সুন্দর সকালে ঘুম ভাংলো আমাদের। আগের দিনের গানের তোড়জোড় নাই। তাই আরাম করেই ঘুম দিয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠেই সব ব্যাগ গোছগাছ করে রাখলাম। সকাল ৮টার সময় আমাদের বের হয়ে যাওয়ার কথা লরি বেকারের সেন্টারের উদ্দেশ্যে। তার আগে আমাদের সব মালপত্র আরেকটা যে হোটেল আছে ‘রাজি হোমস’ সেখানে জমা দিয়ে আসতে হবে। আমরা ব্যাগ নিয়ে প্রায় বের হয়েই যাচ্ছিলাম, কিন্তু হঠাৎ শুনতে পেলাম কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। সব প্ল্যান নাকি বাতিল হয়ে গেছে। সব কিছু বাদ দিয়ে আমরা সেই রেইন বো হোটেলে গেলাম নাশতা খেতে। আমি অর্ডার দিলাম ৬০ রুপির পাউরুটি টোস্ট, বাটার আর জেলি।
আয়েশ করে সেটা খেতে খেতেই শুনলাম আমাদের হোটেলেই নাকি মালপত্র জমা রাখা হবে। আর দেরি হয়ে যাওয়ার কারণে সকাল ৮টার প্রোগ্রাম বাতিল হয়ে গেছে। ফুরফুরে মনে খেয়েদেয়ে আমরা আমাদের হোটেলে ফেরত আসলাম। আমাদের রুমেই অন্যদের মালপত্র রাখা হবে। ‘রাজি হোমস’ থেকে একজন একজন করে ঢাল বেয়ে টেনে টেনে ওদের লাগেজগুলো আনতে লাগলো। পরিশ্রমের কারণে সবার চোখমুখ লাল। মেজাজও থমথমে। প্ল্যান বদলে যাওয়ায় অনেকেই অসন্তুষ্ট। মনের দুঃখ, কষ্ট, রাগ ঝাড়তে গিয়ে পরিস্থিতি উত্তেজিত হয়ে পড়লো। এর মধ্যে শুনলাম রাজি হোমসে হিমির মেজাজ চড়ে গেছে কমিটির উপর। লাগেজ কোথায় রাখা হবে এটা বারবার পরিবর্তন হওয়ায় মেজাজ বিগড়ে গেছে ওর। দীর্ঘদিনের ট্যুরের ফলে অনেকেরই মন মেজাজে পরিবর্তন এসেছে। স্বাভাবিক ঘটনাতেই অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু হচ্ছে। মনে হলো এত দিনের ট্যুরে মানসিক অবস্থা এরকম হয়ে আসাটা খুবই স্বাভাবিক। তবে অন্য সবাই খুবই ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি সামাল দিলো। কমিটি বিকল্প প্ল্যান জানিয়ে দিলো। আমরা সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিলাম।
সকাল ১০টার দিকে আমরা হোটেল থেকে একটু সামনে গিয়ে চমৎকার একটা পাবলিক বাসে চড়ে বসলাম। আমাদের গন্তব্য ইস্ট ফোর্ট। প্রায় আধা ঘন্টা পর ইস্ট গেটে পৌঁছালে আমরা বাস থেকে নেমে পড়ি। ইস্ট গেট অনেকটা আগেরদিন যে শহরে গিয়েছিলাম সেখানকার বাসের ইম্পরট্যান্ট স্টপেজ। আশেপাশে অনেক বাস এসে থামছে আর ছাড়ছে। অনেক বাসে দেখলাম। শাড়ি পরা মহিলা কন্ডাক্টর। আমরা বাস থেকে নেমে এদিক সেদিক দাঁড়াই। অনেকেই ইশারা ইঙ্গিতে খাওয়া দাওয়া কিনে খেতে থাকে। একটা বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে আমরা সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। তারপর আরেকটা বাসে উঠে পড়ি। সেই বাসে আমরা টিকেট কাটি ১৫ রুপির। এই বাস আমাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করে। আল্লাহর ওয়াস্তে সেই যাত্রা আর শেষ হবার নাম গন্ধ নাই। শহর ছেড়ে আঁকা বাঁকা, সরু চিপা, গ্রামের মতন রাস্তা দিয়ে আমাদের বাস হুশ হুশ করে যেতে লাগলো। যখন আমাদের মনে হতে লাগলো যে আমরা বুঝি কেরালা পার হয়ে অন্য কোন দেশে চলে এসেছি, তখন আমরা একটা কাঁচা রাস্তার উপর স্টপেজে নেমে পড়লাম।
নেমে আশেপাশে তাকালাম। এটাই তো সেই জায়গা হওয়ার কথা, কিন্তু চারপাশে তো শুধু গাছ পালা আর জঙ্গল ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ইতস্তত করতে করতে আমরা ঢাল কাঁচা রাস্তা বেয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। তারপর জঙ্গলের ভিতরে খুব সাধারণ একটা গেট পেয়ে সেখান দিয়ে ঢুকে পড়লাম। পেয়ে গেলাম লরি বেকার সেন্টার। জায়গাটা এতই অকৃত্রিম যে বোঝাই যায় না জঙ্গলের মাঝে এখানে কোন স্থাপনা আছে। হাঁটতে হাঁটতে দেখতে লাগলাম ইট আর কনক্রিটের ঢালাই দেওয়া ছাদের ছোট ছোট সব বিল্ডিং। ইট দিয়ে সব বাঁকানো ওয়াল, কার্ভ আর ফ্রি ফর্মের সমাহার দেখলাম খুব সহজভাবে। অত্যন্ত কম খরচে বানানো এই স্থাপনাগুলো আমাদের মুগ্ধ করে দিলো। ঝাঁ চকচকে ব্যাপার ছাড়াও খুব সাধারন স্থাপনাও যে কতটা নান্দনিক হয়ে পারে সেটাই আমরা দেখছিলাম মুগ্ধ হয়ে। কয়েকটা বিল্ডিঙয়ের ভিতরে ঢুকলাম আমরা। বাড়তি কোন ফার্নিচার নাই, সবই বিল্ট ইন- একবারে কনক্রিট ঢালাই বা কাঠ দিয়ে বসানো। রঙ চঙ্গে কাঁচের বোতল দিয়ে চমৎকার স্কাইলাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোথাও এতটুকু বাহুল্য নাই। যা আছে একেবারে মিনিমাল রিকয়ারমেন্ট। একজন মানুষের শুয়ে থাকতে ঠিক যতটুকু জায়গা লাগে ততটুকুই বিছানা, হাঁটা চলার জন্যও সবচেয়ে পরিমিত জায়গা ছাড়া হয়েছে। জায়গাটা সহজেই সবাইকে আপন করে নেয়। কোন শ্রেনির মানুষই মনে হয় এখানে এসে হীন্মন্যতায় ভুগবে না। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম, সারা জীবন সব বড়লোকদের জন্য ডিজাইন করে এসেছি, এই রকম সাধারন ডিজাইনের চ্যালেঞ্জ কখনই পেলাম না।
অনেক ঘুরে ফিরে আমরা বই কিনলাম। লরিবেকারের গাদা গাদা বই। এখানে বইয়ের দাম সবচেয়ে কম। আমি ৯০০ রুপি দিয়ে একগাদা বই কিনে নিলাম। তারপর ওদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বের হয়ে আসলাম সেখান থেকে। সেই ঢাল বেয়ে নামতে নামতেই একটা বাস এসে হাজির হলো আর আমরা হুড়মুড় করে তাতে উঠে বসলাম। সেই বাস আমাদের আবার আগের জায়গায় নামিয়ে দিলো, ‘ইস্ট ফোর্ট’। সেখানে আমরা আরেকটা বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। বাস স্ট্যান্ডের পাশে সারি সারি খাবারের দোকান। রুবাইদা এক দোকান থেকে ‘ কলা বড়া’ জাতীয় এক ধরনের খাবার কিনে নিয়ে আসলো। আমি মুখে দিয়ে দেখলাম খুবই খারাপ খেতে। দোকানে দোকানে বড় বড় কলার কাঁদি ঝুলছে। আমি ১০ রুপি দিয়ে একটা কলা কিনে খেয়ে দেখলাম। আমার মনে হলো কলাটা ঠিক পাকে নাই, কেমন যেন কাঁচা কাঁচা। টেস্ট তেমন আহামরি কিছু না। তবে আমাদের দেশের সাগর কলার ধারে কাছেও নাই। এর মধ্যে আরও অনেকেই এসে জুটলো আমাদের সাথে। ওরা এদিক সেদিক শপিং করছিলো। সবাইকে নিয়েই আমরা একটা বাসে উঠলাম। সেই বাস এক স্কুলের সামনে থামতেই আমরা নেমে পড়লাম। গুগল ম্যাপ দেখে লোকেশন ঠিক বোঝা যাচ্ছিলো না। আমরা আশেপাশে জিজ্ঞেসও করলাম, তবে কোন লাভ হলো না। অনেক কিছু চিন্তা ভাবনা করে আমরা হাঁটতে লাগলাম। প্রচন্ড কড়া রোদ, এরমধ্যে কতদূর যাবো কোন আইডিয়া নাই। তারপরও আমরা হাঁটতে লাগলাম। মায়িশা, নোভা, ঐশিকে দেখলাম অটো ভাড়া করে চলে যেতে। ওরা চলে গেলে আমরা বাকিরা হাঁটতে লাগলাম ফুটপাথ ধরে।
প্রায় ঘন্টা খানেক হাঁটার পর খুঁজে পেলাম ‘কস্ট ফোর্ট’ । এটা এক সময় লরি বেকারের বাসা ছিলো। এখন এটা লরি বেকার ফাউন্ডেশনের অফিস। ছোট্ট সুন্দর দোতলা বাড়িটা আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে ঘুরে দেখলাম। পুরো ঢালুর উপর বানানো বাড়ি। একটুকু নষ্ট করা হয় নাই ঢালটাকে। দরজা, জানালা আর সিড়ির কাঠগুলো সব রিসাইকেলড কাঠ। খুব ভালো লাগলো আমাদের। নিশাত এখান থেকে বই কিনলো, তবে একটু বেশি দাম দিয়ে। এখান থেকে বের হয়ে আবার আমরা দৌড়ে বাস ধরলাম। সেই বাস আমাদের নামিয়ে দিলো ইস্ট ফোর্ট। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেছে। কিছু খাওয়া দরকার। সুমাইয়ার সাজেশনে ৩০ রুপি দিয়ে একটা অটো নিয়ে চলে গেলাম ‘ইন্ডিয়ান কফি হাউজ’ এ। লরি বেকারেরই করা খুবই ইন্টারেস্টিং বিল্ডিং এটা। পুরো বিল্ডিংটাই র্যাম্প। একটা অক্ষকে ধরে পেঁচিয়ে উঠে গেছে। আমরা ভিতরে ঢুকে র্যাম্প বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা খালি বসার জায়গা পেয়ে সেখানে বসে পড়লাম। আমি আর সুমাইয়া মিলে অর্ডার দিলাম ২০ রুপির দুইটা পরোটা আর ৩৫ রুপির ভেজ কোরমা। সেই কলকাতার কফি হাউসের মতন পাগড়ি পরা বেয়ারা এসে অর্ডার নিয়ে গেলো। বেশ অনেক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমাদের খাবার আসলো। সব খাবারই খুব মজা। দামও খুব কমই বলে মনে হলো। আমরা খুব মজা করে গল্প করতে করতে খেলাম। অন্তরা আবার জামের জুস অর্ডার দিয়েছিলো। সেইটাও বেশ মজা ছিলো।
খেয়ে দেয়ে বিল মিটিয়ে দিয়ে আমরা বের হয়ে আসলাম। নিচেই প্রিপেইড অটো কাউন্টার। এখানে যত অটো দাঁড়িয়ে থাকে সেগুলো ভাড়া নিতে হলে আগে ২ রুপির টিকেট কেটে নিতে হয়। আমরা সেরকম একটা টিকেট কেটে একটা অটো ভাড়া করলাম যেটা আমাদের আবার নিয়ে গেলো ইস্ট ফোর্ট। ভাড়া পড়লো ২০ রুপি। সেখানে নেমে আমরা একটা বাসে চেপে বসলাম। এই বাস আমাদের সোজা নিয়ে গেলো কোভালাম। ততক্ষণে দিনের আলো পড়তে শুরু করেছে। বাস আমাদের যেখানে নামিয়ে দিলো, সেই ঢালের সামনে আমরা একটা বড় বাস দেখলাম। সন্ধ্যার সময়ই এই বাসে করেই আমাদের পন্ডিচেরির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার কথা। আমরা তাড়াহুড়া করে ঢাল বেয়ে নেমে হেঁটে হোটেলের কাছে যেতে যেতে দেখলাম উর্মি, অদিতিরা একটা অটো রিক্সা ভাড়া করেছে। মাল্পত্রগুলো অটোরিক্সায় তুলে ওরা ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। দেখে আমার বুকটা ধক করে উঠলো- সর্বনাশ, এই বিশাল ঢালটা পার করে লাগেজগুলো টেনে টেনে নিয়ে যেতে হবে! ওরা না হয় অটো পেলো, আমার কি উপায় হবে? যাইহোক সময় নষ্ট না করে আমরা হোটেলে ঢুকে পড়লাম। আমাদের রুম ভর্তি লাগেজ। কোনমতে লাগেজের স্তুপ পার হয়ে সবাই লাইন ধরে বাথরুম পর্যন্ত পৌঁছালাম। ফ্রেশটেশ হয়ে সবাই যার যার মালপত্র নিয়ে বের হয়ে যেতে লাগলাম। আমি ট্রলি, ব্যাকপ্যাক, সাইড ব্যাগ আর খাবার আর পানির প্যাকেট- এই চারটা জিনিস নিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। জীবনে একটা দারুণ এক্সপেরিএন্স হতে যাচ্ছে নিঃসন্দেহে!
শক্ত হাতে ট্রলি ব্যাগটা টেনে এক কদম এক কদম করে আগাতে লাগলাম। প্রথম কিছুদূর কমই কষ্ট হলো, কয়েক মিনিট পর শুরু হলো সমস্যা। ব্যাক প্যাক, সাইড ব্যাগ আর ট্রলি ব্যাগটা মিলে আমাকে পিছন দিকে টানতে লাগলো। ঢালটা এমনই খাড়া ছিলো যে হাত একটু আলগা হলেই ট্রলি ব্যাগটা পিছন দিকে গড়িয়ে নেমে যাবে। শক্ত করে ব্যাগটা ধরে রাখতে রাখতে হাতের আঙ্গুল গুলোতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে লাল দাগ পড়ে গেলো। এর মধ্যে রাস্তাটাও মসৃণ না। আমাদের দেশের বর্ষা কালে রাস্তায় যেমন বড় বড় গর্ত থাকে সেই রকম গর্তওয়ালা এবড়ো থেবড়ো রাস্তা এটা। এর মধ্যে দিয়েই মাঝে মধ্যে হুউউশ করে অটো রিক্সা যাচ্ছে। তাই ঢালের মধ্যেই একটু পর পর ডানে বামে সরতে হচ্ছে। প্রচন্ড পরিশ্রম হচ্ছিলো। এত জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম মনে হচ্ছিলো যেন পাঁজরের খাঁচাটা ভেঙ্গেই যাবে। এক পর্যায়ে গিয়ে মনে করলাম, এইভাবে আর সম্ভব না। রাস্তার পাশে সব মালপত্র রেখে থামলাম কয়েক মুহূর্ত। থামার সাথে সাথেই টের পেলাম পা দুটোতে কোন অনুভূতি পাচ্ছি না। এই ঢাল বেয়ে উঠতে উঠতেই ওরা যেন অবশ হয়ে গেছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে টের পেলাম গাল মুখ দিয়ে গরম ভাপ এর হচ্ছে। আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম এ ঢালের শেষ কোথায় দেখা যায় কিনা! এর আগে সিমলায় যে ঢাল পার হয়েছিলাম সেটা এটার তুলনায় নস্যি। এটার দৈর্ঘ্য সেই ঢালটার প্রায় চার থেকে পাঁচ গুন বেশি হবে। আমি হাঁপাতে হাঁপাতেই দেখলাম চোখ মুখ লাল করে অন্তরা ইঞ্চি ইঞ্চি করে ওর লাগেজ টেনে টেনে আমার দিকে আগাতে লাগলো। আমাদের দুইজনেরই কাহিল দশা। এখনও অনেকটা পথ বাকি। অন্তরাও খনিকটা জিরিয়ে নিলো আমার সাথে। তেমন কিছু লাভ হলো না। পিঠের বোঝা আর কাঁধের বোঝা তো জায়গা মতনই রইলো। খালি হাতেরটা ছেড়ে দিতেই যা একটু বিশ্রাম হলো। মিনিট তিনেক পরই আবার আমরা রওয়ানা দিলাম। ঘড়ঘড় শব্দ করে আমাদের ট্রলির চাকা চলতে লাগলো পিচ ঢালা পাথুরে রাস্তা দিয়ে। প্রচন্ড পরিশ্রম করে আমরা এক কদম এক কদম করে এগিয়ে যেতে লাগলাম।
এক সময় যখন সত্যি সত্যি ঢালটা পাড়ি দিয়ে ফেললাম হঠাৎ করেই আমার মনে হতে লাগলো আমার চেয়ে সুখি মানুষ বোধহয় এই পৃথিবীতে আর কেউই নাই। এই ঢাল পাড়ি দিয়ে মনে হলো আমি বোধ হয় এভারেস্টও জয় করতে পারবো! নিজেকে কেমন যেন মুসা ইব্রাহিম মনে হতে লাগলো। আচ্ছা মুসা ইব্রাহিম যখন এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলো তখনও কি এই রকম খুশি হয়েছিলো? সমতল রাস্তায় পা দিয়েই আমি বত্রিশ দাঁত বের করে বিশ্বজয়ীর হাসি দিতে লাগলাম। আমাকে দেখে আরও কয়েকজন এগিয়ে এসে এমনভাবে অভিবাদন জানালো যেন আমি বিশাল কিছু করে ফেলেছি! অন্যদের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম সবাই আসলে এই বিশাল ঢাল পাড়ি দেওয়াটাকে বেশ বীরত্বের কাজ হিসেবেই কন্সিডার করছে। আমি মালপত্র টানতে টানতে বাসের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাসের পিছনে লাগেজ রেখে বাসে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। সিট পেলাম প্রথম দিকেই। ব্যাক প্যাকটা রেখে আমি নেমে পড়লাম পানি আর কিছু বিস্কুট কিনে নেওয়ার জন্য। বড় এক বোতল পানি কিনতে গিয়ে দেখতে পেলাম হিমিকে। হিমির গায়ের রঙ টকটকে লাল হয়ে গিয়েছে। সমুদ্রের কারনেই হোক আর ঢাল বেয়ে মালপত্র টেনে তোলাতেই হোক, ওর চেহারায় অসম্ভব ক্লান্তির ছাপ দেখতে পেলাম।
সব কেনাকাটা করে বাসে উঠে বসলাম। বাসটা একেবারেই বিলাসবহুল। আমাদের স্ক্যানিয়া বাসগুলোর মত। বিশাল বড় টিভি স্ক্রিন, আরামদায়ক সব সিট, চওড়া হাতল, দুই সিটের মাঝখানে ব্যাপক জায়গা- এইসব দেখে আমরা দারুণ খুশি হয়ে গেলাম। ইচ্ছমত পা ছড়ানো যাবে- এই সুখ আমরা কোথায় রাখবো সেটা আমরা বুঝতে পারছিলাম না। বাসে একেকজন বলতে শুরু করলো, ‘ আজকে আরামের চোটে রাতে ঘুম আসবে না’ । দীর্ঘদিন গোয়েলের মাপমত সিটে ঘুমাতে ঘুমাতে আমাদের অভ্যাসই হয়ে গিয়েছিলো হাঁটু, ঘাড় আর কোমরের টনটনে ব্যাথা নিয়ে ঘুম দেওয়ার। এত আরামদায়ক বাস পেয়ে আমাদের মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছিলো। সবাই উঠে পড়লে বাস ছেড়ে দিলো। বাসের এসি ছাড়ার সাথে সাথে বাসের তাপমাত্রা আরামদায়ক ঠান্ডা হয়ে গেলো। তখন সবারই মনে পড়ছিলো গোয়েলের কথা। গোয়েলের লোকজন দাবি করেছিলো যে গোয়েল নাকি এসি বাস। কিন্তু আমাদের প্রায় পঞ্চাশ ষাটটা লাগেজ ছাদে রাখতে গিয়ে এসিটা তেরপল দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়েছিলো। এজন্য ঠান্ডার দিনগুলো পার করার পর যখন আমাদের এসিটা ছাড়ার দরকার হয়েছিলো তখন আমরা এসি ছাড়তে পারি নাই। গরমের মধ্যেই অব্যাহত ছিলো আমাদের গোয়েলে যাত্রা। আজকে এসিটা পেয়ে আমাদের মনে হতে লাগলো, ‘এত সুখ কপালে সইবে তো?’
বাস ছাড়তেই কমিটি সারপ্রাইজ হিসেবে সবার হাতে হাতে পাঁচশ রুপি ধরিয়ে দিলো। আমরা খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। অ্যালাউয়েন্স পেয়ে আমরা ফুরফুরে মেজাজে গল্পগুজব করতে লাগলাম। কিছুদূর যেতেই সবাই বলতে লাগলো, ‘সাউথের জার্নিতে সাউথের মুভি না দেখলে কি হয়?’ সবাই চিৎকার করে প্রস্তাবটা সমর্থন দিলো। আমি চিৎকার করে মুভির নাম সাজেস্ট করতে লাগলাম। এর মধ্যে মজুমদার উঠে গেলো মুভি সিলেক্ট করার জন্য। বাসের গাইডের সাথে বেশ খানিক্ষণ কথা বলার চেষ্টা করে মজুমদার আমাদের জানালো, আধুনিক কোন মুভি এই বাসে নাই। রজনীকান্তের একটা মুভি যার নাম ‘বাশহা’ এইটা মজুমদার একবার টিভিতে দেখেছিলো, চাইলে এই মুভিটা আমরা দেখতে পারি। সবাই তাতে রাজি হলো। চালু করা হলো কোন ডাবিং কিংবা সাবটাইটেল ছাড়া তামিল মুভি ‘বাশহা’। শুরুতেই গান, তারপর কঢ় মড়ে তামিল ভাষার ডায়লগ শুনতে শুনতে আমাদের কানে তালা লেগে গেলো। কাহিনী কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কোন কারণ ছাড়াই ধুম ধাড়াক্কা মারপিট শুরু হয়ে গেলো। হটাৎ করেই কাহিনী ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেলো। অনেক বোমা ফুটলো। মন্দির, রথ উড়ে গেলো- শত শত মানুষ মারা গেলো। নায়ক হঠাৎ ভিলেন হয়ে গেলো। সব মিলিয়ে যখন কাহিনী গিট্টুময় হয়ে গেলো তখন পিছন থেকে রিকোয়েস্ট আসতে লাগলো, ‘অনেক হইসে ভাই, বন্ধ কর এই মুভি। তামিল মুভি দেখার শখ উড়ে গেছে, আর নিতে পারতেসি না -প্লিজ বন্ধ কর’ সারা বাসের মধ্যে কেবল আমি আর অন্তরাই নিজেদের মনমত ট্রান্সলেশন করে কাহিনী বানিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু জনতার দাবির মুখে মুভিটা বন্ধই করে দিতে হলো।
মুভি বন্ধ হয়ে যেতেই সবাই ঘুমের দিকে মনোযোগ দিতে লাগলো। আরামদায়ক বিলাসবহুল সিটে ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশে আমরা সবাই ফটাফট ঘুমিয়ে গেলাম। গভীর রাতে আমার ঘুম ভাংলো। বাস থেমেছে একটা স্টপেজে। আমরা বেশিরভাগই নেমে গেলাম। যে জায়গায় নামলাম তার নাম ‘এস ভি হোটেল’। ফ্রেশ টেশ হয়ে আমি, অন্তরা, সীমান্ত আর ফাহাদ রেস্টুরেন্টে ঢুকে একটা টেবিলে একসাথে বসলাম। তখন আরেকটা বাসের লোকজন খাওয়ার অর্ডার দিচ্ছিলো। তাই আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। অন্য কাস্টোমাররা উঠে চলে গেলে আমাদের কাছে লোক আসলো অর্ডার নিতে। আমরা ভেবে চিন্তে অর্ডার দিলাম। হালাল মাংস পাওয়া যায় শুনে চিকেন মাসালার সাথে আমি আর অন্তরা অর্ডার দিলাম পরোটা আর সীমান্ত আর ফাহাদ অর্ডার দিলো ফ্রাইড রাইস। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা প্লেটের উপর পানি দিয়ে ধোয়া কলা পাতার টুকরা বিছিয়ে আমাদের সামনে এসে দিয়ে গেলো। তারপর আসলো খাবার। ৫০ রুপির কড়া মেথির ঘ্রাণওয়ালা দুই পিস চিকেন মাসালার সাথে ৩০ রুপির ছোট্ট গোল গোল হাতের তালুর সমান তিনটা পরোটা। আর ওদের জন্য আসলো চিকন বাসমতি চালের সাথে লাল গাজর আর সবুজ সবজি দেওয়া ফ্রাইড রাইস। আর সাথে টক দইয়ের সাথে পিয়াজের মিষ্টি সালাদ। আমরা খাবারটা মুখে দিয়েই বিমোহিত হয়ে গেলাম। মুরগিটা এতই মজার যে আর বলার মত না! সারা ইন্ডিয়ায় খাওয়া সেরা খাবারগুলোর মধ্যে এই খাবারটা নিঃসন্দেহে একটা। আমি ফ্রাইড রাইসটাও টেস্ট করে দেখলাম -সেটাও দারুণ। খাবারটা এত মজার ছিলো যে মনে হচ্ছিলো আরও একবার অর্ডার দিয়ে খাই। তৃপ্তি নিয়ে খেতে খেতে যারা আসে নাই খেতে তাদের জন্য আমরা আফসোস করতে লাগলাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা যখন বাসে উঠে বসি তখনও আমার হাতে লেগে আছে চিকেন মাসালার গন্ধ।
বাসে উঠে আবার ঘুমের প্রস্তুতি নিলাম। ভরপেট খাওয়া দাওয়ার পর সবাই চাঙ্গা হয়ে অনেক্ষণ গল্পগুজব করলো। তারপর এক সময় একে একে সবাই ঘুমিয়ে পড়তে লাগলো।