The Mighty INDIA CALLING: গোয়ার পথে ঘাটে সারাদিন ঘোরাঘুরি (পর্ব ২৯)

সকালে ঘুম ভাংলো একটু হৈ চৈয়ে। মজুমদারের ফোনটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ও সারা রুম তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলো। আমাদের সবাইকে জিজ্ঞেস তো করলোই, নিচে গিয়েও সবাইকে বলতে লাগলো ওর ফোনের কথা। ওর ফোনে আমাদের ট্যুরের গাদাখানেক ছবি আছে। ফোন হারিয়ে গেলে তো বেশ চিন্তার বিষয়। যাই হোক হাত মুখ ধুয়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে আমরা ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলাম। সবাই একবার বিচে যাওয়ার প্ল্যান করলাম। সকালবেলার হাল্কা রোদে নিরিবিলি বিচে দাঁড়িয়ে আমরা সমুদ্র দেখতে লাগলাম। খুব ভালো লাগছিলো আমাদের। কিন্তু নাশতা করা হয় নাই। তাই আমরা বেশিক্ষণ থাকলাম না। আবার হোটেলের দিকে রওয়ানা দিলাম।

এদফ
সকালবেলা শান্ত সমুদ্রের পাশে (কৃতজ্ঞতায় রেহনুমা তাবাসসুম অন্তরা)

নাশতা খেতে ঢুকলাম ভিন্সি’স প্লেসে। নাশ্তার মেনু দেখে অর্ডার দিলাম ব্রেড উইথ ফ্রায়েড এগ। আমার পাশে সুমাইয়া দিলো ব্রেড উইথ অমলেট। তারপর অর্ডার আসলে আমি খেলাম সুমাইয়ারটা আর সুমাইয়া খেলো আমারটা। বড় বড় টোস্ট করা পাউরুটির সাথে সুন্দর করে ভাজা ডিম। খেতে ভালোই ছিলো। ওদিকে অন্তরার ফিশ অ্যান্ড চিপসও টেস্ট করে দেখলাম। আমরা খেতে খেতে গল্প করছিলাম। খাওয়া শেষে ৪০ রুপি বিল মিটিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেলাম ভিন্সি’স প্লেস থেকে।

এবার আমরা হাঁটতে লাগলাম রাস্তা ধরে। একম একটা রাস্তা যে রাস্তায় আগে যাই নাই। ধীরে সুস্থে আমরা দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগলাম। গোয়ার ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, মানুষজন- সব কিছু একটু আলাদা। রাস্তা দিয়ে প্রচুর মটর সাইকেল যাচ্ছে। টুরিস্টদের জন্য ২০০-৩০০ রুপি দিয়ে সারাদিনের জন্য একটা মটর সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ গোয়া দেখতে একেবারে সেই রকম ঠিক সিনেমাতে যেমনটা দেখা যায়!  আমাদের সামনে অনেকগুলো দোকানপাট চোখে পড়লো। নানা রকম জুয়েলারি সাজিয়ে রেখেছে দোকানে দোকানে। আমর এদিক ওদিক ঢুঁ মারতে লাগলাম। এক দোকানে ঢুকে সবাই নানা রকম জুয়েলারি পছন্দ করতে লাগলো। সবগুলো দোকানেই দাম একটু বেশি মনে হচ্ছিলো। কিন্তু সেই দোকানে আমাদের সব কিছুরই দাম কমিয়ে দিবে বললো। আমরাও উৎসাহ পেয়ে জিনিসপত্র দেখতে লাগলাম। আমরা সবাই মিলে বেশ কিছু জিনিস কিনলাম। দোকানদার আমাদের সবাইকে একটা করে ছোট আয়না উপহার দিলো। দোকান থেকে বের হতেই রুবাইদার সাথে দেখা হলো। রুবাইদা একটা তালপাতার মেক্সিকান হ্যাট কিনেছে। বিশাল মেক্সিকান হ্যাটটা দেখতে খুবই সুন্দর।

আমরা হাঁটতে হাঁটতেই ঠিক করলাম যে আমাদের কালাঙ্গুটে বিচ থেকে দূরে বাগা বিচের দিকে যাবো। তবে ঠিক বিচ ধরে নয়, রাস্তা ধরে শহর দেখতে দেখতে। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে যাচ্ছে দেখে নিশাতই অফার দিলো গতরাতের ভিক্টোরিয়াতে ঢুঁ মারার জন্য। আমরা হেঁটে হেঁটে ভিক্টোরিয়াতে ঢুকে পড়লাম। অনেক দেখেটেখে অর্ডার দিলাম প্রন নুডুলস। অনেক প্রন দেওয়া গরম গরম নুডুলস আসলো। আমরা খুব মজা করে খেলাম। ১২০ রুপি বিল দিয়ে বের হয়ে আসলাম আমরা। এরপর ডক্টর আলফন্সো রোড ধরে সোজা হাঁটতে লাগলাম আমরা। গোয়ায় ট্যাটু করানোর দোকান আছে প্রচুর। এই দোকানগুলোর বাইরে বড় বড়সব কিলবিলে ট্যাটুর ছবি। আর আছে বাদামের দোকান। শুধুই বাদাম যার বেশির ভাগই কাজু। তবে দাম বেশি। এর চেয়ে অনেক কম দামে আমি মানালি থেকে বাদাম কিনেছি। এই সব দেখতে দেখতেই একটা মোড়ে এসে অনেকগুলো বড় বড় দোকানপাট পেলাম। ব্যাঙ্ক এবং মানি এক্সচেঞ্জের দোকান দেখে নিশাত আর পৃথ্বীর ডলার ভাঙ্গানোর কথা মনে পড়লো। তাই আমরা এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে সবচেয়ে ভালো ডলারের রেট আছে এমন মানি এক্সচেঞ্জ খুঁজতে লাগলাম। এরমধ্যে আমাদের সাথে দেখা হলো ফাহাদ আর তানভীরের। ওরা জুম্মার নামাজ পড়ে এসেছে। ওদের দেখে আমরা বুঝলাম আজকে শুক্রবার!

ওরাও আমাদের সাথে যোগ দিলো। সবাই মিলে একটা কাজুবাদামের দোকানে গিয়ে ডলার ভাঙ্গিয়ে নিলো। ডলার ভাঙ্গানো শেষ হলে আমরা সবাই একসাথে রওয়ানা দিলাম বাগা বিচের দিকে। ক্যাফে মোকার অনেক নাম শুনেছিলাম আমরা। একবার ভাবলাম সেখানে আগে ঘুরে আসি। একটা অটোওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতেই ভাড়া চাইলো ৩০০ রুপি। শুনেই আমরা সেই যাত্রায় মোকা যাবার প্ল্যান বাদ দিয়ে কালাংগুটে- বাগা রোড ধরে হাঁটতে লাগলাম। বেশ কিছুদূর হাঁটার পর ফাহাদ একটা দোকান দেখিয়ে বললো গতরাতে ও এখানে গিয়েছিলো। দোকানটার নাম চকোলেট রুম। আমরাও ঢুকে পড়লাম ভিতরে। দারুন সুন্দর সুন্দর সব ডেজার্ট আইটেম সাজানো সেখানে। কোনটা ছেড়ে কোনটা অর্ডার দিবো বুঝতে পারছিলাম না। শেষে ৮০ রুপির একটা চকোলেট স্মুদি অর্ডার দিলাম। স্মুদিটা এত্ত মজা, আর বলার মত না! নিচের চকোলেটটা এতই মোটা যে খেয়েই শেষ করতে পারলাম না।

খেয়েদেয়ে আবার বের হয়ে এলাম। আবার হাঁটা শুরু করলাম। পথটা খুব ছোট নয়, তার উপর আমরা ধীরে সুস্থে গল্পগুজব করতে করতে হাঁটছিলাম। তাই সময় লাগছিলো অনেক বেশি। পথের দুপাশের দোকানগুলোর জিনিস অনেক সুন্দর। ধাতব জুয়েলারি, মুক্তার নেকলেস, পাথরেরর সেটগুলো অনেক সুন্দর সুন্দর। কিন্তু দামগুলো আকাশ্চুম্বী। আমরা খালি দেখেই যাচ্ছিলাম। কেনার উদ্দেশ্য কারও ছিলো না। এই সব দামী দামী দোকান শেষ হয়ে একসময় যখন সুভেনিয়র শপ, লিকার শপ আর নাইট ক্লাব দেখা যেতে লাগলো তখনই আমরা টের পেলাম যে বিচের কাছাকাছি চলে এসেছি। সত্যি সত্যি একটু পরই বিচ চলে আসলো। গনগনে রোদে দাঁড়িয়ে আমরা সমুদ্রের দেখা পেলাম। আমরা একটু ছায়ায় দাঁড়ালাম আর ফাহাদ আর তানভীর গেলো প্যারাসেইলিং দরদাম করতে। ওরা এসে জানালো ৮০০ রুপি লাগবে, মানুষ যত বেশিই হোক- দাম বাড়বে বা কমবে না।

এই বিচের মধ্যে দাঁড়িয়ে না থেকে আমরা ঢুকে পড়লাম একটা শ্যাকে যার নাম ‘ফ্রেশ বিচ সাইড শ্যাক’। সবাই মিলে অর্ডার দিলাম পাস্তা, রেড স্ন্যাপার ফ্রাই আর স্লাইস। অর্ডার আসতে আসতে আমি টুরিস্টদের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। ভারতীয় পর্যটক ছাড়াও গোয়ায় প্রচুর বিদেশি পর্যটক আসে। এদের বড় অংশ সম্ভবত রাশিয়ান কারণ অনেক দোকানের সাইনবোর্ডে রাশিয়ান ভাষায় লিখা দেখেছি। আর বেশির ভাগ পর্যটকই বয়সে তরুন। মধ্য বয়স্ক বা একটু বয়স্ক লোকের সংখ্যা কম। পরিবার নিয়ে আসা লোক মনে হলো খুবই কম। সবাই মোটামুটি বন্ধুবান্ধবের দল নিয়েই বেশি এসেছে। এসব দেখে মনে হলো গোয়া প্রধানত ‘ফুর্তি’ করার জায়গা। বিকালের তীব্র রোদে আমরা মজাদার মাছ ভাজা খেতে খেতে হাসি আড্ডায় মেতে উঠলাম। ফাহাদ একের পর এক কথাবার্তা বলে যেতেই লাগলো আর আমরা হা হা করে হাসতে লাগলাম।

সেফ
বাগা বিচের ছোটখাটো শ্যাক (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

খাওয়া দাওয়া শেষ করে সূর্যের তেজ কমলে আমরা বের হয়ে গেলাম। সমুদ্রের পানিতে পায়ের পাতা ডুবিয়ে হাঁটতে লাগলাম। এগিয়ে যেতে লাগলাম আমাদের কালাঙ্গুটে বিচের দিকে। রাস্তাটা নেহায়েত কম নয়। তাই আমরা হাঁটতে হাঁটতেই সূর্যটার ডোবার সময় হয়ে এলো। দিনের আলোতে সব কিছু দেখে চিনতে পারি। কিন্তু অন্ধকারে আমাদের হোটেলের সামনের বিচটা কেমন করে চিনতে পারবো সেটা নিয়ে চিন্তা করে আমরা পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু লাভ হলো না। একটু পরেই সূর্য ডুবে গেলো। আমরা জোরে জোরে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে অবাক হয়ে দেখলাম সূর্য ডোবার সাথে সাথেই সবগুলো শ্যাক থেকে চেয়ার টেবিল ধরে ধরে বাইরে খোলা আকাশের নিচে নিয়ে আসা হলো। প্রত্যেকটা টেবিলে একটা করে মোমবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। আর শ্যাকগুলোতে রংচঙ্গে বাতি জ্বলে উঠলো। দূর থেকে দেখতে ভারী সুন্দর লাগছিলো। এই দেখতে দেখতে আমরা এক সময় আমাদের হোটেলের কাছাকাছি বিচে চলে আসলাম বলে মনে হলো। সত্যি সত্যি ভালোমত খোঁজাখুঁজি করে পেয়ে গেলাম আমাদের গলিটা।

অন্ধকার হয়ে গেলেও হোটেলে ফিরে যেতে মন চাচ্ছিলো না। আমি আর সুমাইয়া একটা বিচ চেয়ারে বসে গান শুনতে লাগলাম। সুমাইয়ার মোবাইলে চলতে লাগলো, ‘মোর ভাবনারে কে হাওয়ায় মাতালো-’ । আধো অন্ধকার রাতে সমুদ্রের গর্জনের সাথে স্নিগ্ধ লোনা বাতাসে আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। আমরা ঠান্ডা বালিতে পা ডুবিয়ে অনেক্ষণ গল্প করলাম। সবসময় যে গল্প করলাম তা নয়, কখনো কখনো চুপ করে রইলাম দুইজনে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম অন্ধকার সমুদ্রের বিরামহীন আছড়ে পড়া ঢেউ। আমার কখনও রাতের সমুদ্র দেখার ভাগ্য হয় নাই। এই প্রথম অন্ধকারে সমুদ্রের অন্য এক রূপ দেখতে পেলাম। এইভাবে বসে থাকতে থাকতে অনেক সময় পার হয়ে গেলো। আমাদের মোটেও উঠতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না। কিন্তু রাত আটটা বেজে পার হয়ে গেছে। হোটেলে ফির যাওয়া প্রয়োজন। আমি আর সুমাইয়া উঠে পড়লাম। অন্ধকারে বালি পাড়িয়ে বিচ ছেড়ে ঢুকে গেলাম গলির ভেতর। হাঁটতে লাগলাম সোজা, হোটেলের উদ্দেশ্যে।

প্রথমেই হোটেলে না ঢুকে গেলাম ভিন্সি’স প্লেসে। রুবাইদাকে পেলাম সেখানে। কোনকিছু চিন্তা না করেই অর্ডার দিলাম মাশ্রুম ক্রিম পাস্তা। আবারও সেই মজাদার পাস্তা আসলো। গপাগপ খেতে লাগলাম আমি। এখানকার খাবারদাবার এত মজা যে কি আর বলবো!

খাওয়া শেষ করে সোজা হোটেলে ফিরে গেলাম। আগামীকাল প্যারাসেইলিং এর প্ল্যান করে সবাই ঘুমাতে গেলাম আমরা। আমি আবারও ফ্লোরে সটান হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সমুদ্রের বাতাসে আমার ঘুম ভালোই হতে লাগলো।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *