বান্ধবী রিন্তুর বিয়ে!
আরে, বেড়ানোর জন্য এর চেয়ে ভালো আর কোন উপলক্ষ লাগে নাকি?
খুশিতে ডগমগ করতে করতে ঠিক করতে লাগলাম সবকিছু। কিন্তু এখন তো আর আগের মতন নাই সব কিছু, স্টুডেন্ট লাইফ শেষ হওয়ার সাথে সাথে জীবনের রঙগুলো কেমন যেন ফিকে হয়ে যেতে থাকে। আগের উৎসাহ, চঞ্চলতা সব চাপা পড়ে যেতে থাকে চাকরি জীবনের নিচে। নানা ব্যস্ততা আর দুর্বোধ্য রকমের আলসেমি ভর করতে থাকে। মোটামুটি খোঁজ খবর নিতে লাগলাম। আমি, সারা, তানভীর, তমা আর সুমাইয়া যাবো- এতটুকুই ঠিক হলো শেষমেশ।
ময়মনসিংহ শহরটা তেমন কোন দূর দেশে অবস্থিত না। তাই তেমনভাবে চিন্তা ভাবনা কেউই করছিলাম না। তানভীর সার্কিট হাউজে থাকার ব্যবস্থা করবে আর ২১ তারিখ রওয়ানা দিবো বাসে করে- এছাড়া আর কোন কিছুই ঠিক হলো না। পরে সুমাইয়াকে আগের দিন অর্থাৎ ২০ তারিখ রাতে আমার বাসায় চলে আসতে বললাম। ঠিক ঠিক রাত সাড়ে আটটার সময় ও আমার বাসায় এসে হাজির হলো। এসেই জিজ্ঞেস করলো, আমরা কয়টায় বাসে উঠবো? আমিও একই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাচ্ছিলাম কিন্তু ম্যাসেঞ্জারে কেউই কোন সাড়া দিচ্ছিলো না। ওদিকে অবনী আমাদের সাথে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলো এবং মাইক্রোবাস ঠিক করার আশ্বাস দিলো। আমি তো খুশি হয়ে গেলাম! কিন্তু রাত ১২টার আগেই ঠিক হলো আমরা আগামীকাল সকালে না, যাবো দুপুরে। বরাবরের মতই বাসার সবাই হতাশা প্রকাশ করলো আমাদের আনপ্ল্যানড লাইফের প্রতি!
সকালে ঘুম থেকে উঠেই খবর পেলাম অবনী আমাদের সাথে যাবে না। যাই হোক আমি আর সুমাইয়া নাশ্তা করে তৈরি হতে লাগলাম। প্রায় পৌনে ১২টার দিকে আমরা উবারে গাড়ি ঠিক করে উঠে পড়লাম। গন্তব্য মহাখালী বাস টার্মিনাল। ২১শে ফেব্রুয়ারি- একদম ফাঁকা রাস্তা। ১০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম। আমি আর সুমাইয়া গিয়ে বসলাম এনার ওয়েটিং রুমে। অন্যদের খোঁজ খবর নিলাম। সারা আর তমা বের হয় নাই। তানভীর রাস্তায়। যাই হোক আমরা গল্প করতে লাগলাম। পুরো রুম ভর্তি মানুষ। সবাই ঢাকা ছেড়ে ময়মনসিংহ যাচ্ছে। প্রায় পৌনে ১টার দিকে আমি টিকেট কাটতে গেলাম। কোনদিন আমি এই রকম টিকেট কাটি নাই। তাই বেকুবের মতন বলে ফেললাম, দেড়টার বাসের টিকেট দিয়েন। কাউন্টারের লোকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। বললো আমাদের বাস তো টাইম মেনে ছাড়ে না। আমি আর কথা না বাড়িয়ে টিকেট নিয়ে চলে আসলাম। তারপর আমি আর সুমাইয়া টিকেট নিয়ে গবেষণা করতে লাগলাম যে কোন বাসে উঠবো এইটা বুঝবো কেমন করে? অনেক গবেষণা করে বের করলাম বাসের সিরিয়াল নম্বর ৫১। সুমাইয়া গিয়ে খোঁজ নিলো ৪৯ নম্বর পর্যন্ত বাস ছেড়েছে। এর পরের সিরিয়ালই ৫০ আর ৫১। সোয়া ১টার সময় আমি অন্যদের ফোন দিতে লাগলাম। তমা তখন রাস্তায় আর সারা আর তানভীর একটু পরেই এসে পৌঁছালো। দীর্ঘদিন পর ওদের সাথে দেখা, জড়িয়ে ধরলাম সারাকে। ওয়েটিং রুমে আমি ব্যাগপত্র নিয়ে বসলাম আর বাকি সবাই এদিক সেদিক ঘুরতে গেলো।
এরই মধ্যে চলে আসলো দুইটা বাস। লোকজন হুড়হুড় করে বাসে উঠতে লাগলো। ওরাও তাড়াতাড়ি ফেরত আসলো। আমরা ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ৫১ নম্বর বাসের সামনে। ওদিকে তমা আসে নাই। উঠবো কি উঠবো না- এই নিয়ে চিন্তা করছিলাম। কি ভেবে আমরা উঠেই পড়লাম। আমরা উঠে পড়ার ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে তমা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসে পৌঁছালো। একেবারে এক্সাক্ট টাইমে!
প্রায় পৌনে ২টার দিকে বাস ছেড়ে দিলো। বাসটা বেশ ভালো, সিটগুলো আরামদায়ক। আমি আর সুমাইয়া পাশাপাশি বসলাম। বকবক করে গল্প করতে লাগলাম দুইজনে। গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত বাস গেলো ঢিমে তালে। যেই না চৌরাস্তা পার হলো আর ওমনি ছুটতে লাগলো শাঁই শাঁই করে। এরই মধ্যে নাজনীন আপু ফোন দিলো, আমি রওয়ানা দিয়েছি কিনা জানতে। প্রায় রকেটের গতিতে কোন রকম ব্রেক ছাড়াই আমাদের বাস আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলো।
আমার সাথে কেক ছিলো। দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নাই। তারপরও কেন যেন কেকটার কথা মনে করতে করতে দেরি হয়ে গেলো। যখন আমরা কেকটা বের করে কামড় লাগাচ্ছিলাম, তখনই আমাদের বাস ধীরে ধীরে এসে থেমে গেলো। আমরা পৌঁছে গেছি, আর থামার সাথে সাথেই সবাই হুড়হুড় করে নেমে পড়লো। আমরা কেক চিবাতে চিবাতে সবার শেষে নামলাম। জায়গাটার নাম মাসকান্দা। আমরা একটা ইজি বাইক নিলাম। পাঁচ জনে চড়ে বসলাম তাতে। ইজিবাইকে উঠে জানতে পারলাম আমাদের সার্কিট হাউজ বুকিং বাতিল হয়ে গেছে। সারা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে পিডাব্লিউডির রেস্ট হাউসে। সেখানে আমরা থাকতে পারবো কিনা চেষ্টা করে দেখতে। আমরাও ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিলাম, আমরা যাবো আর কোন গন্ডোগোল হবেনা- এটা তো হতেই পারে না!
দীর্ঘদিন পর এরকম অনিশ্চিত একটা পরিস্থিতি আমাদের ইন্ডিয়া ট্যুরের পুরানো কথা মনে করিয়ে দেয়। কোন কারণ ছাড়াই আমরা ইজিবাইকে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকি। রেস্ট হাউসে এসে থামলে আমরা সারা আর তানভীরকে পাঠাই কথা বলতে যাওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ পর তানভীর হাসি হাসি মুখে জানালো এখানে কোন খালি জায়গা নাই। চারটা মোটে রুম, চারটাতেই লোক আছে। সারা কাকে কাকে যেন ফোন দিয়ে কপাল কুঁচকে হেঁটে হেঁটে আসতে লাগলো। ওর কথায় বুঝলাম, আমাদের এখানে থাকা হবে না। আবার আমরা চড়ে বসলাম ইজিবাইকে। বললাম কোন হোটেলে নিয়ে যেতে।
ইজিবাইকে থাকতে থাকতেই আমার মনে পড়লো স্যারের কথা। যা আছে কপালে ভেবে দিলাম স্যারকে ফোন। ফোন ধরলো নাজনীন আপু। আমি সবিস্তারে সব খুলে বললাম আর জানালাম স্যার কি আমাদের কোন জায়গায় রেফার করতে পারবেন কিনা। আপু একটু পরে জানাবেন বললেন। ওদিকে আমরা এসে পৌঁছালাম হোটেল মুস্তাফিজে। আবার আমরা সারা আর তানভীরকে পাঠালাম খোঁজ নিতে। ওরা ঘুরে এসে বললো বেশ ভালো হোটেল, দামটাও বে-শ ভালো। প্রতি রুম ৩০০০ টাকা। আমাদের দুই রুম লাগবে। এত টাকায় থাকা সম্ভব না। আমরা ইজিবাইকওয়ালাকে বললাম আরও একটু সস্তা হোটেলে নিয়ে যেতে। আবার চলতে শুরু করলো ইজিবাইক।
কেমন যেন পাইকারি বাজার বাজার টাইপের জায়গায় এসে আমাদের ইজি বাইক থামলো ‘হোটেল নিরালা’ নামের হোটেলের সামনে। আবার সারা আর তানভীর গেলো খোঁজ নিতে। আমি তাকিয়ে দেখতে লাগলাম জায়গাটার নাম ছোট বাজার আর চক বাজার। পুরাই ঢাকার চকবাজার টাইপের এলাকা। একটু পর ওরা জানালো রুমের অবস্থা বেশ ভালো। ১৫০০ টাকায় ডবল রুম আর সিঙ্গেল রুমও আছে। সব মিলিয়ে আমাদের খরচ কম হবে। আমরা ইজি বাইক ছেড়ে দিলাম ২০০ টাকা দিয়ে। লোকটা খুশি মনে চলে গেলো। আমরা রিসেপশনে গিয়ে বসলাম। তখনই মনে পড়লো স্যারকে ফোন দিয়ে জানাই যে হোটেল পেয়ে গেছি। আমি সাথে সাথে ফোন দিলাম। এবার ফোন স্যার ধরলেন। আমি জানালাম যে থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে ‘হোটেল নিরালা’তে। স্যার জিজ্ঞেস করলেন টাকা দিয়ে ফেলেছি কিনা, আমি বললাম এখনও দেওয়া হয় নাই। স্যার বললেন পাঁচ মিনিট ওয়েট করতে। আমি সবাইকে বললাম অপেক্ষা করতে। এর মধ্যে রিন্তু ফোন দিলো। পাগলের মতন ও জানতে চাইলো আমাদের কি অবস্থা। আমি ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম। ও আমাদের কথা শুনে পুরাই অস্থির হয়ে গেলো। একে ওকে ডেকে চিৎকার করে কি কি সব জিজ্ঞেস করতে লাগলো। ঐদিকে আমার ফোন বেজে উঠলো। স্যারের ফোন।
স্যার জানতে চাইলেন আমরা কয়জন, আমি জানালাম পাঁচ জন। স্যার বললেন, ‘পাঁচটাই কি মেয়ে?’। আমি জানালাম, ‘চারটা মেয়ে একটা ছেলে’। স্যার বললেন, ‘চারটা মেয়ে তোমাদের আপুর বাসায় আর ছেলেটা আমার সাথে আমার বাসায় থাকতে পারবে।‘ স্যার আরও ঠিকানা বলে দিলেন যে এখান থেকে আপুর বাসা খুব কাছে। আমি কানে ঠিকমত শুনতে পাচ্ছিলাম না তবুও বুঝলাম আকন্দ লাল বাড়ি। আমি ফোন রেখে সবাইকে জানালাম যে স্যারের শ্বশুর বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু স্যারের বাড়িতে থাকতে হবে শুনে তানভীর বেঁকে বসলো। ও কিছুতেই স্যারের বাড়ি যাবে না। আমরা বললাম ওকে আমাদের সাথে আকন্দ বাড়ি পর্যন্ত যেতে। পরে ওর ইচ্ছা হলে ও এই নিরালা হোটেলই থাকতে পারবে। তারপর আমরা হাঁটা শুরু করলাম রাস্তা ধরে।
এতক্ষণ তানভীরের মধ্যে কোন ভাবান্তর ছিলো না। হঠাৎ করেই ও বেশ অ্যাক্টিভ হয়ে পড়লো। এদিক সেদিক সমানে ফোন দিতে শুরু করলো। আমরা রাস্তা ধরে হেঁটে শেষ মাথায় পৌঁছালাম। তারপর লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে হাঁটছিলাম। আবার স্যারের ফোন। স্যার আরও কিছু ডিরেকশন দিলেন যার বেশির ভাগই আমি কানে শুনলাম না তবে শুনলাম ‘আঠারো বাড়ি লেন’ আর ‘নদী’ কথাটা। একটু অবাক হলাম, এদিকে তো কোথাও নদী নাই! প্রায় সাথে সাথেই দেখলাম একটা লন্ড্রির দোকানের নাম ‘নদীয়া’। আমরা তার উলটো পাশের গলি দিয়ে ঢুকে পড়লাম। সেই মুহুর্তে তানভীর জানালো ডিসি আংকেল ওকে বলেছে সার্কিট হাউজে গিয়ে ওকে সামনা সামনি কথা বলতে। আমরা বললাম বাড়িটা খুঁজে বের করা পর্যন্ত আমাদের সাথে থাকতে। একটা মুদি দোকানে আকন্দ লাল বাড়ি বলার সাথে সাথে তারা বললো আকন্দ লাল বাড়ি বলে কিছু নাই তবে আকন্দ লজ হচ্ছে উলটো পাশের বাড়িটা। ইয়া আল্লাহ, আমি এতক্ষণ আকন্দ লজকে আকন্দ লাল শুনেছি!
গেটের সামনে দাঁড়ালাম। বনেদি জমিদারি বাড়ি। ইতস্তত করে গেটে ধাক্কা দিলাম। গৃহকর্মী এসে গেট খুলে দিলেন। আমি নাজনীন আপুর নাম বলাতে চিনতে পারলো না, কিন্তু ঝুমি আপু বলার সাথে সাথেই উনি মাথা নেড়ে বললেন ‘হ্যাঁ, এটা ঝুমি আপুদের বাসা’। গেট দিয়ে ঢুকে আমরা হতবাক গয়ে গেলাম। কনক্রিটের ব্লক বিছানো বড় উঠান। তাতে আবার একটা ছোট আউট হাউজ। আর সামনে বিশাল বিশাল মোটা কলামওয়ালা জমিদার বাড়ি। আমরা হেঁটে হেঁটে ঢুকলাম। তানভীর আমাদের ছেড়ে গেলো সার্কিট হাউজে খবর নিতে। আমরা গুটি গুটি পায়ে বসার ঘরে এসে বসলাম। ভিতরে হাসি হাসি মুখে সাদা শাড়ি পরা দারুণ স্মার্ট এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছেন। আমি গিয়ে হড়বড় করে ওনার সামনে গিয়ে নিজের পরিচয় দিতে লাগলাম। উনি আমাদের সবাইকে বসতে বললেন। অল্প বিস্তর কথাবার্তা বললেন। তারপর সেই গৃহকর্মীকে দেকে বললেন আমাদের ওপরের তলার ঘর দেখিয়ে দিতে। আমি মহিলার পিছু পিছু গেলাম উপরের তলায়। যেতে যেতে আমি জানলাম এই বাসায় শুধুই স্যারের শাশুড়ি আর খালা শাশুড়ি থাকেন।
পুরোনো দিনের সিঁড়ি পার হয়ে দোতলায় উঠেই একটা চমৎকার টেরাস দেখতে পেলাম। টেরাসের পাশেই প্রায় ইন্টার কানেক্টেড দুইটা বেড রুম। মহিলা একটা একটা করে রুমের লাইট জ্বালাচ্ছিলেন। আর রুম দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাচ্ছিলো। ফেলুদা, কাকাবাবুরা বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গিয়ে যেসব বাড়িতে ওঠে, ঠিক সেই রকম ঘর একেকটা। ঝাঁ চকচকে রুম, নরম তুলতুলে বনেদি বিছানা- আর কি চাই! মানুষজন থাকে না, তাতেই এই রকম টিপটপ অবস্থা- লোকজন থাকলে না জানি কি হতো!
আমি আবার নিচে নেমে এসে বসার ঘরে ঢুকলাম। আমরা পড়ে গেলাম এক মহা ফ্যাসাদে। এদিকে রাজ বাড়িতে বসে আছি বাদশাহী আয়োজনে, অন্যদিকে তানভীর সার্কিট হাউজের খোঁজ নিতে গিয়ে কোন খবর দিচ্ছে না। আর রিন্তু ফোন দিচ্ছে, ওরও তো টেনশন আছে আবার হলুদের প্রোগ্রামও আছে। সেটার জন্যও আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিলাম। ঠিক করলাম তানভীর খবর পাঠানোর আগ পর্যন্ত আমরা এই বসার ঘরেই বসে থাকবো। যদি রুম পাওয়া যায় সার্কিট হাউজে তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ, আর যদি রুম পাওয়া না যায় তবে আমাদের এখানেই থাকা হবে- সেক্ষেত্রে তানভীরের জন্য কোন একটা ব্যবস্থা করতে হবে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, তানভীর ফোন দিয়ে জানালো সার্কিট হাউসে থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আমরা খবরটা শুনে খুশি হলাম।
আমি নাজনীন আপুকে ফোন দিলাম। খুলে বললাম সব কথা। আপু বললেন আমাদের ফ্রেশ হয়ে চা নাশ্তা খেয়ে ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে। এখানে থাকলেও আমাদের কোন অসুবিধা হবে না এ কথা বারবার বলে দিলেন। আমি অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বলে দিলাম যে, ব্যবস্থা যখন হয়েছে তখন কোন ঝামেলা না করে আমরা সার্কিট হাউজেই চলে যাবো। তারপর আবার বসার ঘরে এসে বসলাম। আমাদের জন্য চা, শিঙ্গাড়া আর বিস্কুট আসলো। স্যারের শাশুড়ি আর খালা শাশুড়ি আমাদের সাথে অনেক গল্প করলেন। আমরাও খোশমেজাজে ওনাদের সাথে গল্পগুজব করছিলাম। ওদিক থেকে তানভীর ফোন দিতে লাগলো, আমরা কেন আসছি না সার্কিট হাউসে। আমরা উঠে বিদায় নিতে যাবো এমন সময় নাজনীন আপু আবার ফোন দিলেন, আমরা কি সিদ্ধান্ত নিলাম সেটা জানতে। আমি আবারও ধন্যবাদ জানিয়ে জানিয়ে দিলাম যে আমরা এখনই সার্কিট হাউসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাচ্ছি।
আকন্দ লজ থেকে বের হয়েই আমরা পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলাম। একটা ইজি বাইক খুঁজতে খুঁজতে প্রায় সেই নিরালা হোটেল পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। শেষমেশ আমরা রিকশা নিলাম। আমি আর তমা উঠলাম এক রিকশায়। ভাড়া দরদাম করে ঠিক করলাম ২০টাকা। মোটর বসানো রিকশা আমাদের নিয়ে ছুটতে লাগলো রকেটের বেগে। চিপাচাপা অলিগলি পার হয়ে আমরা যেতে লাগলাম সার্কিট হাউসের পথে। কিন্তু পথ তো আর শেষ হয় না। তমা তো সন্দেহ করেই বসলো ভাড়া ২০টাকা নাকি ১২০টাকা! অনেক পথ পাড়ি দিয়ে হঠাৎ এক জায়গায় তীর চিহ্ন সহ ‘সার্কিট হাউজ’ লিখা সাইনবোর্ড দেখে আমরা বুঝতে পারলাম যে ঠিক জায়গায় এসেছি। কিন্তু আশ্চর্য, রিকশাওয়ালা আমাদের সেদিকে না নিয়ে অন্যদিকে নিয়ে গেলো। আমি আর তমা চিৎকার করে বললাম ডানদিকে যেতে কিন্তু রিকশাওয়ালা আমাদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আত্মবিশ্বাসের সাথে নিয়ে গেলো একটা পার্কের গেটে। তারপর বললো যে সার্কিট হাউজ বলে সবাই এখানেই আসে। আমার ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো। তারপর অন্যদের কাছে জিজ্ঞেস করে রিকশাওয়ালা আমাদের সার্কিট হাউজেই নামিয়ে দিলো। আমরা ২০টাকা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সার্কিট হাউসে ঢুকে পড়লাম। আমাদের দেখেই কেয়ার টেকার ছুটে আসলো। তানভীরের নাম বলতে ওনারা আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেলো ভিআইপি একটা রুমের সামনে। পাশের রুম থেকে তানভীর বের হয়ে আসলো। ওদিকে সুমাইয়া আর সারাও এসে পৌঁছে গেছে। আমরা ঢুকলাম আমাদের রুমে যার নাম পলাশ।
এও একটা মিনি বাদশাহী ব্যাপার। এলইডি টিভি, গদি আঁটা সোফা, লম্বা ড্রেসিং টেবিল, ডবল বেড, সিঙ্গেল বেড- কি নাই! দশ ফিট লম্বা বিশাল বিশাল সব জানালা ভারী ভারী পর্দা দিয়ে ঢাকা। ঝকঝকে বিশাল বাথরুম- সবকিছুর মধ্যেই অভিজাত ভাব। আমরা ব্যাগটা রেখেই শরীর এলিয়ে দিলাম বিছানায়। আমি ঘড়ি দেখলাম, সাড়ে সাতটা বাজে। কতকিছু হয়ে গেলো গত আড়াই ঘন্টায়! নিজেরাই ঠিক করলাম, যেভাবেই হোক আধা ঘন্টার মধ্যে রেডি হয়ে বের হতে হবে।
খুবই আশ্চর্যজনকভাবে আমরা আধা ঘন্টার মধ্যেই হাতমুখ ধুয়ে, ইস্ত্রি করা শাড়ি পরে (সুমাইয়ার ইস্ত্রির জন্য অনেক কৃতজ্ঞতা) পরিপাটি করে তৈরি হয়ে নিলাম। ঠিক ঠিক আটটা বাজে। আমি বের হয়ে তানভীরের দরজায় ধাক্কা দিলাম। তানভীর বের হয়ে আসলো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম ও তৈরি কিনা। আমাকে ও জানালো দুই মিনিট সময় লাগবে। আমি অবাক হয়ে গেলাম, আমরা আধা ঘন্টায় সবাই হুলুস্থুল করে রেডি হয়ে গেলাম, আর ও কি করলো এতক্ষণ ধরে?
কি আর করা, আমরা শাড়ি পরা চারজন সার্কিট হাউজের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। ভীষণ সুন্দর এই সার্কিট হাউজ। লাল রঙের কলোনিয়াল বিল্ডিং। সারি সারি সব ভিআইপি রুম। কেমন যেন একটা রাজসিক ব্যাপার স্যাপার। তানভীর পাঞ্জাবী পরে বের হয়ে এলে আমরা বের হয়ে গেলাম সার্কিট হাউস থেকে। রাতের অন্ধকারে দেখা যাচ্ছিলো না ঠিকমত তবে বুঝতে পারলাম সার্কিট হাউসের সামনে আছে বিশাল মাঠ। এলাকাটা শুনশান নিরব। কোন মানুষজন নাই। আমরা হাঁটতে লাগলাম পার্কের দিকের রাস্তা ধরে। অন্ধকার রাস্তায় পেয়ে গেলাম একটা ইজিবাইক। রওয়ানা দিলাম সানকিপাড়া, হেলথ কমপ্লেক্সের গলি। নানা অলিগলি আর রেলক্রসিং পেরিয়ে আমরা ছুটতে লাগলাম। আর ভাবতে লাগলাম, অনুষ্ঠান কি আছে নাকি শেষ!
রিন্তুর বাসায় নেমে আমরা সোজা তিনতলায় উঠে গেলাম। ড্রইং রুমে সব মুরুব্বিদের পার হয়ে ভিতরে ঢুকে দেখি একটা দুইটা না, অনেকগুলো রিন্তু! ওদের বাসার সবার চেহারা একরকম। আমরা অনেক খুঁজে বের করলাম আমাদের রিন্তুকে। ওকে চেয়ারে বসিয়ে পৃথ্বী আরও কয়েকজনকে নিয়ে ফিনিশিং মেকাপ দিচ্ছে। চোখে বিশাল বিশাল আইল্যাশ লাগিয়ে ও তখন চোখ প্রায় খুলতেই পারছে না। চোখ পিটপিট করেই আমাদের সাথে কথা বললো। আমি আর সারা ওর হলুদের গয়নার ডালা থেকে দুইটা গয়না তুলে নিলাম। আমি মাথায় পরলাম আর সারা হাতে পরলো। বাসার সবাই তাড়াহুড়া করে রিন্তুকে নিয়ে ছাদে যাওয়ার আয়োজন করতে লাগলো। সেখানেই অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে। অনুষ্ঠান শুরু করতে দেরি হচ্ছে দেখে সবাই অস্থির হয়ে উঠছে।
আমি ছাদে উঠে এলাম। একপাশে প্যান্ডেল টানিয়ে বসার আয়োজন করা হয়েছে। অন্যপাশের ছাদ খালি। আমি সেই ছাদেই চলে এলাম। আজকে বিকাল পাঁচটার পর থেকে আমাকে বাসা থেকে নানা মানুষ ফোন করেছে। প্রতিবারই হু হা করে ফোন রেখে দিয়েছি। কোনটা ধরতেও পারি নাই। এখন ঠান্ডা মাথায় আম্মুকে ফোন দিলাম। সব খুলে বলতে বলতে অনেক সময় লেগে গেলো। তারপর ফোন রেখে গেলাম হলুদের আয়োজনে। রিন্তু পরীর মতন স্টেজে বসে আছে। আর সবাই বেশ হাসিখুশি পরিবেশে ওকে হলুদ দিয়ে যাচ্ছে। আমরাও মজা করছিলাম। এরমধ্যে স্যার আমাকে আরেকবার ফোন দিলেন, আমরা ঠিকমত আছি কিনা জানতে।
ব্যাপক হিন্দি গান শুনে ভরপেট খাওয়া দাওয়া করে রিন্তুর সাথে ছবিটবি তুলে সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমরা বের হয়ে আসলাম রাত ১১টার দিকে। নিচে নেমে দেখি তানভীর ইতোমধ্যে ইজিবাইক ঠিক করে ফেলেছে। আমরা হুউশ করে খালি রাস্তা দিয়ে চলে আসলাম আমাদের সার্কিট হাউজে। এবার রুমে ঢুকে আমরা ফ্ল্যাট। সারাদিনের ক্লান্তি যেন হঠাৎ করেই টের পেলাম। শাড়ি বদলে ফ্রেশ হয়ে সবাই গল্পগুজবের মুডে বসলাম। কতদিন পর এরকম একটা রাত, পূর্ণোদ্যোমে আড্ডাবাজীতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সবাই। ম্যাসেঞ্জারে নিশাত আমাদের সাথে সুদূর আমেরিকা থেকে যোগ দিলো। প্রাণ খুলে হাসলাম সবাই। রাত দুটো বাজলে আড্ডায় ছেদ পড়ে। আমরাও যার যার শোবার জায়গা গোছাতে থাকি। আমি আর সারা থাকবো সিঙ্গেল বেডে আর তমা আর সুমাইয়া থাকবে ডবল বেডে। ফ্যান চালিয়ে, লেপ নিয়ে, লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ি। কিন্তু কথা তো আর থামে না। আমি আর সারা দুনিয়ার বিষয় নিয়ে গল্প করতে থাকি। আমি আবার চা খেয়েছিলাম, তাই ঘুমঘুমভাবটা যেন উধাও হয়ে গিয়েছিলো। কত রাত পর্যন্ত গল্প করেছি বলতে পারবো না। একসময় সারা ঘুমিয়ে পরে, আমিও বোধহয় ঘুমিয়ে পড়ি।
আমাদের ভোর সাতটায় উঠে নদীর তীরে হাঁটার কথা ছিলো। কিন্তু ঘুম ভাঙ্গলো দশটার দিকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমরা হাসতে লাগলাম। আমি বললাম, তানভীর নিশ্চয়ই ভোরে উঠে এতক্ষণে বুকডন সেরে ফেলে নদীর তীরে জগিং করতে গেছে। আমরা ঝটপট রেডি হয়ে বের হয়ে গেলাম রুম থেকে। তানভীরের দরজা নক করতে লাগলাম। কোন সাড়া শব্দ নেই। সারা দিলো ফোন। ও দরজা ফাঁক করে একটু মাথাটা বের করে বললো আমার একটু সময় লাগবে, দশ মিনিট কিংবা তারও বেশি। আমরা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। এতক্ষণে ওর ঘুম ভেঙ্গেছে শুধু!
কি আর করা, আমরা পুরা সার্কিট হাউজটা ঘুরে দেখতে লাগলাম। ছাদে উঠলাম। ছবি তুললাম এবং হাহা হিহি করতেই লাগলাম। ওদিকে তানভীর পাঞ্জাবী পরে রুম থেকে বের হলো। আমরা জানালাম যে, এখন পাঞ্জাবী না পরলেও হয় কারণ আমর যাচ্ছি নাশ্তা খেতে। একটু পর তানভীর রেডি হলে আমরা সবাই মিলে বের হয়ে পড়লাম। নদীর দিকে আমরা হাঁটতে লাগলাম। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে সারিন্দা নামের একটা দোকানে ঢুকলাম। কিন্তু এখানে খালি ফাস্টফুড। তারপর আমরা রিকশা নিয়ে গেলাম টাউন হল মোড়ে। সেখানে একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হোটেলে দেখলাম পরোটা ভাজা হচ্ছে। আমরা সবাই ঢুকে পড়লাম সেই হোটেলে।
অর্ডার দিলাম পরোটা, ডাল ভাজি আর ডিম ভাজা। খুব সুন্দর ছোট ছোট সাইজের ভাঁজওয়ালা পরোটা চলে আসলো। ডাল ভাজি আর ডিম ভাজা দিয়ে খেতে বেশ মজা লাগছিলো। নানা গল্পগুজব আর হাহা হিহি করতে করতে আমরা নাশ্তা পর্ব শেষ করলাম। সবশেষে ওরা সবাই চা খেলো আর সুমাইয়া আমাদের ১৯২টাকা বিল দিয়ে দিলো। আমরা বের হয়ে আসলাম। এখন আমরা রাস্তাঘাট কিছুটা ধরতে পেরেছি। হেঁটে হেঁটেই সার্কিট হাউজের দিকে যেতে লাগলাম আমরা।
রাতের বেলা যে মাঠ দেখেছিলাম দিনের বেলা দেখলাম সেটা আসলে বি-শা-ল। মাঠ পার হয়ে যেতে যেতে আমরা আইস্ক্রিম কিনে খেলাম। সার্কিট হাউজের রাস্তা ছেড়ে আমরা নদীর দিকে এগিয়ে গেলাম। নদীর পার ধরে হাঁটতে লাগলাম। ব্রহ্মপুত্র নদ যথেষ্ট সরু। তারপরও এপার ওপার পারাপারের জন্য প্রচুর নৌকা আছে। আমরা ঠিক করলাম বিকাল বেলা এসে নৌকায় চড়বো। দেখলাম নদীতীরে একটা বানিজ্য মেলাও হচ্ছে। আমাদের হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছিলো। কিন্তু তমা বারবার তাগাদা দিচ্ছিলো ফিরে যাওয়ার জন্য। গোসল করে ফ্রেশ হয়ে রেডি হতে সময় তো লাগবে। আমরা সুমাইয়া আর তমাকে পাঠিয়ে দিলাম, ওরা গোসল করতে থাকুক ততক্ষণে আমরা একটু ঘুরি।
আমি আর সারা পা ডুবিয়ে হাঁটতে লাগলাম নদীর পানিতে। ঠান্ডা পানি, প্রচুর শামুক আর ঝিনুক দেখা যাচ্ছে। অনেকদূর হেঁটে আমরা একটা নৌকায় উঠে পড়লাম। ৬০টাকায় পার হবো ঠিক হলো। মনে হলো যেন পাঁচ মিনিটও লাগলো না। ওপারে নৌকা থেকে নেমে একটা ভাঙ্গা নৌকাকে দেখলাম। তানভীর এটাকে ‘ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রতিভূ’ বলে আখ্যা দিলো। আমরা ব্যাপক হাসতে লাগলাম। নদীর এপারে আসলে কিছুই নাই। কয়েকটা ফুচকার দোকান ছাড়া বাকি পুরাটাই গ্রাম। হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা ইস্কন মন্দির পেলাম। আমরা ঘুরে ঘুরে মন্দির দেখলাম। ঘড়িতে দেখলাম প্রায় একটা বাজে বাজে অবস্থা। আমরা তাড়াতাড়ি নেমে নৌকা নিলাম। এপারে এসে পানিতে পা ভিজিয়ে নিলাম। তারপর হাঁটা শুরু করলাম সার্কিট হাউজের দিকে।
সুমাইয়া আর তমা গোসল করে ফেলেছে। এবার দুই বাথরুমে আমি আর সারা ঢুকলাম। সারা আবার কাপড় ধুয়ে ছাদে মেলে দিয়ে আসলো। গোসল শেষ করে যথারীতি শাড়ি পরে তৈরি হতে হতে দুইটা বেজে গেলো। আমরা আবার হেঁটে হেঁটে আগের রাস্তায় গেলাম। সেখানে গিয়ে রিকশা নিলাম। এবার আমি আর সারা এক রিকশায়। কোন রিকশাওয়ালাই রাস্তা চিনে না। আমরাই আশ্বাস দিলাম যে কাচারি রোডে গেলে অনুভব কমিউনিটি সেন্টার খুঁজে নিতে পারবো!
কোনরকম ঝামেলা ছাড়াই খুঁজে পেলাম জায়গাটা। ভিতরে ঢুকেই সবার আগে রিন্তুর সাথে দেখা করলাম। লাল টুকটুকে বউ সেজে বসে আছে ও। কিছুক্ষণ ছবিটবি তুলে সোজা খেতে বসে পড়লাম। মজা করে খাওয়াদাওয়া শেষ করে আয়েশ করে গল্প করছিলাম। ওদিকে অবনী ঢাকা থেকে এসে ময়মনসিংহে এসে পৌঁছেছে। তানভীর গেছে ওকে নিয়ে সার্কিট হাউস। সাড়ে তিনটার দিকে স্যার, নাজনীন আপু ওনাদের দুই মেয়েসহ এসে পৌঁছালেন। আমি গিয়ে কথা বললাম। স্যারও ওনার পরিচিত লোকজন পেয়ে গেছেন। ওদিকে বর আসার সাথে সাথে হুলুস্থুল অবস্থা হয়ে গেলো। পরে সব কিছু ঠান্ডা হলে আমরা সবাই মিলে অনেকক্ষণ গল্পগুজব করলাম। এক পর্যায়ে স্যার বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আর ওদিকে চেয়ার টেনে গাছ তলায় বসে আইস্ক্রিম খেলাম আমরা সবাই মিলে। রিন্তুর বিয়ে পড়াতে আরও দেরি আছে দেখে আমরা ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। এবার গন্তব্য পৃথ্বীর বাসা।
পৃথ্বীর বাসা খুঁজে পেতে কোন সমস্যা হলো না। ওর বাসার বসার ঘরে আমরা আয়েশ করে বসে পড়লাম। আন্টি একটু পরপর আমাদের খাবার দিতে লাগলেন। প্রথম দফায় হরেক রকমের ফল। দ্বিতীয় দফায় বিভিন্ন রকমের চকোলেট। তৃতীয় দফায় ভাজা পোড়া আইটেম আর কোক। আর সবশেষে চতুর্থ দফায় খাসীর বিরিয়ানি। ভরা পেটেই আমরা সব কপকপ করে খাচ্ছিলাম। আমাদের অনেক প্ল্যান ছিলো বিকাল সন্ধ্যায় এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করার। কিন্তু টানা জম্পেশ আড্ডা আর বিরতিহীন খাবারের সাল্পাই পেয়ে আমাদের আর কোথাও যাওয়া হলো না। সবশেষে আমরা যখন পৃথ্বীর বাসা থেকে বের হই তখন রাত সাড়ে দশটা বাজে।
সার্কিট হাউসে পৌঁছেই আগে খবর নিলাম ছাদ খোলা কিনা! কারণ সারার জামা কাপড় তো ছাদেই রয়ে গেছে। খোলা আছে শুনে আমি আর সারা টপটপ করে চলে গেলাম ছাদে। একটু ঘোরাঘুরি করে ফিরে আসলাম আমাদের রুমে। বিছানায় আআগের মত হাত পা এলিয়ে দিলাম। কোনমতে দাঁত মেজে নিয়ে কম্বলের তলায় ঢুকে পড়লাম। এবার ঐ বিছানায় শুলো তিনজন, তমা, সুমাইয়া আর অবনী। ক্লান্ত ছিলাম বলেই হয়তো গল্প খুব জমলো না। ঘুমিয়ে পড়লাম অল্প সময়েই।
ঘুম ভাংলো সোয়া আটটায়। উঠেই আমি প্রথমে সুমাইয়াকে বললাম তানভীরকে নক করতে। না হলে আজকেও দেরি হবে। আমরা ফ্রেশ হতে হতেই খবর পেলাম রুম ছেড়ে দিতে হবে। ঝটপট মালপত্র গুছিয়ে আমরা বের হয়ে পড়লাম রুম থেকে। ব্যগগুলো কর্মচারিদের হাতে জমা দিলাম। তারপর বের হয়ে পড়লাম সার্কিট হাউজ থেকে। সামনের মাঠটা ক্রস করে হাঁটতে হাঁটতে আগের ঘুটঘুটে অন্ধকার হোটেলের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। শুক্রবার ছুটির দিন বলেই হয় তো মাঠে প্রচুর ভীড়। নানা রকম প্র্যাকটিস আর ওয়ার্মিং আপ হচ্ছে সেখানে। অনেকগুলো স্পোর্টিং ক্লাব পার হয়ে আগের সেই হোটেলের সামনে এসে পড়লাম। এবার গেলাম রাস্তার উল্টাপাশের হোটেলে। এইটা আগেরটার চাইতে একটু দামী। যাই হোক সেই পরোটা, ডাল, ভাজি আর ডিম ভাজা অর্ডার করলাম। খেতে ভালোই ছিলো। মেশিন মেড চা খেয়ে বিল দিয়ে সবাই বের হয়ে পড়লাম।
যাবো শশীলজ। কিন্তু কোন রিকশাই চিনে না। তারপর আমরা হাঁটা শুরু করলাম। হেঁটেই চলে গেলাম শশী লজ। গেট দিয়ে গট গট করে ঢুকে পড়লাম ভিতরে। আমাদের সাথে একটা বিয়ের কনেও ঢুকলো। মনে হয় ফটোসেশন করতে এসেছে! আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বিরাট জমিদার বাড়ি। ভেতরে অবশ্য প্রবেশ নিষেধ, তবুও বাইরেই ঘুরে ঘুরে সবটা দেখতে আমাদের অনেকক্ষণ সময় লেগে গেলো। শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে আমরা অনেক ছবি তুললাম। তারপর অনেকক্ষণ গল্প করে বের হয়ে পড়লাম। এবার যাবো জয়নুল গ্যালারি।
রিকশা নিলাম আমি আর সুমাইয়া। নদীর তীরে জয়নুল গ্যালারিতে পৌঁছে দেখলাম শুক্রবার গ্যালারি খুলবে তিনটার দিকে। এখন ভিতরে ঢুকার কোন উপায় নেই। কি আর করা, মনের দুঃখে আইস্ক্রিম চিবাতে চিবাতে চলে গেলাম নদীর তীরে। কিছুদূর হাঁটাহাঁটি করে নৌকা ভাড়া করলাম। নৌকা আমাদের নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ নদীতে ঘুরে বেড়ালো। পরে নৌকা থেকে নেমে আমরা হেঁটেই চলে গেলাম সার্কিট হাউস। তানভীর জুম্মার নামাজ পড়তে গেলো আর আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম।
এক পর্যায়ে আমি আর অবনী আগেভাগে বের হয়ে পড়লাম টিকেট কাটার উদ্দেশ্যে। রিকশা না পেয়ে হাঁটতে লাগলাম অনেকক্ষণ ধরে। পরে রিকশা নিয়ে ছুটতে লাগলাম মাস্কান্দার দিকে। আমরা পৌঁছানোর সাথে সাথেই দেখি অন্যরা পৌঁছে গেছে। সারা দাঁড়িয়ে পড়লো টিকেটের লাইনে। অল্প সময়ের মধ্যেই এনার টিকেট পেয়ে গেলাম। ঝটপট উঠে পড়লাম আমরা বাসে। আড়াইটা বাজতে না বাজতেই বাস ছেড়ে দিলো। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম শহরটাকে। এই রকম ঝটিকা সফরে দুই দিনের জন্য হলেও ফিরে গিয়েছিলাম আগের সেই জীবনে। কি চমৎকারই না কাটলো দুইটা দিন। মনের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো। কেন বের হলো কে জানে?
রিন্তুর বিয়ে টা যদিও মিস হইসে বাট তোর লেখা টা পড়ে ঘরে বসেই ভারচুয়ালি বিয়ের মজা নিতে পারলাম!! অসাধারণ হইসে ম্যান! hats off dosto