সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেলো। তাড়াহুড়া করে যখন নিচে নামলাম তখনই বাস প্রায় ছেড়ে দিবে দিবে ভাব। হোটেল থেকে বের হতেই দেখি গলিতে মানুষ জন বড় বাঁশ, দড়ি, ডেকচি নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। ঘটনা কি বুঝলাম না। আমি একটু হেঁটে রাস্তার পাশের দোকানে গরম গরম ভাজা ডাল্পুরি দিয়ে নাস্তা সেরে ফেললাম। ১৫ রুপিতে দুইটা ডালপুরি। পাশেই আবার ডিম সিদ্ধ করা হচ্ছে। রুবাইদার উৎসাহে আমিও ওর সাথে ১০ রুপি দিয়ে ডিম সিদ্ধ কিনে খেলাম। নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য লাগছিলো যে আমি বেড়াতে এসে পয়সা খরচ করে ডিম সিদ্ধ কিনে খাচ্ছি, সো অ্যামেজিং!
খেয়ে দেয়েই দৌড় লাগালাম গোয়েলে উঠার জন্য। গোয়েলে উঠে দেখি মেয়েরা অনেকেই সালোয়ার কামিজ পরেছে। দেখতে সবাইকে সুন্দর লাগছিলো। কয়েক জন এসে পৌঁছানোর আগেই দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে বাস ছেড়ে দিলো। আমাদের প্রথম গন্তব্য হুমায়ুন্স টম্ব। ঝলমলে রোদের মধ্যে আমরা চলতে শুরু করলাম। আমার বেশ গরম লাগছিলো। একটা সোয়েটার খুলেই ফেললাম। খানিক্ষন পরেই পৌঁছে গেলাম হুমায়ুন্স টম্বে। বাস থেকে নেমে কমিটির লোকজন টিকেট কাটতে গেলো। আমরা ১০ রুপি করে জমা দিলাম টিকেট কাটার জন্য। টিকেট পেয়ে আমরা লাইন ধরে ভিতরে ঢুকতে লাগলাম।
বিশাল বিশাল গেটের ভিতর দিয়ে ঢোকার সময় কেমন যেন এক অদ্ভূত প্রশান্তির অনুভূতি হচ্ছিলো। মেইন টম্বে ঢোকার আগে ধাপে ধাপে ইতিহাসের বর্ননা ছিলো। হুমায়ুনের কথা, তার বীরত্বের কথা, এই কমপ্লেক্স বানানোর কথা, এর তুর্কি আর্কিটেক্টের কথা, চারবাগের আইডিয়ার কথা, রেড স্যান্ডস্টোনের জালি বানানোর কথা, কেমন করে এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত কয়ে ছিলো সেই কথা, তারপর আবার কেমন করে এগুলো রেনোভেশন করা হয়েছে তার কথা- এই সব দেখতে দেখতে আমি আর সামনে যেতেই পারছিলাম না। এত সুন্দর করে সব বর্ণনা করে রেখেছে যে না দেখেও যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু এক সময় টের পেলাম অনেক সময় লাগবে সব পড়তে গেলে। শেষে কি আর করা সব না পড়েই ছুটতে শুরু করলাম। অবশেষে দেখা পেলাম চার বাগের মধ্যখানে দাঁড়ানো সেই টুকটুকে লাল বিল্ডিঙের- ‘হুমায়ুন্স টম্ব’।
আমরা সিঁড়ি বেয়ে যখন অনেক উঁচু প্ল্যাটফর্মটিতে উঠতে গেলাম তখন দেখলাম সিঁড়ির রাইজার অমানুষিক উঁচু। আমরা প্রায় হাঁপিয়ে গেলাম। টনটনে পা নিয়ে একসময় উপরে উঠে গেলাম আমরা। কি যে ভালো লাগছিলো বলা যাবে না! আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক কবর- এগুলো সবই মুঘল বংশের সদস্যদের কবর। আর ভেতরে তাকিয়ে দেখলাম হুমায়ুনের কবরের উপরের ঢিবিটা। চারপাশে সবুজ ঘাসের বাগানের মাঝখানে এরকম জায়গায় কবর না হয়ে যদি থাকার জায়গা হতো তা হলে মনে হয় বেশি ভালো হতো। তবে নিশ্চয়ই চারপাশের যে শান্তিময় পরিবেশটা আছে, কবরবাসীদের মৃত্যু পরবর্তী কবর জীবনটাও যেন এইরকম শান্তির হয় সেই কথা চিন্তা করেই এ রকম স্ট্রাকচারটা বানানো হয়েছে। কিন্তু কোথাও কবরবাসীদের জন্য বসে দোয়া করার জায়গা দেখলাম না। পুরা জায়গাটাকেই দর্শনীয় স্থান হিসেবে বানিয়ে রাখা হয়েছে। উপর থেকে দাঁড়িয়ে যখন চারপাশটা দেখছিলাম তখন ভীষণ শান্তির এক অনুভূতি লাগছিলো। জায়গাটার মেইন্টেনেন্স অত্যন্ত ভালো। শুধু চারবাগের সেই সব অত্যাশ্চর্য পানির নহর গুলো নেই। বাদবাকি সব কিছুই অত্যন্ত যত্নের সাথে রক্ষা করেছে ভারত সরকার। রাজকীয় সেই টম্ব কমপ্লেক্স থেকে নেমে আসতে আসতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছিলো মনের ভেতর। মনে হচ্ছিলো মুসলমান হয়ে মৃত্যুর পরে সমাধির জন্য যাদের এত রাজকীয় ব্যাপার স্যাপার, জীবদ্দশায় কি বিপুল সম্পত্তিই না তারা ইহজীবনে ভোগ করে গেছে। আবার মনে হচ্ছিলো কি মেধা আর সম্পদই ছিলো আমাদের, স্যান্ডস্টোন আর সাদা মার্বেলের কি নিখুঁত কারুকাজ করার দাপট, বেহেশ্তের কন্সেপ্টের কি অপরূপ বাগান আর প্রাকৃতিক নহরকে কৃত্রিমভাবে ব্যবহার করার কি কৌশলই না ছিলো তাদের- অবিশ্বাস্য!
এই টম্ব থেকে বের হয়ে দেখলাম এখানে আরও অনেকগুলো সমাধি আছে। সব গুলোতে যাওয়ার আর সময় হলো না। দৌড়ে দৌড়ে দেখে এলাম ইশা খানের গার্ডেন টম্ব, হালিমা বুর টম্ব, আফসার ওয়ালা টম্ব -এই গুলো। আমার খুব ইচ্ছা করছিলো আরও কিছুক্ষন থেকে ধীরে ধীরে সব কিছু দেখতে, কিন্তু সবাই তাড়া দিতে লাগলো- বাস নাকি ছেড়ে দিবে। আজকে শুক্রবার, জুম্মার নামাজ আছে। কি আর করা, কিছুটা অতৃপ্তি নিয়েই বের হয়ে আসলাম এই কমপ্লেক্স থেকে। বের হয়ে দেখি সবাই এক আইস্ক্রিম ওয়ালাকে থামিয়ে আইস্ক্রিম খাচ্ছে। আমিও খেলাম শীতের মধ্যে আইস্ক্রিম- মাদার ডেইরির স্ট্রবেরি ক্রাশ মাত্র ৩৫ রুপি দিয়ে। অনেক মজা ছিল আইস্ক্রিমটা। মুখে দিলেই স্ট্রবেরির বিচি গুলো দাঁতের মধ্যে কিচ কিচ করছিলো। আমি অন্য ফ্লেভারগুলোও টেস্ট করে দেখলাম। সবগুলোই মজার।
আমরা গোয়েলে উঠে বসলাম। কিন্তু ইশতিয়াক, নিলয় আর শুভকে পাওয়া গেলো না। ওদের ছাড়াই আমরা রওয়ানা হয়ে গেলাম। মিনিট খানেক পর ওরা বাসের পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে আসলো। ওরা বাসে উঠলে সবাই ওদের বেশ পঁচালো। এবার আমাদের গন্তব্য জামে মসজিদ। আগের বার যারা ঠিকমত খেতে পারে নাই তারা প্ল্যান করলো এই গিয়ে কি কি খাবে। যারা আগেরবার ‘করিমস’ এ খেয়েছিলো তারা অন্যদের বলে দিলো যে দাম আন্দাজ খাবার তেমন আহামরি কিছু না। আমরা সব কিছু প্ল্যান করতে করতেই চলে আসলাম জামে মসজিদের কাছাকাছি। গোয়েল আমাদের নামিয়ে দিলো। আমরা হাঁটতে লাগলাম। আগেরবার বৃষ্টি থাকায় রাস্তা অনেক নোংরা ছিল। আজকে কড়কড়ে রোদ থাকায় রাস্তাটা আগের দিনের মত আর নোংরা লাগলো না। জামে মসজিদের পাশে হঠাৎ বিরাট এক দাড়িওয়ালা ছাগল দেখলাম। অবনী আবার সেটার সাথে পোজ মেরে ছবি তুললো। আগের মত জমজমাট খাবারের দোকান গুলো পার হয়ে লাগলাম। অনেক ভীড় রাস্তায়। আমরা ঠিকমত হাঁটতেই পারছিলাম না। মনে হলো জুম্মার জামায়াত ভেঙ্গেছে। লোকে লোকারন্য ফুটপাথের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে নিশাত, রিন্তু, তমাদের সাথে আমি, রুবাইদা, অন্তরা, মিম ঢুকে পড়লাম ‘আল জাওয়ারিহি’ নামের এক হোটেলের দোতলায়।
এই হোটেলটা বেশ বড়। আমি মেনু দেখে ৯ রুপির নান আর ৪৫ রুপির শিক কাবাব অর্ডার দিলাম। আসতে একটু সময় লাগলো। আমরা চারপাশ দেখতে লাগলাম। অনেক বিদেশি এসেও খাচ্ছে এখানে। হোটেলের পরিবেশটা আমার কাছে আমাদের দেশের স্টার কাবাবের মত লাগলো। খাবার আসার পর ঝাঁপিয়ে পড়লাম খাবারের উপর। মজা করে খেলাম কাবাবটা। খাওয়া দাওয়া শেষে ভাবলাম আবার কই না কই যাবো, একটু বাথরুমে যাওয়া দরকার। লোকজনকে জিজ্ঞেস করতেই সবাই দেখিয়ে দিলো উপরে উঠার সিঁড়ি। আমরা সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠলাম। সেখানে একটা মাত্র বাথরুম। তাতে আমরা লাইন দিলাম। তবে বাথরুমটা ছোট হলেও পরিষ্কার, সব চেয়ে বড় কথা এই বাথরুমে একটা বদনা আছে। ইন্ডিয়াতে কলকাতার বাইরে এই প্রথম কোন বাথরুমে বদনা দেখতে পাই। হাত মুখ ধুয়ে শেষমেষ আমরা বের হয়ে যাই।
এবার হাজির হই কল্যান সুইটসে। আগেরবারের বাদাম দুধের দুঃখ ভুলতে গিয়েই অর্ডার দেই ২৬ রুপির সেই জিনিস। এমনিতেও পেট ভরা ছিল। পুরো এক গ্লাস খেয়ে শেষ করতে পারবো না বলেই মনে হচ্ছিলো। অন্তরার সাথে শেয়ার করি সেই গ্লাস। জিনিসটা এত্ত ঘন, মনে হচ্ছিলো যেন সুস্বাদু কোন ফিরনি খাচ্ছি গ্লাসে করে। কল্যান সুইটস থেকে বের হয়ে এবার সোজা হাঁটা দেই মসজিদের দিকে। অনেক সিঁড়ি পার হয়ে উঠতে থাকি জামে মসজিদের গেটের দিকে। গেটে এক লোক আবার বাধা দিলো ক্যামেরা নিয়ে ভিতরে ঢুকতে। আমি আর রাত্রি বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম। আশেপাশে খুঁজলাম ক্যামেরা জমা দেওয়ার কোন জায়গা আছে কিনা। কিন্তু সেরকম কিছু পেলাম না। এক সময় গেট থেকে সেই লোকটা সরে যেতেই আমি আর রাত্রি সুড়ুৎ করে ভিতরে ঢুকে পড়লাম।
ভিতরে পা রাখলাম রেড স্যান্ডস্টোনের বিশাল প্রান্তরের উপর আর অন্য মাথায় দেখতে পাচ্ছিলাম লাল, সাদা পেয়াজাকৃতি গম্বুজ ওয়ালা মসজিদটাকে। সেই শাহজাহানের আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কত কোটি কোটি মানুষ নামাজ পড়তে এসেছে এই জায়গায়- মসজিদটাকে দেখে আমার মনে তাই এক ধরনের শিহরন জাগলো। আমি ভালো করে দেখতে লাগলাম। চারপাশে উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা প্রান্তরটিতে শুধুই এই রুচিশীল মসজিদটা দাঁড়িয়ে আছে রাজার মত। আর তার সামনে মনের আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে শত শত কবুতর। মসজিদ বরাবর ঠিক সামনে ছোট একটা হাউজের মত। সেখানে লোকজন সবাই ওযু করছে। আমি ধীরে ধীরে ঢুকে পড়লাম মসজিদটিতে। নামাজের ওয়াক্ত নেই বলে সেখানে লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। বিশাল বিশাল কারুকাজ করা আর্চের নিচ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিলো। শুভ, জুবায়েরকে দেখলাম দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। এত বড় স্থাপনা্ কিন্তু কেমন যেন নিস্তব্ধভাব, আবার ঠিক নিস্তব্ধও নয় ভেসে ভেসে আসা শব্দের জোরে কেমন যেন থমথমেভাব।
আমি খুঁজতে লাগলাম মেয়েদের নামাজ পড়ার জায়গা কোথায় আছে। শেষ মেষ অনেক খোঁজাখুঁজি করে আবিষ্কার করলাম মেয়েদের আলাদা কোন জায়গা নাই, যেকোন খানেই নামাজ পড়া যায়। তারপর আমি আর রুবাইদা বাউন্ডারি ওয়ালের পাশে এক জায়গায় বসে তাড়াহুড়া করে যোহরের নামাজ আদায় করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়লাম। তারপর বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম আসরের ওয়াক্তের জন্য। বসে বসেই দেখলাম অবনী হাউজের পানি দিয়ে ওযু করছে। কয়েকজন বিদেশিকে ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম। অনেকেই লুকিয় লুকিয়ে টুকটাক ছবি তুলতে লাগলো। অবশেষে আসরের নামাজ পড়ে আমি, রুবাইদা আর অবনী বের হয়ে আসলাম জামে মসজিদ থেকে।
এরপর হাঁটতে লাগলাম রেড ফোর্টের দিকে। হঠাৎ দেখলাম এক লোক কিউই ফল কেটে বিক্রি করছে। অবনীকে দেখলাম লাফিয়ে লাফিয়ে কিউই কিনতে, এটা নাকি ওর খুব প্রিয় ফল। ওকে দেখে আমারও খুব খেতে ইচ্ছা করলো। কিন্তু দুপুরের শিক কাবাব, নান আর বাদাম দুধ খাওয়ার পর পেট পুরো টইটুম্বুর ছিলো। খাবো কি খাবো না ভাবতে ভাবতেই ১০ রুপি দিয়ে কিউই কিনে খেয়ে ফেললাম। হালকা স্বাদের রসালো ফলটার উপর বিট মশলা ছিটিয়ে দিয়েছে। খেতে ভালই লাগলো। আবার হাঁটতে লাগলাম। নেতাজী সুভাস মার্গ মেইন রোডে উঠে বাম দিকে হেঁটে রেড ফোর্টের দিকে যেতে লাগলাম। রাস্তা পার হতে আমাদের সেই বেগ পেতে হলো। অবশেষে রাস্তা পার হয়ে আমরা রেড ফোর্টের সামনে আসলাম। অবনী টিকেট কেটে আনলো। আমরা ভিতরে ঢুকে পড়লাম।
আমরা ঢুকলাম লাহোর গেট দিয়ে। ঢুকতেই সামনে পড়লো এক বিশাল মীনা বাজার। সবগুলো দোকানই সুভেনিয়র শপ। ছোটবেলায় বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে গিফট পাওয়া কাঁচ বসানো কলম, নোটবুক, চাবির রিং, কাঠের আয়না, কাঠের কলম এই সব জিনিস গুলোকে ঝলমল করতে দেখলাম দোকানগুলোতে। রুবাইদা এক দোকানে ঢুকে মেটাল আর পাথরের মিনা করা ঢাউস সাইজের আংটি কিনলো। আমরা আস্তে আস্তে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি অনেকে ফেরত চলে আসছে। কারণ জিজ্ঞেস করতেই অদিতি বললো, সব কিছু নাকি বন্ধ করে দিচ্ছে আর তেমন ভালো কিছু নাকি দেখার নাই। আমরা পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু কিছুদূর যেতেই গার্ড টাইপের একজন সামনে আর যেতে নিষেধ করলো। ৫টার সময় সব বন্ধ হয়ে যাবে। তাই আমাদের আর ঢুকতে দিলো না। কি আর করা, আমরা আবার উল্টা দিকে হেঁটে সেই মিনা বাজারের ফেরত আসলাম। অনেককেই দেখলাম মজার মজার জিনিস কেনাকাটা করতে। অদিতি ছোট ছোট কাঠের দাবার বোর্ড কিনলো অনেকগুলো। ১৫০ রুপি করে একেকটার দাম পড়েছে। ও আফসোস করে বললো, দাম বোধহয় আরেকটু কমানো যেতো। এখান থেকে কোথায় যাবো সেটা ঠিক করার চেষ্টা করতে লাগলাম। প্ল্যান অনুযায়ী আমাদের বাসে করে ইন্ডিয়া গেট যাওয়ার কথা। কিন্তু যাদের জিজ্ঞেস করলাম তারা কেউই ইন্ডিয়া গেট রাজি নয়। কারন দিল্লী আসার পর থেকে আসা যাওয়ার পথে আমরা প্রায় দুই তিন বার ইন্ডিয়া গেট দেখে ফেলেছি। এখন সেখানে গিয়ে নেমে দেখার কোন মানেই হয় না।
দেখলাম বেশির ভাগ মানুষ শপিং করতে যেত চায় ক্যারোলবাগ। আমরাও ঠিক করলাম ক্যারোল্বাগ যাবো। ফোর্ট থেকে বের হয়ে সামনে আমরা সবাই জড়ো হলাম। দেখলাম কেউই ইন্ডিয়া গেট যেতে চায় না। পরে ঠিক হলো বাসে করেই আমরা ক্যারোল বাগ যাবো। আমরা লাইন ধরে হেঁটে হেঁটে সূর্যাস্তের সময় গোয়েলের কাছাকাছি পৌঁছালাম। ওরা বাস ড্রাইভারকে বলতেই ওনারা রাজী হয়ে গেলো যে পার্কিং এ যাওয়ার আগে আমাদের ক্যারোলবাগ নামিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু বাসে উঠে আবিষ্কার করলাম নোভা, বাঁধন, মৌলি, উর্মি, জাফর, চিং – ওরা সবাই ইন্ডিয়া গেট যাওয়ার জন্য বসে আছে। আমরা সবাই ক্যারোল্বাগ যাবো শুনে ওরা মনে করিয়ে দিলো যে প্ল্যান অনুযায়ী এখন ইন্ডিয়া গেট যাওয়ার কথা। প্ল্যান চেঞ্জ যে হয়েছে- সেটা সবাইকে না জানিয়ে হুট করে কেন করা হলো সেটা নিয়ে হঠাৎ কথা উঠতে লাগলো। এক পর্যায়ে অবনী, শুভ ওরা রাগ করে বাস থেকে হুট করে নেমে গেলো। আমি দৌঁড়ে গিয়ে অবনীকে থামালাম। অবনী গিয়ে শুভকে বুঝিয়ে ধরে নিয়ে আসলো। ওদিকে সীমান্ত ড্রাইভারের সাথে আলোচনা করতে গেলো যে যদিও দুইটা উল্টা পথ, তারপরও কোনভাবে দুই জায়গাতেই বাস নেওয়া যায় কিনা। ড্রাইভার পরে রাজী হলো আগে ইন্ডিয়া গেট হয়ে পরে ক্যারোলবাগ আমাদের নামিয়ে বাস পার্কিং করতে যাবে। ততক্ষণে ইন্ডিয়া গেট পার্টি আবার ডিসিশন নিয়ে ফেলেছে যে ওরা বাস থেকে নেমে নিজেদের মত ইন্ডিয়া গেট যাবে। তখন সীমান্ত আবার চেতে যায়, কারণ ও এতক্ষণ ধরে ড্রাইভারকে বুঝিয়ে এসেছে যে আমরা দুই জায়গাতেই যাবো। শেষমেশ সবাই মুখ গম্ভীর করে বসে থাকে আর আমাদের নিয়ে গোয়েল রওয়ানা দেয়।
গোয়েল আমাদের নিয়ে প্রথমে ইন্ডিয়া গেটের দিকে যেতে থাকে। পুরো বাসে একমাত্র মৌলি আর চিং হাসিমুখে কথা বলে ব্যাপারটাকে খুব স্বাভাবিক করে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। ওদিকে রুবাইদা চোখ বন্ধ করে ঘুম দেয়। আমরা বাকি সবাই চুপচাপ বসে থাকি। ইন্ডিয়া গেট আসলে ওরা সবাই নেমে যায়। এরপর আমরা যেতে থাকি ক্যারোলবাগের দিকে। কিন্তু রাস্তায় অনেক জ্যাম। জ্যামে বসে থাকতে থাকতে বিরক্তি ধরে যায়। ওদিকে আটটার দিকে আবার ক্যারোল্বাগ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু কিছু করার নেই। অনেক জ্যাম ঠেলে একসময় আমাদের এক জায়গায় বাস নামিয়ে দিলো। আমরা সেখান থেকে হাঁটতে লাগলাম। যখন পৌঁছাই ততক্ষনে দোকান পাট প্রায় বন্ধ হই হই করছে। হিমি একটা দোকানে ঢুকে টপ্স কিনতে লাগলো। রাস্তার উপর অনেকেই পালাজ্জো আর ওয়ান পিস সাজিয়ে রেখেছে। সেখান থেকেও অনেকে কেনা কাটা করতে লাগলো। কৌশিক সব কিছুই মাপ দিয়ে দেখছিলো শান্তার সাইজের হবে কিনা! আমার ইচ্ছা ছিলো ফাস্ট ট্র্যাকের একটা ঘড়ি কিনবো। আগের বার যখন দিল্লী আসি তখন রাজীব চকে ফাস্ট ট্র্যাকের একটা ঘড়ি খুব পছন্দ হয়েছিলো আমার। পরে চন্ডীগড়ে গিয়ে খুঁজেছিলাম কিন্তু ফাস্ট ট্র্যাকের শো রুম পাই নাই। ফাহাদ আমাকে বলেছিলো ক্যারোল্বাগে ফাস্ট ট্র্যাকের সবচেয়ে বড় শো রুম আছে। তাই এখানে এসে আমি ঢুকতে চাইলাম ফাস্ট ট্র্যাকে। কিন্তু হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে দোকানপাট সব বন্ধই না হয়ে যায়। আমি রুবাইদাকে সাথে নিয়ে খুঁজতে যাই দোকানটা। কিন্তু রাস্তার দুপাশে একে একে সব দোকান বন্ধ হয়ে যেতে দেখে অনেক দূর হেঁটে গিয়েও আবার ফেরত আসি। ফুটপাথে একজনকে অনেকগুলো ক্লাচ ব্যাগ সাজিয়ে রাখতে দেখি। আমি ৩০০ রুপি দিয়ে তিনটা ব্যাগ কিনি। অনেকে আবার ম্যাকডোনাল্ডে খাওয়াদাওয়া করতে যায়। নিরিবিলি হলুদ সোডিয়াম লাইটের আলোতে হেঁটে হেঁটে কিছু দূর গিয়ে আমি, রুবাইদা, হিমি আর সীমান্ত অটো ভাড়া করে রওয়ানা দেই হোটেলের উদ্দেশ্যে। আমাদের পার হেড ভাড়া পড়ে ২৪ রুপি। আমার আর রাতে খাওয়ার কোন ইচ্ছা ছিলো না। দুপুরের খাওয়াটা তখনও ঠিকমত হজম হয় নাই। পেট ভার হয়ে ছিলো। ঠিক হলো সীমান্ত আর রুবাইদা হোটেলের কাছে নেমে যাবে খাওয়ার জন্য আর আমরা হোটেলে চলে যাবো।
হোটেলের কাছাকাছি এসে আমরা আর গলি চিনতে পারি না। চিনবো কেমন করে- আমাদের গলিতে যে বিয়ের আয়োজন হচ্ছে! সারা গলিতে প্যান্ডেল টানিয়ে, ঝলমলে আলো জ্বালিয়ে, জোরে গান ছেড়ে ধুমধাড়াক্কা বিয়ের আসর বসেছে। আমাদের অবস্থা এমন যে হোটেলে ঢুকতে হলে বিয়ের অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। কি আর করা, আমরা লাইন ধরে গলি তথা প্যান্ডেল তথা বিয়ের অনুষ্ঠানে ঢুকলাম। পুরা গলি জুড়েই প্যান্ডেল টানানোর ফলে অনেক বড় বড় বসার জায়গা, খাওয়ার যায়গা আর রান্না করার জায়গা পাওয়া গেছে। প্রথমে যে জায়গায় ঢুকলাম সেটা ছিলো বসার জায়গা। অনেক চেয়ার সাজানো। একটা স্টেজও দেখলাম তবে বর বা কনে নেই। খালি স্টেজ। আশেপাশে মহিলারা চকমকে পাথর দেওয়া শাড়ি পরে কড়া মেকাপ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছোট ছোট ছেলেরা দেখলাম গানের তালে তালে হাত পা ছেড়ে নাচা নাচির চেষ্টা করছে। এরপর পার্টিশন পার হয়ে আমরা খাওয়ার জায়গায় ঢুকলাম। এখানে মনে হলো বুফে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেক রকমের খাওয়া, কোনটার আবার খালি ডিশ পড়ে আছে। এরপর যে জায়গাটায় গেলাম সেটা রান্নাঘর। বড় বড় ডেকচিতে খাবার ঢেকে রাখা হয়েছে। কয়েকটা ডেকচি আবার খালি হয়ে পড়ে আছে। এর ঠিক পরেই ডেকচি, প্লেট, গ্লাস ধোয়ার জায়গা। সবই ধোয়া হচ্ছে রাস্তার উপরে। কিন্তু আমাদের সেই ধোয়াধায়ি করার জায়গা পর্যন্ত যেতে হলো না, তার আগেই আমাদের হোটেলের দরজা পেয়ে গেলাম। ভিতরে ঢুকতেই রিসিপশনের লোকটা আমাদের দেখে এক গাল হাসি দিলো। উনি জানালো এখানে এভাবে গলিতেই বিয়ের আয়োজন করা হয়। আশেপাশের মানুষের একটু কষ্ট হলেও কেউ কিছু বলে না। সবাই মেনে নেয়। আমরা জিজ্ঞেস করলাম ওনারা দাওয়াত পেয়েছে কিনা। উনি জানালো গলির বিয়েতে দাওয়াত লাগে না। এমনিই যাওয়া যায়। চাইলে আমরাও যেতে পারি, কোন সমস্যা নাই। উনারা আরেকটু পরেই বিয়ে খেতে যাবেন।
রুমে ফেরার পর থেকেই পেটে কেমন অস্বস্তি হতে লাগলো। আগেই বুঝেছিলাম দুপুরে এত কিছু খাওয়া ঠিক হয় নাই। আমার রুমমেট সবাই চিন্তায় পড়ে গেলো আমার অসুস্থতা দেখে। হঠাৎ মজুমদার বোতলের পানিতে ইনো গুলিয়ে দিলো। বললো চটপট খেয়ে ফেলতে। আমি আগে কখনও ইনো খাই নাই। উপায় না দেখে ঢকঢক করে ইনো মিশানো পানি খেতে লাগলাম। তারপর বোতলটা মজুমদারের হাতে রেখে আমি দৌঁড়ে বাথরুমে গিয়ে ভক করে বমি করে দিলাম। বমি করে আমার একটু শান্তি শান্তি লাগলো। আমার রুমমেটরা ভয় ভয় চোখে তাকিয়ে রইলো। আমি ওদের আশ্বস্ত করলাম যে কোন সমস্যা নাই, আমি আল্লাহর রহমতে ভালো হয়ে গেছি। তার পর সবাইকে বললাম আমাদের বাথরুম ইউজ না করে যেন অন্যদের রুমের বাথরুমে সবাই যায়। তারপর ধীরে সুস্থে ব্যাগ গুছাতে শুরু করলাম।
সব কিছু গুছিয়ে আমরা আস্তে আস্তে একটামাত্র লিফট দিয়ে লাগেজ নামাতে থাকি। তারপর গোয়েলের পিছনে লাগেজ জমা দিয়ে বাসে উঠে বসি রাত সাড়ে ১১টার দিকে। আমাদের লাগেজ এত বেশি হয়ে গিয়েছিলো যে পিছনে আর আঁটছিলো না। তারপর আমাদের ইশতিয়াক, নিলয়সহ আরও কয়েকজন মিলে বড় বড় ভারি ভারি লাগেজগুলো এক হাতে ধরে ধরে বাসের ছাদে উঠিয়ে দিলো। এই অবর্ণনীয় কষ্ট ওরা কেমন করে করলো ওরাই জানে। সব শেষে ওরা বাসে উঠলো। আমাদের যাত্রাও শুরু হলো আগ্রার পথে। সিরিয়াল অনুযায়ী আজকে আমাদের পিছনে বসার কথা। রাত্রি বসলো জানালার পাশে, তার পাশে আমি, রুবাইদা, সুমাইয়া, সৃষ্টি, পৃথ্বী। সেই শুরুতে কলকাতার পর আবার ৯০ ডিগ্রি আঙ্গেলের সিট। তবে আশার কথা জার্নিটা বেশি বড় না। রাত্রির হাড্ডিসার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। তবে সারা জার্নিতে ঘুম আসলো না বললেই চলে।