তুলা মেঘের সাজেক উপত্যকা

এ বছরের শুরুতে দেড় মাস ব্যাপী ইন্ডিয়া ট্যুর দেওয়ার পর দ্বিমিকবাসী বেশ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। পুরো একটা টার্ম জুড়ে কোন ট্যুর না দেওয়ার ঘটনা এই লেভেল ৪ টার্ম ১ এ প্রথমবারের মত ঘটে। তাই এইবার বাই হুক অর বাই  কুক একটা ট্যুর দিতেই হবে- এমন চিন্তা শুরু থেকেই আমাদের মাথায় আসে। আমরা বিক্ষিপ্তভাবে নানা প্ল্যান করলেও অবশেষে ওয়ান এন্ড অনলি জাফরের আয়োজনে সবাই বের হয়ে পড়ি মেঘ পাহাড়ের দেশ সাজেকের উদ্দেশ্যে। অনেকদিন পর একটা ব্যাচ ট্যুর- হাসি, আনন্দ আর অ্যাডভেঞ্চারে কানায় কানায় পূর্ণ ছিলো দুইটা দিন। যারা যায় নাই তাদের জন্য যে চরম মিস- সে কথা না বললেও চলে।

 

বাস থেকে নেমেই মনে হলো হাত, পা সব জয়েন্ট থেকে খুলে পড়ে যাবে। সারা রাতে বাসে মুড়ির মতন ঝাঁকানি খেতে খেতে বাস থেকে নেমেই তাই আমরা ২১ জন দ্বিমিকবাসী হাত পা ছুড়তে লাগলাম। যে জায়গাটায় দাঁড়িয়েছিলাম সেটা হলো শাপলা চত্বর। খাগড়াছড়ি শহরের এটাই মনে হলো সব চেয়ে বড় কেন্দ্রস্থল। প্রায় সাথে সাথেই জাফরের সাথে কন্টাক্ট করে জাফরের ঠিক করে রাখা দুই চান্দের গাড়ি এসে হাজির হলো। চান্দের গাড়ি পেয়ে আমরাও মহা উৎসাহে টপাটপ উঠে পড়ি। কিন্তু আমাদের গাড়ি আর ছাড়ে না। খবর নিয়ে জানলাম, সার্কিট হাউস থেকে কর্মকর্তা কেউ একজন আসছেন আমাদের রিসিভ করতে। অবশেষে একজন অফিসার আসলেন। তিনি নোভার সাথে কুশলাদি বিনিময় করে আমাদের সাথে রওয়ানা দিলেন সার্কিট হাউসে। আমরা মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যিস নোভা ছিলো!

পাহাড়ের উপর চমৎকার, ছিমছাম, পরিপাটি সার্কিট হাউস দেখেই আমাদের সবার মনে একসাথে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারী চাকরি করার খায়েশ জাগলো। যাই হোক, চমৎকার তিন খানা রুম আমাদের জন্য খুলে দেওয়া হলো। আমরা মেয়েরা দুইটা রুমে ভাগ হয়ে পালা করে ফ্রেশ হয়ে নিতে লাগলাম। ঐদিকে জাফর আমাদের জন্য সকালের নাস্তা নিয়ে আসতে বললো। আমরা সবাই ডাইনিঙয়ে বসে অফিসারদের মত করে নাশতা খেলাম। পরোটা, ভাজি আর চা। পেট ভরে এসব খেয়ে আমরা ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে পড়লাম। আবার চেপে বসলাম চান্দের গাড়িতে। হেল্পার আমাদের জানালো চাইলে চান্দের গাড়ির উপরেও আমরা বসতে পারি। শিশির টকাটক উঠে গেলো আমাদের গাড়ির উপরে। প্রায় দশটার দিকে দুই গাড়ি লাইন ধরে চলতে লাগলো।

খাগড়াছড়ি শহর পার হতেই রাস্তার দুইপাশে লোকজন কমতে লাগলো। চমৎকার সব পাহাড়ের দিকে আমরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে আমরা চলতে লাগলাম। আর নিজেরা মজাসে গল্পগুজব করছিলাম। নোভা জানালো সাজেক ভ্যালি আসলে রাঙ্গামাটি জেলায় পড়েছে কিন্তু খাগড়াছড়ি থেকে যেতে সুবিধা হয় বলেই নাকি সবাই খাগড়াছড়ি থেকেই সাজেক যায়। শুনে বেশ ভালোই লাগছিলো যে এক সাথে খাগড়াছড়ি প্লাস রাঙ্গামাটি দুইটা জেলায় পা দিতে পারবো। একটু পর পর আর্মির চেক পোস্ট আসছিলো। আমাদের চান্দের গাড়ির হেল্পার বারবার নেমে চেক পোস্টে নানা রকম বিবরন দিয়ে আসছিলো।

এভাবে প্রায় দেড় ঘন্টা চলার পর আমরা থামলাম শুকনাছড়া বা হাজাছড়া ঝর্ণার উদ্দেশ্যে। রাস্তা থেকে নেমে আমরা হাঁটতে লাগলাম। পথ কখনও পানির ধারার নিচে, কখনও উঁচু, কখনও নিচু। বেশ মজা করে আমরা হাঁটতে লাগলাম। প্রায় দশ পনের মিনিট হাঁটতেই আমরা পৌঁছে গেলাম ঝর্ণার কাছে। ঠান্ডা পানিটাতে পা ডুবিয়ে রাখতে আমাদের যে কি ভালো লাগছিলো আর বলার মতন না। সবাই যার যার মত পানিতে নেমে পড়লো। তানভীর আর রাফাত বেয়ে বেয়ে পাহাড়ের গায়ে খাঁজ বরাবর উঠে ঝর্ণার পাশে বসে রইলো। ঝকঝকে রোদের মধ্যে টলটলে পানিটাকে পেয়ে সবাই খুব শান্তি পাচ্ছিলো। কয়েকজন তো চলেই গেলো ঝর্নার নিচে দাঁড়াতে! তবে এখানে পানির গভীরতা কম। তাই তেমন বিপদের কিছু মনে হলো না। ঝর্ণার পানিতে শরীর জুড়িয়ে আমরা আবার ফেরত গেলাম।

ঠান্ডা পানির হাজাছড়া ঝর্ণা (কৃতজ্ঞতায়- পৃথ্বী)
ঠান্ডা পানির হাজাছড়া ঝর্ণা (কৃতজ্ঞতায়- পৃথ্বী)

চান্দের গাড়িতে উঠার আগে দেখলাম পিস এক টাকা হিসেবে পাহাড়ী কলা বিক্রি হচ্ছে। তানভীর আমাদেরকে খাওয়ালো সেই কলা। কলা খেতে খেতে আমরা গাড়িতে উঠলাম। এবার অনেকেই শিশিরের সাথে গাড়ির ছাদে উঠে বসলো। আমরা আগের মতই ভিতরেই বসলাম। গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। ঠান্ডা বাতাসে আমাদের ভেজা জামা কাপড় সব শুকিয়ে যেতে লাগলো। যতই সামনের দিকে যেতে লাগলাম, একটা অদ্ভূত দৃশ্য চোখে পড়লো। রাস্তার দুই পাশে ছোট ছোট উপজাতি বাচ্চারা সব আমাদের গাড়ির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে হাত নাড়তে লাগলো। উপর থেকে জাফর লজেন্স ছুঁড়ে দিতে লাগলো বাচ্চাদের দিকে। বাচ্চারাও দৌড়ে দৌড়ে লজেন্স কুড়াতে লাগলো। এখানে নাকি এটাই সঠিক নিয়ম। বাচ্চারা অভিবাদন জানাবে আর পর্যটকরা তাদের দিকে চকলেট, লজেন্স ছুঁড়ে দিবে। ভাগ্যিস জাফর আগে থেকে জানতো!

আস্তে আস্তে পাহাড়গুলো কেমন যেন বদলে যেতে লাগলো। পরিষ্কার নীল আকাশ, কার্টুনের মত মেঘের চাঁই, বড় বড় সবুজ গাছে ঢাকা পাহাড় দেখতে দেখতে আমাদের যাদের ক্যামেরা ছিলো, তারা সব ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো। কারন নিজের চোখে দেখা এইসব দৃশ্য ক্যামেরাতে এক কানাও ধরে রাখা যাবে না। অন্তরা আর সুমাইয়া গলা ছেড়ে গান ধরলো। রাস্তা কখনও খাড়া নিচু, কখনও খাড়া উঁচু। যখন উঁচুতে উঠি তখন বুক ধুক ধুক করতে থাকে আর যখন নিচে নামি তখন গলা থেকে চিৎকার বের হয়ে আসে অটোমেটিক। ঐদিকে রুবাইদা সামনে বসে প্রায় ঘুমে ঢলে পড়েই যেতে থাকে। আমি বেশ কয়েকবার ওকে জাগিয়ে দেই।

সাজেকের পথে (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী)
সাজেকের পথে (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী)

দীঘি নালা, বাঘাই ঘাট, মাসালং বাজার সব পার হয়ে প্রায় দুইটার দিকে আমরা গিয়ে পৌঁছাই সাজেক ভ্যালির রুইলুই পাড়ায়। চেক পোস্ট পার হয়ে সোজা গিয়ে পৌঁছাই আগে থেকে ঠিক করে রাখা আলো রিসোর্টে। চারটা রুম আমাদের জন্য বুক করে রাখা ছিলো। আমরা মেয়েরা টপাটপ তিনটা রুমের দখল নিয়ে নেই। সবার গোসল করার ইচ্ছা ছিলো কিন্তু রিসোর্টের লোক এসে বলে গেলো এখানে পানি বেশ দামি কারণ পানি আনতে হয় নিচ থেকে গাড়ি করে। যেহেতু আমরা ২১ জন তাই আমাদের বুঝে শুনে পানি খরচ করতে হবে। তাই আমরা আর গোসল না করে হাতমুখ ধুয়েই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা ঠিক করে রাখা হয়ে ছিলো ঠিক পাশের খাবার হোটেলটাতে। দুপুরে খেলাম ভাত, আলু ভর্তা, মুরগি আর ডাল। সাথে শশা, লেবু আর কাঁচা মরিচ। আমি ঝালের চোটে তেমন কিছুই খেতে পারছিলাম না। যাই হোক খেয়েদেয়ে আমরা রুমে ফিরে আসলাম। মার্জিয়া আর অন্তরা বাদে আমরা বিছানায় শুয়ে লম্বা হয়ে রেস্ট নিলাম সবাই। আগের রাতে হতচ্ছাড়া বাসের ঝাঁকুনিতে কেউ এক দন্ডও চোখের পাতা এক করতে পারে নাই। এখন একটু বিশ্রাম না নিলেই নয়।

ঠিকঠাক চারটার সময় আমরা সবাই বের হয়ে পড়লাম। আগের মত চান্দের গাড়িতে করে উঠে রওয়ানা দিলাম কংলাক পাড়ার দিকে। এবার অনেকেই উঠে বসলো গাড়ির ছাদে। একটু দূর গিয়ে গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিলো। বাকিটা পথ হেঁটে যেতে হবে। বাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে আমরা হাঁটতে লাগলাম। বিকালের লাল রঙয়ের রোদে পাহাড়্গুলোকে পুরো ছবির মতন লাগছিলো। আমার এক পাহাড়ের ছায়া অন্য পাহাড়ের গায়ে পড়াতে বেশ চমৎকার এক আলো ছায়ার খেলা দেখা যাচ্ছিলো। আমরা সেদিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে হাঁটতে লাগছিলাম। হঠাৎ কতগুলো ছোট ছোট বাচ্চা ছোট ছোট বাঁশের লাঠি নিয়ে দৌঁড়ে আসলো। আমরা পাঁচ টাকা করে একেকটা লাঠি কিনে নিলাম। বেশ অভিযাত্রীর ভাব নিয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম। একটু পর শুরু হলো পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠা। একে তো হাঁটতে হাঁটতে আমাদের অনেক পরিশ্রম হচ্ছিলো তার উপর খাঁড়া পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে আমরা পুরাই ক্লান্ত হয়ে গেলাম। এই কংলাক পাড়া হচ্ছে সাজেকের সবচেয়ে উঁচু জায়গা। এত কষ্ট করেও কেন মানুষ এইখানে উঠে টের পেলাম উপরে উঠে। এক দৃষ্টিতে যখন তাকিয়ে ছিলাম বিকালের রোদের রঙে রঙ্গিন হয়ে যাওয়া পাহাড়গুলোর দিকে, অনেকক্ষন কোন কথা বলতে পারলাম না। নিশাতকে দেখলাম ক্যামেরা বন্ধ করে ফেলতে। কি লাভ? এই দৃশ্য কোনদিনও ক্যামেরায় ধরে রাখা সম্ভব না। আমাদের সাথে চান্দের গাড়ির দুজন হেল্পার সব সময় ছিলো। ওনারা বললো আরও একটু উপরে উঠেন, সূর্যাস্ত দেখবেন না? আমরা উনাদের ফলো করে লুসাই, টিপরা উপজাতিদের ঘরবাড়ি পার হয়ে আরও উঁচু এক জায়গায় এসে পৌঁছালাম। মনে হলো ক্যানভাসের উপর অস্তগামী সূর্যটা যেন কমলা রঙের বোতল উপুড় করে আকাশের গায়ে রঙ ঢেলে দিয়েছে। সেই রঙের প্রতিফলিত হয়ে ছিটকে পড়ছে ঐ দূরের অবাস্তব পাহাড়গুলোর গায়ে। দৃশ্যটা এতই মনোমুগ্ধকর যে সবাই চুপ হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম, বুঝতে হবে এ তো আর যে সে শিল্পীর ক্যানভাস নয়, এ স্বয়ং আল্লাহর ক্যানভাস। মানুষের সাধ্য কি এই দৃশ্য নকল করার?

কমলা সূর্যটা টুপ করেই ডুবে যাচ্ছিলো (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী)

ওদিকে আমরা গ্রুপ ফটোর জন্য রেডি হতে হতেই সূর্যটা টুপ করে হারিয়ে গেলো আকাশের মাঝে। সূর্য ডুবতেই আমাদের টনক নড়লো। এই পাহাড়ি পথে আমাদের এখন ফেরত যেতে হবে। আমরা তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলাম। আলো থাকতে থাকতেই খাড়া পাহাড়টা বেয়ে নিচে নেমে পড়লাম। তারপরও কোন থামাথামি না করে ছুটতে লাগলাম। অনেক দূর হেঁটে যখন আমরা মোটামুটি ভালো রাস্তায় এসে পৌঁছালাম, তখন দেখলাম আকাশে এক বিশাল গোল চাঁদ। যদিও পরেরদিন পূর্নিমা তারপরও এত বিশাল চাঁদ কেবল ইংলিশ সিনেমাতেই দেখা যায়। আমরা হাঁ করে দেখতে লাগলাম চাঁদটাকে। পাহাড়ের ধারের জংলার ফাঁক দিয়ে দেখা সেই বিশাল চাঁদ তার ধবধবে জোসনা দিয়ে মূহুর্তেই সব আলোকিত করে দিলো। একপাশে বিশাল চাঁদ, অন্য পাশে আকাশের গায়ে লেপ্টে থাকা কমলা রঙ দেখতে দেখতে আমার মনে হলো আমি বোধহয় এই মূহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। এত সুখ কেন জীবনে?

পাহাড়ী চাঁদ (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম)
পাহাড়ী চাঁদ (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম)

চান্দের গাড়িতে যখন উঠলাম, একটু একটু ঠান্ডা লাগতে শুরু করলো। আমাদের আবার নামিয়ে দেওয়া হলো হেলি প্যাডে। বিশাল হেলি প্যাডে দাঁড়িয়ে পরিষ্কার আকাশে বিশাল চাঁদটা দেখে আমাদের মনে হলো আমাদের বোধহয় মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আমি উপরে তাকিয়ে দেখলাম বিশাল আকাশ জুড়ে কোটি কোটি তারা। এত তারা জীবনে দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। ঠান্ডা বাতাসে আমাদের সব ক্লান্তি নিমেষেই দূর হয়ে গেলো। আমরা পাগলের মত ছবি তোলার চেষ্টা করে যেতে লাগলাম সেই চাঁদের আলোয়। সৃষ্টি ধৈর্য ধরে আমাদের সকল পাগলামি ক্যামেরা বন্দি করার চেষ্টা করে যেতে লাগলো। আমরা তারপর সারি ধরে বসে গান গাইতে শুরু করলাম। যখন সৃষ্টি ধরলো, ‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে/ বসন্তেরই মাতাল সমীরনে’ তখন মনে হলো আমি বুঝি কোন এক রূপকথার রাজ্যে এসে পড়েছি। এত সুন্দর একটা দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য দান করার কারণে আল্লাহকে মনেমনে ধন্যবাদ জানালাম।

ওদ
বিশাল একটা চাঁদের নিচে বসে তখন আমাদের মাথা খারাপ অবস্থা            (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম)

আমরা সেখান থেকে আলো রিসোর্টে পৌঁছে চা, চিপস, কেক খেতে খেতেই খবর পেলাম আমাদের রাতের খাবার রেডি। এখানকার লোকাল কেকগুলো খেতে খুবই মজা। দেখতে পিঠার মত, খেতে কেকের মত। জাফর এসে জানালো আমাদের প্ল্যান মত বার বি কিউ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। আগের মেনুই দিলো রাতের বেলা। খেয়ে দেয়ে সবাই কয়েক কদম হেঁটে আসলাম ফুটপাথ বিছানো চওড়া পাকা রাস্তাটা ধরে। চাঁদের আলোয় সব কেমন যেন অপার্থিব লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো বিশাল এক লাইট কেউ জ্বেলে দিয়েছে। দূরের মিজোরামের পাহাড়গুলোও রহস্যময় লাগতে লাগলো। কি সুন্দর পথ, শুধু আমরা ছাড়া আর কেউ নাই! মনে হচ্ছিলো হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই দূরে কোথাও। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয় তাই আমরা তাড়াতাড়ি ফেরত আসলাম। আমি তারপর রুমে ফিরে শুয়ে পড়ার বন্দোবস্ত করতে লাগলাম। অনেকক্ষন পর যখন সবাই রুমে ফেরত আসলো, লাইট নিভিয়ে আমরা ঘুমাতে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ঘুমাতে আর পারছিলাম কই? পাশের রুমের বোর্ডাররা সারা রাত বিকট স্বরে নাক ডেকেই যেতে লাগলো। আমরাও ঘুমানোর চেষ্টা বাদ দিয়ে অন্ধকারে চরম হাসাহাসি করতে লাগলাম।

মে
মেঘ যখন পায়ের নিচে (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী)

পরদিন ভোরে আমি, নিশাত আর পৃথ্বী বাদে বাকি সবাই সূর্যোদয় দেখতে গেলো। আমি পরে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম হোটেলের দরজা দিয়েই দেখা যাচ্ছে আমি যে লেভেলে দাঁড়িয়ে আছি, তার অনেক নিচে জমে আছে তুলা তুলা মেঘ। পাহাড়গুলো অর্ধেক যেন হারিয়ে গেছে তুলা তুলা মেঘের সারির পিছনে। আমি দেখে থ হয়ে গেলাম। যারা সূর্যোদয় দেখতে গিয়েছিল তাদের কাছ থেকে বর্ণনা শুনে বেশ আফসোস লাগলো। আমরা নাস্তা খেতে গেলাম। লুচি, ভাজি, অমলেট আর চা। পেট ভরে খেয়ে আমরা উঠে পড়লাম। আবার রওয়ানা দিলাম চান্দের গাড়িতে চড়ে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে।

এবার আর কোন থামাথামি নাই। টানা চলতে লাগলাম আমরা। ঠিক যেই পথ দিয়ে এসেছি, সেই পথ দিয়ে ফেরত গেলাম। তিন ঘন্টা পর আবার সেই খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউজে এসে নামলাম আমরা। আবার ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এরপর একটু বিশ্রাম নিয়েই বের হলাম সিস্টেম রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে। বাঁশ কাঠের ইন্টেরিয়র করা রেস্টুরেন্টটাতে আমরা সবাই মিলে অর্ডার দিলাম অনেক কিছুই। পোলাওর চালের নরম ভাতের সাথে বাঁশ কুড়ুল, লাউ চিংড়ি, মাশ্রুম, হাঁসের ভুনা, থাঙ্কুনি পাতার ভর্তা, শুটকি ভর্তা, ডাল সবই খেয়ে দেখলাম। বাঁশটা সবচেয়ে মজা ছিলো। আমার কাছে বেশ ভালোই লাগলো খেতে। খেয়েদেয়ে আমরা রওয়ানা হলাম আলুটিলা গুহার উদ্দেশ্যে।

আলুটিলার গেটে পৌঁছে আমরা ৫ টাকার টিকেট আর ১০ টাকার মশাল কিনলাম। মশালটা আসলে কিছুই না, বাঁশের আগায় কেরসিন মাখানো পাটের দড়ি। তারপর সোজা হাঁটা ধরলাম। মোটামুটি ২৬৬ টা সিঁড়ি ভেঙ্গে পৌঁছালাম গুহা মুখে। গুহা মুখে পৌঁছে আমরা জাফরের দেয়াশলাই থেকে মশাল ধরিয়ে নিলাম। খুবই হাস্যকর মশাল। ঝিরঝির পানির উপর দিয়ে যখন গুহা পথে ঢুকলাম মুখ দিয়ে বিস্ময়ের এক আর্ত চিৎকার অটোমেটিক বের হয়ে আসলো। এ তো যেন কোন হলিউডি সিনেমার গুহার ভিতর ঢুকে পড়েছি। কিংবা তিন গোয়েন্দার আটকে পড়া গুহাগুলো তো এইরকমই ছিলো। আমি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে আগাতে শুরু করি। ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এর মধ্যে আমার মশালটা টুপ করে নিভে গেলো। অন্ধকারে পানির ধারা আর বড় বড় পাথরের চাঁই পার হতে হতে একরকমের গা ছমছমে অনুভূতি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আমরা বেশ হৈচৈ মজা করে একে অন্যকে সাহায্য করে আগাতে লাগলাম। গুহার ভেতর কোথাও কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোথাও কোমর পানি, কোথাও কোথাও সরু পথ, কোথাও এত নিচু ছাদ যে কুঁজো হয়ে হাঁটতে হয়। খাগড়াছড়ি টুরের বেস্ট পার্ট মনে হলো আমার এই গুহা দর্শন। প্রায় পনের বিশ মিনিট পর আমরা সূর্যের আলো দেখতে পেলাম। লতা পাতা আর শ্যাওলা জাতীয় গাছে ঢাকা গুহা মুখটা অত্যন্ত সুন্দর ছিলো। বের হয়ে ভাবলাম বাংলাদেশে এত সুন্দর একটা গুহা আছে কল্পনাই করতে পারি নাই। ভেজা আর কাদা মাখা জামা কাপড় নিয়ে আমরা একটু পানি খেয়েই ফেরার পথ ধরলাম। ফেরার পথে দেখতে পেলাম পাহাড়ের উপর থেকে অত্যন্ত সুন্দর খাগড়াছড়ি শহর। মনে হলো যেন সিমলা শহরের ছোট ভার্সন দেখছি।

দ্ব
দারুণ অ্যাডভেঞ্চারের আলুটিলা গুহার শেষ মাথায় দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী

আমরা দৌড়ে দৌড়ে চান্দের গাড়িতে উঠলাম। অবস্থা এমন হলো যে আমার গাড়িতে শুধু আমিই একমাত্র ভিতরে বসে আছি, বাকি সবাই উপরে। যাই হোক পনের মিনিটের মধ্যে গিয়ে পৌঁছালাম রিসাং ঝর্ণার কাছে। অনেক ঢাল বেয়ে গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিলো। আমরা হেঁটে হেঁটে বেশ খাড়া ঢালু পথ দিয়ে দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে নামতে লাগলাম। আসলে দৌড় দিচ্ছিলাম না। পথটা এতই খাড়া ছিলো যে হাঁটাটা অটোমেটিক দৌঁড় হয়ে যাচ্ছিলো। মারজিয়া দৌড় কন্ট্রোল করতে না পেরে হিমির সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়েই গেলো। যাই হোক আমরা লাইন ধরে নামতে লাগলাম। একটা বাঁক পার হওয়ার পর পরই তানভীর আমাদের দেখালো রিসাং ঝর্না। আমরা উপর থেকে দেখলাম অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট একটা ঝর্না। অদ্ভূত ব্যাপার হচ্ছে ঝর্নাটা গিয়ে পড়েছে পুরাই ঢালু হয়ে যাওয়া পাথরের দেওয়ালের উপর। দেখতে অনেক সুন্দর লাগছিলো ঝর্নাটা। কিন্তু সেই ঝর্ণাটা কাছ থেকে দেখা আমাদের আর কপালে ছিলো না। সেই মূহুর্তেই খবর পেলাম আমাদের একটা চান্দের গাড়ি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়েছে। ভয়ানক এই কথা শুনে আমরা হতবাক হয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি যেই পথে নেমেছি সেই পথে উঠতে শুরু করলাম। পরিশ্রমের ঠ্যালায় জিহ্বা বের হয়ে গেল। তারপরও যথাসাধ্য পা চালিয়ে উপরে উঠে এলাম। এসে দেখলাম খবর সত্যি। একটা গাড়ির হেল্পার মাতবরি করে গাড়ি পার্ক করতে গিয়েছিলো। কিন্তু পাহাড়ের ঢালে সে কন্ট্রোল রাখতে পারে নাই। গাড়ি ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গেছে আর উনি লাফ দিয়ে বের হয়ে গেছেন। দেখলাম লোকটা শুয়ে আছে। হাতে, গলায় আর কোমরে মারাত্মক চোট। ব্যাথার চোটে মুখটা লাল হয়ে গেছে। আশেপাশের লোকজন উৎসাহী হয়ে দেখতে আসছে গাড়িটা। উপজাতি কয়েকজনকে দেখলাম তরতর করে পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে নেমে যেতে। শেষমেশ আমরা আর কোন অপশন না পেয়ে এক গাড়িতেই সবাই চাপাচাপি করে ফেরার পথ ধরি।

সার্কিট হাউজে ফিরে এসে দেখি কারেন্ট নাই। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা বসে ছিলাম। বারান্দায় বের হয়ে দেখি আকাশে ফানুস ওড়ানো হচ্ছে। আজ প্রবারনা পূর্ণিমা। কাছেই একটা মন্দির থেকে ওড়ানো হচ্ছে রঙ্গিন ফানুস। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে লাগলাম বিশাল চাঁদ, হাজারও ঝিকিমিকি তারার সাথে ফানুসের ওড়াওড়ি। সাড়ে সাতটার দিকে খেতে গেলাম সার্কিট হাউজের পাশেই বিসমিল্লাহ হোটেলে। অর্ডার দিলাম নান আর সবজি। শেষমেশ চা খেয়ে বের হলাম সেই দোকান থেকে। আমি, লিয়া, মারজিয়া, সৃষ্টি, সুমাইয়া, সুহাইলা মিলে অটো ভাড়া করে রওয়ানা দিলাম বাজারে। উদ্দেশ্য কিছু ফলমূল কেনা। হাতে সময় খুব অল্প। এরই মধ্যে তাড়াহুড়া করে আমরা সবাই মিলে তেঁতুল, কমলা, ডাব, কলা, পেপে, জাম্বুরা কিনলাম। সবই দরাদরি করে কিনতে হলো। সময় থাকলে ঠান্ডা মাথায় কেনা যেত। কিন্তু নয়টায় বাস ছাড়বে, কি আর করা!

তাড়াহুড়া করে সার্কিট হাউসে পৌঁছে লোডশেডিঙের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে ব্যাগটা নিয়েই আবার নেমে পড়ি। আবার অটোতে উঠে শাপলা চত্বরের কাছে বাস কাউন্টারে নেমে পড়ি। ঠিকঠাক সময় মতই বাস ছেড়ে দেয়। এই বাসটা আগের বাসের মতন লক্কর ঝক্কর না। জার্নিটা ভালোই হবে এই আশায় ভালো করে শাল জড়িয়ে ঘুম দেওয়ার প্রিপারেশন নেই। মনে মনে বলি ‘বিদায় খাগড়াছড়ি’।