The Mighty INDIA CALLING: গোলাপি শহরে আকাশের কাছাকাছি আম্বর ফোর্ট এবং জয়গড় ফোর্টে (পর্ব ১৮)

সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখলাম মৌলি গোসলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কলে গরম পানি নাই। এই জন্য ওর দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রুম সার্ভিসে ফোন দিয়ে জানলাম ওদের এখানে বয়লার দিয়ে পানি গরম হয়। সেজন্য প্রায় ঘন্টা খানেক আগে জানাতে হয়। কিন্তু আমাদের হাতে তো অত সময় নাই। প্রথমে মৌলি গোসল করলো। তারপর মজুমদার অনেক কষ্ট করে গোসল করে এসে বললো ভীষন ঠান্ডা পানি। ঠান্ডা পানির কথে শুনে আমি গোসল করার চিন্তা ভাবনা জলাঞ্জলি দিলাম। গরম পানি না পেলে এই ঠান্ডায় আমি কোনভাবেই গোসল করবো না।

আমি আর রুবাইদা বের হয়ে পড়লাম নাশতা খাওয়ার জন্য। আমাদের হোটেলটা একটা আবাসিক এলাকার মাঝখানে। আশেপাশে সব বাসাবাড়ি। কাছাকাছি কোন হোটেল টোটেল নাই। হোটেলের সামনেই এক লোককে দেখলাম ঠেলাগাড়ি নিয়ে বসে আছে। তার গাড়িতে কড়াই, চুলা এইসব সাজানো। রুবাইদা জিজ্ঞেস করেতেই লোকটা জানালো উনি রুটি আর তরকারি বিক্রি করেন। আশেপাশে কোন খাওয়ার দোকানের সন্ধান না পেয়ে শেষমেষ সেই ঠেলাগাড়ির লোকটাকেই বললাম চারটা রুটি আর তরকারি দিতে। উনি আমাদের সামনেই কড়াই ধুয়ে পরিষ্কার করলেন। তারপর পলিথিনের প্যাকেট থেকে কাঁচা কতগুলা সাদা রঙের রুটি বের করে অল্প তেলে ভাজতে লাগলেন। রুটিগুলো অদ্ভূত। ছোট সাইজের ওভাল শেপের রুটি। অনেকটা নান রুটির মত কিন্তু নান রুটি না। তারপর আরেকটা পাত্রে মটর টাইপের একটা জিনিস দেওয়া তরকারি গরম করে দিলেন। তারপর ওয়ান টাইম ইউজ বাটিতে ঢেলে উপরে পিয়াজ কুচি ছড়িয়ে আমাদের সামনে এনে দিলেন। আমরা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই রুটি দিয়ে তরকারি খেলাম। তরকারিটা অত মজা না। তবে খেতে খারাপও না। আমাদের দেখা দেখি অনেকে হোটেল থেকে বের হয়ে সেই রুটি তরকারি অর্ডার দিলো। তারপর রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাশতা খেতে লাগলো।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা গোয়েলে উঠে পড়লাম। আমাদের বাস চলতে শুরু করলো। ঠিক আগের মতনই আমাদের ড্রাইভার আরেক গাইডের কথা বললো। এবার আমাদের কমিটি উনাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলো আমরা বড় প্যাকেজে যাবো না। তবে যদি শুধু  একজন গাইড থাকে তাহলে আমাদের তেমন সমস্যা নাই। তারপর আমাদের বাসে উঠলো হাফ সোয়েটার পরা একজন লোক। আগের বারের লোকটার মত ধুরন্দর চেহারা উনার নাই। তবে উনি আমাদের সামনে এসে কি সব জানি বলতে লাগলো। উনার ভাষাও আমরা বুঝতে পারলাম না। অত্যন্ত বোরিং সেই কথাবার্তা শুনে আমাদের বিরক্তি ধরে গেলো। আমি সৌরভকে বিরক্ত হয়ে বললাম, কেন আমরা পয়সা দিয়ে এইসব ফাউল লোকজন হায়ার করছি ? জবাবে সৌরভ জানালো, গাইড গাইডের মত থাকবে আর আমরা আমাদের মত থাকবো। এই গাইড রাখার একমাত্র কারণ হচ্ছে ড্রাইভারকে না চটানো। সো সামান্য টাকা খরচ হলেও কমিটি এই এক্টামাত্র কারণে এই ফালতু গাইডকে রাখা হয়েছে।

গাইড আমাদের প্রথমে নিয়ে গেলো পাহাড়ের উপর বিড়লা টেম্পলে। সাদা রঙের মার্বেলের টেম্পলটার মাথায় তিন রকমের শিখরা। একটা মন্দিরের, একটা মসজিদের, অন্যটা গুরুদোয়ারার। বিড়লা কোম্পানির মালিক তার বাবা মার স্মরণে এই টেম্পলটা বানিয়ে দিয়েছে। আমরা ভিতরে ঢুকে দেখলাম স্টেজের উপর পর্দা টানানো, আর সবাই চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ ঘন্টা বাজলো। হুশ করে পর্দা সরে গেলো। স্টেজের উপর দুইটা মুর্তি দেখতে পেলাম (সম্ভবত লক্ষী-নারায়ন)। আর সাথে সাথেই গান শুরু হলো। সবাই দাঁড়িয়ে পড়লো, সামনে এগিয়ে গেলো আর দুলে দুলে গানের সাথে গলা মেলাতে লাগলো। তারপর পুরোহিত এক ধরনের পানি সবার দিকে ছিটিয়ে দিতে লাগলেন। আমরা একেবারে পিছনে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখতে লাগলাম। তারপর তাড়াতাড়ি করে মন্দির থেকে বের হয়ে আসলাম। বের হতে হতেই অনেকে বলাবলি করতে লাগলো এটা তো অত্যন্ত টিপিকাল মন্দির। কেন এখানে এসে আমাদের এতগুলো সময় নষ্ট করতে হলো। মনে মনে গাইডকে বকাবকি করে আমরা গোয়েলে উঠলাম।

এরপর অনেক্ষন বাস চলে আমাদের নিয়ে গেলো জয়পুরের সরকারি বিক্রয় কেন্দ্রে। এখানেও আমরা কেন নেমেছি বুঝতে পারলাম না। যাই হোক গাইদের পিছু পিছু আমরা বাস থেকে নামলাম। প্রথমেই একজন লোক আমাদের কিসব জানি ব্লক বাটিকের পদ্ধতি দেখালো। তারপর তারা আমাদের দোকানের ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো। সেখানে শুরুতেই ছেলেদের আলাদা করে দিলো। আর আমাদের মেয়েদের অন্যদিকে নিয়ে যেতে লাগলো। বিক্রয় কেন্দ্রটা অনেক বিশাল। সবকিছুরই দাম অনেক বেশি। শাড়ি, ওড়না, স্যান্ডেল, জুতা সবকিছুর আলাদা আলাদা সেকশন। আমাদের হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে গেলো কাঁথা বালিশ আর কম্বলের সেকশনে। সেখানে আমাদের ‘রাজস্থানী রাজাই’ নামের এক দারুন জিনিস দেখালো। এটা খুবই পাতলা কম্ফোর্ট টাইপের জিনিস। এটা শীতকালে গায়ে দিয়ে ঘুমালে গরম লাগবে আর গরমকালে বিছানায় বিছিয়ে ঘুমালে ঠান্ডা লাগবে। এটাকে ভাঁজ করে একদম ছোট জুতার বাক্সের সমান বানিয়ে ফেলা যায়। আর এটার ওজনও অনেক কম। আমরা বড় বড় চোখ করে সব দেখতে লাগলাম। তারপর উনারা এটার দাম বলে আমাদের বললেন যে আমাদের কোনটা কোনটা পছন্দ। উনাদের কথায় আমরা নড়েচড়ে উঠলাম। আমরা উঠে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু আমরা যতই এখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি উনারা ততই আমাদের আরও ভিতরের দিকে সেকশনে পাঠিয়ে দেয়। আমরা ঝাড়বাতি, ফার্নিচার, রত্ন পাথর সব দেখে দৌড়ে দৌড়ে বের হয়ে যেতে থাকি। আমরা মেয়েরা তো তবুও বের হয়ে আসি, কিন্তু ছেলেদের কোন খবর নাই। আমরা ভাবলাম, ওদের কাছ থেকে বোধহয় ইচ্ছা মত খসিয়ে নিচ্ছে। আমরা গোয়েলে উঠে পড়লাম। অনেক্ষন পরে ছেলেরা ফিরতে লাগলো। ওরা কেউ কিছু কিনে নাই শুধুমাত্র জাফর ছাড়া। জাফর একটা গোলাপি ওড়না কিনে প্রায় চার গুন দাম দিয়ে। ও একটা শাড়িও কিনতে চাচ্ছিলো। ভাগ্যিস কেনার আগে চয়েস করার জন্য মৌলিকে খবর দিতেই মৌলি প্রবল্ভাবে ওকে না করে দেয় এখান থেকে কিনতে। যাক, জাফরের লসটা শুধু একটা ওড়নার উপর দিয়ে গেছে!

ততক্ষনে দুপুর হয়ে গেছে। অনেকেই জুস, চিপস কিনে নিলো। আমিও চিপস কিনে নিলাম। বাসে বসে তাই চিবাতে লাগলাম। সবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে সেই দালাল গাইডের উপর। কতক্ষণ ধরে আমরা বাসে করে ঘুরছি কিন্তু একটাও কাজের জায়গায় যাচ্ছি না, সব আজাইরা জায়গায় গিয়ে শুধু শধু সময় নষ্ট হচ্ছে। এবার গিয়ে কমিটির লোকজন ড্রাইভারকে বলে আসলো যাতে আমরা সোজা আম্বর ফোর্ট যাই। মাঝে আর কোনখানে যাতে থামা না হয়। বাস চলতে শুরু করলো। আমি জানালা দিয়ে দেখতে লাগলাম জয়পুর শহর। অনেক পুরানো শহর কিন্তু প্ল্যান করা। রাজপুত রাজা মানসিংহের বানানো বিল্ডিং প্যাটার্ন অনুযায়ী শহরের মেইন কমার্শিয়াল এলাকাগুলো গড়ে উঠেছে। সবগুলো বিল্ডিংয়েই সেই লালচে কমলা রঙের জালি জালি জানালা দেওয়া রাজকীয় ভাবটা আছে। এ জন্যই বলা হয় ‘দ্যা পিংক সিটি’।

আমাদের গোয়েল এসে পৌঁছালো আম্বর ফোর্ট। বাস থেকে নেমেই মাওতা লেকের সামনে দাঁড়িয়ে গ্রুপ ফটো তুললাম। অনেকে সেখানে জিরা পানি খেলো। সেটার স্বাদ নাকি দারুন। খানিক্ষন পরে সেখান থেকে হাঁটা শুরু করলাম আম্বর ফোর্টের দিকে। মাওতা লেকের পাশ দিয়ে লাইন ধরে হাঁটতে লাগলাম আমরা। এক পাশে টলটলে মাওতা লেক আর লেকের ওপারে সোনালি পাহাড়ের গায়ে এঁকেবেঁকে উঠে গেছে দেওয়াল। ঠিক যেন চীনের প্রাচীর। পুরো পাহাড় জুড়ে রাজকীয় ফোর্টটা যেন আসন গেড়ে বসে আছে। মুখ হাঁ করে এই দেখতে দেখতে আমরা প্রবেশের কাছাকাছি চলে আসলাম। আম্বরের গেটের সামনে ভুট্টার দানা প্লেটে প্লেটে করে বিক্রি হচ্ছে। আশেপাশে অসংখ্য কবুতর ওড়াউড়ি করছে। অনেকে দানাগুলো কিনে কবুতরকে খাওয়াতে লাগলো। বাসিরুনের হাতে একটা কবুতর অনেক্ষন ধরে বসে দানা খেলো। আর বেচারা আফরার হাতের দানা খেতে এক বড়সর সাইজের ছাগল এসে হাজির হলো। ছাগলটা আফরার হাত চেটেপুটে খেতে লাগলো। আমরা দৃশ্যটা দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম।

আম্বর ফোর্টের সামনে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

আমরা আবার হেঁটে পৌঁছালাম গেটের কাছে। প্রথমেই দেখলাম ‘দিল আরাম বাগ’। এটা ফোয়ারা, পানির পুল, চৌচালা ছাউনি, সবুজ ঘাসের লন আর অসংখ্য ফুল গাছ সহ একটা সুন্দর সাজানো বাগান। এখানে আসলে মনে শান্তি লাগে তাই এর নাম ‘দিল আরাম বাগ’। এটার কন্সেপ্ট এসেছে সেই হুমায়ুন্স টম্বের চারবাগ থেকে। এখান থেকে মাওতা লেকের অপরূপ ভিউ দেখতে দেখতে আমরা উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। কি যে সুন্দর দৃশ্য! ঢাল বেয়ে উঠছিলাম আর মাথা ঘুরিয়ে ডানে, বামে, সামনে, পিছনে, উপরে নিচে সবদিকে দেখছিলাম। সমতলে শুধু চারদিক দেখলেই হয়। পাহাড়ের গায়ে উপরে নিচেও দেখা লাগে। কখনও ঢাল, কখনও সিঁড়ি এই বেয়ে বেয়ে আমরা ক্লান্ত হয়ে পৌঁছালাম ‘সুরাজ পোল’ এ। এই গেট পূর্ব দিকে মুখ করা বলে এর নাম সুরাজ পোল। বিশাল রাজকীয় এই গেট পার হয়ে ভিতরে ঢুকে পুরাই পাকা করা বেশ বড় খোলা জায়গা পেলাম। চারিদকে স্ট্রাকচার দিয়ে ঘেরা একটা বিশাল কোর্ট ইয়ার্ডের মত জায়গা। এর নাম ‘জালেব চক’। এখানে সৈন্যরা যুদ্ধ জয় শেষে বিজয় মিছিল করতো। এখানে কেউ ঢুকলে মনেই করবে না যে এটা ভূমি থেকে এত উঁচু একটা জায়গা। এই কোর্টের মধ্যেই অন্য আরেকটা গেট দেখলাম যার নাম ‘চান্দ পোল’। এই গেটের উপরে ছিলো ‘নওবত খানা’। নওবত খানায় ঐতিহ্যবাহী বাদ্য বাজানো হতো। আর যখন বাদ্য বাজতো তখন সবাই চুপ করে শুনতো। আমরা সেখানে স্থানীয় একজনকে দেখলাম এক মনে সারেঙ্গীর মত একটা বাদ্য বাজিয়েই যাচ্ছে। যেমনটা সোনার কেল্লায় পড়েছিলাম। কতগুলো লোক পাগড়ি বিক্রি করছিলো। সীমান্ত ১০০ রুপি দিয়ে পাগড়ি কিনলো। সেই পাগড়ি পরে আমরা পোজ মেরে ছবি তুললাম। এরপর আমরা টিকেট কাটলাম। তারপর সিঁড়ি বেয়ে সত্যিকার রয়াল এলাকায় ঢুকতে শুরু করলাম।

উপরে উঠে দেখতে পেলাম দিউয়ানে আম। দিউয়ানে আমে প্রজাদের সাথে দরবার করার পাশাপাশি যেকোন উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হতো। রাজপুত স্টাইলের চমৎকার কারুকাজ করা কলোনেড স্ট্রাকচারটাতে ঢুকে আমার মনে হলো আমি বোধহয় সেই রাজপুতদের আমলেই চলে এসেছি। কলামগুলো ধরে ধরে হাঁটছিলাম আমি। একেবারে পাহাড়ের ধার ঘেঁষে দিউয়ানে আম, নিচের দিকে তাকালে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি দেওয়াল ঘেরা রাস্তা আর অপূর্ব মাওতা লেক দেখা যাচ্ছে। দৃশ্যটা কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্নময়। আমরা সবাই মিলে দিউয়ানে আমের ভেতর সৃষ্টির ডিরেকশনে লাফ ঝাঁপ দিয়ে ছবি তুললাম। দিউয়ানে আমের পর যে বিশাল রাজকীয় গেটটা দেখলাম সেটা ‘গনেশ পোল’। এই গেটের উপরে জালি দেওয়া জানালা দিয়ে ঘেরা ‘সুহাগ মন্দির’ আছে। এখানে বসে রাজ বংশের মেয়েরা দিউয়ানে আমে অনুষ্ঠিত যে কোন উৎসব উপভোগ করতো। এই গেটের পর থেকে একেবারে প্রাইভেট এলাকা শুরু।

গনেশ পোলের উপরে জালি দেওয়া সুখ মন্দির
গনেশ পোলের উপরে জালি দেওয়া ‘সুহাগ মন্দির’

গনেশ পোল পার হয়ে হাতের বাম পাশে পেলাম ‘দিউয়ানে খাস’ বা ‘জয়মন্দির’ বা ‘শিশ মহল’। এখানে রাজা বিশেষ ব্যক্তিবর্গের সাথে দেখা সাক্ষাত করতেন। মার্বেলের দেওয়ালে সেই তাজমহল লেভেলের ফুল, পাতা এনগ্রেভ করা। দেখেই আমি তবদা লেগে গেলাম। কিন্তু আমার তবদা লাগার আরও বাকি ছিলো। ভিতরে পা রেখে যখন দেখলাম দেওয়াল আর ছাদ কুচি কুচি আয়না দিয়ে জটিল আর কারুকাজ করা জ্যামিতিক আর ফুলেল নকশায় পরিপূর্ণ, তখন আর কথা বলতে পারছিলাম না। আমার সামনে জুবায়ের হাসি হাসি মুখ করে আমাকে বললো, ‘তাও ভালো যে, কিছু কিছু অংশ রঙ দিয়ে নকশা করা, সব জায়গায় পাথর কেটে নকশা করে নাই। তা হলে যে কি হইতো আল্লাহই জানেন’। আমি অবাক হয়ে আয়নাগুলো দেখছিলাম। সব সাধারণ আয়না নয়, লাল, কমলা, গোলাপি, সবুজ, হলুদ – এই সব রঙ্গিন আয়না এত বছর পরও যেন সেই রাজকীয় দ্যুতিই ছড়াচ্ছে। অনেক জায়গায় পাথরের উপর আয়নার কারুকাজ, আয়নার উপর রঙের কারুকাজ, আয়নার উপর পাথরের কারুকাজ – দেখতে দেখতে আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছিলো।

সমগ্র শিশ মহলের দেওয়াল জুড়েই টুকরা টুকরা আয়না দিয়ে দারুণ সব অলংকরণ
সমগ্র শিশ মহলের দেওয়াল জুড়েই টুকরা টুকরা আয়না দিয়ে দারুণ সব অলংকরণ

শিশ মহলের পাশেই চমৎকার একটা বাগান। বাগানের ওপাশে ‘সুখ মন্দির’। গরমের দিনে এখানে রাজ বংশের লোকজনরা থাকতেন। ধবধবে সাদা এই দালানটাকে ফুলেল কারুকাজে পরিপূর্ণ করার পাশাপাশি ঠান্ডা রাখার জন্যও যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিলো। এর উপরে একটা পানির ট্যাংক ছিলো যেখান থেকে পানি নিয়ে এর ভিতরে দেয়াল বেয়ে ফোয়ারার মতন ছাড়া হতো। সেই পানি সোজা গড়িয়ে নেমে যেতো বাগানে। এই সব দেখতে দেখতে আর ছবি তুলতে তুলতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। তানভীরের সাথে দেখা হলো। ও বললো ‘ছবি তোলা বাদ দিয়ে দেখো, এই জিনিস আর জীবনেও দেখতে পারবে না’। এবার সত্যি সত্যি আমি ছবি তোলা বাদ দিয়ে দেখতে লাগলাম। এরপর দেখলাম রাজা মান সিংহের প্যালেস, সারি সারি ল্যাট্রিন, ‘জানাই দেউরি’ বা মহিলাদের থাকার জায়গা। এক চিপা দিয়ে সিড়ি পেয়ে আমি আর তানভীর টপাটপ উপরে উঠে গেলাম। উপরে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেললাম। এত এত ঘর, এত এত করিডর আর এত এত বারান্দা –পুরাই যেন এক গোলক ধাঁধাঁ। আমরা অনেক কষ্টে সেখান থেকে পথ চিনে বের হয়ে আসলাম। তারপর আমি আর তানভীর যে রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম মনে হলো সেটা বের হয়ে যাবার পথ। সেখানে যেতে যেতে দেখতে পেলাম, আম্বর ফোর্ট থেকে আরও উপরে অবস্থিত জয়গড় ফোর্টে যাবার সুড়ঙ্গ পথ।

বের হবার রাস্তায় হঠাৎ দুইটা বড় বড় কড়াই দেখতে পেলাম। আমাদের দেশের মাজারে যেই সাইজের ডেকচি থাকে ঠিক সেই সাইজের কড়াই। কাছে দিয়ে টের পেলাম মৃত্যু দন্ড পাওয়া আসামীকে এই কড়াইয়ের গরম তেলের মধ্যে ডুবিয়ে মারা হতো। বিশাল চকচকে কড়াই দুইটা দেখে মনে হলো কত মানুষ না জানি এখানে ডিপ ফ্রাই হয়ে মরেছে! মোটামুটি ঘুরে আমরা সারি সারি কামান দেখে বের হয়ে আসলাম ঠিক যেখানে টিকেট কেটেছিলাম জালেব চকের, ঠিক সেইখানে। জালেব চকের মাঝখানে মিম আর অন্তরাকে বসে থাকতে দেখলাম। খানিক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আমি, মিম, অন্তরা আর তানভীর রওয়ানা দিলাম জয়গড় ফোর্টের উদ্দেশ্যে। আমাদের সাথে যেতে অনেকেই রাজি হচ্ছিলো না। কারণ সেটা আরও অনেক উঁচুতে অবস্থিত। মূলত তানভীরের উৎসাহেই আমরা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে রওয়ানা দেই। এসেছি যখন একবার, দেখেই যাবো- কি আছে জীবনে?

আম্বর ফোর্ট থেকে বের হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে আমাদের মনে হচ্ছিলো- ‘ব্যাপারটা কি ঠিক হলো? যেতে পারবো তো ঠিকমত? নাকি যেতে যেতেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে আর সব বন্ধ হয়ে যাবে?’। যাই হোক একবার যখন যাত্রা শুরু করেছি তখন আর থামাথামি নাই। কিছুক্ষন যেতেই আমাদের দু পা ধরে আসলো। মুখ দিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে লাগলাম আমি, মিম, আর অন্তরা। কিন্তু তানভীরের কোন বিকার দেখতে পেলাম না। ও বেশ তরতর করেই হাঁটতে লাগলো। আমরা আস্তে ধীরে উঠার চেষ্টা করতে লাগলাম আর আমাদের সাথে ভদ্রতা করে তানভীর আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলো। যে পাহাড়টা বেয়ে আমরা উঠছিলাম সেটার নাম ‘চিল কা টিলা’ বা চিলের পাহাড়। পুরো পাহাড়টাকে পেঁচিয়েই উঠে গেছে রাস্তাটা। আমরা হাঁটছিলাম তো হাঁটছিলাম, কিন্তু পথ শেষ হওয়ার কোন নামগন্ধ পাচ্ছিলাম না। বরঞ্চ একটা বাঁক শেষ হতেই ঘুরে আরও আঁকাবাঁকা সর্পিল বাঁকের রাস্তা দেখছিলাম। পথে অনেক বানর আমাদের ভেংচি কেটে দিচ্ছিলো। ওদের লাফ ঝাঁপ দিয়ে অবলীলায় পাহাড় বেয়ে উঠতে দেখে আমাদের বেশ হিংসা হচ্ছিলো। যেতে যেতে এক সময় মনে হলো আমরা বোধ হয় আজকে আর পৌঁছাতে পারবো না। অনন্তকাল লাগবে এই পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরে উঠতে উঠতেই। হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলাম, শুধু উপরে উঠতেই আমাদের এত কষ্ট- যারা এত উপরে দুর্গ বানিয়েছে না জানি তারা কি লেভেলের পরিশ্রমী, সাহসী আর করিৎকর্মা ছিলো! আরেকবার মনে হলো না হয় কষ্ট করে উপরে উঠলামই, কিন্তু নিচে নামতে নামতে তো অন্ধকার নেমে যাবে। তখন কি হবে? যাই হোক আমাদের হাঁটা বন্ধ হলো না। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে আমরা পাহাড় বাইতেই লাগলাম। একবার থামলাম বিশ্রাম নিতে। হঠাৎ ঢাল ফুড়ে উদয় হলো দুইটা পরিচিত মাথা, সুমাইয়া আর অবনী। ওরাও জোরে জোরে দম ফেলতে ফেলতে আমাদের সাথে এসে যোগ দিলো।

জয়গড় ফোর্টের পথে আমরা
জয়গড় ফোর্টের পথে আমরা

অবশেষে রক্তিম গাল, হাপড়ের মতন পাজড় আর টনটনে পা নিয়ে আমরা এসে পৌঁছালাম জয়গড় ফোর্টের গেটে। গেটের নাম ‘আওয়ানি দরওয়াজা’। টিকেট কেটে ঢুকে পড়লাম রেড স্যান্ড স্টোনে বানানো মোটা মোটা দেওয়াল দিয়ে ঘেরা জয়গড় ফোর্টে। জয়গড় ফোর্ট প্রথমে বানানো হয়েছিলো আম্বর ফোর্টকে রক্ষা করার জন্য। ঢুকতেই আমরা প্রথমে পেয়ে যাই ফাউন্ড্রি। এখানে রাজপুতদের সকল অস্ত্রশত্র বানানো হতো। আমরা ঢুকতেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কামান দেখলাম। এই কামানের নাম ‘জাইভান’। তারপর দেখলাম কামান বানানোর কারিকুরি। বিশাল বিশাল ছাঁচের মধ্যে ধাতু ঢেলে বানানো হতো কামান। এই সব ছাঁচ বানানোর জন্যও আছে বিশাল মেকানিজমওয়ালা কুয়ার মত মেশিন যেটা আসলে ফার্নেস। আমাদেরকে একজন গার্ড মেকানিজমটা সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে দিলেন। আমরা সব দেখে আর শুনে হাঁ হয়ে যাচ্ছিলাম। আকাশের কাছাকাছি একটা জায়গায় এভাবে কামান বানানো- হার্ড টু বিলিভ। তারপর দেখলাম ‘সূর্য মন্দির’। থরে থরে অস্ত্র আর কামারের যন্ত্রপাতি  সাজিয়ে রাখা সেখানে। বর্শা, ঢাল, তলোয়ার, শিরস্ত্রান, গোলা – কি নেই সেখানে!

হাতে সময় অনেক কম। তাই আমরা পা চালাতে লাগলাম। এসে পৌঁছালাম ‘জালেব চক’। আগের মতই বেশ বড় কোর্ট ইয়ার্ড। জালেব চকের চার পাশে হরিহর মন্দির, ভৈরব মন্দির, আর্মারি মিউজিয়াম- আরও অনেক কিছু ছিলো। কিন্তু আমাদের সেগুলোতে ঢুকার সময় নেই। এক রকম দৌড়ে দৌড়ে আমরা প্রাসাদের এলাকায় ঢুকলাম। হলুদ রঙের গেটটা পার হয়ে দেখলাম ‘সুভাত নিবাস’। সেখানে বিশাল বিশাল ঢাক, হাতির পিঠে বসার আসন –এইসব সাজানো আছে। এরপর দেখলাম অত্যন্ত সুন্দর ‘লক্ষী বিলাস’। এটা নাকি রাজাদের ড্রইং রুম ছিলো। এরপর আমরা ছুটতে লাগলাম একটা অন্ধকার চিপা গলি দিয়ে। সেই গলি পার হয়ে ছোট্ট একটা উঠানে এসে পৌঁছালাম। এখান থেকে দেখলাম ডাইনিং হল। সেখানে খুব সুন্দর করে পুতুল দিয়ে সব সাজানো আছে। দেখে মনে হয় যেন সত্যি সত্যি রাজপুত বংশের নারী পুরুষেরা বিশাল বিশাল থালায় হরেক রকম খাবার সাজিয়ে খেতে বসেছে। রান্নাঘরেরও একই অবস্থা। অনেক দাস দাসী মিলে বিশাল বিশাল ডেকচিতে যেন রান্নাবান্না করছে। দেখতে আমার খুবই ভালো লাগছিলো। তারপর দেখলাম ‘ললিত মন্দির’। এটা শোবার ঘর। একটা দোতলা অডিটোরিয়ামও দেখলাম, সামনে স্টেজ সহ। এখানে নাকি নাচ, গান আর পুতুল নাচ হতো। এরপর দেখলাম লাল রঙয়ের ‘বিলাস মন্দির’।

এতক্ষণ ধরে যা যা দেখছিলাম সব কয়টা দালানই এত সুন্দর আর এত প্রাণ জুড়ানো বাতাস যে আমাদের একটু খানিক্ষণ বসে থেকে উপভোগ করতে ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু হাতে সে সময় নেই বলে কোন জায়গাতেই আমরা থামছিলাম না। এক ঝলক দেখেই দৌড় দিচ্ছিলাম। কিন্তু  সাদা রঙের ‘আরাম মন্দির’ দেখে আমরা পুরাই থেমে গেলাম। সামনে যে এক মনোমুগ্ধকর বাগান দেখলাম সেটা আমি নিজের চোখে না দেখলে মনে করতাম এরকম বাগান কেবল রূপকথার বইতেই থাকা সম্ভব। পুরাই যেন কোন বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা সবুজ ঘাস আর ছোট ছোট ঝোপ দিয়ে সাজানো এক পরিপাটি বাগান। আর বাগানটা যে এক আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের উপর অবস্থিত সেইটা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যই যেন তিন তিনটা বিশাল আর্চ পাহাড়ের কিনারায় ভিউ ওপেন করে দাঁড়িয়ে আছে। পুরা দৃশ্যটা এতই বেহেশতি, এতই স্বপ্নময়ী, এতই অবাস্তব যে কয়েক মিনিট আমাদের সময় লাগলো ব্যাপারটা হজম করতে। আমরা কেউ কোন কথাই বলতে পারলাম না কিছুক্ষণ।

ভূমি থেকে হাজার খানেক ফুট উপরে আরাম মন্দির
ভূমি থেকে হাজার খানেক ফুট উপরে আরাম মন্দির

আরাম মন্দিরে এসে আর কোন কিছুর আরাম হোক আর না হোক, আমার চোখের দারুন আরাম হচ্ছিলো। তারপর আমরা হেঁটে হেঁটে একদম জয়গড় ফোর্টের কিনারে এক ওয়াচ টাওয়ারে এসে দাঁড়ালাম। আমার মনে হচ্ছিলো আমি বোধহয় পাখির চোখে পৃথিবী দেখছি। এখান থেকে দেখলাম নিচের আম্বর ফোর্টকে। কত ছোট যে লাগলো সেই বিশাল ফোর্টকে! এক দিকে উপরে সীমাহীন আকাশ অন্যদিকে নিচে পাহাড়ের গায়ে আঁকা বাঁকা দেওয়াল আর ঝকঝকে ‘সাগর লেক’, সেইসাথে মন ভরানো, প্রান জুড়ানো বাতাস- আমার যে কি শান্তি লাগছিলো, সেকথা আর নাই বা বললাম। মনে মনে তানভীরকে ধন্যবাদ দিলাম। ওর জন্যই আজকে এখানে আমার আসা সম্ভব হয়েছে। ওখানকার লোকজন আমাদের তাড়া দিচ্ছিলো বের হয়ে যাবার জন্য। আমাদের আরও অনেক্ষণ ওখানে থাকতে ইচ্ছা করছিলো, কিন্তু উনাদের তাড়া খেয়ে তাড়াতাড়ি আমরা নেমে এলাম। ওনারা আমাদের বের হয়ে যাবার রাস্তা দেখিয়ে দিলেন।

ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা জয়পুর শহর
ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা জয়পুর শহর

আমরা সেই স্বপ্নময়ী বাগান থেকে বের হয়ে হাঁটতে লাগলাম। এবার আমরা দেখলাম তিনটা বি-শা-ল পানির ট্যাঙ্ক। এত উঁচু পাহাড়ে ফোর্ট বানানোর একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা। কৃত্রিমভাবে বানানো সাগর লেক থেকে হাতির পিঠে করে পানি উঠানো হতো। তাছাড়া পুরো ফোর্ট জুড়েই নানা রকম চ্যানেল ছিলো যেগুলো দিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হতো। তিনটা ট্যাঙ্ক মিলে ষাট লাখ গ্যালন পানি ধরে রাখার ক্ষমতা ছিলো। পরে জানলাম এক মজার কাহিনী। এই তিনটা ট্যাঙ্কের একটার ভিতর নয়টা রুম আছে। সেগুলো নাকি রাজা দ্বিতীয় জয় সিংহের আগ পর্যন্ত ট্রেজারি অর্থাৎ রাজকোষ হিসেবে ব্যবহৃত হত। যার মানে দাঁড়ায় রাজ্যের সব সম্পদ এখানে থাকতো। রাজপুত বংশের ব্যাপক ধন ভান্ডার এইখানে লুকানো আছে বলে শোনা যায়। এই ফোর্ট এখনও রাজপুত বংশের লোকদের মালিকানায় আছে, এটা সরকারী সম্পত্তি নয়। তাই এখানে গুপ্তধন আছে কি নেই সেটা নিয়ে ব্যপক কল্পকাহিনী প্রচলিত। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে একবার নাকি জোর তল্লাশি চালানো হয় সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু কিছু পাওয়া গিয়েছে এমন কথা শোনা যায় নাই।

আমরা যখন ট্যাঙ্কগুলো পার হয়ে হয়ে যাচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময়ে ইশতিয়াককে পেলাম সেখানে। ইশতিয়াক মাথা নেড়ে নেড়ে বললো, ‘পুরাই মাথা নষ্ট জায়গা’। আমিও মেনে নিলাম ওর কথা। আসলেই পুরাই মাথা নষ্ট জায়গা। মনে মনে রাজপুতদের স্যালুট জানালাম। আবার আফসোসও লাগলো যে ইন্ডিয়ান ইসলামিক আর হিন্দু আর্কিটেকচার পড়েছি কিন্তু রাজপুতটা কেমন করে যেন হিন্দু আর্কিটেকচার থেকে বাদ পড়ে গেছে। যদি আগে থেকে কিছু পড়াশোনা থাকতো তাহলে দেখাটা আরও বেশি উপভোগ্য হতো। তারপর আমরা সাত জন মিলে গেট দিয়ে বের হয়ে আসলাম। আমরা ঢুকেছিলাম এক গেট দিয়ে আর বের হলাম মেইন গেট দিয়ে। আমার ফোনে রুবাইদা কল দিয়ে জানাতে লাগলো যে, সবাই রওয়ানা দিয়ে দিতে চায়। আমি বলে দিলাম সবাই যদি চলে যেতে চায় তাহলে যেন চলে যায়, আমরা আমাদের মত করে ফিরবো। কিন্তু অবনী এই কথা শুনে বললো, ‘ফাইজলামি নাকি- আমি কমিটি মেম্বার, আমাকে ফেলে গোয়েল চলে যাবে- এতবড় সাহস! এটা কোন কথা হলো?’। আমরা যেন হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম আমাদের সাথে একজন কমিটি মেম্বার আছে। আমরা খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম, যাক আমাদের ফেলে তাহলে গোয়েল চলে যাবে না!

আমরা একটা খালি অটো ঠিক করলাম। অটোটার পিছনে স্পেয়ার চাকা রাখার জায়গাটাতে তানভীর আর ইশতিয়াক জড়াজড়ি করে বসলো। আর আমরা পাঁচজন মেয়ে সামনে গাদাগাদি করে বসলাম। প্রবল বেগে ঢাল বেয়ে আমাদের অটো নিচে নামতে লাগলো। দু পাশের চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা চলতে লাগলাম। হঠাৎ দেখলাম ময়ুর। একটা দুটা নয়, অনেক ময়ুর। আমাদের দেশে গ্রামে যেমন হাঁস মুরগি ঘুরে বেড়ায়, এখানে রাস্তার দুপাশের জঙ্গলে তেমনি রংচঙ্গে ময়ুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক্ষণ ধরে পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে নামতে একসময় আমাদের অটো সমতলে এসে থামলো। থামলো একেবারে জলমহলের পাশে। অটোতে বসে থাকতে থাকতেই আমরা জলমহলের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। অটো থামতেই পার হেড ২০ রুপি ভাড়া দিয়েই দৌড় দিলাম।

এফদ
পানির উপর জলমহল (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

চকচকে সাগর লেকের উপর হালকা হলুদ রঙের বিল্ডিংটার দিকে তাকালেই মনে হবে, ‘ইশ, যদি ভিতরে যেতে পারতাম’। যাওয়ার ব্যবস্থা হয়তো আছে কিন্তু হাতে সময় নাই। দূর থেকে তাকিয়েই দেখে নিলাম জলমহল। এখানে নাকি রাজা প্রথম মাধো সিং হাঁস শিকার করতে আসতেন! কি আর বলবো, কিছু বলার নাই……

আমাদের লোকজনদের দেখলাম সবুজ ঘাসের উপর বসে থাকা হকারদের কাছে গিয়ে স্যান্ডেল দামাদামি করতে। শেষমেশ কয়েকজনকে দেখলাম ১০০ রুপি দিয়ে জোড়া স্যান্ডেল কিনে নিতে। অনেকেই আবার বললো মার্কেটে এর চেয়ে কম দাম হতে পারে। আমাদের দেখেই সবাই চটজলদি গোয়েলে উঠে পড়লো। দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নাই। কিন্তু এখানেও কিছু খাওয়ার নাই। কি আর করা, খালি পেটেই উঠে পড়লাম বাসে। বাস ছেড়ে দিলো। গন্তব্য বাবুবাজার।

সন্ধ্যার সময় বাবুবাজার আসার আগেই সারি সারি দোকানপাট দেখে আমরা নেমে গেলাম। আমি ভাবলাম কোন খাবারের দোকান থেকে কিছু কিনে নিবো। কিন্তু তেমন কোন খাবারের দোকান পেলাম না। আশেপাশের সব দোকানেই মোটামুটি একই জিনিস। দু ধরনের পায়জামা সারি সারি করে ঝুলানো সব দোকানে। এক ধরনের পায়জামা অনেকটা আলাদিন যেরকম পরতো সেরকম, অন্যটা আলাদিনের জিনি যে ধরনের পায়জামা পরতো সেরকম। দাম ১০০ থেকে ১২০ রুপির মতন। পায়জামাগুলো দেখে মনে হলো সিল্ক, জর্জেটের শাড়ি কেটে বানানো। বিভিন্ন দোকানে কাঁচ বসানো ঘাগড়া, বিছানার চাদর, পর্দা, কুশন কভার, ব্যাগ, ওড়না, গিফট আইটেমের মধ্যে কলম, কৌটা, চাবির রিং, নোটবুক ইত্যাদি ঝিকমিক করছে। এছাড়া আছে শাড়ি, জুয়েলারি, স্যান্ডেল, টপস, গিফট আইটেম, শো পিস ইত্যাদি। দোকানদারগুলা বেশ ঘাগু। ইচ্ছা মত দাম হাঁকায়, যার কাছ থেকে যা রাখতে পারে। আর একবার দোকানে ঢুকলে সহসা কাস্টোমারকে খালি হাতে বের হতে দেয় না। আমি আর রুবাইদা হাঁটতে লাগলাম। এরই মধ্যে রুবাইদা কয়েকটা শাড়ি, কুশন কভার, জুয়েলারি, ব্যাগসহ বেশ কিছু কেনাকাটা করে ফেললো। আমরা অনেক্ষণ ধরেই ঘুরতে লাগলাম। আমার কাছে জিনিসপত্র তেমন পছন্দ হচ্ছিলো না। সবার কাছ থেকে শুনে মনে হয়েছিলো জয়পুরের জিনিসপত্র অনেক সুন্দর হবে। কিন্তু সব কিছুই কেমন যেন ঠুনকো লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো কিছুদিন ব্যবহার করলেই সব নষ্ট হয়ে যাবে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো হয়তো আমরা ঠিক জায়গায় শপিং করতে আসি নাই। হয়তো আরও ভালো শপিঙের জায়গা ছিলো।

রাতে এক পর্যায়ে সব দোকানপাট একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। তখন আমরা হাঁটতে হাঁটতে জহুরি বাজার নামের এক জায়গায় ‘দি ফ্রেন্ডস’ নামের এক দোকান পেলাম। এটা অনেকটা মোহাম্মদপুরের সোর্সের মতন দোকান। অবনী এখান থেকে ৫০ রুপি দিয়ে সুন্দর আংটি কিনেছে। দেখে আমার বেশ পছন্দ হলো। আমিও দুইটা আংটি কিনলাম। জুবায়ের আর রাজীবকে দেখলাম চামড়ার কভার দেওয়া স্কেচ বুক কিনতে। তারপর আমরা কয়েকজন মিলে অটো ঠিক করছিলাম। এমন সময় রুবাইদা ফুটপাথে এক লোকের কাছ থেকে ৫০ রুপি দিয়ে সাদা রঙের তিনটা চুড়ির একটা সেট কিনলো। আমি দুসেট নিলাম ১০০ রুপি দিয়ে। সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। লোকটা তাড়াহুড়া করে আমাদের দিলো। তারপর আমরা অটোতে করে রওয়ানা হই হোটেলের দিকে।

হোটেলে নেমে আমরা বের হই খাওয়ার দোকানের খোঁজ করতে। লোকজন দেখিয়ে দেয় রাস্তা। অনেক দূর হেঁটে আমরা এক খাওয়ার দোকান পাই। সেখানে বসে আমরা মেনুর উপর চোখ বুলাই। আলু মটর, পনির মটর, আলু টমাটো- সব স্পাইসি খাবার ছিলো। আমার একদম মশলা খেতে ইচ্ছা করছিলো না। অনেক ভাবনা চিন্তা করে আমি অর্ডার দেই ৩৭ রুপির নান আর ভেজ রায়তা। আর রুবাইদা অর্ডার দেয় বেগুন ভর্তা আর ভাত। আমার ভেজ রায়তা ভালোই ছিলো- টক দইয়ের সাথে সিদ্ধ আলু কিউব। কিন্তু রুবাইদার ভাত আর বেগুন ভর্তা দেখে আমাদের চোখ কপালে উঠে গেলো। টকটকে লাল রঙের ঝোলের একটা তরকারি দিয়ে গেলো। রুবাইদা একবার জিজ্ঞেস করে শিওর হলো যে এটা বেগুন ভর্তা কিনা। ভাতের চালটা মোটা আর হালকা লাল রঙের ছিলো। রুবাইদা সাবধানে ‘বেগুন ভর্তা’ সেই ভাতের সাথে মাখিয়ে মুখে দিলো। তারপর জানালো, খেতে খারাপ না, ভালোই। যদিও বেগুন ভর্তা না হয়ে বেগুনের তরকারি মনে করে খেলে ভালো হতো, তারপরও জয়পুরে এসে জয়পুরি স্টাইলের বেগুন ভর্তা আর ভাত খেয়ে রুবাইদা বেশ খুশি।

খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা উল্টা পাশের মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি কিনে খাই। একেবারে আসল জয়পুরি মিষ্টি! তারপর আমরা রওয়ানা দেই হোটেলের দিকে। হলুদ সোডিয়াম লাইটের আলোতে আমরা হাঁটতে থাকি। ততক্ষনে প্রায় রাত ১১টা বেজে গেছে। আমরা বিস্তর হাসাহাসি করতে করতে নির্জন আবাসিক এলাকার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে থাকি। এক পর্যায়ে রুবাইদা বলে, ‘চিন্তা করে দেখ, ঢাকা শহরে আমার কলিজায় সাহস হবে না রাত ১১টার সময় এভাবে রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে। আর এখন……’। আমিও ভেবে দেখলাম কথাটা ঠিক। বাসায় যদি জানে যে আমি রাত ১১টার সময় রাপা প্লাজার দিকে হেঁটে হেঁটে বাসায় আসছি, আম্মু পিটিয়ে চামড়া তুলে ফেলবে। অথচ এখন কত অবলীলায় হেঁটে যাচ্ছি, কেউ কিছু বলছে না।

হোটেলে ফিরে আমি আবিষ্কার করলাম, বাথরুমে রেলিঙের উপর আমি যে পায়জামা রেখে গিয়েছিলাম তার উপর পাখি এসে বাসা বুনে গেছে। পুরা বাথরুমে খড়কুটা ছড়ানো আর আমার পায়জামার উপর আস্ত পাখির বাসা। রুম সার্ভিসে খবর দিলাম। লোকজন এসে আমাদের বাথরুম পরিষ্কার করে দিলো। আমার খড়কুটা, মাটি লাগানো পায়জামাটা দিয়ে গেলো। এই পায়জামা নিয়ে যা করার তা আগামীকাল ভেবে দেখবো- এই চিন্তা করে আমি শুয়ে পড়ি। সারাদিনে পরিশ্রম কম হয় নাই। তাই ডবল বেডে পাঁচ জন প্যাকড হয়ে শুয়েও সাথে সাথেই ঘুমিয়ে গেলাম।

 

 

 

 

The Mighty INDIA CALLING: ফতেহপুর সিক্রিতে ‘মোঘলাই’ সম্রাজ্য এবং দিন শেষে গন্তব্য জয়পুর (পর্ব ১৭)

সকালে ঘুম ভাংগার সাথে সাথে মনে হলো ‘আমি কোথায়?’। কম্বলের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম আমার পাশে তমা শুয়ে আছে। দুইজনের মাঝখানে এত গ্যাপ আছে যে চাইলে আরও একজন অনায়াসে এই খালি জায়গাটায় ঘুমাতে পারবে। ট্যুরে আসার পর থেকেই মোটামুটি চারজনকে চাপাচাপি করে শুতে হয়েছে। এখানে তাই এত ফাঁকা জায়গা পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেলো এই আশংকায় যে আসলে আমি কোথায়। যাই হোক সবার শেষে ঘুম থেকে উঠে দাঁত মেজে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ব্যাগ আগেই গুছানো ছিলো বলেই দেরি করতে হলো না। সোজা সবাই বের হয়ে পড়লাম। তিনতলার সিড়ি দিয়ে লাগেজ নামাতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। হোটেলের এক জন লোক দৌড়ে এসে আমার লাগেজ নামিয়ে দিলো।

নিচে নেমে আমরা টিপস দিয়ে আবার ব্যাগ পত্র সব বাসের পিছনে জমা করলাম। হোটেলের নিচেই গোয়েল দাঁড়িয়ে ছিলো। সবাই গোয়েলের আশেপাশেই টং ঘর টাইপের দোকান থেকে ধোঁয়া ওঠা গরম চা আর বিস্কুট টাইপের জিনিসপত্র দিয়ে নাশতা খেতে লাগলো। আমি একটু এগিয়ে এক দোকান থেকে ব্রিটানিয়া কেক কিনে সেটা দিয়ে নাশতা করলাম। গোয়েলে ফিরে এসে দেখি এক ধরনের অদ্ভূত জিওমেট্রির খেলনা বিক্রি হচ্ছে। চিকন তার দিয়ে বানানো জিনিস্টাকে নাড়াচাড়া করে বিভিন্ন শেপ বানিয়ে ফেলা যায়। কয়েক জন ২০ রুপি দিয়ে সেই অদ্ভূত খেলনা কিনলো। আমরা বাসে উঠে বসলাম। ফতেহপুর সিক্রির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে দিতে প্রায় ১০টা বেজে গেলো।

পথে আমাদের ড্রাইভার কমিটির লোকজনকে ডেকে বললো যে উনার পরিচিত একজন গাইড আছে। ওনাকে ঠিক করলে উনি আমাদের সব কিছু ঘুরে দেখাতে পারবে। কমিটির লোকজন আমাদের মতামত নিয়ে রাজি হয়। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে দুই জন লোক উঠলো। তাদের একজন লিডার টাইপের অন্যজন তার চ্যালা টাইপের লোক। লিডার টাইপের যে লোক তাকে দেখে আমাদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। ইয়া মোটা, চশমা পরা ধুরন্দর চেহারার এক জন মানুষ। উনি বাসে উঠেই কমিটির লোকজনের সাথে টিকেট, বাস ভাড়া, গাইডের ভাড়া এই সব নিয়ে কমপ্লিট প্যাকেজ করতে লাগলো। আমরা তখন বুঝলাম যে আমরা দালালের খপ্পরে পড়েছি। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। এদের রিফিউজ করে দিলে সামনে গিয়ে আমাদের ঝামেলা হতে পারে। তাই আর কি করা, আমাদের ছেলেরা নেট দেখে দেখে উনার সাথে দর নিয়ে কষাকষি করতে লাগলো। সবশেষে পার হেড ৮০ টাকার কন্টাক্টে সব কিছু দফা হলো। এরপর উনি আমাদের সামনে এসে বিশাল এক লেকচার দিলেন। অনেক হাবিজাবি কথার মধ্যে জানালেন, এখানে জাহিদ হাসান আর মৌকে তিনি ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। ফতেহপুর সিক্রিতে মুঘলই আজম, পরদেশ, মেরি ব্রাদার কি দুলহান, যোধা আকবরসহ আরও অনেক সিনেমার শুটিং হয়েছে। এখানে সেলিম চিশতীর মাজারে গিয়ে অর্থ কড়ি/থালা ভর্তি জিনিস দান করলে মনের ইচ্ছা পূরণ হয়। এইসব শিরকী কথা শুনতে শুনতে আমাদের মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। সব শেষে উনি বললেন, ‘আগার ফতেহপুর নেহি হো তো জাহাঙ্গির নেহি হোতা, আগার জাহাঙ্গির নেহি হো তো শাহজাহান নেহি হোতা, আগার শাহজাহান নেহি হো তো তাজ নেহি হোতা’। আমরা ফতেহপুরের এই ‘বিশাল মাহাত্ম’ বুঝেই বাস থেকে নেমে গেলাম। আড়চোখে একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে লাগলাম- কার পাল্লায় পড়লাম কে জানে?

আমরা বাস থেকে নেমে গেট দিয়ে ঢুকে এক জায়গায় গেলাম। সেখান থেকে আরেকটা বাসে করে ফতেহপুরের গেটে নামলাম। গাইড আমাদের যা বললো তা হলো অনেকটা এরকম, আকবরের কোন উত্তরাধীকার ছিলো না বলে তিনি দরবেশ সেলিম চিশতের কাছে দোয়া নিতে আসেন। সেলিম চিশতের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন এবং এই ফতেহপুরে আকবরের পুত্র সেলিম বা জাহাঙ্গিরের জন্ম হয়। এরপর সেলিম চিশতকে দেওয়া কথা অনুযায়ী আকবর এখানেই রাজধানী স্থাপন করেন। তখন ১২ বছর ধরে সম্পূর্ণ রেড স্যান্ডস্টোনে তৈরি করা হয় এই ফতেহপুর সিক্রি। কিন্তু এরপর এখানে আকবর মাত্র কয়েক বছর থেকেই চলে যান লাহোরে। আমরা সবার আগে দেখলাম দিউয়ানে আম। সবুজ মাঠের এক পাশে আকবরের বসার জায়গা, আর প্রজারা সবাই বসতো খোলা মাঠে। এরপর ভিতরে ঢুকে দেখলাম দিউয়ানে খাস- সেই এক কলাম ওয়ালা মহল। ৩৬টা ব্রাকেটওয়ালা এই মোটা কলামটা পুরোটা জুড়েই পাথর খোদাই করে কারুকাজ করা। জৈন ধর্মের অনুপ্রেরনায় সেই কারুকাজ দেখে আমার চোয়াল ঝুলে পড়লো। কলামের ঠিক উপরে আকবরের বসার জায়গা। আর তারপাশের ব্রিজগুলোতে আকবরের মন্ত্রীরা বসতো।

দিউয়ানে খাসে সবাই লাইন ধরে ঢুকছে
দিউয়ানে খাসে সবাই লাইন ধরে ঢুকছে

আঁখ মিচাউলি বা কোষাগার দেখলাম। এটা আগে নাকি আকবরের রানীদের সাথে লুকোচুরি খেলার ঘর ছিলো। পরে এটা কোষাগার হয়ে যায়। এটা জৈন মন্দিরের অনুপ্রেরনায় বানানো মোটামুটি ছোট্ট ভবন যার দেওয়ালে ছোট ছোট খোপ খোপ করা। এগুলোতে নাকি ধন রত্ন থাকতো। মনে হলো একটু খুঁজে দেখি যদি দুই একটা হীরা মোতি পেয়েই যাই! তারপর দেখলাম পাঁচ মহল। পাঁচ তলার এই স্ট্রাকচারটা হয় মেয়েদের জন্য বানানো হয়েছিলো। নিচ তলায় সম্ভবত বাচ্চারা লেখাপড়া করতো। এর পাশেই আছে পানির ওপর অনুপ তালাও। এখানেই তানসেন গান গাইতো আর তার চারপাশে রয়াল লোকজনরা বসে উপভোগ করতেন। তারপর ছোট্ট একটা পাথরের বাথটাব দেখলাম। এটা নাকি কোন এক রানীর, সম্ভবত যোধার। এরপর ছোট্ট একটা ঘর যার নাম হুজরা এ অনুপ তালাও। এখানে হয়তো আকবরের কোন এক রানী থাকতো।

আকবরের নবরত্ন তানসেনের অনুপ তালাও, পানির ওপরের এই মঞ্চেই তানসেন গান গাইতো আর চারপাশে বসে রাজ পরিবারের লোকেরা তা উপভোগ করতো
আকবরের নবরত্ন তানসেনের অনুপ তালাও, পানির ওপরের এই মঞ্চেই তানসেন গান গাইতো আর চারপাশে বসে রাজ পরিবারের লোকেরা তা উপভোগ করতো

তারপর দেখলাম দিউয়ান খানা, পাচিসি কোর্ট- যেখানে খেলাধূলা হতো। খাব গাও, আবদার খানা, যোধা বাঈয়ের রান্নাঘর, বিরবলস হাউস এই সব দেখতে দেখতে টের পেলাম সবাই বাসে ওঠার জন্য ডাকাডাকি করছে। সবাই মনে হলো চলে গেছে। আমি একা একা ঘুরতে ঘুরতে যোধা বাঈয়ের প্যালেসে গিয়ে ইশতিয়াককে পেলাম। এই সেই প্যালেস যেখানে সামার প্যালেস আর উইন্টার প্যালেস দুইটা আলাদা সিজনে থাকার জন্য আলাদা মহল আছে। আর আছে যোধার জন্য ছোট্ট একটা মন্দির। কোনমতে এই প্যালেস দেখে আমি আর ইশতিয়াক দৌড় দিলাম। ততক্ষনে সবাই বাসে উঠে গেছে। আমি আর ইশতিয়াক উঠতেই বাস ছেড়ে দিলো। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো এখানে বাসের কোন দরকারই নেই। দালাল টাইপের লোকগুলা ইচ্ছা করেই আমাদের জন্য এরকম বাসের ব্যবস্থা করেছে।

তারপর এখান থেকে আমরা বাসে উঠে রওয়ানা দিলাম জামে মসজিদের দিকে। একটা কমপ্লেক্সের ভিতর চারদিকে মসজিদ আর মাঝখানে খোলা জায়গায় মুঘল রাজ বংশের সদস্যদের কবর। এর মধ্যে সাদা রঙের মার্বেলের জালি দেওয়া একটা ঘরের ভিতর সেলিম চিশতির কবর। এখানে ঢোকার আগে সেই লিডার টাইপের লোকটা আমাদের বলতে লাগলো, সেলিম চিশতের মাজারে গিয়ে আগর বাতি জ্বালাতে, টাকা পয়সা দান করতে আর থালা ভর্তি জিনিসপত্র দিয়ে আসতে। আমি ওনাকে গিয়ে বললাম মসজিদে মেয়েদের নামাজ পড়ার জায়গাটা কোথায় সেটা দেখিয়ে দিতে। লোকটা বেশ হতাশ হয়ে বললো মাজারে আগরবাতি জ্বালাবেন না? আমি না উত্তর দিতেই উনি বললো মেয়েদের জন্য আলাদা জায়গা নাই, যেখানে ইচ্ছা নামাজ পড়তে পারি। আমি তাড়াতাড়ি করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে ফেললাম। পরে দেখলাম আমাদের লোকজন অনেকেই মাজারের ভিতরে ঢুকেছে, সবাই একবার চক্কর দিয়ে বের হয়ে আসলো। সীমান্তকে দেখলাম থালা নিয়ে ভিতরে ঢুকতে। আমরা অনেকেই বাইরে বসে ছিলাম। আশেপাশে আজগুবি লোকজন ঘুরতে লাগলো আর এমনভাবে ভিক্ষা চাইতে লাগলো যেন তাদেরকে টাকা পয়সা দিলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ছোট ছোট বাচ্চারা ঘুরতে লাগলো আশেপাশে আর বলতে লাগলো, ‘এক শায়েরি বাতাউ?’। অনুমতি দিলে খুব সুন্দর করে ছন্দ মিলিয়ে শায়েরি বলতে লাগলো। আমরা সব শেষে বুলন্দ দরোয়াজায় গিয়ে বসলাম।

রাজকীয় বুলন্দ দারওয়াজা
রাজকীয় বুলন্দ দারওয়াজা (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

দি ম্যাজেস্টিক বুলন্দ দরোয়াজা। ভূমি থেকে ৫৫ মিটার উপরে অবস্থিত এই গেট হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত গেটওয়ে। আমরা অনেক্ষন সেখানে বসে ছিলাম। তারপর এক লোককে দেখলাম ফল কেটে বিক্রি করতে। আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম ফল খাওয়ার জন্য। ওনার পেপেটা কড়া মিষ্টি ছিলো। আমরা সবাই মিলে সব গুলো পেপে খেয়ে শেষ করে দিলাম। বাকি সব ফলও প্রায় শেষ করে আমরা হাঁটতে লাগলাম। এরপর এক জায়গায় এসে আমি তমা, আফরা, রিজভী, ইশতিয়াক আর জেরিন মিলে বাউন্ডারি ওয়ালের কাছাকাছি একটা কেমন যেন পাহারাদারের দাড়ানোর মতন জায়গায় বসে অনেক্ষন গল্প করলাম। সেখান থেকে দেখলাম আকবরের প্রিয় হাতির স্মরণে বানানো টাওয়ার যাকে বলা হয় হিরা মিনার। মনে মনে ভাবলাম, আকবরের হাতি হয়ে জন্মালেও আজকে আমার স্মরনে টাওয়ার বানানো হতো। আবার সবাই ডাকাডাকি করতেই আমরা নেমে পড়লাম। গোয়েল থেমে আছে সেই হিরা মিনারের নিচে। সবাই বাসে উঠে পড়লাম। সেই দালালগুলোকে সহ আমাদের বাস চলতে শুরু করলো। আমরা সবাই ৮০ রুপি করে বের করে দিলাম। গোয়েলকে নিয়ে তারা থামালো এক ঝাঁ চকচকে হোটেলে। সব সাদা চামড়া টুরিস্টরা ছাতা দেওয়া টেবিলের বসে লাঞ্চ খাচ্ছে। হোটেল দেখেই আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। এত দামি হোটেলে আমরা খেতে পারবো না সেটা বাইরে থেকেই দেখে বোঝা গেলো।

আমাদের দালাল গ্রুপ সেখানেই আমাদের থেকে বিদায় নিলো। আমরা যাত্রা শুরু করলাম জয়পুরের উদ্দেশ্যে। দুপুর পার হয়ে বিকাল হয়ে যেতে লাগলো। কোথাও খাওয়ার জন্য থামা দরকার। ড্রাইভার রাস্তার পাশে এক ধাবায় থামালো। পুরাই টিপিকাল ধাবা। কয়েকটা খাটিয়া আছে বসার জন্য। আর একটা টিনের ঘর, সেখানে সারি সারি চকচকে ডেকচি সাজানো। আমরা গিয়ে ডেকচিতে উঁকি মেরে দেখলাম সেগুলো প্রায় সব গুলোই পরিষ্কার খালি ডেকচি রেখে দেওয়া হয়েছে সৌন্দর্যের জন্য। খাবারের মেনু দেখে আমাদের সুবিধার মনে হলো না। আমরা আবার বাসে উঠে রওয়ানা দিলাম। এরপর খানিক পরে আরেকটা ধাবায় গিয়ে থামলাম। সেটারও প্রায় একই অবস্থা। আমাদেরকে জুবায়ের বললো যে এই এলাকায় এর চেয়ে ভালো খাবার পাওয়া যাবে না। তাই এখানে যা আছে সেটাই কষ্ট করে খেয়ে নেওয়া ভালো। ওরা কথা বলে সবার জন্য ৫০ রুপিতে ডাল, সবজি আর দুইটা করে রুটি অর্ডার দিলো। আমরা কড়া রোদের মধ্যে খাটিয়ায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। অনেকে আবার বাথরুমের খোঁজ করতে গেলো। বাথরুমের সন্ধান পেয়ে আমাদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। চারটা বাঁশ পুঁতে তাতে সিমেন্টের বস্তা দিয়ে ঘিরে বাথরুম বানানো হয়েছে। আমরা সব দেখে টেখে চরম ভয় পেয়ে গেলাম। জুবায়ের আমাদেরকে আরও বলতে লাগলো ‘এখন থেকে শুরু হবে ওয়াইল্ড সেভেন ডেজ’। যাই হোক যখন আমরা রোদে পুড়ে খাক হয়ে গেলাম তখন আমাদের খাওয়া আসলো। রুটিগুলা একদম পোড়া, বিস্বাদ মটর দেওয়া সবজি আর পানসে ডাল। মুখে দিয়েই টের পেলাম অনেক ঝাল। আমি একটু চিনি চেয়ে নিলাম। অনেক কষ্টে একটা রুটি চিনি দিয়ে খেলাম। আর কিছু খেতেই পারলাম না। অনেকে আবার লাচ্ছি অর্ডার দিলো। আমার আর কোন কিছু খাওয়ার প্রতি রুচি ছিলো না। আমি কোনমতে হাত ধুয়ে গোয়েলে উঠে বসলাম। তারপর সবাই একে একে বাসে উঠার পর দেখা গেলো উনারা বলছে আমরা নাকি চার গ্লাস লাচ্ছির দাম দেই নাই। অনেক্ষন ধরে গবেষনা করেও বিল দেয় নাই এরকম কাউকে পাওয়া গেলো না। অগত্যা সীমান্ত ১২০ রুপি গচ্চা দিলো।

efd
সত্যিকার ধাবাতে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় আরমিন রহমান মৌলি)

বাস চলতে শুরু করলো। দুপাশে সব গ্রামের দৃশ্য। সবুজ খেত। কোন ঘরবাড়ি নাই। এক সময় সন্ধ্যা নেমে আসলো। অন্ধকার হয়ে গেলো চারদিক। সবাই চুপচাপ হয়ে গেলে এক পর্যায়ে আমি পাশের রোতে বসে থাকা ইশতিয়াকের সাথে বাংলাদেশ আর ইন্ডিয়ার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করতে লাগলাম। আমাদের কথায় দুই দেশের  ট্রান্সপোর্ট, আর্কিটেকচার, খাওয়া দাওয়া এই সব উঠে আসতে লাগলো। খাওয়া দাওয়া প্রসঙ্গ আসতেই মিষ্টির কথা উঠলো। টাঙ্গাইলের ছেলে ইশতিয়াক আমাদের দেশের মিষ্টি আর ইন্ডিয়ার মিষ্টির চুলচেরা বিশ্লেষন আমাকে বুঝাতে লাগলো। আমাদের দেশের মিষ্টির সাথে ওদের দেশের মিষ্টির পার্থক্য আমি ইশতিয়াকের কথায় পরিষ্কার বুঝতে পারলাম। মিষ্টি পর্ব শেষ করে আমরা অন্য খাওয়া দাওয়ার কথা তুলতেই পিছন থেকে কে একজন ধমক লাগালো, ‘উফ, তোরা থামবি? কতক্ষন ধরে এই দুইটা খাওয়া দাওয়ার কথা বলতেসে। খবরদার আর যদি বলসিস এই খাবার দাবার নিয়ে কথাবার্তা……’। দেখলাম অনেকেই এতে সমর্থন জানালো। বুঝলাম একে তো দুপুরে বিশ্রি খাবার খেয়ে সবার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে, তার উপর অনেকদিন ধরে গরম ভাতের সাথে আলু ভর্তা, ডালের মত টেস্টি খাবার গুলাকে আমরা সবাই মিস করছি। তাই আমাদের খাবার দাবার নিয়ে আলোচনা কেউ সহ্য করতে পারছে না। কি আর করা, আমাদের ইন্টারেস্টিং আলোচনা সেখানেই শেষ হয়ে গেলো।

এর মধ্যে এক পেট্রোল পাম্পে আমাদের বাস থামল। আমরা সবাই নেমে বাথরুমে গেলাম। মোটামুটি পরিষ্কার বাথরুম কিন্তু বদনা নাই। আমি বাস থেকে খালি বোতল নিয়ে আসলাম। তারপর সবাই সেই বোতল নিয়ে বাথরুমে গেলো। তারপর পাশেই এক দোকান থেকে সবাই চা অর্ডার দিয়ে আগুনের কুন্ডুলির চারপাশে চেয়ার নিয়ে বসলাম। ওদিকে পেট্রল পাম্পের লোকজন অভিযোগ জানালো যে আমরা কোন পেট্রোল নেই নাই অথচ তাদের বাথরুম ব্যবহার করেছি, এটা তো ঠিক না। এমন অভিযোগ শুনে আমরা কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। পরে সবাই ১০ রুপি করে দিয়ে আসি উনাদের হাতে। তারপর আবার বাসে উঠি, এবং যথারীতি গোয়েল চলতে থাকে।

প্রায় রাত ৮টার দিকে আমরা জয়পুরে প্রবেশ করি। রাস্তার দুপাশে ঝকমকে উঁচু দালান আর ঝাঁ চকচকে শপিং মলের সারি দেখে আমাদের মুখ হাঁ হয়ে যায়। এত দামী জায়গা জয়পুর শহর- আমার জানা ছিলো না। আমরা রাস্তার দুপাশে বড় বড় চোখ করে দেখতে থাকি। শপিং মল ছাড়াও আরও একটা জিনিস আমাদের চোখে পড়লো আর সেটা হলো বিয়ে।  কমসে কম হলেও ১২-১৫টা বিয়ের আসর আমাদের চোখে পড়লো। খোলা মাঠ প্যান্ডেল টানিয়ে, অনেক বিশাল জায়গা জুড়ে লাইটিং করে বিয়ে গুলো হচ্ছিলো। দেখে আমাদের বুঝতে কষ্ট হলো না যে এ সবই ধনকুবেরদের অনুষ্ঠান। আমাদের অনেকেই তো ঠিক করে ফেললো যে রাতে কোন একটা বিয়ে বাড়িতে ঢুকে খেয়ে আসবে।

আমাদের জন্য কমিটির লোকজন হোটেল ঠিক করলো ‘রঘুরাজ প্যালেস’। খুব সুন্দর হোটেল। আমরা রুম পেলাম দোতলায়। চমৎকার রুম, ঝকঝকে বাথরুম। রুম পছন্দ হওয়ায় আমরা আবার গলা ছেড়ে গান গাইতে শুরু করলাম আর সাথে তাল মিলিয়ে নাচতে লাগলাম। প্রায় সাথে সাথেই নিলয় দরজা নক করে বলে দিলো বেশি গান বাজনা না করতে, কারণ আশেপাশে নানা রকমের মানুষজন আছে। সো চুপচাপ থাকাই ভালো। ওর কথা শুনে আমরা থেমে গেলাম। এর মধ্যে মিমকে আমাদের রুমে পাঠানো হলো থাকার জন্য। আমরা রুম সার্ভিসে খাবার অর্ডার দিলাম ম্যাগী মাঞ্চুরিয়ান। তারপর নিচে নেমে ডাইনিঙে খেতে বসলাম শুধু পানি আর মশলা দিয়ে সিদ্ধ করা এক বাটি নুডুলস। খেয়ে দেয়ে আবার আমরা রুমে ফেরত আসলাম। ডাবল বেডে পাঁচজন মানুষকে শুতে বেশ কসরত করতে হলো। তারপরও শোয়ার প্রায় সাথেসাথেই সবাই গভীর ঘুমে ঢলে পড়লো।

 

 

 

 

 

The Mighty INDIA CALLING: আগ্রায় একদিন এবং যথারীতি ফোর্ট ও তাজমহল দর্শন (পর্ব ১৬)

বাস বলতে গেলে প্রায় গভীর রাতেই আগ্রায় পৌঁছালো। কিন্তু আমরা কেউ নড়লাম না। কম্বল জড়িয়ে তার নিচেই পড়ে রইলাম। সারারাত আমার বিন্দু মাত্র ঘুম হয় নাই। ক্লান্তিতে দুই চোখ খুলতে পারছিলাম না। ঠান্ডা ওয়েদারের মধ্যে বাসের ভিতর আরাম করে বসে রইলাম আমরা। আলো ফুটতে শুরু করলে আমরা একটু একটু নড়তে থাকি। চোখ খুলে আমরা বুঝলাম আমরা আছি তাজমহলের পার্কিং লটে। কমিটির লোকজন যায় তানভীরের আব্বুর দেওয়া পারমিশন লেটার কাজে লাগিয়ে সাধারন টিকেট কাটতে। আর বাকি আমরা সবাই গুটি গুটি পায়ে বাস থেকে নেমে বাথরুমের দিকে রওয়ানা হই।

মেয়েদের বাথরুমটা খুবই চমৎকার। আমরা লাইন ধরে হাতমুখ ধুয়ে, দাঁত মাজতে লাগলাম। এতগুলো মানুষ আমরা একসাথে দাঁত মাজছিলাম- বেশ মজাই লাগছিলো। ফ্রেশ টেশ হয়ে আমরা আবার বাসের দিকে রওয়ানা দেই। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখলাম বেশ কয়েকটা হাইফাই টুরিস্ট বাস সাদা চামড়া টুরিস্ট নিয়ে আসলো। বুড়ো টুরিস্টদেরকে আবার তাদের গাইডরা হাত ধরে ধরে নামিয়ে দিচ্ছে। দেখে আমরা বেশ হাসাহাসি করলাম। ওদিকে কমিটির লোকজনকে ফিরে আসতে দেখলাম। ওরা এসে জানালো যে, এখানে অফিসাররা দশটার আগে আসবেন না। আর অফিসাররা না আসা পর্যন্ত এই পারমিশন লেটার রিসিভ করার এখতিয়ার কারও নাই। ওদিকে সারা এলাকায় এ কথা চাউর হয়ে গেছে যে বাংলাদেশ থেকে ৪৬ জনের একটা দল এসেছে। তাই এখন যদি আমরা ভিতরে ঢুকতে চেষ্টা করি তাহলে গেটে অবশ্যই আমাদের ধরে ফেলবে। ওদিকে সকাল দশটা বাজতে এখনও অনেক ঘন্টা বাকি। সব চিন্তা ভাবনা করে আমরা ডিসিশন নিলাম আপাতত তাজমহল যাওয়া হচ্ছে না। বাসে উঠে আমরা রওয়ানা দিলাম আগ্রা ফোর্টের দিকে।

আগ্রা ফোর্টে নেমে আমরা ২০ রুপি দিয়ে সাধারন টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকার চেষ্টা করি। ফাহাদ টানা হিন্দিতে কথা বলে আমাদের টিকেট কেটে দেয়। কিন্তু লোকগুলো অত্যন্ত চাল্লু। তারা আমাদের দেখেই সন্দেহ প্রকাশ করতে লাগলো যে আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এর মধ্যে রিন্তুর ব্যাগ সার্চ করে টাকা  উদ্ধার করলো এক মহিলা গার্ড। তখন আর কি করা, আমরা সবাই ৫০ রুপি দিয়ে সার্কভুক্ত দেশের টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকি। ঢুকতেই উঁচু ওয়াল দিয়ে ঘেরা ঢালের উপর তিনটা গেট। গেটগুলোর পজিশন এমন যে একটা গেট থেকে অন্যটা দেখা যায় না। যুদ্ধ লাগলে এই গেটগুলো দিয়ে গরম তেল ঢেলে দেওয়া হতো শত্রুপক্ষের দিকে। ভিতরে ঢুকেই পুরো জায়গাটা এক বার চক্কর দিয়ে ফেলি। তারপর নোভাকে দেখি গাইড ঠিক করতে। এরপর গাইড নিয়ে আমরা আবার প্রথম থেকে ঘোরা শুরু করি। নিজে নিজে ঘুরলে আসলে কিছুই বোঝা যায় না। গাইডের কথায় পুরো আগ্রা ফোর্ট যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে আমাদের চোখে।

একটা বড় সবুজ মাঠ পার হয়ে আমরা মূল অংশে ঢুকি। বিশাল গেটে আকবরের তিন স্ত্রীর জন্য হিন্দু, ইসলাম আর জৈন- এ তিন রকম ধর্মের প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে। সবার আগে দেখলাম লাল স্যান্ডস্টোনের জাহাঙ্গিরি মহল। এর সামনে আকবর বা জাহাঙ্গির কারও এক জনের পাথুরে বাথটাব দেখলাম। জাহাঙ্গিরি মহলের ভেতরটা ভালো করে দেখলাম। লাল পাথরের অপরূপ কারুকাজ, ভারী চমৎকার লাগলো দেখতে। এর পর যে অংশটায় ঢুকলাম সেখানকার মোটা ওয়ালের ভিতর দিয়ে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করে এসির মত টেম্পারেচার বানিয়ে ফেলার সিস্টেম দেখলাম। একটা মীনা মসজিদ দেখলাম। তারপর আঙ্গুরের বাগান। এই আঙ্গুর থেকে খুব সম্ভবত মদ তৈরি করা হতো।

তারপর গেলাম মুসাম্মান বুর্জে। এটা শাহজাহানের শোবার মহল। এখানে আওরঙ্গজেব শাহজাহানকে শেষ জীবনের ৮ বছর বন্দী করে রেখেছিলো। ততদিনে শাহজাহানের পাগলামি চরম রূপ ধারন করেছে। সাদা তাজের পর কালো গ্রানাইটের আরও একটা তাজ বানানোর ভূত তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তাই আওরঙ্গজেবের পক্ষে পিতাকে বন্দী করে রাখা ছাড়া আর কোন অপশন ছিলো না। সাদা মার্বেলের এই মহলের বারান্দা থেকে আকবর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যমুনার ওপাশের তাজমহল দেখতেন আর কাঁদতেন। কাঁদতে কাঁদতে তার নাকি চোখের জ্যোতি কমে গিয়েছিলো। তখন তার মেয়ে মুসাম্মান বুর্জের দেয়ালে গর্ত করে কোহিনূর পুঁতে দিয়েছিলেন। দূর্বল চোখ জোড়া দিয়ে সেই কোহিনূরের মধ্যে তাজ মহলের রিফ্লেকশন দেখতেন শাহজাহান। এই বুর্জেই শাহজাহানের মৃত্যু ঘটে। এখান থেকে সিঁড়ি দিয়ে লাশ নামিয়ে নৌকা করে যমুনা নদী পার করে তাজ মহল নিয়ে যাওয়া হয়। পুরো মুসাম্মান বুর্জের বাইরের অংশে সাদা মার্বেলের উপর রঙ্গিন পাথরের ফুল, লতা পাতা ইন লে করে ঢুকানো। এই জিনিসটা কাছ থেকে দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। আর ভিতরে একটা দেওয়াল থেকে নেমে আসা ফোয়ারা আছে যাতে পুরো মহলে পানির নহর বইতে থাকে সবসময়। এছাড়া ভিতরের দেওয়ালে পাথরে গর্ত করে সোনা দিয়ে অর্নামেন্টেশন করা ছিলো। ইংরেজরা এসে আগুন দিয়ে গলিয়ে সব সোনা বের করে নিয়ে যায়। সে আগুনের পোড়া দাগ স্পষ্ট বোঝা যায়। মুসাম্মান বুর্জের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যমুনার পাড়ে কুয়াশার ভিতর আবছায়া তাজ মহলকে দেখতে পেলাম। চোখ সরাতে পারছিলাম না সেই ছোট্ট ‘তাজ’ এর উপর থেকে।

asd
কুয়াশায় ঢাকা ছোট্ট তাজ (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম)

তারপর দেখলাম শাহজাহানের দুই অবিবাহিত মেয়ের জন্য দুইটি ছোট ছোট মহল। এগুলো দেখতে পাল্কির মতন। ছাদটা চৌচালা, সোনালি রঙের পিতলের। এই দুটা মহলের ছাদ নাকি সোনার তৈরি ছিলো। ইংরেজরা এসে সব সোনা তুলে নিয়ে যায়। পরে পিতল দিয়ে একটা ছাদ বানানো হয়। এর পাশেই আছে খাস মহল বা দিউয়ানে খাস। এটাও সাদা মার্বেলের তৈরি। এক সময় এর ভিতরেই ছিলো শাহজাহানের কোহিনূর হীরা খচিত ময়ুর সিংহাসন। এখন এর বাইরে আছে দুইটা সিংহাসন- একটা সাদা মার্বেলের অন্যটা কালো গ্রানাইটের। কালো সিংহাসনটা তখতে জাহাঙ্গির যার একটা কোনা ভাঙ্গা। যুদ্ধের সময় ইংরেজদের কামানের গোলা এসে এই সিংহাসনে লাগে, সেখান থেকে ছিটকে গোলাটা দিউয়ানে খাসের দেওয়ালেও গর্ত তৈরি করে দেয়। এখান থেকে সামনে তাকালে একটা বাগান চোখে পড়ে। এখানে আগে পুকুর ছিলো। সেখানে রঙ্গিন মাছ ঘুরে বেড়াতো। আকবর আর আকবরের স্ত্রী তীর ধনুক দিয়ে সেই মাছ শিকার করতো।

এই সবুজ ঘাসের জায়গাতেই ছিলো রঙ্গিন মাছের পুকুর
এই সবুজ ঘাসের জায়গাতেই ছিলো রঙ্গিন মাছের পুকুর

এরপর একে একে দেখলাম শাহী হাম্মাম, মোতি মসজিদ, নাগিনা মসজিদ, শিশ মহল। শিশ মহলের ভিতর তখন কাজ চলছিলো। আমরা ঢুকতে পারলাম না। তবে ফাঁক দিয়ে দেখলাম। এটা ছিলো শাহজাহানের স্ত্রীর সাজ ঘর। পুরো মহলটা ছোট ছোট কাঁচের টুকরা দিয়ে সাজানো। এর ভিতর একটা মোমবাতি জ্বালালে পুরো কক্ষটাই আলোকিত হয়ে উঠে। এছাড়া মুসাম্মান বুর্জ থেকে তাজ মহলের যে ভিউ দেখেছিলাম, সেখান থেকে অনেক দূরের আরেকটা বারান্দা থেকে তাজ মহলের ভিউ দেখে চমকে উঠলাম- এ কি, তাজ মহলকে আগের চেয়ে বড় মনে হচ্ছে তো!  অথচ এটা মুসাম্মান বুর্জ থেকে অনেক দূরে। ফিজিক্সের নিয়ম অনুযায়ী এখান থেকে তাজকে আরও ছোট দেখার কথা। একবার ভাবলাম চোখের ভুল। পরে গাইড হেসে জানালেন, এটা আসলে অপ্টিকাল ফ্রেমিং এর কারসাজি। এরকম আরও অনেক কারসাজি লুকানো আছে এই ফোর্টের আনাচে কানাচে। আমি পুরা তাজ্জব হয়ে গেলাম। এরপর দেখলাম দিউয়ানে আম। সাদা মার্বেলে ডাবল ডাবল আর্চ করা ভারি সুন্দর মহল। এখানে সিংহাসন থেকে তাকালে এক অদ্ভূত কারণে কলামের পিছনে বসে থাকা সব মানুষকেই দেখা যায়। এখানেও আগে একসময় সোনার কারুকাজ ছিলো।

এই সব দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিলো আমি ফিরে গেছি সেই মুঘল আমলে। সেই শানদান, সেই বিলাসিতা, সেই আভিজাত্য, সেই মেধা যেন নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম। গাইড আমাদের অনেক মজার তথ্য দিলেন। যেমন- আকবরের প্রিয় ছিলো রেড স্যান্ডস্টোন আর শাহজাহানের প্রিয় ছিলো সাদা মার্বেল। এই ফোর্টের যে অংশটুকু লাল সেটা আকবরের বানানো, আর যে অংশটুকু সাদা সেটা শাহজাহানের বানানো। এছাড়া মুঘলদের সময় দরজার প্রচলন ছিলো না। বড় বড় মহলের কোনটাতেই আমরা দরজা দেখি নাই। দরজার জায়গায় বড় বড় আংটা থেকে পরদা ঝুলানো হতো আর সব জায়গাতেই রক্ষী দাঁড়িয়ে থাকতো। আমরা গাইডকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার পাওনা মিটিয়ে দিলাম। পার হেড খরচ পড়লো ৪০ রুপি করে। আমাদের এখান থেকে নড়তে ইচ্ছা করছিলো না। কিন্তু সবার তাড়া খেয়ে একসময় আস্তে আস্তে ফোর্ট থেকে বের হয়ে যেতে থাকি।

ফোর্টের বাইরে এসে রাস্তা পার হয়ে আমরা গোয়েলে উঠে বসি। সকালে কিছু খাওয়া হয় নাই। তারুপর এত হাঁটা হলো। কিন্তু কিছু কিনতে পারলাম না। বাস আমাদের নিয়ে রওয়ানা হলো হোটেলের খোঁজে। প্রকাশ টুরিস্ট কমপ্লেক্স নামের এক হোটেল ঠিক করা হলো। আমরা গোয়েল থেকে আমাদের লাগেজ নামিয়ে টেনে টেনে হোটেলের উঁচু প্লিন্থে তুলতে লাগলাম। এক তলায় আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে লাগেজ রাখতে গেলে দেখলাম রুমটা অনেক ছোট। মজুমদার বললো এই রুমটা তিনজনের জন্য। আমাদের যেকোন একজনকে তিন তলায় অন্য একটা রুমে যেতে হবে। আমি কোন কিছু না ভেবেই বলে ফেললাম, ‘তোরা থাক, আমিই যাচ্ছি’। তিনতলায় এই লাগেজ টেনে টেনে তুলতে আমার ঘাম বের হয়ে গেল। তারপর অবশেষে বারান্দার শেষ মাথার রুমে গিয়ে হাজির হলাম। দেখি রুমে অলরেডি সুমাইয়া এসে বসে আছে। তারপর আসলো তমা, সব শেষে আসলো অবনী।

রুমটা হিউজ। অনেক বড়। বিছানাটাও বিশাল। চারজন কেন, অনায়াসে ছয় সাত জন এখানে থাকা যাবে। বাথরুমটাও অনেক বড়। সেখানে বিছানা ফেললেও দুই তিন জন আরামসে ঘুমাতে পারবে। বাথরুমের কমোডটা বেশ ইন্টারেস্টিং। এটাকে চাইলে ইচ্ছামত হাই কমোড বা লো কমোড হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আমরা তাড়াতাড়ি ফ্রেশটেশ হয়ে নিলাম। দুপুর বেলায় বাইরের ঠান্ডা অনেক কমে গেছে। সব সোয়েটার খুলে একটা মাত্র সোয়েটার ব্যাগে ঢুকিয়ে বের হয়ে পড়লাম। আমি আর রুবাইদা গেলাম হোটেলের সামনে ফৌজি ধাবা নামের এক খাওয়ার দোকানে। আগ্রা টুরিস্ট শহর বলেই হয় তো এই দোকানে সব কিছুর দাম বেশি। আমাদের অনেকেই এখানে কয়েকটা আইটেম অর্ডার দিলো। কোনটাই তেমন ভালো ছিলো না। আমরা অর্ডার দিলাম ৮৫ রুপির ভেজ চাওমিন। প্রায় ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করার পর যখন চাওমিনটা আমাদের সামনে আসলো, দেখেই আমার তেমন সুবিধার মনে হলো না। মুখে দিয়ে দেখলাম- আমার সন্দেহই ঠিক। চাওমিনটা শক্ত, ঠিকমত সিদ্ধ হয় নাই আর সাথের সবজি গুলো অলমোস্ট কাঁচা। অত্যন্ত বিস্বাদ এই চাওমিন খেতেও ভয় লাগছিলো, পেটে সইবে তো!

যাই হোক কোন রকম চাওমিন খেয়ে আমরা আবার আমাদের হোটেলের সামনে ফেরত আসি। সেখানে মজুমদার আমাদের ইন্সট্রাকশন দেয়। যেহেতু আগ্রা ফোর্টে আমরা ধরা খেয়েছি, তাই তাজ মহলে আমাদের অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। এইখানে ধরা খেলে ব্যাপক গচ্চা দিতে হবে। আগেরবার সবাই দল বেঁধে ঢুকেছিলাম, এই বার আমরা ছোট ছোট দলে দুই তিন জন করে করে যাবো। এবং আমরা যে একটা টিম সেটা কোন ভাবেই তাজমহলের বাইরে এমনকি ভিতরেও প্রকাশ করা যাবে না। ভিতরে আর বাইরে নাকি প্রচুর দালাল ঘোরাফেরা করে। সব কিছু শুনে আমি বেশ থ্রিল ফিল করলাম। সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে মজুমদার, ইশতিয়াক আর নিলয় রওয়ানা দিলো। ওদের সাথে দূরত্ব রেখে আমি আর রুবাইদা রওয়ানা দিলাম।

আমাদের হোটেল থেকে তাজ বেশ কাছেই ছিলো। আমরা হেঁটে হেঁটেই পৌঁছে গেলাম। টিকেট কাউন্টারের কাছে আসতেই আমি আর রুবাইদা আলাদা হয়ে গেলাম। আমি রাস্তার একপাশে পাথুরে বসার জায়গায় বসলাম। রুবাইদা অন্যপাশে মজুমদার আর ইশতিয়াকের সাথে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে বসলো। রুবাইদা বেশ আয়েশ আয়েশ ভঙ্গিতে বসে থাকলো। আমি চোখের কোনা দিয়ে দেখতে লাগলাম। নিলয় এর মাঝে কই উধাউ হয়ে গেছে কে জানে। মজুমদার আর ইশতিয়াক খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলছিলো। আমার আর রুবাইদার টিকেট ওদের কেটে দেওয়ার কথা। তাই আমি লক্ষ্য রাখছিলাম ওরা কি করে। এক পর্যায়ে মজুমদার টিকেট কাটে। তারপর রুবাইদাকে পাস করে যাওয়ার সময় কোন কথা না বলে দুইটা টিকেট ওর কোলের উপর রেখে চলে যায়। রুবাইদা রাস্তা পার হয়ে এসে একটা টিকেট আমার সামনে রেখে বিড়বিড় করে বলে, ‘আমি যাওয়ার কিছুক্ষন পর তুমি রওয়ানা দিও’। তারপর উল্টা ঘুরে রুবাইদা হাঁটা দেয়। আমি তখন উত্তেজনায় টগবগ করছিলাম। আমার মনে তখন মিশন ইম্পসিবলের থিম মিউজিক বাজতে লাগলো। আমার মনে হচ্ছিলো আমি বোধহয় মিশন ইম্পসিবল মুভির মত কোন মিশনে অংশ নিচ্ছি। চারিদিকে শত্রুর দল। এর মাঝে নিজের পরিচয় গোপন করে কড়া সিকিউরিটি চেকিং পার হয়ে দূর্গে ঢুকতে হবে। অত্যন্ত প্ল্যানড উপায়ে আমরা ঠান্ডা মাথায় আমাদের মিশনকে সাক্সেস্ফুল করার জন্য চেষ্টা করছি!

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে রুবাইদাকে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখলাম। ঘড়ি ধরে ঠিক তার দুই মিনিট পর আমি উঠে দাঁড়ালাম। সোজা হাঁটতে লাগলাম গেটের দিকে। একা একা চারপাশটা দেখতে দেখতে আমি এগিয়ে যেতে লাগলাম। চারপাশে নানা বয়সী অনেক মানুষ, সারা ইন্ডিয়ার থেকে মনে হলো যেন মানুষ এসেছে। সাউথ, মারাঠি, গুজরাটি সব ধরনের পোশাক পরা মানুষ দেখলাম।  লাইন ধরে ধরে ভিতরের দিকে যাওয়ার সময় আমি মেয়েদের লাইনের দিকে গেলাম। আমার কপাল ভালো, লাইনে আমার সাথেই দাঁড়ালো বোরখা পড়া এক মুসলমান পরিবার। অনেক বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সেই চার পাঁচ জন মহিলা নিজেরা কথা বলতে বলতে আমার আসে পাশে এসে ভিড় করলো। যে মহিলা আমাকে চেক করছিলো সে আমাকেও নিশ্চয়ই ওই পরিবারের কেউ মনে করলো। আমার দিকে কোন সন্দেহর দৃষ্টি না দিয়েই আমাকে ভিতরে ঢুকার জন্য ছেড়ে দিলো। আমি বুকে আটকে থাকা নিশ্বাসটা ছেড়ে দিলাম। যাক বাবা, মিশন সাকসেসফুল।

আমি তাড়াতাড়ি করে গেটের ভিতর দিয়ে হেঁটে ঢুকে গেলাম। চার পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলাম পরিচিত কাউকে দেখতে পাওয়া যায় কিনা। একা একা হাঁটতে হাঁটতেই গাছ তলায় রুবাইদাকে বসে থাকতে দেখলাম। আমি হাসি হাসি মুখে এগিয়ে গেলাম। রুবাইদাও আমাকে দেখে এক গাল হাসি দিলো। যাই হোক ২০ রুপির টিকেট দিয়েই ভিতরে ঢুকতে পারলাম। এবার দেখা যাক ‘তাজ মহল’।

আদস
সাদা ধব্ধবে রাজসিক তাজ মহল (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম )

একটু এগিয়ে যখন একটা আর্চের ভিতর দিয়ে দেখতে পেলাম সাদা ধবধবে বিল্ডিংটাকে, বুঝলাম সত্যি সত্যি এসে গেছি পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের সামনে। চারটা মিনারের মধ্যে বসে থাকা এই রাজসিক মহলের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলো না। তাজকে নিয়ে আর কি বলবো, যারা একবার গিয়েছে তারা তো দেখেছেই, আর যারা যায় নাই তাদের বুঝাতে গিয়ে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে ছবি তুলতে লাগলাম আমরা। ধীরে ধীরে এগিয়ে কাছে যেতে লাগলাম। যত কাছে যাচ্ছিলাম ততই মহলটার স্কেল বাড়তে লাগলো। শত শত মানুষের সাথে আমরা স্যান্ডেল জমা দিয়ে লাইন ধরে তাজ মহলের বেসে উঠলাম। ঠান্ডা সাদা মার্বেলের সাথে আমার পায়ের স্পর্শ হওয়ার সাথে সাথেই এক ধরনের শিহরন লাগলো। সেই কত শত বছর আগে মুঘল বাদশাহরা এই সাদা মার্বেলের উপর দিয়ে হেঁটে গেছেন, কত হাজার হাজার শ্রমিকের নিঁখুত হাতের ছোঁয়ায় মসৃন চারকোনা হয়েছে এই মার্বেল- আজকে আমি ধরে দেখছি সেই মার্বেল!

আমরা চারপাশে ঘুরতে লাগলাম। যমুনা নদীকে দেখলাম শুকিয়ে একটা নালার মত হয়ে আছে। রেড স্যান্ডস্টোনের তৈরি মসজিদটাও দেখলাম। তারপর লাইন ধরলাম তাজের ভিতরে ঢুকার জন্য। বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে ভিতরে ঢুকার সময় ধরে ধরে দেখছিলাম মার্বেলে খোদাই করা প্রত্যেকটা শিরা উপশিরা আর রেনুসহ জ্যান্ত ফুলগুলো, তাদের নুয়ে পড়া পাপড়ি আর পাতাগুলো। শক্ত পাথরে খোদাই করা ফুলগুলোর মধ্যে এমনই কমনীয়তা আছে মনে হচ্ছিলো আঙ্গুল লাগলেই তারা নড়ে উঠবে। একসময় ভিতরে ঢুকলাম লাইন ধরে। একেবারে মধ্য খানে টম্ব চেম্বারটা বেশ অন্ধকার। উপরে টিমটিমে একটা সাদা লাইট জ্বলছে। এখানে আছে শাহজাহান আর মমতাজের কবরের উপরিভাগ। এই বরাবর নিচেই শুয়ে আছে শাহজাহান আর মমতাজ। আগে নিচে যাওয়ার একটা রাস্তা সবার জন্য খোলা ছিলো। এখন সেখানে আর কাউকে যেতে দেয় না। আমরা তো আর নিচে যেতে পারছি না, মার্বেলের জালির মধ্য দিয়ে কবরের উপরিভাগটাই দেখলাম। আমার এক সময় মনে হলো, এত শান শওকত, এত স্থাপত্য, এত মুগ্ধতা, এত বাহবা- সব কিছুই আছে মাটির উপরে। মাটির নিচের জগতে যারা শুয়ে আছেন শত শত বছর ধরে তাদের কাছে এইসব তো অর্থহীন। মৃত্যু পরবর্তী জীবনে এইসবের কোন অস্তিত্ব কি তারা টের পাচ্ছেন?

আমরা মুগ্ধ হয়ে সব দেখতে লাগলাম। ভেতর থেকে একসময় বের হয়ে আসলাম। ততক্ষনে সূর্য হেলে পড়তে শুরু করেছে। লোকজনও সবাই কমতে শুরু করেছে। আমরা দ্বিমিকবাসীরা অল্প অল্প করে জড়ো হতে লাগলাম। চটপট করে বাংলাদেশের পতাকা বের করে তাজ মহলের সামনে গ্রুপ ফটো তুলে ফেললাম। ওদিকে সিকিউরিটি সবাইকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য বলতে লাগলো। আমরা খুব আস্তে আস্তে বের হওয়ার রাস্তার দিকে আগাতে লাগলাম। ততক্ষনে অন্ধকার নেমে গেছে আর পুরো কমপ্লেক্স খালি হয়ে গেছে। আমরা বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলাম তাজকে। যখন বিকালের সূর্য ছিলো তখন এক রকম রূপ, সূর্য ঢলে পড়তেই অন্য রকম রূপ, আর এখন অন্ধকারে আবার যেন রূপ বদলে গেলো তাজের। অন্ধকারের মধ্যেও সাদা আলোর একরকমের দ্যুতি ছড়াতে লাগলো তাজ। আর ভিতরের টিমটিমে আলোটাই যেন পুরো কমপ্লেক্সের এক মাত্র আলোর উৎস হিসেবে জ্বলজ্বল করতে লাগলো। শুনশান নিরবতায়, জনমানব শুন্য এই জগতে স্রেফ দুটা কবরের উপর আলো পড়তে লাগলো। কবর দুটোকে যেন পরম মমতায় আগলে ধরে রেখেছে শ্বেত শুভ্র, রাজকীয় এক ‘তাজ মহল’।

বের হবার সময় শেষ বারের মত মনে তাজ মহলকে বিদায় জানালাম। তারপর আবিষ্কার করলাম যে গেট দিয়ে বের হয়েছি, সেটা আসলে অন্য গেট। আশে পাশে খাবারের দোকান দেখে নোভারা ঢুকে পড়লো। আমি আর রুবাইদা হাঁটতে লাগলাম। দুপাশের সুভেনিয়র শপের লোকরা পারলে আমাদের হাতে তুলে দেয় তাজ মহলের রেপ্লিকা। অন্ধকারের মধ্যে তাদের হাঁকডাক উপেক্ষা করে আমরা সামনের দিকে হেঁটে যেতে লাগলাম। রাস্তা ঘাট কিছু চিনতে পারছি না। হোটেলের কার্ড থেকে ঠিকানাটা বের করে দেখলাম। আশেপাশের লোকগুলোকে জিজ্ঞেস করতে সাহস হচ্ছিলো না, যদি ভুল পথে পাঠিয়ে দেয় আমাদের! যাই হোক আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে এক দুই জন লোককে জিজ্ঞেস করে যখন হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটু পরিচিত রাস্তা পেলাম তখন রাত আটটার মত বাজে। আমরা আগের ফৌজি ধাবায় আর গেলাম না। বরঞ্চ একটা টং ঘরে ১৫ রুপি দিয়ে বোম্বে টোস্ট কিনলাম। এক ঠোঙ্গা ভর্তি করে বোম্বে টোস্ট দিলো। আমরা সেই ঠোঙ্গা নিয়ে রুমে ঢুকলাম।

রুবাইদাও আমার সাথে আমার রুমে আসলো। ও দুঃখ করে বলল নিচের রুমটা খুবই জঘন্য। বাথরুমের অবস্থাও খুব বাজে। আমরা বললাম আমাদের এখানে ওকে থেকে যেতে কিন্তু ও মৌলি আর মজুমদারকে ছেড়ে ও থাকতে রাজি হলো না। আমরা রুমে বসে বসে সেই বোম্বে টোস্ট খেলাম। রুবাইদা খানিক্ষন গল্পগুজব করে চলে গেলো। ওদিকে নোটিশ এসেছে যে আমাদের ভারী ভারী লাগেজ প্রতিবার বাসে উঠানো এবং নামানো অত্যন্ত কষ্টকর ব্যাপার। এই জন্য ঠিক হয়েছে আমাদের সব দরকারি মালপত্র ব্যাকপ্যাকে ভরে নেওয়া হবে যাতে আগামী কয়েকদিন সুটকেস বাস থেকে না নামালেও কোন অসুবিধা না হয়। সেই অনুযায়ী আমি আমার ব্যাকপ্যাক থেকে কম্বল বের করে লাগেজে ঢুকালাম। আর আগামী কয়েকদিনের জামাকাপড় ব্যাকপ্যাকে ভরে নিলাম। এই করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেলো। তারপর আমরা গল্প গুজব করতে করতে শুয়ে পড়লাম। বিশাল বিছানা। ইচ্ছা মত হাত পা ছেড়ে ঘুমালাম।

 

The Mighty INDIA CALLING: একটি ‘মোঘলাই’ সমাধি এবং ওভারলোডেড খাওয়াদাওয়া (পর্ব ১৫)

সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেলো। তাড়াহুড়া করে যখন নিচে নামলাম তখনই বাস প্রায় ছেড়ে দিবে দিবে ভাব। হোটেল থেকে বের হতেই দেখি গলিতে মানুষ জন বড় বাঁশ, দড়ি, ডেকচি নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। ঘটনা কি বুঝলাম না। আমি একটু হেঁটে রাস্তার পাশের দোকানে গরম গরম ভাজা ডাল্পুরি দিয়ে নাস্তা সেরে ফেললাম। ১৫ রুপিতে দুইটা ডালপুরি। পাশেই আবার ডিম সিদ্ধ করা হচ্ছে। রুবাইদার উৎসাহে আমিও ওর সাথে ১০ রুপি দিয়ে ডিম সিদ্ধ কিনে খেলাম। নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য লাগছিলো যে আমি বেড়াতে এসে পয়সা খরচ করে ডিম সিদ্ধ কিনে খাচ্ছি, সো অ্যামেজিং!

খেয়ে দেয়েই দৌড় লাগালাম গোয়েলে উঠার জন্য। গোয়েলে উঠে দেখি মেয়েরা অনেকেই সালোয়ার কামিজ পরেছে। দেখতে সবাইকে সুন্দর লাগছিলো। কয়েক জন এসে পৌঁছানোর আগেই দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে বাস ছেড়ে দিলো। আমাদের প্রথম গন্তব্য হুমায়ুন্স টম্ব। ঝলমলে রোদের মধ্যে আমরা চলতে শুরু করলাম। আমার বেশ গরম লাগছিলো। একটা সোয়েটার খুলেই ফেললাম। খানিক্ষন পরেই পৌঁছে গেলাম হুমায়ুন্স টম্বে। বাস থেকে নেমে কমিটির লোকজন টিকেট কাটতে গেলো। আমরা ১০ রুপি করে জমা দিলাম টিকেট কাটার জন্য। টিকেট পেয়ে আমরা লাইন ধরে ভিতরে ঢুকতে লাগলাম।

বিশাল বিশাল গেটের ভিতর দিয়ে ঢোকার সময় কেমন যেন এক অদ্ভূত প্রশান্তির অনুভূতি হচ্ছিলো। মেইন টম্বে ঢোকার আগে ধাপে ধাপে ইতিহাসের বর্ননা ছিলো। হুমায়ুনের কথা, তার বীরত্বের কথা, এই কমপ্লেক্স বানানোর কথা, এর তুর্কি আর্কিটেক্টের কথা, চারবাগের আইডিয়ার কথা, রেড স্যান্ডস্টোনের জালি বানানোর কথা, কেমন করে এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত কয়ে ছিলো সেই কথা, তারপর আবার কেমন করে এগুলো রেনোভেশন করা হয়েছে তার কথা- এই সব দেখতে দেখতে আমি আর সামনে যেতেই পারছিলাম না। এত সুন্দর করে সব বর্ণনা করে রেখেছে যে না দেখেও যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু এক সময় টের পেলাম অনেক সময় লাগবে সব পড়তে গেলে। শেষে কি আর করা সব না পড়েই ছুটতে শুরু করলাম। অবশেষে দেখা পেলাম চার বাগের মধ্যখানে দাঁড়ানো সেই টুকটুকে লাল বিল্ডিঙের- ‘হুমায়ুন্স টম্ব’।

হুমায়ুনের সমাধি
হুমায়ুনের সমাধি

আমরা সিঁড়ি বেয়ে যখন অনেক উঁচু প্ল্যাটফর্মটিতে উঠতে গেলাম তখন দেখলাম সিঁড়ির রাইজার অমানুষিক উঁচু। আমরা প্রায় হাঁপিয়ে গেলাম। টনটনে পা নিয়ে একসময় উপরে উঠে গেলাম আমরা। কি যে ভালো লাগছিলো বলা যাবে না! আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক কবর- এগুলো সবই মুঘল বংশের সদস্যদের কবর। আর ভেতরে তাকিয়ে দেখলাম হুমায়ুনের কবরের উপরের ঢিবিটা। চারপাশে সবুজ ঘাসের বাগানের মাঝখানে এরকম জায়গায় কবর না হয়ে যদি থাকার জায়গা হতো তা হলে মনে হয় বেশি ভালো হতো। তবে নিশ্চয়ই চারপাশের যে শান্তিময় পরিবেশটা আছে, কবরবাসীদের মৃত্যু পরবর্তী কবর জীবনটাও  যেন এইরকম শান্তির হয় সেই কথা চিন্তা করেই এ রকম স্ট্রাকচারটা বানানো হয়েছে। কিন্তু কোথাও কবরবাসীদের জন্য বসে দোয়া করার  জায়গা দেখলাম না। পুরা জায়গাটাকেই দর্শনীয় স্থান হিসেবে বানিয়ে রাখা হয়েছে। উপর থেকে দাঁড়িয়ে যখন চারপাশটা দেখছিলাম তখন ভীষণ শান্তির এক অনুভূতি লাগছিলো। জায়গাটার মেইন্টেনেন্স অত্যন্ত ভালো। শুধু চারবাগের সেই সব অত্যাশ্চর্য পানির নহর গুলো নেই। বাদবাকি সব কিছুই অত্যন্ত যত্নের সাথে রক্ষা করেছে ভারত সরকার। রাজকীয় সেই টম্ব কমপ্লেক্স থেকে নেমে আসতে আসতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছিলো মনের ভেতর। মনে হচ্ছিলো মুসলমান হয়ে মৃত্যুর পরে সমাধির জন্য যাদের এত রাজকীয় ব্যাপার স্যাপার, জীবদ্দশায় কি বিপুল সম্পত্তিই না তারা ইহজীবনে ভোগ করে গেছে। আবার মনে হচ্ছিলো কি মেধা আর সম্পদই ছিলো আমাদের, স্যান্ডস্টোন আর সাদা মার্বেলের কি নিখুঁত কারুকাজ করার দাপট, বেহেশ্তের কন্সেপ্টের কি অপরূপ বাগান আর প্রাকৃতিক নহরকে কৃত্রিমভাবে ব্যবহার করার কি কৌশলই না ছিলো তাদের- অবিশ্বাস্য!

এই টম্ব থেকে বের হয়ে দেখলাম এখানে আরও অনেকগুলো সমাধি আছে। সব গুলোতে যাওয়ার আর সময় হলো না। দৌড়ে দৌড়ে দেখে এলাম ইশা খানের গার্ডেন টম্ব, হালিমা বুর টম্ব, আফসার ওয়ালা টম্ব -এই গুলো। আমার খুব ইচ্ছা করছিলো আরও কিছুক্ষন থেকে ধীরে ধীরে সব কিছু দেখতে, কিন্তু সবাই তাড়া দিতে লাগলো- বাস নাকি ছেড়ে দিবে। আজকে শুক্রবার, জুম্মার নামাজ আছে।  কি আর করা, কিছুটা অতৃপ্তি নিয়েই বের হয়ে আসলাম এই কমপ্লেক্স থেকে। বের হয়ে দেখি সবাই এক আইস্ক্রিম ওয়ালাকে থামিয়ে আইস্ক্রিম খাচ্ছে। আমিও খেলাম শীতের মধ্যে আইস্ক্রিম- মাদার ডেইরির স্ট্রবেরি ক্রাশ মাত্র ৩৫ রুপি দিয়ে। অনেক মজা ছিল আইস্ক্রিমটা। মুখে দিলেই স্ট্রবেরির বিচি গুলো দাঁতের মধ্যে কিচ কিচ করছিলো।  আমি অন্য ফ্লেভারগুলোও টেস্ট করে দেখলাম। সবগুলোই মজার।

আমরা গোয়েলে উঠে বসলাম। কিন্তু ইশতিয়াক, নিলয় আর শুভকে পাওয়া গেলো না। ওদের ছাড়াই আমরা রওয়ানা হয়ে গেলাম। মিনিট খানেক পর ওরা বাসের পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে আসলো। ওরা বাসে উঠলে সবাই ওদের বেশ পঁচালো। এবার আমাদের গন্তব্য জামে মসজিদ। আগের বার যারা ঠিকমত খেতে পারে নাই তারা প্ল্যান করলো এই গিয়ে কি কি খাবে। যারা আগেরবার ‘করিমস’ এ খেয়েছিলো তারা অন্যদের বলে দিলো যে দাম আন্দাজ খাবার তেমন আহামরি কিছু না। আমরা সব কিছু প্ল্যান করতে করতেই চলে আসলাম জামে মসজিদের কাছাকাছি। গোয়েল আমাদের নামিয়ে দিলো। আমরা হাঁটতে লাগলাম। আগেরবার বৃষ্টি থাকায় রাস্তা অনেক নোংরা ছিল। আজকে কড়কড়ে রোদ থাকায় রাস্তাটা আগের দিনের মত আর নোংরা লাগলো না। জামে মসজিদের পাশে হঠাৎ বিরাট এক দাড়িওয়ালা ছাগল দেখলাম। অবনী আবার সেটার সাথে পোজ মেরে ছবি তুললো। আগের মত জমজমাট খাবারের দোকান গুলো পার হয়ে লাগলাম। অনেক ভীড় রাস্তায়। আমরা ঠিকমত হাঁটতেই পারছিলাম না। মনে হলো জুম্মার জামায়াত ভেঙ্গেছে। লোকে লোকারন্য ফুটপাথের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে নিশাত, রিন্তু, তমাদের সাথে আমি, রুবাইদা, অন্তরা, মিম ঢুকে পড়লাম ‘আল জাওয়ারিহি’ নামের এক হোটেলের দোতলায়।

এই হোটেলটা বেশ বড়। আমি মেনু দেখে ৯ রুপির নান আর ৪৫ রুপির শিক কাবাব অর্ডার দিলাম। আসতে একটু সময় লাগলো। আমরা চারপাশ দেখতে লাগলাম। অনেক বিদেশি এসেও খাচ্ছে এখানে। হোটেলের পরিবেশটা আমার কাছে আমাদের দেশের স্টার কাবাবের মত লাগলো। খাবার আসার পর ঝাঁপিয়ে পড়লাম খাবারের উপর। মজা করে খেলাম কাবাবটা। খাওয়া দাওয়া শেষে ভাবলাম আবার কই না কই যাবো, একটু বাথরুমে যাওয়া দরকার। লোকজনকে জিজ্ঞেস করতেই সবাই দেখিয়ে দিলো উপরে উঠার সিঁড়ি। আমরা সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠলাম। সেখানে একটা মাত্র বাথরুম। তাতে আমরা লাইন দিলাম। তবে বাথরুমটা ছোট হলেও পরিষ্কার, সব চেয়ে বড় কথা এই বাথরুমে একটা বদনা আছে। ইন্ডিয়াতে কলকাতার বাইরে এই প্রথম কোন বাথরুমে বদনা দেখতে পাই। হাত মুখ ধুয়ে শেষমেষ আমরা বের হয়ে যাই।

এবার হাজির হই কল্যান সুইটসে। আগেরবারের বাদাম দুধের দুঃখ ভুলতে গিয়েই অর্ডার দেই ২৬ রুপির সেই জিনিস। এমনিতেও পেট ভরা ছিল। পুরো এক গ্লাস খেয়ে শেষ করতে পারবো না বলেই মনে হচ্ছিলো। অন্তরার সাথে শেয়ার করি সেই গ্লাস। জিনিসটা এত্ত ঘন, মনে হচ্ছিলো যেন সুস্বাদু কোন ফিরনি খাচ্ছি গ্লাসে করে। কল্যান সুইটস থেকে বের হয়ে এবার সোজা হাঁটা দেই মসজিদের দিকে। অনেক সিঁড়ি পার হয়ে উঠতে থাকি জামে মসজিদের গেটের দিকে। গেটে এক লোক আবার বাধা দিলো ক্যামেরা নিয়ে ভিতরে ঢুকতে। আমি আর রাত্রি বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম। আশেপাশে খুঁজলাম ক্যামেরা জমা দেওয়ার কোন জায়গা আছে কিনা। কিন্তু সেরকম কিছু পেলাম না। এক সময় গেট থেকে সেই লোকটা সরে যেতেই আমি আর রাত্রি সুড়ুৎ করে ভিতরে ঢুকে পড়লাম।

চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর জামে মসজিদ
চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর জামে মসজিদ

ভিতরে পা রাখলাম রেড স্যান্ডস্টোনের বিশাল প্রান্তরের উপর আর অন্য মাথায় দেখতে পাচ্ছিলাম লাল, সাদা পেয়াজাকৃতি গম্বুজ ওয়ালা মসজিদটাকে। সেই শাহজাহানের আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কত কোটি কোটি মানুষ নামাজ পড়তে এসেছে এই জায়গায়- মসজিদটাকে দেখে আমার মনে তাই এক ধরনের শিহরন জাগলো। আমি ভালো করে দেখতে লাগলাম। চারপাশে উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা প্রান্তরটিতে শুধুই এই রুচিশীল মসজিদটা দাঁড়িয়ে আছে রাজার মত। আর তার সামনে মনের আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে শত শত কবুতর। মসজিদ বরাবর ঠিক সামনে ছোট একটা হাউজের মত। সেখানে লোকজন সবাই ওযু করছে। আমি ধীরে ধীরে ঢুকে পড়লাম মসজিদটিতে। নামাজের ওয়াক্ত নেই বলে সেখানে লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। বিশাল বিশাল কারুকাজ করা আর্চের নিচ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিলো। শুভ, জুবায়েরকে দেখলাম দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। এত বড় স্থাপনা্‌ কিন্তু কেমন যেন নিস্তব্ধভাব, আবার ঠিক নিস্তব্ধও নয় ভেসে ভেসে আসা শব্দের জোরে কেমন যেন থমথমেভাব।

আমি খুঁজতে লাগলাম মেয়েদের নামাজ পড়ার জায়গা কোথায় আছে। শেষ মেষ অনেক খোঁজাখুঁজি করে আবিষ্কার করলাম মেয়েদের আলাদা কোন জায়গা নাই, যেকোন খানেই নামাজ পড়া যায়। তারপর আমি আর রুবাইদা বাউন্ডারি ওয়ালের পাশে এক জায়গায় বসে তাড়াহুড়া করে যোহরের নামাজ আদায় করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়লাম। তারপর বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম আসরের ওয়াক্তের জন্য। বসে বসেই দেখলাম অবনী হাউজের পানি দিয়ে ওযু করছে। কয়েকজন বিদেশিকে ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম। অনেকেই লুকিয় লুকিয়ে টুকটাক ছবি তুলতে লাগলো। অবশেষে আসরের নামাজ পড়ে আমি, রুবাইদা আর অবনী বের হয়ে আসলাম জামে মসজিদ থেকে।

এরপর হাঁটতে লাগলাম রেড ফোর্টের দিকে। হঠাৎ দেখলাম এক লোক কিউই ফল কেটে বিক্রি করছে। অবনীকে দেখলাম লাফিয়ে লাফিয়ে কিউই কিনতে, এটা নাকি ওর খুব প্রিয় ফল। ওকে দেখে আমারও খুব খেতে ইচ্ছা করলো। কিন্তু দুপুরের শিক কাবাব, নান আর বাদাম দুধ খাওয়ার পর পেট পুরো টইটুম্বুর ছিলো। খাবো কি খাবো না ভাবতে ভাবতেই ১০ রুপি দিয়ে কিউই কিনে খেয়ে ফেললাম। হালকা স্বাদের রসালো ফলটার উপর বিট মশলা ছিটিয়ে দিয়েছে। খেতে ভালই লাগলো। আবার হাঁটতে লাগলাম। নেতাজী সুভাস মার্গ মেইন রোডে উঠে বাম দিকে হেঁটে রেড ফোর্টের দিকে যেতে লাগলাম। রাস্তা পার হতে আমাদের সেই বেগ পেতে হলো। অবশেষে রাস্তা পার হয়ে আমরা রেড ফোর্টের সামনে আসলাম। অবনী টিকেট কেটে আনলো। আমরা ভিতরে ঢুকে পড়লাম।

আমরা ঢুকলাম লাহোর গেট দিয়ে। ঢুকতেই সামনে পড়লো এক বিশাল মীনা বাজার। সবগুলো দোকানই সুভেনিয়র শপ। ছোটবেলায় বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে গিফট পাওয়া কাঁচ বসানো কলম, নোটবুক, চাবির রিং, কাঠের আয়না, কাঠের কলম এই সব জিনিস গুলোকে ঝলমল করতে দেখলাম দোকানগুলোতে। রুবাইদা এক দোকানে ঢুকে মেটাল আর পাথরের মিনা করা ঢাউস সাইজের আংটি কিনলো। আমরা আস্তে আস্তে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি অনেকে ফেরত চলে আসছে। কারণ জিজ্ঞেস করতেই অদিতি বললো, সব কিছু নাকি বন্ধ করে দিচ্ছে আর তেমন ভালো কিছু নাকি দেখার নাই। আমরা পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু কিছুদূর যেতেই গার্ড টাইপের একজন সামনে আর যেতে নিষেধ করলো। ৫টার সময় সব বন্ধ হয়ে যাবে। তাই আমাদের আর ঢুকতে দিলো না। কি আর করা, আমরা আবার উল্টা দিকে হেঁটে সেই মিনা বাজারের ফেরত আসলাম। অনেককেই দেখলাম মজার মজার জিনিস কেনাকাটা করতে। অদিতি ছোট ছোট কাঠের দাবার বোর্ড কিনলো অনেকগুলো। ১৫০ রুপি করে একেকটার দাম পড়েছে। ও আফসোস করে বললো, দাম বোধহয় আরেকটু কমানো যেতো। এখান থেকে কোথায় যাবো সেটা ঠিক করার চেষ্টা করতে লাগলাম। প্ল্যান অনুযায়ী আমাদের বাসে করে ইন্ডিয়া গেট যাওয়ার কথা। কিন্তু যাদের জিজ্ঞেস করলাম তারা কেউই ইন্ডিয়া গেট রাজি নয়। কারন দিল্লী আসার পর থেকে আসা যাওয়ার পথে আমরা প্রায় দুই তিন বার ইন্ডিয়া গেট দেখে ফেলেছি। এখন সেখানে গিয়ে নেমে দেখার কোন মানেই হয় না।

আগ্রা ফোর্টের মিনা বাজার
আগ্রা ফোর্টের মিনা বাজার

দেখলাম বেশির ভাগ মানুষ শপিং করতে যেত চায় ক্যারোলবাগ। আমরাও ঠিক করলাম ক্যারোল্বাগ যাবো। ফোর্ট থেকে বের হয়ে সামনে আমরা সবাই জড়ো হলাম। দেখলাম কেউই ইন্ডিয়া গেট যেতে চায় না। পরে ঠিক হলো বাসে করেই আমরা ক্যারোল বাগ যাবো। আমরা লাইন ধরে হেঁটে হেঁটে সূর্যাস্তের সময় গোয়েলের কাছাকাছি পৌঁছালাম। ওরা বাস ড্রাইভারকে বলতেই ওনারা রাজী হয়ে গেলো যে পার্কিং এ যাওয়ার আগে আমাদের ক্যারোলবাগ নামিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু বাসে উঠে আবিষ্কার করলাম নোভা, বাঁধন, মৌলি, উর্মি, জাফর, চিং – ওরা সবাই ইন্ডিয়া গেট যাওয়ার জন্য বসে আছে। আমরা সবাই ক্যারোল্বাগ যাবো শুনে ওরা মনে করিয়ে দিলো যে প্ল্যান অনুযায়ী এখন ইন্ডিয়া গেট যাওয়ার কথা। প্ল্যান চেঞ্জ যে হয়েছে- সেটা সবাইকে না জানিয়ে হুট করে কেন করা হলো সেটা নিয়ে হঠাৎ কথা উঠতে লাগলো। এক পর্যায়ে অবনী, শুভ ওরা রাগ করে বাস থেকে হুট করে নেমে গেলো। আমি দৌঁড়ে গিয়ে অবনীকে থামালাম। অবনী গিয়ে শুভকে বুঝিয়ে ধরে নিয়ে আসলো। ওদিকে সীমান্ত ড্রাইভারের সাথে আলোচনা করতে গেলো যে যদিও দুইটা উল্টা পথ, তারপরও কোনভাবে দুই জায়গাতেই বাস নেওয়া যায় কিনা। ড্রাইভার পরে রাজী হলো আগে ইন্ডিয়া গেট হয়ে পরে ক্যারোলবাগ আমাদের নামিয়ে বাস পার্কিং করতে যাবে। ততক্ষণে ইন্ডিয়া গেট পার্টি আবার ডিসিশন নিয়ে ফেলেছে যে ওরা বাস থেকে নেমে নিজেদের মত ইন্ডিয়া গেট যাবে। তখন সীমান্ত আবার চেতে যায়, কারণ ও এতক্ষণ ধরে ড্রাইভারকে বুঝিয়ে এসেছে যে আমরা দুই জায়গাতেই যাবো। শেষমেশ সবাই মুখ গম্ভীর করে বসে থাকে আর আমাদের নিয়ে গোয়েল রওয়ানা দেয়।

গোয়েল আমাদের নিয়ে প্রথমে ইন্ডিয়া গেটের দিকে যেতে থাকে। পুরো বাসে একমাত্র মৌলি আর চিং হাসিমুখে কথা বলে ব্যাপারটাকে খুব স্বাভাবিক করে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। ওদিকে রুবাইদা চোখ বন্ধ করে ঘুম দেয়। আমরা বাকি সবাই চুপচাপ বসে থাকি। ইন্ডিয়া গেট আসলে ওরা সবাই নেমে যায়। এরপর আমরা যেতে থাকি ক্যারোলবাগের দিকে। কিন্তু রাস্তায় অনেক জ্যাম। জ্যামে বসে থাকতে থাকতে বিরক্তি ধরে যায়। ওদিকে আটটার দিকে আবার ক্যারোল্বাগ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু কিছু করার নেই। অনেক জ্যাম ঠেলে একসময় আমাদের এক জায়গায় বাস নামিয়ে দিলো। আমরা সেখান থেকে হাঁটতে লাগলাম। যখন পৌঁছাই ততক্ষনে দোকান পাট প্রায় বন্ধ হই হই করছে। হিমি একটা দোকানে ঢুকে টপ্স কিনতে লাগলো। রাস্তার উপর অনেকেই পালাজ্জো আর ওয়ান পিস সাজিয়ে রেখেছে। সেখান থেকেও অনেকে কেনা কাটা করতে লাগলো। কৌশিক সব কিছুই মাপ দিয়ে দেখছিলো শান্তার সাইজের হবে কিনা! আমার ইচ্ছা ছিলো ফাস্ট ট্র্যাকের একটা ঘড়ি কিনবো। আগের বার যখন দিল্লী আসি তখন রাজীব চকে ফাস্ট ট্র্যাকের একটা ঘড়ি খুব পছন্দ হয়েছিলো আমার। পরে চন্ডীগড়ে গিয়ে খুঁজেছিলাম কিন্তু ফাস্ট ট্র্যাকের শো রুম পাই নাই। ফাহাদ আমাকে বলেছিলো ক্যারোল্বাগে ফাস্ট ট্র্যাকের সবচেয়ে বড় শো রুম আছে। তাই এখানে এসে আমি ঢুকতে চাইলাম ফাস্ট ট্র্যাকে। কিন্তু হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে দোকানপাট সব বন্ধই না হয়ে যায়। আমি রুবাইদাকে সাথে নিয়ে খুঁজতে যাই দোকানটা। কিন্তু রাস্তার দুপাশে একে একে সব দোকান বন্ধ হয়ে যেতে দেখে অনেক দূর হেঁটে গিয়েও আবার ফেরত আসি। ফুটপাথে একজনকে অনেকগুলো ক্লাচ ব্যাগ সাজিয়ে রাখতে দেখি। আমি ৩০০ রুপি দিয়ে তিনটা ব্যাগ কিনি। অনেকে আবার ম্যাকডোনাল্ডে খাওয়াদাওয়া করতে যায়। নিরিবিলি হলুদ সোডিয়াম লাইটের আলোতে হেঁটে হেঁটে কিছু দূর গিয়ে আমি, রুবাইদা, হিমি আর সীমান্ত অটো ভাড়া করে রওয়ানা দেই হোটেলের উদ্দেশ্যে। আমাদের পার হেড ভাড়া পড়ে ২৪ রুপি। আমার আর রাতে খাওয়ার কোন ইচ্ছা ছিলো না। দুপুরের খাওয়াটা তখনও ঠিকমত হজম হয় নাই। পেট ভার হয়ে ছিলো। ঠিক হলো সীমান্ত আর রুবাইদা হোটেলের কাছে নেমে যাবে খাওয়ার জন্য আর আমরা হোটেলে চলে যাবো।

হোটেলের কাছাকাছি এসে আমরা আর গলি চিনতে পারি না। চিনবো কেমন করে- আমাদের গলিতে যে বিয়ের আয়োজন হচ্ছে! সারা গলিতে প্যান্ডেল টানিয়ে, ঝলমলে আলো জ্বালিয়ে, জোরে গান ছেড়ে ধুমধাড়াক্কা বিয়ের আসর বসেছে। আমাদের অবস্থা এমন যে হোটেলে ঢুকতে হলে বিয়ের অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। কি আর করা, আমরা লাইন ধরে গলি তথা প্যান্ডেল তথা বিয়ের অনুষ্ঠানে ঢুকলাম। পুরা গলি জুড়েই প্যান্ডেল টানানোর ফলে অনেক বড় বড় বসার জায়গা, খাওয়ার যায়গা আর রান্না করার জায়গা পাওয়া গেছে। প্রথমে যে জায়গায় ঢুকলাম সেটা ছিলো বসার জায়গা। অনেক চেয়ার সাজানো। একটা স্টেজও দেখলাম তবে বর বা কনে নেই। খালি স্টেজ। আশেপাশে মহিলারা চকমকে পাথর দেওয়া শাড়ি পরে কড়া মেকাপ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছোট ছোট ছেলেরা দেখলাম গানের তালে তালে হাত পা ছেড়ে নাচা নাচির চেষ্টা করছে। এরপর পার্টিশন পার হয়ে আমরা খাওয়ার জায়গায় ঢুকলাম। এখানে মনে হলো বুফে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেক রকমের খাওয়া, কোনটার আবার খালি ডিশ পড়ে আছে। এরপর যে জায়গাটায় গেলাম সেটা রান্নাঘর। বড় বড় ডেকচিতে খাবার ঢেকে রাখা হয়েছে। কয়েকটা ডেকচি আবার খালি হয়ে পড়ে আছে। এর ঠিক পরেই ডেকচি, প্লেট, গ্লাস ধোয়ার জায়গা। সবই ধোয়া হচ্ছে রাস্তার উপরে। কিন্তু আমাদের সেই ধোয়াধায়ি করার জায়গা পর্যন্ত যেতে হলো না, তার আগেই আমাদের হোটেলের দরজা পেয়ে গেলাম। ভিতরে ঢুকতেই রিসিপশনের লোকটা আমাদের দেখে এক গাল হাসি দিলো। উনি জানালো এখানে এভাবে গলিতেই বিয়ের আয়োজন করা হয়। আশেপাশের মানুষের একটু কষ্ট হলেও কেউ কিছু বলে না। সবাই মেনে নেয়। আমরা জিজ্ঞেস করলাম ওনারা দাওয়াত পেয়েছে কিনা। উনি জানালো গলির বিয়েতে দাওয়াত লাগে না। এমনিই যাওয়া যায়। চাইলে আমরাও যেতে পারি, কোন সমস্যা নাই। উনারা আরেকটু পরেই বিয়ে খেতে যাবেন।

রুমে ফেরার পর থেকেই পেটে কেমন অস্বস্তি হতে লাগলো। আগেই বুঝেছিলাম দুপুরে এত কিছু খাওয়া ঠিক হয় নাই।  আমার রুমমেট সবাই চিন্তায় পড়ে গেলো আমার অসুস্থতা দেখে। হঠাৎ মজুমদার বোতলের পানিতে ইনো গুলিয়ে দিলো। বললো চটপট খেয়ে ফেলতে। আমি আগে কখনও ইনো খাই নাই। উপায় না দেখে ঢকঢক করে ইনো মিশানো পানি খেতে লাগলাম। তারপর বোতলটা মজুমদারের হাতে রেখে আমি দৌঁড়ে বাথরুমে গিয়ে ভক করে বমি করে দিলাম। বমি করে আমার একটু শান্তি শান্তি লাগলো। আমার রুমমেটরা ভয় ভয় চোখে তাকিয়ে রইলো। আমি ওদের আশ্বস্ত করলাম যে কোন সমস্যা নাই, আমি আল্লাহর রহমতে ভালো হয়ে গেছি। তার পর সবাইকে বললাম আমাদের বাথরুম ইউজ না করে যেন অন্যদের রুমের বাথরুমে সবাই যায়। তারপর ধীরে সুস্থে ব্যাগ গুছাতে শুরু করলাম।

সব কিছু গুছিয়ে আমরা আস্তে আস্তে একটামাত্র লিফট দিয়ে লাগেজ নামাতে থাকি। তারপর গোয়েলের পিছনে লাগেজ জমা দিয়ে বাসে উঠে বসি রাত সাড়ে ১১টার দিকে। আমাদের লাগেজ এত বেশি হয়ে গিয়েছিলো যে পিছনে আর আঁটছিলো না। তারপর আমাদের ইশতিয়াক, নিলয়সহ আরও কয়েকজন মিলে বড় বড় ভারি ভারি লাগেজগুলো এক হাতে ধরে ধরে বাসের ছাদে উঠিয়ে দিলো। এই অবর্ণনীয় কষ্ট ওরা কেমন করে করলো ওরাই জানে। সব শেষে ওরা বাসে উঠলো। আমাদের যাত্রাও শুরু হলো আগ্রার পথে। সিরিয়াল অনুযায়ী আজকে আমাদের পিছনে বসার কথা। রাত্রি বসলো জানালার পাশে, তার পাশে আমি, রুবাইদা, সুমাইয়া, সৃষ্টি, পৃথ্বী। সেই শুরুতে কলকাতার পর আবার ৯০ ডিগ্রি আঙ্গেলের সিট। তবে আশার কথা জার্নিটা বেশি বড় না। রাত্রির হাড্ডিসার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। তবে সারা জার্নিতে ঘুম আসলো না বললেই চলে।

The Mighty INDIA CALLING: পুনরায় দিল্লীতে এবং একটি মন্দির ও দরগা দর্শন (পর্ব ১৪)

দিনে যখন ঘুম ভাংলো, তখন ঘাড় আর কোমরে টনটনে ব্যাথা। ঘাড় মালিশ করতে করতে ছোট্ট সিটের মধ্যে নিজের পা টা মেলে ধরার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু তেমন কোন লাভ হচ্ছিলো না। আর বাসও টানা চলছিলো। থামাথামির যেন কোন বালাই নেই। বাসে গ্যাট মেরে বসে থাকা ছাড়া আর কোন উপায়ও ছিলো না। কি আর করা, আমরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করতে লাগলাম।

প্রায় দুপুর ১২টার দিকে আমরা দিল্লী পৌঁছালাম। সেই আগের ইউ কে হোটেলে উঠি। কিন্তু এইবার আমরা বরাদ্দ পাই সব পচা পচা রুম। প্রথমে আমরা একটা রুমে যাই, সেটার বাথরুম থেকে বোঁটকা এক রকম গন্ধ বের হচ্ছিলো। তাড়াতাড়ি সেইটা বদলে আমরা আরেকটা রুমে উঠি। এই রুমটা অনেক ছোট। রুমে আমাদের লাগেজ গুলো রাখার পর আর তেমন জায়গাই ছিলো না। আর বাথরুমটা খুবই পচা। সেটাতে টিমটিম করে একটা হলুদ লাইট জ্বলছিলো যেটা ভিতরের পরিবেশকে আরও জঘন্য করে দিচ্ছিলো। আমরা রুম পেয়ে খুব মন খারাপ করলাম। কিন্তু কি আর করা, হোটেল মালিক যে এরকম ধড়িবাজ সেটা কি আর আগে জানতাম? ওরা সবাই ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে। আমি মৌলির হিটারটা দিয়ে পানি গরম করে নেই। গোসল করতে গিয়ে আমার গা ঘিনঘিন করছিলো। কোনমতে তাড়াতাড়ি করে বাথরুম থেকে বের হই।

আগের সারাদিনে আমি শুধু একটা স্যান্ডুইচ আর এক প্যাকেট চিপস খেয়ে ছিলাম। আর সকালেও কিছু খাওয়া হয় নাই। আমরা তাই তাড়াতাড়ি করে বের হই খাওয়ার জন্য। হোটেলের কাছেই একটা দোকানে চিকেন বিরিয়ানি পাওয়া যাচ্ছিলো। লোকটা হালাল বলাতে ৪০ রুপি দিয়ে এক প্লেট চিকেন বিরিয়ানি অর্ডার দেই। পিয়াজের টুকরা দিয়ে সাজিয়ে এক প্লেট বিরিয়ানি এসে হাজির হয় সামনে। আমি গোগ্রাসে খাই। খাওয়া দাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে আমরা বের হয়ে আসি। আমরা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই অক্ষরধাম টেম্পল। কিভাবে যাবো জানতে চাইলে একেকজন একেক রকম কথা বলে। দিল্লীর লোকজনকে কোন কথা জিজ্ঞেস করে লাভ নাই বুঝে আমরা ট্রাফিককে জিজ্ঞেস করি যে কেমন করে অক্ষরধাম টেম্পলে যাওয়া যেতে পারে।

আমরা ৬০ রুপি দিয়ে আগের মত অটো ভাড়া করে রাজিব চকে যাই। সেখান থেকে আগের বার যে মেট্রো স্টেশনে গিয়েছিলাম সেখানে যাই। টোকেন কাটি অক্ষরধামের। মেট্রো আসতেই ঠিক ঠিক চড়ে বসি। সব মেট্রো পাতাল দিয়ে যায়, কিন্তু এই মেট্রো হঠাৎ করে পাতাল ফুঁড়ে আকাশে উঠে গেলো। ঝলমলে দিনের আলোয় নিচে দেখা গেলো দিল্লী শহর। একটু পর পর অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছিলো একেকটা স্টপেজের। আমরা কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করছিলাম কোন স্টপেজের কথা বলে। একটু পর পর খেয়াল করছিলাম আমাদের স্টপেজ আসে কিনা। আমাদের অবস্থা দেখে একজন জিজ্ঞেস করে আমরা কোথায় যাবো। অক্ষরধাম যাবো শুনে উনি বলে আপনাদের তো মেট্রো মাঝে বদলাতে হবে। শুনে আমরা ভয় পেয়ে যাই, কারণ এমন কথা আমাদের স্টেশন থেকে কেউ বলে দেয় নাই। উনি আমাদের বোঝাতে থাকেন যে, যমুনা ব্যাংক স্টপেজে আমাদের নেমে যেতে হবে, তারপর আরেকটা মেট্রোতে করে সোজা যাওয়া যাবে অক্ষরধাম। উনার কথায় আশেপাশের অনেকেই সায় দেয়। আমরা বলি যে আমাদের একটাই টোকেন। উনারা বলে এই এক টোকেনেই যাওয়া যাবে, নতুন করে ভাড়া দিতে হবে না। দিল্লীর মানুষের কথায় বিশ্বাস করাটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছলাম না। এছাড়া মেট্রোর ম্যাপ চেক করে দেখলাম ওনাদের কথার সাথে মিলে যাচ্ছে বিষয়গুলো, যা আছে কপালে ‘ফী আমানিল্লাহ’ বলে নেমে পড়লাম যমুনা ব্যাংক স্টপেজে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দেখি অন্য পাশে আর কোন মেট্রো নাই। মনে মনে আল্লাহ, আল্লাহ করতে লাগলাম। এমন সময় হুউউশ করে একটা মেট্রো আসলো। আমরা সেটাতে উঠে পড়লাম। সেটা সত্যিই আমাদের অক্ষরধাম নামিয়ে দিলো। মেট্রো থেকে নেমে দেখি সারা, রাত্রি, বাসিরুন, সুমাইয়া ওদেরকে। সারা বলতে লাগলো, ‘সাহস খুব বেড়ে গেছে রে, মেট্রোতে উঠে আবার মেট্রো চেঞ্জ করে অক্ষরধাম পৌঁছে গেলাম, সাহস খুব বেশী বেড়ে      গেছে রে-’

মেট্রো স্টেশন থেকে বের হয়ে আমরা খোলা আকাশের নিচে এসে পড়লাম। এই জায়গার নাম অক্ষরধাম। এখন মন্দিরটা  কই আছে খুঁজে বের করতে হবে। আমরা কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করলাম। সবাই রাস্তা দেখিয়ে দিলো। মোটেও দূর না। হাঁটা পথ। আমরা রাস্তা পার হয়ে পৌঁছে গেলাম অক্ষরধাম মন্দিরে। গেটে ঢুকার সময় সেই লেভেলের কড়াকড়ি। আমরা সবাই লাইন ধরে এক এক লেয়ারের সিকিউরিটি পার হয়ে হয়ে যেতে লাগলাম। এক জায়গায় আমাদের সবার ব্যাগ জমা নিয়ে নিলো। ক্যামেরা, মোবাইল ফোন, সোয়েটার- সব কিছু জমা দিয়ে প্রায় খালি হাতে আমরা শেষ নিরাপত্তা স্তরে প্রবেশ করলাম। এবার আমাদের সবার চেকিং চললো। আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বারবার প্যান্টের পকেট থাবড়ে থাবড়ে চেক করতে লাগলো। এক পর্যায়ে সারা বেশ চেতেমেতে সিকিউরিটি মহিলাকে ঝাড়ি মেরে দিলো। অবশেষে সব নিরাপত্তা স্তর পার হয়ে আমরা ভিতরে ঢুকলাম।

ভিতরে আলিশান ব্যাপার স্যাপার। চার পাঁচটা অত্যন্ত কারুকাজ করা গেট পার হতে হতেই আমাদের চোয়াল ঝুলে পড়লো। দুটা ময়ুর গেটের মাঝখানে অল্প পানির পুলের মধ্যে বিশাল দুইটা নকশা কাটা পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম। তাতে অনেক পয়সা জমে আছে। জানতে পারলাম, এটা হলো স্বামী নারায়নের পায়ের ছাপের রেপ্লিকা। বিশাল রাস্তার শেষ মাথায় অনেক উঁচুতে অনেক কারুকাজ করা নয় গম্বুজের লাল পাথরের মন্দিরটা দেখা যায়। আমরা সে দিকে হাঁটতে লাগলাম। আরও কিছুদূর হেঁটে জুতা জোড়া জমা দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম মন্দিরে ঢোকার জন্য। এতো এতো অলংকরন দেখতে দেখতে মাথা ঘুরে যায়। যা বুঝলাম মন্দিরটা নতুন কিন্তু বানানো হয়েছে পুরানো টেকনোলজি কাজে লাগিয়ে। পুরাই পাথরের মন্দির, কোন আরসিসি নাই। আর পাথরের দেয়াল কুঁদেই লাখ খানেক ছোট বড় দেব দেবীর মুর্তি, ফুল পাতা, পশু পাখি এইসব বানানো হয়েছে।

মেইন মন্দিরে ঢুকে আমার মনে হলো এইটা যতটা না মন্দির, তার চেয়ে বেশি জাদুঘর বা এক্সিবিশন সেন্টার। গর্ভগৃহের মাঝখানে স্বামী নারায়নের বিশাল চোখ ঝলসানো সোনালি মুর্তি। আর বড় মুর্তিটার চারপাশে সাইজে ছোট আরও কয়েক জনের একই রকম সোনালি মুর্তি। দেখে মনে হলো সোনার তৈরি। আর গর্ভগৃহটা সোনালি রুপালি রঙের এতো বেশি কারুকাজমন্ডিত ছিলো যেটা দেখে আমার ইউরোপের বারোকো স্টাইলের কথা মনে পড়ে গেলো। স্বামী নারায়নের বড় মুর্তি ছাড়াও রাধা কৃষ্ণা, লক্ষী-নারায়ন, রাম-সীতা, শিব-পার্বতীরও মুর্তি ছিলো। সবগুলো মুর্তিই লাইটিঙ্গের কারণে ঝকঝক করছিলো। আমরা চারপাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। দেয়ালে ছবির মাধ্যমে অনেক ইতিহাস বর্ননা করা আছে। এক পাশে স্বামী নারায়নের ব্যবহার্য জিনিস যেমন জামা, মালা, পায়ের ছাপ এইসব সাজানো আছে। সব কিছু দেখে আমরা মেইন মন্দির থেকে বের হয়ে আসলাম। হেঁটে হেঁটে জুতা ফেরত নিয়ে আমরা অন্য দিকে গেলাম।

কতগুলো শো আছে যেগুলো টিকেট কেটে দেখতে হয়। শো দেখতে গেলে আমাদের দেরি হয়ে যাবে বলে আমরা শো দেখতে গেলাম না। আমরা সহজ আনন্দ নামের স্টেপ ওয়েল দেখলাম যেখানে সন্ধ্যার পর নয়নাভিরাম লেজার শো হয়। তারপর দেখলাম অভিষেক মন্দির। জানলাম, এখানে স্বামী নারায়নের কৈশর কালের মুর্তির উপর মন্ত্রপূত পানি ঢাললে মনের আশা পূরন হয়। আমি যখন দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেই যচ্ছিলাম তখন রুবাইদা আমার কাঁধ খামচে ধরলো। আমি কাঁচের জানালা দিয়ে ভিতরে তাকিয়ে দেখি ভিতরে সবাই বসে চোখ বন্ধ করে মন্ত্রের তালে তালে ডানে বামে ঝুঁকছে। এই অবস্থায় আমি ভিতরে ঢুকে পড়লে সেটা খুব বিব্রতকর অবস্থা হতো সবার জন্যই।  আল্লাহ বাচিঁয়ে দিয়েছেন আমাকে। তারপর আমরা দেখি লোটাস গার্ডেন। তারপর হাঁটতে হাঁটতে আমরা কতগুলো চমৎকার ফুড কোর্ট, সুভেনিয়র সুপার শপ পার হয়ে যখন বের হবার রাস্তা খুঁজতে লাগলাম, ততক্ষনে সূর্য প্রায় ডুবে যায় যায় অবস্থা। এরই মধ্যে এখানকার বাথরুমে আমার সানগ্লাসটা হারিয়ে ফেলায় মন বেশ খারাপ ছিলো। আর অন্ধকার নামার সাথে সাথেই শীত জাঁকিয়ে পড়তে লাগলো। আমার সব এক্সট্রা সোয়েটার ঢোকার সময় জমা দিয়ে ফেলেছিলাম। তাই তাড়াহুড়া করে বের হবার চেষ্টা করতে থাকি। পরে মনে পড়ে আমাদের টোকেন সারার কাছে। গেটের কাছাকাছি পৌঁছে সবার জন্য অপেক্ষা করতে করতে এক সময় সারাকে খুঁজে পাই। তাড়াতাড়ি করে ব্যাগ ফেরত নিয়ে সোয়েটার, মাফলার আর হাত মোজা পরে ফেলি।

এবার সবার সাথে আলোচনা করতে থাকি কোথায় যাওয়া যেতে পারে নেক্সট- এই সব নিয়ে। সিদ্ধান্ত হলো নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগায় যাওয়া হবে। আমরা বের হয়ে ট্যাক্সি ঠিক করার চেষ্টা করতে থাকি, কিন্তু ট্যাক্সির বদলে মাইক্রোবাস এসে হাজির হয়। আমরা দরাদরি করে যা আছে কপালে বলে উঠে পড়ি মাইক্রোতে। আমি আর সারা গাদা গাদি করে পিছনে বসি। সারা আবার মাথা নেড়ে আমাকে বলতে থাকে, ‘সাহস খুব বেড়ে গেছে রে, মাইক্রোতে করে কয়েকজন মেয়ে মিলে অপরিচিত শহরে রাতের বেলা দরগায় যাচ্ছি, সাহস খুব বেশী বেড়ে গেছে রে-’।  আমিও ভেবে দেখলাম, ঢাকা শহরেও আমার এরকম রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাইক্রো ভাড়া করে অপরিচিত জায়গায় যাওয়ার সাহস হবে না। আর এখন……

দরগার কাছাকাছি একটা জায়গায় এনে আমাদের নামিয়ে দিলো মাইক্রো বাস। পার হেড ভাড়া পড়লো ৪০ রুপি। আমরা নেমে চিপা গলি দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। দুপাশে খাবার দোকান। কাবাব ভাজা হচ্ছে, মাংস ঝলসানো হচ্ছে, বিশাল বিশাল কড়াইয়ে শত শত লালমোহন মিষ্টি ডুবিয়ে জ্বাল দেওয়ায় হচ্ছে- এই শীতের মধ্যে এই রকম ধোঁয়া ওঠা খাবারের দোকান পার হতে গিয়ে আমাদের সবারই খিদে লেগে গেলো। আমরা ঠিক করলাম ফেরার সময় পেট ভরে খেয়ে নিবো। রাস্তার ধারে নানা রকমের পসরা সাজিয়ে বসেছে লোকজন। এলুমিনিয়ামের বাটি থেকে শুরু করে আতরের শিশি কি নাই সেখানে! সব কিছুই দামে সস্তা। কে জানি একটা ছোট্ট এলুমিনিয়ামের বদনা কিনলো। এই সব দেখতে দেখতে আমরা হাঁটতে লাগলাম। আস্তে আস্তে একেবারে বাজারের মত জায়গায় ঢুকে গেলাম। লোক জনের হাঁকডাক বাড়তে লাগলো। দুইপাশের দোকান গুলোতে থালা ভর্তি ফুল, মোমবাতি, গোলাপ জল, আগরবাতি, লাল সুতা, জরি দেওয়া কাপড় এইসব সাজিয়ে রেখেছে। আর আমাদের চিৎকার করে বলতে লাগলো স্যান্ডেল খুলে জমা দিয়ে ভিতরে যেতে। যারা আগে কখনো দরগায় যায় নাই তারা লোকজনের এই রকম আচরন দেখে নার্ভাস হয়ে গেলো। আমরা কয়েকজন মিলে ঐসব লোকদের ধমক ধামক উপেক্ষা করে হাঁটতে লাগলাম। যতই সামনে যেতে লাগলাম ততই লোকজন আমাদের ধরেবেঁধে ওই সব থালা কিনতে বাধ্য করার চেষ্টা করতে লাগলো। আমরা সবশেষে একেবারে বাজারের শেষ মাথায় এসে জুতা খুললাম। ওইখানে এক দোকানে জুতা জমা দিয়ে ঢুকলাম দরগার উঠানে।

একটা ছবি থেকে তোলা নিজামুদ্দিন দরগার এরিয়াল ভিউ
একটা ছবি থেকে তোলা নিজামুদ্দিন দরগার এরিয়াল ভিউ

এই দরগার খোলা জায়গা গুলো টুকরা টুকরা। আর সারা উঠান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কবর। মনে হলো উনারা যে যেই জায়গায় মারা গিয়েছিলেন ঠিক সেই জায়গাতেই উনাদের কবর দেওয়া হয়েছে। আমরা সাবধানে কবর পাশ কাটিয়ে হেঁটে হেঁটে নিজামুদ্দিনের দরগার সামনে আসলাম। খুব সুন্দর সাদা রঙয়ের পাথরের উপর সোনালি কারুকাজ করা দরগা। ছেলেরা ভিতরে সেই থালা নিয়ে ঢুকছে। আর বাইরে চারপাশে ভীড় করে বসে মহিলারা মোনাজাত করছে, কুরআন শরীফ পড়ছে, কাউকে মনে হলো সেজদা দিতেও দেখলাম। চারিদিকে লাল সুতার সমাহার। দরগার সামনে ছোট উঠানটা জুড়ে কাওয়ালি গানের আসর বসেছে। একজন গায়ক হারমোনিয়াম বাজিয়ে জোর গলায় গান করছে আর তার সাথে অনেকেই ঝুনঝুনি, খঞ্জনি এইসব বাজিয়ে সুর দিচ্ছে। পুরা উঠান জুড়ে লোকজন ভীড় করে গান শুনছে। কেউ কেউ আবেগে মাথা নাড়ছে, হাতে তালি দিচ্ছে। আমার মনে হলো আমাদের দেশে মাজার যেমন শান্ত, নিরিবিলি জায়গা, ইন্ডিয়াতে মাজার বেশ উৎসবমুখর জায়গা। এত বড় একজন আউলিয়ার মাজারের পাশেই উচ্চস্বরে গান বাজনা হচ্ছে ব্যাপারটা দেখে আমার খুব কষ্ট লাগলো। চারিদিকে পুরাই বিদাতি পরিবেশ। এর মাঝে একটু নফল নামাজ পড়া যাবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। তবে খুঁজে পেলাম মেয়েদের নামাজের জায়গা। বলতে গেলে সেটা পুরাই খালি। যাই হোক আমি কোন মতে দু রাকাত নফল নামাজ পড়েই বের হয়ে আসলাম। দেখি কাওয়ালির আসর ভেঙ্গে গিয়েছে। সবাইকে নকুলদানা শিন্নি হিসেবে দেওয়া হয়েছে। আমিও সেই শিন্নির ভাগ পেলাম। লোকজনের হৈচৈ চিৎকার শুনে মনে হলো যেন কোন মেলার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি।

আবার রাত নয়টার সময় শুরু হবে কাওয়ালি। তার আগেই ঘুরেফিরে আমরা বের হয়ে যাওয়ার প্ল্যান করলাম। রাতের বেলায় খুব বেশি ঘোরাঘুরি করতে ইচ্ছা করলো না।  এমনিতেও পরিবেশটা শান্ত নয়, তাই আমরা বের হয়ে এলাম। সেই চিপা বাজারের রাস্তা দিয়ে আবার হেঁটে হেঁটে বাইরে চলে আসলাম। এক লোক দেখলাম ছোট ছোট শিক কাবাব বিক্রি করছে। আমরা ২০ রুপি দিয়ে ৪টা শিক কাবাব কিনে খেলাম। খুব বেশি মজা লাগলো না। পরে ঘোরাঘুরি করে এক হোটেলের দোতলায় উঠে বসলাম। সেই হোটেলে আমরা ছাড়া আর কোন মেয়ে নাই। সারা এলাকাতেই অবশ্য আমরা ছাড়া তেমন কোন  মেয়েই ছিলো না। আমরা আরাম করে বসে নানা রকম আইটেম অর্ডার দিলাম।  গল্পগুজব করতে করতে আমরা হোটেলটাকে গমগমে বানিয়ে ফেললাম। নিচে যেসব লোক বসা ছিলো, ওনারা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো যে কারা এত হৈচৈ করছে। এক সময় আমাদের অর্ডার আসলো। আমার ৩৯ রুপির ডাল গোস্ত আর নান মজা ছিলো। এছাড়া মগজ, নেহেরি, ফ্রায়েড চিকেন, সিল্মা রুটি সবই টেস্ট করে দেখলাম। সবগুলোই মজা। খেয়ে দেয়ে অনেকে আবার চা অর্ডার দিলো। সব শেষে বিল মিটিয়ে আমরা বের হয়ে আসলাম। দেখি বড় বড় লাল মোহন যাকে ওরা বলে ‘গুলাব্জামুন’ জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। আমরা ছোট বাটিতে করে সিরায় ডুবানো লাল মোহন খেলাম। অনেকে হালুয়াও টেস্ট করলো। পেট ভরে সব খেয়ে দেয়ে আমরা ফাইনালি বের হয়ে আসলাম। একটা অটো ভাড়া নিলাম মোড়ের থেকে। ১০০ রুপি ভাড়া নিয়ে সেই অটো আমাদের হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলো।

হোটেলে ফিরে ছোট্ট রুমটাতে ঢুকে আমার আবার মন খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু কি আর করা, একজন লোককে ডাকিয়ে বাথরুমটা পরিষ্কার করে দিতে বললাম। কিন্তু যেই লাউ সেই কদুই রইলো। কিছুক্ষণ পাশের রুমের সুমাইয়া, রাত্রির সাথে গল্পগুজব করে রুমে ফিরে আসলাম। ওদিকে মজুমদার আর মৌলিও ফেরত এসেছে। সবাই মিলে বিছানাটায় চাপাচাপি করে শুয়ে পড়লাম। সহসা ঘুম আসতে চাইলো না। তারপর এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।