The Mighty INDIA CALLING: চোখ ধাঁধাঁনো মরু প্রান্তরে দ্বিমিকবাসী এবং গভীর রাতে ঝলসানো মুরগি ও একটি পূর্ণিমার চাঁদ (পর্ব ২১)

সকালে ঝলমলে দিনের আলোতে ঘুম ভাংলো। ফ্রেশ হওয়ার পর আবার ব্যাকপ্যাক গোছগাছ করতে লাগলাম আজকে রাতের ‘ডেজার্ট নাইট’ এর জন্য। তারপর নিচে নেমে এলাম নাশ্তার জন্য। নাশতা পেলাম বড় বড় মাখন দেওয়া চকচকে রুটি, ভাজি আর টক দই। আমি আর মিম শেয়ার করে খেলাম। মনে হলো যেন বাসার নাশতা খাচ্ছি। আমার কাছে ঝাল লাগায় আমি আবার চিনি নিয়ে নিলাম। খুব তৃপ্তি করে খেলাম সব কিছু।

এর মধ্যে আমাদের বাসের ড্রাইভার আর হেল্পারের ঘুম ভেঙ্গেছে। ওনারা বাস থেকে লাগেজ নামিয়ে দিলো। আমরা যার যার লাগেজ টানতে টানতে রুমে নিয়ে গেলাম। রুমে আবার লাগেজ খুলে মালপত্র গুছালাম। আগামী কয়েক দিনের জন্যও জিনিসপত্র ভরে নিলাম ব্যাকপ্যাকে। তারপর সব গুছিয়ে আমরা রুম ছেড়ে দিলাম। ১০২ নম্বর রুমে সব লাগেজ রেখে আসলাম। লাগেজ জমা দিয়ে বের হলাম আমি, রুবাইদা, মিম আর অন্তরা। গন্তব্য ‘সোনার কেল্লা’।

ওদস
সোনার কেল্লার ভিতরে (কৃতজ্ঞতায় সাবরিনা মেহজাবিন রাত্রি)

দূর থেকে সোনার কেল্লা দেখতে দেখতে আমার চোখ জুড়িয়ে গেলো। এবার সোজা নামলাম কেল্লার সামনে। ঝলমলে দিনের আলোয় কেল্লাটা পুরো ঝকঝক করছিলো। ঢাল বেয়ে উঠতেই কতগুলো স্থানীয় মহিলাকে দেখলাম রুপার গয়না বিক্রি করতে। রুপার নূপুর, টিকলি, নথ, বিছা, নেকলেস এইসব। দাম তুলনা মূলক কম। অনেকেই গয়না কিনতে লাগলো। আরেকজনকে দেখলাম একটা বাঁশের তৈরি বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। এক সাদা টুরিস্টকে দেখলাম আগ্রহ নিয়ে সে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর চেষ্টা করতে। এই সব পার হয়ে কেল্লার ভিতরে ঢুকতে লাগলাম আমরা। চিপা চিপা অলি গলি দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম আমরা। দোকান পাট বেশির ভাগই খালি, কোন মানুষজনই নাই- এমনকি দোকানদারও নাই। দোকানে ঢুকে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে কোথা থেকে যেন দোকানের মালিক এসে হাজির হয়।  দোকান গুলোতে জয়পুরের সেই পায়জামাগুলোই পাওয়া যায় তবে জিনিসগুলো জয়পুরের চেয়ে সুন্দর আর দামও জয়পুরের চেয়ে বেশি। বেশ অ্যান্টিক টাইপের জিনিসপাতি আর রত্ন পাথরের গয়না গাটি দেখতে দেখতে আমরা হাঁটছিলাম। জয়সাল্মীরে আসার পর থেকেই মোবাইলে দেশের সাথে যোগাযোগ করতে পাচ্ছিলাম না। এই কেল্লায় এসে নেটওয়ার্ক পেলাম। বাসায় ফোন দিলাম। আম্মুকে চিৎকার করে সব জানালাম। ভাইয়াকে বললাম সব কিছু।

ফদস
সরু গলি ধরে হেঁটে চলা (কৃতজ্ঞতায় সাবরিনা মেহজাবিন রাত্রি)

কেল্লার কিনার ঘেঁষে একটা জায়গা পেলাম যেটা সুইসাইড পয়েন্ট। এখান থেকে নিচে ঝাঁপ দিয়ে বোধহয় মানুষ আত্মহত্যা করে। আমরা সেখানে ছবি তুললাম। আরেকটা জায়গা পেলাম ‘সিটি ভিউ’ যেখান থেকে শান্ত চুপচাপ জয়সাল্মীর শহরটা দেখা যায়। পুরো কেল্লাটাই হলুদ স্যান্ডস্টোন দিয়ে বানানো, খালি কয়েকটা ঘর দেখলাম নীল রঙ করা। এগুলো নাকি ব্রাহ্মণদের ঘর। যেখানে সেখানে রাস্তা দিয়ে গরু হাঁটছে নির্বিকারভাবে। ভেতরে কয়েকটা মিউজিয়াম ছিলো। তাড়াহুড়া করে সেগুলোতে আর ঢোকা হয় নাই। এর মধ্যে অন্তরাও ১৫০০ রুপির আরেকটা স্কার্ট কিনলো। রুবাইদা কিনলো বিশেষ পাথরের তৈরি মগ, আর সবশেষে অন্তরা নূপুর আর ব্যাগ কিনলো। আমরা বের হয়ে আসতে লাগলাম।

ফাভ
সুইসাইড পয়েন্ট থেকে দেখা জয়সাল্মীর শহর ( কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

বের হয়েই এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা হলো। কোন নির্বাচনী প্রচারনার জন্য ট্রাক ভর্তি করে এক নেতার সমর্থক এসেছে। তারা কেল্লার গেটের সামনে ট্রাক পার্ক করে পটকা ফুটাতে লাগলো আর রাস্তা ব্লক করে নাচতে লাগলো। সেই কি আওয়াজ! আমরা কানে আঙ্গুল চেপে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু রাস্তা ব্লক হয়ে যাওয়ায় কোন অটো আমাদের নিতে চাইছিলো না। শেষমেশ বাড়তি দাম দিয়ে একটা অটো ঠিক করলাম যেটা অনেক রাস্তা ঘুরে আমাদের হোটেলের কাছে নিয়ে গেলো। এইসব রাজনৈতিক শোভাযাত্রার কারণে আমাদের পৌঁছাতে বেশ দেরি হয়ে গেলো। হোটেলের কাছাকাছি আসতেই সবাই ফোনের উপর ফোন করতে লাগলো। স্টেশনের সামনে এক পানিপুরি ওয়ালার কাছ থেকে ওরা পানি পুরি অর্ডার দিলো। কিন্তু ফোনের চোটে আমরা সেই পানিপুরি ফেলেই ছুটতে লাগলাম হোটেলের দিকে। আমরা কোনরকম দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হোটেলের সামনে গিয়ে দেখি সবাই গোয়েলে উঠে বসে আছে। শুধু আমাদের জন্যই গোয়েল ছাড়তে পারছে না। আমি বাসে উঠার আগে নিলয়কে একবার রিকোয়েস্ট করলাম ১০২ এর দরজা খুলে দেওয়ার জন্য যাতে আমি আমার গুছিয়ে রাখা ব্যাকপ্যাকটা আনতে পারি। কিন্তু এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি আর ব্যাকপ্যাকটা নিতে পারলাম না। যেভাবে ছিলাম সেভাবেই আমরা চারজন বাসে উঠে পড়লাম। আমরা বাসে উঠতেই বাস ছেড়ে দিলো।

বাসে বসে ধাতস্থ হতে আমার একটু সময় লাগলো। আমি মনে মনে হিসাব করে দেখলাম আমার কাছে এই মূহুর্তে কি কি জিনিস আছে, আর কি কি লাগতে পারে রাতে থাকার জন্য। সব মিলিয়ে দেখলাম শুধু রাতের কম্বলটাই বাদ পড়েছে। এছাড়া যে জামা ঠিক করে রেখেছিলাম সেটার বদলে যে জামা পরা আছি সেটা পড়েই সারাদিন থাকা যাবে। সবচেয়ে পিছনে বসে বাইরের দিকে তাকাতে লাগলাম। কড়কড়ে রোদে আমার বেশ গরম লাগতে লাগলো। শহরটা পার হয়ে যাওয়ার পরই কয়েকটা রাজ প্রাসাদের মত হোটেল দেখলাম। এখানেই নাকি ‘এক থা টাইগার’ সিনেমার শুটিঙ্গের জন্য নায়ক সালমান খান তার দলবল নিয়ে অবস্থান করছেন! তারপরই শুরু হলো মরুভূমি। এই মরুভূমিটার নাম থর। থর মরুভূমিটা সিনেমায় দেখা মরুভূমির চাইতে আলাদা। মরুভূমি বললেই ধূ ধূ বালির প্রান্তর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু এই মরুভূমিতে অল্প বিস্তর গাছ আছে। মাটিও আছে বলে মনে হলো। আর একেবারে বিস্তীর্ণ নয়। মাঝে মাঝেই মানুষজন, কারখানা, উইন্ড মিল, সোলার প্যানেল চোখে পড়ে। দেখে মনে হচ্ছিলো ঠিক যেন মরুভূমি নয়, কেমন যেন বিরানভূমি। মরুভূমিতে খুব বেশি গরম লাগলো না। সূর্যের তেজও সহনীয় মনে হলো।

বাস আমাদের নামিয়ে দিলো একটা জায়গায় যেখানে লাইন ধরে বসে আছে সারি সারি উট। সেখানে নামার পর আমাদের দ্বিগুন দাম দিয়ে পানির বোতল কিনতে হলো। কারণ সামনে নাকি আর পানি পাওয়া যাবে না। পানি কিনে আমরা রংচঙ্গে গদি দিয়ে সাজানো সারি সারি উটের কাছে এসে দাঁড়ালাম। আমাদের জন্য উট ঠিক করে রাখা আছে। আমি আর রুবাইদা হাচড় পাচড় করে একটা উটের পিঠে চড়ে বসলাম। আমি বসলাম সামনে আর পিছনে বসলো রুবাইদা। সামনে ছোট্ট একটা হাতল আছে যেটা আমি শক্ত করে ধরে রাখলাম। আর রুবাইদা কিছু ধরার না পেয়ে আমাকে জাপটে ধরে রাখলো। একটা মাঝবয়সী নীল পাঞ্জাবী পরা মুসলমান লোক উটের দড়িটা ধরে টান দিয়ে তাকে উঠে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলো। উট দাঁড়ানোর সময় আগে পিছনের পা দুটো সোজা করে, তখন আরোহীরা ভূমির সাথে সমান্তরালে না থেকে ৯০ ডিগ্রি আঙ্গেলে অবস্থান করে। আশে পাশের উটগুলা থেকে আমাদের লোকজনদের চিৎকার শুনে বুঝতে পারছিলাম যে ব্যাপারটা বেশ ভীতিকর। যাই হোক আমাদের উট উঠে দাঁড়ালো। প্রথমে যখন পিছনের পা সোজা করলো তখন আমার মনে হলো আমি বোধহয় ছিটকে পড়ে যাবো। কিন্তু পড়ে যাবার আগেই উটটা সামনের পা সোজা করে উঠে দাঁড়ালো। গলা থেকে আর্তচিৎকার বের হবার আগেই আমি সামলে নিলাম। শুরু হলো আমাদের উটের পিঠে মরুভূমিতে জার্নি।

sv
উটে চড়ে দ্বিমিকবাসীর মরু যাত্রা (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম দিশা)

মরুভূমির মধ্যে দিয়ে সব গুলো উট লাইন ধরে চলতে লাগলো। প্রত্যেকটা উটের সাথে একজন করে লোক দড়ি ধরে হাঁটতে লাগলো। মাথার উপর গনগনে সূর্য থাকলেও কোন গরম লাগছিলো না। বালির উপর আমাদের বড় বড় ছায়া পড়ছিলো ঠিক সিনেমায় যেমনটা দেখা যায় সেরকম। উট চলে বেশ গদাই লস্করি চালে। আমরা ঝাঁকি খেতে খেতে চলতে লাগলাম। আমার বেশ ভালোই লাগছিলো কিন্তু পিছনে বসায় রুবাইদার বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। মাঝে মাঝে দুই একটা উট দৌড়ে আমাদের ওভারটেক করে যেতে লাগলো। সারাকে দেখলাম এরকম একটা উটের পিঠে বসে বেশ চিৎকার করতে। আমরা একেক জন একেক উটের পিঠে থেকে একেকজনকে ডাকাডাকি করতে লাগলাম। হৈ চৈ করতে করতে আমাদের শেষ বিকালের মরুভূমি যাত্রা চলতে লাগলো। আমি চোখ ভরে দুই পাশ দেখে নিলাম, উটের পিঠে মরুভূমিতে পাড়ি দেওয়া জীবনে আর কোনদিন হবে বলে ভাবতেও পারছি না। আল্লাহ কত সুন্দর একটা অভিজ্ঞতার সুযোগ দিয়েছেন আমাকে!

ঐ দূরে আমাদের ক্যাম্পের তাঁবু দেখা যায় (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম দিশা)

প্রায় আধা ঘন্টা পর আমাদের যাত্রা শেষ হলো। উটের বসাটাও সেইরকম এক্সাইটিং। তবে এবার আর আমি কোনমতেই চিৎকার দিলাম না। উটওয়ালা আমাদের ক্যামেরায় ছবি তুলে দিলো। উট থেকে নেমে ১০ রুপি বখশিশ দিলাম তাকে। সবাই একে একে উটের পিঠ থেকে নেমে হাত পা ছুড়তে লাগলো। আমার একবার উটের পিঠে চেপে উটের দৌড়ে অংশ নিতে ইচ্ছা করলো কিন্তু কাউকে পার্টনার পেলাম না বলে সেটা আর হয়ে উঠলো না। খানিক্ষন ছবিটবি তুলে আমরা পায়ে হেঁটে আমাদের ক্যাম্পের দিকে যেতে লাগলাম। কিন্তু ক্যাম্প খুলবে সূর্যাস্তের পর। আমরা ক্যাম্পের বাইরে একটা টং ঘর টাইপের দোকানে জড়ো হয়ে বসলাম। অনেকেই সিদ্ধ ডিম, মিরিন্ডা, চা আর ম্যাগী নুডুলস অর্ডার দিলো।  আমি একটা চিপস কিনে খেলাম।

এদচ
কিস কিস কো চায় চাহিয়ে????             (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম দিশা)

সূর্যাস্ত দেখার জন্য আবার আমরা আগের জায়গায় ফেরত গেলাম। দৌড়ে দৌড়ে বালির ঢিবিতে উঠলাম আমরা। দেখলাম মরুভূমির বুকে সূর্যাস্ত। ছোট্ট কমলা সূর্যটা রঙ ছড়িয়ে কেমন করে যেন মেঘের পিছনে হারিয়ে গেলো। আমরা সবাই ছবি তুললাম। ছোট্ট একটা ভিডিওও করলাম। সূর্য ডুবে যেতেই আমরা সবাই ফিরতে লাগলাম ক্যাম্পের গেটের কাছে। পাকা ওয়ালের বাউন্ডারি দেওয়া বিশাল ক্যাম্পের গেটে লিখা আছে ‘ওয়েসিস ক্যাম্প’। পাশে আবার মাভালা ভাই আর মোহাম্মদ আলী ভাই –এই দুইটা নামের পাশে মোবাইল নম্বর লিখা আছে। গেটে জয়পুরি পোশাক পরা একটা মেয়ে হাতে বরন থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দুপাশে কতগুলো বর্শার মধ্যে লাল সবুজ কাপড় বাঁধা। আর একজন বিশাল একটা ঢাক বাজিয়ে যাচ্ছে। আরও বাস ভর্তি লোকজন এসে নামলো। আমরা সবাই লাইন ধরে দাঁড়ালাম। মেয়েটা প্রত্যেকের কপালে লাল তিলক দিয়ে দিতে লাগলো। এটাই বরন। আমি মনে মনে ভাবলাম আমাদের দেশ হলে নিদেন পক্ষে একটা লজেন্স বা চকোলেট তো দিতই ঢুকার সময়! আমি কপালে তিলক না দিয়েই ভিতরে ঢুকলাম। খুঁজেখুঁজে আমাদের জন্য বরাদ্দ তাঁবুটা বের করলাম। তাবুতে ঢুকে আমাদের চোয়াল ঝুলে পড়লো। বেশ আলিশান তাঁবু। পুরোটাই কার্পেট দিয়ে ঢাকা। ভিতরে একটা রট আয়রনের ডবল বেড সাথে মোটা কম্বল। কম্বল পেয়ে আমার ভাবনা দূর হয়ে গেলো। তাঁবুর সাথেই এটাচড বাথ। বাথরুমও পুরোটা কার্পেটে ঢাকা। একটা পোর্টেবল কমোড, স্টিলের বাথটাব, আর আয়না দেওয়া স্টিলের বেসিন আছে। নিজেকে কেমন জানি রাজা রাজা মনে হলো। মরুর বুকে এরকম বিলাসবহুল থাকার জায়গা পাবো ভাবতেই পারি নাই!

সা
রাজস্থানী সাজে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় সাবরিনা মেহজাবিন রাত্রি)

আমরা ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এর মধ্যে বাইরে থেকে বারবার তাগাদা আসতে লাগলো, কি এক কালচারাল প্রোগ্রাম হবে সেখানে উপস্থিত হওয়ার জন্য তা না হলে আমরা নাশতা পাবো না। ‘নাশতা’ শুনেই আমরা বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লাম, ফ্রিতে পাওয়া খাবার বলে কথা! তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে পড়লাম আমরা। খোলা আকাশের নিচে একটা খাটিয়ার মত স্টেজ, সেটাকে ঘিরে আরব মরুভূমিতে বসে হুক্কা টানার জন্য যেরকম গদি থাকে সেরকম গদি সাজানো। আমরা দৌঁড়ে পিছনের দিকে একটা গদি দখল করলাম। আমাদের লোকজন সবাই পিছনের দিকে বসতে লাগলো। আমরা দেখতে লাগলাম অনুষ্ঠান। কয়েকজন লোক আঞ্চলিক গান গাইলো, তারপর দুইজন নৃত্যশিল্পী নাচের পাশাপাশি নানারকম খেলা দেখাতে লাগলো। ভালোই লাগলো সেইসব দেখতে। এর মধ্যে আমাদের সেই ‘নাশতা’ এসে হাজির হলো। এক কাপ চা আর ছোট বাটিতে যেই জিনিসটা আসলো তার নাম ‘পোহা’। জিনিসটা মুখে দিয়ে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। মনে হলো সিঙ্গারা, সমুচার গুঁড়ার সাথে পিয়াজ মরিচ কুচিকুচি করে দিয়ে চিনির সিরা ঢেলে দিয়েছে। অত্যন্ত বাজে এই জিনিসটা আর মুখে দিতে ইচ্ছা হলো না।

দ্ভ
পূর্ণিমা চাঁদের নিচে রাজস্থানী নাচের সাথে সাথে ব্যালেন্সের খেলা চলছে (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

আরও অনেক রকমের খেলা দেখলাম। একজন লোক চাকা আর আগুন নিয়ে কসরত দেখালো। তারপর নৃত্য শিল্পীরা উঠে এসে সবাইকে সামনে গিয়ে নাচার জন্য আহবান করলো। প্রথমে কয়েকজন ইন্ডিয়ান ইতস্তত করলো। অল্প কয়েকজন মিলে নাচা শুরু করলো। তারপর একে একে বাকিরা এগিয়ে গেলো। আমাদের মধ্যে অনেকে উশখুশ করলো সামনে যাওয়ার জন্য। তারপর অনেকে মিলে একসাথে গিয়ে গোল হয়ে দাঁড়ালো, তারপর আস্তে আস্তে নাচা শুরু করলো। এক পর্যায়ে সব ইন্ডিয়ানরা একে একে সরে গেলো। সামনে নাচতে লাগলো শুধু দ্বিমিকবাসী। আমি, মাইশা, রুবাইদা, জেরিন আমরা বসে বসে দেখতে লাগলাম সবাইকে। ঝলমলে পোশাক পড়া মেয়েদের আর মাথায় পাগড়ি বাঁধা ছেলেদের দেখতে বেশ ভালো লাগছিলো। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম সবাইকে। এক পর্যায়ে তুষার এসে ওর পাগড়িটা খুলে আমাকে দিয়ে গেলো। আমি আনন্দের সাথে পাগড়িটা মাথায় পড়লাম।

এর মধ্যে খবর আসলো আমাদের জন্য ডিনার দেওয়া হয়েছে। আমরা খুশি মনে দৌঁড়ে দৌঁড়ে গেলাম ডাইনিং হলে। বুফে খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কিন্তু আইটেমগুলো সবই ভেজ আর অত্যন্ত জঘন্য লাগলো দেখতে। একটা কাউন্টারে ভাত পাওয়া যাচ্ছে শুনে ছুটে গেলাম সেখানে। লোকটা সামান্য এক চামচ ভাত দিলো। আমি নিজে চামচ দিয়ে আরও বেশি ভাত নিয়ে নিলাম। দেখলাম লোকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বোধহয় জীবনে কাউকে এক চামচের বেশি ভাত নিতে দেখে নাই। যেকয়েকটা তরকারি ছিলো সবই খেতে অত্যন্ত বাজে। কি আর করা, পেট ভরানোর জন্য তাই দিয়ে মেখে ভাত খেতে লাগলাম। আমাদের লোকজন একে একে আসতে লাগলো। একটু পর খবর পেলাম ভাত শেষ হয়ে গেছে। উনারা নতুন করে ভাত চড়াতে গেছে। ১০ মিনিট পর ভাত পাওয়া যাবে। আমি মনে মনে হাসলাম, এই লোকগুলোর সাথে বোধহয় আগে বাঙ্গালি কোন দলের সাথে পরিচয় হয় নাই।

অত্যন্ত পচা স্বাদের খাবার খেয়ে, বিশ্রি আচার টেস্ট করে সবাই মুখ ভেংচে বের হয়ে আসলাম সেই ডাইনিং হল থেকে। কালচারাল স্টেজের সব লাইট নিভে যাওয়ায় টের পেলাম আকাশে তখন বিশাল একটা গোল চাঁদ। মরুর বুকে ঝকঝকে পূর্ণিমার চাঁদ দেকে থ হয়ে গেলাম আমি। বিস্তীর্ণ মরুভূমিটাকে আলোতে উদ্ভাসিত করে দিয়ে রেখেছে গোল চাঁদটা। ঠান্ডার প্রকোপটা একটু একটু করে টের পেলাম। তাঁবু থেকে সোয়েটার নিয়ে এসে বসলাম আমরা স্টেজটার চারপাশে গোল হয়ে। গাইতে লাগলাম একের পর এক গান। মরুর বুকে পূর্নিমা, গান গাওয়াটা তো আসেই। কিন্তু আমরা বেশিক্ষণ সেখানে থাকতে পারলাম না। আশপাশের তাঁবু থেকে কমপ্লেন আসতে লাগলো। আমরাও হাতে করে চেয়ারগুলো টেনে নিয়ে আমাদের তাঁবুর সারির কাছাকাছি গোল হয়ে বসলাম। আজকে রাতে মুরগির বারবিকিউ করার কথা। এখানে নন ভেজ অ্যালাউড না। তারপরও আমাদের বিশেষ অনুমতি দেওয়া হয়েছে বারবিকিউ করার জন্য। কিন্তু শর্ত একটাই, আগে সব মেহমানরা ঘুমিয়ে পড়বে তারপর আমরা বারবিকিউ করতে পারবো। একে একে সব লোক তাঁবুর ভিতর ঢুকে পড়লে ক্যাম্পের লোকজন গুটিগুটি পায়ে এসে এক হটপট ভর্তি রুটি, কেরোসিন তেল, বারবিকিউ করার চুলা, শিক, মেরিনেড করা মুরগির মাংস দিয়ে গেলো। ছেলেরা আর ক্যাম্পের লোকজন মিলে একটা গাছের কয়েকটা ডাল ভেঙ্গে আগুন ধরায়। তার উপর চুলাটা বসিয়ে মুরগির মাংসগুলো রেখে দেওয়া হলো। মাংসগুলো মেরিনেড করেছে জুবায়ের। হালাল মুরগি জোগাড় করে মেরিনেড করতে বেচারার যথেষ্ট কষ্ট হয়েছে।

কনকনে ঠান্ডার মধ্যে মুরগির বারবিকিউ চলছে
কনকনে ঠান্ডার মধ্যে মুরগির বারবিকিউ চলছে

রাত বাড়ার সাথে সাথে হুহু করে ঠান্ডা বাড়তে লাগলো। আমরা জ্বলন্ত আগুনের চারপাশে আমাদের চেয়ারগুলো সাজিয়ে বসলাম। অন্তরা পুরো কম্বলটাই নিয়ে এসেছে। আমি ওর কম্বলে ভাগ বসালাম। স্নিকার পরা পা দুটোকে ঠেলে দিলাম আগুনের কাছাকাছি। প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে অনেকেই খাওয়ার আশা বাদ দিয়ে ঘুমাতে গেলো। রুবাইদা বলে গেলো বারবিকিউ শেষ হলে যেন ওকে খবর দেওয়া হয়। আমরা বাকিরা ধৈর্য ধরে বসে রইলাম। তুষার একটু পর পর মাংসগুলোকে উলটে পালটে দিতে লাগলো। আমরা বুভুক্ষের মত তাকিয়ে রইলাম গনগনে আগুনের উপর ঝলসাতে থাকা ছোট ছোট মুরগির টুকরাগুলোর দিকে। এর মধ্যে উৎপাত শুরু হলো কুকুরের। আগুন আর মাংসের গন্ধ পেয়ে ধাড়ি ধাড়ি কুকুর এসে হাজির হলো। সেগুলো কাউকাউ করতে লাগলো। একটা কুকুর তো সারার চেয়ারের নিচেই ঢুকে পড়লো। আর তাঁবুগুলোর মধ্যে নাই কোন তালার ব্যবস্থা। কাপড়ের দরজা ঠেলেই কুকুর গুলো ভিতরে ঢুকে পড়তে লাগলো। এই কুকুর বাহিনী সামলাতে না সামলাতেই বিশাল এক গরু এসে হাজির হলো। গরুটা দূর থেকে কড়া নজরদারি করতে লাগলো আমাদের উপর। গরু আর কুকুর সামলাতে সামলাতে আমাদের প্রথম দফা বারবিকিউ হয়ে গেলো। তুষার আর রাজিব মিলে সেগুলো যত্ন করে হট পটে তুলে রাখলো। কারণ অ্যাট লিস্ট যতজন উপস্থিত, ততটা টুকরা রেডি না হলে খাওয়া শুরু হবে না। দ্বিতীয় দফা মাংস চড়ানো হলো। সবারই প্রচন্ড ক্লান্তি লাগছে কিন্তু বারবি কিউ ফেলে কেউ যেতে রাজি হচ্ছে না। নোভাকে দেখলাম চেয়ারে বসেই গালে হাত দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। আশেপাশের কয়েকজন আবার নোভার সেই পোজের ছবিও তুলে ফেললো। মাথার উপর বড় একটা চাঁদ, চারদিকে ধবধবে জোছনা, মরুর ঠান্ডা বাতাস আর এর মাঝে আগুনের চারপাশে গোলে হয়ে বসে হাসি, তামাশা, গল্প আর গান করতে করতে বারবিকিউ হতে লাগলো। শুভ হাত তুলে গেয়ে শোনালো বরবাদ সিনেমার গান ‘আসো না’। পরবর্তীতে এই গানটাই আমাদের পুরো ট্যুরের যৌথ থিম সং হয়ে যায়।

sac
গভীর রাতে পূর্ণিমা চাঁদের নিচে আমাদের আড্ডা চলছে (কৃতজ্ঞতায় রিজভী হাসান )

আনুমানিক রাত পৌনে দুইটার দিকে দ্বিতীয় দফা বার বি কিউ শেষ হয়। তখন তৃতীয় দফা মাংস চাপিয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি মুরগিগুলোর উপর। কাড়াকাড়ি করে হটপট থেকে আটার রুটি ভাগাভাগি করে নিয়ে কোনরকম মুরগির টুকরাগুলো নিয়ে আমরা গপাগপ খেতে থাকি। পোড়া রুটিগুলো শক্ত হয়ে গেছে, মাংস রুটি সবখানেই মিশে আছে বালি, মুখে দিতেই কিচকিচ করে উঠছে- কিন্তু তাতে কি? যে মজার ঝলসানো মাংসের স্বাদ পাচ্ছিলাম, তা আমাদের রাতের অখাদ্য ভেজ বুফের দুঃখ একেবারে ভুলিয়ে দিলো। তৃপ্তি করে খেলাম সবাই। আমাদের সবাইকে বলে দেওয়া হলো তাঁবুতে গিয়ে যারা ঘুমাচ্ছে তাদেরকে পাঠিয়ে দিতে। আমরা তিনজন তাঁবুতে ফিরে রুবাইদাকে গভীর ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। ও আর এত রাতে ঘুম ফেলে খেতে যেতে রাজি হলো না। আমরাও আর দেরি করলাম না। চটপট সবাই উঠে পড়লাম বিছানায়। ভারি আর পাতলা দুইটা কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

চোখের সামনে ভেসে উঠলো অনেক কিছু- জ্বলজ্বলে সোনালী দূর্গ, ধূ ধূ মরুভূমি, ক্যামেল রাইডিং, সূর্যাস্ত, কালচারাল নাইট, জঘন্য ডিনার, পূর্ণিমার আলোতে কনকনে ঠান্ডায় বারবিকিউ, বিলাসবহুল তাঁবুতে ঘুম……। সব মিলিয়ে ‘ডেজার্ট নাইট’ টা অসম্ভব ভালো কাটলো। এই সব ভাবতে ভাবতেই চট করে ঘুমিয়ে পড়লাম। পূর্ণিমার রাতে মরুভূমির বুকে তাঁবুতে ঘুম, সেই ঘুমের ভাবই আলাদা!

The Mighty INDIA CALLING: মরুর বুকে সোনালি শহর জয়সালমীরে (পর্ব ২০)

বেশ সকালে আমাদের গোয়েল থামলো এক ধাবাতে। আমরা সবাই নেমে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। কেউ কেউ খাওয়াদাওয়া অর্ডার দিতে বসলো। পাওয়া যাচ্ছে শুধু আলু পরোটা যেটাতে আবার লবন নাই। আমার লবন ছাড়া পরোটা খেতে ইচ্ছা করলো না। আমি বিস্কুটের প্যাকেট কিনে খেতে শুরু করলাম। নাশতা খেয়ে দাঁত মেজে নিলাম ধাবার সামনে হাত ধোয়ার বেসিনে। সব শেষে আবার বাসে উঠলাম। গোয়েল ছেড়ে দিলো। আমরা চলতে শুরু করলাম জয়সাল্মিরের দিকে।

প্রায় সকাল ১১টার দিকে আমরা পৌঁছালাম ছোট শহর জয়সালমিরে। আমাদের জন্য ঠিক করা হলো হোটেল অশোকা। ছোট দোতলা হোটেল। বলতে গেলে আমরাই হোটেলের প্রায় সবগুলো রুম দখল করে নিয়ে নিলাম। আমাদের ভাগ্যে জুটলো ট্রিপল বেডের একটা রুম। আমাদের চারজনের সাথে মিমেরও জায়গা হলো এই রুমে। ঝকঝকে দিনের আলোতে উদ্ভাসিত রুমটা আমাদের বেশ পছন্দই হলো। এই ঝকঝকে আলোতেই আবিষ্কার করলাম গায়ের রঙ কয়েক পোচ কালো হয়ে তো গেছেই প্লাস আমার বাম গালে বিশাল এক কালো ছাপ পড়েছে। মিম দেখে বললো, ‘সান বার্ন’। একে একে আমরা গোসল করতে ঢুকলাম। আমি কলে গরম পানির ব্যবস্থা পেয়ে বেশ খুশি হয়ে গেলাম। দারুন একটা গোসল করে বারান্দার রোদে আমাদের সব কাপড় মেলে দিলাম। এই হোটেলে প্রায় প্রতিটা রুমের দুইটা করে দরজা। একটা সামনের দরজা যেটাতে লবি থেকে ঢুকতে হয়, অন্যটা পিছনের দরজা যেটা দিয়ে টানা একটা বারান্দায় যাওয়া যায়। এই টানা বারান্দা আবার সবগুলো রুমকে কানেক্ট করে। আমি বারান্দা দিয়ে হেঁটে হেঁটে অন্যদের রুমে ঘুরে আসতে লাগলাম।

আমাদের বারান্দা থেকেই দেখা যায় যে নিচে বড় চুলাতে রান্নাবান্না হচ্ছে আর খোলা আকাশের নিচে খাটিয়ায় বসে লোকজন খাচ্ছে। আমার এখানে খেতে ইচ্ছা হলো না। দুপুরে খাওয়ার জন্য আমি বের হলাম মজুমদার, মৌলি আর জাফরের সাথে। হোটেল থেকে বের হয়ে চারপাশটা দেখলাম। এটাকে ঠিক শহর না বলে আমাদের দেশের উপজেলা বা সদর বললে মনে হয় ভালো হতো। যে রাস্তা দিয়ে আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম সেটা পুরো মাটির কাঁচা রাস্তা। দুপাশে জঙ্গল টাইপের গাছ। এর মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা সাইজের শুকর। আমাদের গ্রামগুলোতে যেমন রাস্তাঘাটে ছাগল ঘুরে বেড়ায় তেমনি এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে শুকর। যাই হোক কড়া রোদের মধ্যে হেঁটে গিয়ে শেষমেশ একটা খাবারের হোটেল পাওয়া গেলো। আমরা সবাই সেখানে ঢুকলাম। কিন্তু সেখানে ভেজ নাই। সবই মুরগি আর শুকর। আমি সেখান থেকে বের হয়ে এলাম। আবার সেই জঙ্গল আর শুকরের রাস্তা পার হয়ে হোটেলে ফেরত এলাম। হঠাৎ দেখি রুবাইদা হোটেলের নিচেই একটা ছোট্ট রুমে বসে আমার দিকে হাত নাড়ছে। আমি গিয়ে দেখলাম উপর থেকে যে রান্না বান্না দেখেছিলাম, তাদের ইনডোরে বসে খাওয়ার জায়গা এই রুমটা। রুবাইদা অর্ডার দিয়েছে রুটি বাদে শুধু ভাত দিয়ে ভেজ থালি। আমিও সেটাই অর্ডার দিলাম। মালিকটা অবাক হয়ে বললো, ‘আপ ভি রোটি নেহি মাংতা, স্রেফ চাওয়াল?’। আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।

বড় একটা স্টেনলেস স্টিলের থালিতে অনেকগুলো সাদা ভাত, ছোট ছোট বাটিতে ফুলকপির তরকারি, ডাল আর টক দই আসলো। খাবারটা বেশ মজা। কেমন জানি বাসায় রান্না করা খাবারের মত লাগছিলো। অনেকদিন পর তৃপ্তি করে পেট ভরে ভাত খেলাম। শুধু ফুলকপির তরকারিটা ঝাল ছিলো। কিন্তু আমি বলতেই আমাকে এক বাটি চিনি দিয়ে গেলো। আমার কাছে খেতে খুব ভালো লাগছিলো। আমরা ভাতের উপর তরকারি ঢেলে মাখিয়ে খাচ্ছিলাম। আশেপাশের লোকজন একটু অবাক হয়ে দেখছিলো আমাদের ভাত খাওয়ার তরিকা। সব শেষে ডালটা যখন প্লেট কাত করে চুমুক দিয়ে খাচ্ছিলাম তখন মালিকটা আমাদের জিজ্ঞেস করলো, ‘আপ কাঁহাসে আয়া হো’। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে জানতে চাইলো, ‘ক্যায়া ওয়াহা পে সাব লোগ চাওয়াল খাতা হ্যায়?’। সবাই ভাত খায় শুনে উনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘রোটি নেহি খাতা হ্যায় ক্যায়া?’। আমি হেসে জানালাম যে আমরা রুটিও খাই কিন্তু সকালের নাশ্তায়। লোকটা বেশ অবাক হলো। বিল নেওয়ার সময় আমরা রুটি খাই নাই বলে ৬০ রুপির থালি আমাদের কাছে ৫০ রুপি রাখলো। রুবাইদা জিজ্ঞেস করলো রাতেও ভাত পাওয়া যাবে কিনা। উনি জানালো এমনিতে বেশির ভাগ সময় উনারা ভাত রান্না করে না। কিন্তু আমরা যদি খাই তাহলে বারান্দা দিয়ে চিৎকার করে বলে দিলেই উনি ভাত চড়িয়ে দিবেন।

খাওয়া শেষে আমি আর রুবাইদা একটু ঘুরতে বের হলাম। একটু সামনেই একটা রেল স্টেশন। সেই দিকে হাঁটতে লাগলাম। চারিদিকে কেমন কড়া রোদ আর বালি বালি ভাব। রাস্তা ঘাটে তেমন কোন মানুষ জন নাই। কয়েকটা ছেলে মানুষ তাও দেখতে পেলাম। কিন্তু কোথাও কোন মহিলা পেলাম না। মনে হলো সারা শহরে বোধহয় আমরা দুই জনই মেয়ে। স্টেশনটাতে ঢুকে মনে হলো সারা স্টেশনে আমরা দুইজন ছাড়া আর কোন মানুষ নাই। পুরো জনমানবশূন্য একটা স্টেশন। কেমন যেন অস্বস্তি লাগলো আমাদের। আমরা তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসলাম। স্টেশন থেকে বের হয়ে একটু আগাতেই আমাদের মানুষজনের সাথে দেখা হলো। সবাই কথাবার্তা বলে ঠিক করলাম দুপুরের পর রোদের আঁচ একটু কমলেই আমরা ঘুরতে বের হবো। আমরা হোটেলে ফেরত আসলাম। গনগনে সূর্যের কড়া রোদের মধ্যে আমরা গল্প করার জন্য ছাদে উঠলাম। ছাদে ছাউনি দেওয়া চমৎকার বসার জায়গা আছে। সেখানে বসে আমি, মৌলি, সীমান্ত, তুষার, মজুমদার আমরা চরম হাসাহাসি করতে লাগলাম। এর মধ্যে হিমি এলো চমৎকার একটা জামা পরে। জয়পুর থেকে কিনে এরই মধ্যে ও ফিটিং করে নিয়েছে। খানিক পরে আমরা উঠে গেলাম ছোট্ট একটা ঘুম দেওয়ার জন্য। বিছানায় ধড়াম করে পড়েই আমরা ঘুমিয়ে গেলাম।

ঘুম ভাঙতেই আমরা তাড়াহুড়া করে তৈরি হয়ে বের হয়ে পড়লাম।  ছয় জন মিলে একটা অটো ঠিক করলাম বাজারে যাওয়ার জন্য। পার হেড খরচ পড়লো ১০ টাকা। বাজার আর কেল্লা পাশাপাশি। প্রথমে বাজারে নেমে আমরা হাঁটতে লাগলাম। বাজারের জিনিসগুলো বেশ ফ্যাকাশে আর মলিন। মনে হচ্ছে যেন বহু বছর ধরে এখানে নতুন কোন মাল তোলা হয় নাই। লোকজন নাই, ভিড় নাই কেমন যেন চুপচাপ। আমি ওয়াফির জন্য ছোট্ট একটা লাল টুকটুকে পাগড়ি কিনলাম ৩০ রুপি দিয়ে। থান কাপড়, ওয়ান পিস, ঘাগড়া, জুতা, জুয়েলারি আর সেই সব পায়জামা দেখতে দেখতে আমরা হাঁটতে লাগলাম। এখানে বেশির ভাগ জিনিসের দাম জয়পুরের চেয়ে বেশি আর কয়েকটা জিনিসের দাম কম। হঠাৎ মিম ‘পতঞ্জলি’ নামের এক আয়ুর্বেদিক দোকান থেকে আমাকে সান বার্নের জন্য কিছু একটা কিনে নিতে বললো। আমি আর রুবাইদা মিলে একটা অ্যালোভেরা জেল আর সানস্ক্রিন লোশন কিনলাম। এরই মধ্যে অন্তরা ফোন দিয়ে মন খারাপ করলো যে আমরা ওকে না খবর দিয়েই বের হয়ে পড়েছি। ও একা একা হোটেলে বসে আছে।  ঘুরতে ঘুরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার একটু আগে আমরা কেল্লার ভিতরে ঢুকলাম। কেল্লাটা দেখে কেমন যেন লাগলো। সন্ধ্যার আলোতে বিশাল বড় পাহাড়ের উপর কেল্লাটার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো কি যেন একটা মনে পড়ছে, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি কিছু বলার আগেই মিম বলে উঠলো, ‘সোনার কেল্লা!’।

সোনার কেল্লা! সোনার কেল্লা!! সোনার কেল্লা!!!
সোনার কেল্লা! সোনার কেল্লা!! সোনার কেল্লা!!!

আমার হৃদপিন্ড তখন ড্রাম বাজাতে লাগলো। সোনার কেল্লা! এই সেই সোনার কেল্লা, সেই ক্লাস থ্রিতে থাকতে প্রচ্ছদে পিস্তল হাতে সৌমিত্রর ছবি দেওয়া  নীল আকাশের পিছনে ঝকঝকে সোনালি রঙের যে কেল্লাটার ছবি দেখতাম – এটা সেই কেল্লা! এক সাথে আমার মনে পড়ে গেলো সব। জাতিস্মর মুকুলের কথা, নীলুর কিডন্যাপিঙ্গের কথা, যোধপুরে ট্রেনে ফেলুদার সাথে গুন্ডাদের মারামারির কথা, লালমোহন বাবুর সাথে পরিচয়, শুধু মাত্র জিভে গজা খেয়ে স্টেশনে রাত কাটানোর কথা, সবশেষে সামান্য বানান ভুলের সূত্র ধরে নকল ডক্টর হাজরাকে এই সোনার কেল্লাতেই পাকড়াও করা-। আমি তাকিয়ে রইলাম কেল্লাটার দিকে। আমার শৈশবের অত্যন্ত প্রিয় বই ‘সোনার কেল্লা’র সেই কেল্লাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি! ইয়া আল্লাহ, এত সুখ কেন জীবনে?

ঢাল বেয়ে আমরা উপরে উঠতে লাগলাম। মনে হচ্ছিলো যেন কোন সিনেমার ভিতরে ঢুকে পড়েছি। দুপাশের দেওয়াল জুড়ে নানা রকম জামাকাপড় ঝুলানো। কাঁচ বসানো আসল জয়পুরি সুতার কাজ করা জামা কাপড় দেখলাম। দাম অনেক বেশি। হবেই তো- হাতে কাজ করা যে! আশেপাশে ছোটখাট রেস্টুরেন্ট আছে। সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে আমরা সামনে যেতে লাগলাম। বেশ একটা চত্বরের মত খোলা জায়গায় এসে পড়লাম। চারপাশে দোকান পাট, রেস্টুরেন্ট, ঘরবাড়ি। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম সব কিছু। সন্ধ্যার দিকে দোকানপাট সব বন্ধ করে দিচ্ছিলো লোকজন। একটা গলি ধরে একটু আগাতেই এক দোকানে সুতার কাজ করা সিল্কের স্কার্ট মিমের খুব পছন্দ হলো। দরাদরি করে ১৫০০ রুপিতে মিম সেটা কিনে ফেললো। আমি পাশেই দেখলাম একটা দোকান, ‘মুকুল স্টোন শপ’। ভিতরে সাজানো সারি সারি ‘সোনার পাথর বাটি’। আমি মুখ হাঁ করে দেখতে লাগলাম।

মুকুল স্টোন শপে সাজানো সারি সারি 'সোনার পাথর বাটি'
মুকুল স্টোন শপে সাজানো সারি সারি ‘সোনার পাথর বাটি’

দোকান পাট সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো দেখে আমরা আর ভিতরে ঢুকলাম না। ঢালু রাস্তা বেয়ে নেমে আসলাম। ভাবলাম বাজারে কোন রেস্টুরেন্টের কোথাও বসে খেয়ে নিবো। কিন্তু ঘুরেফিরে কোনটাই ভালো লাগলো না। আবার অটো ঠিক করে হোটেলে ফেরত চলে আসলাম। হোটেল পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেলো। ঢুকতেই দেখলাম হোটেলের দরজার কাছে তুষার মন খারাপ করে বসে আছে। ওদের ছেলেদের দুইটা রুম কম ছিলো। ওরা এক রুমের লোকজন ভাগাভাগি হয়ে যায়। আরেক রুমের লোকজন বাকি থাকে। বলা হয়েছিলো বিকালের পর একটা রুম খালি হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন রুম খালি হয় নাই। ওরা পাশের আরেকটা হোটেল দেখে এসেছে কিন্তু রুম ওদের পছন্দ হয় নাই। এজন্য ওদের মন খারাপ। আমি বললাম যাই হোক অন্য কোথাও থাকার দরকার নাই। একান্তই যদি কোন উপায় না থাকে তাহলে আমরা মেয়েরা প্রত্যেকটা ডাবল রুমে পাঁচ জন করে থাকবো, তাহলেই একটা রুম খালি হয়ে যাবে। আশেপাশে যারা ছিলো তারা সবাই ব্যাপারটাতে সায় দিলো। আরও কিছুক্ষন গল্প করে আমরা উঠে আসলাম রুমে। সবাই পরদিনের ডেজার্ট নাইটের জন্য ব্যাগ প্যাক গুছাতে লাগলো। আমরা বারান্দা দিয়ে চিৎকার করে বললাম ভাত রান্না করার জন্য। পরে নিচে খেতে গেলাম। আমাদের থালিতে সাজিয়ে দিলো ভাত, আলুর তরকারি আর ডাল। তৃপ্তি করে খেলাম। খাওয়া বাবদ ৬০ রুপি দিয়ে আমরা আবার রুমে ফেরত গেলাম। ততক্ষনে মিমের স্কার্টের কথা জানাজানি হয়ে গেছে। সবাই দেখতে আসলো সেই স্কার্ট। আমরাও সবাইকে দেখালাম।

গোছগাছ শেষ করে আমরা শুয়ে পড়লাম। লাইট নিভিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই।

The Mighty INDIA CALLING: দুর্ধর্ষ রাজপুতদের গোলাপি মানমন্দির, প্রাসাদ এবং হাওয়া মহল (পর্ব ১৯)

সকালবেলা আগের মত আর ভুল করলাম না। খবর দিয়ে রাখার কারণে কলে গরম পানি পেলাম। শান্তিমত গোসল করে নিলাম ঘুম থেকে উঠেই। তারপর ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিয়ে বের হবার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। আমি, রুবাইদা, মিম আর অন্তরা হাঁটা ধরলাম আগের দিনে রাতের বেলা খেয়েছিলাম যে হোটেলে তার দিকে। আমি অবশ্য রাস্তার সেই রুটি আর সবজি খেতেই রাজি ছিলাম। কিন্তু রুবাইদা নাকি কি এমন জিনিস দেখেছে যে ও আমাদের কাউকে আর সেই রুটি সবজি খেতে দিতে চাইলো না। পথ কিন্তু বেশ অনেকটা। গতকাল রাতে যে রাস্তায় সোডিয়াম লাইটের নিচ দিয়ে হেঁটেছিলাম, আজকে পরিষ্কার দিনের আলোতে সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছি।

অনেক হাঁটার পর যখন সেই হোটেলে পৌঁছালাম দেখলাম সেখানে খাওয়ার কিছু নেই। তারপর সবাই মিলে সেই আগের দিনের মিষ্টির দোকান থেকে হালুয়া মিষ্টি কিনে খাই। আমি একটা ব্রিটানিয়া কেক দিয়েই নাস্তা সেরে ফেলি। সেই মিষ্টির দোকানে কথা বলে আমরা এমন কতগুলো জায়গার কথা জানতে চাই যেগুলো ওনারা চিনেই না। যেমন – ব্লু সিটির কথা উনারা জীবনেও শুনে নাই। তারপর উনাদের কাছ থেকেই সাজেশন নিয়ে আমরা ৮০ রুপি দিয়ে অটো ঠিক করি ‘যন্তর মন্তর’ এর উদ্দেশ্যে। প্রায় ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাই আমরা যন্তর মন্তর।

গেটে দেখলাম ভারতীয়দের জন্যই টিকেট ৪০ রুপি করে। অবাক হয়ে গেলাম, তাজ মহলের টিকেট যেখানে ২০ রুপি সেখানে এই কি না কি যন্তর মন্তর এ ঢুকতে হবে ৪০ রুপির টিকেট কেটে, কি অদ্ভূত! অন্তরা আমাদের জন্য ভারতীয় টিকেট কেটে আনলো। উঁচু দেওয়াল ঘেরা দুর্গের মত জায়গাটায় গেট দিয়ে ঢুকে পড়লাম আমরা। ঢুকে আমরা টের পেলাম যন্তর মন্তর আসলে রাজপুতদের অ্যাস্ট্রোনমিকাল অব্জারভেটরি অথবা সোজা বাংলায় মানমন্দির। রাজপুত রাজা জয় সিং অ্যাস্ট্রোনমি নিয়ে অনেক উৎসুক ছিলেন। উনি সারা ভারতে মোট পাঁচটি মান মন্দির তৈরি করে গেছেন। এদের মধ্যে এই যন্তর মন্তর সবচেয়ে বড়। এখানে মোটমাট ১৯টা যন্ত্র আছে যেগুলার সবগুলাই এখনো সঠিক রিডিং দেয়।

যন্তর মন্তরের একটি বিশালাকার যন্ত্র
যন্তর মন্তরের একটি বিশালাকার যন্ত্র

আমরা ২০০ রুপি দিয়ে ইংরেজি জানা একজন গাইড ঠিক করলাম। উনি আমাদের সব দেখিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। আমরা দেখলাম চক্র যন্ত্র, দক্ষিনত্তর ভিত্তি যন্ত্র, দিগাংশ যন্ত্র, দিশা যন্ত্র, ধ্রুব দর্শক পত্তিকা, জয় প্রকাশ যন্ত্র, কপালা যন্ত্র, কানালি যন্ত্র, ক্রান্তি বৃত্ত যন্ত্র, লঘু সম্রাট যন্ত্র, মিশ্র যন্ত্র, রাম যন্ত্র, রাশি বাল্য যন্ত্র, বিরাট সম্রাট যন্ত্র, যন্ত্র রাজ যন্ত্র ইত্যাদি। এদের মধ্যে অনেকগুলোই প্রথমে বড় করে বানানো, তারপর ঠিকঠাক মত রিডিং পাওয়ার পর একই জিনিস ছোট করে ফাইনালি বানানো হয়েছে। আমরা সব দেখে বুঝে থ হয়ে যাচ্ছিলাম। এত দিনে কোন এক জায়গায় বিজ্ঞান চর্চা নিয়ে কোন রাজার মাথা ব্যাথা দেখলাম। মনে মনে বলেই ফেললাম, ‘হ্যাটস অফ, রাজপুত’। আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম বড় বড় যন্ত্রগুলোর আনাচে কানাচে ধরে। অনেকক্ষন ধরে ঘুরে ফিরে আমরা এক সময় বের হয়ে আসলাম। এখান থেকে খুব কাছে সিটি প্যালেস।

আমরা ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগলাম। রাস্তার পাশে একজন বীন বাজিয়ে ঝাঁপির ভেতর থেকে সাপ বের করে খেলা দেখাচ্ছে। আমরা দেখলাম সাপের নাচ। হঠাৎ কয়েকজন সাদা চামড়ার বিদেশির উৎসাহ দেখে উনারা বাজনা বন্ধ করে পয়সা চাইতে লাগলো। আমরা তখন সুট করে সরে আসলাম। এবার যখন টিকেট কাটতে গেলাম তখন দেখলাম এখানে রেট আরও বেশি, ১০০ রুপি করে। আমরা ‘বীরেন্দ্র পোল’ নামের ধবধবে সাদা গেটটা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ি। ঢুকতেই সামনে পড়লো সাদা রঙের ‘মোবারক মহল’। মহারাজা দ্বিতীয় মাধো সিং এর আমলে বানানো দোতলা মহলটা এখন টেক্সটাইল গ্যালারী। অর্থাৎ এখানে  রাজপুত বংশের লোকদের ব্যবহার করা জামা কাপড় প্রদর্শন করা আছে। তাদের ফর্মাল ড্রেস, ক্যাসুয়াল ড্রেস, গরমের কাপড়, শীতের কাপড়, পলো খেলার পোশাক, যুদ্ধে পরার পোশাক এই সবকিছু সুন্দর করে ডিস্প্লে করা আছে। এর মধ্যে মহারাজা মাধো সিং এর ২৫০ কেজি ওজনের জামা দেখলাম। আরও দেখলাম রাজপুত বংশের মেয়েরা যাতে রাতের অন্ধকারে পলো খেলতে পারে তার জন্য বিশেষ রকমের পলো বল। এই বলের ভিতরে মোমবাতি বসানো থাকতো এবং এমন মেকানিজম ছিলো যাতে যেকোন দিকে বলটা ছুঁড়ে মারলেও সব সময় মোমবাতিটা সোজা হয়েই থাকে।  আমি খানিক্ষন হাঁ করে তাকিয়ে তাই দেখলাম।

দিউয়ানে খাস বা সর্বোতোভদ্র চক
দিউয়ানে খাস বা সর্বোতোভদ্র চক

মোবারক মহল থেকে বের হয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে পেলাম দিউয়ানে খাস বা ‘সর্বতোভদ্র চক’। এখানে আছে দুইটা পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রূপার কলস ‘গঙ্গাজলি’। এর প্রতিটাতে ৯০০ গ্যালন পানি ধরে। মহারাজা দ্বিতীয় মাধো সিং ইংল্যান্ডের সপ্তম এডওয়ার্ডের করোনেশন সেরেমনিতে যোগ দেওয়ার সময় এই দুই কলস ভরে গঙ্গার পানি নিয়ে গিয়েছিলেন। চকচকে কলস দুইটার সাথে দাঁড়িয়ে আমরা ছবি তুললাম। দেওয়ালে ঝুলানো আছে বল্লম, বর্শা, বন্দুক। সাথেই ছিলো সুভেনিয়র শপ। আমরা ঘুরে ঘুরে এসব দেখলাম। চারিদিকে অনেক সাদা চামড়ার বিদেশি ঘোরাফেরা করছে। এর মধ্যে একজন মহিলা অবাক হয়ে মিমের দীঘল কালো চুল হাত দিয়ে ধরে টেনে দেখলো। মিম তার দিকে অবাক হয়ে তাকাতেই মহিলা কিছু না বলেই সরে গেলো। কে জানে, ওদের দেশে হয়তো রুপাঞ্জেল ছাড়া আর কারও বড় চুলই নেই!

এরপর আমরা গেলাম ‘সিলেহখানা’ বা আর্মারি দেখতে। এখানে সারা ইন্ডিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ অ্যান্টিক অস্ত্রের সংগ্রহ রয়েছে। তলোয়ার, ভোজালি, দুই মাথাওয়ালা ভোজালি, ছুরি, কুড়াল, তীর ধনুক সব কিছু সুন্দর করে সাজানো আছে। হরেক রকমের বন্দুক আর গুলি থরে থরে সাজানো। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর আর শাহজাহানের নাম লিখা তলোয়ার দেখলাম। আবার মহারাজা দ্বিতীয় রাম সিং আর দ্বিতীয় মাধো সিং এর ব্যবহার করা অস্ত্রশস্ত্র দেখলাম। অনেক গুলো ছুরি, ভোজালির বাঁটে আবার বিস্তর ধাতব কারুকাজ করা, মূল্যবান রত্ন পাথর বসানো। অস্ত্রগুলো রাখার জন্য কারুকাজ করা হোল্ডস্টার বা কোফতগিরি দেখলাম। বারুদ রাখার জন্য পশুর চামড়া, শিং, শঙ্খ এইসব দিয়ে বানানো বোতলে আবার ধাতু দিয়ে নকশা করা। এ যেন শুধু অস্ত্র নয়, এ যেন এক শিল্প। সেখানে এক ইন্ডিয়ান ছাত্রী আবার আমাদের সাথে কথাবার্তা বলে নিলো যে, আমরা কোথ থেকে এসেছি, কয়জন এসেছি- এইসব। ওনাদের সাথে কথা বলে যখন গ্যালারি থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলাম, আমি রাজপুত বংশের মেধা নিয়ে কি ভাবছিলাম তা আর নাইই বলি।

তারপর দেখতে গেলাম ‘প্রিতম নিবাস চক’। এখানে খুব সুন্দর কারুকাজ করা চারটা গেট আছে, যেগুলো বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ আর শীতকাল নির্দেশ করে। ময়ুর বসানো কারুকাজ করা গেটটার নিচে আমরা সবাই ছবি তুললাম। এখান থেকে দেখা যায় ‘চন্দ্র মহল’ যেখানে বর্তমানে জয়পুরের রাজা থাকে। সত্যিকারের রাজবাড়িটা দেখতে অনেক সুন্দর। ওখানে ঢুকতে গেলে ২০০০ রুপির টিকেট কাটতে হয়। আমরা তাই বাইরে থেকেই দেখলাম। একেবারে উপরে ইন্ডিয়ার পতাকার সাথে সাথে রাজপুত বংশের পতাকাও উড়ছে সমানতালে। সাত তলার রাজকীয় বিল্ডিংটার দিকে আমরা পলক না ফেলে তাকিয়েই রইলাম অনেকক্ষন।

প্রীতম নিবাস বর্তমান রাজা এবং তার পরিবারের বাসস্থান
প্রীতম নিবাস বর্তমান রাজা এবং তার পরিবারের বাসস্থান

এরপর গেলাম ‘সভা নিবাস’ বা ‘দিউয়ানে আম’ বা দরবার হলে। এখানে আছে রাজার সিংহাসন। সিংহাসনের চারপাশে রাজপুত বংশের সব রাজাদের ছবি, নাম, পরিচয় এবং ইতিহাস দিয়ে পুরা দরবার হলটা সাজানো। এছাড়া বড় বড় ঘটনার ধারা বিবরণী ছবি দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রাজপুতদের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস, জ্ঞান চর্চার নমুনা এবং কূটনৈতিক পদক্ষেপ দেখতে দেখতে আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম। সব শেষে দেখলাম মহারাজা ব্রিগেডিয়ার ভবানী সিং এর পর তার মেয়ের ঘরের নাতি পদ্মনাভ সিং কে মাত্র ১২ বছর বয়সে ২০১০ সালে রাজা ঘোষনা দেওয়া হয়। এখন এই রাজার বয়স ১৬ বছর। কি চমৎকার ব্যাপার, ১৬ বছর বয়সেই একজন টিন এজার রাজা পরিচয় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!

সবশেষে আমরা দেখলাম ‘ভাগ্যি খানা’। এখানে রাজাদের ব্যবহার করা গাড়ি, রথ, পালকি এই সব সাজানো আছে। সামনেই কয়েকজন লোক পুতুল নাচ দেখাচ্ছিলো। চারপাশে অনেক দোকানপাট ছিলো। সেগুলোতে মোটামুটি কম দামেই জিনিসপাতি পাওয়া যাচ্ছিলো। অনেকেই এখান থেকে কেনাকাটা করছিলো। আমরা পুতুলনাচ দেখেটেখে দোকানপাট ঘুরে সেখান থেকে বের হয়ে যেতে লাগলাম। তখন এক ম্যাগজিন বিক্রেতার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম, রাজাকে তারা খুবই ভালোবাসে। রাজ পরিবারের প্রতি তাদের অগাধ শ্রদ্ধা। সবকিছু শুনে খুব ভালো লাগলো। ভালো লাগার পাশাপাশি কেমন যেন একটু দুঃখও লাগলো!

এরপর আমরা কয়েকজন অটোওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম হাওয়া মহলের কথা। তারা আমাদের রাস্তা দেখিয়ে বললো খুবই কাছে, হেঁটেই যাওয়া যাবে। ওদিকে দুপুর প্রায় শেষ হয়ে যায় যায় অবস্থা। আমরা ঠিক করলাম আগে খেয়ে নেই তারপর আবার ঘোরাঘুরি করা যাবে। আমি, অন্তরা আর মিম বড় রাস্তার উপর ‘বালাজি রেস্টুরেন্ট’ নামের এক দোকানে ঢুকলাম। তিন জনে দুইটা ফ্রায়েড রাইস অর্ডার দিলাম। বাংলাদেশের ফ্রায়েড রাইস আর এখানকার ফ্রায়েড রাইসের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। এখানে ফ্রায়েড রাইস বলতে যা দিলো তা হচ্ছে- তেলতেলা বাসমতি চালের পোলাওয়ের উপর বড় বড় সবুজ মটরশুটি আর পিয়াজ। অত্যন্ত লবনাক্ত হওয়ার কারণে আমাদের খেতে খুবই কষ্ট হচ্ছিলো। ১০০ রুপি দিয়ে এই খাবার খেয়ে আমাদের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। পরে দোকান থেকে বের হয়ে একটা কোক খেয়ে মুখের লবনাক্ততা কমালাম আমরা। আমরা ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগলাম। দুইপাশে সারি সারি দোকান। মাঝে মধ্যে দুই একটা দোকানে ঢুঁ মেরে বুঝলাম বেশ সন্দেহজনক সবকিছু। দোকানে একবার লোক ঢুকলেই তারা কিছু না কিছু গছিয়ে দেবার পায়তারা করে। বাইরে থেকে জিনিসের এক দাম বলে, কিন্তু যেই জিনিসটা দেখতে যাবো তখনই সেটার দাম বেড়ে যায়। আর কয়েক জায়গায় দেখলাম, সাদা চামড়া বিদেশিদের গলা কেটে লাভ করে নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। এক পর্যায়ে আমরা দোকানদারদের ডাকাডাকিতে বিরক্ত হয়ে গেলাম। কোন দিক না দেখে সোজা হাঁটতে লাগলাম। ঠিক হলো কোন কিছু কিনতে চাইলে ফেরার সময় কিনে নিবো। এরমধ্যে আমি দরাদরি করে ফিক্সড ১০০ রুপির ‘রেবন’ সানগ্লাস ৬০ রুপি দিয়ে কিনলাম। সব কিছু দেখেটেকে অন্তরা সাবধান হয়ে গেলো। ও ঠিক করলো এখন থেকে সব কিছুর দামাদামি শুরু করবে তিন ভাগের এক ভাগ থেকে।

লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে, অনেক গেট ঘরবাড়ি পার হয়ে আমরা হাওয়া মহলের পিছনে এসে পৌঁছালাম। এইখানে ঢুকতে হয় পিছন দিক দিয়েই। আবার ১০ রুপির টিকেট কেটে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। বাইরে থেকে হাওয়া মহলের এলেভিশন দেখেই আমার পছন্দ হয়ে গেলো। ভিতরে ঢুকে তো আরও মজা পেলাম। কয়েকটা উঠান পার হয়ে বেশ চিপা চিপা জায়গা দিয়ে র‍্যাম্প বেয়ে বেয়ে আমরা উপরে উঠতে উঠতে হাঁপিয়ে গেলাম। মজার ব্যাপার হলো এখানে সিঁড়ি নাই, র‍্যাম্প দিয়েই উঠতে হয়। উঠলাম বেশ চিকন একটা টেরাসে। এখানে সবকিছুই খুব চিপা চিপা। খুবই ছোট্ট ছোট্ট জানালা, প্রায় হাতের তালুর সমান। লাল আর গোলাপি সান্ডস্টোনের জালি দিয়ে হুহু করে বাতাস আসছে। আর ছাদের থেকেই দেখা যাচ্ছে আশেপাশের সব কিছু। আমরা এখান থেকে দেখলাম যন্তর মন্তর, সিটি প্যালেস, চন্দ্র মহল- সব।

হাজার জানালার হাওয়া মহল
হাজার জানালার হাওয়া মহল

পুরো হাওয়া মহলে ৯৫৩ টা জানালা আছে। ১৮০০ সালের দিকে এটা বানানো হয়েছিলো যাতে রাজ বংশের মেয়েরা এখানে দাঁড়িয়ে শহরের সব কর্মকান্ড দেখতে পারে। আমরা উপরে উঠে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। রঙ্গিন কাঁচ দেওয়া অনেকগুলো ঘর, অনেকগুলো ছাদ আমরা ঘুরতে ঘুরতে একসময় রুবাইদা হারিয়ে গেলো। কয়েকটা জায়গায় যাওয়ার আগেই কয়েকটা দরজা বন্ধ করে দিলো। একসময় আমরা তিন জন তিনটা আর্চের নিচে দাঁড়িয়ে পোজ মারলাম আর রুবাইদা ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ করে ছবি তুলতে লাগলো। সেই সময় একটা বিদেশি টুরিস্ট দল এসে রুবাইদার পিছনে দাঁড়িয়ে আমাদের ছবি তুলতে লাগলো। আমরা তাড়াতাড়ি সরে গেলাম সেখান থেকে। কিছুক্ষন পর একটা বিদেশি আমাকে দেখে বললো, ‘ওহ, ইউ ওয়ার দোস গার্লস……’। আমি হাসি দিয়ে বললাম, ‘ইয়েস, উই আর’। অনেক গোলক ধাঁধাঁ পার হয়ে ছোট্ট একটা আর্ট এক্সিবিশন দেখতে দেখতে আমাদের সবাই তাড়া দিতে লাগলো যে এখনই বের হয়ে যেতে হবে। আমরা চিপা চিপা পথ ধরে দৌড়াদৌড়ি করে বের হতে লাগলাম।

বের হয়ে আমরা একটু বসে বিশ্রাম নিলাম। আমি বাথরুমে গেলাম। সেখানে আরেক দল বিদেশি টুরিস্ট হাউকাউ করছে। দেখলাম তারা একজন ভিতরে যাচ্ছে, অন্যজন দরজা ধরে রাখছে। আমি ভয় পেলাম, এখানে কি বাথরুমে ছিটকানি নাই? কিন্তু পরে ঢুকে দেখলাম সবই ঠিক আছে, ওরা মনে হয় ছিটকানি জিনিসটা চেনে না। অ্যামেজিং টুরিস্টস!

আমরা বের হয়ে আবার শপিং এ মনোযোগী হলাম। কিন্তু অভিজ্ঞতা বেশ তিক্ত হলো। বিকালে দেখা জিনিসপত্রের দাম এরই মধ্যে বেড়ে গেছে। দামের উল্টা পালটা তো আছেই। আর দোকানদাররা খুব তেল দিয়ে দিয়ে কথাবার্তা বলে। জিজ্ঞেস করে, ‘কাহাসে আয়া হো? আপ ক্যায়া মালয়শিয়া সে হো?’। পরে বাংলাদেশ শুনে একজন বললো, ‘আই লাইক বাংলাদেশ- মিরপুর স্টেডিয়াম- আই লাইক সাকিব আল হাসান’। দামদর করতে করতে সবার মাথা খারাপ হয়ে গেলো। এরই মধ্যে গতকাল যে চুড়ি আমি ১০০ রুপি দিয়ে কিনেছি সেটা অন্তরা দাম করলো। একই জিনিস এক দোকানে ১৫০, এক দোকানে ৯০ আরেক দোকানে ২৫০ রুপি চাইলো। সব শেষে ৯০ রুপির দোকানে গিয়ে অন্তরা যখন কিনতে চাইলো, তখন উনারা জানালো উনারা চুড়ি বিক্রি করবে না। পুরাই ঠগের রাজ্য যেন চারপাশে। বিকালে তাও যা দাম কম ছিলো, এখন তো যার যা দাম ইচ্ছা, তাই হাঁকছে। জিনিস পছন্দ করার সাথে সাথেই দাম বদলে যায়। কি অদ্ভূত জায়গা রে বাবা! আমার মনে হলো এর চেয়ে সিটি প্যালেসের ভিতরে কেনাকাটা করাই ভাল ছিলো।

এরই মধ্যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে গেলো। আমরা চারজন অটো ভাড়া করে হোটেলের দিকে রওয়ানা হলাম। হোটেলে গিয়ে ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে নিয়ে রাতের খাবারের জন্য বের হয়ে পড়লাম। এবার অর্ডার দিলাম আলু টমেটু আর রুটি। খেতে ভালোই ছিলো। পেট ভরে খেয়েদেয়ে হাঁটা ধরলাম হোটেলের দিকে। গোয়েল প্রস্তুত ছিলো আমাদের জন্য। মালপত্র নিয়ে উঠে পড়লাম আমরা। গোয়েল আমাদের নিয়ে রওয়ানা দিলো। পরবর্তী গন্তব্য- জয়সালমীর।

 

The Mighty INDIA CALLING: গোলাপি শহরে আকাশের কাছাকাছি আম্বর ফোর্ট এবং জয়গড় ফোর্টে (পর্ব ১৮)

সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখলাম মৌলি গোসলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কলে গরম পানি নাই। এই জন্য ওর দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রুম সার্ভিসে ফোন দিয়ে জানলাম ওদের এখানে বয়লার দিয়ে পানি গরম হয়। সেজন্য প্রায় ঘন্টা খানেক আগে জানাতে হয়। কিন্তু আমাদের হাতে তো অত সময় নাই। প্রথমে মৌলি গোসল করলো। তারপর মজুমদার অনেক কষ্ট করে গোসল করে এসে বললো ভীষন ঠান্ডা পানি। ঠান্ডা পানির কথে শুনে আমি গোসল করার চিন্তা ভাবনা জলাঞ্জলি দিলাম। গরম পানি না পেলে এই ঠান্ডায় আমি কোনভাবেই গোসল করবো না।

আমি আর রুবাইদা বের হয়ে পড়লাম নাশতা খাওয়ার জন্য। আমাদের হোটেলটা একটা আবাসিক এলাকার মাঝখানে। আশেপাশে সব বাসাবাড়ি। কাছাকাছি কোন হোটেল টোটেল নাই। হোটেলের সামনেই এক লোককে দেখলাম ঠেলাগাড়ি নিয়ে বসে আছে। তার গাড়িতে কড়াই, চুলা এইসব সাজানো। রুবাইদা জিজ্ঞেস করেতেই লোকটা জানালো উনি রুটি আর তরকারি বিক্রি করেন। আশেপাশে কোন খাওয়ার দোকানের সন্ধান না পেয়ে শেষমেষ সেই ঠেলাগাড়ির লোকটাকেই বললাম চারটা রুটি আর তরকারি দিতে। উনি আমাদের সামনেই কড়াই ধুয়ে পরিষ্কার করলেন। তারপর পলিথিনের প্যাকেট থেকে কাঁচা কতগুলা সাদা রঙের রুটি বের করে অল্প তেলে ভাজতে লাগলেন। রুটিগুলো অদ্ভূত। ছোট সাইজের ওভাল শেপের রুটি। অনেকটা নান রুটির মত কিন্তু নান রুটি না। তারপর আরেকটা পাত্রে মটর টাইপের একটা জিনিস দেওয়া তরকারি গরম করে দিলেন। তারপর ওয়ান টাইম ইউজ বাটিতে ঢেলে উপরে পিয়াজ কুচি ছড়িয়ে আমাদের সামনে এনে দিলেন। আমরা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই রুটি দিয়ে তরকারি খেলাম। তরকারিটা অত মজা না। তবে খেতে খারাপও না। আমাদের দেখা দেখি অনেকে হোটেল থেকে বের হয়ে সেই রুটি তরকারি অর্ডার দিলো। তারপর রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাশতা খেতে লাগলো।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা গোয়েলে উঠে পড়লাম। আমাদের বাস চলতে শুরু করলো। ঠিক আগের মতনই আমাদের ড্রাইভার আরেক গাইডের কথা বললো। এবার আমাদের কমিটি উনাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলো আমরা বড় প্যাকেজে যাবো না। তবে যদি শুধু  একজন গাইড থাকে তাহলে আমাদের তেমন সমস্যা নাই। তারপর আমাদের বাসে উঠলো হাফ সোয়েটার পরা একজন লোক। আগের বারের লোকটার মত ধুরন্দর চেহারা উনার নাই। তবে উনি আমাদের সামনে এসে কি সব জানি বলতে লাগলো। উনার ভাষাও আমরা বুঝতে পারলাম না। অত্যন্ত বোরিং সেই কথাবার্তা শুনে আমাদের বিরক্তি ধরে গেলো। আমি সৌরভকে বিরক্ত হয়ে বললাম, কেন আমরা পয়সা দিয়ে এইসব ফাউল লোকজন হায়ার করছি ? জবাবে সৌরভ জানালো, গাইড গাইডের মত থাকবে আর আমরা আমাদের মত থাকবো। এই গাইড রাখার একমাত্র কারণ হচ্ছে ড্রাইভারকে না চটানো। সো সামান্য টাকা খরচ হলেও কমিটি এই এক্টামাত্র কারণে এই ফালতু গাইডকে রাখা হয়েছে।

গাইড আমাদের প্রথমে নিয়ে গেলো পাহাড়ের উপর বিড়লা টেম্পলে। সাদা রঙের মার্বেলের টেম্পলটার মাথায় তিন রকমের শিখরা। একটা মন্দিরের, একটা মসজিদের, অন্যটা গুরুদোয়ারার। বিড়লা কোম্পানির মালিক তার বাবা মার স্মরণে এই টেম্পলটা বানিয়ে দিয়েছে। আমরা ভিতরে ঢুকে দেখলাম স্টেজের উপর পর্দা টানানো, আর সবাই চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ ঘন্টা বাজলো। হুশ করে পর্দা সরে গেলো। স্টেজের উপর দুইটা মুর্তি দেখতে পেলাম (সম্ভবত লক্ষী-নারায়ন)। আর সাথে সাথেই গান শুরু হলো। সবাই দাঁড়িয়ে পড়লো, সামনে এগিয়ে গেলো আর দুলে দুলে গানের সাথে গলা মেলাতে লাগলো। তারপর পুরোহিত এক ধরনের পানি সবার দিকে ছিটিয়ে দিতে লাগলেন। আমরা একেবারে পিছনে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখতে লাগলাম। তারপর তাড়াতাড়ি করে মন্দির থেকে বের হয়ে আসলাম। বের হতে হতেই অনেকে বলাবলি করতে লাগলো এটা তো অত্যন্ত টিপিকাল মন্দির। কেন এখানে এসে আমাদের এতগুলো সময় নষ্ট করতে হলো। মনে মনে গাইডকে বকাবকি করে আমরা গোয়েলে উঠলাম।

এরপর অনেক্ষন বাস চলে আমাদের নিয়ে গেলো জয়পুরের সরকারি বিক্রয় কেন্দ্রে। এখানেও আমরা কেন নেমেছি বুঝতে পারলাম না। যাই হোক গাইদের পিছু পিছু আমরা বাস থেকে নামলাম। প্রথমেই একজন লোক আমাদের কিসব জানি ব্লক বাটিকের পদ্ধতি দেখালো। তারপর তারা আমাদের দোকানের ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো। সেখানে শুরুতেই ছেলেদের আলাদা করে দিলো। আর আমাদের মেয়েদের অন্যদিকে নিয়ে যেতে লাগলো। বিক্রয় কেন্দ্রটা অনেক বিশাল। সবকিছুরই দাম অনেক বেশি। শাড়ি, ওড়না, স্যান্ডেল, জুতা সবকিছুর আলাদা আলাদা সেকশন। আমাদের হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে গেলো কাঁথা বালিশ আর কম্বলের সেকশনে। সেখানে আমাদের ‘রাজস্থানী রাজাই’ নামের এক দারুন জিনিস দেখালো। এটা খুবই পাতলা কম্ফোর্ট টাইপের জিনিস। এটা শীতকালে গায়ে দিয়ে ঘুমালে গরম লাগবে আর গরমকালে বিছানায় বিছিয়ে ঘুমালে ঠান্ডা লাগবে। এটাকে ভাঁজ করে একদম ছোট জুতার বাক্সের সমান বানিয়ে ফেলা যায়। আর এটার ওজনও অনেক কম। আমরা বড় বড় চোখ করে সব দেখতে লাগলাম। তারপর উনারা এটার দাম বলে আমাদের বললেন যে আমাদের কোনটা কোনটা পছন্দ। উনাদের কথায় আমরা নড়েচড়ে উঠলাম। আমরা উঠে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু আমরা যতই এখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি উনারা ততই আমাদের আরও ভিতরের দিকে সেকশনে পাঠিয়ে দেয়। আমরা ঝাড়বাতি, ফার্নিচার, রত্ন পাথর সব দেখে দৌড়ে দৌড়ে বের হয়ে যেতে থাকি। আমরা মেয়েরা তো তবুও বের হয়ে আসি, কিন্তু ছেলেদের কোন খবর নাই। আমরা ভাবলাম, ওদের কাছ থেকে বোধহয় ইচ্ছা মত খসিয়ে নিচ্ছে। আমরা গোয়েলে উঠে পড়লাম। অনেক্ষন পরে ছেলেরা ফিরতে লাগলো। ওরা কেউ কিছু কিনে নাই শুধুমাত্র জাফর ছাড়া। জাফর একটা গোলাপি ওড়না কিনে প্রায় চার গুন দাম দিয়ে। ও একটা শাড়িও কিনতে চাচ্ছিলো। ভাগ্যিস কেনার আগে চয়েস করার জন্য মৌলিকে খবর দিতেই মৌলি প্রবল্ভাবে ওকে না করে দেয় এখান থেকে কিনতে। যাক, জাফরের লসটা শুধু একটা ওড়নার উপর দিয়ে গেছে!

ততক্ষনে দুপুর হয়ে গেছে। অনেকেই জুস, চিপস কিনে নিলো। আমিও চিপস কিনে নিলাম। বাসে বসে তাই চিবাতে লাগলাম। সবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে সেই দালাল গাইডের উপর। কতক্ষণ ধরে আমরা বাসে করে ঘুরছি কিন্তু একটাও কাজের জায়গায় যাচ্ছি না, সব আজাইরা জায়গায় গিয়ে শুধু শধু সময় নষ্ট হচ্ছে। এবার গিয়ে কমিটির লোকজন ড্রাইভারকে বলে আসলো যাতে আমরা সোজা আম্বর ফোর্ট যাই। মাঝে আর কোনখানে যাতে থামা না হয়। বাস চলতে শুরু করলো। আমি জানালা দিয়ে দেখতে লাগলাম জয়পুর শহর। অনেক পুরানো শহর কিন্তু প্ল্যান করা। রাজপুত রাজা মানসিংহের বানানো বিল্ডিং প্যাটার্ন অনুযায়ী শহরের মেইন কমার্শিয়াল এলাকাগুলো গড়ে উঠেছে। সবগুলো বিল্ডিংয়েই সেই লালচে কমলা রঙের জালি জালি জানালা দেওয়া রাজকীয় ভাবটা আছে। এ জন্যই বলা হয় ‘দ্যা পিংক সিটি’।

আমাদের গোয়েল এসে পৌঁছালো আম্বর ফোর্ট। বাস থেকে নেমেই মাওতা লেকের সামনে দাঁড়িয়ে গ্রুপ ফটো তুললাম। অনেকে সেখানে জিরা পানি খেলো। সেটার স্বাদ নাকি দারুন। খানিক্ষন পরে সেখান থেকে হাঁটা শুরু করলাম আম্বর ফোর্টের দিকে। মাওতা লেকের পাশ দিয়ে লাইন ধরে হাঁটতে লাগলাম আমরা। এক পাশে টলটলে মাওতা লেক আর লেকের ওপারে সোনালি পাহাড়ের গায়ে এঁকেবেঁকে উঠে গেছে দেওয়াল। ঠিক যেন চীনের প্রাচীর। পুরো পাহাড় জুড়ে রাজকীয় ফোর্টটা যেন আসন গেড়ে বসে আছে। মুখ হাঁ করে এই দেখতে দেখতে আমরা প্রবেশের কাছাকাছি চলে আসলাম। আম্বরের গেটের সামনে ভুট্টার দানা প্লেটে প্লেটে করে বিক্রি হচ্ছে। আশেপাশে অসংখ্য কবুতর ওড়াউড়ি করছে। অনেকে দানাগুলো কিনে কবুতরকে খাওয়াতে লাগলো। বাসিরুনের হাতে একটা কবুতর অনেক্ষন ধরে বসে দানা খেলো। আর বেচারা আফরার হাতের দানা খেতে এক বড়সর সাইজের ছাগল এসে হাজির হলো। ছাগলটা আফরার হাত চেটেপুটে খেতে লাগলো। আমরা দৃশ্যটা দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম।

আম্বর ফোর্টের সামনে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

আমরা আবার হেঁটে পৌঁছালাম গেটের কাছে। প্রথমেই দেখলাম ‘দিল আরাম বাগ’। এটা ফোয়ারা, পানির পুল, চৌচালা ছাউনি, সবুজ ঘাসের লন আর অসংখ্য ফুল গাছ সহ একটা সুন্দর সাজানো বাগান। এখানে আসলে মনে শান্তি লাগে তাই এর নাম ‘দিল আরাম বাগ’। এটার কন্সেপ্ট এসেছে সেই হুমায়ুন্স টম্বের চারবাগ থেকে। এখান থেকে মাওতা লেকের অপরূপ ভিউ দেখতে দেখতে আমরা উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। কি যে সুন্দর দৃশ্য! ঢাল বেয়ে উঠছিলাম আর মাথা ঘুরিয়ে ডানে, বামে, সামনে, পিছনে, উপরে নিচে সবদিকে দেখছিলাম। সমতলে শুধু চারদিক দেখলেই হয়। পাহাড়ের গায়ে উপরে নিচেও দেখা লাগে। কখনও ঢাল, কখনও সিঁড়ি এই বেয়ে বেয়ে আমরা ক্লান্ত হয়ে পৌঁছালাম ‘সুরাজ পোল’ এ। এই গেট পূর্ব দিকে মুখ করা বলে এর নাম সুরাজ পোল। বিশাল রাজকীয় এই গেট পার হয়ে ভিতরে ঢুকে পুরাই পাকা করা বেশ বড় খোলা জায়গা পেলাম। চারিদকে স্ট্রাকচার দিয়ে ঘেরা একটা বিশাল কোর্ট ইয়ার্ডের মত জায়গা। এর নাম ‘জালেব চক’। এখানে সৈন্যরা যুদ্ধ জয় শেষে বিজয় মিছিল করতো। এখানে কেউ ঢুকলে মনেই করবে না যে এটা ভূমি থেকে এত উঁচু একটা জায়গা। এই কোর্টের মধ্যেই অন্য আরেকটা গেট দেখলাম যার নাম ‘চান্দ পোল’। এই গেটের উপরে ছিলো ‘নওবত খানা’। নওবত খানায় ঐতিহ্যবাহী বাদ্য বাজানো হতো। আর যখন বাদ্য বাজতো তখন সবাই চুপ করে শুনতো। আমরা সেখানে স্থানীয় একজনকে দেখলাম এক মনে সারেঙ্গীর মত একটা বাদ্য বাজিয়েই যাচ্ছে। যেমনটা সোনার কেল্লায় পড়েছিলাম। কতগুলো লোক পাগড়ি বিক্রি করছিলো। সীমান্ত ১০০ রুপি দিয়ে পাগড়ি কিনলো। সেই পাগড়ি পরে আমরা পোজ মেরে ছবি তুললাম। এরপর আমরা টিকেট কাটলাম। তারপর সিঁড়ি বেয়ে সত্যিকার রয়াল এলাকায় ঢুকতে শুরু করলাম।

উপরে উঠে দেখতে পেলাম দিউয়ানে আম। দিউয়ানে আমে প্রজাদের সাথে দরবার করার পাশাপাশি যেকোন উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হতো। রাজপুত স্টাইলের চমৎকার কারুকাজ করা কলোনেড স্ট্রাকচারটাতে ঢুকে আমার মনে হলো আমি বোধহয় সেই রাজপুতদের আমলেই চলে এসেছি। কলামগুলো ধরে ধরে হাঁটছিলাম আমি। একেবারে পাহাড়ের ধার ঘেঁষে দিউয়ানে আম, নিচের দিকে তাকালে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি দেওয়াল ঘেরা রাস্তা আর অপূর্ব মাওতা লেক দেখা যাচ্ছে। দৃশ্যটা কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্নময়। আমরা সবাই মিলে দিউয়ানে আমের ভেতর সৃষ্টির ডিরেকশনে লাফ ঝাঁপ দিয়ে ছবি তুললাম। দিউয়ানে আমের পর যে বিশাল রাজকীয় গেটটা দেখলাম সেটা ‘গনেশ পোল’। এই গেটের উপরে জালি দেওয়া জানালা দিয়ে ঘেরা ‘সুহাগ মন্দির’ আছে। এখানে বসে রাজ বংশের মেয়েরা দিউয়ানে আমে অনুষ্ঠিত যে কোন উৎসব উপভোগ করতো। এই গেটের পর থেকে একেবারে প্রাইভেট এলাকা শুরু।

গনেশ পোলের উপরে জালি দেওয়া সুখ মন্দির
গনেশ পোলের উপরে জালি দেওয়া ‘সুহাগ মন্দির’

গনেশ পোল পার হয়ে হাতের বাম পাশে পেলাম ‘দিউয়ানে খাস’ বা ‘জয়মন্দির’ বা ‘শিশ মহল’। এখানে রাজা বিশেষ ব্যক্তিবর্গের সাথে দেখা সাক্ষাত করতেন। মার্বেলের দেওয়ালে সেই তাজমহল লেভেলের ফুল, পাতা এনগ্রেভ করা। দেখেই আমি তবদা লেগে গেলাম। কিন্তু আমার তবদা লাগার আরও বাকি ছিলো। ভিতরে পা রেখে যখন দেখলাম দেওয়াল আর ছাদ কুচি কুচি আয়না দিয়ে জটিল আর কারুকাজ করা জ্যামিতিক আর ফুলেল নকশায় পরিপূর্ণ, তখন আর কথা বলতে পারছিলাম না। আমার সামনে জুবায়ের হাসি হাসি মুখ করে আমাকে বললো, ‘তাও ভালো যে, কিছু কিছু অংশ রঙ দিয়ে নকশা করা, সব জায়গায় পাথর কেটে নকশা করে নাই। তা হলে যে কি হইতো আল্লাহই জানেন’। আমি অবাক হয়ে আয়নাগুলো দেখছিলাম। সব সাধারণ আয়না নয়, লাল, কমলা, গোলাপি, সবুজ, হলুদ – এই সব রঙ্গিন আয়না এত বছর পরও যেন সেই রাজকীয় দ্যুতিই ছড়াচ্ছে। অনেক জায়গায় পাথরের উপর আয়নার কারুকাজ, আয়নার উপর রঙের কারুকাজ, আয়নার উপর পাথরের কারুকাজ – দেখতে দেখতে আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছিলো।

সমগ্র শিশ মহলের দেওয়াল জুড়েই টুকরা টুকরা আয়না দিয়ে দারুণ সব অলংকরণ
সমগ্র শিশ মহলের দেওয়াল জুড়েই টুকরা টুকরা আয়না দিয়ে দারুণ সব অলংকরণ

শিশ মহলের পাশেই চমৎকার একটা বাগান। বাগানের ওপাশে ‘সুখ মন্দির’। গরমের দিনে এখানে রাজ বংশের লোকজনরা থাকতেন। ধবধবে সাদা এই দালানটাকে ফুলেল কারুকাজে পরিপূর্ণ করার পাশাপাশি ঠান্ডা রাখার জন্যও যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিলো। এর উপরে একটা পানির ট্যাংক ছিলো যেখান থেকে পানি নিয়ে এর ভিতরে দেয়াল বেয়ে ফোয়ারার মতন ছাড়া হতো। সেই পানি সোজা গড়িয়ে নেমে যেতো বাগানে। এই সব দেখতে দেখতে আর ছবি তুলতে তুলতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। তানভীরের সাথে দেখা হলো। ও বললো ‘ছবি তোলা বাদ দিয়ে দেখো, এই জিনিস আর জীবনেও দেখতে পারবে না’। এবার সত্যি সত্যি আমি ছবি তোলা বাদ দিয়ে দেখতে লাগলাম। এরপর দেখলাম রাজা মান সিংহের প্যালেস, সারি সারি ল্যাট্রিন, ‘জানাই দেউরি’ বা মহিলাদের থাকার জায়গা। এক চিপা দিয়ে সিড়ি পেয়ে আমি আর তানভীর টপাটপ উপরে উঠে গেলাম। উপরে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেললাম। এত এত ঘর, এত এত করিডর আর এত এত বারান্দা –পুরাই যেন এক গোলক ধাঁধাঁ। আমরা অনেক কষ্টে সেখান থেকে পথ চিনে বের হয়ে আসলাম। তারপর আমি আর তানভীর যে রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম মনে হলো সেটা বের হয়ে যাবার পথ। সেখানে যেতে যেতে দেখতে পেলাম, আম্বর ফোর্ট থেকে আরও উপরে অবস্থিত জয়গড় ফোর্টে যাবার সুড়ঙ্গ পথ।

বের হবার রাস্তায় হঠাৎ দুইটা বড় বড় কড়াই দেখতে পেলাম। আমাদের দেশের মাজারে যেই সাইজের ডেকচি থাকে ঠিক সেই সাইজের কড়াই। কাছে দিয়ে টের পেলাম মৃত্যু দন্ড পাওয়া আসামীকে এই কড়াইয়ের গরম তেলের মধ্যে ডুবিয়ে মারা হতো। বিশাল চকচকে কড়াই দুইটা দেখে মনে হলো কত মানুষ না জানি এখানে ডিপ ফ্রাই হয়ে মরেছে! মোটামুটি ঘুরে আমরা সারি সারি কামান দেখে বের হয়ে আসলাম ঠিক যেখানে টিকেট কেটেছিলাম জালেব চকের, ঠিক সেইখানে। জালেব চকের মাঝখানে মিম আর অন্তরাকে বসে থাকতে দেখলাম। খানিক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আমি, মিম, অন্তরা আর তানভীর রওয়ানা দিলাম জয়গড় ফোর্টের উদ্দেশ্যে। আমাদের সাথে যেতে অনেকেই রাজি হচ্ছিলো না। কারণ সেটা আরও অনেক উঁচুতে অবস্থিত। মূলত তানভীরের উৎসাহেই আমরা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে রওয়ানা দেই। এসেছি যখন একবার, দেখেই যাবো- কি আছে জীবনে?

আম্বর ফোর্ট থেকে বের হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে আমাদের মনে হচ্ছিলো- ‘ব্যাপারটা কি ঠিক হলো? যেতে পারবো তো ঠিকমত? নাকি যেতে যেতেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে আর সব বন্ধ হয়ে যাবে?’। যাই হোক একবার যখন যাত্রা শুরু করেছি তখন আর থামাথামি নাই। কিছুক্ষন যেতেই আমাদের দু পা ধরে আসলো। মুখ দিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে লাগলাম আমি, মিম, আর অন্তরা। কিন্তু তানভীরের কোন বিকার দেখতে পেলাম না। ও বেশ তরতর করেই হাঁটতে লাগলো। আমরা আস্তে ধীরে উঠার চেষ্টা করতে লাগলাম আর আমাদের সাথে ভদ্রতা করে তানভীর আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলো। যে পাহাড়টা বেয়ে আমরা উঠছিলাম সেটার নাম ‘চিল কা টিলা’ বা চিলের পাহাড়। পুরো পাহাড়টাকে পেঁচিয়েই উঠে গেছে রাস্তাটা। আমরা হাঁটছিলাম তো হাঁটছিলাম, কিন্তু পথ শেষ হওয়ার কোন নামগন্ধ পাচ্ছিলাম না। বরঞ্চ একটা বাঁক শেষ হতেই ঘুরে আরও আঁকাবাঁকা সর্পিল বাঁকের রাস্তা দেখছিলাম। পথে অনেক বানর আমাদের ভেংচি কেটে দিচ্ছিলো। ওদের লাফ ঝাঁপ দিয়ে অবলীলায় পাহাড় বেয়ে উঠতে দেখে আমাদের বেশ হিংসা হচ্ছিলো। যেতে যেতে এক সময় মনে হলো আমরা বোধ হয় আজকে আর পৌঁছাতে পারবো না। অনন্তকাল লাগবে এই পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরে উঠতে উঠতেই। হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলাম, শুধু উপরে উঠতেই আমাদের এত কষ্ট- যারা এত উপরে দুর্গ বানিয়েছে না জানি তারা কি লেভেলের পরিশ্রমী, সাহসী আর করিৎকর্মা ছিলো! আরেকবার মনে হলো না হয় কষ্ট করে উপরে উঠলামই, কিন্তু নিচে নামতে নামতে তো অন্ধকার নেমে যাবে। তখন কি হবে? যাই হোক আমাদের হাঁটা বন্ধ হলো না। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে আমরা পাহাড় বাইতেই লাগলাম। একবার থামলাম বিশ্রাম নিতে। হঠাৎ ঢাল ফুড়ে উদয় হলো দুইটা পরিচিত মাথা, সুমাইয়া আর অবনী। ওরাও জোরে জোরে দম ফেলতে ফেলতে আমাদের সাথে এসে যোগ দিলো।

জয়গড় ফোর্টের পথে আমরা
জয়গড় ফোর্টের পথে আমরা

অবশেষে রক্তিম গাল, হাপড়ের মতন পাজড় আর টনটনে পা নিয়ে আমরা এসে পৌঁছালাম জয়গড় ফোর্টের গেটে। গেটের নাম ‘আওয়ানি দরওয়াজা’। টিকেট কেটে ঢুকে পড়লাম রেড স্যান্ড স্টোনে বানানো মোটা মোটা দেওয়াল দিয়ে ঘেরা জয়গড় ফোর্টে। জয়গড় ফোর্ট প্রথমে বানানো হয়েছিলো আম্বর ফোর্টকে রক্ষা করার জন্য। ঢুকতেই আমরা প্রথমে পেয়ে যাই ফাউন্ড্রি। এখানে রাজপুতদের সকল অস্ত্রশত্র বানানো হতো। আমরা ঢুকতেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কামান দেখলাম। এই কামানের নাম ‘জাইভান’। তারপর দেখলাম কামান বানানোর কারিকুরি। বিশাল বিশাল ছাঁচের মধ্যে ধাতু ঢেলে বানানো হতো কামান। এই সব ছাঁচ বানানোর জন্যও আছে বিশাল মেকানিজমওয়ালা কুয়ার মত মেশিন যেটা আসলে ফার্নেস। আমাদেরকে একজন গার্ড মেকানিজমটা সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে দিলেন। আমরা সব দেখে আর শুনে হাঁ হয়ে যাচ্ছিলাম। আকাশের কাছাকাছি একটা জায়গায় এভাবে কামান বানানো- হার্ড টু বিলিভ। তারপর দেখলাম ‘সূর্য মন্দির’। থরে থরে অস্ত্র আর কামারের যন্ত্রপাতি  সাজিয়ে রাখা সেখানে। বর্শা, ঢাল, তলোয়ার, শিরস্ত্রান, গোলা – কি নেই সেখানে!

হাতে সময় অনেক কম। তাই আমরা পা চালাতে লাগলাম। এসে পৌঁছালাম ‘জালেব চক’। আগের মতই বেশ বড় কোর্ট ইয়ার্ড। জালেব চকের চার পাশে হরিহর মন্দির, ভৈরব মন্দির, আর্মারি মিউজিয়াম- আরও অনেক কিছু ছিলো। কিন্তু আমাদের সেগুলোতে ঢুকার সময় নেই। এক রকম দৌড়ে দৌড়ে আমরা প্রাসাদের এলাকায় ঢুকলাম। হলুদ রঙের গেটটা পার হয়ে দেখলাম ‘সুভাত নিবাস’। সেখানে বিশাল বিশাল ঢাক, হাতির পিঠে বসার আসন –এইসব সাজানো আছে। এরপর দেখলাম অত্যন্ত সুন্দর ‘লক্ষী বিলাস’। এটা নাকি রাজাদের ড্রইং রুম ছিলো। এরপর আমরা ছুটতে লাগলাম একটা অন্ধকার চিপা গলি দিয়ে। সেই গলি পার হয়ে ছোট্ট একটা উঠানে এসে পৌঁছালাম। এখান থেকে দেখলাম ডাইনিং হল। সেখানে খুব সুন্দর করে পুতুল দিয়ে সব সাজানো আছে। দেখে মনে হয় যেন সত্যি সত্যি রাজপুত বংশের নারী পুরুষেরা বিশাল বিশাল থালায় হরেক রকম খাবার সাজিয়ে খেতে বসেছে। রান্নাঘরেরও একই অবস্থা। অনেক দাস দাসী মিলে বিশাল বিশাল ডেকচিতে যেন রান্নাবান্না করছে। দেখতে আমার খুবই ভালো লাগছিলো। তারপর দেখলাম ‘ললিত মন্দির’। এটা শোবার ঘর। একটা দোতলা অডিটোরিয়ামও দেখলাম, সামনে স্টেজ সহ। এখানে নাকি নাচ, গান আর পুতুল নাচ হতো। এরপর দেখলাম লাল রঙয়ের ‘বিলাস মন্দির’।

এতক্ষণ ধরে যা যা দেখছিলাম সব কয়টা দালানই এত সুন্দর আর এত প্রাণ জুড়ানো বাতাস যে আমাদের একটু খানিক্ষণ বসে থেকে উপভোগ করতে ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু হাতে সে সময় নেই বলে কোন জায়গাতেই আমরা থামছিলাম না। এক ঝলক দেখেই দৌড় দিচ্ছিলাম। কিন্তু  সাদা রঙের ‘আরাম মন্দির’ দেখে আমরা পুরাই থেমে গেলাম। সামনে যে এক মনোমুগ্ধকর বাগান দেখলাম সেটা আমি নিজের চোখে না দেখলে মনে করতাম এরকম বাগান কেবল রূপকথার বইতেই থাকা সম্ভব। পুরাই যেন কোন বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা সবুজ ঘাস আর ছোট ছোট ঝোপ দিয়ে সাজানো এক পরিপাটি বাগান। আর বাগানটা যে এক আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের উপর অবস্থিত সেইটা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যই যেন তিন তিনটা বিশাল আর্চ পাহাড়ের কিনারায় ভিউ ওপেন করে দাঁড়িয়ে আছে। পুরা দৃশ্যটা এতই বেহেশতি, এতই স্বপ্নময়ী, এতই অবাস্তব যে কয়েক মিনিট আমাদের সময় লাগলো ব্যাপারটা হজম করতে। আমরা কেউ কোন কথাই বলতে পারলাম না কিছুক্ষণ।

ভূমি থেকে হাজার খানেক ফুট উপরে আরাম মন্দির
ভূমি থেকে হাজার খানেক ফুট উপরে আরাম মন্দির

আরাম মন্দিরে এসে আর কোন কিছুর আরাম হোক আর না হোক, আমার চোখের দারুন আরাম হচ্ছিলো। তারপর আমরা হেঁটে হেঁটে একদম জয়গড় ফোর্টের কিনারে এক ওয়াচ টাওয়ারে এসে দাঁড়ালাম। আমার মনে হচ্ছিলো আমি বোধহয় পাখির চোখে পৃথিবী দেখছি। এখান থেকে দেখলাম নিচের আম্বর ফোর্টকে। কত ছোট যে লাগলো সেই বিশাল ফোর্টকে! এক দিকে উপরে সীমাহীন আকাশ অন্যদিকে নিচে পাহাড়ের গায়ে আঁকা বাঁকা দেওয়াল আর ঝকঝকে ‘সাগর লেক’, সেইসাথে মন ভরানো, প্রান জুড়ানো বাতাস- আমার যে কি শান্তি লাগছিলো, সেকথা আর নাই বা বললাম। মনে মনে তানভীরকে ধন্যবাদ দিলাম। ওর জন্যই আজকে এখানে আমার আসা সম্ভব হয়েছে। ওখানকার লোকজন আমাদের তাড়া দিচ্ছিলো বের হয়ে যাবার জন্য। আমাদের আরও অনেক্ষণ ওখানে থাকতে ইচ্ছা করছিলো, কিন্তু উনাদের তাড়া খেয়ে তাড়াতাড়ি আমরা নেমে এলাম। ওনারা আমাদের বের হয়ে যাবার রাস্তা দেখিয়ে দিলেন।

ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা জয়পুর শহর
ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা জয়পুর শহর

আমরা সেই স্বপ্নময়ী বাগান থেকে বের হয়ে হাঁটতে লাগলাম। এবার আমরা দেখলাম তিনটা বি-শা-ল পানির ট্যাঙ্ক। এত উঁচু পাহাড়ে ফোর্ট বানানোর একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা। কৃত্রিমভাবে বানানো সাগর লেক থেকে হাতির পিঠে করে পানি উঠানো হতো। তাছাড়া পুরো ফোর্ট জুড়েই নানা রকম চ্যানেল ছিলো যেগুলো দিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হতো। তিনটা ট্যাঙ্ক মিলে ষাট লাখ গ্যালন পানি ধরে রাখার ক্ষমতা ছিলো। পরে জানলাম এক মজার কাহিনী। এই তিনটা ট্যাঙ্কের একটার ভিতর নয়টা রুম আছে। সেগুলো নাকি রাজা দ্বিতীয় জয় সিংহের আগ পর্যন্ত ট্রেজারি অর্থাৎ রাজকোষ হিসেবে ব্যবহৃত হত। যার মানে দাঁড়ায় রাজ্যের সব সম্পদ এখানে থাকতো। রাজপুত বংশের ব্যাপক ধন ভান্ডার এইখানে লুকানো আছে বলে শোনা যায়। এই ফোর্ট এখনও রাজপুত বংশের লোকদের মালিকানায় আছে, এটা সরকারী সম্পত্তি নয়। তাই এখানে গুপ্তধন আছে কি নেই সেটা নিয়ে ব্যপক কল্পকাহিনী প্রচলিত। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে একবার নাকি জোর তল্লাশি চালানো হয় সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু কিছু পাওয়া গিয়েছে এমন কথা শোনা যায় নাই।

আমরা যখন ট্যাঙ্কগুলো পার হয়ে হয়ে যাচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময়ে ইশতিয়াককে পেলাম সেখানে। ইশতিয়াক মাথা নেড়ে নেড়ে বললো, ‘পুরাই মাথা নষ্ট জায়গা’। আমিও মেনে নিলাম ওর কথা। আসলেই পুরাই মাথা নষ্ট জায়গা। মনে মনে রাজপুতদের স্যালুট জানালাম। আবার আফসোসও লাগলো যে ইন্ডিয়ান ইসলামিক আর হিন্দু আর্কিটেকচার পড়েছি কিন্তু রাজপুতটা কেমন করে যেন হিন্দু আর্কিটেকচার থেকে বাদ পড়ে গেছে। যদি আগে থেকে কিছু পড়াশোনা থাকতো তাহলে দেখাটা আরও বেশি উপভোগ্য হতো। তারপর আমরা সাত জন মিলে গেট দিয়ে বের হয়ে আসলাম। আমরা ঢুকেছিলাম এক গেট দিয়ে আর বের হলাম মেইন গেট দিয়ে। আমার ফোনে রুবাইদা কল দিয়ে জানাতে লাগলো যে, সবাই রওয়ানা দিয়ে দিতে চায়। আমি বলে দিলাম সবাই যদি চলে যেতে চায় তাহলে যেন চলে যায়, আমরা আমাদের মত করে ফিরবো। কিন্তু অবনী এই কথা শুনে বললো, ‘ফাইজলামি নাকি- আমি কমিটি মেম্বার, আমাকে ফেলে গোয়েল চলে যাবে- এতবড় সাহস! এটা কোন কথা হলো?’। আমরা যেন হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম আমাদের সাথে একজন কমিটি মেম্বার আছে। আমরা খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম, যাক আমাদের ফেলে তাহলে গোয়েল চলে যাবে না!

আমরা একটা খালি অটো ঠিক করলাম। অটোটার পিছনে স্পেয়ার চাকা রাখার জায়গাটাতে তানভীর আর ইশতিয়াক জড়াজড়ি করে বসলো। আর আমরা পাঁচজন মেয়ে সামনে গাদাগাদি করে বসলাম। প্রবল বেগে ঢাল বেয়ে আমাদের অটো নিচে নামতে লাগলো। দু পাশের চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা চলতে লাগলাম। হঠাৎ দেখলাম ময়ুর। একটা দুটা নয়, অনেক ময়ুর। আমাদের দেশে গ্রামে যেমন হাঁস মুরগি ঘুরে বেড়ায়, এখানে রাস্তার দুপাশের জঙ্গলে তেমনি রংচঙ্গে ময়ুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক্ষণ ধরে পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে নামতে একসময় আমাদের অটো সমতলে এসে থামলো। থামলো একেবারে জলমহলের পাশে। অটোতে বসে থাকতে থাকতেই আমরা জলমহলের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। অটো থামতেই পার হেড ২০ রুপি ভাড়া দিয়েই দৌড় দিলাম।

এফদ
পানির উপর জলমহল (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

চকচকে সাগর লেকের উপর হালকা হলুদ রঙের বিল্ডিংটার দিকে তাকালেই মনে হবে, ‘ইশ, যদি ভিতরে যেতে পারতাম’। যাওয়ার ব্যবস্থা হয়তো আছে কিন্তু হাতে সময় নাই। দূর থেকে তাকিয়েই দেখে নিলাম জলমহল। এখানে নাকি রাজা প্রথম মাধো সিং হাঁস শিকার করতে আসতেন! কি আর বলবো, কিছু বলার নাই……

আমাদের লোকজনদের দেখলাম সবুজ ঘাসের উপর বসে থাকা হকারদের কাছে গিয়ে স্যান্ডেল দামাদামি করতে। শেষমেশ কয়েকজনকে দেখলাম ১০০ রুপি দিয়ে জোড়া স্যান্ডেল কিনে নিতে। অনেকেই আবার বললো মার্কেটে এর চেয়ে কম দাম হতে পারে। আমাদের দেখেই সবাই চটজলদি গোয়েলে উঠে পড়লো। দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নাই। কিন্তু এখানেও কিছু খাওয়ার নাই। কি আর করা, খালি পেটেই উঠে পড়লাম বাসে। বাস ছেড়ে দিলো। গন্তব্য বাবুবাজার।

সন্ধ্যার সময় বাবুবাজার আসার আগেই সারি সারি দোকানপাট দেখে আমরা নেমে গেলাম। আমি ভাবলাম কোন খাবারের দোকান থেকে কিছু কিনে নিবো। কিন্তু তেমন কোন খাবারের দোকান পেলাম না। আশেপাশের সব দোকানেই মোটামুটি একই জিনিস। দু ধরনের পায়জামা সারি সারি করে ঝুলানো সব দোকানে। এক ধরনের পায়জামা অনেকটা আলাদিন যেরকম পরতো সেরকম, অন্যটা আলাদিনের জিনি যে ধরনের পায়জামা পরতো সেরকম। দাম ১০০ থেকে ১২০ রুপির মতন। পায়জামাগুলো দেখে মনে হলো সিল্ক, জর্জেটের শাড়ি কেটে বানানো। বিভিন্ন দোকানে কাঁচ বসানো ঘাগড়া, বিছানার চাদর, পর্দা, কুশন কভার, ব্যাগ, ওড়না, গিফট আইটেমের মধ্যে কলম, কৌটা, চাবির রিং, নোটবুক ইত্যাদি ঝিকমিক করছে। এছাড়া আছে শাড়ি, জুয়েলারি, স্যান্ডেল, টপস, গিফট আইটেম, শো পিস ইত্যাদি। দোকানদারগুলা বেশ ঘাগু। ইচ্ছা মত দাম হাঁকায়, যার কাছ থেকে যা রাখতে পারে। আর একবার দোকানে ঢুকলে সহসা কাস্টোমারকে খালি হাতে বের হতে দেয় না। আমি আর রুবাইদা হাঁটতে লাগলাম। এরই মধ্যে রুবাইদা কয়েকটা শাড়ি, কুশন কভার, জুয়েলারি, ব্যাগসহ বেশ কিছু কেনাকাটা করে ফেললো। আমরা অনেক্ষণ ধরেই ঘুরতে লাগলাম। আমার কাছে জিনিসপত্র তেমন পছন্দ হচ্ছিলো না। সবার কাছ থেকে শুনে মনে হয়েছিলো জয়পুরের জিনিসপত্র অনেক সুন্দর হবে। কিন্তু সব কিছুই কেমন যেন ঠুনকো লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো কিছুদিন ব্যবহার করলেই সব নষ্ট হয়ে যাবে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো হয়তো আমরা ঠিক জায়গায় শপিং করতে আসি নাই। হয়তো আরও ভালো শপিঙের জায়গা ছিলো।

রাতে এক পর্যায়ে সব দোকানপাট একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। তখন আমরা হাঁটতে হাঁটতে জহুরি বাজার নামের এক জায়গায় ‘দি ফ্রেন্ডস’ নামের এক দোকান পেলাম। এটা অনেকটা মোহাম্মদপুরের সোর্সের মতন দোকান। অবনী এখান থেকে ৫০ রুপি দিয়ে সুন্দর আংটি কিনেছে। দেখে আমার বেশ পছন্দ হলো। আমিও দুইটা আংটি কিনলাম। জুবায়ের আর রাজীবকে দেখলাম চামড়ার কভার দেওয়া স্কেচ বুক কিনতে। তারপর আমরা কয়েকজন মিলে অটো ঠিক করছিলাম। এমন সময় রুবাইদা ফুটপাথে এক লোকের কাছ থেকে ৫০ রুপি দিয়ে সাদা রঙের তিনটা চুড়ির একটা সেট কিনলো। আমি দুসেট নিলাম ১০০ রুপি দিয়ে। সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। লোকটা তাড়াহুড়া করে আমাদের দিলো। তারপর আমরা অটোতে করে রওয়ানা হই হোটেলের দিকে।

হোটেলে নেমে আমরা বের হই খাওয়ার দোকানের খোঁজ করতে। লোকজন দেখিয়ে দেয় রাস্তা। অনেক দূর হেঁটে আমরা এক খাওয়ার দোকান পাই। সেখানে বসে আমরা মেনুর উপর চোখ বুলাই। আলু মটর, পনির মটর, আলু টমাটো- সব স্পাইসি খাবার ছিলো। আমার একদম মশলা খেতে ইচ্ছা করছিলো না। অনেক ভাবনা চিন্তা করে আমি অর্ডার দেই ৩৭ রুপির নান আর ভেজ রায়তা। আর রুবাইদা অর্ডার দেয় বেগুন ভর্তা আর ভাত। আমার ভেজ রায়তা ভালোই ছিলো- টক দইয়ের সাথে সিদ্ধ আলু কিউব। কিন্তু রুবাইদার ভাত আর বেগুন ভর্তা দেখে আমাদের চোখ কপালে উঠে গেলো। টকটকে লাল রঙের ঝোলের একটা তরকারি দিয়ে গেলো। রুবাইদা একবার জিজ্ঞেস করে শিওর হলো যে এটা বেগুন ভর্তা কিনা। ভাতের চালটা মোটা আর হালকা লাল রঙের ছিলো। রুবাইদা সাবধানে ‘বেগুন ভর্তা’ সেই ভাতের সাথে মাখিয়ে মুখে দিলো। তারপর জানালো, খেতে খারাপ না, ভালোই। যদিও বেগুন ভর্তা না হয়ে বেগুনের তরকারি মনে করে খেলে ভালো হতো, তারপরও জয়পুরে এসে জয়পুরি স্টাইলের বেগুন ভর্তা আর ভাত খেয়ে রুবাইদা বেশ খুশি।

খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা উল্টা পাশের মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি কিনে খাই। একেবারে আসল জয়পুরি মিষ্টি! তারপর আমরা রওয়ানা দেই হোটেলের দিকে। হলুদ সোডিয়াম লাইটের আলোতে আমরা হাঁটতে থাকি। ততক্ষনে প্রায় রাত ১১টা বেজে গেছে। আমরা বিস্তর হাসাহাসি করতে করতে নির্জন আবাসিক এলাকার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে থাকি। এক পর্যায়ে রুবাইদা বলে, ‘চিন্তা করে দেখ, ঢাকা শহরে আমার কলিজায় সাহস হবে না রাত ১১টার সময় এভাবে রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে। আর এখন……’। আমিও ভেবে দেখলাম কথাটা ঠিক। বাসায় যদি জানে যে আমি রাত ১১টার সময় রাপা প্লাজার দিকে হেঁটে হেঁটে বাসায় আসছি, আম্মু পিটিয়ে চামড়া তুলে ফেলবে। অথচ এখন কত অবলীলায় হেঁটে যাচ্ছি, কেউ কিছু বলছে না।

হোটেলে ফিরে আমি আবিষ্কার করলাম, বাথরুমে রেলিঙের উপর আমি যে পায়জামা রেখে গিয়েছিলাম তার উপর পাখি এসে বাসা বুনে গেছে। পুরা বাথরুমে খড়কুটা ছড়ানো আর আমার পায়জামার উপর আস্ত পাখির বাসা। রুম সার্ভিসে খবর দিলাম। লোকজন এসে আমাদের বাথরুম পরিষ্কার করে দিলো। আমার খড়কুটা, মাটি লাগানো পায়জামাটা দিয়ে গেলো। এই পায়জামা নিয়ে যা করার তা আগামীকাল ভেবে দেখবো- এই চিন্তা করে আমি শুয়ে পড়ি। সারাদিনে পরিশ্রম কম হয় নাই। তাই ডবল বেডে পাঁচ জন প্যাকড হয়ে শুয়েও সাথে সাথেই ঘুমিয়ে গেলাম।

 

 

 

 

The Mighty INDIA CALLING: আগ্রায় একদিন এবং যথারীতি ফোর্ট ও তাজমহল দর্শন (পর্ব ১৬)

বাস বলতে গেলে প্রায় গভীর রাতেই আগ্রায় পৌঁছালো। কিন্তু আমরা কেউ নড়লাম না। কম্বল জড়িয়ে তার নিচেই পড়ে রইলাম। সারারাত আমার বিন্দু মাত্র ঘুম হয় নাই। ক্লান্তিতে দুই চোখ খুলতে পারছিলাম না। ঠান্ডা ওয়েদারের মধ্যে বাসের ভিতর আরাম করে বসে রইলাম আমরা। আলো ফুটতে শুরু করলে আমরা একটু একটু নড়তে থাকি। চোখ খুলে আমরা বুঝলাম আমরা আছি তাজমহলের পার্কিং লটে। কমিটির লোকজন যায় তানভীরের আব্বুর দেওয়া পারমিশন লেটার কাজে লাগিয়ে সাধারন টিকেট কাটতে। আর বাকি আমরা সবাই গুটি গুটি পায়ে বাস থেকে নেমে বাথরুমের দিকে রওয়ানা হই।

মেয়েদের বাথরুমটা খুবই চমৎকার। আমরা লাইন ধরে হাতমুখ ধুয়ে, দাঁত মাজতে লাগলাম। এতগুলো মানুষ আমরা একসাথে দাঁত মাজছিলাম- বেশ মজাই লাগছিলো। ফ্রেশ টেশ হয়ে আমরা আবার বাসের দিকে রওয়ানা দেই। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখলাম বেশ কয়েকটা হাইফাই টুরিস্ট বাস সাদা চামড়া টুরিস্ট নিয়ে আসলো। বুড়ো টুরিস্টদেরকে আবার তাদের গাইডরা হাত ধরে ধরে নামিয়ে দিচ্ছে। দেখে আমরা বেশ হাসাহাসি করলাম। ওদিকে কমিটির লোকজনকে ফিরে আসতে দেখলাম। ওরা এসে জানালো যে, এখানে অফিসাররা দশটার আগে আসবেন না। আর অফিসাররা না আসা পর্যন্ত এই পারমিশন লেটার রিসিভ করার এখতিয়ার কারও নাই। ওদিকে সারা এলাকায় এ কথা চাউর হয়ে গেছে যে বাংলাদেশ থেকে ৪৬ জনের একটা দল এসেছে। তাই এখন যদি আমরা ভিতরে ঢুকতে চেষ্টা করি তাহলে গেটে অবশ্যই আমাদের ধরে ফেলবে। ওদিকে সকাল দশটা বাজতে এখনও অনেক ঘন্টা বাকি। সব চিন্তা ভাবনা করে আমরা ডিসিশন নিলাম আপাতত তাজমহল যাওয়া হচ্ছে না। বাসে উঠে আমরা রওয়ানা দিলাম আগ্রা ফোর্টের দিকে।

আগ্রা ফোর্টে নেমে আমরা ২০ রুপি দিয়ে সাধারন টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকার চেষ্টা করি। ফাহাদ টানা হিন্দিতে কথা বলে আমাদের টিকেট কেটে দেয়। কিন্তু লোকগুলো অত্যন্ত চাল্লু। তারা আমাদের দেখেই সন্দেহ প্রকাশ করতে লাগলো যে আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এর মধ্যে রিন্তুর ব্যাগ সার্চ করে টাকা  উদ্ধার করলো এক মহিলা গার্ড। তখন আর কি করা, আমরা সবাই ৫০ রুপি দিয়ে সার্কভুক্ত দেশের টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকি। ঢুকতেই উঁচু ওয়াল দিয়ে ঘেরা ঢালের উপর তিনটা গেট। গেটগুলোর পজিশন এমন যে একটা গেট থেকে অন্যটা দেখা যায় না। যুদ্ধ লাগলে এই গেটগুলো দিয়ে গরম তেল ঢেলে দেওয়া হতো শত্রুপক্ষের দিকে। ভিতরে ঢুকেই পুরো জায়গাটা এক বার চক্কর দিয়ে ফেলি। তারপর নোভাকে দেখি গাইড ঠিক করতে। এরপর গাইড নিয়ে আমরা আবার প্রথম থেকে ঘোরা শুরু করি। নিজে নিজে ঘুরলে আসলে কিছুই বোঝা যায় না। গাইডের কথায় পুরো আগ্রা ফোর্ট যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে আমাদের চোখে।

একটা বড় সবুজ মাঠ পার হয়ে আমরা মূল অংশে ঢুকি। বিশাল গেটে আকবরের তিন স্ত্রীর জন্য হিন্দু, ইসলাম আর জৈন- এ তিন রকম ধর্মের প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে। সবার আগে দেখলাম লাল স্যান্ডস্টোনের জাহাঙ্গিরি মহল। এর সামনে আকবর বা জাহাঙ্গির কারও এক জনের পাথুরে বাথটাব দেখলাম। জাহাঙ্গিরি মহলের ভেতরটা ভালো করে দেখলাম। লাল পাথরের অপরূপ কারুকাজ, ভারী চমৎকার লাগলো দেখতে। এর পর যে অংশটায় ঢুকলাম সেখানকার মোটা ওয়ালের ভিতর দিয়ে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করে এসির মত টেম্পারেচার বানিয়ে ফেলার সিস্টেম দেখলাম। একটা মীনা মসজিদ দেখলাম। তারপর আঙ্গুরের বাগান। এই আঙ্গুর থেকে খুব সম্ভবত মদ তৈরি করা হতো।

তারপর গেলাম মুসাম্মান বুর্জে। এটা শাহজাহানের শোবার মহল। এখানে আওরঙ্গজেব শাহজাহানকে শেষ জীবনের ৮ বছর বন্দী করে রেখেছিলো। ততদিনে শাহজাহানের পাগলামি চরম রূপ ধারন করেছে। সাদা তাজের পর কালো গ্রানাইটের আরও একটা তাজ বানানোর ভূত তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তাই আওরঙ্গজেবের পক্ষে পিতাকে বন্দী করে রাখা ছাড়া আর কোন অপশন ছিলো না। সাদা মার্বেলের এই মহলের বারান্দা থেকে আকবর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যমুনার ওপাশের তাজমহল দেখতেন আর কাঁদতেন। কাঁদতে কাঁদতে তার নাকি চোখের জ্যোতি কমে গিয়েছিলো। তখন তার মেয়ে মুসাম্মান বুর্জের দেয়ালে গর্ত করে কোহিনূর পুঁতে দিয়েছিলেন। দূর্বল চোখ জোড়া দিয়ে সেই কোহিনূরের মধ্যে তাজ মহলের রিফ্লেকশন দেখতেন শাহজাহান। এই বুর্জেই শাহজাহানের মৃত্যু ঘটে। এখান থেকে সিঁড়ি দিয়ে লাশ নামিয়ে নৌকা করে যমুনা নদী পার করে তাজ মহল নিয়ে যাওয়া হয়। পুরো মুসাম্মান বুর্জের বাইরের অংশে সাদা মার্বেলের উপর রঙ্গিন পাথরের ফুল, লতা পাতা ইন লে করে ঢুকানো। এই জিনিসটা কাছ থেকে দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। আর ভিতরে একটা দেওয়াল থেকে নেমে আসা ফোয়ারা আছে যাতে পুরো মহলে পানির নহর বইতে থাকে সবসময়। এছাড়া ভিতরের দেওয়ালে পাথরে গর্ত করে সোনা দিয়ে অর্নামেন্টেশন করা ছিলো। ইংরেজরা এসে আগুন দিয়ে গলিয়ে সব সোনা বের করে নিয়ে যায়। সে আগুনের পোড়া দাগ স্পষ্ট বোঝা যায়। মুসাম্মান বুর্জের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যমুনার পাড়ে কুয়াশার ভিতর আবছায়া তাজ মহলকে দেখতে পেলাম। চোখ সরাতে পারছিলাম না সেই ছোট্ট ‘তাজ’ এর উপর থেকে।

asd
কুয়াশায় ঢাকা ছোট্ট তাজ (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম)

তারপর দেখলাম শাহজাহানের দুই অবিবাহিত মেয়ের জন্য দুইটি ছোট ছোট মহল। এগুলো দেখতে পাল্কির মতন। ছাদটা চৌচালা, সোনালি রঙের পিতলের। এই দুটা মহলের ছাদ নাকি সোনার তৈরি ছিলো। ইংরেজরা এসে সব সোনা তুলে নিয়ে যায়। পরে পিতল দিয়ে একটা ছাদ বানানো হয়। এর পাশেই আছে খাস মহল বা দিউয়ানে খাস। এটাও সাদা মার্বেলের তৈরি। এক সময় এর ভিতরেই ছিলো শাহজাহানের কোহিনূর হীরা খচিত ময়ুর সিংহাসন। এখন এর বাইরে আছে দুইটা সিংহাসন- একটা সাদা মার্বেলের অন্যটা কালো গ্রানাইটের। কালো সিংহাসনটা তখতে জাহাঙ্গির যার একটা কোনা ভাঙ্গা। যুদ্ধের সময় ইংরেজদের কামানের গোলা এসে এই সিংহাসনে লাগে, সেখান থেকে ছিটকে গোলাটা দিউয়ানে খাসের দেওয়ালেও গর্ত তৈরি করে দেয়। এখান থেকে সামনে তাকালে একটা বাগান চোখে পড়ে। এখানে আগে পুকুর ছিলো। সেখানে রঙ্গিন মাছ ঘুরে বেড়াতো। আকবর আর আকবরের স্ত্রী তীর ধনুক দিয়ে সেই মাছ শিকার করতো।

এই সবুজ ঘাসের জায়গাতেই ছিলো রঙ্গিন মাছের পুকুর
এই সবুজ ঘাসের জায়গাতেই ছিলো রঙ্গিন মাছের পুকুর

এরপর একে একে দেখলাম শাহী হাম্মাম, মোতি মসজিদ, নাগিনা মসজিদ, শিশ মহল। শিশ মহলের ভিতর তখন কাজ চলছিলো। আমরা ঢুকতে পারলাম না। তবে ফাঁক দিয়ে দেখলাম। এটা ছিলো শাহজাহানের স্ত্রীর সাজ ঘর। পুরো মহলটা ছোট ছোট কাঁচের টুকরা দিয়ে সাজানো। এর ভিতর একটা মোমবাতি জ্বালালে পুরো কক্ষটাই আলোকিত হয়ে উঠে। এছাড়া মুসাম্মান বুর্জ থেকে তাজ মহলের যে ভিউ দেখেছিলাম, সেখান থেকে অনেক দূরের আরেকটা বারান্দা থেকে তাজ মহলের ভিউ দেখে চমকে উঠলাম- এ কি, তাজ মহলকে আগের চেয়ে বড় মনে হচ্ছে তো!  অথচ এটা মুসাম্মান বুর্জ থেকে অনেক দূরে। ফিজিক্সের নিয়ম অনুযায়ী এখান থেকে তাজকে আরও ছোট দেখার কথা। একবার ভাবলাম চোখের ভুল। পরে গাইড হেসে জানালেন, এটা আসলে অপ্টিকাল ফ্রেমিং এর কারসাজি। এরকম আরও অনেক কারসাজি লুকানো আছে এই ফোর্টের আনাচে কানাচে। আমি পুরা তাজ্জব হয়ে গেলাম। এরপর দেখলাম দিউয়ানে আম। সাদা মার্বেলে ডাবল ডাবল আর্চ করা ভারি সুন্দর মহল। এখানে সিংহাসন থেকে তাকালে এক অদ্ভূত কারণে কলামের পিছনে বসে থাকা সব মানুষকেই দেখা যায়। এখানেও আগে একসময় সোনার কারুকাজ ছিলো।

এই সব দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিলো আমি ফিরে গেছি সেই মুঘল আমলে। সেই শানদান, সেই বিলাসিতা, সেই আভিজাত্য, সেই মেধা যেন নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম। গাইড আমাদের অনেক মজার তথ্য দিলেন। যেমন- আকবরের প্রিয় ছিলো রেড স্যান্ডস্টোন আর শাহজাহানের প্রিয় ছিলো সাদা মার্বেল। এই ফোর্টের যে অংশটুকু লাল সেটা আকবরের বানানো, আর যে অংশটুকু সাদা সেটা শাহজাহানের বানানো। এছাড়া মুঘলদের সময় দরজার প্রচলন ছিলো না। বড় বড় মহলের কোনটাতেই আমরা দরজা দেখি নাই। দরজার জায়গায় বড় বড় আংটা থেকে পরদা ঝুলানো হতো আর সব জায়গাতেই রক্ষী দাঁড়িয়ে থাকতো। আমরা গাইডকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার পাওনা মিটিয়ে দিলাম। পার হেড খরচ পড়লো ৪০ রুপি করে। আমাদের এখান থেকে নড়তে ইচ্ছা করছিলো না। কিন্তু সবার তাড়া খেয়ে একসময় আস্তে আস্তে ফোর্ট থেকে বের হয়ে যেতে থাকি।

ফোর্টের বাইরে এসে রাস্তা পার হয়ে আমরা গোয়েলে উঠে বসি। সকালে কিছু খাওয়া হয় নাই। তারুপর এত হাঁটা হলো। কিন্তু কিছু কিনতে পারলাম না। বাস আমাদের নিয়ে রওয়ানা হলো হোটেলের খোঁজে। প্রকাশ টুরিস্ট কমপ্লেক্স নামের এক হোটেল ঠিক করা হলো। আমরা গোয়েল থেকে আমাদের লাগেজ নামিয়ে টেনে টেনে হোটেলের উঁচু প্লিন্থে তুলতে লাগলাম। এক তলায় আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে লাগেজ রাখতে গেলে দেখলাম রুমটা অনেক ছোট। মজুমদার বললো এই রুমটা তিনজনের জন্য। আমাদের যেকোন একজনকে তিন তলায় অন্য একটা রুমে যেতে হবে। আমি কোন কিছু না ভেবেই বলে ফেললাম, ‘তোরা থাক, আমিই যাচ্ছি’। তিনতলায় এই লাগেজ টেনে টেনে তুলতে আমার ঘাম বের হয়ে গেল। তারপর অবশেষে বারান্দার শেষ মাথার রুমে গিয়ে হাজির হলাম। দেখি রুমে অলরেডি সুমাইয়া এসে বসে আছে। তারপর আসলো তমা, সব শেষে আসলো অবনী।

রুমটা হিউজ। অনেক বড়। বিছানাটাও বিশাল। চারজন কেন, অনায়াসে ছয় সাত জন এখানে থাকা যাবে। বাথরুমটাও অনেক বড়। সেখানে বিছানা ফেললেও দুই তিন জন আরামসে ঘুমাতে পারবে। বাথরুমের কমোডটা বেশ ইন্টারেস্টিং। এটাকে চাইলে ইচ্ছামত হাই কমোড বা লো কমোড হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আমরা তাড়াতাড়ি ফ্রেশটেশ হয়ে নিলাম। দুপুর বেলায় বাইরের ঠান্ডা অনেক কমে গেছে। সব সোয়েটার খুলে একটা মাত্র সোয়েটার ব্যাগে ঢুকিয়ে বের হয়ে পড়লাম। আমি আর রুবাইদা গেলাম হোটেলের সামনে ফৌজি ধাবা নামের এক খাওয়ার দোকানে। আগ্রা টুরিস্ট শহর বলেই হয় তো এই দোকানে সব কিছুর দাম বেশি। আমাদের অনেকেই এখানে কয়েকটা আইটেম অর্ডার দিলো। কোনটাই তেমন ভালো ছিলো না। আমরা অর্ডার দিলাম ৮৫ রুপির ভেজ চাওমিন। প্রায় ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করার পর যখন চাওমিনটা আমাদের সামনে আসলো, দেখেই আমার তেমন সুবিধার মনে হলো না। মুখে দিয়ে দেখলাম- আমার সন্দেহই ঠিক। চাওমিনটা শক্ত, ঠিকমত সিদ্ধ হয় নাই আর সাথের সবজি গুলো অলমোস্ট কাঁচা। অত্যন্ত বিস্বাদ এই চাওমিন খেতেও ভয় লাগছিলো, পেটে সইবে তো!

যাই হোক কোন রকম চাওমিন খেয়ে আমরা আবার আমাদের হোটেলের সামনে ফেরত আসি। সেখানে মজুমদার আমাদের ইন্সট্রাকশন দেয়। যেহেতু আগ্রা ফোর্টে আমরা ধরা খেয়েছি, তাই তাজ মহলে আমাদের অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। এইখানে ধরা খেলে ব্যাপক গচ্চা দিতে হবে। আগেরবার সবাই দল বেঁধে ঢুকেছিলাম, এই বার আমরা ছোট ছোট দলে দুই তিন জন করে করে যাবো। এবং আমরা যে একটা টিম সেটা কোন ভাবেই তাজমহলের বাইরে এমনকি ভিতরেও প্রকাশ করা যাবে না। ভিতরে আর বাইরে নাকি প্রচুর দালাল ঘোরাফেরা করে। সব কিছু শুনে আমি বেশ থ্রিল ফিল করলাম। সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে মজুমদার, ইশতিয়াক আর নিলয় রওয়ানা দিলো। ওদের সাথে দূরত্ব রেখে আমি আর রুবাইদা রওয়ানা দিলাম।

আমাদের হোটেল থেকে তাজ বেশ কাছেই ছিলো। আমরা হেঁটে হেঁটেই পৌঁছে গেলাম। টিকেট কাউন্টারের কাছে আসতেই আমি আর রুবাইদা আলাদা হয়ে গেলাম। আমি রাস্তার একপাশে পাথুরে বসার জায়গায় বসলাম। রুবাইদা অন্যপাশে মজুমদার আর ইশতিয়াকের সাথে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে বসলো। রুবাইদা বেশ আয়েশ আয়েশ ভঙ্গিতে বসে থাকলো। আমি চোখের কোনা দিয়ে দেখতে লাগলাম। নিলয় এর মাঝে কই উধাউ হয়ে গেছে কে জানে। মজুমদার আর ইশতিয়াক খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলছিলো। আমার আর রুবাইদার টিকেট ওদের কেটে দেওয়ার কথা। তাই আমি লক্ষ্য রাখছিলাম ওরা কি করে। এক পর্যায়ে মজুমদার টিকেট কাটে। তারপর রুবাইদাকে পাস করে যাওয়ার সময় কোন কথা না বলে দুইটা টিকেট ওর কোলের উপর রেখে চলে যায়। রুবাইদা রাস্তা পার হয়ে এসে একটা টিকেট আমার সামনে রেখে বিড়বিড় করে বলে, ‘আমি যাওয়ার কিছুক্ষন পর তুমি রওয়ানা দিও’। তারপর উল্টা ঘুরে রুবাইদা হাঁটা দেয়। আমি তখন উত্তেজনায় টগবগ করছিলাম। আমার মনে তখন মিশন ইম্পসিবলের থিম মিউজিক বাজতে লাগলো। আমার মনে হচ্ছিলো আমি বোধহয় মিশন ইম্পসিবল মুভির মত কোন মিশনে অংশ নিচ্ছি। চারিদিকে শত্রুর দল। এর মাঝে নিজের পরিচয় গোপন করে কড়া সিকিউরিটি চেকিং পার হয়ে দূর্গে ঢুকতে হবে। অত্যন্ত প্ল্যানড উপায়ে আমরা ঠান্ডা মাথায় আমাদের মিশনকে সাক্সেস্ফুল করার জন্য চেষ্টা করছি!

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে রুবাইদাকে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখলাম। ঘড়ি ধরে ঠিক তার দুই মিনিট পর আমি উঠে দাঁড়ালাম। সোজা হাঁটতে লাগলাম গেটের দিকে। একা একা চারপাশটা দেখতে দেখতে আমি এগিয়ে যেতে লাগলাম। চারপাশে নানা বয়সী অনেক মানুষ, সারা ইন্ডিয়ার থেকে মনে হলো যেন মানুষ এসেছে। সাউথ, মারাঠি, গুজরাটি সব ধরনের পোশাক পরা মানুষ দেখলাম।  লাইন ধরে ধরে ভিতরের দিকে যাওয়ার সময় আমি মেয়েদের লাইনের দিকে গেলাম। আমার কপাল ভালো, লাইনে আমার সাথেই দাঁড়ালো বোরখা পড়া এক মুসলমান পরিবার। অনেক বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সেই চার পাঁচ জন মহিলা নিজেরা কথা বলতে বলতে আমার আসে পাশে এসে ভিড় করলো। যে মহিলা আমাকে চেক করছিলো সে আমাকেও নিশ্চয়ই ওই পরিবারের কেউ মনে করলো। আমার দিকে কোন সন্দেহর দৃষ্টি না দিয়েই আমাকে ভিতরে ঢুকার জন্য ছেড়ে দিলো। আমি বুকে আটকে থাকা নিশ্বাসটা ছেড়ে দিলাম। যাক বাবা, মিশন সাকসেসফুল।

আমি তাড়াতাড়ি করে গেটের ভিতর দিয়ে হেঁটে ঢুকে গেলাম। চার পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলাম পরিচিত কাউকে দেখতে পাওয়া যায় কিনা। একা একা হাঁটতে হাঁটতেই গাছ তলায় রুবাইদাকে বসে থাকতে দেখলাম। আমি হাসি হাসি মুখে এগিয়ে গেলাম। রুবাইদাও আমাকে দেখে এক গাল হাসি দিলো। যাই হোক ২০ রুপির টিকেট দিয়েই ভিতরে ঢুকতে পারলাম। এবার দেখা যাক ‘তাজ মহল’।

আদস
সাদা ধব্ধবে রাজসিক তাজ মহল (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম )

একটু এগিয়ে যখন একটা আর্চের ভিতর দিয়ে দেখতে পেলাম সাদা ধবধবে বিল্ডিংটাকে, বুঝলাম সত্যি সত্যি এসে গেছি পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের সামনে। চারটা মিনারের মধ্যে বসে থাকা এই রাজসিক মহলের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলো না। তাজকে নিয়ে আর কি বলবো, যারা একবার গিয়েছে তারা তো দেখেছেই, আর যারা যায় নাই তাদের বুঝাতে গিয়ে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে ছবি তুলতে লাগলাম আমরা। ধীরে ধীরে এগিয়ে কাছে যেতে লাগলাম। যত কাছে যাচ্ছিলাম ততই মহলটার স্কেল বাড়তে লাগলো। শত শত মানুষের সাথে আমরা স্যান্ডেল জমা দিয়ে লাইন ধরে তাজ মহলের বেসে উঠলাম। ঠান্ডা সাদা মার্বেলের সাথে আমার পায়ের স্পর্শ হওয়ার সাথে সাথেই এক ধরনের শিহরন লাগলো। সেই কত শত বছর আগে মুঘল বাদশাহরা এই সাদা মার্বেলের উপর দিয়ে হেঁটে গেছেন, কত হাজার হাজার শ্রমিকের নিঁখুত হাতের ছোঁয়ায় মসৃন চারকোনা হয়েছে এই মার্বেল- আজকে আমি ধরে দেখছি সেই মার্বেল!

আমরা চারপাশে ঘুরতে লাগলাম। যমুনা নদীকে দেখলাম শুকিয়ে একটা নালার মত হয়ে আছে। রেড স্যান্ডস্টোনের তৈরি মসজিদটাও দেখলাম। তারপর লাইন ধরলাম তাজের ভিতরে ঢুকার জন্য। বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে ভিতরে ঢুকার সময় ধরে ধরে দেখছিলাম মার্বেলে খোদাই করা প্রত্যেকটা শিরা উপশিরা আর রেনুসহ জ্যান্ত ফুলগুলো, তাদের নুয়ে পড়া পাপড়ি আর পাতাগুলো। শক্ত পাথরে খোদাই করা ফুলগুলোর মধ্যে এমনই কমনীয়তা আছে মনে হচ্ছিলো আঙ্গুল লাগলেই তারা নড়ে উঠবে। একসময় ভিতরে ঢুকলাম লাইন ধরে। একেবারে মধ্য খানে টম্ব চেম্বারটা বেশ অন্ধকার। উপরে টিমটিমে একটা সাদা লাইট জ্বলছে। এখানে আছে শাহজাহান আর মমতাজের কবরের উপরিভাগ। এই বরাবর নিচেই শুয়ে আছে শাহজাহান আর মমতাজ। আগে নিচে যাওয়ার একটা রাস্তা সবার জন্য খোলা ছিলো। এখন সেখানে আর কাউকে যেতে দেয় না। আমরা তো আর নিচে যেতে পারছি না, মার্বেলের জালির মধ্য দিয়ে কবরের উপরিভাগটাই দেখলাম। আমার এক সময় মনে হলো, এত শান শওকত, এত স্থাপত্য, এত মুগ্ধতা, এত বাহবা- সব কিছুই আছে মাটির উপরে। মাটির নিচের জগতে যারা শুয়ে আছেন শত শত বছর ধরে তাদের কাছে এইসব তো অর্থহীন। মৃত্যু পরবর্তী জীবনে এইসবের কোন অস্তিত্ব কি তারা টের পাচ্ছেন?

আমরা মুগ্ধ হয়ে সব দেখতে লাগলাম। ভেতর থেকে একসময় বের হয়ে আসলাম। ততক্ষনে সূর্য হেলে পড়তে শুরু করেছে। লোকজনও সবাই কমতে শুরু করেছে। আমরা দ্বিমিকবাসীরা অল্প অল্প করে জড়ো হতে লাগলাম। চটপট করে বাংলাদেশের পতাকা বের করে তাজ মহলের সামনে গ্রুপ ফটো তুলে ফেললাম। ওদিকে সিকিউরিটি সবাইকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য বলতে লাগলো। আমরা খুব আস্তে আস্তে বের হওয়ার রাস্তার দিকে আগাতে লাগলাম। ততক্ষনে অন্ধকার নেমে গেছে আর পুরো কমপ্লেক্স খালি হয়ে গেছে। আমরা বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলাম তাজকে। যখন বিকালের সূর্য ছিলো তখন এক রকম রূপ, সূর্য ঢলে পড়তেই অন্য রকম রূপ, আর এখন অন্ধকারে আবার যেন রূপ বদলে গেলো তাজের। অন্ধকারের মধ্যেও সাদা আলোর একরকমের দ্যুতি ছড়াতে লাগলো তাজ। আর ভিতরের টিমটিমে আলোটাই যেন পুরো কমপ্লেক্সের এক মাত্র আলোর উৎস হিসেবে জ্বলজ্বল করতে লাগলো। শুনশান নিরবতায়, জনমানব শুন্য এই জগতে স্রেফ দুটা কবরের উপর আলো পড়তে লাগলো। কবর দুটোকে যেন পরম মমতায় আগলে ধরে রেখেছে শ্বেত শুভ্র, রাজকীয় এক ‘তাজ মহল’।

বের হবার সময় শেষ বারের মত মনে তাজ মহলকে বিদায় জানালাম। তারপর আবিষ্কার করলাম যে গেট দিয়ে বের হয়েছি, সেটা আসলে অন্য গেট। আশে পাশে খাবারের দোকান দেখে নোভারা ঢুকে পড়লো। আমি আর রুবাইদা হাঁটতে লাগলাম। দুপাশের সুভেনিয়র শপের লোকরা পারলে আমাদের হাতে তুলে দেয় তাজ মহলের রেপ্লিকা। অন্ধকারের মধ্যে তাদের হাঁকডাক উপেক্ষা করে আমরা সামনের দিকে হেঁটে যেতে লাগলাম। রাস্তা ঘাট কিছু চিনতে পারছি না। হোটেলের কার্ড থেকে ঠিকানাটা বের করে দেখলাম। আশেপাশের লোকগুলোকে জিজ্ঞেস করতে সাহস হচ্ছিলো না, যদি ভুল পথে পাঠিয়ে দেয় আমাদের! যাই হোক আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে এক দুই জন লোককে জিজ্ঞেস করে যখন হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটু পরিচিত রাস্তা পেলাম তখন রাত আটটার মত বাজে। আমরা আগের ফৌজি ধাবায় আর গেলাম না। বরঞ্চ একটা টং ঘরে ১৫ রুপি দিয়ে বোম্বে টোস্ট কিনলাম। এক ঠোঙ্গা ভর্তি করে বোম্বে টোস্ট দিলো। আমরা সেই ঠোঙ্গা নিয়ে রুমে ঢুকলাম।

রুবাইদাও আমার সাথে আমার রুমে আসলো। ও দুঃখ করে বলল নিচের রুমটা খুবই জঘন্য। বাথরুমের অবস্থাও খুব বাজে। আমরা বললাম আমাদের এখানে ওকে থেকে যেতে কিন্তু ও মৌলি আর মজুমদারকে ছেড়ে ও থাকতে রাজি হলো না। আমরা রুমে বসে বসে সেই বোম্বে টোস্ট খেলাম। রুবাইদা খানিক্ষন গল্পগুজব করে চলে গেলো। ওদিকে নোটিশ এসেছে যে আমাদের ভারী ভারী লাগেজ প্রতিবার বাসে উঠানো এবং নামানো অত্যন্ত কষ্টকর ব্যাপার। এই জন্য ঠিক হয়েছে আমাদের সব দরকারি মালপত্র ব্যাকপ্যাকে ভরে নেওয়া হবে যাতে আগামী কয়েকদিন সুটকেস বাস থেকে না নামালেও কোন অসুবিধা না হয়। সেই অনুযায়ী আমি আমার ব্যাকপ্যাক থেকে কম্বল বের করে লাগেজে ঢুকালাম। আর আগামী কয়েকদিনের জামাকাপড় ব্যাকপ্যাকে ভরে নিলাম। এই করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেলো। তারপর আমরা গল্প গুজব করতে করতে শুয়ে পড়লাম। বিশাল বিছানা। ইচ্ছা মত হাত পা ছেড়ে ঘুমালাম।