গভীর ঘুমটা ভাংলো উর্মির ডাকে। আমি সবসমই দেরি করে ঘুম থেকে উঠি। ওরা উঠে গেছে অনেক আগেই। আমি না উঠলে উর্মি আর নিলয় ঠিকমত বসতে পারছে না। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে ডেকে দিলো উর্মি। চোখমুখ ডলে আড়মোড়া ভেঙ্গে আমি উঠে পড়লাম। জম্পেশ একটা ঘুম দিয়ে শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগতে লাগলো। আমি উঠে বসতেই উর্মির বাংকারটা ভাঁজ করে দিলো নিলয়। আমরা তিনজনে আরাম করে আমার সিটে বসলাম।
নিলয় জানালো গতরাতে ট্রেনের দুলুনিতে আমাদের সবার লাগেজ গড়িয়ে গড়িয়ে ট্রেনের করিডরে ছুটে চলে গিয়েছিলো। নিলয় টের পেয়ে উপরের বাংকার থেকে নেমে আসে। আমাদেরকে মরার মত ঘুমাতে দেখে ও একাই সবার লাগেজ টেনে টেনে আবার জায়গা মত নিয়ে আসে। আমরা একজন অন্যজনের দিকে তাকালাম, এত কিছু হয়ে গেলো আর কিছুই টের পেলাম না?
সকালের নাস্তা কিনে নিলাম ডিম ভাজা আর পাউরুটির একটা বাক্স। ট্রেন একটা স্টেশনে থামতেই চিং ট্রেনের জানালা দিয়ে স্টেশনের এক ফেরিওয়ালার কাছ থেকে একটা প্যাকেট কিনলো। ট্রেন ছেড়ে দিতেই আমরা প্যাকেট খুলে দেখলাম ভিতরে পরোটা আর ভাজি। একদম গরম গরম পরোটা, আর ভাজিটাও খুব মজার। মনে হলো ট্রেনের নাশতা না কিনলেই ভালো হতো! কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা স্টেশনে ট্রেন থামতেই চিঙয়ের উপরের বাংকারে থাকা ভদ্রলোকটা আমাদের কাছ থেকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন। আমরাও হাসিমুখে ওনাকে বিদায় জানালাম। উনি চলে যাওয়ার পর আমরা ভালো করে চারপাশটা দেখলাম। মনে হলো আগের ট্রেন জার্নির মতই এবারও আমাদের খোপে সব মিলিয়ে আটটা সিটেই আমরা চারজন ছাড়া আর কেউ নাই। আমরা একেকজন একেক সিটে গিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বসলাম।
যখন বেলা বাড়লো, তখন ট্রেনের মাঝে সিল করে রাখা দরজাটা খুলে দিলো। ওই পাশ থেকে লোকজন এসে আমাদের সাথে দেখা সাক্ষাত করতে লাগলো। সবাই এসে বললো ‘তোদের খোপে তো বেশ আলো বাতাস আছে!’। একটু পর আমরাও ঘুরতে গেলাম ওদের খোপে। আসলেই ওদের বগিটা বেশ গরম আর তুলনামূলক অন্ধকার, কারণটা কি বুঝলাম না। ওরা সবাই মিলে খুব মজা করছে। আমাকে দেখে সবাই বললো এক পাঞ্জাবী আংকেল নাকি রাত্রির সাথে খুব খাতির জমিয়ে ফেলেছিল। ওরা দুজনে মিলে দারুন সব কথা বার্তা বলে সবাইকে হাসাতে হাসাতে অস্থির করে ফেলেছিলো। আমি খানিক্ষন রুবাইদার পাশে বসে গল্পগুজব করলাম। তারপর ফেরত এলাম আমাদের বগিতে। ওরা অনেকেই আমাদের বগিতে এসেছে গল্পগুজব করতে। আমাদের খোপের ইলেক্ট্রিক সকেটটা ঠিকমত কাজ করছিলো বলে ওরা অনেকেই এসে লাইন ধরে মোবাইল চার্জ দিতে লাগলো।
গল্পগুজব করতে করতে আমাদের দারুন সময় কাটছিলো। এর মধ্যে পেলাম দুঃসংবাদটা। নোভার ব্যাগটা চুরি হয়েছে। অনেক খোঁজাখুজির পর বাথরুমে ব্যাগটা পাওয়া গেলো কিন্তু ভিতরে বেশ কিছু রুপি ছাড়াও ওর দামি মোবাইল, পাওয়ার ব্যাংক ও ঘড়িটা মিসিং। চোর সস্তা মনে করে ওর দামি সানগ্লাসটা রেখে গিয়েছে- এটাই একমাত্র সান্ত্বনা। নোভা আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাপ্লিকেশন লিখে ট্রেনের পুলিশের কাছে জমা দিয়ে আসে। যদিও কোন লাভ হবে না, তারপরও…
এই ট্রেনে সাউথের লোকজনই বেশি। তাদের দেখতে বেশ মজা লাগে। মহিলারা খুব সুন্দর করে টাইট ফিট শাড়ি পরে। সাদা লুঙ্গি পরা লোকজনও দেখলাম। সবচেয়ে মজার হচ্ছে ওদের ভাষা। কি যে অদ্ভূত লাগে শুনতে! ফেরিওয়ালারাও কেমন করে যেন কথা বলে। একটু পর পর এক ফেরিওয়ালাকে দেখলাম ‘-বাডা-বাডা-বাডা-’ বলে কি সব জিনিস বিক্রি করতে। আমি আগ্রহ নিয়ে তাকালাম কি এই জিনিস ‘বাডা’ তাই দেখতে। দেখে মনে হলো পিয়াজুর বড় ভার্সন। আমার মনে হলো কথাটা আসলে ‘বড়া’, সেটাকেই ওদের ভাষায় বলা হচ্ছে ‘বাডা’। চারপাশের সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে আমাদের সময় চটপট কেটে যেতে লাগলো। এরমধ্যে আমি আর উর্মি খেয়ে নিলাম ৭০ রুপির ডিম বিরিয়ানি। দুপুর হয়ে আসতেই একজন অন্যজনকে সতর্ক করে দিতে লাগলো আমাদের স্টপেজ নাকি কাছাকাছি চলে এসেছে। আমরাও গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আমাদের আধা দিনের সংসার গোছাতে শুরু করলাম।
ট্রেন একটু পরপরই একেকটা স্টেশনে থামে আর আমরা উশখুশ করি, এটাই কি আমাদের স্টপেজ কিনা জানার জন্য। আমাদের স্টপেজের নাম কোচভেলি। পরপর অনেকগুলো স্টেশন পার হয়ে গেলো, কিন্তু কোনটাই আমাদের স্টেশন নয়। আমরা আবার টেনশনে পড়ে গেলাম- ভুল করলাম না তো। ঐপাশের বগি থেকে ফোন দিয়ে আমাদের জানায়- না, এখনো আসে নাই আমাদের কোচ ভেলি। এই করতে করতে কতগুলো আন্টি উঠে আসলো এক স্টেশন থেকে। আমি উনাদের কাছে গিয়ে ইংরেজিতে বললাম কোচভেলির কথা। ওনারা বললেন যে চিন্তা করার কিছু নাই, কোচ ভেলিই লাস্ট স্টপেজ। তাই ট্রেন ছেড়ে দিবে সেই ভয় নাই। আর উনারাও কোচ ভেলিতেই যাচ্ছেন। সামনেই আসবে সেটা। দেখতে দেখতে সোয়া তিনটার সময় আমাদের কোচভেলি চলে আসলো। ট্রেন থেমে গেলে আমরা চারজন সব মালপত্র নিয়ে নেমেও গেলাম। কিন্তু প্ল্যাটফর্মে নেমে আর কাউকে দেখতে পেলাম না। নিলয় অন্য সবাইকে ফোন দিলো। অনেক্ষণ পর একজন একজনকে নামতে দেখলাম। ওরা নাকি বুঝতেই পারে নাই কোচভেলি চলে এসেছে! যাই হোক ৪৬ জন মানুষের শ খানেক মালপত্র নিয়ে নামতে বেশ সময় লাগলো। নতুন স্টেশনের দিকে আগালে আমাদের নাকি উল্টা হবে। তাই কমিটি হোটেল ঠিক করতে যখন গেলো তখন মালপত্র নিয়ে আমরা প্ল্যাট ফর্মেই বসে রইলাম। পুরো প্ল্যাটফর্ম খালি, খালি আমরা দ্বিমিকবাসীরাই থেকে গেলাম। আমরা ওয়েটিং চেয়ারগুলোতে বসলাম। আমি সবার দিকে তাকিয়ে লক্ষ করতে লাগলাম, দীর্ঘদিন ভ্রমণের ছাপ পড়েছে সবার চোখেমুখে। সবারই গায়ের রঙ পুড়ে গেছে কয়েক পোচ। আর নোভাকে দেখলাম চোখমুখ লাল করে হাঁটতে। ওর নাকি জ্বর এসেছে। কি আশ্চর্য, ট্রেনে ওঠার সময় নোভা ফর্সা ছিলো আর ট্রেন থেকে নেমে ও হয়ে গেলো লাল!
আমরা অনেক্ষণ হাত পা এলিয়ে বসে ছিলাম। তারপর কে যেন বুদ্ধি দিলো, বসতে হলে ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসি না কেন? তারপর আমরা সবাই হাত পা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়লাম। যার যার মালপত্র নিয়ে সে সে প্ল্যাটফর্মের উল্টা দিকে হাঁটতে লাগলাম। দীর্ঘক্ষণ হাঁটার পর টের পেলাম স্টেশনে যেতে হলে আমাদের প্ল্যাটফর্ম বদলে পাশের প্ল্যাটফর্মে যেতে হবে। মাথায় তখন আমাদের বড়সড় বাজ পড়লো। কেমন করে এই প্ল্যাটফর্ম থেকে ওই প্ল্যাটফর্মে যাবো?
দেখা গেলো তিন ধরনের উপায় আছে। প্রথম উপায়টা হলো ওভার ব্রিজ। আমাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রায় বিশ ফুট উঁচু একটা ওভার ব্রিজ আছে যেটা পাশের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে নেমেছে। আমরা ওভার ব্রিজটা এক ঝলক দেখেই এই প্রস্তাব বাতিল করে দিলাম। এতগুলো মালপত্র নিয়ে এই উঁচু ওভার ব্রিজ পার হওয়া সম্ভব না। দ্বিতীয় উপায়টা হচ্ছে ট্রেন। প্ল্যাট ফর্মে এখনও আমাদের ট্রেনটা থেমে আছে। আর এইটার অন্য পাশে থেমে আছে আরও একটা ট্রেন। এই প্ল্যাটফর্ম থেকে মাল তুলে প্রথমে একটা ট্রেনে ঢুকতে হবে, তারপর সেটার অন্যপাশ দিয়ে নামতে হবে। তারপর ঐ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটায় উঠতে হবে, তারপর সেই ট্রেনটার অন্য পাশ দিয়ে নামলে কাংখিত প্ল্যাটফর্মটা পাওয়া যাবে! আমাদের অনেকেই সেই পদ্ধতিতে আগালো। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম পদ্ধতিটা কেমন। এর মধ্যে অবনী যেই উঠলো মালপত্র নিয়ে একটা ট্রেনে, ওমনি ট্রেনটা অল্প বিস্তর নড়তে লাগলো। আমরা পাগলের মত চিৎকার করতে লাগলাম অবনীর জন্য। অবনী তাড়াতাড়ি করে ওর মালপত্র ছুড়ে ফেলে নেমে গেলো সেই ট্রেন থেকে। আমরাও বুকে আটকে থাকা নিশ্বাসটা ছেড়ে দিলাম। অবনীর অবস্থা দেখে আমাদের কারও আর সাহস হলো না এইভাবে প্ল্যাটফর্ম পার হতে। আমরা সবাই তাই তিন নম্বর উপায়ের দিকেই গেলাম। তিন নম্বর উপায়টা হচ্ছে, প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় গিয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে দুই দুইটা রেল লাইন পার করে অন্য পাশের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে ওঠা। জিনিসটা যত সহজে বলা হয়ে গেলো, করাটা হলো তারচাইতে একশ গুণ কঠিন। পাকা উঁচু প্ল্যাটফর্ম থেকে নামার পরই মাটিতে আমাদের লাগেজের চাকা আটকে যেতে লাগলো। কোনমতে সেটা টেনে হিচড়ে নিয়ে রেললাইনের কাছে আনা হলো। তারপর ভারি লাগেজটা তুলে উঁচু একটা রেল পার করা হলো। তারপর দেখা গেলো পাথর আর কাঠের স্লিপারের কারণে লাগেজ নাড়ানোই যাচ্ছে না। পুরো ভারি লাগেজটাকে তুলে নিয়ে একটা আস্ত রেলাইন কোনমতে পার করা হলো। তারপর কয়েক সেকেন্ড দম ফেলেই আবার মাটির রাস্তায় নেমে পড়তে হলো। তারপর পরের রেললাইনটাও একইভাবে পার করা হলো। তারপর সিঁড়ি দিয়ে লাগেজ গুলো টেনে টেনে প্ল্যাটফর্মে তোলা হলো। কাঁধে হ্যান্ড ব্যাগ, পিঠে ব্যাকপ্যাক, হাতে ট্রলি ব্যাগ আর খাবার পানির প্যাকেট- সব কিছু নিয়ে যখন প্ল্যাটফর্মে উঠলাম তখন আমার পাঁজড় হাপড়ের মত উঠা নামা করছে। আমি হাঁপাতে হাঁপাতেই একবার তাকিয়ে দেখলাম, ওইপাশে উঁচু প্ল্যাটফর্মটা থেকে দুইটা রেল লাইন পার করে এতগুলো মালপত্র নিয়ে আমি এই পাশে কেমন করে আসলাম, ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না!
অমানুষিক কষ্ট করার পর সবাই গলদ্ঘর্ম হয়ে গুটি গুটি পায়ে আগাতে লাগলাম ওয়েটিং রুমের দিকে। সবাই ওয়েটিং রুমের চেয়ারগুলোতে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম। এই লাগেজ টানা নিয়ে প্রচন্ড পরিশ্রম গেছে আমাদের। এবার একটু বিশ্রাম না নিলেই নয়। একটু স্থির হয়ে সবাই খেয়াল করলাম, দুপুরের খাবার হজম হয়ে গেছে- কিছু খেয়ে নেওয়া প্রয়োজন। ওয়েটিং রুমের পাশেই ছোট একটা দোকান থেকে আমি পানি, কেক আর মিল্কিবার কিনে খেতে শুরু করলাম। খাওয়া দাওয়া শেষে একটু পরেই খবর পেলাম আমাদের হোটেল ঠিক হয়ে গেছে। আবার আমরা যার যার বাক্স প্যাটরা নিয়ে রওয়ানা দিলাম।
স্টেশন থেকে বের হয়ে দেখলাম কোন গাড়িঘোড়া নাই। কেমন যেন ফাঁকা রাস্তা। এর মধ্যে একটা একটা অটো আসলেই সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো। কয়েকজন মিলে একেকটা অটো ঠিক করতে লাগলো ৪০০ রুপি দিয়ে। এর মধ্যে অন্তরা কেমন করে যেন ২০০ রুপি দিয়ে একটা অটো ঠিক করে ফেললো। অটো ঠিক করে ফেলার পর শুরু হলো আমাদের মালপত্র উঠানোর সংগ্রাম। ছোট্ট একটা অটোতে মিম, অন্তরা, রুবাইদা আর আমার চারটা বড় লাগেজ, তিনটা ব্যাকপ্যাক আর সাথে অন্যান্য প্যাকেট এবং হ্যান্ড ব্যাগ- সব মিলিয়ে ১২-১৩টা মাল নিয়ে আমি, মিম আর অন্তরা উঠে পড়লাম। রুবাইদার জায়গা হলো না, ও ওর বাকি মালপত্র নিয়ে অন্য কারও সাথে যাবে বলে চলে গেলো। একটা ছোট অটোতে এতগুলো মাল আটানোর পর আমরা তিনজন মানুষ কেমন করে এটে গেলাম- এটা একটা ব্যাপক রহস্য! মিম একটা বড় লাগেজ নিয়ে ড্রাইভারের পাশে কোনরকম বসলো। আমি আর অন্তরা বাকিসব লাগেজের ফাঁকে কোনরকমে বসতে পারলাম। আমার হাঁটুটা বারবার অটো থেকে বাইরে বের হয়ে যাচ্ছিলো। আমি হাত দিয়ে প্রাণপণে হাঁটুটা টেনে ভিতরে ঢুকানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। এই করতে করতেই আমাদের অটোটা ছেড়ে দিলো। এত ওজন নিয়ে অটোটা নড়াচড়া যে করতে পারলো, সেটাই বিশাল ব্যাপার!
আমি আর অন্তরা কুন্ডুলী পাকিয়ে একে অন্যকে জড়াজড়ি করে বসে রইলাম। পুরো ফাঁকা রাস্তা দিয়ে আমাদের অটো শাঁ শাঁ করে চলতে লাগলো। মাঝে মাঝে দেখতে পাচ্ছিলাম অন্য অটোতে আমাদের লোকজনদের। ওদের অবস্থাও আমাদের মতই। এর মধ্যে এক সিগ্নালে আমাদের অটোগুলো পাশাপাশি থামলো। অটোওয়ালা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলো যে আমরা একই সাথে যাচ্ছি। তাই উনি গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন ভাড়া কত করে। অপর অটোওয়ালা জবাব দিলো ৪০০ রুপি করে। আমাদের অটোওয়ালা কিছু বললো না। অন্তরা সব দেখে বললো, ‘ব্যাটা মনে হয় ৪০০ রুপিই নিবে’। আমাদের অটো চলতেই লাগলো। ফাঁকা ফাঁকা পথঘাট পেরিয়ে আমরা যেতে লাগলাম। আমি একবার অন্তরাকে বললাম গুগল ম্যাপে একটু দেখে নেওয়ার জন্য। কিন্তু অন্তরা জানিয়ে দিলো যে মোবাইল পর্যন্ত হাতটা পৌঁছানোর কোন জায়গা নাই। তাই আমরা আল্লাহর ভরসায় চলতে লাগলাম।
প্রায় ঘন্টা খানেক পর যখন গুটিসুটি মেরে থাকতে থাকতে আমাদের হাঁটু, কোমর, ঘাড়, কনুই টনটন করতে লাগলো তখন মনে হলো আমরা কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। হঠাৎ দেখি কমিটির লোকজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ওরা পথ দেখিয়ে দিলো। তারপর হঠাৎ করেই আমরা একটা ঢাল বেয়ে নামতে লাগলাম। আমাদের বুক ধুকপুক করতে লাগলো। এত মালপত্র সমেত অটোটা এমনিতেই ইমব্যালেন্সড, তার উপর খাড়া ঢাল, সামলাতে পারবে তো? আমি আর অন্তরা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়তে লাগলাম। আমাদের অটো প্রচন্ড বেগে ঢাল বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। আমরা রক্তশূন্য মুখে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। হঠাৎ একটা গেটের সামনে ঘ্যাঁচ করে আমাদের অটোটা থামলো। আমি গলা বের করে দেখলাম ইশ্তিয়াক দাঁড়িয়ে আছে। ও জিজ্ঞেস করলো, ‘তোরা কারা কারা আছিস?’ । আমি বললাম আমাদের কথা। ইশতিয়াক বললো, ‘তোদের রুম সামনের হোটেলে’। এমন সময় দেখলাম মজুমদার, মৌলিও একটা অটো থেকে নেমে এই হোটেলে ঢুকছে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি তো এই হোটেলে, তাই না?’। ইশতিয়াক মাথা নেড়ে বলতে লাগলো, ‘সামনের হোটেলে, সামনের হোটেলে-‘। আমি আর কথা বাড়ালাম না। আরও ঢাল বেয়ে আমাদের অটো নামতে লাগলো। তারপর ঢালের মধ্যেই বামদিকে বিশাল একটা টার্ন নিলো। আমাদের বুক ধক করে উঠলো। তারপর আরেকটা হোটেলের সামনে গিয়ে আমাদের অটো থামলো। সেটার নিচে জুবায়ের দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ভাড়া দেওয়ার সময় অটোওয়ালা আমাদের কাছে ৪০০ রুপি দাবি করে বসলো। আমাদের কিছু করার নেই, অন্য সবাইই ৪০০ রুপি দিয়েছে। আমরাও তাই দিলাম। তারপর মাল টেনে টেনে জুবায়েরের কাছে আসতেই জুবায়ের বললো, মিম আর অন্তরার রুম এই হোটেলে কিন্তু আর আমার আর রুবাইদার রুম আগের হোটেলটায়, যেটা আমরা পার হয়ে এসেছি। আমি ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলাম। এখন আমি কেমন করে ঢাল বেয়ে যাবো? শুধু আমার লাগেজ হলেও না হয় কথা ছিলো। সাথে রুবাইদারটাও আছে। কি করবো?
জুবায়ের বললো, ‘দাঁড়া, কোনটা কোনটা লাগেজ বল, সব টেনে দিচ্ছি’। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম, এই ঢাল বেয়ে ‘সব’ লাগেজ তুলে দেওয়ার অফার কেউ দিতে পারে- এটা আমি ভাবতেও পারি নাই। এমন সময় রাজিব যেন আসলো কোথা থেকে। জুবায়ের ওকে বললো আমাকে হেল্প করতে। ও একটা কথাও না বলে দুইটা লাগেজের হ্যান্ডেল ধরে ফেললো। আমি বললাম, ‘আমার লাগেজ আমি নিজেই নিতে পারবো, তুই শুধু রুবাইদারটা টেনে দে, তাহলেই হবে’। রাজিব রুবাইদার লাগেজটা ধরে শক্ত হাতে টেনে নিয়ে ঢাল বেয়ে উঠতে লাগলো। এমনিতে সমতলে লাগেজ টানাই ঝামেলা তার উপর এখন ঢাল। হ্যান্ড ব্যাগ, ব্যাকপ্যাক, খাবারের প্যাকেট আর ট্রলি টেনে টেনে ঢাল বেয়ে উঠতে উঠতে আমার ভীষণ পরিশ্রম হচ্ছিলো। পায়ের মাংসপেশী টনটন করতে লাগলো, হাতের আঙ্গুল্গুলোতো মনে হচ্ছিলো ছিঁড়ে আলাদা হয়ে যাবে। প্রচন্ড পরিশ্রমে আমার চোখমুখ লাল হয়ে গেলো। জোরেজোরে নিশ্বাস নিতে লাগলাম, মনে হচ্ছিলো এই ঢাল বেয়ে ওঠা কোনদিন শেষ হবে না। অথচ খুব বেশি দূরেরও কোন রাস্তা না, সমতল হলে হয়তো তিন মিনিট লাগতো হেঁটে যেতে। আমি সামনে রাজিবকে দেখতে লাগলাম ধীর পায়ে রুবাইদার ব্যাগটা টেনে টেনে যেতে লাগলো। আমিও দাঁতে দাঁত কামড়ে উঠতে লাগলাম ঢাল বেয়ে।
অবশেষে হোটেলের সামনে এসে থামলাম। রাজিব হাঁপাতে হাঁপাতে রুবাইদার লাগেজটা রেখে দিলো। আমি ওকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম। তারপর টেনে টেনে আমি সব মালপত্র নিয়ে আমাদের একতলার রুমে এসে পড়লাম। এসেই হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় গিয়ে ফ্ল্যাট হয়ে পড়ে গেলাম। মজুমদার আর মৌলি গোসলের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। এর মধ্যেই রুবাইদা ওর বাকি মাল সমেত রুমে এসে ঢুকলো। আমি একটু ধাতস্ত হয়ে লক্ষ করলাম আমার রুমটা। খুব বেশি বড় নয়, কিন্তু সুন্দর রুম। সাথে একটা মাঝারি বারান্দাও আছে। সেখানে একটা টি টেবিল আর দুইটা চেয়ার। সব দেখেটেখে আমার রুমটা পছন্দ হলো।
গোসল শেষে মৌলি আর মজুমদার বের হয়ে যায়। এরপর আমি গোসলে ঢুকি। রুবাইদা ওর বিশাল হ্যাভারস্যাকটা খুলে জামা কাপড় বের করতে থাকে। গোসল থেকে বের হয়ে আমি ধোয়া কাপড়গুলো বারান্দা টি টেবিল আর চেয়ারের উপর মেলে দেই। অপেক্ষা করি রুবাইদার গোসল শেষ হওয়ার জন্য। খেয়াল করি, রুবাইদা সব কিছুতেই কেমন যেন নিরুৎসাহী হয়ে গেছে। এই ত্রিভান্দাম আসার পরই দেশে যাবার জন্য রুবাইদার মন যেন একেবারেই ছুটে গেছে। কোন কিছুতেই ওর আর কোন আগ্রহ নাই।
রুবাইদার গোসল শেষ হলে আমরা বের হই। ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে। যদিও বিচ কাছেই তারপরও এই রাতের বেলা কেন যেন বিচে যেতে ইচ্ছা হলো না। যে ঢালু রাস্তায় আমাদের হোটেল তার নাম ‘হিল অ্যান্ড সি ভিউ রিসোর্ট রোড’। এই রোডের দুই পাশে অনেক দোকানপাট। সবগুলোতেই জয়পুরে দেখে আসা সেই পায়জামা ঝুলছে। আর ধারে কাছে বিচ আছে বলে সব দোকানেই সাজানো আছে স্যান্ডেল, হাফ প্যান্ট, হ্যাট- এইসব জিনিসপত্র। আমরা একেকটা দোকান ঢুকে দেখছিলাম। জিনিসগুলো খুবই সুন্দর, জয়পুরের চাইতে মান অনেক ভালো। জয়পুরের জিনিসগুলো দেখে পছন্দ করা মুশকিল, কিন্তু এখানে জিনিসগুলো সহজেই পছন্দ হয়ে যায়। তবে দামও জয়পুরের চাইতে কয়েকগুণ বেশি। আমার মনে পড়লো কমিটির সাজেশন। দেশে থাকতেই কমিটি আমাদের সবসময় সাউথে খরচ করার জন্য ভালো অ্যামাউন্টের টাকা রেখে দিতে বলতো, কারণ সাউথে নাকি সবকিছুর দাম বেশি। আর সাউথের সব জায়গায় ওরা আমাদের ভাষা বুঝবে না এবং ওদের সব খাবার খাওয়াও যায় না। তাই সাউথে খেতে হলে একটু ভালো মানের দোকানে খেতে হবে যেখানে ওরা ইংরেজি বা হিন্দি বুঝবে। আমরা বেশ কয়েকটা দোকান ঘুরে ঘুরে দেখলাম। তারপর হেঁটে হেঁটে ঢালু মোড়টা পার হয়ে আমাদের বাকি লোকজন আছে যেই হোটেলে তার সামনে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। চমৎকার খোলামেলা রেস্টুরেন্ট। আমরা একেবারে শেষের দিকে বেতের চেয়ার টান দিয়ে একটা টেবিল দখল করে দুইজনে বসলাম। রেস্টুরেন্টের দাম আমাদের কাছে মোটামুটি সহনীয় মনে হলো। আমরা অর্ডার দিলাম ৭০ রুপির টমেটো রাইস আর ২০০ রুপির গ্রিল ফিশ। বেশিক্ষণ সময় লাগলো না। একটু পরেই চলে এলো আমাদের খাবার। লাল রঙের টমেটো দিয়ে ফ্রাই করা ভাত খেতে ভালোই লাগলো। আর মাছটাও অনেক মজা। আমরা দুইজনে সময় নিয়ে তৃপ্তি করে খেলাম।
খেয়ে দেয়ে আমরা বের হয়ে গেলাম। এবার যেতে লাগলাম বিচের দিকে। সেই ঢালু মোড়টা থেকে বাঁক না নিয়ে সোজা গেলেই সামনে পড়বে সমুদ্র। রাত হয়ে যাওয়ায় অনেক দোকানপাটই বন্ধ হয়ে গেছে। তবে রাস্তাগুলো শুনশান নিরব না। মানুষজন আছে, আর পরিবেশটা ভালো। আমরা দুইজন একটা মন্দির পার হয়ে সামনে এগিয়ে বিচে চলে গেলাম। বিচটা মোটেও অন্ধকার না। বেশ আলো আছে। কারণ বিচের একেবারে কাছেই সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে দামি দামি দোকানপাট আর রেস্টুরেন্ট। তাদের ঝলমলে আলো বিচটাকে অন্ধকার থাকতে দিচ্ছে না। অদ্ভূত ব্যাপার হচ্ছে, বিচটা ঢালু। কেমন যেন উল্টানো বাটির মত। আমরা বেশিদূর গেলাম না। বালির উপর বসে অনেক্ষণ গল্পগুজব করলাম নানা বিষয় নিয়ে। খানিকদূর হেঁটেও আসলাম বিচ ধরে। তুষারের সাথে দেখা হলো এর মধ্যে, উদাস মনে হাঁটাহাঁটি করছে ও। ঝলমলে দোকানপাট, ঠান্ডা লোনা বাতাস আর সমুদ্রের গর্জনে ভালোই লাগছিলো আমাদের। একসময় ঘড়ি দেখে উঠে পড়লাম আমরা। রাত হয়েছে, হোটেলে ফেরা দরকার।
হোটেলে ফিরেই দেশে ফোন দিলাম। কথা বললাম আম্মুর সাথে। প্রতি রাতেই দেই। তবে আজকে বললাম একটু বেশি সময় ধরে। এর মধ্যে মজুমদার আর মৌলি চলে আসলো। এমনিতেই আমরা ক্লান্ত ছিলাম। সারা দিন কম পরিশ্রম যায় নাই আমাদের। তাই ঘুমাতে একটুও দেরি হলো না। ফ্যানটা ছেড়ে লম্বা হয়ে শুয়ে দিলাম ঘুম। গাঢ় ঘুম।