The Mighty INDIA CALLING: গোলাপি শহরে আকাশের কাছাকাছি আম্বর ফোর্ট এবং জয়গড় ফোর্টে (পর্ব ১৮)

সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখলাম মৌলি গোসলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কলে গরম পানি নাই। এই জন্য ওর দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রুম সার্ভিসে ফোন দিয়ে জানলাম ওদের এখানে বয়লার দিয়ে পানি গরম হয়। সেজন্য প্রায় ঘন্টা খানেক আগে জানাতে হয়। কিন্তু আমাদের হাতে তো অত সময় নাই। প্রথমে মৌলি গোসল করলো। তারপর মজুমদার অনেক কষ্ট করে গোসল করে এসে বললো ভীষন ঠান্ডা পানি। ঠান্ডা পানির কথে শুনে আমি গোসল করার চিন্তা ভাবনা জলাঞ্জলি দিলাম। গরম পানি না পেলে এই ঠান্ডায় আমি কোনভাবেই গোসল করবো না।

আমি আর রুবাইদা বের হয়ে পড়লাম নাশতা খাওয়ার জন্য। আমাদের হোটেলটা একটা আবাসিক এলাকার মাঝখানে। আশেপাশে সব বাসাবাড়ি। কাছাকাছি কোন হোটেল টোটেল নাই। হোটেলের সামনেই এক লোককে দেখলাম ঠেলাগাড়ি নিয়ে বসে আছে। তার গাড়িতে কড়াই, চুলা এইসব সাজানো। রুবাইদা জিজ্ঞেস করেতেই লোকটা জানালো উনি রুটি আর তরকারি বিক্রি করেন। আশেপাশে কোন খাওয়ার দোকানের সন্ধান না পেয়ে শেষমেষ সেই ঠেলাগাড়ির লোকটাকেই বললাম চারটা রুটি আর তরকারি দিতে। উনি আমাদের সামনেই কড়াই ধুয়ে পরিষ্কার করলেন। তারপর পলিথিনের প্যাকেট থেকে কাঁচা কতগুলা সাদা রঙের রুটি বের করে অল্প তেলে ভাজতে লাগলেন। রুটিগুলো অদ্ভূত। ছোট সাইজের ওভাল শেপের রুটি। অনেকটা নান রুটির মত কিন্তু নান রুটি না। তারপর আরেকটা পাত্রে মটর টাইপের একটা জিনিস দেওয়া তরকারি গরম করে দিলেন। তারপর ওয়ান টাইম ইউজ বাটিতে ঢেলে উপরে পিয়াজ কুচি ছড়িয়ে আমাদের সামনে এনে দিলেন। আমরা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই রুটি দিয়ে তরকারি খেলাম। তরকারিটা অত মজা না। তবে খেতে খারাপও না। আমাদের দেখা দেখি অনেকে হোটেল থেকে বের হয়ে সেই রুটি তরকারি অর্ডার দিলো। তারপর রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাশতা খেতে লাগলো।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা গোয়েলে উঠে পড়লাম। আমাদের বাস চলতে শুরু করলো। ঠিক আগের মতনই আমাদের ড্রাইভার আরেক গাইডের কথা বললো। এবার আমাদের কমিটি উনাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলো আমরা বড় প্যাকেজে যাবো না। তবে যদি শুধু  একজন গাইড থাকে তাহলে আমাদের তেমন সমস্যা নাই। তারপর আমাদের বাসে উঠলো হাফ সোয়েটার পরা একজন লোক। আগের বারের লোকটার মত ধুরন্দর চেহারা উনার নাই। তবে উনি আমাদের সামনে এসে কি সব জানি বলতে লাগলো। উনার ভাষাও আমরা বুঝতে পারলাম না। অত্যন্ত বোরিং সেই কথাবার্তা শুনে আমাদের বিরক্তি ধরে গেলো। আমি সৌরভকে বিরক্ত হয়ে বললাম, কেন আমরা পয়সা দিয়ে এইসব ফাউল লোকজন হায়ার করছি ? জবাবে সৌরভ জানালো, গাইড গাইডের মত থাকবে আর আমরা আমাদের মত থাকবো। এই গাইড রাখার একমাত্র কারণ হচ্ছে ড্রাইভারকে না চটানো। সো সামান্য টাকা খরচ হলেও কমিটি এই এক্টামাত্র কারণে এই ফালতু গাইডকে রাখা হয়েছে।

গাইড আমাদের প্রথমে নিয়ে গেলো পাহাড়ের উপর বিড়লা টেম্পলে। সাদা রঙের মার্বেলের টেম্পলটার মাথায় তিন রকমের শিখরা। একটা মন্দিরের, একটা মসজিদের, অন্যটা গুরুদোয়ারার। বিড়লা কোম্পানির মালিক তার বাবা মার স্মরণে এই টেম্পলটা বানিয়ে দিয়েছে। আমরা ভিতরে ঢুকে দেখলাম স্টেজের উপর পর্দা টানানো, আর সবাই চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ ঘন্টা বাজলো। হুশ করে পর্দা সরে গেলো। স্টেজের উপর দুইটা মুর্তি দেখতে পেলাম (সম্ভবত লক্ষী-নারায়ন)। আর সাথে সাথেই গান শুরু হলো। সবাই দাঁড়িয়ে পড়লো, সামনে এগিয়ে গেলো আর দুলে দুলে গানের সাথে গলা মেলাতে লাগলো। তারপর পুরোহিত এক ধরনের পানি সবার দিকে ছিটিয়ে দিতে লাগলেন। আমরা একেবারে পিছনে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখতে লাগলাম। তারপর তাড়াতাড়ি করে মন্দির থেকে বের হয়ে আসলাম। বের হতে হতেই অনেকে বলাবলি করতে লাগলো এটা তো অত্যন্ত টিপিকাল মন্দির। কেন এখানে এসে আমাদের এতগুলো সময় নষ্ট করতে হলো। মনে মনে গাইডকে বকাবকি করে আমরা গোয়েলে উঠলাম।

এরপর অনেক্ষন বাস চলে আমাদের নিয়ে গেলো জয়পুরের সরকারি বিক্রয় কেন্দ্রে। এখানেও আমরা কেন নেমেছি বুঝতে পারলাম না। যাই হোক গাইদের পিছু পিছু আমরা বাস থেকে নামলাম। প্রথমেই একজন লোক আমাদের কিসব জানি ব্লক বাটিকের পদ্ধতি দেখালো। তারপর তারা আমাদের দোকানের ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো। সেখানে শুরুতেই ছেলেদের আলাদা করে দিলো। আর আমাদের মেয়েদের অন্যদিকে নিয়ে যেতে লাগলো। বিক্রয় কেন্দ্রটা অনেক বিশাল। সবকিছুরই দাম অনেক বেশি। শাড়ি, ওড়না, স্যান্ডেল, জুতা সবকিছুর আলাদা আলাদা সেকশন। আমাদের হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে গেলো কাঁথা বালিশ আর কম্বলের সেকশনে। সেখানে আমাদের ‘রাজস্থানী রাজাই’ নামের এক দারুন জিনিস দেখালো। এটা খুবই পাতলা কম্ফোর্ট টাইপের জিনিস। এটা শীতকালে গায়ে দিয়ে ঘুমালে গরম লাগবে আর গরমকালে বিছানায় বিছিয়ে ঘুমালে ঠান্ডা লাগবে। এটাকে ভাঁজ করে একদম ছোট জুতার বাক্সের সমান বানিয়ে ফেলা যায়। আর এটার ওজনও অনেক কম। আমরা বড় বড় চোখ করে সব দেখতে লাগলাম। তারপর উনারা এটার দাম বলে আমাদের বললেন যে আমাদের কোনটা কোনটা পছন্দ। উনাদের কথায় আমরা নড়েচড়ে উঠলাম। আমরা উঠে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু আমরা যতই এখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি উনারা ততই আমাদের আরও ভিতরের দিকে সেকশনে পাঠিয়ে দেয়। আমরা ঝাড়বাতি, ফার্নিচার, রত্ন পাথর সব দেখে দৌড়ে দৌড়ে বের হয়ে যেতে থাকি। আমরা মেয়েরা তো তবুও বের হয়ে আসি, কিন্তু ছেলেদের কোন খবর নাই। আমরা ভাবলাম, ওদের কাছ থেকে বোধহয় ইচ্ছা মত খসিয়ে নিচ্ছে। আমরা গোয়েলে উঠে পড়লাম। অনেক্ষন পরে ছেলেরা ফিরতে লাগলো। ওরা কেউ কিছু কিনে নাই শুধুমাত্র জাফর ছাড়া। জাফর একটা গোলাপি ওড়না কিনে প্রায় চার গুন দাম দিয়ে। ও একটা শাড়িও কিনতে চাচ্ছিলো। ভাগ্যিস কেনার আগে চয়েস করার জন্য মৌলিকে খবর দিতেই মৌলি প্রবল্ভাবে ওকে না করে দেয় এখান থেকে কিনতে। যাক, জাফরের লসটা শুধু একটা ওড়নার উপর দিয়ে গেছে!

ততক্ষনে দুপুর হয়ে গেছে। অনেকেই জুস, চিপস কিনে নিলো। আমিও চিপস কিনে নিলাম। বাসে বসে তাই চিবাতে লাগলাম। সবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে সেই দালাল গাইডের উপর। কতক্ষণ ধরে আমরা বাসে করে ঘুরছি কিন্তু একটাও কাজের জায়গায় যাচ্ছি না, সব আজাইরা জায়গায় গিয়ে শুধু শধু সময় নষ্ট হচ্ছে। এবার গিয়ে কমিটির লোকজন ড্রাইভারকে বলে আসলো যাতে আমরা সোজা আম্বর ফোর্ট যাই। মাঝে আর কোনখানে যাতে থামা না হয়। বাস চলতে শুরু করলো। আমি জানালা দিয়ে দেখতে লাগলাম জয়পুর শহর। অনেক পুরানো শহর কিন্তু প্ল্যান করা। রাজপুত রাজা মানসিংহের বানানো বিল্ডিং প্যাটার্ন অনুযায়ী শহরের মেইন কমার্শিয়াল এলাকাগুলো গড়ে উঠেছে। সবগুলো বিল্ডিংয়েই সেই লালচে কমলা রঙের জালি জালি জানালা দেওয়া রাজকীয় ভাবটা আছে। এ জন্যই বলা হয় ‘দ্যা পিংক সিটি’।

আমাদের গোয়েল এসে পৌঁছালো আম্বর ফোর্ট। বাস থেকে নেমেই মাওতা লেকের সামনে দাঁড়িয়ে গ্রুপ ফটো তুললাম। অনেকে সেখানে জিরা পানি খেলো। সেটার স্বাদ নাকি দারুন। খানিক্ষন পরে সেখান থেকে হাঁটা শুরু করলাম আম্বর ফোর্টের দিকে। মাওতা লেকের পাশ দিয়ে লাইন ধরে হাঁটতে লাগলাম আমরা। এক পাশে টলটলে মাওতা লেক আর লেকের ওপারে সোনালি পাহাড়ের গায়ে এঁকেবেঁকে উঠে গেছে দেওয়াল। ঠিক যেন চীনের প্রাচীর। পুরো পাহাড় জুড়ে রাজকীয় ফোর্টটা যেন আসন গেড়ে বসে আছে। মুখ হাঁ করে এই দেখতে দেখতে আমরা প্রবেশের কাছাকাছি চলে আসলাম। আম্বরের গেটের সামনে ভুট্টার দানা প্লেটে প্লেটে করে বিক্রি হচ্ছে। আশেপাশে অসংখ্য কবুতর ওড়াউড়ি করছে। অনেকে দানাগুলো কিনে কবুতরকে খাওয়াতে লাগলো। বাসিরুনের হাতে একটা কবুতর অনেক্ষন ধরে বসে দানা খেলো। আর বেচারা আফরার হাতের দানা খেতে এক বড়সর সাইজের ছাগল এসে হাজির হলো। ছাগলটা আফরার হাত চেটেপুটে খেতে লাগলো। আমরা দৃশ্যটা দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম।

আম্বর ফোর্টের সামনে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

আমরা আবার হেঁটে পৌঁছালাম গেটের কাছে। প্রথমেই দেখলাম ‘দিল আরাম বাগ’। এটা ফোয়ারা, পানির পুল, চৌচালা ছাউনি, সবুজ ঘাসের লন আর অসংখ্য ফুল গাছ সহ একটা সুন্দর সাজানো বাগান। এখানে আসলে মনে শান্তি লাগে তাই এর নাম ‘দিল আরাম বাগ’। এটার কন্সেপ্ট এসেছে সেই হুমায়ুন্স টম্বের চারবাগ থেকে। এখান থেকে মাওতা লেকের অপরূপ ভিউ দেখতে দেখতে আমরা উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। কি যে সুন্দর দৃশ্য! ঢাল বেয়ে উঠছিলাম আর মাথা ঘুরিয়ে ডানে, বামে, সামনে, পিছনে, উপরে নিচে সবদিকে দেখছিলাম। সমতলে শুধু চারদিক দেখলেই হয়। পাহাড়ের গায়ে উপরে নিচেও দেখা লাগে। কখনও ঢাল, কখনও সিঁড়ি এই বেয়ে বেয়ে আমরা ক্লান্ত হয়ে পৌঁছালাম ‘সুরাজ পোল’ এ। এই গেট পূর্ব দিকে মুখ করা বলে এর নাম সুরাজ পোল। বিশাল রাজকীয় এই গেট পার হয়ে ভিতরে ঢুকে পুরাই পাকা করা বেশ বড় খোলা জায়গা পেলাম। চারিদকে স্ট্রাকচার দিয়ে ঘেরা একটা বিশাল কোর্ট ইয়ার্ডের মত জায়গা। এর নাম ‘জালেব চক’। এখানে সৈন্যরা যুদ্ধ জয় শেষে বিজয় মিছিল করতো। এখানে কেউ ঢুকলে মনেই করবে না যে এটা ভূমি থেকে এত উঁচু একটা জায়গা। এই কোর্টের মধ্যেই অন্য আরেকটা গেট দেখলাম যার নাম ‘চান্দ পোল’। এই গেটের উপরে ছিলো ‘নওবত খানা’। নওবত খানায় ঐতিহ্যবাহী বাদ্য বাজানো হতো। আর যখন বাদ্য বাজতো তখন সবাই চুপ করে শুনতো। আমরা সেখানে স্থানীয় একজনকে দেখলাম এক মনে সারেঙ্গীর মত একটা বাদ্য বাজিয়েই যাচ্ছে। যেমনটা সোনার কেল্লায় পড়েছিলাম। কতগুলো লোক পাগড়ি বিক্রি করছিলো। সীমান্ত ১০০ রুপি দিয়ে পাগড়ি কিনলো। সেই পাগড়ি পরে আমরা পোজ মেরে ছবি তুললাম। এরপর আমরা টিকেট কাটলাম। তারপর সিঁড়ি বেয়ে সত্যিকার রয়াল এলাকায় ঢুকতে শুরু করলাম।

উপরে উঠে দেখতে পেলাম দিউয়ানে আম। দিউয়ানে আমে প্রজাদের সাথে দরবার করার পাশাপাশি যেকোন উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হতো। রাজপুত স্টাইলের চমৎকার কারুকাজ করা কলোনেড স্ট্রাকচারটাতে ঢুকে আমার মনে হলো আমি বোধহয় সেই রাজপুতদের আমলেই চলে এসেছি। কলামগুলো ধরে ধরে হাঁটছিলাম আমি। একেবারে পাহাড়ের ধার ঘেঁষে দিউয়ানে আম, নিচের দিকে তাকালে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি দেওয়াল ঘেরা রাস্তা আর অপূর্ব মাওতা লেক দেখা যাচ্ছে। দৃশ্যটা কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্নময়। আমরা সবাই মিলে দিউয়ানে আমের ভেতর সৃষ্টির ডিরেকশনে লাফ ঝাঁপ দিয়ে ছবি তুললাম। দিউয়ানে আমের পর যে বিশাল রাজকীয় গেটটা দেখলাম সেটা ‘গনেশ পোল’। এই গেটের উপরে জালি দেওয়া জানালা দিয়ে ঘেরা ‘সুহাগ মন্দির’ আছে। এখানে বসে রাজ বংশের মেয়েরা দিউয়ানে আমে অনুষ্ঠিত যে কোন উৎসব উপভোগ করতো। এই গেটের পর থেকে একেবারে প্রাইভেট এলাকা শুরু।

গনেশ পোলের উপরে জালি দেওয়া সুখ মন্দির
গনেশ পোলের উপরে জালি দেওয়া ‘সুহাগ মন্দির’

গনেশ পোল পার হয়ে হাতের বাম পাশে পেলাম ‘দিউয়ানে খাস’ বা ‘জয়মন্দির’ বা ‘শিশ মহল’। এখানে রাজা বিশেষ ব্যক্তিবর্গের সাথে দেখা সাক্ষাত করতেন। মার্বেলের দেওয়ালে সেই তাজমহল লেভেলের ফুল, পাতা এনগ্রেভ করা। দেখেই আমি তবদা লেগে গেলাম। কিন্তু আমার তবদা লাগার আরও বাকি ছিলো। ভিতরে পা রেখে যখন দেখলাম দেওয়াল আর ছাদ কুচি কুচি আয়না দিয়ে জটিল আর কারুকাজ করা জ্যামিতিক আর ফুলেল নকশায় পরিপূর্ণ, তখন আর কথা বলতে পারছিলাম না। আমার সামনে জুবায়ের হাসি হাসি মুখ করে আমাকে বললো, ‘তাও ভালো যে, কিছু কিছু অংশ রঙ দিয়ে নকশা করা, সব জায়গায় পাথর কেটে নকশা করে নাই। তা হলে যে কি হইতো আল্লাহই জানেন’। আমি অবাক হয়ে আয়নাগুলো দেখছিলাম। সব সাধারণ আয়না নয়, লাল, কমলা, গোলাপি, সবুজ, হলুদ – এই সব রঙ্গিন আয়না এত বছর পরও যেন সেই রাজকীয় দ্যুতিই ছড়াচ্ছে। অনেক জায়গায় পাথরের উপর আয়নার কারুকাজ, আয়নার উপর রঙের কারুকাজ, আয়নার উপর পাথরের কারুকাজ – দেখতে দেখতে আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছিলো।

সমগ্র শিশ মহলের দেওয়াল জুড়েই টুকরা টুকরা আয়না দিয়ে দারুণ সব অলংকরণ
সমগ্র শিশ মহলের দেওয়াল জুড়েই টুকরা টুকরা আয়না দিয়ে দারুণ সব অলংকরণ

শিশ মহলের পাশেই চমৎকার একটা বাগান। বাগানের ওপাশে ‘সুখ মন্দির’। গরমের দিনে এখানে রাজ বংশের লোকজনরা থাকতেন। ধবধবে সাদা এই দালানটাকে ফুলেল কারুকাজে পরিপূর্ণ করার পাশাপাশি ঠান্ডা রাখার জন্যও যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিলো। এর উপরে একটা পানির ট্যাংক ছিলো যেখান থেকে পানি নিয়ে এর ভিতরে দেয়াল বেয়ে ফোয়ারার মতন ছাড়া হতো। সেই পানি সোজা গড়িয়ে নেমে যেতো বাগানে। এই সব দেখতে দেখতে আর ছবি তুলতে তুলতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। তানভীরের সাথে দেখা হলো। ও বললো ‘ছবি তোলা বাদ দিয়ে দেখো, এই জিনিস আর জীবনেও দেখতে পারবে না’। এবার সত্যি সত্যি আমি ছবি তোলা বাদ দিয়ে দেখতে লাগলাম। এরপর দেখলাম রাজা মান সিংহের প্যালেস, সারি সারি ল্যাট্রিন, ‘জানাই দেউরি’ বা মহিলাদের থাকার জায়গা। এক চিপা দিয়ে সিড়ি পেয়ে আমি আর তানভীর টপাটপ উপরে উঠে গেলাম। উপরে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেললাম। এত এত ঘর, এত এত করিডর আর এত এত বারান্দা –পুরাই যেন এক গোলক ধাঁধাঁ। আমরা অনেক কষ্টে সেখান থেকে পথ চিনে বের হয়ে আসলাম। তারপর আমি আর তানভীর যে রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম মনে হলো সেটা বের হয়ে যাবার পথ। সেখানে যেতে যেতে দেখতে পেলাম, আম্বর ফোর্ট থেকে আরও উপরে অবস্থিত জয়গড় ফোর্টে যাবার সুড়ঙ্গ পথ।

বের হবার রাস্তায় হঠাৎ দুইটা বড় বড় কড়াই দেখতে পেলাম। আমাদের দেশের মাজারে যেই সাইজের ডেকচি থাকে ঠিক সেই সাইজের কড়াই। কাছে দিয়ে টের পেলাম মৃত্যু দন্ড পাওয়া আসামীকে এই কড়াইয়ের গরম তেলের মধ্যে ডুবিয়ে মারা হতো। বিশাল চকচকে কড়াই দুইটা দেখে মনে হলো কত মানুষ না জানি এখানে ডিপ ফ্রাই হয়ে মরেছে! মোটামুটি ঘুরে আমরা সারি সারি কামান দেখে বের হয়ে আসলাম ঠিক যেখানে টিকেট কেটেছিলাম জালেব চকের, ঠিক সেইখানে। জালেব চকের মাঝখানে মিম আর অন্তরাকে বসে থাকতে দেখলাম। খানিক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আমি, মিম, অন্তরা আর তানভীর রওয়ানা দিলাম জয়গড় ফোর্টের উদ্দেশ্যে। আমাদের সাথে যেতে অনেকেই রাজি হচ্ছিলো না। কারণ সেটা আরও অনেক উঁচুতে অবস্থিত। মূলত তানভীরের উৎসাহেই আমরা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে রওয়ানা দেই। এসেছি যখন একবার, দেখেই যাবো- কি আছে জীবনে?

আম্বর ফোর্ট থেকে বের হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে আমাদের মনে হচ্ছিলো- ‘ব্যাপারটা কি ঠিক হলো? যেতে পারবো তো ঠিকমত? নাকি যেতে যেতেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে আর সব বন্ধ হয়ে যাবে?’। যাই হোক একবার যখন যাত্রা শুরু করেছি তখন আর থামাথামি নাই। কিছুক্ষন যেতেই আমাদের দু পা ধরে আসলো। মুখ দিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে লাগলাম আমি, মিম, আর অন্তরা। কিন্তু তানভীরের কোন বিকার দেখতে পেলাম না। ও বেশ তরতর করেই হাঁটতে লাগলো। আমরা আস্তে ধীরে উঠার চেষ্টা করতে লাগলাম আর আমাদের সাথে ভদ্রতা করে তানভীর আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলো। যে পাহাড়টা বেয়ে আমরা উঠছিলাম সেটার নাম ‘চিল কা টিলা’ বা চিলের পাহাড়। পুরো পাহাড়টাকে পেঁচিয়েই উঠে গেছে রাস্তাটা। আমরা হাঁটছিলাম তো হাঁটছিলাম, কিন্তু পথ শেষ হওয়ার কোন নামগন্ধ পাচ্ছিলাম না। বরঞ্চ একটা বাঁক শেষ হতেই ঘুরে আরও আঁকাবাঁকা সর্পিল বাঁকের রাস্তা দেখছিলাম। পথে অনেক বানর আমাদের ভেংচি কেটে দিচ্ছিলো। ওদের লাফ ঝাঁপ দিয়ে অবলীলায় পাহাড় বেয়ে উঠতে দেখে আমাদের বেশ হিংসা হচ্ছিলো। যেতে যেতে এক সময় মনে হলো আমরা বোধ হয় আজকে আর পৌঁছাতে পারবো না। অনন্তকাল লাগবে এই পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরে উঠতে উঠতেই। হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলাম, শুধু উপরে উঠতেই আমাদের এত কষ্ট- যারা এত উপরে দুর্গ বানিয়েছে না জানি তারা কি লেভেলের পরিশ্রমী, সাহসী আর করিৎকর্মা ছিলো! আরেকবার মনে হলো না হয় কষ্ট করে উপরে উঠলামই, কিন্তু নিচে নামতে নামতে তো অন্ধকার নেমে যাবে। তখন কি হবে? যাই হোক আমাদের হাঁটা বন্ধ হলো না। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে আমরা পাহাড় বাইতেই লাগলাম। একবার থামলাম বিশ্রাম নিতে। হঠাৎ ঢাল ফুড়ে উদয় হলো দুইটা পরিচিত মাথা, সুমাইয়া আর অবনী। ওরাও জোরে জোরে দম ফেলতে ফেলতে আমাদের সাথে এসে যোগ দিলো।

জয়গড় ফোর্টের পথে আমরা
জয়গড় ফোর্টের পথে আমরা

অবশেষে রক্তিম গাল, হাপড়ের মতন পাজড় আর টনটনে পা নিয়ে আমরা এসে পৌঁছালাম জয়গড় ফোর্টের গেটে। গেটের নাম ‘আওয়ানি দরওয়াজা’। টিকেট কেটে ঢুকে পড়লাম রেড স্যান্ড স্টোনে বানানো মোটা মোটা দেওয়াল দিয়ে ঘেরা জয়গড় ফোর্টে। জয়গড় ফোর্ট প্রথমে বানানো হয়েছিলো আম্বর ফোর্টকে রক্ষা করার জন্য। ঢুকতেই আমরা প্রথমে পেয়ে যাই ফাউন্ড্রি। এখানে রাজপুতদের সকল অস্ত্রশত্র বানানো হতো। আমরা ঢুকতেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কামান দেখলাম। এই কামানের নাম ‘জাইভান’। তারপর দেখলাম কামান বানানোর কারিকুরি। বিশাল বিশাল ছাঁচের মধ্যে ধাতু ঢেলে বানানো হতো কামান। এই সব ছাঁচ বানানোর জন্যও আছে বিশাল মেকানিজমওয়ালা কুয়ার মত মেশিন যেটা আসলে ফার্নেস। আমাদেরকে একজন গার্ড মেকানিজমটা সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে দিলেন। আমরা সব দেখে আর শুনে হাঁ হয়ে যাচ্ছিলাম। আকাশের কাছাকাছি একটা জায়গায় এভাবে কামান বানানো- হার্ড টু বিলিভ। তারপর দেখলাম ‘সূর্য মন্দির’। থরে থরে অস্ত্র আর কামারের যন্ত্রপাতি  সাজিয়ে রাখা সেখানে। বর্শা, ঢাল, তলোয়ার, শিরস্ত্রান, গোলা – কি নেই সেখানে!

হাতে সময় অনেক কম। তাই আমরা পা চালাতে লাগলাম। এসে পৌঁছালাম ‘জালেব চক’। আগের মতই বেশ বড় কোর্ট ইয়ার্ড। জালেব চকের চার পাশে হরিহর মন্দির, ভৈরব মন্দির, আর্মারি মিউজিয়াম- আরও অনেক কিছু ছিলো। কিন্তু আমাদের সেগুলোতে ঢুকার সময় নেই। এক রকম দৌড়ে দৌড়ে আমরা প্রাসাদের এলাকায় ঢুকলাম। হলুদ রঙের গেটটা পার হয়ে দেখলাম ‘সুভাত নিবাস’। সেখানে বিশাল বিশাল ঢাক, হাতির পিঠে বসার আসন –এইসব সাজানো আছে। এরপর দেখলাম অত্যন্ত সুন্দর ‘লক্ষী বিলাস’। এটা নাকি রাজাদের ড্রইং রুম ছিলো। এরপর আমরা ছুটতে লাগলাম একটা অন্ধকার চিপা গলি দিয়ে। সেই গলি পার হয়ে ছোট্ট একটা উঠানে এসে পৌঁছালাম। এখান থেকে দেখলাম ডাইনিং হল। সেখানে খুব সুন্দর করে পুতুল দিয়ে সব সাজানো আছে। দেখে মনে হয় যেন সত্যি সত্যি রাজপুত বংশের নারী পুরুষেরা বিশাল বিশাল থালায় হরেক রকম খাবার সাজিয়ে খেতে বসেছে। রান্নাঘরেরও একই অবস্থা। অনেক দাস দাসী মিলে বিশাল বিশাল ডেকচিতে যেন রান্নাবান্না করছে। দেখতে আমার খুবই ভালো লাগছিলো। তারপর দেখলাম ‘ললিত মন্দির’। এটা শোবার ঘর। একটা দোতলা অডিটোরিয়ামও দেখলাম, সামনে স্টেজ সহ। এখানে নাকি নাচ, গান আর পুতুল নাচ হতো। এরপর দেখলাম লাল রঙয়ের ‘বিলাস মন্দির’।

এতক্ষণ ধরে যা যা দেখছিলাম সব কয়টা দালানই এত সুন্দর আর এত প্রাণ জুড়ানো বাতাস যে আমাদের একটু খানিক্ষণ বসে থেকে উপভোগ করতে ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু হাতে সে সময় নেই বলে কোন জায়গাতেই আমরা থামছিলাম না। এক ঝলক দেখেই দৌড় দিচ্ছিলাম। কিন্তু  সাদা রঙের ‘আরাম মন্দির’ দেখে আমরা পুরাই থেমে গেলাম। সামনে যে এক মনোমুগ্ধকর বাগান দেখলাম সেটা আমি নিজের চোখে না দেখলে মনে করতাম এরকম বাগান কেবল রূপকথার বইতেই থাকা সম্ভব। পুরাই যেন কোন বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা সবুজ ঘাস আর ছোট ছোট ঝোপ দিয়ে সাজানো এক পরিপাটি বাগান। আর বাগানটা যে এক আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের উপর অবস্থিত সেইটা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যই যেন তিন তিনটা বিশাল আর্চ পাহাড়ের কিনারায় ভিউ ওপেন করে দাঁড়িয়ে আছে। পুরা দৃশ্যটা এতই বেহেশতি, এতই স্বপ্নময়ী, এতই অবাস্তব যে কয়েক মিনিট আমাদের সময় লাগলো ব্যাপারটা হজম করতে। আমরা কেউ কোন কথাই বলতে পারলাম না কিছুক্ষণ।

ভূমি থেকে হাজার খানেক ফুট উপরে আরাম মন্দির
ভূমি থেকে হাজার খানেক ফুট উপরে আরাম মন্দির

আরাম মন্দিরে এসে আর কোন কিছুর আরাম হোক আর না হোক, আমার চোখের দারুন আরাম হচ্ছিলো। তারপর আমরা হেঁটে হেঁটে একদম জয়গড় ফোর্টের কিনারে এক ওয়াচ টাওয়ারে এসে দাঁড়ালাম। আমার মনে হচ্ছিলো আমি বোধহয় পাখির চোখে পৃথিবী দেখছি। এখান থেকে দেখলাম নিচের আম্বর ফোর্টকে। কত ছোট যে লাগলো সেই বিশাল ফোর্টকে! এক দিকে উপরে সীমাহীন আকাশ অন্যদিকে নিচে পাহাড়ের গায়ে আঁকা বাঁকা দেওয়াল আর ঝকঝকে ‘সাগর লেক’, সেইসাথে মন ভরানো, প্রান জুড়ানো বাতাস- আমার যে কি শান্তি লাগছিলো, সেকথা আর নাই বা বললাম। মনে মনে তানভীরকে ধন্যবাদ দিলাম। ওর জন্যই আজকে এখানে আমার আসা সম্ভব হয়েছে। ওখানকার লোকজন আমাদের তাড়া দিচ্ছিলো বের হয়ে যাবার জন্য। আমাদের আরও অনেক্ষণ ওখানে থাকতে ইচ্ছা করছিলো, কিন্তু উনাদের তাড়া খেয়ে তাড়াতাড়ি আমরা নেমে এলাম। ওনারা আমাদের বের হয়ে যাবার রাস্তা দেখিয়ে দিলেন।

ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা জয়পুর শহর
ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা জয়পুর শহর

আমরা সেই স্বপ্নময়ী বাগান থেকে বের হয়ে হাঁটতে লাগলাম। এবার আমরা দেখলাম তিনটা বি-শা-ল পানির ট্যাঙ্ক। এত উঁচু পাহাড়ে ফোর্ট বানানোর একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা। কৃত্রিমভাবে বানানো সাগর লেক থেকে হাতির পিঠে করে পানি উঠানো হতো। তাছাড়া পুরো ফোর্ট জুড়েই নানা রকম চ্যানেল ছিলো যেগুলো দিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হতো। তিনটা ট্যাঙ্ক মিলে ষাট লাখ গ্যালন পানি ধরে রাখার ক্ষমতা ছিলো। পরে জানলাম এক মজার কাহিনী। এই তিনটা ট্যাঙ্কের একটার ভিতর নয়টা রুম আছে। সেগুলো নাকি রাজা দ্বিতীয় জয় সিংহের আগ পর্যন্ত ট্রেজারি অর্থাৎ রাজকোষ হিসেবে ব্যবহৃত হত। যার মানে দাঁড়ায় রাজ্যের সব সম্পদ এখানে থাকতো। রাজপুত বংশের ব্যাপক ধন ভান্ডার এইখানে লুকানো আছে বলে শোনা যায়। এই ফোর্ট এখনও রাজপুত বংশের লোকদের মালিকানায় আছে, এটা সরকারী সম্পত্তি নয়। তাই এখানে গুপ্তধন আছে কি নেই সেটা নিয়ে ব্যপক কল্পকাহিনী প্রচলিত। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে একবার নাকি জোর তল্লাশি চালানো হয় সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু কিছু পাওয়া গিয়েছে এমন কথা শোনা যায় নাই।

আমরা যখন ট্যাঙ্কগুলো পার হয়ে হয়ে যাচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময়ে ইশতিয়াককে পেলাম সেখানে। ইশতিয়াক মাথা নেড়ে নেড়ে বললো, ‘পুরাই মাথা নষ্ট জায়গা’। আমিও মেনে নিলাম ওর কথা। আসলেই পুরাই মাথা নষ্ট জায়গা। মনে মনে রাজপুতদের স্যালুট জানালাম। আবার আফসোসও লাগলো যে ইন্ডিয়ান ইসলামিক আর হিন্দু আর্কিটেকচার পড়েছি কিন্তু রাজপুতটা কেমন করে যেন হিন্দু আর্কিটেকচার থেকে বাদ পড়ে গেছে। যদি আগে থেকে কিছু পড়াশোনা থাকতো তাহলে দেখাটা আরও বেশি উপভোগ্য হতো। তারপর আমরা সাত জন মিলে গেট দিয়ে বের হয়ে আসলাম। আমরা ঢুকেছিলাম এক গেট দিয়ে আর বের হলাম মেইন গেট দিয়ে। আমার ফোনে রুবাইদা কল দিয়ে জানাতে লাগলো যে, সবাই রওয়ানা দিয়ে দিতে চায়। আমি বলে দিলাম সবাই যদি চলে যেতে চায় তাহলে যেন চলে যায়, আমরা আমাদের মত করে ফিরবো। কিন্তু অবনী এই কথা শুনে বললো, ‘ফাইজলামি নাকি- আমি কমিটি মেম্বার, আমাকে ফেলে গোয়েল চলে যাবে- এতবড় সাহস! এটা কোন কথা হলো?’। আমরা যেন হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম আমাদের সাথে একজন কমিটি মেম্বার আছে। আমরা খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম, যাক আমাদের ফেলে তাহলে গোয়েল চলে যাবে না!

আমরা একটা খালি অটো ঠিক করলাম। অটোটার পিছনে স্পেয়ার চাকা রাখার জায়গাটাতে তানভীর আর ইশতিয়াক জড়াজড়ি করে বসলো। আর আমরা পাঁচজন মেয়ে সামনে গাদাগাদি করে বসলাম। প্রবল বেগে ঢাল বেয়ে আমাদের অটো নিচে নামতে লাগলো। দু পাশের চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা চলতে লাগলাম। হঠাৎ দেখলাম ময়ুর। একটা দুটা নয়, অনেক ময়ুর। আমাদের দেশে গ্রামে যেমন হাঁস মুরগি ঘুরে বেড়ায়, এখানে রাস্তার দুপাশের জঙ্গলে তেমনি রংচঙ্গে ময়ুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক্ষণ ধরে পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে নামতে একসময় আমাদের অটো সমতলে এসে থামলো। থামলো একেবারে জলমহলের পাশে। অটোতে বসে থাকতে থাকতেই আমরা জলমহলের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। অটো থামতেই পার হেড ২০ রুপি ভাড়া দিয়েই দৌড় দিলাম।

এফদ
পানির উপর জলমহল (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

চকচকে সাগর লেকের উপর হালকা হলুদ রঙের বিল্ডিংটার দিকে তাকালেই মনে হবে, ‘ইশ, যদি ভিতরে যেতে পারতাম’। যাওয়ার ব্যবস্থা হয়তো আছে কিন্তু হাতে সময় নাই। দূর থেকে তাকিয়েই দেখে নিলাম জলমহল। এখানে নাকি রাজা প্রথম মাধো সিং হাঁস শিকার করতে আসতেন! কি আর বলবো, কিছু বলার নাই……

আমাদের লোকজনদের দেখলাম সবুজ ঘাসের উপর বসে থাকা হকারদের কাছে গিয়ে স্যান্ডেল দামাদামি করতে। শেষমেশ কয়েকজনকে দেখলাম ১০০ রুপি দিয়ে জোড়া স্যান্ডেল কিনে নিতে। অনেকেই আবার বললো মার্কেটে এর চেয়ে কম দাম হতে পারে। আমাদের দেখেই সবাই চটজলদি গোয়েলে উঠে পড়লো। দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নাই। কিন্তু এখানেও কিছু খাওয়ার নাই। কি আর করা, খালি পেটেই উঠে পড়লাম বাসে। বাস ছেড়ে দিলো। গন্তব্য বাবুবাজার।

সন্ধ্যার সময় বাবুবাজার আসার আগেই সারি সারি দোকানপাট দেখে আমরা নেমে গেলাম। আমি ভাবলাম কোন খাবারের দোকান থেকে কিছু কিনে নিবো। কিন্তু তেমন কোন খাবারের দোকান পেলাম না। আশেপাশের সব দোকানেই মোটামুটি একই জিনিস। দু ধরনের পায়জামা সারি সারি করে ঝুলানো সব দোকানে। এক ধরনের পায়জামা অনেকটা আলাদিন যেরকম পরতো সেরকম, অন্যটা আলাদিনের জিনি যে ধরনের পায়জামা পরতো সেরকম। দাম ১০০ থেকে ১২০ রুপির মতন। পায়জামাগুলো দেখে মনে হলো সিল্ক, জর্জেটের শাড়ি কেটে বানানো। বিভিন্ন দোকানে কাঁচ বসানো ঘাগড়া, বিছানার চাদর, পর্দা, কুশন কভার, ব্যাগ, ওড়না, গিফট আইটেমের মধ্যে কলম, কৌটা, চাবির রিং, নোটবুক ইত্যাদি ঝিকমিক করছে। এছাড়া আছে শাড়ি, জুয়েলারি, স্যান্ডেল, টপস, গিফট আইটেম, শো পিস ইত্যাদি। দোকানদারগুলা বেশ ঘাগু। ইচ্ছা মত দাম হাঁকায়, যার কাছ থেকে যা রাখতে পারে। আর একবার দোকানে ঢুকলে সহসা কাস্টোমারকে খালি হাতে বের হতে দেয় না। আমি আর রুবাইদা হাঁটতে লাগলাম। এরই মধ্যে রুবাইদা কয়েকটা শাড়ি, কুশন কভার, জুয়েলারি, ব্যাগসহ বেশ কিছু কেনাকাটা করে ফেললো। আমরা অনেক্ষণ ধরেই ঘুরতে লাগলাম। আমার কাছে জিনিসপত্র তেমন পছন্দ হচ্ছিলো না। সবার কাছ থেকে শুনে মনে হয়েছিলো জয়পুরের জিনিসপত্র অনেক সুন্দর হবে। কিন্তু সব কিছুই কেমন যেন ঠুনকো লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো কিছুদিন ব্যবহার করলেই সব নষ্ট হয়ে যাবে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো হয়তো আমরা ঠিক জায়গায় শপিং করতে আসি নাই। হয়তো আরও ভালো শপিঙের জায়গা ছিলো।

রাতে এক পর্যায়ে সব দোকানপাট একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। তখন আমরা হাঁটতে হাঁটতে জহুরি বাজার নামের এক জায়গায় ‘দি ফ্রেন্ডস’ নামের এক দোকান পেলাম। এটা অনেকটা মোহাম্মদপুরের সোর্সের মতন দোকান। অবনী এখান থেকে ৫০ রুপি দিয়ে সুন্দর আংটি কিনেছে। দেখে আমার বেশ পছন্দ হলো। আমিও দুইটা আংটি কিনলাম। জুবায়ের আর রাজীবকে দেখলাম চামড়ার কভার দেওয়া স্কেচ বুক কিনতে। তারপর আমরা কয়েকজন মিলে অটো ঠিক করছিলাম। এমন সময় রুবাইদা ফুটপাথে এক লোকের কাছ থেকে ৫০ রুপি দিয়ে সাদা রঙের তিনটা চুড়ির একটা সেট কিনলো। আমি দুসেট নিলাম ১০০ রুপি দিয়ে। সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। লোকটা তাড়াহুড়া করে আমাদের দিলো। তারপর আমরা অটোতে করে রওয়ানা হই হোটেলের দিকে।

হোটেলে নেমে আমরা বের হই খাওয়ার দোকানের খোঁজ করতে। লোকজন দেখিয়ে দেয় রাস্তা। অনেক দূর হেঁটে আমরা এক খাওয়ার দোকান পাই। সেখানে বসে আমরা মেনুর উপর চোখ বুলাই। আলু মটর, পনির মটর, আলু টমাটো- সব স্পাইসি খাবার ছিলো। আমার একদম মশলা খেতে ইচ্ছা করছিলো না। অনেক ভাবনা চিন্তা করে আমি অর্ডার দেই ৩৭ রুপির নান আর ভেজ রায়তা। আর রুবাইদা অর্ডার দেয় বেগুন ভর্তা আর ভাত। আমার ভেজ রায়তা ভালোই ছিলো- টক দইয়ের সাথে সিদ্ধ আলু কিউব। কিন্তু রুবাইদার ভাত আর বেগুন ভর্তা দেখে আমাদের চোখ কপালে উঠে গেলো। টকটকে লাল রঙের ঝোলের একটা তরকারি দিয়ে গেলো। রুবাইদা একবার জিজ্ঞেস করে শিওর হলো যে এটা বেগুন ভর্তা কিনা। ভাতের চালটা মোটা আর হালকা লাল রঙের ছিলো। রুবাইদা সাবধানে ‘বেগুন ভর্তা’ সেই ভাতের সাথে মাখিয়ে মুখে দিলো। তারপর জানালো, খেতে খারাপ না, ভালোই। যদিও বেগুন ভর্তা না হয়ে বেগুনের তরকারি মনে করে খেলে ভালো হতো, তারপরও জয়পুরে এসে জয়পুরি স্টাইলের বেগুন ভর্তা আর ভাত খেয়ে রুবাইদা বেশ খুশি।

খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা উল্টা পাশের মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি কিনে খাই। একেবারে আসল জয়পুরি মিষ্টি! তারপর আমরা রওয়ানা দেই হোটেলের দিকে। হলুদ সোডিয়াম লাইটের আলোতে আমরা হাঁটতে থাকি। ততক্ষনে প্রায় রাত ১১টা বেজে গেছে। আমরা বিস্তর হাসাহাসি করতে করতে নির্জন আবাসিক এলাকার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে থাকি। এক পর্যায়ে রুবাইদা বলে, ‘চিন্তা করে দেখ, ঢাকা শহরে আমার কলিজায় সাহস হবে না রাত ১১টার সময় এভাবে রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে। আর এখন……’। আমিও ভেবে দেখলাম কথাটা ঠিক। বাসায় যদি জানে যে আমি রাত ১১টার সময় রাপা প্লাজার দিকে হেঁটে হেঁটে বাসায় আসছি, আম্মু পিটিয়ে চামড়া তুলে ফেলবে। অথচ এখন কত অবলীলায় হেঁটে যাচ্ছি, কেউ কিছু বলছে না।

হোটেলে ফিরে আমি আবিষ্কার করলাম, বাথরুমে রেলিঙের উপর আমি যে পায়জামা রেখে গিয়েছিলাম তার উপর পাখি এসে বাসা বুনে গেছে। পুরা বাথরুমে খড়কুটা ছড়ানো আর আমার পায়জামার উপর আস্ত পাখির বাসা। রুম সার্ভিসে খবর দিলাম। লোকজন এসে আমাদের বাথরুম পরিষ্কার করে দিলো। আমার খড়কুটা, মাটি লাগানো পায়জামাটা দিয়ে গেলো। এই পায়জামা নিয়ে যা করার তা আগামীকাল ভেবে দেখবো- এই চিন্তা করে আমি শুয়ে পড়ি। সারাদিনে পরিশ্রম কম হয় নাই। তাই ডবল বেডে পাঁচ জন প্যাকড হয়ে শুয়েও সাথে সাথেই ঘুমিয়ে গেলাম।

 

 

 

 

The Mighty INDIA CALLING: সাদা বরফের দেশে রৌদ্র ঝলমলে একদিন (পর্ব ১৩)

সকালে ঘুম থেকে উঠলাম দেরি করে। আড়মোড়া দিয়ে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে চারদিকে তাকালাম। রুমের বিশাল জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঝলমলে রোদ, আগের দিনের বরফের চিহ্ন মাত্র নাই। বিছানা থেকে উঠে আবার সেই জানালার সামনে দাঁড়ালাম। পরপর দুইদিন দুই রকম রূপ দেখলাম মানালির। মন ভরে গেলো। আহ জীবন কত সুন্দর!

দেস
আগের দিনে সাদা বরফের বদলে সবুজ পাতা রোদে ঝলমল করছে চারদিকে

আমরা ঢিলেঢালাভাবে ফ্রেশ হতে লাগলাম পালাক্রমে। কিছুক্ষন পর দরজায় নক পড়লো। খুলে দেখলাম শুভ দাঁড়িয়ে। শুভ জানালো ১২টার মধ্যে রুম ছেড়ে দিয়ে লাগেজ জমা দিতে হবে গতকাল যে রুমে আমরা পার্টি করলাম সেই রুমে। রুবাইদা তখনও ঘুমাচ্ছিলো। ওকে ডেকে তুললাম। বাকি দুইজন ইতোমধ্যে রুম ছেড়ে বের হয়ে পড়েছে। আমি আর রুবাইদা ধীরেসুস্থে ব্যাগপত্র গোছগাছ করলাম। নাশতা খেতে ইচ্ছা করছিলো না আমাদের কারোরই। তাই কোনরকম তাড়াহুড়া করলাম না। ১২টার দিকেই আমরা চাবি জমা দিয়ে রুম থেকে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে পড়ি।

ব্যাগ জমা দিতে গিয়ে দেখি ছেলেদের রুমের চাবি যার কাছে থাকার কথা সে নাই। সবাই ডাইনিং হলে লাগেজ রেখেই চলে গেছে। কিন্তু অনেকেই বললো এভাবে লাগেজ ফেলে যাওয়াটা ঠিক হবে না। পরে আমরা কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিয়ে ডাইনিং হলের দোতলার রুমে লাগেজ রাখলাম। তারপর নিচ থেকে অন্যদের লাগেজগুলোও টেনে টেনে দোতলায় তুলে দিলাম। হঠাৎ একটা ব্যাগের ভিতর থেকে স্পাইডার ম্যানের মাঝারি সাইজের একটা পুতুল উঁকি দিলো। আমি নেড়েচেড়ে দেখলাম পুতুলটা নতুন না, পুরানো। আমাদের বয়সের কেউ একজন সাথে করে স্পাইডারম্যানের পুতুল নিয়ে ঘুরছে, ব্যাপারটা কেমন অবিশ্বাস্য লাগলো। আমি কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করলাম কার পুতুল এটা, কেউই ঠিক মত বলতে পারলো না। কে জানি বললো, সারার হতে পারে। সারার দেড় বছরের ভাতিজা আছে। ভাতিজার পুতুল সারার ব্যাগে আসতেই পারে- এই ভেবে আমি সেখান থেকে বের হয়ে পড়লাম।

বের হয়েই সারা আর রাত্রির সাথে দেখা। সারাকে পুতুলের কথা জিজ্ঞেস করতেই সারা জানায় পুতুলটা বাসিরুনের। বাসিরুনের ছোট্ট ভাই এই পুতুলটা ওকে দিয়ে নাকি বলেছে, ‘স্পাইডারম্যান উইল প্রোটেক্ট ইউ’। ছোট ভাইয়ের পুতুল নিয়ে তাই ও ঘুরছে সারা ইন্ডিয়া। তারপর আমরা হোটেলে নিচে দাঁড়াই খানিক্ষণ। গতদিন সাদা কুয়াশায় সব ঢাকা ছিলো বলে হোটেলের চারপাশটা দেখতে পাই নাই। আজকে দেখলাম, আমাদের হোটেলের পিছনে বরফ ঢাকা সাদা পাহাড়। পাতাহীন কংকাল গাছগুলো বরফে ঢাকা। হোটেলের এক কর্মচারী বললো ‘ওগুলো আপেল গাছ। শীতকালে তো মানলিতে তেমন কেউ আসে না। টুরিস্ট সিজন তো গরমকালে, তখন আপেল গাছগুলো সবুজ হয়ে থাকে। তখনই দেখার মতন দৃশ্য হয়। এখন যে পাহাড় সাদা দেখাচ্ছে সেটা পুরো সবুজ হয়ে যায়’। সারা আমাদের বললো, ‘আমরা ভাই গরমের দেশের মানুষ। জীবনে সবুজ অনেক দেখেছি তাই আবার এখানে আসতে হলে এই বরফের দিন দেখেই আসবো’। আমরাও সারার কথাতেই সায় দিলাম।  কতক্ষন ঘুরেফিরে, ছবি তুলে আমরা বাইরে বের হলাম।

আমরা চার জন সেই অলৌকিক বিয়াস নদীর ধার ধরে হাঁটতে লাগলাম। সেই নীলচে সবুজ রঙয়ের স্রোতওয়ালা পানি আর ছোট বড় হাজারো পাথর- রূপ তার এতটুকু পরিবর্তিত হয় নাই। ঝরঝর শব্দ করে কোনায় বরফ জমে থাকা পাথরে ধাক্কা খেয়ে ছুটে চলা নদীর সাথে সাথে আমরাও হাঁটলে লাগলাম। আমাদের সাথে যোগ দিলো আফরা আর জেরিন। রূপকথার রাজ্যের মতই আমাদের সামনে হাজির হলো লটপটে কিন্তু চওড়া এক সাঁকো। আধা আধি বরফে ডুবে থাকা সাঁকোটা পার হবো বলে ঠিক করলাম আমরা। এর মধ্যেই একটা জিপ হর্ণ দিতে দিতে আমাদের সরিয়ে দিয়ে সেই সাকোঁর উপর দিয়ে জোরে চালিয়ে পার হয়ে গেলো।  আমরা বুঝলাম যেটাকে আমরা চওড়া সাঁকো ভেবেছিলাম সেটা আসলে চিপা ব্রিজ। এবং মোটে লটপটে নয় বরং বেশ শক্তপোক্ত। আমরা হেঁটে হেঁটে সেই ব্রিজ পার হলাম। ব্রিজের ধারে সুতার মধ্যে লাল, নীল, হলুদ বিভিন্ন রঙের চারকোনা কাপড়ের টুকরায় সম্ভবত নেপালি ভাষায় কিছু লিখা আছে। দেখে আমার ভিডিও গেম ‘আঞ্চারটেড- এ্যামাং দ্যা থিভস’ এর কথা মনে পড়লো। সেখানেও রাস্তাঘাটে এরকম টুকরা কাপড় দেখেছিলাম।

আসদ
ব্রিজের ধারে লাল, নীল টুকরা কাপড়ের সারি

আমরা উঁচু নিচু পাহাড়ী ঢাল বেয়ে হাঁটতে লাগলাম। মাঝে একটা পশ দোকান দেখে আমরা ভিতরে ঢুকে পড়লাম। দোকানটা আমাদের দেশের আড়ঙের মত। জিনিসপত্র অনেক সুন্দর কিন্তু সেই দাম সবকিছুর। আমরা ঘুরেফিরে সব নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। অনেক জিনিস পছন্দও হচ্ছিলো কিন্তু কেনার সামর্থ ছিলো না। সেখান থেকে আমরা বের হয়ে পড়লাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতেই মল রোড চলে এলাম।

মল রোডে আরও কয়েকজনের সাথে দেখা হলো। খবর পেলাম এখানে কাছেই একটা মঠ, তিব্বিতি কলোনি আর দূরে হাদিম্বা টেম্পল দেখার মত জায়গা। আমরা দূরেরটা বাদ দিয়ে কাছেরগুলো আগে দেখবো বলে ঠিক করলাম। প্রথমে গেলাম মঠটাতে। মঠটার নাম গাধান থেকচোকক্লিং গোম্পা মনেস্ট্রি। ছোট্ট একটা মঠ। সামনে একটা খোলা জায়গা যেখানে দলা দলা করে বরফ জমে আছে। আমরা সাবধানে বরফগুলো পার হয়ে মঠের সদর দরজায় পৌঁছালাম। ‘যত কান্ড কাঠমান্ডুতে’ যে প্রেয়ার হুইলের কথা পড়েছিলাম আজকে সামনা সামনি দেখলাম। প্রার্থনা কক্ষের চারপাশটা তামাটে আর সোনালি রঙের ধাতুর তৈরি প্রেয়ার হুইল দিয়ে ঘেরা। অনেককেই দেখলাম প্রেয়ার হুইলগুলোকে ঘুরাতে ঘুরাতে পুরো মঠের চারপাশে একবার চক্কর দিতে। আমরা জুতা খুলে ভিতরে ঢুকলাম।

ভিতরে বিশাল বড় এক বুদ্ধ মূর্তি। ছবি তোলা নিষেধ বলে আমরা আর ক্যামেরা বের করলাম না। বিশালাকার এই মূর্তির চারপাশে নানা রঙের বাতি, ধাতব পাত্রে নানা রকম প্রসাদ, ধুপকাঠি টাইপের জিনিস। দেয়াল জুড়ে রঙ্গিন পেইন্টিং। তাতে অনেক ইতিহাসের বর্ননা। নিচের সিড়ি দিয়ে দেখলে বুদ্ধের মাথাটা অনেক উঁচুতে থাকে বলে ভালোমত দেখা যায় না। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই আমরা বুদ্ধের আই লেভেলের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম প্রায়। বুদ্ধের বিশাল মাথাটা আমাদের দিকে যেন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আমরা খানিক্ষন ঘোরাঘুরি করে শান্তি শান্তি জায়গাটা থেকে বের হয়ে গেলাম।

তারপর হাঁটতে লাগলাম তিব্বতি কলোনির দিকে। বেশি দূর যাওয়া লাগলো না। চারপাশেই দেখা পেলাম নেপালি, তিব্বতি স্টাইলের ঘরবাড়ির। রাস্তার দুপাশে সব দোকানপাট। কাঠ, ধাতু দিয়ে তৈরি শো পিসগুলো দেখতে ভালোই লাগছিলো। পোশাকে আশাকে সাধারন মানুষজন, এদের চেহারা মোটেও ইন্ডিয়ান নয় বরং সেই তিব্বতি বা নেপালি ছাপটা অনেক বেশি দৃশ্যমান। ছোট ছোট দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে আমরা একসময় চলে আসলাম সেই মল রোডে। মল রোডে ঢুকতেই নোভাদের সাথে দেখা। ওরা হাদিম্বা টেম্পল থেকে এসেছে। ওদের কাছে জানতে চাইলাম কেমন করে ওখানে যাওয়া যাবে। ওরা পরামর্শ দিলো না যাওয়ার। যেতে হয় অনেকদূর- গিয়েও ওদের কাছে তেমন ভালো লাগে নাই। আমরাও ভাবলাম আর যাবো না ওখানে।

মল রোডটা অনেক চওড়া একটা রাস্তা যেটাতে গাড়ি চলতে দেখি নাই বললেই চলে। পুরা রাস্তাটাই পথচারীদের জন্য। দুই লেনের ডিভাইডারে একটু পর পর বসার ব্যবস্থা। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে যাতে বিশ্রাম নেওয়া যায়। আর রাস্তার দুপাশে আছে দোকানপাট। কাশ্মীরি শাল, স্টোল, সোয়েটার, স্যুট, পঞ্চ, থ্রি পিস- এইসব জিনিসে ভরা সেই দোকানগুলো। আর জিনিসগুলোও দেখার মত। কাশ্মীরি কাপড়গুলোর দিকে আর তাকানো যাচ্ছিলো না। এত সুন্দর সুন্দর শাল আর স্যুট দেখে মনে হয় সব কিনে ফেলি। দামও মোটামুটি কম। একটু দরাদরি করে কিনতে হয়। তবে দোকানদারেরা বেশিরভাগই কাশ্মীরি- তারা দেখতে যেমন লম্বা, ফর্সা, সুন্দর, ব্যবহারও তেমনি ভদ্র। আমাদের অনেককেই এখানে শান্তিতে কেনাকাটা করতে দেখলাম। নিলয় তো একে একে ১৭টা শাল কিনে ফেললো! এছাড়াও আছে বাদাম যেমন কাজু, খেজুর, আঞ্জির, আলুবোখারা, খোরমানি ইত্যাদি, ফ্রেশ জুস, লোকাল মানালি ড্রেস। আগের রাতে লিচি আর পামের জুস খেয়ে দারুন মজা পেয়েছিলাম। এখানে সেই দোকানটা খুঁজে পেলাম। দোকান জুড়ে জুস, আচার, জ্যাম, মধু, আর প্রসেসিং করা শুকনা ফল। আমি জুস নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু ফোনে আম্মুকে বলতেই আম্মু না করে দিলো। বললো ভারি বোতল টানতে অনেক কষ্ট হবে। তখন মনে কষ্ট পেলেও উপদেশটা এক্কেবারে ঠিক ছিলো। আমি সস্তায় দুই প্যাকেট কাজু বাদাম, খোরমানি আর আলুবোখারা কিনলাম। আমরা যেটাকে আলুবোখারা বলি ওরা সেটাকে খোরমানি বলে, আর যেটাকে ওরা আলুবোখারা বলে সেটা আমি চিনলাম না তবে দেখতে বড় কিশমিশের মত। সব মিলিয়ে খরচ পড়লো ৪০০ রুপি। আমরা একটা দোকান থেকে ৫০ রুপি দিয়ে বিশাল একটা ভেজ স্যান্ডুইচ কিনে খেতে লাগলাম। এটাই আমাদের লাঞ্চ।

াদ
মল রোড (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

খেয়েদেয়ে আবার আমরা ঘুরতে লাগলাম। সারা মল রোডেই আমাদের লোকজনকে দেখা যাচ্ছিলো। সুমাইয়াকে দেখলাম রাস্তার উপর বসার জায়গায় বসে এক মনে স্কেচ করছে। নিশাত, তমাকে এক ঝলকের জন্য একটা দোকান থেকে বের হতে দেখলাম। মীম আর অন্তরা তো যেই দোকানে ঢুকছে সেই দোকান থেকেই কিছু না কিছু কিনে বের হচ্ছে। এক সময় আমি আর রুবাইদা বসে বসে গল্প করতে লাগলাম। আমাদের চারপাশে ‘খাঁটি জাফরান’ নিয়ে কয়েকজন ঘোরাঘুরি করতে লাগলো। এক জনকে দেখলাম অসম্ভব কিউট কয়েকটা খরগোশ নিয়ে বসে আছে। এদের সাথে ছবি তুলতে হলে পয়সা দিতে হয়। চারিদিকে কেমন যেন উৎসব উৎসব ভাব। সবাই খুশি খুশি মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে- দেখতেই আমার ভালো লাগছিলো।

ওদিকে চারটার মধ্যে আমাদের হোটেলে ফেরার কথা। আমি, রুবাইদা, মিম আর অন্তরা একটা অটোভাড়া করলাম চন্দ্রমুখী কটেজ পর্যন্ত। পার হেড ভাড়া পড়লো ৬০ রুপি। প্রায় পৌনে চারটার দিকে আমরা হোটেলে পৌঁছাই। হোটেলে যাওয়ার আগে রুবাইদা হঠাৎ বেকারির দোকানগুলোতে ঢুঁ মারতে চায়। কয়েকটা দোকানে ঢুকে দেখলাম মজার মজার কেক, বিস্কুট, পেস্ট্রি সারি সারি করে সাজানো। একটা দোকানে রুবাইদা সাদা রঙের বিস্কুট টাইপের একটা জিনিস কিনতে  চায়। জিনিসটা অনেক মজার ছিলো। আমি জার্নির আগে উলটাপালটা কিছু খাবো না, তারপরও রুবাইদার কাছ থেকে এক চিমটি খেয়ে দেখলাম- আসলেই অনেক মজার। জিনিসটার নাম আমরা বুঝি নাই। দোকান থেকে বের হয়ে মনে পড়লো দোকানটার নামও দেখি নাই। রুবাইদা বললো, ‘আরে, এরকম কয়েকটা গল্প আন ফিনিশড থাকতে হয়। আমরা সবাইকে বলবো ঐ যে চন্দ্রমুখী কটেজের বাম দিকে একটা বেকারির দোকানে কি যে একটা জিনিস খেয়েছিলাম- আহ হা…’।

হোটেলে ফিরে আমরা লাগেজের রুমে গিয়ে বসলাম। একটু পরে আমি গেলাম বারান্দায়। সেখানে আমি আর উর্মি দোলনায় বসে দোল খাচ্ছিলাম। বারান্দা দিয়ে এক পাশে বরফে ঢাকা সাদা আর ধূসর পাহাড় দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিলো, কেন চলে যাচ্ছি এখান থেকে? আরও কয়েকটা দিন এখানে থাকলে কি হতো? ওদিকে অদিতি নতুন লাগেজ কিনেছে। ভিডিও কনভারসেশনে বাসার সবাইকে দেখাচ্ছে ম্যাজেন্টা কালারের সেই লাগেজটা। দিনের আলো হটাৎ করেই যেন কমতে শুরু করলো। কমিটির লোকজন আমাদের জন্য জিপ ঠিক করে নিয়ে আসতে লাগলো। আমরাও একে একে মালপত্র নামিয়ে হোটেলের সামনের ঢালে জড়ো হতে লাগলাম। এই ঢালটা সিমলার ঢালের তুলনায় কিছুই না। মালপত্র মেইন রোডে তুলতে আমাদের তেমন কষ্ট হলো না। একটা জিপে আমি মালপত্র নিয়ে উঠে পড়লাম। জিপটা ছাড়ার আগেই দেখতে পেলাম চন্দ্রমুখী কটেজের সামনে কয়েকটা গাড়ি ভরে নতুন কাস্টোমার এসেছে। আমার মনে হলো যেন আমাদের রুমটাতেই আমি কাউকে যেন উঠতে দেখলাম। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। কয়েক ঘন্টা আগেও এই রুমটা আমার বাসার রুমের মতন আপন ছিলো, অথচ এখন সেটা অন্য কারো দখলে চলে গেছে। মানুষের জীবনটাও এরকম। সময়ের সাথে সাথে একজন মানুষের সব কিছুই অন্য কারও কারও দখলে চলে যায়। কিন্তু মানুষ সেটা বিশ্বাস করতে চায় না। সে শুধু বর্তমানের আনন্দটুকু নিয়েই ব্যস্ত থাকে। ঠিক যেমন আমি একটু আগেও হাসি, গল্প, আনন্দে মেতে ছিলাম- অনেকটা সেরকমই।

জিপ আমাদের নিয়ে থামালো এলয় পার্কিঙ্গে। এখানেই আছে আমাদের বাস গোয়েল। জিপের জন্য পার হেড ১৫০ রুপি করে ভাড়া পড়লো। বাসের পিছনে কাদা পার করে লাগেজ গুলো জড়ো করে রাখতে লাগলাম আমরা। অনেকের মালপত্র অনেক বেড়ে গেছে, তাই শুধু পিছনে লাগেজ আঁটছিলো না। কিছু লাগেজ আমরা আমাদের বসার জায়গাতেও তুলে নিলাম। প্রায় সাড়ে ৬টার দিকে বাস চলতে শুরু করলো দিল্লীর উদ্দেশ্যে।

আস্তে আস্তে রাত নামতে লাগলো। আমাদের বাস ইতোমধ্যে কয়েকটা টানেল পার হলো। আমরা চিৎকার করে আনন্দ করলাম। রাত নামতেই সেই পরিচিত দৃশ্য। পাশের পাহাড়ের গায়ে মিটমিট আলো জ্বলছে যেটাকে আকাশের তারার থেকে খুব একটা আলাদা করা যায় না। তবে সিমলার পাহাড়ের দৃশ্য আর মানালির পাহাড়ের দৃশ্যের মাঝে হাল্কা ফারাক আছে। সেটা নিজের চোখে না দেখলে বোঝা যায় না। এই সুন্দর দৃশ্যের সাথে উপরি পাওনা হিসেবে আকাশে একটা চাঁদের অস্তিত্ব দেখা গেলো। আমার মনে হলো ঘাড় ঘুড়িয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার ঘাড় ব্যাথা হয়েই যাবে। কিন্তু তারপরও তাকিয়ে রইলাম বাইরের দিকে। এই তো শেষ, আজকের রাতের পর এই দৃশ্য জীবনে হয় তো আর কোন দিনও দেখতে পারবো না। মনে মনে বললাম। ‘বিদায় মানালি, বিদায়’।  অনেক ঠান্ডা লাগছিলো, আমি ব্যাগ থেকে কম্বল বের করে মুড়িয়ে বসি। এক সময় আমাদের বাস রাস্তার পাশের এক পাঞ্জাবী ধাবায় থামে। সেখানে খাওয়া দাওয়া তেমন কিছুই নেই। অনেকেই ম্যাগি নুডুলস অর্ডার দেয়। লোকগুলা এত ঢিলা যে সেই নুডুলসের অর্ডার পেতেও প্রায় আধা ঘন্টা- পয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। সবাই যখন এক পর্যায়ে বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে যায় তখন বাটিতে করে সিদ্ধ নুডুলস আসে। আমি এক প্যাকেট চিপস খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলি।

তারপর আবার একসময় বাসে উঠি আমরা। বাস চলতে শুরু করে। জার্নিটা বেশ ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছিলো। কে যেন সামনে গিয়ে গান ছাড়ার ব্যবস্থা করতে বলে। কিন্তু জানা যায় আমাদের কাছ থেকে গান নিয়ে গান ছাড়া যাবে না, শুধু উনাদের কাছে যে সব গানের ক্যাসেট আছে সেগুলো ছাড়া যাবে। উপায় না দেখে আমরা তাতেই রাজি হই। ছাড়া হলো ১৯৮২ সালের ‘শোলা অর শবনম’ সিনেমার ‘তু পাগল প্রেমি আওয়ারা’ গানটা। অসহ্যকর গানের ‘ওয়ে ওয়ে ওয়ে ওয়ে ওয়ে ওয়ে ওয়…’ টানটা আমাদের মাথা ধরিয়ে দিলো। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন এই গানটা শেষ হবে। কিন্তু রহস্যজনক কারনে গানটা শেষই হচ্ছিলো না। যখনই আমরা ধারনা করছিলাম গানটা শেষ হবে তখনই কয়েক মাইক্রো সেকেন্ড বিরতি দিয়ে আবার কথা শুরু হয়ে যাচ্ছিলো। এক পর্যায়ে আমরা সবাই যখন দম ফেললাম যে গানটা শেষ হয়েছে, তখন আদিবা বলে উঠলো, ‘ আই হ্যাভ ডাউট যে গানটা সত্যিই শেষ হয়েছে-’ ঠিক তখনই আদিবার সন্দেহ সত্যি প্রমানিত করে গানটা আবার চলতে লাগলো। লোকজন উঠে হেল্পারকে অনুরোধ করে আসলো গানটা বন্ধ করার জন্য এবং আমাদের বাকি দিনগুলোতে যাতে আর কোনদিনই কোন গান ছাড়া না হয়। আমরা নিজেরা নিজেরা গানটাকে পচিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলাম। এক পর্যায়ে সবাই একে একে ঘুমিয়ে পড়লো। আমিও কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমালাম।

 

 

The Mighty INDIA CALLING: যে সৌন্দর্য শুভ্র নীহারের, যে সৌন্দর্য হিম কুয়াশার (পর্ব ১২)

লেপের তলায় মুখ গুঁজে থাকা অবস্থাতেই মৌলির ফোন বেজে উঠতে শুনলাম। ঘুম জড়ানো কন্ঠে মৌলি ফোনটা ধরলো। জাফর ফোন দিয়েছে। মৌলি ওকে জানালো আমরা ঘুম থেকে এখনো উঠি নাই, লেপের তলাতেই আছি। শুনে জাফর বললো শিগগিরি বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে তাকিয়ে দেখতে। শুনে মৌলি অনেক কষ্টে লেপের তলা থেকে বের হয়ে কোটটা গায়ে জড়িয়ে বিছানা ছেড়ে নামে। হঠাৎ শুনতে পাই চিৎকার। চিৎকার শুনে মজুমদার আর রুবাইদা তড়াক করে উঠে গেলো। আমিও উঠতে গেলাম কিন্তু হাতড়ে ওভারকোটটা পাচ্ছিলাম না। এবার শুনলাম তিনজনের সম্মিলিত চিৎকার। আমি আর অপেক্ষা করলাম না। কম্বলটা গায়ে জড়িয়েই উঠে পড়লাম। দৌড়ে গেলাম জানালার কাছে।

আমি থ হয়ে গেলাম। জানালা দিয়ে দেখা গেলো একটাই রঙ- সাদা। বাইরের সবকিছু সাদা। মাটি, পাকা রাস্তা, গাড়ি, গাছের ডাল, দূরের ঘর বাড়ি- সব সাদা। এক সাদা স্বপ্নের জগতে এসে পড়েছি যেন। সারা রাত তুষারপাত হওয়ার কারনে সব কিছু পুরু বরফের নিচে চাপা পড়ে আছে। দৃশ্যটা দেখে আমার গলা দিয়ে অন্য তিনজনের মত অটোমেটিক চিৎকার বের হয়ে আসলো। আমরা চার জন লাফাতে লাফাতে চিৎকার করতেই থাকলাম। মনে হতে লাগলো খুশীতে আমাদের বুঝি মাথা নষ্ট হয়ে যাবে, আমরা বুঝি পাগল হয়ে যাবো। তারপরও আমরা থামলাম না, একে অন্যকে জড়িয়ে লাফাতে লাগলাম। তাড়াতাড়ি আম্মুকে ফোন দিলাম। খুশীতে আমার গলা দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিলো না। তারপরও কোনমতে বললাম সবকিছু। একে তো মোবাইলে ব্যালেন্স তেমন নাই তার উপর কবে ব্যালেন্স ভরতে পারবো সেটাও জানি না। তাই বেশিক্ষন কথা বলতে পারলাম না। আম্মুও সব শুনে অসুখ বিসুখ না বাধানোর একগাদা উপদেশ দিয়ে ফোন রেখে দিলো।

আমরা তাড়াতাড়ি করে যে যেভাবে ছিলাম তার উপরই কোনমতে গায়ে কোট জড়িয়ে, পায়ে জুতা গলিয়েই বের হয়ে পড়লাম। চারিদিকে সাদা বরফের রাজ্যে পা দিয়েই এক ধরনের শিহরণ অনুভব করলাম। নিস্তব্ধ এক সাদা জগতে আমরা কয়েকজন রঙ্গিন পোশাক পরে হাঁটতে লাগলাম। আমার জুতার সোল বরফে ডুবে যাচ্ছিলো। ওয়াটার প্রুফ জুতা ছিলো বলে বাঁচোয়া। তারপরও মনে হচ্ছিলো জুতার সোলটা বোধহয় ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। তবে এসব পাত্তা না দিয়ে আমরা ঘুরতে লাগলাম। বরফের মধ্যে ছেলেমানুষের মতন ছুটে বেড়াতে লাগলাম। সাদা বরফগুলোকে গ্লাভস পরা আঙ্গুল দিয়ে গুতিয়ে দেখতে লাগলাম, পা দিয়ে নিচের বরফগুলোকে লাথি মারতে লাগলাম, বরফে ঢাকা গাড়ির সামনে ছবি তুললাম আর চন্দ্রমুখী কটেজের বারান্দা থেকে আমাদের যারা বের হয়নাই তারা দাঁত বের করে হাসতে লাগলো।

এফ
চন্দ্রমুখী কটেজের সামনে তখন সবই সাদা (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

কে যেন তাড়া দিলো নাশতা খেয়ে রেডি হয়ে নেওয়ার জন্য। আমরা তাড়াতাড়ি রুমে ফিরে গেলাম। রুমে একজন একজন করে ফ্রেশ হয়ে রেডি হতে লাগলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম আমার গাল গুলো টকটকে লাল হয়ে গেছে। আমি বেশ কয়েকবার ছবি তুলে গালের লাল রংটা ধরে রখতে চাইছিলাম। কিন্তু কোনভাবেই ক্যামেরায় সেটা আসছিলো না। পাশের রুমের সৃষ্টির কাছে থেকে হেয়ার ড্রায়ার এনে লাগেজ খুলে যত্তগুলা গরম কাপড় এনেছিলাম সবগুলো গরম করে গায়ে পরে নিলাম। সবকিছু পরে যখন শেষে ওভারকোটটা গায়ে দিলাম তখন হাত পা আর নাড়াতে পারছিলাম না। এত্তগুলো গরম কাপড় গায়ে দিয়ে আমরা সবাই কেমন যেন কার্টুনের মত হাঁটতে চলতে লাগলাম।

হোটেল থেকে বের হয়ে বাম দিকে হাঁটতে লাগলাম। রাস্তার পাশে ছোট ছোট দোকান। সেগুলোতে ছাতা, গামবুট, গরম কাপড় এইসব ভাড়া দেওয়া হয়। আমরা দৈনিক হিসাবে ছাতা ৩০ রুপি আর গামবুট ৫০ রুপি দরে ভাড়া নিলাম। আকাশের অবস্থা সুবিধার ছিলো না। ঐ দোকানে থাকতে থাকতেই গুড়া গুড়া তুষার পড়তে লাগলো। আমরা এর মধ্যেই ভেজা রাস্তার মধ্য দিয়ে হেঁটে একটা ছোট পাঞ্জাবী ধাবা টাইপের দোকানে নাশতা করতে ঢুকলাম। আমরা অর্ডার দিলাম ২৫ রুপির আলু পরোটা আর ৩০ রুপির ডাবল ডিমের অমলেট। আমরা গুটিসুটি মেরে দোকানে বসে রইলাম। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা আর তুষারপাত আর ভিতরে আমরা হাহা হিহি করে নিজেদের গরম রাখার চেষ্টা করছিলাম। আমাদের সামনেই একজন মহিলা আর তার স্বামী মিলে পরোটা বানাচ্ছিলো আর গরম তাওয়ায় তেল ঢেলে আলু পরোটা ভাজতে লাগলো। কিন্তু ওনাদের মধ্যে কোন তাড়া দেখতে পাচ্ছিলাম না। এমন আস্তে আস্তে ময়দা বেলে তার মধ্যে আলু ঢুকিয়ে পরোটা বানাচ্ছিলেন যেন ওনারা বাসার জন্য নাশতা রেডি করছেন। আমরা ধৈর্য ধরে বসে থাকলাম নাশতা খাওয়ার জন্য। অবশ্য চুলা থেকে নামানো পরোটা আর প্রায় ডুবো তেলে ভাজা ডিমটা অনেক মজা ছিলো।

খেয়ে দেয়ে আমরা হোটেলের সামনে এসে জড়ো হলাম। সেখানে জানতে পারলাম আমাদের আজ রাতেই আমাদের মানালি ছেড়ে দিল্লীর দিকে রওয়ানা হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আবহাওয়ার অবস্থা আর মানালির সৌন্দর্য দেখে ডিসিশন নেওয়া হয়েছে যে আজ আমরা মানালি থেকে যাবো। পরদিন দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো ইনশাল্লাহ । আর আজ রাতেই আমাদের সবার জন্য কমিটির তরফ থেকে অ্যারেঞ্জ করা হবে ‘সারপ্রাইজ পার্টি’। ইতোমধ্যে আবহাওয়ার কারণে আমাদের যে জায়গায় যাওয়ার কথা ছিলো (সম্ভবত সোলাং ভ্যালি) সেটা ক্যান্সেল হয়ে গেছে। তার বদলে আমরা নেহেরু কুন্ডে যাবো বলে ঠিক হলো। এর জন্য কমিটি জিপ ভাড়া করে রেখেছে। আমরা দুদ্দাড় করে জিপে উঠে বসতে লাগলাম। একটা করে জিপ ভরে উঠতে লাগলো আর একটা করে জিপ ছাড়তে লাগলো।

দফগ
নেহেরু কুন্ডে যাবার ঘোলাটে সাদা পথ (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

জিপে করে নেহেরু কুন্ডে যাওয়ার রাস্তাটা অত্যন্ত উপভোগ্য ছিলো। আস্তে আস্তে হাল্কা তুষারপাত বাড়তে লাগলো। এক সময় সেটা এতই বেড়ে গেলো যে ড্রাইভারকে ঘন ঘন ওয়াইপার চালাতে হলো সামনের কাঁচ পরিষ্কার রাখার জন্য। দুপাশের দৃশ্যের কথা আর কি বলবো, সেই দৃশ্য বর্ননা করার সাধ্য আমার নেই। সবাই হাঁ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মজুমদারকে ড্রাইভার বললো এই রকম ওয়েদার খুব একটা থাকে না। আর এক দুই দিনের মধ্যেই হয়তো তুষারপাত বন্ধ হয়ে আবার স্বাভাবিক ওয়েদার হয়ে যাবে। মজুমদার ওর মোবাইল গাড়ির সামনের কাঁচে লাগিয়ে ভিডিও করতে লাগলো। আমি উশখুশ করতে লাগলাম। পায়ের তালুতে কেমন যেন যন্ত্রনা হচ্ছে। যন্ত্রনা বাড়তে বাড়তে যখন অসহ্যকর হয়ে পড়লো তখন গামবুট খুলে ফেললাম। এক লেয়ার পলিথিন ব্যাগ আর তিনটা মোজা খুলে যখন পায়ে হাত দিলাম, টের পেলাম ভেজা। এত সাবধানতা সত্ত্বেও কেমন করে পায়ে পানি বা বরফ কুচি পৌঁছালো সে রহস্য ভেদ করতে পারলাম না। কি আর করা, কাপড় দিয়ে পা মুছে মাত্র একটা মোজা পরে আবার পা গামবুটে ঢুকালাম। ভেজা মোজা গুলো ব্যাগে ভরলাম।

এক সময় আমরা যায়গায় এসে পৌঁছালাম। জিপ থেকে বের হয়েই ভারি তুষার পাত মাথায় নিয়ে দৌড় দিলাম। দেখলাম সবাই একটা দোকানে ঢুকছে। আমরাও ঢুকে পড়লাম। সেখানে ২০০ রুপি দিয়ে বরফের মধ্যে দিয়ে চলাফেরা করার জন্য বিশেষ জামা ভাড়া পাওয়া যায়। দোকানে ঢুকার সাথে সাথে ওরা আমাদের সাইজের রংচঙ্গে সব জামা বের করে দিতে লাগলো। আমাকে দিলো বিশাল সাইজের লাল নীল রঙের হাস্যকর একটা জামা। আমরা ঠিক মত পরতে পারছিলাম না। ওরা আমাদের পরিয়ে দিতে সাহায্য করছিলো। আমরা গায়ের সব গরম কাপড় এমন কি ওভারকোট সহ সেই জামার ভিতরে ঢুকে পড়লাম। আমি পায়ের জন্য কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমাকে বাঁচিয়ে দিলো তমা। ও ব্যাগের ভেতর থেকে এক জোড়া মোটা মোজা বের করে দিলো। আমি চটপট সেই মোজা পায়ে পড়ে ফেললাম। তারপর বের হয়ে পড়লাম সেই দোকান থেকে। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটা ছোটখাটো ঢাল, সেটা পুরাই বরফে ঢাকা। কেমন করে সেই পার হবো সেটা চিন্তা করে মাথা চুলকাতে লাগলাম।

যাই হোক হাচড় পাচড় করে কোনমতে বরফ বেয়ে বেয়ে সেই ঢাল পার হলাম। তারপর হাঁটা ধরলাম সামনের দিকে। এসে পড়লাম ঠিক যেন উত্তর মেরুর কোন জায়গায়। চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ। কিছু বোঝার আগেই বড় বড় পেঁজা তুলার সাইজের তুষার পড়তে লাগলো। যেন এক সাদা ঝড়ের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। অবস্থা এমন হলো যে, আমরা শুধু চার পাঁচ হাত সামনের মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছি। এর বাইরে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না, সবই সাদা আর সাদা। পুরা জিনিসটা কেমন যেন স্বপ্নের মত লাগলো। নরম বরফের উপর পা ফেলে ঠিক মত হাঁটতে পারছিলাম না। এর মধ্যে রিজভীকে দেখলাম ক্যামেরা বের করে বেশ বিপদে পড়েছে। আমি ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম আর তার নিচে রিজভী ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে ছবি তুলতে লাগলো। আমার নিজের ক্যামেরাটা নিয়েও বেশ চিন্তায় পড়লাম কারণ আমার ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগ নাই। তারপর পলিথিন বের করে ক্যামেরাটা ভরে ভালোমত গিঁট দিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলাম। জোর তুষারপাতের মধ্যেই আমরা একে ওকে বরফের বল মারতে লাগলাম। একটা করে পা ফেললেই পায়ের গামবুটের নিচে চুরচুর করে ভাংতে লাগলো বরফ। সাদার সমুদ্রে হঠাৎ হঠাৎ একেক জনকে খুঁজে পাচ্ছিলাম আমরা। উর্মি, আদিবাকে দেখলাম তুষার মানব বানাতে। আমিও হাত লাগালাম। টিভিতে তুষার মানব বানানো দেখে যতটা সোজা মনে হয় বাস্তবে ততটা সোজা নয়। আমাদের তুষারমানব দেখতে অতটা ভালো হলো না, তবে আমরা মাফলার, সানগ্লাস, চিং এর রঙ্গিন ছাতা দিয়ে ওকে ফিনিশিং দিয়ে ছবি তুললাম।

এফদ
ভারী তুষারপাতের কারণে কারও চেহারাই দেখা যাচ্ছে না (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

এর মধ্যেই স্কি নিয়ে কয়েক জন আমাদের পিছে পিছে ঘুরতে লাগলো। আমি যেহেতু স্কিয়িং পারি না, তাই রাজি হলাম না। তবে অনেকেই স্কি ভাড়া নিয়ে চেষ্টা করলো। তারপর মানালি ড্রেস নিয়ে কয়েকজন মহিলা ঘুরঘুর করতে লাগলো। ঝড় একটু কমলে মজুমদার সবার আগে মানালি ড্রেস ভাড়া করে পড়লো। দেখাদেখি আমরা সবাই সেই ড্রেস ৫০ রুপি দিয়ে ভাড়া করে পড়লাম আর ছবি তুললাম। অবনীকে মাঝখানে রেখে আমরা গোল হয়ে সবাই নাচতে লাগলাম। কোন কথা নাই, সুর নাই- তবে আনন্দের কোন কমতি ছিলো না। আমাদের কি যে ভালো লাগছিলো তা আর বলার মত না। আমরা বরফে ডুবে ডুবে ছবি তুলছিলাম। বল ছোড়া তো ছিলই, এছাড়া বরফে শুয়ে বাটারফ্লাই তৈরি করার চেষ্টাও করছিলাম আমরা। এত দৌড় ঝাপ করতে করতে আমার এক রকম গরমই লাগছিলো। তারপর শুনলাম অনেকেই বলছে যে তাদেরও গরম লাগছে। এর মধ্যে নিশাত হাসি মুখে জানালো যে ওর নাক থেকে নাকি রক্ত পড়ছে। বরফে আসলে অনেকেরই এমন হয় শুনেছি, সেদিন সামনা সামনি দেখলাম। আমাদের আশেপাশে যেসব কুকুর ঘোরাফিরা করছিলো তারা দেখতে অনেকটা নেকড়ের মত। এ ছাড়াও আস্ত এক চমড়ি গাই বিশাল শরীর নিয়ে বড়লোকি চালে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিলো। এদের সাথে ফটো তুললে মালিককে ভাড়া দিতে হয়। কেউ কেউ ফ্লাস্কে করে চা কফি বিক্রি করছিলো। আর কয়েকজন আবার কৌটায় করে ‘খাঁটি’ জাফরান নিয়ে সবার পিছে পিছে ঘুরতে লাগলো। ছেলেরা কয়েকজন ‘খাঁটি’ জাফরান কিনে ফেললো প্রায় পানির দরে। আস্তে আস্তে তুষারপাত কমতে কমতে এক সময় থেমেই গেলো। তখন চারদিক একটু একটু করে পরিষ্কার হতে লাগলো।

ওর
আস্তে আস্তে কুয়াশা সরে দূরের রহস্যময় পাহাড়গুলো উঁকি দিতে লাগলো (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম। দূরের বরফ ঢাকা পাহাড়গুলো যেন কেমন বেহেশ্ত থেকে এসেছে বলে মনে হলো। সাদা রঙের আলো ছায়ার খেলা চলতে লাগলো সেই পাহাড়গুলোতে। হাল্কা ধূসর রঙের আকাশের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ সাদা রঙের আলোর পিছনে দূরের একেকটা পাহাড় অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগলো, আবার পর মুহূর্তেই সেই সাদা কুয়াশার আলো সরে যেতেই পাহাড়গুলোকে দেখা যেতে লাগলো। আমরা চোখ সরাতে পারছিলাম না। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম সেই বেহেশ্তি দৃশ্য। ছোটবেলায় যখন স্টুডিওতে ছবি তুলতে যেতাম তখন পিছনে ব্যাকগ্রাউন্ডে কাঁচা হাতে আঁকা বরফের পাহাড়ের দৃশ্য দেখতাম। আমার মনে হলো ঠিক যেন সেই রকম কোন স্টুডিওর ব্যাকগ্রাউন্ড আমি দেখতে পাচ্ছি। তবে শিল্পী যখন আল্লাহ নিজেই, তখন  ওয়ার্কম্যানশিপ কোন লেভেলের হবে সেই প্রশ্ন না করে নিজে থেকেই বুঝে নেওয়া ভালো। এই রকম মনোমুগ্ধকর জায়গা থেকে আমাদের নড়তে কোনই ইচ্ছা করছিলো না। কিন্তু কমিটির লোকজন তাড়া দিতে লাগলো কারণ আবার আকাশ কালো হয়ে যাচ্ছে। তার মানে আবার সেই তুষারপাত শুরু হতে পারে। আবহাওয়া খারাপ হওয়ার আগেই আমাদের হোটেলে পৌঁছানো দরকার।

এফ
ট্যুরের মধ্যে সবচেয়ে আনন্দময় দিনে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

আমরা আগের রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে বের হয়ে সেই দোকানে গেলাম। ওখানে ড্রেস ফেরত দিয়ে আবার জিপে চেপে বসলাম। যখন হোটেলে পৌঁছালাম তখন প্রায় দেড়টা বাজে। হোটেলে না গিয়ে সোজা আগের দিনের সেই খাওয়ার দোকানে গিয়ে ঢুকলাম। এবার ৭৫ রুপি দিয়ে অর্ডার দিলাম ভেজ চপ্সুয়ে। আমরা কান্নুর সাথে দুষ্টামি করতে লাগলাম। কান্নুও পালটা  আমাদের ছাতা টেবিল থেকে টেনে ফেলে দিতে লাগলো। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চপ্সুয়ে আসলো। কি যে মজা, আহহহহহ!

রুবাইদা, মৌলি আর মজুমদার শপিং এ যাবে বললো। আমার একটু আরাম করতে ইচ্ছা করছিলো। আমি শপিং এ যাবো না ঠিক করলাম। মজুমদারের কথা অনুযায়ী খুঁজে খুঁজে ভোদাফোন রিচার্জের একটা দোকান বের করলাম। সেখানের লোকটা বললো ২১৪ রুপি রিচার্জ করতে হলে ২২২ রুপি দিতে হবে। আমি তার কারণ জানতে চাইলে লোকটা জানালো যেহেতু আমারটা কলকাতার সিম, তাই কলকাতার বাইরে রিচার্জ করতে হলে বাড়তি চার্জ দিতে হবে। এই রকম আজাইরা নিয়ম শুনে মেজাজ আমার খারাপ হয়ে গেলো। কিছু না বলে তাও রিচার্জ করে নিলাম। তারপর সিমলা থেকে মজুমদারের কিনে দেওয়া ২০ রুপির কার্ড বের করে উনাকে বললাম রিচার্জ করে দিতে। লোকটা চাঁদ মুখ করে বললো মানালির বাইরে থেকে কেনা কার্ড মানালিতে রিচার্জ হবে না। এই কার্ড রিচার্জ করতে চাইলে আমাকে সিমলা যেতে হবে। শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। এ কি দেশ রে বাবা! সেই চন্ডীগড়ের শেষের দিক থেকে রিচার্জ খুঁজতে খুঁজতে এই মানালিতে এসে রিচার্জ করতে পারলাম তাও ৮ রুপি বাড়তি দিয়ে, আবার বলে এক শহরের কার্ড অন্য শহরে কাজ করবে না। এরা যদি বাংলাদেশের মোবাইল কোম্পানিগুলার সার্ভিসের অবস্থা দেখতো তাহলে মনে হয় মাথা ঘুরে পড়েই যেতো।

আমি হোটেলে ফিরে নিরিবিলি নামাজ আদায় করে লেপ, কম্বলের নিচে ঢুকে শুয়ে থাকলাম। ঘুম তেমন আসলো না। তবে বিশ্রাম হলো। এক সময় অন্তরা আসলো গল্প করতে, আমরা অনেকক্ষন গল্প করলাম। দেখতে দেখতে ঝুপ করেই সন্ধ্যা নামলো। আমি মাগরিবের নামাজ পড়ে আম্মু, বড় মামা আর মিজান আংকেলকে ফোন দিলাম। কিছুক্ষণ পর মজুমদার, মৌলি আর রুবাইদা শপিং করে ফেরত আসলো। রুবাইদা কি কি কিনেছে দেখালো। বাইরে হঠাৎ গান শুনতে পেলাম। অন্তরা বললো মনে হয় আমাদের পার্টির গান। আমি বললাম তাই বলে এত আগে গান ছাড়বে। মজুমদার আর মৌলি বললো নিচে আমাদের পার্টির জন্যই গান হচ্ছে। ডিজে আনা হয়েছে নাকি। মৌলি আর মজুমদার নিচে নাচানাচি করতে চলে গেলো। রাত ৯টার দিকে আমি আর রুবাইদাও বের হলাম। আমরা প্রথমে গেলাম গাম বুট আর ছাতা ফেরত দিতে। নিজেদের জুতা পরে আমরা আসলাম আমাদের পার্টির স্থানে।

খোলা আকাশের নিচে কতগুলো চ্যালাকাঠ জমা করে আগুন জ্বালানো হয়েছে। তার একপাশে এক ডিজে ফিউশন করা মিউজিক বাজাচ্ছে আর তালে তালে আগুনের চারপাশে সবাই গোল হয়ে নাচানাচি করছে। দেয়ালের পাশে হাফ ওয়ালে যারা টায়ার্ড হয়ে যাচ্ছে তারা বসে কিছুক্ষন রেস্ট নিচ্ছে, রেস্ট নেওয়া হয়ে গেলেই আবার নাচতে চলে যাচ্ছে। রুবাইদা বললো যে ও রুমে গিয়ে বসে থাকতে চায়। আমি বললাম ঠিক আছে, খাওয়ার সময় হলে আমি ডেকে দিবো। রুবাইদা চলে গেলে আমি হাফ ওয়ালের উপর বসে পড়ি। আমার খুব ভালো লাগছিলো। সবার চোখেমুখে এক ধরনের আনন্দের ঝিলিক। এই নাচের মধ্যেই মাঝে মাঝে কয়েকজন মিলে আলাদা হয়ে পড়ছিলো, তখন আবার বাকি সবাই মিলে তাদের পচাচ্ছিলো। কিছুক্ষন পর মায়িশা এসে আমার সাথে যোগ দেয়। আমরা দুইজন শুধু বসে থাকি আর অন্যদের দেখতে থাকি। এর মধ্যে জুবায়ের এক জগ গরম পানি এনে দেয়। সবাই খুব মাঞ্জা মেরে গরম পানি জগ থেকে ঢোঁক দিয়ে খেতে থাকে। আমি সবাইকে দেখছিলাম, অন্তরা, ঐশি, কৌশিক, নিলয়, নোভা, তুষার, জাফর, মজুমদার, মৌলি, সৃষ্টি, সৌরভ, সীমান্ত আফরা, হিমি, আদিবা – সবাইকে। সবার আনন্দ দেখে মনে হচ্ছিলো যেন আমাদের জীবনে কোন দুঃখ নাই, কোন দিন ছিলোও না। এ জীবন যেন শুধুই আনন্দের।

নাচানাচি শেষ করে আমরা খাওয়ার রুমে গেলাম। সেখানে আমাদের জন্য বুফে ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভাত, সবজি, মুরগি, ডাল, গাজরের সালাদ আর গরম পানি। জুবায়ের আশ্বস্ত করলো যে প্রত্যেকটা মুরগি ও নিজে জবাই করেছে। আমি রুবাইদাকে ডেকে আনলাম। তারপর সবাই খেতে বসলাম। মেনুটা যত বাঙ্গালি বলে মনে হয়, স্বাদটা ততটা নয়। সবগুলো খাবারই ঝাল। তবে সবজিটা অনেক মজা ছিলো। আর সাথে গরম পানিটাও খুব ভালো লাগছিলো। অনেকদিন পর সালাদ হিসেবে পাওয়া গাজর খেতেও মন্দ লাগছিলো না। যাই হোক আমরা খুব উপভোগ করলাম আমাদের খাওয়া। খাওয়া শেষে হাত ধুতে গেলাম যখন কলের পানিতে, আমার মনে হলো ঠান্ডা পানির স্রোতে আমার পুরা হাত অবশ হয়ে গেছে। খাওয়ার পর ঘোষণা আসলো, আমাদের জন্য মানালির বিখ্যাত তাজা ফলের সিরাপ কেনা হয়েছে। আমরা যেন কমিটির রুমে গিয়ে সিরাপ দিয়ে বানানো জুস খেয়ে আসি। আমরা ডাইনিঙ্গের সিড়ি বেয়ে কমিটির চার তলার রুমে উঠলাম।

সেটা ছিলো হানিমুন স্যুট। চৌচালা রুফের নিচে এত্ত সুন্দর একটা রুম যা দেখেই আমাদের সবার মাথা ঘুরে গেলো। আমরা সবাই মাটিতে পাতা কার্পেটের উপর বসলাম। বিছানায় বসে শুভ আমাদের মধ্যে কাল্পনিক একটা লাইন টেনে বললো দুই দলের মধ্যে গানের কলি খেলা হবে। ব্যাস আর যায় কই, সবাই হৈ হৈ করে গান যুদ্ধে নেমে পড়লো। এই হোটেলে আমরা ছাড়া আর কেউ নাই। তাই আমাদের গলা ছেড়ে গান গাওয়ার পাশাপাশি হৈচৈ চিৎকার করতে কোনই বাধা রইলো না। জোরসে শুরু হলো গান গাওয়ার পাশাপাশি আমাদের আড্ডাবাজী। আর অন্য পাশে জুবায়ের সোফায় বসে এক গ্লাস এক গ্লাস করে জুস বানাতে লাগলো। তারপর রিজভী সেগুলোকে ছোট ছোট ওয়ান টাইম কাপে ঢেলে এক কাপ এক কাপ করে সবার মধ্যে পাস করতে লাগলো। তারপর আমি উঠে গেলাম ওদের সাহায্য করতে। একটা ছোট ট্রেতে রিজভীকে বললাম কাপগুলো তুলে দিতে। আমি সেই ট্রেটা নিয়ে সবার কাছে কাছে গিয়ে এক কাপ এক কাপ করে জুস দিতে লাগলাম।

দে
ঠান্ডার রাতে জুস খেতে ব্যস্ত সবাই (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

ওদিকে গান যুদ্ধ খুব জমে উঠেছে। জাফর আর উর্মি একসাথে চড়াও হয়ে উঠছে অন্য দলের উপর। অন্য দলের নোভা আর মজুমদারও সমান সমান লড়ে যাচ্ছে। জাফর তো আরও সাংঘাতিক, ও এতই সিরিয়াস গানের ব্যাপারে যে বেশ কয়েকবার ভুল করে সে অন্য দলের পক্ষ হয়ে গানও গেয়ে ফেললো। আর ওদিকে জুবায়ের দ্যা জুস মেকার জুস বানিয়ে যেতেই লাগলো, রিজভী দ্যা সাপ্লাইয়ার কাপে জুস ঢেলে দিতে লাগলো আর আমি পাঁচ ছয় রাউন্ড করে জুস বিলি করতে লাগলাম। দুইটা ফ্লেভারের জুস ছিলো। জুসটা এতই ভালো ছিলো যে কারও সামনে নিয়ে যখন জিজ্ঞেস করতাম, ‘দিবো?’ সে বিনা দ্বিধায় হাত বাড়িয়ে কাপটা তুলে নিতো।

এই করতে করতে কখন যে রাত সাড়ে ১২টা বেজে গেলো টেরই পাই নাই। এক সময় আমাদের আসর ভেঙ্গে গেলো। সবাই কমিটিকে ধন্যবাদ দিয়ে যার যার রুমে ফেরত গেলো। সেই আগের মতন আমরা সবাই লেপ কম্বলের নিচে চাপা পড়ে ঘুমাতে লাগলাম।

 

The Mighty INDIA CALLING: লে কর্বুসিয়ের এর শহর এবং একজন পাথর প্রেমিকের আশ্চর্য জগৎ (পর্ব ৯)

সকালবেলা যখন ঘুম থেকে উঠলাম, মনে হলো চারপাশে ঠান্ডার ভাপ জমে আছে। সব গুছিয়ে নিয়ে ওভার কোট গায়ে দিয়ে রুম থেকে বের হলাম। সকাল ৮টা ২০শের দিকে সব লাগেজ লিয়াদের রুমে জমা দিলাম। ছোট ডাবল রুমে এতগুলা মানুষের এতগুলা লাগেজ, ব্যাগপ্যাক আরও অন্যান্য ব্যাগ ঢুকাতে আমাদের সেই কায়দাকানুন করতে হলো। শেষমেষ এমন অবস্থা হলো যে শুধুমাত্র দরজা লাগানোর জায়গাটুকু আছে, আর বাকি পুরো রুমের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা জুড়ে শুধুই লাগেজ আর লাগেজ। অনেক কষ্টে সব ব্যবস্থা করে আমরা বের হলাম নাশতা করার জন্য।

আগের দিনের খুশি ধাবাতে আর যেতে ইচ্ছা করলো না। আমরা খুঁজে খুঁজে নতুন দোকান বের করলাম যার নাম রজনী ধাবা। চিকন লম্বা একটা দোকান। তিনটা টেবিল আর চারটা করে চেয়ার। আমি অর্ডার দিলাম ১০ রুপির আলু পরোটা আর  ২৮ রুপির মিক্সড ভেজিটেবল। সাথে যথারীতি মুলা কুচি। তবে খাওয়াটা ভালোই ছিলো। খেয়েদেয়ে আমরা গোয়েলে উঠলাম। গন্তব্য চন্ডীগড় হাইকোর্ট।

ফস
পাঞ্জাবী খাওয়া দাওয়া (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী)

আবার সেই বোরিং রাস্তা আর একই রকম মোড় পার হতে হতে এক সময় আমরা বেশ সবুজ গাছগাছালিতে ঢাকা একটা জায়গায় এসে পড়লাম। এখান থেকে শুরু রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া। আমরা লাইন ধরে দাঁড়ালাম। আমাদেরকে বললো চুপচাপ থাকতে। কিন্তু আমরা যখন ৪৬ জন দ্বিমিকবাসী একসাথে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা কি আর হয়? বেশ খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর পারমিশন মিললো। অনেকক্ষণ ধরে আমাদের কিছু নিয়মকানুন বলা হলো। তারপর আমাদেরকে চেক করে করে ভিতরে ঢুকতে দিলো। গাইড হিসেবে সাথে থাকলো একজন ইউনিফর্ম পরা লোক। আমরা চেকিং পার হয়েই একটা গ্রুপ ছবি তুললাম। তারপর হাঁটতে লাগলাম। দুপাশে সবুজ ঘাস আর তার মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা পাথুরে রাস্তা দিয়ে শীতের সকালে হাঁটতে লাগলাম আমরা। এক সময় পৌঁছে গেলাম হাইকোর্ট ভবনে।

বিল্ডিঙ্গের সামনে হাজার খানেক মটর সাইকেল পার্ক করে রাখা। আমরা র‍্যাম্প দিয়ে উঠতে লাগলাম উপরে। সেই কি র‍্যাম্প, পা ধরে আসলো সবার। এক পর্যায়ে ছাদের মতন খোলা জায়গায় এসে পড়লাম। কিছুক্ষন সেখানে থেকে তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। তারপর এসে পৌঁছালাম বিখ্যাত সেই রঙ্গিন ওয়ালের সামনে। লাল, হলুদ আর সবুজ এই তিনটা রঙের ওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা খ্যাচ খ্যাচ ছবি তুলতে লাগলাম। এতক্ষন তাও যা আমরা চুপচাপ ভদ্র থাকার চেষ্টা করছিলাম, এই ওয়াল দেখে আমাদের ভদ্র সেজে থাকার সব চেষ্টা বৃথা গেল। আমাদের দৌঁড় ঝাঁপ দেখে সেই গাইড বেচারা তাজ্জব হয়ে গেলো। কয়েকবার সেই লোক আমাদের চুপ করার অনুরোধ করেও শেষমেশ হাল ছেড়ে দিলো। আমাদের তাড়া দিলো সামনে আগানোর জন্য।

সস
বিখ্যাত হ্যান্ড স্কাল্পচারের সামনে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় ইফফাত রিদওয়ানা ঐশী)

আমরা একটু এগিয়ে লে কর্বুসিয়েরের হ্যান্ড স্কাল্পচারের সামনে গিয়ে গ্রুপ ফটো তুললাম। তারপর চলে গেলাম হ্যান্ড স্কাল্পচারের একদম কাছে। সেখানেও সমানে চলতে লাগলো ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক। সেই গাইড আমাদের আবার তাড়া দিয়ে সামনে হাঁটতে বললো। চমৎকার পার্কের মতন জায়গা দিয়ে আমরা হেঁটে বেড়াতে লাগলাম। অনেকক্ষন হাঁটার পর আমরা একটা বিল্ডিঙের সামনে আসলাম কিন্তু ছুটির দিন দেখে সব বন্ধ, আমাদের ঢুকতে দিলো না। আমরা সময় নষ্ট না করে পার্লামেন্ট বিল্ডিঙের দিকে হাঁটতে লাগলাম। শীতের দিনে গাছগাছালি ঘেরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে আমার খুব ভালো লাগছিলো। হাঁটতে হাঁটতে এক এক সময় বেশ গরমও লাগছিলো। আমি ওভার কোটটা খুলে ফেললাম।

অনেক্ষণ হেটে শুকনা প্যাচপ্যাচা ওয়াটার বডি পার হয়ে আমরা পার্লামেন্ট বিল্ডিঙের পিছন দিকে এসে পৌঁছালাম। দ্যা মাইটি ইয়েলো ওয়াল! ডিপার্টমেন্টে ঢোকার পর থেকে কত মানুষের ছবি দেখেছি এই হলুদ ওয়ালের সামনে- আজকে আমরা এখানে এই কথাটা ভাবতেই কেমন যেন আনন্দ লাগলো। ততক্ষনে হাঁটতে হাঁটতে সবাই টায়ার্ড হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ রেস্ট নেওয়া হলো। তারপর গ্রুপ ফটো। নানা রকম ফটো- খালি ক্লিক ক্লিক।

এতদূর হেঁটে সবার এনার্জি লেভেল ডাউন হয়ে গেছে। এরপর আরও হেঁটে যখন বিধানসভা বিল্ডিঙ্গে এসে পৌঁছালাম তখন সবার গলা শুকিয়ে গেছে। অনেকেই বসে পড়লো। অনেকে পানির খোঁজ করতে গেলো। অবশেষে সুপেয় পানি পাওয়া গেল। আমরা সবাই ঢকঢক করে ঠান্ডা পানি খেলাম। এই বিল্ডিংটাও মোটামুটি ঘুরেফিরে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। আবারও অনেক হাঁটা। বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে গোয়েলে এসে পৌঁছালাম। গোয়েলে উঠে হাত পা ছেড়ে বসলাম। গোয়েল আমাদের নিয়ে রওয়ানা দিলো চন্ডীগড় আর্কিটেকচার স্কুলের দিকে।

এক দিকে দুপুর হয়ে গেছে, তার উপর সকাল থেকে এত হাঁটা হাঁটি করার কারনে খিদেয় সবার পেট চোঁ চোঁ করতে লাগলো। আমরা ব্যাস্ত রাস্তাঘাট পার হয়ে এগুতে লাগলাম। এক সময় গোয়েল আমাদের নামিয়ে দিলো। সামনে নাকি রাস্তা কাটা, বাস আর যাবে না। কি আর করা, আমরা বাস থেকে নেমে পড়লাম। সামনে পেলাম এক বাদামবুট ওয়ালা। সবাই ভিড় করে বাদাম, মটর, কটকটি কিনতে লাগলো। আমি ১০ রুপির মুরলি কিনলাম। তাই চিবাতে চিবাতে হাঁটতে লাগলাম। সামনে রাস্তা সত্যি কাটা। সেই কাটা রাস্তা দিয়ে অনেক কসরত করে লাইন ধরে হেঁটে আমরা পৌঁছালাম আর্কি স্কুলে।

ছুটির দিন দেখে এটাও বন্ধ। তবে আমরা বাইরে থেকে ঘুরে বেড়ালাম আর ছবি তুললাম। দুপুরে খাওয়ার জন্য ছুটে গেলাম ক্যাফেতে। ক্যাফেতে খালি দুটা আইটেম- ভেজ স্যান্ডুইচ, ভেজ বার্গার। আমি ২০ রুপি দিয়ে ভেজ স্যান্ডুইচ কিনলাম। অত্যন্ত বাজে। খালি পিয়াজ আর পিয়াজ। এটাই একমাত্র ভেজ। খেয়ে আমার মুখ থেকে পিয়াজের গন্ধ বের হতে লাগলো। পিয়াজের স্বাদ আর গন্ধ দূর করার জন্য আমি দিয়ে ছোট্ট এক প্যাকেট বিস্কুট খেলাম। তারপর বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। সবাই আরও কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলাম ঐ ক্যাম্পাসে। তারপর আবার হাঁটা শুরু করলাম।

পুরোটা পথ পাড়ি দিয়ে যখন গোয়েলে উঠলাম তখন জানতে পারলাম, আমাদের কারণে বাস ফাইন খেয়েছে। আমাদেরকে পাংকু হেল্পার বললো আমাদের আসার কথা শুনে গোয়েল পার্কিং ছেড়ে রাস্তায় বের হয়ে এসেছিলো। কিন্তু আমরা আসতে লেট করেছি দেখে ট্রাফিক পুলিশ এসে সাড়ে চার হাজার টাকার মতন ফাইন করে গেছে। কি আর করা, আমরা সবাই গাটের থেকে ১০০ করে রুপি বের করে দিলাম। নেক্সট আমরা যাবো রক গার্ডেনে। সেখানে আমাদের নামিয়ে বাস চলে যাবে হোটেলে। কারণ রাতে জার্নি আছে, ড্রাইভারকে ঘুমাতে হবে।

রক গার্ডেনের সামনে নেমে আমার আর নড়তে ইচ্ছা হচ্ছিলো না। কিছুক্ষণ ফুটপাথের উপর বসে রইলাম। তারপর ২০ রুপি দিয়ে টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকলাম। রক গার্ডেন শুনে আমার মনে হয়েছিলো সবুজ গাছে ঘেরা কোন একটা পার্কের মধ্যে নিশ্চয়ই পাথরের ভাস্কর্য টাইপ জিনিস্পাতি আছে। কিন্তু আমার ধারনা ভুল। রক গার্ডেন আক্ষরিক অর্থে পাথর দিয়ে বানানো এক রাজ্য। পাথরের রাস্তা, পাথরের নিচু আর্চ দিয়ে হেঁটে যেতে হয় আর একটু পরপর অদ্ভূত সব ভাস্কর্য চোখে পড়ে। দেওয়ালে লিখা ইতিহাস পড়ে জানলাম নেক চাঁদ নামের এক লোক সরকারী জমিতে লুকিয়ে লুকিয়ে এইসব ভাস্কর্য বানানো শুরু করে। ভাংগা কাঁচ, চুড়ি, টাইলস, কমোড, বেসিন, সুইচ, বোতল এইসব হাবিজাবি জিনিস দিয়ে প্রায় দুই হাজার ভাস্কর্য দিয়ে সাজানো হয় অদ্ভূত এক পাথুরে সম্রাজ্য। সরকারের কাছে প্রথম যখন ব্যাপারটা ধরা পড়ে তখন এ নিয়ে বেশ হৈচৈ পড়ে যায়। সরকারি জমিতে অবৈধ স্থাপনা ধ্বংসের কথাটাই উঠে আসে। কিন্তু মানুষ প্রতিবাদ জানায়। পরে সরকার বাধ্য হয় এইটা কমপ্লিট করে জনগনের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে।

আমি আর রুবাইদা হাঁটতে থাকি আর অবাক হই। একজন মানুষ কেমন করে এই বিশাল পাথুরে জগত তৈরি করতে পারে আমরা ভেবে পাই না। হাঁটতে হাঁটতে আমরা জলপ্রপাত পার হই যার রেলিঙে পেচিয়ে আছে পাথুরে সাপ। কখনো একটু উঁচু, কখনো একটু নিচু পথে আমরা চিপা চিপা পথে এগিয়ে যেতে থাকি। খুব ভালো লাগে আমাদের। অনেক বড় জায়গা, আমরা এমনিতেই ক্লান্ত। আমি বিশ্রাম নিতে নিতে এগুতে লাগলাম।

এদ্ভ
অদ্ভূত পাথুরে রাজ্যে পায়ে হেঁটে চলা (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

সুভেনিয়র শপের থেকে রুবাইদা কিছু একটা কিনতে চাইলো। আমরা দুইজনেই কাউন্টারে উকি দিয়ে দেখছিলাম কি কি জিনিস আছে, এমন সময় আমার ব্যাগের চেইন কেউ একজন টান দিয়ে খুলে ফেললো। আমি আর রুবাইদা সাথে সাথে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালাম। মুহূর্তের জন্য একটা মানুষকে দেখলাম এক কদম পিছিয়ে ভীড়ের মধ্যে মিশে যেতে। আমি আর রুবাইদা বিশ্বাস করতে পারলাম না এত চমৎকার একটা জায়গায় কেউ আমাদের ব্যাগ থেকে টাকা চুরির চেষ্টা করতে পারে!  আমি আরও সাবধান হয়ে চলা শুরু করলাম।

হাঁটতে হাঁটতে একেবারে শেষ মাথায় একটা বড় ওপেন স্পেস। সেখানে ওপেন স্টেজে গানের সাথে লাইভ নাচ হচ্ছে। ইন্ডিয়ানদের সাথে অনেক সাদা চামড়ার মানুষ দেখলাম স্টেজে নাচ দেখাচ্ছে। আর তাদের ফলো করে চারপাশের মানুষজনও স্টেপ মিলিয়ে নাচার চেষ্টা করছে। হিন্দি সিনেমায় সাধারণত যে সব নাচ গান দেখি সেটা তাহলে একেবারে অবাস্তব না! একপাশে এক লোক উট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি সেই উটের সাথে ছবি তুললাম। তারপর অনেক্ষন বসে থেকে নাচ গান দেখলাম। শরীরের সব এনার্জি মনে হচ্ছিলো শেষ হয়ে গেছে। এক সময় সেখান থেকে বের হয়ে আসলাম। অটো ভাড়া করে আমরা সুখা লেকে রওয়ানা দিলাম। পার হেড ভাড়া পড়লো ১০ রুপি করে।

সুখা লেক জায়গাটা অনেকটা ধানমন্ডি লেকের মতন। টলটলে পানির একটা লেক। লেকটাকে ঘিরে অনেক রকম এক্টিভিটি। চিকন লম্বা ঠোংগায় করে ঝালমুড়ি, প্লেটে করে ফল কুচি বিক্রি হচ্ছিলো দেদারসে। এক জন লোক পোর্ট্রেট এঁকে দিচ্ছিলো। তার সামনে ভীড় করে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। অনেক মানুষ পড়ন্ত বিকালের সময়টা কাটানোর জন্য এসে জড় হয়েছে এখানে। গল্প গুজব, হাসি ঠাট্টা, আনন্দ আড্ডা সবকিছুই জমজমাট করে রেখেছিল জায়গাটাকে। লেকের পাড়ে বসে থেকে নিজেকে অনেক রিফ্রেশড লাগলো। এখানে বসে থেকেই ডিসিশন নেওয়া হল, আমরা যাবো সেক্টর ২২। তারপর সেখান থেকে যাবো সেক্টর ১৭এ সার্কাস দেখতে। আমরা আবার অটোতে উঠলাম। ভাড়া পড়লো পারহেড ১৫ টাকা করে।

সেক্ট্রর ২২ শে নেমে জাফরকে বলি সার্কাসে যাওয়ার সময় আমাদের খবর দিতে। তারপর আমি আর রুবাইদা সেই শীতের কাপড়ের জায়গায় যাই। রুবাইদা ওর জন্য ইনার কিনতে চায়, কিন্তু পছন্দ হয় না। আমরা ঘুরতে থাকি। এক পর্যায়ে মার্কেটের ভিতরে একটা পুজার রুম আবিষ্কার করি। এখানকার প্রতিমাগুলোকে কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছ। একটা ছবি তুলতে ইচ্ছা করছিলো কিন্তু ভিতরে হঠাৎ কে জানি টিং টিং করে ঘন্টা বাজানো শুরু করে। আমিও ছবি না তুলে সরে আসি। পরে রুবাইদা চিন্তা ভাবনা করে দুইটা মোটা প্যান্ট কিনে। ঐদিকে রাত নামার সাথে সাথে ঠান্ডাটা চাগিয়ে উঠতে থাকে। হঠাৎ করেই আমার খুব দূর্বল লাগতে শুরু করে। মনে হতে থাকে আমি বুঝি আর এক পাও হাঁটতে পারবো না।

রুবাইদা আমাকে নিয়ে একটা বেঞ্চে বসে থাকে। আমার শরীর বেশ খারাপ লাগতে থাকে। পা দুইটা মনে হচ্ছিলো যেন অবশ হয়ে গেছে। এর মধ্যে মোবাইল বের করে দেখি জাফরের মিসকল। কল ব্যাক করে জানলাম আমি ফোন ধরি নাই দেখে ওরা আমাদের ফেলেই চলে গেছে সার্কাসে। রুবাইদা অসম্ভব ঠান্ডা মাথায় আমাকে সাহস দিতে থাকে। ও চিন্তা করে বের করে অনেকদিন অ্যানিমেল প্রোটিন খাওয়া হয় নাই দেখেই মনে হয় আমার এই অবস্থা। আমি অনেক্ষণ বেঞ্চে বসে থাকি। তারপর.৩০ রুপি দিয়ে একটা রিক্সা ঠিক করি সেক্টর ১৭ পর্যন্ত। সেই রিক্সা করে আমরা যেতে থাকি। প্রচন্ড ঠান্ডায় আমরা জমে যাচ্ছিলাম।

সম্পূর্ন অপরিচিত রাস্তা দিয়ে আমরা যেতে যেতে একসময় সার্কাসে পৌঁছালাম। ৭০ রুপি দিয়ে টিকেট কেটে আমরা যখন কোন দিক দিয়ে ঢুকবো বলে ইতস্তত করছিলাম তখন যে লোকটা টিকেট দিলো সে পরিষ্কার বাংলায় কথা বলে আমাদের ঢোকার রাস্তা দেখিয়ে দিলো। সার্কাসে ঢুকে আমি উর্মি, অদিতি, চিং, জাফর, অন্তরা, মিমকে দেখতে পেলাম। আমরাও ওদের সাথে বসে পড়লাম। এটাকে বলা হয় এশিয়াড সার্কাস। অনেকদিন ধরেই চলছে শো। লোকজন নেই বললেই চলে। তবে বেশ সুন্দর পারফর্মেন্স সব। রাশিয়ান পারফর্মারদের পর্বগুলো বেশি চমৎকার ছিলো।  দুইটা বাচ্চা দারুণ সুন্দর ব্যালেন্সের খেলা দেখালো। ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক দেখালো। বিশাল গোলকের ভিতর দুইজন লোক বাইক নিয়ে একে অন্যকে ক্রস করে চক্কর কাটতে লাগলো। পশুপাখির পার্ফরমেন্সও ছিলো অনেকগুলো যেমন- হাতি, পাখি, কুকুর। বামন ভাঁড়েরা দর্শককে হাসাতে লাগলো।  আমাদের খুবই ভালো লাগছিলো।

শো শেষ হওয়ার আগেই পৌনে নয়টার সময় আমরা বের হয়ে যাই। কোথায় রাতের খাবার খাবো ভাবতে থাকি। তখন জাফর খুব সুন্দর একজন শিখ ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে যে কাছাকাছি কোথায় খাওয়ার দোকান আছে? লোকটা তখন খুব আন্তরিকভাবে আমাদের রাস্তা দেখিয়ে দেয়। কয়েক মিনিট হেঁটে আমরা বেশ কিছু খাবারের দোকান পাই। ‘তোশিব ফাস্ট ফুড’ নামের একটা দোকান থেকে ৮০ রুপি দিয়ে এক প্লেট ভেজ চাওমিন অর্ডার দেই আমি আর রুবাইদা। পরিমান দেখে আমাদের চোখ কপালে উঠে যায়। এতগুলা চাওমিন দেয় যে আমরা কোন মতেও খেয়ে শেষ করতে পারবো না। আমরা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে খেতে থাকি। খাওয়াটা খুবই মজা। আমাদের মতন আশেপাশে সবাই গল্পগুজব করে ফুটপাথে দাঁড়িয়েই খাচ্ছে। আমরা কেউই খাওয়া শেষ করতে পারি না। খুব কষ্ট লাগে খাওয়াগুলো নষ্ট করতে কিন্তু কি আর করা, এতগুলো দিবে পরিমানে আমরা বুঝি নাই। শেষমেষ আমরা পানি কিনে হোটেলে ফেরত যাই পৌনে দশটার দিকে।

রাস্তায় আমরা কিছুক্ষণ পর বিয়ে বাড়ির বর যাত্রীকে যেতে দেখি। ঠিক যেমনটা সিনেমায় দেখা যায়- বর ঘোড়ার পিঠে আর তাকে ঘিরে হাই ভলিউমে গানের সাথে আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুদের দুই হাত তুলে নাচ। দেখে মজা পেলাম। হোটেলে আমাদের বসার কোন জায়গা নেই। রিসিপশন জুড়ে ছেলেরা আর মেয়েরা সেই ফুল প্যাকড লাগেজ রুমে লাইন ধরে বাথরুমে ঢুকতে থাকে। অনেকেই বারান্দা, সিড়ি এইসব জায়গায় দাঁড়িয়ে বা বসে থাকে। আমি ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একটা রুম আবিষ্কার করলাম যেটাতে অদিতি, উর্মিসহ আরও কয়েক জন বসে আছে। জানলাম হোটেলওয়ালা আমাদের অবস্থা দেখে দয়া করে এই রুমটা খুলে দিয়েছে বসার জন্য। আমিও বিছানায় হেলান দিয়ে বসলাম। এই চিপা সিঁড়ি দিয়ে লাগেজ নামিয়ে রাস্তা দিয়ে টেনে নিয়ে বাসে তুলে ঠিকঠাক মত রওয়ানা দিতে দিতে আমাদের দেরি হলো।

প্রায় রাত ১২টার সময়  আমাদের গোয়েল যাত্রা শুরু করলো সিমলার উদ্দেশ্যে। বাসে উঠে টের পেলাম আমার পা দুইটা যেন হাতির পায়ের মতন ফুলে গেছে। রুবাইদা বললো জুতা খুলে বসতে। কিন্তু নিজের ফুলে যাওয়া পা দেখে আঁতকে ওঠার ভয়ে আমি জুতা খুললাম না। পায়ের পাতা জুতা ছিঁড়ে যেন বের হয়ে আসতে চাইছিলো। আমি একটু ঢিলা করে দিলাম শুধু। অসম্ভব পরিশ্রমের একটা দিন গেল। একদিনে এত হাঁটা আমি জীবনেও হাঁটি নাই। তবে শহরটা খুবই সুন্দর আর নিরাপদ। মানুষগুলোও যথেষ্ট আন্তরিক আর সাহায্য করার মনোভাব নিয়ে থাকে। সিনেমাতে আমরা পাঞ্জাবী লোকদের যেমনটা দেখি, বাস্তবেও তারা সেরকম। ছেলেরা খুব সুন্দর, ফর্সা। মেয়েরা একটু মোটা, বেশিরভাগই ফর্সা, বাচ্চাগুলো মোটা মোটা। মেয়েরা যথেষ্ট দুর্ধর্ষ। বুড়োরা তো আরও সাংঘাতিক। সবচেয়ে বড় কথা খাবারের দাম এখানে যথেষ্ট রিজনেবল। যদিও আমি অসুস্থ হয়ে পড়ে যথেষ্ট লজ্জা পেয়েছি- কারণ আমি জীবনে কোনদিনও এই রকম ভাবে দূর্বল হয়ে বসে পড়ি নাই, তারপরও সারাদিনটা অনেক সুন্দর ছিলো। চন্ডীগড় ছেড়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, জীবনে আর কি কোন দিন আসা হবে এখানে?

 

 

The Mighty INDIA CALLING: ‘সর্দারজী’ র দেশে দ্বিমিকবাসী (পর্ব ৮)

আমার ঘুম ভাঙল ঘাড় ব্যাথায়। বাসের সিটে হেলান দিয়ে থাকায় প্রচন্ড ঘাড় ব্যাথা হতে লাগলো। চোখ মেলে দেখলাম আমরা পাঞ্জাব পৌঁছে গেছি। তখন মাত্র সকাল হয়েছে। কুয়াশা কেটে চকচকে সূর্যের আলো ফালি ফালি করে বের হচ্ছে। রাস্তাঘাটে মানুষজন নাই। চারপাশে ঝকঝকে রাস্তাঘাট, একটু পর পর পার্ক, সবুজ গাছপালা- সব মিলিয়ে অত্যন্ত রিফ্রেশিং পরিবেশ। আমার ইচ্ছা হলো বাইরে গিয়ে বুক ভরে শ্বাস নেই। কিন্তু জমানো ঠান্ডার ভয়ে জানালাটাও খুলতে পারলাম না। আমাদের বাস এসে থামলো পাঞ্জাব আর হরিয়ানার বর্ডারের কাছাকাছি জায়গায়। আমাদের ছেলেপেলে হোটেল মিডটাউন নামের এক হোটেলে কথা বার্তা বলে সব ঠিক করলো। আমরা নেমে পড়লাম।

এবার আমরা চারজন একসাথে। বাস থেকে নেমেই মজুমদার ছুটলো রুম দখল করতে আর আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম লাগেজের অপেক্ষায়। সবার আগে আমার লাগেজ নামিয়ে দিলো বাসের পিছন থেকে। আমি ওদের রেখে লাগেজ নিয়ে রওয়ানা দিলাম। মজুমদার বললো ও তিন তলায় রুম ঠিক করেছে। অনেকেই রুম পায় নাই। ১০টা বাজলেই কয়েকটা রুম খালি হবে তখন সবাইকে রুম দেওয়া হবে। আপাতত মেয়েদের জন্য তিনটা রুম দেওয়া হয়েছে। তারই একটা রুম আমাদের। আমি আমার সুটকেস অমানুষিক কষ্ট করে সিড়ি দিয়ে টেনে টেনে তিনতলায় তুললাম। ততক্ষনে রুবাইদা আর মৌলি মজুমদারের লাগেজ টেনে টেনে নিয়ে আসলো। সবাই মিলে একে অন্যকে সাহায্য করে মাল পত্র সিড়ি দিয়ে তুলতে লাগলাম।

রুম দেখে আমাদের খুব পছন্দ হলো। অনেক বড় রুম, বিশাল খাট, এটাচড বারান্দা তবে এটা পাশের আরও দুইটা রুমের সাথে কানেক্টেড। বারান্দায় দাঁড়ালে নিচে সবুজ জমি দেখা যায় সেখানে একটা গরু নিবিষ্ট মনে ঘাস চিবাচ্ছে। আমি কিছুক্ষনের জন্য বারান্দায় কড়া রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশ আরাম লাগলো। সবচেয়ে অদ্ভূত হল বাথরুমটা। এত বড় বাথরুম আমি আর কোনও হোটেলে দেখি নাই। মনে হলো যেন ওখানে খাট পেতে ঘুমানো যাবে। যথারীতি বদনা নাই। তবে রুবাইদা এবার ওর সাদা বদনাটা বের করে দিলো। গরম পানির ব্যবস্থা পেয়ে আমরা লাইন ধরে গোসলে ঢুকলাম। গোসল করতে গিয়ে টের পেলাম বালতি আছে কিন্তু কোন মগ নাই। রুম সার্ভিস তখন খুবই ব্যাস্ত আমাদের সবাইকে রুমের ব্যবস্থা করে দিতে, ওখানে জানালে মগ পেতে বেশ দেরি হবে। চট করে আমরা আমাদের রুমের পানির জগটাকেই মগ বানিয়ে গোসল করা শুরু করে দিলাম।

যারা রুম পায় নাই তারা আমাদের রুমে মালপত্র নিয়ে বসে থাকলো। তারপর এক জন একজন করে ওরা রুম পেয়ে পেয়ে বের হয়ে গেলো। আমি দেখতে পেলাম আমাদের বারান্দার সাথে এটাচড রুম দুটা আমাদের মেয়েরাই পেয়েছে। সেই রুমগুলাও খুবই সুন্দর। বারান্দার রোদে ভেজা গামছা মেলে দিয়ে আমি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। ভেজা চুল শুকানোর জন্য মৌলির হেয়ার ড্রায়ার নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমাকে বেশ সুন্দর আর লম্বা লাগছে। মন ভালো হয়ে গেলো। একটু পরেই টের পেলাম আয়নাটাতে সবাইকেই চিকন আর লম্বা লাগে। সবাই খুশি খুশি মনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নানাভাবে দেখতে লাগলো।

রুমের সামনে রিজভীর সাথে দেখা। ওকে ধন্যবাদ দিলাম এত সুন্দর একটা হোটেল ঠিক করে দেওয়ার জন্য। ও বললো বাইরে থেকে এখানকার বিল্ডিংগুলো দেখে আহামরি কিছু মনে হয় না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে হোটেলগুলো অনেক সুন্দর। রুমের বাইরে অনেক খোলামেলা স্পেস, লাইট ওয়েল দিয়ে সরাসরি রোদ এসে পড়ে – এসব দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।

সবার গোসল শেষে আমরা যখন নাস্তা করতে বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন প্রথম জানলাম খবরটা- আমাদের এখনই এই হোটেল ছেড়ে দিতে হবে। সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। ব্যাপার কি? কেন ছেড়ে দিতে হবে এই হোটেল? আসল ঘটনা জানা গেল ইশতিয়াকের কাছে। আমাদের কমিটিকে দামদর সব ঠিকঠাক করার করার পর হোটেল কর্তৃপক্ষ আইডি কার্ড জমা দিতে বলে। ওরা আমাদের পাসপোর্ট জমা দিলে লোকজন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে ‘আপ্লোগ ইন্ডিয়ান নেহি হো? আমরা বাংলাদেশি জানার পর তারা খুব লজ্জিত হয়ে জানায় সরকারি নিয়ম অনুযায়ী এই হোটেলের বিদেশি অতিথি রাখার অনুমতি নাই। ওরাই আমাদের আরেকটা হোটেল ঠিক করে দিবে কিন্তু আমরা এই হোটেলে থাকতে পারবো না। ওদের আর কি দোষ, কমিটির কমিউনিকেশন মেম্বাররা এত ভালো হিন্দিতে কথা বলেছিলো যে ওরা ধরতেই পারে নাই যে আমরা বিদেশি। ওরা নিজেদের ভুল স্বীকার করে খুব অনুরোধ করে আমাদের চলে যাওয়ার জন্য।

কি আর করা- আমরা যা যা মালপত্র বের করেছিলাম সব আবার ঢুকিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে সেই তিনতলার সিড়ি দিয়ে আবার টেনে টেনে ব্যাগ নামাতে লাগলাম। তারপর আবার সেই ব্যাগ বাসে তুলে আমরা বের হয়ে পড়লাম। সেটাই ছিলো ইন্ডিয়া ট্যুরে আমাদের সবচেয়ে ছোট্ট হোটেল স্টেয়িং।

আগের দিন রাতেও ডিনার বলতে যা বলা হয় সেইটা ঠিকমত হয় নাই। সকালেও কোন খাওয়া হল না। সেই অবস্থাতেই বাসে করে আমরা চন্ডীগড় ঢুকে গেলাম। চন্ডীগড় লে কর্বুসিয়েরের ডিজাইন করা অত্যন্ত বড়লোকদের শহর। রাস্তা গুলো চওড়া, চকচকে পরিষ্কার আর একদম সোজা ছক মেনে চলে। একটু পর পর একই রকম চৌ রাস্তার মোড় বা ওদের ভাষায় মার্গ এসে পড়ে যেগুলোতে সবুজ সাইনেজের মাধ্যমে ডিরেকশন দেখানো আছে।  এখন বেলা হয়ে যাওয়ায় রাস্তাঘাটে মানুষজন দেখা যাচ্ছে। দাড়িওয়ালা, পাগড়ি পরা শিখদের দেখতে খুব ভালো লাগছিলো। আর মহিলাগুলো সব সালোয়ার কামিজ পরে, বড় বড় বেনি করে এক কালারের সোয়েটার পরে হেঁটে বেড়াচ্ছে- ঠিক যেমনটা সিনেমায় দেখে থাকি। চন্ডীগড়ের আরেকটা লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে বাইক, মোটরসাইকেল আর সাইকেল। কি ছেলেরা, কি মেয়েরা- সবার কাছেই যেন দুইচাকার বাহনগুলো জনপ্রিয়। বাইক আর মোটরসাইকেলের পাশাপাশি রাস্তাঘাটে প্রচুর মানুষ সাইকেল চালাচ্ছে। এদের মধ্যে হাফ প্যান্ট পরা মোটা স্কুল ইউনিফর্ম পরা বাচ্চা ছেলেটা যেমন আছে তেমনি সাদা চুলগুলো বেনিতে গুঁজে সালোয়ার কামিজ আর কেডস পরা দাদীমাও আছেন। আমি হাঁ করে সব দেখতে লাগলাম। আরেকটা জিনিস লক্ষ করলাম এখানকার গাড়ির নম্বর প্লেট শুরু হয় –CHO দিয়ে।

r
ছবির মতন সাজানো চন্ডিগড় শহরের  ঝকঝকে রাস্তা ( কৃতজ্ঞতায় আরমিন রহমান মৌলি)

আমরা সেক্টর ৪৫ এ এসে থামলাম। এখানেই ঠিক করে দেওয়া হয়েছে আমাদের হোটেল যার নাম গোল্ডেন প্যারাডাইস। হোটেলটা বাইরে থেকে দেখে আমরা দমে গেলাম। রাস্তা থেকেই দেখা যায়, টানা বারান্দা দিয়ে এক সারি রুম। আমাদের দেশে অনেকটা কমলাপুর রেলস্টেশনের আশেপাশে যেরকম হোটেল দেখা যায় সেরকম আর কি। ঢুকতে হয় একটা চিপা গেট দিয়ে। তারপর আড়াই থেকে তিনফুট চওড়া একটা চিপা খাড়া খাড়া স্টেপ ওয়ালা সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে হয়। এবারও আমি আর মজুমদার দৌড়ঝাপ করে সেই তিন তলাতেই রুম ঠিক করলাম। আমাদের রুমটা একেবারে রাস্তার পাশে, বারান্দার শেষ প্রান্তে। ছোট্ট রুমে একটা খাট, দুইটা গদিওয়ালা চেয়ার আর একটা ছোট্ট টেবিল আছে। দেওয়ালে টিভি ঝুলানো, তার সাথে আবার দুইটা রিমোট। বাথরুমটা গিয়ে দেখলাম, অবস্থা মোটামুটি। বালতি, মগ সবই আছে, সাথে আবার ছোট্ট একটা মোড়া। ফ্লোরে সাদা কালো হিজিবিজি প্যাটার্নের পাথর। এতে একটা সুবিধা আছে ফ্লোর ময়লা হলেও টের পাওয়া যাবে না। আমরা আগের হোটেলে গোসল করে আসার কারনে বেশ খুশি ছিলাম। এখন এই বাথরুমে গোসল করতে হবে না ভেবেই আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলাম।

রুমে সেট হয়েই আমরা খেতে বের হলাম। হোটেলের নিচের রাস্তাটা কেমন জানি মরা মরা। নেটে সার্চ দিয়ে কাছেই ‘খুশি ধাবা’ নামের এক খাওয়ার দোকানে গেলাম। ছোট দোকানটাতে তেমন কিছুই খাওয়ার নাই। অনেক কষ্টে একটা থালি নিলাম ২৫ রুপি দিয়ে। এতে আছে ৬টা পোড়া রুটি, সয়া মাংসের ঝোল আর ডাল। সালাদ হিসেবে আছে মুলা কুচি। খাবারের কোন টেস্ট নাই। অনেক ঘন্টা কিছুই খাওয়া হয় নাই দেখে জোর করেই সবগুলা পোড়া রুটি খেয়ে ফেললাম। খাওয়া শেষে আবার হোটেলে ফেরত আসলাম। আশেপাশের রুমে খোঁজ খবর নিয়ে দেখলাম সবাই শপিং করার জায়গায় যেতে চায়- সেক্টর ২২ আর সেক্টর ১৭। আমি আর রুবাইদাও চিন্তা ভাবনা করে বের হয়ে পড়লাম।

হোটেলের সামনের রাস্তাতেই অটো পার্ক করে বসে ছিলো। আমি রুবাইদা আরও কয়েক জনের সাথে অটো ভাড়া করে উঠে পড়লাম। সেক্টর ২২ যেতে পার হেড খরচ পড়লো ২০ রুপি। একই রকম সোজা রাস্তা আর সবুজ চৌরাস্তা পার হয়ে হয়ে আমরা যখন সেক্টর ২২ পৌঁছালাম ততক্ষনে আমার মনে হলো আমরা যে জায়গাটাতে থাকি সেটা বোধহয় তুলনামূলক লো ক্লাস এরিয়া। যাই হোক অটো থেকে নেমে আমরা যে জায়গাটায় আসলাম সেটাকে অনেকটা ঢাকা নিউমার্কেটের মতই মনে হলো। তবে আমাদের নিউ মার্কেট বাউন্ডারির ভেতর আর এটাতে ঠিক বাউন্ডারি নাই। কেমন যেন লম্বাটে টাইপ অনেক বড় জায়গা জুড়ে আলাদা আলাদা মার্কেট।

সামনেই হোটেল-রেস্টুরেন্ট। তারপর শুকনা খাবার যেমন বাদাম, খেজুর, বিস্কুট, চানাচুর, চিপস এইসবের দোকান। পাশাপাশি জামাকাপড়, ব্যাগ, জুতা সব কিছুরই দোকান ছিলো। একটু পর একটা চত্তর। সেখানে হকাররা অনেক টুকিটাকি জিনিস নিয়ে বসে আছে। তারপর শুরু হয় শীতের কাপড়ের দোকান। শীতকালে পাঞ্জাবী ছেলেরা কি মেয়েরা, সবাই এক ধরনের চকচকে পলিথিন পলিথিন টাইপের উজ্জ্বল রঙয়ের জ্যাকেট পরে। প্রায় সব দোকানেই দেখলাম ভেতরে বাইরে সবখানেই সারি সারি লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, বেগুনী সব রঙের হাতা ওয়ালা বা হাতা ছাড়া জ্যাকেট ঝুলিয়ে রেখেছে। দাম যাচাই করে বুঝলাম ২০০ রুপিতে এগুলো কিনতে পাওয়া যাবে। ভেতরের দিকের দোকানে শীতের কাপড়, ঝকমকে জামাকাপড়, জুয়েলারি সবই আছে। দাম মোটামুটি কম। রুবাইদা সুন্দর হাতের কাজ করা ফুলখাড়ি ওড়না কিনলো ৭০০ রুপি দিয়ে।

আমাদের ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমি ১১০ রুপি দিয়ে চানাচুরের প্যাকেট কিনলাম আর রুবাইদা খেজুরের প্যাকেট কিনলো। তারপর  রাস্তা পার হয়ে একটু দামী দোকানপাটওয়ালা জায়গায় যাই। আমরা মনের সুখে চওড়া ফুটপাথ দিয়ে ঘুরতে থাকি আর দুনিয়ার গল্প করতে থাকি। এর মধ্যে দেখলাম এক জুয়েলারির দোকান থেকে মৌলি সস্তায় আনেকগুলো কাজল কিনে ব্যাগ ফ্রি পেল। দেখতে দেখতে সেই জুয়েলারির দোকানে ঠাসাঠাসি ভিড় হয়ে গেল। আমরা হাঁটতে হাঁটতে দেখতে লাগলাম, পাঞ্জাবের পাঞ্জাবী, শেরওয়ানী, কনের পোশাক, পাগড়ি, কোটি, সিল্কের লুঙ্গি, স্টেশনারি দোকানসহ আরও অনেককিছু। রাস্তার পাশেই ঠেলাগাড়িতে করে কমলার জুস বিক্রি হচ্ছে। ইয়া বড় বড় কমলা, ব্লেন্ডারে করে জুস বানিয়ে দিচ্ছে। মায়িশা খেয়ে খুবই প্রশংসা করলো। ওদের সাথে দেখা হওয়ার পর জানলাম ওরা সেক্টর ১৭ যাবে। আমরা দুইজন মনে করেছিলাম এটাই সেক্টর ১৭। কিন্তু বুঝলাম এটা সেক্টর ২২ এর মধ্যেই।

তারপর আমরা ঐশি, নোভা, বাঁধনদের সাথে সাথে অটো ভাড়া করে সেক্টর ১৭তে যাই। পার হেড ভাড়া পরে ১৫ রুপি। সেক্টর ১৭ অনেক পশ। দামি দামি জিনিসের দোকানপাট সব, আবার সেগুলোতে সেল চলছে। আলাদা আলাদা অটোতে আসায় আমি আর রুবাইদা আলাদা হয়ে যাই। তারপর ব্র্যান্ডের দোকান ঘুরতে ঘুরতে আবার একত্র হই। আমাদের ঘুরতে খুবই ভালো লাগে। ঝলমলে সব দোকানপাট, সামনে অনেক চওড়া ফুটপাথ, তারপর এক লেন স্ট্রিট লাইটিং আর সিটিংয়ের জন্য, তারপরে রাস্তা। সবখানে ফর্সা ফর্সা মানুষজন, গল্প করছে, আড্ডা দিচ্ছে। ওদের ভাষাটা কেমন যেন আন্তরিক।

আস্তে আস্তে দোকান পাট বন্ধ হতে থাকে। মানুষজন কমতে থাকে রাস্তা থেকে। আমরা একটা ঝলমলে খাবার দোকানের সামনে দাঁড়াই। আমি আর রুবাইদা একটা ভেজ চাওমিন অর্ডার দেই ১০০ রুপি দিয়ে। খাবারের টেবিলগুলো দোকানের বাইরে, খোলা আকাশের নিচে। অনেক ভিড় থাকায় আমরা ঠিকমত দাড়াতে পারছিলাম না। আমাদেরকে পাশেই একটা সিনেমা হলের ফুড কোর্টে বসতে বলে। আমরা সেখানে গিয়ে দেখি আর কেউ নাই। শুধু আমরা আমরাই। আমরা হৈচৈ করে খেতে থাকি। ঐশির মোবাইলে সেলফিও তোলা হয়। খাবার বেশ মজা ছিলো আর পরিমানে এত বেশি ছিলো যে আমাকে আর রুবাইদাকে পুরোটা শেষ করতে অনেক কষ্ট করতে হয়।

খেয়েদেয়ে আমরা আবার বের হয়ে অটো ঠিক করতে থাকি। রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা ফাঁকা, কিন্তু ভয় লাগে না। শহরটাকে কেন যেন নিরাপদ মনে হয়। এইবার অটো ভাড়া পরে পার হেড ২০ রুপি করে। আমরা একই রকম রাস্তা দিয়ে ছুটতে থাকি। হঠাৎ একটা সার্কাসের প্যান্ডেল চোখে পড়ে। অনেক বড় সার্কাস। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে থাকি।

হোটেলে ফিরে শুনি অনেকেই হোটেলের পাশে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে গেছে। আমার আর বের হওয়ার ইচ্ছা হলো না। কে জানি এসে খবর দিলো রাত ১২টার সময় শান্তর বার্থ ডে কেক কাটা হবে। আমরা সবাই গেলাম। ছোট্ট রুমের মধ্যে গাদাগাদি করে শান্তকে উইশ করা হলো। তারপর লিয়ার আনা কেকটাকে কেটে খাওয়া হলো। এর মধ্যে জাফর কেকের টুকরা জুবায়েরের গায়ে ফেলে দিলো। যাই হোক সবাই শেষমেষ রুমে ফিরে যাই।

কমিটির লোকজন রুমে এসে খবর দিয়ে যায় যে আগামী কাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত সবগুলো রুম ঠিক করা আছে। ১২টার পর ছেলেদের জন্য একটা আর মেয়েদের জন্য একটা রুম থাকবে। তাই মালপত্র সব গুছিয়ে ১২টার আগেই ঐ রুম দুইটায় রেখে তালা মেরে দিতে হবে। আবার আমরা আমাদের সব মালপত্র গুছিয়ে নিলাম যাতে সকালে সমস্যা না হয়। ঘুমানোর জন্য কম্বলের নিচে ঢোকার সময় মনে হলো আমার পা দুইটা বেশ ফুলে গেছে। কি আর করা, ফোলা পা নিয়েই সেকেন্ডের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম।