খুব ভোরে ঘুম ভাংলো জোর একটা গানের শব্দে। উচ্চস্বরে কোথাও গান বাজছে। বিছানা থেকেই টের পেলাম। বালিশ দিয়ে কান চেপে শুয়ে রইলাম অনেক্ষণ। কিন্তু অত্যন্ত উৎসবমুখর গান। খুব বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে দিলো না আমাদের এত উচ্চস্বরের গান। উঠে পড়লাম আমরা। ফ্রেশটেশ হয়ে নিয়ে বের হয়ে পড়লাম নাশতা খাওয়ার জন্য। আবার সেই আগের রেইন বো রেস্টুরেন্টে এসে পৌঁছালাম। রুবাইদা এখানে খেতে রাজি হলো না। ও চলে গেলো। আমি অন্যদের সাথে বসে অর্ডার দিলাম ৬০ রুপির মাসালা পুরি যেটা আসলে ৩টা লুচি আর ডালের প্যাকেজ। খেতে মোটামুটি। গল্পগুজব করতে করতে খাওয়া শেষ করতে অনেক দেরি হয়ে গেলো। খেয়েদেয়ে বের হয়ে সেই মন্দিরটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। রুবাইদা সেখানে হালকা খাওয়াদাওয়া করে নিচ্ছে। ওর জন্য ওয়েট করলাম। এই ফাঁকে দেখলাম অনেক বয়স্ক মহিলা হাঁড়ি, লাকড়ি, কলা গাছ- এইসব জিনিস মাথায় চাপিয়ে দৌড়ে দৌড়ে মন্দিরের প্রাঙ্গনে ঢুকছে। অনেককে দেখলাম মন্দিরের উঠানে লাকড়িতে আগুন দিয়ে হাড়িটা চাপিয়ে কিছু একটা রান্না করতে। আর উচ্চস্বরে একটানা বেজেই যেতে লাগলো গান। তামিল ভাষার আরতি টাইপের গান হবে হয়তো। তবে গানের সংখ্যা খুব বেশি নয়- তিন থেকে চারটা। এগুলোই বাজতে লাগলো বারবার। তবে স্বীকার করতেই হবে গানগুলো যথেষ্ট উৎসব মুখর। অন্তরা তো শুনতে শুনতে মুখস্ত করেই ফেললো একটা দুইটা গান! ওদিকে খাওয়া শেষে রুবাইদা আবার এক লিটারের ট্রপিকানা গোয়াভা জুস কিনলো। আগের দিনের পমেগ্রান্ডের চাইতে গোয়াভাটা খেতে বেশ ভালো।
আমরা দুইজন সিদ্ধান্ত নিলাম আজকে শাড়ি দেখতে শহরে যাবো। আবার সেই ঢাল পার হয়ে দুইজনে সমতল রাস্তায় এসে পৌঁছালাম। লোকজনকে ইশারা ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে করে একটা বাস স্টপেজে এসে দাঁড়ালাম দুইজনে। এই স্টপেজে প্রথম বারের মতন একজন ‘টাউট’ লোকের সাথে পরিচয় হলো আমাদের। মাঝবয়সী একজন লোক আগ বাড়িয়ে আমাদের জজ্ঞেস করলো আমরা মুসলিম কিনা? আমাদের বেশভূষা দেখেই বোঝা যায় যে আমরা মুসলমান, এইটা জিজ্ঞেস করাটা বাহুল্য। তারপরও আমাদের জবাব শুনে উনি হাসিমুখে কি কি যেন সব বললেন, যার অর্থ হয়, ‘আমি ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম যে তোমরা মুসলমান’। তারপর আমাদের বাস আসতেই লোকটা আমাদের সাথে একই বাসে উঠে পড়লো। বাসের ভিতরে ঢুকে লোকটা তার পাশের সিটে বসার জন্য আমাদের ডাকতে লাগলো। বাস মোটামুটি খালিই ছিলো। আমরা লোকটার পাশে না বসে দূরে গিয়ে বসলাম। লোকটা ঠিকই সিট চেঞ্জ করে আমাদের পাশে এসে বসলো। উনি হাসিমুখে রুবাইদার সাথে আকার ইঙ্গিতে অনেক কথা বলতে লাগলো। আমরা একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। একটু পর টিকেট চেকার আসলো। উনি যেন কি বলে দিলো, টিকেট চেকার হাতে ধরে রাখা মেশিন থেকে ঘ্যাসঘ্যাস করে তিনটা প্রিন্টেড টিকেট বের হতে লাগলো। সেই লোকটা চট করে আমাদের তিনজনের টিকেটের দাম দিয়ে দিলো। আমরা হাতপা নেড়ে বোঝাতে লাগলাম যে আমরা এই লোকটার সাথে যাচ্ছি না। রুবাইদা প্রবলভাবে মাথা নেড়ে বলতে লাগলো যে আমরা দুইজন আলাদা- আমরা যাবো এম জি রোড, কিন্তু টিকেট চেকার ধরেই নিয়েছে যে আমরা তিনজন একসাথে যাচ্ছি। উনি লোকটার হাতে অন্য একটা স্টপেজের টিকেট ধরিয়ে দিলো, যে স্টপেজে লোকটা নেমে যাবে। কন্ডাক্টর চলে যাবার পর ওই লোকটা আমাদের দিকে ভালোমানুষের মতন হাসি দিয়ে বলতে লাগলো যে, ‘ কি যে মুর্খ এরা, কিছুই বোঝে না। তবে তোমাদের কোন সমস্যা হবে না। তোমাদের স্টপেজ আরও পরে’। তারপর লোকটা আমাদের দুইজনের কাছে থেকে ১৫ রুপি করে নিলো বাস ভাড়া বাবদ। আমাদের মনে হলো আসলে ভাড়া হয়তো ১০ রুপি, উনি ওনার ভাড়াটা আমাদের উপর দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু কিছু বলার নাই, টিকেট ওনার হাতে, আবার ভাষাও বুঝি না। আমরা একটু অসন্তুষ্ট হয়ে ওনাকে ১৫ রুপি করে দিয়ে দিলাম। লোকটা একটু পরেই নেমে গেলো, এমন কি নামার সময়ও আমাদের দিকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। লোকটা চলে গেলে আমরা একটু হাঁফ ছাড়লাম, যাক বেশি লস যায় নাই!
লোকটা নেমে যেতেই কন্ডাক্টর আমাদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সে তখন প্রথমবার বুঝতে পারলো যে আমরা তিনজন আসলে একসাথে যাচ্ছি না এবং আমরা হাত পা নেড়ে তাকে এই কথাই বুঝাতে চেয়েছিলাম। সে কাছে এসে ইশারায় আমাদের সরি বললো। তারপর আবার জানতে চাইলো যে আমরা কোথায় যাবো। এবার এম জি রোডের কথা বলতেই নতুন করে আমাদের ৭ রুপির টিকেট কেটে দিলো। ভুল করার জন্য লোকটা আবার আমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো। এতক্ষণ ভালোমত চার পাশ দেখতে পারি নাই। এবার খেয়াল করে দেখলাম বাসগুলো অনেক চওড়া, ফাঁকা ফাঁকা সিট, জানালাতে গ্রিল দেওয়া। বিশাল বাসটার আন্দাজে লোকজন অনেক কম। একেকটা স্টপেজে এসে বাস থামে, লোকজন চাপ দিয়ে লক করা দরজা খুলে উঠে পড়ে। সবার শেষে যে উঠে সে দরজা টান দিয়ে লক করে একটা ঘন্টা বাজিয়ে দেয়, ড্রাইভার বাস চালাতে শুরু করে। আবার কেউ নামতে চাইলে ঘন্টা বাজিয়ে দেয়, ড্রাইভার ব্রেক কষে বাস থামিয়ে দেয়। সে নেমে গিয়ে আবার টান দিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। বাসে চড়া এখানে খুব আরামের। এত ছিমছাম পাবলিক ট্রান্সপোর্ট- আমাদের দেশে তো কল্পনাই করা যায় না!
আমরা আগেই বলে রেখেছিলাম যে এম জি রোড আসলেই যেন আমাদের বলে দেওয়া হয়। এম জি রোড আসতেই কন্ডাক্টর আমাদের ইশারা করলো। আমরা বাস থেকে নেমে দরজা টান দিয়ে লাগিয়ে দিলাম। বাস হুশ করে চলে গেলো। আমরা চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম। ঠিক শহর বললে চোখের সামনে যা ভেসে আসে, এটা ঠিক তেমন লাগলো না। চারপাশে অনেক উঁচু উঁচু কাঁচ ঘেরা বিল্ডিং আছে বটে, কিন্তু রাস্তাঘাট অস্বাভাবিক ফাঁকা। লোকজন তেমন নাই বললেই চলে। এদিক ওদিক তাকিয়ে আমরা আন্দাজে হাঁটতে লাগলাম। একটা দোকানে দেখলাম কলা ভাজা বিক্রি হচ্ছে। এর আগে বইয়ে পড়েছিলাম বলে আমার আগ্রহ হলো চেখে দেখার। আমি ১০ রুপির কলা ভাজা কিনে নিলাম। খেতে মজা লাগলো না। কাঁচা কলা প্রসেসিং করে রোদে শুকিয়ে মশলা মাখিয়ে তেলে ভাজা হয়েছে। সেই দোকান ভর্তি শুকনা কলা আর কাঁঠালের স্লাইস। মনে হয় এইগুলো দিয়ে তরকারি রান্নাও হয়। রুবাইদা এর ওর সাথে অল্পবিস্তর কথা বলার চেষ্টা চরিত্র করে আবিষ্কার করলো যে এখানকার সবচেয়ে বড় শাড়ির দোকান ‘পোথি’। আমরা ডিরেকশন বুঝে হাঁটতে লাগলাম সোজা রাস্তা ধরে। হাঁটতে হাঁটতেই পেয়ে গেলাম জয়লক্ষী নামের দোকান যেটা ওদের ভাষায় ‘জায়লাক্সমি’। ঠিক দোকান না, অনেকটা আমাদের গুলশানের শপার্স ওয়ার্ল্ডের মতন। একটা জমিতে একটাই বিল্ডিং, পুরোটাই একটা দোকান। আমরা চারপাশ দেখে ঢুকে পড়লাম সেই দোকানে। আরিব্বাস, শাড়ির জগতে এসে পড়েছি যেন! একেকটা ফ্লোরে একেকটা টাইপের শাড়ি। আমরা ঢুকতেই একগাদা সেলস গার্ল এসে জিজ্ঞেস করতে লাগলো কোন ধরনের শাড়ি দেখত চাই- এইসব। কারনটা একটু পরে বুঝলাম। এত বড় দোকানে ওরা ডিরেকশন না বলে দিলে কেউ শাড়ি খুঁজে পাবেই না!
রুবাইদা কি কি সব বলাতে আমাদের পাঠিয়ে দিলো চার তলায়। আমরা লিফটে করে চার তলায় উঠলাম। সেখানে আমাদের খুব আদর যত্ন করে বসালো। টপাটপ অনেকগুলো শাড়ি বের করে দেখালো। শাড়িগুলো যেমন সুন্দর, তেমনই দাম। রুবাইদা কালো রঙের কথা বলতেই সেলস গার্লটা উঠে কই যেন চলে গেলো। আমরা বসে রইলাম। আমাদের পাশেই এক ফ্যামিলি কনের জন্য বিয়ের শাড়ি কিনতে এসেছে। কয়েকজন সেলস গার্ল টপাটপ করে কনেকে বিয়ের শাড়ি একটার পর একটা গায়ে জড়িয়ে পরিয়ে দেখাচ্ছিলো। খুব কম সময়ের মধ্যে ওরা ব্লাউজ পিসসহ জামার উপর দিয়ে এমন করে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে দেয় দেখে মনে হয় যেন সত্যি সত্যি ব্লাউজ সহ শাড়িটা পরানো হয়েছে। কয়েকটা পরার পর ফাইনালি একটা শাড়ি সিলেক্ট করতেই ওরা কোথা থেকে এক বিশাল কারুকাজ করা ছাতা বের করে আনলো। তারপর কনেকে সেই ছাতার নিচে দাঁড় করিয়ে প্রফেশনাল ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলানো হলো। আর আশেপাশের সব সেলস গার্লরা জোরে হাততালি দিয়ে উঠলো। আমি আর রুবাইদা হাঁ করে সব দেখতে লাগলাম। ততক্ষণে রুবাইদার সেলস গার্ল প্রায় বিশটার মতন কালো শাড়ি নিয়ে এসেছে। আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে শাড়িগুলো দেখলাম। কিন্তু এখনই হুট করে কিনে ফেলাটা মনে হয় ঠিক হবে না ভেবে উঠে চলে আসলাম। আমরা বাকি ফ্লোরগুলোও ঘুরে ঘুরে দেখলাম। প্রত্যেকটা টাইপের শাড়ির জন্য আলাদা আলাদা সেকশন। এবং প্রত্যেক সেকশনে দামের রেঞ্জ অনুযায়ী আলাদা আলাদা সাব সেকশন করা আছে। এত সুন্দর অ্যারেঞ্জমেন্ট যে একজন ক্রেতার আসলে কোন সমস্যাই হওয়ার কথা না। বাজেট অনুযায়ী শাড়ি পছন্দ করার জন্য এরচেয়ে নির্ঝঞ্ঝাট কোন পদ্ধতি হতেই পারে না!
পুরোটা দেখে আমরা বের হয়ে আসলাম। তারপর আবার হাঁটতে লাগলাম ‘পোথি’র উদ্দেশ্যে। হাঁটতে হাঁটতেই রুবাইদা কানের দুল কিনলো, আমি পার্স কিনলাম। তারপর অনেক দূর গিয়ে একসময় পেলাম ‘পোথি’। এটাও আগেরটারই মত। তবে আগেরটা ফাঁকা ফাঁকা ছিলো, আর এটাতে আছে উপচে পড়া ভিড়। অনেক লোকজনের সাথে যখন দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম দেখলাম, এটা আরেকটা শাড়ির জগৎ। আগের দোকানটার মত অত সাজানো গোছানো নয় এটা। যেখানেই একটু জায়গা আছে সেখানেই টাল করে রাখা আছে শাড়ির স্তুপ। আমরা ঢুকে শাড়ি দেখতে লাগলাম। একটা মজার জিনিস আবিষ্কার করলাম আমরা। এখানে একই শাড়ি অনেক গুলো কোয়ালিটির পাওয়া যায়। যেমন একই শাড়ি ৫০০০ রুপি থেকে শুরু করে ৯০০ রুপিতেও পাওয়া যাচ্ছে। এতে সুবিধা হলো, শাড়ি পছন্দ হলে দামের জন্য কেউ ফেরত যাবে না। প্রত্যেকের সাধ্যের মধ্যে শাড়িটার কোন না কোন কোয়ালিটি পাওয়াই যাবে। একটু এগিয়ে যেতেই আমরা দেখতে পেলাম নিশাত, রিন্তু, তমা আর পৃথ্বীকে। পৃথ্বীর হাতে চারটা শাড়ির প্যাকেট। নিশাত ভারি সুন্দর একটা শাড়ি কিনলো। রিন্তুর কেনা থান কাপড়টা আমার খুব পছন্দ হলো। কিন্তু আমি কিনতে গেলে জানতে পেলাম, সেই থানে আর জামা বানানোর জন্য যথেষ্ট কাপড় নাই। আমরা এদিক ওদিক ঘুরে দেখতে লাগলাম। রুবাইদা কয়েকটা শাড়ি পছন্দ করে ফেললো। এত হাজার হাজার শাড়ি দেখে আমাদের মাথা কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছিলো, তাই কোনটা কিনবে রুবাইদা ভাবতে ভাবতেই বের হয়ে আসলাম আমরা।
সকাল থেকেই হাঁটা হচ্ছে, দুপুরে কিছু খেয়ে নেওয়া প্রয়োজন। দেখলাম পোথির বাইরেই সারি ধরে খাবারের দোকান। অনেক মানুষজন খোলা আকাশের নিচে বসে খাচ্ছে, অনেকটা আমাদের সীমান্ত স্কয়ারের মতন। আমরাও সিদ্ধান্ত নিলাম এখান থেকেই খেয়ে নিবো। সবগুলো দোকান ঘুরলাম আমরা। খাবারের মেনু অদ্ভূত ভাষায় লিখা। দেখে আমাদের পেট ফেটে হাসি পাচ্ছিলো। উদ্ভট খাবার কিনে ধরা খেতে ইচ্ছা করছিলো না। তাই সেফ সাইডে থাকার জন্য আমরা অর্ডার দিলাম ৭৫ রুপির কেরালা মিল। একটা বিশাল থালায় সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো মাড়সহ মোটা চালের ভাত, দুইটা বড় বড় পাপড়, শুকনা মরিচ দেওয়া কচু আর নারিকেলের তরকারি, একটা টকটকে লাল রঙের ভাজি, টক নারিকেল আর টক দই। আমরা দুইজনে খেতে খেতে গল্প করছিলাম। খেতে খেতেই রুবাইদা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো যে ও কি কি শাড়ি কিনে ফেলবে। সেই লাল রঙের ভাজিটা ছাড়া বাকি সব খেতে ভালোই ছিলো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে গলাটা শুকিয়ে গেলো। সেখানেই একটা আমুল আইস্ক্রিমের দোকান ছিলো। সেখানে ‘শারজাহ’ নামের একটা ড্রিংকস দেখে আমার খুবই পছন্দ হলো। ৫০ রুপির এক গ্লাস শারজাহ অর্ডার দিয়ে দিলাম। রুবাইদা আমাকে বসিয়ে রেখে আবার পোথিসের ভিতর ঢুকলো শাড়ি কিনে আনতে। আমি বসে রইলাম। একটু পরেই শারজাহ চলে এলো। আহ- কি মজা। এক গ্লাস অত্যন্ত ঘন মিল্ক শেকের মতন একটা জিনিস, তাতে বাদাম, চকোলেট আর আইসক্রিম দেওয়া। আমার খুবই মজা লাগলো খেতে। আমার শারজাহ শেষ হওয়ার আগেই রুবাইদা চলে আসলো। ও এসে আরও একটা শারজাহ অর্ডার দিলো। আমরা দুইজনে বসে বসে শারজাহ খেতে লাগলাম।
এবার আমরা ধীরে সুস্থে ঘুরতে লাগলাম। ঢুকলাম ‘বিগ বাজার’ এ। বিগ বাজারে সব অফার ওয়ালা জিনিসপত্র থাকে। কমদামে ভালো জিনিসই পাওয়া যায়। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম সবকিছু। আমি ওয়াফির জন্য দুইটা বই কিনলাম। বিগ বাজার থেকে বের হয়ে কতগুলো খুব সুন্দর অ্যাংরি বার্ডের চাবির রিং পেলাম। আমি ২০ রুপি করে পাঁচটা কিনলাম। এরপর হাঁটা ধরলাম সোজা। আমার খুব শখ ছিলো সাউথে এসে সাউথের সিনেমা হলে সাউথের মুভি দেখবো। তাই একটা সিনেমা হলে গিয়েছিলাম কি মুভি চলে দেখতে। সেখানে দেখলাম সুপার স্টার ধানুশের একটা মুভি চলছে। সিনেমা হলের বাইরে ‘অল ইন্ডিয়া ধানুশ ফ্যান ক্লাব’, ‘ধানুশ ফ্যান ক্লাব অফ কেরালা’ এইসব নামের বড় বড় ব্যানার ঝুলছে। সিনেমা যে সাউথের মানুষের জীবনের একটা বিরাট অংশ, এগুলো দেখেই সেটা আন্দাজ করা যায়। আমরা যখন যাই তখন কোন কারণে হলটা বন্ধ ছিলো। আমাদের দেখে দারোয়ান তড়িঘড়ি করে বের করে দিয়ে গেট বন্ধ করে দিলো। কথা বলেও কোন লাভ নাই, কারণ ভাষা তো বুঝি না!
সিনেমা হলটা ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে আসতেই অনেক রেললাইনের জাংশন দেখতে পেলাম। তারপর একটু ভিতরের দিকে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে বড় একটা মন্দির পেয়ে গেলাম। মন্দির ঘিরে ব্যাপক সাজ সাজ রব। মনে পড়লো আজকে শিব রাত্রি। এমন উৎসবের দিনে একটু ঘুরে দেখাই যায় মন্দিরটা। সেই চিন্তা করে আমরা দুইজন হাঁটতে লাগলাম মন্দিরটার দিকে। কাছে গিয়ে জানতে পারলাম মন্দিরটার নাম শ্রী পদ্মনাভ স্বামী টেম্পল। মন্দিরের সামনের রাস্তায় বাঁশ ফেলে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা দুইজনে সাবধানে বাঁশটা পার হয়ে সামনের রাস্তায় গেলাম। অনেক মানুষ রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে। বেশির ভাগই সাদা পোশাক। ছেলেরা সাদা শার্টের সাথে সাদা লুঙ্গি আর মেয়েরা সাদা শাড়ি বা লাঙ্গা। রাস্তার দুপাশ ধরে চেঞ্জিং রুম। অনেককেই দেখছিলাম অন্য জামা কাপড় পরে এসে চেঞ্জিং রুমে জামা বদলে লুঙ্গি পরে নিতে। সবাইকে দেখে বেশ অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের মানুষজন বলেই মনে হলো। অনেক স্কুল কলেজ পড়ুয়া কম বয়সী স্মার্ট ছেলেদের দেখলাম ফ্যাশনেবল শার্ট আর টি শার্ট বদলে সাদা শার্ট আর লুঙ্গি পড়তে। মনে হলো এটাও বুঝি উৎসবের একটা অংশ, সবাই থাকবে সাদা পোশাকে।
এত সাদার মাঝে আমাদের দুইজনকে যে খুবই অদ্ভূত লাগছিলো, সেকথা আর না বললেও হয়। যাই হোক এসেছি যখন, মন্দিরটা দেখেই যাই। অনেক উঁচু সিঁড়ি পার হয়ে মন্দিরের দোরগোড়ায় দেখতে পেলাম মেটাল ডিক্টেটর হাতে নিয়ে পুলিশ আর্চ ওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সবাইকে তল্লাশি করেই ভিতরে ঢুকাচ্ছে। আমাদের দেশে অনেক মন্দিরেই গিয়েছি। ইন্ডিয়ার অন্যান্য মন্দিরও ঘুরেছি, কিন্তু কোথাও এমন সিকিউরিটি দেখি নাই। আমি আর রুবাইদা আড়চোখে একজন অন্য জনের দিকে তাকালাম। আমি ঢোক গিলে পুলিশকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলাম আমরা ভিতরে যেতে পারবো কিনা। পুলিশটা এক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো খানিক্ষণ। পাশের আরেকজন জিজ্ঞেস করলো, ‘ হিন্দু হোঁ?’। আমরা মাথা নেড়ে জবাব দিলাম ‘না’। ওনারা হাবেভাবে বুঝিয়ে দিলো ভেতরে যাওয়া যাবে না। এরমধ্যে প্রথমজন গিয়ে তার বসকে ডেকে এনেছে। লোকটা জিজ্ঞেস করলেন যে আমরা কোন ধর্মের লোক, কোথা থেকে এসেছি, কোথায় থাকি এইসব এইসব। তারপর ভদ্রভাবে বললেন যে ভিতরে ঢোকা সম্ভব নয়। আমরাও আর কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পড়লাম। তারপর হাঁটতে লাগলাম রাস্তার দিকে। মন্দিরের সামনের রাস্তা থেকেই আমি আর রুবাইদা পার্স আর ব্যাগ কিনলাম।
আরও খানিক্ষণ হাঁটাহাঁটি করার পর একটা মার্কেট দেখে মনে হলো একটু ঢুকে দেখি ভিতরে। কেমন যেন অন্ধকার, লোকজন নাই- ভুতুড়ে পরিবেশ। আমরা আবার তাড়াতাড়ি বের হয়ে পড়ি সেখান থেকে। তারপর বড় রাস্তাটা পার হয়ে যাই আরেকটা শাড়ির দোকানে। সেটার নাম ‘কল্যান’। এই দোকানটা বাকি দুইটার চেয়ে তুলনামূলক ছোট। চারতলা বিল্ডিং জুড়ে পুরোটাই শাড়ির দোকান। এখানেও রুবাইদার শাড়ি পছন্দ হলো। কালেকশন একটু কম থাকায় রুবাইদার বরঞ্চ সুবিধাই হলো পছন্দ করতে। সেলস গার্লরা আমাদের পিছন পিছন ঘুরতে লাগলো জোঁকের মতন। সব দেখেটেখে রুবাইদা আরও তিনটা শাড়ি কিনে ফেললো। আমরা দোকানে থাকতে থাকতেই তমা আর সৃষ্টিকে দেখলাম দোকানে ঢুকতে। দেশের বাইরে এসে যেখানেই দ্বিমিকবাসীর সাথে দেখা হয় সেখানেই আমরা বেশ কোলাকুলি করে ফেলি, তখন অন্যরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ওদের সাথে হাই হ্যালো করেই আমরা নেমে গেলাম নিচে। বিলটিল দিয়ে যখন আমরা বের হই, তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে।
কল্যানের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম যে কোভালাম যাওয়ার বাস কোথায় থামে। সামনেই বাস স্টপেজ দেখিয়ে উনি আমাদের অপেক্ষা করতে বললো। একটু এগিয়ে স্টপেজে গিয়ে দাঁড়াতেই দশ পনের মিনিটের মধ্যেই একটা বাস চলে আসলো। আমরা তাতে উঠে পড়লাম। ঠিক আগের মত আরামদায়ক, চওড়া আর প্রায় ফাঁকা বাস। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে শোঁ শোঁ করে আমাদের বাস চলতে লাগলো। কন্ডাক্টর আসতেই ১৬ রুপির টিকেট কাটলাম কোভালামের। তবে এই কন্ডাকটরও ভাষা বোঝে না। তাই কোভালাম আসলে যে আমাদের ডেকে দিতে হবে সেই কথাটা ওনাকে বোঝাতে পারছিলাম না। তারপর দেখলাম দুইটা সাদা চামড়ার টুরিস্ট মহিলা আমাদের বাসে বসে আছে। আমরা ভাবলাম এরা নিশ্চয়ই কোভালামই যাচ্ছে। আমরা তক্কে তক্কে রইলাম। ঠিকই একটা স্টপেজ কাছাকাছি আসতেই ঐ দুইজন উঠে দাঁড়ালো। আমরাও জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে লাগলাম যে কোথায় এসেছি। তিনদিন ধরে কোভালামে আছি। তাই স্টপেজটা চিনতে আর ভুল হলো না। বাস থামতেই আমরা নেমে পড়লাম। দুইজনের দুই হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ। এই নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে ঢালের দিকে যেতে লাগলাম আমরা।
আজকে সকালেই তানভীর আর জেরিনকে বলতে শুনেছিলাম ফার্স্ট ক্লাস হালাল মাংস পাওয়া যায় একটা হোটেলে। ঢাল ধরে হেঁটে হেঁটে আসার সময় চোখে পড়ে গেলো ওদের বর্ণনা অনুযায়ী সেই হোটেলটা। আমরা ঠিক করলাম একবারে খেয়ে দেয়েই হোটেলে যাই। হোটেলটার নাম ‘ইশা রেস্টুরেন্ট’। টিনের চাল দেওয়া খুব সাধারণ একটা দোকান। আমরা যখন ঢুকলাম সেখানে, আমরা ছাড়া আর কোন কাস্টোমারই ছিলো না। আমাদের যত্ন করে বসালো। ওরা আমাদের ভাষা চমৎকার বুঝলো। জানালো মুরগি, গরু সবই আছে। আমরা অর্ডার দিলাম ১০ রুপির রুটি আর ৩০ রুপির গরুর মাংস। মাংস রান্নাটা এত মজা যে আর কি বলবো! খুব তৃপ্তি করে আমরা খেতে লাগলাম। সাথে নিলাম ৮ রুপির ইড়িউপ্পাম নামের আরেকটা জিনিস। এটাও ইডলি জাতীয় ভাপা পিঠার মতন কেমন যেন চালের গুড়ির নুডুলস দিয়ে বানানো মনে হলো। খুব মজা লাগছিলো আমাদের খেতে। খেতে খেতেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম যে এখন থেকে প্রতি বেলাই এখানে খাবো। এমন সময় এক হাসিখুশি বিদেশি টুরিস্টের আগমন হলো। লোকটা পুরোদস্তুর ইন্ডিয়ান সাধু বাবা টাইপের গেট আপ নিয়েছে। রেস্টুরেন্টের লোকজন তার গেট আপের অনেক প্রশংসা করলো। লোকটাও খুশি মনে খাওয়া অর্ডার দিয়ে খেতে শুরু করলো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা বিল দিয়ে বের হয়ে গেলাম সেখান থেকে।
বের হতেই রুবাইদা আমাকে জানালো যে ঐ বিদেশি লোকটা পর্ক বা শুকরের মাংস অর্ডার দিয়েছে। শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম- কই, আমাদের তো মেনু বলার সময় একবারও বলে নাই যে পর্ক পাওয়া যায়। মুসলমান দেখেই হয় তো চেপে গিয়েছিলো বিষয়টা। রুবাইদা সাজেশন দিলো এইখানে আর না আসার, কারণ হয় তো পাশাপাশি হাড়িতে একই খুন্তি দিয়ে রান্না হয় মুরগি, গরু আর শুকর। বলা তো যায় না! আমার আফসোস লাগলো, ইশ- কি মজাটাই না ছিলো খাওয়াটা……
হেঁটে হেঁটে যতই হোটেলের কাছে যেতে লাগলাম, কানে বাজতে লাগলো সকালের সেই গান। সকাল থেকে শুরু করে সারাদিন চলছে একই গান। একটা গানের কথা অনেকটা এইরকম, ‘-নামাশ্যিবায়ে, নামাশ্যিবায়ে/ওম নামাশ্যিবায়ে-’। এর মধ্যে আমরা হোটেল পৌঁছে গেলাম। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই আমরা আমাদের শপিংয়ের জিনিসপত্র সব বের করে দেখতে লাগলাম। এত এত জিনিস আমাদের লাগেজে ভরে রাখাটাও বেশ কষ্টসাধ্য কাজ ছিলো। আমরা বেশ ক্লান্ত ছিলাম। সারাদিন কম তো ঘোরাঘুরি হয় নাই! গোছগাছ করতে করতেই মজুমদার আর মৌলি এসে পড়লো। সারা দিনের কথা শুনে মজুমদার বললো জানালো পদ্মনাভ মন্দিরটা খুবই উচ্চ গোত্রের হিন্দুদের জন্য। বিধর্মী তো দূরের কথা, সব হিন্দুরাই সেখানে ঢুকতে পারে না। সেখানে আমাদের দুইজনের ভিতরে ঢুকতে যাওয়াটা বেশ সাহসিকতার কাজ হয়ে গেছে। যাক বাবা, এজন্য যে কোন ঝামেলায় পড়তে হয় নাই সেজন্যই আমরা খুশি হলাম। এর মধ্যে আমি ভাবলাম হোটেলের সামনের মন্দিরটাতেই এত লাইটিং করা হয়েছে, এটাই একবার দেখে আসি। আমি বের হলাম মন্দিরটা ঘুরে আসার জন্য। ভাবলাম হয় তো আমাদের দেশের মন্দিরগুলোর মত বেদির উপর বড় কোন মূর্তি থাকবে, কিন্তু ভিড়ের মধ্যে কোন মূর্তি দেখতে পাচ্ছিলাম না। কাঁচ ঘেরা একটা জায়গায় অনেক ভিড় ছিলো তবে সেটার ধারে কাছেই যেতে পারলাম না। বলতে গেলে প্রায় কিছুই না দেখে আবার হোটেলে ফিরে গেলাম।
যখন ঘুমাতে বিছানায় যাচ্ছিলাম, তখনও কানের কাছে বাজছিলো মন্দিরের সেই গান। রাত হয়ে যাওয়ায় চারপাশ আরও চুপচাপ হয়ে গেছে। গানে শব্দটা আরও জোরে কানে এসে লাগছে। কিন্তু কিছু করার নাই। কানে বালিশ চেপে শুয়ে পড়লাম। তবে ঘুমটা ঠিকমত আসলো না। কিন্তু কিছু করার নাই, উৎসবমুখর গানগুলোর মধ্যেই ঘুমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম আমি।