সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখলাম মৌলি গোসলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কলে গরম পানি নাই। এই জন্য ওর দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রুম সার্ভিসে ফোন দিয়ে জানলাম ওদের এখানে বয়লার দিয়ে পানি গরম হয়। সেজন্য প্রায় ঘন্টা খানেক আগে জানাতে হয়। কিন্তু আমাদের হাতে তো অত সময় নাই। প্রথমে মৌলি গোসল করলো। তারপর মজুমদার অনেক কষ্ট করে গোসল করে এসে বললো ভীষন ঠান্ডা পানি। ঠান্ডা পানির কথে শুনে আমি গোসল করার চিন্তা ভাবনা জলাঞ্জলি দিলাম। গরম পানি না পেলে এই ঠান্ডায় আমি কোনভাবেই গোসল করবো না।
আমি আর রুবাইদা বের হয়ে পড়লাম নাশতা খাওয়ার জন্য। আমাদের হোটেলটা একটা আবাসিক এলাকার মাঝখানে। আশেপাশে সব বাসাবাড়ি। কাছাকাছি কোন হোটেল টোটেল নাই। হোটেলের সামনেই এক লোককে দেখলাম ঠেলাগাড়ি নিয়ে বসে আছে। তার গাড়িতে কড়াই, চুলা এইসব সাজানো। রুবাইদা জিজ্ঞেস করেতেই লোকটা জানালো উনি রুটি আর তরকারি বিক্রি করেন। আশেপাশে কোন খাওয়ার দোকানের সন্ধান না পেয়ে শেষমেষ সেই ঠেলাগাড়ির লোকটাকেই বললাম চারটা রুটি আর তরকারি দিতে। উনি আমাদের সামনেই কড়াই ধুয়ে পরিষ্কার করলেন। তারপর পলিথিনের প্যাকেট থেকে কাঁচা কতগুলা সাদা রঙের রুটি বের করে অল্প তেলে ভাজতে লাগলেন। রুটিগুলো অদ্ভূত। ছোট সাইজের ওভাল শেপের রুটি। অনেকটা নান রুটির মত কিন্তু নান রুটি না। তারপর আরেকটা পাত্রে মটর টাইপের একটা জিনিস দেওয়া তরকারি গরম করে দিলেন। তারপর ওয়ান টাইম ইউজ বাটিতে ঢেলে উপরে পিয়াজ কুচি ছড়িয়ে আমাদের সামনে এনে দিলেন। আমরা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই রুটি দিয়ে তরকারি খেলাম। তরকারিটা অত মজা না। তবে খেতে খারাপও না। আমাদের দেখা দেখি অনেকে হোটেল থেকে বের হয়ে সেই রুটি তরকারি অর্ডার দিলো। তারপর রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাশতা খেতে লাগলো।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা গোয়েলে উঠে পড়লাম। আমাদের বাস চলতে শুরু করলো। ঠিক আগের মতনই আমাদের ড্রাইভার আরেক গাইডের কথা বললো। এবার আমাদের কমিটি উনাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলো আমরা বড় প্যাকেজে যাবো না। তবে যদি শুধু একজন গাইড থাকে তাহলে আমাদের তেমন সমস্যা নাই। তারপর আমাদের বাসে উঠলো হাফ সোয়েটার পরা একজন লোক। আগের বারের লোকটার মত ধুরন্দর চেহারা উনার নাই। তবে উনি আমাদের সামনে এসে কি সব জানি বলতে লাগলো। উনার ভাষাও আমরা বুঝতে পারলাম না। অত্যন্ত বোরিং সেই কথাবার্তা শুনে আমাদের বিরক্তি ধরে গেলো। আমি সৌরভকে বিরক্ত হয়ে বললাম, কেন আমরা পয়সা দিয়ে এইসব ফাউল লোকজন হায়ার করছি ? জবাবে সৌরভ জানালো, গাইড গাইডের মত থাকবে আর আমরা আমাদের মত থাকবো। এই গাইড রাখার একমাত্র কারণ হচ্ছে ড্রাইভারকে না চটানো। সো সামান্য টাকা খরচ হলেও কমিটি এই এক্টামাত্র কারণে এই ফালতু গাইডকে রাখা হয়েছে।
গাইড আমাদের প্রথমে নিয়ে গেলো পাহাড়ের উপর বিড়লা টেম্পলে। সাদা রঙের মার্বেলের টেম্পলটার মাথায় তিন রকমের শিখরা। একটা মন্দিরের, একটা মসজিদের, অন্যটা গুরুদোয়ারার। বিড়লা কোম্পানির মালিক তার বাবা মার স্মরণে এই টেম্পলটা বানিয়ে দিয়েছে। আমরা ভিতরে ঢুকে দেখলাম স্টেজের উপর পর্দা টানানো, আর সবাই চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ ঘন্টা বাজলো। হুশ করে পর্দা সরে গেলো। স্টেজের উপর দুইটা মুর্তি দেখতে পেলাম (সম্ভবত লক্ষী-নারায়ন)। আর সাথে সাথেই গান শুরু হলো। সবাই দাঁড়িয়ে পড়লো, সামনে এগিয়ে গেলো আর দুলে দুলে গানের সাথে গলা মেলাতে লাগলো। তারপর পুরোহিত এক ধরনের পানি সবার দিকে ছিটিয়ে দিতে লাগলেন। আমরা একেবারে পিছনে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখতে লাগলাম। তারপর তাড়াতাড়ি করে মন্দির থেকে বের হয়ে আসলাম। বের হতে হতেই অনেকে বলাবলি করতে লাগলো এটা তো অত্যন্ত টিপিকাল মন্দির। কেন এখানে এসে আমাদের এতগুলো সময় নষ্ট করতে হলো। মনে মনে গাইডকে বকাবকি করে আমরা গোয়েলে উঠলাম।
এরপর অনেক্ষন বাস চলে আমাদের নিয়ে গেলো জয়পুরের সরকারি বিক্রয় কেন্দ্রে। এখানেও আমরা কেন নেমেছি বুঝতে পারলাম না। যাই হোক গাইদের পিছু পিছু আমরা বাস থেকে নামলাম। প্রথমেই একজন লোক আমাদের কিসব জানি ব্লক বাটিকের পদ্ধতি দেখালো। তারপর তারা আমাদের দোকানের ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো। সেখানে শুরুতেই ছেলেদের আলাদা করে দিলো। আর আমাদের মেয়েদের অন্যদিকে নিয়ে যেতে লাগলো। বিক্রয় কেন্দ্রটা অনেক বিশাল। সবকিছুরই দাম অনেক বেশি। শাড়ি, ওড়না, স্যান্ডেল, জুতা সবকিছুর আলাদা আলাদা সেকশন। আমাদের হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে গেলো কাঁথা বালিশ আর কম্বলের সেকশনে। সেখানে আমাদের ‘রাজস্থানী রাজাই’ নামের এক দারুন জিনিস দেখালো। এটা খুবই পাতলা কম্ফোর্ট টাইপের জিনিস। এটা শীতকালে গায়ে দিয়ে ঘুমালে গরম লাগবে আর গরমকালে বিছানায় বিছিয়ে ঘুমালে ঠান্ডা লাগবে। এটাকে ভাঁজ করে একদম ছোট জুতার বাক্সের সমান বানিয়ে ফেলা যায়। আর এটার ওজনও অনেক কম। আমরা বড় বড় চোখ করে সব দেখতে লাগলাম। তারপর উনারা এটার দাম বলে আমাদের বললেন যে আমাদের কোনটা কোনটা পছন্দ। উনাদের কথায় আমরা নড়েচড়ে উঠলাম। আমরা উঠে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু আমরা যতই এখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি উনারা ততই আমাদের আরও ভিতরের দিকে সেকশনে পাঠিয়ে দেয়। আমরা ঝাড়বাতি, ফার্নিচার, রত্ন পাথর সব দেখে দৌড়ে দৌড়ে বের হয়ে যেতে থাকি। আমরা মেয়েরা তো তবুও বের হয়ে আসি, কিন্তু ছেলেদের কোন খবর নাই। আমরা ভাবলাম, ওদের কাছ থেকে বোধহয় ইচ্ছা মত খসিয়ে নিচ্ছে। আমরা গোয়েলে উঠে পড়লাম। অনেক্ষন পরে ছেলেরা ফিরতে লাগলো। ওরা কেউ কিছু কিনে নাই শুধুমাত্র জাফর ছাড়া। জাফর একটা গোলাপি ওড়না কিনে প্রায় চার গুন দাম দিয়ে। ও একটা শাড়িও কিনতে চাচ্ছিলো। ভাগ্যিস কেনার আগে চয়েস করার জন্য মৌলিকে খবর দিতেই মৌলি প্রবল্ভাবে ওকে না করে দেয় এখান থেকে কিনতে। যাক, জাফরের লসটা শুধু একটা ওড়নার উপর দিয়ে গেছে!
ততক্ষনে দুপুর হয়ে গেছে। অনেকেই জুস, চিপস কিনে নিলো। আমিও চিপস কিনে নিলাম। বাসে বসে তাই চিবাতে লাগলাম। সবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে সেই দালাল গাইডের উপর। কতক্ষণ ধরে আমরা বাসে করে ঘুরছি কিন্তু একটাও কাজের জায়গায় যাচ্ছি না, সব আজাইরা জায়গায় গিয়ে শুধু শধু সময় নষ্ট হচ্ছে। এবার গিয়ে কমিটির লোকজন ড্রাইভারকে বলে আসলো যাতে আমরা সোজা আম্বর ফোর্ট যাই। মাঝে আর কোনখানে যাতে থামা না হয়। বাস চলতে শুরু করলো। আমি জানালা দিয়ে দেখতে লাগলাম জয়পুর শহর। অনেক পুরানো শহর কিন্তু প্ল্যান করা। রাজপুত রাজা মানসিংহের বানানো বিল্ডিং প্যাটার্ন অনুযায়ী শহরের মেইন কমার্শিয়াল এলাকাগুলো গড়ে উঠেছে। সবগুলো বিল্ডিংয়েই সেই লালচে কমলা রঙের জালি জালি জানালা দেওয়া রাজকীয় ভাবটা আছে। এ জন্যই বলা হয় ‘দ্যা পিংক সিটি’।
আমাদের গোয়েল এসে পৌঁছালো আম্বর ফোর্ট। বাস থেকে নেমেই মাওতা লেকের সামনে দাঁড়িয়ে গ্রুপ ফটো তুললাম। অনেকে সেখানে জিরা পানি খেলো। সেটার স্বাদ নাকি দারুন। খানিক্ষন পরে সেখান থেকে হাঁটা শুরু করলাম আম্বর ফোর্টের দিকে। মাওতা লেকের পাশ দিয়ে লাইন ধরে হাঁটতে লাগলাম আমরা। এক পাশে টলটলে মাওতা লেক আর লেকের ওপারে সোনালি পাহাড়ের গায়ে এঁকেবেঁকে উঠে গেছে দেওয়াল। ঠিক যেন চীনের প্রাচীর। পুরো পাহাড় জুড়ে রাজকীয় ফোর্টটা যেন আসন গেড়ে বসে আছে। মুখ হাঁ করে এই দেখতে দেখতে আমরা প্রবেশের কাছাকাছি চলে আসলাম। আম্বরের গেটের সামনে ভুট্টার দানা প্লেটে প্লেটে করে বিক্রি হচ্ছে। আশেপাশে অসংখ্য কবুতর ওড়াউড়ি করছে। অনেকে দানাগুলো কিনে কবুতরকে খাওয়াতে লাগলো। বাসিরুনের হাতে একটা কবুতর অনেক্ষন ধরে বসে দানা খেলো। আর বেচারা আফরার হাতের দানা খেতে এক বড়সর সাইজের ছাগল এসে হাজির হলো। ছাগলটা আফরার হাত চেটেপুটে খেতে লাগলো। আমরা দৃশ্যটা দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম।
আমরা আবার হেঁটে পৌঁছালাম গেটের কাছে। প্রথমেই দেখলাম ‘দিল আরাম বাগ’। এটা ফোয়ারা, পানির পুল, চৌচালা ছাউনি, সবুজ ঘাসের লন আর অসংখ্য ফুল গাছ সহ একটা সুন্দর সাজানো বাগান। এখানে আসলে মনে শান্তি লাগে তাই এর নাম ‘দিল আরাম বাগ’। এটার কন্সেপ্ট এসেছে সেই হুমায়ুন্স টম্বের চারবাগ থেকে। এখান থেকে মাওতা লেকের অপরূপ ভিউ দেখতে দেখতে আমরা উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। কি যে সুন্দর দৃশ্য! ঢাল বেয়ে উঠছিলাম আর মাথা ঘুরিয়ে ডানে, বামে, সামনে, পিছনে, উপরে নিচে সবদিকে দেখছিলাম। সমতলে শুধু চারদিক দেখলেই হয়। পাহাড়ের গায়ে উপরে নিচেও দেখা লাগে। কখনও ঢাল, কখনও সিঁড়ি এই বেয়ে বেয়ে আমরা ক্লান্ত হয়ে পৌঁছালাম ‘সুরাজ পোল’ এ। এই গেট পূর্ব দিকে মুখ করা বলে এর নাম সুরাজ পোল। বিশাল রাজকীয় এই গেট পার হয়ে ভিতরে ঢুকে পুরাই পাকা করা বেশ বড় খোলা জায়গা পেলাম। চারিদকে স্ট্রাকচার দিয়ে ঘেরা একটা বিশাল কোর্ট ইয়ার্ডের মত জায়গা। এর নাম ‘জালেব চক’। এখানে সৈন্যরা যুদ্ধ জয় শেষে বিজয় মিছিল করতো। এখানে কেউ ঢুকলে মনেই করবে না যে এটা ভূমি থেকে এত উঁচু একটা জায়গা। এই কোর্টের মধ্যেই অন্য আরেকটা গেট দেখলাম যার নাম ‘চান্দ পোল’। এই গেটের উপরে ছিলো ‘নওবত খানা’। নওবত খানায় ঐতিহ্যবাহী বাদ্য বাজানো হতো। আর যখন বাদ্য বাজতো তখন সবাই চুপ করে শুনতো। আমরা সেখানে স্থানীয় একজনকে দেখলাম এক মনে সারেঙ্গীর মত একটা বাদ্য বাজিয়েই যাচ্ছে। যেমনটা সোনার কেল্লায় পড়েছিলাম। কতগুলো লোক পাগড়ি বিক্রি করছিলো। সীমান্ত ১০০ রুপি দিয়ে পাগড়ি কিনলো। সেই পাগড়ি পরে আমরা পোজ মেরে ছবি তুললাম। এরপর আমরা টিকেট কাটলাম। তারপর সিঁড়ি বেয়ে সত্যিকার রয়াল এলাকায় ঢুকতে শুরু করলাম।
উপরে উঠে দেখতে পেলাম দিউয়ানে আম। দিউয়ানে আমে প্রজাদের সাথে দরবার করার পাশাপাশি যেকোন উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হতো। রাজপুত স্টাইলের চমৎকার কারুকাজ করা কলোনেড স্ট্রাকচারটাতে ঢুকে আমার মনে হলো আমি বোধহয় সেই রাজপুতদের আমলেই চলে এসেছি। কলামগুলো ধরে ধরে হাঁটছিলাম আমি। একেবারে পাহাড়ের ধার ঘেঁষে দিউয়ানে আম, নিচের দিকে তাকালে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি দেওয়াল ঘেরা রাস্তা আর অপূর্ব মাওতা লেক দেখা যাচ্ছে। দৃশ্যটা কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্নময়। আমরা সবাই মিলে দিউয়ানে আমের ভেতর সৃষ্টির ডিরেকশনে লাফ ঝাঁপ দিয়ে ছবি তুললাম। দিউয়ানে আমের পর যে বিশাল রাজকীয় গেটটা দেখলাম সেটা ‘গনেশ পোল’। এই গেটের উপরে জালি দেওয়া জানালা দিয়ে ঘেরা ‘সুহাগ মন্দির’ আছে। এখানে বসে রাজ বংশের মেয়েরা দিউয়ানে আমে অনুষ্ঠিত যে কোন উৎসব উপভোগ করতো। এই গেটের পর থেকে একেবারে প্রাইভেট এলাকা শুরু।
গনেশ পোল পার হয়ে হাতের বাম পাশে পেলাম ‘দিউয়ানে খাস’ বা ‘জয়মন্দির’ বা ‘শিশ মহল’। এখানে রাজা বিশেষ ব্যক্তিবর্গের সাথে দেখা সাক্ষাত করতেন। মার্বেলের দেওয়ালে সেই তাজমহল লেভেলের ফুল, পাতা এনগ্রেভ করা। দেখেই আমি তবদা লেগে গেলাম। কিন্তু আমার তবদা লাগার আরও বাকি ছিলো। ভিতরে পা রেখে যখন দেখলাম দেওয়াল আর ছাদ কুচি কুচি আয়না দিয়ে জটিল আর কারুকাজ করা জ্যামিতিক আর ফুলেল নকশায় পরিপূর্ণ, তখন আর কথা বলতে পারছিলাম না। আমার সামনে জুবায়ের হাসি হাসি মুখ করে আমাকে বললো, ‘তাও ভালো যে, কিছু কিছু অংশ রঙ দিয়ে নকশা করা, সব জায়গায় পাথর কেটে নকশা করে নাই। তা হলে যে কি হইতো আল্লাহই জানেন’। আমি অবাক হয়ে আয়নাগুলো দেখছিলাম। সব সাধারণ আয়না নয়, লাল, কমলা, গোলাপি, সবুজ, হলুদ – এই সব রঙ্গিন আয়না এত বছর পরও যেন সেই রাজকীয় দ্যুতিই ছড়াচ্ছে। অনেক জায়গায় পাথরের উপর আয়নার কারুকাজ, আয়নার উপর রঙের কারুকাজ, আয়নার উপর পাথরের কারুকাজ – দেখতে দেখতে আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছিলো।
শিশ মহলের পাশেই চমৎকার একটা বাগান। বাগানের ওপাশে ‘সুখ মন্দির’। গরমের দিনে এখানে রাজ বংশের লোকজনরা থাকতেন। ধবধবে সাদা এই দালানটাকে ফুলেল কারুকাজে পরিপূর্ণ করার পাশাপাশি ঠান্ডা রাখার জন্যও যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিলো। এর উপরে একটা পানির ট্যাংক ছিলো যেখান থেকে পানি নিয়ে এর ভিতরে দেয়াল বেয়ে ফোয়ারার মতন ছাড়া হতো। সেই পানি সোজা গড়িয়ে নেমে যেতো বাগানে। এই সব দেখতে দেখতে আর ছবি তুলতে তুলতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। তানভীরের সাথে দেখা হলো। ও বললো ‘ছবি তোলা বাদ দিয়ে দেখো, এই জিনিস আর জীবনেও দেখতে পারবে না’। এবার সত্যি সত্যি আমি ছবি তোলা বাদ দিয়ে দেখতে লাগলাম। এরপর দেখলাম রাজা মান সিংহের প্যালেস, সারি সারি ল্যাট্রিন, ‘জানাই দেউরি’ বা মহিলাদের থাকার জায়গা। এক চিপা দিয়ে সিড়ি পেয়ে আমি আর তানভীর টপাটপ উপরে উঠে গেলাম। উপরে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেললাম। এত এত ঘর, এত এত করিডর আর এত এত বারান্দা –পুরাই যেন এক গোলক ধাঁধাঁ। আমরা অনেক কষ্টে সেখান থেকে পথ চিনে বের হয়ে আসলাম। তারপর আমি আর তানভীর যে রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম মনে হলো সেটা বের হয়ে যাবার পথ। সেখানে যেতে যেতে দেখতে পেলাম, আম্বর ফোর্ট থেকে আরও উপরে অবস্থিত জয়গড় ফোর্টে যাবার সুড়ঙ্গ পথ।
বের হবার রাস্তায় হঠাৎ দুইটা বড় বড় কড়াই দেখতে পেলাম। আমাদের দেশের মাজারে যেই সাইজের ডেকচি থাকে ঠিক সেই সাইজের কড়াই। কাছে দিয়ে টের পেলাম মৃত্যু দন্ড পাওয়া আসামীকে এই কড়াইয়ের গরম তেলের মধ্যে ডুবিয়ে মারা হতো। বিশাল চকচকে কড়াই দুইটা দেখে মনে হলো কত মানুষ না জানি এখানে ডিপ ফ্রাই হয়ে মরেছে! মোটামুটি ঘুরে আমরা সারি সারি কামান দেখে বের হয়ে আসলাম ঠিক যেখানে টিকেট কেটেছিলাম জালেব চকের, ঠিক সেইখানে। জালেব চকের মাঝখানে মিম আর অন্তরাকে বসে থাকতে দেখলাম। খানিক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আমি, মিম, অন্তরা আর তানভীর রওয়ানা দিলাম জয়গড় ফোর্টের উদ্দেশ্যে। আমাদের সাথে যেতে অনেকেই রাজি হচ্ছিলো না। কারণ সেটা আরও অনেক উঁচুতে অবস্থিত। মূলত তানভীরের উৎসাহেই আমরা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে রওয়ানা দেই। এসেছি যখন একবার, দেখেই যাবো- কি আছে জীবনে?
আম্বর ফোর্ট থেকে বের হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে আমাদের মনে হচ্ছিলো- ‘ব্যাপারটা কি ঠিক হলো? যেতে পারবো তো ঠিকমত? নাকি যেতে যেতেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে আর সব বন্ধ হয়ে যাবে?’। যাই হোক একবার যখন যাত্রা শুরু করেছি তখন আর থামাথামি নাই। কিছুক্ষন যেতেই আমাদের দু পা ধরে আসলো। মুখ দিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে লাগলাম আমি, মিম, আর অন্তরা। কিন্তু তানভীরের কোন বিকার দেখতে পেলাম না। ও বেশ তরতর করেই হাঁটতে লাগলো। আমরা আস্তে ধীরে উঠার চেষ্টা করতে লাগলাম আর আমাদের সাথে ভদ্রতা করে তানভীর আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলো। যে পাহাড়টা বেয়ে আমরা উঠছিলাম সেটার নাম ‘চিল কা টিলা’ বা চিলের পাহাড়। পুরো পাহাড়টাকে পেঁচিয়েই উঠে গেছে রাস্তাটা। আমরা হাঁটছিলাম তো হাঁটছিলাম, কিন্তু পথ শেষ হওয়ার কোন নামগন্ধ পাচ্ছিলাম না। বরঞ্চ একটা বাঁক শেষ হতেই ঘুরে আরও আঁকাবাঁকা সর্পিল বাঁকের রাস্তা দেখছিলাম। পথে অনেক বানর আমাদের ভেংচি কেটে দিচ্ছিলো। ওদের লাফ ঝাঁপ দিয়ে অবলীলায় পাহাড় বেয়ে উঠতে দেখে আমাদের বেশ হিংসা হচ্ছিলো। যেতে যেতে এক সময় মনে হলো আমরা বোধ হয় আজকে আর পৌঁছাতে পারবো না। অনন্তকাল লাগবে এই পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরে উঠতে উঠতেই। হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলাম, শুধু উপরে উঠতেই আমাদের এত কষ্ট- যারা এত উপরে দুর্গ বানিয়েছে না জানি তারা কি লেভেলের পরিশ্রমী, সাহসী আর করিৎকর্মা ছিলো! আরেকবার মনে হলো না হয় কষ্ট করে উপরে উঠলামই, কিন্তু নিচে নামতে নামতে তো অন্ধকার নেমে যাবে। তখন কি হবে? যাই হোক আমাদের হাঁটা বন্ধ হলো না। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে আমরা পাহাড় বাইতেই লাগলাম। একবার থামলাম বিশ্রাম নিতে। হঠাৎ ঢাল ফুড়ে উদয় হলো দুইটা পরিচিত মাথা, সুমাইয়া আর অবনী। ওরাও জোরে জোরে দম ফেলতে ফেলতে আমাদের সাথে এসে যোগ দিলো।
অবশেষে রক্তিম গাল, হাপড়ের মতন পাজড় আর টনটনে পা নিয়ে আমরা এসে পৌঁছালাম জয়গড় ফোর্টের গেটে। গেটের নাম ‘আওয়ানি দরওয়াজা’। টিকেট কেটে ঢুকে পড়লাম রেড স্যান্ড স্টোনে বানানো মোটা মোটা দেওয়াল দিয়ে ঘেরা জয়গড় ফোর্টে। জয়গড় ফোর্ট প্রথমে বানানো হয়েছিলো আম্বর ফোর্টকে রক্ষা করার জন্য। ঢুকতেই আমরা প্রথমে পেয়ে যাই ফাউন্ড্রি। এখানে রাজপুতদের সকল অস্ত্রশত্র বানানো হতো। আমরা ঢুকতেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কামান দেখলাম। এই কামানের নাম ‘জাইভান’। তারপর দেখলাম কামান বানানোর কারিকুরি। বিশাল বিশাল ছাঁচের মধ্যে ধাতু ঢেলে বানানো হতো কামান। এই সব ছাঁচ বানানোর জন্যও আছে বিশাল মেকানিজমওয়ালা কুয়ার মত মেশিন যেটা আসলে ফার্নেস। আমাদেরকে একজন গার্ড মেকানিজমটা সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে দিলেন। আমরা সব দেখে আর শুনে হাঁ হয়ে যাচ্ছিলাম। আকাশের কাছাকাছি একটা জায়গায় এভাবে কামান বানানো- হার্ড টু বিলিভ। তারপর দেখলাম ‘সূর্য মন্দির’। থরে থরে অস্ত্র আর কামারের যন্ত্রপাতি সাজিয়ে রাখা সেখানে। বর্শা, ঢাল, তলোয়ার, শিরস্ত্রান, গোলা – কি নেই সেখানে!
হাতে সময় অনেক কম। তাই আমরা পা চালাতে লাগলাম। এসে পৌঁছালাম ‘জালেব চক’। আগের মতই বেশ বড় কোর্ট ইয়ার্ড। জালেব চকের চার পাশে হরিহর মন্দির, ভৈরব মন্দির, আর্মারি মিউজিয়াম- আরও অনেক কিছু ছিলো। কিন্তু আমাদের সেগুলোতে ঢুকার সময় নেই। এক রকম দৌড়ে দৌড়ে আমরা প্রাসাদের এলাকায় ঢুকলাম। হলুদ রঙের গেটটা পার হয়ে দেখলাম ‘সুভাত নিবাস’। সেখানে বিশাল বিশাল ঢাক, হাতির পিঠে বসার আসন –এইসব সাজানো আছে। এরপর দেখলাম অত্যন্ত সুন্দর ‘লক্ষী বিলাস’। এটা নাকি রাজাদের ড্রইং রুম ছিলো। এরপর আমরা ছুটতে লাগলাম একটা অন্ধকার চিপা গলি দিয়ে। সেই গলি পার হয়ে ছোট্ট একটা উঠানে এসে পৌঁছালাম। এখান থেকে দেখলাম ডাইনিং হল। সেখানে খুব সুন্দর করে পুতুল দিয়ে সব সাজানো আছে। দেখে মনে হয় যেন সত্যি সত্যি রাজপুত বংশের নারী পুরুষেরা বিশাল বিশাল থালায় হরেক রকম খাবার সাজিয়ে খেতে বসেছে। রান্নাঘরেরও একই অবস্থা। অনেক দাস দাসী মিলে বিশাল বিশাল ডেকচিতে যেন রান্নাবান্না করছে। দেখতে আমার খুবই ভালো লাগছিলো। তারপর দেখলাম ‘ললিত মন্দির’। এটা শোবার ঘর। একটা দোতলা অডিটোরিয়ামও দেখলাম, সামনে স্টেজ সহ। এখানে নাকি নাচ, গান আর পুতুল নাচ হতো। এরপর দেখলাম লাল রঙয়ের ‘বিলাস মন্দির’।
এতক্ষণ ধরে যা যা দেখছিলাম সব কয়টা দালানই এত সুন্দর আর এত প্রাণ জুড়ানো বাতাস যে আমাদের একটু খানিক্ষণ বসে থেকে উপভোগ করতে ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু হাতে সে সময় নেই বলে কোন জায়গাতেই আমরা থামছিলাম না। এক ঝলক দেখেই দৌড় দিচ্ছিলাম। কিন্তু সাদা রঙের ‘আরাম মন্দির’ দেখে আমরা পুরাই থেমে গেলাম। সামনে যে এক মনোমুগ্ধকর বাগান দেখলাম সেটা আমি নিজের চোখে না দেখলে মনে করতাম এরকম বাগান কেবল রূপকথার বইতেই থাকা সম্ভব। পুরাই যেন কোন বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা সবুজ ঘাস আর ছোট ছোট ঝোপ দিয়ে সাজানো এক পরিপাটি বাগান। আর বাগানটা যে এক আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের উপর অবস্থিত সেইটা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যই যেন তিন তিনটা বিশাল আর্চ পাহাড়ের কিনারায় ভিউ ওপেন করে দাঁড়িয়ে আছে। পুরা দৃশ্যটা এতই বেহেশতি, এতই স্বপ্নময়ী, এতই অবাস্তব যে কয়েক মিনিট আমাদের সময় লাগলো ব্যাপারটা হজম করতে। আমরা কেউ কোন কথাই বলতে পারলাম না কিছুক্ষণ।
আরাম মন্দিরে এসে আর কোন কিছুর আরাম হোক আর না হোক, আমার চোখের দারুন আরাম হচ্ছিলো। তারপর আমরা হেঁটে হেঁটে একদম জয়গড় ফোর্টের কিনারে এক ওয়াচ টাওয়ারে এসে দাঁড়ালাম। আমার মনে হচ্ছিলো আমি বোধহয় পাখির চোখে পৃথিবী দেখছি। এখান থেকে দেখলাম নিচের আম্বর ফোর্টকে। কত ছোট যে লাগলো সেই বিশাল ফোর্টকে! এক দিকে উপরে সীমাহীন আকাশ অন্যদিকে নিচে পাহাড়ের গায়ে আঁকা বাঁকা দেওয়াল আর ঝকঝকে ‘সাগর লেক’, সেইসাথে মন ভরানো, প্রান জুড়ানো বাতাস- আমার যে কি শান্তি লাগছিলো, সেকথা আর নাই বা বললাম। মনে মনে তানভীরকে ধন্যবাদ দিলাম। ওর জন্যই আজকে এখানে আমার আসা সম্ভব হয়েছে। ওখানকার লোকজন আমাদের তাড়া দিচ্ছিলো বের হয়ে যাবার জন্য। আমাদের আরও অনেক্ষণ ওখানে থাকতে ইচ্ছা করছিলো, কিন্তু উনাদের তাড়া খেয়ে তাড়াতাড়ি আমরা নেমে এলাম। ওনারা আমাদের বের হয়ে যাবার রাস্তা দেখিয়ে দিলেন।
আমরা সেই স্বপ্নময়ী বাগান থেকে বের হয়ে হাঁটতে লাগলাম। এবার আমরা দেখলাম তিনটা বি-শা-ল পানির ট্যাঙ্ক। এত উঁচু পাহাড়ে ফোর্ট বানানোর একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা। কৃত্রিমভাবে বানানো সাগর লেক থেকে হাতির পিঠে করে পানি উঠানো হতো। তাছাড়া পুরো ফোর্ট জুড়েই নানা রকম চ্যানেল ছিলো যেগুলো দিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হতো। তিনটা ট্যাঙ্ক মিলে ষাট লাখ গ্যালন পানি ধরে রাখার ক্ষমতা ছিলো। পরে জানলাম এক মজার কাহিনী। এই তিনটা ট্যাঙ্কের একটার ভিতর নয়টা রুম আছে। সেগুলো নাকি রাজা দ্বিতীয় জয় সিংহের আগ পর্যন্ত ট্রেজারি অর্থাৎ রাজকোষ হিসেবে ব্যবহৃত হত। যার মানে দাঁড়ায় রাজ্যের সব সম্পদ এখানে থাকতো। রাজপুত বংশের ব্যাপক ধন ভান্ডার এইখানে লুকানো আছে বলে শোনা যায়। এই ফোর্ট এখনও রাজপুত বংশের লোকদের মালিকানায় আছে, এটা সরকারী সম্পত্তি নয়। তাই এখানে গুপ্তধন আছে কি নেই সেটা নিয়ে ব্যপক কল্পকাহিনী প্রচলিত। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে একবার নাকি জোর তল্লাশি চালানো হয় সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু কিছু পাওয়া গিয়েছে এমন কথা শোনা যায় নাই।
আমরা যখন ট্যাঙ্কগুলো পার হয়ে হয়ে যাচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময়ে ইশতিয়াককে পেলাম সেখানে। ইশতিয়াক মাথা নেড়ে নেড়ে বললো, ‘পুরাই মাথা নষ্ট জায়গা’। আমিও মেনে নিলাম ওর কথা। আসলেই পুরাই মাথা নষ্ট জায়গা। মনে মনে রাজপুতদের স্যালুট জানালাম। আবার আফসোসও লাগলো যে ইন্ডিয়ান ইসলামিক আর হিন্দু আর্কিটেকচার পড়েছি কিন্তু রাজপুতটা কেমন করে যেন হিন্দু আর্কিটেকচার থেকে বাদ পড়ে গেছে। যদি আগে থেকে কিছু পড়াশোনা থাকতো তাহলে দেখাটা আরও বেশি উপভোগ্য হতো। তারপর আমরা সাত জন মিলে গেট দিয়ে বের হয়ে আসলাম। আমরা ঢুকেছিলাম এক গেট দিয়ে আর বের হলাম মেইন গেট দিয়ে। আমার ফোনে রুবাইদা কল দিয়ে জানাতে লাগলো যে, সবাই রওয়ানা দিয়ে দিতে চায়। আমি বলে দিলাম সবাই যদি চলে যেতে চায় তাহলে যেন চলে যায়, আমরা আমাদের মত করে ফিরবো। কিন্তু অবনী এই কথা শুনে বললো, ‘ফাইজলামি নাকি- আমি কমিটি মেম্বার, আমাকে ফেলে গোয়েল চলে যাবে- এতবড় সাহস! এটা কোন কথা হলো?’। আমরা যেন হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম আমাদের সাথে একজন কমিটি মেম্বার আছে। আমরা খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম, যাক আমাদের ফেলে তাহলে গোয়েল চলে যাবে না!
আমরা একটা খালি অটো ঠিক করলাম। অটোটার পিছনে স্পেয়ার চাকা রাখার জায়গাটাতে তানভীর আর ইশতিয়াক জড়াজড়ি করে বসলো। আর আমরা পাঁচজন মেয়ে সামনে গাদাগাদি করে বসলাম। প্রবল বেগে ঢাল বেয়ে আমাদের অটো নিচে নামতে লাগলো। দু পাশের চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা চলতে লাগলাম। হঠাৎ দেখলাম ময়ুর। একটা দুটা নয়, অনেক ময়ুর। আমাদের দেশে গ্রামে যেমন হাঁস মুরগি ঘুরে বেড়ায়, এখানে রাস্তার দুপাশের জঙ্গলে তেমনি রংচঙ্গে ময়ুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক্ষণ ধরে পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে নামতে একসময় আমাদের অটো সমতলে এসে থামলো। থামলো একেবারে জলমহলের পাশে। অটোতে বসে থাকতে থাকতেই আমরা জলমহলের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। অটো থামতেই পার হেড ২০ রুপি ভাড়া দিয়েই দৌড় দিলাম।
চকচকে সাগর লেকের উপর হালকা হলুদ রঙের বিল্ডিংটার দিকে তাকালেই মনে হবে, ‘ইশ, যদি ভিতরে যেতে পারতাম’। যাওয়ার ব্যবস্থা হয়তো আছে কিন্তু হাতে সময় নাই। দূর থেকে তাকিয়েই দেখে নিলাম জলমহল। এখানে নাকি রাজা প্রথম মাধো সিং হাঁস শিকার করতে আসতেন! কি আর বলবো, কিছু বলার নাই……
আমাদের লোকজনদের দেখলাম সবুজ ঘাসের উপর বসে থাকা হকারদের কাছে গিয়ে স্যান্ডেল দামাদামি করতে। শেষমেশ কয়েকজনকে দেখলাম ১০০ রুপি দিয়ে জোড়া স্যান্ডেল কিনে নিতে। অনেকেই আবার বললো মার্কেটে এর চেয়ে কম দাম হতে পারে। আমাদের দেখেই সবাই চটজলদি গোয়েলে উঠে পড়লো। দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নাই। কিন্তু এখানেও কিছু খাওয়ার নাই। কি আর করা, খালি পেটেই উঠে পড়লাম বাসে। বাস ছেড়ে দিলো। গন্তব্য বাবুবাজার।
সন্ধ্যার সময় বাবুবাজার আসার আগেই সারি সারি দোকানপাট দেখে আমরা নেমে গেলাম। আমি ভাবলাম কোন খাবারের দোকান থেকে কিছু কিনে নিবো। কিন্তু তেমন কোন খাবারের দোকান পেলাম না। আশেপাশের সব দোকানেই মোটামুটি একই জিনিস। দু ধরনের পায়জামা সারি সারি করে ঝুলানো সব দোকানে। এক ধরনের পায়জামা অনেকটা আলাদিন যেরকম পরতো সেরকম, অন্যটা আলাদিনের জিনি যে ধরনের পায়জামা পরতো সেরকম। দাম ১০০ থেকে ১২০ রুপির মতন। পায়জামাগুলো দেখে মনে হলো সিল্ক, জর্জেটের শাড়ি কেটে বানানো। বিভিন্ন দোকানে কাঁচ বসানো ঘাগড়া, বিছানার চাদর, পর্দা, কুশন কভার, ব্যাগ, ওড়না, গিফট আইটেমের মধ্যে কলম, কৌটা, চাবির রিং, নোটবুক ইত্যাদি ঝিকমিক করছে। এছাড়া আছে শাড়ি, জুয়েলারি, স্যান্ডেল, টপস, গিফট আইটেম, শো পিস ইত্যাদি। দোকানদারগুলা বেশ ঘাগু। ইচ্ছা মত দাম হাঁকায়, যার কাছ থেকে যা রাখতে পারে। আর একবার দোকানে ঢুকলে সহসা কাস্টোমারকে খালি হাতে বের হতে দেয় না। আমি আর রুবাইদা হাঁটতে লাগলাম। এরই মধ্যে রুবাইদা কয়েকটা শাড়ি, কুশন কভার, জুয়েলারি, ব্যাগসহ বেশ কিছু কেনাকাটা করে ফেললো। আমরা অনেক্ষণ ধরেই ঘুরতে লাগলাম। আমার কাছে জিনিসপত্র তেমন পছন্দ হচ্ছিলো না। সবার কাছ থেকে শুনে মনে হয়েছিলো জয়পুরের জিনিসপত্র অনেক সুন্দর হবে। কিন্তু সব কিছুই কেমন যেন ঠুনকো লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো কিছুদিন ব্যবহার করলেই সব নষ্ট হয়ে যাবে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো হয়তো আমরা ঠিক জায়গায় শপিং করতে আসি নাই। হয়তো আরও ভালো শপিঙের জায়গা ছিলো।
রাতে এক পর্যায়ে সব দোকানপাট একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। তখন আমরা হাঁটতে হাঁটতে জহুরি বাজার নামের এক জায়গায় ‘দি ফ্রেন্ডস’ নামের এক দোকান পেলাম। এটা অনেকটা মোহাম্মদপুরের সোর্সের মতন দোকান। অবনী এখান থেকে ৫০ রুপি দিয়ে সুন্দর আংটি কিনেছে। দেখে আমার বেশ পছন্দ হলো। আমিও দুইটা আংটি কিনলাম। জুবায়ের আর রাজীবকে দেখলাম চামড়ার কভার দেওয়া স্কেচ বুক কিনতে। তারপর আমরা কয়েকজন মিলে অটো ঠিক করছিলাম। এমন সময় রুবাইদা ফুটপাথে এক লোকের কাছ থেকে ৫০ রুপি দিয়ে সাদা রঙের তিনটা চুড়ির একটা সেট কিনলো। আমি দুসেট নিলাম ১০০ রুপি দিয়ে। সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। লোকটা তাড়াহুড়া করে আমাদের দিলো। তারপর আমরা অটোতে করে রওয়ানা হই হোটেলের দিকে।
হোটেলে নেমে আমরা বের হই খাওয়ার দোকানের খোঁজ করতে। লোকজন দেখিয়ে দেয় রাস্তা। অনেক দূর হেঁটে আমরা এক খাওয়ার দোকান পাই। সেখানে বসে আমরা মেনুর উপর চোখ বুলাই। আলু মটর, পনির মটর, আলু টমাটো- সব স্পাইসি খাবার ছিলো। আমার একদম মশলা খেতে ইচ্ছা করছিলো না। অনেক ভাবনা চিন্তা করে আমি অর্ডার দেই ৩৭ রুপির নান আর ভেজ রায়তা। আর রুবাইদা অর্ডার দেয় বেগুন ভর্তা আর ভাত। আমার ভেজ রায়তা ভালোই ছিলো- টক দইয়ের সাথে সিদ্ধ আলু কিউব। কিন্তু রুবাইদার ভাত আর বেগুন ভর্তা দেখে আমাদের চোখ কপালে উঠে গেলো। টকটকে লাল রঙের ঝোলের একটা তরকারি দিয়ে গেলো। রুবাইদা একবার জিজ্ঞেস করে শিওর হলো যে এটা বেগুন ভর্তা কিনা। ভাতের চালটা মোটা আর হালকা লাল রঙের ছিলো। রুবাইদা সাবধানে ‘বেগুন ভর্তা’ সেই ভাতের সাথে মাখিয়ে মুখে দিলো। তারপর জানালো, খেতে খারাপ না, ভালোই। যদিও বেগুন ভর্তা না হয়ে বেগুনের তরকারি মনে করে খেলে ভালো হতো, তারপরও জয়পুরে এসে জয়পুরি স্টাইলের বেগুন ভর্তা আর ভাত খেয়ে রুবাইদা বেশ খুশি।
খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা উল্টা পাশের মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি কিনে খাই। একেবারে আসল জয়পুরি মিষ্টি! তারপর আমরা রওয়ানা দেই হোটেলের দিকে। হলুদ সোডিয়াম লাইটের আলোতে আমরা হাঁটতে থাকি। ততক্ষনে প্রায় রাত ১১টা বেজে গেছে। আমরা বিস্তর হাসাহাসি করতে করতে নির্জন আবাসিক এলাকার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে থাকি। এক পর্যায়ে রুবাইদা বলে, ‘চিন্তা করে দেখ, ঢাকা শহরে আমার কলিজায় সাহস হবে না রাত ১১টার সময় এভাবে রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে। আর এখন……’। আমিও ভেবে দেখলাম কথাটা ঠিক। বাসায় যদি জানে যে আমি রাত ১১টার সময় রাপা প্লাজার দিকে হেঁটে হেঁটে বাসায় আসছি, আম্মু পিটিয়ে চামড়া তুলে ফেলবে। অথচ এখন কত অবলীলায় হেঁটে যাচ্ছি, কেউ কিছু বলছে না।
হোটেলে ফিরে আমি আবিষ্কার করলাম, বাথরুমে রেলিঙের উপর আমি যে পায়জামা রেখে গিয়েছিলাম তার উপর পাখি এসে বাসা বুনে গেছে। পুরা বাথরুমে খড়কুটা ছড়ানো আর আমার পায়জামার উপর আস্ত পাখির বাসা। রুম সার্ভিসে খবর দিলাম। লোকজন এসে আমাদের বাথরুম পরিষ্কার করে দিলো। আমার খড়কুটা, মাটি লাগানো পায়জামাটা দিয়ে গেলো। এই পায়জামা নিয়ে যা করার তা আগামীকাল ভেবে দেখবো- এই চিন্তা করে আমি শুয়ে পড়ি। সারাদিনে পরিশ্রম কম হয় নাই। তাই ডবল বেডে পাঁচ জন প্যাকড হয়ে শুয়েও সাথে সাথেই ঘুমিয়ে গেলাম।