‘স্কাল্পচার সেন্টার’ – যা মনে প্রশ্ন জাগায় হোয়াট ইজ আর্কিটেকচার???

যে দিন আমরা ‘স্বরচিত সেবতী’ নামক বাড়িটার উপর রিপোর্ট করে প্রথম দফা জমা দিলাম, সেই দিনই নতুন প্রজেক্ট ঘোষণা করা হলো, ‘স্কাল্পচার সেন্টার’ যার সাইট ধানমন্ডিতে। পরদিন হরতালের মধ্যে পড়িমড়ি করে ছুটে গেলাম সাইট দেখতে। সেই থেকে শুরু হলো আমার স্কাল্পচার সেন্টারের পথ চলা। শুরুতেই স্টুডিওতে রিয়াদ স্যারের স্বপ্নময়ী আইডিয়া শুনে পুরা মাথাটা আউলে গেলো। যেই ফর্ম চিন্তা করি, সেটাই অর্ডিনারি মনে হয়। অনেক কষ্টে কাবজাব ওয়ালা একটি চোঙ্গা সদৃশ ফর্ম নিয়ে হাজির হলাম। স্যারের কথায় সেই ফর্ম ঝড়ো হাওয়ার মতই উড়ে গেলো। আবার শূন্য অবস্থায় ফেরত আসলাম। তারপর যেই ফর্ম বানালাম, সেটা দেখে আশেপাশে সবাই বললো, ‘স্মৃতি সৌধ থেকে ইন্সপিরেশন নিয়েছো বুঝি?’ যা হোক মোটামুটি নিজের সেই ফর্মটা নিজের কাছে ভালোই লাগে। এরপর পরের স্টেপ ফাংশন সলভ করতে শুরু করলাম। শুরু করতে গিয়েই বুঝলাম এই ফর্মে আদৌ ফাংশন ঢুকানো সম্ভব না। তবুও পড়ে রইলাম সেই ফর্ম নিয়ে, কিছু একটা করেই ছাড়বো। এইভাবে কেটে গেলো প্রায় দুই সপ্তাহ। শূন্য এক ফর্ম নিয়ে পাগল পাগল হয়ে ঘুরি, সমাধান পাই না, আইডিয়া পাই না..
তারপর একদিন স্টুডিওতে আসলেন শাহেদা ম্যাডাম। ম্যাডাম এসে এমন এক লেকচার দিলেন, যা শুনে আমি ডিসাইড করি, অনেক হয়েছে আর না। নতুন ফর্ম চাই, তবে আগের চাইতে সহজ এবং সাধারণ। বাসায় এসে সব নতুন করে ডিসাইড করি- সেই বাবল ডায়াগ্রাম, সেই স্কেমেটিক ডায়াগ্রামে ফেরত যাই। পুরাই জিরো থেকে শুরু করি। আবার যাই স্টুডিওতে স্যারদের দেখাতে। সিরিয়াল অনুসারে বাঁধন ভাইয়াকে ডিজাইন দেখাতে যেতে হয়, কিন্তু সাইটের উপর প্ল্যান না এঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেদিন তিনি ডিজাইন দেখেন না। পরদিন কোন এক কারণে সরকারী ছুটি থাকলেও ডিপার্টমেন্টে আমাকে যেতে হয় ডিজাইন দেখানোর জন্য। মোটামুটি রকম কমেন্ট আর রেফারেন্স পেয়ে যখন বের হয়ে আসি, তখন মনে এক ধরনের ফুরফুরে আনন্দ। যাক, আমার ডিজাইন প্রসেস দেরিতে হলেও শুরু হয়েছে।
কিন্তু আটকা পড়ি পরের সপ্তাহে। আগের ফর্ম আর কিছুতেই বাঁধন ভাইয়ার পছন্দ হয় না। বারবার ফর্ম ভেঙ্গে ফেলার পরামর্শ আসে। তারপর সাহস করে ফর্ম ভেঙ্গেই ফেলি। তৈরি হয় অতি জটিল ফর্ম। ভয়ানক ত্যাড়াব্যাকা। ফাংশন সলভ করতে গিয়ে হিমশিম খাই। তারপর আবার দেখাই, এবারও ফর্ম ওনার পছন্দ হয় না। জটিল ত্যাড়াব্যাকা ফর্মের কুফল বুঝতে পারি এবং আবার ফর্ম বদলে ফেলার পরামর্শ পাই। জমার এক সপ্তাহ আগে এরকম পরামর্শ পেয়ে হতাশা চেপে ধরে আমাকে। সাহস করে রিয়াদ স্যারকে দেখালেও তিনিও ফর্ম সহজ করে বদলে ফেলার একই পরামর্শ দেন। আবার সিদ্ধান্ত নেই প্রথম টাইপের ফর্মে ফিরে যাবো, যা চেঞ্জ করার সেটাতেই করবো। শুরু হয় পি. এল.। ক্লাশ খুললেই শনিবার জমা। তার আগের রবিবার আমি শেষবারের মত প্রিলি দেখাতে যাই। সেদিনও ফর্ম চেঞ্জ হয়, রুফ নিয়ে নতুন আইডিয়া পাই। রিকয়ারমেন্ট অনুযায়ী ড্রইং করতে গিয়ে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। এত ড্রইং শেষ করে মডেলসহ শনিবার জমা দেওয়া সম্ভব না।
যাই হোক নাক মুখ গুঁজে ড্রইং করতে থাকি। দিন যায়, রাত আসে, রাত যায়, দিন আসে, কিন্ত কাজ আর শেষ হয় না। শুক্রবার রাতে পাগলের মত কাজ করে সকাল বেলা বুয়েটে গিয়ে দেখি বাঁশ ফেলে গেট ব্লক করা। কোন মতে ভিতরে ঢুকে দেখি সাবমিশন ক্যান্সেল। জানে পানি ফেরত আসে। আবার সব কিছু গুছিয়ে বাসায় আসি। গোসল করে, খেয়ে দেই ঘুম। সন্ধ্যাবেলা ডিপার্টমেন্টে আসি, পরদিন পহেলা বৈশাখের কাজ করার জন্য। সব ব্যাচ ধুমসে কাজ করছে, শুধু আমাদের ব্যাচ এতিমের মত ঘোরাঘুরি করছে- আমাদের কোন প্রিপারেশন নাই, প্ল্যান নাই, কিছুই নাই। অনেক কষ্টে এক খানা স্ট্রাকচার জোড়াতালি দিয়ে মাস্কট বানানো হলো। পরদিনও সেই একই অবস্থা। সব ব্যাচেরই সবাক অংশগ্রহন আছে, খালি আমরা কিছুতেই নাই। যাই হোক, বেশ রাত পর্যন্ত কনসার্টে থেকে বাসায় আসি।
পরদিন খবর পাই আজকে জমা। আবার মাথায় বাজ পড়ে। তাড়াতাড়ি ড্রইংয়ের শুরু করি। খানিক বাদেই খবর পাই, আজকে জমা দেওয়া সম্ভব না। আবার খানিক বাদেই খবর পাই আজকেই হবে জমা। সব মিলিয়ে মাথায় তখন দেড়শ টনের চিন্তা। যাই হোক অনেক কষ্টে আমরা আবার স্যারদের বলে কয়েকটা দিন সময় বাড়াই।

তারপর শুরু হয় সেই লেভেলের কোপা জুরি- যাকে বলে রক্তাক্ত অবস্থা।শাহেদা ম্যাডামের চরম কোপ খেয়ে কয়েকজন ছাড়া আমরা অধিকাংশই মাটির সাথে মিশে গেছি।দীর্ঘ দেড়-দুই মাসের সাধনা পুরস্কারের বদলে তিরস্কার উপহার দেওয়ায় বিষন্নতার ছায়া নেমে আসে জীবনে। এক বুক হতাশা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগে হোয়াট ইজ আর্কিটেকচার??? 

সবচাইতে মজার ব্যাপার হয় টার্ম শেষে যখন আমাদের গ্রেড টানানো হয় তখন অবাক হয়ে আমরা জানতে পারি যে আমাদের স্কাল্পচার সেন্টারের টোটাল গ্রেড, ফাইনাল প্রজেক্ট কমার্শিয়াল ব্যাংকের একটা প্রিলির গ্রেডের সমান গুরুত্ব পেয়েছে। তাহলে এই দেড় দুই মাস পাগলের মত খেটে, পহেলা বৈশাখ বিসর্জন দিয়ে, জুরিতে সাফ ধোলাই খেয়ে রক্তাক্ত হৃদয় নিয়ে বাসায় যে ফিরলাম, তার অর্থ কি হল? কিসের জন্য এত খাটলাম আর সেই খাটনির মূল্যটাই বা কি রইলো?   হোয়াট ইজ আর্কিটেকচার??? ???

আমার বেকুব হওয়ার কাহিনী (পর্ব-৩)

ভারতীয় উপমহাদেশে চারশত খ্রিস্টাব্দে গুপ্ত শাসনামলে প্রথম মন্দির বা ‘টেম্পল’ এর ধারনা আসে। গুপ্ত সম্রাজ্যের পর প্রভাকরবর্ধন (৫৮০-৬০৫), রাজ্যবর্ধন(৬০৫-৬০৬) এবং হর্ষবর্ধন(৬০৬-৬৪৭)নতুন সম্রাজ্যের শুরু করেন সে সময় শাসক রাজ্যবর্ধনের সাথে বর্তমান বাংলাদেশ এলাকার রাজা শশাঙ্কের সাথে কিছুটা গন্ডগোল হয়, যার ইঙ্গিত সংক্ষিপ্ত শাসনামল দেখেই কিছুটা পাওয়া যায়। তবে আসল মিরাকেল ঘটে হর্ষবর্ধনের শাসনামলে। গুপ্ত সম্রাজ্যের সময়ই সর্বপ্রথম নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এই প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিলো পাটালিপুত্রের পাশে পাটনা শহরের ৫৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে। হর্ষবর্ধনের সময় এই বিশ্ববিদ্যালয় উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিলো।

মোটামুটিভাবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮টা কলেজ ছিল সব মিলিয়ে যার ছাত্র সংখ্যা ছিলো ১০ হাজার। সুন্দরভাবে প্ল্যান করা ৮টা আলাদা বিল্ডিং ছিলো যা দেখতেও ছিলো খুব চমৎকার। তিনটা ভিন্ন দালানে ছিলো সমৃদ্ধ পাঠাগার যাদের নাম ছিলো রত্নসাগর, রত্নদধি ও রত্ন্ররঞ্জক। সম্ভবত প্রত্যেকটা দালান প্রায় ৯ তলা বিল্ডিঙের সমান উঁচু ছিলো। উল্লেখ্য পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ইটের তৈরি ছিলো। এটি ছিলো পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যন্ত উঁচু মানের পড়াশোনা হতো। বৌদ্ধ দর্শন, গনিত, আয়ুর্বেদ, চিকিৎসা বিজ্ঞান, আইন, বৈদিক দর্শনসহ আরও অনেক বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর একজন বাঙালি ছিলেন। ভদ্রলোকের নাম ছিলো শীল ভদ্র। পড়াশোনার পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিও ছিলো। নিয়মিত বিতর্ক হতো। ছাত্রদের ক্লাস অ্যাসাইন্মেন্ট দেওয়া হত। বিশ্ববিদ্যালয় ২৪ঘন্টা খোলা থাকতো। বাইরের দেশ থেকে ভিজিটিং প্রফেসররা আসতেন। কোরিয়া, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, চীন, তুরস্ক এবং ইরান থেকেও ছাত্ররা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসতো।

সবচাইতে চমৎকার ব্যাপার হলো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা ব্যবস্থা। এত বিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সরকার থেকে কোনও বরাদ্দ দেওয়া হত না। আশেপাশের ১৮০টা গ্রামের সকল আয় ব্যায় করা হত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনে।

হর্ষবর্ধনের সময় পরিব্রাজক হিউয়েন সাং উপমহাদেশে এসেছিলেন। তার বিবরণ থেকে নালন্দা সম্বন্ধে জানা যায়। ‘হর্ষচরিত’ বই থেকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবরণ পাওয়া যায়। লেখক এ. ঘোষ এর বই ‘এ গাইড টু নালন্দা’ থেকে বর্তমান যুগে নালন্দা ভ্রমনের অভিজ্ঞতা জানা যায়।

এবার আসা যাক তুলনায়। আমরা আবার সবসময় নিজেদের ‘মূর্খ, অসভ্য, অশিক্ষিত’ জেনেছি আর ইউরোপিয়ানদের ‘জ্ঞানী, সভ্য, শিক্ষিত’ জেনে এসেছি তো, তাই তাদের সাথে ছোট্ট একটা তুলনা না করার লোভ সামলাতে পারছি না। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে হিউয়েন সাং যখন নালন্দার কথা লিপিবদ্ধ করতে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময়ে বর্তমান ইতিহাসখ্যাত অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তখনও জংগল হয়ে পড়ে আছে। আর আমেরিকা? আমেরিকা তখনও কলম্বাস আবিষ্কার করেন নি। সভ্যতার ছোঁয়া সেখানে পৌঁছাতে আরও শত শত বছর বাকি।

স্যারের কথা শুনে আমি চুপ করে বসে থাকি। প্রায় এক হাজার বছর আগে এই ছিলো আমাদের সাথে ইউরোপ-আমেরিকার তুলনা। আর এখন?

তিনি সত্যিই চলে গেলেন!

৯৭-৯৮ সালের দিকের কথা। মোটামুটি শিওর হয়ে গেছি হুমায়ুন আহমেদের বই আমার জন্য নয়। মনে মনে বেশ হতাশ হই, এই লেখক এক বাজে লিখেন কেন? যে মানুষ এত ভালো নাটক বানাতে পারে, তাঁর লিখা কেন বোরিং?

নাটকের কথা বললেই সবার আগে মনে পড়ে ‘আজ রবিবার’ এর কথা। কি চরম একটা নাটকই না ছিল সেটা! বড়চাচা, আনিস, দাদাজান, ছোটচাচা, মতি, তিতলি, কংকাদের আমি আজও ভুলতে পারি নাই। একটা পরিবারে যে কত অদ্ভূত সব ঘটনা ঘটতে পারে… কত রকমের যে সমস্যা……… কত বিচিত্র পরিস্থিতি……… সব মিলিয়ে অসাধারণ। তারপর আরও ছিলো ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘সবুজ ছায়া’, ‘সবুজ সাথী’। একটা পর্বও মিস করতাম না। বাসায় আম্মুর নিয়ম ছিলো পরীক্ষা চলাকালীন সময় কোন টিভি ছাড়া যাবে না। ব্যাতিক্রম ছিলো শুধু হুমায়ুন আহমেদের নাটক। আর বাসায় বড়দের কাছে শুনতাম ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’ আর ‘কোথাও কেউ নেই’ এর কথা। বাকের ভাই, বদি আর মজনুর তিন তিনটা পোস্টকার্ড এখনও আছে আমার কাছে। আর ঈদের সময় তো কথাই নেই। রাত ৮টা-সাড়ে ৮টা বাজলেই সারা বাড়ির লোকজন নিঃশব্দে টিভিসেটের সামনে এসে হাজির হতো। মনে আছে একবার ঈদের দিন এক মামার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো। ওদিকে আবার নাটক শুরু হয়ে যাচ্ছে, সব দিক চিন্তা করে অন্ধকার রাস্তায় আমি আর ভাই দিলাম দৌড়। পরে হাঁপাতে হাঁপাতে বসলাম টিভিসেটের সামনে।

২০০৩-০৪ সালের দিকে আবারো চেষ্টা করলাম, যদি তাঁর লেখা ভালো লাগে? আবার সেই একই সমস্যা, বোরিং। হিমু, মিসির আলী কাউকেই পছন্দ করতে পারলাম না। এবার ডিসিশন ফাইনাল, হুমায়ুন আহমেদের বই আমার জন্য নয়।
মাঝে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম মধুমিতায়। সিনেমার নাম ‘দুই দুয়ারী’। চমৎকার ছবি, চমৎকার গান… বিশেষ করে ‘বরষার প্রথম দিনে/ ঘনকালো মেঘ দেখে/ আনন্দে কাঁপে যদি তোমার হৃদয়’ । দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আবার আফসোস, যে মানুষ এত ভালো সিনেমা বানাতে পারে, তাঁর লিখা কেন বোরিং?

বিভিন্ন কারনে প্রায়ই পত্রিকার হেড লাইন হন তিনি। আফসোস হতো, হায়! এরকমটা কি না হলে হত না?
পত্রিকা মারফত জানতে পারি, অসুস্থ হলেন- অস্ত্রোপোচার হলো- সুস্থ হলেন- দেশে আসলেন- আবার চলেও গেলেন। হঠাৎ শুনি তিনি নেই।
তিনি কখনই আমার প্রিয় লেখক ছিলেন না। আমি কখনোই তাঁর বই কিনে পড়ি নাই। কিন্তু তারপরও কেমন একটু কষ্ট লাগলো। কেমন ফাঁকা, শূন্য লাগলো। কি আশ্চর্য! তিনি সত্যিই চলে গেলেন!

একটি প্রাচীন উপদেশ

বিশাল মরু প্রান্তর। বিশাল সিট্রনটা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চারদিকে। সিট্রনের যান্ত্রিক চিৎকারে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠছে। রয়া একটা বড় পাথরের চাঁইয়ের দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। হাতের এটমিক ব্লাস্টারটাই একমাত্র সম্বল। জ্বালানী খুব বেশি নেই, হিসেব করে ব্যবহার করতে হবে- ভাবলো সে। সিট্রন নামক বিশাল রোবটটা যথেষ্ট দূর্বল হয়ে পড়েছে। আর বেশিক্ষণ সময় লাগবে না। রয়া এটমিক রকেটটা রিলোড করে প্রস্তুত হয়ে নিলো। সোজা বের হয়ে সিট্রনের পিছনে দাঁড়ালো। ”তোমার খেলা শেষ, সিট্রন”- বলে যেই চিৎকার দিয়ে রকেটটা ছাড়তে যাবে তখনই রয়ার কানের কাছে বিপবিপ করে সিগনাল বাজতে লাগলো। ততক্ষণে সিট্রন তার দিকে তাক করে ফেলেছে লেজার গান। যেকোন সময়ে রয়ার দিকে ছুটে আসবে একঝাঁক লেজার, ছিন্নভিন্ন করে দিবে তাকে। বাঁচার আর কোন আশা নাই দেখে বিরক্ত হয়ে মাথা থেকে হেডপিসটা খুলে ফেললো সে। মুহূর্তেই মরুপ্রান্তর, বিশাল আকারের রোবট সিট্রন, সিট্রনের যান্ত্রিক ঝনঝনানি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। বরং সেখানে ফুটে উঠলো একটা ঘরের ছবি। রয়া এখন তার ঘরের ভেতর।

একপাশের হলোগ্রাফিক ফোন থেকে এখনও ভেসে আসছে বিপ বিপ শব্দ। রয়া বিরক্ত হওয়ার ভঙ্গিতে হেডপিসটা একপাশে রেখে ফোন অন করে দিলো। ঘরের মাঝে তারই সমবয়সী একটা মেয়ের ভীষণ উত্তেজিত হলোগ্রাফিক ছবি ফুটে উঠলো।

”রয়া, তুই এক্ষুণি আমার বাসায় চলে আয়।”

”দিবিন, তুই জানিস তুই আমার কি ক্ষতিটা করেছিস? আমি আজকেও তোর কারণে একটুর জন্য সিট্রনকে মারতে পারলাম না। আমি প্রায় মেরেই ফেলেছিলাম………. তুই এমন সময় কল দিলি……….আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। তাতেই ব্যাটা আমার দিকে লেজার গান তাক করে ফেললো। ধুৎ, আবার সব শুরু থেকে করতে হবে” -রয়া বেশ দুঃখের সাথেই কথাগুলো বললো।

”তুই আছিস সারাদিন তোর থ্রিডি গেম নিয়ে। তোর এই বদমাশ সিট্রনকে আজকে না মারতে পারলে কালকে মারবি, এটা আর এমন কি ব্যাপার?-” দিবিন তার কথা শেষ করতে পারলো না।

রয়া চিৎকার দিয়ে বললো ” তুই জানিস, আমি তিনদিন ধরে চেষ্টা করছি-”

” চুপ থাক। কোন মেয়েকে আমি এভাবে গেম খেলতে দেখি নাই-”

” আমি মেয়ে হয়ে এভাবে গেম খেললে তোর অসুবিধা কি?”

দিবিন এবার নরম হয়ে যায়,” আহ-হা, আমি কি সে কথা বলেছি? আমি তো শুধু তোকে আমার বাসায় আসতে বলার জন্য কল দিচ্ছিলাম। তুই যে এভাবে সিট্রনের সাথে মরণপণ যুদ্ধ করতে থাকবি এবং আমার কারনে হেরে যাবি এত সব ব্যাপার আমি কেমন করে জানবো? ”

রয়াও এবার শান্ত হয়ে যায়। বেস্টফ্রেন্ডের উপর সে বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারে না। স্বাভাবিক গলায় বলে,” আচ্ছা বল, তোর বাসায় আমার কেন আসতে হবে?”

দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠে দিবিন, ” বাবা, দারুণ একটা জিনিস বাসায় নিয়ে এসেছে।”

” কি জিনিস?”

” বইয়ের পাতা!”

” বইয়ের পাতা? (একমুহূর্ত চিন্তা করে) জাদুঘরে বই দেখেছি। এটা নিশ্চয়ই সেটারই একটা পাতলা অংশ হবে। কিন্তু এটাতে তুই এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন?”

দিবিন একটু আশাহত হয়, ” আমি কখনও এত কাছ থেকে বই দেখি নাই। আর তাছাড়া এই পাতাটার অবস্থা ভালো। চেষ্টা করলে পড়া যেতে পারে। আমি ভাবলাম তুই আর আমি মিলে যদি এটার অর্থ জানতে পারি-”

”তাহলে তো আমাকে আসতেই হয়। তুই দাঁড়া, আমি মাকে বলে এক্ষুণি তোর বাসায় আসছি।”

দিবিন খুশি হয়ে যায়, ” তাড়াতাড়ি আয়” বলে সে লাইন কেটে দেয়।

রয়া হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দিবিনের বাবা প্রত্নতত্ত্ব ও পুরাকীর্তির জগতে বেশ বিখ্যাত মানুষ। সেই সুবাদে দিবিনের বাসায় প্রায়ই আজব আজব জিনিস আসে। সেসব নিয়ে রয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ না থাকলেও দিবিনের কারনে সে এমন ভাব করে যেন সে খুবই আনন্দ পাচ্ছে। রয়া খুব দ্রুত ওর মায়ের সাথে যোগাযোগ করে।

‘হ্যালো মা।”

”কি ব্যাপার, কোন সমস্যা?” মা কপাল কুঁচকে তাকালেন।

”না, কোন সমস্যা না। আমি একটু দিবিনদের বাসায় যেতে চাচ্ছিলাম আর কি।”

”কেন? ওর বাবা আবার কি বিচিত্র জিনিস এনেছে?” মা একটা বাঁকা হাসি দেন।

” আহ- মা, থাক না।” দিবিনও হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করে।

” গেলে যাও। তবে সাথে নেক্সিকে নিয়ে যাও।”

রয়ার মুখটা কালো হয়ে গেল, ” দিবিনের বাসা একদম কাছে। রাইডারে চড়ে গেলে সাত মিনিট সময় লাগে। এখানে নেক্সিকে নিয়ে যাওয়ার দরকার কি? আর তাছাড়া নেক্সি সিকিউরিটি রোবট নয়, হাউস কিপার রোবট-”

”তুমি কি চাও আমি তোমার বাবাকে বলে তোমার জন্য সিকিউরিটি রোবট ঠিক করি?” মা শক্ত গলায় কথাগুলো বললেন।

রয়া মুখ গোঁজ করে উত্তর দিলো, ” না।”

” তাহলে চলে যাও। আর রাইডারটা সাবধানে চালাবে।”

দশ মিনিটের মধ্যে দিবিনের বাসার সামনে রাইডারটা থামলো। রাইডার থেকে রয়ার পিছু পিছু নেক্সিকে নামতে দেখে দিবিন খুব খুশি হলো।

”যাক বাবা, তুই বুদ্ধি করে নেক্সিকে নিয়ে এসেছিস। আমি তো নেক্সির কথা বলতেই ভুলে গিয়েছি।”

”নেক্সিকে দিয়ে তুই কি করবি?” রয়া একটু অবাক হয়।

” বা-রে, নেক্সি না থাকলে ঐ কাগজটা পড়বে কে? তুই?”

”কেন, তোদের জ্ঞানী রোবট লরাক্স কই?”

”লরাক্সের সেন্ট্রাল সিস্টেম ড্যামেজ হয়েছে। ওর সিস্টেম নতুন করে লোড করার জন্য ওকে রোবট ফার্মে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

”কিন্তু লরাক্স ছিলো ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, ভাষা এইসব বিষয়ে এক্সপার্ট। আর নেক্সি হচ্ছে সাধারণ রোবট। ও কি পারবে এই প্রাচীনকালের লিখা পড়তে?”

”যা পারবে তাতেই চলবে। তোকে এত চিন্তা করতে হবে না।”

দিবিন খুব সাবধানে ট্রান্সপারেন্ট ম্যাটার দিয়ে সিল করা বইয়ের পাতাটা এনে দিলো। রয়া দেখলো ময়লা একটা ছাই রঙের জিনিস, এটাকে কাগজ বলে। কাগজটার চারপাশ ছেঁড়া থাকলেও মাঝখানটা মোটামুটি অক্ষত আছে। কিছু হিজিবিজি লিখা আছে, তবে রয়া কিংবা দিবিনের পক্ষে তা পড়া সম্ভব নয়।

নেক্সি তার রোবোটিক আই দিয়ে কাগজটা থ্রিডি স্ক্যান করে যান্ত্রিক কন্ঠে বলে উঠলো, ” প্রাচীন সভ্যতার একটি দূর্লভ নমুনা-”

রয়া তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ”আমরা তোমার কাছে এসব জানতে চাই নাই। তুমি শুধু আমাদের লিখাটা পড়ে শোনাও।”

”কিন্তু মহামান্য রয়া, আমি এ বিষয়ে অভিজ্ঞ নই। আমার সেন্ট্রাল সিস্টেমে ভাষা, অনুবাদ বিষয়ক কোন প্রোগ্রাম নাই।”

রয়া দাঁতে দাঁত ঘষে বললো,”তোমার সিস্টেমে কি কি প্রোগ্রাম আছে তা আমি জানি। তারপরও আমি তোমাকে এটা পড়তে বলছি। তুমি আর কোন কথা না বলে দয়া করে পড়া শুরু কর।”

নেক্সি আর কোন কথা বাড়ালো না। যান্ত্রিক কন্ঠে পড়তে শুরু করলো,”সহজ ব্যাকরণ ও রচনাশৈলী।২৫৮”

” কি? কি বললে?” দুজনেই উৎসুক হয়ে উঠলো, ” ব্যাকরণ, রচনাশৈলী মানে কি? আর ২৫৮ ই বা কি?”

নেক্সি যান্ত্রিক কন্ঠে গড়গড় করে বলতে লাগলো, ” ব্যাকরণ মানে ভাষার নিয়ম কানুন। রচনা মানে কোন বিষয় সম্পর্কে তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন। শৈলী মানে সৌন্দর্যের শিল্প। আর ২৫৮ একটি সংখ্যা।”

”বাপ রে বাপ।” রয়া আড়চোখে দিবিনের দিকে তাকায়।

দিবিন খুব আগ্রহ নিয়ে বলল, ” চমৎকার, নেক্সি। দারুণ হচ্ছে। পড়ে যাও।”

নেক্সি আবার পড়তে লাগলো,” পরীক্ষার পূর্বরাত্রি। এখানে পরীক্ষা মানে নিরীক্ষণ। পূর্ব মানে পূর্ব দিক। রাত্রি মানে রাত।”

দিবিন মাথা চুলকে বললো, ” আমার না মনে হচ্ছে পরীক্ষা মানে আমরা যে পরীক্ষা দেই সেই পরীক্ষা।”

রয়া বললো, ”অসম্ভব। সেই আমলে থ্রিডি স্ক্রিন ছিলো না। কেন্দ্রীয় ডাটাবেস ছিলো না। এসব ছাড়া পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। আর তাছাড়া-”

”তাছাড়া পূর্ব রাত্রি মানে কি? পূর্ব দিকে যে রাত উঠে- সেটা?” দিবিন জিজ্ঞেস করে।

” পূর্ব দিকে যে রাত উঠে- এটা মানে কি? পূর্ব দিকে কোন রাত উঠে নাকি?”

” না মানে পূর্ব দিকে সূর্য তো উঠে-”

”সূর্য আর রাত এক জিনিস হলো নাকি?”

” তা ঠিক। তবে-”

”তুই থাম। আমার মনে হয় শুধু নেক্সিকে বাকি অংশটুকু পড়তে বলা উচিৎ। কারণ এভাবে অর্থ শুনে আলোচনা করতে থাকলে সারা দিন লেগে যাবে।”

দিবিনও রয়ার কথায় সায় দেয়। নেক্সি আবারও পড়তে শুরু করে।

” এই কান ধরিতেছি, আর কোনদিন ক্লাস পালাইয়া সিনেমা দেখিতে যাইবো না। আর কোনদিন ক্লাসের সময় পিছনের সারিতে বসিয়া ঘুমাইয়া লইবো না। আর কোনদিন বাড়ির কাজ না করিয়া ক্লাসে যাইবো না-”

”দাঁড়াও, দাঁড়াও।” দুইজন একসাথে বলে উঠলো।

”দেখেছিস! আমি বলেছিলাম না আমাদের মতন পরীক্ষার কথা হচ্ছে।” দিবিন হাতে কিল দিয়ে ওঠে।

”হুম, সেইরকমই তো মনে হচ্ছে। বিশেষ করে যখন ‘ক্লাস’ শব্দটা আছে। তবে যাই বলিস, ভাষাটা দারুণ কঠিন। কিছুই বুঝতে পারছি না।”

” আমি মনে হয় একটু একটু বুঝতে পারছি। ‘কান ধরা’ ছিলো এক ধরনের শাস্তি। এখানে নিশ্চয়ই কাউকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে যে ‘ক্লাস পালাইয়া সিনেমা দেখিতে’ যেতো। যদিও একথাটার কোন অর্থ আমি বুঝলাম না। সে নিশ্চয় বেশি ঘুমাতো আর ‘বাড়িতে’ মানে ঘরে কোন কাজ করতো না।”

রয়া একটু অবাক হয়ে বললো, ”ঘরে আবার কি কাজ করবে?”

”যেমন ধর রোবটের কাজ। তখন তো আর রোবট ছিলো না, সব কাজ মানুষকেই করতে হত।”

”আহ -হা রে। রোবটের কাজ না করার জন্য মানুষকে শাস্তি? বেশি অমানবিক লাগছে।” রয়া মানুষটার কথাচিন্তা করে দুঃখ পায়।

”………………দুই চোখে রাজ্যের ঘুম নামিতেছে। কখন বাকি অধ্যায়গুলো পড়িব সে উপায় খুঁজিতেছি। আহ, এমন নিশুতি রাত বোধহয় জীবনে আর দেখি নাই। বাড়ির সকলেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। এই নিস্তব্ধ জগৎ সংসারে বোধ করি আমি ছাড়া দ্বিতীয় জনপ্রানী নাই। যদি সারা বছর পড়ায় হেলা না করিতাম, তবে অন্যদের মত আমিও আজ আরাম করিয়া ঘুমাইতে পারিতাম।”

”থামো, থামো।” রয়া দিবিনের দিকে তাকিয়ে বললো, ”কিছু বুঝলি?”

দিবিন মাথা চুলকে বললো,” ইয়ে- মানে এই লাইনগুলো একটু বেশি কঠিন। বুঝতে পারছি না।”

”আমার মনে হয় কোন একজন মানুষের খুব দুঃখের কথা বলা হয়েছে। শব্দগুলোর অর্থ ঠিক বুঝতে পারি নাই। তবে ‘ঘুম’ কথাটা বারবার এসেছে। মনে হচ্ছে সেই শাস্তি পাওয়া লোকটার কোন কারণে ঘুমাতে খুব অসুবিধা হচ্ছে।”

”হতে পারে।” দিবিন ইতস্তত করে বলে,” কিন্তু ঘুমাতে কি অসুবিধা হতে পারে? একজন মানুষ চাইলেই তো ঘুমাতে পারে।”

রয়া হঠাৎ বলে ওঠে,”আমার মনে হয় এটাও ওই লোকটার শাস্তি।”

”কোনটা?”

”ঘুমাতে না দেওয়াটাই শাস্তি।”

”ছিঃ এরকম শাস্তি হয় নাকি? মানুষ তো খুবই নিষ্ঠুর ছিলো। এটা তো চরম অমানবিক শাস্তি। তাও আবার শুধু ঘরের কাজ না করার জন্য- ”

”ঠিকই বলেছিস। কি জানি, রোবট না থাকলে আমরাও হয়তো এরকম শাস্তি পেতাম।” রয়া জীবনে প্রথম বার নেক্সির দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকালো।

”…………আর চোখ খোলা রাখিতে পারিতেছি না। নরম তুলতুলে বালিশটা যেন হাতছানি দিয়া ডাকিতেছে। আধা ঘন্টা ঘুমাইয়া লই। পরে উঠিয়া বাকি অধ্যায়গুলো পড়িয়া লইবো। কিন্তু সিলেবাসের এক চতুর্থাংশও যে শেষ হয় নাই। মাঝরাত্রি প্রায় হইয়া পড়িয়াছে। বাকি অধ্যায়গুলো কখন পড়িবো …………”

দিবিন চিৎকার দিয়ে বলে, ”বালিশ কি জিনিস আমি জানি!”

”কি জিনিস?”

”বালিশ এমন একটা জিনিস যেটা মাথায় দিয়ে আগেকার দিনের মানুষরা ঘুমাতো। চারকোনা, নরম একটা জিনিস। ওদের তো স্লিপিং সেট ছিলো না, তাই আরাম করে ঘুমানোর জন্য মাথার নিচে এই জিনিসটা রেখে ঘুমাতো।”

”ঘুরে ফিরে আবারও ঘুমের ব্যাপারস্যাপার চলে আসছে। আরেকটা কথা দেখেছিস, অনেককিছু ‘পড়া’-র কথা হচ্ছে। কি পড়ছে বল তো?”

” কি জানি? একবার মনে হলো রাত পড়ে যাচ্ছে। আরেকবার মনে হলো ‘অধ্যায়’ নামের কোন জিনিস পড়ে যাচ্ছে।”

” হি হি হি” রয়া হেসে ফেলে, ” রাত কি একটা এটমিক ব্লাস্টার যে হাত থেকে পড়ে যাবে?”

দিবিন গম্ভীর মুখে বলে, ” হাসিস না রয়া। এটা বেশ সিরিয়াস ব্যাপার। প্রাচীনকালে কিভাবে একটা মানুষকে শাস্তি দেওয়া হত সেই ব্যাপারটা আমরা জানতে পারছি। শাস্তিটা খুব সিরিয়াস কিন্তু কারণটা খুব সাধারণ।”

”………যাহা হউক, পাস করিতে না পারলে মুখ দেখানোর জো রইবে না। কিন্তু যাহা পড়িলাম তাহাতে পাস করিব এ কথা প্রশ্ন কর্তাও বলিতে পারিবে না। সকলে নতুন ক্লাসে উঠিবে আর আমি আবারও এখানেই বসিয়া রইবো এইকথা ভাবিতেই চোখে জল চলিয়া আসিলো। আজ সময়ের কাজ সময়ে না করার চরম শিক্ষা হাড়ে হাড়ে টের পাইতেছি। একথা যদি আগে বুঝিতাম তাহা হইলে আজ এই বিপদে পড়িতে হইতো না।”

নেক্সির পড়া শেষ হতেই দুজনে একজন আরেকজনের দিকে তাকালো।

” চোখে জল আসা মানে কাঁদা না?” রয়া জিজ্ঞেস করে।

”তাই তো জানতাম, তুইও জানিস দেখছি।”

রয়া দাঁতে দাঁত ঘষে বললো, ”বদমাশগুলো লোকটাকে এমন শাস্তি দিয়েছে যে লোকটার চোখে পানি চলে এসেছে।”

” মনে হয় শারীরিক নির্যাতনও করেছে।” দিবিন বলে।

” কি করে বুঝলি?”

”শুনিস নাই ‘হাড়ে হাড়ে’ কথাটা? আমার তো মনে হয় পিটিয়ে হাড় ভেঙ্গে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।”

রয়া শিউরে উঠে, ” কি সাংঘাতিক!” এক মূহুর্ত চুপ থেকে সে বলে,” তোর বাসায় এসেছিলাম এমন কিছু দেখতে যাতে মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু কি বাজে জিনিস শুনলাম, প্রাচীনকালে মানুষ এতটা বর্বর ছিলো- ভাবতে গা শিরশির করে উঠছে।”

”আগে আমাদের কখনও এমন হয় নাই। সবসময় আমরা দারুন দারুন তথ্য জানতে পেরেছি। কিন্তু শুধু এইবার-”

”কেন হয়েছে জানিস?”

”কেন?”

”কারণ সবসময় জিনিসগুলোর ব্যাখ্যা দেয় তোদের রোবট লরাক্স। শুধুমাত্র এইবার আমরা নিজেরা জিনিসটা বুঝতে চেষ্টা করেছি।”

”তারমানে- তারমানে- তুই বলতে চাচ্ছিস লরাক্স আমাদের ভুল ব্যাখ্যা দেয়?”

”খুব সম্ভবত তাই।”

”তার মানে এতদিন আমরা যা যা জেনে এসেছি সবই ভুল?”

”হতে পারে। সম্ভবত লরাক্স আমাদের ভুল ইনফর্মেশন দেয়।”

”আর দিবেই না কেন?” দিবিন দুঃখের সাথে বলতে থাকে,”যে ইতিহাসে মা তার সন্তানকে ঘরের কাজ না করার জন্য এত মারাত্মক শাস্তি দিতে পারে-”

”মা!” চমকে উঠে রয়া,” কি আশ্চর্য, মা তার সন্তানকে শাস্তি দিচ্ছে তুই বুঝলি কিভাবে?”

” মা ছাড়া ঘরের কাজ না করার জন্য আর কেই বা শাস্তি দিবে?”

রয়া মিনমিন করে বলে,” তা ঠিক বলেছিস। ভাগ্য ভালো, আমাদের মায়েরা এমন জল্লাদ না। ”

দিবিন গম্ভীর গলায় বলে উঠে,” এখন আমাদের কি করতে হবে জানিস?”

”কি করতে হবে?”

”যেহেতু আমাদের মায়েরা এরকম জল্লাদ না, তাই তাদের কিছু পুরষ্কার দিতে হবে। মায়েদের সব কথা আমাদের শুনতে হবে।”

” ঠিকই বলেছিস। মাঝে মাঝে নেক্সি অকেজো হয়ে গেলে ঘরের সব কাজ মা অফিস করে এসে করে। আমি কিছুই করি না। এজন্য আগেকার দিনে নির্মমভাবে শাস্তি দেওয়া হত। অথচ মা আমাকে কিছুই বলে না।”

”আজকে থেকে আমরা আমাদের মায়েদের সব কথা শুনবো। ঠিক তো?”

”একদম ঠিক।” রয়াও গলা মেলালো।

” কিন্তু-” দিবিন ইতস্তত করে, ”- ইয়ে, আমাদের ঘরের কাজে সাহায্য করার সময় কই? সারাদিন কোন না কোন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়।”

” ধুর গাধা, তোকে কি রোজ রোজ কাজ করতে হবে নাকি? যখন দরকার পড়বে শুধু তখন- তা ছাড়া সব কিছুর জন্য সময় ভাগ করে নিবি। আর দেখিস না, আমি রোজ কিভাবে আমার থ্রিডি গেম খেলার জন্য সময় বের করে নেই?”

দিবিন গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লো, ”বুঝেছি। আর বলতে হবে না।”

তারপর বাচ্চাদুটোর মায়েরা অবাক হয়ে খেয়াল করলো তাদের মেয়েরা বেশ বদলে গেছে। তারা মাকে কাজে অনেক সাহায্য করে আর মায়ের কথার অবাধ্য হয় না। সবচেয়ে বড়কথা তারা সময়ের কাজ সময়ে করে।

সম্পূর্ণ সঠিক উপদেশ সম্পূর্ণ ভুলভাবে জেনে সম্পূর্ণ সঠিকভাবে পালনের এর চেয়ে চমৎকার উদাহরন বোধহয় এরচেয়ে ভালো নেই।

 

 

আমার বেকুব হওয়ার কাহিনী (পর্ব ২): পাটালিপুত্র শহর ও অশোকের স্তুপা

ভারতবর্ষের ইতিহাসে গ্রীকদের শাসন বেশ উল্লেখযোগ্য। তবে সে আমলের কোন কথা ভারতের কোন অধিবাসীর রের্কড থেকে পাওয়া যায় নাই। আমাদের সেই আমলের কথা আমরা বিদেশিদের কাছ থেকে জানতে পারি। স্যার এজন্য দুঃখ প্রকাশ করেন যে, আমাদের ইতিহাস আমরা সংরক্ষণ করিনি- করেছে বিদেশিরা। জনৈক গ্রীক অ্যাম্বাসেডর মেগাস্থিনিসের বিবরন থেকে সেই আমলের কিছু কথা জানা গেছে। গ্রীকরা এদেশের যে জিনিসটা দেখে বেশি অবাক হত তা হলো, এদেশের মানুষ দিনে মাত্র দুই ঘন্টা কাজ করে আর সারা দিন গল্প করে, গান গায়, খায়দায় আর ঘুমায়। গ্রীকদেশের বৈরী আবহাওয়ার জন্য তাদের মানুষদের স্বভাবতই কর্মঠ ও পরিশ্রমী হতে হয়। কঠোর পরিশ্রম করে তারা একমুঠো ফসলের জন্য। অথচ এদেশে মাটিতে বীজ পড়লেই গাছ হয়ে যায়, নদীতে জাল ফেললে কাঁড়ি কাঁড়ি মাছ পাওয়া যায়, কনকনে শীত নেই, নেই ঝাঁ ঝাঁ গরম, সবসময় আরামদায়ক আবহাওয়া। এখান থেকেই সেই কথাটা এসেছে, ”হায় সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!”। উল্লেখ্য সেলুকাস ছিলেন ভারতবর্ষে আলেক্সান্ডারের গভর্নর। তারা অবাক হওয়ার পাশাপাশি এদেশের অঢেল প্রাচূর্য এবং ঐশ্বর্য দেখে ঈর্ষান্বিত হয়েছিলো।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর পর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য অন্যান্য গ্রীক গভর্নরদের পরাজিত করেন। শুধু সেলুকাসের সাথে চুক্তি করা হয় এবং তাকে ২০০ হাতি (খুব সম্ভবত) দেওয়া হয়। সে সময় পাটালিপুত্রে রাজধানী স্থাপন করা হয়। স্যার বড় পর্দায় পাটালিপুত্রের যে ছবি দেখালেন তা দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। পুরো শহর উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, ফাঁকে ফাঁকে তীরন্দাজদের জন্য ছোট ছোট খোপ, শহরের চারপাশে চওড়া ও গভীর পরিখা, ৫০০টা টাওয়ার, ৬৪টা গেট – এ এক বিশাল কান্ড! দেওয়াল, দূর্গ, ঘরবাড়ি অর্থাৎ পুরো শহর কাঠের তৈরি ছিলো। ছবিটা দেখে আমার চোয়াল ঝুলে পড়লো। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ সালের দিকে আমাদের এত উন্নত শহর ছিলো! কি অবাক করা কান্ড!!

তাদের শাসন ব্যাবস্থা শুনে আমি আবার বেকুব হয়ে গেলাম। রাজা চন্দ্রগুপ্ত ৩০ জন সদস্য নিয়ে ৬টা বোর্ড তৈরি করেছিলেন। তাদের কাজ ছিলো যথাক্রমে,

  • শিল্পজাত পন্যের উৎপাদন পর্যবেক্ষন করা
  • বিদেশি অর্থাৎ গ্রীকদের সমস্যা সমাধান করা
  • জন্মমৃত্যুর হিসাব রাখা
  • বাজারে পন্যের গুণাগুণ ও ওজন পর্যবেক্ষন করা
  • ভেজাল, বাসি ও পচা জিনিসপত্র যাতে পন্যে মিশানো না হয় তা পর্যবেক্ষন করা
  • পন্যের বিক্রয়মূল্য থেকে ট্যাক্স আদায় করা

৬টা বোর্ডের মধ্যে প্রায় ৪টাই বাজারের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। অত বছর আগেও রাজা অন্যান্য সবকিছু থেকে বাজারকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন। আর এতবছর পরও আমরা ঠিকমত বুঝতে পারছি না বাজার ব্যাবস্থাকে আসলে কতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। মনের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো। হায়, আমরা কত অভাগা জাতি!

সাঁচিতে অবস্থিত তোরনসহ একটি স্তুপা

এরপর সম্রাট অশোকের সময় স্থাপত্যের মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার শুরু হয়। স্তুপা নামক অর্ধগোলাকৃতি এক ধরনের স্থাপনা তৈরি করা হয় যার উচ্চতা ৩৫ ফুট, ব্যাসার্ধ ৭০ ফুট। এর গেটকে বলা হতো ‘তোরন‘ যাকে অনুসরন করে এখন জাপানে বিভিন্ন রকম গেট তৈরি করা হয়। কি আশ্চর্য, জাপানিজ গেটের উৎপত্তি আমাদের ভারতবর্ষে!! হাঁ হয়ে গেলাম যখন শুনলাম ১/২ টা নয়, সম্রাট অশোক সারা ভারতবর্ষে ৮৪০০০টা স্তুপা তৈরি করে গিয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে অজন্তা ইলোরায় পাহাড় কেটে বানানো বিশেষ ‘রক কাট চেম্বার‘ বানানো হয়েছিলো। আরও ছিলো বৌদ্ধবিহার বা মনেস্ট্রি। সেগুলোর প্ল্যান দেখে থ হয়ে গিয়েছিলাম। কি বুদ্ধি ছিলো মানুষের! এত সুন্দর প্ল্যান করা জিনিস আমাদের এখানে ছিলো ভাবতেই কেমন অদ্ভুত লাগে।