The Mighty INDIA CALLING: এবং ট্যুরের শেষ দিনে শেষ বুফে ডিনার (পর্ব ৪২)

ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না। কিন্তু অন্তরা এসে হাজির। আজকে প্ল্যান মোতাবেক ভারত মিউজিয়ামে যাওয়ার কথা। সব আলসেমি ঝেড়ে ফেলে আমাকে উঠতেই হলো। তবে আমরা তাড়াহুড়া করলাম না। ধীরে সুস্থে তৈরি হয়ে নিলাম। তারপর সবাই মিলে বের হয়ে পড়লাম।

আমি, মিম, অন্তরা আর রুবাইদা প্রথমে নাস্তা সেরে নিলাম। তারপর হাঁটতে লাগলাম ভারত মিউজিয়ামের দিকে। নানারকম চিন্তাও করছিলাম আমরা। আগেরবার আমাদের বিদেশি বলে সন্দেহ করছিলো যেই কারণে আমরা ঢুকি নাই। এইবার যেন সেই সমস্যা না হয়। তবে আগেরবার আমরা নিতান্তই অনভিজ্ঞ ছিলাম, আর এখন আমাদের অভিজ্ঞতার ঝোলায় আছে তাজমহল, অজন্তা, ইলোরা- এইসব টুরিস্ট স্পট। অনেক চিন্তা ভাবনা করে আমরা অন্তরাকে দায়িত্ব দিলাম পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার। অন্তরা মনে মনে ছক কষে নিলো। ভারত মিউজিয়ামে পৌঁছে গেলাম ঠিকমত। টিকেট কাটতেও কোন অসুবিধা হলো না। কিন্তু যখনই আমরা লাইনে দাঁড়ালাম ভিতরে ঢুকার জন্য তখনই সিকিউরিটির লোকজন আমাদের দিকে কড়া গলায় জানতে চাইলো আমরা কোথা থেকে এসেছি। আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম। কিন্তু অন্তরা একটুও না ঘাবড়ে জবাব দিলো, ‘আমদাবাদ সে আয়া হুঁ’।  এই উত্তরের জন্য ওনারা প্রস্তুত ছিলো না। সাধারনত যাদের বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে তারা বড়জোর নিজেদের কোলকাতার লোক বলেই দাবি করে। এইরকম আহমেদাবাদের অধিবাসী বলে দাবি করে বসে না। লোকগুলোর ভ্যাবাচেকা ভাব কাটার আগেই আমরা তাড়াতাড়ি করে ভিতরে ঢুকে পড়ি।

ভিতরে ঢুকে আমরা যুদ্ধজয়ের ভঙ্গি করি। যাক এই শেষ জায়গাটাতেও আমরা ‘ভারতীয়’ সেজে ঢুকতে সফল হয়েছি। মিউজিয়ামের গ্যালারি দেখতে শুরু করলাম। বি-শা-ল মিউজিয়াম। শুরু হলো সেই বৈদিক আমলে ‘কাউ গেট’ দিয়ে। তারপর একে একে সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখতে লাগলাম। আমাদের জাদুঘরে যে সব মূর্তি আছে সেগুলো প্রায় সবই ছোট ছোট। কিন্তু এখানকার মূর্তিগুলো বিশাল সাইজের। তামা, ব্রোঞ্জ, কষ্টি পাথর কত রকমের মূর্তি! মূর্তি ছাড়াও আছে অস্ত্রশস্ত্র, তৈজসপত্র- শুধু এই সব দেখতে দেখতেই আমরা ক্লান্ত হয়ে গেলাম। রুবাইদার শরীর খারাপ লাগা শুরু হলো। ও আর ঘুরতে রাজি হলো না। আমাদের ফেলে ও একাই হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। রুবাইদা চলে গেলে আমরা তিনজন ঘুরতে লাগলাম।

দোতলায় একটা গ্যালারিতে আস্ত মমি রাখা হয়েছে। আমি কখনও সামনাসামনি মমি দেখি নাই। এই প্রথম মমি দেখে আমার সারা শরীরে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠলো। সার্কোফাগাসের ঢাকনাটা সরিয়ে রেখে শুধু মুখটাই অনাবৃত করে রাখা হয়েছে। বাকি শরীর কাপড় দিয়ে জড়ানো। চোখবিহীন শূন্য কোটর, হাড্ডিসার খুলি আর খিঁচানো দাঁত নিয়ে নিথর হয়ে পড়ে আছে যেন মানুষটা। চার হাজার বছর আগে পৃথিবীর বুকে নিশ্চয়ই দোর্দন্ড প্রতাপের সাথে চলাফেরা ছিলো তার। আজ সে মানুষের দর্শনীয় বস্তু হয়ে পড়ে আছে এক মিউজিয়ামের ভিতর। কি অদ্ভূত পরিনতি! আমি তাকিয়েই রইলাম মমিটার দিকে, মানুষ এই স্বল্পক্ষণের জীবনকে নিয়ে কত ব্যস্ততা, কত হিংসা, কত হানাহানি, কত কি। অথচ মৃত্যু অনিবার্য- এই পৃথিবীর কোনকিছুই স্থায়ী নয় এই কথাটা মনে করার সময়টাই মানুষ পায় না। যে পৃথিবীর জন্য এত কিছু করা হচ্ছে, মৃত্যুর পর শুধু হাড়টাই রয়ে যাবে এই পৃথিবীতে- মমিটা যেন আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে এই কথাটা মনে করিয়ে দিলো।

জিওলজি, জুয়োলজি, বোটানি, অ্যান্থ্রোপ্লজি, আর্ট সব সেকশনের গ্যালারি গুলো দেখতে দেখতে আমাদের পা টনটন করছিলো। সব শেষে আর্ট গ্যালারির মধ্যে বাংলাদেশের জামদানি, বালুচরি, মসলিন, নকশি কাঁথা, কাঠের কারুকাজ, হাতির দাঁতের তৈরির জিনিসপত্র দেখেটেখে আমাদের বুক গর্বে দশ হাত ফুলে উঠলো। এই গ্যালারিতে বাংলাদেশের বস্ত্র এবং কারু শিল্পের সাথে পাল্লা দেওয়ার সামর্থ আর কোন এলাকার নাই। সব দেখেটেখে যখন বের হয়ে গেলাম তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে।

মিম আর অন্তরা যাবে পার্ক স্ট্রিটের একটা দোকানে আগের দিনে কেনা একটা ব্যাগ চেঞ্জ করতে। আমি তাই একা একা রওয়ানা হলাম হোটেলের দিকে। আবার সেই নিউ মার্কেটের ভিতর দিয়ে আসতে লাগলাম। ভাবলাম কিছু খেয়ে নেই। খাওয়াদাওয়া করে একা একাই হাঁটছিলাম। হঠাৎ মনে হলো একটা বড় ব্যাগ কেনা দরকার। আমি হকারদের কাছে গিয়ে ব্যাগ দরদাম করছিলাম। এমন সময় রুবাইদা ফোন দিলো। রুবাইদা অনুরোধ জানালো ওর জন্যও একটা ব্যাগ কিনতে। আমি এই মাথা টু ওই মাথা হেঁটে সবার সাথে দরদাম করে শেষ পর্যন্ত ৯০ রুপি করে একেকটা ব্যাগ কিনলাম। তারপর আবার হাঁটতে লাগলাম। মার্কুইস স্ট্রিটের শ্রীলেদার্সের উল্টা পাশে ‘মোর’ সুপার শপে ঢুকে পড়লাম। বেশ কিছু চিপস কিনলাম। এক ভদ্রলোক অনেক সময় নিয়ে কাউন্টারে মালপত্র জমা দিলেন। তার পিছনেই আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। অনেকক্ষণ পর যখন আমার পালা এলো তখন কারেন্ট গেলো চলে। যাইহোক এক সময় কারেন্ট ফেরত এলো। আমি সব বিল মিটিয়ে দিয়ে বের হয়ে আসলাম। তারপর সোজা হাঁটা দিলাম দিদার বক্স লেনের দিকে।

আগের মতই হোটেলে গিয়ে দিলাম ঘুম। ঘুম থেকে উঠে প্রথমে নতুন ব্যাগে মালপত্র ভরলাম। এই ব্যাগ গুছানো শেষ হলে। আমরা খোঁজ খবর নিতে থাকি আমাদের সিনেমা দেখার কি হলো। জানতে পারি এতগুলো টিকেট একসাথে পাওয়া সম্ভব হয় নাই। তাই আপাতত সিনেমা দেখার প্ল্যান বাতিল। তবে রাতে ডিনারের ব্যাপারটা ঠিক আছে। যেতে হবে ‘নিজাম’স রেস্টুরেন্ট’ এ। এটাও নিউ মার্কেট এলাকাতেই। তাই আমরা ভাবলাম যেতেই যখন হবে, আগে থেকে নিউ মার্কেট গিয়ে ঘোরাঘুরি করাই ভালো।

আবার আমরা বের হলাম সেই নিউ মার্কেটের উদ্দেশ্যে। গত দুইদিন ধরে আমরা এতবার এখানে ঘোরাঘুরি করেছি যে প্রতিটা কাকপক্ষীরও আমাদের চিনে ফেলার কথা। তারপরও আমরা ক্ষান্ত হই নাই। ঘুরতে ঘুরতে আমাদের মনে পড়তে লাগলো শেষে মুহূর্তের কিছু কেনাকাটার কথা। একেবারে শেষমুহূর্তে ‘বিগ বাজার’ গিয়ে ভাতিজাটার জন্য খেলনা কিনলাম। ভিতরে বিল দিতে গিয়ে এক বিশাল ঝামেলায় পড়ি। আবার আমার আগের জন গন্ডগোল শুরু করে। ভদ্রলোক দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছেন। উনি কয়েক ট্রলি ভরে প্রায় শ খানেক আইটেম নিয়ে এসেছেন। এত আইটেমের বিল করতে গিয়ে ক্যাশ কাউন্টারে গোলমাল লেগে যাচ্ছিলো। গোলমাল শেষে সব আইটেম ব্যাগে ভরা হলে ওনার ছেলেমেয়েদের আরও কিছু কেনাকাটা করার ইচ্ছা জাগে। তখন সব লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এরকম শ খানেক আইটেম বিল করার পর কেউ যদি বিল না দিয়ে আরও কেনাকাটা করতে যায় তখন মেজাজ খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক। ওনার এই শ খানেক আইটেমের পিছনে আমি মাত্র একটা খেলনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ওনার জন্য কিছুতেই আমার বিলটা হচ্ছে না। তারপর অনেক গ্যাঞ্জাম শেষে আমি কোনমতে বিল মিটিয়ে দিয়ে ছুটতে ছুটতে বের হয়ে আসি। বাইরে রুবাইদা আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। তারপর আমরা ছুটতে ছুটতে যেতে থাকি নিজাম’সের উদ্দেশ্যে। এর মধ্যে তমা আর ফাহাদের সাথে দেখা হয়। তখন আমার  মনে পড়ে যে বাদাম তেল কেনার কথা ছিলো, যেটা আমি বেমালুম ভুলে গেছি। তাড়াতাড়ি করে তমার হাতে রুপি গুঁজে দেই এক বোতল তেল কিনে আনার জন্য। তারপর ছুটতে ছুটতে গিয়ে হাজির হই ‘নিজাম’স’এ।

কমিটি থেকে আমাদের বলা হয় ২০০ রুপির মধ্যে খাবার অর্ডার করতে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে আমরা কেউই ২০০ রুপির অর্ডার দিতে পারলাম না। আমাদের টেবিলে আমি, রুবাইদা, নিশাত আর পৃথ্বী ছিলাম। আমরা হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি, কাবাব রোলস, কুলফি, ফিরনি আর কোল্ড ড্রিংক্স অর্ডার দিলাম। কিন্তু কোনভাবেই বিল ৮০০ রুপির উপরে গেলো না। হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির নাম করে যেটা আসলো সেটা বিরিয়ানিই বটে! এক প্লেট উঁচু করা বিরিয়ানি যার উপরটা কিশমিশ, বাদাম, মোরব্বা আর চেরি দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া। আমি জীবনেও বিরিয়ানিতে এরকম শুকনা ফলের ব্যবহার দেখি নাই। ভয়ে ভয়ে মুখে দিলাম, খেতে না জানি কেমন হয়! মুখে দিয়েই টের পেলাম- না ভুল হয় নাই। চমৎকার স্বাদযুক্ত খাবারই অর্ডার দিয়েছি। বিরিয়ানির সাথে কিশমিশ, মোরব্বা চিবিয়ে খেতে খেতে ভালোই লাগছিলো। কিন্তু পরিমানে এত বেশি ছিলো যে আমি প্রথমেই বুঝেছিলাম খেয়ে শেষ করা সম্ভব হবে না।

efws
শেষ ডিনারে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় মোজাম্মেল হক জাফর)

ওদিকে সবাই হৈচৈ হাহা হিহি করে সেলফি তুলতে লাগলো। জাফর জানালো যে ওকে আমাদের স্টুডিও টিচার বারবার ম্যাসেজ পাঠাচ্ছে সবাইকে নিয়ে ক্লাসে আসার জন্য। আমরা এইসব ব্যাপার নিয়ে প্রাণ খুলে হাসতে লাগলাম। ওদিকে আমাদের কাবাব রোল আর কুলফি চলে আসলো। প্রাণপণ খেয়েও বিরিয়ানি শেষ করতে পারলাম না। তখন মনে হলো রোল দুটো সাথে করে নিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। নিশাত আরও বুদ্ধি দিলো যে, সকালে তো আমরা নাশতা করার সুযোগ পাবো না- এই রোল দিয়েই আমাদের সকালের নাশতা হয়ে যাবে। আমরা রোল দুটোকে প্যাকেট করে দিতে বলে মনোযোগ দিলাম কুলফির উপর। মজা করে কুলফি খেতে খেতে আমরা আফসোস করছিলাম আমাদের ট্যুরটা সত্যি সত্যিই শেষ হয়ে গেলো এজন্য। যাই হোক সব খাওয়া দাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে আমরা বের হয়ে গেলাম ‘নিজামস’ থেকে।

অন্ধকার রাতে সোডিয়াম লাইটের আলোতে আমরা দল বেঁধে হাঁটতে লাগলাম। নিউ মার্কেটের অলিগলি পার হয়ে মির্জা গালিব স্ট্রিট দিয়ে হেঁটেহেঁটে হোটেলের দিকে আসতে লাগলাম। এর মধ্যেও ছোটখাটো মুদি দোকান পেলেই সবাই থেমে গিয়ে এটা সেটা কিনতে শুরু করে। এই করতে করতে আমাদের হোটেল যেতে যেতে বেশ সময় লাগছিলো। রাত হয়ে গেছে, মোটামুটি সব দোকাপাট বন্ধ। লোকজন কম, রাস্তাঘাট শুনশান। এর মধ্যে আমরা দল বেঁধে হেঁটে যেতে লাগলাম। সবার মনেই একটা হাহাকার- এই তো শেষ, এত স্বপ্নময়ী দিনগুলো একে একে সব ফুরিয়ে গেলো। এত অবাধ স্বাধীনতা, এত অনিশ্চয়তা, এত হাসি আনন্দের আজকেই রাতেই ইতি। কেউ কাউকে বলছিলো না কিন্তু একটা চাপা কষ্ট সবার বুকেই জমাট বেঁধে ছিলো।

হোটেলে পৌঁছে আমরা একে একে আমাদের জিনিসপত্র ফাইনালি গুছিয়ে নিলাম। সবারই অনেকগুলো করে ব্যাগ। সব মিলিয়ে আমার সাতটা ব্যাগ হলো। এর মধ্যে বড় ব্যাগ তিনটা আর ছোট ব্যাগ চারটা। ব্যাগগুলো দেখে ভয় লাগলেও মনে মনে ভাবলাম, একবার বাসে উঠাতে পারলেই তো আর চিন্তা নাই। কিন্তু তখন কি আর জানতাম, এই ব্যাগ নিয়ে কি ভোগান্তিটাই না হবে!

শেষবারের মতন আমরা ছোট বিছানাটায় পা ভাঁজ করে শুয়ে পড়লাম। উঠতে হবে গভীর রাতে। তাই বেশি কথাবার্তা না বলে আমরা ঘুমিয়ে গেলাম। গুডবাই কোলকাতা!

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *