খুব ভোরে গোয়েল আমাদের নিয়ে এক বাজারের মতন জায়গায় থামে। আমাদের সবাইকে ডাকাডাকি করে উঠিয়ে দেওয়া হলো। আমরা ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙ্গে বাস থেকে নেমে দেখি গ্রামের একটা ছোট্ট বাজারে এসে পড়েছি। এখনও কোন দোকানপাট খুলে নাই। এখানে থেমে আমাদের কি লাভ হলো বুঝতে পারছিলাম না। কমিটির লোকজন আমাদের জানালো সামনে আর কোন থামার জায়গা নাই। তাই এখানেই ফ্রেশ হয়ে নিতে হবে। কি আর করা, আমরা জনমানবশূন্য এক বাজারের মধ্য দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।
সন্ধান পেলাম এক বাথরুমের। মেয়েদের জন্য একটা জায়গায় লাইন, একটু পাশেই ছেলেদের লাইন অন্য একটা বাথরুমের জন্য। মেয়েদের লাইনে আমি মোটামুটি মাঝের দিকেই দাঁড়ালাম। লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম, একেকজন আতংকজনক চেহারা নিয়ে বাথরুম থেকে বের হচ্ছে। আমরা লাইনে যারা ছিলাম সবাই ভয় পেয়ে গেলাম, এতই খারাপ অবস্থা বাথরুমের! লাইনে একটু সামনে দাঁড়ানো নোভা সবার কাছ থেকে অভিজ্ঞতা শুনে আমাদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিলো যে, এখানে দুইটা বাথরুম আছে। একটা খুব খারাপ, আরেকটা একটু কম খারাপ। আমরা খুব খারাপটাতে না গিয়ে একটু কম খারাপটাতে যাচ্ছি। তবে সেটার অবস্থাই এত খারাপ যে কেউ কিছু বলতে রাজি হচ্ছে না! আমি এই ফাঁকে ছেলেদের লাইনের দিকে গিয়ে খবর নিয়ে আসলাম ওদের বাথরুমের অবস্থা কেমন? আমাকে জাফর বললো, ‘এদিকের কথা জিজ্ঞেস করার কথা চিন্তাও করিস না’। আমি আর জিজ্ঞেস না করে চলে আসলাম।
যাই হোক একে একে সবাই আমরা ভয়ংকর এই পর্বটা শেষ করলাম। তারপর আমি গেলাম দাঁত মাজতে। রাস্তার পাশে ক্ষেতের ধারে একটা পানির কল পেলাম। কিন্তু কলটা বড়ই অদ্ভূত! সাধারণত কল ছাড়লে পানি উপর থেকে নিচে পড়ে, কিন্তু এই কল ছাড়লে পানি ডান থেকে বামে আড়াআড়িভাবে বের হয়। কল ছেড়ে মুখ ধুতে গিয়ে আমি প্রায় পুরো ভিজে গেলাম। আরও অনেকেই আসলো দাঁত মাজতে, আমি তাদের সবাইকে সাবধান করে দিলাম এই অদ্ভূত কলের ব্যাপারে। তাতেও খুব লাভ হলো না, কয়েকজন আবার আমার মতই ভিজে গেলো!
হাতমুখ ধোয়া শেষে যখন আবার রাস্তায় এসে উঠলাম, ততক্ষণে দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে। আমি একটা দোকান থেকে কেক আর বিস্কুট কিনে নিলাম। এই দিয়ে নাশতা সারতে হবে। আমরা যখন কেক খাচ্ছিলাম তখন কোথা থেকে যেন এক বাস ভর্তি স্কুলের ছাত্রীরা এসে হাজির হলো। ইউনিফর্ম দেখে মনে হলো, গ্রামের কোন স্কুল হবে- হয় তো পিকনিক করতে বের হয়েছে। আমাদের মেয়েদের লাইন তখনও শেষ হয় নাই। আমরা মনে মনে হাসলাম, এদের তো অনেক দেরি হবে। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে ওরা সবাই আরেকটা যে বাথরুম আছে ‘খুব খারাপ’, সেটাতে লাইন ধরে ঢুকতে লাগলো। মনে হলো আমরা সবাই মিলে কেন এক লাইনে দাঁড়িয়ে আছি সেইটা নিয়ে ওরা বেশ অবাক হয়ে গেলো!
খাওয়া শেষ করেই আমরা আবার দৌড়ে বাসে উঠলাম। মাইশার ফল কিনতে একটু দেরি হয়ে যাচ্ছিলো দেখে নিলয় দৌড় দিয়ে তাগাদা দিয়ে ওদের নিয়ে আসলো। আমাদের বাস আবার ছেড়ে দিলো। এবং বরাবরের মতই আমরা চলতে শুরু করলাম। আস্তে আস্তে কড়া রোদ বাড়তে লাগলো। বাসের এক পাশের জানালা দিয়ে গনগনে রোদ ঢুকতে লাগলো। আমরা সবাই যার যার কম্বল দিয়ে জানালা ব্লক করে দিলাম। কয়েকদিন আগেও কম্বলটা জড়িয়ে এই বাসের মধ্যেই ঘুমিয়েছি, আর এখন কম্বলটা দিয়েই রোদ আটকিয়ে গরম কমানোর চেষ্টা করছি, কি অদ্ভূত!
গুগল ম্যাপে যখন থেকে দেখাতে লাগলো গোয়ায় ঢুকে পড়েছি, তখন থেকেই চারপাশের দৃশ্যপট বদলে গেলো। সরু রাস্তা, দুপাশে দোতলা তিনতলা বাড়ি, অন্যরকম চেহারার মানুষজন আর প্রচুর সাদা চামড়ার টুরিস্ট দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম। এক পর্যায়ে আমাদের বাস এসে থামলো এক জায়গায়। কমিটির লোকজন হোটেলের খোঁজ খবর নিতে গেলো। আমরা অনেক্ষণ বাসে বসে রইলাম। তারপর গ্রিন সিগনাল পেয়ে সব মালপত্র নিয়ে নেমে পড়লাম গোয়েল থেকে। আমার একটা সোয়েটার ইচ্ছা করেই রেখে দিলাম গোয়েলে। আর একবার হার্ডব্রেক করার সময় প্যাকেটের ভিতর থেকে সুভেনিয়র হিসেবে রেখে দেওয়া ক্যাফে কফি ডের বেলজিয়ান চকো শটের ছোট্ট গ্লাসটা ছিটকে পড়ে গিয়েছিল। ঐটা আর খুঁজে পেলাম না। এই দুইটা জিনিস ছাড়াই হাজির হলাম গোয়েলের পিছনে লাগেজ নেওয়ার জন্য। শেষবারের মত পাংকু হেল্পার আমাদের লাগেজ নামিয়ে দিলো। গোয়েলকে টাটা বাই জানিয়ে কাঁধে হ্যান্ড ব্যাগ, পিঠে ব্যাগ প্যাক, হাতে খাবারের প্যাকেট আর বড় লাগেজ- এই চারটা জিনিস নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। কাঁচা এবড়ো থেবড়ো রাস্তা দিয়ে ট্রলি ব্যাগটা টানতে টানতে কয়েক কদম সামনে যেতেই হাঁপিয়ে গেলাম।
দীর্ঘদিন পর সব লাগেজ একসাথে নিয়ে হাঁটছি, তাও আবার কাঁচা রাস্তায়! দম সব বের হয়ে গেলো। কিন্তু বসে থাকলে তো চলবে না, জোরে নিশ্বাস নিয়ে আবার হাঁটতে লাগলাম। আশেপাশে দেখতে লাগলাম সবারই প্রায় একই অবস্থা। আর দূরত্বটাও নেহায়েত কম নয়, গলির পর গলি হেঁটে যেতে লাগলাম। রাস্তা যেন শেষ হয় না। লাগেজ টানতে টানতে যখন হাতে লাল টকটকে দাগ পড়ে হাত অবশ হয়ে গেলো, পায়ের মাংসপেশী যখন টনটন করতে লাগলো, পরিশ্রমের চোটে আমাদের গাল, মুখ, চোখ যখন লাল হয়ে গেলো- তখন এক চিপার মধ্যে আমাদের রেস্ট হাউজের সন্ধান মিললো। একটা চিপা দিয়ে ঢুকলে ছোট্ট একটা উঠান, তার এক পাশে এক তলা একটা বাড়ি আর অন্য পাশে দোতলা একটা বাড়ি। একতলা বাড়িটাতে দুইটা রুম, দুইটাই ছেলেদের। আর দোতলা বাড়িটাতে মোট চারটা রুম, চারটাই মেয়েদের। আমি এসে দেখি নিচ তলার রুম দুইটায় অলরেডি মায়িশারা আর উর্মিরা উঠে পড়েছে। এই ভারি লাগেজ সিড়ি দিয়ে টেনে টেনে দোতলায় তুলে প্রথম রুমটাতেই ঢুকে আমি বিছানায় ধড়াম করে পড়ে গেলাম।
বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতেই দেখলাম মিম আর অন্তরা এসে বললো ওরাও এই রুমে থাকবে, প্রত্যেক রুমে বরাদ্দ ছয় জন করে। ওরাও মাল পত্র রেখে আমার মত ফ্ল্যাট হয়ে বিছানায় পড়ে গেলো। একে একে মৌলি, মজুমদার, রুবাইদা- সবাই এলো। মৌলি আর মজুমদার চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘গরম কাপড় সব ফেলে দিবো, সঅঅঅব- এই ব্যাগ টানা সম্ভব না’। আমরা খানিকটা ধাতস্থ হয়ে খেয়াল করলাম রুমটা মোটামুটি বড়। ডবল বেডটায় চারজন শোয়া যাবে আর বাকি দুইজনকে ফ্লোরিং করতে হবে। রুমে একটা এসিও আছে দেখে আমরা বেশ খুশি হয়ে গেলাম। বাথরুমটাও চমৎকার আর এই প্রথম কোন বাথরুমে আমরা হ্যান্ড হোস পাইপ পেলাম। আমরা যখন এইসব গবেষণা করছিলাম তখন রিন্তু এসে হাজির হলো। ওকেও এই রুমে থাকার জন্য পাঠানো হয়েছে। সব মিলিয়ে আমরা হলাম সাতজন!
ঝটপট করে আমরা আমাদের লাগেজ খুলে জামাকাপড় বের করে নিলাম। এতদিন পড়ে থাকা কেডসটাকে বারান্দায় দিলাম শুকানোর জন্য। বের করে নিলাম স্পঞ্জের স্যান্ডেল। সকল জিনস বাদ দিয়ে পায়জামা বের করে নিলাম। জামার সাথে পায়জামা আর স্কার্ফের কোন মিল নাই, কিন্তু তাতে কি? একটা হলেই হলো! এর মধ্যে আমি লক্ষ করলাম আমার হাত আর পায়ে বড় বড় জায়গা জুড়ে নতুন চামড়া উঠছে। মিম হাসি মুখে বললো, ‘পরিশ্রমের ঠ্যালায় তোর নরম চামড়া পড়ে গিয়ে শক্ত চামড়া উঠছে। তবে দেশে গিয়ে যখন আবার পরিশ্রম বন্ধ করে দিবি তখন আবার এই শক্ত চামড়া পড়ে গিয়ে নরম চামড়া উঠবে’। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। একটু ফ্রেশ হয়েই সবাই খাওয়া দাওয়ার জন্য বের হয়ে পড়লাম। আমাদের চিপাটার সামনেই ‘ভিন্সি’স প্লেস’ এ গেলাম সবাই মিলে। গিয়ে চটপট একটা টেবিলে বসলাম। কি অর্ডার দিবো না দিবো ভাবতে ভাবতেই শুভ এগিয়ে আসলো। প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দিলো কড়কড়ে এক হাজার রুপির নোট। খুশিতে আমরা চিৎকার দিয়ে উঠলাম! শুভ জানালো এটাই ওর ‘গোয়ার সারপ্রাইজ’। শুনে রুবাইদা বলে উঠলো, ‘সত্যিই খুশিতে চোখে পানি চলে আসছে’। এতদিন ধরে চলতে চলতে অনেকেরই টাকা পয়সায় টানাটানি পড়ে যাচ্ছে। গোয়ায় এমনিতেও সব কিছু একটু দামি, সেখানে হুট করে এক হাজার রুপি পাওয়া বিশাল ব্যাপার!
আমি আর অন্তরা ভেবে চিন্তে অর্ডার দিলাম ২২০ রুপির প্রন থালি। সমুদ্রের কাছাকাছি জায়গায় এসে মাছ জাতীয় খাবার খেতেই মন চাইলো। খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, তাড়াতাড়িই চলে আসলো প্রন থালি। চিংড়ি মাছের তিন রকমের পদ আর সাথে ভাত। মুখে দিয়েই মুগ্ধ হয়ে গেলাম, এত মজার খাবার! একটা পদ ছিলো ছোট চিংড়ি মাছকে সামুদ্রিক মাছের ডিম দিয়ে মাখিয়ে মচমচে ফ্রাই। খেতে এতই মজা ছিলো, কি আর বলবো- আমি আর অন্তরা কোন কথাবার্তা না বলে গপাগপ খেতে লাগলাম। আশেপাশে যারা ছিলো তারা সবাই নিজেরদেরটা খেয়ে টেস্ট খুবই হাই ক্লাস বলতে লাগলো। আমি বুঝলাম, গোয়ার খাবারের দাম যেমন বেশি, টেস্টটাও সেইরকমই!
ভরপেট খাওয়া দাওয়া করে আমরা বিচে ঘুরতে গেলাম। আমরা যেই জায়গাটায় আছি সেটার কাছাকাছি যে বিচটা সেটার নাম কালাংগুটে বিচ। বলতে গেলে আমাদের রেস্ট হাউজ থেকে খুবই কাছে, দুই মিনিটের হাঁটা পথ। সবাই দল বেঁধে বিচে গেলাম। মোটামুটি শান্ত বিচ, তেমন কোন ভিড়ভাট্টা নাই। সবাই নামতে শুরু করলো পানিতে। জোয়ারের সময়, তাই চিন্তার কিছু নাই। তার উপর সমুদ্রে সেফ জোনের মোটামুটি একটা সীমানা টানা আছে, সেই সীমানা ক্রস করলেই লাইফ গার্ড টাইপের লোকজন বাশি ফুঁ দিতে দিতে চলে আসে। বিশাল সমুদ্রের ঢেউয়ের ঝাপটায় আমাদের সব ক্লান্তি মুছে গেলো নিমেষেই। আমি পায়ের গোড়ালি ভিজিয়ে বিচ ধরে হাঁটতে লাগলাম। গোয়ার বিচটা কক্সবাজারের মত এত সুন্দর বলে মনে হলো না। তবে বিচে অনেক রকম অ্যাক্টিভিটি করার সুযোগ আছে, যেমন প্যারাসেইলিং, ওয়াটার স্কুটার, স্পিডবোট ট্রিপ, ব্যানানা রাইডিং সহ আরও অনেক কিছু। বিচ দিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট জিপ গাড়ির মত এক ধরনের গাড়ি। আর একেবারেই বিচের পাশেই বড় বড় শ্যাক। সেখানে সি ফুডের পাশাপাশি নানা রকম অ্যালকোহলের বোতলও সাজিয়ে রাখা হয়েছে সুন্দর করে। এই সব কিছু মিলে বিচটাকে আকর্ষনীয় করে তুলেছে। কিন্তু কক্সবাজারকে আমার মনে হয়েছে আলগা জিনিসপাতি দিয়ে আকর্ষনীয় করার দরকার নাই, সে নিজেই চমৎকার!
এর মধ্যে আমাদের কয়েকজন দেখলাম স্পিড বোটওয়ালার সাথে দরাদরি করছে। বোট ঠিক হয়ে গেলে আমরাও উঠে পড়লাম। প্রত্যেকের জন্য আলাদা সিট, সাথে আবার লাইফ জ্যাকেট পড়ে বসতে হয়। আমাদের নিয়ে বোট ঘুরে আসলো কয়েক মিনিট। বোট থেকে নেমে আমরা ভাড়া মিটিয়ে দিলাম পার হেড ৮০ রুপি করে। আবার গোড়ালি পানির উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে কালাংগুটে বিচের দিকে যেতে লাগলাম। গিয়ে শুনলাম ঢেউয়ের ঝাপ্টা ফাহাদের পকেট থেকে সানগ্লাস আর নিলয়ের পকেট থেকে হোটেল রুমের চাবি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আমরা এই নিয়ে বেশ হাসাহাসি করলাম। ততক্ষনে সূর্য প্রায় ঢলে পড়েছে। সবাই মিলে সূর্যাস্ত দেখলাম। বিশাল কমলা আকাশে টুপ করেই হারিয়ে গেলো ছোট সূর্যটা। সবার জামাকাপড়ই ভেজা, আর লবন বালিতে শরীর কুটকুট করতে লাগলো। সবাই সময় নষ্ট না করে রওয়ানা দিলো হোটেলের উদ্দেশ্যে।
রুমে গিয়েই সবার আগে মৌলি গোসলে ঢুকলো। তারপর মজুমদার। মজুমদারের গোসল অর্ধেক হওয়ার পর পানি শেষ হয়ে গেলো। ও বাথরুম থেকে চিৎকার করতে লাগলো পানির জন্য। আমি পাশের রুমে গেলাম। গিয়ে শুনলাম ওদের বাথরুমে বাসিরুনও গোসল করতে গিয়ে পানির অভাবে আটকা পড়ে আছে। বারান্দা দিয়ে নিচে তাকিয়ে ছেলেদের ডাকাডাকি করলাম। কৌশিক বের হয়ে আসলো। ও বললো কলে পানি নাই, কিন্তু আধা বালতি পানি আছে। চাইলে সেটাই নিতে পারি। কি আর করা তাই নিতে রাজি হলাম। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে আসতে দেখলাম শান্ত মুখে ফেসপ্যাক লাগিয়ে বসে আছে। আমি পানি নিয়ে যাচ্ছি দেখে ও বললো ওর নাকি মুখ ধুতেই এই পানি লাগবে। এই নিয়ে কথা বার্তা হতে হতেই উপর থেকে খবর আসলো যে কলে পানি চলে এসেছে।
একে একে আমরা সবাই গোসল করলাম। আমরা গোসল শেষে সব কাপড় চোপড় ধুয়ে বারান্দায় মেলে দিলাম। এই প্রথম কোন জায়গায় আমরা স্বাধীনভাবে ধোয়া কাপড় মেলে শুকাতে দিতে পারছি। কাপড় মেলে দিতে দিতে যখন পুরো বারান্দা ভরে গেলো তখন আমরা সিঁড়ির রেলিংগুলোতেও কাপড় মেলে দিতে লাগলাম। গোসল এবং কাপড় চোপড় ধোয়ার ফলে বাথরুমে বালির স্তুপ জমে গেলো আর সারা রুম কেমন কাদাকাদা হয়ে গেলো। সবার শেষে বাকি ছিলো রুবাইদা। ও বললো ও ই নাকি সারা রুম গুছিয়ে পরিষ্কার করে দিবে। আমরা ওর গোসল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইলাম, কিন্তু ও আমাদের সবাইকে ঘুরে আসার জন্য বললো। আমি বিপদ আপদের কথা তুলতেই সাহসী রুবাইদা সেগুলো হেসেই উড়িয়ে দিলো। আমরা বললাম তারপরও আমরা দূরে কোথাও যাচ্ছি না, আমাদের বাকি লোকজনের জন্য আরেকটা যে রেস্ট হাউজ আছে সেটাতেই যাচ্ছি। একটু পর চলে আসবো।
আমাদের বারান্দা থেকেই দেখা যায় আরেকটা রেস্ট হাউজ। রাস্তায় নেমে হাতের বাম পাশে কয়েকটা বাসা পার হলেই চলে আসে সেই বিল্ডিঙ্গটা। নিচ তলায় আমাদের কেউ নাই। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। নিশাত তখনও রেডি হয় নাই। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিশাত, তমা, পৃথ্বীদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে দেশে ফোন দিলাম। আম্মুর সাথে কথা বললাম। আম্মু বারবার সমুদ্র থেকে দূরে থাকার জন্য সাবধান করে দিলো। বাসার সবার কথা জিজ্ঞেস করলাম। শুনলাম ভাতিজা ছোট্ট ওয়াফির জন্য ওর মামি একটা খেলনা এনে দিয়েছে সেইটা নিয়ে ও এখন সারাদিন ব্যস্ত থাকে।
ওদিকে নিশাত, তমা আর পৃথ্বীর হয়ে যেতেই আমরা নেমে পড়লাম। আমি আবার আমাদের রেস্ট হাউজে ছুটে গেলাম রুবাইদার জন্য। গিয়ে দেখি এলাহি কারবার! রুবাইদা ওর রিজেক্টেড জামাকাপড় সব বের করে একটা জামা দিয়ে সারা রুম মুছে চকচকে করে ফেলেছে। একটা পাতলা সোয়েটার রেখেছে বাথরুমের সামনে পাপোশ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। সবার এলোমেলো লাগেজ সব এক পাশে সরিয়ে ফ্লোরে শোবার জন্য বন্দোবস্ত করে রেখেছে। এত কিছু করতে গিয়ে ওর গোসলে যাওয়াই হয় নাই। আমি রুমে থাকতে চাইলেও আমাকে ও জোর করে ডিনার খাওয়ার জন্য রিন্তু, তমাদের সাথে পাঠিয়ে দিলো। কি আর করা, রুবাইদাকে ছাড়াই আমরা খেতে চলে গেলাম।
আমরা সবাই মিলে হাঁটতে লাগলাম রাস্তা দিয়ে। চিপা চিপা অন্ধকার গলি গলি রাস্তাগুলো দেখতে সুবিধার লাগে না। অনেক ডান বামে ঘুরে শেষমেশ আমাদের গোয়েল যেখানে নামিয়ে দিয়েছিলো সেখানে পৌঁছে একটা সুন্দর রেস্টুরেন্ট পেলাম যার নাম ‘ভিক্টোরিয়া হোটেল’। কোন একটা বাড়ির উঠানে ছনের ছাউনি দিয়ে সুন্দর টেবিল চেয়ার পাতা আছে। বেশ ঘরোয়া পরিবেশ। ঢুকেই দেখি পাশের টেবিলে রিজভী, তুষার, জেরিন, আদিবা, আফরা- ওরা বসে আছে। আমরাও চটপট অর্ডার দিলাম। আমি শেয়ারে নিলাম মিক্সড ফ্রায়েড রাইস আর প্রণ চিলি। মিম নিলো কালামারি। আমরা সবাই এক জন আরেকজনেরটা শেয়ার করলাম। রান্না খুবই মজা ছিলো। আমরা গোয়ার রান্নার প্রেমে পড়ে গেলাম। হাসি আর গল্পগুজবের মধ্যে আমাদের খাওয়া শেষ হলো। আমার ভাগে বিল আসলো ১৫৮ রুপি। সব বিল মিটিয়ে দিয়ে আমরা বের হয়ে আসলাম। আমাদের আরও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করার শখ ছিলো। কিন্তু নির্জন অন্ধকার রাস্তাঘাট দেখে আর ঘুরতে ইচ্ছা হলো না। আমরা আবার হেঁটে হেঁটে আমাদের হোটেলের দিকে যেতে লাগলাম।
আবার সেই অন্ধকার গলিঘুপচি দিয়ে যেতে যেতে এক সময় আমাদের মনে হলো, ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি তো? ভালো করে ডান বাম দেখে হাঁটতে হাঁটতে একসময় দেখা হলো সুমাইয়া, রাফাত আর শান্তর সাথে। ওদের কাছে শুনলাম, কৌশিক হাতে একটা ড্রাগন ট্যাটু করিয়েছে। রাফাত ওর মোবাইলে ভিডিও দেখালো। আমরা দেখলাম ড্রিল মেশিনের নিচে হাত রেখে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিচ্ছে কৌশিক। তারপর সুমাইয়া আমাদের সাথে যোগ দিলো। আমরা সবাই একসাথে ভিন্সি’স প্লেসে ঢুকলাম। দেখি রুবাইদা সুন্দর একটা টেবিলে একা বসে আছে। আমরা গিয়ে যোগ দিলাম ওর টেবিলে। ও নাকি কি এক পাস্তা অর্ডার দিয়েছে। অর্ডার নেয় যে লোকটা সে ওকে বলেছে আমাদের সবাই নাকি এটাই নিচ্ছে।
ওর অর্ডার আসলে আমরা একটু টেস্ট করে দেখলাম। অসাধারণ টেস্ট! আমি চটপট একটা অর্ডার দিয়ে দিলাম, ‘মাশ্রুম ক্রিম পাস্তা’। আমি সাধারনত শখ করে পাস্তা খাই না। কিন্তু এই পাস্তাটা এতো মজা যে আমি ভরা পেটেও শেয়ারে একটা অর্ডার দিয়ে ফেললাম। বিশাল এক থালা ভর্তি শশা দিয়ে সাজানো সাদা ক্রিমে মাখানো পাস্তা এসে হাজির হলো। পুরো ট্যুরে এই প্রথম কোন এক জায়গায় আমি শশা পেলাম। এই দেশে সবাই সালাদ বলতে পিয়াজ অথবা মুলা কুচিকে বোঝে। শশা বা টমেটু যে সালাদ হিসেবে খাওয়া যায় সেটা এরা জানেই না। বহুদিন পর শশা পেয়ে ঝাপিয়ে পড়লাম আমি। পাস্তা মুখে দেওয়ার আগেই শশাগুলো চিবাতে লাগলাম। আর মজাদার পাস্তাটার কথা আর নাই বা বললাম- আমি পাস্তার সাথে সাথে নিজের প্লেটের সব শশা শেষ করে সুমাইয়ার প্লেটের শশাগুলোও খেয়ে ফেললাম। খাওয়া শেষে চেখে দেখলাম সি ফুড সুপ। উফ, সুপটাও এত্ত মজা-
পেট ওভার লোডেড করে আমরা যার যার রুমে ফেরত আসলাম। নিশাতের রুমের চাবি অন্যের কাছে। ওরা এখনও আসে নাই। তাই বললাম নিশাতকে আমাদের সাথে থেকে যেতে। আমাদের এক্সট্রা তোষক দিয়ে গেছে। নিচে আমরা ফ্লোরিং করলাম। রুবাইদা এক পাশে, আমি, নিশাত আর রিন্তু আরেক পাশে। সারা দিনে কম কষ্ট হয় নাই। তাই বেশি দেরি হলো না, ঘুম চলে আসলো।