The Mighty INDIA CALLING: পড়াশুনার শহর আহমেদাবাদ এবং হোটেল বিড়ম্বনা (পর্ব ২৩)

গোয়েলে এক বেলা ঘুম দিলে শরীরের তিনটা জায়গায় ব্যাথা করতে থাকে। এক নম্বর- ঘাড়, দুই নম্বর কোমর আর তিন নম্বর হাঁটু। এই তিনটা জায়গায় প্রথমে অল্প অল্প তারপর আস্তে আস্তে ব্যাথা বাড়তে থাকে। ব্যাথা করতে করতে যখন টনটন করতে থাকে তখন ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমারও এরকম গভীর ঘুমের মধ্য থেকে  টনটনে ব্যাথার কারনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমি হালকা নড়াচড়া করে ব্যাথাটা কমিয়ে নিলাম। টের পেলাম ভোর হয়ে গেছে আর কোন এক রাস্তার ধারে আমাদের গোয়েল থেমে আছে। আমরা আহমেদাবাদ পৌঁছে গেছি। কমিটির লোকজন হোটেল খুঁজতে গিয়েছে। আমি আবার চোখ বুজে ঘুম দিতে লাগলাম।

একটু বেলা বাড়তেই বাসের লোকজন অল্প অল্প করে জেগে উঠতে লাগলো। ফিসফাস শুনতে পারছিলাম যে হোটেল পেতে নাকি সমস্যা হচ্ছে। একসময় সবাই জেগে উঠলাম। আমি ভালো করে চারপাশ তাকিয়ে দেখলাম। আমাদের বাস একেবারে একটা বড় রাস্তার পাশে পার্ক করা। রাস্তা দিয়ে হুশ করে বড় বড় বাস, প্রাইভেট কার যাচ্ছে। পাশেই ফ্রেশ হওয়ার মত একটা ছোট খাটো হোটেল আছে। অনেকেই নেমে  হাতমুখ ধুয়ে আসতে লাগলো। অনেকেই বাসেই গ্যাট মেরে বসে রইলো। জুবায়ের ওর কম্বলটা দিয়ে মুখটা ঢেকে বসে রইলো, দেখে মনে হচ্ছিলো ওটা শুধুই কম্বলের দলা। বাইরের হোটেল থেকে ফ্রেশ হয়ে তমা হ্যাভার স্যাকের সারি পার হয়ে সিটের দিকে আসতে লাগলো। জুবায়েরকে কম্বল মনে করে ও একবার ভুল করে জুবায়েরের মাথার ওপর হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠলো। সবাই এক দফা হেসে উঠলো। কয়েক মিনিট পর নিশাতও ঠিক একই ভুল করে চিৎকার দিয়ে উঠলো। সবাই আবার হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলো।

বাসে বসে আমরা অপেক্ষা করতেই লাগলাম। সেই অপেক্ষা আর শেষ হচ্ছে না। সত্যিই তাহলে আমাদের কমিটি হোটেল নিয়ে সমস্যায় পড়েছে। প্রায় দুই ঘন্টা অপেক্ষা করার পর সকাল দশটার দিকে শুভ বাসে সবার উদ্দেশ্যে বললো যে সত্যিই হোটেল পেতে সমস্যা হচ্ছে। কি এক বানিজ্য মেলা না কি যেন হচ্ছে এই শহরে। এই জন্য সব হোটেল বুকড। খালি পাওয়া যাচ্ছে না। কোন রকম একটা হোটেল পাওয়া গেছে কিন্তু সেখানে সবার জায়গা হবে না। কমিটি তাই বিশটা মেয়ে আর চারটা ছেলের নাম ঘোষনা করলো যারা এই হোটেলে যাবে। আর বাকিদের বাসে বসেই অপেক্ষা করতে হবে। এই বিশ জন মেয়ের মধ্যে আমার আর রুবাইদার নাম ছিলো। আমি ব্যাক প্যাক পিঠে নিয়ে নেমে পড়তে লাগবো এমন সময় দেখলাম মৌলির শরীর বেশ খারাপ কিন্তু ও নাম বলা হয় নাই। আমি অনেক বললাম যে আমি থেকে যাই আর ও চলে যাক, কিন্তু কিছুতেই ও রাজি হলো না। শেষমেষ কি আর করা, বাকিদের ফেলে রেখে আমরা নেমে পড়লাম বাস থেকে। আর ওদিকে অপেক্ষা করতে হবে শুনে জেরিন চটপট একটা মিনি প্যাক শ্যাম্পু খুলে মাথায় লাগিয়ে সেই হোটেলের হাত ধোয়ার বেসিনে গিয়ে মাথাটা ধুয়ে ফেললো। হোটেলের লোকজন অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।

আমি, রুবাইদা, মিম আর অন্তরা ১০০ রুপি দিয়ে অটো ভাড়া করলাম- নারোলের বিটিআরএস ওয়ার্ক শপের উল্টাপাশের ‘ত্রুপ্তি হোটেল’। আমরা গুটিসুটি মেরে উঠে বসলাম অটোতে। অনেক্ষন পর অটো আমাদের এক জায়গায় এনে নামিয়ে দিতে চাইলো। আমরা হোটেল কোথায় জানতে চাইলে রাস্তার ওপারে দেখিয়ে দিলো। আমরা দেখতে পেলাম ত্রুপ্তি হোটেলের সাইন বোর্ড। আমরা বললাম একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে। অটোওয়ালা কিছুতেই রাজি হলো না। সে বললো যে সে আমাদের রাস্তা পার করে দিবে- চিন্তার কিছু নাই। আমরা ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। লোকটা অন্তরার ব্যাগটা নামিয়ে দিয়ে কোন ফাঁক দিয়ে পালিয়ে গেলো আমরা টেরই পেলাম না।  প্রচন্ড ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে ফুল স্পিডে গাড়ি যাচ্ছে। এর মধ্যে মালপত্র নিয়ে দুই নম্বুরি অটোওয়ালাকে বকতে বকতে আমরা কোন রকম রাস্তা পার হলাম।

হোটেলের নিচ তলাটা খাবার হোটেল। একটা সিড়ি বেয়ে আমরা দোতলার কাউন্টারে পৌঁছালাম। সেখানে রাজিবের সাথে ম্যানেজারের কথা শুনলাম। উনি বার বার জানতে চাইছেন কতজন মেয়ে আছে আমাদের সাথে। আমি রাজিবকে জিজ্ঞেস করলাম কি কাহিনি? রাজিব বললো উনারা চেষ্টা করছেন একই হোটেলে সবাইকে রাখার জন্য। সবাই না হলেও অ্যাট লিস্ট সব মেয়েদের একসাথে জায়গা দেওয়া যাবে কিনা সেই হিসাব করছেন। আমিও শুনে খুশি হলাম। একটু কষ্ট হলেও সবাই যদি একসাথে থাকা যায় সেটাই ভালো। আমি, রুবাইদা, মিম আর অন্তরা একটা রুম পেলাম দোতলায়। রুমটায় ঢুকে একটু হতাশ হলাম। ছোট অন্ধকার রুম, কোন জানালা নাই। কেমন একটা বদ্ধ বোটকা গন্ধ। কিন্তু কি আর করা, থাকার জায়গা পেয়েছি এই তো বেশি। আমরা একে একে সবাই ফ্রেশ হয়ে নেই। তারপর খেতে নামি নিচের দিকে।

রিসিপশনের সামনে দেখা হয় মজুমদার, আর মৌলির সাথে। আমাদের বাকি সবাইকে এই হোটেলেই জায়গা দেওয়া হয়েছে, তবে বেসমেন্টে। যাই হোক সবাই আমরা একই হোটেলে আছি, এটাই বড় কথা। ওরা দুইজন পেয়েছে একটা ডবল রুম। ওরা আমাকে অফার দিলো ওদের রুমে চলে যাওয়ার জন্য। আমার মনে হলো অফারটা ভালো। রুবাইদাও বললো আমাকে ওদের রুমে চলে যেতে। যাই হোক আমরা নিচে নেমে খেতে বসি। খেতে বসে অর্ডার দেই ভেজ পোলাও। খাওয়াটা খুবই মজা আর দাম অনেক কম। মাত্র ৪০ রুপি। আশেপাশে আমাদের যারা খেতে বসেছিলো সবাই জানালো যে প্রত্যেকের আইটেমই ভালো। শান্তকে দেখলাম ৬ রুপি দিয়ে আইস্ক্রিমের কাপ খেতে। ভাদিলালের আইসক্রিম। এত্ত সস্তা দেখে আমারও খুব খেতে ইচ্ছা করলো। কিন্তু পরে আরেকজনের লাচ্ছি দেখে সেটাই অর্ডার দিলাম। সাদা ঘন গ্লাস ভর্তি লাচ্ছি, এর মধ্যে রুহ আফজা, বাদাম, জেলো আর আইসক্রিম দেওয়া। চামচ দিয়ে খেতে হয়। ৩৫ রুপির লাচ্ছিটা খুবই মজা খেতে।

দারুন মজার এক মগ লাচ্ছি
দারুন মজার এক মগ লাচ্ছি

খাওয়াদাওয়া শেষে আমি আমার রুম থেকে মালপত্র নিয়ে বেজমেন্টে মজুমদারদের রুমে চলে আসি। বেজমেন্টের সিড়িটা দিয়ে ঢুকলে হাতের বাম পাশে প্রথম রুমটাই আমাদের। এছাড়া বেজমেন্টের বাকি রুমগুলোতেও সব আমাদের লোকজন। পুরো বেজমেন্টে কেমন যেন একটা ঘরোয়া পরিবেশ তৈরি হলো। সবাই বেশ হৈচৈ করতে লাগলো। আমি ব্যাগট্যাগ নিয়ে রুমে ঢুকলাম। এই রুমটাও ছোট্ট, কোন জানালা নাই, কিন্তু সেই গুমোট বোটকা কোন গন্ধ নাই। মৌলি গোসল করছে আর মজুমদার অলরেডি গোসল করে ফেলেছে। আমি ব্যাগ খুলে আমার জিনিসপত্র বের করে রেডি হয়ে বসে রইলাম, মৌলি বের হলেই আমি ঢুকবো গোসল করতে। মৌলি বের হলে আমি গোসলে ঢুকি আর ওরা খাওয়ার জন্য বের হয়ে যায়। এইখানে গরম পানির ব্যবস্থা নাই, কিন্তু কলের পানিটাই আরামদায়ক তাপমাত্রার। আমি শান্তিমত গোসল করলাম।

গোসল শেষে নামাজ পড়ে নিলাম। তারপর আমি দোতলার রুমে রুবাইদার সাথে দেখা করতে গেলাম। ওরা তিন জনও রেডি। আমাকে দেখেই বের হয়ে পড়লো। আমরা রিসেপশনের লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম আশেপাশে দেখার মতন কি কি আছে। সব শুনে বুঝলাম সস্তায় কেনাকাটা করার মতন জায়গা আছে একটা যেটা আমরা শুনে বুঝতে পারলাম না। লোকটা কাগজে হিন্দীতে কি যান একটা লিখে দিলো। আমরা বললাম বুঝি নাই, ইংরেজিতে লিখে দিতে। লোকটা একটু অবাক হয়ে লিখে দিলো ‘Lal Darwaja’ আর ‘Khamasa’। বললো বাসেও যেতে পারি, অটোতেও যেতে পারি। সব শুনেটুনে আমরা নেমে পড়ি অটো ঠিক করতে।

অটোওয়ালা আর অন্তরার মোবাইলের ‘অ্যারাউন্ড মি’ অ্যাপসের মধ্যে আপস করে আমরা রওয়ানা দেই ‘তিন দরওয়াজা’ নামক জায়গার দিকে। অটোতে করে ঘুরতে ঘুরতে আমি চারপাশটা দেখতে থাকি। আহমেদাবাদে প্রচুর মুসলমান। আমার কাছে দেখে মনে হলো আহমেদাবাদটা অনেকটাই বাংলাদেশের মতন। মানুষজন, পোশাক পরিচ্ছদ, ঘরবাড়ি, অলিগলি, চিপাচাপা সবই আমার দেশের মতন মনে হলো। খালি রাস্তায় প্রচুর মোটর সাইকেল, আর মেয়ে মোটর সাইকেল চালক সংখ্যায় অনেক বেশি -যেটা আমাদের দেশে একেবারেই কম। সব মেয়েরা বিশেষ কায়দায় ওড়না দিয়ে মুখ আর চুল ঢেকে শুধু চোখ দুটো বের করে মোটর সাইকেল চালায়। প্রথমে দেখে আমি এটাকে হিজাব মনে করেছিলাম। কিন্তু পরে মনে হলো এটা মনে হয় ধুলা বালি থেকে মুখ বাঁচানোর উপায়। আমরা চিপাচাপা গলি দিয়ে যেতে থাকি। একসময় পাড়ার মসজিদ চোখে পড়ে। মুসল্লীরা দল বেঁধে বের হচ্ছে মসজিদ থেকে। কারুকাজ করে সাজানো বেশ কয়েকটা ঘোড়ার গাড়িও চোখে পড়লো। অনেক্ষন ঘুরেফিরে আমরা এসে থামলাম আমাদের গন্তব্যে।

আশেপাশে দেখে আমরা একটু ডান বামে তাকালাম। বেশ বিশাল বাজার বলেই মনে হলো। রাস্তার দুইপাশেই হকাররা বসে আছে। হকারদের বহর দেখে মনে হচ্ছে সামনে নিশ্চয়ই বিরাট কোন মার্কেট আছে। আমরা একদিক থেকে হাঁটা শুরু করলাম। প্রচুর হকার, প্রচুর ভিড়, ডাকাডাকি ধাক্কাধাক্কি – যেন পুরাই চাঁদনি চক গাউসিয়ার সামনের ফুটপাথ। সস্তা, চকচকে জিনিসপাতিতে ভরা চারপাশ। আমরা কোনমতে ভিড় ঠেলে ধাক্কাধাক্কি করে সামনে যেতে লাগলাম। কিন্তু কোন বড় মার্কেট আর দেখতে পাচ্ছিলাম না। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম আমরা। জানতে পারলাম এখানে কোন বড় মার্কেট নাই, সবই রাস্তার হকার। আমাদের মন খারাপ হয়ে গেলো কারণ এইসব জিনিস তো আমরা কিনতে আসি নাই। রাস্তার এক ধারে দাঁড়িয়ে দিলাম খোঁজ অ্যারাউন্ড মিতে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে আমরা ঠিক করলাম, যাবো আলফা ওয়ান শপিং মলে। অটো ঠিক করে রওয়ানা দিলাম ‘বস্ত্র পুর’ এর উদ্দেশ্যে।

এটা অনেক দূরের রাস্তা। আমরা আহমেদাবাদের পুরানো এলাকায় ছিলাম যেটা অনেকটা আমাদের পুরানো ঢাকার মত। এরপর একটা নদী পার হলাম যেটার নাম সবরমোতি। নদীটা পার হওয়ার পর থেকেই আমরা নতুন আহমেদাবাদ দেখতে পেলাম। নতুন চকচকে প্ল্যান করা শহর যেন বলে মনে হলো। ঠিক যেন আমাদের দেশের গুলশান বা বনানীর রাস্তাগুলো। সব ঝকঝকে দোকানপাট, ঝাঁ চকচকে দালান আর সাইন বোর্ড চোখে পড়তে লাগলো। বস্ত্র পুরে এসে যখন নামলাম আলফা ওয়ানের সামনে, সুন্দর চকচকে মার্কেটটা দেখে আমরা বেশ খুশি হয়ে গেলাম। বেশ বড় মলটা এল শেপের, বাইরে অনেক খোলা জায়গা, সেখানে অনেক গাড়ি আর মোটর সাইকেল পার্ক করা আছে। আমরা খুশি খুশি মনে ভিতরে ঢুকলাম।

নিচ তলায় বেশ বড় বড় লাইফস্টাইল স্টোর। আমরা সেরকম একটাতে ঢুকে গেলাম। অনেক বড় স্টোর। ঘুরতে ঘুরতে এখানে ফাস্ট ট্র্যাকের সেই ঘড়িটা পেয়ে গেলাম। সাথে আরও একটা গোবদা ঘড়ি ছিলো সেটাও পছন্দ হলো। দেশে ভাইয়াকে এস এম এস করে মডেল নম্বর পাঠালাম। ভাইয়া দেখে আমাকে আগের ঘড়িটাই সাজেস্ট করলো। বেশ কয়েকবার চিন্তা করলাম, ২০০০ এর মত রুপি খরচ করে এখনই ঘড়িটা কিনবো নাকি পরে ফেরার সময় কোলকাতা থেকে কিনে নিবো। এইসব চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরতে লাগলাম। সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় সাজানো আছে যেগুলো আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। মিম আর অন্তরা কসমেটিক কিনলো। আমরা এই স্টোরের বাইরে অনেক সুন্দর সুন্দর জামাকাপড়ের দোকান দেখলাম। কয়েকটা দোকানে দেখলাম ৭০% ছাড় দেওয়ার পরও দাম আমার সাধ্যের বাইরে। এর মধ্যেও বিবা, ফ্যাব ইন্ডিয়া, হ্যাম্লিস, এইসব দোকানে পারফিউম, কস্মেটিক্স, খেলনা এইগুলো আমরা দেখতে লাগলাম। এই দোকান ঐ দোকান দেখতে দেখতে কখন যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে তা টের পাই নাই আমরা। দামি এই মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে আমার মনে হলো এখানকার জিনিস অনেক সুন্দর এবং একইসাথে দামও অনেক চড়া। এরই মধ্যে পেয়ে গেলাম একটা ফাস্ট ট্র্যাকের শোরুম। এইবার আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, যা আছে কপালে- কিনে ফেলি ঘড়িটা। ঘড়িটা কিনে খুশি খুশি মনে গেলাম খাওয়া দাওয়া করতে ‘সাবওয়ে’ তে।

সাবওয়ের লোভনীয় ননভেজ মেনুগুলো বাদ দিয়ে আমি আর রুবাইদা অর্ডার দিলাম ১৩০ রুপির ভেজ আইটেম ‘চানা চটপটা’। রুবাইদার সেরকম ভালো না লাগলেও আমার কাছে খাবারটা পছন্দই হয়েছিল। পেট ভরে খেয়ে দেয়ে আমরা বের হলাম সাবওয়ে থেকে। মোটামুটি রাত ৮ টা বেজে গেছে। নিচে নেমে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা অটো ঠিক করতে লাগলাম। অন্তরা চিৎকার করে ডাকতে লাগলো, ‘ও ভাইসাব, নারোল জাওগি কেয়া? চান্দোলা লেক, বি আর টি এস ওয়ার্কশপকে পাস?’। বেশিরভাগ অটোওয়ালাই যেতে চাইলো না। তারপর কোনরকম একটা অটো রাজি হওয়ার সাথে সাথেই আমরা উঠে পড়ি।

পুরো ইন্ডিয়াতে আমি বেশিরভাগ অটোতেই কারও না কারও কোলে চড়ে পার করেছি। আহমেদাবাদ আসার পর থেকেই রুবাইদার কোলে বসেই সারাদিন ঘোরাঘুরি করা হয়েছে। এবারও তাই হলো। আমরা গাদাগাদি করে বসলাম। অটো আমাদের নিয়ে ছুটতে লাগলো পুরানো আহমেদাবাদের দিকে। আমি গলা বাড়িয়ে দেখতে লাগলাম হলুদ সোডিয়াম আলোতে উদ্ভাসিত রাতের আহমেদাবাদ শহরকে। রাস্তা ভর্তি গাড়িঘোড়া, রাতেও প্রচুর মানুষজন চারপাশে। আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে লাগলাম। আমাদের কথা শুনে অটোওয়ালা কি কি সব বলতে লাগলো, আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। এখানকার লোকজনের ভাষায় হিন্দীর সাথে গুজরাটি ভাষা মিশানো থাকে। গুজরাটি টোনের হিন্দী আমাদের বুঝতে অনেক কষ্টই হয়। আমরা কোনরকম হ্যাঁ, না- এসব বলে বলে টাইম পাস করতে লাগলাম।

ওদিকে অটোওয়ালা অনেক দূর গিয়ে এক জায়গায় এসে আমাদের জিজ্ঞেস করতে লাগলো যে আমাদের হোটেল আর কত দূর, উনি নাকি রাস্তা চিনেন না। আমাদের মেজাজটা গেলো খারাপ হয়ে, ব্যাটা যদি আগে বলতো যে উনি রাস্তা চিনে না তাহলে তো উনাকে আমরা নিতাম না। আমরা বললাম উল্টা পালটা না গিয়ে রাস্তার কাউকে জিজ্ঞেস করে নিতে। উনি এক দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করে বললো যে এটা নাকি আরও সামনে আর এজন্য ওনাকে আরও ২০-৩০ রুপি এক্সট্রা দিতে হবে। সব শুনে আমাদের মেজাজ বেশ খারাপ হয়ে গেলো অটোওয়ালার উপর। আমরা সেই মূহুর্তেই ভাড়া পরিশোধ করে অটো থেকে নেমে পড়লাম। তারপর পায়ে হাঁটা শুরু করলাম। প্রায় ১০-১৫ মিনিট হেঁটে আমরা পেয়ে গেলাম আমাদের ‘ত্রুপ্তি হোটেল’। সেই সকাল থেকেই আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা টের পেলাম আহমেদাবাদ শহরের একমাত্র বিরক্তিকর জিনিস হচ্ছে ‘অটো’ আর ‘অটোওয়ালা’।

হোটেলে ফিরে বেজমেন্টের সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে আমার রুমের দরজা খুললাম আমি। মজুমদাররাও ফিরে আসলো কিছুক্ষনের মধ্যে। ওদিকে হিমি, শুভ, সীমান্ত, ইশতিয়াক ওরা সবাই ওদের রুমের চাবি নিয়ে রুমমেট না আসা পর্যন্ত আমাদের রুমে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। আমাদের ছোট রুমটা হাসিতে আর আড্ডায় গমগম করতে লাগলো। আহমেদাবাদে এসে মোবাইলে নেটের হাই স্পিড পেয়ে অনেকেই বাসায় ভিডিও কনফারেন্স করে ফেলেছে। আমি রুম থেকে বের হয়ে বেসমেন্টের সিড়িতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাসায় ভিডিও কল দিলাম। অনেক দিন পর বাসার সবার চেহারা দেখলাম। আমার ছোট্ট ওয়াফি গোলাপি ফ্লানেলের জামা পরে আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। অনেক্ষন ধরে কথা বললাম বাসার সবার সাথে। আমার বেজমেন্টের রুমটা দেখালাম। বাসার সবাই দেখলো আমার রুম ভর্তি মানুষজন গল্প গুজব করছে!

সবাই আস্তে আস্তে চলে গেলো আমাদের রুম ছেড়ে। পরেরদিন আমাদের মুভি দেখতে যাওয়ার এবং ডিনারের প্ল্যান সবাইকে রুমে রুমে এসে জানিয়ে দেওয়া হলো। কিছুক্ষণ গল্প গুজব করে আমরা লাইট নিভিয়ে ফ্যান ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *