ক্যামেরাবাজীঃ যেভাবে আসলো ক্যামেরা

শুরুতেই বলে নেই, যারা শিরোনাম পড়েই আমাকে পাঁড় ফটোগ্রাফার মনে করছেন তারা আসলে বিশাল ভুল করছেন। আমি মোটেও কোন জাতের কিছু নই। হ্যাঁ ক্যামেরা নিয়ে ক্লিক ক্লিক করতে ভালোই লাগে। তবে সেই ক্লিক ক্লিকের ফলাফলগুলো আমার হার্ড ডিস্কেই সীমাবদ্ধ। তবে আগ্রহের কারণে পাঠশালায় একটি ফটোগ্রাফিক কোর্সে ভর্তি হয়েছি। প্রথম ক্লাসে ফটোগ্রাফির ইতিহাস জেনেই আমি মুগ্ধ। এইজন্য যাদের আগ্রহ আছে তাদের বলছি, ফটোগ্রাফির ইতিহাস জানাটা খুবই জরুরি। এই লিখা পড়ে ইতিহাস বোরিং লাগলে সেটা সম্পূর্ণ আমার দোষ, মোটেও ইতিহাসের দোষ নয়।

সম্পূর্ণ ঘরকে ঘুটঘুটে অন্ধকার করে দেয়ালে ছোট্ট একটা ফুটা করলে বাইরের পুরো দৃশ্য প্রতিফলিত হয়ে দেয়ালজুড়ে ঘরের ভেতর চলে আসে, অনেকটা প্রজেক্টরের মাধ্যমে আমরা যেরকম দেখি ঠিক সেরকম। যারা আমার কথা বিশ্বাস করছেন না তারা গুগলে camera obscura লিখে সার্চ দিন।  আমি কয়েকদিন আগেও এই ব্যাপারটা জানতাম না। তবে পরে মনে করে দেখলাম এই জিনিসটা স্কুলে থাকতে ফিজিক্স বইয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ব্যাপারটা যে এতই চমৎকার তা ধরতে পারি নাই। পড়ার দরকার ছিলো তাই গড়গড় করে পড়ে গিয়েছিলাম। তবে মনে হতে পারে ‘ক্যামেরাবাজী’টাইটেল দিয়ে এইসব ফালতু প্যাচালের অর্থ কি?

আসল ঘটনা হলো এইটাই ক্যামেরার বেসিক প্রিন্সিপাল। অবাক হয়ে গেলাম যখন শুনলাম এরিস্টটলের আমল থেকেই মানুষ এই তত্ত্বটা জানতো। তারা রিফ্লেকশনের সাহায্যে বাইরের দৃশ্য ঘরের ভিতরে দেখার পদ্ধতিটা জানতো কিন্তু কিভাবে ছবিটা রেকর্ড করে রাখতে হয় সেই পদ্ধতি তারা জানতো না। তারপর আবিষ্কার হয় লেন্স। লেন্সের সাহায্যে দেয়ালজুড়ে থাকা বিশাল প্রতিফলনকে ছোট করে ফেলা সম্ভব হয়। এতে শিল্পীদের ছবি আঁকার রেফারেন্স নিতে সুবিধা হয়।

 সর্বপ্রথম জোসেফ নিসেফর নিপ্স ১৮২৬ সালে ফটোসেন্সিটিভ ক্যামিকেল ব্যবহার করে ১০ ঘন্টা ধরে এই ছবিটি তোলেন। বলা হয়ে থাকে এটিই পৃথিবীর প্রথম ছবি।

লুইস ড্যাগুয়ের ১৮৩৯ সালে প্যারিসের রাস্তার তুলনামূলক পরিষ্কার ছবিটি তোলেন। সময় লাগে ১০ মিনিট। তিনি image capture করারপদ্ধতি ঘোষণা করেন। তার ছবি তোলার পদ্ধতিকে ড্যাগুয়ের টাইপ নাম দিয়ে ফরাসী সরকার সত্ব কিনে নেয়।

ছবিটা দেখে মনে হতে পারে যে প্যারিসে হয়তো সেদিন হরতাল ছিলো, কেমন যেন সুনশান নীরব রাস্তা। কিন্তু বিষয় আসলে তা নয়। আসল ঘটনা হলো ছবিটা তুলতে সময় লেগেছে ১০ মিনিট। তার অর্থ হচ্ছে ১০ মিনিট ধরে যে জিনিস স্থির থাকবে ক্যামেরায় শুধু তার ছবি উঠবে। তবে একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে ফুটপাতে একটা পা উঁচু করা মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে । মনে হচ্ছে তিনি সেদিন বুট পালিশ করতে এসেছিলেন। বুটপালিশ করতে এসে এক পা উঁচু করে নিশ্চয়ই ১০ মিনিট স্থির দাঁড়িয়েছিলেন। কি ভাগ্য উনার, বুট পালিশ করতে এসে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন!

প্রায় একই সময়ে উইলিয়াম হেনরী ফক্স ট্যালবট ভিন্ন উপায়ে image capture করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তার পদ্ধতিকে বলা হয় ক্যালো টাইপ

ফরাসী সরকার ড্যাগুয়ের টাইপ উন্মুক্ত করে দেয় ফলে এই পদ্ধতির দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তখনকার দিনে মানুষ নিজের চেহারার সত্যিকার ছবি দেখার জন্য দলে দলে স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তুলতে শুরু করে। যদিও ছবি তুলতে সময় লাগতো ১০ মিনিট কিন্তু তাতে কি, পোর্ট্রেট তোলা হু হু করে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। শুধূ নিজের নয়, বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সাথে ছবি তোলারও চল আসলো। কিন্তু ১০ মিনিট ধরে সময় লাগার কারণে ক্যামেরার প্রতি মনোযোগ স্থির রাখা সম্ভব হতো না। এজন্য আগেকার দিনের ছবিতে সবার চোখের দৃষ্টি থাকতো আনমনা।

ছবি তোলা জনপ্রিয় হওয়ার সাথে সাথে একই ছবির একাধিক কপির প্রয়োজন হয়। এখানেই ছিলো ড্যাগুয়ের টাইপের দূর্বলতা। এই পদ্ধতিতে ছবির কপি করা সম্ভব ছিলো না। অনেকটা ‘ওয়ান পিস মেড কারিগর ডেড’ টাইপের। অন্যদিকে ক্যালো টাইপে ছবির কপি করা সম্ভব ছিলো। তাই ধীরে ধীরে ক্যালো টাইপ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

উনিশ শতকে মূলত পোর্ট্রট, ট্রাভেল ফটোগ্রাফী, ওয়ার ফটোগ্রাফীর বেশি প্রচলন ছিলো। সেই সময়ের বিখ্যাত কয়েকজন পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফার হলেন,

                                                      ডেভিড অক্টাভিয়াস হিল

 

ফেলিক্স নাদারইনি সব বিখ্যাত মানুষদের ছবি তুলতেন।

জুলিয়া মার্গারেট ক্যামেরুন

 

বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ, আর্কিওলজিকাল রিসার্চ, হিস্টোরিক ডকুমেন্ট সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ট্রাভেল ফটোগ্রাফীর প্রচলন বাড়ে। তবে ভ্রমনে ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া মানে এক এলাহি কান্ড। একজন ক্যামেরা নাও্‌, একজন ট্রাইপড নাও, একজন ডার্ক রুম বানানোর তাঁবু নাও, এক জন নাও ওয়াশ করার জন্য ক্যামিকেল …মানে এক বিরাট দল। এই সব লটবহর নিয়ে ভ্রমন করার সামর্থ যাদের থাকতো তারাই শুধু ছবি তুলতে পারতো।

 

তখনকার দিনের যুদ্ধের ছবির সাথে এখনকার দিনের যুদ্ধের ছবির অনেক তফাত। সেইসব ছবি অনেক স্টিল এবং ফ্রোজেন, অর্থাৎ যা ঘটনা ঘটার তা অলরেডি ঘটে গেছে। তার কারণ ছিলো তখনকার দিনে একটা ছবি তুলতে ১০ মিনিট সময় লাগতো আর ছবি তুলে ডার্ক রুম বানিয়ে সাথে সাথে ওয়াশ করতে কম হ্যাপা হতো না। তাই সব ছবিই ছিলো যুদ্ধের আগের বা পরের মুহুর্তের।

 

 

      

১৮৮৮ সালে জর্জ ইস্টম্যানের কোডাক বক্স ক্যামেরা সারা পৃথিবীতে হৈচৈ ফেলে দেয়। এটাই প্রথম সহজে বহনযোগ্য, সর্ব সাধারণের জন্য সহজসাধ্য ক্যামেরা। কারণ এই ক্যামেরায় ১০০টা ফিল্মের রোল ব্যবহার করা হয় যা দিয়ে ছবি তোলার পর পর ক্যামেরাটি কোম্পানির ঠিকানায় পোস্ট করে পাঠালে কোম্পানি ১০০টা ছবি ওয়াশ করে আবার নতুন একটা রোল ভরে পুনরায় গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতো। এক্ষেত্রে ফটোগ্রাফারকে নিজে ডার্ক রুম বানিয়ে গাদা গাদা ক্যামিকেল দিয়ে আর ছবি ওয়াশ করতে হত না। ফলে পুরো পদ্ধতি অনেক সহজ হয়ে গেলো।

ধীরে ধীরে ক্যামেরার প্রসারের সাথে সাথে ডকুমেন্ট হিসেবে, সমাজ পরিবর্তনের সাক্ষী হিসেবে, যুদ্ধের সাক্ষী হিসেবে এবং ফটোসাংবাদিকতার মাধ্যম হিসেবে ফটোগ্রাফীর প্রচলন বাড়ে।

 

 

       

ইউজিন অ্যাটগেট ফটোগ্রাফ তুলে ডকুমেন্টেশন করে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি শিল্পী, স্থপতি, গবেষকদের জন্য ছবি তুলতে তুলতে বিশাল সংগ্রহ গড়ে তুলেন।

 

আরেকজন হচ্ছেন অগাস্ট স্যান্ডার। ইনি তুলতেন সোশাল পোর্ট্রেট। তার কর্মকান্ডের কারণে নাৎসি সরকার বিরক্ত হয়ে বহু ছবি পুড়িয়ে ফেলে। পরে তার বন্ধু, আত্মীয়দের কাছ থেকে পাওয়া ছবিগুলোই আমরা দেখতে পাই।

 

লেউইস হাইন তুলতেন শিশু শ্রমিকের ছবি।

  

 নানা রকম ছলে বলে কৌশলে তিনি কারখানায় ঢুকে ছবি তুলতেন। আমেরিকার চাইল্ড লেবার অ্যাক্ট প্রনয়নে তার তোলা ছবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তার একটি বিখ্যাত উক্তি, ”Photographs may not lie, liers may photograph”

 

 

অ্যান্সেল ইস্টন অ্যাডামস আবার প্রকৃতির ছবি তুলতেন।

 

 

অন্য সবার চাইতে হেনরি কারটিয়ার ব্রেসন ভিন্ন ধারার ছবি তুলতেন। তিনি একাধারে শিল্পী, দার্শনিক, ফটোগ্রাফার ছিলেন। তার ছবিতে চমৎকার কম্পোজিশনের সাথে বিশেষ মুহুর্তের ছোট্ট একটি গতিময় পোশ্চার থাকে যা পুরো ছবিকে প্রাণ দেয়।

মার্গারেট বোর্ক হোয়াইট ছিলেন প্রথম নারী ওয়ার ফটোগ্রাফার। ডরোথা ল্যাংগে, জো রোসেন্থাল, এডি অ্যাডাম, জর্জি জেলমা সবাই যুদ্ধ এবং সাংবাদিকতা বিষয়ক ফটোগ্রাফার ছিলেন। 

বিদেশি প্যাঁচাল তো অনেক হলো, এবার আসি দেশের কথায়। যদি আপনি মনে করেন আমরা অশিক্ষিত মূর্খ জাতি, আমাদের আবার ফটোগ্রাফির ইতিহাস কিতাহলে ভুল কবেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮৪০ সাল থেকেই ক্যামেরা চালু হয়ে যায়। না না আপনি কিন্তু ভুল পড়েন নি। সেই ১৮৪০ সাল থেকেই এখানে ছবি তোলার প্রচলন শুরু হয়ে যায়। তখন মূলত রাজাজমিদারেরাই ছবি তুলতেন। সেই যুগের ফটোগ্রাফার হচ্ছেন রাজেন্দ্র মিত্র। অন্নপূর্ণা দত্ত হলেন সেই যুগের প্রথম পেশাদার নারী ফটোগ্রাফার।

বাংলাদেশের বিখ্যাত ফটোগ্রাফাররা হচ্ছেন গোলাম কাশেম ড্যাডি, মনসুর আলম বেগ, রশিদ তালুকদার, নায়েব উদ্দিন আহমেদ, বিজন সরকার ইত্যাদি। সায়েদা খানম হচ্ছেন পেশাদার প্রথম বাংলাদেশি নারী ফটোগ্রাফার। আরও আছেন আমানুল হক, আনোয়ার হসেন, শহিদুল আলমসহ অনেকেই। 

                                            

গোলাম কাশেম ড্যাডি                                                          রশিদ তালুকদার

                         

আনোয়ার হোসেন                                                   শহিদুল আলম