ইন্ডিয়া-পাকিস্তান এবং আমার বাংলাদেশ

ক্লাশ নাইনে পড়ার সময় একদিনের ঘটনা। ইংরেজী টিচার জান্নাতুল ফেরদৌস শীলা আপার বাসায় পড়তে গিয়েছি। তখন চলছিলো বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ঠিক আগের মুহূর্ত। টিভিতে কোন দলের প্র্যাক্টিস ম্যাচ চলছিলো। খুব সম্ভবত ভারতের কোন খেলা। ভারত সমর্থকরা খুব উত্তেজিত। চার কিংবা ছয় হলেই  অনেকে দৌড়িয়ে পাশের রুমে টিভি দেখতে চলে যাচ্ছিল আর অ্যান্টি ভারত সমর্থকরা টিটকারি দিচ্ছিলো সমানে। এক পর্যায়ে এক মেয়ে টিচারকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপা, আপনি কোন দল, ইন্ডিয়া না পাকিস্তান?’ আপা একটু হেসে বললেন, ‘আমি ইন্ডিয়া পাকিস্তান কোন দলকেই সাপোর্ট দেই না। আসলে আমার নিজের দেশ এত ভালো খেলছে যে অন্য কোন দেশ সাপোর্ট দেওয়ার দরকারই পড়ে না।’ উত্তর শুনে মেয়েটি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। আপা মেয়েটিকে আরও বললেন, ‘তোমরা তো হিসাব বুঝো না। হিসাব করে দেখ, কয়দিন আগে প্র্যাক্টিস ম্যাচে আমরা নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছি। আর নিউজিল্যান্ড কয়েকদিন আগে হারিয়েছে অস্ট্রেলিয়াকে। সেই হিসাবে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের এক নম্বর দল। ‘ আপার কথাগুলো আমার মনে ধরলো। আরে তাই তো, বাংলাদেশ থাকতে অন্য দেশ সাপোর্ট দেওয়ার কি দরকার?

এবার আরও কয়েক বছর আগে ফিরে যাই। ‘৯৯ সালে আমি ক্লাশ টুতে পড়তাম। তখন যে দলটাকে দেখে আমি ক্রিকেট খেলা বুঝতে শিখেছিলাম সেটা হচ্ছে পাকিস্তান। বিশ্বকাপের সময় সাঈদ আনোয়ারের মারমার ব্যাটিং , শোয়েব আখতারের ১০০মাইল বেগে বোলিং, সাকলায়েন মুস্তাকের স্পিন, মঈন খানের ধ্বংসাত্মক ব্যাটিং দেখে আমি তখন পাকিস্তান দলের বিশাল ফ্যান। ধীরে ধীরে আমি ক্রিকেট খেলাটা আরও ভালো করে বুঝতে লাগলাম। খেলা ছাড়াও অন্য কিছু ব্যাপারও বুঝতে শুরু করলাম। অবস্থা এমন হলো যে পাকিস্তান দলকে আর পছন্দের তালিকায় রাখতে পারলাম না।

বাংলাদেশ বাদে সমর্থন তো একটা বড় দলকে দিতে হবে। পাকিস্তানের সবচেয়ে উপযুক্ত বিকল্প হচ্ছে ইন্ডিয়া। কিন্তু ইন্ডিয়া দলটাকে আমি কোনভাবেই পছন্দ করতে পারলাম না। হয়তো তাদের ‘নাক উঁচা’ স্বভাবের জন্যই শচীন, শেবাগের মত ‘আগুনের গোলা’ থাকা সত্ত্বেও আমি কিছুতেই তাদের সমর্থন দিতে পারতাম না। আমি মহা মুশকিলে পড়ে যাই। সবাই জিজ্ঞেস করে ‘কোন দল-ইন্ডিয়া না পাকিস্তান?’ আমি কোন জবাব দিতে পারি না। সবাই এমনভাবে তাকায় যেন আমি নাদান শিশু, ক্রিকেটের কিছুই বুঝি না।

শীলা আপার কথায় আমার চিন্তা ভাবনা পালটে যায়। সত্যিই তো, বাংলাদেশ থাকতে আমি ইন্ডিয়া-পাকিস্তান বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলবো কেন? আমার ফেভারিট দল থাকবে একটাই, আর সেটা হবে বাংলাদেশ।আমি সাপোর্ট দিবো আমার নিজের দেশ বাংলাদেশকে। আমি বাংলাদেশের জন্য পতাকা কিনে ছাদে উড়াবো, বাংলাদেশের জন্য লাল সবুজ রঙ মাখবো, বাংলাদেশ জিতলে চিৎকার করে গলার রগ ছিড়ে ফেলবো, বাংলাদেশ হারলে মন খারাপ করবো (কিন্তু গালাগালি করে চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করবো না)। বাংলাদেশ থাকলে আমি থাকবো, বাংলাদেশ না থাকলে আমি সমর্থক হবো না, হবো স্রেফ দর্শক।

অন্য দেশের পতাকা নিয়ে, তাদের সমর্থন দিয়ে শুনতে হয় ‘বাংলাদেশের বোলিং লাইন আপ সাধারণ’ বা ‘বাংলাদেশ হচ্ছে তেলাপোকার মতন’ এই জাতীয় কথা। আমার তাই কি দরকার তাদের সমর্থন দেওয়ার? একদিকে সমর্থনও দিবো অন্য দিকে তারা আমার দেশকে অপমান করবে সেটা মুখ বুজে সহ্য করবো, এত ধৈর্য্য আমার নাই। আমি সমর্থন দিবো আমার পাশের শহরে বেড়ে ওঠা ২০-২২ বছরের ছোটখাটো লিকলিকে কোন তরুনকে যে প্রায় দ্বিগুণ বয়সী এবং দ্বিগুন অভিজ্ঞ বিদেশি কোন খেলোয়াড়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। আমার প্রিয় খেলোয়াড় অবশ্যই এমন হবে না যার দলের জন্য মাঠে পতাকা নিয়ে সমর্থন দেওয়ার পরও শুনতে হবে, ‘আমরা যেন বাংলাদেশের সমর্থকদের মত না হই’। আমি সাপোর্টার আমার নিজের দেশের। জিতলেও এটা আমার দেশ, হারলেও এটা আমারই দেশ।

গতকালের ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ম্যাচ আমার কাছে তাই বিশেষ কিছু ছিলো না। এই ম্যাচ নিয়ে আমি আনন্দ-দুঃখ কোনটাই অনুভব করি নাই (অবশ্য পাকিস্তানের ব্যাটিং দেখে বিরক্ত লেগেছিলো)। আমার চিন্তা আমার দল নিয়ে, যারা এখন অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আর চিন্তা করবো নাই বা কেন? আমার যে একটাই দল।

4 Replies to “ইন্ডিয়া-পাকিস্তান এবং আমার বাংলাদেশ”

  1. সোজা কথা হচ্ছে – বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সাপোর্টার আমি, বাংলাদেশের বিকল্প কোন দল নাই যে বাংলাদেশ আউট হয়ে গেলে আরেকটাকে আঁকড়ে ধরব। বাংলাদেশ বাংলাদেশই। বাংলাদেশ নাই তো আমার বিশ্বকাপের অন্যান্য দল নিয়ে কোন আগ্রহও নাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *