The Mighty INDIA CALLING: যে সৌন্দর্য শুভ্র নীহারের, যে সৌন্দর্য হিম কুয়াশার (পর্ব ১২)

লেপের তলায় মুখ গুঁজে থাকা অবস্থাতেই মৌলির ফোন বেজে উঠতে শুনলাম। ঘুম জড়ানো কন্ঠে মৌলি ফোনটা ধরলো। জাফর ফোন দিয়েছে। মৌলি ওকে জানালো আমরা ঘুম থেকে এখনো উঠি নাই, লেপের তলাতেই আছি। শুনে জাফর বললো শিগগিরি বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে তাকিয়ে দেখতে। শুনে মৌলি অনেক কষ্টে লেপের তলা থেকে বের হয়ে কোটটা গায়ে জড়িয়ে বিছানা ছেড়ে নামে। হঠাৎ শুনতে পাই চিৎকার। চিৎকার শুনে মজুমদার আর রুবাইদা তড়াক করে উঠে গেলো। আমিও উঠতে গেলাম কিন্তু হাতড়ে ওভারকোটটা পাচ্ছিলাম না। এবার শুনলাম তিনজনের সম্মিলিত চিৎকার। আমি আর অপেক্ষা করলাম না। কম্বলটা গায়ে জড়িয়েই উঠে পড়লাম। দৌড়ে গেলাম জানালার কাছে।

আমি থ হয়ে গেলাম। জানালা দিয়ে দেখা গেলো একটাই রঙ- সাদা। বাইরের সবকিছু সাদা। মাটি, পাকা রাস্তা, গাড়ি, গাছের ডাল, দূরের ঘর বাড়ি- সব সাদা। এক সাদা স্বপ্নের জগতে এসে পড়েছি যেন। সারা রাত তুষারপাত হওয়ার কারনে সব কিছু পুরু বরফের নিচে চাপা পড়ে আছে। দৃশ্যটা দেখে আমার গলা দিয়ে অন্য তিনজনের মত অটোমেটিক চিৎকার বের হয়ে আসলো। আমরা চার জন লাফাতে লাফাতে চিৎকার করতেই থাকলাম। মনে হতে লাগলো খুশীতে আমাদের বুঝি মাথা নষ্ট হয়ে যাবে, আমরা বুঝি পাগল হয়ে যাবো। তারপরও আমরা থামলাম না, একে অন্যকে জড়িয়ে লাফাতে লাগলাম। তাড়াতাড়ি আম্মুকে ফোন দিলাম। খুশীতে আমার গলা দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিলো না। তারপরও কোনমতে বললাম সবকিছু। একে তো মোবাইলে ব্যালেন্স তেমন নাই তার উপর কবে ব্যালেন্স ভরতে পারবো সেটাও জানি না। তাই বেশিক্ষন কথা বলতে পারলাম না। আম্মুও সব শুনে অসুখ বিসুখ না বাধানোর একগাদা উপদেশ দিয়ে ফোন রেখে দিলো।

আমরা তাড়াতাড়ি করে যে যেভাবে ছিলাম তার উপরই কোনমতে গায়ে কোট জড়িয়ে, পায়ে জুতা গলিয়েই বের হয়ে পড়লাম। চারিদিকে সাদা বরফের রাজ্যে পা দিয়েই এক ধরনের শিহরণ অনুভব করলাম। নিস্তব্ধ এক সাদা জগতে আমরা কয়েকজন রঙ্গিন পোশাক পরে হাঁটতে লাগলাম। আমার জুতার সোল বরফে ডুবে যাচ্ছিলো। ওয়াটার প্রুফ জুতা ছিলো বলে বাঁচোয়া। তারপরও মনে হচ্ছিলো জুতার সোলটা বোধহয় ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। তবে এসব পাত্তা না দিয়ে আমরা ঘুরতে লাগলাম। বরফের মধ্যে ছেলেমানুষের মতন ছুটে বেড়াতে লাগলাম। সাদা বরফগুলোকে গ্লাভস পরা আঙ্গুল দিয়ে গুতিয়ে দেখতে লাগলাম, পা দিয়ে নিচের বরফগুলোকে লাথি মারতে লাগলাম, বরফে ঢাকা গাড়ির সামনে ছবি তুললাম আর চন্দ্রমুখী কটেজের বারান্দা থেকে আমাদের যারা বের হয়নাই তারা দাঁত বের করে হাসতে লাগলো।

এফ
চন্দ্রমুখী কটেজের সামনে তখন সবই সাদা (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

কে যেন তাড়া দিলো নাশতা খেয়ে রেডি হয়ে নেওয়ার জন্য। আমরা তাড়াতাড়ি রুমে ফিরে গেলাম। রুমে একজন একজন করে ফ্রেশ হয়ে রেডি হতে লাগলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম আমার গাল গুলো টকটকে লাল হয়ে গেছে। আমি বেশ কয়েকবার ছবি তুলে গালের লাল রংটা ধরে রখতে চাইছিলাম। কিন্তু কোনভাবেই ক্যামেরায় সেটা আসছিলো না। পাশের রুমের সৃষ্টির কাছে থেকে হেয়ার ড্রায়ার এনে লাগেজ খুলে যত্তগুলা গরম কাপড় এনেছিলাম সবগুলো গরম করে গায়ে পরে নিলাম। সবকিছু পরে যখন শেষে ওভারকোটটা গায়ে দিলাম তখন হাত পা আর নাড়াতে পারছিলাম না। এত্তগুলো গরম কাপড় গায়ে দিয়ে আমরা সবাই কেমন যেন কার্টুনের মত হাঁটতে চলতে লাগলাম।

হোটেল থেকে বের হয়ে বাম দিকে হাঁটতে লাগলাম। রাস্তার পাশে ছোট ছোট দোকান। সেগুলোতে ছাতা, গামবুট, গরম কাপড় এইসব ভাড়া দেওয়া হয়। আমরা দৈনিক হিসাবে ছাতা ৩০ রুপি আর গামবুট ৫০ রুপি দরে ভাড়া নিলাম। আকাশের অবস্থা সুবিধার ছিলো না। ঐ দোকানে থাকতে থাকতেই গুড়া গুড়া তুষার পড়তে লাগলো। আমরা এর মধ্যেই ভেজা রাস্তার মধ্য দিয়ে হেঁটে একটা ছোট পাঞ্জাবী ধাবা টাইপের দোকানে নাশতা করতে ঢুকলাম। আমরা অর্ডার দিলাম ২৫ রুপির আলু পরোটা আর ৩০ রুপির ডাবল ডিমের অমলেট। আমরা গুটিসুটি মেরে দোকানে বসে রইলাম। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা আর তুষারপাত আর ভিতরে আমরা হাহা হিহি করে নিজেদের গরম রাখার চেষ্টা করছিলাম। আমাদের সামনেই একজন মহিলা আর তার স্বামী মিলে পরোটা বানাচ্ছিলো আর গরম তাওয়ায় তেল ঢেলে আলু পরোটা ভাজতে লাগলো। কিন্তু ওনাদের মধ্যে কোন তাড়া দেখতে পাচ্ছিলাম না। এমন আস্তে আস্তে ময়দা বেলে তার মধ্যে আলু ঢুকিয়ে পরোটা বানাচ্ছিলেন যেন ওনারা বাসার জন্য নাশতা রেডি করছেন। আমরা ধৈর্য ধরে বসে থাকলাম নাশতা খাওয়ার জন্য। অবশ্য চুলা থেকে নামানো পরোটা আর প্রায় ডুবো তেলে ভাজা ডিমটা অনেক মজা ছিলো।

খেয়ে দেয়ে আমরা হোটেলের সামনে এসে জড়ো হলাম। সেখানে জানতে পারলাম আমাদের আজ রাতেই আমাদের মানালি ছেড়ে দিল্লীর দিকে রওয়ানা হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আবহাওয়ার অবস্থা আর মানালির সৌন্দর্য দেখে ডিসিশন নেওয়া হয়েছে যে আজ আমরা মানালি থেকে যাবো। পরদিন দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো ইনশাল্লাহ । আর আজ রাতেই আমাদের সবার জন্য কমিটির তরফ থেকে অ্যারেঞ্জ করা হবে ‘সারপ্রাইজ পার্টি’। ইতোমধ্যে আবহাওয়ার কারণে আমাদের যে জায়গায় যাওয়ার কথা ছিলো (সম্ভবত সোলাং ভ্যালি) সেটা ক্যান্সেল হয়ে গেছে। তার বদলে আমরা নেহেরু কুন্ডে যাবো বলে ঠিক হলো। এর জন্য কমিটি জিপ ভাড়া করে রেখেছে। আমরা দুদ্দাড় করে জিপে উঠে বসতে লাগলাম। একটা করে জিপ ভরে উঠতে লাগলো আর একটা করে জিপ ছাড়তে লাগলো।

দফগ
নেহেরু কুন্ডে যাবার ঘোলাটে সাদা পথ (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

জিপে করে নেহেরু কুন্ডে যাওয়ার রাস্তাটা অত্যন্ত উপভোগ্য ছিলো। আস্তে আস্তে হাল্কা তুষারপাত বাড়তে লাগলো। এক সময় সেটা এতই বেড়ে গেলো যে ড্রাইভারকে ঘন ঘন ওয়াইপার চালাতে হলো সামনের কাঁচ পরিষ্কার রাখার জন্য। দুপাশের দৃশ্যের কথা আর কি বলবো, সেই দৃশ্য বর্ননা করার সাধ্য আমার নেই। সবাই হাঁ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মজুমদারকে ড্রাইভার বললো এই রকম ওয়েদার খুব একটা থাকে না। আর এক দুই দিনের মধ্যেই হয়তো তুষারপাত বন্ধ হয়ে আবার স্বাভাবিক ওয়েদার হয়ে যাবে। মজুমদার ওর মোবাইল গাড়ির সামনের কাঁচে লাগিয়ে ভিডিও করতে লাগলো। আমি উশখুশ করতে লাগলাম। পায়ের তালুতে কেমন যেন যন্ত্রনা হচ্ছে। যন্ত্রনা বাড়তে বাড়তে যখন অসহ্যকর হয়ে পড়লো তখন গামবুট খুলে ফেললাম। এক লেয়ার পলিথিন ব্যাগ আর তিনটা মোজা খুলে যখন পায়ে হাত দিলাম, টের পেলাম ভেজা। এত সাবধানতা সত্ত্বেও কেমন করে পায়ে পানি বা বরফ কুচি পৌঁছালো সে রহস্য ভেদ করতে পারলাম না। কি আর করা, কাপড় দিয়ে পা মুছে মাত্র একটা মোজা পরে আবার পা গামবুটে ঢুকালাম। ভেজা মোজা গুলো ব্যাগে ভরলাম।

এক সময় আমরা যায়গায় এসে পৌঁছালাম। জিপ থেকে বের হয়েই ভারি তুষার পাত মাথায় নিয়ে দৌড় দিলাম। দেখলাম সবাই একটা দোকানে ঢুকছে। আমরাও ঢুকে পড়লাম। সেখানে ২০০ রুপি দিয়ে বরফের মধ্যে দিয়ে চলাফেরা করার জন্য বিশেষ জামা ভাড়া পাওয়া যায়। দোকানে ঢুকার সাথে সাথে ওরা আমাদের সাইজের রংচঙ্গে সব জামা বের করে দিতে লাগলো। আমাকে দিলো বিশাল সাইজের লাল নীল রঙের হাস্যকর একটা জামা। আমরা ঠিক মত পরতে পারছিলাম না। ওরা আমাদের পরিয়ে দিতে সাহায্য করছিলো। আমরা গায়ের সব গরম কাপড় এমন কি ওভারকোট সহ সেই জামার ভিতরে ঢুকে পড়লাম। আমি পায়ের জন্য কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমাকে বাঁচিয়ে দিলো তমা। ও ব্যাগের ভেতর থেকে এক জোড়া মোটা মোজা বের করে দিলো। আমি চটপট সেই মোজা পায়ে পড়ে ফেললাম। তারপর বের হয়ে পড়লাম সেই দোকান থেকে। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটা ছোটখাটো ঢাল, সেটা পুরাই বরফে ঢাকা। কেমন করে সেই পার হবো সেটা চিন্তা করে মাথা চুলকাতে লাগলাম।

যাই হোক হাচড় পাচড় করে কোনমতে বরফ বেয়ে বেয়ে সেই ঢাল পার হলাম। তারপর হাঁটা ধরলাম সামনের দিকে। এসে পড়লাম ঠিক যেন উত্তর মেরুর কোন জায়গায়। চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ। কিছু বোঝার আগেই বড় বড় পেঁজা তুলার সাইজের তুষার পড়তে লাগলো। যেন এক সাদা ঝড়ের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। অবস্থা এমন হলো যে, আমরা শুধু চার পাঁচ হাত সামনের মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছি। এর বাইরে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না, সবই সাদা আর সাদা। পুরা জিনিসটা কেমন যেন স্বপ্নের মত লাগলো। নরম বরফের উপর পা ফেলে ঠিক মত হাঁটতে পারছিলাম না। এর মধ্যে রিজভীকে দেখলাম ক্যামেরা বের করে বেশ বিপদে পড়েছে। আমি ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম আর তার নিচে রিজভী ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে ছবি তুলতে লাগলো। আমার নিজের ক্যামেরাটা নিয়েও বেশ চিন্তায় পড়লাম কারণ আমার ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগ নাই। তারপর পলিথিন বের করে ক্যামেরাটা ভরে ভালোমত গিঁট দিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলাম। জোর তুষারপাতের মধ্যেই আমরা একে ওকে বরফের বল মারতে লাগলাম। একটা করে পা ফেললেই পায়ের গামবুটের নিচে চুরচুর করে ভাংতে লাগলো বরফ। সাদার সমুদ্রে হঠাৎ হঠাৎ একেক জনকে খুঁজে পাচ্ছিলাম আমরা। উর্মি, আদিবাকে দেখলাম তুষার মানব বানাতে। আমিও হাত লাগালাম। টিভিতে তুষার মানব বানানো দেখে যতটা সোজা মনে হয় বাস্তবে ততটা সোজা নয়। আমাদের তুষারমানব দেখতে অতটা ভালো হলো না, তবে আমরা মাফলার, সানগ্লাস, চিং এর রঙ্গিন ছাতা দিয়ে ওকে ফিনিশিং দিয়ে ছবি তুললাম।

এফদ
ভারী তুষারপাতের কারণে কারও চেহারাই দেখা যাচ্ছে না (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

এর মধ্যেই স্কি নিয়ে কয়েক জন আমাদের পিছে পিছে ঘুরতে লাগলো। আমি যেহেতু স্কিয়িং পারি না, তাই রাজি হলাম না। তবে অনেকেই স্কি ভাড়া নিয়ে চেষ্টা করলো। তারপর মানালি ড্রেস নিয়ে কয়েকজন মহিলা ঘুরঘুর করতে লাগলো। ঝড় একটু কমলে মজুমদার সবার আগে মানালি ড্রেস ভাড়া করে পড়লো। দেখাদেখি আমরা সবাই সেই ড্রেস ৫০ রুপি দিয়ে ভাড়া করে পড়লাম আর ছবি তুললাম। অবনীকে মাঝখানে রেখে আমরা গোল হয়ে সবাই নাচতে লাগলাম। কোন কথা নাই, সুর নাই- তবে আনন্দের কোন কমতি ছিলো না। আমাদের কি যে ভালো লাগছিলো তা আর বলার মত না। আমরা বরফে ডুবে ডুবে ছবি তুলছিলাম। বল ছোড়া তো ছিলই, এছাড়া বরফে শুয়ে বাটারফ্লাই তৈরি করার চেষ্টাও করছিলাম আমরা। এত দৌড় ঝাপ করতে করতে আমার এক রকম গরমই লাগছিলো। তারপর শুনলাম অনেকেই বলছে যে তাদেরও গরম লাগছে। এর মধ্যে নিশাত হাসি মুখে জানালো যে ওর নাক থেকে নাকি রক্ত পড়ছে। বরফে আসলে অনেকেরই এমন হয় শুনেছি, সেদিন সামনা সামনি দেখলাম। আমাদের আশেপাশে যেসব কুকুর ঘোরাফিরা করছিলো তারা দেখতে অনেকটা নেকড়ের মত। এ ছাড়াও আস্ত এক চমড়ি গাই বিশাল শরীর নিয়ে বড়লোকি চালে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিলো। এদের সাথে ফটো তুললে মালিককে ভাড়া দিতে হয়। কেউ কেউ ফ্লাস্কে করে চা কফি বিক্রি করছিলো। আর কয়েকজন আবার কৌটায় করে ‘খাঁটি’ জাফরান নিয়ে সবার পিছে পিছে ঘুরতে লাগলো। ছেলেরা কয়েকজন ‘খাঁটি’ জাফরান কিনে ফেললো প্রায় পানির দরে। আস্তে আস্তে তুষারপাত কমতে কমতে এক সময় থেমেই গেলো। তখন চারদিক একটু একটু করে পরিষ্কার হতে লাগলো।

ওর
আস্তে আস্তে কুয়াশা সরে দূরের রহস্যময় পাহাড়গুলো উঁকি দিতে লাগলো (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম। দূরের বরফ ঢাকা পাহাড়গুলো যেন কেমন বেহেশ্ত থেকে এসেছে বলে মনে হলো। সাদা রঙের আলো ছায়ার খেলা চলতে লাগলো সেই পাহাড়গুলোতে। হাল্কা ধূসর রঙের আকাশের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ সাদা রঙের আলোর পিছনে দূরের একেকটা পাহাড় অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগলো, আবার পর মুহূর্তেই সেই সাদা কুয়াশার আলো সরে যেতেই পাহাড়গুলোকে দেখা যেতে লাগলো। আমরা চোখ সরাতে পারছিলাম না। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম সেই বেহেশ্তি দৃশ্য। ছোটবেলায় যখন স্টুডিওতে ছবি তুলতে যেতাম তখন পিছনে ব্যাকগ্রাউন্ডে কাঁচা হাতে আঁকা বরফের পাহাড়ের দৃশ্য দেখতাম। আমার মনে হলো ঠিক যেন সেই রকম কোন স্টুডিওর ব্যাকগ্রাউন্ড আমি দেখতে পাচ্ছি। তবে শিল্পী যখন আল্লাহ নিজেই, তখন  ওয়ার্কম্যানশিপ কোন লেভেলের হবে সেই প্রশ্ন না করে নিজে থেকেই বুঝে নেওয়া ভালো। এই রকম মনোমুগ্ধকর জায়গা থেকে আমাদের নড়তে কোনই ইচ্ছা করছিলো না। কিন্তু কমিটির লোকজন তাড়া দিতে লাগলো কারণ আবার আকাশ কালো হয়ে যাচ্ছে। তার মানে আবার সেই তুষারপাত শুরু হতে পারে। আবহাওয়া খারাপ হওয়ার আগেই আমাদের হোটেলে পৌঁছানো দরকার।

এফ
ট্যুরের মধ্যে সবচেয়ে আনন্দময় দিনে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

আমরা আগের রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে বের হয়ে সেই দোকানে গেলাম। ওখানে ড্রেস ফেরত দিয়ে আবার জিপে চেপে বসলাম। যখন হোটেলে পৌঁছালাম তখন প্রায় দেড়টা বাজে। হোটেলে না গিয়ে সোজা আগের দিনের সেই খাওয়ার দোকানে গিয়ে ঢুকলাম। এবার ৭৫ রুপি দিয়ে অর্ডার দিলাম ভেজ চপ্সুয়ে। আমরা কান্নুর সাথে দুষ্টামি করতে লাগলাম। কান্নুও পালটা  আমাদের ছাতা টেবিল থেকে টেনে ফেলে দিতে লাগলো। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চপ্সুয়ে আসলো। কি যে মজা, আহহহহহ!

রুবাইদা, মৌলি আর মজুমদার শপিং এ যাবে বললো। আমার একটু আরাম করতে ইচ্ছা করছিলো। আমি শপিং এ যাবো না ঠিক করলাম। মজুমদারের কথা অনুযায়ী খুঁজে খুঁজে ভোদাফোন রিচার্জের একটা দোকান বের করলাম। সেখানের লোকটা বললো ২১৪ রুপি রিচার্জ করতে হলে ২২২ রুপি দিতে হবে। আমি তার কারণ জানতে চাইলে লোকটা জানালো যেহেতু আমারটা কলকাতার সিম, তাই কলকাতার বাইরে রিচার্জ করতে হলে বাড়তি চার্জ দিতে হবে। এই রকম আজাইরা নিয়ম শুনে মেজাজ আমার খারাপ হয়ে গেলো। কিছু না বলে তাও রিচার্জ করে নিলাম। তারপর সিমলা থেকে মজুমদারের কিনে দেওয়া ২০ রুপির কার্ড বের করে উনাকে বললাম রিচার্জ করে দিতে। লোকটা চাঁদ মুখ করে বললো মানালির বাইরে থেকে কেনা কার্ড মানালিতে রিচার্জ হবে না। এই কার্ড রিচার্জ করতে চাইলে আমাকে সিমলা যেতে হবে। শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। এ কি দেশ রে বাবা! সেই চন্ডীগড়ের শেষের দিক থেকে রিচার্জ খুঁজতে খুঁজতে এই মানালিতে এসে রিচার্জ করতে পারলাম তাও ৮ রুপি বাড়তি দিয়ে, আবার বলে এক শহরের কার্ড অন্য শহরে কাজ করবে না। এরা যদি বাংলাদেশের মোবাইল কোম্পানিগুলার সার্ভিসের অবস্থা দেখতো তাহলে মনে হয় মাথা ঘুরে পড়েই যেতো।

আমি হোটেলে ফিরে নিরিবিলি নামাজ আদায় করে লেপ, কম্বলের নিচে ঢুকে শুয়ে থাকলাম। ঘুম তেমন আসলো না। তবে বিশ্রাম হলো। এক সময় অন্তরা আসলো গল্প করতে, আমরা অনেকক্ষন গল্প করলাম। দেখতে দেখতে ঝুপ করেই সন্ধ্যা নামলো। আমি মাগরিবের নামাজ পড়ে আম্মু, বড় মামা আর মিজান আংকেলকে ফোন দিলাম। কিছুক্ষণ পর মজুমদার, মৌলি আর রুবাইদা শপিং করে ফেরত আসলো। রুবাইদা কি কি কিনেছে দেখালো। বাইরে হঠাৎ গান শুনতে পেলাম। অন্তরা বললো মনে হয় আমাদের পার্টির গান। আমি বললাম তাই বলে এত আগে গান ছাড়বে। মজুমদার আর মৌলি বললো নিচে আমাদের পার্টির জন্যই গান হচ্ছে। ডিজে আনা হয়েছে নাকি। মৌলি আর মজুমদার নিচে নাচানাচি করতে চলে গেলো। রাত ৯টার দিকে আমি আর রুবাইদাও বের হলাম। আমরা প্রথমে গেলাম গাম বুট আর ছাতা ফেরত দিতে। নিজেদের জুতা পরে আমরা আসলাম আমাদের পার্টির স্থানে।

খোলা আকাশের নিচে কতগুলো চ্যালাকাঠ জমা করে আগুন জ্বালানো হয়েছে। তার একপাশে এক ডিজে ফিউশন করা মিউজিক বাজাচ্ছে আর তালে তালে আগুনের চারপাশে সবাই গোল হয়ে নাচানাচি করছে। দেয়ালের পাশে হাফ ওয়ালে যারা টায়ার্ড হয়ে যাচ্ছে তারা বসে কিছুক্ষন রেস্ট নিচ্ছে, রেস্ট নেওয়া হয়ে গেলেই আবার নাচতে চলে যাচ্ছে। রুবাইদা বললো যে ও রুমে গিয়ে বসে থাকতে চায়। আমি বললাম ঠিক আছে, খাওয়ার সময় হলে আমি ডেকে দিবো। রুবাইদা চলে গেলে আমি হাফ ওয়ালের উপর বসে পড়ি। আমার খুব ভালো লাগছিলো। সবার চোখেমুখে এক ধরনের আনন্দের ঝিলিক। এই নাচের মধ্যেই মাঝে মাঝে কয়েকজন মিলে আলাদা হয়ে পড়ছিলো, তখন আবার বাকি সবাই মিলে তাদের পচাচ্ছিলো। কিছুক্ষন পর মায়িশা এসে আমার সাথে যোগ দেয়। আমরা দুইজন শুধু বসে থাকি আর অন্যদের দেখতে থাকি। এর মধ্যে জুবায়ের এক জগ গরম পানি এনে দেয়। সবাই খুব মাঞ্জা মেরে গরম পানি জগ থেকে ঢোঁক দিয়ে খেতে থাকে। আমি সবাইকে দেখছিলাম, অন্তরা, ঐশি, কৌশিক, নিলয়, নোভা, তুষার, জাফর, মজুমদার, মৌলি, সৃষ্টি, সৌরভ, সীমান্ত আফরা, হিমি, আদিবা – সবাইকে। সবার আনন্দ দেখে মনে হচ্ছিলো যেন আমাদের জীবনে কোন দুঃখ নাই, কোন দিন ছিলোও না। এ জীবন যেন শুধুই আনন্দের।

নাচানাচি শেষ করে আমরা খাওয়ার রুমে গেলাম। সেখানে আমাদের জন্য বুফে ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভাত, সবজি, মুরগি, ডাল, গাজরের সালাদ আর গরম পানি। জুবায়ের আশ্বস্ত করলো যে প্রত্যেকটা মুরগি ও নিজে জবাই করেছে। আমি রুবাইদাকে ডেকে আনলাম। তারপর সবাই খেতে বসলাম। মেনুটা যত বাঙ্গালি বলে মনে হয়, স্বাদটা ততটা নয়। সবগুলো খাবারই ঝাল। তবে সবজিটা অনেক মজা ছিলো। আর সাথে গরম পানিটাও খুব ভালো লাগছিলো। অনেকদিন পর সালাদ হিসেবে পাওয়া গাজর খেতেও মন্দ লাগছিলো না। যাই হোক আমরা খুব উপভোগ করলাম আমাদের খাওয়া। খাওয়া শেষে হাত ধুতে গেলাম যখন কলের পানিতে, আমার মনে হলো ঠান্ডা পানির স্রোতে আমার পুরা হাত অবশ হয়ে গেছে। খাওয়ার পর ঘোষণা আসলো, আমাদের জন্য মানালির বিখ্যাত তাজা ফলের সিরাপ কেনা হয়েছে। আমরা যেন কমিটির রুমে গিয়ে সিরাপ দিয়ে বানানো জুস খেয়ে আসি। আমরা ডাইনিঙ্গের সিড়ি বেয়ে কমিটির চার তলার রুমে উঠলাম।

সেটা ছিলো হানিমুন স্যুট। চৌচালা রুফের নিচে এত্ত সুন্দর একটা রুম যা দেখেই আমাদের সবার মাথা ঘুরে গেলো। আমরা সবাই মাটিতে পাতা কার্পেটের উপর বসলাম। বিছানায় বসে শুভ আমাদের মধ্যে কাল্পনিক একটা লাইন টেনে বললো দুই দলের মধ্যে গানের কলি খেলা হবে। ব্যাস আর যায় কই, সবাই হৈ হৈ করে গান যুদ্ধে নেমে পড়লো। এই হোটেলে আমরা ছাড়া আর কেউ নাই। তাই আমাদের গলা ছেড়ে গান গাওয়ার পাশাপাশি হৈচৈ চিৎকার করতে কোনই বাধা রইলো না। জোরসে শুরু হলো গান গাওয়ার পাশাপাশি আমাদের আড্ডাবাজী। আর অন্য পাশে জুবায়ের সোফায় বসে এক গ্লাস এক গ্লাস করে জুস বানাতে লাগলো। তারপর রিজভী সেগুলোকে ছোট ছোট ওয়ান টাইম কাপে ঢেলে এক কাপ এক কাপ করে সবার মধ্যে পাস করতে লাগলো। তারপর আমি উঠে গেলাম ওদের সাহায্য করতে। একটা ছোট ট্রেতে রিজভীকে বললাম কাপগুলো তুলে দিতে। আমি সেই ট্রেটা নিয়ে সবার কাছে কাছে গিয়ে এক কাপ এক কাপ করে জুস দিতে লাগলাম।

দে
ঠান্ডার রাতে জুস খেতে ব্যস্ত সবাই (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

ওদিকে গান যুদ্ধ খুব জমে উঠেছে। জাফর আর উর্মি একসাথে চড়াও হয়ে উঠছে অন্য দলের উপর। অন্য দলের নোভা আর মজুমদারও সমান সমান লড়ে যাচ্ছে। জাফর তো আরও সাংঘাতিক, ও এতই সিরিয়াস গানের ব্যাপারে যে বেশ কয়েকবার ভুল করে সে অন্য দলের পক্ষ হয়ে গানও গেয়ে ফেললো। আর ওদিকে জুবায়ের দ্যা জুস মেকার জুস বানিয়ে যেতেই লাগলো, রিজভী দ্যা সাপ্লাইয়ার কাপে জুস ঢেলে দিতে লাগলো আর আমি পাঁচ ছয় রাউন্ড করে জুস বিলি করতে লাগলাম। দুইটা ফ্লেভারের জুস ছিলো। জুসটা এতই ভালো ছিলো যে কারও সামনে নিয়ে যখন জিজ্ঞেস করতাম, ‘দিবো?’ সে বিনা দ্বিধায় হাত বাড়িয়ে কাপটা তুলে নিতো।

এই করতে করতে কখন যে রাত সাড়ে ১২টা বেজে গেলো টেরই পাই নাই। এক সময় আমাদের আসর ভেঙ্গে গেলো। সবাই কমিটিকে ধন্যবাদ দিয়ে যার যার রুমে ফেরত গেলো। সেই আগের মতন আমরা সবাই লেপ কম্বলের নিচে চাপা পড়ে ঘুমাতে লাগলাম।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *