The Mighty INDIA CALLING: দুর্ধর্ষ রাজপুতদের গোলাপি মানমন্দির, প্রাসাদ এবং হাওয়া মহল (পর্ব ১৯)

সকালবেলা আগের মত আর ভুল করলাম না। খবর দিয়ে রাখার কারণে কলে গরম পানি পেলাম। শান্তিমত গোসল করে নিলাম ঘুম থেকে উঠেই। তারপর ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিয়ে বের হবার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। আমি, রুবাইদা, মিম আর অন্তরা হাঁটা ধরলাম আগের দিনে রাতের বেলা খেয়েছিলাম যে হোটেলে তার দিকে। আমি অবশ্য রাস্তার সেই রুটি আর সবজি খেতেই রাজি ছিলাম। কিন্তু রুবাইদা নাকি কি এমন জিনিস দেখেছে যে ও আমাদের কাউকে আর সেই রুটি সবজি খেতে দিতে চাইলো না। পথ কিন্তু বেশ অনেকটা। গতকাল রাতে যে রাস্তায় সোডিয়াম লাইটের নিচ দিয়ে হেঁটেছিলাম, আজকে পরিষ্কার দিনের আলোতে সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছি।

অনেক হাঁটার পর যখন সেই হোটেলে পৌঁছালাম দেখলাম সেখানে খাওয়ার কিছু নেই। তারপর সবাই মিলে সেই আগের দিনের মিষ্টির দোকান থেকে হালুয়া মিষ্টি কিনে খাই। আমি একটা ব্রিটানিয়া কেক দিয়েই নাস্তা সেরে ফেলি। সেই মিষ্টির দোকানে কথা বলে আমরা এমন কতগুলো জায়গার কথা জানতে চাই যেগুলো ওনারা চিনেই না। যেমন – ব্লু সিটির কথা উনারা জীবনেও শুনে নাই। তারপর উনাদের কাছ থেকেই সাজেশন নিয়ে আমরা ৮০ রুপি দিয়ে অটো ঠিক করি ‘যন্তর মন্তর’ এর উদ্দেশ্যে। প্রায় ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাই আমরা যন্তর মন্তর।

গেটে দেখলাম ভারতীয়দের জন্যই টিকেট ৪০ রুপি করে। অবাক হয়ে গেলাম, তাজ মহলের টিকেট যেখানে ২০ রুপি সেখানে এই কি না কি যন্তর মন্তর এ ঢুকতে হবে ৪০ রুপির টিকেট কেটে, কি অদ্ভূত! অন্তরা আমাদের জন্য ভারতীয় টিকেট কেটে আনলো। উঁচু দেওয়াল ঘেরা দুর্গের মত জায়গাটায় গেট দিয়ে ঢুকে পড়লাম আমরা। ঢুকে আমরা টের পেলাম যন্তর মন্তর আসলে রাজপুতদের অ্যাস্ট্রোনমিকাল অব্জারভেটরি অথবা সোজা বাংলায় মানমন্দির। রাজপুত রাজা জয় সিং অ্যাস্ট্রোনমি নিয়ে অনেক উৎসুক ছিলেন। উনি সারা ভারতে মোট পাঁচটি মান মন্দির তৈরি করে গেছেন। এদের মধ্যে এই যন্তর মন্তর সবচেয়ে বড়। এখানে মোটমাট ১৯টা যন্ত্র আছে যেগুলার সবগুলাই এখনো সঠিক রিডিং দেয়।

যন্তর মন্তরের একটি বিশালাকার যন্ত্র
যন্তর মন্তরের একটি বিশালাকার যন্ত্র

আমরা ২০০ রুপি দিয়ে ইংরেজি জানা একজন গাইড ঠিক করলাম। উনি আমাদের সব দেখিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। আমরা দেখলাম চক্র যন্ত্র, দক্ষিনত্তর ভিত্তি যন্ত্র, দিগাংশ যন্ত্র, দিশা যন্ত্র, ধ্রুব দর্শক পত্তিকা, জয় প্রকাশ যন্ত্র, কপালা যন্ত্র, কানালি যন্ত্র, ক্রান্তি বৃত্ত যন্ত্র, লঘু সম্রাট যন্ত্র, মিশ্র যন্ত্র, রাম যন্ত্র, রাশি বাল্য যন্ত্র, বিরাট সম্রাট যন্ত্র, যন্ত্র রাজ যন্ত্র ইত্যাদি। এদের মধ্যে অনেকগুলোই প্রথমে বড় করে বানানো, তারপর ঠিকঠাক মত রিডিং পাওয়ার পর একই জিনিস ছোট করে ফাইনালি বানানো হয়েছে। আমরা সব দেখে বুঝে থ হয়ে যাচ্ছিলাম। এত দিনে কোন এক জায়গায় বিজ্ঞান চর্চা নিয়ে কোন রাজার মাথা ব্যাথা দেখলাম। মনে মনে বলেই ফেললাম, ‘হ্যাটস অফ, রাজপুত’। আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম বড় বড় যন্ত্রগুলোর আনাচে কানাচে ধরে। অনেকক্ষন ধরে ঘুরে ফিরে আমরা এক সময় বের হয়ে আসলাম। এখান থেকে খুব কাছে সিটি প্যালেস।

আমরা ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগলাম। রাস্তার পাশে একজন বীন বাজিয়ে ঝাঁপির ভেতর থেকে সাপ বের করে খেলা দেখাচ্ছে। আমরা দেখলাম সাপের নাচ। হঠাৎ কয়েকজন সাদা চামড়ার বিদেশির উৎসাহ দেখে উনারা বাজনা বন্ধ করে পয়সা চাইতে লাগলো। আমরা তখন সুট করে সরে আসলাম। এবার যখন টিকেট কাটতে গেলাম তখন দেখলাম এখানে রেট আরও বেশি, ১০০ রুপি করে। আমরা ‘বীরেন্দ্র পোল’ নামের ধবধবে সাদা গেটটা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ি। ঢুকতেই সামনে পড়লো সাদা রঙের ‘মোবারক মহল’। মহারাজা দ্বিতীয় মাধো সিং এর আমলে বানানো দোতলা মহলটা এখন টেক্সটাইল গ্যালারী। অর্থাৎ এখানে  রাজপুত বংশের লোকদের ব্যবহার করা জামা কাপড় প্রদর্শন করা আছে। তাদের ফর্মাল ড্রেস, ক্যাসুয়াল ড্রেস, গরমের কাপড়, শীতের কাপড়, পলো খেলার পোশাক, যুদ্ধে পরার পোশাক এই সবকিছু সুন্দর করে ডিস্প্লে করা আছে। এর মধ্যে মহারাজা মাধো সিং এর ২৫০ কেজি ওজনের জামা দেখলাম। আরও দেখলাম রাজপুত বংশের মেয়েরা যাতে রাতের অন্ধকারে পলো খেলতে পারে তার জন্য বিশেষ রকমের পলো বল। এই বলের ভিতরে মোমবাতি বসানো থাকতো এবং এমন মেকানিজম ছিলো যাতে যেকোন দিকে বলটা ছুঁড়ে মারলেও সব সময় মোমবাতিটা সোজা হয়েই থাকে।  আমি খানিক্ষন হাঁ করে তাকিয়ে তাই দেখলাম।

দিউয়ানে খাস বা সর্বোতোভদ্র চক
দিউয়ানে খাস বা সর্বোতোভদ্র চক

মোবারক মহল থেকে বের হয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে পেলাম দিউয়ানে খাস বা ‘সর্বতোভদ্র চক’। এখানে আছে দুইটা পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রূপার কলস ‘গঙ্গাজলি’। এর প্রতিটাতে ৯০০ গ্যালন পানি ধরে। মহারাজা দ্বিতীয় মাধো সিং ইংল্যান্ডের সপ্তম এডওয়ার্ডের করোনেশন সেরেমনিতে যোগ দেওয়ার সময় এই দুই কলস ভরে গঙ্গার পানি নিয়ে গিয়েছিলেন। চকচকে কলস দুইটার সাথে দাঁড়িয়ে আমরা ছবি তুললাম। দেওয়ালে ঝুলানো আছে বল্লম, বর্শা, বন্দুক। সাথেই ছিলো সুভেনিয়র শপ। আমরা ঘুরে ঘুরে এসব দেখলাম। চারিদিকে অনেক সাদা চামড়ার বিদেশি ঘোরাফেরা করছে। এর মধ্যে একজন মহিলা অবাক হয়ে মিমের দীঘল কালো চুল হাত দিয়ে ধরে টেনে দেখলো। মিম তার দিকে অবাক হয়ে তাকাতেই মহিলা কিছু না বলেই সরে গেলো। কে জানে, ওদের দেশে হয়তো রুপাঞ্জেল ছাড়া আর কারও বড় চুলই নেই!

এরপর আমরা গেলাম ‘সিলেহখানা’ বা আর্মারি দেখতে। এখানে সারা ইন্ডিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ অ্যান্টিক অস্ত্রের সংগ্রহ রয়েছে। তলোয়ার, ভোজালি, দুই মাথাওয়ালা ভোজালি, ছুরি, কুড়াল, তীর ধনুক সব কিছু সুন্দর করে সাজানো আছে। হরেক রকমের বন্দুক আর গুলি থরে থরে সাজানো। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর আর শাহজাহানের নাম লিখা তলোয়ার দেখলাম। আবার মহারাজা দ্বিতীয় রাম সিং আর দ্বিতীয় মাধো সিং এর ব্যবহার করা অস্ত্রশস্ত্র দেখলাম। অনেক গুলো ছুরি, ভোজালির বাঁটে আবার বিস্তর ধাতব কারুকাজ করা, মূল্যবান রত্ন পাথর বসানো। অস্ত্রগুলো রাখার জন্য কারুকাজ করা হোল্ডস্টার বা কোফতগিরি দেখলাম। বারুদ রাখার জন্য পশুর চামড়া, শিং, শঙ্খ এইসব দিয়ে বানানো বোতলে আবার ধাতু দিয়ে নকশা করা। এ যেন শুধু অস্ত্র নয়, এ যেন এক শিল্প। সেখানে এক ইন্ডিয়ান ছাত্রী আবার আমাদের সাথে কথাবার্তা বলে নিলো যে, আমরা কোথ থেকে এসেছি, কয়জন এসেছি- এইসব। ওনাদের সাথে কথা বলে যখন গ্যালারি থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলাম, আমি রাজপুত বংশের মেধা নিয়ে কি ভাবছিলাম তা আর নাইই বলি।

তারপর দেখতে গেলাম ‘প্রিতম নিবাস চক’। এখানে খুব সুন্দর কারুকাজ করা চারটা গেট আছে, যেগুলো বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ আর শীতকাল নির্দেশ করে। ময়ুর বসানো কারুকাজ করা গেটটার নিচে আমরা সবাই ছবি তুললাম। এখান থেকে দেখা যায় ‘চন্দ্র মহল’ যেখানে বর্তমানে জয়পুরের রাজা থাকে। সত্যিকারের রাজবাড়িটা দেখতে অনেক সুন্দর। ওখানে ঢুকতে গেলে ২০০০ রুপির টিকেট কাটতে হয়। আমরা তাই বাইরে থেকেই দেখলাম। একেবারে উপরে ইন্ডিয়ার পতাকার সাথে সাথে রাজপুত বংশের পতাকাও উড়ছে সমানতালে। সাত তলার রাজকীয় বিল্ডিংটার দিকে আমরা পলক না ফেলে তাকিয়েই রইলাম অনেকক্ষন।

প্রীতম নিবাস বর্তমান রাজা এবং তার পরিবারের বাসস্থান
প্রীতম নিবাস বর্তমান রাজা এবং তার পরিবারের বাসস্থান

এরপর গেলাম ‘সভা নিবাস’ বা ‘দিউয়ানে আম’ বা দরবার হলে। এখানে আছে রাজার সিংহাসন। সিংহাসনের চারপাশে রাজপুত বংশের সব রাজাদের ছবি, নাম, পরিচয় এবং ইতিহাস দিয়ে পুরা দরবার হলটা সাজানো। এছাড়া বড় বড় ঘটনার ধারা বিবরণী ছবি দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রাজপুতদের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস, জ্ঞান চর্চার নমুনা এবং কূটনৈতিক পদক্ষেপ দেখতে দেখতে আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম। সব শেষে দেখলাম মহারাজা ব্রিগেডিয়ার ভবানী সিং এর পর তার মেয়ের ঘরের নাতি পদ্মনাভ সিং কে মাত্র ১২ বছর বয়সে ২০১০ সালে রাজা ঘোষনা দেওয়া হয়। এখন এই রাজার বয়স ১৬ বছর। কি চমৎকার ব্যাপার, ১৬ বছর বয়সেই একজন টিন এজার রাজা পরিচয় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!

সবশেষে আমরা দেখলাম ‘ভাগ্যি খানা’। এখানে রাজাদের ব্যবহার করা গাড়ি, রথ, পালকি এই সব সাজানো আছে। সামনেই কয়েকজন লোক পুতুল নাচ দেখাচ্ছিলো। চারপাশে অনেক দোকানপাট ছিলো। সেগুলোতে মোটামুটি কম দামেই জিনিসপাতি পাওয়া যাচ্ছিলো। অনেকেই এখান থেকে কেনাকাটা করছিলো। আমরা পুতুলনাচ দেখেটেখে দোকানপাট ঘুরে সেখান থেকে বের হয়ে যেতে লাগলাম। তখন এক ম্যাগজিন বিক্রেতার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম, রাজাকে তারা খুবই ভালোবাসে। রাজ পরিবারের প্রতি তাদের অগাধ শ্রদ্ধা। সবকিছু শুনে খুব ভালো লাগলো। ভালো লাগার পাশাপাশি কেমন যেন একটু দুঃখও লাগলো!

এরপর আমরা কয়েকজন অটোওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম হাওয়া মহলের কথা। তারা আমাদের রাস্তা দেখিয়ে বললো খুবই কাছে, হেঁটেই যাওয়া যাবে। ওদিকে দুপুর প্রায় শেষ হয়ে যায় যায় অবস্থা। আমরা ঠিক করলাম আগে খেয়ে নেই তারপর আবার ঘোরাঘুরি করা যাবে। আমি, অন্তরা আর মিম বড় রাস্তার উপর ‘বালাজি রেস্টুরেন্ট’ নামের এক দোকানে ঢুকলাম। তিন জনে দুইটা ফ্রায়েড রাইস অর্ডার দিলাম। বাংলাদেশের ফ্রায়েড রাইস আর এখানকার ফ্রায়েড রাইসের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। এখানে ফ্রায়েড রাইস বলতে যা দিলো তা হচ্ছে- তেলতেলা বাসমতি চালের পোলাওয়ের উপর বড় বড় সবুজ মটরশুটি আর পিয়াজ। অত্যন্ত লবনাক্ত হওয়ার কারণে আমাদের খেতে খুবই কষ্ট হচ্ছিলো। ১০০ রুপি দিয়ে এই খাবার খেয়ে আমাদের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। পরে দোকান থেকে বের হয়ে একটা কোক খেয়ে মুখের লবনাক্ততা কমালাম আমরা। আমরা ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগলাম। দুইপাশে সারি সারি দোকান। মাঝে মধ্যে দুই একটা দোকানে ঢুঁ মেরে বুঝলাম বেশ সন্দেহজনক সবকিছু। দোকানে একবার লোক ঢুকলেই তারা কিছু না কিছু গছিয়ে দেবার পায়তারা করে। বাইরে থেকে জিনিসের এক দাম বলে, কিন্তু যেই জিনিসটা দেখতে যাবো তখনই সেটার দাম বেড়ে যায়। আর কয়েক জায়গায় দেখলাম, সাদা চামড়া বিদেশিদের গলা কেটে লাভ করে নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। এক পর্যায়ে আমরা দোকানদারদের ডাকাডাকিতে বিরক্ত হয়ে গেলাম। কোন দিক না দেখে সোজা হাঁটতে লাগলাম। ঠিক হলো কোন কিছু কিনতে চাইলে ফেরার সময় কিনে নিবো। এরমধ্যে আমি দরাদরি করে ফিক্সড ১০০ রুপির ‘রেবন’ সানগ্লাস ৬০ রুপি দিয়ে কিনলাম। সব কিছু দেখেটেকে অন্তরা সাবধান হয়ে গেলো। ও ঠিক করলো এখন থেকে সব কিছুর দামাদামি শুরু করবে তিন ভাগের এক ভাগ থেকে।

লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে, অনেক গেট ঘরবাড়ি পার হয়ে আমরা হাওয়া মহলের পিছনে এসে পৌঁছালাম। এইখানে ঢুকতে হয় পিছন দিক দিয়েই। আবার ১০ রুপির টিকেট কেটে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। বাইরে থেকে হাওয়া মহলের এলেভিশন দেখেই আমার পছন্দ হয়ে গেলো। ভিতরে ঢুকে তো আরও মজা পেলাম। কয়েকটা উঠান পার হয়ে বেশ চিপা চিপা জায়গা দিয়ে র‍্যাম্প বেয়ে বেয়ে আমরা উপরে উঠতে উঠতে হাঁপিয়ে গেলাম। মজার ব্যাপার হলো এখানে সিঁড়ি নাই, র‍্যাম্প দিয়েই উঠতে হয়। উঠলাম বেশ চিকন একটা টেরাসে। এখানে সবকিছুই খুব চিপা চিপা। খুবই ছোট্ট ছোট্ট জানালা, প্রায় হাতের তালুর সমান। লাল আর গোলাপি সান্ডস্টোনের জালি দিয়ে হুহু করে বাতাস আসছে। আর ছাদের থেকেই দেখা যাচ্ছে আশেপাশের সব কিছু। আমরা এখান থেকে দেখলাম যন্তর মন্তর, সিটি প্যালেস, চন্দ্র মহল- সব।

হাজার জানালার হাওয়া মহল
হাজার জানালার হাওয়া মহল

পুরো হাওয়া মহলে ৯৫৩ টা জানালা আছে। ১৮০০ সালের দিকে এটা বানানো হয়েছিলো যাতে রাজ বংশের মেয়েরা এখানে দাঁড়িয়ে শহরের সব কর্মকান্ড দেখতে পারে। আমরা উপরে উঠে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। রঙ্গিন কাঁচ দেওয়া অনেকগুলো ঘর, অনেকগুলো ছাদ আমরা ঘুরতে ঘুরতে একসময় রুবাইদা হারিয়ে গেলো। কয়েকটা জায়গায় যাওয়ার আগেই কয়েকটা দরজা বন্ধ করে দিলো। একসময় আমরা তিন জন তিনটা আর্চের নিচে দাঁড়িয়ে পোজ মারলাম আর রুবাইদা ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ করে ছবি তুলতে লাগলো। সেই সময় একটা বিদেশি টুরিস্ট দল এসে রুবাইদার পিছনে দাঁড়িয়ে আমাদের ছবি তুলতে লাগলো। আমরা তাড়াতাড়ি সরে গেলাম সেখান থেকে। কিছুক্ষন পর একটা বিদেশি আমাকে দেখে বললো, ‘ওহ, ইউ ওয়ার দোস গার্লস……’। আমি হাসি দিয়ে বললাম, ‘ইয়েস, উই আর’। অনেক গোলক ধাঁধাঁ পার হয়ে ছোট্ট একটা আর্ট এক্সিবিশন দেখতে দেখতে আমাদের সবাই তাড়া দিতে লাগলো যে এখনই বের হয়ে যেতে হবে। আমরা চিপা চিপা পথ ধরে দৌড়াদৌড়ি করে বের হতে লাগলাম।

বের হয়ে আমরা একটু বসে বিশ্রাম নিলাম। আমি বাথরুমে গেলাম। সেখানে আরেক দল বিদেশি টুরিস্ট হাউকাউ করছে। দেখলাম তারা একজন ভিতরে যাচ্ছে, অন্যজন দরজা ধরে রাখছে। আমি ভয় পেলাম, এখানে কি বাথরুমে ছিটকানি নাই? কিন্তু পরে ঢুকে দেখলাম সবই ঠিক আছে, ওরা মনে হয় ছিটকানি জিনিসটা চেনে না। অ্যামেজিং টুরিস্টস!

আমরা বের হয়ে আবার শপিং এ মনোযোগী হলাম। কিন্তু অভিজ্ঞতা বেশ তিক্ত হলো। বিকালে দেখা জিনিসপত্রের দাম এরই মধ্যে বেড়ে গেছে। দামের উল্টা পালটা তো আছেই। আর দোকানদাররা খুব তেল দিয়ে দিয়ে কথাবার্তা বলে। জিজ্ঞেস করে, ‘কাহাসে আয়া হো? আপ ক্যায়া মালয়শিয়া সে হো?’। পরে বাংলাদেশ শুনে একজন বললো, ‘আই লাইক বাংলাদেশ- মিরপুর স্টেডিয়াম- আই লাইক সাকিব আল হাসান’। দামদর করতে করতে সবার মাথা খারাপ হয়ে গেলো। এরই মধ্যে গতকাল যে চুড়ি আমি ১০০ রুপি দিয়ে কিনেছি সেটা অন্তরা দাম করলো। একই জিনিস এক দোকানে ১৫০, এক দোকানে ৯০ আরেক দোকানে ২৫০ রুপি চাইলো। সব শেষে ৯০ রুপির দোকানে গিয়ে অন্তরা যখন কিনতে চাইলো, তখন উনারা জানালো উনারা চুড়ি বিক্রি করবে না। পুরাই ঠগের রাজ্য যেন চারপাশে। বিকালে তাও যা দাম কম ছিলো, এখন তো যার যা দাম ইচ্ছা, তাই হাঁকছে। জিনিস পছন্দ করার সাথে সাথেই দাম বদলে যায়। কি অদ্ভূত জায়গা রে বাবা! আমার মনে হলো এর চেয়ে সিটি প্যালেসের ভিতরে কেনাকাটা করাই ভাল ছিলো।

এরই মধ্যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে গেলো। আমরা চারজন অটো ভাড়া করে হোটেলের দিকে রওয়ানা হলাম। হোটেলে গিয়ে ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে নিয়ে রাতের খাবারের জন্য বের হয়ে পড়লাম। এবার অর্ডার দিলাম আলু টমেটু আর রুটি। খেতে ভালোই ছিলো। পেট ভরে খেয়েদেয়ে হাঁটা ধরলাম হোটেলের দিকে। গোয়েল প্রস্তুত ছিলো আমাদের জন্য। মালপত্র নিয়ে উঠে পড়লাম আমরা। গোয়েল আমাদের নিয়ে রওয়ানা দিলো। পরবর্তী গন্তব্য- জয়সালমীর।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *