ঘুম থেকে উঠার আগেই টের পেলাম মজুমদার সুস্থ হয়ে উঠেছে। ওই আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে লাগলো। মজুমদার একদম ভোরে উঠে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বসে আছে। আমাদেরকে সবাইকে জ্বালানোর জন্য ও বেশ লজ্জিত। আমরাও ওকে এই সুযোগে আরও জ্বালাতন করতে লাগলাম। গতকাল ওর কারণে আমরা কি কি কষ্ট করেছি সেগুলো বারবার ওকে মনে করিয়ে দিতে লাগলাম। আমরা সময় নষ্ট না করে চটপট রেডি হয়ে গেলাম নাশতা করার জন্য। আমাদের হোটেলে কাছেই নাকি খাওয়ার জায়গা আছে বলে জাফর জানালো। জাফর সমেত আমরা চারজন বের হয়ে পড়লাম।
হোটেল থেকে নামতেই একটা ধাবার মতন টিনের চালা দেওয়া হোটেল পেলাম। নাশ্তার জন্য সবাই মিলে আমরা রুটি, ডিম ভাজা আর পরোটা অর্ডার দিলাম। আমরা আমাদের মতন বসে গল্পগুজব করতে লাগলাম। জাফরকে কোন এক জুনিয়র জানতে চাইলো ইন্ডিয়ায় ট্যুরের বিষয়ে। ওরা কয়েকজন নাকি ট্যুর দিতে চায় অল্প পরিসরে। আমরা এইসব বিষয় আশয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করতে লাগলাম। এক পর্যায়ে আমাদের সব গল্পগুজব ফুরিয়ে গেলো, কিন্তু নাশতা আর আসলো না। আমরা বার বার দেখতে লাগলাম, তাগাদা দিতে লাগলাম- কিন্তু কারও কোন তাড়া আছে বলে মনে হলো না। একজন লোক আস্তে ধীরে পরোটার গোল্লা বানাতে লাগলো, সেটা সুন্দর করে বেলতেই লাগলো বেলতেই লাগলো, তারপর ধীরে সুস্থে তাওয়ায় তেল দিলো, এক সময় তেল গরম হলো, আস্তে করে তিনি পরোটাটা তাওয়ায় ছড়িয়ে দিলেন- এই পরোটা ভাজা শেষ হলে উনি আরেকটা পরোটা ঠিক একইভাবে বানানো শুরু করলেন। আমরা ধৈর্য ধরে সব দেখতে লাগলাম। পাঁচটা পরোটা একই নিয়মে বানানোর পর উনি আস্তে ধীরে দুইটা ডিম ভেঙ্গে, পিয়াজ মরিচ দিয়ে ফিটে ধীরে সুস্থে একটা ডিম ভাজলেন। সব মিলিয়ে প্রায় ৪৫ মিনিট পর উনি ৫টা পরোটা আর ৫টা ডিম ভাজা নিয়ে আমাদের টেবিলের সামনে দিয়ে গেলেন। কিন্তু আমাদের অর্ডার পাঁচটা পরোটা ছিলো না। অনেকে রুটি চেয়েছিলো, তাই উনি পরোটা ফেরত দেওয়ার সময় বলে গেলেন এখনই রুটি বানানো শুরু করবেন। এই কথা শুনে ভয় পেয়ে রুটির অর্ডার ক্যান্সেল করে সবাই পরোটা নিয়ে নিলো। এখন রুটি বানানো শুরু করলে নিশ্চয়ই পাক্কা আরও এক ঘন্টার ধাক্কা!
কোনমতে খেয়ে দেয়েই আমরা দৌড় দিলাম। রুমে গিয়ে আগের দিন রাতে গুছিয়ে রাখা ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে নেমে পড়লাম সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের গোয়েল ছেড়ে দিলো। আমরা চলতে লাগলাম ইলোরার উদ্দেশ্যে। গোয়েল চলতেই লাগলো দুপাশের বন জঙ্গল পার বয়ে। এর মধ্যে চিং আর উর্মির বেশ জ্বর ছিলো। উর্মি বেচারির মুখ জ্বরের চোটে লাল হয়ে রইলো। মোটমাট আমাদের চার ঘন্টা লাগলো ইলোরায় পৌঁছাতে। বাস আমাদের যেখানে নামিয়ে দিলো সেখান থেকে ইলোরার গেট কিছুটা দূর। বাস থেকে নেমেই আমরা টসটসে আঙ্গুর কিনে নিলাম ১০ রুপি দিয়ে। আমাদের দেশে ১০ টাকার আঙ্গুরের কথা ভাবাই যায় না। সবাই অতি উৎসাহে টপাটপ আঙ্গুর খাওয়া শুরু করলো। আমি খুঁজে খুঁজে একটা রেস্টুরেন্টের ওয়াশ রুম বের করলাম। সেখানে বেসিনে সুন্দর করে ধুয়ে নিলাম আঙ্গুরগুলো। তারপর খাওয়া শুরু করলাম।
আঙ্গুর খাওয়া শেষ হতেই ঝটপট অটো ভাড়া করে আমরা রওয়ানা হলাম ইলোরার দিকে। ঠিক হলো অটো আমাদের পুরো ইলোরা ঘুরে দেখাবে। প্রথমেই আমাদের নামিয়ে দিলো ২৯ নম্বর গুহায়। সেই আগের মত পাথর কেটে বানানো গুহা তবে এইখানে আছে বিশাল বিশাল সব পাথুরে মূর্তি। একেকটা ১৫-২০ ফিটের সমান। এই গুহা গুলো অজন্তার তুলনায় বেশ খোলামেলা, আর আলো বাতাস পূর্ণ। একটা করে গুহা দেখা শেষ হয় আর আমরা ছুটে গিয়ে অটোতে উঠি। অটো আমাদের নিয়ে রওয়ানা হয় পরের গুহার দিকে। অজন্তার গুহা গুলা যেমন খুব কাছাকাছি ছিলো, ইলোরারটা মোটেও সেরকম নয়। বরঞ্চ অনেক দূরে দূরে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে ৩২ নম্বর গুহায় গিয়ে হাজির হলাম। সেটা ছিলো দোতলা গুহা। ভিতরে সিড়ি আছে উপরের তলায় যাওয়ার জন্য। সিড়ি গুলো খুবই অদ্ভূত। অনেক খাড়া আর অনেক সরু। একেকটা রাইজার প্রায় এক ফিট উঁচু হবে আর ট্রেড অনেক সরু যাতে কোনমতে পায়ের পাতার অর্ধেকটা আঁটে। টুরিস্টদের পদচারনার চোটে খসখসে পাথুরে সিড়ি মসৃন হয়ে গেছে যেটা দেখে আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পেলাম। যাই হোক আল্লাহ নাম নিয়ে উঠে পড়লাম সিড়ি বেয়ে। তবে নামার সময় ভয়টা হলো আরও। জেরিনকে বলতে শুনলাম, ‘সিড়িগুলা কি জায়ান্টদের জন্য বানানো?’
কোন কোন গুহা খোলা পাহাড়ের উপরে, কোনটার সিলিঙে বিশাল পদ্ম ফুল খোদাই করে বানানো, কোনটায় যেতে হয় অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে, কোন গুহা দেখতে আবার একদম ঘরবাড়ির মত- দরজা, জানালা, রুম গুলা ভাগ করা, কোনটার সামনে বিশাল এক গরুর মূর্তি যাকে বলা হয় নান্দী বুল- এই রকম নানা বৈশিষ্ট্যের গুহা আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। দেখতে দেখতে আমাদের প্রায় সব এনার্জি বের হয়ে গেলো। শেষমেশ অটো আমাদের ১৬ নম্বর গুহার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলো। আমরা অটো ভাড়া ১৬০ রুপি দিয়ে অটো ছেড়ে দিলাম। এসে দাঁড়ালাম একটা পাথুরে পাহাড় কেটে বানানো অর্থাৎ ‘মনোলিথিক রক কাট’ বিশাল এক মন্দিরের সামনে যার নাম ‘কৈলাস টেম্পল’। এই মন্দির পাহাড়ের উপর থেকে পাথর কেটে কেটে ভিতরে গর্ত করে বানানো হয়েছে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেটা বলতে গেলে পাহাড়ের পেটের মধ্যে গর্ত করে বানানো সমতল জায়গাটা। সমতল জায়গাটার মাঝখানে উঁচু একটা মন্দির আর তার চারপাশে উঁচু হয়ে আছে পাহাড়। আমি পুরা থ হয়ে গেলাম। কি আশ্চর্য, হাজার বছর ধরেও এই রকম একটা জায়গায় মন্দিরটা টিকে আছে!
আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। মন্দিরের চারপাশে খোলা জায়গা ছাড়াও পাথুরে পাহাড়ের দেওয়ালে গর্ত করে মোটা মোটা পাথুরে কলাম দিয়ে সাপোর্ট করা প্রদক্ষিণ পথ ছিলো। আমরা সেখান দিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। এই পুরো পাহাড়টা কেন যে ধসে পড়ে যাচ্ছে না সেইটা ভাবতে ভাবতেই আমি ঘুরতে লাগলাম। শতকোটি মূর্তি বিশিষ্ট মন্দিরটা চক্কর দিয়ে ফেলে আমরা ভিতরে ঢুকে পড়লাম। বাইরে পাথর কেটে নকশা করা ছাড়াও সারা মন্দিরটা ছিল হাল্কা কমলা রঙয়ের, এর মধ্যে লাল, সবুজ আর হলুদ রঙ দিয়ে অত্যন্ত সূক্ষ্ম কারুকাজ করা। অনেক জায়গার রঙই নষ্ট হয়ে গেছে। হাজার বছরের পুরানো রঙ- কম কথা নয় তো! ভিতরের অবস্থা তো আরও জটিল, সেখানে সত্যি সত্যি পুজা অর্চনা হচ্ছে। আমি খানিক্ষণ নিশ্বাশ বন্ধ করে দেওয়ালের কারুকাজগুলার উপর হাত বুলালাম। আবছা আলোতে দেখলাম রঙ্গিন সিলিং। সব দেখে টেখে আমরা খোলা বারান্দার মত জায়গায় বের হয়ে আসলাম। আমি মিমের সাথে গল্প করতে করতে হাঁটতে লাগলাম। একটা ‘নান্দী বুল’ পার হয়ে আমরা বসে অনেক্ষণ গল্প করলাম। এই আশ্চর্য রহস্যময় জায়গাটা থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। মনের ভিতর ভাবনা চলতেই লাগলো হাজার বছর আগে কেমন করে সম্ভব হয়েছিলো এই রকম পাথুরে পাহাড়ে এই রকম স্থাপনার? কেমন করে?
ফোন আসতে লাগলো, সবাই নাকি খেতে বসে গিয়েছে। আমি আর মিমও ছুটলাম ক্যান্টিনের দিকে। আমি আর রুবাইদা মিলে অর্ডার দিলাম ৮০ রুপির ভেজ ফ্রায়েড রাইস। একটু শক্ত চালের হলেও খেতে ভালোই ছিলো। খেয়ে দেয়ে আমরা ধীরে সুস্থে গোয়েলে ফেরত গেলাম। সেখানে অনেক ফেরিওয়ালা নানা রকম মালা নিয়ে ঘোরাঘুরি করছিলো। ছোট ছোট পুতির একটা ভারি প্যাঁচানো মালা ৫০ রুপি দিয়ে সবাই কিনতে লাগলো গণ হারে। এক পর্যায়ে সারা তল্লাটের সকল ফেরি ওয়ালা দৌড়ে আসলো মালা সমেত। একজন লোক আবার ছোট্ট চালের দানার উপর নাম লিখে চিকন এক শিশি তেলের ভিতর ভরে চাবির রিং বানিয়ে দিচ্ছিলো। আমি একটা চাবির রিং বানিয়ে নিলাম আমার কামলা পিউয়ের জন্য। তারপর দেখলাম এই যাত্রাই আমাদের গোয়েলের সাথে শেষ যাত্রা বলে সবাই একটু ছবিটবি তুলতে আগ্রহী হয়ে উঠলো। আমরা গোয়েলের সাথে অনেক ছবি তুললাম, ভিডিও ও করলাম। সবশেষে বিকাল ৬টার দিকে রওয়ানা হলাম গোয়ার উদ্দেশ্যে। গোয়েল যাত্রা শুরু করতেই আমরা একটা আনন্দধ্বণির চিৎকার করে উঠলাম।
গোয়েল চলতেই শুরু করলো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হলো। ওদিকে বাসের শেষে বসে রিন্তু নানা রকম কর্মকান্ড করে আমাদের হাসাতে লাগলো। রিন্তু একসময় বিটিভির ধারাভাষ্য দিতে শুরু করলো। অবনী শুরু করে দিলো রাত দশটার ইংরেজি সংবাদ পড়া। আমরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম। একে একে রিন্তু একচেটিয়া বিভিন্ন সুর নকল করে প্যারোডি করতে লাগলো ইত্যাদি, ছায়াছন্দ আর সিসিমপুরের। সারা বাস জুড়ে হাসির রোল উঠলো। হাসতে হাসতে আমাদের পেট ব্যাথা হতে লাগলো।
প্রায় গভীর রাতে আমাদের বাস এসে থামলো অর্পিতা ধাবা নামের এক ধাবায়। এটা বাঙালি ধাবা। ভিতরের লোকজন সব বাংলায় কথা বার্তা বলছে শুনে আমার খুব ভালো লাগলো। বাস থেকে নেমেই আমরা বাথরুমের সন্ধানে গেলাম। এখানকার মেয়েদের বাথরুমে কোন লাইট নাই। কি আর করা মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বেলে সেই সমস্যার সমাধান করা হলো। আমরা ৪৬ জন মানুষ গাদা খানেক জিনিস অর্ডার দিয়ে বসে রইলাম। অর্ডার আর আসে না। প্রথমে আমরা আলু মাসালা আর নান অর্ডার দিয়েছিলাম। এটা দিতে দেরি হবে দেখে আমি আর রুবাইদা চট করে অর্ডার চেঞ্জ করে পাও ভাজি অর্ডার দিয়ে দিলাম। আমাদের অর্ডার চলে এলো সাথে সাথেই। অন্যরা আমাদের দিকে হিংসাপূর্ণ দৃষ্টি দিতে লাগলো। আমি আর রুবাইদা মজা করে পাওভাজি খেলাম। আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পরও অনেকের অর্ডার তখনও আসে নাই। শুভ তো রেগেমেগে না খেয়েই বের হয়ে আসলো ওখান থেকে। আমি পানি আর বিস্কুট কিনে নিলাম। তারপর আবার চড়ে বসলাম গোয়েলে।
গভীর রাতে আমাদের নিয়ে গোয়েল চলতে শুরু করলো। সারা বাস ঘুমিয়ে পড়লো, আমি আর রুবাইদা অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করলাম। ঘুমন্ত বাসে শুধু আমাদের দুইজনের গলাই শোনা গেলো।