ট্রেনে আমি যে গভীর ঘুম দিয়েছিলাম, সেকথা বোধহয় বলার আর প্রয়োজন নাই। আমার অত্যন্ত গাঢ় ঘুমটা ভাংলো রুবাইদার ডাকে। আড়মোড়া ভেঙ্গে যখন উঠলাম চোখ ডলতে ডলতে, তখন বাইরে ঝলমলে দিন। ঘড়ি দেখে চমকে উঠলাম, সর্বনাশ- এ যে দেখি সাড়ে দশটা বাজে! আমি ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম- সবাই উঠে পড়েছে। আমিও দেরি না করে উপর থেকে নেমে পড়লাম।
স্পঞ্জের স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে ছুটলাম বেসিনের দিকে। চোখে মুখে পানি দিয়ে আসলাম। ফ্রেশ হয়ে সিটে এসে বসে মনে হলো কিছু খাওয়া প্রয়োজন। ট্রেনের লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম কি নাশতা পাওয়া যাবে এখন। বুঝতে পারলাম দেরি হয়ে যাওয়ায় সব পাউরুটি অমলেট শেষ হয়ে গেছে। এখন কোন নাশতা নাই। তবে ঘন্টা খানেক পরে দুপুরের খাবার পাওয়া যাবে। কি আর করা! একেবারে দুপুরেই না হয় খেয়ে নিবো।
কিন্তু রুবাইদা থাকতে আমার চিন্তা কি? রুবাইদা চটপট ব্যাগ থেকে ওর কিনে রাখা পাউরুটির প্যাকেট বের করলো। তারপর মিনিপ্যাক জেলি মাখিয়ে দিয়ে দুইটা পাউরুটির স্যান্ডউইচ বানিয়ে আমার হাতে তুলে দিলো। আমিও মজা করে খেয়ে ফেললাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমি পা তুলে দিয়ে সিটের উপর বসলাম। জানালা দিয়ে তখন রোদ গলে আসছে। এর মধ্যে আমরা গল্প করতে শুরু করলাম। ওদিকে অন্য বগি থেকেও আমাদের লোকজন আমাদের খোপের দিকে আসতে লাগলো। আমরা সবাই গাদাগাদি করে বসলাম। কে যেন বের করলো ‘উনো’র কার্ড। ব্যাস সাথে সাথে শুরু হয়ে গেলো খেলা।
আমি আগে কখনও উনো খেলি নাই। আমাকে সবাই মিলে নিয়ম কানুন শিখিয়ে দিলো। বেশ সোজা নিয়ম, খেলা বুঝতে কোন কষ্টই হলো না। আমিও খেলতে নেমে গেলাম। দারুণ মজা হতে লাগলো। আমরা দারুণ হৈ চৈ করে খেলতে লাগলাম। আমাদের চিৎকার চেঁচামেচির কারণে সারা ট্রেনের সকল স্টাফদের মধ্যে খবর রটে গেল যে বাংলাদেশ থেকে বিশাল একদল ছেলেমেয়ে এসেছে- এবং তারা সারা ট্রেন জুড়েই অবস্থান করছে। ওদের আর কি দোষ, আমরা এতগুলো মানুষ এমনভাবে ট্রেনে আড্ডা দিচ্ছিলাম যে সত্যিই ব্যাপারটা বোঝা কষ্টকর যে কার সিট আসলে কোথায়। একটু পর পর যারা আমাদের পাস করে যাচ্ছিলো তারা অনেকেই বলতে লাগলো, ‘আপনাকে না একটু আগে ঐ পাশের বগিতে দেখেছিলাম, আপনি এখানে কেন?’
দারুণ জমজমাট খেলা হলো আমাদের উনো। আশেপাশের বগি থেকে অনেক লোকজন মিলে বিশাল দলে আমরা উনো খেলছিলাম। অনেক হাসি, ঠাট্টা, চুরির মধ্য দিয়ে এক সময় শেষ হলো উনো খেলা। ওদিকে আমাদের দুপুরের খাবার চলে আসলো। আমি আর রুবাইদা দুজনে মিলে অর্ডার দিয়েছিলাম ১৩০ রুপির সবজি, ডিম আর ভাত। ট্রেনের খাবার কখনই মজা হয় নাই। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। মোটামুটি করে আমরা দুইজন খেয়ে নিলাম। খাওয়া দাওয়া শেষে আবার আমরা বসলাম আড্ডা দিতে। এর মধ্যে উড়ো খবর আসতে লাগলো, কমিটি থেকে আমাদের অ্যালাউয়েন্স দেওয়া হবে। আমরা জল্পনা কল্পনা করতে লাগলাম এবার ৫০০ নাকি ১০০০ রুপি আমাদের দেওয়া হবে সেইটা নিয়ে। আমাদের অবাক করে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে রিজভী আর শুভ আমাদের প্রত্যেকের হাতে ৩০০০ করে রুপি ধরিয়ে দিলো। আমরা খুশিতে হত বিহ্ববল হয়ে গেলাম। এমনিতেও শেষের দিকে এসে অনেকের টাকা পয়সার টানাটানি পড়েছে। এই অভাবের মধ্যে ৩০০০ রুপি আমাদের কাছে এক বিশাল নিয়ামত বলে মনে হলো। আমরা খুশিতে বাকবাকুম হয়ে গেলাম।
দিনটা অনেক ঝকঝকে ছিলো। তার উপর তেমন কোন গরম ছিলো না। তাই জার্নিতে আমাদের তেমন কোন কষ্ট হচ্ছিলো না। এজন্য জার্নিটা আমরা খুবই উপভোগ করছিলাম। মৌলিকে দেখলাম জানালার উপর মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে গান শুনতে। খানিক পরে ও উঠে এসে আমাকে বললো, ‘আমার এত ভালো লাগছিলো যে বলার মতন না। আমার মনে হচ্ছিলো যে সারাটা জীবন যদি এভাবেই জানালায় মাথা রেখে থাকতে পারতাম……’
আমাদের ট্রেন চলতেই লাগলো। একেকটা স্টেশনে ট্রেন থামে অনেক মানুষ উঠে আর অনেক মানুষ নেমে যায়। অনেকে স্ট্যান্ডিং টিকেট কাটে, অনেকে কোন টিকেটই কাটে না। আমাদের সিট গুলোতে ফাঁক ফোকর পেয়ে অনেকেই বসে পড়ে। আমাদের কাছে বিষয়টা বিরক্তিকর লাগে, চেনা নাই জানা নাই -হুট করে একজন মানুষ পাশে বসে পড়বে কেন? আমরা মাঝে মাঝে আমাদের সিটে ব্যাকপ্যাক গুলো রেখে দিয়ে ব্লক করে রাখার চেষ্টা করি। কোন কোন সময় তাতেও কাজ হয় না। এরকম করেই জাফরের পাশে এক সাউথ ইন্ডিয়ান দম্পতি বসে পড়লো। তাদের বয়স আমাদের চাইতে খুব একটা বেশি না। লোকটা জাফরের সাথে বেশ আগ্রহ নিয়ে কথা বলছিলো। অবশ্য আমরা একজন আরেকজনের সাথে যেভাবে ডাকাডাকি করে কথা বলছিলাম- আমাদের বিষয়ে জানতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক! কথায় কথায় যখন তারা আমাদের কাহিনী সব শুনলো, তারা আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠলো। লোকটা জাফরের সাথে অনেক্ষণ কথা বললো। জানতে চাইলো বাংলাদেশ নিয়ে। মহিলাটাও কথা বললো। এক পর্যায়ে জাফর মানিব্যাগ থেকে বাংলাদেশি টাকার নোট বের করে দেখালো। ওনারা খুব উৎসুক দৃষ্টিতে নেড়েচেড়ে নোটটা দেখলেন। তারপর ওনাদের স্টেশন এসে গেলে ওনারা জাফরকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়।
ওদিকে আমাদের পাশের খোপে উর্মির সাথে এক ভদ্রলোক বেশ গল্প জুড়ে দিলেন। উনি মনে মনে ভেবেছিলেন যে আমরা বেড়াতে যাচ্ছি আর রুবাইদা হচ্ছে আমাদের লিডার। উর্মির মুখে এই কথা শুনে রুবাইদাসহ আমরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলাম। ইতোমধ্যে আমাদের এখানে খেলতে আসা শুভকে রুবাইদা একবার পাউরুটি জেলি আরেকবার পানির বোতল দিয়ে সাহায্য করায় শুভ রুবাইদাকে উপাধি দেয়, ‘অ্যাঞ্জেল ফ্রম হেভেন’। কোন কাজ নাই দেখে আবার শুরু হয় উনো খেলা। তাসের চাইতে উনো খেলা বেশ জমে ওঠে। আমরাও খুব মজা নিয়ে খেলতে থাকি।
আস্তে আস্তে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে থাকে। একসময় সূর্যটা ডুবে যায়। ট্রেনের বাতি জ্বলে ওঠে। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আমাদের ট্রেন চলতে থাকে। আমরা অলস গল্পগুজব করতে থাকি একজন আরেকজনের সাথে। ওদিকে পাশের খোপে উর্মি আর সৌরভের সাথে আরেক ভদ্রলোকের বেশ খাতির হয়ে গেলো। ইনি বিএসেফের সদস্য। বাংলাদেশকে খুব ভালোই চেনেন! আমাদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত শুনে বেশ খুশি হলেন। এক পর্যায়ে উনি ব্যাগ থেকে একটা বড়সড় চায়ের প্যাকেট আর মাথা ব্যাথার বাম বের করে আমাদের জন্য উপহার হিসেবে উর্মির হাতে তুলে দিলেন। ওদিকে অদিতি আর উর্মিও বুদ্ধি করে চাবির রিং বের করে ওনাকে উপহার দিয়ে দিলো।
প্রতি ট্রেন জার্নির মত এবারও আমি বোতল কেটে বদনা বানিয়েছিলাম। সেগুলো ভালোই কাজ দিচ্ছিলো। আমরা সেগুলো আমাদের সিটের নিচে রাখতাম। এর মধ্যে এক ঝাড়ুদার স্টাফ এসে আমার সব বোতল জানালা দিয়ে ফেলে দিলো। আমি চিৎকার করে বোঝাতে চাইলাম যে, প্লিজ ফেলবেন না। কিন্তু আধা কাটা বোতল না ফেলার জন্য আমি কেন চিৎকার করছি তা উনি কিছুতেই বুঝলেন না। আমাকে আবার আরেকটা বোতল জোগাড় করতে হবে ভাবতেই বিরক্ত লাগলো। পরে খালি বোতল জোগাড় হলে যখন আমি কাটতে উদ্যত হলাম, তখন জুবায়ের বোতলে ছিদ্র করে আরও একধাপ উন্নত বোতল বদনা তৈরি করে দিলো।
ওদিকে হঠাৎ দেখলাম আমাদের বগির বাথরুমের সামনে কয়েকজন ভারতীয়র সাথে সাদা চামড়ার দুজন ছেলেমেয়ে বিশাল বিশাল দুইটা হ্যাভারস্যাক নিয়ে পাংশু মুখে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। আশেপাশের লোকজন ড্যাব ড্যাব করে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে দুর্গন্ধযুক্ত জায়গায় চুপ চাপ বসে আছে। আমার খারাপই লাগলো তাদের জন্য। আহারে, কোন বিপদে পড়ে না জানি এরকম কষ্ট করতে হচ্ছে তাদের।
ইশতিয়াকের সাথে আমার অনেক লম্বা সময় জুড়ে গল্প হলো। ওদিকে রাতের খাবারও চলে আসতে থাকে। আমি আর রুবাইদা নেই ভেজ মিল। তাতে ছিলো ভাত, রুটি, সবজি আর ডাল। রাতের খাবার খেয়ে দেয়ে সবার মধ্যে কেমন যেন একটা খালি খালি ভাব চলে আসলো। এটাই আমাদের শেষ ট্রেন জার্নি। এই রাতই আমাদের ট্রেনে শেষ রাত। আমরা স্বপ্নময়ী একটা ট্যুরের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি। এই যে এত হাসি, আড্ডা, মজা- এগুলো আর কখনও একসাথে হবে কিনা জানি না। ট্যুরের একটা একটা করে পর্ব শেষ হয়ে গিয়েছে। আগামীকাল ইনশাল্লাহ কোলকাতা পৌঁছালে শুধু দেশে ফেরার পর্বটাই বাকি থাকবে। আমরা ঘুমানোর আগে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। এই বিদায় নিতে নিতেই অনেক রাত হয়ে গেলো। তারপর আমরা শুয়ে পড়লাম একে একে।
একসময় ট্রেনের বাতি নিভে গেলো। আমাদের দুই চোখ বেয়ে ঘুম নামলো। ইন্ডিয়া ট্যুরের শেষ ট্রেন জার্নিতে শেষ ঘুম।