The Mighty INDIA CALLING: লে কর্বুসিয়ের এর শহর এবং একজন পাথর প্রেমিকের আশ্চর্য জগৎ (পর্ব ৯)

সকালবেলা যখন ঘুম থেকে উঠলাম, মনে হলো চারপাশে ঠান্ডার ভাপ জমে আছে। সব গুছিয়ে নিয়ে ওভার কোট গায়ে দিয়ে রুম থেকে বের হলাম। সকাল ৮টা ২০শের দিকে সব লাগেজ লিয়াদের রুমে জমা দিলাম। ছোট ডাবল রুমে এতগুলা মানুষের এতগুলা লাগেজ, ব্যাগপ্যাক আরও অন্যান্য ব্যাগ ঢুকাতে আমাদের সেই কায়দাকানুন করতে হলো। শেষমেষ এমন অবস্থা হলো যে শুধুমাত্র দরজা লাগানোর জায়গাটুকু আছে, আর বাকি পুরো রুমের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা জুড়ে শুধুই লাগেজ আর লাগেজ। অনেক কষ্টে সব ব্যবস্থা করে আমরা বের হলাম নাশতা করার জন্য।

আগের দিনের খুশি ধাবাতে আর যেতে ইচ্ছা করলো না। আমরা খুঁজে খুঁজে নতুন দোকান বের করলাম যার নাম রজনী ধাবা। চিকন লম্বা একটা দোকান। তিনটা টেবিল আর চারটা করে চেয়ার। আমি অর্ডার দিলাম ১০ রুপির আলু পরোটা আর  ২৮ রুপির মিক্সড ভেজিটেবল। সাথে যথারীতি মুলা কুচি। তবে খাওয়াটা ভালোই ছিলো। খেয়েদেয়ে আমরা গোয়েলে উঠলাম। গন্তব্য চন্ডীগড় হাইকোর্ট।

ফস
পাঞ্জাবী খাওয়া দাওয়া (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী)

আবার সেই বোরিং রাস্তা আর একই রকম মোড় পার হতে হতে এক সময় আমরা বেশ সবুজ গাছগাছালিতে ঢাকা একটা জায়গায় এসে পড়লাম। এখান থেকে শুরু রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া। আমরা লাইন ধরে দাঁড়ালাম। আমাদেরকে বললো চুপচাপ থাকতে। কিন্তু আমরা যখন ৪৬ জন দ্বিমিকবাসী একসাথে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা কি আর হয়? বেশ খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর পারমিশন মিললো। অনেকক্ষণ ধরে আমাদের কিছু নিয়মকানুন বলা হলো। তারপর আমাদেরকে চেক করে করে ভিতরে ঢুকতে দিলো। গাইড হিসেবে সাথে থাকলো একজন ইউনিফর্ম পরা লোক। আমরা চেকিং পার হয়েই একটা গ্রুপ ছবি তুললাম। তারপর হাঁটতে লাগলাম। দুপাশে সবুজ ঘাস আর তার মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা পাথুরে রাস্তা দিয়ে শীতের সকালে হাঁটতে লাগলাম আমরা। এক সময় পৌঁছে গেলাম হাইকোর্ট ভবনে।

বিল্ডিঙ্গের সামনে হাজার খানেক মটর সাইকেল পার্ক করে রাখা। আমরা র‍্যাম্প দিয়ে উঠতে লাগলাম উপরে। সেই কি র‍্যাম্প, পা ধরে আসলো সবার। এক পর্যায়ে ছাদের মতন খোলা জায়গায় এসে পড়লাম। কিছুক্ষন সেখানে থেকে তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। তারপর এসে পৌঁছালাম বিখ্যাত সেই রঙ্গিন ওয়ালের সামনে। লাল, হলুদ আর সবুজ এই তিনটা রঙের ওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা খ্যাচ খ্যাচ ছবি তুলতে লাগলাম। এতক্ষন তাও যা আমরা চুপচাপ ভদ্র থাকার চেষ্টা করছিলাম, এই ওয়াল দেখে আমাদের ভদ্র সেজে থাকার সব চেষ্টা বৃথা গেল। আমাদের দৌঁড় ঝাঁপ দেখে সেই গাইড বেচারা তাজ্জব হয়ে গেলো। কয়েকবার সেই লোক আমাদের চুপ করার অনুরোধ করেও শেষমেশ হাল ছেড়ে দিলো। আমাদের তাড়া দিলো সামনে আগানোর জন্য।

সস
বিখ্যাত হ্যান্ড স্কাল্পচারের সামনে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় ইফফাত রিদওয়ানা ঐশী)

আমরা একটু এগিয়ে লে কর্বুসিয়েরের হ্যান্ড স্কাল্পচারের সামনে গিয়ে গ্রুপ ফটো তুললাম। তারপর চলে গেলাম হ্যান্ড স্কাল্পচারের একদম কাছে। সেখানেও সমানে চলতে লাগলো ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক। সেই গাইড আমাদের আবার তাড়া দিয়ে সামনে হাঁটতে বললো। চমৎকার পার্কের মতন জায়গা দিয়ে আমরা হেঁটে বেড়াতে লাগলাম। অনেকক্ষন হাঁটার পর আমরা একটা বিল্ডিঙের সামনে আসলাম কিন্তু ছুটির দিন দেখে সব বন্ধ, আমাদের ঢুকতে দিলো না। আমরা সময় নষ্ট না করে পার্লামেন্ট বিল্ডিঙের দিকে হাঁটতে লাগলাম। শীতের দিনে গাছগাছালি ঘেরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে আমার খুব ভালো লাগছিলো। হাঁটতে হাঁটতে এক এক সময় বেশ গরমও লাগছিলো। আমি ওভার কোটটা খুলে ফেললাম।

অনেক্ষণ হেটে শুকনা প্যাচপ্যাচা ওয়াটার বডি পার হয়ে আমরা পার্লামেন্ট বিল্ডিঙের পিছন দিকে এসে পৌঁছালাম। দ্যা মাইটি ইয়েলো ওয়াল! ডিপার্টমেন্টে ঢোকার পর থেকে কত মানুষের ছবি দেখেছি এই হলুদ ওয়ালের সামনে- আজকে আমরা এখানে এই কথাটা ভাবতেই কেমন যেন আনন্দ লাগলো। ততক্ষনে হাঁটতে হাঁটতে সবাই টায়ার্ড হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ রেস্ট নেওয়া হলো। তারপর গ্রুপ ফটো। নানা রকম ফটো- খালি ক্লিক ক্লিক।

এতদূর হেঁটে সবার এনার্জি লেভেল ডাউন হয়ে গেছে। এরপর আরও হেঁটে যখন বিধানসভা বিল্ডিঙ্গে এসে পৌঁছালাম তখন সবার গলা শুকিয়ে গেছে। অনেকেই বসে পড়লো। অনেকে পানির খোঁজ করতে গেলো। অবশেষে সুপেয় পানি পাওয়া গেল। আমরা সবাই ঢকঢক করে ঠান্ডা পানি খেলাম। এই বিল্ডিংটাও মোটামুটি ঘুরেফিরে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। আবারও অনেক হাঁটা। বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে গোয়েলে এসে পৌঁছালাম। গোয়েলে উঠে হাত পা ছেড়ে বসলাম। গোয়েল আমাদের নিয়ে রওয়ানা দিলো চন্ডীগড় আর্কিটেকচার স্কুলের দিকে।

এক দিকে দুপুর হয়ে গেছে, তার উপর সকাল থেকে এত হাঁটা হাঁটি করার কারনে খিদেয় সবার পেট চোঁ চোঁ করতে লাগলো। আমরা ব্যাস্ত রাস্তাঘাট পার হয়ে এগুতে লাগলাম। এক সময় গোয়েল আমাদের নামিয়ে দিলো। সামনে নাকি রাস্তা কাটা, বাস আর যাবে না। কি আর করা, আমরা বাস থেকে নেমে পড়লাম। সামনে পেলাম এক বাদামবুট ওয়ালা। সবাই ভিড় করে বাদাম, মটর, কটকটি কিনতে লাগলো। আমি ১০ রুপির মুরলি কিনলাম। তাই চিবাতে চিবাতে হাঁটতে লাগলাম। সামনে রাস্তা সত্যি কাটা। সেই কাটা রাস্তা দিয়ে অনেক কসরত করে লাইন ধরে হেঁটে আমরা পৌঁছালাম আর্কি স্কুলে।

ছুটির দিন দেখে এটাও বন্ধ। তবে আমরা বাইরে থেকে ঘুরে বেড়ালাম আর ছবি তুললাম। দুপুরে খাওয়ার জন্য ছুটে গেলাম ক্যাফেতে। ক্যাফেতে খালি দুটা আইটেম- ভেজ স্যান্ডুইচ, ভেজ বার্গার। আমি ২০ রুপি দিয়ে ভেজ স্যান্ডুইচ কিনলাম। অত্যন্ত বাজে। খালি পিয়াজ আর পিয়াজ। এটাই একমাত্র ভেজ। খেয়ে আমার মুখ থেকে পিয়াজের গন্ধ বের হতে লাগলো। পিয়াজের স্বাদ আর গন্ধ দূর করার জন্য আমি দিয়ে ছোট্ট এক প্যাকেট বিস্কুট খেলাম। তারপর বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। সবাই আরও কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলাম ঐ ক্যাম্পাসে। তারপর আবার হাঁটা শুরু করলাম।

পুরোটা পথ পাড়ি দিয়ে যখন গোয়েলে উঠলাম তখন জানতে পারলাম, আমাদের কারণে বাস ফাইন খেয়েছে। আমাদেরকে পাংকু হেল্পার বললো আমাদের আসার কথা শুনে গোয়েল পার্কিং ছেড়ে রাস্তায় বের হয়ে এসেছিলো। কিন্তু আমরা আসতে লেট করেছি দেখে ট্রাফিক পুলিশ এসে সাড়ে চার হাজার টাকার মতন ফাইন করে গেছে। কি আর করা, আমরা সবাই গাটের থেকে ১০০ করে রুপি বের করে দিলাম। নেক্সট আমরা যাবো রক গার্ডেনে। সেখানে আমাদের নামিয়ে বাস চলে যাবে হোটেলে। কারণ রাতে জার্নি আছে, ড্রাইভারকে ঘুমাতে হবে।

রক গার্ডেনের সামনে নেমে আমার আর নড়তে ইচ্ছা হচ্ছিলো না। কিছুক্ষণ ফুটপাথের উপর বসে রইলাম। তারপর ২০ রুপি দিয়ে টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকলাম। রক গার্ডেন শুনে আমার মনে হয়েছিলো সবুজ গাছে ঘেরা কোন একটা পার্কের মধ্যে নিশ্চয়ই পাথরের ভাস্কর্য টাইপ জিনিস্পাতি আছে। কিন্তু আমার ধারনা ভুল। রক গার্ডেন আক্ষরিক অর্থে পাথর দিয়ে বানানো এক রাজ্য। পাথরের রাস্তা, পাথরের নিচু আর্চ দিয়ে হেঁটে যেতে হয় আর একটু পরপর অদ্ভূত সব ভাস্কর্য চোখে পড়ে। দেওয়ালে লিখা ইতিহাস পড়ে জানলাম নেক চাঁদ নামের এক লোক সরকারী জমিতে লুকিয়ে লুকিয়ে এইসব ভাস্কর্য বানানো শুরু করে। ভাংগা কাঁচ, চুড়ি, টাইলস, কমোড, বেসিন, সুইচ, বোতল এইসব হাবিজাবি জিনিস দিয়ে প্রায় দুই হাজার ভাস্কর্য দিয়ে সাজানো হয় অদ্ভূত এক পাথুরে সম্রাজ্য। সরকারের কাছে প্রথম যখন ব্যাপারটা ধরা পড়ে তখন এ নিয়ে বেশ হৈচৈ পড়ে যায়। সরকারি জমিতে অবৈধ স্থাপনা ধ্বংসের কথাটাই উঠে আসে। কিন্তু মানুষ প্রতিবাদ জানায়। পরে সরকার বাধ্য হয় এইটা কমপ্লিট করে জনগনের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে।

আমি আর রুবাইদা হাঁটতে থাকি আর অবাক হই। একজন মানুষ কেমন করে এই বিশাল পাথুরে জগত তৈরি করতে পারে আমরা ভেবে পাই না। হাঁটতে হাঁটতে আমরা জলপ্রপাত পার হই যার রেলিঙে পেচিয়ে আছে পাথুরে সাপ। কখনো একটু উঁচু, কখনো একটু নিচু পথে আমরা চিপা চিপা পথে এগিয়ে যেতে থাকি। খুব ভালো লাগে আমাদের। অনেক বড় জায়গা, আমরা এমনিতেই ক্লান্ত। আমি বিশ্রাম নিতে নিতে এগুতে লাগলাম।

এদ্ভ
অদ্ভূত পাথুরে রাজ্যে পায়ে হেঁটে চলা (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

সুভেনিয়র শপের থেকে রুবাইদা কিছু একটা কিনতে চাইলো। আমরা দুইজনেই কাউন্টারে উকি দিয়ে দেখছিলাম কি কি জিনিস আছে, এমন সময় আমার ব্যাগের চেইন কেউ একজন টান দিয়ে খুলে ফেললো। আমি আর রুবাইদা সাথে সাথে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালাম। মুহূর্তের জন্য একটা মানুষকে দেখলাম এক কদম পিছিয়ে ভীড়ের মধ্যে মিশে যেতে। আমি আর রুবাইদা বিশ্বাস করতে পারলাম না এত চমৎকার একটা জায়গায় কেউ আমাদের ব্যাগ থেকে টাকা চুরির চেষ্টা করতে পারে!  আমি আরও সাবধান হয়ে চলা শুরু করলাম।

হাঁটতে হাঁটতে একেবারে শেষ মাথায় একটা বড় ওপেন স্পেস। সেখানে ওপেন স্টেজে গানের সাথে লাইভ নাচ হচ্ছে। ইন্ডিয়ানদের সাথে অনেক সাদা চামড়ার মানুষ দেখলাম স্টেজে নাচ দেখাচ্ছে। আর তাদের ফলো করে চারপাশের মানুষজনও স্টেপ মিলিয়ে নাচার চেষ্টা করছে। হিন্দি সিনেমায় সাধারণত যে সব নাচ গান দেখি সেটা তাহলে একেবারে অবাস্তব না! একপাশে এক লোক উট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি সেই উটের সাথে ছবি তুললাম। তারপর অনেক্ষন বসে থেকে নাচ গান দেখলাম। শরীরের সব এনার্জি মনে হচ্ছিলো শেষ হয়ে গেছে। এক সময় সেখান থেকে বের হয়ে আসলাম। অটো ভাড়া করে আমরা সুখা লেকে রওয়ানা দিলাম। পার হেড ভাড়া পড়লো ১০ রুপি করে।

সুখা লেক জায়গাটা অনেকটা ধানমন্ডি লেকের মতন। টলটলে পানির একটা লেক। লেকটাকে ঘিরে অনেক রকম এক্টিভিটি। চিকন লম্বা ঠোংগায় করে ঝালমুড়ি, প্লেটে করে ফল কুচি বিক্রি হচ্ছিলো দেদারসে। এক জন লোক পোর্ট্রেট এঁকে দিচ্ছিলো। তার সামনে ভীড় করে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। অনেক মানুষ পড়ন্ত বিকালের সময়টা কাটানোর জন্য এসে জড় হয়েছে এখানে। গল্প গুজব, হাসি ঠাট্টা, আনন্দ আড্ডা সবকিছুই জমজমাট করে রেখেছিল জায়গাটাকে। লেকের পাড়ে বসে থেকে নিজেকে অনেক রিফ্রেশড লাগলো। এখানে বসে থেকেই ডিসিশন নেওয়া হল, আমরা যাবো সেক্টর ২২। তারপর সেখান থেকে যাবো সেক্টর ১৭এ সার্কাস দেখতে। আমরা আবার অটোতে উঠলাম। ভাড়া পড়লো পারহেড ১৫ টাকা করে।

সেক্ট্রর ২২ শে নেমে জাফরকে বলি সার্কাসে যাওয়ার সময় আমাদের খবর দিতে। তারপর আমি আর রুবাইদা সেই শীতের কাপড়ের জায়গায় যাই। রুবাইদা ওর জন্য ইনার কিনতে চায়, কিন্তু পছন্দ হয় না। আমরা ঘুরতে থাকি। এক পর্যায়ে মার্কেটের ভিতরে একটা পুজার রুম আবিষ্কার করি। এখানকার প্রতিমাগুলোকে কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছ। একটা ছবি তুলতে ইচ্ছা করছিলো কিন্তু ভিতরে হঠাৎ কে জানি টিং টিং করে ঘন্টা বাজানো শুরু করে। আমিও ছবি না তুলে সরে আসি। পরে রুবাইদা চিন্তা ভাবনা করে দুইটা মোটা প্যান্ট কিনে। ঐদিকে রাত নামার সাথে সাথে ঠান্ডাটা চাগিয়ে উঠতে থাকে। হঠাৎ করেই আমার খুব দূর্বল লাগতে শুরু করে। মনে হতে থাকে আমি বুঝি আর এক পাও হাঁটতে পারবো না।

রুবাইদা আমাকে নিয়ে একটা বেঞ্চে বসে থাকে। আমার শরীর বেশ খারাপ লাগতে থাকে। পা দুইটা মনে হচ্ছিলো যেন অবশ হয়ে গেছে। এর মধ্যে মোবাইল বের করে দেখি জাফরের মিসকল। কল ব্যাক করে জানলাম আমি ফোন ধরি নাই দেখে ওরা আমাদের ফেলেই চলে গেছে সার্কাসে। রুবাইদা অসম্ভব ঠান্ডা মাথায় আমাকে সাহস দিতে থাকে। ও চিন্তা করে বের করে অনেকদিন অ্যানিমেল প্রোটিন খাওয়া হয় নাই দেখেই মনে হয় আমার এই অবস্থা। আমি অনেক্ষণ বেঞ্চে বসে থাকি। তারপর.৩০ রুপি দিয়ে একটা রিক্সা ঠিক করি সেক্টর ১৭ পর্যন্ত। সেই রিক্সা করে আমরা যেতে থাকি। প্রচন্ড ঠান্ডায় আমরা জমে যাচ্ছিলাম।

সম্পূর্ন অপরিচিত রাস্তা দিয়ে আমরা যেতে যেতে একসময় সার্কাসে পৌঁছালাম। ৭০ রুপি দিয়ে টিকেট কেটে আমরা যখন কোন দিক দিয়ে ঢুকবো বলে ইতস্তত করছিলাম তখন যে লোকটা টিকেট দিলো সে পরিষ্কার বাংলায় কথা বলে আমাদের ঢোকার রাস্তা দেখিয়ে দিলো। সার্কাসে ঢুকে আমি উর্মি, অদিতি, চিং, জাফর, অন্তরা, মিমকে দেখতে পেলাম। আমরাও ওদের সাথে বসে পড়লাম। এটাকে বলা হয় এশিয়াড সার্কাস। অনেকদিন ধরেই চলছে শো। লোকজন নেই বললেই চলে। তবে বেশ সুন্দর পারফর্মেন্স সব। রাশিয়ান পারফর্মারদের পর্বগুলো বেশি চমৎকার ছিলো।  দুইটা বাচ্চা দারুণ সুন্দর ব্যালেন্সের খেলা দেখালো। ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক দেখালো। বিশাল গোলকের ভিতর দুইজন লোক বাইক নিয়ে একে অন্যকে ক্রস করে চক্কর কাটতে লাগলো। পশুপাখির পার্ফরমেন্সও ছিলো অনেকগুলো যেমন- হাতি, পাখি, কুকুর। বামন ভাঁড়েরা দর্শককে হাসাতে লাগলো।  আমাদের খুবই ভালো লাগছিলো।

শো শেষ হওয়ার আগেই পৌনে নয়টার সময় আমরা বের হয়ে যাই। কোথায় রাতের খাবার খাবো ভাবতে থাকি। তখন জাফর খুব সুন্দর একজন শিখ ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে যে কাছাকাছি কোথায় খাওয়ার দোকান আছে? লোকটা তখন খুব আন্তরিকভাবে আমাদের রাস্তা দেখিয়ে দেয়। কয়েক মিনিট হেঁটে আমরা বেশ কিছু খাবারের দোকান পাই। ‘তোশিব ফাস্ট ফুড’ নামের একটা দোকান থেকে ৮০ রুপি দিয়ে এক প্লেট ভেজ চাওমিন অর্ডার দেই আমি আর রুবাইদা। পরিমান দেখে আমাদের চোখ কপালে উঠে যায়। এতগুলা চাওমিন দেয় যে আমরা কোন মতেও খেয়ে শেষ করতে পারবো না। আমরা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে খেতে থাকি। খাওয়াটা খুবই মজা। আমাদের মতন আশেপাশে সবাই গল্পগুজব করে ফুটপাথে দাঁড়িয়েই খাচ্ছে। আমরা কেউই খাওয়া শেষ করতে পারি না। খুব কষ্ট লাগে খাওয়াগুলো নষ্ট করতে কিন্তু কি আর করা, এতগুলো দিবে পরিমানে আমরা বুঝি নাই। শেষমেষ আমরা পানি কিনে হোটেলে ফেরত যাই পৌনে দশটার দিকে।

রাস্তায় আমরা কিছুক্ষণ পর বিয়ে বাড়ির বর যাত্রীকে যেতে দেখি। ঠিক যেমনটা সিনেমায় দেখা যায়- বর ঘোড়ার পিঠে আর তাকে ঘিরে হাই ভলিউমে গানের সাথে আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুদের দুই হাত তুলে নাচ। দেখে মজা পেলাম। হোটেলে আমাদের বসার কোন জায়গা নেই। রিসিপশন জুড়ে ছেলেরা আর মেয়েরা সেই ফুল প্যাকড লাগেজ রুমে লাইন ধরে বাথরুমে ঢুকতে থাকে। অনেকেই বারান্দা, সিড়ি এইসব জায়গায় দাঁড়িয়ে বা বসে থাকে। আমি ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একটা রুম আবিষ্কার করলাম যেটাতে অদিতি, উর্মিসহ আরও কয়েক জন বসে আছে। জানলাম হোটেলওয়ালা আমাদের অবস্থা দেখে দয়া করে এই রুমটা খুলে দিয়েছে বসার জন্য। আমিও বিছানায় হেলান দিয়ে বসলাম। এই চিপা সিঁড়ি দিয়ে লাগেজ নামিয়ে রাস্তা দিয়ে টেনে নিয়ে বাসে তুলে ঠিকঠাক মত রওয়ানা দিতে দিতে আমাদের দেরি হলো।

প্রায় রাত ১২টার সময়  আমাদের গোয়েল যাত্রা শুরু করলো সিমলার উদ্দেশ্যে। বাসে উঠে টের পেলাম আমার পা দুইটা যেন হাতির পায়ের মতন ফুলে গেছে। রুবাইদা বললো জুতা খুলে বসতে। কিন্তু নিজের ফুলে যাওয়া পা দেখে আঁতকে ওঠার ভয়ে আমি জুতা খুললাম না। পায়ের পাতা জুতা ছিঁড়ে যেন বের হয়ে আসতে চাইছিলো। আমি একটু ঢিলা করে দিলাম শুধু। অসম্ভব পরিশ্রমের একটা দিন গেল। একদিনে এত হাঁটা আমি জীবনেও হাঁটি নাই। তবে শহরটা খুবই সুন্দর আর নিরাপদ। মানুষগুলোও যথেষ্ট আন্তরিক আর সাহায্য করার মনোভাব নিয়ে থাকে। সিনেমাতে আমরা পাঞ্জাবী লোকদের যেমনটা দেখি, বাস্তবেও তারা সেরকম। ছেলেরা খুব সুন্দর, ফর্সা। মেয়েরা একটু মোটা, বেশিরভাগই ফর্সা, বাচ্চাগুলো মোটা মোটা। মেয়েরা যথেষ্ট দুর্ধর্ষ। বুড়োরা তো আরও সাংঘাতিক। সবচেয়ে বড় কথা খাবারের দাম এখানে যথেষ্ট রিজনেবল। যদিও আমি অসুস্থ হয়ে পড়ে যথেষ্ট লজ্জা পেয়েছি- কারণ আমি জীবনে কোনদিনও এই রকম ভাবে দূর্বল হয়ে বসে পড়ি নাই, তারপরও সারাদিনটা অনেক সুন্দর ছিলো। চন্ডীগড় ছেড়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, জীবনে আর কি কোন দিন আসা হবে এখানে?

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *