দিনে যখন ঘুম ভাংলো, তখন ঘাড় আর কোমরে টনটনে ব্যাথা। ঘাড় মালিশ করতে করতে ছোট্ট সিটের মধ্যে নিজের পা টা মেলে ধরার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু তেমন কোন লাভ হচ্ছিলো না। আর বাসও টানা চলছিলো। থামাথামির যেন কোন বালাই নেই। বাসে গ্যাট মেরে বসে থাকা ছাড়া আর কোন উপায়ও ছিলো না। কি আর করা, আমরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করতে লাগলাম।
প্রায় দুপুর ১২টার দিকে আমরা দিল্লী পৌঁছালাম। সেই আগের ইউ কে হোটেলে উঠি। কিন্তু এইবার আমরা বরাদ্দ পাই সব পচা পচা রুম। প্রথমে আমরা একটা রুমে যাই, সেটার বাথরুম থেকে বোঁটকা এক রকম গন্ধ বের হচ্ছিলো। তাড়াতাড়ি সেইটা বদলে আমরা আরেকটা রুমে উঠি। এই রুমটা অনেক ছোট। রুমে আমাদের লাগেজ গুলো রাখার পর আর তেমন জায়গাই ছিলো না। আর বাথরুমটা খুবই পচা। সেটাতে টিমটিম করে একটা হলুদ লাইট জ্বলছিলো যেটা ভিতরের পরিবেশকে আরও জঘন্য করে দিচ্ছিলো। আমরা রুম পেয়ে খুব মন খারাপ করলাম। কিন্তু কি আর করা, হোটেল মালিক যে এরকম ধড়িবাজ সেটা কি আর আগে জানতাম? ওরা সবাই ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে। আমি মৌলির হিটারটা দিয়ে পানি গরম করে নেই। গোসল করতে গিয়ে আমার গা ঘিনঘিন করছিলো। কোনমতে তাড়াতাড়ি করে বাথরুম থেকে বের হই।
আগের সারাদিনে আমি শুধু একটা স্যান্ডুইচ আর এক প্যাকেট চিপস খেয়ে ছিলাম। আর সকালেও কিছু খাওয়া হয় নাই। আমরা তাই তাড়াতাড়ি করে বের হই খাওয়ার জন্য। হোটেলের কাছেই একটা দোকানে চিকেন বিরিয়ানি পাওয়া যাচ্ছিলো। লোকটা হালাল বলাতে ৪০ রুপি দিয়ে এক প্লেট চিকেন বিরিয়ানি অর্ডার দেই। পিয়াজের টুকরা দিয়ে সাজিয়ে এক প্লেট বিরিয়ানি এসে হাজির হয় সামনে। আমি গোগ্রাসে খাই। খাওয়া দাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে আমরা বের হয়ে আসি। আমরা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই অক্ষরধাম টেম্পল। কিভাবে যাবো জানতে চাইলে একেকজন একেক রকম কথা বলে। দিল্লীর লোকজনকে কোন কথা জিজ্ঞেস করে লাভ নাই বুঝে আমরা ট্রাফিককে জিজ্ঞেস করি যে কেমন করে অক্ষরধাম টেম্পলে যাওয়া যেতে পারে।
আমরা ৬০ রুপি দিয়ে আগের মত অটো ভাড়া করে রাজিব চকে যাই। সেখান থেকে আগের বার যে মেট্রো স্টেশনে গিয়েছিলাম সেখানে যাই। টোকেন কাটি অক্ষরধামের। মেট্রো আসতেই ঠিক ঠিক চড়ে বসি। সব মেট্রো পাতাল দিয়ে যায়, কিন্তু এই মেট্রো হঠাৎ করে পাতাল ফুঁড়ে আকাশে উঠে গেলো। ঝলমলে দিনের আলোয় নিচে দেখা গেলো দিল্লী শহর। একটু পর পর অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছিলো একেকটা স্টপেজের। আমরা কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করছিলাম কোন স্টপেজের কথা বলে। একটু পর পর খেয়াল করছিলাম আমাদের স্টপেজ আসে কিনা। আমাদের অবস্থা দেখে একজন জিজ্ঞেস করে আমরা কোথায় যাবো। অক্ষরধাম যাবো শুনে উনি বলে আপনাদের তো মেট্রো মাঝে বদলাতে হবে। শুনে আমরা ভয় পেয়ে যাই, কারণ এমন কথা আমাদের স্টেশন থেকে কেউ বলে দেয় নাই। উনি আমাদের বোঝাতে থাকেন যে, যমুনা ব্যাংক স্টপেজে আমাদের নেমে যেতে হবে, তারপর আরেকটা মেট্রোতে করে সোজা যাওয়া যাবে অক্ষরধাম। উনার কথায় আশেপাশের অনেকেই সায় দেয়। আমরা বলি যে আমাদের একটাই টোকেন। উনারা বলে এই এক টোকেনেই যাওয়া যাবে, নতুন করে ভাড়া দিতে হবে না। দিল্লীর মানুষের কথায় বিশ্বাস করাটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছলাম না। এছাড়া মেট্রোর ম্যাপ চেক করে দেখলাম ওনাদের কথার সাথে মিলে যাচ্ছে বিষয়গুলো, যা আছে কপালে ‘ফী আমানিল্লাহ’ বলে নেমে পড়লাম যমুনা ব্যাংক স্টপেজে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দেখি অন্য পাশে আর কোন মেট্রো নাই। মনে মনে আল্লাহ, আল্লাহ করতে লাগলাম। এমন সময় হুউউশ করে একটা মেট্রো আসলো। আমরা সেটাতে উঠে পড়লাম। সেটা সত্যিই আমাদের অক্ষরধাম নামিয়ে দিলো। মেট্রো থেকে নেমে দেখি সারা, রাত্রি, বাসিরুন, সুমাইয়া ওদেরকে। সারা বলতে লাগলো, ‘সাহস খুব বেড়ে গেছে রে, মেট্রোতে উঠে আবার মেট্রো চেঞ্জ করে অক্ষরধাম পৌঁছে গেলাম, সাহস খুব বেশী বেড়ে গেছে রে-’
মেট্রো স্টেশন থেকে বের হয়ে আমরা খোলা আকাশের নিচে এসে পড়লাম। এই জায়গার নাম অক্ষরধাম। এখন মন্দিরটা কই আছে খুঁজে বের করতে হবে। আমরা কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করলাম। সবাই রাস্তা দেখিয়ে দিলো। মোটেও দূর না। হাঁটা পথ। আমরা রাস্তা পার হয়ে পৌঁছে গেলাম অক্ষরধাম মন্দিরে। গেটে ঢুকার সময় সেই লেভেলের কড়াকড়ি। আমরা সবাই লাইন ধরে এক এক লেয়ারের সিকিউরিটি পার হয়ে হয়ে যেতে লাগলাম। এক জায়গায় আমাদের সবার ব্যাগ জমা নিয়ে নিলো। ক্যামেরা, মোবাইল ফোন, সোয়েটার- সব কিছু জমা দিয়ে প্রায় খালি হাতে আমরা শেষ নিরাপত্তা স্তরে প্রবেশ করলাম। এবার আমাদের সবার চেকিং চললো। আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বারবার প্যান্টের পকেট থাবড়ে থাবড়ে চেক করতে লাগলো। এক পর্যায়ে সারা বেশ চেতেমেতে সিকিউরিটি মহিলাকে ঝাড়ি মেরে দিলো। অবশেষে সব নিরাপত্তা স্তর পার হয়ে আমরা ভিতরে ঢুকলাম।
ভিতরে আলিশান ব্যাপার স্যাপার। চার পাঁচটা অত্যন্ত কারুকাজ করা গেট পার হতে হতেই আমাদের চোয়াল ঝুলে পড়লো। দুটা ময়ুর গেটের মাঝখানে অল্প পানির পুলের মধ্যে বিশাল দুইটা নকশা কাটা পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম। তাতে অনেক পয়সা জমে আছে। জানতে পারলাম, এটা হলো স্বামী নারায়নের পায়ের ছাপের রেপ্লিকা। বিশাল রাস্তার শেষ মাথায় অনেক উঁচুতে অনেক কারুকাজ করা নয় গম্বুজের লাল পাথরের মন্দিরটা দেখা যায়। আমরা সে দিকে হাঁটতে লাগলাম। আরও কিছুদূর হেঁটে জুতা জোড়া জমা দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম মন্দিরে ঢোকার জন্য। এতো এতো অলংকরন দেখতে দেখতে মাথা ঘুরে যায়। যা বুঝলাম মন্দিরটা নতুন কিন্তু বানানো হয়েছে পুরানো টেকনোলজি কাজে লাগিয়ে। পুরাই পাথরের মন্দির, কোন আরসিসি নাই। আর পাথরের দেয়াল কুঁদেই লাখ খানেক ছোট বড় দেব দেবীর মুর্তি, ফুল পাতা, পশু পাখি এইসব বানানো হয়েছে।
মেইন মন্দিরে ঢুকে আমার মনে হলো এইটা যতটা না মন্দির, তার চেয়ে বেশি জাদুঘর বা এক্সিবিশন সেন্টার। গর্ভগৃহের মাঝখানে স্বামী নারায়নের বিশাল চোখ ঝলসানো সোনালি মুর্তি। আর বড় মুর্তিটার চারপাশে সাইজে ছোট আরও কয়েক জনের একই রকম সোনালি মুর্তি। দেখে মনে হলো সোনার তৈরি। আর গর্ভগৃহটা সোনালি রুপালি রঙের এতো বেশি কারুকাজমন্ডিত ছিলো যেটা দেখে আমার ইউরোপের বারোকো স্টাইলের কথা মনে পড়ে গেলো। স্বামী নারায়নের বড় মুর্তি ছাড়াও রাধা কৃষ্ণা, লক্ষী-নারায়ন, রাম-সীতা, শিব-পার্বতীরও মুর্তি ছিলো। সবগুলো মুর্তিই লাইটিঙ্গের কারণে ঝকঝক করছিলো। আমরা চারপাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। দেয়ালে ছবির মাধ্যমে অনেক ইতিহাস বর্ননা করা আছে। এক পাশে স্বামী নারায়নের ব্যবহার্য জিনিস যেমন জামা, মালা, পায়ের ছাপ এইসব সাজানো আছে। সব কিছু দেখে আমরা মেইন মন্দির থেকে বের হয়ে আসলাম। হেঁটে হেঁটে জুতা ফেরত নিয়ে আমরা অন্য দিকে গেলাম।
কতগুলো শো আছে যেগুলো টিকেট কেটে দেখতে হয়। শো দেখতে গেলে আমাদের দেরি হয়ে যাবে বলে আমরা শো দেখতে গেলাম না। আমরা সহজ আনন্দ নামের স্টেপ ওয়েল দেখলাম যেখানে সন্ধ্যার পর নয়নাভিরাম লেজার শো হয়। তারপর দেখলাম অভিষেক মন্দির। জানলাম, এখানে স্বামী নারায়নের কৈশর কালের মুর্তির উপর মন্ত্রপূত পানি ঢাললে মনের আশা পূরন হয়। আমি যখন দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেই যচ্ছিলাম তখন রুবাইদা আমার কাঁধ খামচে ধরলো। আমি কাঁচের জানালা দিয়ে ভিতরে তাকিয়ে দেখি ভিতরে সবাই বসে চোখ বন্ধ করে মন্ত্রের তালে তালে ডানে বামে ঝুঁকছে। এই অবস্থায় আমি ভিতরে ঢুকে পড়লে সেটা খুব বিব্রতকর অবস্থা হতো সবার জন্যই। আল্লাহ বাচিঁয়ে দিয়েছেন আমাকে। তারপর আমরা দেখি লোটাস গার্ডেন। তারপর হাঁটতে হাঁটতে আমরা কতগুলো চমৎকার ফুড কোর্ট, সুভেনিয়র সুপার শপ পার হয়ে যখন বের হবার রাস্তা খুঁজতে লাগলাম, ততক্ষনে সূর্য প্রায় ডুবে যায় যায় অবস্থা। এরই মধ্যে এখানকার বাথরুমে আমার সানগ্লাসটা হারিয়ে ফেলায় মন বেশ খারাপ ছিলো। আর অন্ধকার নামার সাথে সাথেই শীত জাঁকিয়ে পড়তে লাগলো। আমার সব এক্সট্রা সোয়েটার ঢোকার সময় জমা দিয়ে ফেলেছিলাম। তাই তাড়াহুড়া করে বের হবার চেষ্টা করতে থাকি। পরে মনে পড়ে আমাদের টোকেন সারার কাছে। গেটের কাছাকাছি পৌঁছে সবার জন্য অপেক্ষা করতে করতে এক সময় সারাকে খুঁজে পাই। তাড়াতাড়ি করে ব্যাগ ফেরত নিয়ে সোয়েটার, মাফলার আর হাত মোজা পরে ফেলি।
এবার সবার সাথে আলোচনা করতে থাকি কোথায় যাওয়া যেতে পারে নেক্সট- এই সব নিয়ে। সিদ্ধান্ত হলো নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগায় যাওয়া হবে। আমরা বের হয়ে ট্যাক্সি ঠিক করার চেষ্টা করতে থাকি, কিন্তু ট্যাক্সির বদলে মাইক্রোবাস এসে হাজির হয়। আমরা দরাদরি করে যা আছে কপালে বলে উঠে পড়ি মাইক্রোতে। আমি আর সারা গাদা গাদি করে পিছনে বসি। সারা আবার মাথা নেড়ে আমাকে বলতে থাকে, ‘সাহস খুব বেড়ে গেছে রে, মাইক্রোতে করে কয়েকজন মেয়ে মিলে অপরিচিত শহরে রাতের বেলা দরগায় যাচ্ছি, সাহস খুব বেশী বেড়ে গেছে রে-’। আমিও ভেবে দেখলাম, ঢাকা শহরেও আমার এরকম রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাইক্রো ভাড়া করে অপরিচিত জায়গায় যাওয়ার সাহস হবে না। আর এখন……
দরগার কাছাকাছি একটা জায়গায় এনে আমাদের নামিয়ে দিলো মাইক্রো বাস। পার হেড ভাড়া পড়লো ৪০ রুপি। আমরা নেমে চিপা গলি দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। দুপাশে খাবার দোকান। কাবাব ভাজা হচ্ছে, মাংস ঝলসানো হচ্ছে, বিশাল বিশাল কড়াইয়ে শত শত লালমোহন মিষ্টি ডুবিয়ে জ্বাল দেওয়ায় হচ্ছে- এই শীতের মধ্যে এই রকম ধোঁয়া ওঠা খাবারের দোকান পার হতে গিয়ে আমাদের সবারই খিদে লেগে গেলো। আমরা ঠিক করলাম ফেরার সময় পেট ভরে খেয়ে নিবো। রাস্তার ধারে নানা রকমের পসরা সাজিয়ে বসেছে লোকজন। এলুমিনিয়ামের বাটি থেকে শুরু করে আতরের শিশি কি নাই সেখানে! সব কিছুই দামে সস্তা। কে জানি একটা ছোট্ট এলুমিনিয়ামের বদনা কিনলো। এই সব দেখতে দেখতে আমরা হাঁটতে লাগলাম। আস্তে আস্তে একেবারে বাজারের মত জায়গায় ঢুকে গেলাম। লোক জনের হাঁকডাক বাড়তে লাগলো। দুইপাশের দোকান গুলোতে থালা ভর্তি ফুল, মোমবাতি, গোলাপ জল, আগরবাতি, লাল সুতা, জরি দেওয়া কাপড় এইসব সাজিয়ে রেখেছে। আর আমাদের চিৎকার করে বলতে লাগলো স্যান্ডেল খুলে জমা দিয়ে ভিতরে যেতে। যারা আগে কখনো দরগায় যায় নাই তারা লোকজনের এই রকম আচরন দেখে নার্ভাস হয়ে গেলো। আমরা কয়েকজন মিলে ঐসব লোকদের ধমক ধামক উপেক্ষা করে হাঁটতে লাগলাম। যতই সামনে যেতে লাগলাম ততই লোকজন আমাদের ধরেবেঁধে ওই সব থালা কিনতে বাধ্য করার চেষ্টা করতে লাগলো। আমরা সবশেষে একেবারে বাজারের শেষ মাথায় এসে জুতা খুললাম। ওইখানে এক দোকানে জুতা জমা দিয়ে ঢুকলাম দরগার উঠানে।
এই দরগার খোলা জায়গা গুলো টুকরা টুকরা। আর সারা উঠান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কবর। মনে হলো উনারা যে যেই জায়গায় মারা গিয়েছিলেন ঠিক সেই জায়গাতেই উনাদের কবর দেওয়া হয়েছে। আমরা সাবধানে কবর পাশ কাটিয়ে হেঁটে হেঁটে নিজামুদ্দিনের দরগার সামনে আসলাম। খুব সুন্দর সাদা রঙয়ের পাথরের উপর সোনালি কারুকাজ করা দরগা। ছেলেরা ভিতরে সেই থালা নিয়ে ঢুকছে। আর বাইরে চারপাশে ভীড় করে বসে মহিলারা মোনাজাত করছে, কুরআন শরীফ পড়ছে, কাউকে মনে হলো সেজদা দিতেও দেখলাম। চারিদিকে লাল সুতার সমাহার। দরগার সামনে ছোট উঠানটা জুড়ে কাওয়ালি গানের আসর বসেছে। একজন গায়ক হারমোনিয়াম বাজিয়ে জোর গলায় গান করছে আর তার সাথে অনেকেই ঝুনঝুনি, খঞ্জনি এইসব বাজিয়ে সুর দিচ্ছে। পুরা উঠান জুড়ে লোকজন ভীড় করে গান শুনছে। কেউ কেউ আবেগে মাথা নাড়ছে, হাতে তালি দিচ্ছে। আমার মনে হলো আমাদের দেশে মাজার যেমন শান্ত, নিরিবিলি জায়গা, ইন্ডিয়াতে মাজার বেশ উৎসবমুখর জায়গা। এত বড় একজন আউলিয়ার মাজারের পাশেই উচ্চস্বরে গান বাজনা হচ্ছে ব্যাপারটা দেখে আমার খুব কষ্ট লাগলো। চারিদিকে পুরাই বিদাতি পরিবেশ। এর মাঝে একটু নফল নামাজ পড়া যাবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। তবে খুঁজে পেলাম মেয়েদের নামাজের জায়গা। বলতে গেলে সেটা পুরাই খালি। যাই হোক আমি কোন মতে দু রাকাত নফল নামাজ পড়েই বের হয়ে আসলাম। দেখি কাওয়ালির আসর ভেঙ্গে গিয়েছে। সবাইকে নকুলদানা শিন্নি হিসেবে দেওয়া হয়েছে। আমিও সেই শিন্নির ভাগ পেলাম। লোকজনের হৈচৈ চিৎকার শুনে মনে হলো যেন কোন মেলার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি।
আবার রাত নয়টার সময় শুরু হবে কাওয়ালি। তার আগেই ঘুরেফিরে আমরা বের হয়ে যাওয়ার প্ল্যান করলাম। রাতের বেলায় খুব বেশি ঘোরাঘুরি করতে ইচ্ছা করলো না। এমনিতেও পরিবেশটা শান্ত নয়, তাই আমরা বের হয়ে এলাম। সেই চিপা বাজারের রাস্তা দিয়ে আবার হেঁটে হেঁটে বাইরে চলে আসলাম। এক লোক দেখলাম ছোট ছোট শিক কাবাব বিক্রি করছে। আমরা ২০ রুপি দিয়ে ৪টা শিক কাবাব কিনে খেলাম। খুব বেশি মজা লাগলো না। পরে ঘোরাঘুরি করে এক হোটেলের দোতলায় উঠে বসলাম। সেই হোটেলে আমরা ছাড়া আর কোন মেয়ে নাই। সারা এলাকাতেই অবশ্য আমরা ছাড়া তেমন কোন মেয়েই ছিলো না। আমরা আরাম করে বসে নানা রকম আইটেম অর্ডার দিলাম। গল্পগুজব করতে করতে আমরা হোটেলটাকে গমগমে বানিয়ে ফেললাম। নিচে যেসব লোক বসা ছিলো, ওনারা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো যে কারা এত হৈচৈ করছে। এক সময় আমাদের অর্ডার আসলো। আমার ৩৯ রুপির ডাল গোস্ত আর নান মজা ছিলো। এছাড়া মগজ, নেহেরি, ফ্রায়েড চিকেন, সিল্মা রুটি সবই টেস্ট করে দেখলাম। সবগুলোই মজা। খেয়ে দেয়ে অনেকে আবার চা অর্ডার দিলো। সব শেষে বিল মিটিয়ে আমরা বের হয়ে আসলাম। দেখি বড় বড় লাল মোহন যাকে ওরা বলে ‘গুলাব্জামুন’ জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। আমরা ছোট বাটিতে করে সিরায় ডুবানো লাল মোহন খেলাম। অনেকে হালুয়াও টেস্ট করলো। পেট ভরে সব খেয়ে দেয়ে আমরা ফাইনালি বের হয়ে আসলাম। একটা অটো ভাড়া নিলাম মোড়ের থেকে। ১০০ রুপি ভাড়া নিয়ে সেই অটো আমাদের হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলো।
হোটেলে ফিরে ছোট্ট রুমটাতে ঢুকে আমার আবার মন খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু কি আর করা, একজন লোককে ডাকিয়ে বাথরুমটা পরিষ্কার করে দিতে বললাম। কিন্তু যেই লাউ সেই কদুই রইলো। কিছুক্ষণ পাশের রুমের সুমাইয়া, রাত্রির সাথে গল্পগুজব করে রুমে ফিরে আসলাম। ওদিকে মজুমদার আর মৌলিও ফেরত এসেছে। সবাই মিলে বিছানাটায় চাপাচাপি করে শুয়ে পড়লাম। সহসা ঘুম আসতে চাইলো না। তারপর এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।