ক্যারিবিয়ান সাগরের হাতছানিতে ঈষৎ মেক্সিকো ভ্রমণ

হরেকরকম পরিকল্পনা করে, বারবার আঙ্গুলের কড়ায় বাজেট কষতে কষতে, অন্তর্জালের দুনিয়া থেকে যাবতীয় জ্ঞান অর্জন করে যখন সম্ভাব্য গন্তব্য ঠিক করা হলো মেক্সিকোর ক্যানকুন আর তুলুম শহর- তখন একশো একটা অজানা চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো। সারাক্ষণ খালি চিন্তা করতেই লাগলাম যে অ্যামেরিকা ছেড়ে বের হবার সিদ্ধান্তটা ঠিক হচ্ছে কিনা। কাগজ কলমে বারবার হিসাব করতে লাগলাম যে কোন খরচ বাদ পড়ছে কিনা। মনে হাজারটা অনিশ্চয়তা নিয়ে রাতে ঘুমাতে যেতাম। তবে সকল অনিশ্চয়তার অবসান ঘটলো যখন রাতুলের প্রফেসর খুব স্বাভাবিকভাবে বললো যে তিনি আমাদের ক্যানকুনে হোটেল ঠিক করে দিতে পারবেন। আমাদের হোটেল খরচ বেঁচে যাবে এই খুশিতে আমরা তুলুম শহর ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দিলাম। বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ না করে আমি সস্তায় ঠিক করে রাখা প্লেনের টিকেট আর গাড়ি বুক দিয়ে ফেললাম। আর নানান রকম জল্পনা কল্পনা করতে করতে রাতে ঘুমাতে গেলাম ফুরফুরা মন নিয়ে।

অ্যামেরিকা ছেড়ে বাইরে যাবো বলে আমাদের অনেক প্রস্তুতি নিতে হলো। আমরা মহা উৎসাহের সাথে ডলার ভাঙ্গিয়ে পেসো করলাম, আই টোয়েন্টি সাইন করালাম, স্প্যানিশ ভাষা অল্পবিস্তর দেখে নিলাম, মেক্সিকোর সাইনেজ মুখস্ত করলাম। কিন্তু আমাদের উৎসাহে পানি ঢেলে দিলো ওয়েদার ফোরকাস্ট। গুগলের ভবিষ্যতবানী অনুযায়ী আমরা যে কয়দিন ক্যানকুনে থাকবো সে কয়দিন বজ্রসহ ভারি বৃষ্টিপাত থাকবে। আমাদের উৎসাহ ফাটা বেলুনের মতন চুপসে গেলো। মুহূর্তের মধ্যেই আমরা সিদ্ধান্ত বদলিয়ে প্লেনের টিকেট বাতিল করার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু বিধিবাম, আমাদের টিকেট এতই সস্তা ছিলো যে এর ক্যানসেলেশন ফি টিকেটের দামের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ টিকেট বাতিল করলে কোন টাকা ফেরত পাবো না। যা আছে কপালে বলে আমরা মুখ গোমড়া করে রেইনকোট, ছাতা আর ওয়াটার শুর ব্যাবস্থা করলাম।

পঁচিশ তারিখ আমরা রওয়ানা দিলাম গভীর রাতে। আমাদের লেওভার অরল্যান্ডোতে। গরীবের প্লেন ফ্রন্টিয়ারে চেপে আমরা অরল্যান্ডো পৌঁছে গেলাম সময়মতন। তবে আমাদের এমন কান ব্যাথা শুরু হলো যে বলার মতন না। দাঁতে দাঁত চেপে কান ব্যাথা সহ্য করতে করতে গলা পর্যন্ত ব্যাথা হয়ে গেলো। তবদা লাগা কান আর গলা নিয়ে আমরা অরল্যান্ডোর এমসিও এয়ারপোর্টে গেট খুঁজতে লাগলাম। পরের ফ্লাইটের গেট ডোমেস্টিক টার্মিনালেই। কোন ইমিগ্রেশনের বালাই নাই। মনে হলো যেন বিদেশে যাচ্ছি না, পাশের শহরে যাচ্ছি। ফ্লাইট অন টাইম ছিলো। ল্যান্ডিংয়ের আগে আবার তীব্র কান ব্যাথার চোটে চোখে মুখে অন্ধকার দেখলাম। এরকম ভয়াবহ কান ব্যাথা আগে কোন প্লেন জার্নিতে হয় নাই। তবে জানালা দিয়ে চোখ জুড়ানো নীল রঙ্গের পানি আর সাদা রঙয়ের বালি দেখে চোখের শান্তি হচ্ছিলো। আল্লাহর এমন সুন্দর রঙের ক্যানভাসের দিকে কান ব্যাথা উপেক্ষা করে অপলক তাকিয়ে ছিলাম।

প্লেন থেকে নেমে ঝাঁঝাঁ করতে থাকা কান নিয়ে হাঁটতে থাকলাম। রাতুল বলে ফেললো,”ক্যানকুনে এসে তো কানকুন ব্যাথা হয়ে গেলো!”।  কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই ইমিগ্রেশন পার হয়ে কয়েকজন ইউনিফর্ম পরা দালালকে টপকে আমাদের রেন্ট এ কারের শাটল সার্ভিসের জন্য দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রায় আধা ঘন্টা পর শাটলে চেপে রেন্টে কারের অফিসে পৌঁছাই। অ্যামেরিকার যেকোন অফিসে কর্মীর সংখ্যা কম থাকে। সাধারনত রেন্ট এ কারের অফিসগুলোতে দুই তিনটা কাউন্টারে লোক থাকে। সবাই মেশিনের মতন কাজ করে। দশ পনের মিনিটের মধ্যেই সব কাগজপত্র তৈরি হয়ে যায়। তারপর নিজে নিজে গাড়ি খুঁজে পেতে আরও দশ পনের মিনিট লাগে। সবমিলিয়ে আধা ঘন্টার মধ্যেই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যাওয়া যায়। তবে মেক্স রেন্ট এ কারের অফিসে ঢুকে একটা বাংলাদেশ বাংলাদেশ ভাব পাই। বেশ কয়েকটা কাউন্টার। সবগুলো কাউন্টারেই কর্মী আছে। সবাই অনেক গল্প করছে। কিছু কর্মী এমনিতেই ঘোরাঘুরি করছে আর নিজেরা নিজেরা গল্প করছে, মাঝে মাঝে হাসাহাসি করছে। অসম্ভব ধীর গতিতে লাইন আগাচ্ছে। কাউন্টারের লোকজন কাস্টোমারের সাথে এত কথা বলছে যে রাতুল অসহ্য হয়ে বলেই ফেললো, “ব্যাটারা বিয়ের ঘটকালি করছে নাকি? এত কি কথা বলে?”। শেষমেষ আমাদের সিরিয়াল আসলে আমরা এক কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলার কাছে গেলাম। মহিলা ইংরেজি বোঝে না। ওনার সাথে ভাংগা ভাংগা ইংরেজিতে কথা বলে দীর্ঘসময় পর কাগজপত্র হাতে পাই। তারপর বাইরে এসে বসে থাকি আরও দীর্ঘসময়। এখানে নিজে নিজে গাড়ি নেওয়ার ব্যাপার নাই। বসে থাকতে হবে, আরেকজন লোক এসে গাড়ি দিয়ে যাবে। যখন আমরা কালো শেভ্রলে সেডানটা নিয়ে বের হলাম, ততক্ষণে সব মিলিয়ে দেড় ঘন্টার বেশি পার হয়ে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যখন আমরা হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিচ্ছি, তখন দুপুর পার হয়ে বিকাল হয়ে গেছে।

নীল সাদা মেঘের আকাশ আর ঝকঝকে রোদের মধ্যে আমাদের গাড়ি শাঁ শাঁ করে ছুটতে লাগলো। রাস্তার দুই ধারে বন জংগল, দোকানপাট আর বাসা বাড়ি। কেমন যেন বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো। প্রায় ঘন্টা খানেকের মধ্যে আমরা হোটেলে পৌঁছাই। হোটেল ভিলা ডেল ক্যানকুনে পৌঁছে আমাদের চোয়াল ঝুলে পড়ে। দালানটার চেহারা কদাকার হলেও এটা অত্যন্ত ফিটফাট বড়লোকি হোটেল। ড্রপ অফে গাড়ি রাখতেই একজন ভ্যালে এগিয়ে আসলো। আমাদের লাগেজের সংখ্যা জানতে চাইলো কারণ ওরা লাগেজ রুমে পৌঁছে দিবে। আমাদের তো কোন লাগেজ নাই,আমরা কোনরকম আমাদের দুইটা ব্যাকপ্যাক নিয়ে নেমে পড়ি। ভ্যালে আমাদের হাতে ঠান্ডা পানির বোতল ধরিয়ে দিয়ে লবিতে এক মহিলার কাছে নিয়ে যায়।

খানদানি লবি। বিশাল ঝাড়বাতি। রংবেরঙের সোফায় বড়লোকি ভাব স্পষ্ট। তবে ইন্টেরিয়র স্টাইলটা একটু পুরানো। হাইফাই লবিতে হাসিখুশি মহিলাকে আমরা প্রথমেই ক্যানকুনের আবহাওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। ঊনি আমাদের আশ্বস্ত করেন যে আবহাওয়া এখন ভালো আর গুগলের ভবিষ্যত বাণী এখানে খুব একটা খাটে না। শুনে আমরা বেশ খুশি হয়ে যাই। মহিলা আমাদের নামধাম নিয়ে কাউন্টারে নিয়ে যায়। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের কাজ শেষ হয়ে যায়। তারপর আমাদের একজন কনশিয়ার্জ সোফাতে বসিয়ে হোটেলের ম্যাপ বুঝিয়ে বলে। আরেকটা অফার দেয় যে ওদের পাশে গার্জা ব্লাঙ্কা নামের একটা ফাইভস্টার হোটেল নতুন খুলেছে । ওটার প্রচারের জন্য একটা প্রোগ্রাম চলছে। যদি আমরা প্রোগ্রামটায় জয়েন করি তাহলে আমাদের একদিন ফ্রি ব্রেকফাস্টের সাথে পাশের হোটেলটা ঘুরিয়ে দেখাবে। আর আরও কিছু অফার থাকবে। সব কিছু দেখে আমরা প্রোগ্রামটায় নাম লিখাই আর চিচেন ইৎজার ট্যুরের বুকিং দেওয়ার অফার পাই অনেক কম দামে।

আমাদের রুমের বারান্দা থকে ক্যারিবিয়ান সাগর

তারপর রুমে গিয়ে আমাদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। বারোশো স্কয়ার ফিটের ওয়ান বেডরুম সুইট! কি নাই এখানে? ডাইনিং রুম লিভিং রুম, কিচেন, লন্ড্রি রুম, বেডরুম, দুইটা বাথরুম, জাকুজি আর বিশাল বারান্দা। বারান্দা দিয়ে হোটেলের বিশাল পুল এরিয়া আর সমুদ্রের ঝকঝকে নীল পানি আর ধবধবে সাদা বালি দেখা যাচ্ছে। আমরা কোনরকম হাতমুখ ধুয়ে বের হয়ে পড়লাম। হোটেলের বিশাল পুল এলাকা পার হয়ে আমরা বিচে চলে যাই। শেষ বিকালের আলোতে ঝলমল করছিলো ক্যারিবিয়ান সাগর। কত রকমের যে নীল রঙ, দূরে গাঢ় নীল, তারপর আরেকটু হালকা, তারপর আরেকটু হালকা হয়ে একেবারে বালির কাছে সাদাটে পানি। বালিগুলোও একদম সাদা। বড় বড় দানা। তবে তেমন কোন ঢেউ নাই। ছোট্ট চিকন চিকন ঢেউ সাদা ফেনা নিয়ে আছড়ে পড়ছে বালিতে। শরীর চাংগা করা বাতাস। আমাদের সারাদিনের ক্লান্তি নিমেষেই দূর হয়ে গেলো। পানিতে হাত পা ভিজিয়ে, বালি মাখামখি হয়ে আমরা বিচের পাশেই চেয়ার আর খাটে আধশোয়া হয়ে বসে রইলাম সূর্যাস্ত পর্যন্ত। কি যে শান্তি লাগছিলো আর বলার মতন না। মনে হচ্ছিলো, ইশ- মাত্র দুইদিনের জন্য কেন আসলাম, আরও কয়েকদিন থাকা উচিৎ ছিলো।

রাতে শহর ঘুরতে বের হলাম। একটা জমজমাট পার্কে গেলাম। নাম পার্ক ডে লাস পালাপাস। বিশাল পার্ক। সারি সারি দোকানপাট, ওপেন এয়ার স্টেজ, বাচ্চাদের বিভিন্ন রাইড আর খেলার জায়গা, অজস্র স্ট্রিট ফুডের দোকান, সারি সারি খাবারের দোকান, ছাতাসহ বসার জায়গা, লাইভ গানবাজনা -সব মিলিয়ে রাতের বেলাতেও ঝলমল করছে সবকিছু! প্রচুর মানুষ বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে , ইচ্ছামতন খাওয়াদাওয়া করছে, আড্ডা দিচ্ছে, উচ্চ স্বরে হাসছে- অসম্ভব প্রাণবন্ত একটা জায়গা। আমার দেখে খুব শান্তি লাগলো। আমরা ঘুরে ঘুরে ফিশ ট্যাকো আর স্যুপ কিনে মেক্সিকান সুরেলা গান শুনতে শুনতে আমাদের রাতের খাওয়া সেরে নিলাম। ওদের স্থানীয় মাছ দিয়ে বানানো ফিশ ট্যাকো আর গরম গরম টমেটো চিংড়ির স্যুপ খেতে খুব ভালো লাগছিলো। তারপর রঙ্গিন সব জুসের দোকান পার হয়ে এক ঠেলাগাড়ি থেকে ধাক্কাধাক্কি করে সাদা ভুট্টা কিনলাম। ওরা ভুট্টার দানাগুলো একটা কাপে নিয়ে প্রচুর মেয়োনিজ আর চিজের গুঁড়া মিশিয়ে দিলো। আর আমরা আমাদের ইচ্ছামতন সস আর বিভিন্ন রকম ঝাল গুঁড়া মিশিয়ে নিলাম। তবে খেতে তেমন ভালো লাগলো না। আমি অনেকক্ষণ খোলা আকাশের নিচে বসে থেকে অন্যদের লক্ষ্য করছিলাম। মেক্সিকানরা আনন্দপ্রিয় জাতি, হৈচৈ করতে আর খাওয়াদাওয়া করতে ভালোবাসে। এরা যখন অ্যামেরিকার মতন নিরানন্দ দেশে গিয়ে সেটেলড হয় তখন এই কালচারাল শকটা মেনে নিতে নিশ্চয়ই কষ্ট হয়।

পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় আমাদের পাশের হোটেলে ব্রেকফাস্ট করতে যাওয়ার কথা। আমাদের লবিতে নামতে নামতেই নয়টা বেজে গেলো। একজন কনশিয়ার্জ আমাদেরকে নিয়ে গেলো পাশের হোটেল গার্জা ব্ল্যাংকায়। গার্জা ব্ল্যাঙ্কা একদম নতুন হোটেল- সবকিছু ঝকঝক করছে। কনটেমপোরারি ইন্টেরিয়রের উদাহরণ দেখে আমার নিজের করা বিভিন্ন প্রজেক্টের কথা মনে পড়ে গেলো। আমাদের প্রথমে নিয়ে গেলো একটা রুমে, সেখানে আমাদের বসিয়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে একটা ফর্ম পূরণ করা হলো। তারপর হাসিখুশি একজন মেয়ে এসে আমাদের গাইড করতে লাগলো। প্রথমে নিয়ে গেলো হোটেলের সবচেয়ে উপরের তলায় ইনফিনিটি পুল দেখাতে। তারপর আমরা একসাথে বসে ব্রেকফাস্ট করলাম। নাশতায় মেক্সিকান চিলাকুইলেস খেতে আমার বেশ ভালো লাগলো। খেতে খেতে আমাদের গাইড বিভিন্ন গল্প করলো যার বেশির ভাগই ছিলো আমরা কোথায় কোথায় বেড়াতে গিয়েছি, কত টাকা খরচ হয় একেকটা ট্যুরে, ভবিষ্যতে কোথায় কোথায় যেতে চাই- এইসব। খেয়ে দেয়ে আমরা হোটেলের ডিলাক্স, সুইট এইসব রুম দেখলাম। সবশেষে আমাদের একটা হলরুমে বসিয়ে কাগজ কলম বের করে বিভিন্ন টাকা পয়সার হিসাব দিতে লাগলো যে ওদের মেম্বার হয়ে কত টাকা জমা দিলে বছরে কতগুলো হোটেলে কত কত দিন ফ্রি থাকতে পারবো। আমরা যতই বলি যে এই সিদ্ধান্ত এখন দেওয়া সম্ভব না, ওরা ততই একজনের পর একজন এসে আমাদের বিভিন্ন রকম অফার দিতে লাগলো। এইভাবে লোকজনের সাথে কথা বলতে বলতে প্রায় ঘন্টা খানেক কেটে গেলো। শেষমেষ আমরা সরাসরি না বলে দেওয়ার পর আমাদেরকে উঠতে দিলো। আমাদের গাইড তারপর আমাদের নিয়ে গেলো ভিলা ডেল পালমারের আরেকটা অফিসে। সেখানে মেয়েটা বিদায় নিলো আর আরেকজন লোক আমাদের পাকড়াও করলো। সে ভিলা ডেল পালমারের বিভিন্ন ডিলের বর্ণনা দিতে লাগলো। আমরা শেষে বিরক্ত হয়ে সেখান থেকে উঠে পড়লাম। তারপর ট্যুর কোম্পানির অফিসে যেয়ে আগামীকালের জন্য চিচেন ইৎজা ট্যুরের টাকা জমা দিলাম। এরপর গাড়ি নিয়ে বের হয়ে পড়লাম।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে এইসব হোটেলের অফার শুনতে শুনতে। ইসলা মুহেরেস নামের দ্বীপে যাওয়ার কথা ছিলো, সেটা বাদ দিতে হলো। আমরা গেলাম একটা রেস্টুরেন্টে যার নাম কুকুলকান। একেবারে সমুদ্রের উপরে নারিকেল পাতার ছাউনি দেওয়া বিশাল এক ডেকের উপর সাজানো টেবিলে আমরা বসলাম। মেনু দেখে অর্ডার দিলাম ফিশ ফ্রাই আর হরচাটা নামের একটা শরবত। প্রথমেই আমাদের নাচোস আর ঝাল সালসা দিয়ে গেলো। আমরা বসে বসে নীল ঝকঝকে সমুদ্র দেখতে দেখতে সেগুলো চিবাচ্ছিলাম। এরমধ্যে শুরু হলো কাকের উপদ্রব। খাবারের লোভে কাক এসে হাজির। হাত দিয়ে কাক তাড়াতে হচ্ছে বারবার। যখন ফিশ ফ্রাই আসলো আমাদের মনটাই ভালো হয়ে গেলো। হালকা লবন আর মশলা দিয়ে ভাজা ফিশ ফ্রাইটা অনেক মজা করে খেলাম আমরা। খেয়েদেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বের হয়ে গেলাম রেস্টুরেন্ট থেকে। এরপর গন্তব্য বিচ।

দারুণ মজার ফিশ ফ্রাই

গুগল ম্যাপে প্রথমেই দেখাচ্ছে প্লায়া তরতুগাস। গাড়ি পার্ক করে কয়েক মিনিট হেঁটেই চলে গেলাম সেখানে। জমজমাট বিচ। বিচের পাশেই শ্যাক আর সেখান থেকে বাজানো হচ্ছে উৎসবমুখর গান। বালিতে রোদ পোহাচ্ছে অনেক মানুষ। অনেকে দল বেঁধে নেমে পড়ছে পানিতে। এই বিচটায় হালকা একটু ঢেউ দেখতে পেলাম। আমরা কিছুক্ষণ থাকলাম এখানে। তারপর রওয়ানা দিলাম পরের বিচটা দেখতে।

পরের গন্তব্য প্লায়া দেলফাইন। প্লায়া দেলফাইনে যাওয়ার জন্য আমাদের ক্যানকুনের বিখ্যাত হোটেল জোন পার হতে হবে। ক্যানকুনের এই জায়গাটা মেইন ল্যান্ড থেকে একটা শাখার মতন আলাদা হয়ে গেছে। এই শাখার একপাশে আছে নিচুপ্তে লেগুন আর অন্য পাশে ক্যারিবিয়ান সমুদ্র। এখানেই সব দামি দামি হোটেলগুলো সমুদ্রের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় একেকটা হোটেল বিল্ডিং দেখতে দেখতে আমার থার্ড ইয়ারের স্টুডিওর কাজগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো। থ্রি ওয়ান থ্রি টুতে ছাত্রদের ডিজাইন করা বিল্ডিংগুলোর মতন একেকটা হোটেল যেন! বিলাসবহুল হোটেল দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম প্লায়া দেলফাইন। প্লায়া দেলফাইন খুবই সুন্দর একটা বিচ। সাদা বালির বিচটা সারি সারি নারিকেল পাতার ছাতা দিয়ে সাজানো। আর সমুদের নীল রংটা এখানে যে আরও রাজসিক হয়ে ধরা দিয়েছে। আমাকে আর পায় কে, লাফাতে লাফাতে নেমে গেলাম পানিতে। মনে হলো আর কোথাও যাবো না, এখানেই থেকে যাই বাকিটা সময়। এই বিচে অনেকক্ষণ হাঁটলাম আমরা। তারপর উঠে পড়লাম গাড়িতে। এরপর যাবো প্লায়া মার্লিনে।

ঝকঝকে বিচ প্লায়া দেলফাই

আমরা প্লায়া দেলফাইনে আসার সময় প্লায়া মার্লিনে থামতে চেয়েছিলাম। কিন্তু গাড়ি পার্ক করার জায়গা না পাওয়ায় নামতে পারি নাই। এবার খুঁজে খুঁজে একটা পার্কিং পেয়ে গেলাম। গাড়ি পার্ক করে চলে গেলাম প্লায়া মারলিন।

একটা অদ্ভূত বরফকুচি দেওয়া ভ্যানিলা ফ্লেভারের কোন আইস্ক্রিম খেয়ে নেমে পড়লাম বিচে। আগের দুইটা বিচে পানিতে ইচ্ছামতন দাপাদাপি করেছি। এখানে আর পানিতে নামলাম না। বরং একটা নারিকেল পাতার ছাতার নিচে বসে বসে সুনীল সাগরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। প্রাণ জুড়ানো বাতাসে মনের শান্তি শান্তিভাব বেড়েগেলো বহুগুণ। এখানেই বসে রইলাম দিনের আলো কমে যাওয়া পর্যন্ত। তারপর হেঁটে হেঁটে গেলাম একটা চকচকা মার্কেটে যার নাম কুকুল্কান প্লাজা। ভিতরে তেমন লোকজন নাই। আমরা দুইজনে এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করে দোতলায় একটা গ্রোসারি শপে ঢুকে পড়লাম। গ্রোসারির নাম সোরিয়ানা। মেক্সিকোতে আমাদের একমাত্র গ্রোসারি শপে যাওয়া। শুরুতেই মেক্সিকান ঝাল, মশলাদার চিপস সারি সারি করে সাজিয়ে রাখা। আমরা হেঁটে হেঁটে কোমল পানীয়র ফ্রিজের দিকে গেলাম। মেক্সিকানরা নিশ্চয়ই প্রচুর জুস খেতে ভালোবাসে। ফ্রিজ ভর্তি ঠাসা সব রঙ্গিন জুসের বোতল। এত্ত রকমের ফ্লেভারের জুস যে কোনটা ছেড়ে কোনটা নিবো বুঝতে পারছিলাম না। শেষমেষ খুব কম দামে দুই লিটারের এক বোতল জুস কিনে আমরা বের হয়ে আসলাম।

সন্ধ্যার পর আমরা সাংঘাতিক জমকালো একটা মার্কেট দেখে থামলাম। মার্কেটের নাম লা ইসলা। সে এক এলাহী কান্ড। খোলা আকাশের নিচে বিরাট এলাকা জুড়ে একতলা সব ব্র্যান্ডের দোকানের শোরুম। অনেকটা আমাদের ঢাকা নিউ মার্কেটের মতন ব্যাপারটা। কিন্তু এত চমৎকার ল্যান্ডস্কেপিং যে বলার মতন না। টলটলে হালকা সবুজে নীল পানির কৃত্রিম জলাশয়, নানান রকম গাছ, স্ট্রিট লাইটিং আর বসার জায়গা পুরো জায়গাটাকে অনেক স্বস্তিদায়ক করে তুলেছে। বেশিরভাগ দোকানগুলোই সরোভস্কি, টমি হিলফিগার, গুচি, ভ্যানস, লাকোস্টে, ভিক্টোরিয়াস সিক্রেট, অ্যাডিডাস -এইসব অ্যামেরিকান ব্র্যান্ডের। ক্রেতারা বেশির ভাগই অ্যামেরিকান পর্যটক। তারা দুইহাত ভরে শপিং করছে। মেক্সিকোর সুভেনিয়র শপগুলোতে গেলে বোঝা যায় মেক্সিকানদের জীবনে একটা বড় প্রভাব বিস্তার করে আছে শিল্পী ফ্রিদা কাহলো। আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটা ঝলমলে রঙ্গিন ফেরিস হুইল দেখলাম। আরেকটা ইন্টেরাকটিভ অ্যাকুরিয়াম ছিলো যেটা সেদিনের মতন বন্ধ হয়ে গেছে। প্রাণ জুড়ানো বাতাসে ঝলমলে বিলাসবহুল দোকানগুলো দেখতে আমাদের খুবই ভালো লাগছিলো।

এখান থেকে বের হয়ে ছুটলাম ডিনারের উদ্দেশ্যে। কাছেই একটা রেস্টুরেন্ট ছিলো এল ফিশ ফ্রিটাংগা। নারিকেল পাতার ছাতার নিচে আমরা রেস্টুরেন্টের যেখানে বসলাম তার পাশেই ছিলো বিশাল নিচুপ্তে লেগুন আর একটা ছোট জেটি। জেটিতে বাঁধা সারি সারি স্পিড বোট। দিনের বেলায় দেখলে এটাকে একটা হারবার বলেই মনে হতো। আমরা মেনু দেখে বুঝে শুনে ঝটপট অর্ডার দিলাম ফিশ ট্যাকো, শ্রিম্প ট্যাকো, আর সি ফুড আলফ্রেডো পাস্তা। লাল নীল বাতির আলোকছটায় রাতের আকাশের চাঁদটাকে একটু ম্রিয়মান লাগছিলো। কিন্তু এমন সুন্দর পরিবেশে আমার সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। গরম গরম খাবার আসতেই আসতেই খাওয়া শুরু করে দিলাম আমরা। খেয়েদেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বের ডেজার্ট অর্ডার দিতে চাইলাম, কিন্তু ততক্ষণে কিচেন বন্ধ হয়ে গেছে। কি আর করা, আমরা ডেজার্ট না খেয়েই বের হয়ে আসলাম রেস্টুরেন্ট থেকে। ডেজার্ট খেতে না পারলেও সবমিলিয়ে আমাদের চতুর্থ বিবাহবার্ষিকীর নৈশভোজটা মনে রাখার মতন ছিলো।

এখান থেকে আমাদের হোটেলে যেতে প্রায় পৌনে এক ঘন্টা লাগবে। আমরা বিলাসবহুল হোটেল জোন দিয়ে পার হয়ে আসতে লাগলাম। রাতের বেলা এলাকাটা দেখে আমার কাছে কিছুটা লাস ভেগাসের মতন মনে হলো। সেই ঝলমলেভাবটা একই রকম খালি পার্থক্য এখানে ক্যাসিনো নাই সেরকম। হোটেলে ফিরে পরের দিনের জন্য গোছগাছ করে নিলাম। সকাল সাতটায় বের হতে হবে। ভালোমতন অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। আর মনে মনে কষ্ট পেলাম যে দ্বিতীয় দিনটা শেষ হয়ে গেলো।

পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বারান্দা ভিজা। সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। এবং আকাশ কালো। আমরা যতই দৌড়ঝাঁপ করে রেডি হই না কেন, নিচে লবিতে যেতে যেতে আমাদের চার মিনিট লেট হয়ে যায়। লবিতে নেমে দেখি আমাদের মিনিবাস নিচে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জন্য। তড়িঘড়ি করে উঠে বসলাম গাড়িতে। গাড়ির ভিতরের সিট বেশ আরামদায়ক। সামনে একটা টিভি স্ক্রিনে মিউজিক ভিডিও চলছে। আরও একটা হোটেল থেকে টুরিস্ট নিয়ে আমাদের গাড়িটা ছুটতে শুরু করলো। আমি জানালা দিয়ে দেখতে লাগলাম, বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে গেছে। এরমধ্য দিয়েই গাড়ি মোটর সাইকেল সব নির্বিকারভাবে ছুটছে। দেখে আমার দেশের কথা মনে পড়লো। দেশের কথা মনে পড়াতেই যেন একটা সিগনালে জ্যাম লেগে গেলো। আমাদের গাড়িটা থেমে রইলো অনেকক্ষণ। আমাকে দেশের কথা আরও মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই আমাদের গাড়িটা ব্যাকে যেয়ে পাশের থেমে থাকা পাবলিক বাসের সাথে ধুড়ুম করে ধাক্কা লাগিয়ে দিলো। আমার খুশিতে সবগুলো দাঁত বের হয়ে গেলো। পুরাই বাংলাদেশ বাংলাদেশ ভাইব পাচ্ছি! তবে বাংলাদেশে ধাক্কা লাগার পর যেমন সবাই বের হয়ে মারামারি লেগে যায় এখানে সেরকম কিছু হলো না। আমাদের গাইড কাচুমাচু হয়ে বললো আমরা দশ মিনিট হাঁটতে পারবো কিনা, কারণ পুলিশ না আসা পর্যন্ত এই গাড়ি নড়তে পারবে না। বাসের সবাই রাজি হলে আমরা রাস্তায় নেমে ফুটপাথ দিয়ে লাইন ধরে হাঁটতে থাকি। রাস্তায় মানুষজন খুব একটা নাই। চওড়া ফুটপাথ। মাঝে মাঝে বৃষ্টির পানি জমে আছে। আমরা সাবধানে হাঁটতে থাকি। একসময় একটা বড় বাসের কাছে পৌঁছে যাই, এই বাসে করেই আমরা বাকিটা পথ যাবো।

বাসে উঠে আরাম করে বসি। আমাদের চিচেন ইৎজা যেতে তিনঘন্টা সময় লাগবে। গাইডরা আমাদের মায়ান সভ্যতা নিয়ে বেশ কিছু তথ্য জানিয়ে দেয়। বাইরে আকাশ থমথমে। বেশ একটা ঘুমঘুম পরিবেশ। রাস্তার দুইপাশে তেমন কিছু দেখার না পেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ঘুম পরিবেশেই তিন ঘন্টা কেটে গেলো। আমাদের বাস থামলো একটা সুভেনিয়র শপের সামনে। আমরা ফ্রেশ হয়ে সুভেনিয়র কিনলাম একটা মায়ান রাশিচক্রের প্লেট আর পাথর কেটে বানানো ছুড়ি বা ড্যাগার। তারপর আবার আমরা চলতে শুরু করলাম। আমাদের হাতে হাতে টিকেট ধরিয়ে দিলো গাইড। বাস থামলো চিচেন ইৎজার পার্কিং লটে। আমরা লাইন ধরে গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম।

ভিতরে ঢুকে প্রথমেই আমাদের গাইড একটা সফেদা গাছ দেখালো। সফেদা গাছের আঠা দিয়ে মায়ানরা অনেক কিছু বানাতো। দেশি সফেদা গাছ দেখে আমার যে কি ভালো লাগলো আর বলার মতন না। তারপর আমরা হাঁটতে লাগলাম। যে পথ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম তার দুইপাশে সব ফেরিওয়ালা। সুন্দর সুন্দর পসরা সাজিয়ে রেখেছে। রঙ্গিন কাঠের মুর্তি আর মুখোশগুলো এত সুন্দর যে আমি চোখ সরাতে পারছিলাম না। ফেরিওয়ালার হাঁকডাকে মনে হচ্ছিলো কোন বাজারে চলে এসেছি। সকল ফেরিওয়ালা পার হয়ে অবশেষে পিরামিডটার দেখা পেলাম।

এই ফাঁকে চিচেন ইৎজা নিয়ে কিছু কথা বলে নেই। চিচেন ইৎজা মায়ানদের একটা শহরের নাম। মেক্সিকোর ইউকাটান পেনিন্সুলায় বর্তমানে যেখানে ঘন জঙ্গল, সেখানেই ছিলো একসময়ে মায়ানদের অন্যতম বড় শহর চিচেন ইৎজা। ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালের দিকে গোরাপত্তন ঘটে এই শহরের। এই শহরের প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা বিখ্যাত পিরামিড সদৃশ স্থাপনাটির নাম এল কাস্টিও। চোদ্দশ সালের দিকে ধ্বংস হয়ে যাওয়া চিচেন ইৎজা শহরের এই পিরামিড পরে স্প্যানিশদের দ্বারা আবিষ্কৃত হয়। স্প্যানিশরা এই জঙ্গলের মধ্যে এত উঁচু স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ দেখে মনে করে এটা কোন প্রাসাদ বা ক্যাসেল। সেই থেকে এর নাম দেওয়া হয় এল কাস্টিও। এই এল কাস্টিও পিরামিডটি আসলে একাধারে একটি মন্দির এবং ক্যালেন্ডার। পাখির পালকওয়ালা সর্পদেবতা কুকুল্কানের মন্দিরও বলা হয় একে। এতে সব মিলিয়ে ৩৬৫টা সিঁড়ির ধাপ আছে। আর চারপাশ চারটা ঋতু এবং প্রতি পাশে ৯১টা সিড়ির ধাপ ৯১ দিনকে প্রকাশ করে। বছরের যে দুই দিন দিন রাত সমান হয় অর্থাৎ ইকুই-নক্স, সে দুই দিন এর সিড়ির ধারে এমন করে ছায়া পড়ে যেন মনে হয় আকাশ থেকে নেমে এসেছে কুকুল্কান দেবতা। সেই দুইদিন এখানে পর্যটকদের ভীড় উপচে পড়ে। এত বছর আগে সীমিত প্রযুক্তির প্রয়োগে পাথর দিয়ে নিখুঁতভাবে জোতির্বিজ্ঞানের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে এত বড় একটা স্থাপনা কিভাবে বানানো হয়েছিলো সেটা এক মহা আশ্চর্যের বিষয়। ২০০০ সালে চিচেন ইৎজাকে সেভেন ওয়ান্ডার্স অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড এর একটা বলে ঘোষনা দেওয়া হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই পিরামিডের ভিতরে আছে আরেকটা পিরামিড। ধারণা করা হয়, এক রাজার বানানো পিরামিডের উপরে আরেক রাজা এসে পিরামিড বানিয়ে গেছে।

এল কাস্টিও বা কুকুল্কানের মন্দির (সূত্রঃ ইন্টারনেট)

বৃষ্টির কারণে পরিবেশটা থমথমে ছিলো। এল কাস্টিওকে তাই খুব ঝলমলে দেখতে পেলাম না। আমাদের গাইড একজায়গায় দাঁড়িয়ে থেমে জানালো এই এলাকার মাটির উপরের স্তর হচ্ছে লাইমস্টোনের। তাই খোঁড়াখুড়ি করে পানি পাওয়া কঠিন ছিলো। এরকম জায়গায় শহর স্থাপনের প্রধান কারণ ছিলো পানির উৎস। এই এলাকায় আছে প্রাকৃতিক জলাধার বা সিংক হোল যেটাকে বলা হয় সিনোটে। সিনোটে আছে বলেই মায়ানরা এখানে শহর তৈরি করেছিলো। তবে মায়ানরা সবসময়ই বৃষ্টির দেবতা ‘চাক’কে  তুষ্ট করতে চাইতো। এজন্য মানুষ বলি দেওয়া ছিলো একটা প্রচলিত পদ্ধতি। এল কাস্টিওর উপরে একটা বলি দেওয়ার বেদি ছিলো। সেখানে পুরোহিত শামান যাকে বলি দেওয়া হবে তার বুক চিরে হৃদপিন্ড বের করে ফেলতো। পাশেই সিংহাসনে বসে থাকতো রাজা, আর নিচে ভীড় করে থাকতো সাধারণ মানুষ। কি সাংঘাতিক ব্যাপার!

এরপর গাইডের সাথে হেঁটে হেঁটে আমরা পাশের একটা জায়গায় গেলাম। এটাই বিখ্যাত বল কোর্ট। মেসোঅ্যামেরিকানদের বলকোর্টগুলোর মধ্যে এটাই সব চাইতে বড়। মায়ানদের বিখ্যাত খেলার নাম ছিলো ‘পক আ টক’। খেলাটা অনেকটা বাস্কেটবলের মতন। একটা রাবারের বলকে দেয়ালে রিংএর ভিতর দিয়ে পাঠাতে হবে। দুই দলের মধ্যে খেলা হতো আর কোন দল গোল করতে পারলেই খেলা শেষ। তবে ব্যাপারটা অনেক কঠিন কারণ বলটা হাত কিংবা পা দিয়ে ধরা যেতো না। বলটা মারতে হতো হাতের বাহু, কোমর আর পায়ের উরু দিয়ে। আর রিংটাও বাস্কেটবলের রিঙয়ের মতন হরাইজন্টাল না বরং ভার্টিকাল। এবং তারওপর রিং যথেষ্ট উঁচুতে , মাটি থেকে প্রায় পঁচিশ ফুট উপরে। রাবারের একটা বলকে কিভাবে মাটি থেকে এত উচু একটা রিঙয়ের ভেতর দিয়ে পাঠানো সম্ভব সেটা আমার মাথায় ঢুকলো না। এই খেলার কোর্টটা হচ্ছে ইংরেজি I আকৃতির। মাঠটা নাকি সৌরজগতের রূপক ছিলো। বলটা ছিলো ছুটন্ত গ্রহ নক্ষত্রের প্রতীক, আর খেলোয়াড়রা ছিলো দেবতাদের ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রতীক। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটা শোনা তখনও বাকি ছিলো। এমনিতে এই খেলা সবসময় খেলা হলেও বছরের বিশেষ একটা সময় খেলা হতো দেবতাদের তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে। এবং সেই খেলায় জিতে যাওয়া দলের ক্যাপ্টেন হেরে যাওয়া দলের খেলোয়াড়দের থেকে একজনের মাথা কেটে ফেলতো সবার সামনে। আমাদের গাইড দেওয়ালে পাথরে খোদাই করা রিলিফ দেখালো যে পরাজিত খেলোয়াড়ের কাটা মুন্ডু ধরে আছে জয়ী দলের ক্যাপটেন!

লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় বলকোর্ট (সূত্রঃ ইন্টারনেট)

এখান থেকে বের হয়ে গেলাম যোমপ্লান্টলি প্ল্যাটফর্মে। খেলোয়াড়দের আর শত্রুদের কাটা মুন্ডু দিয়ে বানানো হয়েছিলো এই প্ল্যাটফর্মের স্ট্রাকচার। গাইডের কথায় যা বুঝলাম, মায়ানরা বেশ মারামারি এবং রক্তপাতপ্রিয় জাতি ছিলো। নিজেরা নিজেরা খালি যুদ্ধ করতো। আর এরপর গাইড আমাদের বিদায় দিয়ে এক ঘন্টার মধ্যে বাসে ফিরে যেতে বললো। এরপর আমরা নিজেরা হাঁটা শুরু করলাম। গাইডের কথা অনুযায়ী একদিকে হাঁটতে হাঁটতে আবার ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক পার হয়ে পৌঁছে গেলাম স্যাকরেড সিনোটেতে। এইটা একটা বিশেষ সিনোটে যেখানে মানুষজনকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হতো পানিতে দেবতাদের খুশি করার উদ্দেশ্যে। খাড়া গর্তের মতন সিনোটেতে একবার পড়ে গেলে সাঁতার জানলেও উপর থেকে সাহায্য ছাড়া উঠে আসা সম্ভব ছিলো না। সিনোটের একপাশে ছোট একটা স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ দাঁড়িয়ে আছে। এখানেই বলি দেওয়ার আগে মানুষটাকে গোসল দিয়ে পবিত্র করে নেওয়া হতো। আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম ঘোলাটে সবুজ রংয়ের পানির সিনোটেটাকে। কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো!

সবুজ পানির স্যাকরেড সিনোটে (সূত্রঃ ইন্টারনেট)

আমাদের হাতে সময় কম। পা চালিয়ে আবার চলে আসলাম এল কাস্টিওর কাছাকাছি। মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হচ্ছে। ছাতা নিয়ে হাঁটতে হচ্ছে আমাদের। প্রচুর পর্যটক চারপাশে। ছবি তোলার জন্য খালি কোন জায়গা পাওয়াই যাচ্ছিলো না। এর মধ্যেই দুই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। এরপর গেলাম টেমপল অফ দ্যা ওয়ারিওরের কাছে। এই মন্দিরটা চারটা বড়বড় ধাপের উপর অবস্থিত। চারপাশে অসংখ্য পাথরে খোদাই করা রিলিফ। এই টেম্পলের সাথেই আছে বিশাল কলোনেড।  অসংখ্য পাথরের কলাম, কোনটা গোল কোনটা চারকোনা। এককালে হয়তো ছাদ ছিলো, এখন আর সেসব নাই। সবখানেই সাপ, চিতা, ঈগল, মানুষ এইসব প্রতিকৃতি খোদাই করা। আশেপাশে আরও অনেককিছু ছিলো দেখার মতন। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছিলাম না যে কোথায় কি দেখতে যাবো কারণ কোন নির্দেশনা নাই। অন্যদিকে সময়ও কম বলে আমরা কোথাও থামলাম না। সামনে দিয়ে হেঁটে আরও একটা সিনোটের পাশ দিয়ে একটা ছোট পিরামিড পার হয়ে আবার এল কাস্টিওর সামনে এসে পড়লাম। মানুষজন নানাভাবে ছবি তুলছে। একটা ব্যাপার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো -আগে একসময় যেখানে মানুষ বলি দেওয়া হতো প্রায় দেড় দুই হাজার বছর পর সেখানেই পর্যটকেরা পোজ মেরে ছবি তুলছে! কি অদ্ভূত!!

সাধারণত ছবিতে এল কাস্টিওর যে পাশ দেখানো হয়, সে পাশটা মেরামত করা। বাকি তিনপাশের মধ্যে দুইপাশ অনেকটাই ভাঙ্গা। এতবড় একটা প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট অথচ সেরকম কোন রক্ষণাবেক্ষণ নাই। কোন স্থাপনার সামনে কোন ফলক নাই, কোথাও কোন ইন্সট্রাকশন নাই। গাইড না থাকলে একটা কিচ্ছু বোঝার সাধ্য ছিলো না আমাদের। তারওপর অসংখ্য ফেরিওয়ালার হাঁকডাক, নানা রকম বাঁশির শব্দে বেশ  বিরক্তই লাগছিলো। আজকে যদি এটা প্রথম বিশ্বের কোন দেশের স্পট হতো তাহলে ঢুকতেই ইতিহাস বৃত্তান্ত সমেত ম্যাপ হাতে পেতাম, জায়গায় জায়গায় বড় বড় ফলকে লিখা থাকতো, ইন পার্সন গাইড ছাড়াও অডিও গাইডের ব্যবস্থা থাকতো, কোথাও কোন ফেরিওয়ালা থাকতো না, শব্দ দূষণ থাকতো না, একটা ভিজিটর সেন্টার থাকতো যেখানে ঢুকেই পুরো সাইটটা সম্পর্কে মডেল দেখে কিংবা অডিও ভিজুয়াল প্রেজেন্টেশন দেখে একজন পর্যটক এই জায়গার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেয়ে যেতো। কিন্তু এসব বলে তো লাভ নাই। আমাদের গাইডের কথা অনুযায়ী, মেক্সিকোতে অসংখ্য পুরাতাত্ত্বিক সাইট আছে যার অর্ধেকও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয় নাই। দক্ষতা ও লোকবলের অভাবে এত বড় বড় সাইটের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হিমশিম খাচ্ছে ওরা। এই চিচেন ইৎজাতেই আরও চারটা বল কোর্ট আছে যেগুলো এখনও পুরোপুরি উদ্ধার করা হয় নাই। আমরা যখন ঘুরছিলাম তখনও দেখেছি অনেক মানুষ কাজ করছে টেমপল অফ দ্যা ওয়ারিয়রে। এখনও গবেষণা হচ্ছে এল কাস্টিওর নিচে কোন সিনোটে আছে কিনা সেটা নিয়ে। সব মেরামতের কাজ শেষ করে আজকে থেকে দশ বছর পর হয়তো এখনকার চাইতে আরও ভালো পরিবেশ থাকবে সেখানে।  

আমরা চিচেন ইৎজাকে বিদায় দিয়ে একটা ছোট বুকলেট কিনে বাসে চড়ে বসলাম। বাস আমাদের নিয়ে গেলো আগের সুভেনির শপের জায়গায়। সেখানে সুভেনির শপের পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে আমরা দুপুরে খেতে ঢুকলাম। অনেক বড় খোলা রেস্টুরেন্ট। নারিকেল পাতার বিশাল ছাউনির নিচে বসার জায়গা। আমাদের জন্য বুফে খাবারের ব্যবস্থা ছিলো। আমরা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে খাবার নিলাম। ফিশ ফ্রাই আর ভেজিটেবল সুপটা অনেক মজা ছিলো। আমরা ফিরনি আর আইস্ক্রিম ডেজার্ট খেলাম। এরমধ্যে কিছু মহিলা এসে স্থানীয় গানের সাথে নাচতে শুরু করলো। নাচ শেষ হলে অনেকেই বখশিশ দিলো। আবার কতগুলো ছেলে মুখে শরীরে রঙ মেখে, মাথায় পালকের মুকুট লাগিয়ে মায়ানদের মতন সেজে নাচানাচি শুরু করলো। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি হচ্ছিলো। সব মিলিয়ে খুব ভালো ছিলো এই খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা।

আমরা পেট ভরে খেয়েদেয়ে আবার রওয়ানা দিলাম। বাস আমাদের নিয়ে গেলো সিনোটে সামালে। এবার বৃষ্টি দেখে আমরা রেইনকোট পরে নামলাম বাস থেকে। আমাদের হাতে ব্যান্ড পরিয়ে দেওয়া হলো। আমরা হেঁটে হেঁটে চলে গেলাম সিনোটে সামালে। খাড়া সিঁড়ি দিয়ে মাটি থেকে নিচের দিকে নামতে লাগলাম। মাঝামাঝি এক জায়গায় রেলিং ঘেরা সমতলে ভীড় করে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। আর যারা পানিতে নামবে তারা লাইফ জ্যাকেট ভাড়া করে নিচে নেমে যাচ্ছে। আমরা যে রেলিং ঘেরা সমতলে দাঁড়িয়ে আছি তার নিচে গাঢ় নীল রঙের পানি। তাতে হৈচৈ করে লোকজন সাঁতার কাটছে।  আর উপরে গোল হয়ে দেখা যাচ্ছে আকাশ। অন্য মানুষদের সাঁতার দেখে আমরা কিছুক্ষণ পর উপরে উঠে আসলাম। আশেপাশে রেস্টুরেন্ট, টাকিলা বার আর সুভেনির শপ। সব দেখেটেখে আমরা আবার বাসে উঠে পড়লাম।

সিনোটে সামাল (সূত্রঃ ইন্টারনেট)

আমাদের আজকের দিনের মতন অ্যাডভেঞ্চার শেষ। এবার ফেরার পালা। বাস ছেড়ে দিতেই আবার ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। প্রায় আটটার দিকে আমরা ক্যাঙ্কুনে পৌঁছালাম। বাস আমাদের নামিয়ে দিলো একটা পেট্রোল পাম্পে। সেখানে আমরা একটা ছোট বাসে উঠলাম। সেই ছোট বাসে করে হোটেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় নয়টা বেজে গেলো। রুমে ঢুকে ব্যাগপত্র রেখে তারপর গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলাম ডিনার করতে। এত রাতে আশেপাশের সব জায়গা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা ঠিক করেছি শহরের দিকে একটা রেস্টুরেন্টে যাবো যার নাম লা পারিইয়া ক্যানকুন।

রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি পার্ক করতে করতে ভ্যালে এগিয়ে আসলো। আমরা গাড়ির চাবি দিয়ে নেমে পড়লাম। দারুণ উৎসবমুখর পরিবেশ মনে হচ্ছে ভিতরে। আমরা ঢুকে একটা টেবিলে বসলাম। চিন্তা ভাবনা করে অর্ডার দিয়ে দিলাম। প্রায় সাথে সাথেই নাচোস আর সালসা দিয়ে গেলো। নাচোস চিবাতে চিবাতে আশেপাশে দেখছিলাম। নীল রঙের মেক্সিকান পোশাক পরা একটা গানের দল একটা টেবিলের কাস্টোমারদের গান গেয়ে শোনাচ্ছে। কেউ গাইছে, কেউ বাজাচ্ছে। খুবই আনন্দমুখর পরিবেশ। রেস্টুরেন্টের ভিতরটা আলো দিয়ে ঝলমল করছে। আর নানা রকম রঙ্গিন কাগজ দিয়ে সাজানো ভিতরটা। আশেপাশের টেবিলে মানুষজন উচ্চ স্বরে হাসছে, কথা বলছে। আমাদের খুবই ভালো লাগছিলো। একজন ওয়েটারকে দেখলাম মাথায় একটার উপর আরেকটা বসিয়ে মোটমাট চারটা গ্লাস আর একটা বোতল নিয়ে এসে এক টেবিলে পরিবেশন করতে। আমরা খুবই মজা পেলাম। আমাদের খাওয়া চলে আসলো। অর্ডার ছিলো টোস্টাডিয়া আর ফিশ ফিলে। টোস্টাডিয়াটা খুব মজা ছিলো। তবে ফিশ ফিলেটা মজা লাগে নাই। তারপর ডেজার্ট আসলো বিশাল একটা ট্রেস লেচেস। দারুণ স্বাদের কেকের টুকরাটা এত বড় ছিলো যে আমরা অনেক কষ্টে সেটা খেয়ে শেষ করলাম।

ভরপেট খাওয়া দাওয়া

বিল মিটিয়ে দিয়ে আমরা বের হয়ে আসি সেই রেস্টুরেন্ট থেকে। হোটেলে ফিরতে ফিরতে আরও রাত হয়ে যায়। মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো এই ভেবে যে এত সুন্দর একটা ট্যুর শেষ হয়ে গেলো। রাতে কয়েকঘন্টা ঘুমিয়ে আবার ভোরে উঠে গেলাম ফজরের সময়। রুমের বারান্দায় হ্যামকে শুয়ে শুয়ে দেখলাম সূর্যোদয়। সব মালপত্র গোছগাছ করে এক দফা নিচে নেমে গেলাম। আমাদের শেষ বিচে যাওয়া। সকালের ঠান্ডা বাতাসে ঝকঝকে সমুদ্র দেখে চোখের শান্তি হচ্ছিলো। খালি মনে হচ্ছিলো আরও দুই তিন দিনের জন্য কেন প্ল্যান করলাম না….

সব শেষে সমুদ্রকে বিদায় জানিয়ে রুমে গিয়ে ব্যাগপত্র নিয়ে নেমে পড়লাম। চেক আউট করে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। এরপর হালকা জ্যাম ঠেলে, পেট্রোল পাম্প খুঁজতে যেয়ে ভুল রাস্তায় অনেক্ষণ চক্কর কেটে, অবশেষে তেল নিয়ে, স্যান্ডুইচ কিনে, এয়ারপোর্টের সামনে একই রাস্তায় তিনবার চক্কর কেটে যখন গাড়ি জমা দিতে যাবার রাস্তা খুঁজে পেলাম তখন মনে একটু সন্দেহ জমতে শুরু করেছে যে প্লেন ধরতে পারবো কিনা! তারপর গাড়ি জমা দিয়ে, শাটলের জন্য অপেক্ষা করে, শাটলে চড়ে যখন টার্মিনালে পৌঁছালাম তখন দেখি চেক ইন কাউন্টারে বিরাট লাইন। আল্লাহর রহমতে যখন লাইন ব্রেক করে আমাদের ইমার্জেন্সিভাবে আগে নিয়ে গেলো, তখন একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। চেক ইন করে যখন সিকিউরিটি চেক ইনে গেলাম, তখন আমাদের সুভেনিয়র হিসাবে কেনা ছুরিটা আটকে দিলো। নিজের উপর রাগ লাগলো, কেনার সময় একবারও ভাবি নাই যে এই জিনিস প্লেনে আটকে দিবে। কি আর করা, অগত্যা সুন্দর ছুরিটাকে ফেলেই চলে আসতে হলো। দৌড়ে দৌড়ে গেটে এসে পৌঁছে দেখি বোর্ডিং শুরু হয়ে গেছে। আমরা সরাসরি লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। সোজা প্লেনে চেপে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেন চলতে শুরু করলো।

জানালা দিয়ে দেখছিলাম রোদে ঝলমল করছে ক্যানকুন। সুন্দর এই শহরটাকে বিদায় জানাতে মোটেও ইচ্ছা করছিলো না। মনে মনে আবার এই শহরে আসার স্বপ্ন নিয়ে শেষবারের মতন তাকিয়ে দেখলাম সুন্দর শহরটাকে।        

Adios, Cancun, adios……..

ঝটিকা সফরে ময়মনসিংহে!

বান্ধবী রিন্তুর বিয়ে!

আরে, বেড়ানোর জন্য এর চেয়ে ভালো আর কোন উপলক্ষ লাগে নাকি?

খুশিতে ডগমগ করতে করতে ঠিক করতে লাগলাম সবকিছু। কিন্তু এখন তো আর আগের মতন নাই সব কিছু, স্টুডেন্ট লাইফ শেষ হওয়ার সাথে সাথে জীবনের রঙগুলো কেমন যেন ফিকে হয়ে যেতে থাকে।  আগের উৎসাহ, চঞ্চলতা সব চাপা পড়ে যেতে থাকে চাকরি জীবনের নিচে। নানা ব্যস্ততা আর দুর্বোধ্য রকমের আলসেমি ভর করতে থাকে। মোটামুটি খোঁজ খবর নিতে লাগলাম। আমি, সারা, তানভীর, তমা আর সুমাইয়া যাবো- এতটুকুই ঠিক হলো শেষমেশ।

ময়মনসিংহ শহরটা তেমন কোন দূর দেশে অবস্থিত না। তাই তেমনভাবে চিন্তা ভাবনা কেউই করছিলাম না। তানভীর সার্কিট হাউজে থাকার ব্যবস্থা করবে আর ২১ তারিখ রওয়ানা দিবো বাসে করে- এছাড়া আর কোন কিছুই ঠিক হলো না। পরে সুমাইয়াকে আগের দিন অর্থাৎ ২০ তারিখ রাতে আমার বাসায় চলে আসতে বললাম। ঠিক ঠিক রাত সাড়ে আটটার সময় ও আমার বাসায় এসে হাজির হলো। এসেই জিজ্ঞেস করলো, আমরা কয়টায় বাসে উঠবো? আমিও একই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাচ্ছিলাম কিন্তু ম্যাসেঞ্জারে কেউই কোন সাড়া দিচ্ছিলো না। ওদিকে অবনী আমাদের সাথে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলো এবং মাইক্রোবাস ঠিক করার আশ্বাস দিলো। আমি তো খুশি হয়ে গেলাম! কিন্তু রাত ১২টার আগেই ঠিক হলো আমরা আগামীকাল সকালে না, যাবো দুপুরে। বরাবরের মতই বাসার সবাই হতাশা প্রকাশ করলো আমাদের আনপ্ল্যানড লাইফের প্রতি!

সকালে ঘুম থেকে উঠেই খবর পেলাম অবনী আমাদের সাথে যাবে না। যাই হোক আমি আর সুমাইয়া নাশ্তা করে তৈরি হতে লাগলাম। প্রায় পৌনে ১২টার দিকে আমরা উবারে গাড়ি ঠিক করে উঠে পড়লাম। গন্তব্য মহাখালী বাস টার্মিনাল। ২১শে ফেব্রুয়ারি- একদম ফাঁকা রাস্তা। ১০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম। আমি আর সুমাইয়া গিয়ে বসলাম এনার ওয়েটিং রুমে। অন্যদের খোঁজ খবর নিলাম। সারা আর তমা বের হয় নাই। তানভীর রাস্তায়। যাই হোক আমরা গল্প করতে লাগলাম। পুরো রুম ভর্তি মানুষ। সবাই ঢাকা ছেড়ে ময়মনসিংহ যাচ্ছে। প্রায় পৌনে ১টার দিকে আমি টিকেট কাটতে গেলাম। কোনদিন আমি এই রকম টিকেট কাটি নাই। তাই বেকুবের মতন বলে ফেললাম, দেড়টার বাসের টিকেট দিয়েন। কাউন্টারের লোকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। বললো আমাদের বাস তো টাইম মেনে ছাড়ে না। আমি আর কথা না বাড়িয়ে টিকেট নিয়ে চলে আসলাম। তারপর আমি আর সুমাইয়া টিকেট নিয়ে গবেষণা করতে লাগলাম যে কোন বাসে উঠবো এইটা বুঝবো কেমন করে? অনেক গবেষণা করে বের করলাম বাসের সিরিয়াল নম্বর ৫১। সুমাইয়া গিয়ে খোঁজ নিলো ৪৯ নম্বর পর্যন্ত বাস ছেড়েছে। এর পরের সিরিয়ালই ৫০ আর ৫১। সোয়া ১টার সময় আমি অন্যদের ফোন দিতে লাগলাম। তমা তখন রাস্তায় আর সারা আর তানভীর একটু পরেই এসে পৌঁছালো। দীর্ঘদিন পর ওদের সাথে দেখা, জড়িয়ে ধরলাম সারাকে। ওয়েটিং রুমে আমি ব্যাগপত্র নিয়ে বসলাম আর বাকি সবাই এদিক সেদিক ঘুরতে গেলো।

এরই মধ্যে চলে আসলো দুইটা বাস। লোকজন হুড়হুড় করে বাসে উঠতে লাগলো। ওরাও তাড়াতাড়ি ফেরত আসলো। আমরা ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ৫১ নম্বর বাসের সামনে। ওদিকে তমা আসে নাই। উঠবো কি উঠবো না- এই নিয়ে চিন্তা করছিলাম। কি ভেবে আমরা উঠেই পড়লাম। আমরা উঠে পড়ার ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে তমা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসে পৌঁছালো। একেবারে এক্সাক্ট টাইমে!

প্রায় পৌনে ২টার দিকে বাস ছেড়ে দিলো। বাসটা বেশ ভালো, সিটগুলো আরামদায়ক। আমি আর সুমাইয়া পাশাপাশি বসলাম। বকবক করে গল্প করতে লাগলাম দুইজনে। গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত বাস গেলো ঢিমে তালে। যেই না চৌরাস্তা পার হলো আর ওমনি ছুটতে লাগলো শাঁই শাঁই করে। এরই মধ্যে নাজনীন আপু ফোন দিলো, আমি রওয়ানা দিয়েছি কিনা জানতে। প্রায় রকেটের গতিতে কোন রকম ব্রেক ছাড়াই আমাদের বাস আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলো।

আমার সাথে কেক ছিলো। দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নাই। তারপরও কেন যেন কেকটার কথা মনে করতে করতে দেরি হয়ে গেলো। যখন আমরা কেকটা বের করে কামড় লাগাচ্ছিলাম, তখনই আমাদের বাস ধীরে ধীরে এসে থেমে গেলো। আমরা পৌঁছে গেছি, আর থামার সাথে সাথেই সবাই হুড়হুড় করে নেমে পড়লো। আমরা কেক চিবাতে চিবাতে সবার শেষে নামলাম। জায়গাটার নাম মাসকান্দা। আমরা একটা ইজি বাইক নিলাম। পাঁচ জনে চড়ে বসলাম তাতে। ইজিবাইকে উঠে জানতে পারলাম আমাদের সার্কিট হাউজ বুকিং বাতিল হয়ে গেছে। সারা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে পিডাব্লিউডির রেস্ট হাউসে। সেখানে আমরা থাকতে পারবো কিনা চেষ্টা করে দেখতে। আমরাও ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিলাম, আমরা যাবো আর কোন গন্ডোগোল হবেনা- এটা তো হতেই পারে না!

দীর্ঘদিন পর এরকম অনিশ্চিত একটা পরিস্থিতি আমাদের ইন্ডিয়া ট্যুরের পুরানো কথা মনে করিয়ে দেয়। কোন কারণ ছাড়াই আমরা ইজিবাইকে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকি। রেস্ট হাউসে এসে থামলে আমরা সারা আর তানভীরকে পাঠাই কথা বলতে যাওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ পর তানভীর হাসি হাসি মুখে জানালো এখানে কোন খালি জায়গা নাই। চারটা মোটে রুম, চারটাতেই লোক আছে। সারা কাকে কাকে যেন ফোন দিয়ে কপাল কুঁচকে হেঁটে হেঁটে আসতে লাগলো। ওর কথায় বুঝলাম, আমাদের এখানে থাকা হবে না। আবার আমরা চড়ে বসলাম ইজিবাইকে। বললাম কোন হোটেলে নিয়ে যেতে।

ইজিবাইকে থাকতে থাকতেই আমার মনে পড়লো স্যারের কথা। যা আছে কপালে ভেবে দিলাম স্যারকে ফোন। ফোন ধরলো নাজনীন আপু। আমি সবিস্তারে সব খুলে বললাম আর জানালাম স্যার কি আমাদের কোন জায়গায় রেফার করতে পারবেন কিনা।  আপু একটু পরে জানাবেন বললেন। ওদিকে আমরা এসে পৌঁছালাম হোটেল মুস্তাফিজে। আবার আমরা সারা আর তানভীরকে পাঠালাম খোঁজ নিতে। ওরা ঘুরে এসে বললো বেশ ভালো হোটেল, দামটাও বে-শ ভালো। প্রতি রুম ৩০০০ টাকা। আমাদের দুই রুম লাগবে। এত টাকায় থাকা সম্ভব না। আমরা ইজিবাইকওয়ালাকে বললাম আরও একটু সস্তা হোটেলে নিয়ে যেতে। আবার চলতে শুরু করলো ইজিবাইক।

কেমন যেন পাইকারি বাজার বাজার টাইপের জায়গায় এসে আমাদের ইজি বাইক থামলো ‘হোটেল নিরালা’  নামের হোটেলের সামনে। আবার সারা আর তানভীর গেলো খোঁজ নিতে। আমি তাকিয়ে দেখতে লাগলাম জায়গাটার নাম ছোট বাজার আর চক বাজার। পুরাই ঢাকার চকবাজার টাইপের এলাকা। একটু পর ওরা জানালো রুমের অবস্থা বেশ ভালো। ১৫০০ টাকায় ডবল রুম আর সিঙ্গেল রুমও আছে। সব মিলিয়ে আমাদের খরচ কম হবে। আমরা ইজি বাইক ছেড়ে দিলাম ২০০ টাকা দিয়ে। লোকটা খুশি মনে চলে গেলো। আমরা রিসেপশনে গিয়ে বসলাম। তখনই মনে পড়লো স্যারকে ফোন দিয়ে জানাই যে হোটেল পেয়ে গেছি। আমি সাথে সাথে ফোন দিলাম। এবার ফোন স্যার ধরলেন। আমি জানালাম যে থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে ‘হোটেল নিরালা’তে। স্যার জিজ্ঞেস করলেন টাকা দিয়ে ফেলেছি কিনা, আমি বললাম এখনও দেওয়া হয় নাই। স্যার বললেন পাঁচ মিনিট ওয়েট করতে। আমি সবাইকে বললাম অপেক্ষা করতে। এর মধ্যে রিন্তু ফোন দিলো। পাগলের মতন ও জানতে চাইলো আমাদের কি অবস্থা। আমি ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম। ও আমাদের কথা শুনে পুরাই অস্থির হয়ে গেলো। একে ওকে ডেকে চিৎকার করে কি কি সব জিজ্ঞেস করতে লাগলো। ঐদিকে আমার ফোন বেজে উঠলো। স্যারের ফোন।

স্যার জানতে চাইলেন আমরা কয়জন, আমি জানালাম পাঁচ জন। স্যার বললেন, ‘পাঁচটাই কি মেয়ে?’। আমি জানালাম, ‘চারটা মেয়ে একটা ছেলে’। স্যার বললেন, ‘চারটা মেয়ে তোমাদের আপুর বাসায় আর ছেলেটা আমার সাথে আমার বাসায় থাকতে পারবে।‘ স্যার আরও ঠিকানা বলে দিলেন যে এখান থেকে আপুর বাসা খুব কাছে। আমি কানে ঠিকমত শুনতে পাচ্ছিলাম না তবুও বুঝলাম আকন্দ লাল বাড়ি। আমি ফোন রেখে সবাইকে জানালাম যে স্যারের শ্বশুর বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু স্যারের বাড়িতে থাকতে হবে শুনে তানভীর বেঁকে বসলো। ও কিছুতেই স্যারের বাড়ি যাবে না। আমরা বললাম ওকে আমাদের সাথে আকন্দ বাড়ি পর্যন্ত যেতে। পরে ওর ইচ্ছা হলে ও এই নিরালা হোটেলই থাকতে পারবে। তারপর আমরা হাঁটা শুরু করলাম রাস্তা ধরে।

এতক্ষণ তানভীরের মধ্যে কোন ভাবান্তর ছিলো না। হঠাৎ করেই ও বেশ অ্যাক্টিভ হয়ে পড়লো। এদিক সেদিক সমানে ফোন দিতে শুরু করলো। আমরা রাস্তা ধরে হেঁটে শেষ মাথায় পৌঁছালাম। তারপর লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে হাঁটছিলাম। আবার স্যারের ফোন। স্যার আরও কিছু ডিরেকশন দিলেন যার বেশির ভাগই আমি কানে শুনলাম না তবে শুনলাম ‘আঠারো বাড়ি লেন’ আর ‘নদী’ কথাটা। একটু অবাক হলাম, এদিকে তো কোথাও নদী নাই! প্রায় সাথে সাথেই দেখলাম একটা লন্ড্রির দোকানের নাম ‘নদীয়া’। আমরা তার উলটো পাশের গলি দিয়ে ঢুকে পড়লাম। সেই মুহুর্তে তানভীর জানালো ডিসি আংকেল ওকে বলেছে সার্কিট হাউজে গিয়ে ওকে সামনা সামনি কথা বলতে। আমরা বললাম বাড়িটা খুঁজে বের করা পর্যন্ত আমাদের সাথে থাকতে। একটা মুদি দোকানে আকন্দ লাল বাড়ি বলার সাথে সাথে তারা বললো আকন্দ লাল বাড়ি বলে কিছু নাই তবে আকন্দ লজ হচ্ছে উলটো পাশের বাড়িটা। ইয়া আল্লাহ, আমি এতক্ষণ আকন্দ লজকে আকন্দ লাল শুনেছি!

গেটের সামনে দাঁড়ালাম। বনেদি জমিদারি বাড়ি। ইতস্তত করে গেটে ধাক্কা দিলাম। গৃহকর্মী এসে গেট খুলে দিলেন। আমি নাজনীন আপুর নাম বলাতে চিনতে পারলো না, কিন্তু ঝুমি আপু বলার সাথে সাথেই উনি মাথা নেড়ে বললেন ‘হ্যাঁ, এটা ঝুমি আপুদের বাসা’। গেট দিয়ে ঢুকে আমরা হতবাক গয়ে গেলাম। কনক্রিটের ব্লক বিছানো বড় উঠান। তাতে আবার একটা ছোট আউট হাউজ। আর সামনে বিশাল বিশাল মোটা কলামওয়ালা জমিদার বাড়ি। আমরা হেঁটে হেঁটে ঢুকলাম। তানভীর আমাদের ছেড়ে গেলো সার্কিট হাউজে খবর নিতে। আমরা গুটি গুটি পায়ে বসার ঘরে এসে বসলাম। ভিতরে হাসি হাসি মুখে সাদা শাড়ি পরা দারুণ স্মার্ট এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছেন।  আমি গিয়ে হড়বড় করে ওনার সামনে গিয়ে নিজের পরিচয় দিতে লাগলাম। উনি আমাদের সবাইকে বসতে বললেন। অল্প বিস্তর কথাবার্তা বললেন। তারপর সেই গৃহকর্মীকে দেকে বললেন আমাদের ওপরের তলার ঘর দেখিয়ে দিতে। আমি মহিলার পিছু পিছু গেলাম উপরের তলায়। যেতে যেতে আমি জানলাম  এই বাসায় শুধুই স্যারের শাশুড়ি আর খালা শাশুড়ি থাকেন।

পুরোনো দিনের সিঁড়ি পার হয়ে দোতলায় উঠেই একটা চমৎকার টেরাস দেখতে পেলাম। টেরাসের পাশেই প্রায় ইন্টার কানেক্টেড দুইটা বেড রুম।  মহিলা একটা একটা করে রুমের লাইট জ্বালাচ্ছিলেন। আর রুম দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাচ্ছিলো। ফেলুদা, কাকাবাবুরা বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গিয়ে যেসব বাড়িতে ওঠে, ঠিক সেই রকম ঘর একেকটা। ঝাঁ চকচকে রুম, নরম তুলতুলে বনেদি বিছানা- আর কি চাই! মানুষজন থাকে না, তাতেই এই রকম টিপটপ অবস্থা- লোকজন থাকলে না জানি কি হতো!

আমি আবার নিচে নেমে এসে বসার ঘরে ঢুকলাম। আমরা পড়ে গেলাম এক মহা ফ্যাসাদে। এদিকে রাজ বাড়িতে বসে আছি বাদশাহী আয়োজনে, অন্যদিকে তানভীর সার্কিট হাউজের খোঁজ নিতে গিয়ে কোন খবর দিচ্ছে না। আর রিন্তু ফোন দিচ্ছে, ওরও তো টেনশন আছে আবার হলুদের প্রোগ্রামও আছে। সেটার জন্যও আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিলাম। ঠিক করলাম তানভীর খবর পাঠানোর আগ পর্যন্ত আমরা এই বসার ঘরেই বসে থাকবো। যদি রুম পাওয়া যায় সার্কিট হাউজে তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ, আর যদি রুম পাওয়া না যায় তবে আমাদের এখানেই থাকা হবে- সেক্ষেত্রে তানভীরের জন্য কোন একটা ব্যবস্থা করতে হবে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, তানভীর ফোন দিয়ে জানালো সার্কিট হাউসে থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আমরা খবরটা শুনে খুশি হলাম।

আমি নাজনীন আপুকে ফোন দিলাম। খুলে বললাম সব কথা। আপু বললেন আমাদের ফ্রেশ হয়ে চা নাশ্তা খেয়ে ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে। এখানে থাকলেও আমাদের কোন অসুবিধা হবে না এ কথা বারবার বলে দিলেন। আমি অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বলে দিলাম যে, ব্যবস্থা যখন হয়েছে তখন কোন ঝামেলা না করে আমরা সার্কিট হাউজেই চলে যাবো। তারপর আবার বসার ঘরে এসে বসলাম। আমাদের জন্য চা, শিঙ্গাড়া আর বিস্কুট আসলো। স্যারের শাশুড়ি আর খালা শাশুড়ি আমাদের সাথে অনেক গল্প করলেন। আমরাও খোশমেজাজে ওনাদের সাথে গল্পগুজব করছিলাম। ওদিক থেকে তানভীর ফোন দিতে লাগলো, আমরা কেন আসছি না সার্কিট হাউসে। আমরা উঠে বিদায় নিতে যাবো এমন সময় নাজনীন আপু আবার ফোন দিলেন, আমরা কি সিদ্ধান্ত নিলাম সেটা জানতে। আমি আবারও ধন্যবাদ জানিয়ে জানিয়ে দিলাম যে আমরা এখনই সার্কিট হাউসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাচ্ছি।

আকন্দ লজ থেকে বের হয়েই আমরা পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলাম। একটা ইজি বাইক খুঁজতে খুঁজতে প্রায় সেই নিরালা হোটেল পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। শেষমেশ আমরা রিকশা নিলাম। আমি আর তমা উঠলাম এক রিকশায়। ভাড়া দরদাম করে ঠিক করলাম ২০টাকা। মোটর বসানো রিকশা আমাদের নিয়ে ছুটতে লাগলো রকেটের বেগে। চিপাচাপা অলিগলি পার হয়ে আমরা যেতে লাগলাম সার্কিট হাউসের পথে। কিন্তু পথ তো আর শেষ হয় না। তমা তো সন্দেহ করেই বসলো ভাড়া ২০টাকা নাকি ১২০টাকা! অনেক পথ পাড়ি দিয়ে হঠাৎ এক জায়গায় তীর চিহ্ন সহ ‘সার্কিট হাউজ’ লিখা সাইনবোর্ড দেখে আমরা বুঝতে পারলাম যে ঠিক জায়গায় এসেছি। কিন্তু আশ্চর্য, রিকশাওয়ালা আমাদের সেদিকে না নিয়ে অন্যদিকে নিয়ে গেলো। আমি আর তমা চিৎকার করে বললাম ডানদিকে যেতে কিন্তু রিকশাওয়ালা আমাদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আত্মবিশ্বাসের সাথে নিয়ে গেলো একটা পার্কের গেটে। তারপর বললো যে সার্কিট হাউজ বলে সবাই এখানেই আসে। আমার ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো। তারপর অন্যদের কাছে জিজ্ঞেস করে রিকশাওয়ালা আমাদের সার্কিট হাউজেই নামিয়ে দিলো। আমরা ২০টাকা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সার্কিট হাউসে ঢুকে পড়লাম। আমাদের দেখেই কেয়ার টেকার ছুটে আসলো। তানভীরের নাম বলতে ওনারা আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেলো ভিআইপি একটা রুমের সামনে। পাশের রুম থেকে তানভীর বের হয়ে আসলো। ওদিকে সুমাইয়া আর সারাও এসে পৌঁছে গেছে। আমরা ঢুকলাম আমাদের রুমে যার নাম পলাশ।

এও একটা মিনি বাদশাহী ব্যাপার। এলইডি টিভি, গদি আঁটা সোফা, লম্বা ড্রেসিং টেবিল, ডবল বেড, সিঙ্গেল বেড- কি নাই! দশ ফিট লম্বা বিশাল বিশাল সব জানালা ভারী ভারী পর্দা দিয়ে ঢাকা। ঝকঝকে বিশাল বাথরুম- সবকিছুর মধ্যেই অভিজাত ভাব। আমরা ব্যাগটা রেখেই শরীর এলিয়ে দিলাম বিছানায়। আমি ঘড়ি দেখলাম, সাড়ে সাতটা বাজে। কতকিছু হয়ে গেলো গত আড়াই ঘন্টায়! নিজেরাই ঠিক করলাম, যেভাবেই হোক আধা ঘন্টার মধ্যে রেডি হয়ে বের হতে হবে।

খুবই আশ্চর্যজনকভাবে আমরা আধা ঘন্টার মধ্যেই হাতমুখ ধুয়ে, ইস্ত্রি করা শাড়ি পরে (সুমাইয়ার ইস্ত্রির জন্য অনেক কৃতজ্ঞতা) পরিপাটি করে তৈরি হয়ে নিলাম। ঠিক ঠিক আটটা বাজে। আমি বের হয়ে তানভীরের দরজায় ধাক্কা দিলাম। তানভীর বের হয়ে আসলো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম ও তৈরি কিনা। আমাকে ও জানালো দুই মিনিট সময় লাগবে। আমি অবাক হয়ে গেলাম, আমরা আধা ঘন্টায় সবাই হুলুস্থুল করে রেডি হয়ে গেলাম, আর ও কি করলো এতক্ষণ ধরে?

কি আর করা, আমরা শাড়ি পরা চারজন সার্কিট হাউজের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। ভীষণ সুন্দর এই সার্কিট হাউজ। লাল রঙের কলোনিয়াল বিল্ডিং। সারি সারি সব ভিআইপি রুম। কেমন যেন একটা রাজসিক ব্যাপার স্যাপার। তানভীর পাঞ্জাবী পরে বের হয়ে এলে আমরা বের হয়ে গেলাম সার্কিট হাউস থেকে। রাতের অন্ধকারে দেখা যাচ্ছিলো না ঠিকমত তবে বুঝতে পারলাম সার্কিট হাউসের সামনে আছে বিশাল মাঠ। এলাকাটা শুনশান নিরব। কোন মানুষজন নাই। আমরা হাঁটতে লাগলাম পার্কের দিকের রাস্তা ধরে। অন্ধকার রাস্তায় পেয়ে গেলাম একটা ইজিবাইক। রওয়ানা দিলাম সানকিপাড়া, হেলথ কমপ্লেক্সের গলি। নানা অলিগলি আর রেলক্রসিং পেরিয়ে আমরা ছুটতে লাগলাম। আর ভাবতে লাগলাম, অনুষ্ঠান কি আছে নাকি শেষ!

রিন্তুর বাসায় নেমে আমরা সোজা তিনতলায় উঠে গেলাম। ড্রইং রুমে সব মুরুব্বিদের পার হয়ে ভিতরে ঢুকে দেখি একটা দুইটা না, অনেকগুলো রিন্তু! ওদের বাসার সবার চেহারা একরকম। আমরা অনেক খুঁজে বের করলাম আমাদের রিন্তুকে। ওকে চেয়ারে বসিয়ে পৃথ্বী আরও কয়েকজনকে নিয়ে ফিনিশিং মেকাপ দিচ্ছে। চোখে বিশাল বিশাল আইল্যাশ লাগিয়ে ও তখন চোখ প্রায় খুলতেই পারছে না। চোখ পিটপিট করেই আমাদের সাথে কথা বললো। আমি আর সারা ওর হলুদের গয়নার ডালা থেকে দুইটা গয়না তুলে নিলাম। আমি মাথায় পরলাম আর সারা হাতে পরলো। বাসার সবাই তাড়াহুড়া করে রিন্তুকে নিয়ে ছাদে যাওয়ার আয়োজন করতে লাগলো। সেখানেই অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে। অনুষ্ঠান শুরু করতে দেরি হচ্ছে দেখে সবাই অস্থির হয়ে উঠছে।

আমি ছাদে উঠে এলাম। একপাশে প্যান্ডেল টানিয়ে বসার আয়োজন করা হয়েছে। অন্যপাশের ছাদ খালি। আমি সেই ছাদেই চলে এলাম। আজকে বিকাল পাঁচটার পর থেকে আমাকে বাসা থেকে নানা মানুষ ফোন করেছে। প্রতিবারই হু হা করে ফোন রেখে দিয়েছি। কোনটা ধরতেও পারি নাই। এখন ঠান্ডা মাথায় আম্মুকে ফোন দিলাম। সব খুলে বলতে বলতে অনেক সময় লেগে গেলো। তারপর ফোন রেখে গেলাম হলুদের আয়োজনে। রিন্তু পরীর মতন স্টেজে বসে আছে। আর সবাই বেশ হাসিখুশি পরিবেশে ওকে হলুদ দিয়ে যাচ্ছে। আমরাও মজা করছিলাম। এরমধ্যে স্যার আমাকে আরেকবার ফোন দিলেন, আমরা ঠিকমত আছি কিনা জানতে।

আজ রিন্তুর হলুদ (কৃতজ্ঞতায়- রেশমা তালুকদার)
আজ রিন্তুর হলুদ (কৃতজ্ঞতায়- রেশমা তালুকদার)

ব্যাপক হিন্দি গান শুনে ভরপেট খাওয়া দাওয়া করে রিন্তুর সাথে ছবিটবি তুলে সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমরা বের হয়ে আসলাম রাত ১১টার দিকে। নিচে নেমে দেখি তানভীর ইতোমধ্যে ইজিবাইক ঠিক করে ফেলেছে।  আমরা হুউশ করে খালি রাস্তা দিয়ে চলে আসলাম আমাদের সার্কিট হাউজে। এবার রুমে ঢুকে আমরা ফ্ল্যাট। সারাদিনের ক্লান্তি যেন হঠাৎ করেই টের পেলাম। শাড়ি বদলে ফ্রেশ হয়ে সবাই গল্পগুজবের মুডে বসলাম। কতদিন পর এরকম একটা রাত, পূর্ণোদ্যোমে আড্ডাবাজীতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সবাই। ম্যাসেঞ্জারে নিশাত আমাদের সাথে সুদূর আমেরিকা থেকে যোগ দিলো। প্রাণ খুলে হাসলাম সবাই। রাত দুটো বাজলে আড্ডায় ছেদ পড়ে। আমরাও যার যার শোবার জায়গা গোছাতে থাকি। আমি আর সারা থাকবো সিঙ্গেল বেডে আর তমা আর সুমাইয়া থাকবে ডবল বেডে। ফ্যান চালিয়ে, লেপ নিয়ে, লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ি। কিন্তু কথা তো আর থামে না।  আমি আর সারা দুনিয়ার বিষয় নিয়ে গল্প করতে থাকি। আমি আবার চা খেয়েছিলাম, তাই ঘুমঘুমভাবটা যেন উধাও হয়ে গিয়েছিলো। কত রাত পর্যন্ত গল্প করেছি বলতে পারবো না। একসময় সারা ঘুমিয়ে পরে, আমিও বোধহয় ঘুমিয়ে পড়ি।

আমাদের ভোর সাতটায় উঠে নদীর তীরে হাঁটার কথা ছিলো। কিন্তু ঘুম ভাঙ্গলো দশটার দিকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমরা হাসতে লাগলাম। আমি বললাম, তানভীর নিশ্চয়ই ভোরে উঠে এতক্ষণে বুকডন সেরে ফেলে নদীর তীরে জগিং করতে গেছে। আমরা ঝটপট রেডি হয়ে বের হয়ে গেলাম রুম থেকে। তানভীরের দরজা নক করতে লাগলাম। কোন সাড়া শব্দ নেই। সারা দিলো ফোন। ও দরজা ফাঁক করে একটু মাথাটা বের করে বললো আমার একটু সময় লাগবে, দশ মিনিট কিংবা তারও বেশি। আমরা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। এতক্ষণে ওর ঘুম ভেঙ্গেছে শুধু!

সার্কিট হাউসের বারান্দা...............(কৃতজ্ঞতায়-রেশমা তালুকদার)
সার্কিট হাউসের বারান্দা……………(কৃতজ্ঞতায়-রেশমা তালুকদার)

কি আর করা, আমরা পুরা সার্কিট হাউজটা ঘুরে দেখতে লাগলাম। ছাদে উঠলাম। ছবি তুললাম এবং হাহা হিহি করতেই লাগলাম। ওদিকে তানভীর পাঞ্জাবী পরে রুম থেকে বের হলো। আমরা জানালাম যে, এখন পাঞ্জাবী না পরলেও হয় কারণ আমর যাচ্ছি নাশ্তা খেতে। একটু পর তানভীর রেডি হলে আমরা সবাই মিলে বের হয়ে পড়লাম। নদীর দিকে আমরা হাঁটতে লাগলাম। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে সারিন্দা নামের একটা দোকানে ঢুকলাম। কিন্তু এখানে খালি ফাস্টফুড। তারপর আমরা রিকশা নিয়ে গেলাম টাউন হল মোড়ে। সেখানে একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হোটেলে দেখলাম পরোটা ভাজা হচ্ছে। আমরা সবাই ঢুকে পড়লাম সেই হোটেলে।

অর্ডার দিলাম পরোটা, ডাল ভাজি আর ডিম ভাজা। খুব সুন্দর ছোট ছোট সাইজের ভাঁজওয়ালা পরোটা চলে আসলো। ডাল ভাজি আর ডিম ভাজা দিয়ে খেতে বেশ মজা লাগছিলো। নানা গল্পগুজব আর হাহা হিহি করতে করতে আমরা নাশ্তা পর্ব শেষ করলাম। সবশেষে ওরা সবাই চা খেলো আর সুমাইয়া আমাদের ১৯২টাকা বিল দিয়ে দিলো। আমরা বের হয়ে আসলাম। এখন আমরা রাস্তাঘাট কিছুটা ধরতে পেরেছি। হেঁটে হেঁটেই সার্কিট হাউজের দিকে যেতে লাগলাম আমরা।

রাতের বেলা যে মাঠ দেখেছিলাম দিনের বেলা দেখলাম সেটা আসলে বি-শা-ল। মাঠ পার হয়ে যেতে যেতে আমরা আইস্ক্রিম কিনে খেলাম। সার্কিট হাউজের রাস্তা ছেড়ে আমরা নদীর দিকে এগিয়ে গেলাম। নদীর পার ধরে হাঁটতে লাগলাম। ব্রহ্মপুত্র নদ যথেষ্ট সরু। তারপরও এপার ওপার পারাপারের জন্য প্রচুর নৌকা আছে। আমরা ঠিক করলাম বিকাল বেলা এসে নৌকায় চড়বো। দেখলাম নদীতীরে একটা বানিজ্য মেলাও হচ্ছে। আমাদের হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছিলো। কিন্তু তমা বারবার তাগাদা দিচ্ছিলো ফিরে যাওয়ার জন্য। গোসল করে ফ্রেশ হয়ে রেডি হতে সময় তো লাগবে। আমরা সুমাইয়া আর তমাকে পাঠিয়ে দিলাম, ওরা গোসল করতে থাকুক ততক্ষণে আমরা একটু ঘুরি।

আমি আর সারা পা ডুবিয়ে হাঁটতে লাগলাম নদীর পানিতে। ঠান্ডা পানি, প্রচুর শামুক আর ঝিনুক দেখা যাচ্ছে। অনেকদূর হেঁটে আমরা একটা নৌকায় উঠে পড়লাম। ৬০টাকায় পার হবো ঠিক হলো। মনে হলো যেন পাঁচ মিনিটও লাগলো না। ওপারে নৌকা থেকে নেমে একটা ভাঙ্গা নৌকাকে দেখলাম। তানভীর এটাকে ‘ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রতিভূ’ বলে আখ্যা দিলো। আমরা ব্যাপক হাসতে লাগলাম। নদীর এপারে আসলে কিছুই নাই। কয়েকটা ফুচকার দোকান ছাড়া বাকি পুরাটাই গ্রাম। হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা ইস্কন মন্দির পেলাম। আমরা ঘুরে ঘুরে মন্দির দেখলাম। ঘড়িতে দেখলাম প্রায় একটা বাজে বাজে অবস্থা। আমরা তাড়াতাড়ি নেমে নৌকা নিলাম। এপারে এসে পানিতে পা ভিজিয়ে নিলাম। তারপর হাঁটা শুরু করলাম সার্কিট হাউজের দিকে।

সুমাইয়া আর তমা গোসল করে ফেলেছে। এবার দুই বাথরুমে আমি আর সারা ঢুকলাম। সারা আবার কাপড় ধুয়ে ছাদে মেলে দিয়ে আসলো। গোসল শেষ করে যথারীতি শাড়ি পরে তৈরি হতে হতে দুইটা বেজে গেলো। আমরা আবার হেঁটে হেঁটে আগের রাস্তায় গেলাম। সেখানে গিয়ে রিকশা নিলাম। এবার আমি আর সারা এক রিকশায়। কোন রিকশাওয়ালাই রাস্তা চিনে না। আমরাই আশ্বাস দিলাম যে কাচারি রোডে গেলে অনুভব কমিউনিটি সেন্টার খুঁজে নিতে পারবো!

কোনরকম ঝামেলা ছাড়াই খুঁজে পেলাম জায়গাটা। ভিতরে ঢুকেই সবার আগে রিন্তুর সাথে দেখা করলাম। লাল টুকটুকে বউ সেজে বসে আছে ও। কিছুক্ষণ ছবিটবি তুলে সোজা খেতে বসে পড়লাম। মজা করে খাওয়াদাওয়া শেষ করে আয়েশ করে গল্প করছিলাম। ওদিকে অবনী ঢাকা থেকে এসে ময়মনসিংহে এসে পৌঁছেছে। তানভীর গেছে ওকে নিয়ে সার্কিট হাউস। সাড়ে তিনটার দিকে স্যার, নাজনীন আপু ওনাদের দুই মেয়েসহ এসে পৌঁছালেন। আমি গিয়ে কথা বললাম। স্যারও ওনার পরিচিত লোকজন পেয়ে গেছেন। ওদিকে বর আসার সাথে সাথে হুলুস্থুল অবস্থা হয়ে গেলো। পরে সব কিছু ঠান্ডা হলে আমরা সবাই মিলে অনেকক্ষণ গল্পগুজব করলাম। এক পর্যায়ে স্যার বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আর ওদিকে চেয়ার টেনে গাছ তলায় বসে আইস্ক্রিম খেলাম আমরা সবাই মিলে। রিন্তুর বিয়ে পড়াতে আরও দেরি আছে দেখে আমরা ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। এবার গন্তব্য পৃথ্বীর বাসা।

পৃথ্বীর বাসা খুঁজে পেতে কোন সমস্যা হলো না। ওর বাসার বসার ঘরে আমরা আয়েশ করে বসে পড়লাম। আন্টি একটু পরপর আমাদের খাবার দিতে লাগলেন। প্রথম দফায় হরেক রকমের ফল। দ্বিতীয় দফায় বিভিন্ন রকমের চকোলেট। তৃতীয় দফায় ভাজা পোড়া আইটেম আর কোক। আর সবশেষে চতুর্থ দফায় খাসীর বিরিয়ানি। ভরা পেটেই আমরা সব কপকপ করে খাচ্ছিলাম। আমাদের অনেক প্ল্যান ছিলো বিকাল সন্ধ্যায় এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করার। কিন্তু টানা জম্পেশ আড্ডা আর বিরতিহীন খাবারের সাল্পাই পেয়ে আমাদের আর কোথাও যাওয়া হলো না। সবশেষে আমরা যখন পৃথ্বীর বাসা থেকে বের হই তখন রাত সাড়ে দশটা বাজে।

সার্কিট হাউসে পৌঁছেই আগে খবর নিলাম ছাদ খোলা কিনা! কারণ সারার জামা কাপড় তো ছাদেই রয়ে গেছে। খোলা আছে শুনে আমি আর সারা টপটপ করে চলে গেলাম ছাদে। একটু ঘোরাঘুরি করে ফিরে আসলাম আমাদের রুমে। বিছানায় আআগের মত হাত পা এলিয়ে দিলাম। কোনমতে দাঁত মেজে নিয়ে কম্বলের তলায় ঢুকে পড়লাম। এবার ঐ বিছানায় শুলো তিনজন, তমা, সুমাইয়া আর অবনী। ক্লান্ত ছিলাম বলেই হয়তো গল্প খুব জমলো না। ঘুমিয়ে পড়লাম অল্প সময়েই।

ঘুম ভাংলো সোয়া আটটায়। উঠেই আমি প্রথমে সুমাইয়াকে বললাম তানভীরকে নক করতে। না হলে আজকেও দেরি হবে। আমরা ফ্রেশ হতে হতেই খবর পেলাম রুম ছেড়ে দিতে হবে। ঝটপট মালপত্র গুছিয়ে আমরা বের হয়ে পড়লাম রুম থেকে। ব্যগগুলো কর্মচারিদের হাতে জমা দিলাম। তারপর বের হয়ে পড়লাম সার্কিট হাউজ থেকে। সামনের মাঠটা ক্রস করে হাঁটতে হাঁটতে আগের ঘুটঘুটে অন্ধকার হোটেলের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। শুক্রবার ছুটির দিন বলেই হয় তো মাঠে প্রচুর ভীড়। নানা রকম প্র্যাকটিস আর ওয়ার্মিং আপ হচ্ছে সেখানে। অনেকগুলো স্পোর্টিং ক্লাব পার হয়ে আগের সেই হোটেলের সামনে এসে পড়লাম। এবার গেলাম রাস্তার উল্টাপাশের হোটেলে। এইটা আগেরটার চাইতে একটু দামী। যাই হোক সেই পরোটা, ডাল, ভাজি আর ডিম ভাজা অর্ডার করলাম। খেতে ভালোই ছিলো। মেশিন মেড চা খেয়ে বিল দিয়ে সবাই বের হয়ে পড়লাম।

যাবো শশীলজ। কিন্তু কোন রিকশাই চিনে না। তারপর আমরা হাঁটা শুরু করলাম। হেঁটেই চলে গেলাম শশী লজ। গেট দিয়ে গট গট করে ঢুকে পড়লাম ভিতরে। আমাদের সাথে একটা বিয়ের কনেও ঢুকলো। মনে হয় ফটোসেশন করতে এসেছে! আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বিরাট জমিদার বাড়ি। ভেতরে অবশ্য প্রবেশ নিষেধ, তবুও বাইরেই ঘুরে ঘুরে সবটা দেখতে আমাদের অনেকক্ষণ সময় লেগে গেলো।  শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে আমরা অনেক ছবি তুললাম। তারপর অনেকক্ষণ গল্প করে বের হয়ে পড়লাম। এবার যাবো জয়নুল গ্যালারি।

শশী লজ (কৃতজ্ঞতায় - রেশমা তালুকদার)
শশী লজ (কৃতজ্ঞতায় – রেশমা তালুকদার)

রিকশা নিলাম আমি আর সুমাইয়া। নদীর তীরে জয়নুল গ্যালারিতে পৌঁছে দেখলাম শুক্রবার গ্যালারি খুলবে তিনটার দিকে। এখন ভিতরে ঢুকার কোন উপায় নেই। কি আর করা, মনের দুঃখে আইস্ক্রিম চিবাতে চিবাতে চলে গেলাম নদীর তীরে। কিছুদূর হাঁটাহাঁটি করে নৌকা ভাড়া করলাম। নৌকা আমাদের নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ নদীতে ঘুরে বেড়ালো। পরে নৌকা থেকে নেমে আমরা হেঁটেই চলে গেলাম সার্কিট হাউস। তানভীর জুম্মার নামাজ পড়তে গেলো আর আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম।

এক পর্যায়ে আমি আর অবনী আগেভাগে বের হয়ে পড়লাম টিকেট কাটার উদ্দেশ্যে। রিকশা না পেয়ে হাঁটতে লাগলাম অনেকক্ষণ ধরে। পরে রিকশা নিয়ে ছুটতে লাগলাম মাস্কান্দার দিকে। আমরা পৌঁছানোর সাথে সাথেই দেখি অন্যরা পৌঁছে গেছে। সারা দাঁড়িয়ে পড়লো টিকেটের লাইনে। অল্প সময়ের মধ্যেই এনার টিকেট পেয়ে গেলাম। ঝটপট উঠে পড়লাম আমরা বাসে। আড়াইটা বাজতে না বাজতেই বাস ছেড়ে দিলো। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম শহরটাকে। এই রকম ঝটিকা সফরে দুই দিনের জন্য হলেও ফিরে গিয়েছিলাম আগের সেই জীবনে। কি চমৎকারই না কাটলো দুইটা দিন। মনের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো। কেন বের হলো কে জানে?

The Mighty INDIA CALLING: শুধুমাত্র নিউমার্কেটেই সারাদিন (পর্ব ৪১)

ঘুম ভাংলো সেই অন্ধকার রুমে। অন্য সবাই বের হয়ে গেলেও আমি অনেকক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে পা সোজা করে নিলাম।  এমনিতেও শান্তি নিকেতন যাওয়া হচ্ছে না। তাই আজকে সিদ্ধান্ত নিলাম দূরে কোথাও যাবো না। শুধুই আশেপাশে ঘোরাঘুরি করবো। কোন চাপ নাই। তাই ধীরেসুস্থে ঘুম থেকে উঠলাম।

এত ঢিলামি করতে করতে বেশ দেরি হয়ে গেলো। আমরা হোটেল থেকে বের হয়ে মার্কুইস স্ট্রিটের দিকে হাঁটতে লাগলাম। যখন হেঁটে হেঁটে দাওয়াত হোটেলে পৌঁছালাম তখন দুপুর হয়ে গেছে। আমি পরোটা মাংস অর্ডার দিলেও রুবাইদা ভাত অর্ডার দিলো। আমরা ধীরে সুস্থে খাওয়াদাওয়া করলাম। আজকে আমাদের কোন তাড়া নাই, তাই আমরা খুব ফুরফুরা মেজাজে ছিলাম।

দাওয়াত থেকে বের হয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম নিউমার্কেটের দিকে। পথের মধ্যে সব জায়গা আস্তে ধীরে দেখতে দেখতে গেলাম। একবার ঢুকলাম শ্রীলেদার্সে। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। চটপট পছন্দ হয়ে গেলো কয়েক জোড়া স্যান্ডেল। আমি আর রুবাইদা কিনে ফেললাম অনেকগুলো স্যান্ডেল। তারপর অনেকক্ষণ পর শ্রীলেদার্স থেকে বের হয়ে গেলাম নিউ মার্কেটের দিকে। কোলকাতার নিউ মার্কেটের একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, যানজট এড়ানোর জন্য এখানে গাড়ি চলাচলই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক দূরে গাড়ি রেখে সবাই হেঁটে হেঁটে আসে। আর রাস্তার দুইধার ধরে রাজ্যের সব পসরা নিয়ে হকাররা বসে থাকে। আমরা যখন যাই তখনও মার্কেট ঠিক জমে ওঠে নাই। আমরা তাই লিন্ডসে স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে চৌরঙ্গী রোড অর্থাৎ মেইন রোডে এসে পড়লাম। এর মধ্যেই এর ওর কাছ থেকে টুকটাক জিনিসপত্র কেনাকাটা চলতে লাগলো। তারপর আমরা হাঁটতে লাগলাম এস্প্লানেডের দিকে।

পেয়ে গেলাম একটা বিগ বাজার। দেরি না করে সোজা ঢুকে পড়লাম ভিতরে। অনেক ঘুরে ফিরে সেলসগার্লদের কবল থেকে বেঁচে টপাটপ কিনে ফেললাম আক গাদা ক্যাডবেরির বড় বার। আরও এদিক সেদিক দেখে শুনে কয়েক প্যাকেট চকোলেট নিয়ে নিলাম আমি আর রুবাইদা। তারপর যখন বিগ বাজার থেকে বের হয়ে আসলাম তখন মোটামুটি সব দোকানপাট জমে উঠেছে। আর আমাদের কেনাকাটাও পাল্লা দিয়ে চলতে লাগলো। আমরা হাঁটতেই লাগলাম আর হাঁটতেই লাগলাম। এস এন ব্যানার্জি রোড, চৌরঙ্গি রোড, চৌরঙ্গি প্লেস, হুমায়ুন প্লেস, বার্ট্মান স্ট্রিট, হগ স্ট্রিট, ইট স্ট্রিট, ম্যাজ লেন, সুদ্দার স্ট্রিট, হার্টফোর্ট লেন, কাওয়াই লেন- আরও কত বাহারি নামের রাস্তা ধরে আমরা ঘুরতেই লাগলাম। সাথে সাথে আমাদের হাতে শপিং ব্যাগের সংখ্যাও বাড়তে লাগলো।

ঘুরতে ঘুরতে বিকাল হয়ে গেলে আমরা নিউ মার্কেটের সামনেই এক দোকানে ফাস্ট ফুড খেয়ে নেই। আর সাথে নেই তাজা কমলার জুস। এইসব খেয়েদেয়ে আবার যাই নিউমার্কেটে। আমাদের যেমন মার্কেটের ভিতরটা সরগরম থাকে এই মার্কেটের ব্যাপারটা সেরকম না। দালানের ভিতরটা ফাঁকা, লোকজন নাই, হৈচৈ নাই, চুপচাপ এবং নীরব। অনেকটা আমাদের দেশে ঈদের পর মার্কেটগুলো যেমনটা থাকে ঠিক সেইরকম। আমরা একটু খোঁজাখুঁজি করে একটা চকোলেট লজেন্সের দোকানে ঢুকলাম। সেখান থেকে নানা রকম চকোলেট কিনে তারপর গেলাম এক কস্মেটিক্সের দোকানে। সেখান থেকেও কিনলাম বেশ কিছু জিনিসপাতি। তারপর ভারি ব্যাগ নিয়ে দুই জনে টানতে টানতে বের হয়ে আসলাম মার্কেট থেকে। এভাবে হেঁটে হোটেল যাওয়াটা কষ্টকর। তাই নিলাম এক টানা রিক্সা। এই টানা রিক্সাওয়ালা রাস্তাঘাট চেনে না। কয়েক কদম গিয়েই জানতে চায় আর কত দূর, আর কত দূর। আরাফাত হোটেলের সামনে গিয়ে শেষমেশ লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে আমরা হাঁটাই শুরু করলাম। দুনিয়ার শপিং ব্যাগ নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আমরা হোটেলে ঢুকলাম। রিসেপশনের লোকজন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো আমাদের শপিঙের পরিমান।

কোনমতে রুমে ঢুকে আমরা আমাদের সব মালপত্রগুলো ঢুকালাম। তারপর ঠিক করলাম বিশ্রাম নিবো। জোরে ফ্যান ছেড়ে দুইজনে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। একটু ঘুম দেওয়া দরকার।

ঘুম থেকে উঠে আবার সেই বেরিয়ে পড়া। সেই একই রাস্তা, একই শ্রীলেদার্স, একই নিউমার্কেট। সারাদিন ধরে একই জায়গায় ঘোরার ফলে সব লোকজন আমাদের চেহারা মুখস্ত করে ফেললো। এমনকি শ্রীলেদার্সের লোকজনও আমাদের চিনে ফেললো। এই শ্রীলেদার্সে কেনাকাটা করতে করতেই হঠাৎ আসাদ ভাইয়ের সাথে দেখা। আসাদ ভাই আমার দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। ভিনদেশে এসে দেশের পরিচিত মানুষ পেলে যা আনন্দ লাগে সেটা আর বলার মত না। আসাদ ভাই এসেছেন সিমলা ঘুরতে। ঘোরাফিরা শেষে এখন দেশে ফেরত যাচ্ছেন। ওনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার আমরা বের হয়ে পড়ি। রুবাইদা দুই একবার মার্কেটের ভিতর থেকে কেনাকাটা করতে চাইলো, কিন্তু সেরকম কিছুই আমরা পেলাম না। নিউমার্কেটের বড় শ্রীলেদার্সে গেলাম। সেখানেও কেনাকাটা চললো। আমাদের অনেকের সাথে সেখানে দেখাও হলো। আমরা হাসি ঠাট্টা করে একসময় বের হয়ে আসলাম সেখান থেকে।  রাতের মার্কেট পাড়া চক্কর দিতে দিতে আমরা আবার সেই বিগ বাজারের সামনে এসে থামলাম। আমি তিনটা সুন্দর পানির বোতল কিনলাম ৮০ রুপি দিয়ে।

রাত বাড়ার সাথে সাথে দোকানপাটও বন্ধ হয়ে আস্তে লাগলো। আমরাও আস্তে আস্তে ফেরার রাস্তা ধরলাম।সেই পরিচিত রাতের মার্কুইস স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমাদের হোটেলের দিকে যেতে লাগলাম। হোটেলে যখন ঢুকি, রিসেপশনে যিনি বসা ছিলেন তিনি আমাদের দিকে এক গাল হেসে বললেন, ‘আপনারা তো আমাদের জন্য কিছুই বাকি রাখছেন না, সব জিনিস তুলে নিয়ে যাচ্ছেন’। বলাই বাহুল্য, আমরা প্রত্যেকে যে হারে বড় বড় শপিং ব্যাগ নিয়ে হোটেলে ঢুকছিলাম তাতে ওনার এই মন্তব্য অত্যুক্তি হয় না।

সব মালপত্র নিয়ে রুমে ঢুকে পড়লাম আরেক বিপদে। রুমে তো জিনিসপত্রের জায়গা হচ্ছে না। আমরা শেষমেশ বিছানার উপর তুলে রাখলাম অনেক কিছু। ওদিকে মজুমদার আর মৌলির শপিংও কম নয়। সবাই রুমে আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছিলাম। সিদ্ধান্ত হলো একজন তার মালপত্র গুছাবে আর আমরা বাকিরা রুমের বাইরে বসে থাকবো। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক একজন একজন করে রুমে মালপত্র গুছাতে লাগলো আর আমরা বাকিরা রুমের বাইরে করিডরে হাঁটাহাটি করতে লাগলাম। শেষমেশ সবাই যখন গুছিয়ে শেষ করলো তখন আর রুমে পা রাখার কোন জায়গা নাই। খালি দরজাটা খোলার জন্য যতটুকু খালি জায়গা দরকার ঠিক ততটুকুই জায়গা খালি আছে। রুমে ঢুকে সেখান থেকে এক লাফে বিছানায় উঠে যেতে হয়। বিছানা থেকে সরাসরি বাথরুমে ঢুকে যেতে হয়। আবার বাথরুম থেকে বের হয়ে সরাসরি বিছানায় উঠে যেতে হয়। সেখান থেকে এক লাফে দরজার সামনে চলে আস্তে হয়। এই হলো আমাদের রুম। কোথাও আর পা ফেলার জায়গা নাই।

ওদিকে ফল পার্টির আয়োজন শুরু হচ্ছে। ব্যাগ ভর্তি কেজি কেজি ফল নিয়ে আসা হয়েছে। অন্য সব ফ্লোরের তুলনায় আমাদের ফ্লোরে আমাদের জনসংখ্যা বেশি বলে এই ফ্লোরের করিডরেই পার্টি করা হবে ঠিক হয়েছে। করিডরে একটা টেবিল আর সোফা ছিলো। সেইটা দখল করে আমরা দুনিয়ার ফল সাজিয়ে বসলাম। কলা, মাল্টা, সবুজ আঙ্গুর, কালো আঙ্গুর, আপেল, আনারস, কমলা, পেঁপে, তরমুজ কি নেই! শুভ বিশাল এক ছুরি নিয়ে মাল্টা, আনারস কাটতে বসে গেলো। আমরা হাতে হাতে ওয়ান টাইম ইউজ প্লেট নিয়ে নানা রকমের ফল নিয়ে নিয়ে খেতে লাগলাম। সাথে ছিলো কোক, ফান্টা আর সেভেন আপ। আমরা হৈচৈ করে সেগুলো খেতে লাগলাম। আমাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে ভয় পেয়েই বোধহয় আশেপাশের রুম থেকে কোন কমপ্লেন আসলো না। অনেক মজা আর গল্পগুজব করে আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হলো। আমরা সব সুন্দর করে গুছিয়ে নিলাম। সব ময়লা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে একদম পরিষ্কার ঝকঝকে তকতকে করে দিলাম। তারপর সবাই বিদায় নিয়ে যার যার রুমে ফেরত গেলাম।

আমাদের ফল পার্টি প্রায় শেষ
আমাদের ফল পার্টি প্রায় শেষ

অনেকে গেলো ছাদের মধ্যে আড্ডা দিতে। আমি আর রুবাইদা রুমে বসেই গল্প করছিলাম। আমার সেরকম রাত জাগার অভ্যাস নাই কিন্তু রুবাইদার সাথে গল্প করতে করতে কখন যে সময় চলে যেতে লাগলো টেরই পেলাম না। যখন টনক নড়লো যে অনেক রাত হয়ে গেছে তখন আমরা ঝটপট বালিশ নিয়ে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে ভাবলাম, আর মাত্র একটা দিন!

 

The Mighty INDIA CALLING: চেন্নাই টু কোলকাতা আমাদের শেষ ট্রেন জার্নি (পর্ব ৩৮)

ট্রেনে আমি যে গভীর ঘুম দিয়েছিলাম, সেকথা বোধহয় বলার আর প্রয়োজন নাই। আমার অত্যন্ত গাঢ় ঘুমটা ভাংলো রুবাইদার ডাকে। আড়মোড়া ভেঙ্গে যখন উঠলাম চোখ ডলতে ডলতে, তখন বাইরে ঝলমলে দিন। ঘড়ি দেখে চমকে উঠলাম, সর্বনাশ- এ যে দেখি সাড়ে দশটা বাজে! আমি ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম- সবাই উঠে পড়েছে। আমিও দেরি না করে উপর থেকে নেমে পড়লাম।

স্পঞ্জের স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে ছুটলাম বেসিনের দিকে। চোখে মুখে পানি দিয়ে আসলাম। ফ্রেশ হয়ে সিটে এসে বসে মনে হলো কিছু খাওয়া প্রয়োজন। ট্রেনের লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম কি নাশতা পাওয়া যাবে এখন। বুঝতে পারলাম দেরি হয়ে যাওয়ায় সব পাউরুটি অমলেট শেষ হয়ে গেছে। এখন কোন নাশতা নাই। তবে ঘন্টা খানেক পরে দুপুরের খাবার পাওয়া যাবে। কি আর করা! একেবারে দুপুরেই না হয় খেয়ে নিবো।

কিন্তু রুবাইদা থাকতে আমার চিন্তা কি? রুবাইদা চটপট ব্যাগ থেকে ওর কিনে রাখা পাউরুটির প্যাকেট বের করলো। তারপর মিনিপ্যাক জেলি মাখিয়ে দিয়ে দুইটা পাউরুটির স্যান্ডউইচ বানিয়ে আমার হাতে তুলে দিলো। আমিও মজা করে খেয়ে ফেললাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমি পা তুলে দিয়ে সিটের উপর বসলাম। জানালা দিয়ে তখন রোদ গলে আসছে। এর মধ্যে আমরা গল্প করতে শুরু করলাম। ওদিকে অন্য বগি থেকেও আমাদের লোকজন আমাদের খোপের দিকে আসতে লাগলো। আমরা সবাই গাদাগাদি করে বসলাম। কে যেন বের করলো ‘উনো’র কার্ড। ব্যাস সাথে সাথে শুরু হয়ে গেলো খেলা।

আমি আগে কখনও উনো খেলি নাই। আমাকে সবাই মিলে নিয়ম কানুন শিখিয়ে দিলো। বেশ সোজা নিয়ম, খেলা বুঝতে কোন কষ্টই হলো না। আমিও খেলতে নেমে গেলাম। দারুণ মজা হতে লাগলো। আমরা দারুণ হৈ চৈ করে খেলতে লাগলাম। আমাদের চিৎকার চেঁচামেচির কারণে সারা ট্রেনের সকল স্টাফদের মধ্যে খবর রটে গেল যে বাংলাদেশ থেকে বিশাল একদল ছেলেমেয়ে এসেছে- এবং তারা সারা ট্রেন জুড়েই অবস্থান করছে। ওদের আর কি দোষ, আমরা এতগুলো মানুষ এমনভাবে ট্রেনে আড্ডা দিচ্ছিলাম যে সত্যিই ব্যাপারটা বোঝা কষ্টকর যে কার সিট আসলে কোথায়। একটু পর পর যারা আমাদের পাস করে যাচ্ছিলো তারা অনেকেই বলতে লাগলো, ‘আপনাকে না একটু আগে ঐ পাশের বগিতে দেখেছিলাম, আপনি এখানে কেন?’

আএফ
জমজমাট খেলা চলছে আমাদের (কৃতজ্ঞতায় নিলয় নাথ)

দারুণ জমজমাট খেলা হলো আমাদের উনো। আশেপাশের বগি থেকে অনেক লোকজন মিলে বিশাল দলে আমরা উনো খেলছিলাম। অনেক হাসি, ঠাট্টা, চুরির মধ্য দিয়ে এক সময় শেষ হলো উনো খেলা। ওদিকে আমাদের দুপুরের খাবার চলে আসলো। আমি আর রুবাইদা দুজনে মিলে অর্ডার দিয়েছিলাম ১৩০ রুপির সবজি, ডিম আর ভাত। ট্রেনের খাবার কখনই মজা হয় নাই। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। মোটামুটি করে আমরা দুইজন খেয়ে নিলাম। খাওয়া দাওয়া শেষে আবার আমরা বসলাম আড্ডা দিতে। এর মধ্যে উড়ো খবর আসতে লাগলো, কমিটি থেকে আমাদের অ্যালাউয়েন্স দেওয়া হবে। আমরা জল্পনা কল্পনা করতে লাগলাম এবার ৫০০ নাকি ১০০০ রুপি আমাদের দেওয়া হবে সেইটা নিয়ে। আমাদের অবাক করে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে রিজভী আর শুভ আমাদের প্রত্যেকের হাতে ৩০০০ করে রুপি ধরিয়ে দিলো। আমরা খুশিতে হত বিহ্ববল হয়ে গেলাম। এমনিতেও শেষের দিকে এসে অনেকের টাকা পয়সার টানাটানি পড়েছে। এই অভাবের মধ্যে ৩০০০ রুপি আমাদের কাছে এক বিশাল নিয়ামত বলে মনে হলো। আমরা খুশিতে বাকবাকুম হয়ে গেলাম।

দিনটা অনেক ঝকঝকে ছিলো। তার উপর তেমন কোন গরম ছিলো না। তাই জার্নিতে আমাদের তেমন কোন কষ্ট হচ্ছিলো না। এজন্য জার্নিটা আমরা খুবই উপভোগ করছিলাম। মৌলিকে দেখলাম জানালার উপর মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে গান শুনতে। খানিক পরে ও উঠে এসে আমাকে বললো, ‘আমার এত ভালো লাগছিলো যে বলার মতন না। আমার মনে হচ্ছিলো যে সারাটা জীবন যদি এভাবেই জানালায় মাথা রেখে থাকতে পারতাম……’

আমাদের ট্রেন চলতেই লাগলো। একেকটা স্টেশনে ট্রেন থামে অনেক মানুষ উঠে আর অনেক মানুষ নেমে যায়। অনেকে স্ট্যান্ডিং টিকেট কাটে, অনেকে কোন টিকেটই কাটে না। আমাদের সিট গুলোতে ফাঁক ফোকর পেয়ে অনেকেই বসে পড়ে। আমাদের কাছে বিষয়টা বিরক্তিকর লাগে, চেনা নাই জানা নাই -হুট করে একজন মানুষ পাশে বসে পড়বে কেন? আমরা মাঝে মাঝে আমাদের সিটে ব্যাকপ্যাক গুলো রেখে দিয়ে ব্লক করে রাখার চেষ্টা করি। কোন কোন সময় তাতেও কাজ হয় না। এরকম করেই জাফরের পাশে এক সাউথ ইন্ডিয়ান দম্পতি বসে পড়লো। তাদের বয়স আমাদের চাইতে খুব একটা বেশি না। লোকটা জাফরের সাথে বেশ আগ্রহ নিয়ে কথা বলছিলো। অবশ্য আমরা একজন আরেকজনের সাথে যেভাবে ডাকাডাকি করে কথা বলছিলাম- আমাদের বিষয়ে জানতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক! কথায় কথায় যখন তারা আমাদের কাহিনী সব শুনলো, তারা আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠলো। লোকটা জাফরের সাথে অনেক্ষণ কথা বললো। জানতে চাইলো বাংলাদেশ নিয়ে। মহিলাটাও কথা বললো। এক পর্যায়ে জাফর মানিব্যাগ থেকে বাংলাদেশি টাকার নোট বের করে দেখালো। ওনারা খুব উৎসুক দৃষ্টিতে নেড়েচেড়ে নোটটা দেখলেন। তারপর ওনাদের স্টেশন এসে গেলে ওনারা জাফরকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়।

ওদিকে আমাদের পাশের খোপে উর্মির সাথে এক ভদ্রলোক বেশ গল্প জুড়ে দিলেন। উনি মনে মনে ভেবেছিলেন যে আমরা বেড়াতে যাচ্ছি আর রুবাইদা হচ্ছে আমাদের লিডার। উর্মির মুখে এই কথা শুনে রুবাইদাসহ আমরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলাম।  ইতোমধ্যে আমাদের এখানে খেলতে আসা শুভকে রুবাইদা একবার পাউরুটি জেলি আরেকবার পানির বোতল দিয়ে সাহায্য করায় শুভ রুবাইদাকে উপাধি দেয়, ‘অ্যাঞ্জেল ফ্রম হেভেন’। কোন কাজ নাই দেখে আবার শুরু হয় উনো খেলা। তাসের চাইতে উনো খেলা বেশ জমে ওঠে। আমরাও খুব মজা নিয়ে খেলতে থাকি।

আস্তে আস্তে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে থাকে। একসময় সূর্যটা ডুবে যায়। ট্রেনের বাতি জ্বলে ওঠে। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আমাদের ট্রেন চলতে থাকে। আমরা অলস গল্পগুজব করতে থাকি একজন আরেকজনের সাথে। ওদিকে পাশের খোপে উর্মি আর সৌরভের সাথে আরেক ভদ্রলোকের বেশ খাতির হয়ে গেলো। ইনি বিএসেফের সদস্য। বাংলাদেশকে খুব ভালোই চেনেন! আমাদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত শুনে বেশ খুশি হলেন। এক পর্যায়ে উনি ব্যাগ থেকে একটা বড়সড়  চায়ের প্যাকেট আর মাথা ব্যাথার বাম বের করে আমাদের জন্য উপহার হিসেবে উর্মির হাতে তুলে দিলেন। ওদিকে অদিতি আর উর্মিও বুদ্ধি করে চাবির রিং বের করে ওনাকে উপহার দিয়ে দিলো।

প্রতি ট্রেন জার্নির মত এবারও আমি বোতল কেটে বদনা বানিয়েছিলাম। সেগুলো ভালোই কাজ দিচ্ছিলো। আমরা সেগুলো আমাদের সিটের নিচে রাখতাম। এর মধ্যে এক ঝাড়ুদার স্টাফ এসে আমার সব বোতল জানালা দিয়ে ফেলে দিলো। আমি চিৎকার করে বোঝাতে চাইলাম যে, প্লিজ ফেলবেন না। কিন্তু আধা কাটা বোতল না ফেলার জন্য আমি কেন চিৎকার করছি তা উনি কিছুতেই বুঝলেন না। আমাকে আবার আরেকটা বোতল জোগাড় করতে হবে ভাবতেই বিরক্ত লাগলো। পরে খালি বোতল জোগাড় হলে যখন আমি কাটতে উদ্যত হলাম, তখন জুবায়ের বোতলে ছিদ্র করে আরও একধাপ উন্নত বোতল বদনা তৈরি করে দিলো।

ওদিকে হঠাৎ দেখলাম আমাদের বগির বাথরুমের সামনে কয়েকজন ভারতীয়র সাথে সাদা চামড়ার দুজন ছেলেমেয়ে বিশাল বিশাল দুইটা হ্যাভারস্যাক নিয়ে পাংশু মুখে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। আশেপাশের লোকজন ড্যাব ড্যাব করে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে দুর্গন্ধযুক্ত জায়গায় চুপ চাপ বসে আছে। আমার খারাপই লাগলো তাদের জন্য। আহারে, কোন বিপদে পড়ে না জানি এরকম কষ্ট করতে হচ্ছে তাদের।

ইশতিয়াকের সাথে আমার অনেক লম্বা সময় জুড়ে গল্প হলো। ওদিকে রাতের খাবারও চলে আসতে থাকে। আমি আর রুবাইদা নেই ভেজ মিল। তাতে ছিলো ভাত, রুটি, সবজি আর ডাল। রাতের খাবার খেয়ে দেয়ে সবার মধ্যে কেমন যেন একটা খালি খালি ভাব চলে আসলো। এটাই আমাদের শেষ ট্রেন জার্নি। এই রাতই আমাদের ট্রেনে শেষ রাত। আমরা স্বপ্নময়ী একটা ট্যুরের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি। এই যে এত হাসি, আড্ডা, মজা- এগুলো আর কখনও একসাথে হবে কিনা জানি না। ট্যুরের একটা একটা করে পর্ব শেষ হয়ে গিয়েছে। আগামীকাল ইনশাল্লাহ কোলকাতা পৌঁছালে শুধু দেশে ফেরার পর্বটাই বাকি থাকবে। আমরা ঘুমানোর আগে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। এই বিদায় নিতে নিতেই অনেক রাত হয়ে গেলো। তারপর আমরা শুয়ে পড়লাম একে একে।

একসময় ট্রেনের বাতি নিভে গেলো। আমাদের দুই চোখ বেয়ে ঘুম নামলো। ইন্ডিয়া ট্যুরের শেষ ট্রেন জার্নিতে শেষ ঘুম।

 

The Mighty INDIA CALLING: একদিনেরও কম সময় চেন্নাইয়ে (পর্ব ৩৭)

আমাদের অ্যালার্মগুলা পর পর বাজার পরও আমরা উঠতে পারলাম না। হঠাৎ দরজায় দুমদুম কিল পড়লো। আমরা লাফিয়ে উঠে গেলাম। জুবায়ের আমাদের নাম ধরে ধরে ডাকতে লাগলো। মজুমদার চিৎকার করে জানালো যে আমরা সবাই উঠে গেছি। হঠাৎ করে গভীর ঘুম থেকে উঠে পড়ায় আমার হার্টবিট বেড়ে চৌদ্দগুন হয়ে গেলো। বিছানায় উঠে বসে ঘড়িতে সময় দেখলাম। বাজে ৪টা ২০। সর্বোনাশ! আমাদের যে উঠতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে! আমরা দুদ্দাড় করে বিছানা থেকে নেমে পড়লাম। ঝটপট রেডি হয়েই একজন একজন করে মালপত্র নিয়ে বের হয়ে গেলাম।

সমস্ত লাগেজ টেনে টেনে নিয়ে সিঁড়ির সামনে এসে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। আবার তিন তলা থেকে এইসব জিনিস নামাতে হবে, কি প্যাথেটিক! কিন্তু কিছু করার নাই। পিঠে ব্যাকপ্যাক, কাঁধে সাইড ব্যাগ ঝুলিয়ে বড় লাগেজটা অল্প অল্প করে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামাতে লাগলাম। অনেক পরিশ্রমের পর এক সময় তিন তলা থেকে লাগেজ সমেত আমি নিচ তলায় নেমে আসলাম। নিচে অনেকে লাগেজ নিয়ে সোফায় বসে আছে। আমাদের বাস নাকি এখনও এসে উপস্থিত হয় নাই। আস্তে আস্তে সবাই মোটামুটি নামতে থাকলে নিচ তলাটা পুরো ভরে যায়। দাঁড়ানোর কোন জায়গা আর বাকি থাকে না। তখন যে সিঁড়িতে যতটুকু নামতে পেরেছিলো ততটুকু নেমেই লাগেজ সমেত দাঁড়িয়ে থাকে। যাইহোক, খুব বেশি সমস্যা হওয়ার আগেই ৬টা বাজতে বাজতেই কমিটির লোকজন ঘোষনা দেয় যে বাস চলে এসেছে। আমরাও সময় নষ্ট না করে লগেজ নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ি।

এই বাসটা আগের তুলনায় অনেক ছোট। সাধারণ লোকাল বাসের মত রংচঙ্গে। বাসের সাথে দুইজন লোক ছিলো। আমাদের একেকজনের লাগেজ দেখে উনাদের মাথায় বাজ পড়ে। বাসে তো এত লাগেজ রাখার জায়গা নাই! একজনকে দেখলাম বাসের ছাদে উঠে দড়ি দিয়ে কপিকলের মত বানিয়ে নিচে নামিয়ে দিতে। অন্যজন নিচে থেকে আমাদের লাগেজগুলো দড়িতে বেঁধে দিতেই উপরেরজন টেনে টেনে সেগুলোকে ছাদে তুলে নিচ্ছিলো। কাজ হচ্ছিলো অত্যন্ত ধীর গতিতে। পুরো ব্যাপারটা ছিলো অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ। আমরা এত স্লো লাগেজ ওঠানো দেখে মজা পাচ্ছিলাম। আমাদের কমিটির লোকজন এর চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে মালামাল ‘লোড’ করে ফেলতে অভ্যস্ত! একসময় ছাদ পুরো ভরে গেলো। তখন আমাদের বাকি মালপত্রগুলোকে তোলা হলো বাসের সবচেয়ে পিছন দিকে। দেখতে দেখতে পিছনের তিন সারি সিট সব ভরে গেলো আমাদের লাগেজ আর ব্যাকপ্যাকে। তারপর আমরা সবাই চড়ে বসলাম বাসের ভিতর। সবাই বসার সিট পেলো না, কিন্তু তাতে কারও কোন সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হলো না। অনেকেই দুই জনের সিটে তিনজন করে বসে পড়লো। তারপর সবাই সব ঠিকঠাক আছে কিনা চেক করতেই আবিষ্কার হলো রিন্তু আর পৃথ্বী মিসিং। সাথে সাথে ওদের ফোন দেওয়া হলো। ওরা সূর্যোদয় দেখতে বিচে গেছে। কি আর করা, সবাই মিলে বাসের ভিতর বসে ওদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। এক সময় ওদের দুইজনকে দেখলাম দৌড়াতে দৌড়াতে আসতে। ওরা আসতেই আমাদের বাস ছেড়ে দিলো। মোটামুটি সাড়ে সাতটার সময় আমরা রওয়ানা দিলাম।

আ
আমাদের রংচঙ্গে বাস (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

আমি আর রুবাইদা বসে ছিলাম একদম শেষের দিকের সিটে। আমাদের পরেই লাগেজের স্তুপ। আমাদের সামনে ছিলো জুবায়ের। জুবায়ের লাগেজ গুলোর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, ‘ভয় হচ্ছে, লাগেজের ভারে বাস না আবার খাড়া হয়ে যায়’ । ভোর বেলায় ঊঠার কারণে সবারই চোখে ঘুম ঘুম ভাব ছিলো। বাসে সবাই মোটামুটি হাল্কা পাতলা ঘুম দিতে লাগলো। আমিও চোখ বন্ধ করে ছোট্ট একটা ঘুম দিয়ে নিলাম। পুরো ট্যুরে আমার এই উপকার হয়েছে, আমি এখন বাসে আর ট্রেনে দিব্যি ঘুমাতে শিখে গেছি। ১১টা বাজার আগেই আমরা চেন্নাই এসে পৌঁছে গেলাম। আমাদের বাস এসে থামল হোটেল হরাইজনের সামনে। চেন্নাইতে প্রথমে আমাদের কোন হোটেল নেওয়ার কথা ছিলো না। কারণ আজকে রাতেই আমরা কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো। ঘোরাঘুরি করতে করতেই সারাদিন কেটে যাবে।  কিন্তু পরে প্ল্যানে চেঞ্জ আসে। এত মালপত্র রাখার জন্য আর একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আমাদের একটা হোটেল রুম নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। চেন্নাইতে সুমাইয়ার আব্বুর একজন শিল্পপতি বন্ধু রয়েছেন। তিনি লোক পাঠিয়ে এই একটা হোটেল আমাদের জন্য ঠিক করে দিয়েছেন।

বাস থেকে নেমে আমরা লাগেজের জন্য দাঁড়ালাম। বাসের ছাদ থেকে দড়ি দিয়ে একটা একটা করে লাগেজ নামানো হচ্ছিলো ধীর গতিতে। তাতে আমাদের ধৈর্যে বাঁধ ভাংলে দড়ি ছাড়াই এমনি এমনি লাগেজ নামানো শুরু হয়ে গেলো। এতে দুইটা দুর্ঘটনা ঘটলো। একটা লাগেজ ধরতে গিয়ে আনিসের মুখে লাগেজের চাকার বাড়ি লেগে দাঁতের কোনা ভেঙ্গে গেলো। আর কোন কারণ ছাড়াই রাত্রির লাগেজটা বাসের ছাদের থেকে পড়ে গেলো এবং সেটার চাকা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। যাই হোক আমরা বাকি মানুষজন আমাদের মালপত্র নিয়ে হোটেলে ঢুকলাম। নিচ তলায় একটা রুম নেওয়া হয়েছে, সেটা শুধুই লাগেজ রাখার জন্য। আমরা আমাদের সবার বড় লাগেজ খুব মাপজোক করে একটার উপর আরেকটা রেখে কেমন করে যেন ছেচল্লিশটা লাগেজ একটা ছোট্ট ডোবল রুমে আঁটিয়ে ফেললাম। তারপর বাকি ব্যাগ গুলো নিয়ে উপরে চারতলায় উঠে আসলাম। এখানে আমাদের জন্য তিনটা রুম নেওয়া হয়েছে। একটা ছেলেদের জন্য আর দুইটা মেয়েদের জন্য। আমি একটা রুমে ঢুকে বসলাম। জোরে ফ্যান ছেড়ে যতজন পারলাম একটা ডবল বেডে কোনমতে বসলাম।

একটু ধাতস্থ হতেই একজন একজন করে সবাই বাইরে ঘুরতে যেতে লাগলো। সীমান্ত আর রিন্তু গেলো চোখের ডাক্তার দেখাতে ‘শংকর নেত্রালয়’ হাসপাতালে। সবার শেষে রুমের চাবি নিয়ে আমি বের হয়ে পড়লাম। হোটেলের রিসেপশনের লোকটার সাথে কথা বলে আমি, নিশাত, পৃথ্বী, রুবাইদা, অন্তরা আর মিম ১৫০ রুপি দিয়ে অটো ভাড়া করে রওয়ানা দিলাম টি নগরে। টি নগর বেশ ব্যাস্ত কমার্শিয়াল এলাকা। ফুটপাথ ভর্তি মানুষজন হাঁটা চলা করছে। চওড়া রাস্তার দুই পাশে বড় বড় বিল্ডিং, অনেক দোকানপাট। আমরা একটা জায়গায় নেমেই প্রথমে খাওয়ার দোকান খুঁজলাম। মোটামুটি একটা দোকানে ঢুকে আমি আর রুবাইদা অর্ডার দিলাম ১০০ রুপির ভেজ বিরিয়ানি। বিরিয়ানিটা খেতে মোটেও মজা না। কিন্তু খাওয়া চলে। সকালে এমনিতেও কিছু খাওয়া হয় নাই। তাই আমরা চুপচাপ ভেজ বিরিয়ানি খেয়ে নিলাম।

খাওয়া দাওয়া করে আমরা ঘুরতে বের হলাম। একটু পরেই চোখে পড়লো বিশাল দোকান ‘চেন্নাই সিল্ক’। আমরা ঢুকে পড়লাম সেটাতে। পোথির মতই বড় শাড়ির দোকান, কিন্তু ‘পোথি’র মত নয়! আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। তারপর বের হয়েই পাশেই আরেকটা বড় শাড়ির দোকান পেলাম ‘এস কুমার’স’ । এই দোকান দেখতে দেখতে হঠাৎ আমাদের মনে হলো এই জায়গা তো আগেও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে- এমন তো হবার কথা না! হঠাৎ টের পেলাম আমরা আসলে চেন্নাই সিল্কে চলে এসেছি। এই দুইটা দোকানের ভিতর দিয়ে কানেকশন আছে। দুইটা বোধহয় একই মালিকের দোকান। তারপর এখান থেকে বের হয়ে কয়েক কদম হাঁটতেই চোখে পড়লো ‘পোথি’। আবার সেই ‘পোথি’! মহা উৎসাহে আমরা ঢুকে পড়লাম পোথিতে। আগের মতনই ঘটনা। অন্য দোকানগুলোর থেকে পোথিতে ভিড় সবচেয়ে বেশি। তবে বেশি ভিড় হলে যা হয় আর কি, খুব ভালো করে কোনকিছু দেখা হলো না। তবে কেন যেন মনে হলো ত্রিভান্দাম বা পন্ডিচেরির কালেকশন বেশি ভালো ছিলো। মোটামুটি ভিড় ঠেলে ঠেলে আমরা সব কিছু দেখছিলাম। এক জায়গায় হঠাৎ করে ‘ঢাকাই শাড়ি’ একটা সেকশন দেখে সেখানে কি আছে আগ্রহী হয়ে দেখতে যাই। কয়েকটা তাঁতের শাড়ি আর জামদানি শাড়ি দিয়ে ভরে রাখা তাক। দেখে ভালোই লাগলো, যাক আমার দেশের শাড়িও তাহলে এখানে আছে!

পোথি থেকে বের হয়ে আমরা ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকি। হঠাৎ একটা দোকানের সামনে আমাদের বেশ কয়েকজনকে পেয়ে যাই। জানতে পারি এই দোকানে নাকি সব পানির দরে জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দোকানটার নাম দেখে নেই ‘সারাভানা’। আমরা ঢুকে পড়ি সারভানাতে। এ এক বিশাল দোকান। এর কোন শেষ নেই। মনে হয় যেন বিশাল কোন গুদাম ঘরে ঢুকে পড়েছি। তাক কে তাক ভর্তি জর্জেটের শাড়ি আর শাড়ি। নানা রকম দামের শাড়ি, কমতে কমতে ২২০ রুপিতে গিয়ে ঠেকলো। তখন রুবাইদা বললো, ‘চল, আরেকটু খুঁজি। সামনে মনে হয় ১০০ রুপিতেও শাড়ি পাওয়া যাবে’। এত শাড়ি দেখে যখন মাথা বন বন করছিলো তখন শুরু হলো জর্জেটের ওড়না। নানা রঙের শত শত ওড়না। ওড়নার দামও কমতে কমতে ৬০ রুপিতে গিয়ে ঠেকলো। এত কিছু দেখার পরও অন্তরা বিছানার চাদর দেখতে চাইলো। সেলসম্যানরা আমাদের লিফটে তুলে উপরে পাঠিয়ে দিলো। উপরে উঠে আমরা পেলাম রেডিমেড জামাকাপড়। মেয়েদের প্যান্ট, স্কার্ট, টপস- এইসব জিনিস। বিশাল ফ্লোর জুড়ে এই সব জামাকাপড় দেখতে দেখতে আমার সত্যিই কেমন যেন অসুস্থ লাগছিলো। এর মধ্যে আমরা সবাই কম বেশি হারিয়ে গিয়েছিলাম। পরে একজন আরেকজনকে ফোন করে খুঁজে বের করে নিয়েছি। অনেক্ষণ পর আমরা এই জায়গা থেকে নেমে আসলাম। নিচ তলায় আসতে আসতেই মিম আর অন্তরার লিপস্টিক কেনার শখ হলো। আমি আর রুবাইদা ওদের রেখে বের হয়ে গেলাম এই দোকান থেকে। বসে পড়লাম দোকানের সামনের সিঁড়িতে। সেখানে আমাদের মতই আরও অনেক মানুষ বসে আছে। সবার হাতেই অনেক অনেক শপিং। আর এদিকে শুধু রুবাইদা কয়েকটা ওড়না কিনেছে বলে আমাদের হাতে একটা ছোট্ট প্যাকেট। আমি আর রুবাইদা বসে বসে গল্প করতে লাগলাম। এই দোকানে ঢোকার পর কখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেছে টেরই পাই নাই।

মিম আর অন্তরা বের হয়ে আসলে আমরা কয়েক কদম হেঁটে একটা জুসের দোকানে ঢুকি। দোকানে আমরা ছাড়া আর কোন কাস্টোমার নাই। একটা কমবয়সী ছেলে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে আমাদের কাছে আসলো অর্ডার নিতে। আমরা যেইটা নিতে চাই, সে বিরক্ত হয়ে জানায় যে দেওয়া যাবে না। সব শেষে আমি নেই মিল্কশেক। ছেলেটা চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি ফুটিয়ে জুস বানাতে চলে যায়। আমি একটু লক্ষ করতেই দেখলাম। সবুজ একটা কলা ছিলে সে ব্লেন্ডারে দিয়ে দিলো। হায় হায় কাঁচা কলার শেক খেতে হবে দেখছি! আমাদের জুস বানাতে খুব বেশিক্ষন লাগলো না, তবে আমরা খেলাম বেশ সময় নিয়ে। আমার কাঁচা কলার শেকটা খারাপ ছিলো না। অবশ্য কলাটা একেবারে কাঁচা না, একটু পাকাও ছিলো! আমাদের এক সমস্যা হলো আমরা চুপচাপ থাকতে পারি না। গল্পগুজব একবার শুরু হলে আমরা উচ্চস্বরে হাহা হিহি করতে থাকি। জুসের দোকানেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। তবে আমাদের হৈচৈ দেখে দোকানের ছেলেটা বারবার অগ্নি দৃষ্টি দিতে লাগলো।

জুসের দোকান থেকে বের হয়ে আমরা অলসভাবে খানিক্ষণ হাঁটাহাঁটি করছিলাম। রাস্তার পাশেই দেখলাম সিনেমার ডিভিডির বড় বড় দোকান। সেই সব দোকানে রজনীকান্তের নতুন সিনেমা ‘লিঙ্গা’র বড় বড় পোস্টার টানানো। সত্যিই, সাউথের ভাবসাবই আলাদা! আমরা সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার আগেই একটা অটো ঠিক করে ফেললাম। সেই অটোতে করে রওয়ানা দিলাম আমাদের হোটেলের উদ্দেশ্যে। আমাদের হোটেলের কাছাকাছি পৌঁছাতেই শুনতে পেলাম মাগরিবের আযান। হোটেলের ঠিক পাশের গলিতেই একটা বড় মসজিদ আছে আমি খেয়ালই করি নাই। অনেকদিন পর কানে আযানের ধ্বনি যেতেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। হোটেলে ঢুকেই আমরা প্রথমে রুমে গেলাম। একটু হাতমুখ ধুয়ে বিশ্রাম নিয়েই বের হয়ে পড়লাম আবার।

হোটেল থেকে বের হয়ে আমরা পাশের গলির দিকে হাঁটতে লাগলাম। ততক্ষনে মাগরিবের জামাত শেষ হয়েছে। রাস্তায় মুসল্লিদের ঢল নেমেছে। আমরা প্রথমে বড় একটা দোকানে ঢুকলাম। রাতে ট্রেন জার্নি আছে। সেজন্য খাবার দাবার কিনে নিতে হবে। আমরা দোকান ঘুরে ঘুরে নিজেদের পছন্দমত কেক, বিস্কুট, বাদাম এসব কিনে নিলাম। ক্যাশ কাউন্টারে বিল দিতে গিয়ে দেখি সেখানে একজন বড় দাড়িওয়ালা মুসলমান বসে আছেন। আমাদের দেশের তাবলীগের অনুসারীরা দেখতে যেমন হয়ে, ওনাকেও দেখতে সেরকমই লাগলো। আমি বিল মিটিয়ে দেওয়ার সময় লোকটা গম্ভীর হয়ে মিমের দিকে ইঙ্গিত করে আমাকে বললো, ‘ইনি কি আপনার সাথেই এসেছেন?’ আমি হ্যাঁ জবাব দিতেই আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইনি কি মুসলমান?’ আবারও আমি হ্যাঁসূচক জবাব দিলাম। তখন লোকটা আরও গম্ভীর মুখে বললেন, ‘ওনাকে বলবেন চুল বেঁধে চলাফেরা করতে। এত বড় চুল খুলে রেখে চলা ঠিক না’। আমি একটু হাসি দিয়ে বললাম, ‘জ্বি আচ্ছা, বলবো’। ওদিকে মিমও টের পেয়েছে ওকে উদ্দেশ্য করে আমরা কথা বলছি। আমি কাছে আসতেই ও জানতে চাইলো কি ব্যাপার। আমি ওকে সব খুলে বলতেই ও একটা হাল্কা হাসি দিলো।

কেনাকাটা শেষ করে আমরা এবার খাওয়া দাওয়া করার জন্য জায়গা খুঁজছিলাম। রাস্তার পাশেই বেশ বড়বড় হোটেল। আমরা সেখান থেকে বেছে বেছে একটা হোটেলে ঢুকলাম। ভিতরে ঢুকে আমরা দোতলায় গিয়ে বসলাম। হালাল মাংস পাওয়া যায় শুনে অর্ডার দিলাম তন্দুরি চিকেন আর পরোটা। অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করতে করতেই শুভ, রিজভীসহ আরও কয়েকজন এসে ঢুকলো ভিতরে। ওরা আমাদের পিছনে একটা টেবিল জুড়ে বসে পড়লো। কিছুক্ষনের মধ্যেই খাবার আসলো। খেতে ভালোই ছিল মুরগিটা। আমরা মজা করে খেলাম। আর পিছনের টেবিল থেকে ওরা জানতে চাইলো যে, টেস্ট কেমন খাবারের।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা আবার হোটেলে ফিরে আসলাম। আমাদের নিচতলার সেই লাগেজ রুম খুলে দেওয়া হয়েছে। আমরা আমাদের মালপত্র বের করে যার যার জিনিসপত্র গুছিয়ে রিসেপশনের সামনে বসে রইলাম। রেল স্টেশন আমাদের হোটেল থেকে কাছেই। হেঁটে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু এত মালপত্র নিয়ে কেমন করে যাওয়া হবে সেটা নিয়ে বেশ আলাপ আলোচনা হচ্ছিলো। তখন হঠাৎ খবর আসলো, সুমাইয়ার পরিচিত সেই শিল্পপতি আংকেল আমাদের জন্য গাড়ির ব্যাবস্থা করে দিচ্ছেন আর সবার জন্য রাতের খাবার পাঠাচ্ছেন। শুনে আমরা খুশিতে গদ্গদ হয়ে গেলাম। সুমাইয়াকে দেখলাম, হ্যাভার স্যাকের ভারে কুঁজো হয়ে হেঁটে যেতে। পন্ডিচেরিতে একটা ছোটখাটো দুর্ঘটনায় আফরা পায়ে ব্যাথা পেয়েছিলো। ওকে দেখলাম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে। কিছুক্ষনের মধ্যেই গাড়ি চলে আসলো। আসলে ঠিক গাড়ি নয়, আসলো একটা বড়সড় পিকাপ আর আরেকটা গাড়ি। ডিসিশন হলো যে, পিকাপ আর গাড়িতে আমাদের সব মালপত্র উঠিয়ে দিয়ে আমরা হেঁটেই স্টেশন চলে যাবো। আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করলাম। বড় লাগেজগুলো পিকাপের পিছনে রেখে দিলাম আর দুজন লোক হাসিমুখে আমাদের মালপত্রগুলো পিকাপে তুলে দিতে লাগলো।

বড় লাগেজটা রেখে দিয়েই আমরা ব্যাকপ্যাক, সাইডব্যাগ এগুলো নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। সবার মাল না উঠানো হলে গাড়িগুলো ছাড়বে না। তাই ততক্ষন অপেক্ষা করার কোন মানে হয় না। রাস্তা পার হয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম। রাত খুব বেশি না হলেও রাস্তাঘাট শুনশান নিরব। তার উপর রাস্তাঘাটও ঠিকমত চিনি না। ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি কিনা বলতে পারলাম না। তবে বুঝলাম আমরা আসল এন্ট্রি দিয়ে না ঢুকে একটা চিপা ইনফর্মাল এন্ট্রি দিয়ে ঢুকার চেষ্টা করছি কারণ এটাই আমাদের হোটেলের থেকে সবচেয়ে কাছে। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে একসময় মনে হলো আমরা কাছাকাছি চলে এসেছি। তারপর খুঁজে খুঁজে যে জায়গায় আমাদের পিকাপের আসার কথা সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। স্টেশনের ভিতরে না ঢুকে আমরা বাইরের দিকে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর ফোনে খবর পেলাম, পিকাপ চলে এসেছে। রুবাইদা আমাকে দাড়করিয়ে রেখে নিয়ে গেলো আমাদের দুইজনের মালপত্র নিয়ে আসতে। আর আমি দাঁড়িয়ে রইলাম আমাদের ব্যাকপ্যাক, হ্যাভারস্যাক আর অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে। আমাদের অনেককেই দেখলাম জোরে জোরে হাঁপাতে হাঁপাতে লাগেজ টেনে টেনে আনতে। আমার তখন মনে হলো, দুইটা ভারি ভারি লাগেজ টেনে আনতে নিশ্চয়ই রুবাইদার অনেক কষ্টই হবে। আমার এরকম  থেকে যাওয়াটা বোধহয় উচিৎ হয় নাই। আমি চিন্তিত মুখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। আমার সকল দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে রুবাইদা হাসি মুখে ভারি ভারি দুইটা লাগেজ টানতে টানতে আসতে লাগলো। রুবাইদা চলে এলে আমরা যে যার মাল বুঝে নিয়ে নিজে নিজে টানতে লাগলাম। অন্তরাকে দেখলাম কোনটা ফেলে কোনটা টানবে বুঝতে পারছে না। ব্যাপক মালপত্র সবার কাছেই, তাই কেউ যে কাউকে সাহায্য করবে- সেটা সম্ভব হচ্ছে না।

আমরা যথাসম্ভব তাড়তাহুড়া করে আমাদের প্ল্যাটফর্মে এসে হাজির হলাম। এই প্রথমবার আমরা দেখলাম প্ল্যাট ফর্মে আমাদের ট্রেন এসে বসে আছে। এবং ভেতরের সব লাইট বন্ধ। ট্রেন খালি, অর্থাৎ এখনও যাত্রী ওঠা শুরু হয় নাই। এই প্রথমবার আমাদের দৌড় ঝাপ করে ট্রেনে উঠতে হচ্ছে না- ব্যাপারটা আমাদের নিজেদের কাছেই কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগলো! আমরা আগের মত আমাদের মালপত্র সব স্তুপ করে রেখে তার চারপাশে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি আশেপাশে  তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। প্ল্যাটফর্মে অনেক মানুষ দিব্যি মশারি টানিয়ে শুয়ে পড়েছে। তারা কোন অসহায় গরীব মানুষ না, তারা ট্রেনেরই যাত্রী। মনে হয় ট্রেন লেট করেছে তাই সময় নষ্ট না প্ল্যাটফর্মের কলাম আর ওয়েটিং চেয়ারের সাথে সবাই মশারি টানিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। প্ল্যাটফর্মে সারি সারি রংচঙ্গে মশারি দেখে আমার বেশ মজা লাগলো। অদ্ভূত, এরা বেড়ানোর সময় সাথে করে মশারিও নিয়ে আসে!

ট্রেনে ওঠার আগে স্টেশনে মালপত্র নিয়ে আমরা
ট্রেনে ওঠার আগে স্টেশনে মালপত্র নিয়ে আমরা

ট্রেনের জেনারেটর অন হতেই ভিতরে লাইট জ্বলে উঠলো। আমরাও টপাটপ ভিতরে ঢুকে পড়লাম। আমাদের খোপে আমরা জিনিসপত্র নিয়ে উঠে পড়লাম। আমি আর রুবাইদা এবার সিট পেলাম করিডরের পাশে। আমি উপরে আর রুবাইদা নিচে। আমাদের খোপে সাতটাই আমাদের লোকজন। পাশের খোপে কৌশিক একমাত্র এসেছে। ও তাড়াতাড়ি আমাদের খোপের আট নম্বর লোকের সাথে সিট বদলে নিলো। তারপর টের পেলাম পাশের খোপে নিশাত, রিন্তু পৃথ্বী আর তানভীরের সিট। কৌশিক আমাদের খোপে চলে না আসলেও পারতো!

আমাদের লাগেজগুলো ততদিনে ফুলে ফেঁপে বিশাল আকার ধারন করেছে। সবগুলো খোপেই আমাদের মানুষ থাকার কারণে অনেকগুলো লাগেজ আমাদের কায়দা করে রাখতে হলো। সব লাগেজ রাখার পর মাটিতে পা ফেলার আর কোন জায়গাই রইলো না। কি আর করা, সবাই তাই পা তুলেই সিটে বসে রইলো। ওদিকে নিশাতরাও অনেক কষ্টে লাগেজ গুছিয়ে রাখলো। সবশেষে নিশাত ওর ম্যাজেন্টা কালারের ফুলেল কম্বলটা দিয়ে লাগেজের বিশাল স্তুপটাকে ঢেকে দিলো। তখন পুরা জিনিসটাকে দেখতে মাজারের মতন লাগতে শুরু করলো। নিশাত আমাকে হাসি মুখে বললো, ‘আমরা মাজার সাজিয়ে বসেছি, তোরা আয় আর আমাদের মাজারে পয়সা দিয়ে যা’।

আমরা গোছগাছ করে বসতে বসতেই ট্রেন ছেড়ে দিলো। ট্রেন ছাড়তেই আমরা গল্পগুজবের মুডে বসলাম। নিজেরা গল্প করতে লাগলাম আর হাসতে লাগলাম হাহা হিহি করে। ওদিকে কে যেন বের করে আনলো তাস। ব্যাস আর যায় কই, সবাই হাত পা গুটিয়ে বসে পড়লো তাস নিয়ে। আমি আর রুবাইদা রুবাইদার সিটে বসে গল্প করতে লাগলাম। এর মধ্যে একটা স্টেশনে ট্রেন থামলো, ওদিকে সৈকত আর সুমাইয়া খাবারের প্যাকেট নিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে আসলো। শিল্পপতি আংকেলের দেওয়া খাবার সব সুমাইয়ার কাছে। কিন্তু ওর বগি আর আমাদের বগির মাঝখানে দরজা সিল করা। তাই ও আমাদের খাবারগুলো দিতে পারে নাই। এজন্য ট্রেন থামতেই ওরা প্যাকেট হাতে নেমে পড়ে। কয়েকটা জানালা দিয়ে ওরা খাবারের প্যাকেটগুলো দিয়ে ফেলে। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই ট্রেন হুইসেল দিয়ে নড়তে শুরু করে। ওরা দুইজন আতংকিত হয়ে খাবারের প্যাকেট প্ল্যাটফর্মে ফেলেই দৌড় লাগায়। আমরা গলা বাড়িয়ে চিৎকার করতে থাকি। আমরা তাড়াতাড়ি ফোন করে খবর নিতে থাকি যে ওরা ঠিকমত উঠতে পেরেছে কি না। খবর পাই যে ওরা ঠিক মতই উঠেছে কিন্তু খাবারের প্যাকেটটা ফেলে আসায় ওরা খুব আফসোস করছে। আমাদের সেজন্য আফসোস নাই, ওরা ঠিক মত আছে -এটাই তো বড় কথা! এদিকে আমাদের আশেপাশের খোপে যারা খাবার পেয়েছিলো তারা আমাদের সাথে সেটা শেয়ার করলো। জিনিসটা ছিলো বিশাল পরোটা দিয়ে প্যাঁচানো শর্মা টাইপের জিনিস।

রাত বেশি করলাম না। গত রাতে ঠিকমত ঘুম হয় নাই। সকালেই একটা জার্নি করেছি, সারাদিনে কোন বিশ্রামও নেওয়া হলো না। সবাই তাই ক্লান্ত ছিলো। আমরা যার যার জায়গা গুছিয়ে শুয়ে পড়লাম। এবং বলাই বাহুল্য, প্রায় শোয়ার সাথে সাথেই সবাই ঘুমে অচেতন হয়ে গেলো।