ক্যারিবিয়ান সাগরের হাতছানিতে ঈষৎ মেক্সিকো ভ্রমণ

হরেকরকম পরিকল্পনা করে, বারবার আঙ্গুলের কড়ায় বাজেট কষতে কষতে, অন্তর্জালের দুনিয়া থেকে যাবতীয় জ্ঞান অর্জন করে যখন সম্ভাব্য গন্তব্য ঠিক করা হলো মেক্সিকোর ক্যানকুন আর তুলুম শহর- তখন একশো একটা অজানা চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো। সারাক্ষণ খালি চিন্তা করতেই লাগলাম যে অ্যামেরিকা ছেড়ে বের হবার সিদ্ধান্তটা ঠিক হচ্ছে কিনা। কাগজ কলমে বারবার হিসাব করতে লাগলাম যে কোন খরচ বাদ পড়ছে কিনা। মনে হাজারটা অনিশ্চয়তা নিয়ে রাতে ঘুমাতে যেতাম। তবে সকল অনিশ্চয়তার অবসান ঘটলো যখন রাতুলের প্রফেসর খুব স্বাভাবিকভাবে বললো যে তিনি আমাদের ক্যানকুনে হোটেল ঠিক করে দিতে পারবেন। আমাদের হোটেল খরচ বেঁচে যাবে এই খুশিতে আমরা তুলুম শহর ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দিলাম। বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ না করে আমি সস্তায় ঠিক করে রাখা প্লেনের টিকেট আর গাড়ি বুক দিয়ে ফেললাম। আর নানান রকম জল্পনা কল্পনা করতে করতে রাতে ঘুমাতে গেলাম ফুরফুরা মন নিয়ে।

অ্যামেরিকা ছেড়ে বাইরে যাবো বলে আমাদের অনেক প্রস্তুতি নিতে হলো। আমরা মহা উৎসাহের সাথে ডলার ভাঙ্গিয়ে পেসো করলাম, আই টোয়েন্টি সাইন করালাম, স্প্যানিশ ভাষা অল্পবিস্তর দেখে নিলাম, মেক্সিকোর সাইনেজ মুখস্ত করলাম। কিন্তু আমাদের উৎসাহে পানি ঢেলে দিলো ওয়েদার ফোরকাস্ট। গুগলের ভবিষ্যতবানী অনুযায়ী আমরা যে কয়দিন ক্যানকুনে থাকবো সে কয়দিন বজ্রসহ ভারি বৃষ্টিপাত থাকবে। আমাদের উৎসাহ ফাটা বেলুনের মতন চুপসে গেলো। মুহূর্তের মধ্যেই আমরা সিদ্ধান্ত বদলিয়ে প্লেনের টিকেট বাতিল করার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু বিধিবাম, আমাদের টিকেট এতই সস্তা ছিলো যে এর ক্যানসেলেশন ফি টিকেটের দামের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ টিকেট বাতিল করলে কোন টাকা ফেরত পাবো না। যা আছে কপালে বলে আমরা মুখ গোমড়া করে রেইনকোট, ছাতা আর ওয়াটার শুর ব্যাবস্থা করলাম।

পঁচিশ তারিখ আমরা রওয়ানা দিলাম গভীর রাতে। আমাদের লেওভার অরল্যান্ডোতে। গরীবের প্লেন ফ্রন্টিয়ারে চেপে আমরা অরল্যান্ডো পৌঁছে গেলাম সময়মতন। তবে আমাদের এমন কান ব্যাথা শুরু হলো যে বলার মতন না। দাঁতে দাঁত চেপে কান ব্যাথা সহ্য করতে করতে গলা পর্যন্ত ব্যাথা হয়ে গেলো। তবদা লাগা কান আর গলা নিয়ে আমরা অরল্যান্ডোর এমসিও এয়ারপোর্টে গেট খুঁজতে লাগলাম। পরের ফ্লাইটের গেট ডোমেস্টিক টার্মিনালেই। কোন ইমিগ্রেশনের বালাই নাই। মনে হলো যেন বিদেশে যাচ্ছি না, পাশের শহরে যাচ্ছি। ফ্লাইট অন টাইম ছিলো। ল্যান্ডিংয়ের আগে আবার তীব্র কান ব্যাথার চোটে চোখে মুখে অন্ধকার দেখলাম। এরকম ভয়াবহ কান ব্যাথা আগে কোন প্লেন জার্নিতে হয় নাই। তবে জানালা দিয়ে চোখ জুড়ানো নীল রঙ্গের পানি আর সাদা রঙয়ের বালি দেখে চোখের শান্তি হচ্ছিলো। আল্লাহর এমন সুন্দর রঙের ক্যানভাসের দিকে কান ব্যাথা উপেক্ষা করে অপলক তাকিয়ে ছিলাম।

প্লেন থেকে নেমে ঝাঁঝাঁ করতে থাকা কান নিয়ে হাঁটতে থাকলাম। রাতুল বলে ফেললো,”ক্যানকুনে এসে তো কানকুন ব্যাথা হয়ে গেলো!”।  কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই ইমিগ্রেশন পার হয়ে কয়েকজন ইউনিফর্ম পরা দালালকে টপকে আমাদের রেন্ট এ কারের শাটল সার্ভিসের জন্য দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রায় আধা ঘন্টা পর শাটলে চেপে রেন্টে কারের অফিসে পৌঁছাই। অ্যামেরিকার যেকোন অফিসে কর্মীর সংখ্যা কম থাকে। সাধারনত রেন্ট এ কারের অফিসগুলোতে দুই তিনটা কাউন্টারে লোক থাকে। সবাই মেশিনের মতন কাজ করে। দশ পনের মিনিটের মধ্যেই সব কাগজপত্র তৈরি হয়ে যায়। তারপর নিজে নিজে গাড়ি খুঁজে পেতে আরও দশ পনের মিনিট লাগে। সবমিলিয়ে আধা ঘন্টার মধ্যেই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যাওয়া যায়। তবে মেক্স রেন্ট এ কারের অফিসে ঢুকে একটা বাংলাদেশ বাংলাদেশ ভাব পাই। বেশ কয়েকটা কাউন্টার। সবগুলো কাউন্টারেই কর্মী আছে। সবাই অনেক গল্প করছে। কিছু কর্মী এমনিতেই ঘোরাঘুরি করছে আর নিজেরা নিজেরা গল্প করছে, মাঝে মাঝে হাসাহাসি করছে। অসম্ভব ধীর গতিতে লাইন আগাচ্ছে। কাউন্টারের লোকজন কাস্টোমারের সাথে এত কথা বলছে যে রাতুল অসহ্য হয়ে বলেই ফেললো, “ব্যাটারা বিয়ের ঘটকালি করছে নাকি? এত কি কথা বলে?”। শেষমেষ আমাদের সিরিয়াল আসলে আমরা এক কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলার কাছে গেলাম। মহিলা ইংরেজি বোঝে না। ওনার সাথে ভাংগা ভাংগা ইংরেজিতে কথা বলে দীর্ঘসময় পর কাগজপত্র হাতে পাই। তারপর বাইরে এসে বসে থাকি আরও দীর্ঘসময়। এখানে নিজে নিজে গাড়ি নেওয়ার ব্যাপার নাই। বসে থাকতে হবে, আরেকজন লোক এসে গাড়ি দিয়ে যাবে। যখন আমরা কালো শেভ্রলে সেডানটা নিয়ে বের হলাম, ততক্ষণে সব মিলিয়ে দেড় ঘন্টার বেশি পার হয়ে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যখন আমরা হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিচ্ছি, তখন দুপুর পার হয়ে বিকাল হয়ে গেছে।

নীল সাদা মেঘের আকাশ আর ঝকঝকে রোদের মধ্যে আমাদের গাড়ি শাঁ শাঁ করে ছুটতে লাগলো। রাস্তার দুই ধারে বন জংগল, দোকানপাট আর বাসা বাড়ি। কেমন যেন বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো। প্রায় ঘন্টা খানেকের মধ্যে আমরা হোটেলে পৌঁছাই। হোটেল ভিলা ডেল ক্যানকুনে পৌঁছে আমাদের চোয়াল ঝুলে পড়ে। দালানটার চেহারা কদাকার হলেও এটা অত্যন্ত ফিটফাট বড়লোকি হোটেল। ড্রপ অফে গাড়ি রাখতেই একজন ভ্যালে এগিয়ে আসলো। আমাদের লাগেজের সংখ্যা জানতে চাইলো কারণ ওরা লাগেজ রুমে পৌঁছে দিবে। আমাদের তো কোন লাগেজ নাই,আমরা কোনরকম আমাদের দুইটা ব্যাকপ্যাক নিয়ে নেমে পড়ি। ভ্যালে আমাদের হাতে ঠান্ডা পানির বোতল ধরিয়ে দিয়ে লবিতে এক মহিলার কাছে নিয়ে যায়।

খানদানি লবি। বিশাল ঝাড়বাতি। রংবেরঙের সোফায় বড়লোকি ভাব স্পষ্ট। তবে ইন্টেরিয়র স্টাইলটা একটু পুরানো। হাইফাই লবিতে হাসিখুশি মহিলাকে আমরা প্রথমেই ক্যানকুনের আবহাওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। ঊনি আমাদের আশ্বস্ত করেন যে আবহাওয়া এখন ভালো আর গুগলের ভবিষ্যত বাণী এখানে খুব একটা খাটে না। শুনে আমরা বেশ খুশি হয়ে যাই। মহিলা আমাদের নামধাম নিয়ে কাউন্টারে নিয়ে যায়। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের কাজ শেষ হয়ে যায়। তারপর আমাদের একজন কনশিয়ার্জ সোফাতে বসিয়ে হোটেলের ম্যাপ বুঝিয়ে বলে। আরেকটা অফার দেয় যে ওদের পাশে গার্জা ব্লাঙ্কা নামের একটা ফাইভস্টার হোটেল নতুন খুলেছে । ওটার প্রচারের জন্য একটা প্রোগ্রাম চলছে। যদি আমরা প্রোগ্রামটায় জয়েন করি তাহলে আমাদের একদিন ফ্রি ব্রেকফাস্টের সাথে পাশের হোটেলটা ঘুরিয়ে দেখাবে। আর আরও কিছু অফার থাকবে। সব কিছু দেখে আমরা প্রোগ্রামটায় নাম লিখাই আর চিচেন ইৎজার ট্যুরের বুকিং দেওয়ার অফার পাই অনেক কম দামে।

আমাদের রুমের বারান্দা থকে ক্যারিবিয়ান সাগর

তারপর রুমে গিয়ে আমাদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। বারোশো স্কয়ার ফিটের ওয়ান বেডরুম সুইট! কি নাই এখানে? ডাইনিং রুম লিভিং রুম, কিচেন, লন্ড্রি রুম, বেডরুম, দুইটা বাথরুম, জাকুজি আর বিশাল বারান্দা। বারান্দা দিয়ে হোটেলের বিশাল পুল এরিয়া আর সমুদ্রের ঝকঝকে নীল পানি আর ধবধবে সাদা বালি দেখা যাচ্ছে। আমরা কোনরকম হাতমুখ ধুয়ে বের হয়ে পড়লাম। হোটেলের বিশাল পুল এলাকা পার হয়ে আমরা বিচে চলে যাই। শেষ বিকালের আলোতে ঝলমল করছিলো ক্যারিবিয়ান সাগর। কত রকমের যে নীল রঙ, দূরে গাঢ় নীল, তারপর আরেকটু হালকা, তারপর আরেকটু হালকা হয়ে একেবারে বালির কাছে সাদাটে পানি। বালিগুলোও একদম সাদা। বড় বড় দানা। তবে তেমন কোন ঢেউ নাই। ছোট্ট চিকন চিকন ঢেউ সাদা ফেনা নিয়ে আছড়ে পড়ছে বালিতে। শরীর চাংগা করা বাতাস। আমাদের সারাদিনের ক্লান্তি নিমেষেই দূর হয়ে গেলো। পানিতে হাত পা ভিজিয়ে, বালি মাখামখি হয়ে আমরা বিচের পাশেই চেয়ার আর খাটে আধশোয়া হয়ে বসে রইলাম সূর্যাস্ত পর্যন্ত। কি যে শান্তি লাগছিলো আর বলার মতন না। মনে হচ্ছিলো, ইশ- মাত্র দুইদিনের জন্য কেন আসলাম, আরও কয়েকদিন থাকা উচিৎ ছিলো।

রাতে শহর ঘুরতে বের হলাম। একটা জমজমাট পার্কে গেলাম। নাম পার্ক ডে লাস পালাপাস। বিশাল পার্ক। সারি সারি দোকানপাট, ওপেন এয়ার স্টেজ, বাচ্চাদের বিভিন্ন রাইড আর খেলার জায়গা, অজস্র স্ট্রিট ফুডের দোকান, সারি সারি খাবারের দোকান, ছাতাসহ বসার জায়গা, লাইভ গানবাজনা -সব মিলিয়ে রাতের বেলাতেও ঝলমল করছে সবকিছু! প্রচুর মানুষ বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে , ইচ্ছামতন খাওয়াদাওয়া করছে, আড্ডা দিচ্ছে, উচ্চ স্বরে হাসছে- অসম্ভব প্রাণবন্ত একটা জায়গা। আমার দেখে খুব শান্তি লাগলো। আমরা ঘুরে ঘুরে ফিশ ট্যাকো আর স্যুপ কিনে মেক্সিকান সুরেলা গান শুনতে শুনতে আমাদের রাতের খাওয়া সেরে নিলাম। ওদের স্থানীয় মাছ দিয়ে বানানো ফিশ ট্যাকো আর গরম গরম টমেটো চিংড়ির স্যুপ খেতে খুব ভালো লাগছিলো। তারপর রঙ্গিন সব জুসের দোকান পার হয়ে এক ঠেলাগাড়ি থেকে ধাক্কাধাক্কি করে সাদা ভুট্টা কিনলাম। ওরা ভুট্টার দানাগুলো একটা কাপে নিয়ে প্রচুর মেয়োনিজ আর চিজের গুঁড়া মিশিয়ে দিলো। আর আমরা আমাদের ইচ্ছামতন সস আর বিভিন্ন রকম ঝাল গুঁড়া মিশিয়ে নিলাম। তবে খেতে তেমন ভালো লাগলো না। আমি অনেকক্ষণ খোলা আকাশের নিচে বসে থেকে অন্যদের লক্ষ্য করছিলাম। মেক্সিকানরা আনন্দপ্রিয় জাতি, হৈচৈ করতে আর খাওয়াদাওয়া করতে ভালোবাসে। এরা যখন অ্যামেরিকার মতন নিরানন্দ দেশে গিয়ে সেটেলড হয় তখন এই কালচারাল শকটা মেনে নিতে নিশ্চয়ই কষ্ট হয়।

পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় আমাদের পাশের হোটেলে ব্রেকফাস্ট করতে যাওয়ার কথা। আমাদের লবিতে নামতে নামতেই নয়টা বেজে গেলো। একজন কনশিয়ার্জ আমাদেরকে নিয়ে গেলো পাশের হোটেল গার্জা ব্ল্যাংকায়। গার্জা ব্ল্যাঙ্কা একদম নতুন হোটেল- সবকিছু ঝকঝক করছে। কনটেমপোরারি ইন্টেরিয়রের উদাহরণ দেখে আমার নিজের করা বিভিন্ন প্রজেক্টের কথা মনে পড়ে গেলো। আমাদের প্রথমে নিয়ে গেলো একটা রুমে, সেখানে আমাদের বসিয়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে একটা ফর্ম পূরণ করা হলো। তারপর হাসিখুশি একজন মেয়ে এসে আমাদের গাইড করতে লাগলো। প্রথমে নিয়ে গেলো হোটেলের সবচেয়ে উপরের তলায় ইনফিনিটি পুল দেখাতে। তারপর আমরা একসাথে বসে ব্রেকফাস্ট করলাম। নাশতায় মেক্সিকান চিলাকুইলেস খেতে আমার বেশ ভালো লাগলো। খেতে খেতে আমাদের গাইড বিভিন্ন গল্প করলো যার বেশির ভাগই ছিলো আমরা কোথায় কোথায় বেড়াতে গিয়েছি, কত টাকা খরচ হয় একেকটা ট্যুরে, ভবিষ্যতে কোথায় কোথায় যেতে চাই- এইসব। খেয়ে দেয়ে আমরা হোটেলের ডিলাক্স, সুইট এইসব রুম দেখলাম। সবশেষে আমাদের একটা হলরুমে বসিয়ে কাগজ কলম বের করে বিভিন্ন টাকা পয়সার হিসাব দিতে লাগলো যে ওদের মেম্বার হয়ে কত টাকা জমা দিলে বছরে কতগুলো হোটেলে কত কত দিন ফ্রি থাকতে পারবো। আমরা যতই বলি যে এই সিদ্ধান্ত এখন দেওয়া সম্ভব না, ওরা ততই একজনের পর একজন এসে আমাদের বিভিন্ন রকম অফার দিতে লাগলো। এইভাবে লোকজনের সাথে কথা বলতে বলতে প্রায় ঘন্টা খানেক কেটে গেলো। শেষমেষ আমরা সরাসরি না বলে দেওয়ার পর আমাদেরকে উঠতে দিলো। আমাদের গাইড তারপর আমাদের নিয়ে গেলো ভিলা ডেল পালমারের আরেকটা অফিসে। সেখানে মেয়েটা বিদায় নিলো আর আরেকজন লোক আমাদের পাকড়াও করলো। সে ভিলা ডেল পালমারের বিভিন্ন ডিলের বর্ণনা দিতে লাগলো। আমরা শেষে বিরক্ত হয়ে সেখান থেকে উঠে পড়লাম। তারপর ট্যুর কোম্পানির অফিসে যেয়ে আগামীকালের জন্য চিচেন ইৎজা ট্যুরের টাকা জমা দিলাম। এরপর গাড়ি নিয়ে বের হয়ে পড়লাম।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে এইসব হোটেলের অফার শুনতে শুনতে। ইসলা মুহেরেস নামের দ্বীপে যাওয়ার কথা ছিলো, সেটা বাদ দিতে হলো। আমরা গেলাম একটা রেস্টুরেন্টে যার নাম কুকুলকান। একেবারে সমুদ্রের উপরে নারিকেল পাতার ছাউনি দেওয়া বিশাল এক ডেকের উপর সাজানো টেবিলে আমরা বসলাম। মেনু দেখে অর্ডার দিলাম ফিশ ফ্রাই আর হরচাটা নামের একটা শরবত। প্রথমেই আমাদের নাচোস আর ঝাল সালসা দিয়ে গেলো। আমরা বসে বসে নীল ঝকঝকে সমুদ্র দেখতে দেখতে সেগুলো চিবাচ্ছিলাম। এরমধ্যে শুরু হলো কাকের উপদ্রব। খাবারের লোভে কাক এসে হাজির। হাত দিয়ে কাক তাড়াতে হচ্ছে বারবার। যখন ফিশ ফ্রাই আসলো আমাদের মনটাই ভালো হয়ে গেলো। হালকা লবন আর মশলা দিয়ে ভাজা ফিশ ফ্রাইটা অনেক মজা করে খেলাম আমরা। খেয়েদেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বের হয়ে গেলাম রেস্টুরেন্ট থেকে। এরপর গন্তব্য বিচ।

দারুণ মজার ফিশ ফ্রাই

গুগল ম্যাপে প্রথমেই দেখাচ্ছে প্লায়া তরতুগাস। গাড়ি পার্ক করে কয়েক মিনিট হেঁটেই চলে গেলাম সেখানে। জমজমাট বিচ। বিচের পাশেই শ্যাক আর সেখান থেকে বাজানো হচ্ছে উৎসবমুখর গান। বালিতে রোদ পোহাচ্ছে অনেক মানুষ। অনেকে দল বেঁধে নেমে পড়ছে পানিতে। এই বিচটায় হালকা একটু ঢেউ দেখতে পেলাম। আমরা কিছুক্ষণ থাকলাম এখানে। তারপর রওয়ানা দিলাম পরের বিচটা দেখতে।

পরের গন্তব্য প্লায়া দেলফাইন। প্লায়া দেলফাইনে যাওয়ার জন্য আমাদের ক্যানকুনের বিখ্যাত হোটেল জোন পার হতে হবে। ক্যানকুনের এই জায়গাটা মেইন ল্যান্ড থেকে একটা শাখার মতন আলাদা হয়ে গেছে। এই শাখার একপাশে আছে নিচুপ্তে লেগুন আর অন্য পাশে ক্যারিবিয়ান সমুদ্র। এখানেই সব দামি দামি হোটেলগুলো সমুদ্রের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় একেকটা হোটেল বিল্ডিং দেখতে দেখতে আমার থার্ড ইয়ারের স্টুডিওর কাজগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো। থ্রি ওয়ান থ্রি টুতে ছাত্রদের ডিজাইন করা বিল্ডিংগুলোর মতন একেকটা হোটেল যেন! বিলাসবহুল হোটেল দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম প্লায়া দেলফাইন। প্লায়া দেলফাইন খুবই সুন্দর একটা বিচ। সাদা বালির বিচটা সারি সারি নারিকেল পাতার ছাতা দিয়ে সাজানো। আর সমুদের নীল রংটা এখানে যে আরও রাজসিক হয়ে ধরা দিয়েছে। আমাকে আর পায় কে, লাফাতে লাফাতে নেমে গেলাম পানিতে। মনে হলো আর কোথাও যাবো না, এখানেই থেকে যাই বাকিটা সময়। এই বিচে অনেকক্ষণ হাঁটলাম আমরা। তারপর উঠে পড়লাম গাড়িতে। এরপর যাবো প্লায়া মার্লিনে।

ঝকঝকে বিচ প্লায়া দেলফাই

আমরা প্লায়া দেলফাইনে আসার সময় প্লায়া মার্লিনে থামতে চেয়েছিলাম। কিন্তু গাড়ি পার্ক করার জায়গা না পাওয়ায় নামতে পারি নাই। এবার খুঁজে খুঁজে একটা পার্কিং পেয়ে গেলাম। গাড়ি পার্ক করে চলে গেলাম প্লায়া মারলিন।

একটা অদ্ভূত বরফকুচি দেওয়া ভ্যানিলা ফ্লেভারের কোন আইস্ক্রিম খেয়ে নেমে পড়লাম বিচে। আগের দুইটা বিচে পানিতে ইচ্ছামতন দাপাদাপি করেছি। এখানে আর পানিতে নামলাম না। বরং একটা নারিকেল পাতার ছাতার নিচে বসে বসে সুনীল সাগরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। প্রাণ জুড়ানো বাতাসে মনের শান্তি শান্তিভাব বেড়েগেলো বহুগুণ। এখানেই বসে রইলাম দিনের আলো কমে যাওয়া পর্যন্ত। তারপর হেঁটে হেঁটে গেলাম একটা চকচকা মার্কেটে যার নাম কুকুল্কান প্লাজা। ভিতরে তেমন লোকজন নাই। আমরা দুইজনে এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করে দোতলায় একটা গ্রোসারি শপে ঢুকে পড়লাম। গ্রোসারির নাম সোরিয়ানা। মেক্সিকোতে আমাদের একমাত্র গ্রোসারি শপে যাওয়া। শুরুতেই মেক্সিকান ঝাল, মশলাদার চিপস সারি সারি করে সাজিয়ে রাখা। আমরা হেঁটে হেঁটে কোমল পানীয়র ফ্রিজের দিকে গেলাম। মেক্সিকানরা নিশ্চয়ই প্রচুর জুস খেতে ভালোবাসে। ফ্রিজ ভর্তি ঠাসা সব রঙ্গিন জুসের বোতল। এত্ত রকমের ফ্লেভারের জুস যে কোনটা ছেড়ে কোনটা নিবো বুঝতে পারছিলাম না। শেষমেষ খুব কম দামে দুই লিটারের এক বোতল জুস কিনে আমরা বের হয়ে আসলাম।

সন্ধ্যার পর আমরা সাংঘাতিক জমকালো একটা মার্কেট দেখে থামলাম। মার্কেটের নাম লা ইসলা। সে এক এলাহী কান্ড। খোলা আকাশের নিচে বিরাট এলাকা জুড়ে একতলা সব ব্র্যান্ডের দোকানের শোরুম। অনেকটা আমাদের ঢাকা নিউ মার্কেটের মতন ব্যাপারটা। কিন্তু এত চমৎকার ল্যান্ডস্কেপিং যে বলার মতন না। টলটলে হালকা সবুজে নীল পানির কৃত্রিম জলাশয়, নানান রকম গাছ, স্ট্রিট লাইটিং আর বসার জায়গা পুরো জায়গাটাকে অনেক স্বস্তিদায়ক করে তুলেছে। বেশিরভাগ দোকানগুলোই সরোভস্কি, টমি হিলফিগার, গুচি, ভ্যানস, লাকোস্টে, ভিক্টোরিয়াস সিক্রেট, অ্যাডিডাস -এইসব অ্যামেরিকান ব্র্যান্ডের। ক্রেতারা বেশির ভাগই অ্যামেরিকান পর্যটক। তারা দুইহাত ভরে শপিং করছে। মেক্সিকোর সুভেনিয়র শপগুলোতে গেলে বোঝা যায় মেক্সিকানদের জীবনে একটা বড় প্রভাব বিস্তার করে আছে শিল্পী ফ্রিদা কাহলো। আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটা ঝলমলে রঙ্গিন ফেরিস হুইল দেখলাম। আরেকটা ইন্টেরাকটিভ অ্যাকুরিয়াম ছিলো যেটা সেদিনের মতন বন্ধ হয়ে গেছে। প্রাণ জুড়ানো বাতাসে ঝলমলে বিলাসবহুল দোকানগুলো দেখতে আমাদের খুবই ভালো লাগছিলো।

এখান থেকে বের হয়ে ছুটলাম ডিনারের উদ্দেশ্যে। কাছেই একটা রেস্টুরেন্ট ছিলো এল ফিশ ফ্রিটাংগা। নারিকেল পাতার ছাতার নিচে আমরা রেস্টুরেন্টের যেখানে বসলাম তার পাশেই ছিলো বিশাল নিচুপ্তে লেগুন আর একটা ছোট জেটি। জেটিতে বাঁধা সারি সারি স্পিড বোট। দিনের বেলায় দেখলে এটাকে একটা হারবার বলেই মনে হতো। আমরা মেনু দেখে বুঝে শুনে ঝটপট অর্ডার দিলাম ফিশ ট্যাকো, শ্রিম্প ট্যাকো, আর সি ফুড আলফ্রেডো পাস্তা। লাল নীল বাতির আলোকছটায় রাতের আকাশের চাঁদটাকে একটু ম্রিয়মান লাগছিলো। কিন্তু এমন সুন্দর পরিবেশে আমার সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। গরম গরম খাবার আসতেই আসতেই খাওয়া শুরু করে দিলাম আমরা। খেয়েদেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বের ডেজার্ট অর্ডার দিতে চাইলাম, কিন্তু ততক্ষণে কিচেন বন্ধ হয়ে গেছে। কি আর করা, আমরা ডেজার্ট না খেয়েই বের হয়ে আসলাম রেস্টুরেন্ট থেকে। ডেজার্ট খেতে না পারলেও সবমিলিয়ে আমাদের চতুর্থ বিবাহবার্ষিকীর নৈশভোজটা মনে রাখার মতন ছিলো।

এখান থেকে আমাদের হোটেলে যেতে প্রায় পৌনে এক ঘন্টা লাগবে। আমরা বিলাসবহুল হোটেল জোন দিয়ে পার হয়ে আসতে লাগলাম। রাতের বেলা এলাকাটা দেখে আমার কাছে কিছুটা লাস ভেগাসের মতন মনে হলো। সেই ঝলমলেভাবটা একই রকম খালি পার্থক্য এখানে ক্যাসিনো নাই সেরকম। হোটেলে ফিরে পরের দিনের জন্য গোছগাছ করে নিলাম। সকাল সাতটায় বের হতে হবে। ভালোমতন অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। আর মনে মনে কষ্ট পেলাম যে দ্বিতীয় দিনটা শেষ হয়ে গেলো।

পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বারান্দা ভিজা। সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। এবং আকাশ কালো। আমরা যতই দৌড়ঝাঁপ করে রেডি হই না কেন, নিচে লবিতে যেতে যেতে আমাদের চার মিনিট লেট হয়ে যায়। লবিতে নেমে দেখি আমাদের মিনিবাস নিচে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জন্য। তড়িঘড়ি করে উঠে বসলাম গাড়িতে। গাড়ির ভিতরের সিট বেশ আরামদায়ক। সামনে একটা টিভি স্ক্রিনে মিউজিক ভিডিও চলছে। আরও একটা হোটেল থেকে টুরিস্ট নিয়ে আমাদের গাড়িটা ছুটতে শুরু করলো। আমি জানালা দিয়ে দেখতে লাগলাম, বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে গেছে। এরমধ্য দিয়েই গাড়ি মোটর সাইকেল সব নির্বিকারভাবে ছুটছে। দেখে আমার দেশের কথা মনে পড়লো। দেশের কথা মনে পড়াতেই যেন একটা সিগনালে জ্যাম লেগে গেলো। আমাদের গাড়িটা থেমে রইলো অনেকক্ষণ। আমাকে দেশের কথা আরও মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই আমাদের গাড়িটা ব্যাকে যেয়ে পাশের থেমে থাকা পাবলিক বাসের সাথে ধুড়ুম করে ধাক্কা লাগিয়ে দিলো। আমার খুশিতে সবগুলো দাঁত বের হয়ে গেলো। পুরাই বাংলাদেশ বাংলাদেশ ভাইব পাচ্ছি! তবে বাংলাদেশে ধাক্কা লাগার পর যেমন সবাই বের হয়ে মারামারি লেগে যায় এখানে সেরকম কিছু হলো না। আমাদের গাইড কাচুমাচু হয়ে বললো আমরা দশ মিনিট হাঁটতে পারবো কিনা, কারণ পুলিশ না আসা পর্যন্ত এই গাড়ি নড়তে পারবে না। বাসের সবাই রাজি হলে আমরা রাস্তায় নেমে ফুটপাথ দিয়ে লাইন ধরে হাঁটতে থাকি। রাস্তায় মানুষজন খুব একটা নাই। চওড়া ফুটপাথ। মাঝে মাঝে বৃষ্টির পানি জমে আছে। আমরা সাবধানে হাঁটতে থাকি। একসময় একটা বড় বাসের কাছে পৌঁছে যাই, এই বাসে করেই আমরা বাকিটা পথ যাবো।

বাসে উঠে আরাম করে বসি। আমাদের চিচেন ইৎজা যেতে তিনঘন্টা সময় লাগবে। গাইডরা আমাদের মায়ান সভ্যতা নিয়ে বেশ কিছু তথ্য জানিয়ে দেয়। বাইরে আকাশ থমথমে। বেশ একটা ঘুমঘুম পরিবেশ। রাস্তার দুইপাশে তেমন কিছু দেখার না পেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ঘুম পরিবেশেই তিন ঘন্টা কেটে গেলো। আমাদের বাস থামলো একটা সুভেনিয়র শপের সামনে। আমরা ফ্রেশ হয়ে সুভেনিয়র কিনলাম একটা মায়ান রাশিচক্রের প্লেট আর পাথর কেটে বানানো ছুড়ি বা ড্যাগার। তারপর আবার আমরা চলতে শুরু করলাম। আমাদের হাতে হাতে টিকেট ধরিয়ে দিলো গাইড। বাস থামলো চিচেন ইৎজার পার্কিং লটে। আমরা লাইন ধরে গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম।

ভিতরে ঢুকে প্রথমেই আমাদের গাইড একটা সফেদা গাছ দেখালো। সফেদা গাছের আঠা দিয়ে মায়ানরা অনেক কিছু বানাতো। দেশি সফেদা গাছ দেখে আমার যে কি ভালো লাগলো আর বলার মতন না। তারপর আমরা হাঁটতে লাগলাম। যে পথ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম তার দুইপাশে সব ফেরিওয়ালা। সুন্দর সুন্দর পসরা সাজিয়ে রেখেছে। রঙ্গিন কাঠের মুর্তি আর মুখোশগুলো এত সুন্দর যে আমি চোখ সরাতে পারছিলাম না। ফেরিওয়ালার হাঁকডাকে মনে হচ্ছিলো কোন বাজারে চলে এসেছি। সকল ফেরিওয়ালা পার হয়ে অবশেষে পিরামিডটার দেখা পেলাম।

এই ফাঁকে চিচেন ইৎজা নিয়ে কিছু কথা বলে নেই। চিচেন ইৎজা মায়ানদের একটা শহরের নাম। মেক্সিকোর ইউকাটান পেনিন্সুলায় বর্তমানে যেখানে ঘন জঙ্গল, সেখানেই ছিলো একসময়ে মায়ানদের অন্যতম বড় শহর চিচেন ইৎজা। ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালের দিকে গোরাপত্তন ঘটে এই শহরের। এই শহরের প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা বিখ্যাত পিরামিড সদৃশ স্থাপনাটির নাম এল কাস্টিও। চোদ্দশ সালের দিকে ধ্বংস হয়ে যাওয়া চিচেন ইৎজা শহরের এই পিরামিড পরে স্প্যানিশদের দ্বারা আবিষ্কৃত হয়। স্প্যানিশরা এই জঙ্গলের মধ্যে এত উঁচু স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ দেখে মনে করে এটা কোন প্রাসাদ বা ক্যাসেল। সেই থেকে এর নাম দেওয়া হয় এল কাস্টিও। এই এল কাস্টিও পিরামিডটি আসলে একাধারে একটি মন্দির এবং ক্যালেন্ডার। পাখির পালকওয়ালা সর্পদেবতা কুকুল্কানের মন্দিরও বলা হয় একে। এতে সব মিলিয়ে ৩৬৫টা সিঁড়ির ধাপ আছে। আর চারপাশ চারটা ঋতু এবং প্রতি পাশে ৯১টা সিড়ির ধাপ ৯১ দিনকে প্রকাশ করে। বছরের যে দুই দিন দিন রাত সমান হয় অর্থাৎ ইকুই-নক্স, সে দুই দিন এর সিড়ির ধারে এমন করে ছায়া পড়ে যেন মনে হয় আকাশ থেকে নেমে এসেছে কুকুল্কান দেবতা। সেই দুইদিন এখানে পর্যটকদের ভীড় উপচে পড়ে। এত বছর আগে সীমিত প্রযুক্তির প্রয়োগে পাথর দিয়ে নিখুঁতভাবে জোতির্বিজ্ঞানের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে এত বড় একটা স্থাপনা কিভাবে বানানো হয়েছিলো সেটা এক মহা আশ্চর্যের বিষয়। ২০০০ সালে চিচেন ইৎজাকে সেভেন ওয়ান্ডার্স অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড এর একটা বলে ঘোষনা দেওয়া হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই পিরামিডের ভিতরে আছে আরেকটা পিরামিড। ধারণা করা হয়, এক রাজার বানানো পিরামিডের উপরে আরেক রাজা এসে পিরামিড বানিয়ে গেছে।

এল কাস্টিও বা কুকুল্কানের মন্দির (সূত্রঃ ইন্টারনেট)

বৃষ্টির কারণে পরিবেশটা থমথমে ছিলো। এল কাস্টিওকে তাই খুব ঝলমলে দেখতে পেলাম না। আমাদের গাইড একজায়গায় দাঁড়িয়ে থেমে জানালো এই এলাকার মাটির উপরের স্তর হচ্ছে লাইমস্টোনের। তাই খোঁড়াখুড়ি করে পানি পাওয়া কঠিন ছিলো। এরকম জায়গায় শহর স্থাপনের প্রধান কারণ ছিলো পানির উৎস। এই এলাকায় আছে প্রাকৃতিক জলাধার বা সিংক হোল যেটাকে বলা হয় সিনোটে। সিনোটে আছে বলেই মায়ানরা এখানে শহর তৈরি করেছিলো। তবে মায়ানরা সবসময়ই বৃষ্টির দেবতা ‘চাক’কে  তুষ্ট করতে চাইতো। এজন্য মানুষ বলি দেওয়া ছিলো একটা প্রচলিত পদ্ধতি। এল কাস্টিওর উপরে একটা বলি দেওয়ার বেদি ছিলো। সেখানে পুরোহিত শামান যাকে বলি দেওয়া হবে তার বুক চিরে হৃদপিন্ড বের করে ফেলতো। পাশেই সিংহাসনে বসে থাকতো রাজা, আর নিচে ভীড় করে থাকতো সাধারণ মানুষ। কি সাংঘাতিক ব্যাপার!

এরপর গাইডের সাথে হেঁটে হেঁটে আমরা পাশের একটা জায়গায় গেলাম। এটাই বিখ্যাত বল কোর্ট। মেসোঅ্যামেরিকানদের বলকোর্টগুলোর মধ্যে এটাই সব চাইতে বড়। মায়ানদের বিখ্যাত খেলার নাম ছিলো ‘পক আ টক’। খেলাটা অনেকটা বাস্কেটবলের মতন। একটা রাবারের বলকে দেয়ালে রিংএর ভিতর দিয়ে পাঠাতে হবে। দুই দলের মধ্যে খেলা হতো আর কোন দল গোল করতে পারলেই খেলা শেষ। তবে ব্যাপারটা অনেক কঠিন কারণ বলটা হাত কিংবা পা দিয়ে ধরা যেতো না। বলটা মারতে হতো হাতের বাহু, কোমর আর পায়ের উরু দিয়ে। আর রিংটাও বাস্কেটবলের রিঙয়ের মতন হরাইজন্টাল না বরং ভার্টিকাল। এবং তারওপর রিং যথেষ্ট উঁচুতে , মাটি থেকে প্রায় পঁচিশ ফুট উপরে। রাবারের একটা বলকে কিভাবে মাটি থেকে এত উচু একটা রিঙয়ের ভেতর দিয়ে পাঠানো সম্ভব সেটা আমার মাথায় ঢুকলো না। এই খেলার কোর্টটা হচ্ছে ইংরেজি I আকৃতির। মাঠটা নাকি সৌরজগতের রূপক ছিলো। বলটা ছিলো ছুটন্ত গ্রহ নক্ষত্রের প্রতীক, আর খেলোয়াড়রা ছিলো দেবতাদের ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রতীক। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটা শোনা তখনও বাকি ছিলো। এমনিতে এই খেলা সবসময় খেলা হলেও বছরের বিশেষ একটা সময় খেলা হতো দেবতাদের তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে। এবং সেই খেলায় জিতে যাওয়া দলের ক্যাপ্টেন হেরে যাওয়া দলের খেলোয়াড়দের থেকে একজনের মাথা কেটে ফেলতো সবার সামনে। আমাদের গাইড দেওয়ালে পাথরে খোদাই করা রিলিফ দেখালো যে পরাজিত খেলোয়াড়ের কাটা মুন্ডু ধরে আছে জয়ী দলের ক্যাপটেন!

লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় বলকোর্ট (সূত্রঃ ইন্টারনেট)

এখান থেকে বের হয়ে গেলাম যোমপ্লান্টলি প্ল্যাটফর্মে। খেলোয়াড়দের আর শত্রুদের কাটা মুন্ডু দিয়ে বানানো হয়েছিলো এই প্ল্যাটফর্মের স্ট্রাকচার। গাইডের কথায় যা বুঝলাম, মায়ানরা বেশ মারামারি এবং রক্তপাতপ্রিয় জাতি ছিলো। নিজেরা নিজেরা খালি যুদ্ধ করতো। আর এরপর গাইড আমাদের বিদায় দিয়ে এক ঘন্টার মধ্যে বাসে ফিরে যেতে বললো। এরপর আমরা নিজেরা হাঁটা শুরু করলাম। গাইডের কথা অনুযায়ী একদিকে হাঁটতে হাঁটতে আবার ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক পার হয়ে পৌঁছে গেলাম স্যাকরেড সিনোটেতে। এইটা একটা বিশেষ সিনোটে যেখানে মানুষজনকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হতো পানিতে দেবতাদের খুশি করার উদ্দেশ্যে। খাড়া গর্তের মতন সিনোটেতে একবার পড়ে গেলে সাঁতার জানলেও উপর থেকে সাহায্য ছাড়া উঠে আসা সম্ভব ছিলো না। সিনোটের একপাশে ছোট একটা স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ দাঁড়িয়ে আছে। এখানেই বলি দেওয়ার আগে মানুষটাকে গোসল দিয়ে পবিত্র করে নেওয়া হতো। আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম ঘোলাটে সবুজ রংয়ের পানির সিনোটেটাকে। কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো!

সবুজ পানির স্যাকরেড সিনোটে (সূত্রঃ ইন্টারনেট)

আমাদের হাতে সময় কম। পা চালিয়ে আবার চলে আসলাম এল কাস্টিওর কাছাকাছি। মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হচ্ছে। ছাতা নিয়ে হাঁটতে হচ্ছে আমাদের। প্রচুর পর্যটক চারপাশে। ছবি তোলার জন্য খালি কোন জায়গা পাওয়াই যাচ্ছিলো না। এর মধ্যেই দুই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। এরপর গেলাম টেমপল অফ দ্যা ওয়ারিওরের কাছে। এই মন্দিরটা চারটা বড়বড় ধাপের উপর অবস্থিত। চারপাশে অসংখ্য পাথরে খোদাই করা রিলিফ। এই টেম্পলের সাথেই আছে বিশাল কলোনেড।  অসংখ্য পাথরের কলাম, কোনটা গোল কোনটা চারকোনা। এককালে হয়তো ছাদ ছিলো, এখন আর সেসব নাই। সবখানেই সাপ, চিতা, ঈগল, মানুষ এইসব প্রতিকৃতি খোদাই করা। আশেপাশে আরও অনেককিছু ছিলো দেখার মতন। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছিলাম না যে কোথায় কি দেখতে যাবো কারণ কোন নির্দেশনা নাই। অন্যদিকে সময়ও কম বলে আমরা কোথাও থামলাম না। সামনে দিয়ে হেঁটে আরও একটা সিনোটের পাশ দিয়ে একটা ছোট পিরামিড পার হয়ে আবার এল কাস্টিওর সামনে এসে পড়লাম। মানুষজন নানাভাবে ছবি তুলছে। একটা ব্যাপার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো -আগে একসময় যেখানে মানুষ বলি দেওয়া হতো প্রায় দেড় দুই হাজার বছর পর সেখানেই পর্যটকেরা পোজ মেরে ছবি তুলছে! কি অদ্ভূত!!

সাধারণত ছবিতে এল কাস্টিওর যে পাশ দেখানো হয়, সে পাশটা মেরামত করা। বাকি তিনপাশের মধ্যে দুইপাশ অনেকটাই ভাঙ্গা। এতবড় একটা প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট অথচ সেরকম কোন রক্ষণাবেক্ষণ নাই। কোন স্থাপনার সামনে কোন ফলক নাই, কোথাও কোন ইন্সট্রাকশন নাই। গাইড না থাকলে একটা কিচ্ছু বোঝার সাধ্য ছিলো না আমাদের। তারওপর অসংখ্য ফেরিওয়ালার হাঁকডাক, নানা রকম বাঁশির শব্দে বেশ  বিরক্তই লাগছিলো। আজকে যদি এটা প্রথম বিশ্বের কোন দেশের স্পট হতো তাহলে ঢুকতেই ইতিহাস বৃত্তান্ত সমেত ম্যাপ হাতে পেতাম, জায়গায় জায়গায় বড় বড় ফলকে লিখা থাকতো, ইন পার্সন গাইড ছাড়াও অডিও গাইডের ব্যবস্থা থাকতো, কোথাও কোন ফেরিওয়ালা থাকতো না, শব্দ দূষণ থাকতো না, একটা ভিজিটর সেন্টার থাকতো যেখানে ঢুকেই পুরো সাইটটা সম্পর্কে মডেল দেখে কিংবা অডিও ভিজুয়াল প্রেজেন্টেশন দেখে একজন পর্যটক এই জায়গার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেয়ে যেতো। কিন্তু এসব বলে তো লাভ নাই। আমাদের গাইডের কথা অনুযায়ী, মেক্সিকোতে অসংখ্য পুরাতাত্ত্বিক সাইট আছে যার অর্ধেকও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয় নাই। দক্ষতা ও লোকবলের অভাবে এত বড় বড় সাইটের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হিমশিম খাচ্ছে ওরা। এই চিচেন ইৎজাতেই আরও চারটা বল কোর্ট আছে যেগুলো এখনও পুরোপুরি উদ্ধার করা হয় নাই। আমরা যখন ঘুরছিলাম তখনও দেখেছি অনেক মানুষ কাজ করছে টেমপল অফ দ্যা ওয়ারিয়রে। এখনও গবেষণা হচ্ছে এল কাস্টিওর নিচে কোন সিনোটে আছে কিনা সেটা নিয়ে। সব মেরামতের কাজ শেষ করে আজকে থেকে দশ বছর পর হয়তো এখনকার চাইতে আরও ভালো পরিবেশ থাকবে সেখানে।  

আমরা চিচেন ইৎজাকে বিদায় দিয়ে একটা ছোট বুকলেট কিনে বাসে চড়ে বসলাম। বাস আমাদের নিয়ে গেলো আগের সুভেনির শপের জায়গায়। সেখানে সুভেনির শপের পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে আমরা দুপুরে খেতে ঢুকলাম। অনেক বড় খোলা রেস্টুরেন্ট। নারিকেল পাতার বিশাল ছাউনির নিচে বসার জায়গা। আমাদের জন্য বুফে খাবারের ব্যবস্থা ছিলো। আমরা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে খাবার নিলাম। ফিশ ফ্রাই আর ভেজিটেবল সুপটা অনেক মজা ছিলো। আমরা ফিরনি আর আইস্ক্রিম ডেজার্ট খেলাম। এরমধ্যে কিছু মহিলা এসে স্থানীয় গানের সাথে নাচতে শুরু করলো। নাচ শেষ হলে অনেকেই বখশিশ দিলো। আবার কতগুলো ছেলে মুখে শরীরে রঙ মেখে, মাথায় পালকের মুকুট লাগিয়ে মায়ানদের মতন সেজে নাচানাচি শুরু করলো। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি হচ্ছিলো। সব মিলিয়ে খুব ভালো ছিলো এই খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা।

আমরা পেট ভরে খেয়েদেয়ে আবার রওয়ানা দিলাম। বাস আমাদের নিয়ে গেলো সিনোটে সামালে। এবার বৃষ্টি দেখে আমরা রেইনকোট পরে নামলাম বাস থেকে। আমাদের হাতে ব্যান্ড পরিয়ে দেওয়া হলো। আমরা হেঁটে হেঁটে চলে গেলাম সিনোটে সামালে। খাড়া সিঁড়ি দিয়ে মাটি থেকে নিচের দিকে নামতে লাগলাম। মাঝামাঝি এক জায়গায় রেলিং ঘেরা সমতলে ভীড় করে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। আর যারা পানিতে নামবে তারা লাইফ জ্যাকেট ভাড়া করে নিচে নেমে যাচ্ছে। আমরা যে রেলিং ঘেরা সমতলে দাঁড়িয়ে আছি তার নিচে গাঢ় নীল রঙের পানি। তাতে হৈচৈ করে লোকজন সাঁতার কাটছে।  আর উপরে গোল হয়ে দেখা যাচ্ছে আকাশ। অন্য মানুষদের সাঁতার দেখে আমরা কিছুক্ষণ পর উপরে উঠে আসলাম। আশেপাশে রেস্টুরেন্ট, টাকিলা বার আর সুভেনির শপ। সব দেখেটেখে আমরা আবার বাসে উঠে পড়লাম।

সিনোটে সামাল (সূত্রঃ ইন্টারনেট)

আমাদের আজকের দিনের মতন অ্যাডভেঞ্চার শেষ। এবার ফেরার পালা। বাস ছেড়ে দিতেই আবার ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। প্রায় আটটার দিকে আমরা ক্যাঙ্কুনে পৌঁছালাম। বাস আমাদের নামিয়ে দিলো একটা পেট্রোল পাম্পে। সেখানে আমরা একটা ছোট বাসে উঠলাম। সেই ছোট বাসে করে হোটেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় নয়টা বেজে গেলো। রুমে ঢুকে ব্যাগপত্র রেখে তারপর গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলাম ডিনার করতে। এত রাতে আশেপাশের সব জায়গা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা ঠিক করেছি শহরের দিকে একটা রেস্টুরেন্টে যাবো যার নাম লা পারিইয়া ক্যানকুন।

রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি পার্ক করতে করতে ভ্যালে এগিয়ে আসলো। আমরা গাড়ির চাবি দিয়ে নেমে পড়লাম। দারুণ উৎসবমুখর পরিবেশ মনে হচ্ছে ভিতরে। আমরা ঢুকে একটা টেবিলে বসলাম। চিন্তা ভাবনা করে অর্ডার দিয়ে দিলাম। প্রায় সাথে সাথেই নাচোস আর সালসা দিয়ে গেলো। নাচোস চিবাতে চিবাতে আশেপাশে দেখছিলাম। নীল রঙের মেক্সিকান পোশাক পরা একটা গানের দল একটা টেবিলের কাস্টোমারদের গান গেয়ে শোনাচ্ছে। কেউ গাইছে, কেউ বাজাচ্ছে। খুবই আনন্দমুখর পরিবেশ। রেস্টুরেন্টের ভিতরটা আলো দিয়ে ঝলমল করছে। আর নানা রকম রঙ্গিন কাগজ দিয়ে সাজানো ভিতরটা। আশেপাশের টেবিলে মানুষজন উচ্চ স্বরে হাসছে, কথা বলছে। আমাদের খুবই ভালো লাগছিলো। একজন ওয়েটারকে দেখলাম মাথায় একটার উপর আরেকটা বসিয়ে মোটমাট চারটা গ্লাস আর একটা বোতল নিয়ে এসে এক টেবিলে পরিবেশন করতে। আমরা খুবই মজা পেলাম। আমাদের খাওয়া চলে আসলো। অর্ডার ছিলো টোস্টাডিয়া আর ফিশ ফিলে। টোস্টাডিয়াটা খুব মজা ছিলো। তবে ফিশ ফিলেটা মজা লাগে নাই। তারপর ডেজার্ট আসলো বিশাল একটা ট্রেস লেচেস। দারুণ স্বাদের কেকের টুকরাটা এত বড় ছিলো যে আমরা অনেক কষ্টে সেটা খেয়ে শেষ করলাম।

ভরপেট খাওয়া দাওয়া

বিল মিটিয়ে দিয়ে আমরা বের হয়ে আসি সেই রেস্টুরেন্ট থেকে। হোটেলে ফিরতে ফিরতে আরও রাত হয়ে যায়। মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো এই ভেবে যে এত সুন্দর একটা ট্যুর শেষ হয়ে গেলো। রাতে কয়েকঘন্টা ঘুমিয়ে আবার ভোরে উঠে গেলাম ফজরের সময়। রুমের বারান্দায় হ্যামকে শুয়ে শুয়ে দেখলাম সূর্যোদয়। সব মালপত্র গোছগাছ করে এক দফা নিচে নেমে গেলাম। আমাদের শেষ বিচে যাওয়া। সকালের ঠান্ডা বাতাসে ঝকঝকে সমুদ্র দেখে চোখের শান্তি হচ্ছিলো। খালি মনে হচ্ছিলো আরও দুই তিন দিনের জন্য কেন প্ল্যান করলাম না….

সব শেষে সমুদ্রকে বিদায় জানিয়ে রুমে গিয়ে ব্যাগপত্র নিয়ে নেমে পড়লাম। চেক আউট করে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। এরপর হালকা জ্যাম ঠেলে, পেট্রোল পাম্প খুঁজতে যেয়ে ভুল রাস্তায় অনেক্ষণ চক্কর কেটে, অবশেষে তেল নিয়ে, স্যান্ডুইচ কিনে, এয়ারপোর্টের সামনে একই রাস্তায় তিনবার চক্কর কেটে যখন গাড়ি জমা দিতে যাবার রাস্তা খুঁজে পেলাম তখন মনে একটু সন্দেহ জমতে শুরু করেছে যে প্লেন ধরতে পারবো কিনা! তারপর গাড়ি জমা দিয়ে, শাটলের জন্য অপেক্ষা করে, শাটলে চড়ে যখন টার্মিনালে পৌঁছালাম তখন দেখি চেক ইন কাউন্টারে বিরাট লাইন। আল্লাহর রহমতে যখন লাইন ব্রেক করে আমাদের ইমার্জেন্সিভাবে আগে নিয়ে গেলো, তখন একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। চেক ইন করে যখন সিকিউরিটি চেক ইনে গেলাম, তখন আমাদের সুভেনিয়র হিসাবে কেনা ছুরিটা আটকে দিলো। নিজের উপর রাগ লাগলো, কেনার সময় একবারও ভাবি নাই যে এই জিনিস প্লেনে আটকে দিবে। কি আর করা, অগত্যা সুন্দর ছুরিটাকে ফেলেই চলে আসতে হলো। দৌড়ে দৌড়ে গেটে এসে পৌঁছে দেখি বোর্ডিং শুরু হয়ে গেছে। আমরা সরাসরি লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। সোজা প্লেনে চেপে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেন চলতে শুরু করলো।

জানালা দিয়ে দেখছিলাম রোদে ঝলমল করছে ক্যানকুন। সুন্দর এই শহরটাকে বিদায় জানাতে মোটেও ইচ্ছা করছিলো না। মনে মনে আবার এই শহরে আসার স্বপ্ন নিয়ে শেষবারের মতন তাকিয়ে দেখলাম সুন্দর শহরটাকে।        

Adios, Cancun, adios……..

ঝটিকা সফরে ময়মনসিংহে!

বান্ধবী রিন্তুর বিয়ে!

আরে, বেড়ানোর জন্য এর চেয়ে ভালো আর কোন উপলক্ষ লাগে নাকি?

খুশিতে ডগমগ করতে করতে ঠিক করতে লাগলাম সবকিছু। কিন্তু এখন তো আর আগের মতন নাই সব কিছু, স্টুডেন্ট লাইফ শেষ হওয়ার সাথে সাথে জীবনের রঙগুলো কেমন যেন ফিকে হয়ে যেতে থাকে।  আগের উৎসাহ, চঞ্চলতা সব চাপা পড়ে যেতে থাকে চাকরি জীবনের নিচে। নানা ব্যস্ততা আর দুর্বোধ্য রকমের আলসেমি ভর করতে থাকে। মোটামুটি খোঁজ খবর নিতে লাগলাম। আমি, সারা, তানভীর, তমা আর সুমাইয়া যাবো- এতটুকুই ঠিক হলো শেষমেশ।

ময়মনসিংহ শহরটা তেমন কোন দূর দেশে অবস্থিত না। তাই তেমনভাবে চিন্তা ভাবনা কেউই করছিলাম না। তানভীর সার্কিট হাউজে থাকার ব্যবস্থা করবে আর ২১ তারিখ রওয়ানা দিবো বাসে করে- এছাড়া আর কোন কিছুই ঠিক হলো না। পরে সুমাইয়াকে আগের দিন অর্থাৎ ২০ তারিখ রাতে আমার বাসায় চলে আসতে বললাম। ঠিক ঠিক রাত সাড়ে আটটার সময় ও আমার বাসায় এসে হাজির হলো। এসেই জিজ্ঞেস করলো, আমরা কয়টায় বাসে উঠবো? আমিও একই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাচ্ছিলাম কিন্তু ম্যাসেঞ্জারে কেউই কোন সাড়া দিচ্ছিলো না। ওদিকে অবনী আমাদের সাথে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলো এবং মাইক্রোবাস ঠিক করার আশ্বাস দিলো। আমি তো খুশি হয়ে গেলাম! কিন্তু রাত ১২টার আগেই ঠিক হলো আমরা আগামীকাল সকালে না, যাবো দুপুরে। বরাবরের মতই বাসার সবাই হতাশা প্রকাশ করলো আমাদের আনপ্ল্যানড লাইফের প্রতি!

সকালে ঘুম থেকে উঠেই খবর পেলাম অবনী আমাদের সাথে যাবে না। যাই হোক আমি আর সুমাইয়া নাশ্তা করে তৈরি হতে লাগলাম। প্রায় পৌনে ১২টার দিকে আমরা উবারে গাড়ি ঠিক করে উঠে পড়লাম। গন্তব্য মহাখালী বাস টার্মিনাল। ২১শে ফেব্রুয়ারি- একদম ফাঁকা রাস্তা। ১০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম। আমি আর সুমাইয়া গিয়ে বসলাম এনার ওয়েটিং রুমে। অন্যদের খোঁজ খবর নিলাম। সারা আর তমা বের হয় নাই। তানভীর রাস্তায়। যাই হোক আমরা গল্প করতে লাগলাম। পুরো রুম ভর্তি মানুষ। সবাই ঢাকা ছেড়ে ময়মনসিংহ যাচ্ছে। প্রায় পৌনে ১টার দিকে আমি টিকেট কাটতে গেলাম। কোনদিন আমি এই রকম টিকেট কাটি নাই। তাই বেকুবের মতন বলে ফেললাম, দেড়টার বাসের টিকেট দিয়েন। কাউন্টারের লোকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। বললো আমাদের বাস তো টাইম মেনে ছাড়ে না। আমি আর কথা না বাড়িয়ে টিকেট নিয়ে চলে আসলাম। তারপর আমি আর সুমাইয়া টিকেট নিয়ে গবেষণা করতে লাগলাম যে কোন বাসে উঠবো এইটা বুঝবো কেমন করে? অনেক গবেষণা করে বের করলাম বাসের সিরিয়াল নম্বর ৫১। সুমাইয়া গিয়ে খোঁজ নিলো ৪৯ নম্বর পর্যন্ত বাস ছেড়েছে। এর পরের সিরিয়ালই ৫০ আর ৫১। সোয়া ১টার সময় আমি অন্যদের ফোন দিতে লাগলাম। তমা তখন রাস্তায় আর সারা আর তানভীর একটু পরেই এসে পৌঁছালো। দীর্ঘদিন পর ওদের সাথে দেখা, জড়িয়ে ধরলাম সারাকে। ওয়েটিং রুমে আমি ব্যাগপত্র নিয়ে বসলাম আর বাকি সবাই এদিক সেদিক ঘুরতে গেলো।

এরই মধ্যে চলে আসলো দুইটা বাস। লোকজন হুড়হুড় করে বাসে উঠতে লাগলো। ওরাও তাড়াতাড়ি ফেরত আসলো। আমরা ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ৫১ নম্বর বাসের সামনে। ওদিকে তমা আসে নাই। উঠবো কি উঠবো না- এই নিয়ে চিন্তা করছিলাম। কি ভেবে আমরা উঠেই পড়লাম। আমরা উঠে পড়ার ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে তমা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসে পৌঁছালো। একেবারে এক্সাক্ট টাইমে!

প্রায় পৌনে ২টার দিকে বাস ছেড়ে দিলো। বাসটা বেশ ভালো, সিটগুলো আরামদায়ক। আমি আর সুমাইয়া পাশাপাশি বসলাম। বকবক করে গল্প করতে লাগলাম দুইজনে। গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত বাস গেলো ঢিমে তালে। যেই না চৌরাস্তা পার হলো আর ওমনি ছুটতে লাগলো শাঁই শাঁই করে। এরই মধ্যে নাজনীন আপু ফোন দিলো, আমি রওয়ানা দিয়েছি কিনা জানতে। প্রায় রকেটের গতিতে কোন রকম ব্রেক ছাড়াই আমাদের বাস আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলো।

আমার সাথে কেক ছিলো। দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নাই। তারপরও কেন যেন কেকটার কথা মনে করতে করতে দেরি হয়ে গেলো। যখন আমরা কেকটা বের করে কামড় লাগাচ্ছিলাম, তখনই আমাদের বাস ধীরে ধীরে এসে থেমে গেলো। আমরা পৌঁছে গেছি, আর থামার সাথে সাথেই সবাই হুড়হুড় করে নেমে পড়লো। আমরা কেক চিবাতে চিবাতে সবার শেষে নামলাম। জায়গাটার নাম মাসকান্দা। আমরা একটা ইজি বাইক নিলাম। পাঁচ জনে চড়ে বসলাম তাতে। ইজিবাইকে উঠে জানতে পারলাম আমাদের সার্কিট হাউজ বুকিং বাতিল হয়ে গেছে। সারা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে পিডাব্লিউডির রেস্ট হাউসে। সেখানে আমরা থাকতে পারবো কিনা চেষ্টা করে দেখতে। আমরাও ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিলাম, আমরা যাবো আর কোন গন্ডোগোল হবেনা- এটা তো হতেই পারে না!

দীর্ঘদিন পর এরকম অনিশ্চিত একটা পরিস্থিতি আমাদের ইন্ডিয়া ট্যুরের পুরানো কথা মনে করিয়ে দেয়। কোন কারণ ছাড়াই আমরা ইজিবাইকে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকি। রেস্ট হাউসে এসে থামলে আমরা সারা আর তানভীরকে পাঠাই কথা বলতে যাওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ পর তানভীর হাসি হাসি মুখে জানালো এখানে কোন খালি জায়গা নাই। চারটা মোটে রুম, চারটাতেই লোক আছে। সারা কাকে কাকে যেন ফোন দিয়ে কপাল কুঁচকে হেঁটে হেঁটে আসতে লাগলো। ওর কথায় বুঝলাম, আমাদের এখানে থাকা হবে না। আবার আমরা চড়ে বসলাম ইজিবাইকে। বললাম কোন হোটেলে নিয়ে যেতে।

ইজিবাইকে থাকতে থাকতেই আমার মনে পড়লো স্যারের কথা। যা আছে কপালে ভেবে দিলাম স্যারকে ফোন। ফোন ধরলো নাজনীন আপু। আমি সবিস্তারে সব খুলে বললাম আর জানালাম স্যার কি আমাদের কোন জায়গায় রেফার করতে পারবেন কিনা।  আপু একটু পরে জানাবেন বললেন। ওদিকে আমরা এসে পৌঁছালাম হোটেল মুস্তাফিজে। আবার আমরা সারা আর তানভীরকে পাঠালাম খোঁজ নিতে। ওরা ঘুরে এসে বললো বেশ ভালো হোটেল, দামটাও বে-শ ভালো। প্রতি রুম ৩০০০ টাকা। আমাদের দুই রুম লাগবে। এত টাকায় থাকা সম্ভব না। আমরা ইজিবাইকওয়ালাকে বললাম আরও একটু সস্তা হোটেলে নিয়ে যেতে। আবার চলতে শুরু করলো ইজিবাইক।

কেমন যেন পাইকারি বাজার বাজার টাইপের জায়গায় এসে আমাদের ইজি বাইক থামলো ‘হোটেল নিরালা’  নামের হোটেলের সামনে। আবার সারা আর তানভীর গেলো খোঁজ নিতে। আমি তাকিয়ে দেখতে লাগলাম জায়গাটার নাম ছোট বাজার আর চক বাজার। পুরাই ঢাকার চকবাজার টাইপের এলাকা। একটু পর ওরা জানালো রুমের অবস্থা বেশ ভালো। ১৫০০ টাকায় ডবল রুম আর সিঙ্গেল রুমও আছে। সব মিলিয়ে আমাদের খরচ কম হবে। আমরা ইজি বাইক ছেড়ে দিলাম ২০০ টাকা দিয়ে। লোকটা খুশি মনে চলে গেলো। আমরা রিসেপশনে গিয়ে বসলাম। তখনই মনে পড়লো স্যারকে ফোন দিয়ে জানাই যে হোটেল পেয়ে গেছি। আমি সাথে সাথে ফোন দিলাম। এবার ফোন স্যার ধরলেন। আমি জানালাম যে থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে ‘হোটেল নিরালা’তে। স্যার জিজ্ঞেস করলেন টাকা দিয়ে ফেলেছি কিনা, আমি বললাম এখনও দেওয়া হয় নাই। স্যার বললেন পাঁচ মিনিট ওয়েট করতে। আমি সবাইকে বললাম অপেক্ষা করতে। এর মধ্যে রিন্তু ফোন দিলো। পাগলের মতন ও জানতে চাইলো আমাদের কি অবস্থা। আমি ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম। ও আমাদের কথা শুনে পুরাই অস্থির হয়ে গেলো। একে ওকে ডেকে চিৎকার করে কি কি সব জিজ্ঞেস করতে লাগলো। ঐদিকে আমার ফোন বেজে উঠলো। স্যারের ফোন।

স্যার জানতে চাইলেন আমরা কয়জন, আমি জানালাম পাঁচ জন। স্যার বললেন, ‘পাঁচটাই কি মেয়ে?’। আমি জানালাম, ‘চারটা মেয়ে একটা ছেলে’। স্যার বললেন, ‘চারটা মেয়ে তোমাদের আপুর বাসায় আর ছেলেটা আমার সাথে আমার বাসায় থাকতে পারবে।‘ স্যার আরও ঠিকানা বলে দিলেন যে এখান থেকে আপুর বাসা খুব কাছে। আমি কানে ঠিকমত শুনতে পাচ্ছিলাম না তবুও বুঝলাম আকন্দ লাল বাড়ি। আমি ফোন রেখে সবাইকে জানালাম যে স্যারের শ্বশুর বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু স্যারের বাড়িতে থাকতে হবে শুনে তানভীর বেঁকে বসলো। ও কিছুতেই স্যারের বাড়ি যাবে না। আমরা বললাম ওকে আমাদের সাথে আকন্দ বাড়ি পর্যন্ত যেতে। পরে ওর ইচ্ছা হলে ও এই নিরালা হোটেলই থাকতে পারবে। তারপর আমরা হাঁটা শুরু করলাম রাস্তা ধরে।

এতক্ষণ তানভীরের মধ্যে কোন ভাবান্তর ছিলো না। হঠাৎ করেই ও বেশ অ্যাক্টিভ হয়ে পড়লো। এদিক সেদিক সমানে ফোন দিতে শুরু করলো। আমরা রাস্তা ধরে হেঁটে শেষ মাথায় পৌঁছালাম। তারপর লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে হাঁটছিলাম। আবার স্যারের ফোন। স্যার আরও কিছু ডিরেকশন দিলেন যার বেশির ভাগই আমি কানে শুনলাম না তবে শুনলাম ‘আঠারো বাড়ি লেন’ আর ‘নদী’ কথাটা। একটু অবাক হলাম, এদিকে তো কোথাও নদী নাই! প্রায় সাথে সাথেই দেখলাম একটা লন্ড্রির দোকানের নাম ‘নদীয়া’। আমরা তার উলটো পাশের গলি দিয়ে ঢুকে পড়লাম। সেই মুহুর্তে তানভীর জানালো ডিসি আংকেল ওকে বলেছে সার্কিট হাউজে গিয়ে ওকে সামনা সামনি কথা বলতে। আমরা বললাম বাড়িটা খুঁজে বের করা পর্যন্ত আমাদের সাথে থাকতে। একটা মুদি দোকানে আকন্দ লাল বাড়ি বলার সাথে সাথে তারা বললো আকন্দ লাল বাড়ি বলে কিছু নাই তবে আকন্দ লজ হচ্ছে উলটো পাশের বাড়িটা। ইয়া আল্লাহ, আমি এতক্ষণ আকন্দ লজকে আকন্দ লাল শুনেছি!

গেটের সামনে দাঁড়ালাম। বনেদি জমিদারি বাড়ি। ইতস্তত করে গেটে ধাক্কা দিলাম। গৃহকর্মী এসে গেট খুলে দিলেন। আমি নাজনীন আপুর নাম বলাতে চিনতে পারলো না, কিন্তু ঝুমি আপু বলার সাথে সাথেই উনি মাথা নেড়ে বললেন ‘হ্যাঁ, এটা ঝুমি আপুদের বাসা’। গেট দিয়ে ঢুকে আমরা হতবাক গয়ে গেলাম। কনক্রিটের ব্লক বিছানো বড় উঠান। তাতে আবার একটা ছোট আউট হাউজ। আর সামনে বিশাল বিশাল মোটা কলামওয়ালা জমিদার বাড়ি। আমরা হেঁটে হেঁটে ঢুকলাম। তানভীর আমাদের ছেড়ে গেলো সার্কিট হাউজে খবর নিতে। আমরা গুটি গুটি পায়ে বসার ঘরে এসে বসলাম। ভিতরে হাসি হাসি মুখে সাদা শাড়ি পরা দারুণ স্মার্ট এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছেন।  আমি গিয়ে হড়বড় করে ওনার সামনে গিয়ে নিজের পরিচয় দিতে লাগলাম। উনি আমাদের সবাইকে বসতে বললেন। অল্প বিস্তর কথাবার্তা বললেন। তারপর সেই গৃহকর্মীকে দেকে বললেন আমাদের ওপরের তলার ঘর দেখিয়ে দিতে। আমি মহিলার পিছু পিছু গেলাম উপরের তলায়। যেতে যেতে আমি জানলাম  এই বাসায় শুধুই স্যারের শাশুড়ি আর খালা শাশুড়ি থাকেন।

পুরোনো দিনের সিঁড়ি পার হয়ে দোতলায় উঠেই একটা চমৎকার টেরাস দেখতে পেলাম। টেরাসের পাশেই প্রায় ইন্টার কানেক্টেড দুইটা বেড রুম।  মহিলা একটা একটা করে রুমের লাইট জ্বালাচ্ছিলেন। আর রুম দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাচ্ছিলো। ফেলুদা, কাকাবাবুরা বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গিয়ে যেসব বাড়িতে ওঠে, ঠিক সেই রকম ঘর একেকটা। ঝাঁ চকচকে রুম, নরম তুলতুলে বনেদি বিছানা- আর কি চাই! মানুষজন থাকে না, তাতেই এই রকম টিপটপ অবস্থা- লোকজন থাকলে না জানি কি হতো!

আমি আবার নিচে নেমে এসে বসার ঘরে ঢুকলাম। আমরা পড়ে গেলাম এক মহা ফ্যাসাদে। এদিকে রাজ বাড়িতে বসে আছি বাদশাহী আয়োজনে, অন্যদিকে তানভীর সার্কিট হাউজের খোঁজ নিতে গিয়ে কোন খবর দিচ্ছে না। আর রিন্তু ফোন দিচ্ছে, ওরও তো টেনশন আছে আবার হলুদের প্রোগ্রামও আছে। সেটার জন্যও আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিলাম। ঠিক করলাম তানভীর খবর পাঠানোর আগ পর্যন্ত আমরা এই বসার ঘরেই বসে থাকবো। যদি রুম পাওয়া যায় সার্কিট হাউজে তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ, আর যদি রুম পাওয়া না যায় তবে আমাদের এখানেই থাকা হবে- সেক্ষেত্রে তানভীরের জন্য কোন একটা ব্যবস্থা করতে হবে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, তানভীর ফোন দিয়ে জানালো সার্কিট হাউসে থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আমরা খবরটা শুনে খুশি হলাম।

আমি নাজনীন আপুকে ফোন দিলাম। খুলে বললাম সব কথা। আপু বললেন আমাদের ফ্রেশ হয়ে চা নাশ্তা খেয়ে ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে। এখানে থাকলেও আমাদের কোন অসুবিধা হবে না এ কথা বারবার বলে দিলেন। আমি অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বলে দিলাম যে, ব্যবস্থা যখন হয়েছে তখন কোন ঝামেলা না করে আমরা সার্কিট হাউজেই চলে যাবো। তারপর আবার বসার ঘরে এসে বসলাম। আমাদের জন্য চা, শিঙ্গাড়া আর বিস্কুট আসলো। স্যারের শাশুড়ি আর খালা শাশুড়ি আমাদের সাথে অনেক গল্প করলেন। আমরাও খোশমেজাজে ওনাদের সাথে গল্পগুজব করছিলাম। ওদিক থেকে তানভীর ফোন দিতে লাগলো, আমরা কেন আসছি না সার্কিট হাউসে। আমরা উঠে বিদায় নিতে যাবো এমন সময় নাজনীন আপু আবার ফোন দিলেন, আমরা কি সিদ্ধান্ত নিলাম সেটা জানতে। আমি আবারও ধন্যবাদ জানিয়ে জানিয়ে দিলাম যে আমরা এখনই সার্কিট হাউসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাচ্ছি।

আকন্দ লজ থেকে বের হয়েই আমরা পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলাম। একটা ইজি বাইক খুঁজতে খুঁজতে প্রায় সেই নিরালা হোটেল পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। শেষমেশ আমরা রিকশা নিলাম। আমি আর তমা উঠলাম এক রিকশায়। ভাড়া দরদাম করে ঠিক করলাম ২০টাকা। মোটর বসানো রিকশা আমাদের নিয়ে ছুটতে লাগলো রকেটের বেগে। চিপাচাপা অলিগলি পার হয়ে আমরা যেতে লাগলাম সার্কিট হাউসের পথে। কিন্তু পথ তো আর শেষ হয় না। তমা তো সন্দেহ করেই বসলো ভাড়া ২০টাকা নাকি ১২০টাকা! অনেক পথ পাড়ি দিয়ে হঠাৎ এক জায়গায় তীর চিহ্ন সহ ‘সার্কিট হাউজ’ লিখা সাইনবোর্ড দেখে আমরা বুঝতে পারলাম যে ঠিক জায়গায় এসেছি। কিন্তু আশ্চর্য, রিকশাওয়ালা আমাদের সেদিকে না নিয়ে অন্যদিকে নিয়ে গেলো। আমি আর তমা চিৎকার করে বললাম ডানদিকে যেতে কিন্তু রিকশাওয়ালা আমাদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আত্মবিশ্বাসের সাথে নিয়ে গেলো একটা পার্কের গেটে। তারপর বললো যে সার্কিট হাউজ বলে সবাই এখানেই আসে। আমার ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো। তারপর অন্যদের কাছে জিজ্ঞেস করে রিকশাওয়ালা আমাদের সার্কিট হাউজেই নামিয়ে দিলো। আমরা ২০টাকা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সার্কিট হাউসে ঢুকে পড়লাম। আমাদের দেখেই কেয়ার টেকার ছুটে আসলো। তানভীরের নাম বলতে ওনারা আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেলো ভিআইপি একটা রুমের সামনে। পাশের রুম থেকে তানভীর বের হয়ে আসলো। ওদিকে সুমাইয়া আর সারাও এসে পৌঁছে গেছে। আমরা ঢুকলাম আমাদের রুমে যার নাম পলাশ।

এও একটা মিনি বাদশাহী ব্যাপার। এলইডি টিভি, গদি আঁটা সোফা, লম্বা ড্রেসিং টেবিল, ডবল বেড, সিঙ্গেল বেড- কি নাই! দশ ফিট লম্বা বিশাল বিশাল সব জানালা ভারী ভারী পর্দা দিয়ে ঢাকা। ঝকঝকে বিশাল বাথরুম- সবকিছুর মধ্যেই অভিজাত ভাব। আমরা ব্যাগটা রেখেই শরীর এলিয়ে দিলাম বিছানায়। আমি ঘড়ি দেখলাম, সাড়ে সাতটা বাজে। কতকিছু হয়ে গেলো গত আড়াই ঘন্টায়! নিজেরাই ঠিক করলাম, যেভাবেই হোক আধা ঘন্টার মধ্যে রেডি হয়ে বের হতে হবে।

খুবই আশ্চর্যজনকভাবে আমরা আধা ঘন্টার মধ্যেই হাতমুখ ধুয়ে, ইস্ত্রি করা শাড়ি পরে (সুমাইয়ার ইস্ত্রির জন্য অনেক কৃতজ্ঞতা) পরিপাটি করে তৈরি হয়ে নিলাম। ঠিক ঠিক আটটা বাজে। আমি বের হয়ে তানভীরের দরজায় ধাক্কা দিলাম। তানভীর বের হয়ে আসলো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম ও তৈরি কিনা। আমাকে ও জানালো দুই মিনিট সময় লাগবে। আমি অবাক হয়ে গেলাম, আমরা আধা ঘন্টায় সবাই হুলুস্থুল করে রেডি হয়ে গেলাম, আর ও কি করলো এতক্ষণ ধরে?

কি আর করা, আমরা শাড়ি পরা চারজন সার্কিট হাউজের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। ভীষণ সুন্দর এই সার্কিট হাউজ। লাল রঙের কলোনিয়াল বিল্ডিং। সারি সারি সব ভিআইপি রুম। কেমন যেন একটা রাজসিক ব্যাপার স্যাপার। তানভীর পাঞ্জাবী পরে বের হয়ে এলে আমরা বের হয়ে গেলাম সার্কিট হাউস থেকে। রাতের অন্ধকারে দেখা যাচ্ছিলো না ঠিকমত তবে বুঝতে পারলাম সার্কিট হাউসের সামনে আছে বিশাল মাঠ। এলাকাটা শুনশান নিরব। কোন মানুষজন নাই। আমরা হাঁটতে লাগলাম পার্কের দিকের রাস্তা ধরে। অন্ধকার রাস্তায় পেয়ে গেলাম একটা ইজিবাইক। রওয়ানা দিলাম সানকিপাড়া, হেলথ কমপ্লেক্সের গলি। নানা অলিগলি আর রেলক্রসিং পেরিয়ে আমরা ছুটতে লাগলাম। আর ভাবতে লাগলাম, অনুষ্ঠান কি আছে নাকি শেষ!

রিন্তুর বাসায় নেমে আমরা সোজা তিনতলায় উঠে গেলাম। ড্রইং রুমে সব মুরুব্বিদের পার হয়ে ভিতরে ঢুকে দেখি একটা দুইটা না, অনেকগুলো রিন্তু! ওদের বাসার সবার চেহারা একরকম। আমরা অনেক খুঁজে বের করলাম আমাদের রিন্তুকে। ওকে চেয়ারে বসিয়ে পৃথ্বী আরও কয়েকজনকে নিয়ে ফিনিশিং মেকাপ দিচ্ছে। চোখে বিশাল বিশাল আইল্যাশ লাগিয়ে ও তখন চোখ প্রায় খুলতেই পারছে না। চোখ পিটপিট করেই আমাদের সাথে কথা বললো। আমি আর সারা ওর হলুদের গয়নার ডালা থেকে দুইটা গয়না তুলে নিলাম। আমি মাথায় পরলাম আর সারা হাতে পরলো। বাসার সবাই তাড়াহুড়া করে রিন্তুকে নিয়ে ছাদে যাওয়ার আয়োজন করতে লাগলো। সেখানেই অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে। অনুষ্ঠান শুরু করতে দেরি হচ্ছে দেখে সবাই অস্থির হয়ে উঠছে।

আমি ছাদে উঠে এলাম। একপাশে প্যান্ডেল টানিয়ে বসার আয়োজন করা হয়েছে। অন্যপাশের ছাদ খালি। আমি সেই ছাদেই চলে এলাম। আজকে বিকাল পাঁচটার পর থেকে আমাকে বাসা থেকে নানা মানুষ ফোন করেছে। প্রতিবারই হু হা করে ফোন রেখে দিয়েছি। কোনটা ধরতেও পারি নাই। এখন ঠান্ডা মাথায় আম্মুকে ফোন দিলাম। সব খুলে বলতে বলতে অনেক সময় লেগে গেলো। তারপর ফোন রেখে গেলাম হলুদের আয়োজনে। রিন্তু পরীর মতন স্টেজে বসে আছে। আর সবাই বেশ হাসিখুশি পরিবেশে ওকে হলুদ দিয়ে যাচ্ছে। আমরাও মজা করছিলাম। এরমধ্যে স্যার আমাকে আরেকবার ফোন দিলেন, আমরা ঠিকমত আছি কিনা জানতে।

আজ রিন্তুর হলুদ (কৃতজ্ঞতায়- রেশমা তালুকদার)
আজ রিন্তুর হলুদ (কৃতজ্ঞতায়- রেশমা তালুকদার)

ব্যাপক হিন্দি গান শুনে ভরপেট খাওয়া দাওয়া করে রিন্তুর সাথে ছবিটবি তুলে সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমরা বের হয়ে আসলাম রাত ১১টার দিকে। নিচে নেমে দেখি তানভীর ইতোমধ্যে ইজিবাইক ঠিক করে ফেলেছে।  আমরা হুউশ করে খালি রাস্তা দিয়ে চলে আসলাম আমাদের সার্কিট হাউজে। এবার রুমে ঢুকে আমরা ফ্ল্যাট। সারাদিনের ক্লান্তি যেন হঠাৎ করেই টের পেলাম। শাড়ি বদলে ফ্রেশ হয়ে সবাই গল্পগুজবের মুডে বসলাম। কতদিন পর এরকম একটা রাত, পূর্ণোদ্যোমে আড্ডাবাজীতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সবাই। ম্যাসেঞ্জারে নিশাত আমাদের সাথে সুদূর আমেরিকা থেকে যোগ দিলো। প্রাণ খুলে হাসলাম সবাই। রাত দুটো বাজলে আড্ডায় ছেদ পড়ে। আমরাও যার যার শোবার জায়গা গোছাতে থাকি। আমি আর সারা থাকবো সিঙ্গেল বেডে আর তমা আর সুমাইয়া থাকবে ডবল বেডে। ফ্যান চালিয়ে, লেপ নিয়ে, লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ি। কিন্তু কথা তো আর থামে না।  আমি আর সারা দুনিয়ার বিষয় নিয়ে গল্প করতে থাকি। আমি আবার চা খেয়েছিলাম, তাই ঘুমঘুমভাবটা যেন উধাও হয়ে গিয়েছিলো। কত রাত পর্যন্ত গল্প করেছি বলতে পারবো না। একসময় সারা ঘুমিয়ে পরে, আমিও বোধহয় ঘুমিয়ে পড়ি।

আমাদের ভোর সাতটায় উঠে নদীর তীরে হাঁটার কথা ছিলো। কিন্তু ঘুম ভাঙ্গলো দশটার দিকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমরা হাসতে লাগলাম। আমি বললাম, তানভীর নিশ্চয়ই ভোরে উঠে এতক্ষণে বুকডন সেরে ফেলে নদীর তীরে জগিং করতে গেছে। আমরা ঝটপট রেডি হয়ে বের হয়ে গেলাম রুম থেকে। তানভীরের দরজা নক করতে লাগলাম। কোন সাড়া শব্দ নেই। সারা দিলো ফোন। ও দরজা ফাঁক করে একটু মাথাটা বের করে বললো আমার একটু সময় লাগবে, দশ মিনিট কিংবা তারও বেশি। আমরা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। এতক্ষণে ওর ঘুম ভেঙ্গেছে শুধু!

সার্কিট হাউসের বারান্দা...............(কৃতজ্ঞতায়-রেশমা তালুকদার)
সার্কিট হাউসের বারান্দা……………(কৃতজ্ঞতায়-রেশমা তালুকদার)

কি আর করা, আমরা পুরা সার্কিট হাউজটা ঘুরে দেখতে লাগলাম। ছাদে উঠলাম। ছবি তুললাম এবং হাহা হিহি করতেই লাগলাম। ওদিকে তানভীর পাঞ্জাবী পরে রুম থেকে বের হলো। আমরা জানালাম যে, এখন পাঞ্জাবী না পরলেও হয় কারণ আমর যাচ্ছি নাশ্তা খেতে। একটু পর তানভীর রেডি হলে আমরা সবাই মিলে বের হয়ে পড়লাম। নদীর দিকে আমরা হাঁটতে লাগলাম। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে সারিন্দা নামের একটা দোকানে ঢুকলাম। কিন্তু এখানে খালি ফাস্টফুড। তারপর আমরা রিকশা নিয়ে গেলাম টাউন হল মোড়ে। সেখানে একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হোটেলে দেখলাম পরোটা ভাজা হচ্ছে। আমরা সবাই ঢুকে পড়লাম সেই হোটেলে।

অর্ডার দিলাম পরোটা, ডাল ভাজি আর ডিম ভাজা। খুব সুন্দর ছোট ছোট সাইজের ভাঁজওয়ালা পরোটা চলে আসলো। ডাল ভাজি আর ডিম ভাজা দিয়ে খেতে বেশ মজা লাগছিলো। নানা গল্পগুজব আর হাহা হিহি করতে করতে আমরা নাশ্তা পর্ব শেষ করলাম। সবশেষে ওরা সবাই চা খেলো আর সুমাইয়া আমাদের ১৯২টাকা বিল দিয়ে দিলো। আমরা বের হয়ে আসলাম। এখন আমরা রাস্তাঘাট কিছুটা ধরতে পেরেছি। হেঁটে হেঁটেই সার্কিট হাউজের দিকে যেতে লাগলাম আমরা।

রাতের বেলা যে মাঠ দেখেছিলাম দিনের বেলা দেখলাম সেটা আসলে বি-শা-ল। মাঠ পার হয়ে যেতে যেতে আমরা আইস্ক্রিম কিনে খেলাম। সার্কিট হাউজের রাস্তা ছেড়ে আমরা নদীর দিকে এগিয়ে গেলাম। নদীর পার ধরে হাঁটতে লাগলাম। ব্রহ্মপুত্র নদ যথেষ্ট সরু। তারপরও এপার ওপার পারাপারের জন্য প্রচুর নৌকা আছে। আমরা ঠিক করলাম বিকাল বেলা এসে নৌকায় চড়বো। দেখলাম নদীতীরে একটা বানিজ্য মেলাও হচ্ছে। আমাদের হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছিলো। কিন্তু তমা বারবার তাগাদা দিচ্ছিলো ফিরে যাওয়ার জন্য। গোসল করে ফ্রেশ হয়ে রেডি হতে সময় তো লাগবে। আমরা সুমাইয়া আর তমাকে পাঠিয়ে দিলাম, ওরা গোসল করতে থাকুক ততক্ষণে আমরা একটু ঘুরি।

আমি আর সারা পা ডুবিয়ে হাঁটতে লাগলাম নদীর পানিতে। ঠান্ডা পানি, প্রচুর শামুক আর ঝিনুক দেখা যাচ্ছে। অনেকদূর হেঁটে আমরা একটা নৌকায় উঠে পড়লাম। ৬০টাকায় পার হবো ঠিক হলো। মনে হলো যেন পাঁচ মিনিটও লাগলো না। ওপারে নৌকা থেকে নেমে একটা ভাঙ্গা নৌকাকে দেখলাম। তানভীর এটাকে ‘ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রতিভূ’ বলে আখ্যা দিলো। আমরা ব্যাপক হাসতে লাগলাম। নদীর এপারে আসলে কিছুই নাই। কয়েকটা ফুচকার দোকান ছাড়া বাকি পুরাটাই গ্রাম। হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা ইস্কন মন্দির পেলাম। আমরা ঘুরে ঘুরে মন্দির দেখলাম। ঘড়িতে দেখলাম প্রায় একটা বাজে বাজে অবস্থা। আমরা তাড়াতাড়ি নেমে নৌকা নিলাম। এপারে এসে পানিতে পা ভিজিয়ে নিলাম। তারপর হাঁটা শুরু করলাম সার্কিট হাউজের দিকে।

সুমাইয়া আর তমা গোসল করে ফেলেছে। এবার দুই বাথরুমে আমি আর সারা ঢুকলাম। সারা আবার কাপড় ধুয়ে ছাদে মেলে দিয়ে আসলো। গোসল শেষ করে যথারীতি শাড়ি পরে তৈরি হতে হতে দুইটা বেজে গেলো। আমরা আবার হেঁটে হেঁটে আগের রাস্তায় গেলাম। সেখানে গিয়ে রিকশা নিলাম। এবার আমি আর সারা এক রিকশায়। কোন রিকশাওয়ালাই রাস্তা চিনে না। আমরাই আশ্বাস দিলাম যে কাচারি রোডে গেলে অনুভব কমিউনিটি সেন্টার খুঁজে নিতে পারবো!

কোনরকম ঝামেলা ছাড়াই খুঁজে পেলাম জায়গাটা। ভিতরে ঢুকেই সবার আগে রিন্তুর সাথে দেখা করলাম। লাল টুকটুকে বউ সেজে বসে আছে ও। কিছুক্ষণ ছবিটবি তুলে সোজা খেতে বসে পড়লাম। মজা করে খাওয়াদাওয়া শেষ করে আয়েশ করে গল্প করছিলাম। ওদিকে অবনী ঢাকা থেকে এসে ময়মনসিংহে এসে পৌঁছেছে। তানভীর গেছে ওকে নিয়ে সার্কিট হাউস। সাড়ে তিনটার দিকে স্যার, নাজনীন আপু ওনাদের দুই মেয়েসহ এসে পৌঁছালেন। আমি গিয়ে কথা বললাম। স্যারও ওনার পরিচিত লোকজন পেয়ে গেছেন। ওদিকে বর আসার সাথে সাথে হুলুস্থুল অবস্থা হয়ে গেলো। পরে সব কিছু ঠান্ডা হলে আমরা সবাই মিলে অনেকক্ষণ গল্পগুজব করলাম। এক পর্যায়ে স্যার বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আর ওদিকে চেয়ার টেনে গাছ তলায় বসে আইস্ক্রিম খেলাম আমরা সবাই মিলে। রিন্তুর বিয়ে পড়াতে আরও দেরি আছে দেখে আমরা ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। এবার গন্তব্য পৃথ্বীর বাসা।

পৃথ্বীর বাসা খুঁজে পেতে কোন সমস্যা হলো না। ওর বাসার বসার ঘরে আমরা আয়েশ করে বসে পড়লাম। আন্টি একটু পরপর আমাদের খাবার দিতে লাগলেন। প্রথম দফায় হরেক রকমের ফল। দ্বিতীয় দফায় বিভিন্ন রকমের চকোলেট। তৃতীয় দফায় ভাজা পোড়া আইটেম আর কোক। আর সবশেষে চতুর্থ দফায় খাসীর বিরিয়ানি। ভরা পেটেই আমরা সব কপকপ করে খাচ্ছিলাম। আমাদের অনেক প্ল্যান ছিলো বিকাল সন্ধ্যায় এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করার। কিন্তু টানা জম্পেশ আড্ডা আর বিরতিহীন খাবারের সাল্পাই পেয়ে আমাদের আর কোথাও যাওয়া হলো না। সবশেষে আমরা যখন পৃথ্বীর বাসা থেকে বের হই তখন রাত সাড়ে দশটা বাজে।

সার্কিট হাউসে পৌঁছেই আগে খবর নিলাম ছাদ খোলা কিনা! কারণ সারার জামা কাপড় তো ছাদেই রয়ে গেছে। খোলা আছে শুনে আমি আর সারা টপটপ করে চলে গেলাম ছাদে। একটু ঘোরাঘুরি করে ফিরে আসলাম আমাদের রুমে। বিছানায় আআগের মত হাত পা এলিয়ে দিলাম। কোনমতে দাঁত মেজে নিয়ে কম্বলের তলায় ঢুকে পড়লাম। এবার ঐ বিছানায় শুলো তিনজন, তমা, সুমাইয়া আর অবনী। ক্লান্ত ছিলাম বলেই হয়তো গল্প খুব জমলো না। ঘুমিয়ে পড়লাম অল্প সময়েই।

ঘুম ভাংলো সোয়া আটটায়। উঠেই আমি প্রথমে সুমাইয়াকে বললাম তানভীরকে নক করতে। না হলে আজকেও দেরি হবে। আমরা ফ্রেশ হতে হতেই খবর পেলাম রুম ছেড়ে দিতে হবে। ঝটপট মালপত্র গুছিয়ে আমরা বের হয়ে পড়লাম রুম থেকে। ব্যগগুলো কর্মচারিদের হাতে জমা দিলাম। তারপর বের হয়ে পড়লাম সার্কিট হাউজ থেকে। সামনের মাঠটা ক্রস করে হাঁটতে হাঁটতে আগের ঘুটঘুটে অন্ধকার হোটেলের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। শুক্রবার ছুটির দিন বলেই হয় তো মাঠে প্রচুর ভীড়। নানা রকম প্র্যাকটিস আর ওয়ার্মিং আপ হচ্ছে সেখানে। অনেকগুলো স্পোর্টিং ক্লাব পার হয়ে আগের সেই হোটেলের সামনে এসে পড়লাম। এবার গেলাম রাস্তার উল্টাপাশের হোটেলে। এইটা আগেরটার চাইতে একটু দামী। যাই হোক সেই পরোটা, ডাল, ভাজি আর ডিম ভাজা অর্ডার করলাম। খেতে ভালোই ছিলো। মেশিন মেড চা খেয়ে বিল দিয়ে সবাই বের হয়ে পড়লাম।

যাবো শশীলজ। কিন্তু কোন রিকশাই চিনে না। তারপর আমরা হাঁটা শুরু করলাম। হেঁটেই চলে গেলাম শশী লজ। গেট দিয়ে গট গট করে ঢুকে পড়লাম ভিতরে। আমাদের সাথে একটা বিয়ের কনেও ঢুকলো। মনে হয় ফটোসেশন করতে এসেছে! আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বিরাট জমিদার বাড়ি। ভেতরে অবশ্য প্রবেশ নিষেধ, তবুও বাইরেই ঘুরে ঘুরে সবটা দেখতে আমাদের অনেকক্ষণ সময় লেগে গেলো।  শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে আমরা অনেক ছবি তুললাম। তারপর অনেকক্ষণ গল্প করে বের হয়ে পড়লাম। এবার যাবো জয়নুল গ্যালারি।

শশী লজ (কৃতজ্ঞতায় - রেশমা তালুকদার)
শশী লজ (কৃতজ্ঞতায় – রেশমা তালুকদার)

রিকশা নিলাম আমি আর সুমাইয়া। নদীর তীরে জয়নুল গ্যালারিতে পৌঁছে দেখলাম শুক্রবার গ্যালারি খুলবে তিনটার দিকে। এখন ভিতরে ঢুকার কোন উপায় নেই। কি আর করা, মনের দুঃখে আইস্ক্রিম চিবাতে চিবাতে চলে গেলাম নদীর তীরে। কিছুদূর হাঁটাহাঁটি করে নৌকা ভাড়া করলাম। নৌকা আমাদের নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ নদীতে ঘুরে বেড়ালো। পরে নৌকা থেকে নেমে আমরা হেঁটেই চলে গেলাম সার্কিট হাউস। তানভীর জুম্মার নামাজ পড়তে গেলো আর আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম।

এক পর্যায়ে আমি আর অবনী আগেভাগে বের হয়ে পড়লাম টিকেট কাটার উদ্দেশ্যে। রিকশা না পেয়ে হাঁটতে লাগলাম অনেকক্ষণ ধরে। পরে রিকশা নিয়ে ছুটতে লাগলাম মাস্কান্দার দিকে। আমরা পৌঁছানোর সাথে সাথেই দেখি অন্যরা পৌঁছে গেছে। সারা দাঁড়িয়ে পড়লো টিকেটের লাইনে। অল্প সময়ের মধ্যেই এনার টিকেট পেয়ে গেলাম। ঝটপট উঠে পড়লাম আমরা বাসে। আড়াইটা বাজতে না বাজতেই বাস ছেড়ে দিলো। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম শহরটাকে। এই রকম ঝটিকা সফরে দুই দিনের জন্য হলেও ফিরে গিয়েছিলাম আগের সেই জীবনে। কি চমৎকারই না কাটলো দুইটা দিন। মনের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো। কেন বের হলো কে জানে?

The Mighty INDIA CALLING: শেষের কথা (পর্ব ৪৪)

দেশে পৌঁছার পর পটোল ভাজি, মাছের তরকারি আর ডাল খেতে কি মজা লাগতো! দীর্ঘদিন ধরে বাইরের খাবার খেতে খেতে বাসার খাবার মুখে দিতেই অন্যরকম শান্তি পেতে লাগলাম। প্রথম কয়েকদিন বেঘোরে বিছানায় পড়ে ঘুমাতে লাগলাম। চোখ বুজলেই দেখতে পেতাম সাদা বরফের মধ্যে গামবুট পরে হাঁটছি আর পায়ের নিচে সাদা বরফের স্তুপের মধ্যে জুতার ছাপ পড়ে যাচ্ছে। কতবার যে ঘুমের ঘোরে দেখেছি এই দৃশ্য! অনেক সময় হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যেত, ভাবতাম আরে, পা সোজা করতে পারছি কেমন করে? পায়ের কাছের দেওয়ালটা কই চলে গেলো? পরক্ষণেই মনে পড়তো, আমি তো কলকাতায় নাই, আছি আমার নিজের দেশে নিজের ঘরে। এইভাবে পার হলো কত দিনের পর দিন!

প্রথম প্রথম দ্বিমিকবাসীর সাথে দেখা হলেই খালি ইন্ডিয়া ট্যুরের কথাই আসতো ঘুরে ফিরে। ক্লাস শুরু করার পর থেকে সেটা আরও বড় পরিসরে হতে লাগলো। সারা ফোর্থ ইয়ারে খুব কমই দিন গেছে যে আমরা ইন্ডিয়া ট্যুরের কোন কথা আলোচনা করছি না। এমনকি এখনও আমরা দল বেঁধে গল্প করছি আর ইন্ডিয়া ট্যুরের কথা উঠে আসে না, এমনটা কখনই হয় না। কোন না কোনভাবে সেই দিনগুলোর কথা আসবেই…

আমার ব্যাক্তিগত জীবনেও অনেক পরিবর্তন এসেছে এই ট্যুরের পর। যেখানে যার সাথেই দেখা হয়, কায়দা করে জানিয়ে দেই আমার তেতাল্লিশদিন ব্যাপী ভ্রমনের কথা। সবাই তখন চোখ বড় বড় করে তাকায়। আর গত দু বছর ধরে বাসার লোকজন ট্যুরের কথা শুনতে শুনতে ত্যাক্তবিরক্ত। একমাত্র আম্মু ছাড়া এখন ভদ্রতা করেও কেউ আর শুনতে চায় না। এছাড়া সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো আমার নিজের উপর আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে বহুগুণ। যেকোন পরিবেশে খাপ খাওয়ানো, বিভিন্ন পরিস্থিতি সামলে নেওয়া, বিভিন্ন মানুষের সাথে মেশা, অস্বাভাবিক শারীরিক পরিশ্রম করা, অচেনা জায়গায় চলাফেরার কায়দা রপ্ত করা, দলগত সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া, দিনের পর দিন সত্যিকারের ‘টিম ওয়ার্ক’ করাসহ আরও নানা রকম অভিজ্ঞতা হয়েছিলো বলেই নিজেকে আমি চিনতে পেরেছি নতুন রূপে (মাঝে মাঝে নিজেই অবাক হয়ে যাই, যখন ভাবি এত কিছু তখন কেমন করে করেছি!) । আমার মাঝে যে এত প্রতিভা সুপ্ত হয়ে লুকিয়ে ছিলো সে কথা আমি জানতে পারলামই এই ট্যুরে গিয়ে!

 

লাগেজ ভর্তি শীতের পোশাক, পিঠে ব্যাকপ্যাক, কাঁধে ডিএসএলআর, হৃদয়ে তুমুল অ্যাডভেঞ্চারের নেশা আর মনে বরফ, মরুভূমি, পাহাড়, গুহা আর সমুদ্র যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আমরা ৪৬ জন সম বয়সী পাড়ি জমিয়েছিলাম ভিনদেশের উদ্দেশ্যে। অনেক রকম আশংকা, অনেক অনিশ্চয়তা, টাকা পয়সার টানাটানি এই রকম নানা রকম সমস্যাকে সাথে নিয়েই সত্যিকারের জীবনটাকে দেখতে পেয়েছি খুব কাছ থেকে এবং সেই দেখা কমানোর ব্যাপারে এতটুকু ছাড় দিতে রাজী ছিলাম না কেউই। সামর্থের মধ্যে যতটুকু পাওয়া সম্ভব তার সবটুকুই পেয়েছি এবং আল্লাহর রহমতে জীবনের সবচেয়ে সেরা সময়টা পার করেছি এই তেতাল্লিশদিনে।  নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার সেই টাটকা অভিজ্ঞতাগুলো সবার স্মৃতির মানসপটে পাকাপাকিভাবে ছাপ ফেলে দিয়েছে।  সেই ছাপ মলিন হলেও কিছুতেই মুছে যাবার নয়, বরং জীবনের নানা রকম পরিস্থিতি বারবার মনে করিয়ে দেয় সেই স্বপ্নময়ী দিনগুলোর কথা।

‘Go bag packing in your 20’s. It can be life changing’

উদার প্রকৃতি, রাজসিক স্থাপত্য, জীবন ঘনিষ্ট রীতিনীতি আর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে গড়ে ওঠা হাজারও স্মৃতি এই ছেচল্লিশজন মানুষ বয়ে বেড়াবে বাকি জীবন………

দ্বিমিক ১০ এর ভারত ভ্রমণ INDIA CALLING
দ্বিমিক ১০ এর ভারত ভ্রমণ INDIA CALLING

The Mighty INDIA CALLING: জার্নি ব্যাক টু বাংলাদেশ এবং বর্ডারে ছোটখাটো ‘কেয়ামত’ (পর্ব ৪৩)

সত্যি সত্যি গভীর রাতেই আমরা ঘুম থেকে উঠলাম। মোটামুটি চারটা বাজে তখন। নিজেরা চোখ ডলে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। প্রত্যেকেই রেডি হয়ে শেষ বারের মত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম। এতটুকু সময় নষ্ট না করে একে একে মালপত্র রুম থেকে বের করতে লাগলাম। সবার লাগেজের সংখ্যাই ছয়, সাত, আটের মতন। একটা মাত্র লিফট দিয়ে এতগুলো লাগেজ নিচে নামানোটাও কম হ্যাপা না। সবার আগে মজুমদার আর মৌলি বের হয়ে গেলো। সবার শেষে আমি আর রুবাইদা রুম ছেড়ে বের হলাম। লিফটের সামনে তখন লাগেজের লাইন পড়ে গেছে। এদিকে আমরা আবার তিনতলায় আছি। ওদিকে দোতলার লোকজন সব লিফট ভরে মালপত্র ঢুকাচ্ছে কারণ লিফট তিন তলায় আসার আগে দোতলায় থামে। তাই লিফট যখনই তিন তলায় আসে তখনই ভরা থাকে, আমরা আর উঠতে পারি না। এভাবে কেটে গেলো অনেকক্ষণ। শেষে আমরা অধৈর্য্য হয়ে গেলাম। তখন দোতলার লোকজনদের একটু মায়া দয়া হলো। ওরা আমাদের জন্য একটা খালি লিফট পাঠালো। সেই লিফটেই আমি আমার সব বড় ব্যাগ সাধ্যমত তুলে দিলাম। বাকি গুলো নিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলাম।

নিচে গিয়ে আবার লিফট থেকে মালপত্র টেনে টেনে নামাতে হলো। আগেই দেখেছিলাম নিচতলার ফ্লোরটায় লেভেল আপডাউন অনেক বেশি। এই ভারি ভারি ব্যাগ টেনে হিঁচড়ে নিতে নিতে আমাদের ঘাম ছুটে গেলো। আমরা মালপত্র রিসেপশনে রেখে বাইরে বের হয়ে আসলাম। অন্ধকার রাত, সূর্য ওঠার কোন লক্ষণ নাই। ওদিকে আমাদের বাস আসে নাই। তাই আমরা বের হতে পারছি না।

একসময় আমাদের বাস আসলো। সেটা দাঁড়িয়ে রইলো রফি আহমেদ স্ট্রিটে। আমাদেরকে সেখান পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে। হেঁটে যাওয়াটা তো কোন ব্যাপারই না। কিন্তু সাথে যখন এতগুলো মালপত্র, তখন আমাদের মাথা চুলকাতে হলো। কিন্তু কিছু করার নাই। বিসমিল্লাহ বলে রওয়ানা দিলাম। পিঠে ব্যাকপ্যাক, কাঁধে সাইড ব্যাগ, এক হাতে দুইটা পোথিসের ব্যাগ আর লাগেজের উপর বড় ব্যাগটা বসিয়ে অন্য হাতে আরেকটা ছোট ব্যাগ নিয়ে সেই হাতেই লাগেজটা টানতে লাগলাম। আমার মনে হলো আমার সব বোধ শক্তি শেষ হয়ে গেছে। এভাবে করে সাতটা ব্যাগ নিয়ে এই রাস্তা হেঁটে পাড়ি দেওয়া যে সম্ভব না সেটা বুঝার ক্ষমতাও যেন লোপ পেয়ে গিয়েছে। লাগেজের হ্যান্ডেল ধরে টানার সময় একটু পর পর ধুড়ুম করে লাগেজের উপর থেকে বড় ব্যাগটা পড়ে যেতে লাগলো। একবার আমি নিজেই তুললাম, আরেকবার জাফর তুলে দিলো, আরেকবার তুলে দিলো রুবাইদা। শেষে আমার অবস্থা দেখে রুবাইদা এগিয়ে আসলো। ও বুদ্ধিমানের মতন সব লাগেজ একবারে না এনে ভাগেভাগে নিয়ে এসেছে। ও আমার কয়েকটা জিনিস বয়ে নিয়ে গেলো।

অনন্তকাল পর মনে হলো আমি রফি আহমেদ স্ট্রিটে এসে পৌঁছেছি। তখন আকাশ একটু একটু পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। ভোরের সেই ফ্যাকাশে আলোয় দেখলাম একটা সাধারণ বাস রাস্তায় ট্রাম লাইনের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তার পিছনে আমাদের লাগেজের বিশাল স্তুপ। আমি গিয়ে আমার লাগেজও সেখানে রেখে দিলাম। বাসে কেন লাগেজ ওঠানো হচ্ছে না- এই প্রশ্নের উত্তর পেলাম একটু পরেই। আসলে লাগেজ ওঠানোর সব জায়গা ভরে গেছে। বাসের লোকজন চিন্তা ভাবনা করে কিছু কিছু লাগেজ বাসের ভিতর আমাদের বসার জায়গায় তুলে দিচ্ছে। কিন্তু এই পাহাড়সম লাগেজের স্তুপ কোথায় জায়গা দেওয়া হবে সেটার কোন সমাধান কেউ করতে পারছে না। ওদিকে কমিটির লোকজন উশখুশ করতে লাগলো। বাস এখনই ছেড়ে দিতে হবে কারণ আমরা দাঁড়িয়ে আছি ট্রাম লাইনের উপর। ট্রাম চলাচল শুরু হলে আমাদের বাসের কারণে রাস্তা ব্লক হয়ে যাবে। ওদিকে সবাই এসে পৌঁছায়ও নাই। আমরা যারা যারা ছিলাম তারা বাকিদের ফোন দিতে লাগলাম। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই মোটামুটি সবাই চলে আসলো। ওরা কোথায় যেন এক ভ্যান ওয়ালাকে পেয়েছিলো। সবার সব মালপত্র ভ্যানে তুলে দিয়ে ওরা দৌঁড়ে দৌঁড়ে আসতে লাগলো।

ওদিকে মারাত্মক গ্যাঞ্জাম লেগে যাচ্ছে। এত লাগেজ কেমন করে তোলা হবে সেটার কোন সমাধান হচ্ছিলো না। সবাই মিলে একসাথে হৈচৈ জুড়ে দিতে শুরু করলো কারণ সময় পার হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। শেষমেষ ব্যাপক চিৎকার করে ইশতিয়াক পরিস্থিতি সামলালো। প্রথমে আমরা সবাই সুড়সুড় করে বাসের ভিতর ঢুকে পড়লাম। বসার জায়গার কোন বালাই নাই, দুইজনের সিটে তিনজন করেও বসে গেলাম। কোনমতে সবাই উঠে বসার পর হাতে হাতে সব মালপত্র টেনে আমাদের সম্পূর্ণ বাসটা ভরে ফেলা হলো। আমাদের আর নড়া চড়ার কোন উপায় রইলো না। এক সমুদ্র লাগেজে যেন আমরা ডুবে গেলাম। সব লাগেজ উঠে যেতেই আমাদের বাস ছেড়ে দিলো। এই বার আমি নিজের দিকে একটু মনোযোগ দিলাম। জানালার পাশে বসেছে নোভা আর তারপাশে বসেছি আমি। তবে আমার সিটটা আমি শেয়ার করছিলাম নোভার হ্যাভারস্যাকের সাথে। নোভার কোলেও একটা ব্যাগ, পায়ের নিচেও আরেকটা ব্যাগ। আমার পায়ের নিচটা খালি ছিলো দেখে আমি আমার কোলে ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে অন্য একটা ব্যাগ পায়ের নিচে রেখে দিলাম।

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদের দিকে তাকানোর চেষ্টা করছিলাম। লাগেজের ফাঁক ফোকড়ে টাইট প্যাকড হয়ে বসে থাকা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত চেহারাগুলো দেখে আমার কেন যেন হাসি পেতে লাগলো। সারা বাসের মধ্যে আমিই একমাত্র হাসতে লাগলাম।  কয়েকজন একটু বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকালো। অন্তরা বলেই ফেললো, ‘নুযহাত, হাসি থামা নইলে মাইর খাবি কিন্তু’। আমার যে কষ্ট হচ্ছিলো না সেটা নয়। কিন্তু এরকম অভিজ্ঞতার কথা জীবনে আর দ্বিতীয়বার হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। কি অদ্ভূতভাবেই না আমরা ইন্ডিয়া ছেড়ে যাচ্ছি! ওদিকে অন্তরার বসার জায়গা ছিলো খুবই সামান্য। ও সেখান থেকে উঠে একটা ব্যাগের উপর পা তুলে বসে পড়লো আর নিজেকে ‘বিজনেস ক্লাস’ এর যাত্রী বলে দাবী করলো। এটা দেখেও আমি আরও হাসতে লাগলাম।

কিছু সময় পার হয়ে গেলে আমি একটু চোখ বন্ধ করার উপায় খুঁজছিলাম। আমার বামদিকে নোভার হ্যাভারস্যাকটা গ্যাঁট মেরে বসে আছে। আর ডানদিকে লাগেজের স্তুপের মধ্যে তানভীরের সবুজ স্যুটকেসটা উল্টা হয়ে এমনভাবে পড়ে আছে যার চাকাটা একদম আমার মাথা বরাবর। কি আর করা, একবার হ্যাভারস্যাক আরেকবার স্যুটকেস জড়িয়ে আমি চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করতে লাগলাম। শরীর প্রচন্ড ক্লান্ত, চোখ বন্ধ হয়ে এলেও ঠিক ঘুম আসলো না।

বর্ডারের কাছাকাছি চলে আসতেই সবাই নড়েচড়ে উঠলো। তখন আরেকটা আতংকজনক ব্যাপার বুঝতে পারলাম। আমাদের এই বাস এইখানেই ছেড়ে দিতে হবে। বর্ডার ক্রস করে আমরা আরেকটা বাসে উঠবো। এই লাগেজগুলো নিয়ে কেমন করে বর্ডার পার হবো সেই চিন্তা করে আমার পেটের ভেতর পাক খেয়ে উঠতে লাগলো। পেট্রোপোল বর্ডারে এসে আমাদের বাসটা থামলো একেবারে রাস্তার উপর। বাস থামার সাথে সাথেই কয়েকজন লোক অসম্ভত দ্রুত গতিতে আমাদের বাস থেকে মাল নামাতে শুরু করলো। ওদিকে বাইরে এই বাসে ওঠার জন্য যাত্রীদের জটলা বেঁধে গেলো। আমরা সবাই চুপ করে বসে রইলাম। সব মাল বের করা হয়ে গেলে আমরাও একে একে বাস থেকে নামতে লাগলাম। গা ঘেঁষে হুউশ করে পিছন দিয়ে যাচ্ছে বাস। তাড়াহুড়া করে লোকজন উঠছে আর নামছে বাস থেকে। এরকমই এক ব্যস্ত রাস্তার ধারেই বি-শা-ল স্তুপ করে আমাদের মালপত্র রাখা হয়েছে। আর সেটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছি আমরা সবাই। সে এক দেখার মতন দৃশ্য!

এই লাগেজের পাহাড়ের মধ্যেই আমরা যার যার নিজেদের লাগেজ খুঁজতে লাগলাম। কোনমতে একটু কোনা দেখতে পেলেও সবাই খুশি হচ্ছিলো, ‘যাক বাবা- লাগেজ হারায় নাই, আছে’।  বর্ডারে সবাই শেষবারের মত রুপি ভাঙ্গিয়ে টাকা করে নিলো। আমরা শ্যামলী ওয়েটিং রুমে খানিক্ষন বসলামও। সেখানেই জানতে পারলাম, দেবার একটা ব্যাগ মিসিং। ভাগ্য ভালো খুব মূল্যবান কিছু ছিলো না সেটাতে। তবে দেবার মন খারাপ হয়ে গেলো। আমি আমার ফোনে গ্রামীনের সিমটা ভরে ফেললাম। কিন্তু ফোন দিতে পারলাম না কারণ টাকা নাই। ওদিকে আম্মু রুবাইদার ফোনে ফোন দিয়ে আমার সাথে কথা বললো। আমি আম্মুকে বললাম আমার ফোনে টাকা পাঠাতে।

কিছুক্ষনের মধ্যেই কমিটির লোকজন বললো ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়াতে। কিন্তু আমাদের লাগেজের কি হবে? এই প্রশ্নের জবাবে ওরা জানালো শ্যামলীর লোকজনই লাগেজ নিয়ে যাবে। শুনে আমরা হতবাক হয়ে গেলাম। কে নিয়ে যাবে, কই নিয়ে যাবে কিছুই তো জানতে পারবো না! কিন্তু এছাড়া কিছু করারও নাই। তাই আল্লাহর ভরসায় লাগেজগুলোকে রেখেই আমরা লাইনে দাঁড়ালাম। লাইনে তো দাঁড়িয়েছি, কিন্তু অজানা আশংকায় বুক দুরুদুরু করতে লাগলো। ঠিকমত আসবে তো সব লাগেজ? দেবারটা তো চোখের সামনেই হারিয়ে গেলো!

লাইন ধরে ভিতরে ঢুকে পাসপোর্টে সিল মেরে ফটো তুলে ঠিকঠাক মত বের হয়ে এসে দেখি এক খোলা জায়গায় মাটির উপর আমাদের লাগেজ গুলো পড়ে আছে। কি সর্বনাশ! আমি দৌড়ে গিয়ে আমারগুলো খুঁজে বের করলাম। এখান থেকে বর্ডারের গেট পর্যন্ত লাগেজ টেনে নেওয়ার জন্য লাল উইনিফর্ম পরা অথরাইজড কুলি আছে। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে বুঝতে লাগলাম কি করা উচিৎ। সব শেষে যা আছে কপালে ভেবে সেই আগের মত সাতটা লাগেজ বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করে নিজেই টানা শুরু করি। সে যে এক কি ব্যাপক অভিজ্ঞতা সে কথা আর নাই বলি! আমার পাশেপাশে রুবাইদাও ওর মালপত্র টেনে টেনে নিচ্ছে। লাইন ধরে বাংলাদেশ-ভারত গেট পার হলাম। গেট পার হতেই সবুজ উইনিফর্ম পরা বাংলাদেশের অথরাইজড কুলিরা আমাদের সাথে দরদাম করতে লাগলো। এতক্ষণ তো নিজেই টেনে এনেছি, কিন্তু এইবার মনে হলো  শরীরে কুলাবে না। একটা কুলি নিতেই হবে। আমি আর রুবাইদা মিলে একজনকে ঠিক করলাম। লোকটা আমার আর রুবাইদার বড় ব্যাগগুলো বয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। বড় লাগেজ ব্যাকপ্যাক আর ছোটখাটো ব্যাগগুলো আমরা নিজেরাই টানতে লাগলাম।

ব্যাগপত্র টেনে আমরা বেনাপোলের কাস্টমসের অফিসে পৌঁছালাম। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফর্ম ফিলাপ করলাম। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মালপত্রগুলো নিয়ে শেষমেশ আমরা বের হয়ে পড়লাম। কুলি আমাদের সাথে হেঁটে হেঁটে আমাদের মালপত্রগুলো শ্যামলীর কাউন্টার পর্যন্ত পৌঁছে দিলো। সেখানে দেখলাম ভ্যান গাড়িতে আমাদের মাল তোলা হচ্ছে। তারপর ভ্যানগাড়িতে করেই ব্যাগেজ নিয়ে যাওয়া হবে বাস পর্যন্ত। আমি আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আবার আল্লাহর ভরসায় সব মাল দিয়ে দিতে হবে। কারণ বাস কোথায় আছে সেটা জানিনা আর এই ভ্যান আদৌ বাস পর্যন্ত পৌঁছাবে কিনা সেটারও কোন গ্যারান্টি নাই। আর অল্প বিস্তর লাগেজ হলে এক কথা, এরকম দুই তিনশ মালপত্র বাসে নিয়ে ওঠাতে ওঠাতেই যে কয়েকটা মিসিং হয়ে যাবে না সেটাও বা কে বলতে পারে? কিন্তু কিছুই করার নাই। ‘ফী আমানিল্লাহ’ বলে দিয়ে দিলাম সব মালপত্র।

এই কাউন্টারে দাঁড়িয়েই শুনলাম আমাদের বাসে কয়েকটা সিট কম আছে। তাই আমাদের কয়েকজনকে অন্য একটা বাসে করে যেতে হবে। সেই বাসটা এখনই ছেড়ে দিবে, এটা শুনেই ছেলেরা টপাটপ রাজি হয়ে গেলো। ওদেরকে আমরা বিদায় জানিয়ে দিলাম। তারপর হাঁটতে লাগলাম আমাদের বাসের দিকে।  কিছুদূরে হেঁটে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের বাসের কাছে। বিশাল খোলা জায়গায় শ্যামলীর লাল রঙের বাসটা দাঁড়িয়ে আছে। সেটার নিচে লাগেজ রাখার ফোঁকরে লোকজন লাগেজ তুলছে আর মুখ টিপে হাসি দিচ্ছে। ভাবখানা এমন, ‘বাপ রে বাপ, লাগেজের বহর দেখো!’।

আমরা বাসে উঠে বসলাম। আমি আর রুবাইদা সিট পেলাম একেবারে পিছনের সিটের আগে রোতে। বিলাসবহুল বাস, চওড়া সিট। এসির ঠান্ডা বাতাসে আমরা আমাদের ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে আরাম করে বসলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই বাসের লোকজন মাথা চুলকে বলতে লাগলো যে সিকিভাগ মাল দিয়েই লাগেজ কম্পার্টমেন্ট ভরে গেছে আর এসি বাস হওয়ায় ছাদের মাল তোলা সম্ভব না। এখন ওনারা কি করবেন বুঝতে পারছেন না। কমিটি ওনাদের আশ্বাস দিয়ে বললো যে ওনারা যেন নিশ্চিন্তে বাকি সব মাল বাসের ভিতর পুরে দেয়, যেভাবেই হোক।

ওনারা পিছন থেকে মাল ভরা শুরু করলো। পুরো আইল জুড়ে এমনভাবে জিনিসপত্র রাখা হলো সেগুলো একেবারে ছাদ পর্যন্ত ঠেকে গেলো। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে আমার সারির অন্য পাশের সিটে যে বসেছে তাদের চেহারা দেখতে পাচ্ছিলাম না। দাঁড়ালেও তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সিটের উপর পা তুলে কুঁজো হয়ে দাঁড়ালে অন্য আইলের অন্য পাশের মানুষদের একটু আধটু দেখা যায় আর কি! আমরা নিজেদের দুরাবস্থায় নিজেরাই হাসতে লাগলাম! সব লাগেজ তোলা হয়ে গেলে আমাদের অবস্থা আগের মত হয়ে গেলো। তবে সকালের বাসে যদি লাগেজের সমুদ্র সৃষ্টি হয়ে থাকে, এই বাসে বাসে সৃষ্টি হলো ‘মহা সমুদ্র’। তবে পার্খক্য একটাই, আগেরবার বসার জায়গা জুড়েও লাগেজ ছিলো, এইবার অ্যাটলিস্ট বসার জায়গাটুকুন ফাঁকা আছে!

লাগেজের স্তুপের সাথে আমরা
লাগেজের স্তুপের সাথে আমরা

বাস যখন চলতে শুরু করে তখন আমাদের গায়ে কোন শক্তি নাই। এর মধ্যেই জুবায়ের কমিটির তরফ থেকে বিদায়ী ভাষণ দিলো। আমাদের পক্ষ থেকেও মজুমদার কমিটিকে ধন্যবাদ জানালো। এর মধ্যেই আমাদের যাত্রা শুরু হলো। মোটামুটি বাস চলতে শুরু করার সাথে সাথেই সবাই চোখ বুঁজে ফেললো। বেশিরভাগই ঘুমিয়ে পড়লো, যারা ঘুমাতে পারলো না তারাও টুঁ শব্দটি করলো না। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত একদল যাত্রী নিয়ে আমাদের বাস ছুটতে লাগলো ঢাকার পথে।

বিকাল বেলা বাস থামলো মধুখালীতে। আমরা আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠলাম। একটু ফ্রেশ হওয়া দরকার। কিন্তু যেই না নামতে যাবো, সেই লাগলো বিপত্তি। নামার তো কোন জায়গা নাই- কেমন করে নামবো? আমাদের কয়েকজন তখন বিকল্প ‘রুট’ আবিষ্কার করলো। সামনের জনের সিটের মাথার উপর এক পা আর হ্যান্ডেলের উপর আরেক পা রেখে রেখে লোকজন সিট টপকে টপকে বের হতে লাগলো। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য! এই সব দেখে আমি প্রথমে ভাবলাম বের হবারই কোন দরকার নাই। তারপর কে যেন বললো, ‘এই অভিজ্ঞতা কি হবে আর জীবনে? কি আছে জীবনে- একবার ট্রাই করেই দ্যাখ!’ । এরকম উৎসাহে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমিও সাহস করে এগিয়ে গেলাম। খুব সাবধানে একেকজনের সিট টপকে টপকে বাস পার হওয়া- একটু ব্যতিক্রমধর্মী কাজই বটে! তবে ব্যাপারটা যে দারুণ অ্যাডভেঞ্চারাস, তাতে কোন সন্দেহই নাই!

এই লাগেজের সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে আমাদের নামতে হয়েছে
এই লাগেজের সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে আমাদের নামতে হয়েছে

আমাদের বেশির ভাগেরই পকেটে টাকা নাই। তাই খুব কম মানুষই খাবার কিনতে গেলো। আমার খাওয়ার কোন ইচ্ছা ছিলো না। আমি ফিরে আসলাম আবার বাসের মধ্যে। যেভাবে নেমেছিলাম ঠিক সেভাবে উঠে পড়লাম। ওদিকে কমিটি আমাদের প্যাটিস আর কিমা বন কিনে দিলো। এটাই ছিলো কমিটির তরফ থেকে আমাদের শেষ ট্রিট। আমরা চপচপে তেল দেওয়া খাবারগুলো তৃপ্তির সাথে খেয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ পর আবার যখন বাস ছাড়লো, তখন আবার অনেকে ঘুমিয়ে পড়লো।

সন্ধ্যা সাতটা থেকেই বাসা থেকে ফোন আসতে লাগলো। আমরাও মোটামুটি আন্দাজ করে করে টাইম বলছিলাম। কিন্তু বরাবরের মতনই নানা কারণে বারবার লেট হচ্ছিলো। দীর্ঘদিন পর ঢাকা শহর দেখে আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে যেতে লাগলো শেষমেশ যখন বাস ভার্সিটি এলাকায় ঢুকলো, তখন সবাই আনন্দের একটা চিৎকার দিয়ে উঠলো। সেই সাথে একটা হাহাকারও কানে বাজতে লাগলো সমানতালে। ইন্ডিয়া ট্যুর শেষ! আমাদের এত দিনের এত জল্পনা কল্পনার ট্যুরটা শেষ করে আমরা সত্যিই দেশে ফিরে এসেছি! এও কি সম্ভব যে জীবনে ইন্ডিয়া ট্যুরে যাওয়ার এক্সাইটমেন্ট আর থাকবে না?

বাস যখন পলাশি ঢুকে তখন শেষবারের মত আমরা গলা ছেড়ে গান ধরলাম। বুয়েটে এসে বাস ঢুকতেই দেখলাম আমাদের সবার আব্বু আম্মুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাস থামতে দেখেই সবাই উৎসুক হয়ে বাসের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কয়েকজন বোধহয় বাসে উঠেও যেতেন কিন্তু লাগেজের সমারোহ দেখে কেউ আর কাছে আসলেন না। সামনের দিকে যারা ছিলো তারা হ্যাঁচকা টান দিয়ে দিয়ে লাগেজগুলো ছুঁড়ে মারতে লাগলো বাইরের দিকে। এভাবে করে লাগেজ সরাতে সরাতে যাদের যাদের বের হবার পথ ক্লিয়ার হচ্ছিলো তারা বের হয়ে যাচ্ছিলো। আমরা যারা পিছনে আছি তারা বের হলাম সবার শেষে। বাস থেকে নামতেই দেখি আগের মত পাহাড় বানিয়ে লাগেজ রাখা হয়েছে। সেখান থেকে একেকজন একেকজনের লাগেজ টেনে টেনে বের করছে।

আমাকে রিসিভ করার জন্য আম্মু, আব্বু আর মামা এসেছে। আমার বাসার লোকজন আমাকে প্রথমে চিনতে পারে নাই। চিনতে পারবেই বা কেমন করে? ওজন কমেছে অন্তত পাঁচ কেজি, গায়ের রঙ মিশমিশে কালো হয়ে গেছে। এতদিন পর নিজেকে দেখে নিজেই চিনতে পারতাম কিনা সন্দেহ! সবাইকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি যখন একেকটা লাগেজ খুঁজে খুঁজে বের করে আনতে লাগলাম তখন সবাই অবাক হয়ে গেলো। আমি এতগুলো মাল টেনে টেনে আনছি দেখে সবাই অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো, কেমন করে আমি এতগুলো জিনিস নিয়ে আসলাম? সব শেষে যখন বড় ব্যাগটা টেনে আনলাম তখন মামা দৌড়ে আসলো ব্যাগটা ধরতে।

গাড়িতে ওঠার সময় গুনে গুনে দেখলাম সাতটা ব্যাগই এসেছে। একটা শান্তির নিশ্বাস ফেললাম, যাক- আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। কোনমতে সব কিছু গাড়িতে ভরে আমরা রওয়ানা হলাম বাসার উদ্দেশ্যে। গাড়িতে ওঠার সাথে সাথেই আম্মু দুনিয়ার কথা বলতে শুরু করলো। আমি সবই শুনছিলাম, কিন্তু কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে। মাথায় খালি ঘুরছিলো একেটা দৃশ্য- মালালির বরফ, আগ্রার তাজমহল, জয়সাল্মীরের মরুভূমি, গোয়ার সমুদ্র, ত্রিভান্দামের সৈকত, কলকাতার আলো ঝলমলে মার্কুইস স্ট্রিট- আরও কত কি!

কোথায় ছিলাম আর কোথায় চলে আসলাম? সত্যি সত্যিই কি ইন্ডিয়া ট্যুর শেষ হয়ে গেলো?

The Mighty INDIA CALLING: এবং ট্যুরের শেষ দিনে শেষ বুফে ডিনার (পর্ব ৪২)

ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না। কিন্তু অন্তরা এসে হাজির। আজকে প্ল্যান মোতাবেক ভারত মিউজিয়ামে যাওয়ার কথা। সব আলসেমি ঝেড়ে ফেলে আমাকে উঠতেই হলো। তবে আমরা তাড়াহুড়া করলাম না। ধীরে সুস্থে তৈরি হয়ে নিলাম। তারপর সবাই মিলে বের হয়ে পড়লাম।

আমি, মিম, অন্তরা আর রুবাইদা প্রথমে নাস্তা সেরে নিলাম। তারপর হাঁটতে লাগলাম ভারত মিউজিয়ামের দিকে। নানারকম চিন্তাও করছিলাম আমরা। আগেরবার আমাদের বিদেশি বলে সন্দেহ করছিলো যেই কারণে আমরা ঢুকি নাই। এইবার যেন সেই সমস্যা না হয়। তবে আগেরবার আমরা নিতান্তই অনভিজ্ঞ ছিলাম, আর এখন আমাদের অভিজ্ঞতার ঝোলায় আছে তাজমহল, অজন্তা, ইলোরা- এইসব টুরিস্ট স্পট। অনেক চিন্তা ভাবনা করে আমরা অন্তরাকে দায়িত্ব দিলাম পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার। অন্তরা মনে মনে ছক কষে নিলো। ভারত মিউজিয়ামে পৌঁছে গেলাম ঠিকমত। টিকেট কাটতেও কোন অসুবিধা হলো না। কিন্তু যখনই আমরা লাইনে দাঁড়ালাম ভিতরে ঢুকার জন্য তখনই সিকিউরিটির লোকজন আমাদের দিকে কড়া গলায় জানতে চাইলো আমরা কোথা থেকে এসেছি। আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম। কিন্তু অন্তরা একটুও না ঘাবড়ে জবাব দিলো, ‘আমদাবাদ সে আয়া হুঁ’।  এই উত্তরের জন্য ওনারা প্রস্তুত ছিলো না। সাধারনত যাদের বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে তারা বড়জোর নিজেদের কোলকাতার লোক বলেই দাবি করে। এইরকম আহমেদাবাদের অধিবাসী বলে দাবি করে বসে না। লোকগুলোর ভ্যাবাচেকা ভাব কাটার আগেই আমরা তাড়াতাড়ি করে ভিতরে ঢুকে পড়ি।

ভিতরে ঢুকে আমরা যুদ্ধজয়ের ভঙ্গি করি। যাক এই শেষ জায়গাটাতেও আমরা ‘ভারতীয়’ সেজে ঢুকতে সফল হয়েছি। মিউজিয়ামের গ্যালারি দেখতে শুরু করলাম। বি-শা-ল মিউজিয়াম। শুরু হলো সেই বৈদিক আমলে ‘কাউ গেট’ দিয়ে। তারপর একে একে সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখতে লাগলাম। আমাদের জাদুঘরে যে সব মূর্তি আছে সেগুলো প্রায় সবই ছোট ছোট। কিন্তু এখানকার মূর্তিগুলো বিশাল সাইজের। তামা, ব্রোঞ্জ, কষ্টি পাথর কত রকমের মূর্তি! মূর্তি ছাড়াও আছে অস্ত্রশস্ত্র, তৈজসপত্র- শুধু এই সব দেখতে দেখতেই আমরা ক্লান্ত হয়ে গেলাম। রুবাইদার শরীর খারাপ লাগা শুরু হলো। ও আর ঘুরতে রাজি হলো না। আমাদের ফেলে ও একাই হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। রুবাইদা চলে গেলে আমরা তিনজন ঘুরতে লাগলাম।

দোতলায় একটা গ্যালারিতে আস্ত মমি রাখা হয়েছে। আমি কখনও সামনাসামনি মমি দেখি নাই। এই প্রথম মমি দেখে আমার সারা শরীরে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠলো। সার্কোফাগাসের ঢাকনাটা সরিয়ে রেখে শুধু মুখটাই অনাবৃত করে রাখা হয়েছে। বাকি শরীর কাপড় দিয়ে জড়ানো। চোখবিহীন শূন্য কোটর, হাড্ডিসার খুলি আর খিঁচানো দাঁত নিয়ে নিথর হয়ে পড়ে আছে যেন মানুষটা। চার হাজার বছর আগে পৃথিবীর বুকে নিশ্চয়ই দোর্দন্ড প্রতাপের সাথে চলাফেরা ছিলো তার। আজ সে মানুষের দর্শনীয় বস্তু হয়ে পড়ে আছে এক মিউজিয়ামের ভিতর। কি অদ্ভূত পরিনতি! আমি তাকিয়েই রইলাম মমিটার দিকে, মানুষ এই স্বল্পক্ষণের জীবনকে নিয়ে কত ব্যস্ততা, কত হিংসা, কত হানাহানি, কত কি। অথচ মৃত্যু অনিবার্য- এই পৃথিবীর কোনকিছুই স্থায়ী নয় এই কথাটা মনে করার সময়টাই মানুষ পায় না। যে পৃথিবীর জন্য এত কিছু করা হচ্ছে, মৃত্যুর পর শুধু হাড়টাই রয়ে যাবে এই পৃথিবীতে- মমিটা যেন আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে এই কথাটা মনে করিয়ে দিলো।

জিওলজি, জুয়োলজি, বোটানি, অ্যান্থ্রোপ্লজি, আর্ট সব সেকশনের গ্যালারি গুলো দেখতে দেখতে আমাদের পা টনটন করছিলো। সব শেষে আর্ট গ্যালারির মধ্যে বাংলাদেশের জামদানি, বালুচরি, মসলিন, নকশি কাঁথা, কাঠের কারুকাজ, হাতির দাঁতের তৈরির জিনিসপত্র দেখেটেখে আমাদের বুক গর্বে দশ হাত ফুলে উঠলো। এই গ্যালারিতে বাংলাদেশের বস্ত্র এবং কারু শিল্পের সাথে পাল্লা দেওয়ার সামর্থ আর কোন এলাকার নাই। সব দেখেটেখে যখন বের হয়ে গেলাম তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে।

মিম আর অন্তরা যাবে পার্ক স্ট্রিটের একটা দোকানে আগের দিনে কেনা একটা ব্যাগ চেঞ্জ করতে। আমি তাই একা একা রওয়ানা হলাম হোটেলের দিকে। আবার সেই নিউ মার্কেটের ভিতর দিয়ে আসতে লাগলাম। ভাবলাম কিছু খেয়ে নেই। খাওয়াদাওয়া করে একা একাই হাঁটছিলাম। হঠাৎ মনে হলো একটা বড় ব্যাগ কেনা দরকার। আমি হকারদের কাছে গিয়ে ব্যাগ দরদাম করছিলাম। এমন সময় রুবাইদা ফোন দিলো। রুবাইদা অনুরোধ জানালো ওর জন্যও একটা ব্যাগ কিনতে। আমি এই মাথা টু ওই মাথা হেঁটে সবার সাথে দরদাম করে শেষ পর্যন্ত ৯০ রুপি করে একেকটা ব্যাগ কিনলাম। তারপর আবার হাঁটতে লাগলাম। মার্কুইস স্ট্রিটের শ্রীলেদার্সের উল্টা পাশে ‘মোর’ সুপার শপে ঢুকে পড়লাম। বেশ কিছু চিপস কিনলাম। এক ভদ্রলোক অনেক সময় নিয়ে কাউন্টারে মালপত্র জমা দিলেন। তার পিছনেই আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। অনেকক্ষণ পর যখন আমার পালা এলো তখন কারেন্ট গেলো চলে। যাইহোক এক সময় কারেন্ট ফেরত এলো। আমি সব বিল মিটিয়ে দিয়ে বের হয়ে আসলাম। তারপর সোজা হাঁটা দিলাম দিদার বক্স লেনের দিকে।

আগের মতই হোটেলে গিয়ে দিলাম ঘুম। ঘুম থেকে উঠে প্রথমে নতুন ব্যাগে মালপত্র ভরলাম। এই ব্যাগ গুছানো শেষ হলে। আমরা খোঁজ খবর নিতে থাকি আমাদের সিনেমা দেখার কি হলো। জানতে পারি এতগুলো টিকেট একসাথে পাওয়া সম্ভব হয় নাই। তাই আপাতত সিনেমা দেখার প্ল্যান বাতিল। তবে রাতে ডিনারের ব্যাপারটা ঠিক আছে। যেতে হবে ‘নিজাম’স রেস্টুরেন্ট’ এ। এটাও নিউ মার্কেট এলাকাতেই। তাই আমরা ভাবলাম যেতেই যখন হবে, আগে থেকে নিউ মার্কেট গিয়ে ঘোরাঘুরি করাই ভালো।

আবার আমরা বের হলাম সেই নিউ মার্কেটের উদ্দেশ্যে। গত দুইদিন ধরে আমরা এতবার এখানে ঘোরাঘুরি করেছি যে প্রতিটা কাকপক্ষীরও আমাদের চিনে ফেলার কথা। তারপরও আমরা ক্ষান্ত হই নাই। ঘুরতে ঘুরতে আমাদের মনে পড়তে লাগলো শেষে মুহূর্তের কিছু কেনাকাটার কথা। একেবারে শেষমুহূর্তে ‘বিগ বাজার’ গিয়ে ভাতিজাটার জন্য খেলনা কিনলাম। ভিতরে বিল দিতে গিয়ে এক বিশাল ঝামেলায় পড়ি। আবার আমার আগের জন গন্ডগোল শুরু করে। ভদ্রলোক দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছেন। উনি কয়েক ট্রলি ভরে প্রায় শ খানেক আইটেম নিয়ে এসেছেন। এত আইটেমের বিল করতে গিয়ে ক্যাশ কাউন্টারে গোলমাল লেগে যাচ্ছিলো। গোলমাল শেষে সব আইটেম ব্যাগে ভরা হলে ওনার ছেলেমেয়েদের আরও কিছু কেনাকাটা করার ইচ্ছা জাগে। তখন সব লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এরকম শ খানেক আইটেম বিল করার পর কেউ যদি বিল না দিয়ে আরও কেনাকাটা করতে যায় তখন মেজাজ খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক। ওনার এই শ খানেক আইটেমের পিছনে আমি মাত্র একটা খেলনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ওনার জন্য কিছুতেই আমার বিলটা হচ্ছে না। তারপর অনেক গ্যাঞ্জাম শেষে আমি কোনমতে বিল মিটিয়ে দিয়ে ছুটতে ছুটতে বের হয়ে আসি। বাইরে রুবাইদা আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। তারপর আমরা ছুটতে ছুটতে যেতে থাকি নিজাম’সের উদ্দেশ্যে। এর মধ্যে তমা আর ফাহাদের সাথে দেখা হয়। তখন আমার  মনে পড়ে যে বাদাম তেল কেনার কথা ছিলো, যেটা আমি বেমালুম ভুলে গেছি। তাড়াতাড়ি করে তমার হাতে রুপি গুঁজে দেই এক বোতল তেল কিনে আনার জন্য। তারপর ছুটতে ছুটতে গিয়ে হাজির হই ‘নিজাম’স’এ।

কমিটি থেকে আমাদের বলা হয় ২০০ রুপির মধ্যে খাবার অর্ডার করতে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে আমরা কেউই ২০০ রুপির অর্ডার দিতে পারলাম না। আমাদের টেবিলে আমি, রুবাইদা, নিশাত আর পৃথ্বী ছিলাম। আমরা হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি, কাবাব রোলস, কুলফি, ফিরনি আর কোল্ড ড্রিংক্স অর্ডার দিলাম। কিন্তু কোনভাবেই বিল ৮০০ রুপির উপরে গেলো না। হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির নাম করে যেটা আসলো সেটা বিরিয়ানিই বটে! এক প্লেট উঁচু করা বিরিয়ানি যার উপরটা কিশমিশ, বাদাম, মোরব্বা আর চেরি দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া। আমি জীবনেও বিরিয়ানিতে এরকম শুকনা ফলের ব্যবহার দেখি নাই। ভয়ে ভয়ে মুখে দিলাম, খেতে না জানি কেমন হয়! মুখে দিয়েই টের পেলাম- না ভুল হয় নাই। চমৎকার স্বাদযুক্ত খাবারই অর্ডার দিয়েছি। বিরিয়ানির সাথে কিশমিশ, মোরব্বা চিবিয়ে খেতে খেতে ভালোই লাগছিলো। কিন্তু পরিমানে এত বেশি ছিলো যে আমি প্রথমেই বুঝেছিলাম খেয়ে শেষ করা সম্ভব হবে না।

efws
শেষ ডিনারে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় মোজাম্মেল হক জাফর)

ওদিকে সবাই হৈচৈ হাহা হিহি করে সেলফি তুলতে লাগলো। জাফর জানালো যে ওকে আমাদের স্টুডিও টিচার বারবার ম্যাসেজ পাঠাচ্ছে সবাইকে নিয়ে ক্লাসে আসার জন্য। আমরা এইসব ব্যাপার নিয়ে প্রাণ খুলে হাসতে লাগলাম। ওদিকে আমাদের কাবাব রোল আর কুলফি চলে আসলো। প্রাণপণ খেয়েও বিরিয়ানি শেষ করতে পারলাম না। তখন মনে হলো রোল দুটো সাথে করে নিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। নিশাত আরও বুদ্ধি দিলো যে, সকালে তো আমরা নাশতা করার সুযোগ পাবো না- এই রোল দিয়েই আমাদের সকালের নাশতা হয়ে যাবে। আমরা রোল দুটোকে প্যাকেট করে দিতে বলে মনোযোগ দিলাম কুলফির উপর। মজা করে কুলফি খেতে খেতে আমরা আফসোস করছিলাম আমাদের ট্যুরটা সত্যি সত্যিই শেষ হয়ে গেলো এজন্য। যাই হোক সব খাওয়া দাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে আমরা বের হয়ে গেলাম ‘নিজামস’ থেকে।

অন্ধকার রাতে সোডিয়াম লাইটের আলোতে আমরা দল বেঁধে হাঁটতে লাগলাম। নিউ মার্কেটের অলিগলি পার হয়ে মির্জা গালিব স্ট্রিট দিয়ে হেঁটেহেঁটে হোটেলের দিকে আসতে লাগলাম। এর মধ্যেও ছোটখাটো মুদি দোকান পেলেই সবাই থেমে গিয়ে এটা সেটা কিনতে শুরু করে। এই করতে করতে আমাদের হোটেল যেতে যেতে বেশ সময় লাগছিলো। রাত হয়ে গেছে, মোটামুটি সব দোকাপাট বন্ধ। লোকজন কম, রাস্তাঘাট শুনশান। এর মধ্যে আমরা দল বেঁধে হেঁটে যেতে লাগলাম। সবার মনেই একটা হাহাকার- এই তো শেষ, এত স্বপ্নময়ী দিনগুলো একে একে সব ফুরিয়ে গেলো। এত অবাধ স্বাধীনতা, এত অনিশ্চয়তা, এত হাসি আনন্দের আজকেই রাতেই ইতি। কেউ কাউকে বলছিলো না কিন্তু একটা চাপা কষ্ট সবার বুকেই জমাট বেঁধে ছিলো।

হোটেলে পৌঁছে আমরা একে একে আমাদের জিনিসপত্র ফাইনালি গুছিয়ে নিলাম। সবারই অনেকগুলো করে ব্যাগ। সব মিলিয়ে আমার সাতটা ব্যাগ হলো। এর মধ্যে বড় ব্যাগ তিনটা আর ছোট ব্যাগ চারটা। ব্যাগগুলো দেখে ভয় লাগলেও মনে মনে ভাবলাম, একবার বাসে উঠাতে পারলেই তো আর চিন্তা নাই। কিন্তু তখন কি আর জানতাম, এই ব্যাগ নিয়ে কি ভোগান্তিটাই না হবে!

শেষবারের মতন আমরা ছোট বিছানাটায় পা ভাঁজ করে শুয়ে পড়লাম। উঠতে হবে গভীর রাতে। তাই বেশি কথাবার্তা না বলে আমরা ঘুমিয়ে গেলাম। গুডবাই কোলকাতা!