সকালে ঘুম ভাঙ্গলো দেরিতে। অন্যান্য দিনের মতই মৌলি আর মজুমদার আগেভাগে বের হয়ে গেলো। আমি আর রুবাইদা আলসেমি করে আস্তে ধীরে বের হলাম। আমাদের সাথে যোগ দিলো মিম আর অন্তরা। আমরা হোটেল থেকে বের হয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য নাশতা করা। গত রাতে যে গলিতে খাবার খেয়েছিলাম, হেঁটে হেঁটে সেই গলিতে গেলাম আমরা। খাবারের দোকান আছে কিন্তু প্রায় সব দোকানেই নাশতা শেষ। খুঁজে পেতে একটা দোকান পাওয়া গেলো যেখানে কিছু খাওয়া অবশিষ্ট আছে। আমরা ঝটপট বসে পড়লাম। প্রত্যেকটা পুরি দশ রুপি করে আর সাথে সবজি ফ্রি। আমি দুইটা পুরি নিলাম একটা থালায়। আর একজন লোক এসে ছোটখাটো স্টেনলেস স্টিলের বালতির মত পাত্র থেকে বিশাল বড় চামচে করে ঝোল ওয়ালা আলুর তরকারি ঢেলে দিয়ে গেলো। এই সবজি আর পুরি ছাড়াও ইডলি, সম্বর, নারিকেলের ভর্তা, চাটনি এই রকম মজার মজার জিনিস ছিলো। খেতে আমাদের মোটামুটি লাগলো। খেয়ে দেয়ে আমরা বের হয়ে আসলাম সেই দোকান থেকে। হাঁটা ধরলাম আন্না সালাই রোডের দিকে।
আন্না সালাই রোডে একটা অদ্ভূত রিকশা পার্ক করে রাখা দেখলাম। আমাদের দেশের মতন প্যাডেল রিকশাই, তবে দেখতে কেমন যেন হাস্যকর! একটা পেস্ট্রি শপ দেখলাম, ‘কেক পয়েন্ট’। ভেতরে ঢুকে পড়লাম আমরা। এটা নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কেক বানানোর জন্য গিনেজ রেকর্ডধারী দোকান। তবে এমন রেকর্ডধারী দোকানেও খুব কম দামেই পেস্ট্রি পাওয়া যাচ্ছে। আমরা নানা রকম পেস্ট্রি অর্ডার দিলাম। তারপর গল্প করতে করতে খেতে লাগলাম। আর ওদিকে ডিসিশন নিতে লাগলাম এরপর কোথায় যাবো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে বের হয়ে পড়লাম। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে একটা বাসে উঠে পড়লাম। এখন আমাদের গন্তব্য ‘অরোভিল’।
পন্ডিচেরির বাসগুলো বেশ আরামের। আমি বসলাম একেবারে পিছনে। আশেপাশে সব শাড়ি পরা শক্ত সমর্থ চেহারার মহিলারা। একজন বুড়ো মহিলাকে দেখলাম এক গামলা ভেজা কাপড় নিয়ে বাসে উঠে পড়তে। কন্ডাক্টর এসে ওনার সাথে তর্ক জুড়ে দিলো। মহিলাও গলা চড়িয়ে কথা বলতে লাগলো। এর মধ্যে আমি অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম, তর্ক করতে করতেই কন্ডাক্টর এসে গামলাটা ধরে সুন্দর করে একটা জায়গার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে লাগলো। আমরা পাঁচ রুপির টিকেট কাটলাম। প্রায় আধা ঘন্টা পর বড় রাস্তার ধারে দুই পাশে কিছুই নাই এমন এক জায়গায় আমাদের নামিয়ে দিলো বাস। যে জায়গাটায় আমাদের নামিয়ে দিলো সেখান শুধু কতগুলো অটোরিক্সা পার্ক করা আছে। আমরা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলাম অরোভিল কোথায়? কিন্তু কিছুই খুঁজে পেলাম না। অন্তরার ফোনে দেখলাম এখান থেকেও অরোভিল বেশ দূরে। বুঝলাম বাসের রুট এখানেই শেষ, এরপর অটো নিতে হবে। অগত্যা আমরা ১৫০ রুপি দিয়ে একটা অটো ভাড়া করলাম। অটো আমাদের নিয়ে চলতে শুরু করলো।
যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম সেটা অনেকটা গ্রামের রাস্তার মত। কিন্তু দেখার মত তেমন কোন জিনিসপাতি নাই। রাস্তার দুইধারে সারি সারি গাছ, সম্ভবত ইউক্যালিপ্টাস। লাল রঙের মাটি আর সবখানে লাল রঙের ধূলা। কেমন যেন অদ্ভূত রাস্তা! এর মধ্য দিয়েই দেখতে পারছিলাম সাদা চামড়ার অনেক বিদেশি লোকজন বাইকে চেপে আমাদের ওভার টেক করে যাচ্ছে। আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকাচ্ছিলাম। অরোভিল জায়গাটা আসলে কি? আমাদের একটা গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে অটোওয়ালা জানতে চাইলো আমরা চাইলে একঘন্টার মধ্যে এই অটোতে করে ফেরত যেতে পারি। আমরা সেই মোতাবেক ঠিক করলাম। অটোওয়ালা জানালো সে এইখানে আমাদের জন্য বসে থাকবে।
আমরা গেট দিয়ে ঢুকে পড়লাম। জায়গাটা অদ্ভূত। কতগুলো সুন্দর সুন্দর দোকানপাট চোখে পড়লো। আমরা ঢুকে পড়লাম একটায়। দোকানগুলো আমাদের দেশি ব্র্যান্ড ‘যাত্রা’র মত। হাতে তৈরি দারুণ সুন্দর সুন্দর সব জিনিস। আর সেই রকম দামি। প্রথম দোকানটা দেখেই আমরা বুঝে গেলাম সবটা দেখে কিছুতেই এক ঘন্টার মধ্যে বের হওয়া যাবে না। তাহলে আর শুধু শুধু অটোওয়ালাকে আটকে রেখে লাভ কি? আমি তাড়াতাড়ি এসে অটোওয়ালাকে খুঁজে বের করে তার পাওনা বুঝিয়ে দিলাম। তারপর আবার হেঁটে গেলাম সেই দোকানটার দিকে।
এইরকম আরও অনেকগুলো দোকানে ঢুকলাম। কোনটাতেই আমরা কিছু কিনতে পারলাম না। খালি দেখেই যেতে লাগলাম। তারপর গেলাম একটা এক্সিবিশন হল টাইপের জায়গায়। সেখানে মোটামুটি জানতে পারলাম, এক ফ্রেঞ্চ মহিলা যাকে সবাই ‘দি মাদার’ বলে, তিনি এই অরোভিলের প্রতিষ্ঠাতা। ব্যাপার স্যাপার খুব কঠিন, তারপরও যা বুঝলাম তার সারমর্ম হচ্ছে এইরকম- মাদারের ইচ্ছা ছিলো এমন একটা জায়গা গড়ে তোলা যেখানে মানুষ জাতি, ধর্ম, গোত্রের পরিচয়ে পরিচিত হবে না। বরং তা হবে সব ধরনের মানুষের জন্য উন্মুক্ত। এখানে এসে কাজ করার বিনিময়ে যে কেউ থাকতে পারবে। এই ইচ্ছা বাস্তবায়ন করার জন্য মাদারকে সাহায্য করেছিলেন স্বামী অরবিন্দ নামক আরেক জন সাধু। এখান থেকেই জানতে পারলাম এখানে ‘মাতৃমন্দির’ নামক একটা বলের মত গোল বিল্ডিং আছে। সবাই বের হয়ে হাঁটতে লাগলাম সেই বিল্ডিঙের খোঁজে। প্রথমে বিল্ডিং দেখার পাস নিলাম। ভিতরে ঢুকা যাবে না, শুধু বাইরে থেকেই দেখতে হবে। যাই হোক, এই পাস নিয়েই আমরা হাঁটতে লাগলাম। কিছুদূর পর কেমন জঙ্গল শুরু হলো। ঠিক জঙ্গল না, অনেকটা পার্কের মত, আবার ঠিক পার্কও না। প্রচন্ড গরমে গাছের ছায়ায় ছায়ায় আমরা হাঁটতে লাগলাম। এক পর্যায়ে আমাদের হাত পা ধরে এলো। এর মধ্যে হিমি সীমান্তদের সাথে দেখা হলো। ওরাও ওদের অটোওয়ালাকে এক ঘণ্টার কথা বলে ভিতরে ঢুকে অনেক্ষণ সময় পার করে ফেলেছে। এখন কি করবে বুঝতে পারছে না।
এর মধ্যে আমরা গাছপালার ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো এক কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে ফেলেছি। গরমে আমাদের গলা শুকিয়ে গেলো। অনেক্ষণ পর একটা গেট পেলাম যেখানে আমাদের পাস চেক করে করে ঢুকতে দিচ্ছিলো। গেটটা পার হয়েই একটু পরই চোখে পড়লো বিশাল এক বট গাছ। সেখানে আনিস, বাসিরুন, লিয়া আর সুহার সাথে আমাদের দেখা হলো। অদ্ভূত এই বটগাছের ঝুলন্ত শিকড় থেকে গজিয়েছে আরও অনেকগুলো গাছ। গাছটা অনেক পুরানো। বিশাল ডালপালা মেলা এই গাছটার ছায়ায় বসে আমরা খানিক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। তারপর আমরা সবাই আবার হাঁটা শুরু করলাম। এবার বেশিক্ষণ লাগলো না। কয়েক মিনিট পরেই পেয়ে গেলাম সেই ‘মাতৃমন্দির’। বিশাল জায়গার মধ্যে মস্ত বড় গোলক, তার সারা গায়ে পিতলের বাসনের মতন বৃত্তাকার প্লেট লাগানো। আমাদের একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত যাওয়ার পারমিশন ছিলো। আমরা তাই দূরে দাঁড়িয়েই দেখতে লাগলাম। নিচের ল্যান্ডস্কেপিংও এমনভাবে করা যেন মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে এসেছে এই গোলকটি। আমরা সবাই গোল্লাটাকে পাশে রেখে ছবি তুলতে লাগলাম।
সত্যি বলতে কি, যখন ক্লাস প্রজেক্টে গোল্লা বিল্ডিং ডিজাইন করা হয় তখন মডেলে দেখতে মন্দ লাগে না। কিন্তু যখন সত্যি সত্যি চোখের সামনে এত্ত বিশাল একটা গোল্লা দাঁড়িয়ে থাকে তখন যেন কেমন অদ্ভূত লাগে। আর সোনালি রঙের ধাতব প্লেটগুলোতে সূর্যের আলোর রিফ্লেকশোনের ফলে পুরো গোল্লাটা চকচক করছিলো। তাই দেখে কেন যেন আমাদের সবার গরম লাগা শুরু হলো। তাই আমরা আর বেশিক্ষন থাকলাম না। উঠে পড়লাম। এবার আর বেশি কষ্ট করতে হলো না। পেয়ে গেলাম এক বাস সার্ভিস। এই বাসে করে নির্দিষ্ট সময় পরপর দর্শনার্থীদের বিনা পয়সায় আবার আগের জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হয়। আমরা উঠে পড়লাম সেই বাসে। টাইম হয়ে গেলে আমাদের নিয়ে বাস ছেড়ে দিলো। প্রায় দশ মিনিটের মাথায় আমরা পৌঁছে গেলাম প্রথমবার আমাদের অটো ঠিক যেখানে নামিয়েছিলো সেইখানে। আমরা আবার গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। এবার দেখতে পেলাম একটা শর্ট মুভি দেখানো হচ্ছে। সবাই দুদ্দাড় করে ঢুকে পড়লাম সেখানে। মুভিটায় দেখানো হলো অরোভিলের কথা আর মাদারের কথা। প্রায় ত্রিশ মিনিটের ভিডিও দেখে আমরা সেই হল থেকে বের হয়ে আসলাম।
ততক্ষনে বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। ভাবলাম দুপুরের খাবারটা সেরে নেই এখানে কোথাও। কিন্তু লাভ হলো না। যেই ক্যাফেতেই যাই, দাম দেখে আর খেতে পারি না। শেষে সিদ্ধান্তে নেই যে, এখানে না, বাইরে কোথাও খেয়ে নেওয়া যাবে। আর বেশি দেরি না করে আমরা এসে দাঁড়াই মেইন গেটের সামনে। তাকিয়ে দেখি একটা অটোও নাই। কোন অটো আসলেই লোকজন খপ করে সেটাতে চড়ে বসছে। আমরা ভয়ে পেয়ে গেলাম, এরকম হলে অটো পাবো কেমন করে? কিন্তু মিম আর অন্তরা অনেক কাহিনী করে একটা অটো ঠিক করে ফেললো। সেই অটো আমাদের বাস চলাচলের বড় রাস্তার সামনে নামিয়ে দিলো। আমরা নেমে এদিক ওদিক তাকালাম। একটা সস্তা খাবারের হোটেল চোখে পড়লো আর তাতেই আমরা ঢুকে পড়লাম। পুরো হোটেলে আমরা ছাড়া আর কেউ নাই। আমি আর রুবাইদা মিলে অর্ডার দিলাম ৯০ রুপির ভাত আর সবজি। একটা লোক অর্ডার নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। বুঝলাম ইনিই রান্না করবেন অর্থাৎ দেরি হবে খাবার আসতে। গল্প করতে করতেই খাবার চলে আসলো। ঝরঝরে বাসমতি চালের ভাত আর সবজি আমরা গপাগপ খেতে লাগলাম। মজাই লাগলো খেতে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। এখান দিয়ে হরদম লোকাল বাস যাচ্ছে। এইরকম একটা লোকাল বাসে উঠে পড়লাম আমরা। বসার কোন জায়গা পেলাম না। কোনমতে রড ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রচন্ড ভিড়। এতই ভিড় ছিলো যে কন্ডাক্টর আর আমাদের কাছেই আসতে পারে নাই। কোনমতে আন্না সালাই রোডে এসে আমরা নেমে পড়ি আর ৫ রুপি ভাড়া মিটিয়ে দেই। বাস থেকে নেমে খানিক্ষণ দম ফেলে ধাতস্থ হই। এবার ঠিক করি নেক্সট যাবো অরবিন্দ আশ্রমে। একটা অটো ঠিক করি ৫০ রুপি ভাড়া দিয়ে। অটো আমাদের নামিয়ে দেয় কাছাকাছি একটা রাস্তায়। সেখান থেকে হেঁটে আমরা আশ্রমের সামনে যাই। রাস্তার উপর জুতা জমা দেওয়ার কাউন্টার আছে সেখানে স্যান্ডেল জমা দিয়ে আমরা আশ্রমের ভিতরে ঢুকে পড়ি।
গেট দিয়ে ঢুকার সাথেসাথেই মনে হলো কোন এক নিঃশব্দ জগতে ঢুকে পড়লাম। কেউ কোন কথা বলছে না। সবাই চুপ। আমরাও চুপ হয়ে গেলাম। সবাই লাইন ধরে কোথায় যেন যাচ্ছে, আমরাও সবার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম। জায়গাটা আসলে একটা বিশাল বাড়ির। আমরা ফুলের বাগান পার হয়ে উঠানের মত জায়গায় এসে পৌঁছালাম। সেখানে দেখলাম ছোট্ট একটা চাদরের নিচে একটা কবর বাঁধাই করা। তার উপর প্রচুর ফুল। সেই বাঁধানো কবরটাকে ঘিরে সব মানুষজন বসে আছে চুপ করে। মনে হলো এটা স্বামী অরবিন্দের কবর। আমরা এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করছিলাম, আর কি দেখার আছে খুঁজে বের করার জন্য। পুরো জায়গাটা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক পুরানো বিশাল বাড়ি। আমরা বারান্দা ধরে হাঁটছিলাম। বারান্দার পাশে সারি সারি ঘর। এরকম একটা ঘরের ভিতর মনে হলো ‘দি মাদার’ এর কবর। রুমের ভেতর একটা কফিন। সেটার উপর আবার নেটের সাদা কাপড়ের পর্দা। তার সামনে কয়েকজন চুপচাপ বসে আছে। একজনকে তো দেখলাম মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে কফিনের সামনে পড়ে থাকতে। দৃশ্যটা দেখে আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। এই রকম প্রকাশ্য শিরক আমি চোখের সামনে কোথাও দেখি নাই। আমরা খুব বেশিক্ষণ এখানে থাকলাম না। আমরা লাইব্রেরিটা ঘুরে দেখলাম। রুবাইদা কয়েকটা বাচ্চাদের জন্য নীতিকথার বই কিনলো। তারপর আমরা বের হয়ে গেলাম।
এখান থেকে বিচটা খুবই কাছে। আমরা হেঁটে হেঁটে বিচে চলে গেলাম। সমুদ্রের প্রাণ জুড়ানো বাতাসে আমাদের মন ফুরফুরে হয়ে গেলো। দিনের আলোতে দেখতে লাগলাম সমুদ্রকে। কোন ভিড়ভাট্টা নাই, আছে শুধু শান্তি আর শান্তি। পাথুরে ব্লকের উপর বসে অলস ভঙ্গিতে বসে গল্প করতে লাগলাম সবাই মিলে। শেষ বিকালের সময়টা এভাবেই কাটলো। তারপর আমাদের চোখের সামনে সূর্যটা লাল হয়ে টুপ করে ডুবে গেলো পানির ভেতর। সন্ধ্যা নামতেই আমরা উঠে পড়লাম। প্রশান্তির এই সমুদ্রকে বিদায় জানিয়ে আমরা হাঁটা ধরলাম।
হাঁটতে লাগলাম গলি ধরে। কোনখানেই তেমন কোন লোকজন নাই। চুপচাপ শান্ত আর নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে আমরা গল্প করতে করতে হাঁটতে লাগলাম। দুপাশের সুন্দর সুন্দর সব ঘরবাড়ি দেখতে দেখতে হাঁটছিলাম আমরা। আমি এক দোকান থেকে ৩০ রুপি দিয়ে নানা রকম চিপস আর চানাচুর মিশিয়ে কিনে নিলাম। সেইটা খেতে খেতে আমরা হাঁটছিলাম। আন্না সালাই রোডে এসে পড়লে চোখে পড়লো বিশাল বিশাল সব সিনেমার পোস্টার। এত বড় পোস্টার আমি কখনও দেখি নাই!
এখান থেকে আমরা দুই দলে ভাগ হয়ে গেলাম। রুবাইদা আর মিম চলে গেলো হোটেলে আর আমি আর অন্তরা গেলাম শাড়ির দোকান ‘পোথি’ র উদ্দেশ্যে। এর মধ্যে অন্তরা আবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে পানিপুরি খেয়ে নিলো। তারপর আমরা ঢুকলাম পোথিতে। পুরো পোথি ভর্তি খালি আমাদের লোকজনই ভরা। বেচার ইশতিয়াককে দেখলাম একটা শাড়ি কিনতে চাচ্ছে কিন্তু সব মেয়েদের সাজেশন নিয়ে আর এত এত শাড়ি দেখে বেচারার পাগল হয়ে যাওয়ার দশা। ঐদিকে তমা টপাটপ দুইটা শাড়ি কিনে ফেললো। আমি ঘুরে ঘুরে অন্যদের শাড়ি কেনা দেখতে লাগলাম। পোথির লোকজনও আমাদের দলটাকে দেখে বেশ অবাক। সারা দিন ধরে একই বয়সী ছেলেমেয়ে ভিড় আর হৈ চৈ করে শাড়ি কিনছে এটা বোধহয় তারা কখনও দেখে নাই। একেবারে শেষ পর্যন্ত আমরা দোকানে রইলাম। আমাদের জন্যই বোধহয় ওরা দোকান বন্ধ করতে পারছিলো না। শেষবারের মত কেনাকাটা করে আমরা বের হয়ে আসলাম।
পোথির উল্টা পাশেই একটা বেশ বড় রকমের খাবারের দোকান চোখে পড়লো। আমি আর তমা ঢুকে পড়লাম সেখানে। পুরাই ভেজ দোকান। তাই আমার অর্ডার দিতে কোনই সমস্যা রইলো না। আমরা অর্ডার দিলাম ইডলি-সম্বর আর পাও ভাজি সাথে ডেজার্ট হিসেবে মিষ্টি। একটা হলুদ প্লাস্টিকের থালায় আসলো দুইটা ইডলি, তিন রকমের চাটনি আর একটা ছোট বাটিতে সম্বর বা পাতলা ডাল। আরেকটা লাল থালায় আসলো দুইটা বনরুটির সাথে পাওভাজি আর পিয়াজ কুচি। আর একটা ছোট কাপে করে আসলো রসে ডুবানো চারটা লালমোহন মিষ্টি। সব মিলিয়ে আমাদের খরচ হলো ১০০ রুপি। আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে খেতে শুরু করলাম। ইডলিটা দেখতে যতটা সুন্দর খেতে ততটা ভালো নয়। পাওভাজিটাই মজা করে খাওয়া গেলো। আর মিষ্টিটা ছিলো খুবই শক্ত। খেয়ে মুখের টেস্টটাই নষ্ট হয়ে গেলো।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে হোটেলে ফিরে আসলাম আমরা। ইতোমধ্যে বলে দেওয়া হয়েছে ভোর চারটার সময় ঘুম থেকে উঠতে হবে আমাদের। জুবায়ের প্রতি রুমে রুমে এসে ডেকে তুলবে সবাইকে। আমাদের জন্য বাস এসে বসে থাকবে। ভোর বেলাতেই রওয়ানা হবো চেন্নাইয়ের উদ্দ্যেশ্যে। ক্লান্ত শরীরে ব্যাগ গুছিয়েই শুয়ে পড়লাম আমরা। প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম।