The Mighty INDIA CALLING: সুনীল সাগরের গোয়ায় পদার্পন এবং গোয়েলের বিদায় (পর্ব ২৮)

খুব ভোরে গোয়েল আমাদের নিয়ে এক বাজারের মতন জায়গায় থামে। আমাদের সবাইকে ডাকাডাকি করে উঠিয়ে দেওয়া হলো। আমরা ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙ্গে বাস থেকে নেমে দেখি গ্রামের একটা ছোট্ট বাজারে এসে পড়েছি। এখনও কোন দোকানপাট খুলে নাই। এখানে থেমে আমাদের কি লাভ হলো বুঝতে পারছিলাম না। কমিটির লোকজন আমাদের জানালো সামনে আর কোন থামার জায়গা নাই। তাই এখানেই ফ্রেশ হয়ে নিতে হবে। কি আর করা, আমরা জনমানবশূন্য এক বাজারের মধ্য দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

সন্ধান পেলাম এক বাথরুমের। মেয়েদের জন্য একটা জায়গায় লাইন, একটু পাশেই ছেলেদের লাইন অন্য একটা বাথরুমের জন্য। মেয়েদের লাইনে আমি মোটামুটি মাঝের দিকেই দাঁড়ালাম। লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম, একেকজন আতংকজনক চেহারা নিয়ে বাথরুম থেকে বের হচ্ছে। আমরা লাইনে যারা ছিলাম সবাই ভয় পেয়ে গেলাম, এতই খারাপ অবস্থা বাথরুমের! লাইনে একটু সামনে দাঁড়ানো নোভা সবার কাছ থেকে অভিজ্ঞতা শুনে আমাদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিলো যে, এখানে দুইটা বাথরুম আছে। একটা খুব খারাপ, আরেকটা একটু কম খারাপ। আমরা খুব খারাপটাতে না গিয়ে একটু কম খারাপটাতে যাচ্ছি। তবে সেটার অবস্থাই এত খারাপ যে কেউ কিছু বলতে রাজি হচ্ছে না! আমি এই ফাঁকে ছেলেদের লাইনের দিকে গিয়ে খবর নিয়ে আসলাম ওদের বাথরুমের অবস্থা কেমন? আমাকে জাফর বললো, ‘এদিকের কথা জিজ্ঞেস করার কথা চিন্তাও করিস না’। আমি আর জিজ্ঞেস না করে চলে আসলাম।

যাই হোক একে একে সবাই আমরা ভয়ংকর এই পর্বটা শেষ করলাম। তারপর আমি গেলাম দাঁত মাজতে। রাস্তার পাশে ক্ষেতের ধারে একটা পানির কল পেলাম। কিন্তু কলটা বড়ই অদ্ভূত! সাধারণত কল ছাড়লে পানি উপর থেকে নিচে পড়ে, কিন্তু এই কল ছাড়লে পানি ডান থেকে বামে আড়াআড়িভাবে বের হয়। কল ছেড়ে মুখ ধুতে গিয়ে আমি প্রায় পুরো ভিজে গেলাম। আরও অনেকেই আসলো দাঁত মাজতে, আমি তাদের সবাইকে সাবধান করে দিলাম এই অদ্ভূত কলের ব্যাপারে। তাতেও খুব লাভ হলো না, কয়েকজন আবার আমার মতই ভিজে গেলো!

হাতমুখ ধোয়া শেষে যখন আবার রাস্তায় এসে উঠলাম, ততক্ষণে দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে। আমি একটা দোকান থেকে কেক আর বিস্কুট কিনে নিলাম। এই দিয়ে নাশতা সারতে হবে। আমরা যখন কেক খাচ্ছিলাম তখন কোথা থেকে যেন এক বাস ভর্তি স্কুলের ছাত্রীরা এসে হাজির হলো। ইউনিফর্ম দেখে মনে হলো, গ্রামের কোন স্কুল হবে- হয় তো পিকনিক করতে বের হয়েছে। আমাদের মেয়েদের লাইন তখনও শেষ হয় নাই। আমরা মনে মনে হাসলাম, এদের তো অনেক দেরি হবে। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে ওরা সবাই আরেকটা যে বাথরুম আছে ‘খুব খারাপ’, সেটাতে লাইন ধরে ঢুকতে লাগলো। মনে হলো আমরা সবাই মিলে কেন এক লাইনে দাঁড়িয়ে আছি সেইটা নিয়ে ওরা বেশ অবাক হয়ে গেলো!

খাওয়া শেষ করেই আমরা আবার দৌড়ে বাসে উঠলাম। মাইশার ফল কিনতে একটু দেরি হয়ে যাচ্ছিলো দেখে নিলয় দৌড় দিয়ে তাগাদা দিয়ে ওদের নিয়ে আসলো। আমাদের বাস আবার ছেড়ে দিলো। এবং বরাবরের মতই আমরা চলতে শুরু করলাম। আস্তে আস্তে কড়া রোদ বাড়তে লাগলো। বাসের এক পাশের জানালা দিয়ে গনগনে রোদ ঢুকতে লাগলো। আমরা সবাই যার যার কম্বল দিয়ে জানালা ব্লক করে দিলাম। কয়েকদিন আগেও কম্বলটা জড়িয়ে এই বাসের মধ্যেই ঘুমিয়েছি, আর এখন কম্বলটা দিয়েই রোদ আটকিয়ে গরম কমানোর চেষ্টা করছি, কি অদ্ভূত!

গুগল ম্যাপে যখন থেকে দেখাতে লাগলো গোয়ায় ঢুকে পড়েছি, তখন থেকেই চারপাশের দৃশ্যপট বদলে গেলো। সরু রাস্তা, দুপাশে দোতলা তিনতলা বাড়ি, অন্যরকম চেহারার মানুষজন আর প্রচুর সাদা চামড়ার টুরিস্ট দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম। এক পর্যায়ে আমাদের বাস এসে থামলো এক জায়গায়। কমিটির লোকজন হোটেলের খোঁজ খবর নিতে গেলো। আমরা অনেক্ষণ বাসে বসে রইলাম। তারপর গ্রিন সিগনাল পেয়ে সব মালপত্র নিয়ে নেমে পড়লাম গোয়েল থেকে। আমার একটা সোয়েটার ইচ্ছা করেই রেখে দিলাম গোয়েলে। আর একবার হার্ডব্রেক করার সময় প্যাকেটের ভিতর থেকে সুভেনিয়র হিসেবে রেখে দেওয়া ক্যাফে কফি ডের বেলজিয়ান চকো শটের ছোট্ট গ্লাসটা ছিটকে পড়ে গিয়েছিল। ঐটা আর খুঁজে পেলাম না। এই দুইটা জিনিস ছাড়াই হাজির হলাম গোয়েলের পিছনে লাগেজ নেওয়ার জন্য। শেষবারের মত পাংকু হেল্পার আমাদের লাগেজ নামিয়ে দিলো। গোয়েলকে টাটা বাই জানিয়ে কাঁধে হ্যান্ড ব্যাগ, পিঠে ব্যাগ প্যাক, হাতে খাবারের প্যাকেট আর বড় লাগেজ- এই চারটা জিনিস নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। কাঁচা এবড়ো থেবড়ো রাস্তা দিয়ে ট্রলি ব্যাগটা টানতে টানতে কয়েক কদম সামনে যেতেই হাঁপিয়ে গেলাম।

দে
আমাদের গোয়েল (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

দীর্ঘদিন পর সব লাগেজ একসাথে নিয়ে হাঁটছি, তাও আবার কাঁচা রাস্তায়! দম সব বের হয়ে গেলো। কিন্তু বসে থাকলে তো চলবে না, জোরে নিশ্বাস নিয়ে আবার হাঁটতে লাগলাম। আশেপাশে দেখতে লাগলাম সবারই প্রায় একই অবস্থা। আর দূরত্বটাও নেহায়েত কম নয়, গলির পর গলি হেঁটে যেতে লাগলাম। রাস্তা যেন শেষ হয় না। লাগেজ টানতে টানতে যখন হাতে লাল টকটকে দাগ পড়ে হাত অবশ হয়ে গেলো, পায়ের মাংসপেশী যখন টনটন করতে লাগলো, পরিশ্রমের চোটে আমাদের গাল, মুখ, চোখ যখন লাল হয়ে গেলো- তখন এক চিপার মধ্যে আমাদের রেস্ট হাউজের সন্ধান মিললো। একটা চিপা দিয়ে ঢুকলে ছোট্ট একটা উঠান, তার এক পাশে এক তলা একটা বাড়ি আর অন্য পাশে দোতলা একটা বাড়ি। একতলা বাড়িটাতে দুইটা রুম, দুইটাই ছেলেদের। আর দোতলা বাড়িটাতে মোট চারটা রুম, চারটাই মেয়েদের। আমি এসে দেখি নিচ তলার রুম দুইটায় অলরেডি মায়িশারা আর উর্মিরা উঠে পড়েছে। এই ভারি লাগেজ সিড়ি দিয়ে টেনে টেনে দোতলায় তুলে প্রথম রুমটাতেই ঢুকে আমি বিছানায় ধড়াম করে পড়ে গেলাম।

বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতেই দেখলাম মিম আর অন্তরা এসে বললো ওরাও এই রুমে থাকবে, প্রত্যেক রুমে বরাদ্দ ছয় জন করে। ওরাও মাল পত্র রেখে আমার মত ফ্ল্যাট হয়ে বিছানায় পড়ে গেলো। একে একে মৌলি, মজুমদার, রুবাইদা- সবাই এলো। মৌলি আর মজুমদার চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘গরম কাপড় সব ফেলে দিবো, সঅঅঅব- এই ব্যাগ টানা সম্ভব না’। আমরা খানিকটা ধাতস্থ হয়ে খেয়াল করলাম রুমটা মোটামুটি বড়। ডবল বেডটায় চারজন শোয়া যাবে আর বাকি দুইজনকে ফ্লোরিং করতে হবে। রুমে একটা এসিও আছে দেখে আমরা বেশ খুশি হয়ে গেলাম। বাথরুমটাও চমৎকার আর এই প্রথম কোন বাথরুমে আমরা হ্যান্ড হোস পাইপ পেলাম। আমরা যখন এইসব গবেষণা করছিলাম তখন রিন্তু এসে হাজির হলো। ওকেও এই রুমে থাকার জন্য পাঠানো হয়েছে। সব মিলিয়ে আমরা হলাম সাতজন!

ঝটপট করে আমরা আমাদের লাগেজ খুলে জামাকাপড় বের করে নিলাম। এতদিন পড়ে থাকা কেডসটাকে বারান্দায় দিলাম শুকানোর জন্য। বের করে নিলাম স্পঞ্জের স্যান্ডেল। সকল জিনস বাদ দিয়ে পায়জামা বের করে নিলাম। জামার সাথে পায়জামা আর স্কার্ফের কোন মিল নাই, কিন্তু তাতে কি? একটা হলেই হলো! এর মধ্যে আমি লক্ষ করলাম আমার হাত আর পায়ে বড় বড় জায়গা জুড়ে নতুন চামড়া উঠছে। মিম হাসি মুখে বললো, ‘পরিশ্রমের ঠ্যালায় তোর নরম চামড়া পড়ে গিয়ে শক্ত চামড়া উঠছে। তবে দেশে গিয়ে যখন আবার পরিশ্রম বন্ধ করে দিবি তখন আবার এই শক্ত চামড়া পড়ে গিয়ে নরম চামড়া উঠবে’। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। একটু ফ্রেশ হয়েই সবাই খাওয়া দাওয়ার জন্য বের হয়ে পড়লাম। আমাদের চিপাটার সামনেই ‘ভিন্সি’স প্লেস’ এ গেলাম সবাই মিলে।  গিয়ে চটপট একটা টেবিলে বসলাম। কি অর্ডার দিবো না দিবো ভাবতে ভাবতেই শুভ এগিয়ে আসলো। প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দিলো কড়কড়ে এক হাজার রুপির নোট। খুশিতে আমরা চিৎকার দিয়ে উঠলাম! শুভ জানালো এটাই ওর ‘গোয়ার সারপ্রাইজ’। শুনে রুবাইদা বলে উঠলো, ‘সত্যিই খুশিতে চোখে পানি চলে আসছে’। এতদিন ধরে চলতে চলতে অনেকেরই টাকা পয়সায় টানাটানি পড়ে যাচ্ছে। গোয়ায় এমনিতেও সব কিছু একটু দামি, সেখানে হুট করে এক হাজার রুপি পাওয়া বিশাল ব্যাপার!

আমি আর অন্তরা ভেবে চিন্তে অর্ডার দিলাম ২২০ রুপির প্রন থালি। সমুদ্রের কাছাকাছি জায়গায় এসে মাছ জাতীয় খাবার খেতেই মন চাইলো। খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, তাড়াতাড়িই চলে আসলো প্রন থালি। চিংড়ি মাছের তিন রকমের পদ আর সাথে ভাত। মুখে দিয়েই মুগ্ধ হয়ে গেলাম, এত মজার খাবার! একটা পদ ছিলো ছোট চিংড়ি মাছকে সামুদ্রিক মাছের ডিম দিয়ে মাখিয়ে মচমচে ফ্রাই। খেতে এতই মজা ছিলো, কি আর বলবো- আমি আর অন্তরা কোন কথাবার্তা না বলে গপাগপ খেতে লাগলাম।  আশেপাশে যারা ছিলো তারা সবাই নিজেরদেরটা খেয়ে টেস্ট খুবই হাই ক্লাস বলতে লাগলো। আমি বুঝলাম, গোয়ার খাবারের দাম যেমন বেশি, টেস্টটাও সেইরকমই!

ভরপেট খাওয়া দাওয়া করে আমরা বিচে ঘুরতে গেলাম। আমরা যেই জায়গাটায় আছি সেটার কাছাকাছি যে বিচটা সেটার নাম কালাংগুটে বিচ। বলতে গেলে আমাদের রেস্ট হাউজ থেকে খুবই কাছে, দুই মিনিটের হাঁটা পথ। সবাই দল বেঁধে বিচে গেলাম। মোটামুটি শান্ত বিচ, তেমন কোন ভিড়ভাট্টা নাই। সবাই নামতে শুরু করলো পানিতে। জোয়ারের সময়, তাই চিন্তার কিছু নাই। তার উপর সমুদ্রে সেফ জোনের মোটামুটি একটা সীমানা টানা আছে, সেই সীমানা ক্রস করলেই লাইফ গার্ড টাইপের লোকজন বাশি ফুঁ দিতে দিতে চলে আসে। বিশাল সমুদ্রের ঢেউয়ের ঝাপটায় আমাদের সব ক্লান্তি মুছে গেলো নিমেষেই।  আমি পায়ের গোড়ালি ভিজিয়ে বিচ ধরে হাঁটতে লাগলাম। গোয়ার বিচটা কক্সবাজারের মত এত সুন্দর বলে মনে হলো না। তবে বিচে অনেক রকম অ্যাক্টিভিটি করার সুযোগ আছে, যেমন প্যারাসেইলিং, ওয়াটার স্কুটার, স্পিডবোট ট্রিপ, ব্যানানা রাইডিং সহ আরও অনেক কিছু। বিচ দিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট জিপ গাড়ির মত এক ধরনের গাড়ি। আর একেবারেই বিচের পাশেই বড় বড় শ্যাক। সেখানে সি ফুডের পাশাপাশি নানা রকম অ্যালকোহলের বোতলও সাজিয়ে রাখা হয়েছে সুন্দর করে। এই সব কিছু মিলে বিচটাকে আকর্ষনীয় করে তুলেছে। কিন্তু কক্সবাজারকে আমার মনে হয়েছে আলগা জিনিসপাতি দিয়ে আকর্ষনীয় করার দরকার নাই, সে নিজেই চমৎকার!

এর মধ্যে আমাদের কয়েকজন দেখলাম স্পিড বোটওয়ালার সাথে দরাদরি করছে। বোট ঠিক হয়ে গেলে আমরাও উঠে পড়লাম। প্রত্যেকের জন্য আলাদা সিট, সাথে আবার লাইফ জ্যাকেট পড়ে বসতে হয়। আমাদের নিয়ে বোট ঘুরে আসলো কয়েক মিনিট। বোট থেকে নেমে আমরা ভাড়া মিটিয়ে দিলাম পার হেড ৮০ রুপি করে। আবার গোড়ালি পানির উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে কালাংগুটে বিচের দিকে যেতে লাগলাম। গিয়ে শুনলাম ঢেউয়ের ঝাপ্টা ফাহাদের পকেট থেকে সানগ্লাস আর নিলয়ের পকেট থেকে হোটেল রুমের চাবি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আমরা এই নিয়ে বেশ হাসাহাসি করলাম। ততক্ষনে সূর্য প্রায় ঢলে পড়েছে। সবাই মিলে সূর্যাস্ত দেখলাম। বিশাল কমলা আকাশে টুপ করেই হারিয়ে গেলো ছোট সূর্যটা। সবার জামাকাপড়ই ভেজা, আর লবন বালিতে শরীর কুটকুট করতে লাগলো। সবাই সময় নষ্ট না করে রওয়ানা দিলো হোটেলের উদ্দেশ্যে।

দফচ
গোয়ার সমুদ্রে সূর্যাস্ত (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

রুমে গিয়েই সবার আগে মৌলি গোসলে ঢুকলো। তারপর মজুমদার। মজুমদারের গোসল অর্ধেক হওয়ার পর পানি শেষ হয়ে গেলো। ও বাথরুম থেকে চিৎকার করতে লাগলো পানির জন্য। আমি পাশের রুমে গেলাম। গিয়ে শুনলাম ওদের বাথরুমে বাসিরুনও গোসল করতে গিয়ে পানির অভাবে আটকা পড়ে আছে। বারান্দা দিয়ে নিচে তাকিয়ে ছেলেদের ডাকাডাকি করলাম। কৌশিক বের হয়ে আসলো। ও বললো কলে পানি নাই, কিন্তু আধা বালতি পানি আছে। চাইলে সেটাই নিতে পারি। কি আর করা তাই নিতে রাজি হলাম। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে আসতে দেখলাম শান্ত মুখে ফেসপ্যাক লাগিয়ে বসে আছে। আমি পানি নিয়ে যাচ্ছি দেখে ও বললো ওর নাকি মুখ ধুতেই এই পানি লাগবে।  এই নিয়ে কথা বার্তা হতে হতেই উপর থেকে খবর আসলো যে কলে পানি চলে এসেছে।

একে একে আমরা সবাই গোসল করলাম। আমরা গোসল শেষে সব কাপড় চোপড় ধুয়ে বারান্দায় মেলে দিলাম। এই প্রথম কোন জায়গায় আমরা স্বাধীনভাবে ধোয়া কাপড় মেলে শুকাতে দিতে পারছি। কাপড় মেলে দিতে দিতে যখন পুরো বারান্দা ভরে গেলো তখন আমরা সিঁড়ির রেলিংগুলোতেও কাপড় মেলে দিতে লাগলাম। গোসল এবং কাপড় চোপড় ধোয়ার ফলে বাথরুমে বালির স্তুপ জমে গেলো আর সারা রুম কেমন কাদাকাদা হয়ে গেলো। সবার শেষে বাকি ছিলো রুবাইদা। ও বললো ও ই নাকি সারা রুম গুছিয়ে পরিষ্কার করে দিবে। আমরা ওর গোসল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইলাম, কিন্তু ও আমাদের সবাইকে ঘুরে আসার জন্য বললো। আমি বিপদ আপদের কথা তুলতেই সাহসী রুবাইদা সেগুলো হেসেই উড়িয়ে দিলো। আমরা বললাম তারপরও আমরা দূরে কোথাও যাচ্ছি না, আমাদের বাকি লোকজনের জন্য আরেকটা যে রেস্ট হাউজ আছে সেটাতেই যাচ্ছি। একটু পর চলে আসবো।

আমাদের বারান্দা থেকেই দেখা যায় আরেকটা রেস্ট হাউজ। রাস্তায় নেমে হাতের বাম পাশে কয়েকটা বাসা পার হলেই চলে আসে সেই বিল্ডিঙ্গটা। নিচ তলায় আমাদের কেউ নাই। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। নিশাত তখনও রেডি হয় নাই। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিশাত, তমা, পৃথ্বীদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে দেশে ফোন দিলাম। আম্মুর সাথে কথা বললাম। আম্মু বারবার সমুদ্র থেকে দূরে থাকার জন্য সাবধান করে দিলো। বাসার সবার কথা জিজ্ঞেস করলাম। শুনলাম ভাতিজা ছোট্ট ওয়াফির জন্য ওর মামি একটা খেলনা এনে দিয়েছে সেইটা নিয়ে ও এখন সারাদিন ব্যস্ত থাকে।

ওদিকে নিশাত, তমা আর পৃথ্বীর হয়ে যেতেই আমরা নেমে পড়লাম। আমি আবার আমাদের রেস্ট হাউজে ছুটে গেলাম রুবাইদার জন্য। গিয়ে দেখি এলাহি কারবার! রুবাইদা ওর রিজেক্টেড জামাকাপড় সব বের করে একটা জামা দিয়ে সারা রুম মুছে চকচকে করে ফেলেছে। একটা পাতলা সোয়েটার রেখেছে বাথরুমের সামনে পাপোশ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। সবার এলোমেলো লাগেজ সব এক পাশে সরিয়ে ফ্লোরে শোবার জন্য বন্দোবস্ত করে রেখেছে। এত কিছু করতে গিয়ে ওর গোসলে যাওয়াই হয় নাই। আমি রুমে থাকতে চাইলেও আমাকে ও জোর করে ডিনার খাওয়ার জন্য রিন্তু, তমাদের সাথে পাঠিয়ে দিলো। কি আর করা, রুবাইদাকে ছাড়াই আমরা খেতে চলে গেলাম।

আমরা সবাই মিলে হাঁটতে লাগলাম রাস্তা দিয়ে। চিপা চিপা অন্ধকার গলি গলি রাস্তাগুলো দেখতে সুবিধার লাগে না। অনেক ডান বামে ঘুরে শেষমেশ আমাদের গোয়েল যেখানে নামিয়ে দিয়েছিলো সেখানে পৌঁছে একটা সুন্দর রেস্টুরেন্ট পেলাম যার নাম ‘ভিক্টোরিয়া হোটেল’। কোন একটা বাড়ির উঠানে ছনের ছাউনি দিয়ে সুন্দর টেবিল চেয়ার পাতা আছে। বেশ ঘরোয়া পরিবেশ। ঢুকেই দেখি পাশের টেবিলে রিজভী, তুষার, জেরিন, আদিবা, আফরা- ওরা বসে আছে। আমরাও চটপট অর্ডার দিলাম। আমি শেয়ারে নিলাম মিক্সড ফ্রায়েড রাইস আর প্রণ চিলি। মিম নিলো কালামারি। আমরা সবাই এক জন আরেকজনেরটা শেয়ার করলাম। রান্না খুবই মজা ছিলো। আমরা গোয়ার রান্নার প্রেমে পড়ে গেলাম। হাসি আর গল্পগুজবের মধ্যে আমাদের খাওয়া শেষ হলো। আমার ভাগে বিল আসলো ১৫৮ রুপি। সব বিল মিটিয়ে দিয়ে আমরা বের হয়ে আসলাম। আমাদের আরও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করার শখ ছিলো। কিন্তু নির্জন অন্ধকার রাস্তাঘাট দেখে আর ঘুরতে ইচ্ছা হলো না। আমরা আবার হেঁটে হেঁটে আমাদের হোটেলের দিকে যেতে লাগলাম।

আবার সেই অন্ধকার গলিঘুপচি দিয়ে যেতে যেতে এক সময় আমাদের মনে হলো, ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি তো? ভালো করে ডান বাম দেখে হাঁটতে হাঁটতে একসময় দেখা হলো সুমাইয়া, রাফাত আর শান্তর সাথে। ওদের কাছে শুনলাম, কৌশিক হাতে একটা ড্রাগন ট্যাটু করিয়েছে। রাফাত ওর মোবাইলে ভিডিও দেখালো। আমরা দেখলাম ড্রিল মেশিনের নিচে হাত রেখে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিচ্ছে কৌশিক। তারপর সুমাইয়া আমাদের সাথে যোগ দিলো। আমরা সবাই একসাথে ভিন্সি’স প্লেসে ঢুকলাম। দেখি রুবাইদা সুন্দর একটা টেবিলে একা বসে আছে। আমরা গিয়ে যোগ দিলাম ওর টেবিলে। ও নাকি কি এক পাস্তা অর্ডার দিয়েছে। অর্ডার নেয় যে লোকটা সে ওকে বলেছে আমাদের সবাই নাকি এটাই নিচ্ছে।

ওর অর্ডার আসলে আমরা একটু টেস্ট করে দেখলাম। অসাধারণ টেস্ট! আমি চটপট একটা অর্ডার দিয়ে দিলাম, ‘মাশ্রুম ক্রিম পাস্তা’। আমি সাধারনত শখ করে পাস্তা খাই না। কিন্তু এই পাস্তাটা এতো মজা যে আমি ভরা পেটেও শেয়ারে একটা অর্ডার দিয়ে ফেললাম। বিশাল এক থালা ভর্তি শশা দিয়ে সাজানো সাদা ক্রিমে মাখানো পাস্তা এসে হাজির হলো। পুরো ট্যুরে এই প্রথম কোন এক জায়গায় আমি শশা পেলাম। এই দেশে সবাই সালাদ বলতে পিয়াজ অথবা মুলা কুচিকে বোঝে। শশা বা টমেটু যে সালাদ হিসেবে খাওয়া যায় সেটা এরা জানেই না। বহুদিন পর শশা পেয়ে ঝাপিয়ে পড়লাম আমি। পাস্তা মুখে দেওয়ার আগেই শশাগুলো চিবাতে লাগলাম। আর মজাদার পাস্তাটার কথা আর নাই বা বললাম- আমি পাস্তার সাথে সাথে নিজের প্লেটের সব শশা শেষ করে সুমাইয়ার প্লেটের শশাগুলোও খেয়ে ফেললাম। খাওয়া শেষে চেখে দেখলাম সি ফুড সুপ। উফ, সুপটাও এত্ত মজা-

পেট ওভার লোডেড করে আমরা যার যার রুমে ফেরত আসলাম। নিশাতের রুমের চাবি অন্যের কাছে। ওরা এখনও আসে নাই। তাই বললাম নিশাতকে আমাদের সাথে থেকে যেতে। আমাদের এক্সট্রা তোষক দিয়ে গেছে। নিচে আমরা ফ্লোরিং করলাম। রুবাইদা এক পাশে, আমি, নিশাত আর রিন্তু আরেক পাশে। সারা দিনে কম কষ্ট হয় নাই। তাই বেশি দেরি হলো না, ঘুম চলে আসলো।

 

 

The Mighty INDIA CALLING: ইলোরার অদ্ভূত জগতে সারাদিন (পর্ব ২৭)

ঘুম থেকে উঠার আগেই টের পেলাম মজুমদার সুস্থ হয়ে উঠেছে। ওই আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে লাগলো। মজুমদার একদম ভোরে উঠে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বসে আছে। আমাদেরকে সবাইকে জ্বালানোর জন্য ও বেশ লজ্জিত। আমরাও ওকে এই সুযোগে আরও জ্বালাতন করতে লাগলাম। গতকাল ওর কারণে আমরা কি কি কষ্ট করেছি সেগুলো বারবার ওকে  মনে করিয়ে দিতে লাগলাম। আমরা সময় নষ্ট না করে চটপট রেডি হয়ে গেলাম নাশতা করার জন্য। আমাদের হোটেলে কাছেই নাকি খাওয়ার জায়গা আছে বলে জাফর জানালো। জাফর সমেত আমরা চারজন বের হয়ে পড়লাম।

হোটেল থেকে নামতেই একটা ধাবার মতন টিনের চালা দেওয়া হোটেল পেলাম। নাশ্তার জন্য সবাই মিলে আমরা রুটি, ডিম ভাজা আর পরোটা অর্ডার দিলাম। আমরা আমাদের মতন বসে গল্পগুজব করতে লাগলাম। জাফরকে কোন এক জুনিয়র জানতে চাইলো ইন্ডিয়ায় ট্যুরের বিষয়ে। ওরা কয়েকজন নাকি ট্যুর দিতে চায় অল্প পরিসরে। আমরা এইসব বিষয় আশয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করতে লাগলাম। এক পর্যায়ে আমাদের সব গল্পগুজব ফুরিয়ে গেলো, কিন্তু নাশতা আর আসলো না। আমরা বার বার দেখতে লাগলাম, তাগাদা দিতে লাগলাম- কিন্তু কারও কোন তাড়া আছে বলে মনে হলো না। একজন লোক আস্তে ধীরে পরোটার গোল্লা বানাতে লাগলো, সেটা সুন্দর করে বেলতেই লাগলো বেলতেই লাগলো, তারপর ধীরে সুস্থে তাওয়ায় তেল দিলো, এক সময় তেল গরম হলো, আস্তে করে তিনি পরোটাটা তাওয়ায় ছড়িয়ে দিলেন- এই পরোটা ভাজা শেষ হলে উনি আরেকটা পরোটা ঠিক একইভাবে বানানো শুরু করলেন। আমরা ধৈর্য ধরে সব দেখতে লাগলাম। পাঁচটা পরোটা একই নিয়মে বানানোর পর উনি আস্তে ধীরে দুইটা ডিম ভেঙ্গে, পিয়াজ মরিচ দিয়ে ফিটে ধীরে সুস্থে একটা ডিম ভাজলেন। সব মিলিয়ে প্রায় ৪৫ মিনিট পর উনি ৫টা পরোটা আর ৫টা ডিম ভাজা নিয়ে আমাদের টেবিলের সামনে দিয়ে গেলেন। কিন্তু আমাদের অর্ডার পাঁচটা পরোটা ছিলো না। অনেকে রুটি চেয়েছিলো, তাই উনি পরোটা ফেরত দেওয়ার সময় বলে গেলেন এখনই রুটি বানানো শুরু করবেন। এই কথা শুনে ভয় পেয়ে রুটির অর্ডার ক্যান্সেল করে সবাই পরোটা নিয়ে নিলো। এখন রুটি বানানো শুরু করলে নিশ্চয়ই পাক্কা আরও এক ঘন্টার ধাক্কা!

কোনমতে খেয়ে দেয়েই আমরা দৌড় দিলাম। রুমে গিয়ে আগের দিন রাতে গুছিয়ে রাখা ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে নেমে পড়লাম সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের গোয়েল ছেড়ে দিলো। আমরা চলতে লাগলাম ইলোরার উদ্দেশ্যে। গোয়েল চলতেই লাগলো দুপাশের বন জঙ্গল পার বয়ে। এর মধ্যে চিং আর উর্মির বেশ জ্বর ছিলো। উর্মি বেচারির মুখ জ্বরের চোটে লাল হয়ে রইলো। মোটমাট আমাদের চার ঘন্টা লাগলো ইলোরায় পৌঁছাতে। বাস আমাদের যেখানে নামিয়ে দিলো সেখান থেকে ইলোরার গেট কিছুটা দূর। বাস থেকে নেমেই আমরা টসটসে আঙ্গুর কিনে নিলাম ১০ রুপি দিয়ে। আমাদের দেশে ১০ টাকার আঙ্গুরের কথা ভাবাই যায় না। সবাই অতি উৎসাহে টপাটপ আঙ্গুর খাওয়া শুরু করলো। আমি খুঁজে খুঁজে একটা রেস্টুরেন্টের ওয়াশ রুম বের করলাম। সেখানে বেসিনে সুন্দর করে ধুয়ে নিলাম আঙ্গুরগুলো। তারপর খাওয়া শুরু করলাম।

আঙ্গুর খাওয়া শেষ হতেই ঝটপট অটো ভাড়া করে আমরা রওয়ানা হলাম ইলোরার দিকে। ঠিক হলো অটো আমাদের পুরো ইলোরা ঘুরে দেখাবে। প্রথমেই আমাদের নামিয়ে দিলো ২৯ নম্বর গুহায়। সেই আগের মত পাথর কেটে বানানো গুহা তবে এইখানে আছে বিশাল বিশাল সব পাথুরে মূর্তি। একেকটা ১৫-২০ ফিটের সমান। এই গুহা গুলো অজন্তার তুলনায় বেশ খোলামেলা, আর আলো বাতাস পূর্ণ। একটা করে গুহা দেখা শেষ হয় আর আমরা ছুটে গিয়ে অটোতে উঠি। অটো আমাদের নিয়ে রওয়ানা হয় পরের গুহার দিকে। অজন্তার গুহা গুলা যেমন খুব কাছাকাছি ছিলো, ইলোরারটা মোটেও সেরকম নয়। বরঞ্চ অনেক দূরে দূরে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে ৩২ নম্বর গুহায় গিয়ে হাজির হলাম। সেটা ছিলো দোতলা গুহা। ভিতরে সিড়ি আছে উপরের তলায় যাওয়ার জন্য। সিড়ি গুলো খুবই অদ্ভূত। অনেক খাড়া আর অনেক সরু। একেকটা রাইজার প্রায় এক ফিট উঁচু হবে আর ট্রেড অনেক সরু যাতে কোনমতে পায়ের পাতার অর্ধেকটা আঁটে। টুরিস্টদের পদচারনার চোটে খসখসে পাথুরে সিড়ি মসৃন হয়ে গেছে যেটা দেখে আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পেলাম। যাই হোক আল্লাহ নাম নিয়ে উঠে পড়লাম সিড়ি বেয়ে। তবে নামার সময় ভয়টা হলো আরও। জেরিনকে বলতে শুনলাম, ‘সিড়িগুলা কি জায়ান্টদের জন্য বানানো?’

ওফ
দূরে থেকে ইলোরার গুহা (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

কোন কোন গুহা খোলা পাহাড়ের উপরে, কোনটার সিলিঙে বিশাল পদ্ম ফুল খোদাই করে বানানো, কোনটায় যেতে হয় অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে, কোন গুহা দেখতে আবার একদম ঘরবাড়ির মত- দরজা, জানালা, রুম গুলা ভাগ করা, কোনটার সামনে বিশাল এক গরুর মূর্তি যাকে বলা হয় নান্দী বুল- এই রকম নানা বৈশিষ্ট্যের গুহা আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। দেখতে দেখতে আমাদের প্রায় সব এনার্জি বের হয়ে গেলো। শেষমেশ অটো আমাদের ১৬ নম্বর গুহার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলো। আমরা অটো ভাড়া ১৬০ রুপি দিয়ে অটো ছেড়ে দিলাম। এসে দাঁড়ালাম একটা পাথুরে পাহাড় কেটে বানানো অর্থাৎ ‘মনোলিথিক রক কাট’ বিশাল এক মন্দিরের সামনে যার নাম ‘কৈলাস টেম্পল’। এই মন্দির পাহাড়ের উপর থেকে পাথর কেটে কেটে ভিতরে গর্ত করে বানানো হয়েছে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেটা বলতে গেলে পাহাড়ের পেটের মধ্যে গর্ত করে বানানো সমতল জায়গাটা। সমতল জায়গাটার মাঝখানে উঁচু একটা মন্দির আর তার চারপাশে উঁচু হয়ে আছে পাহাড়। আমি পুরা থ হয়ে গেলাম। কি আশ্চর্য, হাজার বছর ধরেও এই রকম একটা জায়গায় মন্দিরটা টিকে আছে!

শ খানেক হাতির উপর কৈলাশ মন্দির
শ খানেক হাতির উপর কৈলাশ মন্দির

আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। মন্দিরের চারপাশে খোলা জায়গা ছাড়াও পাথুরে পাহাড়ের দেওয়ালে গর্ত করে মোটা মোটা পাথুরে কলাম দিয়ে সাপোর্ট করা প্রদক্ষিণ পথ ছিলো। আমরা সেখান দিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। এই পুরো পাহাড়টা কেন যে ধসে পড়ে যাচ্ছে না সেইটা ভাবতে ভাবতেই আমি ঘুরতে লাগলাম। শতকোটি মূর্তি বিশিষ্ট মন্দিরটা চক্কর দিয়ে ফেলে আমরা ভিতরে ঢুকে পড়লাম। বাইরে পাথর কেটে নকশা করা ছাড়াও সারা মন্দিরটা ছিল হাল্কা কমলা রঙয়ের, এর মধ্যে লাল, সবুজ আর হলুদ রঙ দিয়ে অত্যন্ত সূক্ষ্ম কারুকাজ করা। অনেক জায়গার রঙই নষ্ট হয়ে গেছে। হাজার বছরের পুরানো রঙ- কম কথা নয় তো! ভিতরের অবস্থা তো আরও জটিল, সেখানে সত্যি সত্যি পুজা অর্চনা হচ্ছে। আমি খানিক্ষণ নিশ্বাশ বন্ধ করে দেওয়ালের কারুকাজগুলার উপর হাত বুলালাম। আবছা আলোতে দেখলাম রঙ্গিন সিলিং। সব দেখে টেখে আমরা খোলা বারান্দার মত জায়গায় বের হয়ে আসলাম। আমি মিমের সাথে গল্প করতে করতে হাঁটতে লাগলাম। একটা ‘নান্দী বুল’ পার হয়ে আমরা বসে অনেক্ষণ গল্প করলাম। এই আশ্চর্য রহস্যময় জায়গাটা থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। মনের ভিতর ভাবনা চলতেই লাগলো হাজার বছর আগে কেমন করে সম্ভব হয়েছিলো এই রকম পাথুরে পাহাড়ে এই রকম স্থাপনার? কেমন করে?

পাহাড়ের তলায় প্রদক্ষিণ পথ
পাহাড়ের তলায় প্রদক্ষিণ পথ

ফোন আসতে লাগলো, সবাই নাকি খেতে বসে গিয়েছে। আমি আর মিমও ছুটলাম ক্যান্টিনের দিকে। আমি আর রুবাইদা মিলে অর্ডার দিলাম ৮০ রুপির ভেজ ফ্রায়েড রাইস। একটু শক্ত চালের হলেও খেতে ভালোই ছিলো। খেয়ে দেয়ে আমরা ধীরে সুস্থে গোয়েলে ফেরত গেলাম। সেখানে অনেক ফেরিওয়ালা নানা রকম মালা নিয়ে ঘোরাঘুরি করছিলো। ছোট ছোট পুতির একটা ভারি প্যাঁচানো মালা ৫০ রুপি দিয়ে সবাই কিনতে লাগলো গণ হারে। এক পর্যায়ে সারা তল্লাটের সকল ফেরি ওয়ালা দৌড়ে আসলো মালা সমেত। একজন লোক আবার ছোট্ট চালের দানার উপর নাম লিখে চিকন এক শিশি তেলের ভিতর ভরে চাবির রিং বানিয়ে দিচ্ছিলো। আমি একটা চাবির রিং বানিয়ে নিলাম আমার কামলা পিউয়ের জন্য। তারপর দেখলাম এই যাত্রাই আমাদের গোয়েলের সাথে শেষ যাত্রা বলে সবাই একটু ছবিটবি তুলতে আগ্রহী হয়ে উঠলো। আমরা গোয়েলের সাথে অনেক ছবি তুললাম, ভিডিও ও করলাম। সবশেষে বিকাল ৬টার দিকে রওয়ানা হলাম গোয়ার উদ্দেশ্যে। গোয়েল যাত্রা শুরু করতেই আমরা একটা আনন্দধ্বণির চিৎকার করে উঠলাম।

গোয়েল চলতেই শুরু করলো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হলো। ওদিকে বাসের শেষে বসে রিন্তু নানা রকম কর্মকান্ড করে আমাদের হাসাতে লাগলো। রিন্তু একসময় বিটিভির ধারাভাষ্য দিতে শুরু করলো। অবনী শুরু করে দিলো রাত দশটার ইংরেজি সংবাদ পড়া। আমরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম। একে একে রিন্তু একচেটিয়া বিভিন্ন সুর নকল করে প্যারোডি করতে লাগলো ইত্যাদি, ছায়াছন্দ আর সিসিমপুরের। সারা বাস জুড়ে হাসির রোল উঠলো। হাসতে হাসতে আমাদের পেট ব্যাথা হতে লাগলো।

প্রায় গভীর রাতে আমাদের বাস এসে থামলো অর্পিতা ধাবা নামের এক ধাবায়। এটা বাঙালি ধাবা। ভিতরের লোকজন সব বাংলায় কথা বার্তা বলছে শুনে আমার খুব ভালো লাগলো। বাস থেকে নেমেই আমরা বাথরুমের সন্ধানে গেলাম। এখানকার মেয়েদের বাথরুমে কোন লাইট নাই। কি আর করা মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বেলে সেই সমস্যার সমাধান করা হলো। আমরা ৪৬ জন মানুষ গাদা খানেক জিনিস অর্ডার দিয়ে বসে রইলাম। অর্ডার আর আসে না। প্রথমে আমরা আলু মাসালা আর নান অর্ডার দিয়েছিলাম। এটা দিতে দেরি হবে দেখে আমি আর রুবাইদা চট করে অর্ডার চেঞ্জ করে পাও ভাজি অর্ডার দিয়ে দিলাম। আমাদের অর্ডার চলে এলো সাথে সাথেই। অন্যরা আমাদের দিকে হিংসাপূর্ণ দৃষ্টি দিতে লাগলো। আমি আর রুবাইদা মজা করে পাওভাজি খেলাম। আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পরও অনেকের অর্ডার তখনও আসে নাই। শুভ তো রেগেমেগে না খেয়েই বের হয়ে আসলো ওখান থেকে। আমি পানি আর বিস্কুট কিনে নিলাম। তারপর আবার চড়ে বসলাম গোয়েলে।

গভীর রাতে আমাদের নিয়ে গোয়েল চলতে শুরু করলো। সারা বাস ঘুমিয়ে পড়লো, আমি আর রুবাইদা অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করলাম। ঘুমন্ত বাসে শুধু আমাদের দুইজনের গলাই শোনা গেলো।

The Mighty INDIA CALLING: পথ হারিয়ে এক বিকেলে অজন্তার রহস্যময় গুহায় (পর্ব ২৬)

ঘাড়, কোমর আর হাঁটুর টনটনে ব্যাথার কারনে একটু পরপর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছিলো। এই করতে করতে টের পেলাম খুব সকালবেলা আমাদের গোয়েল থামলো এক ধাবাতে। আমরা আড়মোড়া ভেঙ্গে আস্তে ধীরে নামতে লাগলাম। রুবাইদাকে দেখলাম ব্যাগ খুলে বদনা বের করে আনতে। আমরা সবাই খুশি হলাম, যাক- বোতল আর খুঁজতে হলো না। ফ্রেশ হয়ে দাঁতটাত মেজে ধাবাতে খাওয়াদাওয়া খোঁজ করলাম, তেমন কিছুই নাই। জ্যাব্জ্যাবে তেল দেওয়া একটা পরোটা পাওয়া যাচ্ছে। দেখে খাওয়া পছন্দ হলো না। তাই কিছু না খেয়েই আবার বাসে চড়ে বসলাম। বাস চলতে শুরু করলো।

যতভাবেই বসে থাকি, একটু গা এলিয়ে দিলেই ঐ তিনটা পয়েন্টে টনটনে ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে আমাদের কথাবার্তাও বাড়তে থাকে। এক সময় ঘুম ঘুমভাব ছেড়ে পুরা বাস জেগে ওঠে। আমরা নিজেরা হৈচৈ করেতে থাকি। কিন্তু কতক্ষণ আর হৈচৈ করা যায়, পথ তো শেষ হয় না। অনেকে উশখুশ করতে থাকে- ঘড়ি দেখতে থাকে। গুগল ম্যাপ বের করে খোঁজাখুঁজি করা শুরু হয়। সব দেখে মনে হতে থাকে আমরা বোধহয় গন্তব্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। ব্যাপারটা সঠিক কিনা জানার জন্য নানাভাবে গবেষণা শুরু হয়। একসময় সত্যিই মনে হতে থাকে আমরা ভুল রাস্তায় যাচ্ছি। কমিটির লোকজন ড্রাইভারকে গিয়ে একথা জানায় কিন্তু ড্রাইভারের কোন ভাবান্তর নাই। সে একমনে বাস চালিয়ে যেতেই লাগলো। আমরা ম্যাপে দেখতে লাগলাম আমরা কোথায় যাচ্ছি। প্রতি মূহুর্তে আমরা আওরংগবাদ থেকে কয় কিলোমিটার দূরে সরে যাচ্ছি নিলয় এসে আপডেট দিতে লাগলো।

এতদিন ট্যুর করে আমরাও কেমন যেন অদ্ভূত টাইপের মানুষ হয়ে গেছি। কোথায় সবাই ভয় পেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিবে- তা নয়। বরং সবাই বেশ ঠাট্টা তামাশা করতে লাগলো যে আমরা পথ হারিয়েছি। আমরা নিজেরা নিজেরা রাস্তা হারিয়েছি বলে হাসি তামাশা শুরু করে দিলাম। এভাবে মোটমাট ঘন্টা দুয়েক চলার পর আমরা ম্যাপে রিডিং দেখলাম যে সঠিক পথে যাচ্ছি, গন্তব্যের সাথে আমাদের দূরত্ব কমতে লাগলো। তবে বাস চলতেই লাগলো। আমরা ধৈর্য ধরে বসেই রইলাম।

মোটমাট ১২-১৪ ঘন্টার জার্নি ১৮ ঘন্টায় শেষ করে আমরা নামলাম সরাসরি অজন্তায়। গনগনে দুপুরবেলায় আমরা বাস থেকে নেমে হাত পা ছুঁড়তে লাগলাম। সামনে একজন লোক পেয়ারা নিয়ে বসে ছিলো। ১০ রুপি দিয়ে সুন্দর একটা পেয়ারা কিনে তাতে কামড় বসিয়ে দিলাম। একেবারে খালি পেটে ফল খেতে হলো, আল্লাহ আল্লাহ করলাম পেটে যেন কোন সমস্যা না হয়। কমিটির লোকজন টিকেট কেটে আনতে গেলো। আমি বসে বসে পেয়ারা চিবাতে লাগলাম। কমিটির মধ্যে আমাদের শিডিউল নিয়ে একটা সমস্যা হচ্ছে টের পাচ্ছিলাম। সত্যি সত্যি শুভ ঘোষনা দিলো, আমাদের হিসাব থেকে মূল্যবান ৬ ঘন্টা হারিয়ে গেছে এই অজন্তায় আসার পথে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মুম্বাই যেটা এখান থেকে আরও ৭-৮ ঘন্টার জার্নি। মুম্বাইয়ে আমাদের আধা বেলা থাকার কথা ছিলো তারপরই রওয়ানা দেওয়ার কথা গোয়ার উদ্দেশ্যে। গোয়ায় নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের বাস ছেড়ে দিতে হবে তাই সেটার নড়চড় করা যাবে না। এখন মুম্বাইয়ের দিকে যাওয়া সম্ভব না কারণ ড্রাইভারকে ঘুমাতে দিতে হবে। আর যদি কষ্টকরে আমরা যাইও ৭-৮ ঘন্টা জার্নি করে, মাত্র কয়েকঘন্টার মধ্যে আমাদের আবার একটা বড় জার্নি করতে হবে গোয়ার উদ্দেশ্যে। তাই সব কিছু চিন্তা করে কমিটি ডিসিশন নিয়েছে আমাদের মুম্বাই ট্রিপ ক্যান্সেল। তারচেয়ে বরং আজকে রাতে আমরা আওরঙ্গবাদে থেকে যাবো। কাল ইলোরা দেখে সেখান থেকেই গোয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো।

মুম্বাই বাতিল হয়ে যাওয়ায় আমাদের মন খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু অনেকেই পড়লো বিপদে যেমন- রাত্রি। রাত্রির চাচাতো ভাইয়ের বাসা মুম্বাইয়ে। সেখানে ওর সাথে দেখা করার জন্য ওর চাচা আরেক শহর থেকে ফ্লাই করে এসে বসে আছে। আজকে সকাল পর্যন্ত ও চাচার সাথে যোগাযোগ করে বলে এসেছে যে ও আসছে মুম্বাই। এখন ও না গেলে ব্যাপারটা খুব খারাপ হয়। এই নিয়ে ও বেশ টেনশনে পড়ে গেলো। অন্যদিকে মৌলির বাবা মুম্বাইয়ের এক লোকের মাধ্যমে মৌলির কাছে টাকা পাঠাচ্ছে। এখন মুম্বাই না গেলে কেমন করে সেই টাকা ও যোগাড় করবে? সব কিছু মিলিয়ে আমরা কিছুটা মন খারাপ, কিছুটা দুঃখ, কিছুটা আশংকা নিয়ে ঢুকতে লাগলাম অজন্তায়।

দূর থেকে দেখা পাহাড়ের গায়ে অজন্তার গুহা
দূর থেকে দেখা পাহাড়ের গায়ে অজন্তার গুহা

হাঁটতে লাগলাম অনেক দূর। কেমন যেন বাজারঘাট, পার্ক -সব পার হয়েও আমরা হাঁটতে লাগলাম। তারপর পেলাম এক বাস। ৪০ রুপি দিয়ে টিকেট কেটে সবাই উঠে পড়লাম সেই বাসে। বাস আমাদের নিয়ে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে উঠতে লাগলো। প্রায় ১৫-২০ মিনিট জার্নির পর আমাদের নামিয়ে দিলো এক জায়গায়। সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে আমরা চলে গেলাম অজন্তার গুহাসারির সামনে। গুহা সারি বললাম এই কারণে যে পাথুরে পাহাড়ের এক পাশে খাদ আর অন্য পাশে সারি সারি গুহা। আমরা হেঁটে হেঁটে একেকটা গুহায় ঢুকতে লাগলাম। প্রথমে কারুকাজ করা কলাম ওয়ালা একটা গুহায় ঢুকলাম। ভেতরটা বেশ অন্ধকার। কিন্তু এর মধ্যে ইলেক্ট্রিক বাল্বের হালকা নীলচে আলোয় জ্বলজ্বল করছে বিশাল এক বুদ্ধ মূর্তি। আমরা সবাই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মুর্তিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কেমন যেন অদ্ভূত অনুভূতি হলো। হাজার হাজার বছর আগে কতশত মানুষ কতই না কষ্ট করে আসতো -এই গুহাগুলোতে –ইলেক্ট্রিক লাইট বিহীন এই ঘুটঘুটে অন্ধকার জায়গায়-  এই সব ভাবতে ভাবতে কেমন যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে লাগলো আমার। ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, লাল নীল রঙয়ের জ্যামিতিক কারুকাজে ভরা পুরা সিলিংটা যার বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু অনেকাংশই টিকে আছে হাজার বছর ধরে। আবছা আলোয় দেওয়ালের হাতে আঁকা রঙ্গিন ফ্রেস্কো চিত্রকর্ম দেখে থ হয়ে গেলাম। হাজার বছর আগের এই পাহাড়ি গুহার  দেওয়াল ও ছাদ জুড়ে থাকা রঙ্গিন সব জটিল কারুকাজ, ফুলেল নকশা ও চিত্রকর্ম দেখে নিজেকে কেমন যেন বেকুব বেকুব লাগলো।

এক নম্বর গুহায় দ্বিমিকবাসী
এক নম্বর গুহায় দ্বিমিকবাসী

এক নম্বর গুহা থেকে বের হয়ে আমরা পরের গুহাগুলোর দিকে হাঁটতে লাগলাম। দেখতে লাগলাম আরও অনেক মূর্তি, এদের কোনটা বুদ্ধের, কোনটা অন্যদের, কোনটা অনেক বড়, কোনটা আবার ছোট্ট, কোনটা দাঁড়ানো, কোনটা বসা, কোনটা আবার নাচের ভঙ্গিতে। দেখলাম পুরোহিতদের ঘুমানোর জন্য পাথুরে দুইটা বিছানাসহ ছোট্ট ছোট্ট ঘর। আরও দেখলাম চৈত্য হল, চৈত্য জানালা, প্রদক্ষিণ পথ, স্তুপা- বইয়ে যা যা পড়েছিলাম সবই! এইভাবে একে একে দেখা হয়ে গেলো ৩০ টা গুহা। শেষের দিকে এসে প্রায় দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছিলাম কারণ গুহা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় হয়ে আসছিলো। এক পাশে অদ্ভূত সুন্দর সবুজ পাহাড়ের নৈসর্গিক দৃশ্য, অন্য পাশে মানব সৃষ্ট পাথর কেটে বানানো হাজার বছরের পুরানো গুহা- দেখতে দেখতে কখন যে দিনে আলো কমতে শুরু করেছিলো তা টেরই পাই নাই। তাই শেষে দৌড়ে দৌড়ে অজন্তা থেকে বের হয়ে যেত লাগলাম আমরা। আশেপাশে বসে থাকা বানরগুলো আমাদের দিকে মুখ ভ্যাংচাতে লাগলো, সেই দিকে পাত্তা না দিয়ে আমরা ৪৬ জন তাড়াহুড়া করে পার হতে লাগলাম পাথুরে রাস্তা।

দফ
মা বানর ও বাচ্চা বানর (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

অজন্তা থেকে বের হতে হতেই হুড়াহুড়ি করে বাসে উঠলাম আমরা। বাস আমাদের যখন সেই বাজার টাইপের জায়গায় নামিয়ে দিলো তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সেই সকাল থেকেই কিছু খাওয়া হয় নাই। আমরা কোন ভাবনা চিন্তা না করেই সবাই ভাগ হয়ে দুইটা দোকানে বসে পড়লাম। আমি আর রুবাইদা অর্ডার দিলাম ৫০ রুপির পাও ভাজি। রুবাইদা মুম্বাই গিয়ে পাও ভাজি খাওয়ার প্ল্যান করে রেখেছিলো, যেহেতু মুম্বাই ক্যান্সেল- তাই এখানেই চেখে ফেললাম পাও ভাজি। এটা তেমন আহামরি কোন খাবার নয়। বনরুটির সাথে মটরের ডাল জাতীয় একটা তরকারি দেওয়া হয় যার উপর অনেক পিঁয়াজ কুচি ছড়ানো থাকে। খেতে খারাপ মোটামুটি। এমন একটা টাইমে খেলাম যে বুঝতে পারছিলাম রাতে আর খাওয়া হবে না। আমরা তাই ধীরে সুস্থে আয়েশ করে খেলাম। খাওয়াদাওয়া শেষে অনেকে কেনাকাটা করতে লাগলো। ঐশী, নোভারা দরাদরি করে পাথরের মালা মোটামুটি কম দামেই কিনতে লাগলো। আমি ঘুরে ফিরে বিস্কুটের প্যাকেট কিনে নিলাম ঘুমানোর আগে খাওয়ার জন্য। মোটমাট রাত আটটার দিকে আমরা গোয়েলে গিয়ে উঠলাম।

গোয়েল আমাদের নিয়ে গেলো হোটেল মুরলি মনোহরে। গোয়েল থামতেই টের পেলাম মজুমদার অসুস্থ। মৌলি ওকে ধরে বসে আছে। আমাদের ও বললো রুমে চলে যেতে। আমি আর রুবাইদা রুমে চলে গেলাম। বেশ ছিমছাম একটা হোটেল। বেশ বড় রুম, সাথে ঝকঝকে বাথরুম আর বড় একটা খোলা বারান্দা। রুমে ঢুকেই প্রথমে রুবাইদা গেলো গোসলে। আমি ততক্ষণে জিনিসপত্র গুছিয়ে রেডি হয়ে বসে আছি গোসলে যাবার জন্য। মজুমদার রুমে এসেই শুয়ে পড়লো বিছানায়, মৌলি বললো একবার বমি করেছে- খাওয়াটা মনে হয় সুবিধার ছিলো না। রুবাইদা বের হতেই আমি গোসলে ঢুকলাম। বাথরুম থেকেই টের পেলাম রুমে বেশ চিৎকার-হৈচৈ হচ্ছে। তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করে বের হয়ে দেখলাম মজুমদার বলতে গেলে কারও ডাকেই সাড়া দিচ্ছে না। খুব খারাপ লাগছে নাকি ওর। রুম ভর্তি মানুষজন। একেক জন একেক সাজেশন দিতে লাগলো। তবে সবাই এক বাক্যে বললো, ওষুধ খাওয়ানোর আগে পেটে খাওয়া দিতে হবে। শুভ নাকি ভাত খুঁজতে বের হয়ে গেছে। এই মহারাষ্ট্রে এসে এত রাতে ভাত খুঁজে পাওয়া কি সোজা কথা? কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে শুভ কোথা থেকে যেন এক প্যাকেট ভাত, কড়া একটা ডিম ভাজা, লাল মরিচ দিয়ে বাগার দেওয়া ঘন ডাল নিয়ে আসলো। এই দৃশ্য দেখে মজুমদার শত অসুস্থতার মধ্যেও আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলো! রুম সার্ভিসে খবর দিয়ে একটা প্লেট আনালাম। সেই প্লেটে শক্ত ভাত ডাল দিয়ে মেখে আমি মজুমদারকে খাওয়াতে লাগলাম। মজুমদার মুখ বিকৃত করে ডাল ভাত গিলতে লাগলো। একটু খাওয়ার পরই আমরা ওকে স্যালাইন আর অ্যান্টাসিড খাইয়ে দিলাম। ও পড়ে ঘুম দিতে লাগলো। ওদিকে সৌরভের বার্থডে পার্টি ছিলো রাতে। মজুমদার অসুস্থ বলে আমরা কেউ গেলাম না। আমাদের একটা এক্সট্রা তোষক দিয়ে গেলো রুম সার্ভিস থেকে। রুবাইদা সেখানে নিজের শোবার ব্যবস্থা করলো। এরই মধ্যে উঠলো ঝড়! আক্ষরিক অর্থেই ঝড়! ঠিক যেন কাল বৈশাখি!

হঠাৎ করে প্রবল বাতাসের ঝাপ্টায় জানালার কাঁচ থরথর করে কেঁপে উঠলো। আমি দৌঁড়ে বারান্দায় মেলে দেওয়া কাপড়, জুতা নিয়ে আসতে গেলাম। বারান্দায় গিয়ে আমার মনে হলো এটা বোধহয় ধুলি ঝড়। চোখে মুখে প্রচন্ড বাতাসের সাথে বালির ঝাপটা এসে লাগলো। আমি অল্প একটু চোখ ফাঁক করে দেখলাম আশেপাশে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সব ঢেকে গেছে ধুলার কুয়াশায়। তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে বন্ধ করে দিলাম বারান্দার দরজা। মজুমদারের পাশে আমি লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। ভাবলাম ইন্ডিয়ায় এসে ধুলার ঝড়ের সাথেও দেখা হয়ে গেল, কি ভাগ্য!

The Mighty INDIA CALLING: CEPT, NID, IIMA -সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখার একটি ‘শিক্ষনীয়’ দিন (পর্ব ২৫)

আগেই বলেছিলাম বেজমেন্টের রুমে দিনরাত বোঝা যায় না। তাই আবারও আমাদের উঠতে দেরি হয়ে গেলো। ঘুম থেকে উঠেই তাড়াহুড়া করে রেডি হয়ে বের হয়ে পড়লাম। নাস্তা না খেয়েই ছুটলাম একেবারে ঝড়ের বেগে। সেপ্টের সাথে সময় ঠিকঠাক করে রাখা আছে। দেরি করে গেলে ব্যাপারটা লজ্জার হবে। আমাদের মত অন্য সবাইও ছুটলো ঝড়ের বেগে। আমরা একটা অটো ঠিক করে নিলাম। অটোতে উঠে গুগল ম্যাপটা খুলে বসলাম। মাঝে একবার ড্রাইভারকে রাস্তা বলে দিতে হলো। তারপর ঠিকঠাক এসে পড়লাম সেপ্টে।

গেট দিয়ে ঢুকে দেখলাম আমাদের কেউ নাই। বুঝলাম তাড়াহুড়া করে আমরাই সবার আগে এসে পড়েছি। আমরা গেটের কাছে বসে রইলাম। খুব সুন্দর পরিবেশ। অনেকটা আমাদের মিন্টো রোডের বাড়িগুলোর মতন অবস্থা। চারিদিকে সবুজ গাছ আর হাজার পাখির কিচিরমিচির। সকাল বেলা সবকিছু শান্ত চুপচাপ, এর মধ্যে আমরা কয়েকজন বসে আছি হাফ ওয়ালে আর আমাদের সামনে দিয়ে শিক্ষার্থীরা হেঁটে হেঁটে যেতে লাগলো। আমি এই সুযোগে ব্যাগ থেকে ‘থ্রি মিস্টেক্স অফ মাই লাইফ’ বের করে পড়তে লাগলাম পা ঝুলিয়ে।

ছায়া ঘেরা CEPT ক্যাম্পাস
ছায়া ঘেরা CEPT ক্যাম্পাস

একে একে সবাই আসলে আমরা ভিতরে ঢুকে পড়ি। ঢুকতেই আমরা একটা ক্যাফের সামনে থেমে পড়ি। জাফরের দেখাদেখি ২৫ রুপির বাটার টোস্ট অর্ডার দিলাম। ক্যাফের লোকগুলা এত্ত ঢিলা যে আমার মনে হলো অনন্তকাল অপেক্ষা করার পর আমি একটা বাটার মাখানো টোস্ট পেলাম। আহামরি কিছু না। তবে ২৫ রুপি দামটা বেশি লাগলো।  নাশতা খাওয়া হয়ে গেলে আমরা এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে থাকি। ওপেন স্পেস গুলা খুব মজার। এখানে সেখানে হুটহাট করে আমরা বসে পড়ি। ওদের স্টুডিওগুলা দেখলাম। একটাতে তো জুরি চলছে। খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে জুরি দেখলাম। স্টুডিওগুলা বেশ ইন্টারেক্টিভ। ছিম ছাম সাজানো স্পেসগুলো ঘুরে বেড়াতে আমাদের খুব ভালো লাগছিলো। এখানে ভারতীয়দের সাথে অনেক সাদা চামড়াও পড়ে। এমনকি টিচাররাও অনেকে সাদা চামড়া। আমরা ছোট্ট স্টেশনারি শপ থেকে কেনাকাটা করতে লাগলাম। দোকানটা আমাদের আউয়ালের মত। আর লোকটা কোলকাতার। আমাদের পেয়ে বাংলাতেই কথা বলা শুরু করে দিলো। আমরা কম দামে লিড হোল্ডার, স্কেচ বুক এইসব জিনিসপত্র কিনে নিলাম।

খুব বেশিক্ষন আমরা ওখানে থাকলাম না। সেপ্ট থেকে অটোতে করে রওয়ানা দিলাম NID এর উদ্দেশ্যে। ঢুকে আমরা এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ালাম। বিভিন্ন ওয়ার্কশপগুলো দেখলাম। তারপর দেখলাম ডিসপ্লে সেন্টার। সেখানে সব ডিপার্টমেন্টের কাজ ডিস্প্লে করা আছে। অটোমোবাইল ডিপার্টমেন্টের কাজ দেখে আমাদের ইশতিয়াকের মাথা খারাপ হয়ে গেলো। এমনিতেই ওর এইসব গাড়ি বিষয়ক ঝোঁক আছে, তার উপর কাবজাব মার্কা গাড়ির ডিজাইন দেখে ও মাথা নেড়ে বলতে লাগলো, ‘আমি বুয়েট ছেড়ে এইখানে চলে আসবো……’ । এইখানকার স্পেস গুলোও অনেক সুন্দর। একটা খুবই সুন্দর স্পাইরাল সিঁড়ি দেখে আমরা মুগ্ধ হলাম। ঘুরতে ঘুরতেই টের পেলাম বেলা হয়ে গেছে, কিছু খেয়ে নেওয়া প্রয়োজন। খুঁজে খুঁজে ক্যাফেটা বের করলাম। গাছ তলায় অনেকটা সেমি ওপেন জায়গায় কিছু কিছু স্ন্যাক্স বানানো হচ্ছে আর খোলা আকাশের নিচেই চেয়ার টেবিলে বসে অনেকে খেয়েদেয়ে নিচ্ছে। আর ইন্ডোর ক্যাফেতে অনেক লম্বা লাইন। অনেক চিন্তা ভাবনা করে তাড়াতাড়ি করার জন্য আমি.৪০ রুপির ভেজ পিৎজা অর্ডার দিলাম। লোকটা আমার সামনেই ধীরে সুস্থে একটা রুটি বানালো, তার উপর সস দিলো, কিছু পিয়াজ দিলো, তারপর আস্তে আস্তে চিজ কুচি কুচি করে ছড়িয়ে দিলো, সবশেষে জিনিসটা ওভেনে ঢুকিয়ে দিলো। আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ওভেনে টিং করে শব্দ হলো তারপর উনি আস্তে ধীরে পিৎজাটা বের করে আনলেন। তারপর আস্তে ধীরে সেটাকে কেটে টুকরা করে প্যাকেট করে আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি অবাক হয়ে গেলাম, এত শত শত শিক্ষার্থীকে এই গতিতে খাবার দিয়ে কেমন করে তারা চলতে পারে? আর সবাই এতক্ষণ ধরে ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকে কেমন করে?

আমি প্যাকেটটা হাতে নিয়েই দৌড় দিলাম। গেটের সামনে সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করেছে। গিয়ে দেখি অটো ঠিক করা হয়ে গেছে, আমি আসতেই সবাই ধুপধাপ উঠে পড়লাম। রওয়ানা দিলাম ক্রসওয়ার্ডের উদ্দেশ্যে। আমি অটোতে বসেই গপাগপ কামড় দিয়ে পিৎজাটা খেয়ে নিলাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা ক্রসওয়ার্ড নেমে পড়লাম। উরে বাব্বাহ, বিশাল বইয়ের দুনিয়া! শুধু কি বই, গাদা গাদা স্টেশনারি দিয়ে ভরা জায়গাটা। আমরা সবাই বই ফেলে স্টেশনারির দিকে ছুটলাম। অনেক জিনিস আছে অনেক সুন্দর তবে সেটা সত্যিকারে তেমন কোন কাজে আসবে না। আমরা রঙ্গিন কলমের সেট খুঁজতে লাগলাম। বড়গুলো সব মনে হয় গতকাল যারা এসেছিলো তারা কিনে নিয়ে গেছে, আমরা তেমন কোন সেটই পেলাম না। অনেক কিছুই পছন্দ হচ্ছিলো কিন্তু দাম বেশি। এর মধ্যেও আমরা ট্রলি ঠেলে ঠেলে জিনিসপাতি দেখতে লাগলাম। রঙ পেন্সিল, পেস্টাল, রিডিং লাইট, লিড হোল্ডার, ইরেজার, কালার পেন- এইসব কেনা কাটা করেই আমরা তাড়াহুড়া করে বের হয়ে আসলাম। তাড়াতাড়ি করে আবার অটো ঠিক করে ছুটলাম IIMA এর উদ্দেশ্যে।

লুই কানের করা IIMA এর পুরানো ক্যাম্পাস
লুই কানের করা IIMA এর পুরানো ক্যাম্পাস

আইআইএমে এসে দেখলাম অনেকেই এসে পড়েছে। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম বাকিদের জন্য। নিশাতকে দেখলাম ‘ক্যান্ডেল’ নামের একটা দোকান থেকে সুন্দর সুন্দর সব স্টেশনারি কিনেছে। দেখে মনে হলো, ক্রসওয়ার্ড না গিয়ে ক্যান্ডেল গেলেই মনে হয় ভালো হতো! সবাই চলে আসলে আমরা একসাথে ভিতরে ঢুকতে লাগলাম। আমাদের সাথে এই ইন্সটিটিউটের এক জন লোককে দেওয়া হলো সব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। বিল্ডিংটা দূর থেকে দেখেই সবাই বুঝে ফেললাম, লুই কানের নকশা করা! আমাদের সংসদ ভবনের লাল ইটের কমপ্লেক্সগুলোর মত এই বিল্ডিংও বিশাল বিশাল আর্চ দেওয়া একেকটা লাল ইটের কম্পোজিশন। প্রায় একই সময় করা নাকি এই দুইটা ডিজাইন! আমরা বিশাল ক্যাম্পাস ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলাম। কোন এক হিন্দি সিনেমা নাকি এখানে শুটিং করা হয়েছিলো। যারা যারা সেই সিনেমাটি দেখেছে তারা একেকটা জায়গা দেখে চিনতে পারলো আর আমাদের কাছে বলতে লাগলো দৃশ্যগুলোর কথা। অনেকক্ষণ হেঁটে হেঁটে আমরা পুরানো ক্যাম্পাস দেখা শেষ করে গেলাম নতুন ক্যাম্পাসের দিকে। নতুনটা তো আরও সুন্দর! কনক্রিট আর গ্লাস দিয়ে বানানো নতুন ক্যাম্পাসের সাথে পুরানোটার তেমন কোন মিল নাই বললেই চলে। দেখে কেমন যেন মনে হয় যে রফিক আজমের ডিজাইন! এই বিকাল বেলায় এখানে কোন ক্লাস-টাস নাই। তাই ছিমছাম জনমানব শূন্য ক্যাম্পাসে আমরা ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগলাম। সুন্দর গাছপালা, সবুজ ঘাস, সাথে খোলামেলা চকচকে ঝকঝকে হলগুলো দেখতে দেখতে আমাদের বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো, হায়- এরকম এক দুইটা ক্যাম্পাস যদি আমাদের দেশে থাকতো!  পুরো ক্যাম্পাস ঘুরেফিরে আমরা ফুরফুরা মেজাজে বের হয়ে আসলাম।

IIMA এর নতুন ক্যাম্পাস
চার্লস কোরেয়ার করা IIMA এর নতুন ক্যাম্পাস

এখান থেকে বের হয়ে দেখলাম অবনী আর তানভীর মিল ওনার্স এসোসিয়েশনে যাবে। আমিও ওদের সাথে জুটে গেলাম। তারপর আমরা একটা অটো নিয়ে রওয়ানা দিলাম আগের দিনের আশ্রম রোডে মিল ওনার্সের বিল্ডিঙের দিকে। পৌঁছাতেই দুঃসংবাদ পেলাম, দারোয়ান বললো অফিস বন্ধ- তাই ভিতরে ঢুকা যাবে না। আমরা তো মহা মুসিবতে পড়লাম। পরে অবনী আর তানভীর অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে দারোয়ানকে রাজি করিয়ে ভিতরে ঢুকার ব্যবস্থা করলো। পুরো বিল্ডিং বন্ধ এর মধ্যে আমরা সিড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম। লুই কানের নকশা করা বিল্ডিংটার এক পাশ মূলত কালো আর হলুদ আর অন্য পাশে অনেক রকম রঙ। শেষ বিকালের লালচে রোদে হলুদ একটা দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা ছবি তুললাম। আমরা ঠিক যখন বের হতে যাবো তখনই দেখলাম মায়িশা, নোভা ওরাও গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকছে। ওদের সাথে দেখা করেই আমরা বের হয়ে পড়লাম। আশ্রম রোডেই আমরা ‘এগ ফাস্ট রেস্টুরেন্ট’ নামের একটা খাবার দোকানে থামলাম, কারণ তানভীর আর অবনী লাঞ্চ করে নাই। দোকানটার ইন্টেরিয়র খুবই সুন্দর। আর শুধুমাত্র ডিমের তৈরি খাবারই পাওয়া যায়। ওরা মজা করে খেলো। এরপর আমরা যাবো কাঙ্কারিয়া লেক।

আমরা একটা অটো ঠিক করলাম। অটোওয়ালা ভালো মানুষের মত বললো, ‘ মিটারে যা ভাড়া আসবে তাই দিবেন’। অটোতে যে মিটার আছে সেটা আমরা খেয়ালই করি নাই। ঠিক আছে, মিটারে যেতে যেহেতু রাজি হয়েছে, আমরা খুশি মনে উঠে পড়লাম। সূর্য ডুবতে ডুবতেই আমরা পৌঁছে গেলাম লেকের গেটে। অটোওয়ালা আমাদের ভাড়া জানালো ১৫০ রুপি। আমাদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো শুনে। ১৫০ রুপি মানে! দশ পনের মিনিট লাগলো পৌঁছাতে আর ভাড়া ১৫০ রুপি কেমন করে হয়? অটো ওয়ালা বিরক্ত হয়ে আমাদের মিটারের রিডিং দেখিয়ে কি সব চার্ট থেকে কিলোমিটারের সাথে রুপি গুন দিয়ে হিসাব করে দেখাতে লাগলো যে ভাড়া ঠিকই আছে। তানভীর সব বুঝে গম্ভীর হয়ে বললো, ‘ হিসাব ঠিক আছে, অন্য কোনভাবে কারসাজি করেছে’। আমি গ্যাঞ্জামে জড়াতে চাইলাম না। অবনীকে বললাম দিয়ে দিতে যা ভাড়া চেয়েছে। কিন্তু অবনী বেঁকে বসলো, ‘মগের মুল্লুক নাকি’। অবনী ছুটে গেলো লেকের গেটে দাঁড়ানো দারোয়ানের কাছে। তাদের কাছে গিয়ে অবনী সব খুলে বললো। লোকগুলো হিন্দীতে বললো, ‘আপনারা ওঠার সময় মিটারে রিডিং জিরো দেখে উঠেন নাই?’ আমরা বললাম যে আমরা তো প্যাচঘোচ বুঝি নাই যে ভাড়ায় দুই নম্বরী করা যাবে। লোকগুলো তখন অটোওয়ালার সাথে কথা বললো। প্রথমে অটোওয়ালা বেশ শক্ত ছিলো। কিন্তু দারোওয়ানগুলো যখন ঝাড়ি মেরে উঠলো তখন সে মিনমিন করতে লাগলো। শেষমেশ ৭০ রুপিতে দফা রফা হলো। ভাড়া মিটিয়ে দিতেই ব্যাটা চোখের পলকে চলে গেলো। দারোয়ানগুলো আমাদের বললো যে সাধারনত কেউ মিটারে যেতে রাজি হয় না, আমরা বিদেশি টের পেয়েই ব্যাটা মামদোবাজী করতে চেয়েছিলো।  আমাদেরকে সাবধান করে দিলো পরেরবার যেন মিটারে জিরো দেখে অটোতে উঠি। ঝামেলা চুকে যাওয়ার পর আমরা আমরা যখন বললাম যে লেক দেখতে চাই তখন দারোয়ান আমাদেরকে জানালো যে সন্ধ্যার সময় লেক বন্ধ হয়ে যায়, রাতে ভিতরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। আমরা অনেক বোঝালাম যে একবার দেখে যেতে চাই লেকটা। কিন্তু তারা কিছুতেই রাজি হলো না। আমরা শেষ পর্যন্ত গেটের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে লেকটা দেখলাম। গোল একটা লেক, মনে হলো আসেপাশের পার্কটা বেশ সুন্দর। শেষমেষ কি আর করা, আমরা আরও কিছুদূর হেঁটে আবার অটো নিলাম। এবার খুব সাবধানে কথাবার্তা বলে ভাড়া ঠিক করে নিলাম। এই অটোওয়ালা ঠিকভাবেই আমাদের হোটেলের কাছাকাছি নামিয়ে দিলো। বাকিটা পথ আমরা হেঁটেই চলে গেলাম।

হোটেলে ফিরেই সব ঠিকমত গুছিয়ে নিলাম। রাতের খাবার খেয়ে নেওয়া দরকার, কিন্তু আর কাউকে পাচ্ছিলাম না পার্টনার হিসেবে। শেষ পর্যন্ত একাই চলে গেলাম এক তলার সেই খাবার রেস্টুরেন্টে। দেখলাম একটা টেবিলে জুবায়ের বসে খাচ্ছে। সেই টেবিলে বসেই অর্ডার দিলাম টমেটু মাসালা আর পুরি। এত সুস্বাদু ছিলো খাবারটা যে আমি গোগ্রাসে খেতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর জুবায়ের খেয়ে উঠে চলে গেলো। আমি একা একা বসেই চেটেপুটে খেতে লাগলাম। খাওয়া শেষ করে বিল দিয়ে বের হয়ে আসতে যাবো, এমন সময় দেখলাম অনেকে ছোট ছোট প্যাকেটে পানি কিনছে। দুই রুপি করে একেকটা প্যাকেট। অনেকটা সাবানের প্যাকেটের সমান সাইজ। দেখে মজা লাগলো।

সব গুছিয়ে আমরা বেজমেন্ট থেকে আমাদের মালপত্র উপরে উঠাতে লাগলাম। টের পেলাম আমার সানগ্লাসটা খুঁজে পাচ্ছি না। মন খারাপ হয়ে গেলো। একটা সানগ্লাস অলরেডি হারিয়েছি, এই দুই নম্বরটাও যদি হারায় তাহলে ……। এমন সময় নিশাত এসে সানগ্লাসটা দিয়ে বললো, ‘আমাদের রুমে ফেলে গিয়েছিস’। মনে মনে বলে উঠলাম, ‘আলহামদুলিল্লাহ’। আমরা হোটেলের সামনে ছেচল্লিশ জন দুনিয়ার লাগেজ নিয়ে অপেক্ষা করছি গোয়েলের জন্য। কিন্তু গোয়েল আর আসে না। ওদিকে রাস্তাঘাট, হোটেল আর আশেপাশের সব লোকজন আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো, এত মানুষ- এত লাগেজ……। অবশেষে গোয়েল আসলো। আমরা ঝাঁপাঝাপি করে উঠে বসলাম। কমিটির লোকজন ধৈর্য নিয়ে লাগেজ ওঠা তদারকি করতে লাগলো। প্রায় ১০টার দিকে আমরা রওয়ানা দিলাম। এবারে আমাদের গন্তব্য আওরঙ্গবাদ।

আমি চুপচাপ ভাবতে লাগলাম আহমেদাবাদের কথা। এখানকার রান্না খুবই মজার আর অ-নে-ক সস্তা। বিআরটিএস বাস সার্ভিসটা মেইন হলেও সব সময় বাসে করে সব জায়গায় যাওয়া যায় না। অটোই ভরসা কিন্তু অটোওয়ালাগুলো সবচেয়ে খারাপ। এই কয় দিনের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অটোওয়ালাদের সাথে দেখা হওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। তবে সাধারন মানুষগুলো ভালোই। বেশভূষা আমাদের দেশের মানুষদের মতন। সব মিলিয়ে মনে হলো শুধু খাওয়াদাওয়ার জন্যই আরেকবার আহমেদাবাদ আসলে মন্দ হয় না।

সারা দিনের ঘোরাঘুরির পর ক্লান্ত হয়ে আমি চোখ বন্ধ করলাম। বিশাল জার্নি করতে হবে আমাদের। প্রায় চৌদ্দ ঘন্টা। এখন চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নেওয়া দরকার। সলিড বিশ্রাম।

 

The Mighty INDIA CALLING: গান্ধী মেমোরিয়াল, ল’ গার্ডেন, মুভি দেখা এবং কমিটির গ্র্যান্ড ডিনার (পর্ব ২৪)

বেসমেন্টে রুমে থাকার একটা সমস্যা হলো দিন রাতের পার্থক্য বুঝতে না পারা। কি সকাল, কি দিন, কি রাত- সবসময় একই রকম অন্ধকার থাকে রুমটা। অন্ধকার রুমে যখন ঘুম ভাংলো তখন দেখলাম সাড়ে নয়টা বাজে। তাড়াহুড়া করে উঠে আমরা ফ্রেশ হয়েই রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। তারপর টের পেলাম শুধু আমরা না, কেউই এখনো পর্যন্ত রেডি হয় নাই। তারমানে সবারই রওয়ানা দিতে বেশ দেরি হবে। এই হোটেলে না খেয়ে ভাবলাম আসেপাশে ঘোরাঘুরি করে খাওয়াদাওয়া করি।

আমি আর রুবাইদা বের হয়ে ডান দিকে হাঁটতে লাগলাম। হোটেলের একটু পাশেই একটা মুসলমান হোটেল পেলাম যেখানে হালাল মাংস পাওয়া যাচ্ছিলো। আমরা সেখানে বসে পড়লাম। আমি অর্ডার দিলাম ৩ রুপি করে দুইটা নান রুটি আর ৩০ রুপির খাসির কোরমা। কোরমা বললেই আমাদের চোখে যেমন সাদা রঙের ঘন দুধের ঝোলের তরকারি ভেসে ওঠে, এই কোরমা সেই রকম নয়। এটা তেল দেওয়া লাল টকটকে রঙের মসলাদার ঝোলওয়ালা খাসির মাংসের তরকারি। আমি ভ্রূ কুঁচকে তাকাতেই রুবাইদা বললো নতুন ধরনের এই ‘কোরমা’টা উচ্চবাচ্য না করে খেয়ে ফেলতে। আমি খেয়ে দেখলাম খেতে বেশ মজা তবে একটু ঝাল। আমরা তৃপ্তি করে খেলাম। আহমেদাবাদে খাওয়া খরচ আসলেই কম। খাওয়া দাওয়া করতে করতেই আমরা আলোচনা করছিলাম কেমন করে কোথায় যাব। খাওয়া দাওয়া শেষ করে হাঁটতে লাগলাম আমাদের হোটেলের দিকে। আমার বেশ ঝাল লাগছিলো আর পানি খাওয়া হয় নাই বলে একটা স্লাইস কিনে খেলাম আমি। এর মধ্যে মিম আর অন্তরা এসে পড়লো। আমরা চারজনে ঠিক করলাম যাবো ‘গান্ধীর সবরমোতি আশ্রম’। আগের দিনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভাবলাম অনেক তো অটো হলো- এইবার বাসে করে যাই।

আহমেদাবাদে আসার পর থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম এখানকার রাস্তাগুলো একটু অদ্ভূত। রাস্তাগুলো ডিভাইডার দিয়ে চারভাগে বিভক্ত। খালি দুইপাশের লেন দুইটা দিয়ে গাড়ি ঘোড়া চলে। মাঝের লেন দুইটা দিয়ে কি হয় খেয়াল করি নাই। বাসের টিকেট কাটতে গিয়ে টের পেলাম মাঝের দুইটা লেন শুধুই বাসের জন্য। আর এই বাসের নামই ‘বি আর টি এস’। আমরা টিকেট কাউন্টারে গিয়ে বললাম গান্ধীর সবরমোতি আশ্রম যেতে চাই। ওরা আমাদের ২৮ টাকা করে ‘আর টি ও রোড’ এর টিকেট কেটে দিলো। আমরা টিকেট নিয়ে ওয়েটিং এ বসে রইলাম। বেশ দৃষ্টি নন্দন ছিলো যাত্রী ছাউনিটা। আমরা বসে বসে দেখতে লাগলাম হুউউশ করে একেকটা বাস এসে থামছে, কয়েক সেকেন্ড পরই আবার হুউউশ করে বের হয়ে যাচ্ছে। আমরা তক্কে তক্কে থাকলাম আমাদের নির্দিষ্ট নম্বরের বাসের জন্য। এক সময় আমাদের কাংখিত বাস আসলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য দরজাটা খুললো, আর অন্য অনেক মানুষের সাথে আমরা চার জন হুড়মুড় করে উঠে পড়লাম। ওঠার প্রায় সাথে সাথেই ঠাস ঠাস করে দরজাটা অটোমেটিক বন্ধ হয়ে গেলো। আর প্রচন্ড বেগে আমাদের বাস চলতে শুরু করলো। ভীড়ের জন্য আমরা বসার কোন জায়গাই দেখতে পাচ্ছিলাম না। কোন কিছু হাত দিয়ে ধরার আগেই বাস ছেড়ে দেওয়ায় আমরা তাল সামলাতে না পেরে একজন অন্যজনের উপর হেলে পড়লাম। এর মধ্যে মিম উপরে ঝুলতে থাকা একটা খালি হাতল কোনমতে ধরে ফেললো। আমি কোন কিছু ধরতে না পেরে শেষমেষ মিমকেই দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। এই ভীড়ের মধ্যেই মিমের হাতে চপচপে তেল দেওয়া এক লোকের চুল ঘষা খাচ্ছিলো। মিম বেশ বিরক্ত হলো কিন্তু কিছু বলার উপায় নাই।

আলোর গতিতে আমাদের বাস চলতে লাগলো। যেহেতু এটা শুধু বাসেরই লেন তাই সামনে অন্য কোন গাড়ি বা ওভারটেকিং এইসব ব্যাপার নাই। প্রচন্ড গতিতে চলতে থাকা বাসটা কেবল স্টপেজ আর মোড় আসলেই হার্ড ব্রেক কষে, আর সারা বাসে শুধু আমরা চার জনই তাল সামলাতে না পেরে ঢলে কাত হয়ে যাই। বাস একেক স্টপেজে থামে আর অল্প কিছু মানুষ নামে, বেশিরভাগই ওঠে। এমনিতেই ভেতরে কোন জায়গা নাই, কিন্তু এটা নিয়ে কারও কোন চিন্তা আছে বলে মনে হলো না। হেল্পার ছাড়াই বাসে দিব্যি লোকজন ঠেলাঠেলি করে ঊঠতে লাগলো। ভীড়ের মধ্যে অন্তরাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। রুবাইদাকে দেখতে পেলাম সবচেয়ে অসুবিধায় আছে। কোন খালি জায়গা না পেয়ে ও বাসের দরজার সামনের খালি জায়গাটুকুতে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবার বাস স্টপেজে থামে আর অটোমেটিক ফোল্ডিং দরজাটা খোলার সময় প্রথমেই রুবাইদা ঠাস ঠাস করে বাড়ি খায়। তারপর দলে দলে মানুষজন ওকে ধাক্কা মেরে বাসের ভিতরে ঢুকে। তারপর আবার দরজা বন্ধ হলে ও সামনের সেই ফাঁকা জায়গাটাতে দাঁড়ায়। ওর অবস্থা দেখে মায়াই লাগলো।

ইন্ডিয়ার একেক রাজ্য একেক উপায়ে তাদের পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশোন সমস্যা সমাধান করে রেখেছে। এর মধ্যে আহমেদাবাদের বি আর টি এস বাস সার্ভিসটা খুবই ইউনিক মনে হলো। বাসের ভেতরের দৃশ্য দেখলে যে কারও এটাকে মেট্রো মনে করে ভুল হতে পারে। মেট্রোর মতনই বসার সিট খুবই কম। দাঁড়ানোর জায়গাই বেশি। আর একটু পর পর যান্ত্রিক কন্ঠে অ্যানাউন্সমেন্ট বাজছে ‘ ধেয়ান দিজিয়ে, আগলা স্টেশন অমুক অমুক-’ ঠিক যেন মেট্রোর মত। ভিড়ের মধ্যে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ একটা স্টপেজ আসলো আর বাসের অর্ধেক লোক নেমে গেলো। আমরা একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাস এতই ফাঁকা হয়ে গেলো যে আমরা বসার সিটও পেয়ে গেলাম! অবশ্য বেশিক্ষণ বসতে না বসতেই আমাদের স্টপেজ আর টি ও রোড চলে আসলো। আমরা তাড়াতাড়ি করে নেমে পড়লাম। আমাদের নামিয়ে দিয়েই বাস হুউউশ করে চলে গেলো।

গুগল ম্যাপে দেখলাম যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে আশ্রমটা খুব দূরে নয়, হেঁটেই যাওয়া যায়। কিন্তু এই বাস জার্নি শেষে কারও গায়ে আর কোন শক্তি নেই। তাই আমরা ২০ রুপি দিয়ে একটা অটো ভাড়া করলাম আশ্রম পর্যন্ত যাওয়ার জন্য। অটো আমাদের আশ্রমের গেটেই নামিয়ে দিলো। আমরা গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। খুব সুন্দর শান্তি শান্তি পরিবেশ। চার পাশে সবুজ গাছপালা, ঝলমলে রোদ আর হাজারো পাখির কিচিরমিচির। ঢুকতেই সবার মন ভালো হয়ে গেলো।

প্রথমে গেলাম গান্ধী স্মারক সংগ্রহালয়ে। এটা একটা ছবির মিউজিয়াম। মহাত্মা গান্ধীর পুরো জীবন ও আদর্শ ধারাবাহিকভাবে সাদাকালো ছবির মাধ্যমে উঠে এসেছে। চার্লস কোরেয়ার ডিজাইন করা ইট আর কনক্রিটের তৈরি এই মিউজয়ামের প্রদর্শনীর কিছু অংশ সেমি আউটডোর অর্থাৎ খোলা বারান্দার মত জায়গা, কিছু অংশ ইন্ডোর অর্থাৎ রুমের ভেতর। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম সব কিছু। মাঝে মাঝে দেখা হতে থাকে সীমান্ত, ইশতিয়াক, হিমি, নিশাত, তমা রিন্তু, সুহাইলা, নিলয়দের সাথে। পুরো প্রদর্শনী ঘোরা শেষে আমরা ঢুকি সুভেনিয়র এবং বুক শপে। সেখানে অনেকেই অনেক কিছু কিনলো। বাচ্চাদের জন্য গান্ধীর কমিক্স থেকে শুরু করে গবেষণা পত্র পর্যন্ত সব কিছুই পাওয়া যাচ্ছিলো। সুন্দর সুন্দর কলম, চাবির রিং, পেন ড্রাইভ, পোস্ট কার্ড, ঘড়ি অনেক কিছুই ছিলো। আমি ৫০ রুপি দিয়ে বাংলায় অনুদিত গান্ধীর আত্মজীবনী কিনলাম। সব শেষে মিউজয়াম থেকে বের হয়ে গেলাম।

দচ
‘My Life Is My Message’ – M.K Gandhi (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম দিশা)

এরপর গেলাম গান্ধীর বাড়ি দেখতে। সবরমোতি নদীর পাশে খুব সাধারন একটা কুটির। আমরা স্যান্ডেল খুলে ভিতরে ঢুকলাম। এত শান্তি লুকিয়ে আছে এই ছোট্ট কুটিরে বাইরে থেকে দেখে বুঝতে পারি নাই। প্রত্যেকটা জানালার সবুজ প্রাকৃতিক ক্যানভাস আর প্রাণ জুড়ানো মিষ্টি বাতাস মনের মাঝে ধীরতা, স্থিরতা আর প্রশান্তির উদ্রেক করে। দেখলাম গান্ধীর চরকা, অতি সাধারণ বসার আসন, গান্ধীর ব্যবহার্য সাধারণ জিনিসপত্র, ঘুমানোর জন্য সুতায় বোনা খাটিয়া। এক ঘর থেকে বারান্দা দিয়ে আরেক ঘরে যেতে লাগলাম আমরা। কি সাধারণ এই ঘর গুলোতে অসাধারণ সব মানুষজন এসেছিলেন…….. কতই না সামান্য সাধারণ ছিলো তাদের জীবন……………. অথচ কতই না বড় মাপের হৃদয় ছিলো তাদের………। আমরা এখান থেকে বের হয়ে খানিক্ষন বসলাম সবরমোতী নদীর তীরে। প্রচন্ড কড়া রোদে অবশ্য আমরা বেশিক্ষণ ওখানে দাঁড়াতে পারলাম না। অল্প কিছুক্ষনের জন্যই দেখলাম টলটলে পানির সবরমোতি নদীকে। আমাদের বুড়িগঙ্গার মত এই নদীর দুই পারেও শহর। কিন্তু তারপরও কত সুন্দর অবস্থা এই নদীটার! আর আমাদের বুড়িগঙ্গা- থাক সে কথা আর নাই বা বলি।

আমরা দর্শনার্থীদের জন্য তৈরি বাথরুমে গেলাম। এখানকার বাথরুমটাও ভারি সুন্দর। অনেক চওড়া, প্রশস্থ আর আলোবাতাস পূর্ণ। আমরা খুব খুশি মনে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। একবার নয়- বেশ কয়েকবার! ফুরফুরে মনে এখান থেকে বের হয়ে আসলাম আমরা। এরপর অটো ঠিক করলাম আমরা- যাবো ‘ল গার্ডেন’।

অটোওয়ালা আমাদের নামিয়ে দিলো শহরের মধ্যে এক জায়গায়। সামনে হাত তুলে দেখিয়ে দিলো ‘ল গার্ডেন’। ল গার্ডেন একটা ছোট্ট পার্ক। এর বাইরের ফুটপাথের দুইপাশ জুড়ে সারি সারি দোকানপাট। আমরা ঠিক করলাম আগে খেয়ে নেই, তারপর ঘোরাঘুরি করা হবে। রুবাইদা গেলো স্ট্রিট ফুডের দিকে আর মিম ও অন্তরার সাথে আমিও ঢুকলাম ডমিনাস পিৎজাতে। কিন্তু ভেজ পিৎজা শেয়ার করার পার্টনার নাই বলে আমি বের হয়ে আসলাম ওখান থেকে। বের হয়ে রুবাইদাকে খুঁজতে লাগলাম। দেখি ও কাগজের বাটিতে করে মিহিদানা বা বুন্দিয়ার মত কি এক অদ্ভূত জিনিস খাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করতেই ও বললো, এই জিনিসের নাম ওকে খিচুড়ি বলেছে। কিন্তু এটা হচ্ছে মশলা দিয়ে রান্না করা সাগুদানা। জিনিসটা খেতে মোটেও ভালো না। রুবাইদাকে দেখলাম বিরস বদনে ‘খিচুড়ি’ চিবিয়ে যাচ্ছে। রুবাইদার খাওয়া শেষে আমরা দুইজনে হেঁটে হেঁটে যেতে লাগলাম সেই ফুটপাথের দোকানপাটগুলোর দিকে।

সারি সারি দোকানপাট। সেগুলোতে ভর্তি গুজরাটি কাজ করা জামা কাপড়, জুয়েলারি, জয়পুরি স্যান্ডেল, ওয়ান পিস- এইসব জিনিস। গুজরাটি লেহেঙ্গা চোলিগুলোতে বড় বড় কাঁচের টুকরা বসানো, অনেক রঙের কাপড় জোড়া দিয়ে বানানো- চোখ ধাঁধাঁনো ঝকমকে। আমার চোখে কল্পনায় জয়পুরকে আমি এরকমই ভেবেছিলাম। এই রকম দেখলাম এসে গুজরাটে। আমরা এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটতে লাগলাম। আমার দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নাই। একেবারে ল গার্ডেনের শেষে রাস্তার উল্টা পাশে একটা বড় শপিং মলের নিচে অনেকগুলো ফাস্টফুডের দোকান দেখে আমি থেমে গেলাম। সবগুলো দোকান দেখে শেষ পর্যন্ত একটা দোকানে ঢুকে ৬০ রুপি দিয়ে ভেজ বার্গার ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর কোক খেয়ে নিলাম। খেয়েদেয়ে আমরা আবার হাঁটতে লাগলাম। আশেপাশে অসংখ্য দোকান কিন্তু সব দোকানেই প্রায় একই জিনিস। আমরা এই গলি ছাড়িয়ে অন্য গলিতে ঢুকে পড়লাম। কিছুদূর হেঁটেই সন্ধান পেলাম ‘তক্ষশীলা’র। ‘তক্ষশীলা’ একটা চমৎকার বইয়ের দোকান। ভেতরে ঢুকেই আমাদের মন ভালো হলে গেলো। দারুন সুন্দর সুন্দর বই। ঝকঝকে সব বইয়ের মধ্যে এনিড ব্লাইটনের অনেক অনেক বই, ন্যন্সি ড্রিউয়ের ফুল কালেকশন আর হ্যাঁ- যেটার কথা কোনদিনই ভুলবো না সেটা হচ্ছে তিন বাক্স টিনটিনের অরিজিনাল ফুল সেট যার দাম ৮০০০ রুপি। নীল বাক্স থেকে একটা টিনটিন বের করে হাতে নিয়ে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। পৃষ্ঠাগুলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম- পুরা মাখনের মত, ঝকঝকে ছবিগুলা আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করতে লাগলো- কিন্তু কিছুই করার নাই! সবগুলা টিনটিন সেই বাচ্চাকাল থেকেই আমার বাসায় আছে, এই সেট কেনার কোন অর্থই হয় না। কিন্তু তারপরও আমার মন আঁকুপাকু করতে লাগলো। শেষমেশ সবার তাড়া খেয়ে আমি বইগুলো ছেড়ে উঠে আসলাম। আমাদের মধ্যে কেবল অন্তরাই ওর ভাইয়ের জন্য ‘টিন ডিটেক্টিভস’ এর মোটা মোটা কমিক্স কিনলো।

আমরা বের হয়েই একে ওকে ফোন দিতে লাগলাম। কারণ আমাদের মুভি দেখার জায়গা এখনও ঠিক হয় নাই। কোন এক ড্রাইভ ইন সিনেমাতে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু সেটা ফাইনাল না। পরে আমরা ফোন দিয়ে জানলাম আমাদের যেতে হবে আমরা যেখান থেকে এসেছি সেখানে- আশ্রম রোডের শিব সিনেমা হলে। আমরা তক্ষশীলার সামনে থেকে ২০ রুপি দিয়ে অটো ঠিক করলাম। সেই অটো করে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের সিনেমা হলের সামনে। ঠিক উল্টা পাশে আরেকটা সিনেমা হল থাকায় একটু কনফিউশন হচ্ছিলো যে কোনটা আমাদের সিনেমা হল, তারপর গিয়ে ঠিকঠাকটাতে গিয়ে হাজির হলাম। সিনেমা শুরু হতেও অনেক্ষন বাকি। আমরা লবিতে দাঁড়িয়ে কয়েকটা সেলফি তুললাম। এর মধ্যেই দেখলাম মাইশা দুই হাত ভরে শপিং করেছে ‘ক্রস ওয়ার্ড’ থেকে। সবই স্টেশনারি। আমরা বেশ উত্তেজিত হয়ে দেখতে লাগলাম ওর জিনিসপাতি। এরই মধ্যে শোর সময় হয়ে গেলে আমরা ঢুকে পড়লাম। সিট বেশ আরামদায়ক আমাদের স্টার সিনেপ্লেক্সের মত। প্রথমে শামিতাভ, তারপর রয়ের ট্রেইলার চললো। তারপর শুরু হলো ‘বেবি’। নাম শুনে ভেবেছিলাম লেইম মুভি হবে বোধহয়। কিন্তু আমার আশংকা ভুল হলো। দারুণ থ্রিলার একটা মুভি- খুবই সুন্দর।

dc
সিনেমা হলে ঢুকার আগে লাউঞ্জে কতিপয় দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় মোজাম্মেল হক জাফর)

মুভি শেষ হতে হতেই কমিটি আমাদের তাড়া দিতে লাগলো। ডিনারের জন্য বুকিং দেওয়া যেই জায়গা, সেখান থেকে ফোন আসছে। দশটার মধ্যে নাকি তাদের অর্ডার নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। আমরা সবাই ছুটতে লাগলাম। সারি সারি অটোরিক্সায় টপাটপ উঠে পড়তে লাগলাম আমরা। সবার গন্তব্য প্যারামাউন্ট হোটেল- তিন দরওয়াজা। প্যারামাউন্ট হোটেলে পৌঁছে ৫০ রুপি ভাড়া দিয়ে নেমে পড়লাম। তাড়াহুড়া করে ভিতরে ঢুকে দেখি কোথাও কোন বসার জায়গা নেই, সব কানায় কানায় পূর্ণ। আমরা এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলাম, কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না। তবে ওরা আশ্বাস দিলো যে কিছুক্ষনের মধ্যেই কয়েকটা টেবিল খালি হয়ে যাবে। সত্যি টেবিল খালি হওয়ার সাথে সাথে আমি, রুবাইদা, অন্তরা, মিম, সারা আর সুহাইলা একসাথে বসে পড়লাম। বাকিরাও ফাঁক ফোকর পেয়ে বসে যেতে লাগলো। আমাদের টেবিলে আমরা মিলেমিশে অর্ডার দিলাম- তিনটা প্রন পোলাও, ভেজ আমেরিকান চপ্সুয়ে, মাসালা চিকেন আর সাথে পেপসি। মুসল্মান হোটেল তাই চিকেন অর্ডার দিতে কোনই বাধা রইলো না। আমরা মজা করে খেলাম। রুবাইদা পেপসি অর্ডার দিতে চায় নাই, আমরা এক প্রকার জোর করে ওর পেপসিটা খেয়ে ফেললাম। হাহা হিহি গল্পগুজবের সাথে আমাদের খাওয়া দাওয়া চলতে লাগলো। এক সময় পুরো রেস্টুরেন্ট খালি হয়ে গেলো। শুধু রইলাম আমরা। তবুও যেন আমাদের গল্প শেষ হয় না।

কমিটি সবার বিল দিয়ে দিলো। আমরা যখন ভরপেট খেয়ে ওখান থেকে বের হয়ে আসি তখন বাজে রাত সাড়ে এগারটা। তিন দরওয়াজা পার হয়ে আমরা একটার পর একটা অটো নিতে থাকি। লাইন ধরে সব অটো চলতে থাকে ‘ত্রুপ্তি হোটেল’ এর উদ্দেশ্যে। আর আমরা অটোতে গাদাগাদি করে বসে খোশ গল্প করতে থাকি। হোটেলে পৌঁছানোর পর আমরা শুনি গোয়েল থেকে আমাদের লাগেজ নামানো হবে। সবাই হোটেলের সামনে ভীড় করে দাঁড়াই। এক সময় গোয়েল আসে, আমরা আমাদের লাগেজ টেনে টেনে রুমে নিতে থাকি। লাগেজ খুলে সব জিনিসপাতি গোছগাছ করতে থাকি। আমি আর মজুমদার মনের সুখে ‘আসো না’ গাইছিলাম। হঠাৎ দরজায় নক পড়ায় আমরা চুপ হয়ে যাই। দরজা খুলতেই শুভ উঁকি দিয়ে বললো, ‘মজা লস?’ আমাদের মুখে ওর গাওয়া গান শুনতে পেয়েই ও এসে হাজির হয়েছে।

শুভকে আমরা জানাই ডিনার খেয়ে আমরা ব্যাপক খুশি। আর মজুমদার বলে যে প্রতিদিন ১০০ রুপি ১০০ রুপি করে অ্যালাউয়েন্স দেওয়ার চাইতে আমাদের ব্যাপারগুলা ভালো হচ্ছে। এর আগে মানালির পার্টি, ডেজার্ট নাইট, আজকের মুভি আর ডিনার- এই গুলোই বেশি মজার। শুভ তখন বললো, ‘গোয়াতে গিয়ে এমন সারপ্রাইজ দিবো যে চোখে পানি চলে আসবে’। শুভ চলে গেলে আমরা লাগেজ গুছিয়ে শুয়ে পড়ি। আগামীকাল অনেক ‘শিক্ষনীয়’ জায়গায় যেতে হবে যার নাম CEPT।