This is a test post
ম্যারিকা দেশে ভ্রমন (পর্ব ২) জন ডেনভারের দেশ ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায়
কুচকুচে কালো ফোর্ডের গাড়িটা দেখে উত্তেজনায় আমার হৃদকম্পন বেড়ে গেলো। আমরা সত্যিই সত্যিই ফোর্ডের গাড়ি ভাড়া করতে যাচ্ছি নাকি! সত্যিই তাই, দোকানের লোকটা যখন গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছিলো- তখনও আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এইদেশে লং জার্নিতে গেলে বেশিরভাগ মানুষ নিজের গাড়ি না নিয়ে ভাড়া গাড়ি নিয়ে যায়। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় যাওয়ার জন্য মাকসিম ভাইও তাই এসেছে গাড়ি ভাড়া করতে। কিন্তু সেগুলো যে ঝাঁ চকচকে ফোর্ডের গাড়ি হবে সেটা আমার কল্পনাতেও ছিলো না।
লেবার ডে উপলক্ষে লং উইকেন্ড থাকায় সবাই মিলে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ট্যুরের প্ল্যান করছিলো। কিন্তু কোন খানে বুকিং না পাওয়ায় প্ল্যানটা ভেস্তে যায়। বরঞ্চ তারপরের সপ্তাহেই ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া যাওয়া হবে ঠিক হয়। আমরা মাত্র এক মাস হয় নর্থ ক্যারোলাইনা এসেছি। ব্যাপার স্যাপার ঠিকমত বুঝিসুঝি না, তাই সবাই যা বলে আমরাও তাতে রাজি হয়ে যাই। অবশ্য তেমন কোন প্রিপারেশন ছিলো না। আমরা শুধু আমাজনে দুই জোড়া ওয়াটার শু অর্ডার দিলাম র্যাফটিঙ্গের জন্য। মোটামুটি ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে আগের দিনই তৈরি হয়ে থাকলাম।
প্ল্যানমত শুক্রবার সাড়ে তিনটার জুম্মার জামাত শেষে রওয়ানা দিলাম আমরা রলে মসজিদ থেকে মাকসিম ভাইদের সাথে। মসজিদ থেকে বের হয়েই আমরা গাড়ি ভাড়া করতে যাই। এবং ঝকঝকে একটা ফোর্ডের গাড়ি ভাড়া করে ফেলি। তমা আপু একবার ট্রায়াল নিয়ে সব কিছু ঠিকঠাক বুঝে নিলো। তারপর আমাদের সমস্ত মালপত্র মাকসিম ভাইয়ের গাড়ি থেকে ভাড়া করা গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে রওয়ানা দিলাম প্রায় বিকাল পাঁচটার সময়।
বিশাল চওড়া হাইওয়ে দিয়ে শাই শাই করে ছুটতে লাগলো আমাদের গাড়ি। আমেরিকার হাইওয়েতে অনেক মজার মজার গাড়ি দেখা যায়। ছোটবেলা থেকেই তিন গোয়েন্দাতে একটা জিনিস পড়তাম ‘ট্রেলার’। এখানে আমাদের গাড়ির পাশ দিয়ে অহরহ ছুটে যাচ্ছে বিশাল বিশাল সব ট্রেলার। আরেকটা মজার জিনিস হচ্ছে অটো ট্রান্সপোর্ট ট্রেলার। ছয়টা থেকে আটটা গাড়ি নিয়ে লম্বা লম্বা সব ট্রান্সপোর্ট ট্রেলার যাচ্ছে। দেখতে খুব মজা! বিশাল চওড়া রাস্তায় দাগ দিয়ে লেন ভাগ করা, তাই ওভার টেকিং নিয়ে কোন কামড়াকামড়ি নাই। যার যার লেনে সে সে ছুটছে। এইসব দেশে গাড়ি চালানো খুব সহজ কাজ বলেই মনে হলো!
এই দেশে রাস্তার দুইপাশে কোন জনমনিষ্যি নাই। প্রথম প্রথম রাস্তার দুই পাশ শুধু ঘাস আর বড়বড় গাছ ছিলো। ধীরে ধীরে টপোগ্রাফি বদলাতে লাগলো। দুই পাশ জুড়ে শুরু হতে লাগলো পাহাড়। শুরু হলো পাহাড়ি রাস্তা। আমরা ধীরে ধীরে উঁচুতে উঠতে লাগলাম। একপর্যায়ে দুই পাশে বিশাল বিশাল পাথুরে পাহাড় ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে পাথুরে হোক আর মাটিই হোক- সব পাহাড়ই সবুজ জঙ্গলে ঢাকা। শেষ বিকালের কমলা রোদে ঝলমলে দেখাচ্ছিলো দুইপাশের দৃশ্যকে। ইতোমধ্যে একটা পাহাড়ের পেটের ভিতর টানেলে ঢুকে পড়লো আমাদের রাস্তাটা। টানেলটার নাম ইস্ট রিভার মাউন্টেন টানেল। বি-শা-ল একটা টানেল। এই পাহাড়ের এক প্রান্তে ভার্জিনিয়া অন্যপ্রান্তে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া। পাহাড় না কেটে পাহাড়টা ফুটো করে রাস্তা বানানো হয়েছে। টানেল পাড়ি দিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম, এত্তবড় পাহাড়টা ফুটো করা- কি অবাক কান্ড!
ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় ঢোকার পর থেকেই পাহাড়ের সাইজ আরও বড় হতে লাগলো। জন ডেনভারের দেশ ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় যেতে যেতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে পড়লো। সূর্যটা আকাশে কমলা রঙ গুলিয়ে দিয়ে কোথায় যেন টুপ করে হারিয়ে গেলো। আর সাথে সাথেই পাহাড়ের দেশে নেমে এলো ঘুটঘুটা অন্ধকার। দুপাশে কিছু দেখা না গেলেও আমরা টের পাচ্ছিলাম যে ঘন জঙ্গল সমেত পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে আমরা ছুটে চলছি। ওদিকে গুগল ম্যাপের ডিরেকশন অনুযায়ী আমরা বড় রাস্তা ছেড়ে ছোট রাস্তায় উঠলাম। এইবার রাস্তাটা দেখে আমার একটু শান্তি লাগলো। রাস্তাগুলো চিকন, ঠিক আমাদের দেশের রাস্তার মতন। দুই পাশে এখন পাহাড়ের বদলে একটু আধটু ঘরবাড়ি দেখা যেতে লাগলো। তবে এত দূরে দূরে একেকটা বাড়ি, যে দেখে আমারই ভয় হতে লাগলো। প্রায় একর খানেক জমি নিয়ে একেকটা ঘর। নিকষ অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ হলদেটে আলোর ছটা জানান দিচ্ছে এক আধটা ঘরের অস্তিত্বের কথা। আমার মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিয়ে গেলো, এইসব বাড়ির বাসিন্দারা বাজার করে কোথায়?
নানা রকম বাঁকপূর্ণ রাস্তা পার হয়ে রাত নয়টার দিকে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছালাম। গাড়ি থেকে নেমে একটা বিরাট কনফিউশনে পরে গেলাম সবাই। ঠিকানা অনুযায়ী যেখানে এসে থামলাম আমরা, সেখানে সারি ধরে দোতলা তিনতলা কটেজ। কোনটা আমাদের এয়ার বিএনবিতে ঠিক করা কটেজ, এই রাতের বেলায় বাইরে থেকে বোঝার উপায় নাই। সব গুলো দেখতে প্রায় একই রকম। আমি, রাতুল আর তমা আপু হেঁটে হেঁটে গবেষণা করতে লাগলাম। প্রথম দুইটা কটেজ দেখে হেঁটে পার হয়ে গেলাম। কোনটায় কোন মানুষ নাই। সব গুলো কটেজ ফাঁকা। তিন নম্বরটায় গিয়ে আমাদের মনে হলো এইটাই বোধহয় আমাদের কটেজ। আমরা সিড়ি ধরে তিনতলায় উঠে গেলাম। আশে পাশে আতিপাতি করে খোঁজা হলো কোন বাড়ির নম্বর আছে কিনা, কিন্তু কিছুই পাওয়া গেলো না। তারপর যা আছে কপালে ভেবে মেইলে পাঠানো নম্বর দেখে তমা আপু দরজার কম্বিনেশন লক মিলাতে শুরু করলো। আমার মনে হলো এখনই বার্গ্লার অ্যালার্ম বেজে উঠবে আর প্যাঁ প্যাঁ করে শেরিফের গাড়ি এসে হাজির হবে। তারপর ট্রেসপাসিঙের দায়ে আমাদের সবাইকে কোমরে দড়ি বেঁধে হাজতে নিয়ে যাবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না, বরঞ্চ খুট করে কম্বিনেশন লকটা খুলে গেলো। আমরা সবাই খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। যাক, পাওয়া গেলো! তিনতলাটা খুলে আমরা দোতলার দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। এবার এই দরজার কম্বিনেশন মিলাতে শুরু করলাম, কিন্তু এইটা কিছুতেই খুললো না। আমরা নানাভাবে চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। আমাদের বুক দেওয়া ছিলো দোতলা আর তিনতলা। এর মধ্যে দোতলাটা বড় আর তিনতলাটা ছোট। একটা তলা না খুলতে পারলে তো বিপদে পড়ে যাবো। ওদিকে দোতলা আর তিনতলার কম্বিনেশনের সিকোয়েন্স অনুযায়ী একতলার লকটা খোলার চেষ্টা করতেই সেটাও খুট করে খুলে গেলো। আমরা মাথা নেড়ে বিকল্প বুদ্ধি করলাম, যদি দোতলা খুলতে না পারি, তাহলে একতলাতেই আস্তানা গেড়ে বসতে হবে!
ওদিকে আমরা গাড়ি থেকে ব্যাগপত্র নামিয়ে তিনতলায় চলে গেলাম। খুব সুন্দর কাঠের কেবিন। ডাইনিং, লিভিং, কিচেনেট, বাথরুম আর বেডরুম। আমি ঢুকে সব ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এখানে আমরাই সবার আগে এসেছি। অন্যরা এখনও রাস্তায়। আমি আর তমা আপু ডিনারের জন্য বেগুন ভাজবো বলে ঠিক ছিলো। আমিও প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, হঠাৎ মনে হলো আচ্ছা বেগুন যে ভাজবো- চুলা কোথায়? ভালো মত তাকিয়ে দেখলাম। কিচেনেটের টেবিল টপে কফি মেশিন, টোস্টার, ইলেক্ট্রিক ওভেন সবই আছে- কিন্তু চুলা নাই। তমা আপুকে ডেকে জানালাম ব্যাপারটা। আপু ঠাশ ঠাশ করে সবগুলো ক্যাবিনেটের দরজা খুলে ফেললো, আমি অবাক হয়ে দেখলাম ভিতরে সারি সারি কাঁচের প্লেট, মগ, বাটি, গামলা সাজানো। আপু খুঁজে খুঁজে একটা ইলেক্ট্রিক ফ্রাই প্যান বের করলো (জিনিসটা খুব অদ্ভূত, ফ্রাই প্যানের সাথে তার লাগানো- কারেন্টে দিলে গরম হয়ে যায়), কিন্তু এই এক ফ্রাই প্যানে আর কয়টাই বা বেগুন ভাজা যাবে? আপু বিরক্ত হয়ে বললো যে এক্ষুণি একটা বাজে রিভিউ দিতে হবে এয়ার বিএনবিটার নামে!
ওদিকে নাহিদ ভাইয়ের গাড়ি এসে পৌঁছালো। সবাই এগিয়ে গেলো ওনাদের নিয়ে আসতে। ইতোমধ্যে অনেক কসরত করে দোতলার দরজা খোলা সম্ভব হলো। আমাদের সকল ঝামেলার অবসান ঘটিয়ে দিয়ে দোতলায় পাওয়া গেলো মস্ত বড় কিচেন। আমি আর তমা আপু ফ্রেশ হয়েই দৌড়ে চলে গেলাম দোতলায়। মোটা মোটা সব বেগুন ধুয়ে, কেটে, মশলা মাখিয়ে তিন তিনটা ফ্রাই প্যানে হুলুস্থুল করে ভাজতে লাগলাম আমরা। ওদিকে আমাদের বেগুনের গন্ধে পুরো দোতলা ভরে গেলো। সবাই সমানে কাশতে লাগলো। আমরা বেগুন ভাজতে ভাজতেই বাকি লোকজনরা আসতে লাগলো ধীরে ধীরে। একেক জন একেকটা আইটেম রান্না করে নিয়ে এসেছিলো। সবাই এসে পড়লে আমরা খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, মিট বল আর কোক দিয়ে দৌঁড় ঝাপ করে ডিনার সারলাম। রাতের খাবার শেষ হতেই সবাই ঘুমাবার আয়োজন ঠিক করতে লাগলো। ঠিক হলো তিনতলার দুইটা টুইন বেডে থাকবো আমি, তাসনিম আপু, কুসুম আপু আর লুবনা আপু।
এই রুমের মধ্যে একমাত্র আমারই ছিলো পরেরদিন র্যাফটিং। তাই রাত ১২টা সাড়ে ১২টা বাজতে না বাজতেই আমি ঘুমানোর ইন্তেজাম করতে লাগলাম। দাঁতটাত মেজে মোবাইলে এলার্ম দিয়ে তুলতুলে নরম বিছানায়, তুলতুলে নরম বালিশে মাথা ডুবিয়ে নরম কম্বলটা গায়ে টেনে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু কেন যেন ঠিকঠাকমত ঘুম আসলো না। বরঞ্চ মাঝরাতে সবাইকে জাগিয়ে বিকট স্বরে আমার ফোনে এলার্ম বাজতে লাগলো। কোন রকম উঠে ফোনটা বন্ধ করে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।
যাই হোক, ঘুম থেকে সকালেই উঠে গেলাম। তৈরি হয়ে নিচে নেমে নাশতা করতে গেলাম। সারা রান্নাঘর আর ডাইনিং টেবিল ভর্তি খাবার দাবার ছড়ানো। আমি খুঁজে খুঁজে পরোটা বের করলাম। কে যেন ডিম ভেজে দিলো। ঝটপট খেয়ে আমরা বেড় হয়ে গেলাম। আমরা আর মাকসিম ভাইরা একসাথে রওয়ানা দিলাম। সকাল বেলা হালকা হালকা করে ভালোই ঠাণ্ডা পড়েছে। আমরা সবাই কম বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লাম, এই রকম ঠাণ্ডায় পানিতে নামবো কিভাবে সেই কথা চিন্তা করে।
আমরা ফেয়েটভিল নামের জায়গায় পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে ছুটতে ছুটতে গাড়িতে তেল ভরে প্রায় চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমাদের বুকিং দিয়ে রাখা র্যাফটিং কোম্পানির বেসে। গাড়ির ডিকিতে আমাদের সব মালপত্র রেখে আমরা বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঠাণ্ডা বাতাসে আমার হালকা কাঁপুনি ধরে যাচ্ছিলো। ধীরে ধীরে আমরা সাতজন ছাড়াও আরও কিছু বিদেশি এসে হাজির হলো। আমরা নানা রকম জল্পনা কল্পনা করতে করতেই একসময় র্যাফটিং কোম্পানির অফিসে গাড়ির চাবি জমা দিয়ে ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়’ এই মর্মে স্বাক্ষর করে মনে প্রাণে প্রস্তুত হয়ে নিলাম! আমাদের সাথে দুইজন ইন্সট্রাক্টর দেয়া হলো। একজন মহিলা ইন্সট্রাক্টর এসে আমাদের হাতে কমলা রঙের লাইফ জ্যাকেট, কমলা বৈঠা আর নীল রঙের হেলমেট দিয়ে গেলো। আমাদের যাদের পরতে অসুবিধা হচ্ছিলো তাদেরকে আবার ওনারা সাহায্য করে দিচ্ছিল। আমাদের সবার গায়ে লাইফ জ্যাকেট, মাথায় হেলমেট, পায়ে ওয়াটার শু আর হাতে বৈঠা, দেখতে বেশ চমৎকার লাগছিলো! খুব একটা অভিযাত্রী অভিযাত্রী ভাব নিয়ে আমরা একজন আরেকজনকে দেখতে লাগলাম।
আমাদের সবাইকে একটা বাসে ওঠানো হলো। বাসটা দেখে আমার প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। পুরানো রঙ জলা বিবর্ণ একটা ঝরঝরে বাস। এই দেশে এসে সব ঝাঁ চকচকে জিনিস দেখতে দেখতে একঘেয়ে লাগছিলো। এই প্রথম এরকম একটা বাস পেয়ে আমার শান্তি লাগলো। আমরা সবাই বৈঠা হাতে নিয়ে একে একে বাসে উঠতে লাগলাম। আমাদের সাথে নয়জনের আরেকটা দল ছিলো। সবাই উঠে বসতেই বাস ছেড়ে দিলো। সেই মহিলা ইন্সট্রাক্টর সামনে এসে আমাদের সাথে পরিচিতি শুরু করলো। তারপর পরিচয় করিয়ে দিল বাস ড্রাইভার ক্যান্ট্রেল র্যাফটিং এর মালিকের সাথে। আমি অবাক হয়ে গেলাম। কোম্পানির মালিক নিজে বাস চালিয়ে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে! কি আশ্চর্য ! ইন্সট্রাক্টর কোন রকম নিশ্বাস না ফেলে একটানা কথা বলে যেতেই লাগলো। কিছু সাজেশন, কিছু ঠাট্টা, কিছু সতর্কতা- টানা এইসব কথাবার্তা বলতে বলতেই আমরা এসে পড়লাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত জায়গা কুনার্ডে। বৈঠা হাতে বাস থেকে নেমে আমরা একটু দাঁড়ালাম। সাথে সাথে কমবয়সী সোনালি চুলের একটা মেয়ে ক্যামেরা হাতে আমাদের ছবি তুলে দিতে লাগলো। আমরাও পোজ মেরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে লাগলাম। তারপর সবাই মিলে বাসের পিছনে ট্রেলারে থাকা দুইটা ভেলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের দুই দলের জন্য দুইটা ভেলা। ঠিক হলো আমাদের ইন্সট্রাক্টর হবে জেরি নামের একজন, আর ওই মহিলা হবে অন্য দলটির ইন্সট্রাক্টর। আমরা প্রথমেই জেরি কে বললাম আমরা সাতজনের কেউই সাঁতার পারিনা। জেরি আমাদের মধ্য থেকে দুইজন নেতা ঠিক করতে বললো। আমরা মাক্সিম ভাই আর নাহিদ ভাইকে আমাদের নেতা বানিয়ে দিলাম। তারপর সবাই ধরে ধরে ভেলাটাকে নিয়ে নিচে ‘নিউ রিভার’ নামক নদীতে নামালাম। তারপর সবাই টকাটক করে উঠে পড়লাম। সবার সামনে মাকসিম ভাই আর নাহিদ ভাই। তার পিছনে শাহরিয়ার আর তমা আপু, তার পিছনে আমি আর রাতুল, আমার পিছনে দিশা। আর সবশেষে আমাদের ইন্সট্রাক্টর জেরি। নদীর পানিতে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করলাম।
প্রথমে জেরি কিছুক্ষণ আমাদের শিখিয়ে দিলো কিভাবে জেরির নির্দেশ অনুসরন করতে হবে। আমরাও নির্দেশমতন বৈঠা বেয়ে ওয়ার্ম আপ করে নিলাম। মোটামুটি ব্যাপারটা বুঝে যাওয়ার পর আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। দুইপাশে উঁচু পাহাড়ের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে গেছে নদীটা। টলটলে স্বচ্ছ পানি। তবে আনন্দের বিষয় হচ্ছে পানিটা ঠাণ্ডা না। স্বাভাবিক তাপমাত্রা। আমাদের শীতশীতভাব যেন কোথায় উবে গেলো। কয়েক মিনিট সামনে যাওয়ার পর আসলো প্রথম র্যাপিড। ছোট বড় বিভিন্ন আকারের পাথরের মধ্য দিয়ে আমাদের ভেলাটাকে নিয়ে যেতে হবে। আমরা টানটান হয়ে জেরির নির্দেশমত বৈঠা বাইতে লাগলাম। সফলভাবে আমরা প্রথম র্যাপিডটা পার হয়ে গেলাম। সবাই খুশিতে চিৎকার করে উঠলাম। আমাদের খুব মজা লাগছিলো। সুন্দর নদীটার দুইপাশে নানারকম দেখার জিনিস। দুই পাশের পাহাড়ে কখনো ঘন সবুজ জংগল, কখনো কয়লা খনির ভাঙ্গা চোরা স্থাপনা, কখনো বিশাল বিশাল পাথর আবার কখনো বা বিখ্যাত গর্জ সেতু – এইসব দেখতে দেখতে আমারা ছোট বড় বিভিন্ন র্যাপিড পার হচ্ছিলাম। এভাবে আমরা ভেলাটাকে বাইতে বাইতে একে একে ১২টা র্যাপিড পার হলাম। আমাদের অভিযান যখন শেষ হলো তখন দুপুর হয়ে গেছে। আবার পানি থেকে ভেলাটাকে টেনে ধরে ট্রেলারে ওঠানো হোল। আবার সব বৈঠা নিয়ে আমরা বাসে উঠে বসলাম। বাস ছেড়ে দিতেই টের পেলাম শীত। আমাদের সারা শরীর ভেজা। বাসে জানালা দিয়ে হুহু করে ঢুকতে লাগলো ঠাণ্ডা বাতাস। ভাগ্যিস লাইফ জ্যাকেটটা ছিলো বলে জমে যাই নাই।
আমরা বাসে থাকতে থাকতেই সেই মহিলা ইন্সট্রাক্টর আমাদের নানা রকম জিনিসের বর্ণনা দিচ্ছিল। আমরা জানলাম যে, এখন অনেকেই ভ্যাকেশন হাউজ বানানোর জন্য ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় জমি কিনে। আমরাও চাইলে এখানে জমি কিনতে পারি। তারপর আমাদের বাস যখন গর্জ সেতুর উপর দিয়ে পার হচ্ছিলো তখন জানলাম ‘ব্রিজ ডে’র কথা। প্রত্যেক অক্টোবর তৃতীয় শনিবার পালিত হয় ‘ব্রিজ ডে’। এই দিন এই সেতুর উপর গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সারা দিন ধরে বড় উৎসবের মতন হয়। দলে দলে ডাইভাররা ব্রিজের উপর থেকে নদীতে ঝাঁপ দেয়। তারপর দেখলাম ‘টুডোরস বিস্কুট ওয়ার্ল্ড’ নামের ‘বিখ্যাত’ দোকান যেটা আসলে বার্গারের দোকান। শহরের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আমর ফটোগ্রাফি দোকানও দেখলাম যেখানে আমাদের র্যাফটিং করা ছবিগুলো কিনতে পাওয়া যাবে। প্রায় পনের থেকে বিশ মিনিট ধরে টানা কথা বলার পরও মহিলা এক মুহুর্তের জন্য ক্লান্ত হলো না। আমি মহিলার স্টযামিনা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এর কি খায় কে জানে?
আমরা বাস থেকে নেমে দৌড়ে চেঞ্জ রুমে গেলাম। ভেজা জামা কাপড় বদলে বেড় হয়ে আসতে আসতেই দেখি হাইল্যান্ডার থেকে অন্য সবাই গাড়ি নিয়ে আমাদের এখানে চলে এসেছে। আমাদেরকে ক্যান্ট্রেল র্যাফটিংএর মালিক সন্ধ্যায় পার্টির দাওয়াত দিলো। গানবাজনা হবে, খাওয়া দাওয়া হবে- সব মিলিয়ে নাকি খুব মজা! কিন্তু আমরা সাতপাঁচ ভেবে তেমন কোন লাভ দেখলাম না। তাই নিজের আলোচনা করে যার যার গাড়িতে উঠে আমরা রওয়ানা দিলাম। প্রথমে গেলাম নিউ রিভারের তীরে যেখানে আমাদের র্যাফটিং শেষ হয়েছিলো সেই জায়গায়। সবাই ছোট বড় পাথরের উপর স্বচ্ছ পানিতে পা ডুবিয়ে বসে ছিলাম। দেখলাম আমাদের মতনই আরও অনেক ভেলা যাচ্ছে র্যাফটিং করতে করতে। অনেকে শুধুমাত্র একটা রিঙয়ের মধ্যে শুয়ে শুয়ে ভেসে যাচ্ছে। অনেকে আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা সার্ফবোর্ডের মতন নৌকায় করে যাচ্ছিলো। খুব ভালো লাগছিলো আমাদের। অনেকক্ষণ এখানে বসে থেকে তারপর আমরা আবার গাড়িতে উঠে গেলাম ভিজিটর সেন্টারের দিকে। পথে আমি আর তমা আপু সেই ফটোগ্রাফি দোকানে নেমে আমাদের ছবিগুলো দেখে আসলাম আর তাদের গলা কাটা রেটের কথা জেনে আসলাম। একটু পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম ভিজিটর সেন্টারে। সেখানে হেঁটে হেঁটে ছোট একটা মিউজিয়াম দেখলাম যেটা ছিলো ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার কয়লা খনির ইতিহাসের উপর। সেখান থেকে ছোট্ট করে বারান্দা দিয়ে দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে নিউ রিভার দেখা যাচ্ছে। তারপর ভিজিটর সেন্টার থেকে বের হয়ে আমরা গেলাম ভিউইং ডেকের দিকে। পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আমরা একটা সুন্দর ডেকে গিয়ে পৌঁছালাম যেখান থেকে গর্জ সেতুটা চমৎকারভাবে দেখা যায়। ছবিটবি তুলে আমরা সিঁড়ি বেয়ে আবার উপরে উঠে গেলাম। তারপর রওয়ানা দিলাম দুপুরের খাবারের উদ্দেশ্যে।
আমরা একটা সাবওয়েতে নেমে গেলাম। সবাই পেট ভরে স্যান্ডউইচ খেয়ে নিলাম। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে গেলাম একটা পার্কে। শেষ বিকালের কমলা রোদে ঝলমল করছিলো পার্কটা। এখান থেকেও নিউ রিভার নদী দেখা যায়। আমার এক পর্যায়ে মনে হলো এই পুরো ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া আসলে বেঁচে আছে এই একমাত্র নিউ রিভার নদী আর গর্জ সেতুর উপর নির্ভর করে। পার্কে খুব বেশি সময় নষ্ট না করে আমরা চলে গেলাম স্যান্ডস্টোন ফলস দেখতে। স্যান্ডস্টোন ফলসে যাওয়ার রাস্তাটা বেশ বুনো এবং পাহাড়ি। এক পর্যায়ে আমরা ভয় পেয়ে যাচ্ছিলাম যে এই পথের শেষে আদৌ কিছু আছে কিনা! কিন্তু সবশেষে ফলসটা দেখতে পেয়ে আমাদের সব দুঃখ দূর হয়ে গেলো। আসলেই খুব সুন্দর। বিশাল এলাকা জুড়ে পানির ধারা পাথর ডিঙ্গিয়ে মাত্র কয়েক ফুট করে করে নিচে নামছে। জায়গাটা অত্যন্ত রিফ্রেশিং। আমাদের খুব ভালো লাগছিলো। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকার উপায় ছিলো না। কারণ সুর্য ডুবে যাচ্ছে। আরেকটু পড় ঝুপ করে অন্ধকার নেমে পড়বে।
সূর্য ডোবার ঠিক আগ মুহুর্তে আমরা রওয়ানা দিলাম। স্যান্ডস্টোন ফলসের গা ঘেঁষে পাহাড়ি রাস্তা ধরে সামনে যেতে বেশ ভালোই লাগছিলো। একপাশে হঠাৎ অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখলাম। সারি সারি কারাভ্যান। আগে কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়লে জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে বস্তি দেখতাম। এই কারাভ্যানের সারি দেখে আমার সেই বস্তির কথা মনে পড়ে গেলো। জটলা পাকানো কারাভ্যানগুলো যেন জিপসিদের আস্তানা, যেমনটা আমাদের দেশে বেদেদের দল আস্তানা গাড়ে কোন এক নদীর ধারে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। এইদেশেও এরকম উদ্বাস্তু মানুষের দেখা পাবো ভাবি নাই। অন্ধকার নেমে যেতেই আমার দু চোখের পাতা ভারী হয়ে যেতে লাগলো। মাকসিম ভাই কিভাবে ড্রাইভ করছেন চোখের ঘুম তাড়িয়ে, আমি ভাবতেও পারলাম না। এরমধ্যে আরেক উপদ্রব শুরু হলো। হরিণ উপদ্রব! বলা নেই কওয়া নেই, ঝড়ের বেগে হরিণ দৌড়ে যাচ্ছে অন্ধকার পাহাড়ি রাস্তার এই পার থেকে ওই পারে। সবাই ঢুলুঢুলু চোখ ডলে সতর্ক হলো হরিণের জন্য।
অবশেষে আমরা এসে পৌছালাম আমাদের হাইল্যান্ডারে। ক্লান্ত শরীরে নামতে নামতেই আমরা লেগে পড়লাম বার বি কিউ করতে। দুই দুইটা বার বি কিউ চুলায় চাপিয়ে দেওয়া হলো ম্যারিনেড করা মুরগি। আর চুলায় ভাজা হতে থাকলো ফ্রোজেন পরোটা। সবশেষে পেট ভরে খেয়ে দেয়ে আমরা আঙ্গুল চাটতে লাগলাম তৃপ্তি করে। তারপর কেক কাটা হলো তমা আপুর জন্মদিন উপলক্ষে। তারপর নানা রকম হাসির গল্প চলতে লাগলো অনেক রাত পর্যন্ত।
পরদিন সকালে উঠে দেখি আমরা আগের দিনের কয়জন ছাড়া বাকিরা সবাই চলে গেছে র্যাফটিং করতে। আমি কোনরকম কিছু খেয়ে নিলাম। ওদিকে তমা আপু আর রিমা আপু কোমর বেধে নেমেছে রান্নাঘর পরিষ্কার করতে। আমি বাইরে গিয়ে দেশে ফোন করে খানিক্ষণ কথা বললাম। তারপর তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিয়ে হাইল্যান্ডারকে বাই বাই বলে বের হয়ে পড়লাম সবাই। আমরা গাড়িতে ওঠার সময় দেখলাম থুথুরে বুড়ো মহিলা দামি শানদানি গাড়ি নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। আমরা মনে করলাম সে বুঝি এই কটেজের মালিক। পড়ে জানতে পারলাম সে হচ্ছে ক্লিনার, আমরা বের হয়ে গেলেই সে ঘর বাড়ি গোছগাছ করতে যাবে!
ঝলমলে সুন্দর দিনের আলোয় আমরা গেলাম একটা পার্ক দেখতে। তবে সেখানকার ফলসটা শুকিয়ে গেছে। তারপর কাছাকাছি আরেকটা ফলস দেখতে গিয়ে দেখি সেই একই ব্যাপার। পানির ধারা শুকিয়ে গেছে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে কাছাকাছি কোথাও ঘোড়াদের কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনেক লোক পোষা ঘোড়া নিয়ে হাজির। ইয়া বড় বড় উঁচু একেকটা ঘোড়া। কয়েকটা ট্রেলারের মতন আস্তাবলও দেখলাম। কি সুন্দর চলমান আস্তাবল! এক মহিলা আর তার মেয়ে দুইজনে মিলে দুইটা ঘোড়ার লোম আঁচড়ে দিচ্ছে। ঘোড়া গুলো আরাম করে উপভোগ করছে ব্যাপারটা। আমি কয়েকটা ঘোড়াকে আদর করলাম। কি সুন্দর ঝলমলে কেশর!
ঘোড়াদের বিদায় দিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। পথিমধ্যে আর তেমন কোন সমস্যা হলো না (শুধু মাঝখানে এক স্টপেজে আমার প্রিয় ঘড়িটা ভুল করে রেখে আসা ছাড়া। কিভাবে সেই ঘড়ি ফেরত পেলাম সে এক বিশাল কাহিনী। এ গল্প আরেকদিন করা যাবে… )। শহরে ফিরে আবার ফোর্ডের গাড়িটা ফেরত দিয়ে মাকসিম ভাইয়ের গাড়িতে করে বাসায় এসে পৌঁছালাম। সারাদিন গাড়িতে বসে হাবিজাবি চিবাতে চিবাতে খিদেটাই নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরে ঢুকে কি খাবো কি খাবো ভাবতে ভাবতেই দেখি তামান্না চিকেন বিরিয়ানি করে রেখেছে।
যাই হোক রিজিকের মালিক আল্লাহ তায়ালা। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া বেড়িয়ে এসে বাসায় বসে নিশ্চিন্তে খেতে লাগলাম গরম গরম ধোঁয়া ওঠা বিরিয়ানি!
The Mighty INDIA CALLING: মিশন গড়িয়াহাট, বড়বাজার এবং কলেজ স্ট্রিট (পর্ব ৪০)
ঘুম ভাংলো অন্ধকার রুমের ভিতর। রুমে কোন দরজা জানালা না থাকায় ভিতরটা একদমই অন্ধকার। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম বেলা হয়ে গেছে। সারা রাত পা ভাঁজ করে রাখতে রাখতে পা দুটো যেন কেমন হয়ে গেছে। অন্যরা বিছানা ছেড়ে নেমে গেলে আমি এই ফাঁকে পা দুটো টানটান করে নেই। সবার শেষে গোসল করলাম আমি। বাথরুমের দরজা থেকেই লাফিয়ে উঠে গেলাম বিছানায়। এর মধ্যে আমাদের চারজনেরই বেশ কিছু শপিং হয়েছে। পোঁটলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু আমাদের রুমে তো তেমন জায়গা নাই। তাই আমরা সেগুলো বাথরুমের সামনের আসা যাওয়ার জায়গাটাতে স্তুপ করে রেখে দিয়েছি। এজন্য বাথরুমে যেতে হচ্ছে আমাদের বিছানার উপর থেকে সরাসরি। আবার বের হয়েও সরাসরি বিছানায় উঠে যেতে হচ্ছে।
নাশতা খেতে আবার নাজ হোটেল গেলাম আমরা। সেখানে শুনলাম নিশাতরা আজকে ঠাকুর বাড়ি যাবে। আগেরবার ওদের সাথে ঘোরাঘুরি করেছিলাম। আমাদের সেবার ঠাকুরবাড়ি যাওয়া হয় নাই। এবার ওরা যাচ্ছে দেখে আমার লোভ লাগলো। কারণ প্ল্যান করেছি প্রথমে গড়িয়া হাটে যাবো, তারপর কলেজ স্ট্রিট। আর কালকের দিনে সময় পেলে নিউ মার্কেট আর ভারত মিউজিয়াম ঘুরে আসবো। ওদের কথা শুনে কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেলাম, গড়িয়াহাটের প্ল্যান বাদ দিয়ে জোড়াসাঁকো চলে যাবো নাকি? পরে কলেজ স্ট্রিটের কথা চিন্তা করে সেই প্ল্যান বাদ দিলাম। আগের বার কলেজস্ট্রিট গিয়েও সাপ্তাহিক ছুটিতে বইয়ের দোকান বন্ধ থাকায় কোন লাভ হয় নাই। তাই এবার কলেজ স্ট্রিট যদি না যাই তাহলে আমার হৃদয়টা চৌচির হয়ে যাবে। ফেলুদা, টেনিদা, কাকাবাবু, টিনটিন, অ্যাস্টেরিক্স, আনন্দমেলার প্রকাশনী আনন্দ পাবলিশার্সে যাওয়ার আমার কত বছরের শখ! কোলকাতায় এসে যদি না যাই এখানে, তাহলে আমার কিছুতেই চলবে না। জোড়াসাঁকো বাদ দিতে পাড়ি কিন্তু কলেজ স্ট্রিট- নেভার! নাজ হোটেলে বসে নাশতার টেবিলে বসে বিস্তর আলোচনা করে শেষমেশ ঠিক করলাম, যাই হোক ‘স্টিক টু দ্যা প্ল্যান’ থাকি।
নাশতা খেয়ে দেয়ে আমরা বের হয়ে গেলাম। রফি আহমেদ স্ট্রিটে উঠে ট্রামের জন্য অপেক্ষা করলাম খানিক্ষন। আগেরবার ট্রামে চড়া হয় নাই। তাই এবার ট্রামে না চড়লেই নয়। ট্রাম আসলে আমরা উঠে পড়ি ট্রামে। মোটামুটি খালিই ট্রাম। আমাদের নিয়ে গদাই লস্করি চালে ট্রাম চলতে লাগলো। এতই ধীরে ধীরে যাচ্ছিলো যে আমাদের মনে হলো হেঁটে গেলেই বোধহয় এর চেয়ে তাড়াতাড়ি যেতে পারতাম। অনেকক্ষণ ধরে চড়ার পর নানা রকম জ্যাম ঠেলেঠুলে ট্রাম আমাদের পার্ক স্ট্রিট নামিয়ে দিলো। পার্ক স্ট্রিটে নেমে আমরা একটা লোকাল বাসে উঠলাম। মোটামুটি ভিড় ছিলো বাসে। আমরা কোনমতে ফাঁক ফোকর দিয়ে বসার জায়গা ম্যানেজ করলাম। প্রচন্ড গরমে বাসের ভিতর আমরা দরদর করে ঘামতে লাগলাম। অনেক রাস্তা পার হয়ে, জ্যাম পার হয়ে শেষমেশ আমরা গড়িয়াহাটে পৌঁছালাম। বাস থেকে নেমে আমাদের মনে হলো- আহ কি শান্তি!
গড়িয়াহাটকে আমি মনে করেছিলাম আমাদের মিরপুর বেনারসি পল্লীর মতন হবে বোধহয়। কিন্তু আমার আইডিয়া ঠিক হলো না। আমরা এদিক ওদিক তাকিয়েও কোন শাড়ির দোকান দেখলাম না। অন্তরা লোকজনকে শাড়ির দোকান কোথায় সে কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলো। সবাই বললো সামনের দিকে হাঁটতে। আমরাও হাঁটতে লাগলাম। হঠাৎ দেখা পেলাম ‘আদি ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়’। রুবাইদা জানালো এটা নাকি বিখ্যাত দোকান। আমিও তাই আগ্রহী হয়ে উঠলাম, বিখ্যাত দোকান বলে তো কথা! ঢুকে আমাদের কাছে আহামরি কিছু লাগলো না। খুব বড় কোন দোকান না। সব সুতি টাইপের কাপড়ের শাড়ি আর ধুতি। রুবাইদা তো চিন্তা করতে লাগলো ধুতির কাপড় দিয়ে দেশে গিয়ে আংকেলের জন্য পাঞ্জাবি বানাবে কিনা? আমাদের আশাহত চেহারা দেখেই হয় তো সেলসম্যানরা আমাদের দোতলায় যেতে বললো। আমরা একটা চিপা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেলাম। দোতলায় সব জমকালো শাড়ি। কিন্তু পছন্দ হবার মতন নয়। আর সাউথের দোকানগুলোতে শাড়ি দেখার একটা আরাম ছিলো, এখানে এসে সেটা পাচ্ছিলাম না। এখানকার সেলসম্যান আমাদের দেখে জানতে চাইলো কি শাড়ি দেখতে এসেছি, নিজের জন্য শাড়ি না মায়ের জন্য শাড়ি- এইসব ফালতু কথা বার্তা। আমরা শাড়ি নিয়ে আগ্রহী হচ্ছিলাম না বলে হটাৎ করে বললো, ‘বুঝেছি, ছোটরা এসেছো বলে পছন্দ করতে পারছো না, তাই তো?’ আমরা মুখ টিপে হাসতে লাগলাম। তারপর লোকটা বললো, ‘কার সাথে এসেছো এখানে?’ এই কথা শুনে আমরা আরও হাসতে লাগলাম। ‘কারও সাথে আসি নাই’- আমাদের মুখে এই জবাব শুনে লোকটা কেমন যেন বোকা বনে গেলো। এবার সিরিয়াস টোনে জিজ্ঞেস করলো, ‘সত্যি করে বল তো, মা কি নিচ তলায় শাড়ি দেখছেন?’ আমাদের পেট ফেটে হাসি আসতে লাগলো। আমরা তাড়াতাড়ি এমন ভান করে সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে লাগলাম যেন ‘মা’কে ডাকতে যাচ্ছি। নিচে এসে দেখলাম অন্তরা কি এক ঘিচা সিল্ক নামের শাড়ি আবিষ্কার করেছে। শাড়িটা দেখতে স্মার্ট কিন্তু দামটা অতিরিক্ত বেশি।
খালি ধুতির কাপড় কিনেই আমরা বের হয়ে গেলাম ‘বিখ্যাত’ দোকান থেকে। সবাই মনে মনে একটু আশাহতও হলাম। আমরা গড়িয়াহাটের দোকানগুলোকে ঠিক পছন্দ করতে পারছিলাম না। আর রাস্তার দুপাশ জুড়েও সব শাড়ির দোকান না। বেশ খানিকক্ষন পরপর একেকটা দোকান। আমরা ঢুঁ মেরে ঢুকি, আর ঠিক সেভাবেই বের হয়ে যাই। শাড়ি দেখে ভালো লাগে না। বরং রাস্তার চওড়া ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে আমাদের ভালোই লাগছিলো। আবার ফুটপাথের পাশেই নানারকম ফেরিওয়ালা জিনিসপত্র নিয়ে বসে আছে। ব্যাগ, জুয়েলারি, ওয়ান পিস, স্যান্ডেল এইসব জিনিসপত্র সাজিয়ে বসে আসে লোকজন। আবার অনেককে দেখলাম কতগুলো বই খুলে সাজিয়ে বসে আছে। বুঝতে পারলাম, ওনারা হাতে মেহেদি পরিয়ে দেয়। বইগুলোতে নানারকম নকশা আছে। মহিলারা এসে যেই ডিজাইন দেখিয়ে দেয়, ওনারা সেই অনুযায়ী হাতে নকশা করে দেয়। একটা ব্যাপার হাস্যকর লাগলো, আমাদের দেশে সব জায়গায় মেয়েরাই মেহেদি আর্টিস্ট হয়। ছেলে মেহেদি আর্টিস্ট এই প্রথম দেখলাম আমি।
আমরা এমনি এমনি ঘুরতে ঘুরতে ‘প্রিয় গোপাল বিষয়ী’ নামের একটা দোকানে ঢুকলাম। নিচ তলায় হঠাৎ করেই ছেলেদের পাঞ্জাবী পেয়ে গেলাম। রঙ্গিন পাঞ্জাবিগুলো সিম্পলের মধ্যে বেশ সুন্দর। রুবাইদা বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছিলো। হঠাৎ ও একটা পাঞ্জাবির দাম জিজ্ঞেস করলো লোকটা জবাব দিলো, ‘৬০০ রুপি’। আমাদের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। মাত্র সাত আটশ টাকায় আমাদের দেশে এরকম কোন পাঞ্জাবিই পাওয়া যায় না। এত সস্তা পাঞ্জাবি! রুবাইদা একটা পাঞ্জাবি খুলে দেখাতে বললো। ভাঁজ করা পাঞ্জাবিটা খোলার সাথে সাথেই সাদা একটা পায়জামা বের হয়ে আসলো। রুবাইদা জিজ্ঞেস করলো ‘পায়জামার দাম কত?’। লোকটা বললো, ‘পায়জামা সহই দাম ৬০০ রুপি’। এবার আমরা আক্ষরিক অর্থেই চিৎকার করে উঠলাম, ‘পা-য়-জা-মা সহ ৬০০ রু-পি-ই-ই! অবিশ্বাস্য কমদাম’। সেলসম্যান বোধহয় ঘাবড়ে গেলো আমাদের রিঅ্যাকশন দেখে। কিন্তু তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। আমরা সত্যিই ঝাঁপিয়ে পড়লাম পাঞ্জাবী কিনতে। রুবাইদা ওর বাবা আর ভাইয়ের জন্য দুইটা, আমি আমার বাবা, ভাই আর মামার জন্য তিনটা, অন্তরা ওর বাবা আর ভাইয়ের জন্য দুইটা করে পাঞ্জাবি চয়েস করলাম। বিল মিটিয়ে দিয়ে আমরা খুশি খুশি মনে পাঞ্জাবি কিনে দোকান থেকে বের হয়ে আসলাম।
আরও খানিক্ষণ এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করলাম আমরা। সবশেষে মিম একটা দোকান থেকে ওর বাবার জন্য পাঞ্জাবি কিনে নিলো। আমরা আর ঘোরাঘুরি করার আগ্রহ পেলাম না। শাড়ির দোকানগুলো দেখে বেশ বিরক্ত লাগছিলো। সাউথের এত চমৎকার শাড়ির কালেকশনসমেত দোকানগুলোকে আমরা ভুলতেই পারছিলাম না। সেটার তুলনায় কোলকাতার শাড়িগুলোকে ‘খ্যাত’ লাগছিলো। আর শাড়ি দেখার মধ্যেও আনন্দ পাচ্ছিলাম না। সাউথে শাড়ি কিনে আমাদের মাথা এমনই আউলে গেছে যে নামকরা গড়িয়াহাটে এসে আমরা কেউই কোন শাড়ি পছন্দ করতে পারছিলাম না বরং এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা একটা বাসে চড়ে বসলাম। গন্তব্য বড় বাজার। উর্মির কাছে শুনেছিলাম, বড় বাজারে পাইকারি দামে চকোলেট আর কসমেটিক্স পাওয়া যায়। সেই উদ্দেশ্যেই রওয়ানা দিলাম।
জ্যাম ঠেলেঠুলে গঙ্গার পাড় দিয়ে বাস আমাদের নিয়ে চলতে লাগলো বড় বাজার। অন্য দুইজন শাড়ি পরা মহিলার সাথে আমিও ইঞ্জিনের ধার ঘেঁষে লম্বা সিটে বসেছিলাম। ওনারা পূর্বপরিচিত কারণ দুইজনই কোন একজনের আচরনে খুব কষ্ট পেয়েছেন, সেই কথাই আলোচনা করছিলেন। আমিও বসে বসে সেই আলোচনা শুনছিলাম। বেশ অনেকক্ষণ জার্নি করে আমরা পৌঁছালাম বড়বাজার। বাস থেকে নেমেই মনে হলো, এখানে আসাটা মনে হচ্ছে ঠিক হয় নাই। জায়গাটা আমাদের দেশের কাওরান বাজারের মতন অনেকটা। রাস্তাঘাটে প্রচুর ভিড়, প্রচুর লোক হাঁটাহাঁটি করছে। ছোট ছোট দোকান উপচে পড়া সস্তা জিনিসপাতি। আমরা খানিকক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরলাম। লোকজনের ধাক্কা খেয়ে শেষমেষ বুঝতে পারলাম এইখানে কোন সুবিধা করতে পারবো না। বাকি সবাই অস্থির হয়ে যেতেই আমরা চট করে একটা বাসে চড়ে বসলাম। বাসটা আমাদের নিয়ে গেলো কলেজ স্ট্রিট।
কলেজ স্ট্রিট নেমে হাঁপ ছেড়ে বাঁচালাম। বাস থেকে নেমেই আমরা লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম আনন্দ পাবলিশার্সের কথা। সেই ডিরেকশন মতন চলতেই প্রথমে চোখে পড়লো একটা শাড়ির দোকান ‘আদি মোহিনী মোহন কাঞ্জিলাল’। নাম দেখেই অন্তরা খুব আগ্রহী হয়ে উঠলো। আমরা ভিতরে ঢুকতেই অসম্ভব কড়া মেকাপ দেওয়া একজন মহিলা আমাদের দেখে মিষ্টি একটা হাসি দিলো। তারপর উনি কতগুলো লোকজন ডেকে আমাদেরকে উপরে নিয়ে যেতে বললেন। আমরা সরু, চিপা পথ দিয়ে হেঁটে একটা সিঁড়ি পেলাম। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই দেখলাম এই মহিলার শাড়ি পরা বড় বড় ছবি দেওয়ালে টানানো। বুঝলাম ইনি হচ্ছেন মডেল। দোতলায় উঠে আমরা এসি দেওয়া জায়গা পেলাম। কলকাতায় এই একটা দোকানে দেখলাম ছোট ছোট খোপ খোপ করে বিভিন্ন রকম শাড়ি নিয়ে একেকজন বসে আছেন। যেন আমাদের হকার্স মার্কেটের আট দশটা দোকান নিয়ে এই একটাই দোকান। অনেকক্ষণ দেখেটেখে অন্তরা শেষ পর্যন্ত একটা শাড়ি কিনে ফেললো। আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে ওনারা বারাবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো, দিদির সাথে দেখা হয়েছে কিনা? দিদি কে- জানতে চাইলেই ওনারা চোখ কপালে তুলে এমন ভঙ্গি করলেন যেন বাংলাদেশে থেকে দিদিকে না চেনাটা খুবই আশ্চর্য বিষয়। ওনাদের কথা শুনে বুঝতে পারলাম এই মহিলা শুধু মডেলই নন, ইনি সম্ভবত বিখ্যাত নায়িকা। ওনাকেই সবাই দিদি বলে ডাকে।
এখান থেকে বের হয়েই একটা রাস্তার ধারের দোকানে বসে লুচি আর ভাজি খেয়ে নিলাম। তারপর মিম আর অন্তরা গেল ওদের এক পরিচিত আংকেলের সাথে দেখা করতে, আর আমার পাল্লায় পড়ে রুবাইদা গেলো আনন্দ পাব্লিশার্সের শোরুম খুঁজতে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে পেয়ে গেলাম সেই কাংখিত দোকান- আমার স্বপ্নের জায়গা ‘আনন্দ পাব্লিশার্স’। কাঁচের দরজা ঠেলে দোকানে ঢুকতেই একটু ধাক্কা খেলাম- এত ছোট্ট দোকান! আমার কল্পনার আনন্দ পাব্লিশার্স অনেক বড়, সেখানে লাইব্রেরির মতন তাকে তাকে বই সাজানো থাকবে। বই খুঁজতে খুঁজতে দুই একটা মানুষ হারিয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু যেন- এরকমই আমি মনে মনে ভেবেছিলাম। কিন্তু এ কি দেখছি? এ তো আমাদের বইমেলার স্টলগুলোর সমান সাইজের একটা দোকান। দেওয়াল জুড়ে তাকের মধ্যে বই সাজানো, কিন্তু অনেক ফাঁকা ফাঁকা। একটা কমবয়সী ছেলে অলস ভঙ্গিতে কাউন্টারে বসে আছে আর আরেকজন লোক মাঝ বয়সী কি সব হিসাব নিকাশ করছে। আমি ঢুকেই জিজ্ঞেস করলাম এটাই কি আপনাদের দোকান নাকি আরও দোকান আছে। মাঝ বয়সী লোকটা মাথা তুলে জবাব দিলো, ‘না এটাই আমাদের একমাত্র দোকান’। যাই হোক আমি ইতি উতি করে তাকিয়ে বই খুঁজতে লাগলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই কয়েকজন সিনিয়র আপু ভাইয়া এসে হাজির হলো। আমরা আনন্দের সাথে আপুদের সাথে মোলাকাত করলাম। ওনারাও ঢুকে একই প্রশ্ন করলো, ‘এটাই দোকান, নাকি আরও কিছু আছে?’ । ওনারাও কিছু বইপত্র কিনে চলে গেলো। ওদিকে মিম আর অন্তরাও হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির। মিমও একই এক্সপ্রেশন দিলো, ‘এত ছোট দোকান!’। আমাদের রহস্যজনক অভিব্যাক্তি দেখে মাঝবয়সী লোকটা কাউন্টারে ছেড়ে উঠে আসলো। উনি কৌতুহলী হয়ে আমাদের সাথে কথা বলতেই বের হয়ে গেলো আমাদের ‘ইন্ডিয়া কলিং’ এর সারকথা। ভদ্র লোক চোখ কপালে তুলে ফেললেন, ‘মাই গড, বাংলাদেশ থেকে-’ উনি নিজের পরিচয় দিলেন জয়ন্ত দাস নামে। আমাদের উনি সাহায্য করলেন বই খুঁজে বের করতে। কয়েকটা বই চাইতেই উনি লোক পাঠিয়ে কোথা থেকে যেন এনে হাজির করলেন। তারপর কি কি যেন অফার আছে, সেইসব দিয়ে আমাদের বইয়ের দাম কমিয়ে দিলেন। সব শেষে সুন্দর করে আমাদের গাদা গাদা বই প্যাক করে দিলেন। তারপর এক গাদা বুকলিস্ট দিয়ে উনি নিজের নাম আর ফোন নম্বর লিখে দিলেন। বললেন দেশে ফিরে যেন ওনাকে একটা পৌঁছ সংবাদ পাঠাই। ওনার কাছ থেকে আরও একটা ইংলিশ বইয়ের দোকানের ঠিকানা আর হাতে আঁকা ম্যাপ নিয়ে বের হয়ে গেলাম আমরা।
আনন্দ থেকে বের হয়ে আমরা চলে গেলাম কফি হাউজ। আবার সেই আগের জায়গা। দোতলায় গিয়ে বসলাম আমরা। অর্ডার দিলাম কোল্ড কফি। খানিক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে কফি খেয়েদেয়ে কফি হাউজকে বিদায় জানিয়ে বের হয়ে আসলাম। ততক্ষনে সূর্য ডুবে গেছে। ম্যাপ ধরে ধরে অন্ধকারের মধ্যে রাস্তা খুঁজে খুঁজে বের করে ফেললাম ‘ইন্ডিয়ানা’ নামের দোকানটা। দোকানের সামনের দিকটা বন্ধ। আমরা ঘুরে গলির ভেতর দিয়ে পিছনের দরজার দিকে হাজির হলাম। দোকানটাতে ঢুকার কোন জায়গা নাই। সারা দোকান জুড়েই স্তুপ করে রাখা বই। আমাদের মধ্যে মিম একমাত্র দোকানটার ভিতরে গিয়ে বলে আসলো যে আমরা বই কিনতে এসেছি। দোকানের লোকজন একটু ইতস্তত করতে লাগলো। বুঝলাম ওনারা একটা মেলায় অংশগ্রহন করেছিলেন। আজকে ছিল সেই মেলার শেষদিন। তাই মেলার সব বই এনে টাল করে দোকানে রাখা হয়েছে। এজন্য দোকান জুড়েই খালি বই আর বই। অন্য সবার জন্য দোকান বন্ধ থাকলেও আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি আর জয়ন্ত দাস পাঠিয়েছে শুনে এই অবস্থার মধ্যেও ওনারা কয়েকজন বের হয়ে আমাদের দোকানে ঢুকার ব্যবস্থা করে দিলেন। আমাদের হাতের মালপত্র সব বাইরে রেখে আমরা চারজন মানুষ কোনমতে দোকানের ভিতরে ঢুকে পড়লাম। এইরকম বাজে দিনে এসেছি বলেই হয়েতো ওনারা সব বইয়ের দাম অনেক কমিয়ে রাখলেন। আমরাও দুই হাত ভরে কিনতে লাগলাম। ইতিহাস, থ্রিলার থেকে শুরু করে বাচ্চাদের এবিসিডির বই কিছুই বাদ গেলো না। অনেক বই ওনারা আমাদের দিতে পারছিলেন না, কারণ সেগুলো অনেক ভিতরে। বারবার বলছিলেন যেন আগামীকাল আসি। ওনারা দোকানটা গুছিয়ে নিলেই আমাদের পছন্দ মতন সব বই ওনারা হাজির করতে পারবেন। যাই হোক আমরা সব বইয়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে ভারী ভারী সব বইয়ের বোঝা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসলাম। ততক্ষণে বেশ রাত হয়ে গেছে। দোকানের লোকজনই আমাদের ট্যাক্সি ঠিক করে দিলো। ট্যাক্সিতে আমাদের গাদাগাদা বইয়ের প্যাকেট তুলে দিয়ে আমরা উঠে বসলাম। রাতের বেলায় ট্যাক্সি আমাদের নিয়ে ছুটলো দিদার বক্স লেনের দিকে।
হোটেলে পৌঁছে আমাদের বইয়ের বোঝা কোনরকম রুমে জায়গা করে ঢুকালাম। তারপর খেতে নামলাম নিচের নাজ হোটেলে। খুব সস্তায় সেখানে শিক কাবাব পাওয়া যায়। আট রুপি করে একেকটা শিক কাবাব। আমরা রুটি আর শিক কাবাব অর্ডার দিলাম। খেতে অত ভালো ছিলো না। যাই হোক কোন রকম খেয়েদেয়ে রুমে ফেরত গেলাম। রুমে গিয়ে শুনতে পেলাম ডিসিশন ফাইনাল, আরও দুই দিন আমরা কোলকাতায় থাকবো। তারপরের দিন রওয়ানা দিবো দেশের পথে। এর মধ্যে আগামীকাল রাতে আমাদের ফল পার্টি হবে আর শেষদিন রাতে থাকবে মুভি দেখা আর ডিনার।
হাতে সময় আছে দেখে ভাবছিলাম শান্তিনিকেতন ঘুরে আসা যায় কিনা। তানভীরের সাথে এই নিয়ে কথাও বললাম। শুনলাম শেয়ালদা স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ে সোজা শান্তিনিকেতন গিয়ে পৌঁছায়। কেমন করে শেয়ালদা যাওয়া যায় সেইটা নিয়ে অনেকক্ষণ কথাবার্তাও হলো। অনেকক্ষণ কথাবার্তা হওয়ার পর আমরাই বুঝতে পারলাম যে, মনে হয় যাওয়া হবে না। যাই হোক, রাত হয়েছে- সবাই যার যার ছোট্ট রুমে ঢুকে পা ভাঁজ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ভাঁজ করা পা নিয়ে শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে গেলাম।
The Mighty INDIA CALLING: চেন্নাই টু কোলকাতা আমাদের শেষ ট্রেন জার্নি (পর্ব ৩৮)
ট্রেনে আমি যে গভীর ঘুম দিয়েছিলাম, সেকথা বোধহয় বলার আর প্রয়োজন নাই। আমার অত্যন্ত গাঢ় ঘুমটা ভাংলো রুবাইদার ডাকে। আড়মোড়া ভেঙ্গে যখন উঠলাম চোখ ডলতে ডলতে, তখন বাইরে ঝলমলে দিন। ঘড়ি দেখে চমকে উঠলাম, সর্বনাশ- এ যে দেখি সাড়ে দশটা বাজে! আমি ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম- সবাই উঠে পড়েছে। আমিও দেরি না করে উপর থেকে নেমে পড়লাম।
স্পঞ্জের স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে ছুটলাম বেসিনের দিকে। চোখে মুখে পানি দিয়ে আসলাম। ফ্রেশ হয়ে সিটে এসে বসে মনে হলো কিছু খাওয়া প্রয়োজন। ট্রেনের লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম কি নাশতা পাওয়া যাবে এখন। বুঝতে পারলাম দেরি হয়ে যাওয়ায় সব পাউরুটি অমলেট শেষ হয়ে গেছে। এখন কোন নাশতা নাই। তবে ঘন্টা খানেক পরে দুপুরের খাবার পাওয়া যাবে। কি আর করা! একেবারে দুপুরেই না হয় খেয়ে নিবো।
কিন্তু রুবাইদা থাকতে আমার চিন্তা কি? রুবাইদা চটপট ব্যাগ থেকে ওর কিনে রাখা পাউরুটির প্যাকেট বের করলো। তারপর মিনিপ্যাক জেলি মাখিয়ে দিয়ে দুইটা পাউরুটির স্যান্ডউইচ বানিয়ে আমার হাতে তুলে দিলো। আমিও মজা করে খেয়ে ফেললাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমি পা তুলে দিয়ে সিটের উপর বসলাম। জানালা দিয়ে তখন রোদ গলে আসছে। এর মধ্যে আমরা গল্প করতে শুরু করলাম। ওদিকে অন্য বগি থেকেও আমাদের লোকজন আমাদের খোপের দিকে আসতে লাগলো। আমরা সবাই গাদাগাদি করে বসলাম। কে যেন বের করলো ‘উনো’র কার্ড। ব্যাস সাথে সাথে শুরু হয়ে গেলো খেলা।
আমি আগে কখনও উনো খেলি নাই। আমাকে সবাই মিলে নিয়ম কানুন শিখিয়ে দিলো। বেশ সোজা নিয়ম, খেলা বুঝতে কোন কষ্টই হলো না। আমিও খেলতে নেমে গেলাম। দারুণ মজা হতে লাগলো। আমরা দারুণ হৈ চৈ করে খেলতে লাগলাম। আমাদের চিৎকার চেঁচামেচির কারণে সারা ট্রেনের সকল স্টাফদের মধ্যে খবর রটে গেল যে বাংলাদেশ থেকে বিশাল একদল ছেলেমেয়ে এসেছে- এবং তারা সারা ট্রেন জুড়েই অবস্থান করছে। ওদের আর কি দোষ, আমরা এতগুলো মানুষ এমনভাবে ট্রেনে আড্ডা দিচ্ছিলাম যে সত্যিই ব্যাপারটা বোঝা কষ্টকর যে কার সিট আসলে কোথায়। একটু পর পর যারা আমাদের পাস করে যাচ্ছিলো তারা অনেকেই বলতে লাগলো, ‘আপনাকে না একটু আগে ঐ পাশের বগিতে দেখেছিলাম, আপনি এখানে কেন?’
দারুণ জমজমাট খেলা হলো আমাদের উনো। আশেপাশের বগি থেকে অনেক লোকজন মিলে বিশাল দলে আমরা উনো খেলছিলাম। অনেক হাসি, ঠাট্টা, চুরির মধ্য দিয়ে এক সময় শেষ হলো উনো খেলা। ওদিকে আমাদের দুপুরের খাবার চলে আসলো। আমি আর রুবাইদা দুজনে মিলে অর্ডার দিয়েছিলাম ১৩০ রুপির সবজি, ডিম আর ভাত। ট্রেনের খাবার কখনই মজা হয় নাই। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। মোটামুটি করে আমরা দুইজন খেয়ে নিলাম। খাওয়া দাওয়া শেষে আবার আমরা বসলাম আড্ডা দিতে। এর মধ্যে উড়ো খবর আসতে লাগলো, কমিটি থেকে আমাদের অ্যালাউয়েন্স দেওয়া হবে। আমরা জল্পনা কল্পনা করতে লাগলাম এবার ৫০০ নাকি ১০০০ রুপি আমাদের দেওয়া হবে সেইটা নিয়ে। আমাদের অবাক করে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে রিজভী আর শুভ আমাদের প্রত্যেকের হাতে ৩০০০ করে রুপি ধরিয়ে দিলো। আমরা খুশিতে হত বিহ্ববল হয়ে গেলাম। এমনিতেও শেষের দিকে এসে অনেকের টাকা পয়সার টানাটানি পড়েছে। এই অভাবের মধ্যে ৩০০০ রুপি আমাদের কাছে এক বিশাল নিয়ামত বলে মনে হলো। আমরা খুশিতে বাকবাকুম হয়ে গেলাম।
দিনটা অনেক ঝকঝকে ছিলো। তার উপর তেমন কোন গরম ছিলো না। তাই জার্নিতে আমাদের তেমন কোন কষ্ট হচ্ছিলো না। এজন্য জার্নিটা আমরা খুবই উপভোগ করছিলাম। মৌলিকে দেখলাম জানালার উপর মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে গান শুনতে। খানিক পরে ও উঠে এসে আমাকে বললো, ‘আমার এত ভালো লাগছিলো যে বলার মতন না। আমার মনে হচ্ছিলো যে সারাটা জীবন যদি এভাবেই জানালায় মাথা রেখে থাকতে পারতাম……’
আমাদের ট্রেন চলতেই লাগলো। একেকটা স্টেশনে ট্রেন থামে অনেক মানুষ উঠে আর অনেক মানুষ নেমে যায়। অনেকে স্ট্যান্ডিং টিকেট কাটে, অনেকে কোন টিকেটই কাটে না। আমাদের সিট গুলোতে ফাঁক ফোকর পেয়ে অনেকেই বসে পড়ে। আমাদের কাছে বিষয়টা বিরক্তিকর লাগে, চেনা নাই জানা নাই -হুট করে একজন মানুষ পাশে বসে পড়বে কেন? আমরা মাঝে মাঝে আমাদের সিটে ব্যাকপ্যাক গুলো রেখে দিয়ে ব্লক করে রাখার চেষ্টা করি। কোন কোন সময় তাতেও কাজ হয় না। এরকম করেই জাফরের পাশে এক সাউথ ইন্ডিয়ান দম্পতি বসে পড়লো। তাদের বয়স আমাদের চাইতে খুব একটা বেশি না। লোকটা জাফরের সাথে বেশ আগ্রহ নিয়ে কথা বলছিলো। অবশ্য আমরা একজন আরেকজনের সাথে যেভাবে ডাকাডাকি করে কথা বলছিলাম- আমাদের বিষয়ে জানতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক! কথায় কথায় যখন তারা আমাদের কাহিনী সব শুনলো, তারা আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠলো। লোকটা জাফরের সাথে অনেক্ষণ কথা বললো। জানতে চাইলো বাংলাদেশ নিয়ে। মহিলাটাও কথা বললো। এক পর্যায়ে জাফর মানিব্যাগ থেকে বাংলাদেশি টাকার নোট বের করে দেখালো। ওনারা খুব উৎসুক দৃষ্টিতে নেড়েচেড়ে নোটটা দেখলেন। তারপর ওনাদের স্টেশন এসে গেলে ওনারা জাফরকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়।
ওদিকে আমাদের পাশের খোপে উর্মির সাথে এক ভদ্রলোক বেশ গল্প জুড়ে দিলেন। উনি মনে মনে ভেবেছিলেন যে আমরা বেড়াতে যাচ্ছি আর রুবাইদা হচ্ছে আমাদের লিডার। উর্মির মুখে এই কথা শুনে রুবাইদাসহ আমরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলাম। ইতোমধ্যে আমাদের এখানে খেলতে আসা শুভকে রুবাইদা একবার পাউরুটি জেলি আরেকবার পানির বোতল দিয়ে সাহায্য করায় শুভ রুবাইদাকে উপাধি দেয়, ‘অ্যাঞ্জেল ফ্রম হেভেন’। কোন কাজ নাই দেখে আবার শুরু হয় উনো খেলা। তাসের চাইতে উনো খেলা বেশ জমে ওঠে। আমরাও খুব মজা নিয়ে খেলতে থাকি।
আস্তে আস্তে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে থাকে। একসময় সূর্যটা ডুবে যায়। ট্রেনের বাতি জ্বলে ওঠে। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আমাদের ট্রেন চলতে থাকে। আমরা অলস গল্পগুজব করতে থাকি একজন আরেকজনের সাথে। ওদিকে পাশের খোপে উর্মি আর সৌরভের সাথে আরেক ভদ্রলোকের বেশ খাতির হয়ে গেলো। ইনি বিএসেফের সদস্য। বাংলাদেশকে খুব ভালোই চেনেন! আমাদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত শুনে বেশ খুশি হলেন। এক পর্যায়ে উনি ব্যাগ থেকে একটা বড়সড় চায়ের প্যাকেট আর মাথা ব্যাথার বাম বের করে আমাদের জন্য উপহার হিসেবে উর্মির হাতে তুলে দিলেন। ওদিকে অদিতি আর উর্মিও বুদ্ধি করে চাবির রিং বের করে ওনাকে উপহার দিয়ে দিলো।
প্রতি ট্রেন জার্নির মত এবারও আমি বোতল কেটে বদনা বানিয়েছিলাম। সেগুলো ভালোই কাজ দিচ্ছিলো। আমরা সেগুলো আমাদের সিটের নিচে রাখতাম। এর মধ্যে এক ঝাড়ুদার স্টাফ এসে আমার সব বোতল জানালা দিয়ে ফেলে দিলো। আমি চিৎকার করে বোঝাতে চাইলাম যে, প্লিজ ফেলবেন না। কিন্তু আধা কাটা বোতল না ফেলার জন্য আমি কেন চিৎকার করছি তা উনি কিছুতেই বুঝলেন না। আমাকে আবার আরেকটা বোতল জোগাড় করতে হবে ভাবতেই বিরক্ত লাগলো। পরে খালি বোতল জোগাড় হলে যখন আমি কাটতে উদ্যত হলাম, তখন জুবায়ের বোতলে ছিদ্র করে আরও একধাপ উন্নত বোতল বদনা তৈরি করে দিলো।
ওদিকে হঠাৎ দেখলাম আমাদের বগির বাথরুমের সামনে কয়েকজন ভারতীয়র সাথে সাদা চামড়ার দুজন ছেলেমেয়ে বিশাল বিশাল দুইটা হ্যাভারস্যাক নিয়ে পাংশু মুখে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। আশেপাশের লোকজন ড্যাব ড্যাব করে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে দুর্গন্ধযুক্ত জায়গায় চুপ চাপ বসে আছে। আমার খারাপই লাগলো তাদের জন্য। আহারে, কোন বিপদে পড়ে না জানি এরকম কষ্ট করতে হচ্ছে তাদের।
ইশতিয়াকের সাথে আমার অনেক লম্বা সময় জুড়ে গল্প হলো। ওদিকে রাতের খাবারও চলে আসতে থাকে। আমি আর রুবাইদা নেই ভেজ মিল। তাতে ছিলো ভাত, রুটি, সবজি আর ডাল। রাতের খাবার খেয়ে দেয়ে সবার মধ্যে কেমন যেন একটা খালি খালি ভাব চলে আসলো। এটাই আমাদের শেষ ট্রেন জার্নি। এই রাতই আমাদের ট্রেনে শেষ রাত। আমরা স্বপ্নময়ী একটা ট্যুরের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি। এই যে এত হাসি, আড্ডা, মজা- এগুলো আর কখনও একসাথে হবে কিনা জানি না। ট্যুরের একটা একটা করে পর্ব শেষ হয়ে গিয়েছে। আগামীকাল ইনশাল্লাহ কোলকাতা পৌঁছালে শুধু দেশে ফেরার পর্বটাই বাকি থাকবে। আমরা ঘুমানোর আগে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। এই বিদায় নিতে নিতেই অনেক রাত হয়ে গেলো। তারপর আমরা শুয়ে পড়লাম একে একে।
একসময় ট্রেনের বাতি নিভে গেলো। আমাদের দুই চোখ বেয়ে ঘুম নামলো। ইন্ডিয়া ট্যুরের শেষ ট্রেন জার্নিতে শেষ ঘুম।
The Mighty INDIA CALLING: গোয়ার পথে ঘাটে সারাদিন ঘোরাঘুরি (পর্ব ২৯)
সকালে ঘুম ভাংলো একটু হৈ চৈয়ে। মজুমদারের ফোনটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ও সারা রুম তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলো। আমাদের সবাইকে জিজ্ঞেস তো করলোই, নিচে গিয়েও সবাইকে বলতে লাগলো ওর ফোনের কথা। ওর ফোনে আমাদের ট্যুরের গাদাখানেক ছবি আছে। ফোন হারিয়ে গেলে তো বেশ চিন্তার বিষয়। যাই হোক হাত মুখ ধুয়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে আমরা ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলাম। সবাই একবার বিচে যাওয়ার প্ল্যান করলাম। সকালবেলার হাল্কা রোদে নিরিবিলি বিচে দাঁড়িয়ে আমরা সমুদ্র দেখতে লাগলাম। খুব ভালো লাগছিলো আমাদের। কিন্তু নাশতা করা হয় নাই। তাই আমরা বেশিক্ষণ থাকলাম না। আবার হোটেলের দিকে রওয়ানা দিলাম।
নাশতা খেতে ঢুকলাম ভিন্সি’স প্লেসে। নাশ্তার মেনু দেখে অর্ডার দিলাম ব্রেড উইথ ফ্রায়েড এগ। আমার পাশে সুমাইয়া দিলো ব্রেড উইথ অমলেট। তারপর অর্ডার আসলে আমি খেলাম সুমাইয়ারটা আর সুমাইয়া খেলো আমারটা। বড় বড় টোস্ট করা পাউরুটির সাথে সুন্দর করে ভাজা ডিম। খেতে ভালোই ছিলো। ওদিকে অন্তরার ফিশ অ্যান্ড চিপসও টেস্ট করে দেখলাম। আমরা খেতে খেতে গল্প করছিলাম। খাওয়া শেষে ৪০ রুপি বিল মিটিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেলাম ভিন্সি’স প্লেস থেকে।
এবার আমরা হাঁটতে লাগলাম রাস্তা ধরে। একম একটা রাস্তা যে রাস্তায় আগে যাই নাই। ধীরে সুস্থে আমরা দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগলাম। গোয়ার ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, মানুষজন- সব কিছু একটু আলাদা। রাস্তা দিয়ে প্রচুর মটর সাইকেল যাচ্ছে। টুরিস্টদের জন্য ২০০-৩০০ রুপি দিয়ে সারাদিনের জন্য একটা মটর সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ গোয়া দেখতে একেবারে সেই রকম ঠিক সিনেমাতে যেমনটা দেখা যায়! আমাদের সামনে অনেকগুলো দোকানপাট চোখে পড়লো। নানা রকম জুয়েলারি সাজিয়ে রেখেছে দোকানে দোকানে। আমর এদিক ওদিক ঢুঁ মারতে লাগলাম। এক দোকানে ঢুকে সবাই নানা রকম জুয়েলারি পছন্দ করতে লাগলো। সবগুলো দোকানেই দাম একটু বেশি মনে হচ্ছিলো। কিন্তু সেই দোকানে আমাদের সব কিছুরই দাম কমিয়ে দিবে বললো। আমরাও উৎসাহ পেয়ে জিনিসপত্র দেখতে লাগলাম। আমরা সবাই মিলে বেশ কিছু জিনিস কিনলাম। দোকানদার আমাদের সবাইকে একটা করে ছোট আয়না উপহার দিলো। দোকান থেকে বের হতেই রুবাইদার সাথে দেখা হলো। রুবাইদা একটা তালপাতার মেক্সিকান হ্যাট কিনেছে। বিশাল মেক্সিকান হ্যাটটা দেখতে খুবই সুন্দর।
আমরা হাঁটতে হাঁটতেই ঠিক করলাম যে আমাদের কালাঙ্গুটে বিচ থেকে দূরে বাগা বিচের দিকে যাবো। তবে ঠিক বিচ ধরে নয়, রাস্তা ধরে শহর দেখতে দেখতে। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে যাচ্ছে দেখে নিশাতই অফার দিলো গতরাতের ভিক্টোরিয়াতে ঢুঁ মারার জন্য। আমরা হেঁটে হেঁটে ভিক্টোরিয়াতে ঢুকে পড়লাম। অনেক দেখেটেখে অর্ডার দিলাম প্রন নুডুলস। অনেক প্রন দেওয়া গরম গরম নুডুলস আসলো। আমরা খুব মজা করে খেলাম। ১২০ রুপি বিল দিয়ে বের হয়ে আসলাম আমরা। এরপর ডক্টর আলফন্সো রোড ধরে সোজা হাঁটতে লাগলাম আমরা। গোয়ায় ট্যাটু করানোর দোকান আছে প্রচুর। এই দোকানগুলোর বাইরে বড় বড়সব কিলবিলে ট্যাটুর ছবি। আর আছে বাদামের দোকান। শুধুই বাদাম যার বেশির ভাগই কাজু। তবে দাম বেশি। এর চেয়ে অনেক কম দামে আমি মানালি থেকে বাদাম কিনেছি। এই সব দেখতে দেখতেই একটা মোড়ে এসে অনেকগুলো বড় বড় দোকানপাট পেলাম। ব্যাঙ্ক এবং মানি এক্সচেঞ্জের দোকান দেখে নিশাত আর পৃথ্বীর ডলার ভাঙ্গানোর কথা মনে পড়লো। তাই আমরা এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে সবচেয়ে ভালো ডলারের রেট আছে এমন মানি এক্সচেঞ্জ খুঁজতে লাগলাম। এরমধ্যে আমাদের সাথে দেখা হলো ফাহাদ আর তানভীরের। ওরা জুম্মার নামাজ পড়ে এসেছে। ওদের দেখে আমরা বুঝলাম আজকে শুক্রবার!
ওরাও আমাদের সাথে যোগ দিলো। সবাই মিলে একটা কাজুবাদামের দোকানে গিয়ে ডলার ভাঙ্গিয়ে নিলো। ডলার ভাঙ্গানো শেষ হলে আমরা সবাই একসাথে রওয়ানা দিলাম বাগা বিচের দিকে। ক্যাফে মোকার অনেক নাম শুনেছিলাম আমরা। একবার ভাবলাম সেখানে আগে ঘুরে আসি। একটা অটোওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতেই ভাড়া চাইলো ৩০০ রুপি। শুনেই আমরা সেই যাত্রায় মোকা যাবার প্ল্যান বাদ দিয়ে কালাংগুটে- বাগা রোড ধরে হাঁটতে লাগলাম। বেশ কিছুদূর হাঁটার পর ফাহাদ একটা দোকান দেখিয়ে বললো গতরাতে ও এখানে গিয়েছিলো। দোকানটার নাম চকোলেট রুম। আমরাও ঢুকে পড়লাম ভিতরে। দারুন সুন্দর সুন্দর সব ডেজার্ট আইটেম সাজানো সেখানে। কোনটা ছেড়ে কোনটা অর্ডার দিবো বুঝতে পারছিলাম না। শেষে ৮০ রুপির একটা চকোলেট স্মুদি অর্ডার দিলাম। স্মুদিটা এত্ত মজা, আর বলার মত না! নিচের চকোলেটটা এতই মোটা যে খেয়েই শেষ করতে পারলাম না।
খেয়েদেয়ে আবার বের হয়ে এলাম। আবার হাঁটা শুরু করলাম। পথটা খুব ছোট নয়, তার উপর আমরা ধীরে সুস্থে গল্পগুজব করতে করতে হাঁটছিলাম। তাই সময় লাগছিলো অনেক বেশি। পথের দুপাশের দোকানগুলোর জিনিস অনেক সুন্দর। ধাতব জুয়েলারি, মুক্তার নেকলেস, পাথরেরর সেটগুলো অনেক সুন্দর সুন্দর। কিন্তু দামগুলো আকাশ্চুম্বী। আমরা খালি দেখেই যাচ্ছিলাম। কেনার উদ্দেশ্য কারও ছিলো না। এই সব দামী দামী দোকান শেষ হয়ে একসময় যখন সুভেনিয়র শপ, লিকার শপ আর নাইট ক্লাব দেখা যেতে লাগলো তখনই আমরা টের পেলাম যে বিচের কাছাকাছি চলে এসেছি। সত্যি সত্যি একটু পরই বিচ চলে আসলো। গনগনে রোদে দাঁড়িয়ে আমরা সমুদ্রের দেখা পেলাম। আমরা একটু ছায়ায় দাঁড়ালাম আর ফাহাদ আর তানভীর গেলো প্যারাসেইলিং দরদাম করতে। ওরা এসে জানালো ৮০০ রুপি লাগবে, মানুষ যত বেশিই হোক- দাম বাড়বে বা কমবে না।
এই বিচের মধ্যে দাঁড়িয়ে না থেকে আমরা ঢুকে পড়লাম একটা শ্যাকে যার নাম ‘ফ্রেশ বিচ সাইড শ্যাক’। সবাই মিলে অর্ডার দিলাম পাস্তা, রেড স্ন্যাপার ফ্রাই আর স্লাইস। অর্ডার আসতে আসতে আমি টুরিস্টদের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। ভারতীয় পর্যটক ছাড়াও গোয়ায় প্রচুর বিদেশি পর্যটক আসে। এদের বড় অংশ সম্ভবত রাশিয়ান কারণ অনেক দোকানের সাইনবোর্ডে রাশিয়ান ভাষায় লিখা দেখেছি। আর বেশির ভাগ পর্যটকই বয়সে তরুন। মধ্য বয়স্ক বা একটু বয়স্ক লোকের সংখ্যা কম। পরিবার নিয়ে আসা লোক মনে হলো খুবই কম। সবাই মোটামুটি বন্ধুবান্ধবের দল নিয়েই বেশি এসেছে। এসব দেখে মনে হলো গোয়া প্রধানত ‘ফুর্তি’ করার জায়গা। বিকালের তীব্র রোদে আমরা মজাদার মাছ ভাজা খেতে খেতে হাসি আড্ডায় মেতে উঠলাম। ফাহাদ একের পর এক কথাবার্তা বলে যেতেই লাগলো আর আমরা হা হা করে হাসতে লাগলাম।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে সূর্যের তেজ কমলে আমরা বের হয়ে গেলাম। সমুদ্রের পানিতে পায়ের পাতা ডুবিয়ে হাঁটতে লাগলাম। এগিয়ে যেতে লাগলাম আমাদের কালাঙ্গুটে বিচের দিকে। রাস্তাটা নেহায়েত কম নয়। তাই আমরা হাঁটতে হাঁটতেই সূর্যটার ডোবার সময় হয়ে এলো। দিনের আলোতে সব কিছু দেখে চিনতে পারি। কিন্তু অন্ধকারে আমাদের হোটেলের সামনের বিচটা কেমন করে চিনতে পারবো সেটা নিয়ে চিন্তা করে আমরা পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু লাভ হলো না। একটু পরেই সূর্য ডুবে গেলো। আমরা জোরে জোরে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে অবাক হয়ে দেখলাম সূর্য ডোবার সাথে সাথেই সবগুলো শ্যাক থেকে চেয়ার টেবিল ধরে ধরে বাইরে খোলা আকাশের নিচে নিয়ে আসা হলো। প্রত্যেকটা টেবিলে একটা করে মোমবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। আর শ্যাকগুলোতে রংচঙ্গে বাতি জ্বলে উঠলো। দূর থেকে দেখতে ভারী সুন্দর লাগছিলো। এই দেখতে দেখতে আমরা এক সময় আমাদের হোটেলের কাছাকাছি বিচে চলে আসলাম বলে মনে হলো। সত্যি সত্যি ভালোমত খোঁজাখুঁজি করে পেয়ে গেলাম আমাদের গলিটা।
অন্ধকার হয়ে গেলেও হোটেলে ফিরে যেতে মন চাচ্ছিলো না। আমি আর সুমাইয়া একটা বিচ চেয়ারে বসে গান শুনতে লাগলাম। সুমাইয়ার মোবাইলে চলতে লাগলো, ‘মোর ভাবনারে কে হাওয়ায় মাতালো-’ । আধো অন্ধকার রাতে সমুদ্রের গর্জনের সাথে স্নিগ্ধ লোনা বাতাসে আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। আমরা ঠান্ডা বালিতে পা ডুবিয়ে অনেক্ষণ গল্প করলাম। সবসময় যে গল্প করলাম তা নয়, কখনো কখনো চুপ করে রইলাম দুইজনে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম অন্ধকার সমুদ্রের বিরামহীন আছড়ে পড়া ঢেউ। আমার কখনও রাতের সমুদ্র দেখার ভাগ্য হয় নাই। এই প্রথম অন্ধকারে সমুদ্রের অন্য এক রূপ দেখতে পেলাম। এইভাবে বসে থাকতে থাকতে অনেক সময় পার হয়ে গেলো। আমাদের মোটেও উঠতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না। কিন্তু রাত আটটা বেজে পার হয়ে গেছে। হোটেলে ফির যাওয়া প্রয়োজন। আমি আর সুমাইয়া উঠে পড়লাম। অন্ধকারে বালি পাড়িয়ে বিচ ছেড়ে ঢুকে গেলাম গলির ভেতর। হাঁটতে লাগলাম সোজা, হোটেলের উদ্দেশ্যে।
প্রথমেই হোটেলে না ঢুকে গেলাম ভিন্সি’স প্লেসে। রুবাইদাকে পেলাম সেখানে। কোনকিছু চিন্তা না করেই অর্ডার দিলাম মাশ্রুম ক্রিম পাস্তা। আবারও সেই মজাদার পাস্তা আসলো। গপাগপ খেতে লাগলাম আমি। এখানকার খাবারদাবার এত মজা যে কি আর বলবো!
খাওয়া শেষ করে সোজা হোটেলে ফিরে গেলাম। আগামীকাল প্যারাসেইলিং এর প্ল্যান করে সবাই ঘুমাতে গেলাম আমরা। আমি আবারও ফ্লোরে সটান হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সমুদ্রের বাতাসে আমার ঘুম ভালোই হতে লাগলো।