The Mighty INDIA CALLING: একদিনেরও কম সময় চেন্নাইয়ে (পর্ব ৩৭)

আমাদের অ্যালার্মগুলা পর পর বাজার পরও আমরা উঠতে পারলাম না। হঠাৎ দরজায় দুমদুম কিল পড়লো। আমরা লাফিয়ে উঠে গেলাম। জুবায়ের আমাদের নাম ধরে ধরে ডাকতে লাগলো। মজুমদার চিৎকার করে জানালো যে আমরা সবাই উঠে গেছি। হঠাৎ করে গভীর ঘুম থেকে উঠে পড়ায় আমার হার্টবিট বেড়ে চৌদ্দগুন হয়ে গেলো। বিছানায় উঠে বসে ঘড়িতে সময় দেখলাম। বাজে ৪টা ২০। সর্বোনাশ! আমাদের যে উঠতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে! আমরা দুদ্দাড় করে বিছানা থেকে নেমে পড়লাম। ঝটপট রেডি হয়েই একজন একজন করে মালপত্র নিয়ে বের হয়ে গেলাম।

সমস্ত লাগেজ টেনে টেনে নিয়ে সিঁড়ির সামনে এসে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। আবার তিন তলা থেকে এইসব জিনিস নামাতে হবে, কি প্যাথেটিক! কিন্তু কিছু করার নাই। পিঠে ব্যাকপ্যাক, কাঁধে সাইড ব্যাগ ঝুলিয়ে বড় লাগেজটা অল্প অল্প করে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামাতে লাগলাম। অনেক পরিশ্রমের পর এক সময় তিন তলা থেকে লাগেজ সমেত আমি নিচ তলায় নেমে আসলাম। নিচে অনেকে লাগেজ নিয়ে সোফায় বসে আছে। আমাদের বাস নাকি এখনও এসে উপস্থিত হয় নাই। আস্তে আস্তে সবাই মোটামুটি নামতে থাকলে নিচ তলাটা পুরো ভরে যায়। দাঁড়ানোর কোন জায়গা আর বাকি থাকে না। তখন যে সিঁড়িতে যতটুকু নামতে পেরেছিলো ততটুকু নেমেই লাগেজ সমেত দাঁড়িয়ে থাকে। যাইহোক, খুব বেশি সমস্যা হওয়ার আগেই ৬টা বাজতে বাজতেই কমিটির লোকজন ঘোষনা দেয় যে বাস চলে এসেছে। আমরাও সময় নষ্ট না করে লগেজ নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ি।

এই বাসটা আগের তুলনায় অনেক ছোট। সাধারণ লোকাল বাসের মত রংচঙ্গে। বাসের সাথে দুইজন লোক ছিলো। আমাদের একেকজনের লাগেজ দেখে উনাদের মাথায় বাজ পড়ে। বাসে তো এত লাগেজ রাখার জায়গা নাই! একজনকে দেখলাম বাসের ছাদে উঠে দড়ি দিয়ে কপিকলের মত বানিয়ে নিচে নামিয়ে দিতে। অন্যজন নিচে থেকে আমাদের লাগেজগুলো দড়িতে বেঁধে দিতেই উপরেরজন টেনে টেনে সেগুলোকে ছাদে তুলে নিচ্ছিলো। কাজ হচ্ছিলো অত্যন্ত ধীর গতিতে। পুরো ব্যাপারটা ছিলো অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ। আমরা এত স্লো লাগেজ ওঠানো দেখে মজা পাচ্ছিলাম। আমাদের কমিটির লোকজন এর চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে মালামাল ‘লোড’ করে ফেলতে অভ্যস্ত! একসময় ছাদ পুরো ভরে গেলো। তখন আমাদের বাকি মালপত্রগুলোকে তোলা হলো বাসের সবচেয়ে পিছন দিকে। দেখতে দেখতে পিছনের তিন সারি সিট সব ভরে গেলো আমাদের লাগেজ আর ব্যাকপ্যাকে। তারপর আমরা সবাই চড়ে বসলাম বাসের ভিতর। সবাই বসার সিট পেলো না, কিন্তু তাতে কারও কোন সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হলো না। অনেকেই দুই জনের সিটে তিনজন করে বসে পড়লো। তারপর সবাই সব ঠিকঠাক আছে কিনা চেক করতেই আবিষ্কার হলো রিন্তু আর পৃথ্বী মিসিং। সাথে সাথে ওদের ফোন দেওয়া হলো। ওরা সূর্যোদয় দেখতে বিচে গেছে। কি আর করা, সবাই মিলে বাসের ভিতর বসে ওদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। এক সময় ওদের দুইজনকে দেখলাম দৌড়াতে দৌড়াতে আসতে। ওরা আসতেই আমাদের বাস ছেড়ে দিলো। মোটামুটি সাড়ে সাতটার সময় আমরা রওয়ানা দিলাম।

আ
আমাদের রংচঙ্গে বাস (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

আমি আর রুবাইদা বসে ছিলাম একদম শেষের দিকের সিটে। আমাদের পরেই লাগেজের স্তুপ। আমাদের সামনে ছিলো জুবায়ের। জুবায়ের লাগেজ গুলোর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, ‘ভয় হচ্ছে, লাগেজের ভারে বাস না আবার খাড়া হয়ে যায়’ । ভোর বেলায় ঊঠার কারণে সবারই চোখে ঘুম ঘুম ভাব ছিলো। বাসে সবাই মোটামুটি হাল্কা পাতলা ঘুম দিতে লাগলো। আমিও চোখ বন্ধ করে ছোট্ট একটা ঘুম দিয়ে নিলাম। পুরো ট্যুরে আমার এই উপকার হয়েছে, আমি এখন বাসে আর ট্রেনে দিব্যি ঘুমাতে শিখে গেছি। ১১টা বাজার আগেই আমরা চেন্নাই এসে পৌঁছে গেলাম। আমাদের বাস এসে থামল হোটেল হরাইজনের সামনে। চেন্নাইতে প্রথমে আমাদের কোন হোটেল নেওয়ার কথা ছিলো না। কারণ আজকে রাতেই আমরা কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো। ঘোরাঘুরি করতে করতেই সারাদিন কেটে যাবে।  কিন্তু পরে প্ল্যানে চেঞ্জ আসে। এত মালপত্র রাখার জন্য আর একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আমাদের একটা হোটেল রুম নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। চেন্নাইতে সুমাইয়ার আব্বুর একজন শিল্পপতি বন্ধু রয়েছেন। তিনি লোক পাঠিয়ে এই একটা হোটেল আমাদের জন্য ঠিক করে দিয়েছেন।

বাস থেকে নেমে আমরা লাগেজের জন্য দাঁড়ালাম। বাসের ছাদ থেকে দড়ি দিয়ে একটা একটা করে লাগেজ নামানো হচ্ছিলো ধীর গতিতে। তাতে আমাদের ধৈর্যে বাঁধ ভাংলে দড়ি ছাড়াই এমনি এমনি লাগেজ নামানো শুরু হয়ে গেলো। এতে দুইটা দুর্ঘটনা ঘটলো। একটা লাগেজ ধরতে গিয়ে আনিসের মুখে লাগেজের চাকার বাড়ি লেগে দাঁতের কোনা ভেঙ্গে গেলো। আর কোন কারণ ছাড়াই রাত্রির লাগেজটা বাসের ছাদের থেকে পড়ে গেলো এবং সেটার চাকা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। যাই হোক আমরা বাকি মানুষজন আমাদের মালপত্র নিয়ে হোটেলে ঢুকলাম। নিচ তলায় একটা রুম নেওয়া হয়েছে, সেটা শুধুই লাগেজ রাখার জন্য। আমরা আমাদের সবার বড় লাগেজ খুব মাপজোক করে একটার উপর আরেকটা রেখে কেমন করে যেন ছেচল্লিশটা লাগেজ একটা ছোট্ট ডোবল রুমে আঁটিয়ে ফেললাম। তারপর বাকি ব্যাগ গুলো নিয়ে উপরে চারতলায় উঠে আসলাম। এখানে আমাদের জন্য তিনটা রুম নেওয়া হয়েছে। একটা ছেলেদের জন্য আর দুইটা মেয়েদের জন্য। আমি একটা রুমে ঢুকে বসলাম। জোরে ফ্যান ছেড়ে যতজন পারলাম একটা ডবল বেডে কোনমতে বসলাম।

একটু ধাতস্থ হতেই একজন একজন করে সবাই বাইরে ঘুরতে যেতে লাগলো। সীমান্ত আর রিন্তু গেলো চোখের ডাক্তার দেখাতে ‘শংকর নেত্রালয়’ হাসপাতালে। সবার শেষে রুমের চাবি নিয়ে আমি বের হয়ে পড়লাম। হোটেলের রিসেপশনের লোকটার সাথে কথা বলে আমি, নিশাত, পৃথ্বী, রুবাইদা, অন্তরা আর মিম ১৫০ রুপি দিয়ে অটো ভাড়া করে রওয়ানা দিলাম টি নগরে। টি নগর বেশ ব্যাস্ত কমার্শিয়াল এলাকা। ফুটপাথ ভর্তি মানুষজন হাঁটা চলা করছে। চওড়া রাস্তার দুই পাশে বড় বড় বিল্ডিং, অনেক দোকানপাট। আমরা একটা জায়গায় নেমেই প্রথমে খাওয়ার দোকান খুঁজলাম। মোটামুটি একটা দোকানে ঢুকে আমি আর রুবাইদা অর্ডার দিলাম ১০০ রুপির ভেজ বিরিয়ানি। বিরিয়ানিটা খেতে মোটেও মজা না। কিন্তু খাওয়া চলে। সকালে এমনিতেও কিছু খাওয়া হয় নাই। তাই আমরা চুপচাপ ভেজ বিরিয়ানি খেয়ে নিলাম।

খাওয়া দাওয়া করে আমরা ঘুরতে বের হলাম। একটু পরেই চোখে পড়লো বিশাল দোকান ‘চেন্নাই সিল্ক’। আমরা ঢুকে পড়লাম সেটাতে। পোথির মতই বড় শাড়ির দোকান, কিন্তু ‘পোথি’র মত নয়! আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। তারপর বের হয়েই পাশেই আরেকটা বড় শাড়ির দোকান পেলাম ‘এস কুমার’স’ । এই দোকান দেখতে দেখতে হঠাৎ আমাদের মনে হলো এই জায়গা তো আগেও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে- এমন তো হবার কথা না! হঠাৎ টের পেলাম আমরা আসলে চেন্নাই সিল্কে চলে এসেছি। এই দুইটা দোকানের ভিতর দিয়ে কানেকশন আছে। দুইটা বোধহয় একই মালিকের দোকান। তারপর এখান থেকে বের হয়ে কয়েক কদম হাঁটতেই চোখে পড়লো ‘পোথি’। আবার সেই ‘পোথি’! মহা উৎসাহে আমরা ঢুকে পড়লাম পোথিতে। আগের মতনই ঘটনা। অন্য দোকানগুলোর থেকে পোথিতে ভিড় সবচেয়ে বেশি। তবে বেশি ভিড় হলে যা হয় আর কি, খুব ভালো করে কোনকিছু দেখা হলো না। তবে কেন যেন মনে হলো ত্রিভান্দাম বা পন্ডিচেরির কালেকশন বেশি ভালো ছিলো। মোটামুটি ভিড় ঠেলে ঠেলে আমরা সব কিছু দেখছিলাম। এক জায়গায় হঠাৎ করে ‘ঢাকাই শাড়ি’ একটা সেকশন দেখে সেখানে কি আছে আগ্রহী হয়ে দেখতে যাই। কয়েকটা তাঁতের শাড়ি আর জামদানি শাড়ি দিয়ে ভরে রাখা তাক। দেখে ভালোই লাগলো, যাক আমার দেশের শাড়িও তাহলে এখানে আছে!

পোথি থেকে বের হয়ে আমরা ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকি। হঠাৎ একটা দোকানের সামনে আমাদের বেশ কয়েকজনকে পেয়ে যাই। জানতে পারি এই দোকানে নাকি সব পানির দরে জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দোকানটার নাম দেখে নেই ‘সারাভানা’। আমরা ঢুকে পড়ি সারভানাতে। এ এক বিশাল দোকান। এর কোন শেষ নেই। মনে হয় যেন বিশাল কোন গুদাম ঘরে ঢুকে পড়েছি। তাক কে তাক ভর্তি জর্জেটের শাড়ি আর শাড়ি। নানা রকম দামের শাড়ি, কমতে কমতে ২২০ রুপিতে গিয়ে ঠেকলো। তখন রুবাইদা বললো, ‘চল, আরেকটু খুঁজি। সামনে মনে হয় ১০০ রুপিতেও শাড়ি পাওয়া যাবে’। এত শাড়ি দেখে যখন মাথা বন বন করছিলো তখন শুরু হলো জর্জেটের ওড়না। নানা রঙের শত শত ওড়না। ওড়নার দামও কমতে কমতে ৬০ রুপিতে গিয়ে ঠেকলো। এত কিছু দেখার পরও অন্তরা বিছানার চাদর দেখতে চাইলো। সেলসম্যানরা আমাদের লিফটে তুলে উপরে পাঠিয়ে দিলো। উপরে উঠে আমরা পেলাম রেডিমেড জামাকাপড়। মেয়েদের প্যান্ট, স্কার্ট, টপস- এইসব জিনিস। বিশাল ফ্লোর জুড়ে এই সব জামাকাপড় দেখতে দেখতে আমার সত্যিই কেমন যেন অসুস্থ লাগছিলো। এর মধ্যে আমরা সবাই কম বেশি হারিয়ে গিয়েছিলাম। পরে একজন আরেকজনকে ফোন করে খুঁজে বের করে নিয়েছি। অনেক্ষণ পর আমরা এই জায়গা থেকে নেমে আসলাম। নিচ তলায় আসতে আসতেই মিম আর অন্তরার লিপস্টিক কেনার শখ হলো। আমি আর রুবাইদা ওদের রেখে বের হয়ে গেলাম এই দোকান থেকে। বসে পড়লাম দোকানের সামনের সিঁড়িতে। সেখানে আমাদের মতই আরও অনেক মানুষ বসে আছে। সবার হাতেই অনেক অনেক শপিং। আর এদিকে শুধু রুবাইদা কয়েকটা ওড়না কিনেছে বলে আমাদের হাতে একটা ছোট্ট প্যাকেট। আমি আর রুবাইদা বসে বসে গল্প করতে লাগলাম। এই দোকানে ঢোকার পর কখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেছে টেরই পাই নাই।

মিম আর অন্তরা বের হয়ে আসলে আমরা কয়েক কদম হেঁটে একটা জুসের দোকানে ঢুকি। দোকানে আমরা ছাড়া আর কোন কাস্টোমার নাই। একটা কমবয়সী ছেলে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে আমাদের কাছে আসলো অর্ডার নিতে। আমরা যেইটা নিতে চাই, সে বিরক্ত হয়ে জানায় যে দেওয়া যাবে না। সব শেষে আমি নেই মিল্কশেক। ছেলেটা চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি ফুটিয়ে জুস বানাতে চলে যায়। আমি একটু লক্ষ করতেই দেখলাম। সবুজ একটা কলা ছিলে সে ব্লেন্ডারে দিয়ে দিলো। হায় হায় কাঁচা কলার শেক খেতে হবে দেখছি! আমাদের জুস বানাতে খুব বেশিক্ষন লাগলো না, তবে আমরা খেলাম বেশ সময় নিয়ে। আমার কাঁচা কলার শেকটা খারাপ ছিলো না। অবশ্য কলাটা একেবারে কাঁচা না, একটু পাকাও ছিলো! আমাদের এক সমস্যা হলো আমরা চুপচাপ থাকতে পারি না। গল্পগুজব একবার শুরু হলে আমরা উচ্চস্বরে হাহা হিহি করতে থাকি। জুসের দোকানেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। তবে আমাদের হৈচৈ দেখে দোকানের ছেলেটা বারবার অগ্নি দৃষ্টি দিতে লাগলো।

জুসের দোকান থেকে বের হয়ে আমরা অলসভাবে খানিক্ষণ হাঁটাহাঁটি করছিলাম। রাস্তার পাশেই দেখলাম সিনেমার ডিভিডির বড় বড় দোকান। সেই সব দোকানে রজনীকান্তের নতুন সিনেমা ‘লিঙ্গা’র বড় বড় পোস্টার টানানো। সত্যিই, সাউথের ভাবসাবই আলাদা! আমরা সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার আগেই একটা অটো ঠিক করে ফেললাম। সেই অটোতে করে রওয়ানা দিলাম আমাদের হোটেলের উদ্দেশ্যে। আমাদের হোটেলের কাছাকাছি পৌঁছাতেই শুনতে পেলাম মাগরিবের আযান। হোটেলের ঠিক পাশের গলিতেই একটা বড় মসজিদ আছে আমি খেয়ালই করি নাই। অনেকদিন পর কানে আযানের ধ্বনি যেতেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। হোটেলে ঢুকেই আমরা প্রথমে রুমে গেলাম। একটু হাতমুখ ধুয়ে বিশ্রাম নিয়েই বের হয়ে পড়লাম আবার।

হোটেল থেকে বের হয়ে আমরা পাশের গলির দিকে হাঁটতে লাগলাম। ততক্ষনে মাগরিবের জামাত শেষ হয়েছে। রাস্তায় মুসল্লিদের ঢল নেমেছে। আমরা প্রথমে বড় একটা দোকানে ঢুকলাম। রাতে ট্রেন জার্নি আছে। সেজন্য খাবার দাবার কিনে নিতে হবে। আমরা দোকান ঘুরে ঘুরে নিজেদের পছন্দমত কেক, বিস্কুট, বাদাম এসব কিনে নিলাম। ক্যাশ কাউন্টারে বিল দিতে গিয়ে দেখি সেখানে একজন বড় দাড়িওয়ালা মুসলমান বসে আছেন। আমাদের দেশের তাবলীগের অনুসারীরা দেখতে যেমন হয়ে, ওনাকেও দেখতে সেরকমই লাগলো। আমি বিল মিটিয়ে দেওয়ার সময় লোকটা গম্ভীর হয়ে মিমের দিকে ইঙ্গিত করে আমাকে বললো, ‘ইনি কি আপনার সাথেই এসেছেন?’ আমি হ্যাঁ জবাব দিতেই আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইনি কি মুসলমান?’ আবারও আমি হ্যাঁসূচক জবাব দিলাম। তখন লোকটা আরও গম্ভীর মুখে বললেন, ‘ওনাকে বলবেন চুল বেঁধে চলাফেরা করতে। এত বড় চুল খুলে রেখে চলা ঠিক না’। আমি একটু হাসি দিয়ে বললাম, ‘জ্বি আচ্ছা, বলবো’। ওদিকে মিমও টের পেয়েছে ওকে উদ্দেশ্য করে আমরা কথা বলছি। আমি কাছে আসতেই ও জানতে চাইলো কি ব্যাপার। আমি ওকে সব খুলে বলতেই ও একটা হাল্কা হাসি দিলো।

কেনাকাটা শেষ করে আমরা এবার খাওয়া দাওয়া করার জন্য জায়গা খুঁজছিলাম। রাস্তার পাশেই বেশ বড়বড় হোটেল। আমরা সেখান থেকে বেছে বেছে একটা হোটেলে ঢুকলাম। ভিতরে ঢুকে আমরা দোতলায় গিয়ে বসলাম। হালাল মাংস পাওয়া যায় শুনে অর্ডার দিলাম তন্দুরি চিকেন আর পরোটা। অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করতে করতেই শুভ, রিজভীসহ আরও কয়েকজন এসে ঢুকলো ভিতরে। ওরা আমাদের পিছনে একটা টেবিল জুড়ে বসে পড়লো। কিছুক্ষনের মধ্যেই খাবার আসলো। খেতে ভালোই ছিল মুরগিটা। আমরা মজা করে খেলাম। আর পিছনের টেবিল থেকে ওরা জানতে চাইলো যে, টেস্ট কেমন খাবারের।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা আবার হোটেলে ফিরে আসলাম। আমাদের নিচতলার সেই লাগেজ রুম খুলে দেওয়া হয়েছে। আমরা আমাদের মালপত্র বের করে যার যার জিনিসপত্র গুছিয়ে রিসেপশনের সামনে বসে রইলাম। রেল স্টেশন আমাদের হোটেল থেকে কাছেই। হেঁটে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু এত মালপত্র নিয়ে কেমন করে যাওয়া হবে সেটা নিয়ে বেশ আলাপ আলোচনা হচ্ছিলো। তখন হঠাৎ খবর আসলো, সুমাইয়ার পরিচিত সেই শিল্পপতি আংকেল আমাদের জন্য গাড়ির ব্যাবস্থা করে দিচ্ছেন আর সবার জন্য রাতের খাবার পাঠাচ্ছেন। শুনে আমরা খুশিতে গদ্গদ হয়ে গেলাম। সুমাইয়াকে দেখলাম, হ্যাভার স্যাকের ভারে কুঁজো হয়ে হেঁটে যেতে। পন্ডিচেরিতে একটা ছোটখাটো দুর্ঘটনায় আফরা পায়ে ব্যাথা পেয়েছিলো। ওকে দেখলাম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে। কিছুক্ষনের মধ্যেই গাড়ি চলে আসলো। আসলে ঠিক গাড়ি নয়, আসলো একটা বড়সড় পিকাপ আর আরেকটা গাড়ি। ডিসিশন হলো যে, পিকাপ আর গাড়িতে আমাদের সব মালপত্র উঠিয়ে দিয়ে আমরা হেঁটেই স্টেশন চলে যাবো। আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করলাম। বড় লাগেজগুলো পিকাপের পিছনে রেখে দিলাম আর দুজন লোক হাসিমুখে আমাদের মালপত্রগুলো পিকাপে তুলে দিতে লাগলো।

বড় লাগেজটা রেখে দিয়েই আমরা ব্যাকপ্যাক, সাইডব্যাগ এগুলো নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। সবার মাল না উঠানো হলে গাড়িগুলো ছাড়বে না। তাই ততক্ষন অপেক্ষা করার কোন মানে হয় না। রাস্তা পার হয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম। রাত খুব বেশি না হলেও রাস্তাঘাট শুনশান নিরব। তার উপর রাস্তাঘাটও ঠিকমত চিনি না। ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি কিনা বলতে পারলাম না। তবে বুঝলাম আমরা আসল এন্ট্রি দিয়ে না ঢুকে একটা চিপা ইনফর্মাল এন্ট্রি দিয়ে ঢুকার চেষ্টা করছি কারণ এটাই আমাদের হোটেলের থেকে সবচেয়ে কাছে। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে একসময় মনে হলো আমরা কাছাকাছি চলে এসেছি। তারপর খুঁজে খুঁজে যে জায়গায় আমাদের পিকাপের আসার কথা সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। স্টেশনের ভিতরে না ঢুকে আমরা বাইরের দিকে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর ফোনে খবর পেলাম, পিকাপ চলে এসেছে। রুবাইদা আমাকে দাড়করিয়ে রেখে নিয়ে গেলো আমাদের দুইজনের মালপত্র নিয়ে আসতে। আর আমি দাঁড়িয়ে রইলাম আমাদের ব্যাকপ্যাক, হ্যাভারস্যাক আর অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে। আমাদের অনেককেই দেখলাম জোরে জোরে হাঁপাতে হাঁপাতে লাগেজ টেনে টেনে আনতে। আমার তখন মনে হলো, দুইটা ভারি ভারি লাগেজ টেনে আনতে নিশ্চয়ই রুবাইদার অনেক কষ্টই হবে। আমার এরকম  থেকে যাওয়াটা বোধহয় উচিৎ হয় নাই। আমি চিন্তিত মুখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। আমার সকল দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে রুবাইদা হাসি মুখে ভারি ভারি দুইটা লাগেজ টানতে টানতে আসতে লাগলো। রুবাইদা চলে এলে আমরা যে যার মাল বুঝে নিয়ে নিজে নিজে টানতে লাগলাম। অন্তরাকে দেখলাম কোনটা ফেলে কোনটা টানবে বুঝতে পারছে না। ব্যাপক মালপত্র সবার কাছেই, তাই কেউ যে কাউকে সাহায্য করবে- সেটা সম্ভব হচ্ছে না।

আমরা যথাসম্ভব তাড়তাহুড়া করে আমাদের প্ল্যাটফর্মে এসে হাজির হলাম। এই প্রথমবার আমরা দেখলাম প্ল্যাট ফর্মে আমাদের ট্রেন এসে বসে আছে। এবং ভেতরের সব লাইট বন্ধ। ট্রেন খালি, অর্থাৎ এখনও যাত্রী ওঠা শুরু হয় নাই। এই প্রথমবার আমাদের দৌড় ঝাপ করে ট্রেনে উঠতে হচ্ছে না- ব্যাপারটা আমাদের নিজেদের কাছেই কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগলো! আমরা আগের মত আমাদের মালপত্র সব স্তুপ করে রেখে তার চারপাশে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি আশেপাশে  তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। প্ল্যাটফর্মে অনেক মানুষ দিব্যি মশারি টানিয়ে শুয়ে পড়েছে। তারা কোন অসহায় গরীব মানুষ না, তারা ট্রেনেরই যাত্রী। মনে হয় ট্রেন লেট করেছে তাই সময় নষ্ট না প্ল্যাটফর্মের কলাম আর ওয়েটিং চেয়ারের সাথে সবাই মশারি টানিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। প্ল্যাটফর্মে সারি সারি রংচঙ্গে মশারি দেখে আমার বেশ মজা লাগলো। অদ্ভূত, এরা বেড়ানোর সময় সাথে করে মশারিও নিয়ে আসে!

ট্রেনে ওঠার আগে স্টেশনে মালপত্র নিয়ে আমরা
ট্রেনে ওঠার আগে স্টেশনে মালপত্র নিয়ে আমরা

ট্রেনের জেনারেটর অন হতেই ভিতরে লাইট জ্বলে উঠলো। আমরাও টপাটপ ভিতরে ঢুকে পড়লাম। আমাদের খোপে আমরা জিনিসপত্র নিয়ে উঠে পড়লাম। আমি আর রুবাইদা এবার সিট পেলাম করিডরের পাশে। আমি উপরে আর রুবাইদা নিচে। আমাদের খোপে সাতটাই আমাদের লোকজন। পাশের খোপে কৌশিক একমাত্র এসেছে। ও তাড়াতাড়ি আমাদের খোপের আট নম্বর লোকের সাথে সিট বদলে নিলো। তারপর টের পেলাম পাশের খোপে নিশাত, রিন্তু পৃথ্বী আর তানভীরের সিট। কৌশিক আমাদের খোপে চলে না আসলেও পারতো!

আমাদের লাগেজগুলো ততদিনে ফুলে ফেঁপে বিশাল আকার ধারন করেছে। সবগুলো খোপেই আমাদের মানুষ থাকার কারণে অনেকগুলো লাগেজ আমাদের কায়দা করে রাখতে হলো। সব লাগেজ রাখার পর মাটিতে পা ফেলার আর কোন জায়গাই রইলো না। কি আর করা, সবাই তাই পা তুলেই সিটে বসে রইলো। ওদিকে নিশাতরাও অনেক কষ্টে লাগেজ গুছিয়ে রাখলো। সবশেষে নিশাত ওর ম্যাজেন্টা কালারের ফুলেল কম্বলটা দিয়ে লাগেজের বিশাল স্তুপটাকে ঢেকে দিলো। তখন পুরা জিনিসটাকে দেখতে মাজারের মতন লাগতে শুরু করলো। নিশাত আমাকে হাসি মুখে বললো, ‘আমরা মাজার সাজিয়ে বসেছি, তোরা আয় আর আমাদের মাজারে পয়সা দিয়ে যা’।

আমরা গোছগাছ করে বসতে বসতেই ট্রেন ছেড়ে দিলো। ট্রেন ছাড়তেই আমরা গল্পগুজবের মুডে বসলাম। নিজেরা গল্প করতে লাগলাম আর হাসতে লাগলাম হাহা হিহি করে। ওদিকে কে যেন বের করে আনলো তাস। ব্যাস আর যায় কই, সবাই হাত পা গুটিয়ে বসে পড়লো তাস নিয়ে। আমি আর রুবাইদা রুবাইদার সিটে বসে গল্প করতে লাগলাম। এর মধ্যে একটা স্টেশনে ট্রেন থামলো, ওদিকে সৈকত আর সুমাইয়া খাবারের প্যাকেট নিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে আসলো। শিল্পপতি আংকেলের দেওয়া খাবার সব সুমাইয়ার কাছে। কিন্তু ওর বগি আর আমাদের বগির মাঝখানে দরজা সিল করা। তাই ও আমাদের খাবারগুলো দিতে পারে নাই। এজন্য ট্রেন থামতেই ওরা প্যাকেট হাতে নেমে পড়ে। কয়েকটা জানালা দিয়ে ওরা খাবারের প্যাকেটগুলো দিয়ে ফেলে। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই ট্রেন হুইসেল দিয়ে নড়তে শুরু করে। ওরা দুইজন আতংকিত হয়ে খাবারের প্যাকেট প্ল্যাটফর্মে ফেলেই দৌড় লাগায়। আমরা গলা বাড়িয়ে চিৎকার করতে থাকি। আমরা তাড়াতাড়ি ফোন করে খবর নিতে থাকি যে ওরা ঠিকমত উঠতে পেরেছে কি না। খবর পাই যে ওরা ঠিক মতই উঠেছে কিন্তু খাবারের প্যাকেটটা ফেলে আসায় ওরা খুব আফসোস করছে। আমাদের সেজন্য আফসোস নাই, ওরা ঠিক মত আছে -এটাই তো বড় কথা! এদিকে আমাদের আশেপাশের খোপে যারা খাবার পেয়েছিলো তারা আমাদের সাথে সেটা শেয়ার করলো। জিনিসটা ছিলো বিশাল পরোটা দিয়ে প্যাঁচানো শর্মা টাইপের জিনিস।

রাত বেশি করলাম না। গত রাতে ঠিকমত ঘুম হয় নাই। সকালেই একটা জার্নি করেছি, সারাদিনে কোন বিশ্রামও নেওয়া হলো না। সবাই তাই ক্লান্ত ছিলো। আমরা যার যার জায়গা গুছিয়ে শুয়ে পড়লাম। এবং বলাই বাহুল্য, প্রায় শোয়ার সাথে সাথেই সবাই ঘুমে অচেতন হয়ে গেলো।

The Mighty INDIA CALLING: অরোভিল যাত্রার একদিন (পর্ব ৩৬)

সকালে ঘুম ভাঙ্গলো দেরিতে। অন্যান্য দিনের মতই মৌলি আর মজুমদার আগেভাগে বের হয়ে গেলো। আমি আর রুবাইদা আলসেমি করে আস্তে ধীরে বের হলাম। আমাদের সাথে যোগ দিলো মিম আর অন্তরা। আমরা হোটেল থেকে বের হয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য নাশতা করা। গত রাতে যে গলিতে খাবার খেয়েছিলাম, হেঁটে হেঁটে সেই গলিতে গেলাম আমরা। খাবারের দোকান আছে কিন্তু প্রায় সব দোকানেই নাশতা শেষ। খুঁজে পেতে একটা দোকান পাওয়া গেলো যেখানে কিছু খাওয়া অবশিষ্ট আছে। আমরা ঝটপট বসে পড়লাম। প্রত্যেকটা পুরি দশ রুপি করে আর সাথে সবজি ফ্রি। আমি দুইটা পুরি নিলাম একটা থালায়। আর একজন লোক এসে ছোটখাটো স্টেনলেস স্টিলের বালতির মত পাত্র থেকে বিশাল বড় চামচে করে ঝোল ওয়ালা আলুর তরকারি ঢেলে দিয়ে গেলো। এই সবজি আর পুরি ছাড়াও ইডলি, সম্বর, নারিকেলের ভর্তা, চাটনি এই রকম মজার মজার জিনিস ছিলো। খেতে আমাদের মোটামুটি লাগলো। খেয়ে দেয়ে আমরা বের হয়ে আসলাম সেই দোকান থেকে। হাঁটা ধরলাম আন্না সালাই রোডের দিকে।

আন্না সালাই রোডে একটা অদ্ভূত রিকশা পার্ক করে রাখা দেখলাম। আমাদের দেশের মতন প্যাডেল রিকশাই, তবে দেখতে কেমন যেন হাস্যকর! একটা পেস্ট্রি শপ দেখলাম, ‘কেক পয়েন্ট’। ভেতরে ঢুকে পড়লাম আমরা। এটা নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কেক বানানোর জন্য গিনেজ রেকর্ডধারী দোকান। তবে এমন রেকর্ডধারী দোকানেও খুব কম দামেই পেস্ট্রি পাওয়া যাচ্ছে। আমরা নানা রকম পেস্ট্রি অর্ডার দিলাম। তারপর গল্প করতে করতে খেতে লাগলাম। আর ওদিকে ডিসিশন নিতে লাগলাম এরপর কোথায় যাবো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে বের হয়ে পড়লাম। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে একটা বাসে উঠে পড়লাম। এখন আমাদের গন্তব্য ‘অরোভিল’।

কেক পয়েন্টের পেস্ট্রি
কেক পয়েন্টের পেস্ট্রি

পন্ডিচেরির বাসগুলো বেশ আরামের। আমি বসলাম একেবারে পিছনে। আশেপাশে সব শাড়ি পরা শক্ত সমর্থ চেহারার মহিলারা। একজন বুড়ো মহিলাকে দেখলাম এক গামলা ভেজা কাপড় নিয়ে বাসে উঠে পড়তে। কন্ডাক্টর এসে ওনার সাথে তর্ক জুড়ে দিলো। মহিলাও গলা চড়িয়ে কথা বলতে লাগলো। এর মধ্যে আমি অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম, তর্ক করতে করতেই কন্ডাক্টর এসে গামলাটা ধরে সুন্দর করে একটা জায়গার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে লাগলো। আমরা পাঁচ রুপির টিকেট কাটলাম। প্রায় আধা ঘন্টা পর বড় রাস্তার ধারে দুই পাশে কিছুই নাই এমন এক জায়গায় আমাদের নামিয়ে দিলো বাস। যে জায়গাটায় আমাদের নামিয়ে দিলো সেখান শুধু কতগুলো অটোরিক্সা পার্ক করা আছে। আমরা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলাম অরোভিল কোথায়? কিন্তু কিছুই খুঁজে পেলাম না। অন্তরার ফোনে দেখলাম এখান থেকেও অরোভিল বেশ দূরে। বুঝলাম বাসের রুট এখানেই শেষ, এরপর অটো নিতে হবে। অগত্যা আমরা ১৫০ রুপি দিয়ে একটা অটো ভাড়া করলাম। অটো আমাদের নিয়ে চলতে শুরু করলো।

যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম সেটা অনেকটা গ্রামের রাস্তার মত। কিন্তু দেখার মত তেমন কোন জিনিসপাতি নাই। রাস্তার দুইধারে সারি সারি গাছ, সম্ভবত ইউক্যালিপ্টাস। লাল রঙের মাটি আর সবখানে লাল রঙের ধূলা। কেমন যেন অদ্ভূত রাস্তা! এর মধ্য দিয়েই দেখতে পারছিলাম সাদা চামড়ার অনেক বিদেশি লোকজন বাইকে চেপে আমাদের ওভার টেক করে যাচ্ছে। আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকাচ্ছিলাম। অরোভিল জায়গাটা আসলে কি? আমাদের একটা গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে অটোওয়ালা জানতে চাইলো আমরা চাইলে একঘন্টার মধ্যে এই অটোতে করে ফেরত যেতে পারি। আমরা সেই মোতাবেক ঠিক করলাম। অটোওয়ালা জানালো সে এইখানে আমাদের জন্য বসে থাকবে।

আমরা গেট দিয়ে ঢুকে পড়লাম। জায়গাটা অদ্ভূত। কতগুলো সুন্দর সুন্দর দোকানপাট চোখে পড়লো। আমরা ঢুকে পড়লাম একটায়। দোকানগুলো আমাদের দেশি ব্র্যান্ড ‘যাত্রা’র মত। হাতে তৈরি দারুণ সুন্দর সুন্দর সব জিনিস। আর সেই রকম দামি। প্রথম দোকানটা দেখেই আমরা বুঝে গেলাম সবটা দেখে কিছুতেই এক ঘন্টার মধ্যে বের হওয়া যাবে না। তাহলে আর শুধু শুধু অটোওয়ালাকে আটকে রেখে লাভ কি? আমি তাড়াতাড়ি এসে অটোওয়ালাকে খুঁজে বের করে তার পাওনা বুঝিয়ে দিলাম। তারপর আবার হেঁটে গেলাম সেই দোকানটার দিকে।

এইরকম আরও অনেকগুলো দোকানে ঢুকলাম। কোনটাতেই আমরা কিছু কিনতে পারলাম না। খালি দেখেই যেতে লাগলাম। তারপর গেলাম একটা এক্সিবিশন হল টাইপের জায়গায়। সেখানে মোটামুটি জানতে পারলাম, এক ফ্রেঞ্চ মহিলা যাকে সবাই ‘দি মাদার’ বলে, তিনি এই অরোভিলের প্রতিষ্ঠাতা। ব্যাপার স্যাপার খুব কঠিন, তারপরও যা বুঝলাম তার সারমর্ম হচ্ছে এইরকম- মাদারের ইচ্ছা ছিলো এমন একটা জায়গা গড়ে তোলা যেখানে মানুষ জাতি, ধর্ম, গোত্রের পরিচয়ে পরিচিত হবে না। বরং তা হবে সব ধরনের মানুষের জন্য উন্মুক্ত। এখানে এসে কাজ করার বিনিময়ে যে কেউ থাকতে পারবে। এই ইচ্ছা বাস্তবায়ন করার জন্য মাদারকে সাহায্য করেছিলেন স্বামী অরবিন্দ নামক আরেক জন সাধু। এখান থেকেই জানতে পারলাম এখানে ‘মাতৃমন্দির’ নামক একটা বলের মত গোল বিল্ডিং আছে। সবাই বের হয়ে হাঁটতে লাগলাম সেই বিল্ডিঙের খোঁজে। প্রথমে বিল্ডিং দেখার পাস নিলাম। ভিতরে ঢুকা যাবে না, শুধু বাইরে থেকেই দেখতে হবে। যাই হোক, এই পাস নিয়েই আমরা হাঁটতে লাগলাম। কিছুদূর পর কেমন জঙ্গল শুরু হলো। ঠিক জঙ্গল না, অনেকটা পার্কের মত, আবার ঠিক পার্কও না। প্রচন্ড গরমে গাছের ছায়ায় ছায়ায় আমরা হাঁটতে লাগলাম। এক পর্যায়ে আমাদের হাত পা ধরে এলো। এর মধ্যে হিমি সীমান্তদের সাথে দেখা হলো। ওরাও ওদের অটোওয়ালাকে এক ঘণ্টার কথা বলে ভিতরে ঢুকে অনেক্ষণ সময় পার করে ফেলেছে। এখন কি করবে বুঝতে পারছে না।

জঙ্গলের ভিতর দিয়ে  হেঁটে চলা
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলা

এর মধ্যে আমরা গাছপালার ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো এক কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে ফেলেছি। গরমে আমাদের গলা শুকিয়ে গেলো। অনেক্ষণ পর একটা গেট পেলাম যেখানে আমাদের পাস চেক করে করে ঢুকতে দিচ্ছিলো। গেটটা পার হয়েই একটু পরই চোখে পড়লো বিশাল এক বট গাছ। সেখানে আনিস, বাসিরুন, লিয়া আর সুহার সাথে আমাদের দেখা হলো। অদ্ভূত এই বটগাছের ঝুলন্ত শিকড় থেকে গজিয়েছে আরও অনেকগুলো গাছ। গাছটা অনেক পুরানো। বিশাল ডালপালা মেলা এই গাছটার ছায়ায় বসে আমরা খানিক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। তারপর আমরা সবাই আবার হাঁটা শুরু করলাম। এবার বেশিক্ষণ লাগলো না। কয়েক মিনিট পরেই পেয়ে গেলাম সেই ‘মাতৃমন্দির’। বিশাল জায়গার মধ্যে মস্ত বড় গোলক, তার সারা গায়ে পিতলের বাসনের মতন বৃত্তাকার প্লেট লাগানো। আমাদের একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত যাওয়ার পারমিশন ছিলো। আমরা তাই দূরে দাঁড়িয়েই দেখতে লাগলাম। নিচের ল্যান্ডস্কেপিংও এমনভাবে করা যেন মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে এসেছে এই গোলকটি। আমরা সবাই গোল্লাটাকে পাশে রেখে ছবি তুলতে লাগলাম।

চোখ ঝলসানো সোনালি রঙের মাতৃমন্দির
চোখ ঝলসানো সোনালি রঙের মাতৃমন্দির

সত্যি বলতে কি, যখন ক্লাস প্রজেক্টে গোল্লা বিল্ডিং ডিজাইন করা হয় তখন মডেলে দেখতে মন্দ লাগে না। কিন্তু যখন সত্যি সত্যি চোখের সামনে এত্ত বিশাল একটা গোল্লা দাঁড়িয়ে থাকে তখন যেন কেমন অদ্ভূত লাগে। আর সোনালি রঙের ধাতব প্লেটগুলোতে সূর্যের আলোর রিফ্লেকশোনের ফলে পুরো গোল্লাটা চকচক করছিলো। তাই দেখে কেন যেন আমাদের সবার গরম লাগা শুরু হলো। তাই আমরা আর বেশিক্ষন থাকলাম না। উঠে পড়লাম। এবার আর বেশি কষ্ট করতে হলো না। পেয়ে গেলাম এক বাস সার্ভিস। এই বাসে করে নির্দিষ্ট সময় পরপর দর্শনার্থীদের বিনা পয়সায় আবার আগের জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হয়। আমরা উঠে পড়লাম সেই বাসে। টাইম হয়ে গেলে আমাদের নিয়ে বাস ছেড়ে দিলো। প্রায় দশ মিনিটের মাথায় আমরা পৌঁছে গেলাম প্রথমবার আমাদের অটো ঠিক যেখানে নামিয়েছিলো সেইখানে। আমরা আবার গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। এবার দেখতে পেলাম একটা শর্ট মুভি দেখানো হচ্ছে। সবাই দুদ্দাড় করে ঢুকে পড়লাম সেখানে। মুভিটায় দেখানো হলো অরোভিলের কথা আর মাদারের কথা। প্রায় ত্রিশ মিনিটের ভিডিও দেখে আমরা সেই হল থেকে বের হয়ে আসলাম।

ততক্ষনে বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। ভাবলাম দুপুরের খাবারটা সেরে নেই এখানে কোথাও। কিন্তু লাভ হলো না। যেই ক্যাফেতেই যাই, দাম দেখে আর খেতে পারি না। শেষে সিদ্ধান্তে নেই যে, এখানে না, বাইরে কোথাও খেয়ে নেওয়া যাবে। আর বেশি দেরি না করে  আমরা এসে দাঁড়াই মেইন গেটের সামনে। তাকিয়ে দেখি একটা অটোও নাই। কোন অটো আসলেই লোকজন খপ করে সেটাতে চড়ে বসছে। আমরা ভয়ে পেয়ে গেলাম, এরকম হলে অটো পাবো কেমন করে? কিন্তু মিম আর অন্তরা অনেক কাহিনী করে একটা অটো ঠিক করে ফেললো। সেই অটো আমাদের বাস চলাচলের বড় রাস্তার সামনে নামিয়ে দিলো। আমরা নেমে এদিক ওদিক তাকালাম। একটা সস্তা খাবারের হোটেল চোখে পড়লো আর তাতেই আমরা ঢুকে পড়লাম। পুরো হোটেলে আমরা ছাড়া আর কেউ নাই। আমি আর রুবাইদা মিলে অর্ডার দিলাম ৯০ রুপির ভাত আর সবজি। একটা লোক অর্ডার নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। বুঝলাম ইনিই রান্না করবেন অর্থাৎ দেরি হবে খাবার আসতে।  গল্প করতে করতেই খাবার চলে আসলো। ঝরঝরে বাসমতি চালের ভাত আর সবজি আমরা গপাগপ খেতে লাগলাম। মজাই লাগলো খেতে।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। এখান দিয়ে হরদম লোকাল বাস যাচ্ছে। এইরকম একটা লোকাল বাসে উঠে পড়লাম আমরা। বসার কোন জায়গা পেলাম না। কোনমতে রড ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রচন্ড ভিড়। এতই ভিড় ছিলো যে কন্ডাক্টর আর আমাদের কাছেই আসতে পারে নাই। কোনমতে আন্না সালাই রোডে এসে আমরা নেমে পড়ি আর ৫ রুপি ভাড়া মিটিয়ে দেই। বাস থেকে নেমে খানিক্ষণ দম ফেলে ধাতস্থ হই। এবার ঠিক করি নেক্সট যাবো অরবিন্দ আশ্রমে। একটা অটো ঠিক করি ৫০ রুপি ভাড়া দিয়ে। অটো আমাদের নামিয়ে দেয় কাছাকাছি একটা রাস্তায়। সেখান থেকে হেঁটে আমরা আশ্রমের সামনে যাই। রাস্তার উপর জুতা জমা দেওয়ার কাউন্টার আছে সেখানে স্যান্ডেল জমা দিয়ে আমরা আশ্রমের ভিতরে ঢুকে পড়ি।

গেট দিয়ে ঢুকার সাথেসাথেই মনে হলো কোন এক নিঃশব্দ জগতে ঢুকে পড়লাম। কেউ কোন কথা বলছে না। সবাই চুপ। আমরাও চুপ হয়ে গেলাম। সবাই লাইন ধরে কোথায় যেন যাচ্ছে, আমরাও সবার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম। জায়গাটা আসলে একটা বিশাল বাড়ির। আমরা ফুলের বাগান পার হয়ে উঠানের মত জায়গায় এসে পৌঁছালাম। সেখানে দেখলাম ছোট্ট একটা চাদরের নিচে একটা কবর বাঁধাই করা। তার উপর প্রচুর ফুল। সেই বাঁধানো কবরটাকে ঘিরে সব মানুষজন বসে আছে চুপ করে। মনে হলো এটা স্বামী অরবিন্দের কবর। আমরা এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করছিলাম, আর কি দেখার আছে খুঁজে বের করার জন্য। পুরো জায়গাটা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক পুরানো বিশাল বাড়ি। আমরা বারান্দা ধরে হাঁটছিলাম। বারান্দার পাশে সারি সারি ঘর। এরকম একটা ঘরের ভিতর মনে হলো ‘দি মাদার’ এর কবর। রুমের ভেতর একটা কফিন। সেটার উপর আবার নেটের সাদা কাপড়ের পর্দা। তার সামনে কয়েকজন চুপচাপ বসে আছে। একজনকে তো দেখলাম মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে কফিনের সামনে পড়ে থাকতে। দৃশ্যটা দেখে আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। এই রকম প্রকাশ্য শিরক আমি চোখের সামনে কোথাও দেখি নাই। আমরা খুব বেশিক্ষণ এখানে থাকলাম না। আমরা লাইব্রেরিটা ঘুরে দেখলাম। রুবাইদা কয়েকটা বাচ্চাদের জন্য নীতিকথার বই কিনলো। তারপর আমরা বের হয়ে গেলাম।

এখান থেকে বিচটা খুবই কাছে। আমরা হেঁটে হেঁটে বিচে চলে গেলাম। সমুদ্রের প্রাণ জুড়ানো বাতাসে আমাদের মন ফুরফুরে হয়ে গেলো। দিনের আলোতে দেখতে লাগলাম সমুদ্রকে। কোন ভিড়ভাট্টা নাই, আছে শুধু শান্তি আর শান্তি। পাথুরে ব্লকের উপর বসে অলস ভঙ্গিতে বসে গল্প করতে লাগলাম সবাই মিলে। শেষ বিকালের সময়টা এভাবেই কাটলো। তারপর আমাদের চোখের সামনে সূর্যটা লাল হয়ে টুপ করে ডুবে গেলো পানির ভেতর। সন্ধ্যা নামতেই আমরা উঠে পড়লাম। প্রশান্তির এই সমুদ্রকে বিদায় জানিয়ে আমরা হাঁটা ধরলাম।

পন্ডিচেরির শান্তির সৈকত
পন্ডিচেরির শান্তির সৈকত

হাঁটতে লাগলাম গলি ধরে। কোনখানেই তেমন কোন লোকজন নাই। চুপচাপ শান্ত আর নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে আমরা গল্প করতে করতে হাঁটতে লাগলাম। দুপাশের সুন্দর সুন্দর সব ঘরবাড়ি দেখতে দেখতে হাঁটছিলাম আমরা। আমি এক দোকান থেকে ৩০ রুপি দিয়ে নানা রকম চিপস আর চানাচুর মিশিয়ে কিনে নিলাম। সেইটা খেতে খেতে আমরা হাঁটছিলাম। আন্না সালাই রোডে এসে পড়লে চোখে পড়লো বিশাল বিশাল সব সিনেমার পোস্টার। এত বড় পোস্টার আমি কখনও দেখি নাই!

এখান থেকে আমরা দুই দলে ভাগ হয়ে গেলাম। রুবাইদা আর মিম চলে গেলো হোটেলে আর আমি আর অন্তরা গেলাম শাড়ির দোকান ‘পোথি’ র উদ্দেশ্যে। এর মধ্যে অন্তরা আবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে পানিপুরি খেয়ে নিলো। তারপর আমরা ঢুকলাম পোথিতে। পুরো পোথি ভর্তি খালি আমাদের লোকজনই ভরা। বেচার ইশতিয়াককে দেখলাম একটা শাড়ি কিনতে চাচ্ছে কিন্তু সব মেয়েদের সাজেশন নিয়ে আর এত এত শাড়ি দেখে বেচারার পাগল হয়ে যাওয়ার দশা। ঐদিকে তমা টপাটপ দুইটা শাড়ি কিনে ফেললো। আমি ঘুরে ঘুরে অন্যদের শাড়ি কেনা দেখতে লাগলাম। পোথির লোকজনও আমাদের দলটাকে দেখে বেশ অবাক। সারা দিন ধরে একই বয়সী ছেলেমেয়ে ভিড় আর হৈ চৈ করে শাড়ি কিনছে এটা বোধহয় তারা কখনও দেখে নাই।  একেবারে শেষ পর্যন্ত আমরা দোকানে রইলাম। আমাদের জন্যই বোধহয় ওরা দোকান বন্ধ করতে পারছিলো না। শেষবারের মত কেনাকাটা করে আমরা বের হয়ে আসলাম।

পোথির উল্টা পাশেই একটা বেশ বড় রকমের খাবারের দোকান চোখে পড়লো। আমি আর তমা ঢুকে পড়লাম সেখানে। পুরাই ভেজ দোকান। তাই আমার অর্ডার দিতে কোনই সমস্যা রইলো না। আমরা অর্ডার দিলাম ইডলি-সম্বর আর পাও ভাজি সাথে ডেজার্ট হিসেবে মিষ্টি।  একটা হলুদ প্লাস্টিকের থালায় আসলো দুইটা ইডলি, তিন রকমের চাটনি আর একটা ছোট বাটিতে সম্বর বা পাতলা ডাল। আরেকটা লাল থালায় আসলো দুইটা বনরুটির সাথে পাওভাজি আর পিয়াজ কুচি। আর একটা ছোট কাপে করে আসলো রসে ডুবানো চারটা লালমোহন মিষ্টি। সব মিলিয়ে আমাদের খরচ হলো ১০০ রুপি। আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে খেতে শুরু করলাম। ইডলিটা দেখতে যতটা সুন্দর খেতে ততটা ভালো নয়। পাওভাজিটাই মজা করে খাওয়া গেলো। আর মিষ্টিটা ছিলো খুবই শক্ত। খেয়ে মুখের টেস্টটাই নষ্ট হয়ে গেলো।

ইডলি আর পাওভাজির সাথে সেই শক্ত লালমোহন
ইডলি আর পাওভাজির সাথে সেই শক্ত লালমোহন

খাওয়া দাওয়া শেষ করে হোটেলে ফিরে আসলাম আমরা। ইতোমধ্যে বলে দেওয়া হয়েছে ভোর চারটার সময় ঘুম থেকে উঠতে হবে আমাদের। জুবায়ের প্রতি রুমে রুমে এসে ডেকে তুলবে সবাইকে। আমাদের জন্য বাস এসে বসে থাকবে। ভোর বেলাতেই রওয়ানা হবো চেন্নাইয়ের উদ্দ্যেশ্যে। ক্লান্ত শরীরে ব্যাগ গুছিয়েই শুয়ে পড়লাম আমরা। প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

 

The Mighty INDIA CALLING: খুব ভোরে একদিন পন্ডিচেরিতে (পর্ব ৩৫)

পন্ডিচেরিতে পৌঁছালাম ভোর বেলা। আমাদের বাস এসে থামল এমন একটা জায়গায় যার নাম ‘মারাইমালাই আদি গাসালাই’ । আমরা এসি বাসে আরাম করে চোখ বুজে পড়ে রইলাম। আমাদের কমিটির লোকজন নামলো হোটেল ঠিক করতে। দুই একটা হোটেলের পাশে বাস পার্ক করা হলো। কিন্তু ঠিকঠাক হচ্ছিলো না। অবশেষে ইশতিয়াক আমাদের সবার উদ্দেশ্যে বললো যে হোটেল একটা পাওয়া গেছে কিন্তু হোটেল ওয়ালাদের একটু ‘শুচি’ সমস্যা আছে। একসাথে ছেচল্লিশজনকে তারা থাকতে দিচ্ছে কিন্তু তাদের একটাই শর্ত যেন রুম আর বাথরুম পরিষ্কার থাকে। শুনে আমাদের হাসি পেল। ওরা আমাদের পরিষ্কার রুম আর বাথরুম দিলে আমরাও পরিষ্কার রুম আর বাথরুমই ফেরত দিবো- এ আর এমন কি?

আমরা লাইন ধরে বাস থেকে নামতে লাগলাম। আমাদের লাগেজগুলো বের করে নিয়ে লাইন ধরে মালপত্র টানতে টানতে দুইটা গলি পার হয়ে আমাদের হোটেলের দিকে যেতে লাগলাম। আর রাস্তাঘাটে স্কুলের বাচ্চারা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে অবাক হয়ে আমাদের দেখতে লাগলো। যে হোটেলে আমরা ঢুকলাম তার নাম ‘হোটেল সর্বমংগলম ইন’ । ভেতরটা বেশ পরিপাটি করে সাজানো। ঠিক কমার্শিয়াল হোটেলের মতন না, বরং বাসাবাড়ির মত ঘরোয়া। আমাদের রুম ঠিক করা হয়েছে তিন তলায়। সব চেয়ে বড় যে সমস্যায় পড়লাম যখন টের পেলাম যে হোটেলে কোন লিফট নাই। কাঠের রেলিং দেওয়া চকচকে সিড়ি বেয়ে আমরা আমাদের মালপত্র টেনে উঠাতে লাগলাম। তিন তলায় যখন পৌঁছালাম, তখন আর আমাদের গায়ে কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই। খুঁজে খুঁজে আমাদের রুম বের করলাম। ছোট্ট একটা পরিপাটি রুম যার একটা মাত্র জানালা করিডরে খুলে, আর সাথে ঝকঝকে একটা বাথরুম। বরাবরের মতই রুমে ঢুকে ফ্যান ছেড়ে আমরা চারজন বিছানায় ফ্ল্যাট হয়ে পড়ে গেলাম।

'হোটেল সর্বমঙ্গলম ইন' এর অ্যাট্রিয়াম
‘হোটেল সর্বমঙ্গলম ইন’ এর অ্যাট্রিয়াম

একজন একজন করে গোসল করতে ঢুকলাম বাথরুমে। মজুমদার আর মৌলি আগে গোসল করে বের হয়ে পড়লো। আমি আর রুবাইদা বের হলাম খানিক্ষণ পরে। হোটেলের নিচে রিসেপশনে আমাদের প্রত্যেককে একটা করে ফর্ম ফিল আপ করে সাথে পাসপোর্ট সাইজের ছবি জুড়ে দিতে হলো। বিদেশি নাগরিকদের নাকি এসব করতে হয়! আমরা মুখ টিপে হাসলাম। সারা ইন্ডিয়ার কোথাও এরকম ঝামেলা করতে হয় নাই দেখে বুঝলাম উনারা অন্য সবার চাইতে বেশি সাবধানী। এই সব করে বের হতে হতে বেশ দেরি হয়ে গেলো। আমি, রুবাইদা, মিম আর অন্তরা বের হলাম একসাথে। মোবাইলে দেখলাম কাছেই আছে আন্না সালাই রোড। খাওয়া দাওয়া করতে সেদিকেই হাঁটা ধরলাম।

রাস্তাঘাট একদম নির্জন। আশেপাশে দোকানপাট প্রায় সবই ফাঁকা। একটা ফাস্ট ফুড টাইপের দোকানে গিয়ে ঢুকলাম আমরা। কোন কাস্টোমার নাই। আমাদের দেখে একজন লোক এগিয়ে এসে তামিল ভাষায় কি যেন বলেই বের হয়ে গেলো। আমরা একটু অবাক হয়ে গেলাম – এ কি ব্যাপার রে ভাই? কাস্টোমারকে রেখে দোকানদার বের হয়ে যায় কখনও তো দেখি নাই! কি আর করা, খালি দোকানে বসে আমরা মেনু উল্টাচ্ছিলাম। মিনিট পাঁচেক পর অন্য একজন লোক ঢুকে আমাদের কাছে এসে অর্ডার নেওয়ার ভংগিতে দাঁড়ালো। আমরা অর্ডার দিতে লাগলাম। কিন্তু লোকটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে কথা বলে অদ্ভূতভাবে ডানে বামে মাথা নাড়াতে লাগলো। আমরা বুঝলাম না সে কি অর্ডার নিচ্ছে নাকি নিচ্ছে না? খানিক পরে বুঝলাম এইরকম ভঙ্গিতে মাথা নাড়ানোর অর্থ ‘হ্যাঁ’। আমি আর রুবাইদা ভেজ নিচ্ছিলাম দেখে কেন যেন সে বলে উঠলো, ‘চিকেন হালাল’। বলেই সে কাঁচের দরজায় লাগানো একটা স্টিকার দেখালো, ‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট হালাল’। আমি শিওর হবার জন্য আরেকবার জিজ্ঞেস করলাম সত্যিই হালাল কিনা? উনি আবার কনফিউসড ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’।

যাই হোক অর্ডার দিয়ে আমরা গল্পগুজব করতে লাগলাম। বেশ অনেকক্ষণ সময় পর খাবার আসলো। আমি অর্ডার দিয়েছিলাম ১০০ রুপির চিকেন চিজ বার্গার। আমারটাই আসলো সবার আগে। চারকোনা প্লেটে সার্ভ করা মেয়নিজ আর লেটুস দেওয়া বার্গারটা বেশ মজাই ছিলো। অন্যদের অর্ডার গুলোও চলে আসলো। আমরা গপাগপ খেতে লাগলাম। খেয়েদেয়ে বিল মিটিয়ে দিয়ে বের হয়ে আসলাম সেই দোকান থেকে। এবার হাঁটতে লাগলাম রাস্তা ধরে। রাস্তার পাশেই একটা সিনেমা হলে বড় পোস্টার ঝুলছে। নামটা তামিল ভাষায় লিখা। পোস্টারে পৌরানিক দৈত্যের মতন একজনের সাথে সুন্দরী এক নায়িকার ছবি আছে। আমার সাউথের একটা মুভি হলে বসে দেখার খুব শখ ছিলো। কিন্তু এই দৈত্য দানব দেখে মুভিটা আর দেখতে ইচ্ছা হলো না। যদি খুব ভায়োলেন্ট মুভি হয়, এই ভয়ে আমি আর ওদিকের পথ মাড়ালাম না। পরে জেনেছিলাম সিনেমাটার নাম ‘আই’।

হালাল সেই চিকেন চিজ বার্গার
হালাল সেই চিকেন চিজ বার্গার

কিছুদূর হেঁটেই আমরা তাজ্জব হয়ে গেলাম। এ কি, ভুল দেখছি না তো? এ যে বিশাল এক ‘পোথি’র শো রুম! মাত্রই ত্রিভান্দামে ঘুরে আসা শাড়ির জনপ্রিয় ব্র্যান্ড পোথির শো রুম দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সামনে। আমরা হৈ হৈ করে ঢুকে পড়লাম তাতে। ত্রিভান্দামের চাইতে এই পোথিতে ভীড় একদমই কম। ভীড়বাট্টা দেখে আমরা আরও খুশী হয়ে গেলাম। আমাদের অনেকজনকেই দেখলাম বিভিন্ন ফ্লোরে শাড়ি দেখছে। লোকজন নাই দেখে শান্তি মত ঘুরে ঘুরে শাড়ি পছন্দ করতে লাগলাম আমরা। একেকবার একেক ফ্লোরে ঘুরে ঘুরে শাড়ি দেখতে দেখতে কখন যে সময় কেটে যেতে লাগলো টেরই পাই নাই। মোটমাট তিনটা শাড়ি আর সাতটা থ্রি পিস কিনে আমরা যখন বের হই পোথি থেকে তখন বিকাল হয়ে গেছে। আমি আর রুবাইদা দুই হাত ভর্তি শপিং নিয়ে হোটেলে ফিরে গেলাম। কয়েক ঘন্টা রেস্ট নেওয়া জরুরি, না হলে শরীর চলবে না।

অল্প বিস্তর রেস্ট নিয়ে আমরা যখন আবার বের হবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমি, অন্তরা, মিম আর রুবাইদা বের হলাম বিচের উদ্দেশ্যে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে নির্জন ফাঁকা রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম আমরা। একটা মজার জিনিস আমার চোখে পড়লো। রাস্তার আশেপাশের দেওয়ালে সিনেমার পোস্টারের মত নানা রকমের শুভেচ্ছা মূলক পোস্টার। যেমন- কোন একটা বাচ্চার জন্মদিন, তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে হয় তো তার পরিবারের লোকজন পোস্টার টানিয়েছে। পোস্টারে বড় করে বাচ্চাটার ছবি, তারপর সবার উপরে নায়ক রজনীকান্তের ছবি, তার আশে পাশে অন্য মানুষদের আলাদা আলাদা পোজ মারা ছবি। এরাই মনে হচ্ছে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। এই রকম এক দম্পতিকে বিয়ের শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্টার, একজন বুড়ো মানুষকে শুভেচ্ছা জানিয়েও পোস্টার দেখলাম। মজাই পেলাম। এই সব দেখেই বুঝলাম, এই এলাকার লোকদের জীবনের সাথে সিনেমা ব্যাপারটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

একটি শিশুকে অভিনন্দন জানিয়ে তার শুভাকাংখীদের পোস্টার!!!!!!
একটি শিশুকে অভিনন্দন জানিয়ে তার শুভাকাংখীদের পোস্টার!!!!!!

বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা দোকানে চা খাওয়ার জন্য সবাই থামলো। দেখলাম জুবায়ের আর রাজিব ভাড়া নেওয়া একটা বাইক পার্ক করে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। এর আগে গোয়াতেও বাইক ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা ছিলো। কিন্তু সেখানে বাইক চালাতে লাইসেন্স লাগে। তাই আমাদের কেউ বাইক ভাড়া নিতে পারে নাই। কিন্তু পন্ডিচেরিতে লাইসেন্সের বালাই নাই। এমনিতেই বাইক ভাড়া পাওয়া যায়। আমাদের জাফর, শুভ, রিজভি, ইশতিয়াক, রাজিব ওদের সবাইকেই দেখা গেল একটা করে বাইকে চেপে ঘোরাঘুরি করতে। এতে একটা ভাবও আসে! যাই হোক, ওরাও চা খাবে। চায়ের অর্ডার দিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম। গরম গরম তেলে কি কি যেন ভাজা হচ্ছে। রুবাইদা বেসনে মরিচ ভাজা কিনলো কয়েকটা। আমি খেলাম সিংগারা। আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করে নানা রকম গল্প করতে লাগালাম। কিন্তু চা আর আসে না। সারাটা ইন্ডিয়াতেই লোকজনের এই ঢিলামি এত দিনে আমাদের সহ্য হয়ে যাওয়া উচিৎ ছিলো, কিন্তু তাতেও আমাদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙ্গে। ঠিক এমন সময়ে চা এসে হাজির হলো। তাড়াতাড়ি চা খেয়ে আমরা রওয়ানা হলাম।

রাস্তাঘাট শুনশান নিরব। হাঁটতে চলতে খুবই আরাম। হাঁটতে হাঁটতে আমরা বিচের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। দেখতে পেলাম অভিজাত সব ইতালিয় রেস্টুরেন্ট। সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে আমরা বিচে চলে গেলাম। এই বিচটা আমার পরিচিত কক্সবাজার বা গোয়ার বিচের মতন নয়। পায়ে হাঁটার জন্য একটা বিশাল চওড়া রাস্তা, তার পাশে অনেকটা জায়গা ছেড়ে বেশ নিচে কঙ্ক্রিটের ব্লক ফেলা। ঠিক সেই ব্লক গুলোতে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউ। এখানে সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে হাঁটার ব্যাপার নাই। ব্লকগুলোতে যাওয়াই বেশ কঠিন কাজ। আর একবার পা হড়কে পড়ে গেলে তো সবই শেষ!

চারদিক বেশ শান্ত। লোকজন ঘুরছে ফিরছে, কিন্তু কোন হৈহুল্লোড় নাই। হলুদ সোডিয়াম লাইটের আলোতে ঝকঝক করছে চারদিক। ঠান্ডা প্রাণ জুড়ানো বাতাসে আমাদের সবার মন ভালো হয়ে গেলো। আমরা সবাই বসে গল্প করতে লাগলাম। বিশুদ্ধ নোনা বাতাস, মায়াবী সোডিয়াম লাইট, আর পায়ের নিচে উত্তাল সমুদ্রের গর্জন- আহ, এত শান্তি কি করে লুকিয়ে থাকতে পারে একটা জায়গায়? অনেকক্ষণ বসে রইলাম আমরা। তারপর হাঁটতে লাগলাম বড় রাস্তা ধরে এই মাথা টু ওই মাথা। মন আমাদের এত ফুরফুরে হয়ে গেলো যে ভুলেই যাচ্ছিলাম যে রাত বাড়ছে, আমাদের ফিরে যেতে হবে। রাত আনুমানিক সোয়া নয়টার দিকে আমরা বের হয়ে আসলাম সেই বিচ থেকে। এতটা পথ হেঁটে আর হোটেল যেতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না। ৪০ রুপি দিয়ে একটা অটো ভাড়া করলাম। একটা অদ্ভূত জিনিস খেয়াল করলাম, পন্ডিচেরির অটোতে ইলেক্ট্রিক হর্নের বদলে বাচ্চাদের খেলনা ভেঁপু লাগানো। ড্রাইভার চালাতে চালাতে বাঁশির পিছনের রাবারের বলটাতে টিপ দিলে পোঁপ পোঁপ করে বেজে ওঠে সেটা। বেশ মজা লাগলো। অটোতে করে খুব কম সময়ে ফিরলাম হোটেলে।

হলুদ সোডিয়াম বাতির আলোতে উদ্ভাসিত পন্ডিচেরির বিচ ও তার পাশের বিশাল চওড়া রাস্তা
হলুদ সোডিয়াম বাতির আলোতে উদ্ভাসিত পন্ডিচেরির বিচ ও তার পাশের বিশাল চওড়া রাস্তা

হোটেলে নেমেই রুবাইদা রুমে চলে গেলো। আমি, অন্তরা আর মিম রাতের খাবার খাওয়ার জন্য পায়তারা করতে লাগলাম। হোটেলের গলিটা পার হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে আরও দুই একটা গলি পার হয়েই কয়েকটা ছোট্ট খাবারের দোকান পেয়ে গেলাম। দোকানটা খুব ছোট, তাই রাস্তার উপরই চেয়ার টেবিল পেতে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা একটা টেবিলের চার পাশে ঘিরে বসলাম। একজন লোক এগিয়ে আসলো। পরিষ্কার হিন্দিতে জানালো পরোটা, চিকেন আর মাটন পাওয়া যাবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম ভেজ কিছু আছে কিনা? জানতে পারলাম একটা সব্জির তরকারি আছে। কিন্তু লোকটা আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলো, মাংস না খেয়ে কেন ভেজ অর্ডার দিচ্ছি। আমার হয়ে মিম এর উত্তর দিয়ে দিলো। শুনে লোকটা হাসি মুখে বললো এখানে সব মাংসই হালাল। আমরা শুনে খুশি হয়ে গেলাম। আমি শিওর হওয়ার জন্য দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করলাম, ‘সত্যিই তো?’। লোকটা হাসিমুখে জবাব দিলো, ‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট অ্যান্ড ইটস অ্যা প্রমিস’। তারপর আর কি, আমরা চিকেন আর মাটন দুটোই অর্ডার দিলাম। পরোটা দিয়ে মজা করে খেলাম হালাল চিকেন আর মাটন। বেশ মজা ছিলো খেতে। আমার বিল আসলো ৬৭ রুপি। খেয়ে দেয়ে বিল মিটিয়ে দিয়ে তৃপ্ত মনে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে হোটেলের দিকে রওয়ানা দিলাম।

হোটেলের লবিতে দেখি এক মহিলাকে ঘিরে আমাদের লোকজনের জটলা বেঁধে আছে। ভদ্রমহিলা পরিবার নিয়ে কলকাতা থেকে এসেছেন। কয়েকদিন বাংলা না বলতে পেরে ওনার কেমন যেন হাঁসফাঁস লাগছিলো। হঠাৎ আমাদের বাংলা কথা বলতে শুনে উনি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। বাংলায় গল্প জুড়ে দিলেন আমাদের সাথে। যখন জানতে পারলেন আমাদের কান্ড কাহিনী, খুব মজা পেলেন। বিরক্ত হয়ে বলতে লাগলেন এটা একটা জায়গা হলো নাকি- কেউ তো কোন ভাষাই বোঝে না। এখানকার শাড়ির যা দাম, কোলকাতায় তো সব নাকি পানির দরে পাওয়া যায়। মন খুলে কথা বলতে লাগলেন আমাদের সাথে। বাংলা ভাষায় কথা বলতে পেরে চোখে মুখে আনন্দ ঠিকরে পড়ছিলো ওনার।

রুমে ফিরে আসলাম। আমাদের পাশের রুমটা নিশাতদের রুম। নিশাতের মোবাইলটা ধার করে শাড়ি, জামা কাপড়ের ছবি তুলে বাসার লোকজনকে পাঠালাম। লাগেজ উলট পালট করে সব কিছু ভিতরে ঢুকালাম। ততক্ষণে মজুমদার আর মৌলিও ফেরত এসে গেছে। গোছগাছ শেষ হলে জোড়ে ফ্যান ছেড়ে লাইট নিভিয়ে আমরা চারজন শুয়ে পড়লাম। এবং চোখ বন্ধ করার সাথে সাথেই ঘুম চলে আসলো।

The Mighty INDIA CALLING: ব্রিক মাস্টার লরি বেকারের জগৎ এবং পন্ডিচেরি যাত্রা (পর্ব ৩৪)

সুন্দর সকালে ঘুম ভাংলো আমাদের। আগের দিনের গানের তোড়জোড় নাই। তাই আরাম করেই ঘুম দিয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠেই সব ব্যাগ গোছগাছ করে রাখলাম। সকাল ৮টার সময় আমাদের বের হয়ে যাওয়ার কথা লরি বেকারের সেন্টারের উদ্দেশ্যে। তার আগে আমাদের সব মালপত্র আরেকটা যে হোটেল আছে ‘রাজি হোমস’ সেখানে জমা দিয়ে আসতে হবে। আমরা ব্যাগ নিয়ে প্রায় বের হয়েই যাচ্ছিলাম, কিন্তু হঠাৎ শুনতে পেলাম কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। সব প্ল্যান নাকি বাতিল হয়ে গেছে। সব কিছু বাদ দিয়ে আমরা সেই রেইন বো হোটেলে গেলাম নাশতা খেতে। আমি অর্ডার দিলাম ৬০ রুপির পাউরুটি টোস্ট, বাটার আর জেলি।

আয়েশ করে সেটা খেতে খেতেই শুনলাম আমাদের হোটেলেই নাকি মালপত্র জমা রাখা হবে। আর দেরি হয়ে যাওয়ার কারণে সকাল ৮টার প্রোগ্রাম বাতিল হয়ে গেছে। ফুরফুরে মনে খেয়েদেয়ে আমরা আমাদের হোটেলে ফেরত আসলাম। আমাদের রুমেই অন্যদের মালপত্র রাখা হবে। ‘রাজি হোমস’ থেকে একজন একজন করে ঢাল বেয়ে টেনে টেনে ওদের লাগেজগুলো আনতে লাগলো। পরিশ্রমের কারণে সবার চোখমুখ লাল। মেজাজও থমথমে। প্ল্যান বদলে যাওয়ায় অনেকেই অসন্তুষ্ট। মনের দুঃখ, কষ্ট, রাগ ঝাড়তে গিয়ে পরিস্থিতি উত্তেজিত হয়ে পড়লো। এর মধ্যে শুনলাম রাজি হোমসে হিমির মেজাজ চড়ে গেছে কমিটির উপর। লাগেজ কোথায় রাখা হবে এটা বারবার পরিবর্তন হওয়ায় মেজাজ বিগড়ে গেছে ওর। দীর্ঘদিনের ট্যুরের ফলে অনেকেরই মন মেজাজে পরিবর্তন এসেছে। স্বাভাবিক ঘটনাতেই অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু হচ্ছে। মনে হলো এত দিনের ট্যুরে মানসিক অবস্থা এরকম হয়ে আসাটা খুবই স্বাভাবিক। তবে অন্য সবাই খুবই ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি সামাল দিলো। কমিটি বিকল্প প্ল্যান জানিয়ে দিলো। আমরা সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিলাম।

সকাল ১০টার দিকে আমরা হোটেল থেকে একটু সামনে গিয়ে চমৎকার একটা পাবলিক বাসে চড়ে বসলাম। আমাদের গন্তব্য ইস্ট ফোর্ট। প্রায় আধা ঘন্টা পর ইস্ট গেটে পৌঁছালে আমরা বাস থেকে নেমে পড়ি। ইস্ট গেট অনেকটা আগেরদিন যে শহরে গিয়েছিলাম সেখানকার বাসের ইম্পরট্যান্ট স্টপেজ। আশেপাশে অনেক বাস এসে থামছে আর ছাড়ছে। অনেক বাসে দেখলাম। শাড়ি পরা মহিলা কন্ডাক্টর। আমরা বাস থেকে নেমে এদিক সেদিক দাঁড়াই। অনেকেই ইশারা ইঙ্গিতে খাওয়া দাওয়া কিনে খেতে থাকে। একটা বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে আমরা সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। তারপর আরেকটা বাসে উঠে পড়ি। সেই বাসে আমরা টিকেট কাটি ১৫ রুপির। এই বাস আমাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করে। আল্লাহর ওয়াস্তে সেই যাত্রা আর শেষ হবার নাম গন্ধ নাই। শহর ছেড়ে আঁকা বাঁকা, সরু চিপা, গ্রামের মতন রাস্তা দিয়ে আমাদের বাস হুশ হুশ করে যেতে লাগলো। যখন আমাদের মনে হতে লাগলো যে আমরা বুঝি কেরালা পার হয়ে অন্য কোন দেশে চলে এসেছি, তখন আমরা একটা কাঁচা রাস্তার উপর স্টপেজে নেমে পড়লাম।

নেমে আশেপাশে তাকালাম। এটাই তো সেই জায়গা হওয়ার কথা, কিন্তু চারপাশে তো শুধু গাছ পালা আর জঙ্গল ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ইতস্তত করতে করতে আমরা ঢাল কাঁচা রাস্তা বেয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। তারপর জঙ্গলের ভিতরে খুব সাধারণ একটা গেট পেয়ে সেখান দিয়ে ঢুকে পড়লাম।  পেয়ে গেলাম লরি বেকার সেন্টার। জায়গাটা এতই অকৃত্রিম যে বোঝাই যায় না জঙ্গলের মাঝে এখানে কোন স্থাপনা আছে। হাঁটতে হাঁটতে দেখতে লাগলাম ইট আর কনক্রিটের ঢালাই দেওয়া ছাদের ছোট ছোট সব বিল্ডিং। ইট দিয়ে সব বাঁকানো ওয়াল, কার্ভ আর ফ্রি ফর্মের সমাহার দেখলাম খুব সহজভাবে। অত্যন্ত কম খরচে বানানো এই স্থাপনাগুলো আমাদের মুগ্ধ করে দিলো। ঝাঁ চকচকে ব্যাপার ছাড়াও খুব সাধারন স্থাপনাও যে কতটা নান্দনিক হয়ে পারে সেটাই আমরা দেখছিলাম মুগ্ধ হয়ে। কয়েকটা বিল্ডিঙয়ের ভিতরে ঢুকলাম আমরা। বাড়তি কোন ফার্নিচার নাই, সবই বিল্ট ইন- একবারে কনক্রিট ঢালাই বা কাঠ দিয়ে বসানো। রঙ চঙ্গে কাঁচের বোতল দিয়ে চমৎকার স্কাইলাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোথাও এতটুকু বাহুল্য নাই। যা আছে একেবারে মিনিমাল রিকয়ারমেন্ট। একজন মানুষের শুয়ে থাকতে ঠিক যতটুকু জায়গা লাগে ততটুকুই বিছানা, হাঁটা চলার জন্যও সবচেয়ে পরিমিত জায়গা ছাড়া হয়েছে। জায়গাটা সহজেই সবাইকে আপন করে নেয়। কোন শ্রেনির মানুষই মনে হয় এখানে এসে হীন্মন্যতায় ভুগবে না। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম, সারা জীবন সব বড়লোকদের জন্য ডিজাইন করে এসেছি, এই রকম সাধারন ডিজাইনের চ্যালেঞ্জ কখনই পেলাম না।

ইটের তৈরি শান্তিময় স্থাপনা
ইটের তৈরি শান্তিময় স্থাপনা

অনেক ঘুরে ফিরে আমরা বই কিনলাম। লরিবেকারের গাদা গাদা বই। এখানে বইয়ের দাম সবচেয়ে কম। আমি ৯০০ রুপি দিয়ে একগাদা বই কিনে নিলাম। তারপর ওদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বের হয়ে আসলাম সেখান থেকে। সেই ঢাল বেয়ে নামতে নামতেই একটা বাস এসে হাজির হলো আর আমরা হুড়মুড় করে তাতে উঠে বসলাম। সেই বাস আমাদের আবার আগের জায়গায় নামিয়ে দিলো, ‘ইস্ট ফোর্ট’। সেখানে আমরা আরেকটা বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। বাস স্ট্যান্ডের পাশে সারি সারি খাবারের দোকান। রুবাইদা এক দোকান থেকে ‘ কলা বড়া’ জাতীয় এক ধরনের খাবার কিনে নিয়ে আসলো। আমি মুখে দিয়ে দেখলাম খুবই খারাপ খেতে। দোকানে দোকানে বড় বড় কলার কাঁদি ঝুলছে। আমি ১০ রুপি দিয়ে একটা কলা কিনে খেয়ে দেখলাম। আমার মনে হলো কলাটা ঠিক পাকে নাই, কেমন যেন কাঁচা কাঁচা। টেস্ট তেমন আহামরি কিছু না। তবে আমাদের দেশের সাগর কলার ধারে কাছেও নাই। এর মধ্যে আরও অনেকেই এসে জুটলো আমাদের সাথে। ওরা এদিক সেদিক শপিং করছিলো। সবাইকে নিয়েই আমরা একটা বাসে উঠলাম। সেই বাস এক স্কুলের সামনে থামতেই আমরা নেমে পড়লাম। গুগল ম্যাপ দেখে লোকেশন ঠিক বোঝা যাচ্ছিলো না। আমরা আশেপাশে জিজ্ঞেসও করলাম, তবে কোন লাভ হলো না। অনেক কিছু চিন্তা ভাবনা করে আমরা হাঁটতে লাগলাম। প্রচন্ড কড়া রোদ, এরমধ্যে কতদূর যাবো কোন আইডিয়া নাই। তারপরও আমরা হাঁটতে লাগলাম। মায়িশা, নোভা, ঐশিকে দেখলাম অটো ভাড়া করে চলে যেতে। ওরা চলে গেলে আমরা বাকিরা হাঁটতে লাগলাম ফুটপাথ ধরে।

প্রায় ঘন্টা খানেক হাঁটার পর খুঁজে পেলাম ‘কস্ট ফোর্ট’ । এটা এক সময় লরি বেকারের বাসা ছিলো। এখন এটা লরি বেকার ফাউন্ডেশনের অফিস।  ছোট্ট সুন্দর দোতলা বাড়িটা আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে ঘুরে দেখলাম। পুরো ঢালুর উপর বানানো বাড়ি। একটুকু নষ্ট করা হয় নাই ঢালটাকে। দরজা, জানালা আর সিড়ির কাঠগুলো সব রিসাইকেলড কাঠ। খুব ভালো লাগলো আমাদের। নিশাত এখান থেকে বই কিনলো, তবে একটু বেশি দাম দিয়ে। এখান থেকে বের হয়ে আবার আমরা দৌড়ে বাস ধরলাম। সেই বাস আমাদের নামিয়ে দিলো ইস্ট ফোর্ট। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেছে। কিছু খাওয়া দরকার। সুমাইয়ার সাজেশনে ৩০ রুপি দিয়ে একটা অটো নিয়ে চলে গেলাম ‘ইন্ডিয়ান কফি হাউজ’ এ। লরি বেকারেরই করা খুবই ইন্টারেস্টিং বিল্ডিং এটা। পুরো বিল্ডিংটাই র‍্যাম্প। একটা অক্ষকে ধরে পেঁচিয়ে উঠে গেছে। আমরা ভিতরে ঢুকে র‍্যাম্প বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা খালি বসার জায়গা পেয়ে সেখানে বসে পড়লাম। আমি আর সুমাইয়া মিলে অর্ডার দিলাম ২০ রুপির দুইটা পরোটা আর ৩৫ রুপির ভেজ কোরমা। সেই কলকাতার কফি হাউসের মতন পাগড়ি পরা বেয়ারা এসে অর্ডার নিয়ে গেলো। বেশ অনেক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমাদের খাবার আসলো। সব খাবারই খুব মজা। দামও খুব কমই বলে মনে হলো। আমরা খুব মজা করে গল্প করতে করতে খেলাম। অন্তরা আবার জামের জুস অর্ডার দিয়েছিলো। সেইটাও বেশ মজা ছিলো।

ঢাল বিশিষ্ট 'ইন্ডিয়ান কফি হাউস' এ
ঢাল বিশিষ্ট ‘ইন্ডিয়ান কফি হাউস’ এ

খেয়ে দেয়ে বিল মিটিয়ে দিয়ে আমরা বের হয়ে আসলাম। নিচেই প্রিপেইড অটো কাউন্টার। এখানে যত অটো দাঁড়িয়ে থাকে সেগুলো ভাড়া নিতে হলে আগে ২ রুপির টিকেট কেটে নিতে হয়। আমরা সেরকম একটা টিকেট কেটে একটা অটো ভাড়া করলাম যেটা আমাদের আবার নিয়ে গেলো ইস্ট ফোর্ট। ভাড়া পড়লো ২০ রুপি। সেখানে নেমে আমরা একটা বাসে চেপে বসলাম। এই বাস আমাদের সোজা নিয়ে গেলো কোভালাম। ততক্ষণে দিনের আলো পড়তে শুরু করেছে। বাস আমাদের যেখানে নামিয়ে দিলো, সেই ঢালের সামনে আমরা একটা বড় বাস দেখলাম। সন্ধ্যার সময়ই এই বাসে করেই আমাদের পন্ডিচেরির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার কথা। আমরা তাড়াহুড়া করে ঢাল বেয়ে নেমে হেঁটে হোটেলের কাছে যেতে যেতে দেখলাম উর্মি, অদিতিরা একটা অটো রিক্সা ভাড়া করেছে। মাল্পত্রগুলো অটোরিক্সায় তুলে ওরা ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো।   দেখে আমার বুকটা ধক করে উঠলো- সর্বনাশ, এই বিশাল ঢালটা পার করে লাগেজগুলো টেনে টেনে নিয়ে যেতে হবে! ওরা না হয় অটো পেলো, আমার কি উপায় হবে? যাইহোক সময় নষ্ট না করে আমরা হোটেলে ঢুকে পড়লাম। আমাদের রুম ভর্তি লাগেজ। কোনমতে লাগেজের স্তুপ পার হয়ে সবাই লাইন ধরে বাথরুম পর্যন্ত পৌঁছালাম। ফ্রেশটেশ হয়ে সবাই যার যার মালপত্র নিয়ে বের হয়ে যেতে লাগলাম। আমি ট্রলি, ব্যাকপ্যাক, সাইড ব্যাগ আর খাবার আর পানির প্যাকেট- এই চারটা জিনিস নিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। জীবনে একটা দারুণ এক্সপেরিএন্স হতে যাচ্ছে নিঃসন্দেহে!

শক্ত হাতে ট্রলি ব্যাগটা টেনে এক কদম এক কদম করে আগাতে লাগলাম। প্রথম কিছুদূর কমই কষ্ট হলো, কয়েক মিনিট পর শুরু হলো সমস্যা। ব্যাক প্যাক, সাইড ব্যাগ আর ট্রলি ব্যাগটা মিলে আমাকে পিছন দিকে টানতে লাগলো। ঢালটা এমনই খাড়া ছিলো যে হাত একটু আলগা হলেই ট্রলি ব্যাগটা পিছন দিকে গড়িয়ে নেমে যাবে। শক্ত করে ব্যাগটা ধরে রাখতে রাখতে হাতের আঙ্গুল গুলোতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে লাল দাগ পড়ে গেলো। এর মধ্যে রাস্তাটাও মসৃণ না। আমাদের দেশের বর্ষা কালে রাস্তায় যেমন বড় বড় গর্ত থাকে সেই রকম গর্তওয়ালা এবড়ো থেবড়ো রাস্তা এটা। এর মধ্যে দিয়েই মাঝে মধ্যে হুউউশ করে অটো রিক্সা যাচ্ছে। তাই ঢালের মধ্যেই একটু পর পর ডানে বামে সরতে হচ্ছে। প্রচন্ড পরিশ্রম হচ্ছিলো। এত জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম মনে হচ্ছিলো যেন পাঁজরের খাঁচাটা ভেঙ্গেই যাবে। এক পর্যায়ে গিয়ে মনে করলাম, এইভাবে আর সম্ভব না। রাস্তার পাশে সব মালপত্র রেখে থামলাম কয়েক মুহূর্ত। থামার সাথে সাথেই টের পেলাম পা দুটোতে কোন অনুভূতি পাচ্ছি না। এই ঢাল বেয়ে উঠতে উঠতেই ওরা যেন অবশ হয়ে গেছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে টের পেলাম গাল মুখ দিয়ে গরম ভাপ এর হচ্ছে। আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম এ ঢালের শেষ কোথায় দেখা যায় কিনা! এর আগে সিমলায় যে ঢাল পার হয়েছিলাম সেটা এটার তুলনায় নস্যি। এটার দৈর্ঘ্য সেই ঢালটার প্রায় চার থেকে পাঁচ গুন বেশি হবে। আমি হাঁপাতে হাঁপাতেই দেখলাম চোখ মুখ লাল করে অন্তরা ইঞ্চি ইঞ্চি করে ওর লাগেজ টেনে টেনে আমার দিকে আগাতে লাগলো। আমাদের দুইজনেরই কাহিল দশা। এখনও অনেকটা পথ বাকি। অন্তরাও খনিকটা জিরিয়ে নিলো আমার সাথে। তেমন কিছু লাভ হলো না। পিঠের বোঝা আর কাঁধের বোঝা তো জায়গা মতনই রইলো। খালি হাতেরটা ছেড়ে দিতেই যা একটু বিশ্রাম হলো। মিনিট তিনেক পরই আবার আমরা রওয়ানা দিলাম। ঘড়ঘড় শব্দ করে আমাদের ট্রলির চাকা চলতে লাগলো পিচ ঢালা পাথুরে রাস্তা দিয়ে। প্রচন্ড পরিশ্রম করে আমরা এক কদম এক কদম করে এগিয়ে যেতে লাগলাম।

এক সময় যখন সত্যি সত্যি ঢালটা পাড়ি দিয়ে ফেললাম হঠাৎ করেই আমার মনে হতে লাগলো আমার চেয়ে সুখি মানুষ বোধহয় এই পৃথিবীতে আর কেউই নাই। এই ঢাল পাড়ি দিয়ে মনে হলো আমি বোধ হয় এভারেস্টও জয় করতে পারবো! নিজেকে কেমন যেন মুসা ইব্রাহিম মনে হতে লাগলো। আচ্ছা মুসা ইব্রাহিম যখন এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলো তখনও কি এই রকম খুশি হয়েছিলো? সমতল রাস্তায় পা দিয়েই আমি বত্রিশ দাঁত বের করে বিশ্বজয়ীর হাসি দিতে লাগলাম। আমাকে দেখে আরও কয়েকজন এগিয়ে এসে এমনভাবে অভিবাদন জানালো যেন আমি বিশাল কিছু করে ফেলেছি! অন্যদের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম সবাই আসলে এই বিশাল ঢাল পাড়ি দেওয়াটাকে বেশ বীরত্বের কাজ হিসেবেই কন্সিডার করছে। আমি মালপত্র টানতে টানতে বাসের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাসের পিছনে লাগেজ রেখে বাসে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। সিট পেলাম প্রথম দিকেই। ব্যাক প্যাকটা রেখে আমি নেমে পড়লাম পানি আর কিছু বিস্কুট কিনে নেওয়ার জন্য। বড় এক বোতল পানি কিনতে গিয়ে দেখতে পেলাম হিমিকে। হিমির গায়ের রঙ টকটকে লাল হয়ে গিয়েছে। সমুদ্রের কারনেই হোক আর ঢাল বেয়ে মালপত্র টেনে তোলাতেই হোক, ওর চেহারায় অসম্ভব ক্লান্তির ছাপ দেখতে পেলাম।

সব কেনাকাটা করে বাসে উঠে বসলাম। বাসটা একেবারেই বিলাসবহুল। আমাদের স্ক্যানিয়া বাসগুলোর মত। বিশাল বড় টিভি স্ক্রিন, আরামদায়ক সব সিট, চওড়া হাতল, দুই সিটের মাঝখানে ব্যাপক জায়গা- এইসব দেখে আমরা দারুণ খুশি হয়ে গেলাম। ইচ্ছমত পা ছড়ানো যাবে- এই সুখ আমরা কোথায় রাখবো সেটা আমরা বুঝতে পারছিলাম না। বাসে একেকজন বলতে শুরু করলো, ‘ আজকে আরামের চোটে রাতে ঘুম আসবে না’ । দীর্ঘদিন গোয়েলের মাপমত সিটে ঘুমাতে ঘুমাতে আমাদের অভ্যাসই হয়ে গিয়েছিলো হাঁটু, ঘাড় আর কোমরের টনটনে ব্যাথা নিয়ে ঘুম দেওয়ার। এত আরামদায়ক বাস পেয়ে আমাদের মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছিলো। সবাই উঠে পড়লে বাস ছেড়ে দিলো। বাসের এসি ছাড়ার সাথে সাথে বাসের তাপমাত্রা আরামদায়ক ঠান্ডা হয়ে গেলো। তখন সবারই মনে পড়ছিলো গোয়েলের কথা। গোয়েলের লোকজন দাবি করেছিলো যে গোয়েল নাকি এসি বাস। কিন্তু আমাদের প্রায় পঞ্চাশ ষাটটা লাগেজ ছাদে রাখতে গিয়ে এসিটা তেরপল দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়েছিলো। এজন্য ঠান্ডার দিনগুলো পার করার পর যখন আমাদের এসিটা ছাড়ার দরকার হয়েছিলো তখন আমরা এসি ছাড়তে পারি নাই। গরমের মধ্যেই অব্যাহত ছিলো আমাদের গোয়েলে যাত্রা। আজকে এসিটা পেয়ে আমাদের মনে হতে লাগলো, ‘এত সুখ কপালে সইবে তো?’

বাস ছাড়তেই কমিটি সারপ্রাইজ হিসেবে সবার হাতে হাতে পাঁচশ রুপি ধরিয়ে দিলো। আমরা খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। অ্যালাউয়েন্স পেয়ে আমরা ফুরফুরে মেজাজে গল্পগুজব করতে লাগলাম।  কিছুদূর যেতেই সবাই বলতে লাগলো, ‘সাউথের জার্নিতে সাউথের মুভি না দেখলে কি হয়?’ সবাই চিৎকার করে প্রস্তাবটা সমর্থন দিলো। আমি চিৎকার করে মুভির নাম সাজেস্ট করতে লাগলাম। এর মধ্যে মজুমদার উঠে গেলো মুভি সিলেক্ট করার জন্য। বাসের গাইডের সাথে বেশ খানিক্ষণ কথা বলার চেষ্টা করে মজুমদার আমাদের জানালো, আধুনিক কোন মুভি এই বাসে নাই। রজনীকান্তের একটা মুভি যার নাম ‘বাশহা’ এইটা মজুমদার একবার টিভিতে দেখেছিলো, চাইলে এই মুভিটা আমরা দেখতে পারি। সবাই তাতে রাজি হলো। চালু করা হলো কোন ডাবিং কিংবা সাবটাইটেল ছাড়া তামিল মুভি ‘বাশহা’। শুরুতেই গান, তারপর কঢ় মড়ে তামিল ভাষার ডায়লগ শুনতে শুনতে আমাদের কানে তালা লেগে গেলো। কাহিনী কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কোন কারণ ছাড়াই ধুম ধাড়াক্কা মারপিট শুরু হয়ে গেলো। হটাৎ করেই কাহিনী ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেলো। অনেক বোমা ফুটলো। মন্দির, রথ উড়ে গেলো- শত শত মানুষ মারা গেলো। নায়ক হঠাৎ ভিলেন হয়ে গেলো। সব মিলিয়ে যখন কাহিনী গিট্টুময় হয়ে গেলো তখন পিছন থেকে রিকোয়েস্ট আসতে লাগলো, ‘অনেক হইসে ভাই, বন্ধ কর এই মুভি। তামিল মুভি দেখার শখ উড়ে গেছে, আর নিতে পারতেসি না -প্লিজ বন্ধ কর’ সারা বাসের মধ্যে কেবল আমি আর অন্তরাই নিজেদের মনমত ট্রান্সলেশন করে কাহিনী বানিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু জনতার দাবির মুখে মুভিটা বন্ধই করে দিতে হলো।

মুভি বন্ধ হয়ে যেতেই সবাই ঘুমের দিকে মনোযোগ দিতে লাগলো। আরামদায়ক বিলাসবহুল সিটে ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশে আমরা সবাই ফটাফট ঘুমিয়ে গেলাম। গভীর রাতে আমার ঘুম ভাংলো। বাস থেমেছে একটা স্টপেজে। আমরা বেশিরভাগই নেমে গেলাম। যে জায়গায় নামলাম তার নাম ‘এস ভি হোটেল’। ফ্রেশ টেশ হয়ে আমি, অন্তরা, সীমান্ত আর ফাহাদ রেস্টুরেন্টে ঢুকে একটা টেবিলে একসাথে বসলাম। তখন আরেকটা বাসের লোকজন খাওয়ার অর্ডার দিচ্ছিলো। তাই আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। অন্য কাস্টোমাররা উঠে চলে গেলে আমাদের কাছে লোক আসলো অর্ডার নিতে। আমরা ভেবে চিন্তে অর্ডার দিলাম। হালাল মাংস পাওয়া যায় শুনে চিকেন মাসালার সাথে আমি আর অন্তরা অর্ডার দিলাম পরোটা আর সীমান্ত আর ফাহাদ অর্ডার দিলো ফ্রাইড রাইস। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা প্লেটের উপর পানি দিয়ে ধোয়া কলা পাতার টুকরা বিছিয়ে আমাদের সামনে এসে দিয়ে গেলো। তারপর আসলো খাবার। ৫০ রুপির কড়া মেথির ঘ্রাণওয়ালা দুই পিস চিকেন মাসালার সাথে ৩০ রুপির ছোট্ট গোল গোল হাতের তালুর সমান তিনটা পরোটা।  আর ওদের জন্য আসলো চিকন বাসমতি চালের সাথে লাল গাজর আর সবুজ সবজি দেওয়া ফ্রাইড রাইস। আর সাথে টক দইয়ের সাথে পিয়াজের মিষ্টি সালাদ। আমরা খাবারটা মুখে দিয়েই বিমোহিত হয়ে গেলাম। মুরগিটা এতই মজার যে আর বলার মত না! সারা ইন্ডিয়ায় খাওয়া সেরা খাবারগুলোর মধ্যে এই খাবারটা নিঃসন্দেহে একটা। আমি ফ্রাইড রাইসটাও টেস্ট করে দেখলাম -সেটাও দারুণ। খাবারটা এত মজার ছিলো যে মনে হচ্ছিলো আরও একবার অর্ডার দিয়ে খাই। তৃপ্তি নিয়ে খেতে খেতে যারা আসে নাই খেতে তাদের জন্য আমরা আফসোস করতে লাগলাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা যখন বাসে উঠে বসি তখনও আমার হাতে লেগে আছে চিকেন মাসালার গন্ধ।

কলাপাতায় ফ্রায়েড রাইস আর পরোটার সাথে চিকেন মাসালা

 

বাসে উঠে আবার ঘুমের প্রস্তুতি নিলাম। ভরপেট খাওয়া দাওয়ার পর সবাই চাঙ্গা হয়ে অনেক্ষণ গল্পগুজব করলো। তারপর এক সময় একে একে সবাই ঘুমিয়ে পড়তে লাগলো।

 

The Mighty INDIA CALLING: ত্রিভান্দাম শহরে একটি ‘শাড়ি’ময় দিন (পর্ব ৩৩)

খুব ভোরে ঘুম ভাংলো জোর একটা গানের শব্দে। উচ্চস্বরে কোথাও গান বাজছে। বিছানা থেকেই টের পেলাম। বালিশ দিয়ে কান চেপে শুয়ে রইলাম অনেক্ষণ। কিন্তু অত্যন্ত উৎসবমুখর গান। খুব বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে দিলো না আমাদের এত উচ্চস্বরের গান। উঠে পড়লাম আমরা। ফ্রেশটেশ হয়ে নিয়ে বের হয়ে পড়লাম নাশতা খাওয়ার জন্য। আবার সেই আগের রেইন বো রেস্টুরেন্টে এসে পৌঁছালাম। রুবাইদা এখানে খেতে রাজি হলো না। ও চলে গেলো। আমি অন্যদের সাথে বসে অর্ডার দিলাম ৬০ রুপির মাসালা পুরি যেটা আসলে ৩টা লুচি আর ডালের প্যাকেজ। খেতে মোটামুটি। গল্পগুজব করতে করতে খাওয়া শেষ করতে অনেক দেরি হয়ে গেলো। খেয়েদেয়ে বের হয়ে সেই মন্দিরটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। রুবাইদা সেখানে হালকা খাওয়াদাওয়া করে নিচ্ছে। ওর জন্য ওয়েট করলাম। এই ফাঁকে দেখলাম অনেক বয়স্ক মহিলা হাঁড়ি, লাকড়ি, কলা গাছ- এইসব জিনিস মাথায় চাপিয়ে দৌড়ে দৌড়ে মন্দিরের প্রাঙ্গনে ঢুকছে। অনেককে দেখলাম মন্দিরের উঠানে লাকড়িতে আগুন দিয়ে হাড়িটা চাপিয়ে কিছু একটা রান্না করতে। আর উচ্চস্বরে একটানা বেজেই যেতে লাগলো গান। তামিল ভাষার আরতি টাইপের গান হবে হয়তো। তবে গানের সংখ্যা খুব বেশি নয়- তিন থেকে চারটা। এগুলোই বাজতে লাগলো বারবার। তবে স্বীকার করতেই হবে গানগুলো যথেষ্ট উৎসব মুখর। অন্তরা তো শুনতে শুনতে মুখস্ত করেই ফেললো একটা দুইটা গান! ওদিকে খাওয়া শেষে রুবাইদা আবার এক লিটারের ট্রপিকানা গোয়াভা জুস কিনলো। আগের দিনের পমেগ্রান্ডের চাইতে গোয়াভাটা খেতে বেশ ভালো।

আমরা দুইজন সিদ্ধান্ত নিলাম আজকে শাড়ি দেখতে শহরে যাবো। আবার সেই ঢাল পার হয়ে দুইজনে সমতল রাস্তায় এসে পৌঁছালাম। লোকজনকে ইশারা ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে করে একটা বাস স্টপেজে এসে দাঁড়ালাম দুইজনে। এই স্টপেজে প্রথম বারের মতন একজন ‘টাউট’ লোকের সাথে পরিচয় হলো আমাদের। মাঝবয়সী একজন লোক আগ বাড়িয়ে আমাদের জজ্ঞেস করলো আমরা মুসলিম কিনা? আমাদের বেশভূষা দেখেই বোঝা যায় যে আমরা মুসলমান, এইটা জিজ্ঞেস করাটা বাহুল্য। তারপরও আমাদের জবাব শুনে উনি হাসিমুখে কি কি যেন সব বললেন, যার অর্থ হয়, ‘আমি ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম যে তোমরা মুসলমান’। তারপর আমাদের বাস আসতেই লোকটা আমাদের সাথে একই বাসে উঠে পড়লো। বাসের ভিতরে ঢুকে লোকটা তার পাশের সিটে বসার জন্য আমাদের ডাকতে লাগলো। বাস মোটামুটি খালিই ছিলো। আমরা লোকটার পাশে না বসে দূরে গিয়ে বসলাম। লোকটা ঠিকই সিট চেঞ্জ করে আমাদের পাশে এসে বসলো। উনি হাসিমুখে রুবাইদার সাথে আকার ইঙ্গিতে অনেক কথা বলতে লাগলো। আমরা একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। একটু পর টিকেট চেকার আসলো। উনি যেন কি বলে দিলো, টিকেট চেকার হাতে ধরে রাখা মেশিন থেকে ঘ্যাসঘ্যাস করে তিনটা প্রিন্টেড টিকেট বের হতে লাগলো। সেই লোকটা চট করে আমাদের তিনজনের টিকেটের দাম দিয়ে দিলো। আমরা হাতপা নেড়ে বোঝাতে লাগলাম যে আমরা এই লোকটার সাথে যাচ্ছি না। রুবাইদা প্রবলভাবে মাথা নেড়ে বলতে লাগলো যে আমরা দুইজন আলাদা- আমরা যাবো এম জি রোড, কিন্তু টিকেট চেকার ধরেই নিয়েছে যে আমরা তিনজন একসাথে যাচ্ছি। উনি লোকটার হাতে অন্য একটা স্টপেজের টিকেট ধরিয়ে দিলো, যে স্টপেজে লোকটা নেমে যাবে। কন্ডাক্টর চলে যাবার পর ওই লোকটা আমাদের দিকে ভালোমানুষের মতন হাসি দিয়ে বলতে লাগলো যে, ‘ কি যে মুর্খ এরা, কিছুই বোঝে না। তবে তোমাদের কোন সমস্যা হবে না। তোমাদের স্টপেজ আরও পরে’। তারপর লোকটা আমাদের দুইজনের কাছে থেকে ১৫ রুপি করে নিলো বাস ভাড়া বাবদ। আমাদের মনে হলো আসলে ভাড়া হয়তো ১০ রুপি, উনি ওনার ভাড়াটা আমাদের উপর দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু কিছু বলার নাই, টিকেট ওনার হাতে, আবার ভাষাও বুঝি না। আমরা একটু অসন্তুষ্ট হয়ে ওনাকে ১৫ রুপি করে দিয়ে দিলাম। লোকটা একটু পরেই নেমে গেলো, এমন কি নামার সময়ও আমাদের দিকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। লোকটা চলে গেলে আমরা একটু হাঁফ ছাড়লাম, যাক বেশি লস যায় নাই!

লোকটা নেমে যেতেই কন্ডাক্টর আমাদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সে তখন প্রথমবার বুঝতে পারলো যে আমরা তিনজন আসলে একসাথে যাচ্ছি না এবং আমরা হাত পা নেড়ে তাকে এই কথাই বুঝাতে চেয়েছিলাম। সে কাছে এসে ইশারায় আমাদের সরি বললো। তারপর আবার জানতে চাইলো যে আমরা কোথায় যাবো। এবার এম জি রোডের কথা বলতেই নতুন করে আমাদের ৭ রুপির টিকেট কেটে দিলো। ভুল করার জন্য লোকটা আবার আমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো। এতক্ষণ ভালোমত চার পাশ দেখতে পারি নাই। এবার খেয়াল করে দেখলাম বাসগুলো অনেক চওড়া, ফাঁকা ফাঁকা সিট, জানালাতে গ্রিল দেওয়া। বিশাল বাসটার আন্দাজে লোকজন অনেক কম। একেকটা স্টপেজে এসে বাস থামে, লোকজন চাপ দিয়ে লক করা দরজা খুলে উঠে পড়ে। সবার শেষে যে উঠে সে দরজা টান দিয়ে লক করে একটা ঘন্টা বাজিয়ে দেয়, ড্রাইভার বাস চালাতে শুরু করে। আবার কেউ নামতে চাইলে ঘন্টা বাজিয়ে দেয়, ড্রাইভার ব্রেক কষে বাস থামিয়ে দেয়। সে নেমে গিয়ে আবার টান দিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। বাসে চড়া এখানে খুব আরামের। এত ছিমছাম পাবলিক ট্রান্সপোর্ট- আমাদের দেশে তো কল্পনাই করা যায় না!

আমরা আগেই বলে রেখেছিলাম যে এম জি রোড আসলেই যেন আমাদের বলে দেওয়া হয়। এম জি রোড আসতেই কন্ডাক্টর আমাদের ইশারা করলো। আমরা বাস থেকে নেমে দরজা টান দিয়ে লাগিয়ে দিলাম। বাস হুশ করে চলে গেলো। আমরা চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম। ঠিক শহর বললে চোখের সামনে যা ভেসে আসে, এটা ঠিক তেমন লাগলো না। চারপাশে অনেক উঁচু উঁচু কাঁচ ঘেরা বিল্ডিং আছে বটে, কিন্তু রাস্তাঘাট অস্বাভাবিক ফাঁকা। লোকজন তেমন নাই বললেই চলে। এদিক ওদিক তাকিয়ে আমরা আন্দাজে হাঁটতে লাগলাম। একটা দোকানে দেখলাম কলা ভাজা বিক্রি হচ্ছে। এর আগে বইয়ে পড়েছিলাম বলে আমার আগ্রহ হলো চেখে দেখার। আমি ১০ রুপির কলা ভাজা কিনে নিলাম। খেতে মজা লাগলো না। কাঁচা কলা প্রসেসিং করে রোদে শুকিয়ে মশলা মাখিয়ে তেলে ভাজা হয়েছে। সেই দোকান ভর্তি শুকনা কলা আর কাঁঠালের স্লাইস। মনে হয় এইগুলো দিয়ে তরকারি রান্নাও হয়। রুবাইদা এর ওর সাথে অল্পবিস্তর কথা বলার চেষ্টা চরিত্র করে আবিষ্কার করলো যে এখানকার সবচেয়ে বড় শাড়ির দোকান ‘পোথি’। আমরা ডিরেকশন বুঝে হাঁটতে লাগলাম সোজা রাস্তা ধরে। হাঁটতে হাঁটতেই পেয়ে গেলাম জয়লক্ষী নামের দোকান যেটা ওদের ভাষায় ‘জায়লাক্সমি’। ঠিক দোকান না, অনেকটা আমাদের গুলশানের শপার্স ওয়ার্ল্ডের মতন। একটা জমিতে একটাই বিল্ডিং, পুরোটাই একটা দোকান। আমরা চারপাশ দেখে ঢুকে পড়লাম সেই দোকানে। আরিব্বাস, শাড়ির জগতে এসে পড়েছি যেন! একেকটা ফ্লোরে একেকটা টাইপের শাড়ি। আমরা ঢুকতেই একগাদা সেলস গার্ল এসে জিজ্ঞেস করতে লাগলো কোন ধরনের শাড়ি দেখত চাই- এইসব। কারনটা একটু পরে বুঝলাম। এত বড় দোকানে ওরা ডিরেকশন না বলে দিলে কেউ শাড়ি খুঁজে পাবেই না!

রুবাইদা কি কি সব বলাতে আমাদের পাঠিয়ে দিলো চার তলায়। আমরা লিফটে করে চার তলায় উঠলাম। সেখানে আমাদের খুব আদর যত্ন করে বসালো। টপাটপ অনেকগুলো শাড়ি বের করে দেখালো। শাড়িগুলো যেমন সুন্দর, তেমনই দাম। রুবাইদা কালো রঙের কথা বলতেই সেলস গার্লটা উঠে কই যেন চলে গেলো। আমরা বসে রইলাম। আমাদের পাশেই এক ফ্যামিলি কনের জন্য বিয়ের শাড়ি কিনতে এসেছে। কয়েকজন সেলস গার্ল টপাটপ করে কনেকে বিয়ের শাড়ি একটার পর একটা গায়ে জড়িয়ে পরিয়ে দেখাচ্ছিলো। খুব কম সময়ের মধ্যে ওরা ব্লাউজ পিসসহ জামার উপর দিয়ে এমন করে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে দেয় দেখে মনে হয় যেন সত্যি সত্যি ব্লাউজ সহ শাড়িটা পরানো হয়েছে। কয়েকটা পরার পর ফাইনালি একটা শাড়ি সিলেক্ট করতেই ওরা কোথা থেকে এক বিশাল কারুকাজ করা ছাতা বের করে আনলো। তারপর কনেকে সেই ছাতার নিচে দাঁড় করিয়ে প্রফেশনাল ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলানো হলো। আর আশেপাশের সব সেলস গার্লরা জোরে হাততালি দিয়ে উঠলো। আমি আর রুবাইদা হাঁ করে সব দেখতে লাগলাম। ততক্ষণে রুবাইদার সেলস গার্ল প্রায় বিশটার মতন কালো শাড়ি নিয়ে এসেছে। আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে শাড়িগুলো দেখলাম। কিন্তু এখনই হুট করে কিনে ফেলাটা মনে হয় ঠিক হবে না ভেবে উঠে চলে আসলাম। আমরা বাকি ফ্লোরগুলোও ঘুরে ঘুরে দেখলাম। প্রত্যেকটা টাইপের শাড়ির জন্য আলাদা আলাদা সেকশন। এবং প্রত্যেক সেকশনে দামের রেঞ্জ অনুযায়ী আলাদা আলাদা সাব সেকশন করা আছে। এত সুন্দর অ্যারেঞ্জমেন্ট যে একজন ক্রেতার আসলে কোন সমস্যাই হওয়ার কথা না। বাজেট অনুযায়ী শাড়ি পছন্দ করার জন্য এরচেয়ে নির্ঝঞ্ঝাট কোন পদ্ধতি হতেই পারে না!

পুরোটা দেখে আমরা বের হয়ে আসলাম। তারপর আবার হাঁটতে লাগলাম ‘পোথি’র উদ্দেশ্যে। হাঁটতে হাঁটতেই রুবাইদা কানের দুল কিনলো, আমি পার্স কিনলাম। তারপর অনেক দূর গিয়ে একসময় পেলাম ‘পোথি’। এটাও আগেরটারই মত। তবে আগেরটা ফাঁকা ফাঁকা ছিলো, আর এটাতে আছে উপচে পড়া ভিড়। অনেক লোকজনের সাথে যখন দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম দেখলাম, এটা আরেকটা শাড়ির জগৎ। আগের দোকানটার মত অত সাজানো গোছানো নয় এটা। যেখানেই একটু জায়গা আছে সেখানেই টাল করে রাখা আছে শাড়ির স্তুপ। আমরা ঢুকে শাড়ি দেখতে লাগলাম। একটা মজার জিনিস আবিষ্কার করলাম আমরা। এখানে একই শাড়ি অনেক গুলো কোয়ালিটির পাওয়া যায়। যেমন একই শাড়ি ৫০০০ রুপি থেকে শুরু করে ৯০০ রুপিতেও পাওয়া যাচ্ছে। এতে সুবিধা হলো, শাড়ি পছন্দ হলে দামের জন্য কেউ ফেরত যাবে না। প্রত্যেকের সাধ্যের মধ্যে শাড়িটার কোন না কোন কোয়ালিটি পাওয়াই যাবে। একটু এগিয়ে যেতেই আমরা দেখতে পেলাম নিশাত, রিন্তু, তমা আর পৃথ্বীকে। পৃথ্বীর হাতে চারটা শাড়ির প্যাকেট। নিশাত ভারি সুন্দর একটা শাড়ি কিনলো। রিন্তুর কেনা থান কাপড়টা আমার খুব পছন্দ হলো। কিন্তু আমি কিনতে গেলে জানতে পেলাম, সেই থানে আর জামা বানানোর জন্য যথেষ্ট কাপড় নাই। আমরা এদিক ওদিক ঘুরে দেখতে লাগলাম। রুবাইদা কয়েকটা শাড়ি পছন্দ করে ফেললো। এত হাজার হাজার শাড়ি দেখে আমাদের মাথা কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছিলো, তাই কোনটা কিনবে রুবাইদা ভাবতে ভাবতেই বের হয়ে আসলাম আমরা।

সকাল থেকেই হাঁটা হচ্ছে, দুপুরে কিছু খেয়ে নেওয়া প্রয়োজন। দেখলাম পোথির বাইরেই সারি ধরে খাবারের দোকান। অনেক মানুষজন খোলা আকাশের নিচে বসে খাচ্ছে, অনেকটা আমাদের সীমান্ত স্কয়ারের মতন। আমরাও সিদ্ধান্ত নিলাম এখান থেকেই খেয়ে নিবো। সবগুলো দোকান ঘুরলাম আমরা। খাবারের মেনু অদ্ভূত ভাষায় লিখা। দেখে আমাদের পেট ফেটে হাসি পাচ্ছিলো। উদ্ভট খাবার কিনে ধরা খেতে ইচ্ছা করছিলো না। তাই সেফ সাইডে থাকার জন্য আমরা অর্ডার দিলাম ৭৫ রুপির কেরালা মিল। একটা বিশাল থালায় সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো মাড়সহ মোটা চালের ভাত, দুইটা বড় বড় পাপড়, শুকনা মরিচ দেওয়া কচু আর নারিকেলের তরকারি, একটা টকটকে লাল রঙের ভাজি, টক নারিকেল আর টক দই। আমরা দুইজনে খেতে খেতে গল্প করছিলাম। খেতে খেতেই রুবাইদা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো যে ও কি কি শাড়ি কিনে ফেলবে। সেই লাল রঙের ভাজিটা ছাড়া বাকি সব খেতে ভালোই ছিলো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে গলাটা শুকিয়ে গেলো। সেখানেই একটা আমুল আইস্ক্রিমের দোকান ছিলো। সেখানে ‘শারজাহ’ নামের একটা ড্রিংকস দেখে আমার খুবই পছন্দ হলো। ৫০ রুপির এক গ্লাস শারজাহ অর্ডার দিয়ে দিলাম। রুবাইদা আমাকে বসিয়ে রেখে আবার পোথিসের ভিতর ঢুকলো শাড়ি কিনে আনতে। আমি বসে রইলাম। একটু পরেই শারজাহ চলে এলো। আহ- কি মজা। এক গ্লাস অত্যন্ত ঘন মিল্ক শেকের মতন একটা জিনিস, তাতে বাদাম, চকোলেট আর আইসক্রিম দেওয়া। আমার খুবই মজা লাগলো খেতে। আমার শারজাহ শেষ হওয়ার আগেই রুবাইদা চলে আসলো। ও এসে আরও একটা শারজাহ অর্ডার দিলো। আমরা দুইজনে বসে বসে শারজাহ খেতে লাগলাম।

কেরালা থালি
কেরালা মিল

এবার আমরা ধীরে সুস্থে ঘুরতে লাগলাম। ঢুকলাম ‘বিগ বাজার’ এ। বিগ বাজারে সব অফার ওয়ালা জিনিসপত্র থাকে। কমদামে ভালো জিনিসই পাওয়া যায়। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম সবকিছু। আমি ওয়াফির জন্য দুইটা বই কিনলাম। বিগ বাজার থেকে বের হয়ে কতগুলো খুব সুন্দর অ্যাংরি বার্ডের চাবির রিং পেলাম। আমি ২০ রুপি করে পাঁচটা কিনলাম। এরপর হাঁটা ধরলাম সোজা। আমার খুব শখ ছিলো সাউথে এসে সাউথের সিনেমা হলে সাউথের মুভি দেখবো। তাই একটা সিনেমা হলে গিয়েছিলাম কি মুভি চলে দেখতে। সেখানে দেখলাম সুপার স্টার ধানুশের একটা মুভি চলছে। সিনেমা হলের বাইরে ‘অল ইন্ডিয়া ধানুশ ফ্যান ক্লাব’, ‘ধানুশ ফ্যান ক্লাব অফ কেরালা’ এইসব নামের বড় বড় ব্যানার ঝুলছে। সিনেমা যে সাউথের মানুষের জীবনের একটা বিরাট অংশ, এগুলো দেখেই সেটা আন্দাজ করা যায়। আমরা যখন যাই তখন কোন কারণে হলটা বন্ধ ছিলো। আমাদের দেখে দারোয়ান তড়িঘড়ি করে বের করে দিয়ে গেট বন্ধ করে দিলো। কথা বলেও কোন লাভ নাই, কারণ ভাষা তো বুঝি না!

সিনেমা হলটা ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে আসতেই অনেক রেললাইনের জাংশন দেখতে পেলাম। তারপর একটু ভিতরের দিকে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে বড় একটা মন্দির পেয়ে গেলাম। মন্দির ঘিরে ব্যাপক সাজ সাজ রব। মনে পড়লো আজকে শিব রাত্রি। এমন উৎসবের দিনে একটু ঘুরে দেখাই যায় মন্দিরটা। সেই চিন্তা করে আমরা দুইজন হাঁটতে লাগলাম মন্দিরটার দিকে। কাছে গিয়ে জানতে পারলাম মন্দিরটার নাম শ্রী পদ্মনাভ স্বামী টেম্পল। মন্দিরের সামনের রাস্তায় বাঁশ ফেলে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা দুইজনে সাবধানে বাঁশটা পার হয়ে সামনের রাস্তায় গেলাম। অনেক মানুষ রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে। বেশির ভাগই সাদা পোশাক। ছেলেরা সাদা শার্টের সাথে সাদা লুঙ্গি আর মেয়েরা সাদা শাড়ি বা লাঙ্গা। রাস্তার দুপাশ ধরে চেঞ্জিং রুম। অনেককেই দেখছিলাম অন্য জামা কাপড় পরে এসে চেঞ্জিং রুমে জামা বদলে লুঙ্গি পরে নিতে। সবাইকে দেখে বেশ অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের মানুষজন বলেই মনে হলো। অনেক স্কুল কলেজ পড়ুয়া কম বয়সী স্মার্ট ছেলেদের দেখলাম ফ্যাশনেবল শার্ট আর টি শার্ট বদলে সাদা শার্ট আর লুঙ্গি পড়তে। মনে হলো এটাও বুঝি উৎসবের একটা অংশ, সবাই থাকবে সাদা পোশাকে।

এত সাদার মাঝে আমাদের দুইজনকে যে খুবই অদ্ভূত লাগছিলো, সেকথা আর না বললেও হয়। যাই হোক এসেছি যখন, মন্দিরটা দেখেই যাই। অনেক উঁচু সিঁড়ি পার হয়ে মন্দিরের দোরগোড়ায় দেখতে পেলাম মেটাল ডিক্টেটর হাতে নিয়ে পুলিশ আর্চ ওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সবাইকে তল্লাশি করেই ভিতরে ঢুকাচ্ছে। আমাদের দেশে অনেক মন্দিরেই গিয়েছি। ইন্ডিয়ার অন্যান্য মন্দিরও ঘুরেছি, কিন্তু কোথাও এমন সিকিউরিটি দেখি নাই। আমি আর রুবাইদা আড়চোখে একজন অন্য জনের দিকে তাকালাম। আমি ঢোক গিলে পুলিশকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলাম আমরা ভিতরে যেতে পারবো কিনা। পুলিশটা এক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো খানিক্ষণ। পাশের আরেকজন জিজ্ঞেস করলো, ‘ হিন্দু হোঁ?’। আমরা মাথা নেড়ে জবাব দিলাম ‘না’। ওনারা হাবেভাবে বুঝিয়ে দিলো ভেতরে যাওয়া যাবে না। এরমধ্যে প্রথমজন গিয়ে তার বসকে ডেকে এনেছে। লোকটা জিজ্ঞেস করলেন যে আমরা কোন ধর্মের লোক, কোথা থেকে এসেছি, কোথায় থাকি এইসব এইসব। তারপর ভদ্রভাবে বললেন যে ভিতরে ঢোকা সম্ভব নয়। আমরাও আর কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পড়লাম। তারপর হাঁটতে লাগলাম রাস্তার দিকে। মন্দিরের সামনের রাস্তা থেকেই আমি আর রুবাইদা পার্স আর ব্যাগ কিনলাম।

আরও খানিক্ষণ হাঁটাহাঁটি করার পর একটা মার্কেট দেখে মনে হলো একটু ঢুকে দেখি ভিতরে। কেমন যেন অন্ধকার, লোকজন নাই- ভুতুড়ে পরিবেশ। আমরা আবার তাড়াতাড়ি বের হয়ে পড়ি সেখান থেকে। তারপর বড় রাস্তাটা পার হয়ে যাই আরেকটা শাড়ির দোকানে। সেটার নাম ‘কল্যান’। এই দোকানটা বাকি দুইটার চেয়ে তুলনামূলক ছোট। চারতলা বিল্ডিং জুড়ে পুরোটাই শাড়ির দোকান। এখানেও রুবাইদার শাড়ি পছন্দ হলো। কালেকশন একটু কম থাকায় রুবাইদার বরঞ্চ সুবিধাই হলো পছন্দ করতে। সেলস গার্লরা আমাদের পিছন পিছন ঘুরতে লাগলো জোঁকের মতন। সব দেখেটেখে রুবাইদা আরও তিনটা শাড়ি কিনে ফেললো। আমরা দোকানে থাকতে থাকতেই তমা আর সৃষ্টিকে দেখলাম দোকানে ঢুকতে। দেশের বাইরে এসে যেখানেই দ্বিমিকবাসীর সাথে দেখা হয় সেখানেই আমরা বেশ কোলাকুলি করে ফেলি, তখন অন্যরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ওদের সাথে হাই হ্যালো করেই আমরা নেমে গেলাম নিচে। বিলটিল দিয়ে যখন আমরা বের হই, তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে।

কল্যানের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম যে কোভালাম যাওয়ার বাস কোথায় থামে। সামনেই বাস স্টপেজ দেখিয়ে উনি আমাদের অপেক্ষা করতে বললো। একটু এগিয়ে স্টপেজে গিয়ে দাঁড়াতেই দশ পনের মিনিটের মধ্যেই একটা বাস চলে আসলো। আমরা তাতে উঠে পড়লাম। ঠিক আগের মত আরামদায়ক, চওড়া আর প্রায় ফাঁকা বাস। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে শোঁ শোঁ করে আমাদের বাস চলতে লাগলো। কন্ডাক্টর আসতেই ১৬ রুপির টিকেট কাটলাম কোভালামের। তবে এই কন্ডাকটরও ভাষা বোঝে না। তাই কোভালাম আসলে যে আমাদের ডেকে দিতে হবে সেই কথাটা ওনাকে বোঝাতে পারছিলাম না। তারপর দেখলাম দুইটা সাদা চামড়ার টুরিস্ট মহিলা আমাদের বাসে বসে আছে। আমরা ভাবলাম এরা নিশ্চয়ই কোভালামই যাচ্ছে। আমরা তক্কে তক্কে রইলাম। ঠিকই একটা স্টপেজ কাছাকাছি আসতেই ঐ দুইজন উঠে দাঁড়ালো। আমরাও জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে লাগলাম যে কোথায় এসেছি। তিনদিন ধরে কোভালামে আছি। তাই স্টপেজটা চিনতে আর ভুল হলো না। বাস থামতেই আমরা নেমে পড়লাম। দুইজনের দুই হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ। এই নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে ঢালের দিকে যেতে লাগলাম আমরা।

আজকে সকালেই তানভীর আর জেরিনকে বলতে শুনেছিলাম ফার্স্ট ক্লাস হালাল মাংস পাওয়া যায় একটা হোটেলে। ঢাল ধরে হেঁটে হেঁটে আসার সময় চোখে পড়ে গেলো ওদের বর্ণনা অনুযায়ী সেই হোটেলটা। আমরা ঠিক করলাম একবারে খেয়ে দেয়েই হোটেলে যাই। হোটেলটার নাম ‘ইশা রেস্টুরেন্ট’। টিনের চাল দেওয়া খুব সাধারণ একটা দোকান। আমরা যখন ঢুকলাম সেখানে, আমরা ছাড়া আর কোন কাস্টোমারই ছিলো না। আমাদের যত্ন করে বসালো। ওরা আমাদের ভাষা চমৎকার বুঝলো। জানালো মুরগি, গরু সবই আছে। আমরা অর্ডার দিলাম ১০ রুপির রুটি আর ৩০ রুপির গরুর মাংস। মাংস রান্নাটা এত মজা যে আর কি বলবো! খুব তৃপ্তি করে আমরা খেতে লাগলাম। সাথে নিলাম ৮ রুপির ইড়িউপ্পাম নামের আরেকটা জিনিস। এটাও ইডলি জাতীয় ভাপা পিঠার মতন কেমন যেন চালের গুড়ির নুডুলস দিয়ে বানানো মনে হলো। খুব মজা লাগছিলো আমাদের খেতে। খেতে খেতেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম যে এখন থেকে প্রতি বেলাই এখানে খাবো। এমন সময় এক হাসিখুশি বিদেশি টুরিস্টের আগমন হলো। লোকটা পুরোদস্তুর ইন্ডিয়ান সাধু বাবা টাইপের গেট আপ নিয়েছে।  রেস্টুরেন্টের লোকজন তার গেট আপের অনেক প্রশংসা করলো। লোকটাও খুশি মনে খাওয়া অর্ডার দিয়ে খেতে শুরু করলো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা বিল দিয়ে বের হয়ে গেলাম সেখান থেকে।

বের হতেই রুবাইদা আমাকে জানালো যে ঐ বিদেশি লোকটা পর্ক বা শুকরের মাংস অর্ডার দিয়েছে। শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম- কই, আমাদের তো মেনু বলার সময় একবারও বলে নাই যে পর্ক পাওয়া যায়। মুসলমান দেখেই হয় তো চেপে গিয়েছিলো বিষয়টা। রুবাইদা সাজেশন দিলো এইখানে আর না আসার, কারণ হয় তো পাশাপাশি হাড়িতে একই খুন্তি দিয়ে রান্না হয় মুরগি, গরু আর শুকর। বলা তো যায় না! আমার আফসোস লাগলো, ইশ- কি মজাটাই না ছিলো খাওয়াটা……

হেঁটে হেঁটে যতই হোটেলের কাছে যেতে লাগলাম, কানে বাজতে লাগলো সকালের সেই গান। সকাল থেকে শুরু করে সারাদিন চলছে একই গান। একটা গানের কথা অনেকটা এইরকম, ‘-নামাশ্যিবায়ে, নামাশ্যিবায়ে/ওম নামাশ্যিবায়ে-’। এর মধ্যে আমরা হোটেল পৌঁছে গেলাম। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই আমরা আমাদের শপিংয়ের জিনিসপত্র সব বের করে দেখতে লাগলাম। এত এত জিনিস আমাদের লাগেজে ভরে রাখাটাও বেশ কষ্টসাধ্য কাজ ছিলো। আমরা বেশ ক্লান্ত ছিলাম। সারাদিন কম তো ঘোরাঘুরি হয় নাই! গোছগাছ করতে করতেই মজুমদার আর মৌলি এসে পড়লো। সারা দিনের কথা শুনে মজুমদার বললো জানালো পদ্মনাভ মন্দিরটা খুবই উচ্চ গোত্রের হিন্দুদের জন্য। বিধর্মী তো দূরের কথা, সব হিন্দুরাই সেখানে ঢুকতে পারে না। সেখানে আমাদের দুইজনের ভিতরে ঢুকতে যাওয়াটা বেশ সাহসিকতার কাজ হয়ে গেছে। যাক বাবা, এজন্য যে কোন ঝামেলায় পড়তে হয় নাই সেজন্যই আমরা খুশি হলাম। এর মধ্যে আমি ভাবলাম হোটেলের সামনের মন্দিরটাতেই এত লাইটিং করা হয়েছে, এটাই একবার দেখে আসি। আমি বের হলাম মন্দিরটা ঘুরে আসার জন্য। ভাবলাম হয় তো আমাদের দেশের মন্দিরগুলোর মত বেদির উপর বড় কোন মূর্তি থাকবে, কিন্তু ভিড়ের মধ্যে কোন মূর্তি দেখতে পাচ্ছিলাম না। কাঁচ ঘেরা একটা জায়গায় অনেক ভিড় ছিলো তবে সেটার ধারে কাছেই যেতে পারলাম না। বলতে গেলে প্রায় কিছুই না দেখে আবার হোটেলে ফিরে গেলাম।

যখন ঘুমাতে বিছানায় যাচ্ছিলাম, তখনও কানের কাছে বাজছিলো মন্দিরের সেই গান। রাত হয়ে যাওয়ায় চারপাশ আরও চুপচাপ হয়ে গেছে। গানে শব্দটা আরও জোরে কানে এসে লাগছে। কিন্তু কিছু করার নাই। কানে বালিশ চেপে শুয়ে পড়লাম। তবে ঘুমটা ঠিকমত আসলো না। কিন্তু কিছু করার নাই, উৎসবমুখর গানগুলোর মধ্যেই ঘুমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম আমি।