‘স্কাল্পচার সেন্টার’ – যা মনে প্রশ্ন জাগায় হোয়াট ইজ আর্কিটেকচার???

যে দিন আমরা ‘স্বরচিত সেবতী’ নামক বাড়িটার উপর রিপোর্ট করে প্রথম দফা জমা দিলাম, সেই দিনই নতুন প্রজেক্ট ঘোষণা করা হলো, ‘স্কাল্পচার সেন্টার’ যার সাইট ধানমন্ডিতে। পরদিন হরতালের মধ্যে পড়িমড়ি করে ছুটে গেলাম সাইট দেখতে। সেই থেকে শুরু হলো আমার স্কাল্পচার সেন্টারের পথ চলা। শুরুতেই স্টুডিওতে রিয়াদ স্যারের স্বপ্নময়ী আইডিয়া শুনে পুরা মাথাটা আউলে গেলো। যেই ফর্ম চিন্তা করি, সেটাই অর্ডিনারি মনে হয়। অনেক কষ্টে কাবজাব ওয়ালা একটি চোঙ্গা সদৃশ ফর্ম নিয়ে হাজির হলাম। স্যারের কথায় সেই ফর্ম ঝড়ো হাওয়ার মতই উড়ে গেলো। আবার শূন্য অবস্থায় ফেরত আসলাম। তারপর যেই ফর্ম বানালাম, সেটা দেখে আশেপাশে সবাই বললো, ‘স্মৃতি সৌধ থেকে ইন্সপিরেশন নিয়েছো বুঝি?’ যা হোক মোটামুটি নিজের সেই ফর্মটা নিজের কাছে ভালোই লাগে। এরপর পরের স্টেপ ফাংশন সলভ করতে শুরু করলাম। শুরু করতে গিয়েই বুঝলাম এই ফর্মে আদৌ ফাংশন ঢুকানো সম্ভব না। তবুও পড়ে রইলাম সেই ফর্ম নিয়ে, কিছু একটা করেই ছাড়বো। এইভাবে কেটে গেলো প্রায় দুই সপ্তাহ। শূন্য এক ফর্ম নিয়ে পাগল পাগল হয়ে ঘুরি, সমাধান পাই না, আইডিয়া পাই না..
তারপর একদিন স্টুডিওতে আসলেন শাহেদা ম্যাডাম। ম্যাডাম এসে এমন এক লেকচার দিলেন, যা শুনে আমি ডিসাইড করি, অনেক হয়েছে আর না। নতুন ফর্ম চাই, তবে আগের চাইতে সহজ এবং সাধারণ। বাসায় এসে সব নতুন করে ডিসাইড করি- সেই বাবল ডায়াগ্রাম, সেই স্কেমেটিক ডায়াগ্রামে ফেরত যাই। পুরাই জিরো থেকে শুরু করি। আবার যাই স্টুডিওতে স্যারদের দেখাতে। সিরিয়াল অনুসারে বাঁধন ভাইয়াকে ডিজাইন দেখাতে যেতে হয়, কিন্তু সাইটের উপর প্ল্যান না এঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেদিন তিনি ডিজাইন দেখেন না। পরদিন কোন এক কারণে সরকারী ছুটি থাকলেও ডিপার্টমেন্টে আমাকে যেতে হয় ডিজাইন দেখানোর জন্য। মোটামুটি রকম কমেন্ট আর রেফারেন্স পেয়ে যখন বের হয়ে আসি, তখন মনে এক ধরনের ফুরফুরে আনন্দ। যাক, আমার ডিজাইন প্রসেস দেরিতে হলেও শুরু হয়েছে।
কিন্তু আটকা পড়ি পরের সপ্তাহে। আগের ফর্ম আর কিছুতেই বাঁধন ভাইয়ার পছন্দ হয় না। বারবার ফর্ম ভেঙ্গে ফেলার পরামর্শ আসে। তারপর সাহস করে ফর্ম ভেঙ্গেই ফেলি। তৈরি হয় অতি জটিল ফর্ম। ভয়ানক ত্যাড়াব্যাকা। ফাংশন সলভ করতে গিয়ে হিমশিম খাই। তারপর আবার দেখাই, এবারও ফর্ম ওনার পছন্দ হয় না। জটিল ত্যাড়াব্যাকা ফর্মের কুফল বুঝতে পারি এবং আবার ফর্ম বদলে ফেলার পরামর্শ পাই। জমার এক সপ্তাহ আগে এরকম পরামর্শ পেয়ে হতাশা চেপে ধরে আমাকে। সাহস করে রিয়াদ স্যারকে দেখালেও তিনিও ফর্ম সহজ করে বদলে ফেলার একই পরামর্শ দেন। আবার সিদ্ধান্ত নেই প্রথম টাইপের ফর্মে ফিরে যাবো, যা চেঞ্জ করার সেটাতেই করবো। শুরু হয় পি. এল.। ক্লাশ খুললেই শনিবার জমা। তার আগের রবিবার আমি শেষবারের মত প্রিলি দেখাতে যাই। সেদিনও ফর্ম চেঞ্জ হয়, রুফ নিয়ে নতুন আইডিয়া পাই। রিকয়ারমেন্ট অনুযায়ী ড্রইং করতে গিয়ে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। এত ড্রইং শেষ করে মডেলসহ শনিবার জমা দেওয়া সম্ভব না।
যাই হোক নাক মুখ গুঁজে ড্রইং করতে থাকি। দিন যায়, রাত আসে, রাত যায়, দিন আসে, কিন্ত কাজ আর শেষ হয় না। শুক্রবার রাতে পাগলের মত কাজ করে সকাল বেলা বুয়েটে গিয়ে দেখি বাঁশ ফেলে গেট ব্লক করা। কোন মতে ভিতরে ঢুকে দেখি সাবমিশন ক্যান্সেল। জানে পানি ফেরত আসে। আবার সব কিছু গুছিয়ে বাসায় আসি। গোসল করে, খেয়ে দেই ঘুম। সন্ধ্যাবেলা ডিপার্টমেন্টে আসি, পরদিন পহেলা বৈশাখের কাজ করার জন্য। সব ব্যাচ ধুমসে কাজ করছে, শুধু আমাদের ব্যাচ এতিমের মত ঘোরাঘুরি করছে- আমাদের কোন প্রিপারেশন নাই, প্ল্যান নাই, কিছুই নাই। অনেক কষ্টে এক খানা স্ট্রাকচার জোড়াতালি দিয়ে মাস্কট বানানো হলো। পরদিনও সেই একই অবস্থা। সব ব্যাচেরই সবাক অংশগ্রহন আছে, খালি আমরা কিছুতেই নাই। যাই হোক, বেশ রাত পর্যন্ত কনসার্টে থেকে বাসায় আসি।
পরদিন খবর পাই আজকে জমা। আবার মাথায় বাজ পড়ে। তাড়াতাড়ি ড্রইংয়ের শুরু করি। খানিক বাদেই খবর পাই, আজকে জমা দেওয়া সম্ভব না। আবার খানিক বাদেই খবর পাই আজকেই হবে জমা। সব মিলিয়ে মাথায় তখন দেড়শ টনের চিন্তা। যাই হোক অনেক কষ্টে আমরা আবার স্যারদের বলে কয়েকটা দিন সময় বাড়াই।

তারপর শুরু হয় সেই লেভেলের কোপা জুরি- যাকে বলে রক্তাক্ত অবস্থা।শাহেদা ম্যাডামের চরম কোপ খেয়ে কয়েকজন ছাড়া আমরা অধিকাংশই মাটির সাথে মিশে গেছি।দীর্ঘ দেড়-দুই মাসের সাধনা পুরস্কারের বদলে তিরস্কার উপহার দেওয়ায় বিষন্নতার ছায়া নেমে আসে জীবনে। এক বুক হতাশা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগে হোয়াট ইজ আর্কিটেকচার??? 

সবচাইতে মজার ব্যাপার হয় টার্ম শেষে যখন আমাদের গ্রেড টানানো হয় তখন অবাক হয়ে আমরা জানতে পারি যে আমাদের স্কাল্পচার সেন্টারের টোটাল গ্রেড, ফাইনাল প্রজেক্ট কমার্শিয়াল ব্যাংকের একটা প্রিলির গ্রেডের সমান গুরুত্ব পেয়েছে। তাহলে এই দেড় দুই মাস পাগলের মত খেটে, পহেলা বৈশাখ বিসর্জন দিয়ে, জুরিতে সাফ ধোলাই খেয়ে রক্তাক্ত হৃদয় নিয়ে বাসায় যে ফিরলাম, তার অর্থ কি হল? কিসের জন্য এত খাটলাম আর সেই খাটনির মূল্যটাই বা কি রইলো?   হোয়াট ইজ আর্কিটেকচার??? ???