The Mighty INDIA CALLING: পড়াশুনার শহর আহমেদাবাদ এবং হোটেল বিড়ম্বনা (পর্ব ২৩)

গোয়েলে এক বেলা ঘুম দিলে শরীরের তিনটা জায়গায় ব্যাথা করতে থাকে। এক নম্বর- ঘাড়, দুই নম্বর কোমর আর তিন নম্বর হাঁটু। এই তিনটা জায়গায় প্রথমে অল্প অল্প তারপর আস্তে আস্তে ব্যাথা বাড়তে থাকে। ব্যাথা করতে করতে যখন টনটন করতে থাকে তখন ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমারও এরকম গভীর ঘুমের মধ্য থেকে  টনটনে ব্যাথার কারনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমি হালকা নড়াচড়া করে ব্যাথাটা কমিয়ে নিলাম। টের পেলাম ভোর হয়ে গেছে আর কোন এক রাস্তার ধারে আমাদের গোয়েল থেমে আছে। আমরা আহমেদাবাদ পৌঁছে গেছি। কমিটির লোকজন হোটেল খুঁজতে গিয়েছে। আমি আবার চোখ বুজে ঘুম দিতে লাগলাম।

একটু বেলা বাড়তেই বাসের লোকজন অল্প অল্প করে জেগে উঠতে লাগলো। ফিসফাস শুনতে পারছিলাম যে হোটেল পেতে নাকি সমস্যা হচ্ছে। একসময় সবাই জেগে উঠলাম। আমি ভালো করে চারপাশ তাকিয়ে দেখলাম। আমাদের বাস একেবারে একটা বড় রাস্তার পাশে পার্ক করা। রাস্তা দিয়ে হুশ করে বড় বড় বাস, প্রাইভেট কার যাচ্ছে। পাশেই ফ্রেশ হওয়ার মত একটা ছোট খাটো হোটেল আছে। অনেকেই নেমে  হাতমুখ ধুয়ে আসতে লাগলো। অনেকেই বাসেই গ্যাট মেরে বসে রইলো। জুবায়ের ওর কম্বলটা দিয়ে মুখটা ঢেকে বসে রইলো, দেখে মনে হচ্ছিলো ওটা শুধুই কম্বলের দলা। বাইরের হোটেল থেকে ফ্রেশ হয়ে তমা হ্যাভার স্যাকের সারি পার হয়ে সিটের দিকে আসতে লাগলো। জুবায়েরকে কম্বল মনে করে ও একবার ভুল করে জুবায়েরের মাথার ওপর হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠলো। সবাই এক দফা হেসে উঠলো। কয়েক মিনিট পর নিশাতও ঠিক একই ভুল করে চিৎকার দিয়ে উঠলো। সবাই আবার হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলো।

বাসে বসে আমরা অপেক্ষা করতেই লাগলাম। সেই অপেক্ষা আর শেষ হচ্ছে না। সত্যিই তাহলে আমাদের কমিটি হোটেল নিয়ে সমস্যায় পড়েছে। প্রায় দুই ঘন্টা অপেক্ষা করার পর সকাল দশটার দিকে শুভ বাসে সবার উদ্দেশ্যে বললো যে সত্যিই হোটেল পেতে সমস্যা হচ্ছে। কি এক বানিজ্য মেলা না কি যেন হচ্ছে এই শহরে। এই জন্য সব হোটেল বুকড। খালি পাওয়া যাচ্ছে না। কোন রকম একটা হোটেল পাওয়া গেছে কিন্তু সেখানে সবার জায়গা হবে না। কমিটি তাই বিশটা মেয়ে আর চারটা ছেলের নাম ঘোষনা করলো যারা এই হোটেলে যাবে। আর বাকিদের বাসে বসেই অপেক্ষা করতে হবে। এই বিশ জন মেয়ের মধ্যে আমার আর রুবাইদার নাম ছিলো। আমি ব্যাক প্যাক পিঠে নিয়ে নেমে পড়তে লাগবো এমন সময় দেখলাম মৌলির শরীর বেশ খারাপ কিন্তু ও নাম বলা হয় নাই। আমি অনেক বললাম যে আমি থেকে যাই আর ও চলে যাক, কিন্তু কিছুতেই ও রাজি হলো না। শেষমেষ কি আর করা, বাকিদের ফেলে রেখে আমরা নেমে পড়লাম বাস থেকে। আর ওদিকে অপেক্ষা করতে হবে শুনে জেরিন চটপট একটা মিনি প্যাক শ্যাম্পু খুলে মাথায় লাগিয়ে সেই হোটেলের হাত ধোয়ার বেসিনে গিয়ে মাথাটা ধুয়ে ফেললো। হোটেলের লোকজন অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।

আমি, রুবাইদা, মিম আর অন্তরা ১০০ রুপি দিয়ে অটো ভাড়া করলাম- নারোলের বিটিআরএস ওয়ার্ক শপের উল্টাপাশের ‘ত্রুপ্তি হোটেল’। আমরা গুটিসুটি মেরে উঠে বসলাম অটোতে। অনেক্ষন পর অটো আমাদের এক জায়গায় এনে নামিয়ে দিতে চাইলো। আমরা হোটেল কোথায় জানতে চাইলে রাস্তার ওপারে দেখিয়ে দিলো। আমরা দেখতে পেলাম ত্রুপ্তি হোটেলের সাইন বোর্ড। আমরা বললাম একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে। অটোওয়ালা কিছুতেই রাজি হলো না। সে বললো যে সে আমাদের রাস্তা পার করে দিবে- চিন্তার কিছু নাই। আমরা ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। লোকটা অন্তরার ব্যাগটা নামিয়ে দিয়ে কোন ফাঁক দিয়ে পালিয়ে গেলো আমরা টেরই পেলাম না।  প্রচন্ড ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে ফুল স্পিডে গাড়ি যাচ্ছে। এর মধ্যে মালপত্র নিয়ে দুই নম্বুরি অটোওয়ালাকে বকতে বকতে আমরা কোন রকম রাস্তা পার হলাম।

হোটেলের নিচ তলাটা খাবার হোটেল। একটা সিড়ি বেয়ে আমরা দোতলার কাউন্টারে পৌঁছালাম। সেখানে রাজিবের সাথে ম্যানেজারের কথা শুনলাম। উনি বার বার জানতে চাইছেন কতজন মেয়ে আছে আমাদের সাথে। আমি রাজিবকে জিজ্ঞেস করলাম কি কাহিনি? রাজিব বললো উনারা চেষ্টা করছেন একই হোটেলে সবাইকে রাখার জন্য। সবাই না হলেও অ্যাট লিস্ট সব মেয়েদের একসাথে জায়গা দেওয়া যাবে কিনা সেই হিসাব করছেন। আমিও শুনে খুশি হলাম। একটু কষ্ট হলেও সবাই যদি একসাথে থাকা যায় সেটাই ভালো। আমি, রুবাইদা, মিম আর অন্তরা একটা রুম পেলাম দোতলায়। রুমটায় ঢুকে একটু হতাশ হলাম। ছোট অন্ধকার রুম, কোন জানালা নাই। কেমন একটা বদ্ধ বোটকা গন্ধ। কিন্তু কি আর করা, থাকার জায়গা পেয়েছি এই তো বেশি। আমরা একে একে সবাই ফ্রেশ হয়ে নেই। তারপর খেতে নামি নিচের দিকে।

রিসিপশনের সামনে দেখা হয় মজুমদার, আর মৌলির সাথে। আমাদের বাকি সবাইকে এই হোটেলেই জায়গা দেওয়া হয়েছে, তবে বেসমেন্টে। যাই হোক সবাই আমরা একই হোটেলে আছি, এটাই বড় কথা। ওরা দুইজন পেয়েছে একটা ডবল রুম। ওরা আমাকে অফার দিলো ওদের রুমে চলে যাওয়ার জন্য। আমার মনে হলো অফারটা ভালো। রুবাইদাও বললো আমাকে ওদের রুমে চলে যেতে। যাই হোক আমরা নিচে নেমে খেতে বসি। খেতে বসে অর্ডার দেই ভেজ পোলাও। খাওয়াটা খুবই মজা আর দাম অনেক কম। মাত্র ৪০ রুপি। আশেপাশে আমাদের যারা খেতে বসেছিলো সবাই জানালো যে প্রত্যেকের আইটেমই ভালো। শান্তকে দেখলাম ৬ রুপি দিয়ে আইস্ক্রিমের কাপ খেতে। ভাদিলালের আইসক্রিম। এত্ত সস্তা দেখে আমারও খুব খেতে ইচ্ছা করলো। কিন্তু পরে আরেকজনের লাচ্ছি দেখে সেটাই অর্ডার দিলাম। সাদা ঘন গ্লাস ভর্তি লাচ্ছি, এর মধ্যে রুহ আফজা, বাদাম, জেলো আর আইসক্রিম দেওয়া। চামচ দিয়ে খেতে হয়। ৩৫ রুপির লাচ্ছিটা খুবই মজা খেতে।

দারুন মজার এক মগ লাচ্ছি
দারুন মজার এক মগ লাচ্ছি

খাওয়াদাওয়া শেষে আমি আমার রুম থেকে মালপত্র নিয়ে বেজমেন্টে মজুমদারদের রুমে চলে আসি। বেজমেন্টের সিড়িটা দিয়ে ঢুকলে হাতের বাম পাশে প্রথম রুমটাই আমাদের। এছাড়া বেজমেন্টের বাকি রুমগুলোতেও সব আমাদের লোকজন। পুরো বেজমেন্টে কেমন যেন একটা ঘরোয়া পরিবেশ তৈরি হলো। সবাই বেশ হৈচৈ করতে লাগলো। আমি ব্যাগট্যাগ নিয়ে রুমে ঢুকলাম। এই রুমটাও ছোট্ট, কোন জানালা নাই, কিন্তু সেই গুমোট বোটকা কোন গন্ধ নাই। মৌলি গোসল করছে আর মজুমদার অলরেডি গোসল করে ফেলেছে। আমি ব্যাগ খুলে আমার জিনিসপত্র বের করে রেডি হয়ে বসে রইলাম, মৌলি বের হলেই আমি ঢুকবো গোসল করতে। মৌলি বের হলে আমি গোসলে ঢুকি আর ওরা খাওয়ার জন্য বের হয়ে যায়। এইখানে গরম পানির ব্যবস্থা নাই, কিন্তু কলের পানিটাই আরামদায়ক তাপমাত্রার। আমি শান্তিমত গোসল করলাম।

গোসল শেষে নামাজ পড়ে নিলাম। তারপর আমি দোতলার রুমে রুবাইদার সাথে দেখা করতে গেলাম। ওরা তিন জনও রেডি। আমাকে দেখেই বের হয়ে পড়লো। আমরা রিসেপশনের লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম আশেপাশে দেখার মতন কি কি আছে। সব শুনে বুঝলাম সস্তায় কেনাকাটা করার মতন জায়গা আছে একটা যেটা আমরা শুনে বুঝতে পারলাম না। লোকটা কাগজে হিন্দীতে কি যান একটা লিখে দিলো। আমরা বললাম বুঝি নাই, ইংরেজিতে লিখে দিতে। লোকটা একটু অবাক হয়ে লিখে দিলো ‘Lal Darwaja’ আর ‘Khamasa’। বললো বাসেও যেতে পারি, অটোতেও যেতে পারি। সব শুনেটুনে আমরা নেমে পড়ি অটো ঠিক করতে।

অটোওয়ালা আর অন্তরার মোবাইলের ‘অ্যারাউন্ড মি’ অ্যাপসের মধ্যে আপস করে আমরা রওয়ানা দেই ‘তিন দরওয়াজা’ নামক জায়গার দিকে। অটোতে করে ঘুরতে ঘুরতে আমি চারপাশটা দেখতে থাকি। আহমেদাবাদে প্রচুর মুসলমান। আমার কাছে দেখে মনে হলো আহমেদাবাদটা অনেকটাই বাংলাদেশের মতন। মানুষজন, পোশাক পরিচ্ছদ, ঘরবাড়ি, অলিগলি, চিপাচাপা সবই আমার দেশের মতন মনে হলো। খালি রাস্তায় প্রচুর মোটর সাইকেল, আর মেয়ে মোটর সাইকেল চালক সংখ্যায় অনেক বেশি -যেটা আমাদের দেশে একেবারেই কম। সব মেয়েরা বিশেষ কায়দায় ওড়না দিয়ে মুখ আর চুল ঢেকে শুধু চোখ দুটো বের করে মোটর সাইকেল চালায়। প্রথমে দেখে আমি এটাকে হিজাব মনে করেছিলাম। কিন্তু পরে মনে হলো এটা মনে হয় ধুলা বালি থেকে মুখ বাঁচানোর উপায়। আমরা চিপাচাপা গলি দিয়ে যেতে থাকি। একসময় পাড়ার মসজিদ চোখে পড়ে। মুসল্লীরা দল বেঁধে বের হচ্ছে মসজিদ থেকে। কারুকাজ করে সাজানো বেশ কয়েকটা ঘোড়ার গাড়িও চোখে পড়লো। অনেক্ষন ঘুরেফিরে আমরা এসে থামলাম আমাদের গন্তব্যে।

আশেপাশে দেখে আমরা একটু ডান বামে তাকালাম। বেশ বিশাল বাজার বলেই মনে হলো। রাস্তার দুইপাশেই হকাররা বসে আছে। হকারদের বহর দেখে মনে হচ্ছে সামনে নিশ্চয়ই বিরাট কোন মার্কেট আছে। আমরা একদিক থেকে হাঁটা শুরু করলাম। প্রচুর হকার, প্রচুর ভিড়, ডাকাডাকি ধাক্কাধাক্কি – যেন পুরাই চাঁদনি চক গাউসিয়ার সামনের ফুটপাথ। সস্তা, চকচকে জিনিসপাতিতে ভরা চারপাশ। আমরা কোনমতে ভিড় ঠেলে ধাক্কাধাক্কি করে সামনে যেতে লাগলাম। কিন্তু কোন বড় মার্কেট আর দেখতে পাচ্ছিলাম না। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম আমরা। জানতে পারলাম এখানে কোন বড় মার্কেট নাই, সবই রাস্তার হকার। আমাদের মন খারাপ হয়ে গেলো কারণ এইসব জিনিস তো আমরা কিনতে আসি নাই। রাস্তার এক ধারে দাঁড়িয়ে দিলাম খোঁজ অ্যারাউন্ড মিতে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে আমরা ঠিক করলাম, যাবো আলফা ওয়ান শপিং মলে। অটো ঠিক করে রওয়ানা দিলাম ‘বস্ত্র পুর’ এর উদ্দেশ্যে।

এটা অনেক দূরের রাস্তা। আমরা আহমেদাবাদের পুরানো এলাকায় ছিলাম যেটা অনেকটা আমাদের পুরানো ঢাকার মত। এরপর একটা নদী পার হলাম যেটার নাম সবরমোতি। নদীটা পার হওয়ার পর থেকেই আমরা নতুন আহমেদাবাদ দেখতে পেলাম। নতুন চকচকে প্ল্যান করা শহর যেন বলে মনে হলো। ঠিক যেন আমাদের দেশের গুলশান বা বনানীর রাস্তাগুলো। সব ঝকঝকে দোকানপাট, ঝাঁ চকচকে দালান আর সাইন বোর্ড চোখে পড়তে লাগলো। বস্ত্র পুরে এসে যখন নামলাম আলফা ওয়ানের সামনে, সুন্দর চকচকে মার্কেটটা দেখে আমরা বেশ খুশি হয়ে গেলাম। বেশ বড় মলটা এল শেপের, বাইরে অনেক খোলা জায়গা, সেখানে অনেক গাড়ি আর মোটর সাইকেল পার্ক করা আছে। আমরা খুশি খুশি মনে ভিতরে ঢুকলাম।

নিচ তলায় বেশ বড় বড় লাইফস্টাইল স্টোর। আমরা সেরকম একটাতে ঢুকে গেলাম। অনেক বড় স্টোর। ঘুরতে ঘুরতে এখানে ফাস্ট ট্র্যাকের সেই ঘড়িটা পেয়ে গেলাম। সাথে আরও একটা গোবদা ঘড়ি ছিলো সেটাও পছন্দ হলো। দেশে ভাইয়াকে এস এম এস করে মডেল নম্বর পাঠালাম। ভাইয়া দেখে আমাকে আগের ঘড়িটাই সাজেস্ট করলো। বেশ কয়েকবার চিন্তা করলাম, ২০০০ এর মত রুপি খরচ করে এখনই ঘড়িটা কিনবো নাকি পরে ফেরার সময় কোলকাতা থেকে কিনে নিবো। এইসব চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরতে লাগলাম। সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় সাজানো আছে যেগুলো আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। মিম আর অন্তরা কসমেটিক কিনলো। আমরা এই স্টোরের বাইরে অনেক সুন্দর সুন্দর জামাকাপড়ের দোকান দেখলাম। কয়েকটা দোকানে দেখলাম ৭০% ছাড় দেওয়ার পরও দাম আমার সাধ্যের বাইরে। এর মধ্যেও বিবা, ফ্যাব ইন্ডিয়া, হ্যাম্লিস, এইসব দোকানে পারফিউম, কস্মেটিক্স, খেলনা এইগুলো আমরা দেখতে লাগলাম। এই দোকান ঐ দোকান দেখতে দেখতে কখন যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে তা টের পাই নাই আমরা। দামি এই মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে আমার মনে হলো এখানকার জিনিস অনেক সুন্দর এবং একইসাথে দামও অনেক চড়া। এরই মধ্যে পেয়ে গেলাম একটা ফাস্ট ট্র্যাকের শোরুম। এইবার আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, যা আছে কপালে- কিনে ফেলি ঘড়িটা। ঘড়িটা কিনে খুশি খুশি মনে গেলাম খাওয়া দাওয়া করতে ‘সাবওয়ে’ তে।

সাবওয়ের লোভনীয় ননভেজ মেনুগুলো বাদ দিয়ে আমি আর রুবাইদা অর্ডার দিলাম ১৩০ রুপির ভেজ আইটেম ‘চানা চটপটা’। রুবাইদার সেরকম ভালো না লাগলেও আমার কাছে খাবারটা পছন্দই হয়েছিল। পেট ভরে খেয়ে দেয়ে আমরা বের হলাম সাবওয়ে থেকে। মোটামুটি রাত ৮ টা বেজে গেছে। নিচে নেমে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা অটো ঠিক করতে লাগলাম। অন্তরা চিৎকার করে ডাকতে লাগলো, ‘ও ভাইসাব, নারোল জাওগি কেয়া? চান্দোলা লেক, বি আর টি এস ওয়ার্কশপকে পাস?’। বেশিরভাগ অটোওয়ালাই যেতে চাইলো না। তারপর কোনরকম একটা অটো রাজি হওয়ার সাথে সাথেই আমরা উঠে পড়ি।

পুরো ইন্ডিয়াতে আমি বেশিরভাগ অটোতেই কারও না কারও কোলে চড়ে পার করেছি। আহমেদাবাদ আসার পর থেকেই রুবাইদার কোলে বসেই সারাদিন ঘোরাঘুরি করা হয়েছে। এবারও তাই হলো। আমরা গাদাগাদি করে বসলাম। অটো আমাদের নিয়ে ছুটতে লাগলো পুরানো আহমেদাবাদের দিকে। আমি গলা বাড়িয়ে দেখতে লাগলাম হলুদ সোডিয়াম আলোতে উদ্ভাসিত রাতের আহমেদাবাদ শহরকে। রাস্তা ভর্তি গাড়িঘোড়া, রাতেও প্রচুর মানুষজন চারপাশে। আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে লাগলাম। আমাদের কথা শুনে অটোওয়ালা কি কি সব বলতে লাগলো, আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। এখানকার লোকজনের ভাষায় হিন্দীর সাথে গুজরাটি ভাষা মিশানো থাকে। গুজরাটি টোনের হিন্দী আমাদের বুঝতে অনেক কষ্টই হয়। আমরা কোনরকম হ্যাঁ, না- এসব বলে বলে টাইম পাস করতে লাগলাম।

ওদিকে অটোওয়ালা অনেক দূর গিয়ে এক জায়গায় এসে আমাদের জিজ্ঞেস করতে লাগলো যে আমাদের হোটেল আর কত দূর, উনি নাকি রাস্তা চিনেন না। আমাদের মেজাজটা গেলো খারাপ হয়ে, ব্যাটা যদি আগে বলতো যে উনি রাস্তা চিনে না তাহলে তো উনাকে আমরা নিতাম না। আমরা বললাম উল্টা পালটা না গিয়ে রাস্তার কাউকে জিজ্ঞেস করে নিতে। উনি এক দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করে বললো যে এটা নাকি আরও সামনে আর এজন্য ওনাকে আরও ২০-৩০ রুপি এক্সট্রা দিতে হবে। সব শুনে আমাদের মেজাজ বেশ খারাপ হয়ে গেলো অটোওয়ালার উপর। আমরা সেই মূহুর্তেই ভাড়া পরিশোধ করে অটো থেকে নেমে পড়লাম। তারপর পায়ে হাঁটা শুরু করলাম। প্রায় ১০-১৫ মিনিট হেঁটে আমরা পেয়ে গেলাম আমাদের ‘ত্রুপ্তি হোটেল’। সেই সকাল থেকেই আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা টের পেলাম আহমেদাবাদ শহরের একমাত্র বিরক্তিকর জিনিস হচ্ছে ‘অটো’ আর ‘অটোওয়ালা’।

হোটেলে ফিরে বেজমেন্টের সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে আমার রুমের দরজা খুললাম আমি। মজুমদাররাও ফিরে আসলো কিছুক্ষনের মধ্যে। ওদিকে হিমি, শুভ, সীমান্ত, ইশতিয়াক ওরা সবাই ওদের রুমের চাবি নিয়ে রুমমেট না আসা পর্যন্ত আমাদের রুমে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। আমাদের ছোট রুমটা হাসিতে আর আড্ডায় গমগম করতে লাগলো। আহমেদাবাদে এসে মোবাইলে নেটের হাই স্পিড পেয়ে অনেকেই বাসায় ভিডিও কনফারেন্স করে ফেলেছে। আমি রুম থেকে বের হয়ে বেসমেন্টের সিড়িতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাসায় ভিডিও কল দিলাম। অনেক দিন পর বাসার সবার চেহারা দেখলাম। আমার ছোট্ট ওয়াফি গোলাপি ফ্লানেলের জামা পরে আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। অনেক্ষন ধরে কথা বললাম বাসার সবার সাথে। আমার বেজমেন্টের রুমটা দেখালাম। বাসার সবাই দেখলো আমার রুম ভর্তি মানুষজন গল্প গুজব করছে!

সবাই আস্তে আস্তে চলে গেলো আমাদের রুম ছেড়ে। পরেরদিন আমাদের মুভি দেখতে যাওয়ার এবং ডিনারের প্ল্যান সবাইকে রুমে রুমে এসে জানিয়ে দেওয়া হলো। কিছুক্ষণ গল্প গুজব করে আমরা লাইট নিভিয়ে ফ্যান ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

 

 

The Mighty INDIA CALLING: মরুর শহরে দ্বিমিকবাসীর শেষদিন (পর্ব ২২)

কম্বলের নিচে আরামদায়ক পরিবেশে খাসা ঘুমটা ভাংলো এক হতচ্ছাড়া লোকের ডাকাডাকিতে। বিরামহীনভাবে লোকটা ডাকতেই লাগলো। আমার শুনে মনে হলো চা নাশতা খাওয়ার জন্য ডাকছে। এক পর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে মজুমদার হিন্দীতে চিৎকার করে লোকটাকে চলে যেতে বললো। লোকটা যাবার আগেও আরও কয়েকবার চিৎকার করে ডাকতে লাগলো। আরামের ঘুমের চৌদ্দটা বাজিয়ে দেওয়ায় লোকটাকে বকতে বকতে আমরা বিছানা ছেড়ে উঠলাম। বাথরুমে গিয়ে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে দাঁত ব্রাশ করলাম। এখানকার পানি খুবই লবনাক্ত। কেমন যেন স্যালাইন স্যালাইন। জয়সাল্মীর শহরের পানিও লবনাক্ত কিন্তু এতটা না।

হাত মুখ ধোয়ার পর হাত মুখের চামড়া শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেলো। ব্যাগ যেহেতু আনি নাই, তাই লোশন আনাও হয় নাই। কোন উপায় না দেখে শেষমেষ মৌলির কাছ থেকে ‘সিসি ক্রিম’ নিয়ে মুখে মেখে ফেললাম। আমরা সবাই নাশতা খেতে যাওয়ার আগেই তাঁবুতে কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। ব্রেকফাস্টে যাওয়ার জন্য আমাদের তেমন কোন উৎসাহ নাই কারণ আগের দিনের ডিনার দেখেই অনুমান করতে পারছিলাম নাশতাটা কেমন হতে পারে! পরে সবার তাড়া খেয়ে ডাইনিং হলে গেলাম। নাশ্তায় ছিলো লুচি আর আলুর একটা তরকারি। লুচিটা বেশ তেলতেলে আর আলুর তরকারিটায় কোন লবন নাই। কিন্তু এটা পেয়েই আমরা বেশ খুশি হয়ে গেলাম। কারণ আগের রাতের ডিনারের তুলনায় এটা বেশ ভালো। আস্তে ধীরে খেয়েদেয়ে আমরা তাঁবুতে ফিরে আসলাম। আমাদের জিনিসপাতি সব গুছিয়ে বের হয়ে আসলাম তাঁবু থেকে। সকালের হাল্কা রোদে বেশ সতেজ লাগছিলো। আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখছিলাম পুরো ক্যাম্পটা। আমাদের বারবিকিউ করার জায়গাটা সেরকমই পড়ে আছে। সবাই একসাথে হলে আমরা গোয়েলে উঠে পড়লাম। মনে মনে বললাম, ‘বিদায় মরুভূমি’।

আমাদের নিয়ে গোয়েল চলতে শুরু করলো। আবার আগের পথ পাড়ি দিয়ে আমরা চলতে শুরু করলাম জয়সাল্মীরের দিকে। মরুভূমি দেখতে দেখতে একসময় আমার দুই চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। ঠিক সেই সময়ে গোয়েল থেমে গেলো বাড়াবাগ নামক জায়গায়। এখানে নাকি একটা সুন্দর মন্দির আছে। সামনে কে একজন চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলো ‘তোরা কেউ মন্দির দেখতে যেতে চাস?’ সবাই সমস্বরে চিৎকার দিয়ে বললো, ‘না’।  এমনিতেই আমাদের রওয়ানা দিতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো, তার উপর রাত জেগে বারবি কিউ করে সবাই ক্লান্ত, আর এই গনগনে রোদে কারও মন্দিরে যেতে ইচ্ছা করছিলো না। আমরা তাই আর সময় নষ্ট না করে রওয়ানা দিলাম জয়সাল্মীরের দিকে।

জয়সাল্মীরের হোটেলে পৌঁছে আমরা আবার আগের রুমে উঠে বসলাম। ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। তারপর আমি আর রুবাইদা দুজনে দুইটা বই হাতে নিয়ে বের হয়ে পড়লাম গাড়সিসার লেকের উদ্দেশ্যে। অনেকে মুভি দেখার উদ্দেশ্যে বের হলো। আমরা ওদের বিদায় জানিয়ে একটা অটো নিলাম ২০ রুপি দিয়ে। সেটা আমাদের লেকের কাছাকাছি নামিয়ে দিলো। সেখান থেকে নেমে আমরা হাঁটতে লাগলাম। লেকটার চারপাশে বেশ সুন্দর কিছু ইয়েলো স্যান্ডস্টোনের মন্দির আছে। ঢুকতেই একটা পাথুরে গেট পেলাম যেটা ‘তিলোন কি গেট’। সেটাতে একটা বিষ্ণু মূর্তি বসানো। বেশ সুন্দর লাগলো সব কিছু। যদিও লেকের পাশটা নোংরা, লেকটা বেশ পরিষ্কার, টলটলে আর শান্ত। কিন্তু একেবারে নির্জন। আমরা দুইজন ছাড়া বোধহয় আর কোন মানুষজন নেই। দুই একজন লোক অলসভাবে কিছু ব্যাগ, জামাকাপড়, গয়না সাজিয়ে বসে আছে। আমরা লেকের পাড়ে বসতে চাইলাম কিন্তু সেখানে সেখানে বেশ দূর্গন্ধ। শেষমেশ আমরা দুইজন লেকের থেকে দূরে একটা গাছের তলায় বসে বসে চেতন ভগতের বই পড়তে লাগলাম। আমি পড়ছিলাম, ‘থ্রি মিস্টেক্স অফ মাই লাইফ’ আর রুবাইদা পড়ছিলো ‘হাফ গার্লফ্রেন্ড’।  গাছের ছায়ায় বসে বই পড়তে পড়তেই টের পেলাম যারা মুভি দেখতে গিয়েছিলো তারা এখানে এসে ঘোরাঘুরি করছে। হাত নেড়ে ওদের ডাকলাম। জাফর জানালো ওরা মুভির টাইম ধরতে পারে নাই। তাই মুভি দেখার চিন্তা বাদ দিয়ে এখানে চলে এসেছে।

গাড়সিসার লেকের ঘাট
গাড়সিসার লেকের ঘাট

ঠিক ঠিক ১ টা বাজতেই আমরা উঠে পড়ি। লেকের সামনে থেকেই সস্তায় আমি আর রুবাইদা বেশ কিছু জিনিস কিনে ফেলি। আমি এক জোড়া পিতলের বালা কিনি ৩০ রুপি দিয়ে যেটা কোলকাতায় একটাই বিক্রি হচ্ছিলো ৪০ রুপি করে। রুবাইদা নোটবুক, ব্যাগসহ কিছু গিফট আইটেম কিনে। তারপর আমরা হেঁটে হেঁটেই হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই।  নির্জন শহরের লোকজন খুবই কম। রাস্তার আইল্যান্ডে রাজার হালে দাঁড়িয়ে আছে গরুর দল। কেউ কিছু বলছে না। হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেলাম হোটেলে। নিচতলায় সেই খাবার জায়গাটায় বসে অর্ডার দিলাম ভেজ থালি। আমাদের দেখেই সাথে সাথেই ভাত, সবজি, ডাল আর দই এসে হাজির হলো। আবার খুব মজা করে খেলাম। আমাদের সাথে খেতে বসেছিলো তানভীর। লোকটা এসে জিজ্ঞেস করে গেলো তানভীরও ভাত খেতে চায় কিনা? তানভীরও মাথা নেড়ে জানালো যে সেও আমাদের মতন ভাত খেতে চায়। এর মধ্যে একজন কোট পরা লোক তানভীরের সাথে বেশ গল্প জুড়ে দিলো। আমরা দল বেঁধে ৪৫ জন এসেছি, ৪০ দিনের জন্য শুনে লোকটা খুব অবাক হলো। তারপর আরও অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলো, আমরা কই কই গেছি, কই কই যাবো এইসব। সবশেষে উনি বললো উনি এই স্টেশনের মাস্টার। লাঞ্চ করতে এখানে এসেছেন। আমরা খেয়েদেয়ে রুমে ফেরত গেলাম। আমাদের রুম বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা এসে উঠলাম নিশাতদের রুমে।

রুমে ঢুকে দেখি মিম আর অন্তরা টিভি দেখছে। আমি চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে দেখি জি স্টুডিওতে ‘রিয়েল স্টিল’ দেখাচ্ছে। আমরা বিছানায় আধ শোয়া হয়ে মুভি দেখতে লাগলাম। অন্যরাও ফেরত আসলো। ৫টা বাজতেই আমরা নিচে নেমে পড়লাম। ১০২ নম্বর রুম খুলে দেওয়া হলো। আমি ভিতরে ঢুকে লাগেজে স্তুপ সরিয়ে আমার ব্যাকপ্যাকটা আবিষ্কার করলাম যেটা আমি গুছিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। মালপত্র টেনে টেনে নিয়ে গোয়েলের পিছনে দিয়ে আসলাম। আমাদের কমিটি পরম ধৈর্য নিয়ে লাগেজ ওঠানো তদারকি করতে লাগলো। আমি আর রুবাইদা গেলাম পানি কিনতে। এখনও পর্যন্ত যতগুলো জায়গায় গেছি, তারমধ্যে সবচেয়ে সস্তা পানি পেলাম এই জয়সাল্মীরে। এক লিটারের বোতল ১০ রুপি করে। আমি আর রুবাইদা বেশি করে পানি কিনে নিলাম সস্তা পেয়ে। পানি কিনে যখন ফেরত আসি তখন ইশতিয়াক আর নিলয় মিলে বাসের ছাদে ভারি ভারি লাগেজ তুলছে। কাজটা যে কি পরিমান কষ্ট সাধ্য সেটা আর নাই বা বললাম।

আমাদের সিট পড়লো একেবারে শেষের দিকে। আমাদের লাগেজের পরিমান দিন কে দিন বেড়েই চলেছে। বাসের পিছনের কম্পার্টমেন্ট, ছাদ সব ভরে এখন ভিতরেও ব্যাকপ্যাক আসতে শুরু করেছে। আমাদের বাসের আইলের পিছন দিকে  সাত আটটার মতন হ্যাভার স্যাক এসে জড়ো হয়েছে। সাড়ে ৫টার সময় আহমেবাদের উদ্দেশ্যে বাস ছাড়তেই আমি দিব্যি জুতা খুলে একটা হ্যাভার স্যাকের উপর পা তুলে দিলাম। অল্প একটু পরেই অন্ধকার নেমে পড়লো। বড় একটা গোল চাঁদ আমাদের ফলো করতে করতে ছুটতে লাগলো। বাসের ভিতর ঢুকে পড়তে লাগলো ধবধবে জোছনা। আমরাও গলা ছেড়ে গান গাইলাম। বেশ একটা চমৎকার পরিবেশ তৈরি হলো বাসের ভেতর। এরই মধ্যে বাসের ভেতর একটু উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হলো। অবনী ঝট করে উঠে গিয়ে পরিস্থিতি সামলালো। কথা আর বেশি দূর গড়ালো না। আমরা আবার গান গাইতে লাগলাম। নোভাকে দেখলাম ডেজার্ট নাইট শেষ হয়ে গেছে বলে দুঃখ করতে। ডেজার্ট নাইট শেষ মানে নাকি ইন্ডিয়া ট্যুরই শেষ! বাকি দিন গুলা নাকি দেখতে দেখতেই পার হয়ে যাবে। এত স্বপ্নময়ী একটা ট্যুর শেষ হয়ে যাচ্ছে শুনে আমাদের সবারই মন খারাপ হলো। কিন্তু অবনী সবাইকে ধমক দিয়ে বললো, ‘কে বলে ইন্ডিয়া ট্যুর শেষ? শুধু মাত্র সাউথেই আমাদের ১১ দিন থাকতে হবে। এখনও আমাদের অনেক দিন বাকি আছে’। এ কথা শুনে আমরা সবাই ছোট বাচ্চাদের মত একটা আনন্দ ধ্বনি করলাম।

রাত বাড়তে লাগলো। আমরাও চুপচাপ হতে লাগলাম। এই জার্নিটা অনেক বড়। আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। বোধহয় ঘুমিয়েও পড়েছিলাম। রাত ১২ টার সময় বাস থামল ‘সহযোগ রেস্টুরেন্ট’ এ। আমরা সবাই নেমে পড়লাম বাস থেকে। বাথরুমে যাবার জন্য আমরা ছেলেরা আর মেয়েরা পাশাপাশি লাইন ধরলাম। ফ্রেশ হয়ে এসে খাবারের মেনুর উপর চোখ বুলিয়ে দেখলাম। সবাই দেখলাম কমবেশি বিরিয়ানি অর্ডার দিচ্ছে। আমি আর রুবাইদা ভেবে চিনতে ৮০ রুপির হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি অর্ডার দিলাম। এরপর দেখলাম বাহারি রঙের বিরিয়ানি আসছে। হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি একজনেরটা লাল রঙের অন্যজনেরটা সবুজ রঙের। আবার ভেজ বিরিয়ানি কমলা রঙের, ভেজ পোলাভ সেটা আসলে পোলাও সেটা খালি সাদা। আমার মনে হলো সবগুলো একই জিনিস খালি চালের উপর রঙ্গটা আলাদা। আমরা সবাই বাহারি রঙের বিরিয়ানি খেতে লাগলাম। খেতে তেমন কোনই আহামরি কিছু নয়। রঙ চঙ্গে বিরিয়ানি খেয়ে আমরা আবার বাসে উঠলাম। গোয়েল আবার চলতে শুরু করলো।

কোন স্টপেজ থেকে ছাড়ার পর সবাই নতুন উদ্যমে হৈচৈ করতে শুরু করে। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। আমাদের খোশ গল্পে সরগরম হয়ে উঠলো গোয়েল। মধ্যরাতেও আমাদের গল্প, আড্ডা, হাসি চলতেই লাগলো।

 

The Mighty INDIA CALLING: চোখ ধাঁধাঁনো মরু প্রান্তরে দ্বিমিকবাসী এবং গভীর রাতে ঝলসানো মুরগি ও একটি পূর্ণিমার চাঁদ (পর্ব ২১)

সকালে ঝলমলে দিনের আলোতে ঘুম ভাংলো। ফ্রেশ হওয়ার পর আবার ব্যাকপ্যাক গোছগাছ করতে লাগলাম আজকে রাতের ‘ডেজার্ট নাইট’ এর জন্য। তারপর নিচে নেমে এলাম নাশ্তার জন্য। নাশতা পেলাম বড় বড় মাখন দেওয়া চকচকে রুটি, ভাজি আর টক দই। আমি আর মিম শেয়ার করে খেলাম। মনে হলো যেন বাসার নাশতা খাচ্ছি। আমার কাছে ঝাল লাগায় আমি আবার চিনি নিয়ে নিলাম। খুব তৃপ্তি করে খেলাম সব কিছু।

এর মধ্যে আমাদের বাসের ড্রাইভার আর হেল্পারের ঘুম ভেঙ্গেছে। ওনারা বাস থেকে লাগেজ নামিয়ে দিলো। আমরা যার যার লাগেজ টানতে টানতে রুমে নিয়ে গেলাম। রুমে আবার লাগেজ খুলে মালপত্র গুছালাম। আগামী কয়েক দিনের জন্যও জিনিসপত্র ভরে নিলাম ব্যাকপ্যাকে। তারপর সব গুছিয়ে আমরা রুম ছেড়ে দিলাম। ১০২ নম্বর রুমে সব লাগেজ রেখে আসলাম। লাগেজ জমা দিয়ে বের হলাম আমি, রুবাইদা, মিম আর অন্তরা। গন্তব্য ‘সোনার কেল্লা’।

ওদস
সোনার কেল্লার ভিতরে (কৃতজ্ঞতায় সাবরিনা মেহজাবিন রাত্রি)

দূর থেকে সোনার কেল্লা দেখতে দেখতে আমার চোখ জুড়িয়ে গেলো। এবার সোজা নামলাম কেল্লার সামনে। ঝলমলে দিনের আলোয় কেল্লাটা পুরো ঝকঝক করছিলো। ঢাল বেয়ে উঠতেই কতগুলো স্থানীয় মহিলাকে দেখলাম রুপার গয়না বিক্রি করতে। রুপার নূপুর, টিকলি, নথ, বিছা, নেকলেস এইসব। দাম তুলনা মূলক কম। অনেকেই গয়না কিনতে লাগলো। আরেকজনকে দেখলাম একটা বাঁশের তৈরি বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। এক সাদা টুরিস্টকে দেখলাম আগ্রহ নিয়ে সে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর চেষ্টা করতে। এই সব পার হয়ে কেল্লার ভিতরে ঢুকতে লাগলাম আমরা। চিপা চিপা অলি গলি দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম আমরা। দোকান পাট বেশির ভাগই খালি, কোন মানুষজনই নাই- এমনকি দোকানদারও নাই। দোকানে ঢুকে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে কোথা থেকে যেন দোকানের মালিক এসে হাজির হয়।  দোকান গুলোতে জয়পুরের সেই পায়জামাগুলোই পাওয়া যায় তবে জিনিসগুলো জয়পুরের চেয়ে সুন্দর আর দামও জয়পুরের চেয়ে বেশি। বেশ অ্যান্টিক টাইপের জিনিসপাতি আর রত্ন পাথরের গয়না গাটি দেখতে দেখতে আমরা হাঁটছিলাম। জয়সাল্মীরে আসার পর থেকেই মোবাইলে দেশের সাথে যোগাযোগ করতে পাচ্ছিলাম না। এই কেল্লায় এসে নেটওয়ার্ক পেলাম। বাসায় ফোন দিলাম। আম্মুকে চিৎকার করে সব জানালাম। ভাইয়াকে বললাম সব কিছু।

ফদস
সরু গলি ধরে হেঁটে চলা (কৃতজ্ঞতায় সাবরিনা মেহজাবিন রাত্রি)

কেল্লার কিনার ঘেঁষে একটা জায়গা পেলাম যেটা সুইসাইড পয়েন্ট। এখান থেকে নিচে ঝাঁপ দিয়ে বোধহয় মানুষ আত্মহত্যা করে। আমরা সেখানে ছবি তুললাম। আরেকটা জায়গা পেলাম ‘সিটি ভিউ’ যেখান থেকে শান্ত চুপচাপ জয়সাল্মীর শহরটা দেখা যায়। পুরো কেল্লাটাই হলুদ স্যান্ডস্টোন দিয়ে বানানো, খালি কয়েকটা ঘর দেখলাম নীল রঙ করা। এগুলো নাকি ব্রাহ্মণদের ঘর। যেখানে সেখানে রাস্তা দিয়ে গরু হাঁটছে নির্বিকারভাবে। ভেতরে কয়েকটা মিউজিয়াম ছিলো। তাড়াহুড়া করে সেগুলোতে আর ঢোকা হয় নাই। এর মধ্যে অন্তরাও ১৫০০ রুপির আরেকটা স্কার্ট কিনলো। রুবাইদা কিনলো বিশেষ পাথরের তৈরি মগ, আর সবশেষে অন্তরা নূপুর আর ব্যাগ কিনলো। আমরা বের হয়ে আসতে লাগলাম।

ফাভ
সুইসাইড পয়েন্ট থেকে দেখা জয়সাল্মীর শহর ( কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

বের হয়েই এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা হলো। কোন নির্বাচনী প্রচারনার জন্য ট্রাক ভর্তি করে এক নেতার সমর্থক এসেছে। তারা কেল্লার গেটের সামনে ট্রাক পার্ক করে পটকা ফুটাতে লাগলো আর রাস্তা ব্লক করে নাচতে লাগলো। সেই কি আওয়াজ! আমরা কানে আঙ্গুল চেপে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু রাস্তা ব্লক হয়ে যাওয়ায় কোন অটো আমাদের নিতে চাইছিলো না। শেষমেশ বাড়তি দাম দিয়ে একটা অটো ঠিক করলাম যেটা অনেক রাস্তা ঘুরে আমাদের হোটেলের কাছে নিয়ে গেলো। এইসব রাজনৈতিক শোভাযাত্রার কারণে আমাদের পৌঁছাতে বেশ দেরি হয়ে গেলো। হোটেলের কাছাকাছি আসতেই সবাই ফোনের উপর ফোন করতে লাগলো। স্টেশনের সামনে এক পানিপুরি ওয়ালার কাছ থেকে ওরা পানি পুরি অর্ডার দিলো। কিন্তু ফোনের চোটে আমরা সেই পানিপুরি ফেলেই ছুটতে লাগলাম হোটেলের দিকে। আমরা কোনরকম দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হোটেলের সামনে গিয়ে দেখি সবাই গোয়েলে উঠে বসে আছে। শুধু আমাদের জন্যই গোয়েল ছাড়তে পারছে না। আমি বাসে উঠার আগে নিলয়কে একবার রিকোয়েস্ট করলাম ১০২ এর দরজা খুলে দেওয়ার জন্য যাতে আমি আমার গুছিয়ে রাখা ব্যাকপ্যাকটা আনতে পারি। কিন্তু এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি আর ব্যাকপ্যাকটা নিতে পারলাম না। যেভাবে ছিলাম সেভাবেই আমরা চারজন বাসে উঠে পড়লাম। আমরা বাসে উঠতেই বাস ছেড়ে দিলো।

বাসে বসে ধাতস্থ হতে আমার একটু সময় লাগলো। আমি মনে মনে হিসাব করে দেখলাম আমার কাছে এই মূহুর্তে কি কি জিনিস আছে, আর কি কি লাগতে পারে রাতে থাকার জন্য। সব মিলিয়ে দেখলাম শুধু রাতের কম্বলটাই বাদ পড়েছে। এছাড়া যে জামা ঠিক করে রেখেছিলাম সেটার বদলে যে জামা পরা আছি সেটা পড়েই সারাদিন থাকা যাবে। সবচেয়ে পিছনে বসে বাইরের দিকে তাকাতে লাগলাম। কড়কড়ে রোদে আমার বেশ গরম লাগতে লাগলো। শহরটা পার হয়ে যাওয়ার পরই কয়েকটা রাজ প্রাসাদের মত হোটেল দেখলাম। এখানেই নাকি ‘এক থা টাইগার’ সিনেমার শুটিঙ্গের জন্য নায়ক সালমান খান তার দলবল নিয়ে অবস্থান করছেন! তারপরই শুরু হলো মরুভূমি। এই মরুভূমিটার নাম থর। থর মরুভূমিটা সিনেমায় দেখা মরুভূমির চাইতে আলাদা। মরুভূমি বললেই ধূ ধূ বালির প্রান্তর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু এই মরুভূমিতে অল্প বিস্তর গাছ আছে। মাটিও আছে বলে মনে হলো। আর একেবারে বিস্তীর্ণ নয়। মাঝে মাঝেই মানুষজন, কারখানা, উইন্ড মিল, সোলার প্যানেল চোখে পড়ে। দেখে মনে হচ্ছিলো ঠিক যেন মরুভূমি নয়, কেমন যেন বিরানভূমি। মরুভূমিতে খুব বেশি গরম লাগলো না। সূর্যের তেজও সহনীয় মনে হলো।

বাস আমাদের নামিয়ে দিলো একটা জায়গায় যেখানে লাইন ধরে বসে আছে সারি সারি উট। সেখানে নামার পর আমাদের দ্বিগুন দাম দিয়ে পানির বোতল কিনতে হলো। কারণ সামনে নাকি আর পানি পাওয়া যাবে না। পানি কিনে আমরা রংচঙ্গে গদি দিয়ে সাজানো সারি সারি উটের কাছে এসে দাঁড়ালাম। আমাদের জন্য উট ঠিক করে রাখা আছে। আমি আর রুবাইদা হাচড় পাচড় করে একটা উটের পিঠে চড়ে বসলাম। আমি বসলাম সামনে আর পিছনে বসলো রুবাইদা। সামনে ছোট্ট একটা হাতল আছে যেটা আমি শক্ত করে ধরে রাখলাম। আর রুবাইদা কিছু ধরার না পেয়ে আমাকে জাপটে ধরে রাখলো। একটা মাঝবয়সী নীল পাঞ্জাবী পরা মুসলমান লোক উটের দড়িটা ধরে টান দিয়ে তাকে উঠে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলো। উট দাঁড়ানোর সময় আগে পিছনের পা দুটো সোজা করে, তখন আরোহীরা ভূমির সাথে সমান্তরালে না থেকে ৯০ ডিগ্রি আঙ্গেলে অবস্থান করে। আশে পাশের উটগুলা থেকে আমাদের লোকজনদের চিৎকার শুনে বুঝতে পারছিলাম যে ব্যাপারটা বেশ ভীতিকর। যাই হোক আমাদের উট উঠে দাঁড়ালো। প্রথমে যখন পিছনের পা সোজা করলো তখন আমার মনে হলো আমি বোধহয় ছিটকে পড়ে যাবো। কিন্তু পড়ে যাবার আগেই উটটা সামনের পা সোজা করে উঠে দাঁড়ালো। গলা থেকে আর্তচিৎকার বের হবার আগেই আমি সামলে নিলাম। শুরু হলো আমাদের উটের পিঠে মরুভূমিতে জার্নি।

sv
উটে চড়ে দ্বিমিকবাসীর মরু যাত্রা (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম দিশা)

মরুভূমির মধ্যে দিয়ে সব গুলো উট লাইন ধরে চলতে লাগলো। প্রত্যেকটা উটের সাথে একজন করে লোক দড়ি ধরে হাঁটতে লাগলো। মাথার উপর গনগনে সূর্য থাকলেও কোন গরম লাগছিলো না। বালির উপর আমাদের বড় বড় ছায়া পড়ছিলো ঠিক সিনেমায় যেমনটা দেখা যায় সেরকম। উট চলে বেশ গদাই লস্করি চালে। আমরা ঝাঁকি খেতে খেতে চলতে লাগলাম। আমার বেশ ভালোই লাগছিলো কিন্তু পিছনে বসায় রুবাইদার বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। মাঝে মাঝে দুই একটা উট দৌড়ে আমাদের ওভারটেক করে যেতে লাগলো। সারাকে দেখলাম এরকম একটা উটের পিঠে বসে বেশ চিৎকার করতে। আমরা একেক জন একেক উটের পিঠে থেকে একেকজনকে ডাকাডাকি করতে লাগলাম। হৈ চৈ করতে করতে আমাদের শেষ বিকালের মরুভূমি যাত্রা চলতে লাগলো। আমি চোখ ভরে দুই পাশ দেখে নিলাম, উটের পিঠে মরুভূমিতে পাড়ি দেওয়া জীবনে আর কোনদিন হবে বলে ভাবতেও পারছি না। আল্লাহ কত সুন্দর একটা অভিজ্ঞতার সুযোগ দিয়েছেন আমাকে!

ঐ দূরে আমাদের ক্যাম্পের তাঁবু দেখা যায় (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম দিশা)

প্রায় আধা ঘন্টা পর আমাদের যাত্রা শেষ হলো। উটের বসাটাও সেইরকম এক্সাইটিং। তবে এবার আর আমি কোনমতেই চিৎকার দিলাম না। উটওয়ালা আমাদের ক্যামেরায় ছবি তুলে দিলো। উট থেকে নেমে ১০ রুপি বখশিশ দিলাম তাকে। সবাই একে একে উটের পিঠ থেকে নেমে হাত পা ছুড়তে লাগলো। আমার একবার উটের পিঠে চেপে উটের দৌড়ে অংশ নিতে ইচ্ছা করলো কিন্তু কাউকে পার্টনার পেলাম না বলে সেটা আর হয়ে উঠলো না। খানিক্ষন ছবিটবি তুলে আমরা পায়ে হেঁটে আমাদের ক্যাম্পের দিকে যেতে লাগলাম। কিন্তু ক্যাম্প খুলবে সূর্যাস্তের পর। আমরা ক্যাম্পের বাইরে একটা টং ঘর টাইপের দোকানে জড়ো হয়ে বসলাম। অনেকেই সিদ্ধ ডিম, মিরিন্ডা, চা আর ম্যাগী নুডুলস অর্ডার দিলো।  আমি একটা চিপস কিনে খেলাম।

এদচ
কিস কিস কো চায় চাহিয়ে????             (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম দিশা)

সূর্যাস্ত দেখার জন্য আবার আমরা আগের জায়গায় ফেরত গেলাম। দৌড়ে দৌড়ে বালির ঢিবিতে উঠলাম আমরা। দেখলাম মরুভূমির বুকে সূর্যাস্ত। ছোট্ট কমলা সূর্যটা রঙ ছড়িয়ে কেমন করে যেন মেঘের পিছনে হারিয়ে গেলো। আমরা সবাই ছবি তুললাম। ছোট্ট একটা ভিডিওও করলাম। সূর্য ডুবে যেতেই আমরা সবাই ফিরতে লাগলাম ক্যাম্পের গেটের কাছে। পাকা ওয়ালের বাউন্ডারি দেওয়া বিশাল ক্যাম্পের গেটে লিখা আছে ‘ওয়েসিস ক্যাম্প’। পাশে আবার মাভালা ভাই আর মোহাম্মদ আলী ভাই –এই দুইটা নামের পাশে মোবাইল নম্বর লিখা আছে। গেটে জয়পুরি পোশাক পরা একটা মেয়ে হাতে বরন থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দুপাশে কতগুলো বর্শার মধ্যে লাল সবুজ কাপড় বাঁধা। আর একজন বিশাল একটা ঢাক বাজিয়ে যাচ্ছে। আরও বাস ভর্তি লোকজন এসে নামলো। আমরা সবাই লাইন ধরে দাঁড়ালাম। মেয়েটা প্রত্যেকের কপালে লাল তিলক দিয়ে দিতে লাগলো। এটাই বরন। আমি মনে মনে ভাবলাম আমাদের দেশ হলে নিদেন পক্ষে একটা লজেন্স বা চকোলেট তো দিতই ঢুকার সময়! আমি কপালে তিলক না দিয়েই ভিতরে ঢুকলাম। খুঁজেখুঁজে আমাদের জন্য বরাদ্দ তাঁবুটা বের করলাম। তাবুতে ঢুকে আমাদের চোয়াল ঝুলে পড়লো। বেশ আলিশান তাঁবু। পুরোটাই কার্পেট দিয়ে ঢাকা। ভিতরে একটা রট আয়রনের ডবল বেড সাথে মোটা কম্বল। কম্বল পেয়ে আমার ভাবনা দূর হয়ে গেলো। তাঁবুর সাথেই এটাচড বাথ। বাথরুমও পুরোটা কার্পেটে ঢাকা। একটা পোর্টেবল কমোড, স্টিলের বাথটাব, আর আয়না দেওয়া স্টিলের বেসিন আছে। নিজেকে কেমন জানি রাজা রাজা মনে হলো। মরুর বুকে এরকম বিলাসবহুল থাকার জায়গা পাবো ভাবতেই পারি নাই!

সা
রাজস্থানী সাজে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় সাবরিনা মেহজাবিন রাত্রি)

আমরা ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এর মধ্যে বাইরে থেকে বারবার তাগাদা আসতে লাগলো, কি এক কালচারাল প্রোগ্রাম হবে সেখানে উপস্থিত হওয়ার জন্য তা না হলে আমরা নাশতা পাবো না। ‘নাশতা’ শুনেই আমরা বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লাম, ফ্রিতে পাওয়া খাবার বলে কথা! তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে পড়লাম আমরা। খোলা আকাশের নিচে একটা খাটিয়ার মত স্টেজ, সেটাকে ঘিরে আরব মরুভূমিতে বসে হুক্কা টানার জন্য যেরকম গদি থাকে সেরকম গদি সাজানো। আমরা দৌঁড়ে পিছনের দিকে একটা গদি দখল করলাম। আমাদের লোকজন সবাই পিছনের দিকে বসতে লাগলো। আমরা দেখতে লাগলাম অনুষ্ঠান। কয়েকজন লোক আঞ্চলিক গান গাইলো, তারপর দুইজন নৃত্যশিল্পী নাচের পাশাপাশি নানারকম খেলা দেখাতে লাগলো। ভালোই লাগলো সেইসব দেখতে। এর মধ্যে আমাদের সেই ‘নাশতা’ এসে হাজির হলো। এক কাপ চা আর ছোট বাটিতে যেই জিনিসটা আসলো তার নাম ‘পোহা’। জিনিসটা মুখে দিয়ে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। মনে হলো সিঙ্গারা, সমুচার গুঁড়ার সাথে পিয়াজ মরিচ কুচিকুচি করে দিয়ে চিনির সিরা ঢেলে দিয়েছে। অত্যন্ত বাজে এই জিনিসটা আর মুখে দিতে ইচ্ছা হলো না।

দ্ভ
পূর্ণিমা চাঁদের নিচে রাজস্থানী নাচের সাথে সাথে ব্যালেন্সের খেলা চলছে (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

আরও অনেক রকমের খেলা দেখলাম। একজন লোক চাকা আর আগুন নিয়ে কসরত দেখালো। তারপর নৃত্য শিল্পীরা উঠে এসে সবাইকে সামনে গিয়ে নাচার জন্য আহবান করলো। প্রথমে কয়েকজন ইন্ডিয়ান ইতস্তত করলো। অল্প কয়েকজন মিলে নাচা শুরু করলো। তারপর একে একে বাকিরা এগিয়ে গেলো। আমাদের মধ্যে অনেকে উশখুশ করলো সামনে যাওয়ার জন্য। তারপর অনেকে মিলে একসাথে গিয়ে গোল হয়ে দাঁড়ালো, তারপর আস্তে আস্তে নাচা শুরু করলো। এক পর্যায়ে সব ইন্ডিয়ানরা একে একে সরে গেলো। সামনে নাচতে লাগলো শুধু দ্বিমিকবাসী। আমি, মাইশা, রুবাইদা, জেরিন আমরা বসে বসে দেখতে লাগলাম সবাইকে। ঝলমলে পোশাক পড়া মেয়েদের আর মাথায় পাগড়ি বাঁধা ছেলেদের দেখতে বেশ ভালো লাগছিলো। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম সবাইকে। এক পর্যায়ে তুষার এসে ওর পাগড়িটা খুলে আমাকে দিয়ে গেলো। আমি আনন্দের সাথে পাগড়িটা মাথায় পড়লাম।

এর মধ্যে খবর আসলো আমাদের জন্য ডিনার দেওয়া হয়েছে। আমরা খুশি মনে দৌঁড়ে দৌঁড়ে গেলাম ডাইনিং হলে। বুফে খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কিন্তু আইটেমগুলো সবই ভেজ আর অত্যন্ত জঘন্য লাগলো দেখতে। একটা কাউন্টারে ভাত পাওয়া যাচ্ছে শুনে ছুটে গেলাম সেখানে। লোকটা সামান্য এক চামচ ভাত দিলো। আমি নিজে চামচ দিয়ে আরও বেশি ভাত নিয়ে নিলাম। দেখলাম লোকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বোধহয় জীবনে কাউকে এক চামচের বেশি ভাত নিতে দেখে নাই। যেকয়েকটা তরকারি ছিলো সবই খেতে অত্যন্ত বাজে। কি আর করা, পেট ভরানোর জন্য তাই দিয়ে মেখে ভাত খেতে লাগলাম। আমাদের লোকজন একে একে আসতে লাগলো। একটু পর খবর পেলাম ভাত শেষ হয়ে গেছে। উনারা নতুন করে ভাত চড়াতে গেছে। ১০ মিনিট পর ভাত পাওয়া যাবে। আমি মনে মনে হাসলাম, এই লোকগুলোর সাথে বোধহয় আগে বাঙ্গালি কোন দলের সাথে পরিচয় হয় নাই।

অত্যন্ত পচা স্বাদের খাবার খেয়ে, বিশ্রি আচার টেস্ট করে সবাই মুখ ভেংচে বের হয়ে আসলাম সেই ডাইনিং হল থেকে। কালচারাল স্টেজের সব লাইট নিভে যাওয়ায় টের পেলাম আকাশে তখন বিশাল একটা গোল চাঁদ। মরুর বুকে ঝকঝকে পূর্ণিমার চাঁদ দেকে থ হয়ে গেলাম আমি। বিস্তীর্ণ মরুভূমিটাকে আলোতে উদ্ভাসিত করে দিয়ে রেখেছে গোল চাঁদটা। ঠান্ডার প্রকোপটা একটু একটু করে টের পেলাম। তাঁবু থেকে সোয়েটার নিয়ে এসে বসলাম আমরা স্টেজটার চারপাশে গোল হয়ে। গাইতে লাগলাম একের পর এক গান। মরুর বুকে পূর্নিমা, গান গাওয়াটা তো আসেই। কিন্তু আমরা বেশিক্ষণ সেখানে থাকতে পারলাম না। আশপাশের তাঁবু থেকে কমপ্লেন আসতে লাগলো। আমরাও হাতে করে চেয়ারগুলো টেনে নিয়ে আমাদের তাঁবুর সারির কাছাকাছি গোল হয়ে বসলাম। আজকে রাতে মুরগির বারবিকিউ করার কথা। এখানে নন ভেজ অ্যালাউড না। তারপরও আমাদের বিশেষ অনুমতি দেওয়া হয়েছে বারবিকিউ করার জন্য। কিন্তু শর্ত একটাই, আগে সব মেহমানরা ঘুমিয়ে পড়বে তারপর আমরা বারবিকিউ করতে পারবো। একে একে সব লোক তাঁবুর ভিতর ঢুকে পড়লে ক্যাম্পের লোকজন গুটিগুটি পায়ে এসে এক হটপট ভর্তি রুটি, কেরোসিন তেল, বারবিকিউ করার চুলা, শিক, মেরিনেড করা মুরগির মাংস দিয়ে গেলো। ছেলেরা আর ক্যাম্পের লোকজন মিলে একটা গাছের কয়েকটা ডাল ভেঙ্গে আগুন ধরায়। তার উপর চুলাটা বসিয়ে মুরগির মাংসগুলো রেখে দেওয়া হলো। মাংসগুলো মেরিনেড করেছে জুবায়ের। হালাল মুরগি জোগাড় করে মেরিনেড করতে বেচারার যথেষ্ট কষ্ট হয়েছে।

কনকনে ঠান্ডার মধ্যে মুরগির বারবিকিউ চলছে
কনকনে ঠান্ডার মধ্যে মুরগির বারবিকিউ চলছে

রাত বাড়ার সাথে সাথে হুহু করে ঠান্ডা বাড়তে লাগলো। আমরা জ্বলন্ত আগুনের চারপাশে আমাদের চেয়ারগুলো সাজিয়ে বসলাম। অন্তরা পুরো কম্বলটাই নিয়ে এসেছে। আমি ওর কম্বলে ভাগ বসালাম। স্নিকার পরা পা দুটোকে ঠেলে দিলাম আগুনের কাছাকাছি। প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে অনেকেই খাওয়ার আশা বাদ দিয়ে ঘুমাতে গেলো। রুবাইদা বলে গেলো বারবিকিউ শেষ হলে যেন ওকে খবর দেওয়া হয়। আমরা বাকিরা ধৈর্য ধরে বসে রইলাম। তুষার একটু পর পর মাংসগুলোকে উলটে পালটে দিতে লাগলো। আমরা বুভুক্ষের মত তাকিয়ে রইলাম গনগনে আগুনের উপর ঝলসাতে থাকা ছোট ছোট মুরগির টুকরাগুলোর দিকে। এর মধ্যে উৎপাত শুরু হলো কুকুরের। আগুন আর মাংসের গন্ধ পেয়ে ধাড়ি ধাড়ি কুকুর এসে হাজির হলো। সেগুলো কাউকাউ করতে লাগলো। একটা কুকুর তো সারার চেয়ারের নিচেই ঢুকে পড়লো। আর তাঁবুগুলোর মধ্যে নাই কোন তালার ব্যবস্থা। কাপড়ের দরজা ঠেলেই কুকুর গুলো ভিতরে ঢুকে পড়তে লাগলো। এই কুকুর বাহিনী সামলাতে না সামলাতেই বিশাল এক গরু এসে হাজির হলো। গরুটা দূর থেকে কড়া নজরদারি করতে লাগলো আমাদের উপর। গরু আর কুকুর সামলাতে সামলাতে আমাদের প্রথম দফা বারবিকিউ হয়ে গেলো। তুষার আর রাজিব মিলে সেগুলো যত্ন করে হট পটে তুলে রাখলো। কারণ অ্যাট লিস্ট যতজন উপস্থিত, ততটা টুকরা রেডি না হলে খাওয়া শুরু হবে না। দ্বিতীয় দফা মাংস চড়ানো হলো। সবারই প্রচন্ড ক্লান্তি লাগছে কিন্তু বারবি কিউ ফেলে কেউ যেতে রাজি হচ্ছে না। নোভাকে দেখলাম চেয়ারে বসেই গালে হাত দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। আশেপাশের কয়েকজন আবার নোভার সেই পোজের ছবিও তুলে ফেললো। মাথার উপর বড় একটা চাঁদ, চারদিকে ধবধবে জোছনা, মরুর ঠান্ডা বাতাস আর এর মাঝে আগুনের চারপাশে গোলে হয়ে বসে হাসি, তামাশা, গল্প আর গান করতে করতে বারবিকিউ হতে লাগলো। শুভ হাত তুলে গেয়ে শোনালো বরবাদ সিনেমার গান ‘আসো না’। পরবর্তীতে এই গানটাই আমাদের পুরো ট্যুরের যৌথ থিম সং হয়ে যায়।

sac
গভীর রাতে পূর্ণিমা চাঁদের নিচে আমাদের আড্ডা চলছে (কৃতজ্ঞতায় রিজভী হাসান )

আনুমানিক রাত পৌনে দুইটার দিকে দ্বিতীয় দফা বার বি কিউ শেষ হয়। তখন তৃতীয় দফা মাংস চাপিয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি মুরগিগুলোর উপর। কাড়াকাড়ি করে হটপট থেকে আটার রুটি ভাগাভাগি করে নিয়ে কোনরকম মুরগির টুকরাগুলো নিয়ে আমরা গপাগপ খেতে থাকি। পোড়া রুটিগুলো শক্ত হয়ে গেছে, মাংস রুটি সবখানেই মিশে আছে বালি, মুখে দিতেই কিচকিচ করে উঠছে- কিন্তু তাতে কি? যে মজার ঝলসানো মাংসের স্বাদ পাচ্ছিলাম, তা আমাদের রাতের অখাদ্য ভেজ বুফের দুঃখ একেবারে ভুলিয়ে দিলো। তৃপ্তি করে খেলাম সবাই। আমাদের সবাইকে বলে দেওয়া হলো তাঁবুতে গিয়ে যারা ঘুমাচ্ছে তাদেরকে পাঠিয়ে দিতে। আমরা তিনজন তাঁবুতে ফিরে রুবাইদাকে গভীর ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। ও আর এত রাতে ঘুম ফেলে খেতে যেতে রাজি হলো না। আমরাও আর দেরি করলাম না। চটপট সবাই উঠে পড়লাম বিছানায়। ভারি আর পাতলা দুইটা কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

চোখের সামনে ভেসে উঠলো অনেক কিছু- জ্বলজ্বলে সোনালী দূর্গ, ধূ ধূ মরুভূমি, ক্যামেল রাইডিং, সূর্যাস্ত, কালচারাল নাইট, জঘন্য ডিনার, পূর্ণিমার আলোতে কনকনে ঠান্ডায় বারবিকিউ, বিলাসবহুল তাঁবুতে ঘুম……। সব মিলিয়ে ‘ডেজার্ট নাইট’ টা অসম্ভব ভালো কাটলো। এই সব ভাবতে ভাবতেই চট করে ঘুমিয়ে পড়লাম। পূর্ণিমার রাতে মরুভূমির বুকে তাঁবুতে ঘুম, সেই ঘুমের ভাবই আলাদা!

The Mighty INDIA CALLING: মরুর বুকে সোনালি শহর জয়সালমীরে (পর্ব ২০)

বেশ সকালে আমাদের গোয়েল থামলো এক ধাবাতে। আমরা সবাই নেমে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। কেউ কেউ খাওয়াদাওয়া অর্ডার দিতে বসলো। পাওয়া যাচ্ছে শুধু আলু পরোটা যেটাতে আবার লবন নাই। আমার লবন ছাড়া পরোটা খেতে ইচ্ছা করলো না। আমি বিস্কুটের প্যাকেট কিনে খেতে শুরু করলাম। নাশতা খেয়ে দাঁত মেজে নিলাম ধাবার সামনে হাত ধোয়ার বেসিনে। সব শেষে আবার বাসে উঠলাম। গোয়েল ছেড়ে দিলো। আমরা চলতে শুরু করলাম জয়সাল্মিরের দিকে।

প্রায় সকাল ১১টার দিকে আমরা পৌঁছালাম ছোট শহর জয়সালমিরে। আমাদের জন্য ঠিক করা হলো হোটেল অশোকা। ছোট দোতলা হোটেল। বলতে গেলে আমরাই হোটেলের প্রায় সবগুলো রুম দখল করে নিয়ে নিলাম। আমাদের ভাগ্যে জুটলো ট্রিপল বেডের একটা রুম। আমাদের চারজনের সাথে মিমেরও জায়গা হলো এই রুমে। ঝকঝকে দিনের আলোতে উদ্ভাসিত রুমটা আমাদের বেশ পছন্দই হলো। এই ঝকঝকে আলোতেই আবিষ্কার করলাম গায়ের রঙ কয়েক পোচ কালো হয়ে তো গেছেই প্লাস আমার বাম গালে বিশাল এক কালো ছাপ পড়েছে। মিম দেখে বললো, ‘সান বার্ন’। একে একে আমরা গোসল করতে ঢুকলাম। আমি কলে গরম পানির ব্যবস্থা পেয়ে বেশ খুশি হয়ে গেলাম। দারুন একটা গোসল করে বারান্দার রোদে আমাদের সব কাপড় মেলে দিলাম। এই হোটেলে প্রায় প্রতিটা রুমের দুইটা করে দরজা। একটা সামনের দরজা যেটাতে লবি থেকে ঢুকতে হয়, অন্যটা পিছনের দরজা যেটা দিয়ে টানা একটা বারান্দায় যাওয়া যায়। এই টানা বারান্দা আবার সবগুলো রুমকে কানেক্ট করে। আমি বারান্দা দিয়ে হেঁটে হেঁটে অন্যদের রুমে ঘুরে আসতে লাগলাম।

আমাদের বারান্দা থেকেই দেখা যায় যে নিচে বড় চুলাতে রান্নাবান্না হচ্ছে আর খোলা আকাশের নিচে খাটিয়ায় বসে লোকজন খাচ্ছে। আমার এখানে খেতে ইচ্ছা হলো না। দুপুরে খাওয়ার জন্য আমি বের হলাম মজুমদার, মৌলি আর জাফরের সাথে। হোটেল থেকে বের হয়ে চারপাশটা দেখলাম। এটাকে ঠিক শহর না বলে আমাদের দেশের উপজেলা বা সদর বললে মনে হয় ভালো হতো। যে রাস্তা দিয়ে আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম সেটা পুরো মাটির কাঁচা রাস্তা। দুপাশে জঙ্গল টাইপের গাছ। এর মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা সাইজের শুকর। আমাদের গ্রামগুলোতে যেমন রাস্তাঘাটে ছাগল ঘুরে বেড়ায় তেমনি এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে শুকর। যাই হোক কড়া রোদের মধ্যে হেঁটে গিয়ে শেষমেশ একটা খাবারের হোটেল পাওয়া গেলো। আমরা সবাই সেখানে ঢুকলাম। কিন্তু সেখানে ভেজ নাই। সবই মুরগি আর শুকর। আমি সেখান থেকে বের হয়ে এলাম। আবার সেই জঙ্গল আর শুকরের রাস্তা পার হয়ে হোটেলে ফেরত এলাম। হঠাৎ দেখি রুবাইদা হোটেলের নিচেই একটা ছোট্ট রুমে বসে আমার দিকে হাত নাড়ছে। আমি গিয়ে দেখলাম উপর থেকে যে রান্না বান্না দেখেছিলাম, তাদের ইনডোরে বসে খাওয়ার জায়গা এই রুমটা। রুবাইদা অর্ডার দিয়েছে রুটি বাদে শুধু ভাত দিয়ে ভেজ থালি। আমিও সেটাই অর্ডার দিলাম। মালিকটা অবাক হয়ে বললো, ‘আপ ভি রোটি নেহি মাংতা, স্রেফ চাওয়াল?’। আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।

বড় একটা স্টেনলেস স্টিলের থালিতে অনেকগুলো সাদা ভাত, ছোট ছোট বাটিতে ফুলকপির তরকারি, ডাল আর টক দই আসলো। খাবারটা বেশ মজা। কেমন জানি বাসায় রান্না করা খাবারের মত লাগছিলো। অনেকদিন পর তৃপ্তি করে পেট ভরে ভাত খেলাম। শুধু ফুলকপির তরকারিটা ঝাল ছিলো। কিন্তু আমি বলতেই আমাকে এক বাটি চিনি দিয়ে গেলো। আমার কাছে খেতে খুব ভালো লাগছিলো। আমরা ভাতের উপর তরকারি ঢেলে মাখিয়ে খাচ্ছিলাম। আশেপাশের লোকজন একটু অবাক হয়ে দেখছিলো আমাদের ভাত খাওয়ার তরিকা। সব শেষে ডালটা যখন প্লেট কাত করে চুমুক দিয়ে খাচ্ছিলাম তখন মালিকটা আমাদের জিজ্ঞেস করলো, ‘আপ কাঁহাসে আয়া হো’। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে জানতে চাইলো, ‘ক্যায়া ওয়াহা পে সাব লোগ চাওয়াল খাতা হ্যায়?’। সবাই ভাত খায় শুনে উনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘রোটি নেহি খাতা হ্যায় ক্যায়া?’। আমি হেসে জানালাম যে আমরা রুটিও খাই কিন্তু সকালের নাশ্তায়। লোকটা বেশ অবাক হলো। বিল নেওয়ার সময় আমরা রুটি খাই নাই বলে ৬০ রুপির থালি আমাদের কাছে ৫০ রুপি রাখলো। রুবাইদা জিজ্ঞেস করলো রাতেও ভাত পাওয়া যাবে কিনা। উনি জানালো এমনিতে বেশির ভাগ সময় উনারা ভাত রান্না করে না। কিন্তু আমরা যদি খাই তাহলে বারান্দা দিয়ে চিৎকার করে বলে দিলেই উনি ভাত চড়িয়ে দিবেন।

খাওয়া শেষে আমি আর রুবাইদা একটু ঘুরতে বের হলাম। একটু সামনেই একটা রেল স্টেশন। সেই দিকে হাঁটতে লাগলাম। চারিদিকে কেমন কড়া রোদ আর বালি বালি ভাব। রাস্তা ঘাটে তেমন কোন মানুষ জন নাই। কয়েকটা ছেলে মানুষ তাও দেখতে পেলাম। কিন্তু কোথাও কোন মহিলা পেলাম না। মনে হলো সারা শহরে বোধহয় আমরা দুই জনই মেয়ে। স্টেশনটাতে ঢুকে মনে হলো সারা স্টেশনে আমরা দুইজন ছাড়া আর কোন মানুষ নাই। পুরো জনমানবশূন্য একটা স্টেশন। কেমন যেন অস্বস্তি লাগলো আমাদের। আমরা তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসলাম। স্টেশন থেকে বের হয়ে একটু আগাতেই আমাদের মানুষজনের সাথে দেখা হলো। সবাই কথাবার্তা বলে ঠিক করলাম দুপুরের পর রোদের আঁচ একটু কমলেই আমরা ঘুরতে বের হবো। আমরা হোটেলে ফেরত আসলাম। গনগনে সূর্যের কড়া রোদের মধ্যে আমরা গল্প করার জন্য ছাদে উঠলাম। ছাদে ছাউনি দেওয়া চমৎকার বসার জায়গা আছে। সেখানে বসে আমি, মৌলি, সীমান্ত, তুষার, মজুমদার আমরা চরম হাসাহাসি করতে লাগলাম। এর মধ্যে হিমি এলো চমৎকার একটা জামা পরে। জয়পুর থেকে কিনে এরই মধ্যে ও ফিটিং করে নিয়েছে। খানিক পরে আমরা উঠে গেলাম ছোট্ট একটা ঘুম দেওয়ার জন্য। বিছানায় ধড়াম করে পড়েই আমরা ঘুমিয়ে গেলাম।

ঘুম ভাঙতেই আমরা তাড়াহুড়া করে তৈরি হয়ে বের হয়ে পড়লাম।  ছয় জন মিলে একটা অটো ঠিক করলাম বাজারে যাওয়ার জন্য। পার হেড খরচ পড়লো ১০ টাকা। বাজার আর কেল্লা পাশাপাশি। প্রথমে বাজারে নেমে আমরা হাঁটতে লাগলাম। বাজারের জিনিসগুলো বেশ ফ্যাকাশে আর মলিন। মনে হচ্ছে যেন বহু বছর ধরে এখানে নতুন কোন মাল তোলা হয় নাই। লোকজন নাই, ভিড় নাই কেমন যেন চুপচাপ। আমি ওয়াফির জন্য ছোট্ট একটা লাল টুকটুকে পাগড়ি কিনলাম ৩০ রুপি দিয়ে। থান কাপড়, ওয়ান পিস, ঘাগড়া, জুতা, জুয়েলারি আর সেই সব পায়জামা দেখতে দেখতে আমরা হাঁটতে লাগলাম। এখানে বেশির ভাগ জিনিসের দাম জয়পুরের চেয়ে বেশি আর কয়েকটা জিনিসের দাম কম। হঠাৎ মিম ‘পতঞ্জলি’ নামের এক আয়ুর্বেদিক দোকান থেকে আমাকে সান বার্নের জন্য কিছু একটা কিনে নিতে বললো। আমি আর রুবাইদা মিলে একটা অ্যালোভেরা জেল আর সানস্ক্রিন লোশন কিনলাম। এরই মধ্যে অন্তরা ফোন দিয়ে মন খারাপ করলো যে আমরা ওকে না খবর দিয়েই বের হয়ে পড়েছি। ও একা একা হোটেলে বসে আছে।  ঘুরতে ঘুরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার একটু আগে আমরা কেল্লার ভিতরে ঢুকলাম। কেল্লাটা দেখে কেমন যেন লাগলো। সন্ধ্যার আলোতে বিশাল বড় পাহাড়ের উপর কেল্লাটার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো কি যেন একটা মনে পড়ছে, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি কিছু বলার আগেই মিম বলে উঠলো, ‘সোনার কেল্লা!’।

সোনার কেল্লা! সোনার কেল্লা!! সোনার কেল্লা!!!
সোনার কেল্লা! সোনার কেল্লা!! সোনার কেল্লা!!!

আমার হৃদপিন্ড তখন ড্রাম বাজাতে লাগলো। সোনার কেল্লা! এই সেই সোনার কেল্লা, সেই ক্লাস থ্রিতে থাকতে প্রচ্ছদে পিস্তল হাতে সৌমিত্রর ছবি দেওয়া  নীল আকাশের পিছনে ঝকঝকে সোনালি রঙের যে কেল্লাটার ছবি দেখতাম – এটা সেই কেল্লা! এক সাথে আমার মনে পড়ে গেলো সব। জাতিস্মর মুকুলের কথা, নীলুর কিডন্যাপিঙ্গের কথা, যোধপুরে ট্রেনে ফেলুদার সাথে গুন্ডাদের মারামারির কথা, লালমোহন বাবুর সাথে পরিচয়, শুধু মাত্র জিভে গজা খেয়ে স্টেশনে রাত কাটানোর কথা, সবশেষে সামান্য বানান ভুলের সূত্র ধরে নকল ডক্টর হাজরাকে এই সোনার কেল্লাতেই পাকড়াও করা-। আমি তাকিয়ে রইলাম কেল্লাটার দিকে। আমার শৈশবের অত্যন্ত প্রিয় বই ‘সোনার কেল্লা’র সেই কেল্লাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি! ইয়া আল্লাহ, এত সুখ কেন জীবনে?

ঢাল বেয়ে আমরা উপরে উঠতে লাগলাম। মনে হচ্ছিলো যেন কোন সিনেমার ভিতরে ঢুকে পড়েছি। দুপাশের দেওয়াল জুড়ে নানা রকম জামাকাপড় ঝুলানো। কাঁচ বসানো আসল জয়পুরি সুতার কাজ করা জামা কাপড় দেখলাম। দাম অনেক বেশি। হবেই তো- হাতে কাজ করা যে! আশেপাশে ছোটখাট রেস্টুরেন্ট আছে। সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে আমরা সামনে যেতে লাগলাম। বেশ একটা চত্বরের মত খোলা জায়গায় এসে পড়লাম। চারপাশে দোকান পাট, রেস্টুরেন্ট, ঘরবাড়ি। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম সব কিছু। সন্ধ্যার দিকে দোকানপাট সব বন্ধ করে দিচ্ছিলো লোকজন। একটা গলি ধরে একটু আগাতেই এক দোকানে সুতার কাজ করা সিল্কের স্কার্ট মিমের খুব পছন্দ হলো। দরাদরি করে ১৫০০ রুপিতে মিম সেটা কিনে ফেললো। আমি পাশেই দেখলাম একটা দোকান, ‘মুকুল স্টোন শপ’। ভিতরে সাজানো সারি সারি ‘সোনার পাথর বাটি’। আমি মুখ হাঁ করে দেখতে লাগলাম।

মুকুল স্টোন শপে সাজানো সারি সারি 'সোনার পাথর বাটি'
মুকুল স্টোন শপে সাজানো সারি সারি ‘সোনার পাথর বাটি’

দোকান পাট সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো দেখে আমরা আর ভিতরে ঢুকলাম না। ঢালু রাস্তা বেয়ে নেমে আসলাম। ভাবলাম বাজারে কোন রেস্টুরেন্টের কোথাও বসে খেয়ে নিবো। কিন্তু ঘুরেফিরে কোনটাই ভালো লাগলো না। আবার অটো ঠিক করে হোটেলে ফেরত চলে আসলাম। হোটেল পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেলো। ঢুকতেই দেখলাম হোটেলের দরজার কাছে তুষার মন খারাপ করে বসে আছে। ওদের ছেলেদের দুইটা রুম কম ছিলো। ওরা এক রুমের লোকজন ভাগাভাগি হয়ে যায়। আরেক রুমের লোকজন বাকি থাকে। বলা হয়েছিলো বিকালের পর একটা রুম খালি হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন রুম খালি হয় নাই। ওরা পাশের আরেকটা হোটেল দেখে এসেছে কিন্তু রুম ওদের পছন্দ হয় নাই। এজন্য ওদের মন খারাপ। আমি বললাম যাই হোক অন্য কোথাও থাকার দরকার নাই। একান্তই যদি কোন উপায় না থাকে তাহলে আমরা মেয়েরা প্রত্যেকটা ডাবল রুমে পাঁচ জন করে থাকবো, তাহলেই একটা রুম খালি হয়ে যাবে। আশেপাশে যারা ছিলো তারা সবাই ব্যাপারটাতে সায় দিলো। আরও কিছুক্ষন গল্প করে আমরা উঠে আসলাম রুমে। সবাই পরদিনের ডেজার্ট নাইটের জন্য ব্যাগ প্যাক গুছাতে লাগলো। আমরা বারান্দা দিয়ে চিৎকার করে বললাম ভাত রান্না করার জন্য। পরে নিচে খেতে গেলাম। আমাদের থালিতে সাজিয়ে দিলো ভাত, আলুর তরকারি আর ডাল। তৃপ্তি করে খেলাম। খাওয়া বাবদ ৬০ রুপি দিয়ে আমরা আবার রুমে ফেরত গেলাম। ততক্ষনে মিমের স্কার্টের কথা জানাজানি হয়ে গেছে। সবাই দেখতে আসলো সেই স্কার্ট। আমরাও সবাইকে দেখালাম।

গোছগাছ শেষ করে আমরা শুয়ে পড়লাম। লাইট নিভিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই।

The Mighty INDIA CALLING: দুর্ধর্ষ রাজপুতদের গোলাপি মানমন্দির, প্রাসাদ এবং হাওয়া মহল (পর্ব ১৯)

সকালবেলা আগের মত আর ভুল করলাম না। খবর দিয়ে রাখার কারণে কলে গরম পানি পেলাম। শান্তিমত গোসল করে নিলাম ঘুম থেকে উঠেই। তারপর ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিয়ে বের হবার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। আমি, রুবাইদা, মিম আর অন্তরা হাঁটা ধরলাম আগের দিনে রাতের বেলা খেয়েছিলাম যে হোটেলে তার দিকে। আমি অবশ্য রাস্তার সেই রুটি আর সবজি খেতেই রাজি ছিলাম। কিন্তু রুবাইদা নাকি কি এমন জিনিস দেখেছে যে ও আমাদের কাউকে আর সেই রুটি সবজি খেতে দিতে চাইলো না। পথ কিন্তু বেশ অনেকটা। গতকাল রাতে যে রাস্তায় সোডিয়াম লাইটের নিচ দিয়ে হেঁটেছিলাম, আজকে পরিষ্কার দিনের আলোতে সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছি।

অনেক হাঁটার পর যখন সেই হোটেলে পৌঁছালাম দেখলাম সেখানে খাওয়ার কিছু নেই। তারপর সবাই মিলে সেই আগের দিনের মিষ্টির দোকান থেকে হালুয়া মিষ্টি কিনে খাই। আমি একটা ব্রিটানিয়া কেক দিয়েই নাস্তা সেরে ফেলি। সেই মিষ্টির দোকানে কথা বলে আমরা এমন কতগুলো জায়গার কথা জানতে চাই যেগুলো ওনারা চিনেই না। যেমন – ব্লু সিটির কথা উনারা জীবনেও শুনে নাই। তারপর উনাদের কাছ থেকেই সাজেশন নিয়ে আমরা ৮০ রুপি দিয়ে অটো ঠিক করি ‘যন্তর মন্তর’ এর উদ্দেশ্যে। প্রায় ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাই আমরা যন্তর মন্তর।

গেটে দেখলাম ভারতীয়দের জন্যই টিকেট ৪০ রুপি করে। অবাক হয়ে গেলাম, তাজ মহলের টিকেট যেখানে ২০ রুপি সেখানে এই কি না কি যন্তর মন্তর এ ঢুকতে হবে ৪০ রুপির টিকেট কেটে, কি অদ্ভূত! অন্তরা আমাদের জন্য ভারতীয় টিকেট কেটে আনলো। উঁচু দেওয়াল ঘেরা দুর্গের মত জায়গাটায় গেট দিয়ে ঢুকে পড়লাম আমরা। ঢুকে আমরা টের পেলাম যন্তর মন্তর আসলে রাজপুতদের অ্যাস্ট্রোনমিকাল অব্জারভেটরি অথবা সোজা বাংলায় মানমন্দির। রাজপুত রাজা জয় সিং অ্যাস্ট্রোনমি নিয়ে অনেক উৎসুক ছিলেন। উনি সারা ভারতে মোট পাঁচটি মান মন্দির তৈরি করে গেছেন। এদের মধ্যে এই যন্তর মন্তর সবচেয়ে বড়। এখানে মোটমাট ১৯টা যন্ত্র আছে যেগুলার সবগুলাই এখনো সঠিক রিডিং দেয়।

যন্তর মন্তরের একটি বিশালাকার যন্ত্র
যন্তর মন্তরের একটি বিশালাকার যন্ত্র

আমরা ২০০ রুপি দিয়ে ইংরেজি জানা একজন গাইড ঠিক করলাম। উনি আমাদের সব দেখিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। আমরা দেখলাম চক্র যন্ত্র, দক্ষিনত্তর ভিত্তি যন্ত্র, দিগাংশ যন্ত্র, দিশা যন্ত্র, ধ্রুব দর্শক পত্তিকা, জয় প্রকাশ যন্ত্র, কপালা যন্ত্র, কানালি যন্ত্র, ক্রান্তি বৃত্ত যন্ত্র, লঘু সম্রাট যন্ত্র, মিশ্র যন্ত্র, রাম যন্ত্র, রাশি বাল্য যন্ত্র, বিরাট সম্রাট যন্ত্র, যন্ত্র রাজ যন্ত্র ইত্যাদি। এদের মধ্যে অনেকগুলোই প্রথমে বড় করে বানানো, তারপর ঠিকঠাক মত রিডিং পাওয়ার পর একই জিনিস ছোট করে ফাইনালি বানানো হয়েছে। আমরা সব দেখে বুঝে থ হয়ে যাচ্ছিলাম। এত দিনে কোন এক জায়গায় বিজ্ঞান চর্চা নিয়ে কোন রাজার মাথা ব্যাথা দেখলাম। মনে মনে বলেই ফেললাম, ‘হ্যাটস অফ, রাজপুত’। আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম বড় বড় যন্ত্রগুলোর আনাচে কানাচে ধরে। অনেকক্ষন ধরে ঘুরে ফিরে আমরা এক সময় বের হয়ে আসলাম। এখান থেকে খুব কাছে সিটি প্যালেস।

আমরা ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগলাম। রাস্তার পাশে একজন বীন বাজিয়ে ঝাঁপির ভেতর থেকে সাপ বের করে খেলা দেখাচ্ছে। আমরা দেখলাম সাপের নাচ। হঠাৎ কয়েকজন সাদা চামড়ার বিদেশির উৎসাহ দেখে উনারা বাজনা বন্ধ করে পয়সা চাইতে লাগলো। আমরা তখন সুট করে সরে আসলাম। এবার যখন টিকেট কাটতে গেলাম তখন দেখলাম এখানে রেট আরও বেশি, ১০০ রুপি করে। আমরা ‘বীরেন্দ্র পোল’ নামের ধবধবে সাদা গেটটা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ি। ঢুকতেই সামনে পড়লো সাদা রঙের ‘মোবারক মহল’। মহারাজা দ্বিতীয় মাধো সিং এর আমলে বানানো দোতলা মহলটা এখন টেক্সটাইল গ্যালারী। অর্থাৎ এখানে  রাজপুত বংশের লোকদের ব্যবহার করা জামা কাপড় প্রদর্শন করা আছে। তাদের ফর্মাল ড্রেস, ক্যাসুয়াল ড্রেস, গরমের কাপড়, শীতের কাপড়, পলো খেলার পোশাক, যুদ্ধে পরার পোশাক এই সবকিছু সুন্দর করে ডিস্প্লে করা আছে। এর মধ্যে মহারাজা মাধো সিং এর ২৫০ কেজি ওজনের জামা দেখলাম। আরও দেখলাম রাজপুত বংশের মেয়েরা যাতে রাতের অন্ধকারে পলো খেলতে পারে তার জন্য বিশেষ রকমের পলো বল। এই বলের ভিতরে মোমবাতি বসানো থাকতো এবং এমন মেকানিজম ছিলো যাতে যেকোন দিকে বলটা ছুঁড়ে মারলেও সব সময় মোমবাতিটা সোজা হয়েই থাকে।  আমি খানিক্ষন হাঁ করে তাকিয়ে তাই দেখলাম।

দিউয়ানে খাস বা সর্বোতোভদ্র চক
দিউয়ানে খাস বা সর্বোতোভদ্র চক

মোবারক মহল থেকে বের হয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে পেলাম দিউয়ানে খাস বা ‘সর্বতোভদ্র চক’। এখানে আছে দুইটা পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রূপার কলস ‘গঙ্গাজলি’। এর প্রতিটাতে ৯০০ গ্যালন পানি ধরে। মহারাজা দ্বিতীয় মাধো সিং ইংল্যান্ডের সপ্তম এডওয়ার্ডের করোনেশন সেরেমনিতে যোগ দেওয়ার সময় এই দুই কলস ভরে গঙ্গার পানি নিয়ে গিয়েছিলেন। চকচকে কলস দুইটার সাথে দাঁড়িয়ে আমরা ছবি তুললাম। দেওয়ালে ঝুলানো আছে বল্লম, বর্শা, বন্দুক। সাথেই ছিলো সুভেনিয়র শপ। আমরা ঘুরে ঘুরে এসব দেখলাম। চারিদিকে অনেক সাদা চামড়ার বিদেশি ঘোরাফেরা করছে। এর মধ্যে একজন মহিলা অবাক হয়ে মিমের দীঘল কালো চুল হাত দিয়ে ধরে টেনে দেখলো। মিম তার দিকে অবাক হয়ে তাকাতেই মহিলা কিছু না বলেই সরে গেলো। কে জানে, ওদের দেশে হয়তো রুপাঞ্জেল ছাড়া আর কারও বড় চুলই নেই!

এরপর আমরা গেলাম ‘সিলেহখানা’ বা আর্মারি দেখতে। এখানে সারা ইন্ডিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ অ্যান্টিক অস্ত্রের সংগ্রহ রয়েছে। তলোয়ার, ভোজালি, দুই মাথাওয়ালা ভোজালি, ছুরি, কুড়াল, তীর ধনুক সব কিছু সুন্দর করে সাজানো আছে। হরেক রকমের বন্দুক আর গুলি থরে থরে সাজানো। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর আর শাহজাহানের নাম লিখা তলোয়ার দেখলাম। আবার মহারাজা দ্বিতীয় রাম সিং আর দ্বিতীয় মাধো সিং এর ব্যবহার করা অস্ত্রশস্ত্র দেখলাম। অনেক গুলো ছুরি, ভোজালির বাঁটে আবার বিস্তর ধাতব কারুকাজ করা, মূল্যবান রত্ন পাথর বসানো। অস্ত্রগুলো রাখার জন্য কারুকাজ করা হোল্ডস্টার বা কোফতগিরি দেখলাম। বারুদ রাখার জন্য পশুর চামড়া, শিং, শঙ্খ এইসব দিয়ে বানানো বোতলে আবার ধাতু দিয়ে নকশা করা। এ যেন শুধু অস্ত্র নয়, এ যেন এক শিল্প। সেখানে এক ইন্ডিয়ান ছাত্রী আবার আমাদের সাথে কথাবার্তা বলে নিলো যে, আমরা কোথ থেকে এসেছি, কয়জন এসেছি- এইসব। ওনাদের সাথে কথা বলে যখন গ্যালারি থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলাম, আমি রাজপুত বংশের মেধা নিয়ে কি ভাবছিলাম তা আর নাইই বলি।

তারপর দেখতে গেলাম ‘প্রিতম নিবাস চক’। এখানে খুব সুন্দর কারুকাজ করা চারটা গেট আছে, যেগুলো বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ আর শীতকাল নির্দেশ করে। ময়ুর বসানো কারুকাজ করা গেটটার নিচে আমরা সবাই ছবি তুললাম। এখান থেকে দেখা যায় ‘চন্দ্র মহল’ যেখানে বর্তমানে জয়পুরের রাজা থাকে। সত্যিকারের রাজবাড়িটা দেখতে অনেক সুন্দর। ওখানে ঢুকতে গেলে ২০০০ রুপির টিকেট কাটতে হয়। আমরা তাই বাইরে থেকেই দেখলাম। একেবারে উপরে ইন্ডিয়ার পতাকার সাথে সাথে রাজপুত বংশের পতাকাও উড়ছে সমানতালে। সাত তলার রাজকীয় বিল্ডিংটার দিকে আমরা পলক না ফেলে তাকিয়েই রইলাম অনেকক্ষন।

প্রীতম নিবাস বর্তমান রাজা এবং তার পরিবারের বাসস্থান
প্রীতম নিবাস বর্তমান রাজা এবং তার পরিবারের বাসস্থান

এরপর গেলাম ‘সভা নিবাস’ বা ‘দিউয়ানে আম’ বা দরবার হলে। এখানে আছে রাজার সিংহাসন। সিংহাসনের চারপাশে রাজপুত বংশের সব রাজাদের ছবি, নাম, পরিচয় এবং ইতিহাস দিয়ে পুরা দরবার হলটা সাজানো। এছাড়া বড় বড় ঘটনার ধারা বিবরণী ছবি দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রাজপুতদের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস, জ্ঞান চর্চার নমুনা এবং কূটনৈতিক পদক্ষেপ দেখতে দেখতে আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম। সব শেষে দেখলাম মহারাজা ব্রিগেডিয়ার ভবানী সিং এর পর তার মেয়ের ঘরের নাতি পদ্মনাভ সিং কে মাত্র ১২ বছর বয়সে ২০১০ সালে রাজা ঘোষনা দেওয়া হয়। এখন এই রাজার বয়স ১৬ বছর। কি চমৎকার ব্যাপার, ১৬ বছর বয়সেই একজন টিন এজার রাজা পরিচয় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!

সবশেষে আমরা দেখলাম ‘ভাগ্যি খানা’। এখানে রাজাদের ব্যবহার করা গাড়ি, রথ, পালকি এই সব সাজানো আছে। সামনেই কয়েকজন লোক পুতুল নাচ দেখাচ্ছিলো। চারপাশে অনেক দোকানপাট ছিলো। সেগুলোতে মোটামুটি কম দামেই জিনিসপাতি পাওয়া যাচ্ছিলো। অনেকেই এখান থেকে কেনাকাটা করছিলো। আমরা পুতুলনাচ দেখেটেখে দোকানপাট ঘুরে সেখান থেকে বের হয়ে যেতে লাগলাম। তখন এক ম্যাগজিন বিক্রেতার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম, রাজাকে তারা খুবই ভালোবাসে। রাজ পরিবারের প্রতি তাদের অগাধ শ্রদ্ধা। সবকিছু শুনে খুব ভালো লাগলো। ভালো লাগার পাশাপাশি কেমন যেন একটু দুঃখও লাগলো!

এরপর আমরা কয়েকজন অটোওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম হাওয়া মহলের কথা। তারা আমাদের রাস্তা দেখিয়ে বললো খুবই কাছে, হেঁটেই যাওয়া যাবে। ওদিকে দুপুর প্রায় শেষ হয়ে যায় যায় অবস্থা। আমরা ঠিক করলাম আগে খেয়ে নেই তারপর আবার ঘোরাঘুরি করা যাবে। আমি, অন্তরা আর মিম বড় রাস্তার উপর ‘বালাজি রেস্টুরেন্ট’ নামের এক দোকানে ঢুকলাম। তিন জনে দুইটা ফ্রায়েড রাইস অর্ডার দিলাম। বাংলাদেশের ফ্রায়েড রাইস আর এখানকার ফ্রায়েড রাইসের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। এখানে ফ্রায়েড রাইস বলতে যা দিলো তা হচ্ছে- তেলতেলা বাসমতি চালের পোলাওয়ের উপর বড় বড় সবুজ মটরশুটি আর পিয়াজ। অত্যন্ত লবনাক্ত হওয়ার কারণে আমাদের খেতে খুবই কষ্ট হচ্ছিলো। ১০০ রুপি দিয়ে এই খাবার খেয়ে আমাদের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। পরে দোকান থেকে বের হয়ে একটা কোক খেয়ে মুখের লবনাক্ততা কমালাম আমরা। আমরা ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগলাম। দুইপাশে সারি সারি দোকান। মাঝে মধ্যে দুই একটা দোকানে ঢুঁ মেরে বুঝলাম বেশ সন্দেহজনক সবকিছু। দোকানে একবার লোক ঢুকলেই তারা কিছু না কিছু গছিয়ে দেবার পায়তারা করে। বাইরে থেকে জিনিসের এক দাম বলে, কিন্তু যেই জিনিসটা দেখতে যাবো তখনই সেটার দাম বেড়ে যায়। আর কয়েক জায়গায় দেখলাম, সাদা চামড়া বিদেশিদের গলা কেটে লাভ করে নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। এক পর্যায়ে আমরা দোকানদারদের ডাকাডাকিতে বিরক্ত হয়ে গেলাম। কোন দিক না দেখে সোজা হাঁটতে লাগলাম। ঠিক হলো কোন কিছু কিনতে চাইলে ফেরার সময় কিনে নিবো। এরমধ্যে আমি দরাদরি করে ফিক্সড ১০০ রুপির ‘রেবন’ সানগ্লাস ৬০ রুপি দিয়ে কিনলাম। সব কিছু দেখেটেকে অন্তরা সাবধান হয়ে গেলো। ও ঠিক করলো এখন থেকে সব কিছুর দামাদামি শুরু করবে তিন ভাগের এক ভাগ থেকে।

লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে, অনেক গেট ঘরবাড়ি পার হয়ে আমরা হাওয়া মহলের পিছনে এসে পৌঁছালাম। এইখানে ঢুকতে হয় পিছন দিক দিয়েই। আবার ১০ রুপির টিকেট কেটে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। বাইরে থেকে হাওয়া মহলের এলেভিশন দেখেই আমার পছন্দ হয়ে গেলো। ভিতরে ঢুকে তো আরও মজা পেলাম। কয়েকটা উঠান পার হয়ে বেশ চিপা চিপা জায়গা দিয়ে র‍্যাম্প বেয়ে বেয়ে আমরা উপরে উঠতে উঠতে হাঁপিয়ে গেলাম। মজার ব্যাপার হলো এখানে সিঁড়ি নাই, র‍্যাম্প দিয়েই উঠতে হয়। উঠলাম বেশ চিকন একটা টেরাসে। এখানে সবকিছুই খুব চিপা চিপা। খুবই ছোট্ট ছোট্ট জানালা, প্রায় হাতের তালুর সমান। লাল আর গোলাপি সান্ডস্টোনের জালি দিয়ে হুহু করে বাতাস আসছে। আর ছাদের থেকেই দেখা যাচ্ছে আশেপাশের সব কিছু। আমরা এখান থেকে দেখলাম যন্তর মন্তর, সিটি প্যালেস, চন্দ্র মহল- সব।

হাজার জানালার হাওয়া মহল
হাজার জানালার হাওয়া মহল

পুরো হাওয়া মহলে ৯৫৩ টা জানালা আছে। ১৮০০ সালের দিকে এটা বানানো হয়েছিলো যাতে রাজ বংশের মেয়েরা এখানে দাঁড়িয়ে শহরের সব কর্মকান্ড দেখতে পারে। আমরা উপরে উঠে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। রঙ্গিন কাঁচ দেওয়া অনেকগুলো ঘর, অনেকগুলো ছাদ আমরা ঘুরতে ঘুরতে একসময় রুবাইদা হারিয়ে গেলো। কয়েকটা জায়গায় যাওয়ার আগেই কয়েকটা দরজা বন্ধ করে দিলো। একসময় আমরা তিন জন তিনটা আর্চের নিচে দাঁড়িয়ে পোজ মারলাম আর রুবাইদা ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ করে ছবি তুলতে লাগলো। সেই সময় একটা বিদেশি টুরিস্ট দল এসে রুবাইদার পিছনে দাঁড়িয়ে আমাদের ছবি তুলতে লাগলো। আমরা তাড়াতাড়ি সরে গেলাম সেখান থেকে। কিছুক্ষন পর একটা বিদেশি আমাকে দেখে বললো, ‘ওহ, ইউ ওয়ার দোস গার্লস……’। আমি হাসি দিয়ে বললাম, ‘ইয়েস, উই আর’। অনেক গোলক ধাঁধাঁ পার হয়ে ছোট্ট একটা আর্ট এক্সিবিশন দেখতে দেখতে আমাদের সবাই তাড়া দিতে লাগলো যে এখনই বের হয়ে যেতে হবে। আমরা চিপা চিপা পথ ধরে দৌড়াদৌড়ি করে বের হতে লাগলাম।

বের হয়ে আমরা একটু বসে বিশ্রাম নিলাম। আমি বাথরুমে গেলাম। সেখানে আরেক দল বিদেশি টুরিস্ট হাউকাউ করছে। দেখলাম তারা একজন ভিতরে যাচ্ছে, অন্যজন দরজা ধরে রাখছে। আমি ভয় পেলাম, এখানে কি বাথরুমে ছিটকানি নাই? কিন্তু পরে ঢুকে দেখলাম সবই ঠিক আছে, ওরা মনে হয় ছিটকানি জিনিসটা চেনে না। অ্যামেজিং টুরিস্টস!

আমরা বের হয়ে আবার শপিং এ মনোযোগী হলাম। কিন্তু অভিজ্ঞতা বেশ তিক্ত হলো। বিকালে দেখা জিনিসপত্রের দাম এরই মধ্যে বেড়ে গেছে। দামের উল্টা পালটা তো আছেই। আর দোকানদাররা খুব তেল দিয়ে দিয়ে কথাবার্তা বলে। জিজ্ঞেস করে, ‘কাহাসে আয়া হো? আপ ক্যায়া মালয়শিয়া সে হো?’। পরে বাংলাদেশ শুনে একজন বললো, ‘আই লাইক বাংলাদেশ- মিরপুর স্টেডিয়াম- আই লাইক সাকিব আল হাসান’। দামদর করতে করতে সবার মাথা খারাপ হয়ে গেলো। এরই মধ্যে গতকাল যে চুড়ি আমি ১০০ রুপি দিয়ে কিনেছি সেটা অন্তরা দাম করলো। একই জিনিস এক দোকানে ১৫০, এক দোকানে ৯০ আরেক দোকানে ২৫০ রুপি চাইলো। সব শেষে ৯০ রুপির দোকানে গিয়ে অন্তরা যখন কিনতে চাইলো, তখন উনারা জানালো উনারা চুড়ি বিক্রি করবে না। পুরাই ঠগের রাজ্য যেন চারপাশে। বিকালে তাও যা দাম কম ছিলো, এখন তো যার যা দাম ইচ্ছা, তাই হাঁকছে। জিনিস পছন্দ করার সাথে সাথেই দাম বদলে যায়। কি অদ্ভূত জায়গা রে বাবা! আমার মনে হলো এর চেয়ে সিটি প্যালেসের ভিতরে কেনাকাটা করাই ভাল ছিলো।

এরই মধ্যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে গেলো। আমরা চারজন অটো ভাড়া করে হোটেলের দিকে রওয়ানা হলাম। হোটেলে গিয়ে ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে নিয়ে রাতের খাবারের জন্য বের হয়ে পড়লাম। এবার অর্ডার দিলাম আলু টমেটু আর রুটি। খেতে ভালোই ছিলো। পেট ভরে খেয়েদেয়ে হাঁটা ধরলাম হোটেলের দিকে। গোয়েল প্রস্তুত ছিলো আমাদের জন্য। মালপত্র নিয়ে উঠে পড়লাম আমরা। গোয়েল আমাদের নিয়ে রওয়ানা দিলো। পরবর্তী গন্তব্য- জয়সালমীর।