সকালে ঘুম থেকে উঠলাম দেরি করে। আড়মোড়া দিয়ে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে চারদিকে তাকালাম। রুমের বিশাল জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঝলমলে রোদ, আগের দিনের বরফের চিহ্ন মাত্র নাই। বিছানা থেকে উঠে আবার সেই জানালার সামনে দাঁড়ালাম। পরপর দুইদিন দুই রকম রূপ দেখলাম মানালির। মন ভরে গেলো। আহ জীবন কত সুন্দর!
আমরা ঢিলেঢালাভাবে ফ্রেশ হতে লাগলাম পালাক্রমে। কিছুক্ষন পর দরজায় নক পড়লো। খুলে দেখলাম শুভ দাঁড়িয়ে। শুভ জানালো ১২টার মধ্যে রুম ছেড়ে দিয়ে লাগেজ জমা দিতে হবে গতকাল যে রুমে আমরা পার্টি করলাম সেই রুমে। রুবাইদা তখনও ঘুমাচ্ছিলো। ওকে ডেকে তুললাম। বাকি দুইজন ইতোমধ্যে রুম ছেড়ে বের হয়ে পড়েছে। আমি আর রুবাইদা ধীরেসুস্থে ব্যাগপত্র গোছগাছ করলাম। নাশতা খেতে ইচ্ছা করছিলো না আমাদের কারোরই। তাই কোনরকম তাড়াহুড়া করলাম না। ১২টার দিকেই আমরা চাবি জমা দিয়ে রুম থেকে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে পড়ি।
ব্যাগ জমা দিতে গিয়ে দেখি ছেলেদের রুমের চাবি যার কাছে থাকার কথা সে নাই। সবাই ডাইনিং হলে লাগেজ রেখেই চলে গেছে। কিন্তু অনেকেই বললো এভাবে লাগেজ ফেলে যাওয়াটা ঠিক হবে না। পরে আমরা কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিয়ে ডাইনিং হলের দোতলার রুমে লাগেজ রাখলাম। তারপর নিচ থেকে অন্যদের লাগেজগুলোও টেনে টেনে দোতলায় তুলে দিলাম। হঠাৎ একটা ব্যাগের ভিতর থেকে স্পাইডার ম্যানের মাঝারি সাইজের একটা পুতুল উঁকি দিলো। আমি নেড়েচেড়ে দেখলাম পুতুলটা নতুন না, পুরানো। আমাদের বয়সের কেউ একজন সাথে করে স্পাইডারম্যানের পুতুল নিয়ে ঘুরছে, ব্যাপারটা কেমন অবিশ্বাস্য লাগলো। আমি কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করলাম কার পুতুল এটা, কেউই ঠিক মত বলতে পারলো না। কে জানি বললো, সারার হতে পারে। সারার দেড় বছরের ভাতিজা আছে। ভাতিজার পুতুল সারার ব্যাগে আসতেই পারে- এই ভেবে আমি সেখান থেকে বের হয়ে পড়লাম।
বের হয়েই সারা আর রাত্রির সাথে দেখা। সারাকে পুতুলের কথা জিজ্ঞেস করতেই সারা জানায় পুতুলটা বাসিরুনের। বাসিরুনের ছোট্ট ভাই এই পুতুলটা ওকে দিয়ে নাকি বলেছে, ‘স্পাইডারম্যান উইল প্রোটেক্ট ইউ’। ছোট ভাইয়ের পুতুল নিয়ে তাই ও ঘুরছে সারা ইন্ডিয়া। তারপর আমরা হোটেলে নিচে দাঁড়াই খানিক্ষণ। গতদিন সাদা কুয়াশায় সব ঢাকা ছিলো বলে হোটেলের চারপাশটা দেখতে পাই নাই। আজকে দেখলাম, আমাদের হোটেলের পিছনে বরফ ঢাকা সাদা পাহাড়। পাতাহীন কংকাল গাছগুলো বরফে ঢাকা। হোটেলের এক কর্মচারী বললো ‘ওগুলো আপেল গাছ। শীতকালে তো মানলিতে তেমন কেউ আসে না। টুরিস্ট সিজন তো গরমকালে, তখন আপেল গাছগুলো সবুজ হয়ে থাকে। তখনই দেখার মতন দৃশ্য হয়। এখন যে পাহাড় সাদা দেখাচ্ছে সেটা পুরো সবুজ হয়ে যায়’। সারা আমাদের বললো, ‘আমরা ভাই গরমের দেশের মানুষ। জীবনে সবুজ অনেক দেখেছি তাই আবার এখানে আসতে হলে এই বরফের দিন দেখেই আসবো’। আমরাও সারার কথাতেই সায় দিলাম। কতক্ষন ঘুরেফিরে, ছবি তুলে আমরা বাইরে বের হলাম।
আমরা চার জন সেই অলৌকিক বিয়াস নদীর ধার ধরে হাঁটতে লাগলাম। সেই নীলচে সবুজ রঙয়ের স্রোতওয়ালা পানি আর ছোট বড় হাজারো পাথর- রূপ তার এতটুকু পরিবর্তিত হয় নাই। ঝরঝর শব্দ করে কোনায় বরফ জমে থাকা পাথরে ধাক্কা খেয়ে ছুটে চলা নদীর সাথে সাথে আমরাও হাঁটলে লাগলাম। আমাদের সাথে যোগ দিলো আফরা আর জেরিন। রূপকথার রাজ্যের মতই আমাদের সামনে হাজির হলো লটপটে কিন্তু চওড়া এক সাঁকো। আধা আধি বরফে ডুবে থাকা সাঁকোটা পার হবো বলে ঠিক করলাম আমরা। এর মধ্যেই একটা জিপ হর্ণ দিতে দিতে আমাদের সরিয়ে দিয়ে সেই সাকোঁর উপর দিয়ে জোরে চালিয়ে পার হয়ে গেলো। আমরা বুঝলাম যেটাকে আমরা চওড়া সাঁকো ভেবেছিলাম সেটা আসলে চিপা ব্রিজ। এবং মোটে লটপটে নয় বরং বেশ শক্তপোক্ত। আমরা হেঁটে হেঁটে সেই ব্রিজ পার হলাম। ব্রিজের ধারে সুতার মধ্যে লাল, নীল, হলুদ বিভিন্ন রঙের চারকোনা কাপড়ের টুকরায় সম্ভবত নেপালি ভাষায় কিছু লিখা আছে। দেখে আমার ভিডিও গেম ‘আঞ্চারটেড- এ্যামাং দ্যা থিভস’ এর কথা মনে পড়লো। সেখানেও রাস্তাঘাটে এরকম টুকরা কাপড় দেখেছিলাম।
আমরা উঁচু নিচু পাহাড়ী ঢাল বেয়ে হাঁটতে লাগলাম। মাঝে একটা পশ দোকান দেখে আমরা ভিতরে ঢুকে পড়লাম। দোকানটা আমাদের দেশের আড়ঙের মত। জিনিসপত্র অনেক সুন্দর কিন্তু সেই দাম সবকিছুর। আমরা ঘুরেফিরে সব নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। অনেক জিনিস পছন্দও হচ্ছিলো কিন্তু কেনার সামর্থ ছিলো না। সেখান থেকে আমরা বের হয়ে পড়লাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতেই মল রোড চলে এলাম।
মল রোডে আরও কয়েকজনের সাথে দেখা হলো। খবর পেলাম এখানে কাছেই একটা মঠ, তিব্বিতি কলোনি আর দূরে হাদিম্বা টেম্পল দেখার মত জায়গা। আমরা দূরেরটা বাদ দিয়ে কাছেরগুলো আগে দেখবো বলে ঠিক করলাম। প্রথমে গেলাম মঠটাতে। মঠটার নাম গাধান থেকচোকক্লিং গোম্পা মনেস্ট্রি। ছোট্ট একটা মঠ। সামনে একটা খোলা জায়গা যেখানে দলা দলা করে বরফ জমে আছে। আমরা সাবধানে বরফগুলো পার হয়ে মঠের সদর দরজায় পৌঁছালাম। ‘যত কান্ড কাঠমান্ডুতে’ যে প্রেয়ার হুইলের কথা পড়েছিলাম আজকে সামনা সামনি দেখলাম। প্রার্থনা কক্ষের চারপাশটা তামাটে আর সোনালি রঙের ধাতুর তৈরি প্রেয়ার হুইল দিয়ে ঘেরা। অনেককেই দেখলাম প্রেয়ার হুইলগুলোকে ঘুরাতে ঘুরাতে পুরো মঠের চারপাশে একবার চক্কর দিতে। আমরা জুতা খুলে ভিতরে ঢুকলাম।
ভিতরে বিশাল বড় এক বুদ্ধ মূর্তি। ছবি তোলা নিষেধ বলে আমরা আর ক্যামেরা বের করলাম না। বিশালাকার এই মূর্তির চারপাশে নানা রঙের বাতি, ধাতব পাত্রে নানা রকম প্রসাদ, ধুপকাঠি টাইপের জিনিস। দেয়াল জুড়ে রঙ্গিন পেইন্টিং। তাতে অনেক ইতিহাসের বর্ননা। নিচের সিড়ি দিয়ে দেখলে বুদ্ধের মাথাটা অনেক উঁচুতে থাকে বলে ভালোমত দেখা যায় না। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই আমরা বুদ্ধের আই লেভেলের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম প্রায়। বুদ্ধের বিশাল মাথাটা আমাদের দিকে যেন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আমরা খানিক্ষন ঘোরাঘুরি করে শান্তি শান্তি জায়গাটা থেকে বের হয়ে গেলাম।
তারপর হাঁটতে লাগলাম তিব্বতি কলোনির দিকে। বেশি দূর যাওয়া লাগলো না। চারপাশেই দেখা পেলাম নেপালি, তিব্বতি স্টাইলের ঘরবাড়ির। রাস্তার দুপাশে সব দোকানপাট। কাঠ, ধাতু দিয়ে তৈরি শো পিসগুলো দেখতে ভালোই লাগছিলো। পোশাকে আশাকে সাধারন মানুষজন, এদের চেহারা মোটেও ইন্ডিয়ান নয় বরং সেই তিব্বতি বা নেপালি ছাপটা অনেক বেশি দৃশ্যমান। ছোট ছোট দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে আমরা একসময় চলে আসলাম সেই মল রোডে। মল রোডে ঢুকতেই নোভাদের সাথে দেখা। ওরা হাদিম্বা টেম্পল থেকে এসেছে। ওদের কাছে জানতে চাইলাম কেমন করে ওখানে যাওয়া যাবে। ওরা পরামর্শ দিলো না যাওয়ার। যেতে হয় অনেকদূর- গিয়েও ওদের কাছে তেমন ভালো লাগে নাই। আমরাও ভাবলাম আর যাবো না ওখানে।
মল রোডটা অনেক চওড়া একটা রাস্তা যেটাতে গাড়ি চলতে দেখি নাই বললেই চলে। পুরা রাস্তাটাই পথচারীদের জন্য। দুই লেনের ডিভাইডারে একটু পর পর বসার ব্যবস্থা। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে যাতে বিশ্রাম নেওয়া যায়। আর রাস্তার দুপাশে আছে দোকানপাট। কাশ্মীরি শাল, স্টোল, সোয়েটার, স্যুট, পঞ্চ, থ্রি পিস- এইসব জিনিসে ভরা সেই দোকানগুলো। আর জিনিসগুলোও দেখার মত। কাশ্মীরি কাপড়গুলোর দিকে আর তাকানো যাচ্ছিলো না। এত সুন্দর সুন্দর শাল আর স্যুট দেখে মনে হয় সব কিনে ফেলি। দামও মোটামুটি কম। একটু দরাদরি করে কিনতে হয়। তবে দোকানদারেরা বেশিরভাগই কাশ্মীরি- তারা দেখতে যেমন লম্বা, ফর্সা, সুন্দর, ব্যবহারও তেমনি ভদ্র। আমাদের অনেককেই এখানে শান্তিতে কেনাকাটা করতে দেখলাম। নিলয় তো একে একে ১৭টা শাল কিনে ফেললো! এছাড়াও আছে বাদাম যেমন কাজু, খেজুর, আঞ্জির, আলুবোখারা, খোরমানি ইত্যাদি, ফ্রেশ জুস, লোকাল মানালি ড্রেস। আগের রাতে লিচি আর পামের জুস খেয়ে দারুন মজা পেয়েছিলাম। এখানে সেই দোকানটা খুঁজে পেলাম। দোকান জুড়ে জুস, আচার, জ্যাম, মধু, আর প্রসেসিং করা শুকনা ফল। আমি জুস নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু ফোনে আম্মুকে বলতেই আম্মু না করে দিলো। বললো ভারি বোতল টানতে অনেক কষ্ট হবে। তখন মনে কষ্ট পেলেও উপদেশটা এক্কেবারে ঠিক ছিলো। আমি সস্তায় দুই প্যাকেট কাজু বাদাম, খোরমানি আর আলুবোখারা কিনলাম। আমরা যেটাকে আলুবোখারা বলি ওরা সেটাকে খোরমানি বলে, আর যেটাকে ওরা আলুবোখারা বলে সেটা আমি চিনলাম না তবে দেখতে বড় কিশমিশের মত। সব মিলিয়ে খরচ পড়লো ৪০০ রুপি। আমরা একটা দোকান থেকে ৫০ রুপি দিয়ে বিশাল একটা ভেজ স্যান্ডুইচ কিনে খেতে লাগলাম। এটাই আমাদের লাঞ্চ।
খেয়েদেয়ে আবার আমরা ঘুরতে লাগলাম। সারা মল রোডেই আমাদের লোকজনকে দেখা যাচ্ছিলো। সুমাইয়াকে দেখলাম রাস্তার উপর বসার জায়গায় বসে এক মনে স্কেচ করছে। নিশাত, তমাকে এক ঝলকের জন্য একটা দোকান থেকে বের হতে দেখলাম। মীম আর অন্তরা তো যেই দোকানে ঢুকছে সেই দোকান থেকেই কিছু না কিছু কিনে বের হচ্ছে। এক সময় আমি আর রুবাইদা বসে বসে গল্প করতে লাগলাম। আমাদের চারপাশে ‘খাঁটি জাফরান’ নিয়ে কয়েকজন ঘোরাঘুরি করতে লাগলো। এক জনকে দেখলাম অসম্ভব কিউট কয়েকটা খরগোশ নিয়ে বসে আছে। এদের সাথে ছবি তুলতে হলে পয়সা দিতে হয়। চারিদিকে কেমন যেন উৎসব উৎসব ভাব। সবাই খুশি খুশি মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে- দেখতেই আমার ভালো লাগছিলো।
ওদিকে চারটার মধ্যে আমাদের হোটেলে ফেরার কথা। আমি, রুবাইদা, মিম আর অন্তরা একটা অটোভাড়া করলাম চন্দ্রমুখী কটেজ পর্যন্ত। পার হেড ভাড়া পড়লো ৬০ রুপি। প্রায় পৌনে চারটার দিকে আমরা হোটেলে পৌঁছাই। হোটেলে যাওয়ার আগে রুবাইদা হঠাৎ বেকারির দোকানগুলোতে ঢুঁ মারতে চায়। কয়েকটা দোকানে ঢুকে দেখলাম মজার মজার কেক, বিস্কুট, পেস্ট্রি সারি সারি করে সাজানো। একটা দোকানে রুবাইদা সাদা রঙের বিস্কুট টাইপের একটা জিনিস কিনতে চায়। জিনিসটা অনেক মজার ছিলো। আমি জার্নির আগে উলটাপালটা কিছু খাবো না, তারপরও রুবাইদার কাছ থেকে এক চিমটি খেয়ে দেখলাম- আসলেই অনেক মজার। জিনিসটার নাম আমরা বুঝি নাই। দোকান থেকে বের হয়ে মনে পড়লো দোকানটার নামও দেখি নাই। রুবাইদা বললো, ‘আরে, এরকম কয়েকটা গল্প আন ফিনিশড থাকতে হয়। আমরা সবাইকে বলবো ঐ যে চন্দ্রমুখী কটেজের বাম দিকে একটা বেকারির দোকানে কি যে একটা জিনিস খেয়েছিলাম- আহ হা…’।
হোটেলে ফিরে আমরা লাগেজের রুমে গিয়ে বসলাম। একটু পরে আমি গেলাম বারান্দায়। সেখানে আমি আর উর্মি দোলনায় বসে দোল খাচ্ছিলাম। বারান্দা দিয়ে এক পাশে বরফে ঢাকা সাদা আর ধূসর পাহাড় দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিলো, কেন চলে যাচ্ছি এখান থেকে? আরও কয়েকটা দিন এখানে থাকলে কি হতো? ওদিকে অদিতি নতুন লাগেজ কিনেছে। ভিডিও কনভারসেশনে বাসার সবাইকে দেখাচ্ছে ম্যাজেন্টা কালারের সেই লাগেজটা। দিনের আলো হটাৎ করেই যেন কমতে শুরু করলো। কমিটির লোকজন আমাদের জন্য জিপ ঠিক করে নিয়ে আসতে লাগলো। আমরাও একে একে মালপত্র নামিয়ে হোটেলের সামনের ঢালে জড়ো হতে লাগলাম। এই ঢালটা সিমলার ঢালের তুলনায় কিছুই না। মালপত্র মেইন রোডে তুলতে আমাদের তেমন কষ্ট হলো না। একটা জিপে আমি মালপত্র নিয়ে উঠে পড়লাম। জিপটা ছাড়ার আগেই দেখতে পেলাম চন্দ্রমুখী কটেজের সামনে কয়েকটা গাড়ি ভরে নতুন কাস্টোমার এসেছে। আমার মনে হলো যেন আমাদের রুমটাতেই আমি কাউকে যেন উঠতে দেখলাম। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। কয়েক ঘন্টা আগেও এই রুমটা আমার বাসার রুমের মতন আপন ছিলো, অথচ এখন সেটা অন্য কারো দখলে চলে গেছে। মানুষের জীবনটাও এরকম। সময়ের সাথে সাথে একজন মানুষের সব কিছুই অন্য কারও কারও দখলে চলে যায়। কিন্তু মানুষ সেটা বিশ্বাস করতে চায় না। সে শুধু বর্তমানের আনন্দটুকু নিয়েই ব্যস্ত থাকে। ঠিক যেমন আমি একটু আগেও হাসি, গল্প, আনন্দে মেতে ছিলাম- অনেকটা সেরকমই।
জিপ আমাদের নিয়ে থামালো এলয় পার্কিঙ্গে। এখানেই আছে আমাদের বাস গোয়েল। জিপের জন্য পার হেড ১৫০ রুপি করে ভাড়া পড়লো। বাসের পিছনে কাদা পার করে লাগেজ গুলো জড়ো করে রাখতে লাগলাম আমরা। অনেকের মালপত্র অনেক বেড়ে গেছে, তাই শুধু পিছনে লাগেজ আঁটছিলো না। কিছু লাগেজ আমরা আমাদের বসার জায়গাতেও তুলে নিলাম। প্রায় সাড়ে ৬টার দিকে বাস চলতে শুরু করলো দিল্লীর উদ্দেশ্যে।
আস্তে আস্তে রাত নামতে লাগলো। আমাদের বাস ইতোমধ্যে কয়েকটা টানেল পার হলো। আমরা চিৎকার করে আনন্দ করলাম। রাত নামতেই সেই পরিচিত দৃশ্য। পাশের পাহাড়ের গায়ে মিটমিট আলো জ্বলছে যেটাকে আকাশের তারার থেকে খুব একটা আলাদা করা যায় না। তবে সিমলার পাহাড়ের দৃশ্য আর মানালির পাহাড়ের দৃশ্যের মাঝে হাল্কা ফারাক আছে। সেটা নিজের চোখে না দেখলে বোঝা যায় না। এই সুন্দর দৃশ্যের সাথে উপরি পাওনা হিসেবে আকাশে একটা চাঁদের অস্তিত্ব দেখা গেলো। আমার মনে হলো ঘাড় ঘুড়িয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার ঘাড় ব্যাথা হয়েই যাবে। কিন্তু তারপরও তাকিয়ে রইলাম বাইরের দিকে। এই তো শেষ, আজকের রাতের পর এই দৃশ্য জীবনে হয় তো আর কোন দিনও দেখতে পারবো না। মনে মনে বললাম। ‘বিদায় মানালি, বিদায়’। অনেক ঠান্ডা লাগছিলো, আমি ব্যাগ থেকে কম্বল বের করে মুড়িয়ে বসি। এক সময় আমাদের বাস রাস্তার পাশের এক পাঞ্জাবী ধাবায় থামে। সেখানে খাওয়া দাওয়া তেমন কিছুই নেই। অনেকেই ম্যাগি নুডুলস অর্ডার দেয়। লোকগুলা এত ঢিলা যে সেই নুডুলসের অর্ডার পেতেও প্রায় আধা ঘন্টা- পয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। সবাই যখন এক পর্যায়ে বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে যায় তখন বাটিতে করে সিদ্ধ নুডুলস আসে। আমি এক প্যাকেট চিপস খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলি।
তারপর আবার একসময় বাসে উঠি আমরা। বাস চলতে শুরু করে। জার্নিটা বেশ ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছিলো। কে যেন সামনে গিয়ে গান ছাড়ার ব্যবস্থা করতে বলে। কিন্তু জানা যায় আমাদের কাছ থেকে গান নিয়ে গান ছাড়া যাবে না, শুধু উনাদের কাছে যে সব গানের ক্যাসেট আছে সেগুলো ছাড়া যাবে। উপায় না দেখে আমরা তাতেই রাজি হই। ছাড়া হলো ১৯৮২ সালের ‘শোলা অর শবনম’ সিনেমার ‘তু পাগল প্রেমি আওয়ারা’ গানটা। অসহ্যকর গানের ‘ওয়ে ওয়ে ওয়ে ওয়ে ওয়ে ওয়ে ওয়…’ টানটা আমাদের মাথা ধরিয়ে দিলো। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন এই গানটা শেষ হবে। কিন্তু রহস্যজনক কারনে গানটা শেষই হচ্ছিলো না। যখনই আমরা ধারনা করছিলাম গানটা শেষ হবে তখনই কয়েক মাইক্রো সেকেন্ড বিরতি দিয়ে আবার কথা শুরু হয়ে যাচ্ছিলো। এক পর্যায়ে আমরা সবাই যখন দম ফেললাম যে গানটা শেষ হয়েছে, তখন আদিবা বলে উঠলো, ‘ আই হ্যাভ ডাউট যে গানটা সত্যিই শেষ হয়েছে-’ ঠিক তখনই আদিবার সন্দেহ সত্যি প্রমানিত করে গানটা আবার চলতে লাগলো। লোকজন উঠে হেল্পারকে অনুরোধ করে আসলো গানটা বন্ধ করার জন্য এবং আমাদের বাকি দিনগুলোতে যাতে আর কোনদিনই কোন গান ছাড়া না হয়। আমরা নিজেরা নিজেরা গানটাকে পচিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলাম। এক পর্যায়ে সবাই একে একে ঘুমিয়ে পড়লো। আমিও কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমালাম।