আমার বেকুব হওয়ার কাহিনী (পর্ব ১): সিন্ধু সভ্যতা এবং আলেক্সান্ডার

খুব ছোটকালে বাঙালি জাতি সম্পর্কে চমৎকার ধারনা পেয়েছিলাম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে। কবিতার কয়েকটা লাইন এরকম ছিলো,

”অলস দেহ ক্লীষ্ট গতি-
গৃহের প্রতি টান।
তৈল-ঢালা স্নিগ্ধ তনু
নিদ্রারসে ভরা,
মাথায় ছোট বহরে বড়
বাঙালি সন্তান।”

কবিতাটা পড়ে তখন থমকে গিয়েছিলাম। মনে মনে ভাবলাম সত্যি সত্যি বাঙালি কি এমন? নাহলে কবিগুরু তো আর এমনি এমনি লিখে যাননি। আস্তে আস্তে সব কিছু আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে এলো, কবিগুরু কোন ফালতু কথা বলে যাননি। বাঙালি আসলেই এমন। এটা বোঝা অবশ্য কঠিন কিছু না। আমরা পরপর তিনবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন, এটা কি এমনি এমনি সম্ভব? আমার বিদেশে থাকা কাজিনদের কাছ থেকে শুনতে পাই বাঙালি পরিচয় দিলে ওদের কতরকম অসুবিধা হয় কারন ওদের দেশে সকল প্রকার অপরাধ কর্মের সাথে সাথে কমপক্ষে এক জন বাঙালি জড়িত থাকবেই। এক কাজিন তো বলেই ফেললো কোনভাবে ন্যাশনালিটি বদলানো যায় কিনা! তাছাড়া সব কাজে বাঙালি নিজেকে নিজেই ব্যাঙ্গ করে, যেমন- বাঙ্গালির টাইম বলে একটা কথা আছে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি এটা কোন বিদেশি মানুষ বলে যাননি। বাঙালি যে সময়ানুবর্তীতার প্রতি কেমন উদাসীন তা প্রমান করার জন্যই নিজেরাই এই প্রবচন চালু করেছে। যতই বড় হচ্ছি ততই দেখছি বাঙালি হিসেবে আসলে বড় গলায় বলার কিছু নেই। আমাদের গর্ব করার বিষয় শুধু বায়ান্ন, একাত্তর আর ড. মুহম্মদ ইউনুস। এছাড়া এত বিশাল জাতি হিসেবে আমাদের সত্যিকার অর্থে অর্জন খুব বেশি কিছু নাই।
আমি এই ধারনা নিয়েই এত বছর বেড়ে উঠেছিলাম। অন্তত কয়েক মাস আগ পর্যন্ত আমার বাঙালি জাতি সম্পর্কে এই ধারনাই ছিলো। কিন্তু রমজান মাসের এক শনিবার হঠাৎ আমি ধাক্কা খেলাম। যে সে ধাক্কা না, বেশ বড়সড় ধাক্কা।

আমাদের লেভেল-১, টার্ম-২ এ নতুন একটা কোর্স পেলাম যার নাম হিস্ট্রি অফ বেঙল আর্কিটেকচার। খুব স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছিলাম প্রচন্ড বোরিং একটা ক্লাস হবে। কিন্তু ক্লাসে ঢুকে স্যার প্রথম যে কথা বললেন শুনে হচকিয়ে গেলাম। স্যার আমাদের খুব সিম্পল প্রশ্ন করলেন, বাংলাদেশে কয়টা নদী আছে? বেশ অবাক হয়ে আমি আবিষ্কার করলাম প্রশ্নের উত্তরটা তো আমি জানিনা। শুধু আমি যে জানিনা তা নয়, ক্লাসের কেউই সঠিক উত্তরটা জানে না। স্যার বললেন, ”আমাদের দেশ সম্পর্কে আমরা শুধু এটা জানি যে আমরা আসলে কিছুই জানি না”। লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেলো। স্যার জানতে চাইলেন আমাদের প্রধান খাদ্য চালের বাৎসরিক চাহিদা সম্পর্কে। আমরা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। স্যার বোর্ডে বিশাল সংখ্যাটা লিখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”আমরা পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশের একটা হয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি খাবার চাল খাই। শুধু খাই না, সবটাই নিজেরা উৎপাদন করি। এটা মোটেই কম কথা নয়”। খানিকপর স্যার বললেন আমাদের ইতিহাসের কথা। মহেঞ্জদারো, হরপ্পা, সিন্ধু সভ্যতার কথা। খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সালে গড়ে ওঠা সে শহরে ছিল ড্রেনেজ সিস্টেম, অ্যাটাচড বাথরুম, আন্ডার গ্রাউন্ড ওয়াটার স্টোরেজ। একই সময়ে ইংল্যান্ডে চলছে স্টোনহেঞ্জের যুগ! শুনে আমি কেমন যেন বেকুব হয়ে গেলাম। আমাদের ভারতবর্ষে যখন প্ল্যানড সিটি, ইংল্যান্ডে তখন মাত্র স্টোনহেঞ্জ!! স্কুল কলেজে শিক্ষা নিতে নিতে জীবনের ১২ টা বছর পার করলাম, অথচ আমাদের ইতিহাসের এই সাংঘাতিক কথাটা আমি জানতাম না। কি আশ্চর্য!!!

পরের ক্লাসগুলোতে আরও ধাক্কা খেলাম। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে যখন আলেক্সান্ডার ভারতবর্ষ আক্রমন করে, তখন পুরো ভারতবর্ষ দখল করলেও মাত্র দুটো এলাকা আক্রমন করে নাই। সত্যি বলতে আক্রমন করার সাহস পায় নাই। সে এলাকার দূর্গ এবং রক্ষণ ব্যবস্থা এতই উন্নত ছিলো যে আলেক্সান্ডারের নীতিনির্ধারকেরা সে দিকে আক্রমণ করার চিন্তা ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়েছিলেন। সে জায়গা দুটোর নাম ছিলো গঙ্গারিডো আর প্রাসিওই। নাম দুটো গ্রীকদের দেওয়া। যখন নাটকীয়ভাবে স্যার বললেন প্রাচীন এই দুটো জায়গাকে বর্তমানে বাংলাদেশ বলা হয়, আমার মাথায় বাজ পড়লেও আমি এত অবাক হতাম না। কি সাংঘাতিক কথা, আমার দেশ এত উন্নত ছিলো! আলেক্সান্ডার দ্যা গ্রেট পর্যন্ত এই দেশ আক্রমন করতে সাহস পায় নি। হায় খোদা! নিজের দেশের এই কথা আমি এত বছর জানলাম না, কি পোড়া কপাল!!

আগে বাঙালি হিসেবে মানসিকভাবে ‘একটু’ দূর্বল ছিলাম, এখন আমি আর দূর্বল না। আমার ভারতবর্ষ, আমার দেশের ইতিহাস মোটেও হেলাফেলা করার মত না। শুধু দুঃখের ব্যাপারটা হলো, এই সাংঘাতিক ইতিহাসগুলো আমরা কেউই জানি না। এই স্যার না বললে আমরাও কোনদিন জানতে পারতাম না।

চাঁদটা শুধু ওঠার অপেক্ষা

এবার শুধু অপেক্ষার পালা। দীর্ঘ এক মাস ধরে চলা প্রস্তুতির সমাপ্তি পর্যায়ে দাঁড়িয়ে সকলে একবার করে হিসেব করে নিচ্ছেন ঈদের কি কি প্রস্তুতি এখনও বাকি রয়ে গেছে।

শবে ক্বদর শেষে আরও কয়েকটা রোজা বাকি থাকলেও ইফতারির দোকানগুলোতে হাঁড়ি পাতিল গোছানোর ভাব শুরু হয়ে গেছে। বাইরের মানুষ ইতোমধ্যে ঢাকা শহর ছেড়ে চলে গিয়েছে। গাড়ির হর্নমুক্ত, জ্যামহীন ঢাকা শহরের রাস্তায় নেমে ‘অরিজিনাল’ ঢাকাবাসীদের মুখের হাসি চওড়া হচ্ছে। টেলিভিশনে বাড়ি ফেরার বিজ্ঞাপনগুলো (বিশেষ করে গ্রামীনফোনের) প্রচার করা হচ্ছে। যারা এখনও বাড়ি ফিরতে পারেননি তারা লাস্ট চান্স হিসেবে বাসের ছাদ, লঞ্চের ছাদ আর ট্রেনের ছাদে একটা পা রাখতে পারার আশায় টার্মিনালগুলোতে বসে আছেন।

ঈদের জন্য কেনা নতুন জামাগুলো বের করে সবাই একচোখ দেখে নিচ্ছেন। নতুন জামা, পায়জামা আর পাঞ্জাবিগুলো ইস্ত্রি করা হচ্ছে। জামা আর শাড়ির সাথে মিলিয়ে গয়নাগাটি কেনা হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু কখন কোন পোশাক পড়া হবে সেটা আলোচনা করে ঠিক করাই বাকি। ঈদের নামাজে যাওয়ার জন্য আতর, টুপিও রেডি। নতুন স্যান্ডেলটাও বাক্স থেকে বের করে রাখা আছে।

বাজারে ‘আগুন’ লেগে যাওয়ার পরও প্রত্যেক ঘরে ঘরে চিনি, দুধ আর সেমাই কেনা হয়ে গেছে। গৃহকর্ত্রী মনে মনে হিসেব করছেন কয়টা মুরগি আর কয় কেজি গরু রান্না করতে হবে। কোন বিছানায় কোন চাদর দেয়া হবে আর টেবিলে নতুন কি ক্লথ বিছানো হবে সেটা ঠিক করতে করতে মা মেয়ের মধ্যে বাদ প্রতিবাদ শুরু হয়ে গেছে।

ছোটরা দাদা বাড়ি অথবা নানা বাড়িতে দারুণ হৈচৈ করছে। পাতা মেহেদি বাটা মেয়েদের নখে বসে পড়তে শুরু করেছে। আর টিউব মেহেদি বার বার নেড়েচেড়ে দেখা হচ্ছে, ঠিকমত মেহেদি বের হচ্ছে কিনা।

ব্যাংক থেকে আনা নতুন একশো টাকার নোটগুলো বের করে ভাগ করে রাখা হচ্ছে। ছোটরা সালাম করতে এলে তো আর খালি হাতে যেতে দেওয়া যায় না! মোবাইল ফোনগুলোতে টাকা ভরে রাখা আছে। ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে পরিচিতদের এসএমএস করতে যাতে এক মূহুর্তও দেরি না হয়।

যে মানুষ সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে, হঠাৎ করেই ঘুরেফিরে তাদের কথা মনে পড়তে শুরু করেছে। কি আশ্চর্য, গত ঈদেও মানুষটা আমাদের সাথে আনন্দ করেছে অথচ এ বছর সে কেমন করে হারিয়ে যেতে পারলো সবাইকে ছেড়ে? আর যে পরিবারের সদস্য পড়ে আছে বিদেশ বিভুঁইয়ে, তারা বুকে একধরনের বিশাল শূন্যতা চেপে রেখেছে। আহা, সবাই মিলে যদি একসাথে ঈদ করা যেত- ভাবতে ভাবতেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে দুফোঁটা নোনা জল। তবে কেউ দেখে ফেলার আগেই হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তাড়াতাড়ি সেটা মুছে ফেলতে হচ্ছে।

সব রকম প্রস্তুতিই শেষ। এবার শুধু চাঁদটা উঠার অপেক্ষা। সকল প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সন্ধ্যার আকাশে দেখা যাবে বাঁকা এক ফালি চাঁদ। আর ঘরে ঘরে বেজে উঠবে চির সবুজ সেই গান, “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ”। আর ছড়িয়ে পড়বে এক অনাবিল আনন্দ, সারা দেশ মেতে উঠবে খুশির কলকাকলিতে।

সকলকে জানাই ঈদ মুবারাক

পল্লীবর্ষা!

অনেকদিন ধরেই টানা বৃষ্টি হচ্ছে। অামার বর্ষার প্রিয় কবিতা ‘পল্লীবর্ষা’র বেশির ভাগ অংশই মনে করতে পারছিলাম না। খুব অাফসোস হচ্ছিলো মনে মনে। অাজকে হঠাৎ নেটে খুঁজে পেলাম কবিতাটা। খুব ভালো লাগলো পড়ে। যারা অামার মতন স্কুলের পরও পল্লীবর্ষাকে ভালোবাসে তাদের জন্য কবিতাটা নিচে দিয়ে দিলাম।

                         পল্লীবর্ষা

আজিকার রোদ ঘুমায়ে পড়িছে ঘোলাটে মেঘের আড়ে
কেয়া-বন-পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জলধারে।
কাহার ঝিয়ারি কদম্ব-শাখে নিঝ্‌ঝুম নিরালায়,
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!
বাদলের জলে নাহিয়া সে-মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়,
সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়।
কাননের পথে লহর খেলিছে অবরাম জলধারা,
তারি স্রোতে আজি শুকনো পাতারা ছুটিয়াছে ঘরছাড়া।
হিজলের বন ফুলের আখরে লিখিয়া রঙিন চিঠি,
নিরালা বাদলে ভাসায়ে দিয়েছে না জানি সে কোনো দিঠি!
চিঠির ওপরে চিঠি ভেসে যায় জনহীন বন-বাটে,
না জানি তাহারা ভিড়িবে যাইয়া কার কেয়া-বন-ঘাটে!
কোন সে বিরল বুনো ঝাউ-শাখে বুনিয়া গুলাবি শাড়ি-
হয়তো আজিও চেয়ে আছে পথে কানন-কুমার তারি!
এদিকে দিগন্তে যতদূর চাহি, পাংশু মেঘের জাল,
পায়ে জড়াইয়া পথে দাঁড়ায়েছে আজিকার মহাকাল।

গাঁয়ের চাষিরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়,
গল্পে গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!
কেউ বসে বসে বাখারি চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রশি
কেউবা নতুন দোয়াড়ির গায়ে চাকা বাঁধে কসি কসি।
কেউ তুলিতেছে বাঁশের লাঠিতে সুন্দর করে ফুল,
কেউবা গড়িছে সারিন্দা এক কেটে নির্ভুল।
মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুণ ভাটির সুরে
আমির সাধুর কাহিনী কহিছে সারাটি দলিজা জুড়ে।
লাঠির ওপরে, ফুলের ওপরে আঁকা হইতেছে ফুল,
কঠিন কাঠ সে সারিন্দা হয়ে বাজিতেছে নির্ভুল।
তারি সাথে সাথে গল্প চলেছে, আমির সাধুর নাও
বহু দেশ ঘুরে আজিকে আবার ফিরিয়াছে নিজ গাঁও।
ডাব্বা হুঁকাও চলিয়াছে ছুটি এর হাতে ওর হাতে,
নানান রকম রশি বুনানও হইতেছে তার সাথে।

বাহিরে নাচিছে ঝর ঝর জল, গুরু গুরু মেঘ ডাকে,
এ সবের মাঝে রূপকথা যেন আর রূপকথা আঁকে।
যেন ও বৃদ্ধ, গাঁয়ের চাষিরা, আর ওই রূপকথা,
বাদলের সাথে মিশিয়া গড়িছে আরেক কল্পলতা।
বউদের আজ কোনো কাজ নাই, বেড়ায় বাঁধিয়া রশি,
সমুদ্রকলি শিকা বানাইয়া নীরবে দেখিছে বসি।
কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপনখানি,
তারে ভাষা দেয় দীঘল সূতার মায়াবী আখর টানি।
আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছলছল জলধারে,
বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে

ফিরে এসেছে রমজান !

ক্লাশ এইটে থাকতে একটা প্যারাগ্রাফ পড়েছিলাম, ‘Summer is back in the wind’। ক্যালেন্ডারের দিকে না  তাকিয়ে কিভাবে বোঝা যায় যে প্রকৃতিতে গ্রীষ্মকাল শুরু হচ্ছে সেইটা নানা কসরত করে ইংরেজী সাহিত্যে প্রকাশ করতে হত। সেই প্যারাগ্রাফের মত আজ বলতে ইচ্ছে করছে ‘Holy Ramadan is back in the wind’। আমাদের জীবনে এক বছর পরে আবারও রমজান মাস ফিরে এসেছে, ক্যালেন্ডারের সাহায্য ছাড়াই সহজে ব্যপারটা টের পাওয়া যায়।

রাস্তার মোড়ে মোড়ে যখন ছোট টেবিলে পলিথিনের ঠোঙ্গায় যখন মুড়ি বিক্রি করতে দেখা যায় তখনই বুঝতে হয় রমজান এসে গেছে। রমজান মাসে খাবারের দোকানগুলো সেজে ওঠে বাহারি সাজে। দোকানের সীমানা ছাড়িয়ে সামনের ফুটপাথে রঙ বেরংয়ের ব্যানার টানিয়ে লিখা হয় ‘………শাহী ইফতারের বিশাল আয়োজন’। অনেকে আবার কম্পিটিশনে নেমে যায় ১০০ পদ ও ১৫০ পদের ইফতারি তৈরি করতে। পুরানো ঢাকার অবস্থা তো আরও রমরমা। কম বেশি প্রতিদিন পত্রিকায় একটা করে ছবি আসে সাদা সাদা টুপি পড়া হাজারও কালো কালো মাথা গিজগিজ করছে ছোট্ট একটা জায়গাকে কেন্দ্র করে। নিচের ক্যাপশন দেখে বুঝে নিতে হয় এটা পুরানো ঢাকার ইফতারের দোকানের ছবি।

শুধু কি খাবারের দোকান? ফলের দোকানেও চলে বাহারি আয়োজন। দোকানের ফল দোকানের সীমানা ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে এমন আকর্ষণীয় ভাবে যে চলতে ফিরতে একবার না একবার ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখতেই হবে। অনেকে আবার ফলের গিফট বক্স তৈরি করেন। এটা তেমন কিছুই না, একটা বাঁশের ঝুড়িতে নানা পদের ফল আর রুহ আফজা সাজিয়ে সেলোফেন পেপার দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়। কোন বাসায় ইফতার পার্টিতে যাওয়ার সময় অনেকেই ফলের দোকান থেকে এরকম গিফট বক্স কিনে নেন। আর অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে রোজায় ফলের বেচা বিক্রি হয় দ্বিগুন। তাই ফলওয়ালাদের দন্ত বিকশিত হাসি দেখেই বোঝা যায় রমজান এসেছে।

রোজায় মার্কেটগুলো সাজানো হয় রঙ্গিন কাপড় দিয়ে। রোজা শুরুর সাথে সাথে সকল জিনিসের ট্যাগে পুরানো দাম মুছে ১০ থেকে ২০০০ টাকা বাড়িয়ে লিখা হয়। এরপরও মানুষের কেনাকাটায় কোন থামাথামি নাই। ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় সামলাতে সামলাতে বিক্রেতাদের দম ফেলার সুযোগ থাকে না। আর গাউসিয়া, নিউ মার্কেট, চাঁদনী চক এলাকার তো কথাই নেই। ওইসব মার্কেটে যাওয়া তো দূরের কথা, ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার কথা শুনলেই অনেকের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে।

রোজার সময় আজকাল স্কুল কলেজ সব সরকারী নির্দেশেই বন্ধ থাকে। এটা অবশ্যই ভালো দিক। তবে পত্রিকায় দুজন প্রভাষককে দেখলাম রোজার ছুটির চরম বিরোধিতা করে চিঠি পাঠিয়েছে। তাদের মতে বাচ্চাদের পড়াশুনার ক্ষতিবন্ধ করার জন্য অবিলম্বে রোজার ছুটি বাতিল করা উচিত। আমি দুবছর আগে স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলাম। আমার দশ বছর স্কুল জীবন এবং দেড় বছর কলেজ জীবনে কখনই মনে হয় নাই যে স্কুল বন্ধ হওয়ার কারণে পড়াশুনার বিন্দুমাত্র ক্ষতিহয়েছে। এবং আমার বিশ্বাস যদি দুই বছরে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যাবস্থায় আমূলপরিবর্তন না হয়ে থাকে তবে এখনকার সকল শিক্ষার্থী আমার সাথে এই বিষয়ে একমত হবে। আর মুসলিম দেশে যদি ক্ষুদে রোজাদারদের যদি রোজা রেখে স্কুলে দৌড়াতে হয় তবে এরচাইতে বড় লজ্জা বোধহয় আর কিছুতেই হবে না।

এ তো গেলো শুধু বাইরের কথা। এবার আসি ঘরের কথায়। দুপুর হলেই মায়েদের রান্নাঘরের কাজ শুরু হয়ে যায়। আর বিকেল হলে তো পিঁয়াজু, বেগুনি, সবজি বড়া ভাজার গন্ধে পেটে খিদে গুরগুরিয়ে ওঠে। ইফতারের সময় যত ঘনিয়ে আসে, শুরু হয় ঘরের সবার ব্যস্ততা। ইফতারের টেবিল সাজানোর কাজটা ঘরের সব সদস্যরা মিলেই করে। কেউ শসা কাটে, কেঊ ফল কাটে, কেউ শরবত বানায়, কেউ খেজুর পরিষ্কার করে এভাবে হাতে হাতে কাজ করতে করতেই আযান পড়ে যায়।

রমযানের অন্যতম শিক্ষা সংযম। আর সংযমের সবচাইতে বড় বাধা টেলিভিশন। তাই রোজায় ঘরে ঘরে টেলিভিশন দেখার হার কমে যায়। কমে যায় হাই ভলিউমে গান ছাড়ার প্রবনতা। হিপহপ গানের বদলে অনেক জায়গা থেকে ভেসে আসে কুরআন তেলওয়াত। ঘরে ঘরে কুরআন তেলোয়াতের হারও বেড়ে যায়। অনেকেই চায় সাতাশ রোজা অর্থাৎ শবে কদরের আগে কুরআন খতম করতে। ছেলেরা জামাআতে তারাবীহ পড়ার সময়ই এক খতম করে এক ঢিলে দুই পাখি মেরে ফেলে। আবার ঘরে বসেও অনেকে আরেক খতম দেয়।

রমজান মাস রহমতের মাস, বরকতের মাস, সংযমের মাস। সারা বছরের সকল পাপের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাওয়ার সর্বোত্তম সময় এই রমজান মাস। যে রমজান মাস পেয়েও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলো না তার চেয়ে দুর্ভাগ্যবান বোধহয় আর কেউ নেই। আমাদের জীবনে আরও একটি রমজান মাস এসেছে। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সামর্থ দান করুন যাতে আমরা সঠিকভাবে মাসটিকে কাজে লাগাতে পারি এই প্রার্থনা হোক সকল মুসলমানের।

 

বৃত্তিপ্রাপ্ত ভিকিদের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় সাবধান বাণী!

” অপেক্ষা মানুষকে দার্শনিক করে তোলে ”– মাত্র দুইটা সাইনওয়ালা ফর্ম ফিলাপ করার জন্য পাঁচ ঘন্টা অপেক্ষা করতে করতে আমার বন্ধু সুমাইয়া মন্তব্যটি করে। আমি নিজে একজন ভিকি। তাই সব বৃত্তিপ্রাপ্ত ভিকিদের সাবধান করে দিতে চাচ্ছি, প্রত্যয়ন পত্র তুলতে চাইলে এক্ষুনি সারাদিনের প্রস্তুতি নিতে থাকো।

বুয়েটে আজ গিয়েছিলাম বৃত্তি বিষয়ক খবর নিতে। জানতে পারলাম নিজ নিজ কলেজ থেকে বিশেষ প্রত্যয়ন পত্র এনে জমা দিতে হবে। জমা দেওয়ার শেষদিন ছিলো গতকাল, তাই আমি ভয়ে আর বেশি কিছু জানতে চাইনি। প্রত্যেক ভিকি মাত্রই জানে আমাদের অফিসে কি আজব এক চিড়িয়া বাস করে। সব সার্টিফিকেট তোলা হয়ে গেলে মনে মনে আনন্দ ধ্বনি করেছিলাম ‘ হুররে, আমাকে আর এই লোকটার সামনে আসতে হবে না’। কিন্তু ঘুরে ফিরে আবার আমাকে ওই লোকটার সামনেই দাঁড়াতে হলো। এবং তাঁর অসম্ভব বকাঝকা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহ্য করে দুইটা সাইন যোগাড় করতে আমার সকাল এগারটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত সময় লেগেছে। আমার সাথে মোট ছয় জন ছিলো, কিন্তু মাঝপথে একজন রণে ভংগ দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত আমরা পাঁচজন পাঁচ ঘন্টা অপেক্ষা করে অবশেষে  মহামূল্যবাণ মিলিয়ন ডলারের প্রত্যয়ন পত্র নিতে সক্ষম হই।

তাই সকল বৃত্তিপ্রাপ্তদের বলছি, প্রত্যয়ন পত্র তুলতে এখনই মাঠে নেমে পড়। আর বিশেষ করে ভিকিরা, তোমরা চাইলে পিকনিক পিকনিক মুড নিয়ে সারাদিনের জন্য খাবার দাবার আর বিছানা বালিশ নিয়ে যেতে পারো।