য এক চিলতে ফাঁকা জায়গা আর বাথরুমে যাওয়ার জন্য আরেক চিলতে জায়গা। ব্যাস, রুম শেষ। একটা মাত্র জানালা সেটাও করিডরে খুলে। আমরা চারজন মানুষ সব মালপত্র নিয়ে ঢুকলে জায়গা হবে কিনা সন্দেহ হচ্ছিলো। যাই হোক, আমরা সিস্টেমেটিকভাবে লাগেজ রেখে কোনমতে ব্যবস্থা করলাম। এর মধ্যে বাইরে টের পেলাম কথাবার্তা হচ্ছে। অদিতিদের রুমে পাঁচ জনের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, অথচ রুমটা খুবই ছোট যদিও এতে একটা ডবল বেড আর একটা সিঙ্গেল বেড আছে। ওরা অনুরোধ করছিলো কোনভাবে রুম অদলবদল করা যায় কিনা। অবনী আমাদের এসে সব খুলে বললো। আমরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলাম। কিন্তু  আমাদের কষ্ট হবে দেখে শেষমেশ ওরা আর রুম বদল করতে চাইলো না। আমরা কোনরকম গোসল করে খাওয়ার জন্য বের হলাম।

নিচের নাজ হোটেলে গিয়ে হাজির হলাম। খেতে চাইলাম নাশতা কিন্তু নাশ্তার সময় শেষ। বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। শেষমেশ বেগুন আর আলুর ঝোল তরকারি দিয়ে বিশাল বিশাল মচমচে লুচি খেয়ে নিলাম আমি আর রুবাইদা। কোন মতে খেয়েই আমার দৌড়ে রুমে চলে গেলাম। ঘুম দেওয়া খুবই জরুরি। কোন কিছু না ভেবেই আমরা চারজন লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। এই বিছানায় দেওয়ালের জন্য পা টানটান করে শোয়া যায় না। কিন্তু আমাদের অতকিছু ভাবার সময় নাই। জোরে ফ্যান ছেড়ে লাইট নিভিয়ে দিতেই রুমের মধ্যে রাতের অন্ধকার নেমে আসলো। আমরা দিলাম ঘুম। যাকে বলে সাউন্ড স্লিপ।

আমার ঘুম ভাংলো বিকালের দিকে। ততক্ষনে মৌলি আর মজুমদার এক দফা বের হয়ে শ্রীলেদার্স থেকে বেশ কিছু জিনিস কেনাকাটা করে ফিরেছে। ওরা জানালো, জিরো নাইন ব্যাচের সবাই শ্রীলেদার্স খালি করে দিয়েছে। এখন সেখানে তেমন কিছুই নাই। আমি আর রুবাইদা রেডি হয়ে নিলাম। তারপর ওদের কাছ থেকে জেনে নিলাম যে আমরা মার্কুইস স্ট্রিট থেকে কত দূরে আছি। তারপর বের হয়ে পড়লাম দুইজনে। আমাদের এলাকাটা মুসলমান অধ্যুষিত। নাজ হোটেলের লোকজন সব মুসল্লীরা। সামনেই আছে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেও সব মাদ্রাসা ছাত্রদের মতন লোকজন দেখা যায়। দেখলে মনে হবে আমি বোধহয় ঢাকা শহরের কোন মসজিদের পাশেই আছি। আমরা হেঁটে হেঁটে রফি আহমেদ স্ট্রিটে উঠলাম। সেখান দিয়ে ট্রাম লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে মার্কুইস স্ট্রিটের মোড়টা পেয়ে গেলাম। আরাফাত হোটেলের উল্টা পাশে রাস্তার ধারে একটা মোমোর দোকানে বসলাম। এখানে নাকি হালাল মোমো পাওয়া যায়। আমি আর রুবাইদা মিলে অর্ডার দিলাম মোমো। লোকটা প্রথমে আমাদের মোমো দিলো। সাথে করে সুপের বাটি। রুবাইদা জানালো এই সুপে ডুবিয়ে নাকি মোমো খেতে হয়। মোমোটা প্রচন্ড গরম ছিলো। তাই খেতে আমাদের কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু সুস্বাদু যে ছিলো সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। মোমো খেতে খেতেই আমরা ভাবছিলাম আর কি কি অর্ডার দেওয়া যায়। আমি উঠে গিয়ে একটা চিকেন পপ আর একটা নুডুলস অর্ডার দিলাম। আর এদিকে গরম গরম স্যুপে ডুবিয়ে মোমো খাচ্ছিলাম।

লোকটা দুই বাটি নুডুলস রেডি করছিলো। আমরা সেটা দেখছিলাম। আমার মনে হচ্ছিলো একটা বাটি আমাদের আর আরেকটা বাটি অন্য কারও হবে বোধহয়।  কিন্তু লোকটা আমাদের ডেকে দুইটা বাটিই নিয়ে যেতে বলে। আমি বুঝলাম, সে আমাদের দুইজনের জন্য দুইটা অর্ডার নিয়ে ফেলেছে। কি আর করা, দুই বাটি নুডুলস খাওয়া শুরু করলাম আমরা। ওদিকে হটাৎ মনে পড়লো চিকেন পপের অর্ডারও তো বাকি আছে। আমি তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেলাম সেটা ক্যান্সেল করতে। গিয়ে দেখি, এক প্লেট অলরেডি রেডি হয়ে গেছে। কি আর করা, সেই এক প্লেট নিয়েও আমরা খেতে বসলাম।

ইতোমধ্যে বিকাল শেষ হয়ে সুর্য ডুবে সন্ধ্যা শেষ হয়ে রাত নেমে এসেছে। মার্কুইস স্ট্রিটের ঝলমলে হলুদ বাতি জ্বলে উঠেছে আগের মত। ঘটাং ঘটাং শব্দ করে ট্রাম চলছে। সেই আগের দৃশ্য আমার চোখে ভেসে উঠেছে। আর এদিকে আমরা খাওয়া শেষ করতে পারছি না। অনেক কষ্ট করে যখন খাওয়া শেষ করে বিল মিটিয়ে দিয়ে আমরা উঠে পড়লাম তখন আমাদের পেট একদম টায়টায় ভর্তি। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম নিউ মার্কেটের দিকে।

মার্কুইস স্ট্রিট, প্যারাডাইস হোটেল, শ্যামলী কাউন্টার, দাওয়াত হোটেল, রাঁধুনী হোটেল, শ্রীলেদার্স, মোর সুপার শপ পার হয়ে লিন্ডসে স্ট্রিটে উঠে দেখা পেলাম নিউ মার্কেটের। লিন্ডসে স্ট্রিটে আমরা একটা বড় মেগা শপ টাইপের দোকান পেয়ে তাতে ঢুকে গেলাম। দুনিয়ার জিনিসপাতি, কিন্তু কোনটাই পছন্দ হয় না। আমরা অনেক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখলাম। কিন্তু কিছুই কেনার মত পছন্দ হচ্ছিলো না। তারপর নেমে আসলাম রাস্তায় নিউমার্কেটে সামনে সারি ধরে রাস্তা দখল করে হকাররা বসে আছে। এই রাস্তা দিয়ে কোন গাড়ি চলে না। পুরোটাই হকারদের দখলে। কি নাই সেখানে? প্লাস্টিকের বোতল থেকে শুরু করে বড় ব্যাগ, চাবির রিং, জামা, জুতা, জুয়েলারি সবই আছে। আমরা ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করছিলাম।

নিউ মার্কেট বিশাল এলাকা। আমরা অলিতে গলিতে হাঁটাহাটি করলাম। সর্বনিম্ন ৫০ রুপিতে টপস বিক্রি হচ্ছে দেখতে পেলাম। তবে বেশিক্ষণ ঘোরাঘুরি হলো না। দোকানপাট বন্ধ হতে শুরু করলো। আমরাও যে রাস্তায় এসেছিলাম সেই রাস্তা দিয়ে ফেরত যেতে শুরু করলাম। আমাদের হোটেলে যাওয়ার জন্য আর কোন যানবাহন নাই। হয় পায়ে হেঁটে, অথবা টানা রিকশায়। টানা রিকশা ব্যাপারটা কেন যেন আমার পছন্দ না। আমরা দুইজনে হাঁটতে লাগলাম মার্কুইস স্ট্রিট ধরে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় চলে আসলাম দিদার বক্স লেনে।

আমাদের হোটেলে ঢুকে দেখলাম এখনও সিদ্ধান্ত ফাইনাল হয় নাই যে আমরা কবে দেশে ফিরবো। দু দিনও হতে পারে আবার চার দিনও হতে পারে। আমরা মিম আর অন্তরার সাথে বৈঠক দিলাম। ঠিক হলো আগামীকাল যাবো গড়িয়াহাট আর কলেজ স্ট্রিট আর তার পরের দিন চেষ্টা করবো শান্তি নিকেতন যেতে। তারপর যদি আরও থাকা হয় তাহলে দেখা যাবে!