The Mighty INDIA CALLING: ‘ব্যাক ওয়াটার’ অভিযান (পর্ব ৩২)

চমৎকার একটা ঘুম দেওয়ার পর সকালে ফুরফুরে মেজাজে ঘুম ভাঙ্গলো হাজারও পাখির কিচির মিচির ডাকে। আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লাম। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আমরা বের হয়ে পড়লাম নাশতা খাওয়ার উদ্দেশ্যে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে গত রাতের সেই রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। দেখি আমাদের লোকজন আরও অনেকজন আছে। আমরা ওদের সাথে একটা টেবিল শেয়ার করে বসে পড়লাম। মেনু দেখে অর্ডার দিলাম চাপাতি আর ডাল ফ্রাই। অর্ডার দিয়ে অনেক্ষণ বসে রইলাম। আমরা হাহা হিহি করে হাসাহাসি করে দারুন গল্প জুড়ে দিলাম। গত রাতে ভালো করে দেখতে পারি নাই, দিনের আলোতে তাই চারপাশটা ভালো করে দেখলাম। আমরা যেখানে বসে আছি সেখানে ছনের চাল দেওয়া। পাশেই একটা টলটলে নীল পানির সুইমিং পুল। এখানকার হোটেলে বেশ কয়েকজন ভিনদেশি অতিথি আছে। তারাও সকালে খাওয়ার জন্য ফুল ফ্যামিলি সুদ্ধু খেতে নেমে এসেছে। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলো ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে- আমরা খুব মজা পেলাম এইসব দেখতে দেখতে।

নাশতা খেয়ে বের হয়ে আসি আমরা। আমার খুব আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা করছিলো। মোড়ের দোকানটায় গিয়ে কিনে নিলাম ‘আমুল আইসক্রিম’। ৩৫ রুপি আন্দাজে অনেক মজার আইসক্রিম। আইসক্রিম খেতে খেতেই হোটেলে ফিরে গেলাম। কিছুটা রেডি হয়ে নিলাম, তবে কোথায় যাবো এখনও কিন্তু জানি না। এরপর শুনলাম আমাদের আরেকটা যেই হোটেল আছে ‘রাজি হোমস’ সেটাতে কমিটি একটা মিটিং কল করেছে। আমরা সেখানে ছুটে গেলাম। আমরা সবাই দোতলার বারান্দায় লাইন ধরে বসলাম। আদিবা সবাইকে বললো, দুইটা অপশন আছে- আলাপুজা আর পুভার। আলাপুজায় যাওয়া বেশ সময় সাপেক্ষ সেক্ষেত্রে পুভারে যাওয়াটা ভালো অপশন। কমিটি গিয়ে কথা বার্তা বলে এসেছে, এখানে থেকে রিজার্ভ বাসে করে গিয়ে সব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আবার এখানে ফিরে আসতে মোটমাট প্রত্যেকের ৪৫০ রুপি করে খরচ পড়বে। আমরা সবাই এই প্রস্তাবে রাজি হই। ঠিক হয় বাস ঠিক দুইটার সময় এসে হাজির হবে। আমরা যেখানেই যাই যেন সময়মত এসে বাস ধরতে পারি।

এই হোটেল থেকে বের হয়ে রুবাইদা ট্রপিকানার পমেগ্র্যান্ডে ফ্লেভারের জুস কিনলো। বড় সেই জুসের প্যাকেট হাতে নিয়ে আমরা কোথায় যাবো, কোথায় যাবো চিন্তা করতে লাগলাম। হাতে যেহেতু সময় বেশি নাই, তাই দূরে কোথাও না গিয়ে বিচে ঘোরাঘুরি করে আসার কথাতেই সবাই সায় দিলো। রুবাইদা হোটেলে চলে গেলো। আমি, অন্তরা আর মিম ঘুরতে গেলাম বিচের দিকে। রাতের বেলায় যেমন জমজমাট দেখেছিলাম বিচের পাশের দোকানপাট আর হোটেলগুলো, দিনের বেলা সেরকম নয়। প্রায় সবই ফাঁকা, লোকজন কম। আমরা প্রথমে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম লাইট হাউজের দিকে। ভাঙ্গাচোরা একটা পুরানো লাইট হাউজ সমুদ্রের পাড়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। লাইট হাউজের ছায়ায় বসে আমরা অনেক্ষন গল্পগুজব করলাম। নিরিবিলি চুপচাপ এই বিচে সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে পাথরের উপর হাত পা ছড়িয়ে অলস বসে থাকতে আমাদের ভালোই লাগছিলো। অনেক্ষণ পর আমরা উঠে পড়লাম। হাঁটতে লাগলাম দোকানগুলোর দিকে। একেকটা দোকানে ঢুকে আমাদের মাথা ঘুরে গেলো। একদম কাশ্মিরের শাল সোয়েটার থেকে শুরু করে মুক্তার সেট, রত্ন পাথর কি নাই এখানে! যা দেখি সেটাই পছন্দ হয়, কিন্তু দাম আকাশ্চুম্বী। আমরা তাই কোনকিছু কেনার কথা চিন্তা করছিলাম না। ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম একেক দোকান। এর মধ্যে সুমাইয়াকে দেখলাম নারিকেল দিয়ে বানানো একটা বানর কিনতে। বানরটা খুবই সুন্দর। শয়তানি ভরা কালো কালো চোখ দুইটা দিয়ে তাকিয়ে থাকে।

দেফ
বাটির মতন উল্টানো বৃত্তাকার ঢালু বিচ  (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

আমরা তাড়াতাড়ি করে বিচ থেকে বের হয়ে আবার সেই আগের রেস্টুরেন্টে গেলাম। এবার শেয়ারে অর্ডার দিলাম ভাত, চিংড়ি মাসালা আর এগ নুডুলস। আমার খরচ পড়লো ১৮৫ রুপি। খুব মজা করে খেলাম আমরা। তাড়াতাড়ি করে খেয়ে আমরা দৌড় দিলাম হোটেলের দিকে। হোটেলে গিয়ে রুবাইদাকে নিয়ে আমরা দুইজনে একবারে বের হয়ে পড়লাম ২.৩০ টার দিকে। বাস এসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ঢালের অন্য প্রান্তে। পুরো ঢালটা আমাদের পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হবে, তাও এই গরমের মধ্যে! ওকে, দিলাম না হয় পাড়ি- কি আছে জীবনে? এই বিশাল ঢাল বেয়ে উপরের দিকে উঠতে উঠতে আমাদের সব শক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছিলো। ভাগ্য ভালো ঢালটা খুব বেশি খাড়া নয়। তবে খুব বেশি খাড়া না হলেও অনেক বিশাল পথ পাড়ি দিতে আমাদের কষ্ট হচ্ছিলো কারণ মাথার উপর গনগনে সূর্য। গরমের কারনেই আমাদের দম বের হয়ে যাচ্ছিলো। অবশেষে আমরা ঢাল পাড়ি দিয়ে শেষ মাথায় এসে দেখি এক বিশাল বাস দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে ভিতর থেকে একজন কমবয়সী ছেলে বের হয়ে আসলো। আকারে ইঙ্গিতে বুঝলাম এটাই আমাদের বাস। আমরা ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম আর কেউই আসে নাই, খালি আমরা দুইজন।

আমি বাসের ভিতর উঠে দেখলাম চমৎকার বাস। দামি বাস বলতে যা বোঝায় আর কি- সেরকম বাস। মজার ব্যাপার হচ্ছে বাসের এক পাশে দুই সিটের রো আর অন্য পাশে তিন সিটের রো। আমি তাড়াতাড়ি করে দুই সিটের রোতে এক জায়গায় ব্যাগ রেখে সিট দখল করলাম। রুবাইদা গরমে টিকতে না পেরে নেমে গেলো। আমি বাসেই বসে রইলাম। আস্তে আস্তে সবাই আসতে লাগলো। সবাই উঠে পড়লে বাসে এসি ছেড়ে দিলো। আমরা খুশিতে চিৎকার করে উঠলাম। গোয়েলে চড়তে চড়তে বাসে যে এসি থাকতে পারে সেই বিষয়টাই ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের নিয়ে বাস চলতে শুরু করলো। আর সেই সাথে হাই ভলিউমে বাজতে লাগলো ধুমধাড়াক্কা সব গান। এরমাঝে আমাদের জানিয়ে দেওয়া হয় ফাইনালি ৪০০ রুপি করে দিতে হবে পার হেড। শুনে আমরা আরেক দফা খুশি হয়ে গেলাম।

খুব বেশিক্ষন লাগলো না। আমরা পৌঁছে গেলাম পুভার। পুভারে আমরা যেই জায়গাটায় থামলাম তার নাম ব্যাক ওয়াটার। গাছপালা দিয়ে ঘেরা একটা জায়গার মাঝখানে একটা জলাশয় আছে। সেটাতে আমরা নৌকায় চড়ে পাড়ি দিবো। আমাদের জন্য তিন তিনটা নৌকা আসলো। নৌকাগুলো দেখতে কাশ্মিরি শিকারা নৌকার মতন লাগলো। আমরা টপাটপ করে উঠে বসলাম নৌকাগুলোতে। একটা নৌকায় আমি, শুভ, রিজভী, তুষার, রুবাইদা, রিন্তু, নিশাত, পৃথ্বী আর বাসিরুন চড়ে বসলাম। আমাদের প্রত্যেককে লাইফ জ্যাকেট পড়তে হলো। তারপর ভটভট করে ইঞ্জিন স্টার্ট হলো। চলতে শুরু করলো আমাদের তিন নৌকা। প্রচুর নারিকেল গাছসহ দুইপাশে নানা রকম গাছগাছালির ছায়ায় ঢাকা টলটলে সবুজ পানির উপর দিয়ে আমরা চলতে লাগলাম। পাখির কিচিরমিচির আর পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাড়া আর তেমন কোন শব্দ নাই। সব কিছু মিলিয়ে খুবই চমৎকার পরিবেশ, কিন্তু আমরা কেমন যেন ছটফট করতে লাগলাম- এইই দেখতে এসেছি শুধু? এই জঙ্গল, পানি, পাখির ডাক তো দেশে সবখানেই পাওয়া যায়, এটা তো তেমন আহামরি কিছু না। আর যদি বিচার করতেই হয় তাহলে স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের রাতারগুলের ধারে কাছে এটা নাই। আমরা একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলাম এই জঙ্গলের শেষ দেখার জন্য। এর মধ্যেই এক নৌকা থেকে অন্য নৌকায় আমরা একে অন্যকে চিৎকার করে ডাকাডাকি করতে লাগলাম, হাত ডুবিয়ে একে অন্যকে পানি ছিটিয়ে দিতে লাগলাম। এই করতে করতেই আমাদের নৌকা একটা বিচে এসে থামলো।

ঘোলা পানির উপর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আমাদের নৌকাগুলো যাচ্ছিলো
ঘোলা পানির উপর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আমাদের নৌকাগুলো যাচ্ছিলো

আমাদের আগেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিলো যে বিচটা খুবই বিপজ্জনক, আমরা যেন কেউই পানিতে না নামি। গিয়ে দেখলাম সত্যি তাইই। একেবারে ঢালু একটা বিচ সোজা নেমে গেছে নিচের দিকে। আর প্রচন্ড শক্তিতে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগলো বালির উপর। একবার পা হড়কালে আর উঠে আসার সম্ভাবনা নাই। আমরা কক্সবাজার দেখে অভ্যস্ত। কক্সবাজারের মত এত সুন্দর নিরাপদ বিচ দেখতে দেখতে বিপজ্জনক বিচ কেমন হতে পারে তা নিয়ে আমার আইডিয়া ছিলো না। তাই এরকম একটা বিচ দেখে সত্যিই আমরা সবাই সাবধানে দাঁড়ালাম। পানিতে নামার কথা কেউ ভুলেও চিন্তা করছিলাম না।

ওয়েক
ঢালু হয়ে যাওয়া বিচে নীল সমুদ্রের পাশে ‘কালা’ হয়ে যাওয়া কতিপয় দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় সাবরিনা মেহজাবিন রাত্র)

খানিক দূর এগিয়ে সবাই ডাব কিনে খেলাম। দাম নেহায়েত কম ন্য। ২৫ রুপি করে রাখলো একেকটা। অল্পবিস্তর হাঁটাহাটি করে ছবিটবি তুলেই আমরা রওয়ানা দিয়ে দিলাম। আবার উঠে বসলাম সেই নৌকাটাতে। নৌকাতে যেতে যেতেই অন্য এক নৌকার দিকে আমাদের চোখ আটকে গেলো। সেই নৌকাটা বাইছে একজন সাদা চামড়ার পর্যটক। সাথে ওনার স্ত্রী বসে ছিলো। মহিলাটা বসা ছিলো হুইল চেয়ারে। লোকটা এবং মহিলাটা দুজনেই আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো। আমরাও পালটা হাত নাড়লাম। কত কষ্ট করে হলেও মানুষ আসে দূর দূরান্ত ঘুরতে। আর তাদের দুইজনে হাসিখুশি চেহারা দেখে মনে হলো, জীবনে সুখী হওয়ার জন্য আসলে মনটাই বড় ব্যাপার, অন্য কিছু নয়।

আচ
সেই পর্যটক আর হুইল চেয়ারে বসা ওনার স্ত্রী (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

জঙ্গল পার হয়ে আমরা এসে পড়লাম তীরে। সেখানেই হঠাৎ করে এক লোককে দেখে মনে হলো সৌরভের তামিল ভার্সন। আমরা এই নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাসাহাসি করলাম। এরপর দেখলাম অনেকেই উশখুশ করছে শহরে গিয়ে ‘রয়’ মুভিটা দেখে আসার জন্য। কিন্তু শহর কেমন করে যাওয়া হবে, মুভি দেখে কেমন করে সেখান থেকে ফেরত আসা হবে- এই নিয়ে নানা রকম চিন্তা ভাবনা হচ্ছিলো। আমরা সবাই উঠে বসলাম আমাদের বাসে। ধুমধাড়াক্কা গান ছেড়ে আমাদের বাস চলতে শুরু করলো। আমি জানালা দিয়ে দেখতে লাগলাম দুপাশের দৃশ্য। সাউথের ঘরবাড়িগুলো অনেক বেশি কারুকাজ করা আর রংচঙ্গে- ঠিক যেমনটা সিনেমায় দেখা যায়। মন্দিরগুলোতে অনেক অনেক মুর্তি। আবার মন্দির ছাড়াও অনেক চার্চ দেখলাম। আর যে দিকেই চোখ যায় শুধু নারিকেল গাছ আর নারিকেল গাছ। মনে হয় যেন পথেঘাটে ফ্রি নারিকেল পাওয়া যাবে। মাঝে অনেকেই শহরে নেমে গেলো। বাকিদের নিয়ে বাস আবার চলতে শুরু করলো।

বাস আমাদের নামিয়ে দিলো সেই ঢালের মাথায়। ততক্ষনে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাস থেকে নেমে আমি আর রুবাইদা এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করবো বলে ঠিক করলাম। কাছেই একটা শাড়ির দোকান পেয়ে ঢুকে গেলাম আমরা। ছোট দোকান হলেও ওনারা যত্ন নিয়ে শাড়ি দেখালো। দেখলাম যেটাকে আমরা শাড়ি ভেবে ভুল করেছি, সেটা আসলে শাড়ি নয়, সেটার নাম লাঙ্গা। বাচ্চা মেয়েদের জন্য লাঙ্গাগুলো দেখলাম- খুবই সুন্দর। আমরা অনেক্ষন দেখে টেখে বের হয়ে আসলাম। এরপর গেলাম একটা অত্যন্ত দামি দোকানে। দেখে মনে হলো আমাদের আড়ংয়ের মতন। অনেক সুন্দর সুন্দর সব জিনিসের অনেক দাম। আমরা চুপচাপ পুরোটা দেখে বের হয়ে আসলাম। কোথাও শান্তিমত শাড়ি দেখতে পাচ্ছি না। ঠিক করলাম পরেরদিন শহরে যাবো শাড়ির দোকান খুঁজতে। আমরা ঢালের দিকে ফেরত গেলাম। দেখলাম পুরো ঢালের বিশাল এলাকা জুড়েই লাইটিং হচ্ছে আর মাইক লাগানো হচ্ছে। আগামীকাল শিবরাত্রি- তারই জন্য এত আয়োজন। আর বিচের আগে আমাদের হোটেলের সামনেই একটা শিব মন্দির আছে। সেখান থেকেই এসব করা হচ্ছে।

আমরা হোটেলে ফিরে গেলাম। কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে গোসল সেরে আবার বের হয়ে পড়লাম বিচের উদ্দেশ্যে। রাতের বেলায় প্রাণ জুড়ানো ঠান্ডা বাতাসে বসে আমি আর রুবাইদা অনেক্ষন গল্প করলাম। কখনও বসে, কখনও দাঁড়িয়ে, কখনও হেঁটে। বিচের ঝলমলে রেস্টুরেন্ট আর সুভেনিয়র শপে আলোতেও আমরা ঘুরতে লাগলাম এ মাথা থেকে ও মাথায়। অন্ধকার সমুদ্রের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিলো- কি চমৎকারই না এই জীবন!

রাত বেশ গড়িয়ে গেলে আমি আর রুবাইদা উঠে পড়ি। চলে যাই সেই রেস্টুরেন্টে। পেটে তেমন খিদে ছিলো না। তাই অর্ডার দেই এগ নুডুলস। ১০০ রুপির এগ নুডুলসটা ভালোই ছিলো। নুডুলস শেষ করে একটা আইসক্রিমও খেলাম আমি। খেয়ে দেয়ে হোটেলে ফেরত গেলাম আমরা দুইজনে। অল্পক্ষনের মধ্যেই বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে দিলাম ঘুম।

 

 

The Mighty INDIA CALLING: ত্রিভান্দাম দিয়ে ‘দক্ষিণ’ এর যাত্রা শুরু (পর্ব ৩১)

গভীর ঘুমটা ভাংলো উর্মির ডাকে। আমি সবসমই দেরি করে ঘুম থেকে উঠি। ওরা উঠে গেছে অনেক আগেই। আমি না উঠলে উর্মি আর নিলয় ঠিকমত বসতে পারছে না। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে ডেকে দিলো উর্মি। চোখমুখ ডলে আড়মোড়া ভেঙ্গে আমি উঠে পড়লাম। জম্পেশ একটা ঘুম দিয়ে শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগতে লাগলো। আমি উঠে বসতেই উর্মির বাংকারটা ভাঁজ করে দিলো নিলয়। আমরা তিনজনে আরাম করে আমার সিটে বসলাম।

নিলয় জানালো গতরাতে ট্রেনের দুলুনিতে আমাদের সবার লাগেজ গড়িয়ে গড়িয়ে ট্রেনের করিডরে ছুটে চলে গিয়েছিলো। নিলয় টের পেয়ে উপরের বাংকার থেকে নেমে আসে। আমাদেরকে মরার মত ঘুমাতে দেখে ও একাই সবার লাগেজ টেনে   টেনে আবার জায়গা মত নিয়ে আসে। আমরা একজন অন্যজনের দিকে তাকালাম, এত কিছু হয়ে গেলো আর কিছুই টের পেলাম না?

সকালের নাস্তা কিনে নিলাম ডিম ভাজা আর পাউরুটির একটা বাক্স। ট্রেন একটা স্টেশনে থামতেই চিং ট্রেনের জানালা দিয়ে স্টেশনের এক ফেরিওয়ালার কাছ থেকে একটা প্যাকেট কিনলো। ট্রেন ছেড়ে দিতেই আমরা প্যাকেট খুলে দেখলাম ভিতরে পরোটা আর ভাজি। একদম গরম গরম পরোটা, আর ভাজিটাও খুব মজার। মনে হলো ট্রেনের নাশতা না কিনলেই ভালো হতো! কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা স্টেশনে ট্রেন থামতেই চিঙয়ের উপরের বাংকারে থাকা ভদ্রলোকটা আমাদের কাছ থেকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন। আমরাও হাসিমুখে ওনাকে বিদায় জানালাম। উনি চলে যাওয়ার পর আমরা ভালো করে চারপাশটা দেখলাম। মনে হলো আগের ট্রেন জার্নির মতই এবারও আমাদের খোপে সব মিলিয়ে আটটা সিটেই আমরা চারজন ছাড়া আর কেউ নাই। আমরা একেকজন একেক সিটে গিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বসলাম।

যখন বেলা বাড়লো, তখন ট্রেনের মাঝে সিল করে রাখা দরজাটা খুলে দিলো। ওই পাশ থেকে লোকজন এসে আমাদের সাথে দেখা সাক্ষাত করতে লাগলো। সবাই এসে বললো ‘তোদের খোপে তো বেশ আলো বাতাস আছে!’। একটু পর আমরাও ঘুরতে গেলাম ওদের খোপে। আসলেই ওদের বগিটা বেশ গরম আর তুলনামূলক অন্ধকার, কারণটা কি বুঝলাম না। ওরা সবাই মিলে খুব মজা করছে। আমাকে দেখে সবাই বললো এক পাঞ্জাবী আংকেল নাকি রাত্রির সাথে খুব খাতির জমিয়ে ফেলেছিল। ওরা দুজনে মিলে দারুন সব কথা বার্তা বলে সবাইকে হাসাতে হাসাতে অস্থির করে ফেলেছিলো। আমি খানিক্ষন রুবাইদার পাশে বসে গল্পগুজব করলাম। তারপর ফেরত এলাম আমাদের বগিতে। ওরা অনেকেই আমাদের বগিতে এসেছে গল্পগুজব করতে। আমাদের খোপের ইলেক্ট্রিক সকেটটা ঠিকমত কাজ করছিলো বলে ওরা অনেকেই এসে লাইন ধরে মোবাইল চার্জ দিতে লাগলো।

গল্পগুজব করতে করতে আমাদের দারুন সময় কাটছিলো। এর মধ্যে পেলাম দুঃসংবাদটা। নোভার ব্যাগটা চুরি হয়েছে। অনেক খোঁজাখুজির পর বাথরুমে ব্যাগটা পাওয়া গেলো কিন্তু ভিতরে বেশ কিছু রুপি ছাড়াও ওর দামি মোবাইল, পাওয়ার ব্যাংক ও ঘড়িটা মিসিং। চোর সস্তা মনে করে ওর দামি সানগ্লাসটা রেখে গিয়েছে- এটাই একমাত্র সান্ত্বনা। নোভা আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাপ্লিকেশন লিখে ট্রেনের পুলিশের কাছে জমা দিয়ে আসে। যদিও কোন লাভ হবে না, তারপরও…

এই ট্রেনে সাউথের লোকজনই বেশি। তাদের দেখতে বেশ মজা লাগে। মহিলারা খুব সুন্দর করে টাইট ফিট শাড়ি পরে। সাদা লুঙ্গি পরা লোকজনও দেখলাম। সবচেয়ে মজার হচ্ছে ওদের ভাষা। কি যে অদ্ভূত লাগে শুনতে! ফেরিওয়ালারাও কেমন করে যেন কথা বলে। একটু পর পর এক ফেরিওয়ালাকে দেখলাম ‘-বাডা-বাডা-বাডা-’ বলে কি সব জিনিস বিক্রি করতে। আমি আগ্রহ নিয়ে তাকালাম কি এই জিনিস ‘বাডা’ তাই দেখতে। দেখে মনে হলো পিয়াজুর বড় ভার্সন। আমার মনে হলো কথাটা আসলে ‘বড়া’, সেটাকেই ওদের ভাষায় বলা হচ্ছে ‘বাডা’। চারপাশের সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে আমাদের সময় চটপট কেটে যেতে লাগলো। এরমধ্যে আমি আর উর্মি খেয়ে নিলাম ৭০ রুপির ডিম বিরিয়ানি। দুপুর হয়ে আসতেই একজন অন্যজনকে সতর্ক করে দিতে লাগলো আমাদের স্টপেজ নাকি কাছাকাছি চলে এসেছে। আমরাও গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আমাদের আধা দিনের সংসার গোছাতে শুরু করলাম।

ট্রেন একটু পরপরই একেকটা স্টেশনে থামে আর আমরা উশখুশ করি, এটাই কি আমাদের স্টপেজ কিনা জানার জন্য। আমাদের স্টপেজের নাম কোচভেলি। পরপর অনেকগুলো স্টেশন পার হয়ে গেলো, কিন্তু কোনটাই আমাদের স্টেশন নয়। আমরা আবার টেনশনে পড়ে গেলাম- ভুল করলাম না তো। ঐপাশের বগি থেকে ফোন দিয়ে আমাদের জানায়- না, এখনো আসে নাই আমাদের কোচ ভেলি। এই করতে করতে কতগুলো আন্টি উঠে আসলো এক স্টেশন থেকে। আমি উনাদের কাছে গিয়ে ইংরেজিতে বললাম কোচভেলির কথা। ওনারা বললেন যে চিন্তা করার কিছু নাই, কোচ ভেলিই লাস্ট স্টপেজ। তাই ট্রেন ছেড়ে দিবে সেই ভয় নাই। আর উনারাও কোচ ভেলিতেই যাচ্ছেন। সামনেই আসবে সেটা। দেখতে দেখতে সোয়া তিনটার সময় আমাদের কোচভেলি চলে আসলো। ট্রেন থেমে গেলে আমরা চারজন সব মালপত্র নিয়ে নেমেও গেলাম। কিন্তু প্ল্যাটফর্মে নেমে আর কাউকে দেখতে পেলাম না। নিলয় অন্য সবাইকে ফোন দিলো। অনেক্ষণ পর একজন একজনকে নামতে দেখলাম। ওরা নাকি বুঝতেই পারে নাই কোচভেলি চলে এসেছে! যাই হোক ৪৬ জন মানুষের শ খানেক মালপত্র নিয়ে নামতে বেশ সময় লাগলো। নতুন স্টেশনের দিকে আগালে আমাদের নাকি উল্টা হবে। তাই কমিটি হোটেল ঠিক করতে যখন গেলো তখন মালপত্র নিয়ে আমরা প্ল্যাট ফর্মেই বসে রইলাম। পুরো প্ল্যাটফর্ম খালি, খালি আমরা দ্বিমিকবাসীরাই থেকে গেলাম। আমরা ওয়েটিং চেয়ারগুলোতে বসলাম। আমি সবার দিকে তাকিয়ে লক্ষ করতে লাগলাম, দীর্ঘদিন ভ্রমণের ছাপ পড়েছে সবার চোখেমুখে। সবারই গায়ের রঙ পুড়ে গেছে কয়েক পোচ। আর নোভাকে দেখলাম চোখমুখ লাল করে হাঁটতে। ওর নাকি জ্বর এসেছে। কি আশ্চর্য, ট্রেনে ওঠার সময় নোভা ফর্সা ছিলো আর ট্রেন থেকে নেমে ও হয়ে গেলো লাল!

আমরা অনেক্ষণ হাত পা এলিয়ে বসে ছিলাম। তারপর কে যেন বুদ্ধি দিলো, বসতে হলে ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসি না কেন? তারপর আমরা সবাই হাত পা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়লাম। যার যার মালপত্র নিয়ে সে সে প্ল্যাটফর্মের উল্টা দিকে হাঁটতে লাগলাম। দীর্ঘক্ষণ হাঁটার পর টের পেলাম স্টেশনে যেতে হলে আমাদের প্ল্যাটফর্ম বদলে পাশের প্ল্যাটফর্মে যেতে হবে। মাথায় তখন আমাদের বড়সড় বাজ পড়লো। কেমন করে এই প্ল্যাটফর্ম থেকে ওই প্ল্যাটফর্মে যাবো?

দেখা গেলো তিন ধরনের উপায় আছে। প্রথম উপায়টা হলো ওভার ব্রিজ। আমাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রায় বিশ ফুট উঁচু একটা ওভার ব্রিজ আছে যেটা পাশের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে নেমেছে। আমরা ওভার ব্রিজটা এক ঝলক দেখেই এই প্রস্তাব বাতিল করে দিলাম। এতগুলো মালপত্র নিয়ে এই উঁচু ওভার ব্রিজ পার হওয়া সম্ভব না। দ্বিতীয় উপায়টা হচ্ছে ট্রেন। প্ল্যাট ফর্মে এখনও আমাদের ট্রেনটা থেমে আছে। আর এইটার অন্য পাশে থেমে আছে আরও একটা ট্রেন। এই প্ল্যাটফর্ম থেকে মাল তুলে প্রথমে একটা ট্রেনে ঢুকতে হবে, তারপর সেটার অন্যপাশ দিয়ে নামতে হবে। তারপর ঐ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটায় উঠতে হবে, তারপর সেই ট্রেনটার অন্য পাশ দিয়ে নামলে কাংখিত প্ল্যাটফর্মটা পাওয়া যাবে! আমাদের অনেকেই সেই পদ্ধতিতে আগালো। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম পদ্ধতিটা কেমন। এর মধ্যে অবনী যেই উঠলো মালপত্র নিয়ে একটা ট্রেনে, ওমনি ট্রেনটা অল্প বিস্তর নড়তে লাগলো। আমরা পাগলের মত চিৎকার করতে লাগলাম অবনীর জন্য। অবনী তাড়াতাড়ি করে ওর মালপত্র ছুড়ে ফেলে নেমে গেলো সেই ট্রেন থেকে। আমরাও বুকে আটকে থাকা নিশ্বাসটা ছেড়ে দিলাম। অবনীর অবস্থা দেখে আমাদের কারও আর সাহস হলো না এইভাবে প্ল্যাটফর্ম পার হতে। আমরা সবাই তাই তিন নম্বর উপায়ের দিকেই গেলাম। তিন নম্বর উপায়টা হচ্ছে, প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় গিয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে দুই দুইটা রেল লাইন পার করে অন্য পাশের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে ওঠা। জিনিসটা যত সহজে বলা হয়ে গেলো, করাটা হলো তারচাইতে একশ গুণ কঠিন। পাকা উঁচু প্ল্যাটফর্ম থেকে নামার পরই মাটিতে আমাদের লাগেজের চাকা আটকে যেতে লাগলো। কোনমতে সেটা টেনে হিচড়ে নিয়ে রেললাইনের কাছে আনা হলো। তারপর ভারি লাগেজটা তুলে উঁচু একটা রেল পার করা হলো। তারপর দেখা গেলো পাথর আর কাঠের স্লিপারের কারণে লাগেজ নাড়ানোই যাচ্ছে না। পুরো ভারি লাগেজটাকে তুলে নিয়ে একটা আস্ত রেলাইন কোনমতে পার করা হলো। তারপর কয়েক সেকেন্ড দম ফেলেই আবার মাটির রাস্তায় নেমে পড়তে হলো। তারপর পরের রেললাইনটাও একইভাবে পার করা হলো। তারপর সিঁড়ি দিয়ে লাগেজ গুলো টেনে টেনে প্ল্যাটফর্মে তোলা হলো। কাঁধে হ্যান্ড ব্যাগ, পিঠে ব্যাকপ্যাক, হাতে ট্রলি ব্যাগ আর খাবার পানির প্যাকেট- সব কিছু নিয়ে যখন প্ল্যাটফর্মে উঠলাম তখন আমার পাঁজড় হাপড়ের মত উঠা নামা করছে। আমি হাঁপাতে হাঁপাতেই একবার তাকিয়ে দেখলাম, ওইপাশে উঁচু প্ল্যাটফর্মটা থেকে দুইটা রেল লাইন পার করে এতগুলো মালপত্র নিয়ে আমি এই পাশে কেমন করে আসলাম, ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না!

অমানুষিক কষ্ট করার পর সবাই গলদ্ঘর্ম হয়ে গুটি গুটি পায়ে আগাতে লাগলাম ওয়েটিং রুমের দিকে। সবাই ওয়েটিং রুমের চেয়ারগুলোতে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম। এই লাগেজ টানা নিয়ে প্রচন্ড পরিশ্রম গেছে আমাদের। এবার একটু বিশ্রাম না নিলেই নয়। একটু স্থির হয়ে সবাই খেয়াল করলাম, দুপুরের খাবার হজম হয়ে গেছে- কিছু খেয়ে নেওয়া প্রয়োজন। ওয়েটিং রুমের পাশেই ছোট একটা দোকান থেকে আমি পানি, কেক আর মিল্কিবার কিনে খেতে শুরু করলাম। খাওয়া দাওয়া শেষে একটু পরেই খবর পেলাম আমাদের হোটেল ঠিক হয়ে গেছে। আবার আমরা যার যার বাক্স প্যাটরা নিয়ে রওয়ানা দিলাম।

স্টেশন থেকে বের হয়ে দেখলাম কোন গাড়িঘোড়া নাই। কেমন যেন ফাঁকা রাস্তা। এর মধ্যে একটা একটা অটো আসলেই সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো। কয়েকজন মিলে একেকটা অটো ঠিক করতে লাগলো ৪০০ রুপি দিয়ে। এর মধ্যে অন্তরা কেমন করে যেন ২০০ রুপি দিয়ে একটা অটো ঠিক করে ফেললো। অটো ঠিক করে ফেলার পর শুরু হলো আমাদের মালপত্র উঠানোর সংগ্রাম। ছোট্ট একটা অটোতে মিম, অন্তরা, রুবাইদা আর আমার চারটা বড় লাগেজ, তিনটা ব্যাকপ্যাক আর সাথে অন্যান্য প্যাকেট এবং হ্যান্ড ব্যাগ- সব মিলিয়ে ১২-১৩টা মাল নিয়ে আমি, মিম আর অন্তরা উঠে পড়লাম। রুবাইদার জায়গা হলো না, ও ওর বাকি মালপত্র নিয়ে অন্য কারও সাথে যাবে বলে চলে গেলো। একটা ছোট অটোতে এতগুলো মাল আটানোর পর আমরা তিনজন মানুষ কেমন করে এটে গেলাম- এটা একটা ব্যাপক রহস্য! মিম একটা বড় লাগেজ নিয়ে ড্রাইভারের পাশে কোনরকম বসলো। আমি আর অন্তরা বাকিসব লাগেজের ফাঁকে কোনরকমে বসতে পারলাম। আমার হাঁটুটা বারবার অটো থেকে বাইরে বের হয়ে যাচ্ছিলো। আমি হাত দিয়ে প্রাণপণে হাঁটুটা টেনে ভিতরে ঢুকানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। এই করতে করতেই আমাদের অটোটা ছেড়ে দিলো। এত ওজন নিয়ে অটোটা নড়াচড়া যে করতে পারলো, সেটাই বিশাল ব্যাপার!

আমি আর অন্তরা কুন্ডুলী পাকিয়ে একে অন্যকে জড়াজড়ি করে বসে রইলাম। পুরো ফাঁকা রাস্তা দিয়ে আমাদের অটো শাঁ শাঁ করে চলতে লাগলো। মাঝে মাঝে দেখতে পাচ্ছিলাম অন্য অটোতে আমাদের লোকজনদের। ওদের অবস্থাও আমাদের মতই। এর মধ্যে এক সিগ্নালে আমাদের অটোগুলো পাশাপাশি থামলো। অটোওয়ালা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলো যে আমরা একই সাথে যাচ্ছি। তাই উনি গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন ভাড়া কত করে। অপর অটোওয়ালা জবাব দিলো ৪০০ রুপি করে। আমাদের অটোওয়ালা কিছু বললো না। অন্তরা সব দেখে বললো, ‘ব্যাটা মনে হয় ৪০০ রুপিই নিবে’। আমাদের অটো চলতেই লাগলো। ফাঁকা ফাঁকা পথঘাট পেরিয়ে আমরা যেতে লাগলাম। আমি একবার অন্তরাকে বললাম গুগল ম্যাপে একটু দেখে নেওয়ার জন্য। কিন্তু অন্তরা জানিয়ে দিলো যে মোবাইল পর্যন্ত হাতটা পৌঁছানোর কোন জায়গা নাই। তাই আমরা আল্লাহর ভরসায় চলতে লাগলাম।

প্রায় ঘন্টা খানেক পর যখন গুটিসুটি মেরে থাকতে থাকতে আমাদের হাঁটু, কোমর, ঘাড়, কনুই টনটন করতে লাগলো তখন মনে হলো আমরা কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। হঠাৎ দেখি কমিটির লোকজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ওরা পথ দেখিয়ে দিলো। তারপর হঠাৎ করেই আমরা একটা ঢাল বেয়ে নামতে লাগলাম। আমাদের বুক ধুকপুক করতে লাগলো। এত মালপত্র সমেত অটোটা এমনিতেই ইমব্যালেন্সড, তার উপর খাড়া ঢাল, সামলাতে পারবে তো? আমি আর অন্তরা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়তে লাগলাম। আমাদের অটো প্রচন্ড বেগে ঢাল বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। আমরা রক্তশূন্য মুখে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। হঠাৎ একটা গেটের সামনে ঘ্যাঁচ করে আমাদের অটোটা থামলো। আমি গলা বের করে দেখলাম ইশ্তিয়াক দাঁড়িয়ে আছে। ও জিজ্ঞেস করলো, ‘তোরা কারা কারা আছিস?’ । আমি বললাম আমাদের কথা। ইশতিয়াক বললো, ‘তোদের রুম সামনের হোটেলে’। এমন সময় দেখলাম মজুমদার, মৌলিও একটা অটো থেকে নেমে এই হোটেলে ঢুকছে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি তো এই হোটেলে, তাই না?’। ইশতিয়াক মাথা নেড়ে বলতে লাগলো, ‘সামনের হোটেলে, সামনের হোটেলে-‘। আমি আর কথা বাড়ালাম না। আরও ঢাল বেয়ে আমাদের অটো নামতে লাগলো। তারপর ঢালের মধ্যেই বামদিকে বিশাল একটা টার্ন নিলো। আমাদের বুক ধক করে উঠলো। তারপর আরেকটা হোটেলের সামনে গিয়ে আমাদের অটো থামলো। সেটার নিচে জুবায়ের দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ভাড়া দেওয়ার সময় অটোওয়ালা আমাদের কাছে ৪০০ রুপি দাবি করে বসলো। আমাদের কিছু করার নেই, অন্য সবাইই ৪০০ রুপি দিয়েছে। আমরাও তাই দিলাম। তারপর মাল টেনে টেনে জুবায়েরের কাছে আসতেই জুবায়ের বললো, মিম আর অন্তরার রুম এই হোটেলে কিন্তু আর আমার আর রুবাইদার রুম আগের হোটেলটায়, যেটা আমরা পার হয়ে এসেছি। আমি ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলাম। এখন আমি কেমন করে ঢাল বেয়ে যাবো? শুধু আমার লাগেজ হলেও না হয় কথা ছিলো। সাথে রুবাইদারটাও আছে। কি করবো?

জুবায়ের বললো, ‘দাঁড়া, কোনটা কোনটা লাগেজ বল, সব টেনে দিচ্ছি’। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম, এই ঢাল বেয়ে ‘সব’ লাগেজ তুলে দেওয়ার অফার কেউ দিতে পারে- এটা আমি ভাবতেও পারি নাই। এমন সময় রাজিব যেন আসলো কোথা থেকে। জুবায়ের ওকে বললো আমাকে হেল্প করতে। ও একটা কথাও না বলে দুইটা লাগেজের হ্যান্ডেল ধরে ফেললো। আমি বললাম, ‘আমার লাগেজ আমি নিজেই নিতে পারবো, তুই শুধু রুবাইদারটা টেনে দে, তাহলেই হবে’। রাজিব রুবাইদার লাগেজটা ধরে শক্ত হাতে টেনে নিয়ে ঢাল বেয়ে উঠতে লাগলো। এমনিতে সমতলে লাগেজ টানাই ঝামেলা তার উপর এখন ঢাল। হ্যান্ড ব্যাগ, ব্যাকপ্যাক, খাবারের প্যাকেট আর ট্রলি টেনে টেনে ঢাল বেয়ে উঠতে উঠতে আমার ভীষণ পরিশ্রম হচ্ছিলো। পায়ের মাংসপেশী টনটন করতে লাগলো, হাতের আঙ্গুল্গুলোতো মনে হচ্ছিলো ছিঁড়ে আলাদা হয়ে যাবে। প্রচন্ড পরিশ্রমে আমার চোখমুখ লাল হয়ে গেলো। জোরেজোরে নিশ্বাস নিতে লাগলাম, মনে হচ্ছিলো এই ঢাল বেয়ে ওঠা কোনদিন শেষ হবে না। অথচ খুব বেশি দূরেরও কোন রাস্তা না, সমতল হলে হয়তো তিন মিনিট লাগতো হেঁটে যেতে। আমি সামনে রাজিবকে দেখতে লাগলাম ধীর পায়ে রুবাইদার ব্যাগটা টেনে টেনে যেতে লাগলো। আমিও দাঁতে দাঁত কামড়ে উঠতে লাগলাম ঢাল বেয়ে।

অবশেষে হোটেলের সামনে এসে থামলাম। রাজিব হাঁপাতে হাঁপাতে রুবাইদার লাগেজটা রেখে দিলো। আমি ওকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম। তারপর টেনে টেনে আমি সব মালপত্র নিয়ে আমাদের একতলার রুমে এসে পড়লাম। এসেই হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় গিয়ে ফ্ল্যাট হয়ে পড়ে গেলাম। মজুমদার আর মৌলি গোসলের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। এর মধ্যেই রুবাইদা ওর বাকি মাল সমেত রুমে এসে ঢুকলো। আমি একটু ধাতস্ত হয়ে লক্ষ করলাম আমার রুমটা। খুব বেশি বড় নয়, কিন্তু সুন্দর রুম। সাথে একটা মাঝারি বারান্দাও আছে। সেখানে একটা টি টেবিল আর দুইটা চেয়ার। সব দেখেটেখে আমার রুমটা পছন্দ হলো।

গোসল শেষে মৌলি আর মজুমদার বের হয়ে যায়। এরপর আমি গোসলে ঢুকি। রুবাইদা ওর বিশাল হ্যাভারস্যাকটা খুলে জামা কাপড় বের করতে থাকে। গোসল থেকে বের হয়ে আমি ধোয়া কাপড়গুলো বারান্দা টি টেবিল আর চেয়ারের উপর মেলে দেই। অপেক্ষা করি রুবাইদার গোসল শেষ হওয়ার জন্য। খেয়াল করি, রুবাইদা সব কিছুতেই কেমন যেন নিরুৎসাহী হয়ে গেছে। এই ত্রিভান্দাম আসার পরই দেশে যাবার জন্য রুবাইদার মন যেন একেবারেই ছুটে গেছে। কোন কিছুতেই ওর আর কোন আগ্রহ নাই।

রুবাইদার গোসল শেষ হলে আমরা বের হই। ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে। যদিও বিচ কাছেই তারপরও এই রাতের বেলা কেন যেন বিচে যেতে ইচ্ছা হলো না। যে ঢালু রাস্তায় আমাদের হোটেল তার নাম ‘হিল অ্যান্ড সি ভিউ রিসোর্ট রোড’। এই রোডের দুই পাশে অনেক দোকানপাট। সবগুলোতেই জয়পুরে দেখে আসা সেই পায়জামা ঝুলছে। আর ধারে কাছে বিচ আছে বলে সব দোকানেই সাজানো আছে স্যান্ডেল, হাফ প্যান্ট, হ্যাট- এইসব জিনিসপত্র। আমরা একেকটা দোকান ঢুকে দেখছিলাম। জিনিসগুলো খুবই সুন্দর, জয়পুরের চাইতে মান অনেক ভালো। জয়পুরের জিনিসগুলো দেখে পছন্দ করা মুশকিল, কিন্তু এখানে জিনিসগুলো সহজেই পছন্দ হয়ে যায়। তবে দামও জয়পুরের চাইতে কয়েকগুণ বেশি। আমার মনে পড়লো কমিটির সাজেশন। দেশে থাকতেই কমিটি আমাদের সবসময় সাউথে খরচ করার জন্য ভালো অ্যামাউন্টের টাকা রেখে দিতে বলতো, কারণ সাউথে নাকি সবকিছুর দাম বেশি। আর সাউথের সব জায়গায় ওরা আমাদের ভাষা বুঝবে না এবং ওদের সব খাবার খাওয়াও যায় না। তাই সাউথে খেতে হলে একটু ভালো মানের দোকানে খেতে হবে যেখানে ওরা ইংরেজি বা হিন্দি বুঝবে। আমরা বেশ কয়েকটা দোকান ঘুরে ঘুরে দেখলাম। তারপর হেঁটে হেঁটে ঢালু মোড়টা পার হয়ে আমাদের বাকি লোকজন আছে যেই হোটেলে তার সামনে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। চমৎকার খোলামেলা রেস্টুরেন্ট। আমরা একেবারে শেষের দিকে বেতের চেয়ার টান দিয়ে একটা টেবিল দখল করে দুইজনে বসলাম। রেস্টুরেন্টের দাম আমাদের কাছে মোটামুটি সহনীয় মনে হলো। আমরা অর্ডার দিলাম ৭০ রুপির টমেটো রাইস আর ২০০ রুপির গ্রিল ফিশ। বেশিক্ষণ সময় লাগলো না। একটু পরেই চলে এলো আমাদের খাবার। লাল রঙের টমেটো দিয়ে ফ্রাই করা ভাত খেতে ভালোই লাগলো। আর মাছটাও অনেক মজা। আমরা দুইজনে সময় নিয়ে তৃপ্তি করে খেলাম।

এফ
সূর্য ডোবার ঠিক আগে কোভালাম বিচে (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

খেয়ে দেয়ে আমরা বের হয়ে গেলাম। এবার যেতে লাগলাম বিচের দিকে। সেই ঢালু মোড়টা থেকে বাঁক না নিয়ে সোজা গেলেই সামনে পড়বে সমুদ্র। রাত হয়ে যাওয়ায় অনেক দোকানপাটই বন্ধ হয়ে গেছে। তবে রাস্তাগুলো শুনশান নিরব না। মানুষজন আছে, আর পরিবেশটা ভালো। আমরা দুইজন একটা মন্দির পার হয়ে সামনে এগিয়ে বিচে চলে গেলাম। বিচটা মোটেও অন্ধকার না। বেশ আলো আছে। কারণ বিচের একেবারে কাছেই সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে দামি দামি দোকানপাট আর রেস্টুরেন্ট। তাদের ঝলমলে আলো বিচটাকে অন্ধকার থাকতে দিচ্ছে না। অদ্ভূত ব্যাপার হচ্ছে, বিচটা ঢালু। কেমন যেন উল্টানো বাটির মত। আমরা বেশিদূর গেলাম না। বালির উপর বসে অনেক্ষণ গল্পগুজব করলাম নানা বিষয় নিয়ে। খানিকদূর হেঁটেও আসলাম বিচ ধরে। তুষারের সাথে দেখা হলো এর মধ্যে, উদাস মনে হাঁটাহাঁটি করছে ও। ঝলমলে দোকানপাট, ঠান্ডা লোনা বাতাস আর সমুদ্রের গর্জনে ভালোই লাগছিলো আমাদের। একসময় ঘড়ি দেখে উঠে পড়লাম আমরা। রাত হয়েছে, হোটেলে ফেরা দরকার।

হোটেলে ফিরেই দেশে ফোন দিলাম। কথা বললাম আম্মুর সাথে। প্রতি রাতেই দেই। তবে আজকে বললাম একটু বেশি সময় ধরে। এর মধ্যে মজুমদার আর মৌলি চলে আসলো। এমনিতেই আমরা ক্লান্ত ছিলাম। সারা দিন কম পরিশ্রম যায় নাই আমাদের। তাই ঘুমাতে একটুও দেরি হলো না। ফ্যানটা ছেড়ে লম্বা হয়ে শুয়ে দিলাম ঘুম। গাঢ় ঘুম।

 

The Mighty INDIA CALLING: অ্যাডভেঞ্চারের নাম ‘প্যারাসেইলিং’ এবং ট্রেন ধরার টেনশন (পর্ব ৩০)

পরদিন সকালে ঘুম ভাংলো মজুমদারের কান্নাকাটিতে। মোবাইলটা হারিয়ে যাওয়ার শোকটা এখনও ভুলতে পারছে না ও। তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে বের হয়ে পড়লাম। আমাদের সবার ইচ্ছা ওল্ড গোয়ায় একবার যাওয়ার। আমি, রুবাইদা, মিম আর অন্তরা মিলে হাঁটা দিলাম মেইন রাস্তার দিকে। ডক্টর আলফনসো রোডের মোড়ে বেশ কয়েকটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিলো। আমাদের দেখে এগিয়ে আসলো। ওল্ড গোয়ায় যাবো শুনে সবাই খুব আগ্রহ দেখালো। কিন্তু দাম চাইলো আকাশ্চুম্বী। সব চেয়ে কম যেটা চাইলো সেটাই ছিলো ১০০০ রুপি। ট্যাক্সি ভাড়া শুনে আর সময় হিসাব করে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে ওল্ড গোয়ায় আর যাওয়া যাবে না। এতে রুবাইদার মন খারাপ হলো সবচেয়ে বেশি। আমরা আবার হেটে হেটে হোটেলের দিকে যেতে লাগলাম।

নাশতা করার জন্য কোন চিন্তা ভাবনা না করেই ভিন্সিস প্লেসে ঢুকে আগের দিনের ব্রেড অমলেট আর সাথে সি ফুড সুপ অর্ডার দিয়ে দিলাম। পেট ভরে নাশতাটাই এত মজা করে খেলাম যে মনে হলো হাঁটাহাঁটি করা প্রয়োজন। ওদিকে সবাইকে দেখছিলাম প্যারাসেইলিং এ যাওয়ার কথাবার্তা বলছে। আমরাও যোগ দিলাম এতে। খাওয়াদাওয়া শেষে বের হয়ে পড়লাম আমরা। প্রথমে গেলাম কাছের কালাঙ্গুটে বিচে। সেখান থেকে হাঁটা ধরলাম বাগা বিচের উদ্দেশ্যে। বাগা বিচে পৌঁছানোর আগেই শুভ, রাজিব, নিলয়কে দেখলাম এক দোকানের সাথে কন্ট্রাক্ট করতে প্যারাসেইলিং এর জন্য। নরমালটা ৬০০ রুপি আর Deep Sea নিলে ৮০০ রুপি। আমরা সবাই নরমালটা নিলাম ৬০০ রুপি দিয়ে। এমনিতেই সাঁতার পারি না, তার উপর Deep Sea, কোন দরকার নাই বাবা!

আমি, নিশাত, পৃথ্বী, রিন্তু, মজুমদার, রুবাইদা, নিলয়, রাজিব, তুষার, শুভ আমরা সবাই মিলে এক সাথে লাইন ধরলাম বোটের জন্য। সেখানে আমাদের বাংলা কথা বলতে দেখে বোটের একজন লোক এগিয়ে আসলো। জানালো তার বাড়ি বরিশাল। এখানেই প্যারাসেইলিংয়ের কাজ করে। বাড়ি যাওয়া হয় না অনেক বছর। আমাদের দেখে বললো, ‘দেশের মানুষ পেয়ে খুব ভালো লাগছে’। আমাদের কয়েকজনকে উনি আশ্বস্ত করলেন যে গোয়ার নাবিকরা অনেক দক্ষ। তাই যত বিপদজনক রাইডই হোক না কেন পর্যটকদের কোন বিপদ হওয়ার আশংকা খুবই কম। একটা স্পিড বোট এসে থামলো। আমরা টকাটক উঠে পড়লাম সেই বোটে। বোট আমাদের নিয়ে ছুটলো সৈকত থেকে দূরে।

বড় বড় ঢেউয়ের ঝাকুনি খেয়ে আমরা গিয়ে থামলাম আরেকটা বোটের পাশে। এই বোটটা বড়। আমরা সবাই গিয়ে উঠলাম সেই বোটে। আমাদের নামিয়ে দিয়ে স্পিড বোট চলে গেলো। আমাদের সবাইকে লাইফ জ্যাকেট পরতে বলা হলো। আমরা সবাই গলা ঢুকিয়ে দিলাম লাইফ জ্যাকেটের ফোকড়ে। আমাদের সামনেই দুজন লোক মিলে রঙ্গিন প্যারাসুট বের করলো। তারপর সেটা কপিকলের সাথে ঠিকমত বাঁধাছাদা করতে লাগলো। তারপর ছেড়ে দিতেই ফুলে ফেঁপে সেটা একটা বিশাল রঙ্গিন বেলুনের আকার ধারন করলো। সব দড়িটড়ি ঠিক ঠাকমত চেক করে লোকগুলো তারপর আমাদের দিকে তাকালো। সবার আগে নিলয় এগিয়ে গেলো। নিলয়কে কপিকলের কোথায় জানি আটকে দিলো। যেই বোটটাকে চালাতে লাগলো আর ওমনি নিলয় সাঁ করে উড়ে গেলো। ঠিক উড়ে চলে গেলো না, দড়ি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় বোটের উপর ভাসতে লাগলো। আমরা নিচ থেকে হাঁ করে দেখতে লাগলাম। ঠিক কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নিলয় আবার নেমে আসলো। তারপর ঠিক একইভাবে পৃথ্বী, নিশাত আর মজুমদার উড়ে গেলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য। আমরা নিজেরা একবার ‘ডিপ সি’র কথা বলাবলি করছিলাম, তখন মোটা লোকটা জোরে জোরে আমাদের আশ্বস্ত করতে লাগলো, ‘ কোয়ি রিস্ক নেহি, বিল্কুল সেফ হ্যায়, সুইমিং কি কোয়ি জরুরাত নেহি, বহত আচ্ছা হ্যায়’। রাজিবের পালা আসতেই রাজিব ২০০ রুপি হাতে নিয়ে চালক সেই মোটা লোকটার হাতে গুঁজে দিয়ে বললো, ‘ডিপ সি’। লোকটাও মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেলো। তারপর আমরা দেখতে লাগলাম, একইভাবে রাজিবও উড়ে গেলো। উড়ে যেতেই লাগলো অনেক দূর। তারপর প্রচন্ড বেগে ছুটতে ছুটতে আস্তে আস্তে নিচে নামতে লাগলো। নামতে নামতে অর্ধেক ওর ডুবে গেলো পানিতে। তারপর আবার কিছুটা উঠে গেলো উপরে। তারপর একইভাবে আবার নামতে লাগলো পানিতে। ওই অবস্থায় রাজিবকে দেখে আমরা যারা বাকি ছিলাম সবাই পকেট থেকে ২০০ রুপি বের করে হাতে নিয়ে বসে থাকলাম। কেউ আর নরমালটা করতে রাজি না, সবাই ডিপ সি করতে চায়। আমি মনে মনে হাসলাম, এটা তাহলে Deep Sea না হয়ে হবে Dip Sea।

অর্ধেক মানুষের হয়ে গেলে আগের সেই স্পিড বোট নতুন প্যাসেঞ্জার নিয়ে আসলো। যাদের যাদের হয়ে গেছে তারা নেমে গেলো, আর নতুন প্যাসেঞ্জাররা আমাদের সাথে বোটে উঠে আসলো। এক দল ছেলেমেয়ে, আমাদের সমানই হবে হয়তো বয়স। আর আমরাও একেকজনকে পানিতে নাকানি চুবানি খেতে দেখছিলাম আনন্দ নিয়ে। আমার পালা যখন এলো আমি উঠে দাঁড়ালাম। কপিকলটার সামনে দাঁড়াতেই কয়েকটা জয়েন্ট লক করে আমাকে একবার জিজ্ঞেস করলো, ‘রেডি?’ । আমি মাথা নাড়তেই প্যারাসুটটার প্রচন্ড টানে আমি উঠে গেলাম উপরে। প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ফিট উপরে উঠে যাওয়ার পর আমার মনে হলো আমার পায়ের নিচে সারা পৃথিবীটা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে নিচে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম নিশ্চুপ, শান্ত বিশাল নীলচে সবুজ রঙের সমুদ্রকে। অনেক দূরে একপাশে দেখা যাচ্ছে বিচের দিগন্ত রেখা। আর অন্য সব পাশেই শুধুই সমুদ্র। দূরে দূরে আরও কয়েকটা বোট থেকে আমার মতন আরও কয়েকজন আকাশে ভেসে আছে, তাদের ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম। টলটলে কাঁচের মতন পানি। সেখানে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট বোটটাকে যার পাশে আমার প্যারাসুট আর আমার ছায়া পড়েছে বিশাল জায়গা জুড়ে। আমি সাবধানে পা নাড়িয়ে দেখলাম, বিশাল ছায়াটার বিশাল বিশাল পা দুটো নড়ছে। মনের মধ্যে এক অদ্ভূত আনন্দের অনুভূতি হলো। একবার মনে হলো চিৎকার করে সবাইকে জানিয়ে দেই মনের আনন্দটার কথা। কিন্তু কাকে বলবো? কে শুনবে? এই উচ্চতায় তো আমি একা। এই নিস্তব্ধ পৃথিবীটার দিকে যেন আমি একা তাকিয়ে আছি। কতক্ষন হবে- কয়েক সেকেন্ড? বড়জোড় এক মিনিট? কিন্তু আমার কাছে  মনে  হয়েছিলো যেন পৃথিবীটা থেমে গেছে কয়েক মুহুর্তের জন্য।

একটু পরেই টান অনুভব করলাম। আমাকে নিয়ে প্যারাসুট নিচে নামতে লাগলো। সোজা পানির উপরে। প্রচন্ড বেগে ছুটতে ছুটতে আমি পানি স্পর্শ করলাম। আস্তে আস্তে আমার শরীরের প্রায় অর্ধেক পানিতে ডুবে গেলো। সেই অবস্থায় স্পিড বোটের সাথে পাল্লা দিয়ে আমি প্রায় সমান তালে পানির মধ্যে দিয়ে ছুটতে লাগলাম। ব্যাপারটা যে কত মজার সেটা যে না করবে তাকে কোনদিনই বোঝানো সম্ভব না। আমাকে একবার পানির উপর তুলে কয়েক সেকেন্ড পর আবার ডুবানো হলো। আমি সেই অবস্থায় দাঁত বের করে হাসতে লাগলাম। নিশাত সবার প্যারাসেইলিংয়ের দৃশ্য ভিডিও করেছে। আমার সেই দাঁত বের করা হাসির দৃশ্যো ওর ক্যামেরায় বন্দি হয়ে রইলো। এরপর আমাকে সোজা উপরে উঠিয়ে আবার টেনে বোটে নিয়ে নামালো। আমি নামতেই লোকগুলো আমার বাঁধন খুলে দিলো। সব মিলিয়ে হয় তো আড়াই মিনিট হবে। আড়াই মিনিটের অভিজ্ঞতায় আমি ফুরফুরে আনন্দের অনুভূতি নিয়ে বসে পড়লাম অন্য সবার সাথে। আমার পর তুষার বাকি ছিলো। ওকে রাখলো সবচেয়ে বেশিক্ষণ। ওকে ডুবালো সব মিলিয়ে চারবার। একবার তো বলতে গেলে পুরাই ডুবিয়ে ফেললো!

সদ
রঙ্গিন প্যারাসুট নিয়ে পানিতে নাকানি চোবানি

আমাদের সবার হয়ে গেলে আমরা স্পিড বোটের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ততক্ষণে অন্য যেই দলটা এসেছে তাদেরকে উঠানো হতে লাগলো। ওরাও আমাদের মত নরমাল টিকেট কেটেছে। প্রথম একজন কয়েক সেকেন্ড ভেসে থাকার পর ওদের একজন চ্যাঁচামেচি করতে লাগলো যে আমাদের বেশি সময় রাখা হয়েছে আর ওদের কমসময় রাখা হচ্ছে। স্টেয়ারিং হুইলে থাকা মোটা লোকটা তখন রেগে গেলো। সেই লোকটাও পালটা চিৎকার করে বলতে লাগলো যে আমরা ‘ডিপ সি’র টিকেট কেটে এনেছিলাম তাই আমাদের বেশি সময় রাখা হয়েছে। ওরাও তখন ডিপ সির জন্য বাড়তি টাকা দিতে চাইলো কিন্তু লোকটা তাদের সরাসরি না করে দিলো। সাফ জানিয়ে দিলো, টিকেট ছাড়া কাউকেই বাড়তি কিছু দেওয়া হবে না। ওরা কিছু বলতে না পেরে মুখ গোঁজ করে বসে রইলো। আর আমরা একজন আরেকজনের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করে মিটিমিটি হাসতে লাগলাম। আমাদের সময় উনিই সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়েছিলেন, আর এখন উনিই কড়াভাবে না করে দিলেন!

স্পিড বোট আসলে আমরা উঠে পড়লাম। বোট আমাদের তীরে নিয়ে নামিয়ে দিলো। আমাদের অনেকে অন্যান্য রাইডের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করলো। জাফররা মনে হয় ব্যানানা রাইডে উঠার প্রিপারেশন নিলো। আমার আর কোন কিছুর প্রতি আকর্ষণ ছিলো না। আমরা কয়েকজন হেঁটে হেঁটে কালাঙ্গুটের দিকে যেতে লাগলাম। আমি আর রিন্তু পাশাপাশি হাঁটছিলাম। ফস করে কে যেন পাশ থেকে বলে উঠলো, ‘আয়সি কাপড়ে পেহেনকার ইয়াহা কোয়ি আতাহে?’। আমি শুনি নাই, কিন্তু রিন্তু শুনে ফেললো। এই বিচের মধ্যে হিজাব পরা লোকজন হয়তো খুব একটা দেখা যায় না, তাই আমাদের দেখে মন্তব্যকারীর মত অনেকেই হয়তো বেশ অবাক হয়েছে। আমি আর রিন্তু একজন অন্যজনের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

আজকেই আমাদের গোয়ায় শেষদিন। বিকালেই গোয়া ছেড়ে চলে যাবো। তাই শেষবারের মত কালাঙ্গুটে বিচে এসে পানির উপর বসলাম আমি আর তমা। মিম, অন্তরা আর রিন্তু হোটেলে ফিরে গেলো। ওদের গোসল করে বের হতে সময় লাগবে। তাই এই মুহুর্তে আমার হোটেলে ফিরে গিয়ে লাভ নাই। রুবাইদা, আমি আর তমা বেশ আয়েশ করেই পানিতে বসলাম। তারপর আমি আর তমা গল্প করতে লাগলাম। লোনা পানির ঢেউয়ের ঝাপ্টায় আমাদের গল্পে মাঝে মাঝে ছেদ পড়তে লাগলো। আমরা তাল সামলে আবার ঠিক হয়ে বসে গল্প করতে লাগলাম। প্যারাসেইলিং করবো বলে মোবাইল কিংবা ঘড়ি কোনটাই নিয়ে বের হই নাই। তাই কেউ ফোন করারও নাই, বা ঘড়িতে সময় দেখারও উপায় নাই। দুপুরের গনগনে সূর্যের তাপকে আমরা পাত্তাই দিলাম না। বিশাল সমুদ্রের তীরে বসে সব চিন্তা বাদ দিয়ে লোনা পানির ঢেউয়ে বসে বসে নিশ্চিন্ত মনে গল্প করতে লাগলাম আমরা। যখন মনে হলো অনেক সময় পার হয়ে গেছে, তখন আমরা তিনজন উঠে পড়লাম। শেষবারের মত বিদায় জানালাম ভুমধ্যসাগরকে। বিচ ছেড়ে হাঁটতে শুরু করলাম হোটেলের দিকে।

রুমে পৌঁছে দেখি ওদের গোসল প্রায় শেষ। আমি ঢুকে পড়লাম গোসল করার জন্য। ততক্ষণে বাথরুমে বালির এক বিশাল পাহাড় তৈরি হয়েছে। যতই পানিঢালা হোক না কেন সেই বালি কিছুতেই সরে না। আমার গোসল শেষে জামাকাপড় ধোয়ার পর সেই পাহাড় আরও বড় হয়ে গেলো। গোসল শেষে বের হয়ে দেখি রিন্তু চলে গেছে। ওদের সাথে ক্যাফে মোকায় যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু কি আর করা, আমার দেরি হয়ে গেছে। আমি তাড়াতাড়ি তমাদের বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলাম। তমা, রিজভী আর আফরা বের হয়ে আসলো। ওরাও ক্যাফে মোকাতেই যাবে। আমি ওদের সাথে জুটে গেলাম। কিন্তু কমিটির লোকজন বার বার বলতে লাগলো ঠিক ঠিক চারটার সময় আমরা রওয়ানা দিয়ে দিবো। যে করেই হোক তার আগেই এসে বসে থাকতে হবে। আমরা বের হয়ে অটো ঠিক করতে গেলাম। কিন্তু অটোওয়ালা রাজি হলো না। আমরাও সময় হিসাব করে দেখলাম গিয়ে ফেরত আসা সম্ভব হবে না। তাই কি আর করা, মোকাতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম আমরা। দুপুরে খাওয়ার জন্য ঢুকলাম ‘বৃন্দাবন হোটেল’ এ।

বেশ বড় খোলামেলা হোটেল। আমরা বসার সাথেসাথেই মেনু নিয়ে আসলো একজন লোক। আমি অর্ডার দিলাম প্রন হাক্কা নুডুলস আর ব্যানানা শেক। কিছুক্ষনের মধ্যেই বড় বড় চিংড়ি দেওয়া মজাদার নুডুলস এসে হাজির হলো। আমরা সবাই গোগ্রাসে খাওয়া শুরু করলাম। সবার খাওয়ার পরিমান এত বেশি ছিলো যে খেয়ে কিছুতেই শেষ করা গেলো না। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আমি আর তমা বের হয়ে পড়লাম বাদাম কেনার জন্য। তমা বাদাম কিনতে চায়, কিন্তু কয়েকটা দোকানে বাদামের অস্বাভাবিক দাম দেখে ও না কেনার সিদ্ধান্ত নিলো। একটা আইসক্রিমওয়ালার কাছ থেকে ‘ভাদিলালাল’ এর একটা চকোবার কিনলো তমা। আমি খেয়াল করলাম লোকটা নিজেই আইস্ক্রিমের প্যাকেটটা ছিড়ে আইসক্রিম বের করে তমার হাতে দিলো। পরে তমা খেতে খেতে বললো আইস্ক্রিমটা একটু অন্যরকম। আমি বললাম- এটা দুই নম্বুরি ভাদিলাল। কারণ আমাদের প্যাকেট দেখতে দেয় নাই। ব্যাটা নিজেই ফেলে দিয়েছে। তমাও মনে হয় ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। দুঃখি দুঃখি মনে তমা আইসক্রিম খেতে লাগলো।

হোটেলে ফেরার পথেই রুবাইদার সাথে দেখা। ও ১০০-১৫০ রুপি দিয়ে স্কার্ফ কিনেছে। আমাকে দেখানোর জন্য ঐ দোকানে নিয়ে গেলো ও। আমার তেমন পছন্দ হলো না। আমরা সেই দোকান থেকে বের হয়ে হোটেলের দিকে যেতে লাগলাম। হোটেলের সামনে গিয়ে দেখি সারি সারি বড় বড় মাইক্রো দাঁড়ানো। এইগুলোতে করে আমরা রেলস্টেশন যাবো। সেগুলোতে আমাদের লোকজন উঠে মালপত্র টানাটানি করে ঢুকাচ্ছে। কি সর্বনাশ, সবাই গাড়িতে উঠে গেছে! আমি আর রুবাইদা দৌড় দিলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে সিড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে বারান্দায় শুকাতে দেওয়া কাপড়গুলো একটানে নিয়ে লাগেজে ভরে লাগেজ টানতে টানতে নেমে পড়লাম। আবার সেই সিড়ি দিয়ে লাগেজ নামিয়ে কাঁচা রাস্তার উপর দিয়ে টেনে টেনে মাইক্রোর সামনে এসে দাঁড়ালাম। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখি সব গাড়িই ভর্তি। কোনটাই খালি নাই। আমি রুবাইদা আর তুষার আমরা তিনজন লাগেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তায়। কোন গাড়িতে উঠতে পারছি না। শুনলাম আরও একটা গাড়ি নাকি আসবে। সেটাতে আমরা উঠবো।

ওই দিকে জুবায়ের একটা গাড়ির সামনে বসে জানালো তুষারকে কোনমতে উঠে পড়ার জন্য সেই গাড়িতে। কিন্তু ভিতর থেকে সবাই বলতে লাগলো আমাকে উঠে পড়তে। জুবায়ে বললো, ‘লাগেজের জায়গা হবে না কিন্তু’।  রুবাইদা আর তুষার আমাকে বললো লাগেজ ছাড়াই উঠে পড়তে। আমি কোন মতে উঠে পড়লাম। ভেতরে এক অদ্ভূত দৃশ্য! পুরো গাড়িটা মানুষ আর লাগেজে এমনভাবে পরিপূর্ণ যে কোন নড়াচড়ার জায়গা নেই। ভেতরে ঢুকতেও আমাকে বেশ বেগ পেতে হলো। সৌভাগ্যক্রমে আমি অন্তরার পাশে এক চিলতে বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। আমি বসার পর মনে হলো, আমার লাগেজটাও মনে হয় কোনমতে এটে যাবে। আমি সেকথা বলতেই বাইরে থেকে তুষার আমার লাগেজটা ঠেলে ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো। কিন্তু ভারি লাগেজটা আমি ধরে রাখতে পারছিলাম না। হাত থেকে ফস্কে যাচ্ছিলো। এগিয়ে এলো রিন্তু, ফাহাদ, ইশতিয়াক আর শুভ। সবাই মিলে হ্যাঁচকা টান দিয়ে হাতবদল করতে করতে লাগেজটাকে একদম পিছে পাঠিয়ে দিলো। এক চিলতে জায়গায় কোলের উপর ব্যাকপ্যাকটাকে নিয়েই বসলাম। অ্যাট লিস্ট গাড়িতে উঠার জায়গা পেয়েছি, এটাই বা কম কিসে?

বাইরে থেকে আমাদের হোটেলের একজন লোক উসখুস করতে লাগলো, কেন আমরা রওয়ানা দিচ্ছি না। উনিই বললো আরেকটা গাড়ি এসে যাবে, এখন যেই গাড়িগুলো আছে সেইগুলো রওয়ানা দিয়ে দেওয়া দরকার। যেতে নাকি অনেক সময় লাগবে। ওনার তাড়াহুড়া দেখে কমিটি নির্দেশ দিলো রওয়ানা দেওয়ার। একটা একটা করে গাড়ি চলতে শুরু করলো। আমরা দেখলাম, সৌরভ, তুষার আর রুবাইদা বেশ কিছু মালপত্র নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ওরা অপেক্ষা করতে লাগলো ওদের গাড়ির জন্য। আর ওদের ফেলেই আমরা রওয়ানা দিলাম।

আমাদের ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো আমাদের ট্রেন কয়টায়। সাড়ে ছয়টায় ট্রেন শুনে ড্রাইভার অবাক হয়ে হিন্দিতে বললো, ‘এত দেরিতে কেন রওয়ানা দিয়েছেন? আপনারা তো পৌঁছাতে পারবেন না’। হোটেলের লোক আমাদেরকে স্টেশন এক দেড় ঘন্টার পথ বলেছে- এই কথা শুনে সে বললো, ‘সে তো অন্যসব দিনের জন্য, কিন্তু আজকে তো ভ্যালেন্টাইন ডে- আজকের জন্য তো আলাদা হিসাব’। এই বলে ড্রাইভার বেশ তাড়াহুড়া করে চালাতে লাগলো। জুবায়ের বারবার ওনাকে আস্তে ধীরে চালাতে বললো। কিন্তু ঊনার মুখে একটাই কথা, ‘আপনারা তো পৌঁছাতে পারবেন না’। বারবার একই কথা বলা আমরা একটু ভয় পেয়ে গেলাম।

মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা দিয়েই আমাদের গাড়ি চলতে লাগলো। একটা হাইওয়েতে উঠে টের পেলাম ‘ভ্যালেন্টিন ডে’র মাহাত্ম। পুরো হাইওয়ে জ্যাম। বিশাল হাইওয়ে জুড়ে হাজার হাজার গাড়ি থমকে বসে আছে। কেউ নড়াচড়া  করছে না। শুনলাম সামনে নাকি কি এক কার্নিভাল আছে ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষে- সেই জন্য এত জ্যাম। বেশ খানিক্ষণ জ্যামে বসে থেকে আমরা ছটফট করতে লাগলাম। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যেতে লাগলো, কিন্তু আমরা থেমেই রইলাম। গাড়ির পিছনে ততক্ষণে নানা আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। শুভ বলছে যে ট্রেন যখন মিস করবোই তখন আর সামনে গিয়ে লাভ কি, ব্যাক করে গোয়াতে ফিরে গেলেই হয়। আবার রিন্তু বলতে লাগলো, ট্রেন পাই আর না পাই, স্টেশন পর্যন্ত যেতে তো আর অসুবিধা নাই। ইশতিয়াক বলতে লাগলো, অত রাত করে স্টেশনে পৌঁছে ব্যাক করার সুযোগ পাবো না, তারচেয়ে সময় থাকতে থাকতে ব্যাক করে ফেলা ভালো। শুভ ওইদিকে বসে বসে ‘প্ল্যান বি’ চিন্তা করতে লাগলো। ট্যুর প্ল্যান থেকে সাউথের পার্টটা বাদ দিয়ে কাশ্মির কিংবা দার্জিলিং অ্যাড করলে কেমন হয় সেই নিয়ে জোর আলোচনা হতে লাগলো। সব শুনে আমাদের মনে হতে থাকে, আজকের দিনে দারুণ একটা ঘটনা ঘটবে। ট্যুর প্ল্যানটা বোধহয় এইবার লন্ডভন্ড হয়ে গেলো!

ওদের প্ল্যান বি মোটামুটি ফাইনাল হয়ে গেলো, রিন্তু আর ফাহাদ একটু পর পর ম্যাঁও ম্যাঁও ডাকতে লাগলো, জুবায়ের গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগলো- কিন্তু আমরা আর জ্যাম ছেড়ে বের হতে পারলাম না। মাঝে মাঝে একটু আধটু নড়াচড়া হয়, কিন্তু জ্যাম থেকে আর বের হতে পারি না। এরমধ্যেই মোটামুটি ৬টা বেজে গেলো। আমরা যখন শিওর যে পৌঁছানো সম্ভব নয়, তখন জুবায়ের জানালো ট্রেন ডিলে করেছে এক ঘন্টা। আমরা খুশি হয়ে গেলাম, কিন্তু ড্রাইভার আগের মতই বলতে লাগলো, ‘লাভ নাই, ট্রেন মিস করবেন’। এক সময় আমাদের কথার সব স্টক শেষ হয়ে গেলো। আমরা ক্লান্ত হয়ে চুপ হয়ে গেলাম। সূর্য ডুবে গেলো। আমাদের মাইক্রো একটু একটু করে এগিয়ে যেতে লাগলো। রাত হয়ে গেলে আমাদের গাড়ি একটু ফাঁকা রাস্তা পেয়ে গেলো। ড্রাইভার প্রাণপণে গাড়ি চালাতে লাগলো।

আমরা যখন মারগাও স্টেশনে পৌঁছাই তখন আরও দুইটা গাড়ি এসে পড়েছে। আমরা তিন গাড়ির লোকজন দ্রুত গতিতে মালপত্র নামাতে লাগলাম। লাগেজটা হাতে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে স্টেশনে ঢুকে পড়লাম আমরা। হাঁপাতে হাঁপাতে যখন ওয়েটিং রুমে পৌঁছালাম তখন বাজে রাত পৌঁনে আটটা। সেখানে ঢুকে খবর পেলাম ট্রেন আরও এক দফা ডিলে হয়ে আসার টাইম হয়েছে রাত পৌনে দশটা। আমরা বুকের ভিতর আটকে থাকা নিশ্বাস ছাড়লাম। যাক বাবা, বাঁচা গেলো! আগের মত আমরা আমাদের মালপত্র বাঁধাছাঁদা করে বিশাল স্তুপ করে রাখলাম। আমার মোবাইলে রিচার্জ করা দরকার। আমি আর চিং খুঁজতে বের হলাম রিচার্জ করার দোকান।

অদ্ভূত ব্যাপার হলো রিচার্জ খুঁজতে খুঁজতে আমরা একটা ওভারব্রিজ পার হয়ে স্টেশন থেকে বের হয়ে পড়লাম। তাও কোন দোকান খুঁজে পেলাম না। এত্ত বড় স্টেশনে কোন মোবাইল রিচার্জের দোকান নাই, কি আজব! খুঁজতে খুঁজতে এক সময় যখন বুঝলাম কোন লাভ নাই, তখন আমি আর চিং ব্যাক করলাম। আমাদের দুজনের পায়েই স্পঞ্জের স্যান্ডেল- সেটা নিয়ে আমরা বেশ হাসাহাসি করলাম। স্টেশনের ভিতরে একটা দোকান থেকে আমি পানি আর বিশাল একটা স্যান্ডউইচ কিনে নিলাম। আপাতত এটাই আমার রাতের খাবার। এইসব নিয়ে আবার ওয়েটিং রুমে ফেরত গেলাম। সেখানে বসে খাওয়াদাওয়া করে নিলাম। তারপর গেলাম ‘সুলভ শৌচালয়’ এ। একেবারে দাঁতটাত মেজে ফ্রেশ হয়ে বের হলাম।

আগেরবারের মত এবার আর আমরা ভুল করলাম না। সাড়ে নয়টা বাজতেই আমরা ব্যাগপত্র নিয়ে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমি, উর্মি, চিং আর নিলয় ছাড়া বাকি ৪২ জনের সিট পড়েছে এক বগিতে। আমরা চারজন শুধু আলাদা বগিতে। ওরা ৪২ জন ওদের বগির নম্বর লিখা প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দাঁড়ালো। ট্রেন নাকি থামবে কয়েক মিনিটের জন্য। এরমধ্যে সব মালপত্র নিয়ে এতজন মানুষের ট্রেনে ওঠা একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। তাই ওরা বুদ্ধি করে ২১ জনের দুইটা দলে ভাগ হয়ে গেলো। একদল ঢুকবে ডান পাশের দরজা দিয়ে, আরেকদল ঢুকবে বামপাশের দরজা দিয়ে। নিজেদের মধ্যে অনেক প্ল্যান প্রোগ্রামও হয়ে যাচ্ছিলো যে কিভাবে কে আগে উঠবে আর কিভাবে মালপত্র আর অন্যরা উঠবে। আর এদিকে আমরা চারজন খানিক দূরে প্ল্যাটফর্ম ১৮তে দাঁড়িয়ে আছি। আমরা খুব বেশি মানুষজন না, তাই আমাদের চিন্তাও কম। আমরা অধীর আগ্রহে ট্রেনের জন্য দাঁড়িয়ে রইলাম। উল্টাপাশের প্ল্যাটফর্মে একটা ট্রেন এসে থামলো। আমরা বাকিদের দিকে তাকাতে লাগলাম, ঐটা আমাদের ট্রেন নয়তো? দূর থেকে ওরাও ইশারা দিলো, না-ঐটা না। আমরা আবার অপেক্ষা করতে লাগলাম। এরমধ্যে একটা অদ্ভূত ট্রেন দেখলাম। এটা মালগাড়ি। তবে কন্টেনারের বদলে ট্রাক টানছে। মাল বোঝাই ট্রাকগুলোর ভিতরে ড্রাইভার আর হেল্পার বসে আছে। ট্রেনের ইঞ্জিন দিয়ে ট্রাক টেনে নেওয়ার ঘটনাটা আমি কখনও দেখি নাই। আমরা অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম।

পৌনে দশটা বেজে পার হয়ে গেলো অথচ ট্রেন আসছে না দেখে আমরা চিন্তায় পড়ে গেলাম- কোন ভুল করলাম না তো?। এদিকে পুরো প্ল্যাট ফর্মে আমরা ছাড়া তেমন আর কোন মানুষজন নাই। এর মধ্যে কতগুলো কুকুর ঘাউঘাউ করতে লাগলো। একজন লম্বা মতন লোক কুকুরগুলোর থেকে দূরে সরে আমাদের কাছে এসে দাঁড়ালো। উনি উর্মিকে জিজ্ঞেস করতে লাগলো যে আমরা কই যাবো, কোথা থেকে এসেছে- এইসব। অন্য সবার মত আমাদের বিশদ কাহিনী শুনে লোকটাও বেশ অবাক হলো। লোকটা আমাদের নিশ্চিত করলো যে আমাদের ট্রেন এই জায়গাতেই আসবে। লোকটা নিজেকে একজন ইন্ডিয়ান আর্মি অফিসার হিসেবে পরিচয় দিলো। উনার কথাশুনে আমরা কিছুটা ভরসা পেলাম যে, ট্রেন আমাদের মিস হয় নাই!

অবশেষে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ট্রেন আসলো। আমরা স্নায়ু টানটান করে দাঁড়িয়ে রইলাম। যেই ট্রেনটা থামলো সবার আগে আমি উঠে গেলাম দরজা দিয়ে। নিলয় নিচ থেকে টপাটপ আমাদের লাগেজগুলো তুলে দিতে লাগলো। আমরা সেগুলো টেনেটেনে ভিতরে ঢুকাতে লাগলাম। আমাদের তিনটা বড় লাগেজ ওঠানো হয়ে গেলে নিলয় উঠে পড়লো। সব মিলিয়ে মাত্র দশ থেকে পনের সেকেন্ড সময় লাগলো। আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম। নিজেরদের কর্মে নিজেরাই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তারপর মালপত্র ঠেলে বগির ভিতরে ঢুকলাম। আমাদের সিট নম্বরগুলো পেয়ে গেলাম সহজেই। আমাদের খোপে একপাশে সবার উপরে নিলয়, তারপরেরটায় উর্মি আর সবচেয়ে নিচেরটায় আমি। আমার ঠিক উল্টো পাশে চিং। আমাদের বিশাল বিশাল লাগেজ ঢোকাতেই দুই সিটের মাঝখানের জায়গাটা ভরে গেলো। আগে তাও সিটের তলায় লাগেজ ঢুকেছিলো। এখন সব ফুলে ফেঁপে বড় হয়ে যাওয়ায় আমারটা ছাড়া আর কারওটা সিটের নিচে গেলো না। আমার লাগেজ আর সবার ব্যাকপ্যাকগুলো ঢুকানো হলো সিটের নিচে। নিলয়ের হ্যাভারস্যাক, উর্মি আর চিঙয়ের লাগেজটা রাখা হলো লাইন ধরে দুইসিটের মাঝখানে। আমাদের সব কিছু গোছগাছ করতে করতে ট্রেন ছেড়ে দিলো। একটু গুছিয়ে নিয়ে আমরা ফোন দিয়ে অন্যদের খবর নিলাম। ওরাও অন্য বগি থেকে আমাদের খবর নিলো আমরা ঠিক মত উঠেছি কিনা!

আমি একবার অন্য বগিতে সবার সাথে দেখা করে আসতে চাইলাম। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে টের পাই মাঝে এক বগির দরজা সিল করে দেওয়া। তাই অন্যদের সাথে দেখা না করেই ফিরে আসি। এদিকে চিঙয়ের উপরের সিটটা একজন চমৎকার আংকেলের। উনি ব্যাগ গোছগাছ করতে আমাদের সাহায্য করলেন। ভদ্রলোক সাউথ ইন্ডিয়ান। হিন্দি বোঝেন না। অল্পবিস্তর ইংরেজি জানেন। তাই দিয়ে আমাদের সাথে কথা বলতে লাগলেন। আমাদের কাহিনী শুনে বেশ মজা পেলেন। চিং ওনাকে ইশারায় বললো যে ও রাতের খাবার খেয়েই মাঝের বাংকারটা মেলে দিবে। উনিও হাসিমুখে সায় দিলেন। কিন্তু কয়েক মিনিট পর ঘুমের চোটে ঝিমাতে লাগলেন। চিং তাড়াতাড়ি খেয়ে ওনার বাঙ্কারটা মেলে দিতেই উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি, নিলয় আর উর্মি কিছুক্ষণ কথা বার্তা বলে যার যার জায়গায় শুয়ে পড়লাম। শুয়ে পড়তেই ঘুম চলে আসলো। টের পেলাম প্রচন্ড গতিতে আমাদের নিয়ে ছুটে চলছে এই ট্রেন।

The Mighty INDIA CALLING: গোয়ার পথে ঘাটে সারাদিন ঘোরাঘুরি (পর্ব ২৯)

সকালে ঘুম ভাংলো একটু হৈ চৈয়ে। মজুমদারের ফোনটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ও সারা রুম তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলো। আমাদের সবাইকে জিজ্ঞেস তো করলোই, নিচে গিয়েও সবাইকে বলতে লাগলো ওর ফোনের কথা। ওর ফোনে আমাদের ট্যুরের গাদাখানেক ছবি আছে। ফোন হারিয়ে গেলে তো বেশ চিন্তার বিষয়। যাই হোক হাত মুখ ধুয়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে আমরা ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলাম। সবাই একবার বিচে যাওয়ার প্ল্যান করলাম। সকালবেলার হাল্কা রোদে নিরিবিলি বিচে দাঁড়িয়ে আমরা সমুদ্র দেখতে লাগলাম। খুব ভালো লাগছিলো আমাদের। কিন্তু নাশতা করা হয় নাই। তাই আমরা বেশিক্ষণ থাকলাম না। আবার হোটেলের দিকে রওয়ানা দিলাম।

এদফ
সকালবেলা শান্ত সমুদ্রের পাশে (কৃতজ্ঞতায় রেহনুমা তাবাসসুম অন্তরা)

নাশতা খেতে ঢুকলাম ভিন্সি’স প্লেসে। নাশ্তার মেনু দেখে অর্ডার দিলাম ব্রেড উইথ ফ্রায়েড এগ। আমার পাশে সুমাইয়া দিলো ব্রেড উইথ অমলেট। তারপর অর্ডার আসলে আমি খেলাম সুমাইয়ারটা আর সুমাইয়া খেলো আমারটা। বড় বড় টোস্ট করা পাউরুটির সাথে সুন্দর করে ভাজা ডিম। খেতে ভালোই ছিলো। ওদিকে অন্তরার ফিশ অ্যান্ড চিপসও টেস্ট করে দেখলাম। আমরা খেতে খেতে গল্প করছিলাম। খাওয়া শেষে ৪০ রুপি বিল মিটিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেলাম ভিন্সি’স প্লেস থেকে।

এবার আমরা হাঁটতে লাগলাম রাস্তা ধরে। একম একটা রাস্তা যে রাস্তায় আগে যাই নাই। ধীরে সুস্থে আমরা দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগলাম। গোয়ার ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, মানুষজন- সব কিছু একটু আলাদা। রাস্তা দিয়ে প্রচুর মটর সাইকেল যাচ্ছে। টুরিস্টদের জন্য ২০০-৩০০ রুপি দিয়ে সারাদিনের জন্য একটা মটর সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ গোয়া দেখতে একেবারে সেই রকম ঠিক সিনেমাতে যেমনটা দেখা যায়!  আমাদের সামনে অনেকগুলো দোকানপাট চোখে পড়লো। নানা রকম জুয়েলারি সাজিয়ে রেখেছে দোকানে দোকানে। আমর এদিক ওদিক ঢুঁ মারতে লাগলাম। এক দোকানে ঢুকে সবাই নানা রকম জুয়েলারি পছন্দ করতে লাগলো। সবগুলো দোকানেই দাম একটু বেশি মনে হচ্ছিলো। কিন্তু সেই দোকানে আমাদের সব কিছুরই দাম কমিয়ে দিবে বললো। আমরাও উৎসাহ পেয়ে জিনিসপত্র দেখতে লাগলাম। আমরা সবাই মিলে বেশ কিছু জিনিস কিনলাম। দোকানদার আমাদের সবাইকে একটা করে ছোট আয়না উপহার দিলো। দোকান থেকে বের হতেই রুবাইদার সাথে দেখা হলো। রুবাইদা একটা তালপাতার মেক্সিকান হ্যাট কিনেছে। বিশাল মেক্সিকান হ্যাটটা দেখতে খুবই সুন্দর।

আমরা হাঁটতে হাঁটতেই ঠিক করলাম যে আমাদের কালাঙ্গুটে বিচ থেকে দূরে বাগা বিচের দিকে যাবো। তবে ঠিক বিচ ধরে নয়, রাস্তা ধরে শহর দেখতে দেখতে। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে যাচ্ছে দেখে নিশাতই অফার দিলো গতরাতের ভিক্টোরিয়াতে ঢুঁ মারার জন্য। আমরা হেঁটে হেঁটে ভিক্টোরিয়াতে ঢুকে পড়লাম। অনেক দেখেটেখে অর্ডার দিলাম প্রন নুডুলস। অনেক প্রন দেওয়া গরম গরম নুডুলস আসলো। আমরা খুব মজা করে খেলাম। ১২০ রুপি বিল দিয়ে বের হয়ে আসলাম আমরা। এরপর ডক্টর আলফন্সো রোড ধরে সোজা হাঁটতে লাগলাম আমরা। গোয়ায় ট্যাটু করানোর দোকান আছে প্রচুর। এই দোকানগুলোর বাইরে বড় বড়সব কিলবিলে ট্যাটুর ছবি। আর আছে বাদামের দোকান। শুধুই বাদাম যার বেশির ভাগই কাজু। তবে দাম বেশি। এর চেয়ে অনেক কম দামে আমি মানালি থেকে বাদাম কিনেছি। এই সব দেখতে দেখতেই একটা মোড়ে এসে অনেকগুলো বড় বড় দোকানপাট পেলাম। ব্যাঙ্ক এবং মানি এক্সচেঞ্জের দোকান দেখে নিশাত আর পৃথ্বীর ডলার ভাঙ্গানোর কথা মনে পড়লো। তাই আমরা এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে সবচেয়ে ভালো ডলারের রেট আছে এমন মানি এক্সচেঞ্জ খুঁজতে লাগলাম। এরমধ্যে আমাদের সাথে দেখা হলো ফাহাদ আর তানভীরের। ওরা জুম্মার নামাজ পড়ে এসেছে। ওদের দেখে আমরা বুঝলাম আজকে শুক্রবার!

ওরাও আমাদের সাথে যোগ দিলো। সবাই মিলে একটা কাজুবাদামের দোকানে গিয়ে ডলার ভাঙ্গিয়ে নিলো। ডলার ভাঙ্গানো শেষ হলে আমরা সবাই একসাথে রওয়ানা দিলাম বাগা বিচের দিকে। ক্যাফে মোকার অনেক নাম শুনেছিলাম আমরা। একবার ভাবলাম সেখানে আগে ঘুরে আসি। একটা অটোওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতেই ভাড়া চাইলো ৩০০ রুপি। শুনেই আমরা সেই যাত্রায় মোকা যাবার প্ল্যান বাদ দিয়ে কালাংগুটে- বাগা রোড ধরে হাঁটতে লাগলাম। বেশ কিছুদূর হাঁটার পর ফাহাদ একটা দোকান দেখিয়ে বললো গতরাতে ও এখানে গিয়েছিলো। দোকানটার নাম চকোলেট রুম। আমরাও ঢুকে পড়লাম ভিতরে। দারুন সুন্দর সুন্দর সব ডেজার্ট আইটেম সাজানো সেখানে। কোনটা ছেড়ে কোনটা অর্ডার দিবো বুঝতে পারছিলাম না। শেষে ৮০ রুপির একটা চকোলেট স্মুদি অর্ডার দিলাম। স্মুদিটা এত্ত মজা, আর বলার মত না! নিচের চকোলেটটা এতই মোটা যে খেয়েই শেষ করতে পারলাম না।

খেয়েদেয়ে আবার বের হয়ে এলাম। আবার হাঁটা শুরু করলাম। পথটা খুব ছোট নয়, তার উপর আমরা ধীরে সুস্থে গল্পগুজব করতে করতে হাঁটছিলাম। তাই সময় লাগছিলো অনেক বেশি। পথের দুপাশের দোকানগুলোর জিনিস অনেক সুন্দর। ধাতব জুয়েলারি, মুক্তার নেকলেস, পাথরেরর সেটগুলো অনেক সুন্দর সুন্দর। কিন্তু দামগুলো আকাশ্চুম্বী। আমরা খালি দেখেই যাচ্ছিলাম। কেনার উদ্দেশ্য কারও ছিলো না। এই সব দামী দামী দোকান শেষ হয়ে একসময় যখন সুভেনিয়র শপ, লিকার শপ আর নাইট ক্লাব দেখা যেতে লাগলো তখনই আমরা টের পেলাম যে বিচের কাছাকাছি চলে এসেছি। সত্যি সত্যি একটু পরই বিচ চলে আসলো। গনগনে রোদে দাঁড়িয়ে আমরা সমুদ্রের দেখা পেলাম। আমরা একটু ছায়ায় দাঁড়ালাম আর ফাহাদ আর তানভীর গেলো প্যারাসেইলিং দরদাম করতে। ওরা এসে জানালো ৮০০ রুপি লাগবে, মানুষ যত বেশিই হোক- দাম বাড়বে বা কমবে না।

এই বিচের মধ্যে দাঁড়িয়ে না থেকে আমরা ঢুকে পড়লাম একটা শ্যাকে যার নাম ‘ফ্রেশ বিচ সাইড শ্যাক’। সবাই মিলে অর্ডার দিলাম পাস্তা, রেড স্ন্যাপার ফ্রাই আর স্লাইস। অর্ডার আসতে আসতে আমি টুরিস্টদের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। ভারতীয় পর্যটক ছাড়াও গোয়ায় প্রচুর বিদেশি পর্যটক আসে। এদের বড় অংশ সম্ভবত রাশিয়ান কারণ অনেক দোকানের সাইনবোর্ডে রাশিয়ান ভাষায় লিখা দেখেছি। আর বেশির ভাগ পর্যটকই বয়সে তরুন। মধ্য বয়স্ক বা একটু বয়স্ক লোকের সংখ্যা কম। পরিবার নিয়ে আসা লোক মনে হলো খুবই কম। সবাই মোটামুটি বন্ধুবান্ধবের দল নিয়েই বেশি এসেছে। এসব দেখে মনে হলো গোয়া প্রধানত ‘ফুর্তি’ করার জায়গা। বিকালের তীব্র রোদে আমরা মজাদার মাছ ভাজা খেতে খেতে হাসি আড্ডায় মেতে উঠলাম। ফাহাদ একের পর এক কথাবার্তা বলে যেতেই লাগলো আর আমরা হা হা করে হাসতে লাগলাম।

সেফ
বাগা বিচের ছোটখাটো শ্যাক (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

খাওয়া দাওয়া শেষ করে সূর্যের তেজ কমলে আমরা বের হয়ে গেলাম। সমুদ্রের পানিতে পায়ের পাতা ডুবিয়ে হাঁটতে লাগলাম। এগিয়ে যেতে লাগলাম আমাদের কালাঙ্গুটে বিচের দিকে। রাস্তাটা নেহায়েত কম নয়। তাই আমরা হাঁটতে হাঁটতেই সূর্যটার ডোবার সময় হয়ে এলো। দিনের আলোতে সব কিছু দেখে চিনতে পারি। কিন্তু অন্ধকারে আমাদের হোটেলের সামনের বিচটা কেমন করে চিনতে পারবো সেটা নিয়ে চিন্তা করে আমরা পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু লাভ হলো না। একটু পরেই সূর্য ডুবে গেলো। আমরা জোরে জোরে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে অবাক হয়ে দেখলাম সূর্য ডোবার সাথে সাথেই সবগুলো শ্যাক থেকে চেয়ার টেবিল ধরে ধরে বাইরে খোলা আকাশের নিচে নিয়ে আসা হলো। প্রত্যেকটা টেবিলে একটা করে মোমবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। আর শ্যাকগুলোতে রংচঙ্গে বাতি জ্বলে উঠলো। দূর থেকে দেখতে ভারী সুন্দর লাগছিলো। এই দেখতে দেখতে আমরা এক সময় আমাদের হোটেলের কাছাকাছি বিচে চলে আসলাম বলে মনে হলো। সত্যি সত্যি ভালোমত খোঁজাখুঁজি করে পেয়ে গেলাম আমাদের গলিটা।

অন্ধকার হয়ে গেলেও হোটেলে ফিরে যেতে মন চাচ্ছিলো না। আমি আর সুমাইয়া একটা বিচ চেয়ারে বসে গান শুনতে লাগলাম। সুমাইয়ার মোবাইলে চলতে লাগলো, ‘মোর ভাবনারে কে হাওয়ায় মাতালো-’ । আধো অন্ধকার রাতে সমুদ্রের গর্জনের সাথে স্নিগ্ধ লোনা বাতাসে আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। আমরা ঠান্ডা বালিতে পা ডুবিয়ে অনেক্ষণ গল্প করলাম। সবসময় যে গল্প করলাম তা নয়, কখনো কখনো চুপ করে রইলাম দুইজনে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম অন্ধকার সমুদ্রের বিরামহীন আছড়ে পড়া ঢেউ। আমার কখনও রাতের সমুদ্র দেখার ভাগ্য হয় নাই। এই প্রথম অন্ধকারে সমুদ্রের অন্য এক রূপ দেখতে পেলাম। এইভাবে বসে থাকতে থাকতে অনেক সময় পার হয়ে গেলো। আমাদের মোটেও উঠতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না। কিন্তু রাত আটটা বেজে পার হয়ে গেছে। হোটেলে ফির যাওয়া প্রয়োজন। আমি আর সুমাইয়া উঠে পড়লাম। অন্ধকারে বালি পাড়িয়ে বিচ ছেড়ে ঢুকে গেলাম গলির ভেতর। হাঁটতে লাগলাম সোজা, হোটেলের উদ্দেশ্যে।

প্রথমেই হোটেলে না ঢুকে গেলাম ভিন্সি’স প্লেসে। রুবাইদাকে পেলাম সেখানে। কোনকিছু চিন্তা না করেই অর্ডার দিলাম মাশ্রুম ক্রিম পাস্তা। আবারও সেই মজাদার পাস্তা আসলো। গপাগপ খেতে লাগলাম আমি। এখানকার খাবারদাবার এত মজা যে কি আর বলবো!

খাওয়া শেষ করে সোজা হোটেলে ফিরে গেলাম। আগামীকাল প্যারাসেইলিং এর প্ল্যান করে সবাই ঘুমাতে গেলাম আমরা। আমি আবারও ফ্লোরে সটান হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সমুদ্রের বাতাসে আমার ঘুম ভালোই হতে লাগলো।

 

The Mighty INDIA CALLING: সুনীল সাগরের গোয়ায় পদার্পন এবং গোয়েলের বিদায় (পর্ব ২৮)

খুব ভোরে গোয়েল আমাদের নিয়ে এক বাজারের মতন জায়গায় থামে। আমাদের সবাইকে ডাকাডাকি করে উঠিয়ে দেওয়া হলো। আমরা ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙ্গে বাস থেকে নেমে দেখি গ্রামের একটা ছোট্ট বাজারে এসে পড়েছি। এখনও কোন দোকানপাট খুলে নাই। এখানে থেমে আমাদের কি লাভ হলো বুঝতে পারছিলাম না। কমিটির লোকজন আমাদের জানালো সামনে আর কোন থামার জায়গা নাই। তাই এখানেই ফ্রেশ হয়ে নিতে হবে। কি আর করা, আমরা জনমানবশূন্য এক বাজারের মধ্য দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

সন্ধান পেলাম এক বাথরুমের। মেয়েদের জন্য একটা জায়গায় লাইন, একটু পাশেই ছেলেদের লাইন অন্য একটা বাথরুমের জন্য। মেয়েদের লাইনে আমি মোটামুটি মাঝের দিকেই দাঁড়ালাম। লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম, একেকজন আতংকজনক চেহারা নিয়ে বাথরুম থেকে বের হচ্ছে। আমরা লাইনে যারা ছিলাম সবাই ভয় পেয়ে গেলাম, এতই খারাপ অবস্থা বাথরুমের! লাইনে একটু সামনে দাঁড়ানো নোভা সবার কাছ থেকে অভিজ্ঞতা শুনে আমাদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিলো যে, এখানে দুইটা বাথরুম আছে। একটা খুব খারাপ, আরেকটা একটু কম খারাপ। আমরা খুব খারাপটাতে না গিয়ে একটু কম খারাপটাতে যাচ্ছি। তবে সেটার অবস্থাই এত খারাপ যে কেউ কিছু বলতে রাজি হচ্ছে না! আমি এই ফাঁকে ছেলেদের লাইনের দিকে গিয়ে খবর নিয়ে আসলাম ওদের বাথরুমের অবস্থা কেমন? আমাকে জাফর বললো, ‘এদিকের কথা জিজ্ঞেস করার কথা চিন্তাও করিস না’। আমি আর জিজ্ঞেস না করে চলে আসলাম।

যাই হোক একে একে সবাই আমরা ভয়ংকর এই পর্বটা শেষ করলাম। তারপর আমি গেলাম দাঁত মাজতে। রাস্তার পাশে ক্ষেতের ধারে একটা পানির কল পেলাম। কিন্তু কলটা বড়ই অদ্ভূত! সাধারণত কল ছাড়লে পানি উপর থেকে নিচে পড়ে, কিন্তু এই কল ছাড়লে পানি ডান থেকে বামে আড়াআড়িভাবে বের হয়। কল ছেড়ে মুখ ধুতে গিয়ে আমি প্রায় পুরো ভিজে গেলাম। আরও অনেকেই আসলো দাঁত মাজতে, আমি তাদের সবাইকে সাবধান করে দিলাম এই অদ্ভূত কলের ব্যাপারে। তাতেও খুব লাভ হলো না, কয়েকজন আবার আমার মতই ভিজে গেলো!

হাতমুখ ধোয়া শেষে যখন আবার রাস্তায় এসে উঠলাম, ততক্ষণে দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে। আমি একটা দোকান থেকে কেক আর বিস্কুট কিনে নিলাম। এই দিয়ে নাশতা সারতে হবে। আমরা যখন কেক খাচ্ছিলাম তখন কোথা থেকে যেন এক বাস ভর্তি স্কুলের ছাত্রীরা এসে হাজির হলো। ইউনিফর্ম দেখে মনে হলো, গ্রামের কোন স্কুল হবে- হয় তো পিকনিক করতে বের হয়েছে। আমাদের মেয়েদের লাইন তখনও শেষ হয় নাই। আমরা মনে মনে হাসলাম, এদের তো অনেক দেরি হবে। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে ওরা সবাই আরেকটা যে বাথরুম আছে ‘খুব খারাপ’, সেটাতে লাইন ধরে ঢুকতে লাগলো। মনে হলো আমরা সবাই মিলে কেন এক লাইনে দাঁড়িয়ে আছি সেইটা নিয়ে ওরা বেশ অবাক হয়ে গেলো!

খাওয়া শেষ করেই আমরা আবার দৌড়ে বাসে উঠলাম। মাইশার ফল কিনতে একটু দেরি হয়ে যাচ্ছিলো দেখে নিলয় দৌড় দিয়ে তাগাদা দিয়ে ওদের নিয়ে আসলো। আমাদের বাস আবার ছেড়ে দিলো। এবং বরাবরের মতই আমরা চলতে শুরু করলাম। আস্তে আস্তে কড়া রোদ বাড়তে লাগলো। বাসের এক পাশের জানালা দিয়ে গনগনে রোদ ঢুকতে লাগলো। আমরা সবাই যার যার কম্বল দিয়ে জানালা ব্লক করে দিলাম। কয়েকদিন আগেও কম্বলটা জড়িয়ে এই বাসের মধ্যেই ঘুমিয়েছি, আর এখন কম্বলটা দিয়েই রোদ আটকিয়ে গরম কমানোর চেষ্টা করছি, কি অদ্ভূত!

গুগল ম্যাপে যখন থেকে দেখাতে লাগলো গোয়ায় ঢুকে পড়েছি, তখন থেকেই চারপাশের দৃশ্যপট বদলে গেলো। সরু রাস্তা, দুপাশে দোতলা তিনতলা বাড়ি, অন্যরকম চেহারার মানুষজন আর প্রচুর সাদা চামড়ার টুরিস্ট দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম। এক পর্যায়ে আমাদের বাস এসে থামলো এক জায়গায়। কমিটির লোকজন হোটেলের খোঁজ খবর নিতে গেলো। আমরা অনেক্ষণ বাসে বসে রইলাম। তারপর গ্রিন সিগনাল পেয়ে সব মালপত্র নিয়ে নেমে পড়লাম গোয়েল থেকে। আমার একটা সোয়েটার ইচ্ছা করেই রেখে দিলাম গোয়েলে। আর একবার হার্ডব্রেক করার সময় প্যাকেটের ভিতর থেকে সুভেনিয়র হিসেবে রেখে দেওয়া ক্যাফে কফি ডের বেলজিয়ান চকো শটের ছোট্ট গ্লাসটা ছিটকে পড়ে গিয়েছিল। ঐটা আর খুঁজে পেলাম না। এই দুইটা জিনিস ছাড়াই হাজির হলাম গোয়েলের পিছনে লাগেজ নেওয়ার জন্য। শেষবারের মত পাংকু হেল্পার আমাদের লাগেজ নামিয়ে দিলো। গোয়েলকে টাটা বাই জানিয়ে কাঁধে হ্যান্ড ব্যাগ, পিঠে ব্যাগ প্যাক, হাতে খাবারের প্যাকেট আর বড় লাগেজ- এই চারটা জিনিস নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। কাঁচা এবড়ো থেবড়ো রাস্তা দিয়ে ট্রলি ব্যাগটা টানতে টানতে কয়েক কদম সামনে যেতেই হাঁপিয়ে গেলাম।

দে
আমাদের গোয়েল (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

দীর্ঘদিন পর সব লাগেজ একসাথে নিয়ে হাঁটছি, তাও আবার কাঁচা রাস্তায়! দম সব বের হয়ে গেলো। কিন্তু বসে থাকলে তো চলবে না, জোরে নিশ্বাস নিয়ে আবার হাঁটতে লাগলাম। আশেপাশে দেখতে লাগলাম সবারই প্রায় একই অবস্থা। আর দূরত্বটাও নেহায়েত কম নয়, গলির পর গলি হেঁটে যেতে লাগলাম। রাস্তা যেন শেষ হয় না। লাগেজ টানতে টানতে যখন হাতে লাল টকটকে দাগ পড়ে হাত অবশ হয়ে গেলো, পায়ের মাংসপেশী যখন টনটন করতে লাগলো, পরিশ্রমের চোটে আমাদের গাল, মুখ, চোখ যখন লাল হয়ে গেলো- তখন এক চিপার মধ্যে আমাদের রেস্ট হাউজের সন্ধান মিললো। একটা চিপা দিয়ে ঢুকলে ছোট্ট একটা উঠান, তার এক পাশে এক তলা একটা বাড়ি আর অন্য পাশে দোতলা একটা বাড়ি। একতলা বাড়িটাতে দুইটা রুম, দুইটাই ছেলেদের। আর দোতলা বাড়িটাতে মোট চারটা রুম, চারটাই মেয়েদের। আমি এসে দেখি নিচ তলার রুম দুইটায় অলরেডি মায়িশারা আর উর্মিরা উঠে পড়েছে। এই ভারি লাগেজ সিড়ি দিয়ে টেনে টেনে দোতলায় তুলে প্রথম রুমটাতেই ঢুকে আমি বিছানায় ধড়াম করে পড়ে গেলাম।

বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতেই দেখলাম মিম আর অন্তরা এসে বললো ওরাও এই রুমে থাকবে, প্রত্যেক রুমে বরাদ্দ ছয় জন করে। ওরাও মাল পত্র রেখে আমার মত ফ্ল্যাট হয়ে বিছানায় পড়ে গেলো। একে একে মৌলি, মজুমদার, রুবাইদা- সবাই এলো। মৌলি আর মজুমদার চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘গরম কাপড় সব ফেলে দিবো, সঅঅঅব- এই ব্যাগ টানা সম্ভব না’। আমরা খানিকটা ধাতস্থ হয়ে খেয়াল করলাম রুমটা মোটামুটি বড়। ডবল বেডটায় চারজন শোয়া যাবে আর বাকি দুইজনকে ফ্লোরিং করতে হবে। রুমে একটা এসিও আছে দেখে আমরা বেশ খুশি হয়ে গেলাম। বাথরুমটাও চমৎকার আর এই প্রথম কোন বাথরুমে আমরা হ্যান্ড হোস পাইপ পেলাম। আমরা যখন এইসব গবেষণা করছিলাম তখন রিন্তু এসে হাজির হলো। ওকেও এই রুমে থাকার জন্য পাঠানো হয়েছে। সব মিলিয়ে আমরা হলাম সাতজন!

ঝটপট করে আমরা আমাদের লাগেজ খুলে জামাকাপড় বের করে নিলাম। এতদিন পড়ে থাকা কেডসটাকে বারান্দায় দিলাম শুকানোর জন্য। বের করে নিলাম স্পঞ্জের স্যান্ডেল। সকল জিনস বাদ দিয়ে পায়জামা বের করে নিলাম। জামার সাথে পায়জামা আর স্কার্ফের কোন মিল নাই, কিন্তু তাতে কি? একটা হলেই হলো! এর মধ্যে আমি লক্ষ করলাম আমার হাত আর পায়ে বড় বড় জায়গা জুড়ে নতুন চামড়া উঠছে। মিম হাসি মুখে বললো, ‘পরিশ্রমের ঠ্যালায় তোর নরম চামড়া পড়ে গিয়ে শক্ত চামড়া উঠছে। তবে দেশে গিয়ে যখন আবার পরিশ্রম বন্ধ করে দিবি তখন আবার এই শক্ত চামড়া পড়ে গিয়ে নরম চামড়া উঠবে’। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। একটু ফ্রেশ হয়েই সবাই খাওয়া দাওয়ার জন্য বের হয়ে পড়লাম। আমাদের চিপাটার সামনেই ‘ভিন্সি’স প্লেস’ এ গেলাম সবাই মিলে।  গিয়ে চটপট একটা টেবিলে বসলাম। কি অর্ডার দিবো না দিবো ভাবতে ভাবতেই শুভ এগিয়ে আসলো। প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দিলো কড়কড়ে এক হাজার রুপির নোট। খুশিতে আমরা চিৎকার দিয়ে উঠলাম! শুভ জানালো এটাই ওর ‘গোয়ার সারপ্রাইজ’। শুনে রুবাইদা বলে উঠলো, ‘সত্যিই খুশিতে চোখে পানি চলে আসছে’। এতদিন ধরে চলতে চলতে অনেকেরই টাকা পয়সায় টানাটানি পড়ে যাচ্ছে। গোয়ায় এমনিতেও সব কিছু একটু দামি, সেখানে হুট করে এক হাজার রুপি পাওয়া বিশাল ব্যাপার!

আমি আর অন্তরা ভেবে চিন্তে অর্ডার দিলাম ২২০ রুপির প্রন থালি। সমুদ্রের কাছাকাছি জায়গায় এসে মাছ জাতীয় খাবার খেতেই মন চাইলো। খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, তাড়াতাড়িই চলে আসলো প্রন থালি। চিংড়ি মাছের তিন রকমের পদ আর সাথে ভাত। মুখে দিয়েই মুগ্ধ হয়ে গেলাম, এত মজার খাবার! একটা পদ ছিলো ছোট চিংড়ি মাছকে সামুদ্রিক মাছের ডিম দিয়ে মাখিয়ে মচমচে ফ্রাই। খেতে এতই মজা ছিলো, কি আর বলবো- আমি আর অন্তরা কোন কথাবার্তা না বলে গপাগপ খেতে লাগলাম।  আশেপাশে যারা ছিলো তারা সবাই নিজেরদেরটা খেয়ে টেস্ট খুবই হাই ক্লাস বলতে লাগলো। আমি বুঝলাম, গোয়ার খাবারের দাম যেমন বেশি, টেস্টটাও সেইরকমই!

ভরপেট খাওয়া দাওয়া করে আমরা বিচে ঘুরতে গেলাম। আমরা যেই জায়গাটায় আছি সেটার কাছাকাছি যে বিচটা সেটার নাম কালাংগুটে বিচ। বলতে গেলে আমাদের রেস্ট হাউজ থেকে খুবই কাছে, দুই মিনিটের হাঁটা পথ। সবাই দল বেঁধে বিচে গেলাম। মোটামুটি শান্ত বিচ, তেমন কোন ভিড়ভাট্টা নাই। সবাই নামতে শুরু করলো পানিতে। জোয়ারের সময়, তাই চিন্তার কিছু নাই। তার উপর সমুদ্রে সেফ জোনের মোটামুটি একটা সীমানা টানা আছে, সেই সীমানা ক্রস করলেই লাইফ গার্ড টাইপের লোকজন বাশি ফুঁ দিতে দিতে চলে আসে। বিশাল সমুদ্রের ঢেউয়ের ঝাপটায় আমাদের সব ক্লান্তি মুছে গেলো নিমেষেই।  আমি পায়ের গোড়ালি ভিজিয়ে বিচ ধরে হাঁটতে লাগলাম। গোয়ার বিচটা কক্সবাজারের মত এত সুন্দর বলে মনে হলো না। তবে বিচে অনেক রকম অ্যাক্টিভিটি করার সুযোগ আছে, যেমন প্যারাসেইলিং, ওয়াটার স্কুটার, স্পিডবোট ট্রিপ, ব্যানানা রাইডিং সহ আরও অনেক কিছু। বিচ দিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট জিপ গাড়ির মত এক ধরনের গাড়ি। আর একেবারেই বিচের পাশেই বড় বড় শ্যাক। সেখানে সি ফুডের পাশাপাশি নানা রকম অ্যালকোহলের বোতলও সাজিয়ে রাখা হয়েছে সুন্দর করে। এই সব কিছু মিলে বিচটাকে আকর্ষনীয় করে তুলেছে। কিন্তু কক্সবাজারকে আমার মনে হয়েছে আলগা জিনিসপাতি দিয়ে আকর্ষনীয় করার দরকার নাই, সে নিজেই চমৎকার!

এর মধ্যে আমাদের কয়েকজন দেখলাম স্পিড বোটওয়ালার সাথে দরাদরি করছে। বোট ঠিক হয়ে গেলে আমরাও উঠে পড়লাম। প্রত্যেকের জন্য আলাদা সিট, সাথে আবার লাইফ জ্যাকেট পড়ে বসতে হয়। আমাদের নিয়ে বোট ঘুরে আসলো কয়েক মিনিট। বোট থেকে নেমে আমরা ভাড়া মিটিয়ে দিলাম পার হেড ৮০ রুপি করে। আবার গোড়ালি পানির উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে কালাংগুটে বিচের দিকে যেতে লাগলাম। গিয়ে শুনলাম ঢেউয়ের ঝাপ্টা ফাহাদের পকেট থেকে সানগ্লাস আর নিলয়ের পকেট থেকে হোটেল রুমের চাবি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আমরা এই নিয়ে বেশ হাসাহাসি করলাম। ততক্ষনে সূর্য প্রায় ঢলে পড়েছে। সবাই মিলে সূর্যাস্ত দেখলাম। বিশাল কমলা আকাশে টুপ করেই হারিয়ে গেলো ছোট সূর্যটা। সবার জামাকাপড়ই ভেজা, আর লবন বালিতে শরীর কুটকুট করতে লাগলো। সবাই সময় নষ্ট না করে রওয়ানা দিলো হোটেলের উদ্দেশ্যে।

দফচ
গোয়ার সমুদ্রে সূর্যাস্ত (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

রুমে গিয়েই সবার আগে মৌলি গোসলে ঢুকলো। তারপর মজুমদার। মজুমদারের গোসল অর্ধেক হওয়ার পর পানি শেষ হয়ে গেলো। ও বাথরুম থেকে চিৎকার করতে লাগলো পানির জন্য। আমি পাশের রুমে গেলাম। গিয়ে শুনলাম ওদের বাথরুমে বাসিরুনও গোসল করতে গিয়ে পানির অভাবে আটকা পড়ে আছে। বারান্দা দিয়ে নিচে তাকিয়ে ছেলেদের ডাকাডাকি করলাম। কৌশিক বের হয়ে আসলো। ও বললো কলে পানি নাই, কিন্তু আধা বালতি পানি আছে। চাইলে সেটাই নিতে পারি। কি আর করা তাই নিতে রাজি হলাম। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে আসতে দেখলাম শান্ত মুখে ফেসপ্যাক লাগিয়ে বসে আছে। আমি পানি নিয়ে যাচ্ছি দেখে ও বললো ওর নাকি মুখ ধুতেই এই পানি লাগবে।  এই নিয়ে কথা বার্তা হতে হতেই উপর থেকে খবর আসলো যে কলে পানি চলে এসেছে।

একে একে আমরা সবাই গোসল করলাম। আমরা গোসল শেষে সব কাপড় চোপড় ধুয়ে বারান্দায় মেলে দিলাম। এই প্রথম কোন জায়গায় আমরা স্বাধীনভাবে ধোয়া কাপড় মেলে শুকাতে দিতে পারছি। কাপড় মেলে দিতে দিতে যখন পুরো বারান্দা ভরে গেলো তখন আমরা সিঁড়ির রেলিংগুলোতেও কাপড় মেলে দিতে লাগলাম। গোসল এবং কাপড় চোপড় ধোয়ার ফলে বাথরুমে বালির স্তুপ জমে গেলো আর সারা রুম কেমন কাদাকাদা হয়ে গেলো। সবার শেষে বাকি ছিলো রুবাইদা। ও বললো ও ই নাকি সারা রুম গুছিয়ে পরিষ্কার করে দিবে। আমরা ওর গোসল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইলাম, কিন্তু ও আমাদের সবাইকে ঘুরে আসার জন্য বললো। আমি বিপদ আপদের কথা তুলতেই সাহসী রুবাইদা সেগুলো হেসেই উড়িয়ে দিলো। আমরা বললাম তারপরও আমরা দূরে কোথাও যাচ্ছি না, আমাদের বাকি লোকজনের জন্য আরেকটা যে রেস্ট হাউজ আছে সেটাতেই যাচ্ছি। একটু পর চলে আসবো।

আমাদের বারান্দা থেকেই দেখা যায় আরেকটা রেস্ট হাউজ। রাস্তায় নেমে হাতের বাম পাশে কয়েকটা বাসা পার হলেই চলে আসে সেই বিল্ডিঙ্গটা। নিচ তলায় আমাদের কেউ নাই। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। নিশাত তখনও রেডি হয় নাই। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিশাত, তমা, পৃথ্বীদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে দেশে ফোন দিলাম। আম্মুর সাথে কথা বললাম। আম্মু বারবার সমুদ্র থেকে দূরে থাকার জন্য সাবধান করে দিলো। বাসার সবার কথা জিজ্ঞেস করলাম। শুনলাম ভাতিজা ছোট্ট ওয়াফির জন্য ওর মামি একটা খেলনা এনে দিয়েছে সেইটা নিয়ে ও এখন সারাদিন ব্যস্ত থাকে।

ওদিকে নিশাত, তমা আর পৃথ্বীর হয়ে যেতেই আমরা নেমে পড়লাম। আমি আবার আমাদের রেস্ট হাউজে ছুটে গেলাম রুবাইদার জন্য। গিয়ে দেখি এলাহি কারবার! রুবাইদা ওর রিজেক্টেড জামাকাপড় সব বের করে একটা জামা দিয়ে সারা রুম মুছে চকচকে করে ফেলেছে। একটা পাতলা সোয়েটার রেখেছে বাথরুমের সামনে পাপোশ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। সবার এলোমেলো লাগেজ সব এক পাশে সরিয়ে ফ্লোরে শোবার জন্য বন্দোবস্ত করে রেখেছে। এত কিছু করতে গিয়ে ওর গোসলে যাওয়াই হয় নাই। আমি রুমে থাকতে চাইলেও আমাকে ও জোর করে ডিনার খাওয়ার জন্য রিন্তু, তমাদের সাথে পাঠিয়ে দিলো। কি আর করা, রুবাইদাকে ছাড়াই আমরা খেতে চলে গেলাম।

আমরা সবাই মিলে হাঁটতে লাগলাম রাস্তা দিয়ে। চিপা চিপা অন্ধকার গলি গলি রাস্তাগুলো দেখতে সুবিধার লাগে না। অনেক ডান বামে ঘুরে শেষমেশ আমাদের গোয়েল যেখানে নামিয়ে দিয়েছিলো সেখানে পৌঁছে একটা সুন্দর রেস্টুরেন্ট পেলাম যার নাম ‘ভিক্টোরিয়া হোটেল’। কোন একটা বাড়ির উঠানে ছনের ছাউনি দিয়ে সুন্দর টেবিল চেয়ার পাতা আছে। বেশ ঘরোয়া পরিবেশ। ঢুকেই দেখি পাশের টেবিলে রিজভী, তুষার, জেরিন, আদিবা, আফরা- ওরা বসে আছে। আমরাও চটপট অর্ডার দিলাম। আমি শেয়ারে নিলাম মিক্সড ফ্রায়েড রাইস আর প্রণ চিলি। মিম নিলো কালামারি। আমরা সবাই এক জন আরেকজনেরটা শেয়ার করলাম। রান্না খুবই মজা ছিলো। আমরা গোয়ার রান্নার প্রেমে পড়ে গেলাম। হাসি আর গল্পগুজবের মধ্যে আমাদের খাওয়া শেষ হলো। আমার ভাগে বিল আসলো ১৫৮ রুপি। সব বিল মিটিয়ে দিয়ে আমরা বের হয়ে আসলাম। আমাদের আরও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করার শখ ছিলো। কিন্তু নির্জন অন্ধকার রাস্তাঘাট দেখে আর ঘুরতে ইচ্ছা হলো না। আমরা আবার হেঁটে হেঁটে আমাদের হোটেলের দিকে যেতে লাগলাম।

আবার সেই অন্ধকার গলিঘুপচি দিয়ে যেতে যেতে এক সময় আমাদের মনে হলো, ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি তো? ভালো করে ডান বাম দেখে হাঁটতে হাঁটতে একসময় দেখা হলো সুমাইয়া, রাফাত আর শান্তর সাথে। ওদের কাছে শুনলাম, কৌশিক হাতে একটা ড্রাগন ট্যাটু করিয়েছে। রাফাত ওর মোবাইলে ভিডিও দেখালো। আমরা দেখলাম ড্রিল মেশিনের নিচে হাত রেখে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিচ্ছে কৌশিক। তারপর সুমাইয়া আমাদের সাথে যোগ দিলো। আমরা সবাই একসাথে ভিন্সি’স প্লেসে ঢুকলাম। দেখি রুবাইদা সুন্দর একটা টেবিলে একা বসে আছে। আমরা গিয়ে যোগ দিলাম ওর টেবিলে। ও নাকি কি এক পাস্তা অর্ডার দিয়েছে। অর্ডার নেয় যে লোকটা সে ওকে বলেছে আমাদের সবাই নাকি এটাই নিচ্ছে।

ওর অর্ডার আসলে আমরা একটু টেস্ট করে দেখলাম। অসাধারণ টেস্ট! আমি চটপট একটা অর্ডার দিয়ে দিলাম, ‘মাশ্রুম ক্রিম পাস্তা’। আমি সাধারনত শখ করে পাস্তা খাই না। কিন্তু এই পাস্তাটা এতো মজা যে আমি ভরা পেটেও শেয়ারে একটা অর্ডার দিয়ে ফেললাম। বিশাল এক থালা ভর্তি শশা দিয়ে সাজানো সাদা ক্রিমে মাখানো পাস্তা এসে হাজির হলো। পুরো ট্যুরে এই প্রথম কোন এক জায়গায় আমি শশা পেলাম। এই দেশে সবাই সালাদ বলতে পিয়াজ অথবা মুলা কুচিকে বোঝে। শশা বা টমেটু যে সালাদ হিসেবে খাওয়া যায় সেটা এরা জানেই না। বহুদিন পর শশা পেয়ে ঝাপিয়ে পড়লাম আমি। পাস্তা মুখে দেওয়ার আগেই শশাগুলো চিবাতে লাগলাম। আর মজাদার পাস্তাটার কথা আর নাই বা বললাম- আমি পাস্তার সাথে সাথে নিজের প্লেটের সব শশা শেষ করে সুমাইয়ার প্লেটের শশাগুলোও খেয়ে ফেললাম। খাওয়া শেষে চেখে দেখলাম সি ফুড সুপ। উফ, সুপটাও এত্ত মজা-

পেট ওভার লোডেড করে আমরা যার যার রুমে ফেরত আসলাম। নিশাতের রুমের চাবি অন্যের কাছে। ওরা এখনও আসে নাই। তাই বললাম নিশাতকে আমাদের সাথে থেকে যেতে। আমাদের এক্সট্রা তোষক দিয়ে গেছে। নিচে আমরা ফ্লোরিং করলাম। রুবাইদা এক পাশে, আমি, নিশাত আর রিন্তু আরেক পাশে। সারা দিনে কম কষ্ট হয় নাই। তাই বেশি দেরি হলো না, ঘুম চলে আসলো।