কম্বলের নিচে আরামদায়ক পরিবেশে খাসা ঘুমটা ভাংলো এক হতচ্ছাড়া লোকের ডাকাডাকিতে। বিরামহীনভাবে লোকটা ডাকতেই লাগলো। আমার শুনে মনে হলো চা নাশতা খাওয়ার জন্য ডাকছে। এক পর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে মজুমদার হিন্দীতে চিৎকার করে লোকটাকে চলে যেতে বললো। লোকটা যাবার আগেও আরও কয়েকবার চিৎকার করে ডাকতে লাগলো। আরামের ঘুমের চৌদ্দটা বাজিয়ে দেওয়ায় লোকটাকে বকতে বকতে আমরা বিছানা ছেড়ে উঠলাম। বাথরুমে গিয়ে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে দাঁত ব্রাশ করলাম। এখানকার পানি খুবই লবনাক্ত। কেমন যেন স্যালাইন স্যালাইন। জয়সাল্মীর শহরের পানিও লবনাক্ত কিন্তু এতটা না।
হাত মুখ ধোয়ার পর হাত মুখের চামড়া শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেলো। ব্যাগ যেহেতু আনি নাই, তাই লোশন আনাও হয় নাই। কোন উপায় না দেখে শেষমেষ মৌলির কাছ থেকে ‘সিসি ক্রিম’ নিয়ে মুখে মেখে ফেললাম। আমরা সবাই নাশতা খেতে যাওয়ার আগেই তাঁবুতে কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। ব্রেকফাস্টে যাওয়ার জন্য আমাদের তেমন কোন উৎসাহ নাই কারণ আগের দিনের ডিনার দেখেই অনুমান করতে পারছিলাম নাশতাটা কেমন হতে পারে! পরে সবার তাড়া খেয়ে ডাইনিং হলে গেলাম। নাশ্তায় ছিলো লুচি আর আলুর একটা তরকারি। লুচিটা বেশ তেলতেলে আর আলুর তরকারিটায় কোন লবন নাই। কিন্তু এটা পেয়েই আমরা বেশ খুশি হয়ে গেলাম। কারণ আগের রাতের ডিনারের তুলনায় এটা বেশ ভালো। আস্তে ধীরে খেয়েদেয়ে আমরা তাঁবুতে ফিরে আসলাম। আমাদের জিনিসপাতি সব গুছিয়ে বের হয়ে আসলাম তাঁবু থেকে। সকালের হাল্কা রোদে বেশ সতেজ লাগছিলো। আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখছিলাম পুরো ক্যাম্পটা। আমাদের বারবিকিউ করার জায়গাটা সেরকমই পড়ে আছে। সবাই একসাথে হলে আমরা গোয়েলে উঠে পড়লাম। মনে মনে বললাম, ‘বিদায় মরুভূমি’।
আমাদের নিয়ে গোয়েল চলতে শুরু করলো। আবার আগের পথ পাড়ি দিয়ে আমরা চলতে শুরু করলাম জয়সাল্মীরের দিকে। মরুভূমি দেখতে দেখতে একসময় আমার দুই চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। ঠিক সেই সময়ে গোয়েল থেমে গেলো বাড়াবাগ নামক জায়গায়। এখানে নাকি একটা সুন্দর মন্দির আছে। সামনে কে একজন চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলো ‘তোরা কেউ মন্দির দেখতে যেতে চাস?’ সবাই সমস্বরে চিৎকার দিয়ে বললো, ‘না’। এমনিতেই আমাদের রওয়ানা দিতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো, তার উপর রাত জেগে বারবি কিউ করে সবাই ক্লান্ত, আর এই গনগনে রোদে কারও মন্দিরে যেতে ইচ্ছা করছিলো না। আমরা তাই আর সময় নষ্ট না করে রওয়ানা দিলাম জয়সাল্মীরের দিকে।
জয়সাল্মীরের হোটেলে পৌঁছে আমরা আবার আগের রুমে উঠে বসলাম। ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। তারপর আমি আর রুবাইদা দুজনে দুইটা বই হাতে নিয়ে বের হয়ে পড়লাম গাড়সিসার লেকের উদ্দেশ্যে। অনেকে মুভি দেখার উদ্দেশ্যে বের হলো। আমরা ওদের বিদায় জানিয়ে একটা অটো নিলাম ২০ রুপি দিয়ে। সেটা আমাদের লেকের কাছাকাছি নামিয়ে দিলো। সেখান থেকে নেমে আমরা হাঁটতে লাগলাম। লেকটার চারপাশে বেশ সুন্দর কিছু ইয়েলো স্যান্ডস্টোনের মন্দির আছে। ঢুকতেই একটা পাথুরে গেট পেলাম যেটা ‘তিলোন কি গেট’। সেটাতে একটা বিষ্ণু মূর্তি বসানো। বেশ সুন্দর লাগলো সব কিছু। যদিও লেকের পাশটা নোংরা, লেকটা বেশ পরিষ্কার, টলটলে আর শান্ত। কিন্তু একেবারে নির্জন। আমরা দুইজন ছাড়া বোধহয় আর কোন মানুষজন নেই। দুই একজন লোক অলসভাবে কিছু ব্যাগ, জামাকাপড়, গয়না সাজিয়ে বসে আছে। আমরা লেকের পাড়ে বসতে চাইলাম কিন্তু সেখানে সেখানে বেশ দূর্গন্ধ। শেষমেশ আমরা দুইজন লেকের থেকে দূরে একটা গাছের তলায় বসে বসে চেতন ভগতের বই পড়তে লাগলাম। আমি পড়ছিলাম, ‘থ্রি মিস্টেক্স অফ মাই লাইফ’ আর রুবাইদা পড়ছিলো ‘হাফ গার্লফ্রেন্ড’। গাছের ছায়ায় বসে বই পড়তে পড়তেই টের পেলাম যারা মুভি দেখতে গিয়েছিলো তারা এখানে এসে ঘোরাঘুরি করছে। হাত নেড়ে ওদের ডাকলাম। জাফর জানালো ওরা মুভির টাইম ধরতে পারে নাই। তাই মুভি দেখার চিন্তা বাদ দিয়ে এখানে চলে এসেছে।
ঠিক ঠিক ১ টা বাজতেই আমরা উঠে পড়ি। লেকের সামনে থেকেই সস্তায় আমি আর রুবাইদা বেশ কিছু জিনিস কিনে ফেলি। আমি এক জোড়া পিতলের বালা কিনি ৩০ রুপি দিয়ে যেটা কোলকাতায় একটাই বিক্রি হচ্ছিলো ৪০ রুপি করে। রুবাইদা নোটবুক, ব্যাগসহ কিছু গিফট আইটেম কিনে। তারপর আমরা হেঁটে হেঁটেই হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। নির্জন শহরের লোকজন খুবই কম। রাস্তার আইল্যান্ডে রাজার হালে দাঁড়িয়ে আছে গরুর দল। কেউ কিছু বলছে না। হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেলাম হোটেলে। নিচতলায় সেই খাবার জায়গাটায় বসে অর্ডার দিলাম ভেজ থালি। আমাদের দেখেই সাথে সাথেই ভাত, সবজি, ডাল আর দই এসে হাজির হলো। আবার খুব মজা করে খেলাম। আমাদের সাথে খেতে বসেছিলো তানভীর। লোকটা এসে জিজ্ঞেস করে গেলো তানভীরও ভাত খেতে চায় কিনা? তানভীরও মাথা নেড়ে জানালো যে সেও আমাদের মতন ভাত খেতে চায়। এর মধ্যে একজন কোট পরা লোক তানভীরের সাথে বেশ গল্প জুড়ে দিলো। আমরা দল বেঁধে ৪৫ জন এসেছি, ৪০ দিনের জন্য শুনে লোকটা খুব অবাক হলো। তারপর আরও অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলো, আমরা কই কই গেছি, কই কই যাবো এইসব। সবশেষে উনি বললো উনি এই স্টেশনের মাস্টার। লাঞ্চ করতে এখানে এসেছেন। আমরা খেয়েদেয়ে রুমে ফেরত গেলাম। আমাদের রুম বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা এসে উঠলাম নিশাতদের রুমে।
রুমে ঢুকে দেখি মিম আর অন্তরা টিভি দেখছে। আমি চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে দেখি জি স্টুডিওতে ‘রিয়েল স্টিল’ দেখাচ্ছে। আমরা বিছানায় আধ শোয়া হয়ে মুভি দেখতে লাগলাম। অন্যরাও ফেরত আসলো। ৫টা বাজতেই আমরা নিচে নেমে পড়লাম। ১০২ নম্বর রুম খুলে দেওয়া হলো। আমি ভিতরে ঢুকে লাগেজে স্তুপ সরিয়ে আমার ব্যাকপ্যাকটা আবিষ্কার করলাম যেটা আমি গুছিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। মালপত্র টেনে টেনে নিয়ে গোয়েলের পিছনে দিয়ে আসলাম। আমাদের কমিটি পরম ধৈর্য নিয়ে লাগেজ ওঠানো তদারকি করতে লাগলো। আমি আর রুবাইদা গেলাম পানি কিনতে। এখনও পর্যন্ত যতগুলো জায়গায় গেছি, তারমধ্যে সবচেয়ে সস্তা পানি পেলাম এই জয়সাল্মীরে। এক লিটারের বোতল ১০ রুপি করে। আমি আর রুবাইদা বেশি করে পানি কিনে নিলাম সস্তা পেয়ে। পানি কিনে যখন ফেরত আসি তখন ইশতিয়াক আর নিলয় মিলে বাসের ছাদে ভারি ভারি লাগেজ তুলছে। কাজটা যে কি পরিমান কষ্ট সাধ্য সেটা আর নাই বা বললাম।
আমাদের সিট পড়লো একেবারে শেষের দিকে। আমাদের লাগেজের পরিমান দিন কে দিন বেড়েই চলেছে। বাসের পিছনের কম্পার্টমেন্ট, ছাদ সব ভরে এখন ভিতরেও ব্যাকপ্যাক আসতে শুরু করেছে। আমাদের বাসের আইলের পিছন দিকে সাত আটটার মতন হ্যাভার স্যাক এসে জড়ো হয়েছে। সাড়ে ৫টার সময় আহমেবাদের উদ্দেশ্যে বাস ছাড়তেই আমি দিব্যি জুতা খুলে একটা হ্যাভার স্যাকের উপর পা তুলে দিলাম। অল্প একটু পরেই অন্ধকার নেমে পড়লো। বড় একটা গোল চাঁদ আমাদের ফলো করতে করতে ছুটতে লাগলো। বাসের ভিতর ঢুকে পড়তে লাগলো ধবধবে জোছনা। আমরাও গলা ছেড়ে গান গাইলাম। বেশ একটা চমৎকার পরিবেশ তৈরি হলো বাসের ভেতর। এরই মধ্যে বাসের ভেতর একটু উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হলো। অবনী ঝট করে উঠে গিয়ে পরিস্থিতি সামলালো। কথা আর বেশি দূর গড়ালো না। আমরা আবার গান গাইতে লাগলাম। নোভাকে দেখলাম ডেজার্ট নাইট শেষ হয়ে গেছে বলে দুঃখ করতে। ডেজার্ট নাইট শেষ মানে নাকি ইন্ডিয়া ট্যুরই শেষ! বাকি দিন গুলা নাকি দেখতে দেখতেই পার হয়ে যাবে। এত স্বপ্নময়ী একটা ট্যুর শেষ হয়ে যাচ্ছে শুনে আমাদের সবারই মন খারাপ হলো। কিন্তু অবনী সবাইকে ধমক দিয়ে বললো, ‘কে বলে ইন্ডিয়া ট্যুর শেষ? শুধু মাত্র সাউথেই আমাদের ১১ দিন থাকতে হবে। এখনও আমাদের অনেক দিন বাকি আছে’। এ কথা শুনে আমরা সবাই ছোট বাচ্চাদের মত একটা আনন্দ ধ্বনি করলাম।
রাত বাড়তে লাগলো। আমরাও চুপচাপ হতে লাগলাম। এই জার্নিটা অনেক বড়। আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। বোধহয় ঘুমিয়েও পড়েছিলাম। রাত ১২ টার সময় বাস থামল ‘সহযোগ রেস্টুরেন্ট’ এ। আমরা সবাই নেমে পড়লাম বাস থেকে। বাথরুমে যাবার জন্য আমরা ছেলেরা আর মেয়েরা পাশাপাশি লাইন ধরলাম। ফ্রেশ হয়ে এসে খাবারের মেনুর উপর চোখ বুলিয়ে দেখলাম। সবাই দেখলাম কমবেশি বিরিয়ানি অর্ডার দিচ্ছে। আমি আর রুবাইদা ভেবে চিনতে ৮০ রুপির হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি অর্ডার দিলাম। এরপর দেখলাম বাহারি রঙের বিরিয়ানি আসছে। হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি একজনেরটা লাল রঙের অন্যজনেরটা সবুজ রঙের। আবার ভেজ বিরিয়ানি কমলা রঙের, ভেজ পোলাভ সেটা আসলে পোলাও সেটা খালি সাদা। আমার মনে হলো সবগুলো একই জিনিস খালি চালের উপর রঙ্গটা আলাদা। আমরা সবাই বাহারি রঙের বিরিয়ানি খেতে লাগলাম। খেতে তেমন কোনই আহামরি কিছু নয়। রঙ চঙ্গে বিরিয়ানি খেয়ে আমরা আবার বাসে উঠলাম। গোয়েল আবার চলতে শুরু করলো।
কোন স্টপেজ থেকে ছাড়ার পর সবাই নতুন উদ্যমে হৈচৈ করতে শুরু করে। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। আমাদের খোশ গল্পে সরগরম হয়ে উঠলো গোয়েল। মধ্যরাতেও আমাদের গল্প, আড্ডা, হাসি চলতেই লাগলো।