আমাদের অ্যালার্মগুলা পর পর বাজার পরও আমরা উঠতে পারলাম না। হঠাৎ দরজায় দুমদুম কিল পড়লো। আমরা লাফিয়ে উঠে গেলাম। জুবায়ের আমাদের নাম ধরে ধরে ডাকতে লাগলো। মজুমদার চিৎকার করে জানালো যে আমরা সবাই উঠে গেছি। হঠাৎ করে গভীর ঘুম থেকে উঠে পড়ায় আমার হার্টবিট বেড়ে চৌদ্দগুন হয়ে গেলো। বিছানায় উঠে বসে ঘড়িতে সময় দেখলাম। বাজে ৪টা ২০। সর্বোনাশ! আমাদের যে উঠতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে! আমরা দুদ্দাড় করে বিছানা থেকে নেমে পড়লাম। ঝটপট রেডি হয়েই একজন একজন করে মালপত্র নিয়ে বের হয়ে গেলাম।
সমস্ত লাগেজ টেনে টেনে নিয়ে সিঁড়ির সামনে এসে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। আবার তিন তলা থেকে এইসব জিনিস নামাতে হবে, কি প্যাথেটিক! কিন্তু কিছু করার নাই। পিঠে ব্যাকপ্যাক, কাঁধে সাইড ব্যাগ ঝুলিয়ে বড় লাগেজটা অল্প অল্প করে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামাতে লাগলাম। অনেক পরিশ্রমের পর এক সময় তিন তলা থেকে লাগেজ সমেত আমি নিচ তলায় নেমে আসলাম। নিচে অনেকে লাগেজ নিয়ে সোফায় বসে আছে। আমাদের বাস নাকি এখনও এসে উপস্থিত হয় নাই। আস্তে আস্তে সবাই মোটামুটি নামতে থাকলে নিচ তলাটা পুরো ভরে যায়। দাঁড়ানোর কোন জায়গা আর বাকি থাকে না। তখন যে সিঁড়িতে যতটুকু নামতে পেরেছিলো ততটুকু নেমেই লাগেজ সমেত দাঁড়িয়ে থাকে। যাইহোক, খুব বেশি সমস্যা হওয়ার আগেই ৬টা বাজতে বাজতেই কমিটির লোকজন ঘোষনা দেয় যে বাস চলে এসেছে। আমরাও সময় নষ্ট না করে লগেজ নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ি।
এই বাসটা আগের তুলনায় অনেক ছোট। সাধারণ লোকাল বাসের মত রংচঙ্গে। বাসের সাথে দুইজন লোক ছিলো। আমাদের একেকজনের লাগেজ দেখে উনাদের মাথায় বাজ পড়ে। বাসে তো এত লাগেজ রাখার জায়গা নাই! একজনকে দেখলাম বাসের ছাদে উঠে দড়ি দিয়ে কপিকলের মত বানিয়ে নিচে নামিয়ে দিতে। অন্যজন নিচে থেকে আমাদের লাগেজগুলো দড়িতে বেঁধে দিতেই উপরেরজন টেনে টেনে সেগুলোকে ছাদে তুলে নিচ্ছিলো। কাজ হচ্ছিলো অত্যন্ত ধীর গতিতে। পুরো ব্যাপারটা ছিলো অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ। আমরা এত স্লো লাগেজ ওঠানো দেখে মজা পাচ্ছিলাম। আমাদের কমিটির লোকজন এর চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে মালামাল ‘লোড’ করে ফেলতে অভ্যস্ত! একসময় ছাদ পুরো ভরে গেলো। তখন আমাদের বাকি মালপত্রগুলোকে তোলা হলো বাসের সবচেয়ে পিছন দিকে। দেখতে দেখতে পিছনের তিন সারি সিট সব ভরে গেলো আমাদের লাগেজ আর ব্যাকপ্যাকে। তারপর আমরা সবাই চড়ে বসলাম বাসের ভিতর। সবাই বসার সিট পেলো না, কিন্তু তাতে কারও কোন সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হলো না। অনেকেই দুই জনের সিটে তিনজন করে বসে পড়লো। তারপর সবাই সব ঠিকঠাক আছে কিনা চেক করতেই আবিষ্কার হলো রিন্তু আর পৃথ্বী মিসিং। সাথে সাথে ওদের ফোন দেওয়া হলো। ওরা সূর্যোদয় দেখতে বিচে গেছে। কি আর করা, সবাই মিলে বাসের ভিতর বসে ওদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। এক সময় ওদের দুইজনকে দেখলাম দৌড়াতে দৌড়াতে আসতে। ওরা আসতেই আমাদের বাস ছেড়ে দিলো। মোটামুটি সাড়ে সাতটার সময় আমরা রওয়ানা দিলাম।
আমি আর রুবাইদা বসে ছিলাম একদম শেষের দিকের সিটে। আমাদের পরেই লাগেজের স্তুপ। আমাদের সামনে ছিলো জুবায়ের। জুবায়ের লাগেজ গুলোর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, ‘ভয় হচ্ছে, লাগেজের ভারে বাস না আবার খাড়া হয়ে যায়’ । ভোর বেলায় ঊঠার কারণে সবারই চোখে ঘুম ঘুম ভাব ছিলো। বাসে সবাই মোটামুটি হাল্কা পাতলা ঘুম দিতে লাগলো। আমিও চোখ বন্ধ করে ছোট্ট একটা ঘুম দিয়ে নিলাম। পুরো ট্যুরে আমার এই উপকার হয়েছে, আমি এখন বাসে আর ট্রেনে দিব্যি ঘুমাতে শিখে গেছি। ১১টা বাজার আগেই আমরা চেন্নাই এসে পৌঁছে গেলাম। আমাদের বাস এসে থামল হোটেল হরাইজনের সামনে। চেন্নাইতে প্রথমে আমাদের কোন হোটেল নেওয়ার কথা ছিলো না। কারণ আজকে রাতেই আমরা কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো। ঘোরাঘুরি করতে করতেই সারাদিন কেটে যাবে। কিন্তু পরে প্ল্যানে চেঞ্জ আসে। এত মালপত্র রাখার জন্য আর একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আমাদের একটা হোটেল রুম নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। চেন্নাইতে সুমাইয়ার আব্বুর একজন শিল্পপতি বন্ধু রয়েছেন। তিনি লোক পাঠিয়ে এই একটা হোটেল আমাদের জন্য ঠিক করে দিয়েছেন।
বাস থেকে নেমে আমরা লাগেজের জন্য দাঁড়ালাম। বাসের ছাদ থেকে দড়ি দিয়ে একটা একটা করে লাগেজ নামানো হচ্ছিলো ধীর গতিতে। তাতে আমাদের ধৈর্যে বাঁধ ভাংলে দড়ি ছাড়াই এমনি এমনি লাগেজ নামানো শুরু হয়ে গেলো। এতে দুইটা দুর্ঘটনা ঘটলো। একটা লাগেজ ধরতে গিয়ে আনিসের মুখে লাগেজের চাকার বাড়ি লেগে দাঁতের কোনা ভেঙ্গে গেলো। আর কোন কারণ ছাড়াই রাত্রির লাগেজটা বাসের ছাদের থেকে পড়ে গেলো এবং সেটার চাকা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। যাই হোক আমরা বাকি মানুষজন আমাদের মালপত্র নিয়ে হোটেলে ঢুকলাম। নিচ তলায় একটা রুম নেওয়া হয়েছে, সেটা শুধুই লাগেজ রাখার জন্য। আমরা আমাদের সবার বড় লাগেজ খুব মাপজোক করে একটার উপর আরেকটা রেখে কেমন করে যেন ছেচল্লিশটা লাগেজ একটা ছোট্ট ডোবল রুমে আঁটিয়ে ফেললাম। তারপর বাকি ব্যাগ গুলো নিয়ে উপরে চারতলায় উঠে আসলাম। এখানে আমাদের জন্য তিনটা রুম নেওয়া হয়েছে। একটা ছেলেদের জন্য আর দুইটা মেয়েদের জন্য। আমি একটা রুমে ঢুকে বসলাম। জোরে ফ্যান ছেড়ে যতজন পারলাম একটা ডবল বেডে কোনমতে বসলাম।
একটু ধাতস্থ হতেই একজন একজন করে সবাই বাইরে ঘুরতে যেতে লাগলো। সীমান্ত আর রিন্তু গেলো চোখের ডাক্তার দেখাতে ‘শংকর নেত্রালয়’ হাসপাতালে। সবার শেষে রুমের চাবি নিয়ে আমি বের হয়ে পড়লাম। হোটেলের রিসেপশনের লোকটার সাথে কথা বলে আমি, নিশাত, পৃথ্বী, রুবাইদা, অন্তরা আর মিম ১৫০ রুপি দিয়ে অটো ভাড়া করে রওয়ানা দিলাম টি নগরে। টি নগর বেশ ব্যাস্ত কমার্শিয়াল এলাকা। ফুটপাথ ভর্তি মানুষজন হাঁটা চলা করছে। চওড়া রাস্তার দুই পাশে বড় বড় বিল্ডিং, অনেক দোকানপাট। আমরা একটা জায়গায় নেমেই প্রথমে খাওয়ার দোকান খুঁজলাম। মোটামুটি একটা দোকানে ঢুকে আমি আর রুবাইদা অর্ডার দিলাম ১০০ রুপির ভেজ বিরিয়ানি। বিরিয়ানিটা খেতে মোটেও মজা না। কিন্তু খাওয়া চলে। সকালে এমনিতেও কিছু খাওয়া হয় নাই। তাই আমরা চুপচাপ ভেজ বিরিয়ানি খেয়ে নিলাম।
খাওয়া দাওয়া করে আমরা ঘুরতে বের হলাম। একটু পরেই চোখে পড়লো বিশাল দোকান ‘চেন্নাই সিল্ক’। আমরা ঢুকে পড়লাম সেটাতে। পোথির মতই বড় শাড়ির দোকান, কিন্তু ‘পোথি’র মত নয়! আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। তারপর বের হয়েই পাশেই আরেকটা বড় শাড়ির দোকান পেলাম ‘এস কুমার’স’ । এই দোকান দেখতে দেখতে হঠাৎ আমাদের মনে হলো এই জায়গা তো আগেও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে- এমন তো হবার কথা না! হঠাৎ টের পেলাম আমরা আসলে চেন্নাই সিল্কে চলে এসেছি। এই দুইটা দোকানের ভিতর দিয়ে কানেকশন আছে। দুইটা বোধহয় একই মালিকের দোকান। তারপর এখান থেকে বের হয়ে কয়েক কদম হাঁটতেই চোখে পড়লো ‘পোথি’। আবার সেই ‘পোথি’! মহা উৎসাহে আমরা ঢুকে পড়লাম পোথিতে। আগের মতনই ঘটনা। অন্য দোকানগুলোর থেকে পোথিতে ভিড় সবচেয়ে বেশি। তবে বেশি ভিড় হলে যা হয় আর কি, খুব ভালো করে কোনকিছু দেখা হলো না। তবে কেন যেন মনে হলো ত্রিভান্দাম বা পন্ডিচেরির কালেকশন বেশি ভালো ছিলো। মোটামুটি ভিড় ঠেলে ঠেলে আমরা সব কিছু দেখছিলাম। এক জায়গায় হঠাৎ করে ‘ঢাকাই শাড়ি’ একটা সেকশন দেখে সেখানে কি আছে আগ্রহী হয়ে দেখতে যাই। কয়েকটা তাঁতের শাড়ি আর জামদানি শাড়ি দিয়ে ভরে রাখা তাক। দেখে ভালোই লাগলো, যাক আমার দেশের শাড়িও তাহলে এখানে আছে!
পোথি থেকে বের হয়ে আমরা ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকি। হঠাৎ একটা দোকানের সামনে আমাদের বেশ কয়েকজনকে পেয়ে যাই। জানতে পারি এই দোকানে নাকি সব পানির দরে জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দোকানটার নাম দেখে নেই ‘সারাভানা’। আমরা ঢুকে পড়ি সারভানাতে। এ এক বিশাল দোকান। এর কোন শেষ নেই। মনে হয় যেন বিশাল কোন গুদাম ঘরে ঢুকে পড়েছি। তাক কে তাক ভর্তি জর্জেটের শাড়ি আর শাড়ি। নানা রকম দামের শাড়ি, কমতে কমতে ২২০ রুপিতে গিয়ে ঠেকলো। তখন রুবাইদা বললো, ‘চল, আরেকটু খুঁজি। সামনে মনে হয় ১০০ রুপিতেও শাড়ি পাওয়া যাবে’। এত শাড়ি দেখে যখন মাথা বন বন করছিলো তখন শুরু হলো জর্জেটের ওড়না। নানা রঙের শত শত ওড়না। ওড়নার দামও কমতে কমতে ৬০ রুপিতে গিয়ে ঠেকলো। এত কিছু দেখার পরও অন্তরা বিছানার চাদর দেখতে চাইলো। সেলসম্যানরা আমাদের লিফটে তুলে উপরে পাঠিয়ে দিলো। উপরে উঠে আমরা পেলাম রেডিমেড জামাকাপড়। মেয়েদের প্যান্ট, স্কার্ট, টপস- এইসব জিনিস। বিশাল ফ্লোর জুড়ে এই সব জামাকাপড় দেখতে দেখতে আমার সত্যিই কেমন যেন অসুস্থ লাগছিলো। এর মধ্যে আমরা সবাই কম বেশি হারিয়ে গিয়েছিলাম। পরে একজন আরেকজনকে ফোন করে খুঁজে বের করে নিয়েছি। অনেক্ষণ পর আমরা এই জায়গা থেকে নেমে আসলাম। নিচ তলায় আসতে আসতেই মিম আর অন্তরার লিপস্টিক কেনার শখ হলো। আমি আর রুবাইদা ওদের রেখে বের হয়ে গেলাম এই দোকান থেকে। বসে পড়লাম দোকানের সামনের সিঁড়িতে। সেখানে আমাদের মতই আরও অনেক মানুষ বসে আছে। সবার হাতেই অনেক অনেক শপিং। আর এদিকে শুধু রুবাইদা কয়েকটা ওড়না কিনেছে বলে আমাদের হাতে একটা ছোট্ট প্যাকেট। আমি আর রুবাইদা বসে বসে গল্প করতে লাগলাম। এই দোকানে ঢোকার পর কখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেছে টেরই পাই নাই।
মিম আর অন্তরা বের হয়ে আসলে আমরা কয়েক কদম হেঁটে একটা জুসের দোকানে ঢুকি। দোকানে আমরা ছাড়া আর কোন কাস্টোমার নাই। একটা কমবয়সী ছেলে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে আমাদের কাছে আসলো অর্ডার নিতে। আমরা যেইটা নিতে চাই, সে বিরক্ত হয়ে জানায় যে দেওয়া যাবে না। সব শেষে আমি নেই মিল্কশেক। ছেলেটা চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি ফুটিয়ে জুস বানাতে চলে যায়। আমি একটু লক্ষ করতেই দেখলাম। সবুজ একটা কলা ছিলে সে ব্লেন্ডারে দিয়ে দিলো। হায় হায় কাঁচা কলার শেক খেতে হবে দেখছি! আমাদের জুস বানাতে খুব বেশিক্ষন লাগলো না, তবে আমরা খেলাম বেশ সময় নিয়ে। আমার কাঁচা কলার শেকটা খারাপ ছিলো না। অবশ্য কলাটা একেবারে কাঁচা না, একটু পাকাও ছিলো! আমাদের এক সমস্যা হলো আমরা চুপচাপ থাকতে পারি না। গল্পগুজব একবার শুরু হলে আমরা উচ্চস্বরে হাহা হিহি করতে থাকি। জুসের দোকানেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। তবে আমাদের হৈচৈ দেখে দোকানের ছেলেটা বারবার অগ্নি দৃষ্টি দিতে লাগলো।
জুসের দোকান থেকে বের হয়ে আমরা অলসভাবে খানিক্ষণ হাঁটাহাঁটি করছিলাম। রাস্তার পাশেই দেখলাম সিনেমার ডিভিডির বড় বড় দোকান। সেই সব দোকানে রজনীকান্তের নতুন সিনেমা ‘লিঙ্গা’র বড় বড় পোস্টার টানানো। সত্যিই, সাউথের ভাবসাবই আলাদা! আমরা সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার আগেই একটা অটো ঠিক করে ফেললাম। সেই অটোতে করে রওয়ানা দিলাম আমাদের হোটেলের উদ্দেশ্যে। আমাদের হোটেলের কাছাকাছি পৌঁছাতেই শুনতে পেলাম মাগরিবের আযান। হোটেলের ঠিক পাশের গলিতেই একটা বড় মসজিদ আছে আমি খেয়ালই করি নাই। অনেকদিন পর কানে আযানের ধ্বনি যেতেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। হোটেলে ঢুকেই আমরা প্রথমে রুমে গেলাম। একটু হাতমুখ ধুয়ে বিশ্রাম নিয়েই বের হয়ে পড়লাম আবার।
হোটেল থেকে বের হয়ে আমরা পাশের গলির দিকে হাঁটতে লাগলাম। ততক্ষনে মাগরিবের জামাত শেষ হয়েছে। রাস্তায় মুসল্লিদের ঢল নেমেছে। আমরা প্রথমে বড় একটা দোকানে ঢুকলাম। রাতে ট্রেন জার্নি আছে। সেজন্য খাবার দাবার কিনে নিতে হবে। আমরা দোকান ঘুরে ঘুরে নিজেদের পছন্দমত কেক, বিস্কুট, বাদাম এসব কিনে নিলাম। ক্যাশ কাউন্টারে বিল দিতে গিয়ে দেখি সেখানে একজন বড় দাড়িওয়ালা মুসলমান বসে আছেন। আমাদের দেশের তাবলীগের অনুসারীরা দেখতে যেমন হয়ে, ওনাকেও দেখতে সেরকমই লাগলো। আমি বিল মিটিয়ে দেওয়ার সময় লোকটা গম্ভীর হয়ে মিমের দিকে ইঙ্গিত করে আমাকে বললো, ‘ইনি কি আপনার সাথেই এসেছেন?’ আমি হ্যাঁ জবাব দিতেই আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইনি কি মুসলমান?’ আবারও আমি হ্যাঁসূচক জবাব দিলাম। তখন লোকটা আরও গম্ভীর মুখে বললেন, ‘ওনাকে বলবেন চুল বেঁধে চলাফেরা করতে। এত বড় চুল খুলে রেখে চলা ঠিক না’। আমি একটু হাসি দিয়ে বললাম, ‘জ্বি আচ্ছা, বলবো’। ওদিকে মিমও টের পেয়েছে ওকে উদ্দেশ্য করে আমরা কথা বলছি। আমি কাছে আসতেই ও জানতে চাইলো কি ব্যাপার। আমি ওকে সব খুলে বলতেই ও একটা হাল্কা হাসি দিলো।
কেনাকাটা শেষ করে আমরা এবার খাওয়া দাওয়া করার জন্য জায়গা খুঁজছিলাম। রাস্তার পাশেই বেশ বড়বড় হোটেল। আমরা সেখান থেকে বেছে বেছে একটা হোটেলে ঢুকলাম। ভিতরে ঢুকে আমরা দোতলায় গিয়ে বসলাম। হালাল মাংস পাওয়া যায় শুনে অর্ডার দিলাম তন্দুরি চিকেন আর পরোটা। অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করতে করতেই শুভ, রিজভীসহ আরও কয়েকজন এসে ঢুকলো ভিতরে। ওরা আমাদের পিছনে একটা টেবিল জুড়ে বসে পড়লো। কিছুক্ষনের মধ্যেই খাবার আসলো। খেতে ভালোই ছিল মুরগিটা। আমরা মজা করে খেলাম। আর পিছনের টেবিল থেকে ওরা জানতে চাইলো যে, টেস্ট কেমন খাবারের।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা আবার হোটেলে ফিরে আসলাম। আমাদের নিচতলার সেই লাগেজ রুম খুলে দেওয়া হয়েছে। আমরা আমাদের মালপত্র বের করে যার যার জিনিসপত্র গুছিয়ে রিসেপশনের সামনে বসে রইলাম। রেল স্টেশন আমাদের হোটেল থেকে কাছেই। হেঁটে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু এত মালপত্র নিয়ে কেমন করে যাওয়া হবে সেটা নিয়ে বেশ আলাপ আলোচনা হচ্ছিলো। তখন হঠাৎ খবর আসলো, সুমাইয়ার পরিচিত সেই শিল্পপতি আংকেল আমাদের জন্য গাড়ির ব্যাবস্থা করে দিচ্ছেন আর সবার জন্য রাতের খাবার পাঠাচ্ছেন। শুনে আমরা খুশিতে গদ্গদ হয়ে গেলাম। সুমাইয়াকে দেখলাম, হ্যাভার স্যাকের ভারে কুঁজো হয়ে হেঁটে যেতে। পন্ডিচেরিতে একটা ছোটখাটো দুর্ঘটনায় আফরা পায়ে ব্যাথা পেয়েছিলো। ওকে দেখলাম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে। কিছুক্ষনের মধ্যেই গাড়ি চলে আসলো। আসলে ঠিক গাড়ি নয়, আসলো একটা বড়সড় পিকাপ আর আরেকটা গাড়ি। ডিসিশন হলো যে, পিকাপ আর গাড়িতে আমাদের সব মালপত্র উঠিয়ে দিয়ে আমরা হেঁটেই স্টেশন চলে যাবো। আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করলাম। বড় লাগেজগুলো পিকাপের পিছনে রেখে দিলাম আর দুজন লোক হাসিমুখে আমাদের মালপত্রগুলো পিকাপে তুলে দিতে লাগলো।
বড় লাগেজটা রেখে দিয়েই আমরা ব্যাকপ্যাক, সাইডব্যাগ এগুলো নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। সবার মাল না উঠানো হলে গাড়িগুলো ছাড়বে না। তাই ততক্ষন অপেক্ষা করার কোন মানে হয় না। রাস্তা পার হয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম। রাত খুব বেশি না হলেও রাস্তাঘাট শুনশান নিরব। তার উপর রাস্তাঘাটও ঠিকমত চিনি না। ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি কিনা বলতে পারলাম না। তবে বুঝলাম আমরা আসল এন্ট্রি দিয়ে না ঢুকে একটা চিপা ইনফর্মাল এন্ট্রি দিয়ে ঢুকার চেষ্টা করছি কারণ এটাই আমাদের হোটেলের থেকে সবচেয়ে কাছে। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে একসময় মনে হলো আমরা কাছাকাছি চলে এসেছি। তারপর খুঁজে খুঁজে যে জায়গায় আমাদের পিকাপের আসার কথা সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। স্টেশনের ভিতরে না ঢুকে আমরা বাইরের দিকে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর ফোনে খবর পেলাম, পিকাপ চলে এসেছে। রুবাইদা আমাকে দাড়করিয়ে রেখে নিয়ে গেলো আমাদের দুইজনের মালপত্র নিয়ে আসতে। আর আমি দাঁড়িয়ে রইলাম আমাদের ব্যাকপ্যাক, হ্যাভারস্যাক আর অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে। আমাদের অনেককেই দেখলাম জোরে জোরে হাঁপাতে হাঁপাতে লাগেজ টেনে টেনে আনতে। আমার তখন মনে হলো, দুইটা ভারি ভারি লাগেজ টেনে আনতে নিশ্চয়ই রুবাইদার অনেক কষ্টই হবে। আমার এরকম থেকে যাওয়াটা বোধহয় উচিৎ হয় নাই। আমি চিন্তিত মুখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। আমার সকল দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে রুবাইদা হাসি মুখে ভারি ভারি দুইটা লাগেজ টানতে টানতে আসতে লাগলো। রুবাইদা চলে এলে আমরা যে যার মাল বুঝে নিয়ে নিজে নিজে টানতে লাগলাম। অন্তরাকে দেখলাম কোনটা ফেলে কোনটা টানবে বুঝতে পারছে না। ব্যাপক মালপত্র সবার কাছেই, তাই কেউ যে কাউকে সাহায্য করবে- সেটা সম্ভব হচ্ছে না।
আমরা যথাসম্ভব তাড়তাহুড়া করে আমাদের প্ল্যাটফর্মে এসে হাজির হলাম। এই প্রথমবার আমরা দেখলাম প্ল্যাট ফর্মে আমাদের ট্রেন এসে বসে আছে। এবং ভেতরের সব লাইট বন্ধ। ট্রেন খালি, অর্থাৎ এখনও যাত্রী ওঠা শুরু হয় নাই। এই প্রথমবার আমাদের দৌড় ঝাপ করে ট্রেনে উঠতে হচ্ছে না- ব্যাপারটা আমাদের নিজেদের কাছেই কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগলো! আমরা আগের মত আমাদের মালপত্র সব স্তুপ করে রেখে তার চারপাশে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। প্ল্যাটফর্মে অনেক মানুষ দিব্যি মশারি টানিয়ে শুয়ে পড়েছে। তারা কোন অসহায় গরীব মানুষ না, তারা ট্রেনেরই যাত্রী। মনে হয় ট্রেন লেট করেছে তাই সময় নষ্ট না প্ল্যাটফর্মের কলাম আর ওয়েটিং চেয়ারের সাথে সবাই মশারি টানিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। প্ল্যাটফর্মে সারি সারি রংচঙ্গে মশারি দেখে আমার বেশ মজা লাগলো। অদ্ভূত, এরা বেড়ানোর সময় সাথে করে মশারিও নিয়ে আসে!
ট্রেনের জেনারেটর অন হতেই ভিতরে লাইট জ্বলে উঠলো। আমরাও টপাটপ ভিতরে ঢুকে পড়লাম। আমাদের খোপে আমরা জিনিসপত্র নিয়ে উঠে পড়লাম। আমি আর রুবাইদা এবার সিট পেলাম করিডরের পাশে। আমি উপরে আর রুবাইদা নিচে। আমাদের খোপে সাতটাই আমাদের লোকজন। পাশের খোপে কৌশিক একমাত্র এসেছে। ও তাড়াতাড়ি আমাদের খোপের আট নম্বর লোকের সাথে সিট বদলে নিলো। তারপর টের পেলাম পাশের খোপে নিশাত, রিন্তু পৃথ্বী আর তানভীরের সিট। কৌশিক আমাদের খোপে চলে না আসলেও পারতো!
আমাদের লাগেজগুলো ততদিনে ফুলে ফেঁপে বিশাল আকার ধারন করেছে। সবগুলো খোপেই আমাদের মানুষ থাকার কারণে অনেকগুলো লাগেজ আমাদের কায়দা করে রাখতে হলো। সব লাগেজ রাখার পর মাটিতে পা ফেলার আর কোন জায়গাই রইলো না। কি আর করা, সবাই তাই পা তুলেই সিটে বসে রইলো। ওদিকে নিশাতরাও অনেক কষ্টে লাগেজ গুছিয়ে রাখলো। সবশেষে নিশাত ওর ম্যাজেন্টা কালারের ফুলেল কম্বলটা দিয়ে লাগেজের বিশাল স্তুপটাকে ঢেকে দিলো। তখন পুরা জিনিসটাকে দেখতে মাজারের মতন লাগতে শুরু করলো। নিশাত আমাকে হাসি মুখে বললো, ‘আমরা মাজার সাজিয়ে বসেছি, তোরা আয় আর আমাদের মাজারে পয়সা দিয়ে যা’।
আমরা গোছগাছ করে বসতে বসতেই ট্রেন ছেড়ে দিলো। ট্রেন ছাড়তেই আমরা গল্পগুজবের মুডে বসলাম। নিজেরা গল্প করতে লাগলাম আর হাসতে লাগলাম হাহা হিহি করে। ওদিকে কে যেন বের করে আনলো তাস। ব্যাস আর যায় কই, সবাই হাত পা গুটিয়ে বসে পড়লো তাস নিয়ে। আমি আর রুবাইদা রুবাইদার সিটে বসে গল্প করতে লাগলাম। এর মধ্যে একটা স্টেশনে ট্রেন থামলো, ওদিকে সৈকত আর সুমাইয়া খাবারের প্যাকেট নিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে আসলো। শিল্পপতি আংকেলের দেওয়া খাবার সব সুমাইয়ার কাছে। কিন্তু ওর বগি আর আমাদের বগির মাঝখানে দরজা সিল করা। তাই ও আমাদের খাবারগুলো দিতে পারে নাই। এজন্য ট্রেন থামতেই ওরা প্যাকেট হাতে নেমে পড়ে। কয়েকটা জানালা দিয়ে ওরা খাবারের প্যাকেটগুলো দিয়ে ফেলে। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই ট্রেন হুইসেল দিয়ে নড়তে শুরু করে। ওরা দুইজন আতংকিত হয়ে খাবারের প্যাকেট প্ল্যাটফর্মে ফেলেই দৌড় লাগায়। আমরা গলা বাড়িয়ে চিৎকার করতে থাকি। আমরা তাড়াতাড়ি ফোন করে খবর নিতে থাকি যে ওরা ঠিকমত উঠতে পেরেছে কি না। খবর পাই যে ওরা ঠিক মতই উঠেছে কিন্তু খাবারের প্যাকেটটা ফেলে আসায় ওরা খুব আফসোস করছে। আমাদের সেজন্য আফসোস নাই, ওরা ঠিক মত আছে -এটাই তো বড় কথা! এদিকে আমাদের আশেপাশের খোপে যারা খাবার পেয়েছিলো তারা আমাদের সাথে সেটা শেয়ার করলো। জিনিসটা ছিলো বিশাল পরোটা দিয়ে প্যাঁচানো শর্মা টাইপের জিনিস।
রাত বেশি করলাম না। গত রাতে ঠিকমত ঘুম হয় নাই। সকালেই একটা জার্নি করেছি, সারাদিনে কোন বিশ্রামও নেওয়া হলো না। সবাই তাই ক্লান্ত ছিলো। আমরা যার যার জায়গা গুছিয়ে শুয়ে পড়লাম। এবং বলাই বাহুল্য, প্রায় শোয়ার সাথে সাথেই সবাই ঘুমে অচেতন হয়ে গেলো।