ঘুম ভাংলো সেই অন্ধকার রুমে। অন্য সবাই বের হয়ে গেলেও আমি অনেকক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে পা সোজা করে নিলাম। এমনিতেও শান্তি নিকেতন যাওয়া হচ্ছে না। তাই আজকে সিদ্ধান্ত নিলাম দূরে কোথাও যাবো না। শুধুই আশেপাশে ঘোরাঘুরি করবো। কোন চাপ নাই। তাই ধীরেসুস্থে ঘুম থেকে উঠলাম।
এত ঢিলামি করতে করতে বেশ দেরি হয়ে গেলো। আমরা হোটেল থেকে বের হয়ে মার্কুইস স্ট্রিটের দিকে হাঁটতে লাগলাম। যখন হেঁটে হেঁটে দাওয়াত হোটেলে পৌঁছালাম তখন দুপুর হয়ে গেছে। আমি পরোটা মাংস অর্ডার দিলেও রুবাইদা ভাত অর্ডার দিলো। আমরা ধীরে সুস্থে খাওয়াদাওয়া করলাম। আজকে আমাদের কোন তাড়া নাই, তাই আমরা খুব ফুরফুরা মেজাজে ছিলাম।
দাওয়াত থেকে বের হয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম নিউমার্কেটের দিকে। পথের মধ্যে সব জায়গা আস্তে ধীরে দেখতে দেখতে গেলাম। একবার ঢুকলাম শ্রীলেদার্সে। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। চটপট পছন্দ হয়ে গেলো কয়েক জোড়া স্যান্ডেল। আমি আর রুবাইদা কিনে ফেললাম অনেকগুলো স্যান্ডেল। তারপর অনেকক্ষণ পর শ্রীলেদার্স থেকে বের হয়ে গেলাম নিউ মার্কেটের দিকে। কোলকাতার নিউ মার্কেটের একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, যানজট এড়ানোর জন্য এখানে গাড়ি চলাচলই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক দূরে গাড়ি রেখে সবাই হেঁটে হেঁটে আসে। আর রাস্তার দুইধার ধরে রাজ্যের সব পসরা নিয়ে হকাররা বসে থাকে। আমরা যখন যাই তখনও মার্কেট ঠিক জমে ওঠে নাই। আমরা তাই লিন্ডসে স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে চৌরঙ্গী রোড অর্থাৎ মেইন রোডে এসে পড়লাম। এর মধ্যেই এর ওর কাছ থেকে টুকটাক জিনিসপত্র কেনাকাটা চলতে লাগলো। তারপর আমরা হাঁটতে লাগলাম এস্প্লানেডের দিকে।
পেয়ে গেলাম একটা বিগ বাজার। দেরি না করে সোজা ঢুকে পড়লাম ভিতরে। অনেক ঘুরে ফিরে সেলসগার্লদের কবল থেকে বেঁচে টপাটপ কিনে ফেললাম আক গাদা ক্যাডবেরির বড় বার। আরও এদিক সেদিক দেখে শুনে কয়েক প্যাকেট চকোলেট নিয়ে নিলাম আমি আর রুবাইদা। তারপর যখন বিগ বাজার থেকে বের হয়ে আসলাম তখন মোটামুটি সব দোকানপাট জমে উঠেছে। আর আমাদের কেনাকাটাও পাল্লা দিয়ে চলতে লাগলো। আমরা হাঁটতেই লাগলাম আর হাঁটতেই লাগলাম। এস এন ব্যানার্জি রোড, চৌরঙ্গি রোড, চৌরঙ্গি প্লেস, হুমায়ুন প্লেস, বার্ট্মান স্ট্রিট, হগ স্ট্রিট, ইট স্ট্রিট, ম্যাজ লেন, সুদ্দার স্ট্রিট, হার্টফোর্ট লেন, কাওয়াই লেন- আরও কত বাহারি নামের রাস্তা ধরে আমরা ঘুরতেই লাগলাম। সাথে সাথে আমাদের হাতে শপিং ব্যাগের সংখ্যাও বাড়তে লাগলো।
ঘুরতে ঘুরতে বিকাল হয়ে গেলে আমরা নিউ মার্কেটের সামনেই এক দোকানে ফাস্ট ফুড খেয়ে নেই। আর সাথে নেই তাজা কমলার জুস। এইসব খেয়েদেয়ে আবার যাই নিউমার্কেটে। আমাদের যেমন মার্কেটের ভিতরটা সরগরম থাকে এই মার্কেটের ব্যাপারটা সেরকম না। দালানের ভিতরটা ফাঁকা, লোকজন নাই, হৈচৈ নাই, চুপচাপ এবং নীরব। অনেকটা আমাদের দেশে ঈদের পর মার্কেটগুলো যেমনটা থাকে ঠিক সেইরকম। আমরা একটু খোঁজাখুঁজি করে একটা চকোলেট লজেন্সের দোকানে ঢুকলাম। সেখান থেকে নানা রকম চকোলেট কিনে তারপর গেলাম এক কস্মেটিক্সের দোকানে। সেখান থেকেও কিনলাম বেশ কিছু জিনিসপাতি। তারপর ভারি ব্যাগ নিয়ে দুই জনে টানতে টানতে বের হয়ে আসলাম মার্কেট থেকে। এভাবে হেঁটে হোটেল যাওয়াটা কষ্টকর। তাই নিলাম এক টানা রিক্সা। এই টানা রিক্সাওয়ালা রাস্তাঘাট চেনে না। কয়েক কদম গিয়েই জানতে চায় আর কত দূর, আর কত দূর। আরাফাত হোটেলের সামনে গিয়ে শেষমেশ লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে আমরা হাঁটাই শুরু করলাম। দুনিয়ার শপিং ব্যাগ নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আমরা হোটেলে ঢুকলাম। রিসেপশনের লোকজন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো আমাদের শপিঙের পরিমান।
কোনমতে রুমে ঢুকে আমরা আমাদের সব মালপত্রগুলো ঢুকালাম। তারপর ঠিক করলাম বিশ্রাম নিবো। জোরে ফ্যান ছেড়ে দুইজনে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। একটু ঘুম দেওয়া দরকার।
ঘুম থেকে উঠে আবার সেই বেরিয়ে পড়া। সেই একই রাস্তা, একই শ্রীলেদার্স, একই নিউমার্কেট। সারাদিন ধরে একই জায়গায় ঘোরার ফলে সব লোকজন আমাদের চেহারা মুখস্ত করে ফেললো। এমনকি শ্রীলেদার্সের লোকজনও আমাদের চিনে ফেললো। এই শ্রীলেদার্সে কেনাকাটা করতে করতেই হঠাৎ আসাদ ভাইয়ের সাথে দেখা। আসাদ ভাই আমার দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। ভিনদেশে এসে দেশের পরিচিত মানুষ পেলে যা আনন্দ লাগে সেটা আর বলার মত না। আসাদ ভাই এসেছেন সিমলা ঘুরতে। ঘোরাফিরা শেষে এখন দেশে ফেরত যাচ্ছেন। ওনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার আমরা বের হয়ে পড়ি। রুবাইদা দুই একবার মার্কেটের ভিতর থেকে কেনাকাটা করতে চাইলো, কিন্তু সেরকম কিছুই আমরা পেলাম না। নিউমার্কেটের বড় শ্রীলেদার্সে গেলাম। সেখানেও কেনাকাটা চললো। আমাদের অনেকের সাথে সেখানে দেখাও হলো। আমরা হাসি ঠাট্টা করে একসময় বের হয়ে আসলাম সেখান থেকে। রাতের মার্কেট পাড়া চক্কর দিতে দিতে আমরা আবার সেই বিগ বাজারের সামনে এসে থামলাম। আমি তিনটা সুন্দর পানির বোতল কিনলাম ৮০ রুপি দিয়ে।
রাত বাড়ার সাথে সাথে দোকানপাটও বন্ধ হয়ে আস্তে লাগলো। আমরাও আস্তে আস্তে ফেরার রাস্তা ধরলাম।সেই পরিচিত রাতের মার্কুইস স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমাদের হোটেলের দিকে যেতে লাগলাম। হোটেলে যখন ঢুকি, রিসেপশনে যিনি বসা ছিলেন তিনি আমাদের দিকে এক গাল হেসে বললেন, ‘আপনারা তো আমাদের জন্য কিছুই বাকি রাখছেন না, সব জিনিস তুলে নিয়ে যাচ্ছেন’। বলাই বাহুল্য, আমরা প্রত্যেকে যে হারে বড় বড় শপিং ব্যাগ নিয়ে হোটেলে ঢুকছিলাম তাতে ওনার এই মন্তব্য অত্যুক্তি হয় না।
সব মালপত্র নিয়ে রুমে ঢুকে পড়লাম আরেক বিপদে। রুমে তো জিনিসপত্রের জায়গা হচ্ছে না। আমরা শেষমেশ বিছানার উপর তুলে রাখলাম অনেক কিছু। ওদিকে মজুমদার আর মৌলির শপিংও কম নয়। সবাই রুমে আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছিলাম। সিদ্ধান্ত হলো একজন তার মালপত্র গুছাবে আর আমরা বাকিরা রুমের বাইরে বসে থাকবো। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক একজন একজন করে রুমে মালপত্র গুছাতে লাগলো আর আমরা বাকিরা রুমের বাইরে করিডরে হাঁটাহাটি করতে লাগলাম। শেষমেশ সবাই যখন গুছিয়ে শেষ করলো তখন আর রুমে পা রাখার কোন জায়গা নাই। খালি দরজাটা খোলার জন্য যতটুকু খালি জায়গা দরকার ঠিক ততটুকুই জায়গা খালি আছে। রুমে ঢুকে সেখান থেকে এক লাফে বিছানায় উঠে যেতে হয়। বিছানা থেকে সরাসরি বাথরুমে ঢুকে যেতে হয়। আবার বাথরুম থেকে বের হয়ে সরাসরি বিছানায় উঠে যেতে হয়। সেখান থেকে এক লাফে দরজার সামনে চলে আস্তে হয়। এই হলো আমাদের রুম। কোথাও আর পা ফেলার জায়গা নাই।
ওদিকে ফল পার্টির আয়োজন শুরু হচ্ছে। ব্যাগ ভর্তি কেজি কেজি ফল নিয়ে আসা হয়েছে। অন্য সব ফ্লোরের তুলনায় আমাদের ফ্লোরে আমাদের জনসংখ্যা বেশি বলে এই ফ্লোরের করিডরেই পার্টি করা হবে ঠিক হয়েছে। করিডরে একটা টেবিল আর সোফা ছিলো। সেইটা দখল করে আমরা দুনিয়ার ফল সাজিয়ে বসলাম। কলা, মাল্টা, সবুজ আঙ্গুর, কালো আঙ্গুর, আপেল, আনারস, কমলা, পেঁপে, তরমুজ কি নেই! শুভ বিশাল এক ছুরি নিয়ে মাল্টা, আনারস কাটতে বসে গেলো। আমরা হাতে হাতে ওয়ান টাইম ইউজ প্লেট নিয়ে নানা রকমের ফল নিয়ে নিয়ে খেতে লাগলাম। সাথে ছিলো কোক, ফান্টা আর সেভেন আপ। আমরা হৈচৈ করে সেগুলো খেতে লাগলাম। আমাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে ভয় পেয়েই বোধহয় আশেপাশের রুম থেকে কোন কমপ্লেন আসলো না। অনেক মজা আর গল্পগুজব করে আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হলো। আমরা সব সুন্দর করে গুছিয়ে নিলাম। সব ময়লা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে একদম পরিষ্কার ঝকঝকে তকতকে করে দিলাম। তারপর সবাই বিদায় নিয়ে যার যার রুমে ফেরত গেলাম।
অনেকে গেলো ছাদের মধ্যে আড্ডা দিতে। আমি আর রুবাইদা রুমে বসেই গল্প করছিলাম। আমার সেরকম রাত জাগার অভ্যাস নাই কিন্তু রুবাইদার সাথে গল্প করতে করতে কখন যে সময় চলে যেতে লাগলো টেরই পেলাম না। যখন টনক নড়লো যে অনেক রাত হয়ে গেছে তখন আমরা ঝটপট বালিশ নিয়ে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে ভাবলাম, আর মাত্র একটা দিন!