ঘাড়, কোমর আর হাঁটুর টনটনে ব্যাথার কারনে একটু পরপর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছিলো। এই করতে করতে টের পেলাম খুব সকালবেলা আমাদের গোয়েল থামলো এক ধাবাতে। আমরা আড়মোড়া ভেঙ্গে আস্তে ধীরে নামতে লাগলাম। রুবাইদাকে দেখলাম ব্যাগ খুলে বদনা বের করে আনতে। আমরা সবাই খুশি হলাম, যাক- বোতল আর খুঁজতে হলো না। ফ্রেশ হয়ে দাঁতটাত মেজে ধাবাতে খাওয়াদাওয়া খোঁজ করলাম, তেমন কিছুই নাই। জ্যাব্জ্যাবে তেল দেওয়া একটা পরোটা পাওয়া যাচ্ছে। দেখে খাওয়া পছন্দ হলো না। তাই কিছু না খেয়েই আবার বাসে চড়ে বসলাম। বাস চলতে শুরু করলো।
যতভাবেই বসে থাকি, একটু গা এলিয়ে দিলেই ঐ তিনটা পয়েন্টে টনটনে ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে আমাদের কথাবার্তাও বাড়তে থাকে। এক সময় ঘুম ঘুমভাব ছেড়ে পুরা বাস জেগে ওঠে। আমরা নিজেরা হৈচৈ করেতে থাকি। কিন্তু কতক্ষণ আর হৈচৈ করা যায়, পথ তো শেষ হয় না। অনেকে উশখুশ করতে থাকে- ঘড়ি দেখতে থাকে। গুগল ম্যাপ বের করে খোঁজাখুঁজি করা শুরু হয়। সব দেখে মনে হতে থাকে আমরা বোধহয় গন্তব্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। ব্যাপারটা সঠিক কিনা জানার জন্য নানাভাবে গবেষণা শুরু হয়। একসময় সত্যিই মনে হতে থাকে আমরা ভুল রাস্তায় যাচ্ছি। কমিটির লোকজন ড্রাইভারকে গিয়ে একথা জানায় কিন্তু ড্রাইভারের কোন ভাবান্তর নাই। সে একমনে বাস চালিয়ে যেতেই লাগলো। আমরা ম্যাপে দেখতে লাগলাম আমরা কোথায় যাচ্ছি। প্রতি মূহুর্তে আমরা আওরংগবাদ থেকে কয় কিলোমিটার দূরে সরে যাচ্ছি নিলয় এসে আপডেট দিতে লাগলো।
এতদিন ট্যুর করে আমরাও কেমন যেন অদ্ভূত টাইপের মানুষ হয়ে গেছি। কোথায় সবাই ভয় পেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিবে- তা নয়। বরং সবাই বেশ ঠাট্টা তামাশা করতে লাগলো যে আমরা পথ হারিয়েছি। আমরা নিজেরা নিজেরা রাস্তা হারিয়েছি বলে হাসি তামাশা শুরু করে দিলাম। এভাবে মোটমাট ঘন্টা দুয়েক চলার পর আমরা ম্যাপে রিডিং দেখলাম যে সঠিক পথে যাচ্ছি, গন্তব্যের সাথে আমাদের দূরত্ব কমতে লাগলো। তবে বাস চলতেই লাগলো। আমরা ধৈর্য ধরে বসেই রইলাম।
মোটমাট ১২-১৪ ঘন্টার জার্নি ১৮ ঘন্টায় শেষ করে আমরা নামলাম সরাসরি অজন্তায়। গনগনে দুপুরবেলায় আমরা বাস থেকে নেমে হাত পা ছুঁড়তে লাগলাম। সামনে একজন লোক পেয়ারা নিয়ে বসে ছিলো। ১০ রুপি দিয়ে সুন্দর একটা পেয়ারা কিনে তাতে কামড় বসিয়ে দিলাম। একেবারে খালি পেটে ফল খেতে হলো, আল্লাহ আল্লাহ করলাম পেটে যেন কোন সমস্যা না হয়। কমিটির লোকজন টিকেট কেটে আনতে গেলো। আমি বসে বসে পেয়ারা চিবাতে লাগলাম। কমিটির মধ্যে আমাদের শিডিউল নিয়ে একটা সমস্যা হচ্ছে টের পাচ্ছিলাম। সত্যি সত্যি শুভ ঘোষনা দিলো, আমাদের হিসাব থেকে মূল্যবান ৬ ঘন্টা হারিয়ে গেছে এই অজন্তায় আসার পথে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মুম্বাই যেটা এখান থেকে আরও ৭-৮ ঘন্টার জার্নি। মুম্বাইয়ে আমাদের আধা বেলা থাকার কথা ছিলো তারপরই রওয়ানা দেওয়ার কথা গোয়ার উদ্দেশ্যে। গোয়ায় নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের বাস ছেড়ে দিতে হবে তাই সেটার নড়চড় করা যাবে না। এখন মুম্বাইয়ের দিকে যাওয়া সম্ভব না কারণ ড্রাইভারকে ঘুমাতে দিতে হবে। আর যদি কষ্টকরে আমরা যাইও ৭-৮ ঘন্টা জার্নি করে, মাত্র কয়েকঘন্টার মধ্যে আমাদের আবার একটা বড় জার্নি করতে হবে গোয়ার উদ্দেশ্যে। তাই সব কিছু চিন্তা করে কমিটি ডিসিশন নিয়েছে আমাদের মুম্বাই ট্রিপ ক্যান্সেল। তারচেয়ে বরং আজকে রাতে আমরা আওরঙ্গবাদে থেকে যাবো। কাল ইলোরা দেখে সেখান থেকেই গোয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো।
মুম্বাই বাতিল হয়ে যাওয়ায় আমাদের মন খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু অনেকেই পড়লো বিপদে যেমন- রাত্রি। রাত্রির চাচাতো ভাইয়ের বাসা মুম্বাইয়ে। সেখানে ওর সাথে দেখা করার জন্য ওর চাচা আরেক শহর থেকে ফ্লাই করে এসে বসে আছে। আজকে সকাল পর্যন্ত ও চাচার সাথে যোগাযোগ করে বলে এসেছে যে ও আসছে মুম্বাই। এখন ও না গেলে ব্যাপারটা খুব খারাপ হয়। এই নিয়ে ও বেশ টেনশনে পড়ে গেলো। অন্যদিকে মৌলির বাবা মুম্বাইয়ের এক লোকের মাধ্যমে মৌলির কাছে টাকা পাঠাচ্ছে। এখন মুম্বাই না গেলে কেমন করে সেই টাকা ও যোগাড় করবে? সব কিছু মিলিয়ে আমরা কিছুটা মন খারাপ, কিছুটা দুঃখ, কিছুটা আশংকা নিয়ে ঢুকতে লাগলাম অজন্তায়।
হাঁটতে লাগলাম অনেক দূর। কেমন যেন বাজারঘাট, পার্ক -সব পার হয়েও আমরা হাঁটতে লাগলাম। তারপর পেলাম এক বাস। ৪০ রুপি দিয়ে টিকেট কেটে সবাই উঠে পড়লাম সেই বাসে। বাস আমাদের নিয়ে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে উঠতে লাগলো। প্রায় ১৫-২০ মিনিট জার্নির পর আমাদের নামিয়ে দিলো এক জায়গায়। সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে আমরা চলে গেলাম অজন্তার গুহাসারির সামনে। গুহা সারি বললাম এই কারণে যে পাথুরে পাহাড়ের এক পাশে খাদ আর অন্য পাশে সারি সারি গুহা। আমরা হেঁটে হেঁটে একেকটা গুহায় ঢুকতে লাগলাম। প্রথমে কারুকাজ করা কলাম ওয়ালা একটা গুহায় ঢুকলাম। ভেতরটা বেশ অন্ধকার। কিন্তু এর মধ্যে ইলেক্ট্রিক বাল্বের হালকা নীলচে আলোয় জ্বলজ্বল করছে বিশাল এক বুদ্ধ মূর্তি। আমরা সবাই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মুর্তিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কেমন যেন অদ্ভূত অনুভূতি হলো। হাজার হাজার বছর আগে কতশত মানুষ কতই না কষ্ট করে আসতো -এই গুহাগুলোতে –ইলেক্ট্রিক লাইট বিহীন এই ঘুটঘুটে অন্ধকার জায়গায়- এই সব ভাবতে ভাবতে কেমন যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে লাগলো আমার। ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, লাল নীল রঙয়ের জ্যামিতিক কারুকাজে ভরা পুরা সিলিংটা যার বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু অনেকাংশই টিকে আছে হাজার বছর ধরে। আবছা আলোয় দেওয়ালের হাতে আঁকা রঙ্গিন ফ্রেস্কো চিত্রকর্ম দেখে থ হয়ে গেলাম। হাজার বছর আগের এই পাহাড়ি গুহার দেওয়াল ও ছাদ জুড়ে থাকা রঙ্গিন সব জটিল কারুকাজ, ফুলেল নকশা ও চিত্রকর্ম দেখে নিজেকে কেমন যেন বেকুব বেকুব লাগলো।
এক নম্বর গুহা থেকে বের হয়ে আমরা পরের গুহাগুলোর দিকে হাঁটতে লাগলাম। দেখতে লাগলাম আরও অনেক মূর্তি, এদের কোনটা বুদ্ধের, কোনটা অন্যদের, কোনটা অনেক বড়, কোনটা আবার ছোট্ট, কোনটা দাঁড়ানো, কোনটা বসা, কোনটা আবার নাচের ভঙ্গিতে। দেখলাম পুরোহিতদের ঘুমানোর জন্য পাথুরে দুইটা বিছানাসহ ছোট্ট ছোট্ট ঘর। আরও দেখলাম চৈত্য হল, চৈত্য জানালা, প্রদক্ষিণ পথ, স্তুপা- বইয়ে যা যা পড়েছিলাম সবই! এইভাবে একে একে দেখা হয়ে গেলো ৩০ টা গুহা। শেষের দিকে এসে প্রায় দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছিলাম কারণ গুহা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় হয়ে আসছিলো। এক পাশে অদ্ভূত সুন্দর সবুজ পাহাড়ের নৈসর্গিক দৃশ্য, অন্য পাশে মানব সৃষ্ট পাথর কেটে বানানো হাজার বছরের পুরানো গুহা- দেখতে দেখতে কখন যে দিনে আলো কমতে শুরু করেছিলো তা টেরই পাই নাই। তাই শেষে দৌড়ে দৌড়ে অজন্তা থেকে বের হয়ে যেত লাগলাম আমরা। আশেপাশে বসে থাকা বানরগুলো আমাদের দিকে মুখ ভ্যাংচাতে লাগলো, সেই দিকে পাত্তা না দিয়ে আমরা ৪৬ জন তাড়াহুড়া করে পার হতে লাগলাম পাথুরে রাস্তা।
অজন্তা থেকে বের হতে হতেই হুড়াহুড়ি করে বাসে উঠলাম আমরা। বাস আমাদের যখন সেই বাজার টাইপের জায়গায় নামিয়ে দিলো তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সেই সকাল থেকেই কিছু খাওয়া হয় নাই। আমরা কোন ভাবনা চিন্তা না করেই সবাই ভাগ হয়ে দুইটা দোকানে বসে পড়লাম। আমি আর রুবাইদা অর্ডার দিলাম ৫০ রুপির পাও ভাজি। রুবাইদা মুম্বাই গিয়ে পাও ভাজি খাওয়ার প্ল্যান করে রেখেছিলো, যেহেতু মুম্বাই ক্যান্সেল- তাই এখানেই চেখে ফেললাম পাও ভাজি। এটা তেমন আহামরি কোন খাবার নয়। বনরুটির সাথে মটরের ডাল জাতীয় একটা তরকারি দেওয়া হয় যার উপর অনেক পিঁয়াজ কুচি ছড়ানো থাকে। খেতে খারাপ মোটামুটি। এমন একটা টাইমে খেলাম যে বুঝতে পারছিলাম রাতে আর খাওয়া হবে না। আমরা তাই ধীরে সুস্থে আয়েশ করে খেলাম। খাওয়াদাওয়া শেষে অনেকে কেনাকাটা করতে লাগলো। ঐশী, নোভারা দরাদরি করে পাথরের মালা মোটামুটি কম দামেই কিনতে লাগলো। আমি ঘুরে ফিরে বিস্কুটের প্যাকেট কিনে নিলাম ঘুমানোর আগে খাওয়ার জন্য। মোটমাট রাত আটটার দিকে আমরা গোয়েলে গিয়ে উঠলাম।
গোয়েল আমাদের নিয়ে গেলো হোটেল মুরলি মনোহরে। গোয়েল থামতেই টের পেলাম মজুমদার অসুস্থ। মৌলি ওকে ধরে বসে আছে। আমাদের ও বললো রুমে চলে যেতে। আমি আর রুবাইদা রুমে চলে গেলাম। বেশ ছিমছাম একটা হোটেল। বেশ বড় রুম, সাথে ঝকঝকে বাথরুম আর বড় একটা খোলা বারান্দা। রুমে ঢুকেই প্রথমে রুবাইদা গেলো গোসলে। আমি ততক্ষণে জিনিসপত্র গুছিয়ে রেডি হয়ে বসে আছি গোসলে যাবার জন্য। মজুমদার রুমে এসেই শুয়ে পড়লো বিছানায়, মৌলি বললো একবার বমি করেছে- খাওয়াটা মনে হয় সুবিধার ছিলো না। রুবাইদা বের হতেই আমি গোসলে ঢুকলাম। বাথরুম থেকেই টের পেলাম রুমে বেশ চিৎকার-হৈচৈ হচ্ছে। তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করে বের হয়ে দেখলাম মজুমদার বলতে গেলে কারও ডাকেই সাড়া দিচ্ছে না। খুব খারাপ লাগছে নাকি ওর। রুম ভর্তি মানুষজন। একেক জন একেক সাজেশন দিতে লাগলো। তবে সবাই এক বাক্যে বললো, ওষুধ খাওয়ানোর আগে পেটে খাওয়া দিতে হবে। শুভ নাকি ভাত খুঁজতে বের হয়ে গেছে। এই মহারাষ্ট্রে এসে এত রাতে ভাত খুঁজে পাওয়া কি সোজা কথা? কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে শুভ কোথা থেকে যেন এক প্যাকেট ভাত, কড়া একটা ডিম ভাজা, লাল মরিচ দিয়ে বাগার দেওয়া ঘন ডাল নিয়ে আসলো। এই দৃশ্য দেখে মজুমদার শত অসুস্থতার মধ্যেও আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলো! রুম সার্ভিসে খবর দিয়ে একটা প্লেট আনালাম। সেই প্লেটে শক্ত ভাত ডাল দিয়ে মেখে আমি মজুমদারকে খাওয়াতে লাগলাম। মজুমদার মুখ বিকৃত করে ডাল ভাত গিলতে লাগলো। একটু খাওয়ার পরই আমরা ওকে স্যালাইন আর অ্যান্টাসিড খাইয়ে দিলাম। ও পড়ে ঘুম দিতে লাগলো। ওদিকে সৌরভের বার্থডে পার্টি ছিলো রাতে। মজুমদার অসুস্থ বলে আমরা কেউ গেলাম না। আমাদের একটা এক্সট্রা তোষক দিয়ে গেলো রুম সার্ভিস থেকে। রুবাইদা সেখানে নিজের শোবার ব্যবস্থা করলো। এরই মধ্যে উঠলো ঝড়! আক্ষরিক অর্থেই ঝড়! ঠিক যেন কাল বৈশাখি!
হঠাৎ করে প্রবল বাতাসের ঝাপ্টায় জানালার কাঁচ থরথর করে কেঁপে উঠলো। আমি দৌঁড়ে বারান্দায় মেলে দেওয়া কাপড়, জুতা নিয়ে আসতে গেলাম। বারান্দায় গিয়ে আমার মনে হলো এটা বোধহয় ধুলি ঝড়। চোখে মুখে প্রচন্ড বাতাসের সাথে বালির ঝাপটা এসে লাগলো। আমি অল্প একটু চোখ ফাঁক করে দেখলাম আশেপাশে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সব ঢেকে গেছে ধুলার কুয়াশায়। তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে বন্ধ করে দিলাম বারান্দার দরজা। মজুমদারের পাশে আমি লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। ভাবলাম ইন্ডিয়ায় এসে ধুলার ঝড়ের সাথেও দেখা হয়ে গেল, কি ভাগ্য!
I was so upset about not being able to go to Mumbai. But it was so exciting!!! 💜 lots of love for bringing back the memories!!
💜 💜 ধন্যবাদ জেরিন 💜 💜
tui atto kichhu kivabe mone rakhis dost kibhabe???????
joss lekha,,tui boi ber kor taratari
বই ছাপিয়ে যে ব্যাপক লসের সম্মুখীন হবো, সেই টাকাটা কি তুই দিবি????
age loss houk tarpor dekha jabe…
loss khabi na insha Allah!